অগ্নিপুরুষ: ১.১-২ ঝাঁকড়া মাথা পাইন

অগ্নিপুরুষ: ১.১-২ ঝাঁকড়া মাথা পাইন

১.১-২ ঝাঁকড়া মাথা পাইন

০১.

ঝাঁকড়া মাথা পাইন, নারকেল বীথি আর গাংচিলদের ডানা ঢেকে রেখেছে আকাশটাকে। বাতাসে দারুচিনি আর জলপাইয়ের গন্ধ। চারদিকে মিঠে-কড়া রোদ, ছায়ায় বসন্তের আমেজ। দূর সৈকতে ঝিনুক-লোভী কিশোরীরা স্কার্ট খানিকটা ওপরে তুলে ছুটোছুটি করছে, তেড়ে এসে পায়ে লুটিয়ে পড়ছে ভূমধ্যসাগর, তাদের ভেজা পায়ে ঝিকমিক করছে সোনালি রোদ। অলস দুপুর, রাস্তার পাশের একটা গাছ থেকে নিঃসঙ্গ এক কোকিল হঠাৎ জরুরি আবেদনের। সুরে কু-কু-কু করে ডেকে উঠছে, চোখ তুলে তাকাচ্ছে দুএকজন অন্যমনস্ক পথিক, নিঃশ্বাসে মদের গন্ধ।

দ্বীপের নাম কর্সিকা। বাস্তিয়া বন্দর।

দিন দুই বেশ গরম পড়েছে অথচ সময়টা শীতকাল। একজন বার মালিক বুদ্ধি করে একটা টেবিল আর খান কতক চেয়ার টেনে নিয়ে এসে ফেলেছে ছাল ওঠা পেভমেন্টে। ওখানে বসে একা এক বয়স্ক লোক হুইস্কি খাচ্ছে, তার চোখ পড়ে আছে ডকের দিকে। ডকে যাত্রার জন্যে তৈরি হচ্ছে একটা ফেরি, লিভোরনোয় যাবে ওটা।

প্রায় দুঘন্টা হয়ে গেল ওখানে বসে রয়েছে লোকটা। প্রথম দিকে পাঁচ-সাত মিনিট পরপরই গ্লাস ভরে দেয়ার জন্যে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল, শেষে বার মালিক গোটা একটা বোতল, প্লেট ভর্তি কালো জলপাই আর খোসা ছাড়ানো কাজু বাদাম রেখে গেছে তার টেবিলে। রাস্তায় আর পেভমেন্টে অনবরত বাকবাকুম। আওয়াজ তুলে গর্বিত ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছে এক ঝাঁক পায়রা, হঠাৎ খেয়াল হলে ওগুলোর দিকে এক মুঠো করে কাজু বাদাম ছুঁড়ে দিচ্ছে আগন্তুক।

রাস্তার ওপারে, পেভমেন্টের ওপর বসে রয়েছে ছোট এক ছেলে। ভাঁজ করা হাঁটু দুটো এক করা, তার ওপর চিবুক রেখে গভীর মনোযোগের সাথে লোকটার জলপাই আর হুইস্কি খাওয়া লক্ষ্য করছে সে।

চারদিক শান্ত আর নিরিবিলি, টুরিস্টরা এ-সময় এদিকটায় আসে না। আগন্তুক ছাড়া ছেলেটার, দৃষ্টি কাড়ে এমন কিছু নেই আশেপাশে। কচি মনে কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছে লোকটা। অদ্ভুত একটা স্থির, অচঞ্চল ভাব রয়েছে তার। মধ্যে, প্রয়োজন ছাড়া তার শরীরের কোন অংশ এক চুল নড়ে না। দুজনের মাঝখানে রাস্তা, মাঝে মধ্যে দুএকটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, কিন্তু সেগুলোর দিকে একবারও তাকাচ্ছে না আগন্তুক। তাকিয়ে আছে ডক আর ফেরির দিকে।

মাঝে মধ্যে ছেলেটার দিকে চোখ পড়ছে তার। গম্ভীর মুখ, নিরাসক্ত দৃষ্টি। তার মুখে দুটো দাগ, একটা বা চোখের নিচে, আরেকটা কপালের ডান দিক। ঘেঁষে। সারা মুখে আধ ইঞ্চি লম্বা কুচকুচে কালো দাড়ি, নাকটা টিকালো, গায়ের রং রোদে পুড়ে তামাটে মত। কিন্তু ছেলেটার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে তার চোখ জোড়া। মায়াভরা দুই চোখের মাঝখানে একটু যেন বেশি দূরতু, ভারি পাতা–সরু। হয়ে আছে, যেন সিগারেটের ধোয়া এড়াবার চেষ্টা করছে, অথচ লোকটা এই। মুহূর্তে ধূমপান করছে না।

হুইস্কির অর্ডার দেয়ার সময় লোকটাকে ঝরঝরে ফ্রেঞ্চ বলতে শুনেছে সে, কিন্তু তবু তার মনে হয়েছে এ লোক ফরাসী হতে পারে না। তার পরনের ঘন নীল ট্রাউজার, পোলো নেক সোয়েটারের ওপর ডেনিম জ্যাকেট খুবই দামি, কিন্তু বহু ব্যবহারে মলিন। তার পায়ের কাছে রাখা লেদার সুটকেসটাও তাই। অচেনা, নতুন লোক অনেক দেখেছে ছেলেটা, বিশেষ করে আগন্তুকদের চরিত্র আর আর্থিক অবস্থা বুঝে নেয়ার আশ্চর্য একটা ক্ষমতা আছে তার। কিন্তু এই লোকটা তাকে ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। এর আগে এই প্রকৃতির লোক সে কখনও দেখেনি। তার মনে হল, এই লোক জন্ম থেকে একা, নিঃসঙ্গ যাযাবর। মনে হল, এই লোককে বিশ্বাস করে কেউ কোনদিন ঠকবে না। লোকটা হাতঘড়ি দেখল, বোতল থেকে শেষ হুইস্কিটুকু গ্লাসে ঢেলে এক চুমুকে নিঃশেষ করল। বার মালিককে ডেকে টাকা দিল, কি যেন বলল তাকে; মুখ তুলে রাস্তার ওপারে বসা ছেলেটার দিকে একবার। তাকাল বার মালিক। লেদার সুটকেস হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল লোকটা, তারপর। রাস্তা পেরোবার জন্যে পা বাড়াল।

পেভমেন্টে স্থির বসে থাকল ছেলেটা, লোকটার এগিয়ে আসা দেখছে। লোকটা আরও কাছে আসতে বোঝা গেল, বেশ লম্বা সে, প্রায় ছয় ফুটের। কাছাকাছি। শরীরে একটু মেদ জমেছে, তবু আশ্চর্য হালকা পা ফেলে হাঁটতে পারে। হাঁটাটা অদ্ভুত, প্রথমে মাটি ছোয় পায়ের বাইরের অংশ বা কিনারাগুলো।

পাশ কাটাবার সময় ছেলেটার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল লোকটা। প্রায়। দেড় বোতল মদ খেয়েও সহজ, সাবলীল ভঙ্গিতে হাঁটছে সে। লাফ দিয়ে উঠে। দাঁড়িয়ে এক ছুটে রাস্তা পেরোল ছেলেটা, টেবিলের ওপর ঝুঁকে খুজল তার জন্যে এটো কিছু পড়ে আছে কিনা। এই সময় বার থেকে বেরিয়ে এল প্রৌঢ় মালিক। তার গম্ভীর চেহারা দেখে পিছিয়ে আসতে শুরু করল বেচারা। পাঁচ হাত পিছিয়ে। এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সে, কারণ লোকটার হাতে দুটো প্লেট দেখতে পেয়েছে। কিন্তু বারের ভিতর বা বাইরে কোন খদ্দের নেই।

চোখ ইশারায় কাছে ডাকল বার মালিক। প্লেট দুটো টেবিলে নামিয়ে রাখল। সে। কেউ যদি পায়রাগুলোকে এই বাদাম খাওয়ায়, প্লেট ভর্তি কাজু বাদাম, দেখিয়ে বলল, তাহলে, দ্বিতীয় প্লেটটা দেখাল এবার, এই জলপাইগুলো মজুরি। হিসেবে পাবে সে।

বার মালিকের দিকে নয়, ঘাড় ফিরিয়ে ডকের দিকে তাকাল ছেলেটা। লোকটাকে দেখতে পেল সে, ওর দিকে পিছন ফিরে ফেরিতে উঠছে। ফেরিতে উঠে লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

এগিয়ে এসে প্লেট থেকে দুটো জলপাই তুলে নিয়েই ঘুরল ছেলেটা, ছুটল। পিছন থেকে মালিক সবিস্ময়ে চেঁচিয়ে বলল, কি হল?

পরে। এক ছুটে রাস্তা পেরিয়ে কিনারায় এসে দাঁড়াল ছেলেটা। দুটো জলপাই মুখে পুরে দিয়েছে। পনেরো মিনিট পর ডক থেকে রওনা হল ফেরি। অল্প। কজন যাত্রী, তাদের মধ্যে থেকে আগন্তুককে খুঁজে নিতে কোন অসুবিধে হল না। পিছন দিকে রেইল ধরে একা দাঁড়িয়ে আছে লোকটা।

ধীরে ধীরে গতি বাড়তে লাগল ফেরির। কি এক সঙ্কোচ আর দ্বিধা জড়িয়ে। ধরলেও, সব কাটিয়ে উঠে এক সময় একটা হাত মাথার ওপর তুলে নাড়ল। ছেলেটা।

ফেরি তখন অনেক দূরে চলে গেছে। আগন্তুকের চোখ এত দূর থেকে দেখা যায় না, কিন্তু নিজের মুখের ওপর তার দৃষ্টি অনুভব করল ছেলেটা। পরিষ্কার। দেখল, রেইল থেকে হাত তুলল লোকটা, ছোট্ট করে একবার নাড়ল।

পরম আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ছেলেটার মুখ। তোমার ভাল হোক, বিড়বিড় করে বলল সে। তোমার ভাল হোক!

এই আশীর্বাদ আগন্তুকের দরকার ছিল।

.

০২.

আলো-আঁধারির ভেতর অলস পায়ে হাটাহাটি করছে লরা আভান্তি, ঠোঁটে ক্ষীণ। একটু হাসির রেখা। এক সময়ে ফ্রেঞ্চ উইণ্ডোর সামনে দাঁড়াল সে, চোখের সামনে উদ্ভাসিত হল লেক। লেকের নিস্তরঙ্গ, কালো পারদের মত টলটলে পানিতে। ঝিলমিল করছে শেরাটন হোটেলের আলো।

লরা আভান্তির রূপের বুঝি কোন তুলনা হয় না। অভিজাত সমাজে তাকে বলা হয়, বিশুদ্ধ নিয়াপলিটান সৌন্দর্যের উৎকৃষ্ট নমুনা। যৌবন নয়, যেন ফুলের। কমনীয়তা; মুখ নয়, যেন শিশিরের স্নিগ্ধতা; চোখ নয়, যেন সাগরের গভীরতা। তবু, যার দেখার চোখ আছে, লরা আভান্তির চেহারায় বিদ্রূপ আর দুষ্ট ভাব সময়। সময় ঠিকই দেখতে পায় সে। তার নিটোল ঠোঁটে যৌনাবেদন ফুটে থাকে, বড় বড় চোখে মদির আহ্বান। তার মুখের সৌন্দর্য শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে চওড়া চোয়ালের নিখুঁত গড়ন, প্রায় গোল কপালের সাথে ভারি সুন্দর মানিয়ে গেছে। ঘন। কালো চুল সোজা নেমে এসে ভেতর দিকে ভাঁজ নিয়ে কাঁধ ছুঁয়েছে, তারপর অনেকগুলো ঢেউ তুলে সরু কোমর পর্যন্ত ঝুলে আছে। কোমর থেকে ওপরের দিকটা ক্রমশ চওড়া হয়ে উঠে গেছে। পা জোড়া লম্বা। মেদহীন পাঁজর, গলায়। কোন ভঁজ নেই। অর্ধবৃত্ত আকারের স্তন, ভরাট, এতটুকু ঢিলেঢালা ভাব নেই কোথাও।

পুরুষের লোভ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে জানে লরা, কিন্তু পুরুষমানুষ নিয়ে খেলার প্রবণতা তার জন্মগত। অভিজাত সমাজের হোমরা-চোমরা লোকজন তার চারপাশে ভিড় করে থাকে, ধরা দেয়ার ভান করে তাদের কাছে ডাকে সে, কিন্তু কখনোই ধরা দেয় না। এটাই তার সবচেয়ে প্রিয় খেলা। তার এই খেলার শিকার বেচারা স্বামী ভিটো আভান্তিও। স্ত্রীকে একান্ত কাছে পেতে রীতিমত সাধনা করতে হয় তার। গাধার সামনে মুলো ঝুলিয়ে রাখার মত পুরুষের সামনে নিজেকে ঝুলিয়ে রাখে লরা। এই খেলার স্বার্থে নিজেকেও তার বঞ্চিত করতে হয়, শরীরের চাহিদা অনেক সময়ই যথাযথ মেটে না। গত ডিসেম্বরেই তো ভিটো অনুযোগের সুরে বলেছিল, এ-বছর মোট কবার তোমাকে পেয়েছি গুণে বলে দিতে পারি।

লরার চেহারায় বিষণ্ণ একটু হাসি ফুটে উঠেছিল। তার জবাব ছিল, বেশি। কোন জিনিসই ভাল নয়। তাছাড়া, যতটা সম্ভব অক্ষত, অটুট থাকতে চাই আমি ঘাটাঘাটি করে নষ্ট করতে চাও কেন?

আর এক ঘন্টা পর, রাত আটটায়, তার সাথে গল্প করতে আসরে আলবারগো লোরান। গল্প মানে মুগ্ধ চোখে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকা আর লরার রূপের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা। লোরান আশা করবে লরা তাকে ডিনারের জন্যে থেকে যেতে বলবে, কিন্তু রা তার ধার দিয়েও যাবে না। পারিবারিক কোন অনুষ্ঠানে লোরানকে ডিনার খাওয়া যায়, কিন্তু লরা ব্যক্তিগতভাবে কখনও সে অনুরোধ ওকে করবে না।

আজ সাত দিন পর বিদেশ থেকে ফিরছে ভিটোও। ভিটো পৌঁছুবে নটায়, তার মানে লোরানকে আজ বেশি সময় দেয়া যাবে না, ভাবল লরা।

.

জানালার কার্নিসে ভাঁজ করা হাতের কনুই, তালুতে চিবুক ঠেকে আছে, ছল ছল করছে চোখ জোড়া। বন্দিনীর মন ভাল নেই।

লুবনা আভান্তি মায়ের সমস্ত সৌন্দর্য তো পেয়েইছে, পেয়েছে আরও অনেক বেশি করে। মা মেয়ের কাপে যেমন মিল আছে, তেমনি স্বভাবে আবার অমিলও আছে প্রচুর। মায়ের চেহারায় আছে গর্ব, মেয়ের চেহারায় সারল্য। মায়ের চোখে তির্যক কটাক্ষ, মেয়ের চোখে মায়া। লরা শান্ত, সতর্ক; লুবনা ছটফটে, প্রাণচঞ্চল। মা আত্মকেন্দ্রিক, নিজেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে রাখে; আর মেয়ে নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে ছটফট করে বেড়ায়।

কিন্তু এ এক শ্বাসরুদ্ধকর বন্দী জীবন। এই বয়সে তার খেলার সাথী দরকার, অথচ বাড়ির বাইরে পা বাড়ানো নিষেধ। ওর দেখাশোনার জন্যে ওকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে আথিয়া আর গভর্নেস আছে বটে, কিন্তু দুজনের একজনকেও সহ্য করতে পারে না লুবনা। আথিয়া চাকরানী, মনিব কন্যার ওপর খবরদারি করার সুযোগ পেয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলে। এত কথা বলে না, এত কৌতূহল ঠিক নয়, এত হাসি ভাল নয়, বড় হচ্ছ এত লাফায় না–এই চারটে না ছাড়া আর কোন কথা নেই তার মুখে। গভর্নেস বুড়ি আরেক যন্ত্রণা। কেউ যে এমন অঙ্ক-পাগল হতে পারে, বুড়িকে না দেখলে বিশ্বাস হত না লুবনার। দুক্লাস ওপরের বই থেকেও অঙ্ক শিখতে হয় লুবনাকে, আর রোজই শুনতে হয়–সুখী হতে হলে জীবনটাকে এখন থেকে অঙ্কের নিয়মে সাজিয়ে নাও।

আর আছে বাবা। কিন্তু বাবার দেখা পাওয়া লুবনার জন্যে ভাগ্যের ব্যাপার। ব্যবসার কাজে বছরের বেশিরভাগ দিনই বাইরে থাকে বাবা। আর যখন ঘরে থাকে, তাকে দখল করে রাখে মা। লুবনার মনে হয়, বাবা তাকে ভালবাসলেও, আলাদা একটা অস্তিত্ব হিসেবে নয়, মায়ের একটা অংশ হিসেবে ভালবাসে।

আর মা যেন থেকেও নেই।

কেন যেন মাকে ভীষণ ভয় করে লুবনার। মা কখনও তাকে শাসন করে না, কখনও বকাঝকা করেছে বলে মনে পড়ে না, অথচ তবু মায়ের সামনে যেতে তার বুক কাঁপতে থাকে। নিজেকেই সে কতবার প্রশ্ন করেছে, মাকে আমার এমন পর। পর লাগে কেন? তাকে দেখলেই মা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যায়, সেটাই কি তার কারণ? তার ভাল-মন্দ কিছু জানতে চেয়েছে, তার কথায় কখনও হেসেছে, তাকে। কাছে ডেকে কখনও আদর করেছে কই, মনে পড়ে, না লুবনার। সামনে পড়ে। গেলে মা যেন কেমন অদ্ভুত চোখে তাকায় তার দিকে। তখন শুধু ভয় নয়, কেমন যেন সঙ্কোচ বোধ করে লুবনা, একটা আড়ষ্ট ভাব এসে তাকে কুকড়ে দেয়।

এই নিরানন্দ, বন্দী জীবনে একমাত্র খোলা জানালা ছিল স্কুল। কিন্তু আজ দুমাস হল স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বান্ধবীদের কথা মনে পড়ে লুবনার, মনে পড়ে টিফিন আওয়ারে সবুজ ঘাসে পা ছড়িয়ে বসে আইসক্রীম। খাওয়া আর দল বেঁধে হুটোপুটি করার কথা। আর মনে পড়লেই ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি, কান্না পায়।

নিঃসঙ্গ এক পাখির ছানা, খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখে বাগান থেকে ধরে নিয়ে এসে খাঁচায় পুরে রেখেছিল লুবনা–নিজেকে তার সেই কাতর পাখির মত লাগে। পাখিটাকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে তবু তো সে ছিল; কিন্তু তার কে আছে?

সন্ধে থেকে দুবার মায়ের কাছে যাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে সে। প্রথমবার ঘর থেকে বেরিয়েছিল, কিন্তু বারান্দা থেকে ফিরে এসেছে। দ্বিতীয়বার। সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত পৌঁছেছিল, কিন্তু তারপর আবারও সাহস হারিয়ে ফেলে। লুবনা জানে, বাবা আজ ফিরে আসছে। কথাটা বলতে হলে আজই মাকে তার বলে রাখতে হবে।

মনে মনে সাহস সঞ্চয় করল লুবনা। বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল সে। দাঁড়ালে বোঝা যায়, লম্বায় মাকেও ছাড়িয়ে যেতে চলেছে সে। ঘর থেকে বেরুবার আগে। আয়নায় চোখ পড়ল, নিজের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন লজ্জা লাগল তার। এখনও সে রোগা, কিন্তু মুখে ফোলা ফোলা একটা ভাব দেখা দিতে শুরু করেছে। হাতে-পায়ে মাংস নেই, কিন্তু ওগুলো আশ্চর্যভাবে বদলে গিয়ে আরও সুন্দর একটা। গড়ন নিচ্ছে। হঠাৎ খচ করে বিধল প্রশ্নটা, মা কি তাকে ঈর্ষা করে?

অন্যমনস্কভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে এল লুবনা। মা-বাবার বেডরূমের সামনে কখন এসে দাঁড়িয়েছে বলতে পারবে না। ঘরের দরজা খোলা, ভেতরে নেই কেউ। মা কি তবে বাইরে কোথাও গেছে?

মা একা একা বেড়াতে চলে যায়, তাকে সাথেও নেয় না, বলেও যায় না।

ড্রইংরূমের দিকে এগোল লুবনা। ভারি, পুরুষালি একটা আওয়াজ আসছে। ওদিক থেকে। দূর থেকেই আলোকিত জানালা দেখা গেল, কিন্তু দরজা বন্ধ। গলাটা চিনতে পারল লুবনা, বাবার বন্ধু আলবারগো লোরান কথা বলছে। মার হাসির আওয়াজও শুনতে পেল সে।

আমার সাথে মা কখনও এভাবে হাসে না, ভাবল সে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। খানিক ইতস্তত করল, তারপর মৃদু টোকা দিল কবাটে।

ভেতর থেকে মা বলল, দাঁড়াও

লোরান কাকুর একটা কথাও পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে না লুবনা, কথাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে মার হাসিতে। একবার ইচ্ছে হল ফিরে যায়। কিন্তু মাকে কথাটা বলা একান্ত দরকার। বাবা হয়ত আবার কাল সকালেই দিন কতকের জন্যে অন্য। কোথাও চলে যাবে।

আরও পাঁচ মিনিট কাটল। আবার নক করবে কিনা ভাবল লুবনা। মা হাসছে। আর হাসছে। আওয়াজটা যেন ঘরের ভেতর ছুটে বেড়াচ্ছে.••একবার কাছে। আসছে, আবার দূরে সরে যাচ্ছে, ঘরের ভেতর ওরা ছুটোছুটি করছে নাকি! হঠাৎ, মাঝপথে থেমে গেল মার হাসি, কেউ যেন তার মুখে কিছু চাপা দিল। তারপর আর কোন আওয়াজ নেই।

আরও দুমিনিট পর দরজা খুলে গেল। মাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল লুবনা।

ও, তুমি, বলল লরা, এ-সময় মেয়েকে তার কাছে আসতে দেখে একটু অবাকই হয়েছে সে।

অনেক দুঃখ আর অভিমান জমে আছে লুবনার বুকে, ইচ্ছে হল মাকে জড়িয়ে ধরে প্রাণ ভরে কাঁদে আজ। কিন্তু মার চোখে সেই দৃষ্টিটা ফুটে উঠতে দেখে আড়ষ্ট হয়ে গেল লুবনা। মা হাসছে না, শুধু তাকিয়ে আছে, সে তাকানোতে আদরও নেই। প্রশ্রয়ও নেই। লুবনার মনে হল, মার দৃষ্টি তার কাপড়, চামড়া, হাড়ভেদ করে শরীরের ভেতর চলে গেছে। সে যেন একটা দর্শনীয় বস্তু, মা যেন তাকে এই প্রথম। দেখছে।

কিছু বলবে? মেয়েকে পাশ কাটিয়ে ড্রেসিংরূমের দিকে এগোল লরা।

কয়েক সেকেণ্ড কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল লুবনা। তারপর ধীরে ধীরে ঘুরল। ইতিমধ্যে ড্রেসিংরুমের ভেতর ঢুকে পড়েছে লরা, দরজার কবাট ধরে অপেক্ষা করছে।

ধীর ভঙ্গিতে কয়েক পা এগোল লুবনা, তারপর দাঁড়িয়ে পড়ল, ড্রেসিংরূমের। দরজা থেকে আট দশ হাত দূরে। বুঝতে পেরেছে, মা দরজা বন্ধ করতে চাইছে।

আমি স্কুলে যেতে চাই, প্রচণ্ড জেদের সাথে বলতে চাইলেও গলায় তেমন জোর পেল না লুবনা। বাবাকে বল…

ঠিক আছে, বলল লরা। হঠাৎ অন্যমনস্ক দেখাল তাকে। দরজা বন্ধ করার সময় মেয়ের দিকে তার খেয়ালও থাকল না।

ঘাড় একদিকে একটু কাত হয়ে আছে লুবনার, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল সে। বন্ধ দরজাটা যখন ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে, ঝট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের। ঘরের দিকে ছুটল। তার ফোপানর আওয়াজ কেউ শুনতে পেল না।

.

প্লেনে করে হংকং থেকে সিঙ্গাপুর, তারপর মিলান, মিলান থেকে গাড়ি হাঁকিয়ে কোমো-তে ফিরছে ভিটো আভান্তি। সাত দিন পর বাড়ি ফিরছে সে, বাড়ি ফেরার একটা আনন্দ আছে। দেশের বাইরে কোথাও গেলে বরাবর যা হয়, লরা আর লুবনার জন্যে উদ্বেগের মধ্যে ছিল সে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল নয়, কোন দিক থেকে কি বিপদ আসে কেউ বলতে পারে না। তাছাড়া, বাড়িতে একটা। সমর্থ পুরুষ মানুষ নেই।

একমাত্র ভরসা ওদের পারিবারিক বন্ধু লোরান। আলবারগো লোরান শুধু স্বনামধন্য ব্যক্তিই নয়, লোকটা পিঁপড়ের মত ব্যস্তও। কিন্তু দায়ে-বিপদে আভান্তি পরিবারের পাশে ঠিকই তাকে পাওয়া যাবে। ভিটো যখনই দেশের বাইরে কোথাও একা বা সস্ত্রীক গেছে, লোরান তার শত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় করে নিয়ে ওদের বাড়িতে এসে খোঁজ-খবর নিয়েছে, বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত। কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করল ভিটো, লোরানের মত বন্ধু হয় না।

কিন্তু বাড়ি ফেরার আনন্দটা পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছে না ভিটো। অনেক দিন থেকেই গুমোট একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এবার সেটা ঝড় তুলবে। কিছু কিছু ব্যাপারে সিদ্ধান্ত এবার নিতেই হবে। ভিটো জানে সিদ্ধান্তগুলো। পছন্দ হবে না লরার। ঝড়টা তখনই উঠবে।

তেরো বছর দাম্পত্য জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে ভিটো জানে এই সঙ্কটকে ছোট করে দেখা চলে না। বছরগুলো স্মরণ করল সে, নিজেকে প্রশ্ন করল, আমি কি সুখী?

এর কোন জবাব নেই। লরা শুধু স্ত্রী নয়, নয় কেবলমাত্র সুন্দরী নারী, লরা তার কাছে প্রচণ্ড একটা নেশা। বিয়ের আগে, প্রথম যেদিন লরাকে দেখে সে, ওর রূপ তাকে মাতাল করে দিয়েছিল। সেই ঘোর আজও কাটেনি, কাজেই এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভালমন্দ কিছুই সে বলতে পারবে না।

আসলে সহজ সরল একটা পরিস্থিতির শিকার সে। ভাগ্যগুণে তার স্ত্রী অসম্ভব সুন্দরী আর আত্মকেন্দ্রিক, নিজের শখ সাধ ছাড়া কিছু বোঝে না, চলে আপন। খেয়ালে। সে জানে লরা কোনদিন বদলাবে না, কাজেই হয় সে তাকে ত্যাগ করতে পারে, আর নয়ত মেনে নিতে পারে। সিদ্ধান্তটা কি হবে, অনেক দিন আগেই পরিষ্কার বুঝে নিয়েছে ভিটো। মেনে নেয়া সম্ভব, ত্যাগ করার কথা ভাবা যায় না।

বিয়ের পর প্রথম দিকে এই নেশা যতটা না ছিল মানসিক, তারচেয়ে বেশি। ছিল শারীরিক। রূপ সায়রে অবগাহন করে বেহুশ হয়ে ছিল সে। রূপ-যৌবনের সেই আকর্ষণ আজও আগের মতই অনুভব করে ভিটো, কারণ বিধি-নিষেধের বেড়া তুলে দিয়ে নিজেকে লরা দুর্লভ করে রেখেছে। তবে সেই আকর্ষণের সাথে। নতুন আরও কিছু যোগ হয়েছে এখন। দুষ্প্রাপ্য কোন বস্তুর মালিক হতে পারলে লোকে যেমন গর্ব বোধ করে, লরার মালিকানা স্বত্ব সেই গর্ববোধ জাগিয়ে দিয়েছে। ভিটোর মনে। লরা যাদের অধিকারে নেই তারা ঈর্ষা করে তাকে, কেউ কেউ শ্রদ্ধাও করে। তার ঘরে লরা আছে বলেই অভিজাত সমাজে আর বন্ধু মহলে তার এত খাতির। তার সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে লরা। খাতির আর মর্যাদার মোহ, এ-ও এক দুর্দান্ত নেশা।

লেকের কাছে এসে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে। ল্যানসিয়া ডান দিকে বাঁক নিল। মেয়ের কথা মনে পড়তেই খচ করে একটা অপরাধ বোধ জাগল বুকে। লুবনাকে সে ভালরাসে। কিন্তু স্নেহ আর আদরের যতটুকু লুবনার প্রাপ্য ততটুকু তাকে দেয়া হয়ে ওঠে না। এর জন্যে কিছুটা দায়ী তার ব্যস্ততা, কিছুটা লরার অন্যায় আবদার। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে ভিটো, তার ধারে কাছে কাউকে ভিড়তে দেয় না লরা। কোথাও বেড়াতে বা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলে লরা চায় শুধু তারা। দুজনই যাবে। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভিটো।

.

ওরা তিনজন ডিনার খেতে বসেছে। চওড়া মেহগনি টেবিলের দুমাথায়, সামনাসামনি বসেছে ভিটো আর লরা। মাঝখানে লুবনা। পরিবেশন করছে মেইড। বসার এই ছক কেতাদুরস্ত আর আনুষ্ঠানিক, ঘরোয়া পরিবেশে আপনজনদের সান্নিধ্য ভাল লাগার যে অনুভূতি এনে দেয়, তিনজনের মধ্যেই তার বড় অভাব। লরার সাথে আজ কথা কাটাকাটি হবে, সেজন্যে টেনশনে ভুগছে ভিটো। আর ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে তার যুদ্ধ-কৌশল কি হবে ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে লরা। তাছাড়া, ঘরে বসে ডিনার খেতে চিরকালই তার একঘেয়ে। লাগে। সবচেয়ে স্নান দেখাল লুবনাকে। বুক ভরা অভিমান তো আছেই, আবার তাকে স্কুলে যেতে দেয়া হবে কিনা এই অনিশ্চয়তায়ও ভুগছে সে।

আদর্শ স্ত্রীর মতই স্বামীকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে লরা। কোমর জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে দিয়েছে, টেনে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসিয়েছে, নিজের হাতে মার্টিনি তৈরি করে দিয়েছে, গভীর আগ্রহের সাথে জানতে চেয়েছে বিদেশ-ভ্রমণ কেমন। লাগল। কিন্তু, লুবনা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ভিটোকে সে অভিযোগের সুরে জানিয়ে দিয়েছে, মেয়ের মন ভাল নেই, ও স্কুলে যেতে চায়, কিছু একটা ব্যবস্থা। আর না করলেই নয়।

সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়েছে ভিটো, বলেছে, ব্যাপারটা নিয়ে ডিনারের পর আলোচনা করব। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

মা-বাবা দুজনেই যে স্নায়ুযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ডিনারে বসে সেটা টের পেয়ে গেল লুবনা। তার অনেক কথা বলার ছিল, কিন্তু পরিবেশ অনুমতি না দেয়ায় চুপচাপই থাকল। ডিনার শেষ হতে না হতেই উঠে দাঁড়াল সে, মা-বাবাকে চুমো খেল, অভিযোগের সুরে বলল, ঘরের ভেতর বসে থাকতে থাকতে আমার মাথা। ধরে গেছে, আমি শুতে যাচ্ছি।

অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা পিছনে রেখে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল লুবনা।

খানিক পর নিস্তব্ধতা ভাঙলো লরা, গভর্নেসকে ওর পছন্দ নয়।

কাঁধ ঝাঁকাল ভিটো। আসল সমস্যা সেটা নয়। ওর কোন বন্ধু নেই। আমরাও ওকে সঙ্গ দিতে পারি না। এই বয়সে মেয়েরা খেলতে চায়, বেড়াতে যেতে চায়। স্কুলে গেলে তবু বান্ধবীদের সাথে দেখা হত… উঠে দাঁড়িয়ে বার-এর। সামনে চলে এল সে, গ্রাসে খানিকটা কনিয়াক ঢেলে ছোট্ট করে চুমুক দিল। টেবিল। পরিষ্কার করছে মেইড, তার বিদায় না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল সে। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ হবার পর আবার সে মুখ খুলল, লরা, কিছু কিছু বিষয় আমাদের। ভেবে দেখতে হবে। আমি চাই আলোচনাটা যেন যুক্তির বাইরে না যায়।

চেহারায় বিরূপ কোন ভাব তো নেই-ই, স্বামীর দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি। হাসছে লরা, চোখে কৌতুক মেশানো প্রশ্রয়।

লরার এইভাব লক্ষ্য করে মনে মনে শঙ্কিত হল ভিটো। বুঝল, তর্ক-যুদ্ধে জেতার জন্যে নিশ্চয়ই কোন কৌশল ঠিক করে ফেলেছে লরা। সেটা কি, বুঝতে না পেরে তার অস্বস্তি আরও বেড়ে গেল।

দুটো ব্যাপারে কথা বলতে চাই আমি, গ্লাসে আরেকটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলল ভিটো। এক, লুবনাকে স্কুলে পাঠাতে হবে। আর দুই, তোমার বাজে খরচ কমাতে হবে।

আমার বাজে খরচ? চোখের কৌতুক লরার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল।

এ-মাসেই তুমি নতুন ডিনার সেট আর অ্যান্টিকস কিনে নব্বই লাখ লিরা খরচ করেছ–কোন মানে হয়?

কিন্তু ভিটো, বাজারে ওগুলো এই প্রথম এল; কিনব না? বিস্মিত দেখাল লরাকে।

বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ল ভিটো। তার আগে আমাদের সামর্থ্যের কথা ভেবে। দেখবে। তুমি তো জান ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে আমাদের। প্রোডাকশন কস্ট অনেক বেড়ে গেছে, তার ওপর সস্তা বোটে ছেয়ে গেছে ওয়ার্ল্ড মার্কেট। এ-বছর যা প্রোডাকশন দিয়েছি তার সিকি ভাগও বিক্রি করতে পারব না। অনেক মিলিয়ন লিরা লোকসান দিতে হবে। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে আমি একবারে ডুবে আছি।

কত লোন নিয়েছ?

বারো শো মিলিয়ন লিরা, বলে কাধ ঝাঁকাল ভিটো।

বাবা বলত, একজন মানুষের ওজন বোঝা যায় তার সম্পদ দেখে, নয়ত তার দেনা দেখে। শুধু পরিমাণটাই আসল কথা।

রেগে উঠল ভিটো। তোমার বাবা অন্য এক জগতে বাস করতেন। তোমার ভায়েরা সমস্ত দেনা শোধ করতে পেরেছিল বলে, নয়ত বেচে থাকলে তোমার। বাবাকে দেশের সেরা দেউলিয়া বলে ঘোষণা করা হত।

ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি নিয়ে লরা বলল, বাবার সময়জ্ঞান ছিল টনটনে, মরার সময় সেটা দেখিয়ে গেছে। আমার কি ধারণা জান? যে যত বড়, তার ভার সহ্য করার ক্ষমতাও তত বেশি। তুমি খুব বড় পরিবার থেকে এসেছ, দেশের সেরা ধনী পরিবারের একটা থেকে, মাত্র বারো শো মিলিয়ন লোন করে ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন?

নিজেকে সামলে নিল ভিটো। ব্যাপারটা আর হালকা চোখে দেখার পর্যায়ে। নেই, লরা। বাস্তবকে তোমার মেনে নিতে হবে। দুএক মাসের মধ্যে ব্যাঙ্কের সাথে। একটা এগ্রিমেন্ট না হলে সত্যিই আমি খুব বিপদে পড়ব।

স্থির হয়ে সোফায় বসে থাকল লরা। খানিক চিন্তা করে জানতে চাইল, তা কি করবে বলে ঠিক করেছ?

খুব সাবধানে উত্তর দিল ভিটো। সমস্যার দুটো দিক। এক, ছোট বোটের একচেটিয়া বাজার আমরা হারাচ্ছি। প্রতিযোগিতা করতে হলে শৌখিন বড়লোকদের জন্যে দামি ইয়ট তৈরি করতে হবে। একমাত্র উপায় দুষ্প্রাপ্য জিনিস। দিয়ে চড়া দাম আদায় করা, সস্তাদরের বোটের বাজার যার খুশি দখল করুক গে।

মনোযোগ দিয়ে শুনছিল লরা, ভিটো থামতেই জানতে চাইল, বেশ, তাই কর, কে তোমাকে বাধা দিচ্ছে?

ডকইয়ার্ড, বলল ভিটো। লীজের মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে, কাজেই এটা। ছেড়ে দিয়ে নতুন ডকইয়ার্ড ভাড়া নিতে হবে। নতুন কিছু মেশিনপত্রও দরকার হবে আমাদের। সব মিলিয়ে এখনি তিনশো মিলিয়ন লিরা চাই আমার।

কিন্তু ব্যাঙ্ক সাহায্য করতে চাইছে না?

বার-এর দিকে ফিরল ভিটো, গ্লাসে আরও খানিকটা কনিয়াক ঢালল। স্ত্রীর। দিকে ফিরে বলল, এখানেই সমস্যার আরেক দিক। জমি ছাড়া ডকইয়ার্ডের সমস্ত কিছু এরইমধ্যে মর্টগেজ রাখা হয়েছে, এই বাড়ি আর রোমের অ্যাপার্টমেন্ট সহ। নতুন লোন আমাকে নিতেই হবে, অথচ মর্টগেজ রাখার মত আর কিছু নেই আমার। অন্য পথে চেষ্টা করছি, কিন্তু কতদূর কি করতে পারব জানি না।

লোরানের সাথে কথা বলেছ?

না, মুহূর্তের জন্যে একটু অন্যমনস্ক দেখাল ভিটোকে। আগামী হপ্তায় একসাথে লাঞ্চ খাব আমরা, তখন আলোচনা হবে। লরা, আমি চাইছি, আমরা। সমস্যায় পড়েছি এটা শুধু তুমি মনে রাখ।

হাসিটা আবার লুবনার মুখে ফিরে এসেছে, তাতে বিদ্রুপের ছিটেফোঁটাও নেই। ভিটো, প্লীজ, আমাকেও খানিকটা কনিয়াক দাও।

স্ত্রীর জন্যে ড্রিঙ্ক নিয়ে এগিয়ে এল ভিটো, তার পিছনে দাঁড়াল। হাতের গ্লাসটা রাখার জন্যে লরার কাঁধের ওপর দিয়ে টেবিলের দিকে ঝুঁকল সে। একেবারে স্থির বসে থাকল লরা, গ্লাসটা ছেড়ে দিয়ে তার চুলের ভেতর, গলার পিছনে চলে এল। ভিটোর হাত। স্বামীর হাতের ওপর হাত রাখল লরা, তার আঙুলের ওপর চাপ দিল। মাথাটা ভিটোর পেটে ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে ওপর-নিচে ঘষতে লাগল সে।

ভুলে গেছে, সমস্যার কথা এখন আর ভাবছে না ভিটো।

দাঁড়াল লরা, চেয়ারটাকে পাশ কাটিয়ে একটু সরে এসে চুমো খেল ভিটোর। চোখে আর গালে। ঠিক চুমো নয়, কোমল ঠোঁটের আলতো স্পর্শ মাত্র। ভিটো জানে, এভাবেই তাকে অস্থির করে তোলে লরা, অস্থির করে তুলে মজা পায়। সে যত ব্যর্থ হয়ে উঠবে, লরা ততই ধীর লয়ে উনাক্ত করবে নিজেকে। এটাই তার। রীতি।

স্বামীর হাত দুটো নিজের হাতে আটকে রেখেছে লরা। ভিটোর গালে ঠোঁট বুলাতে বুলাতে বলল, চিন্তা কোরো না, লোরান একটা উপায় ঠিকই বের করবে।

স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বেডরূমে এল লরা। বিছানায় উঠে অনেকক্ষণ একাই ব্যস্ত হয়ে থাকল সে। ভিটো যখন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না, শুধু।

তখনই নিজেকে তার হাতে তুলে দিল সে।

বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে থেকে দম নিল ভিটো। কাপড় না পরেই নিচতলায় নেমে গেছে লরা, কনিয়াক আর সিগারেট আনার জন্যে। ক্ষীণ একটু হাসির রেখা। ফুটে আছে ভিটোর ঠোঁটে, স্ত্রীর কথা ভাবছে। প্রেম করার এই রীতি লরার একান্ত নিজস্ব। সে-ই প্রথমে উদ্যোগী হয়, সে-ই গাইড করে, কিন্তু তবু শেষ পর্যন্ত নারী সুলভ আচরণ বিসর্জন দেয় না, একটু দেরিতে হলেও ঠিকই আত্মসমর্পণ করে। মিলন পর্ব সমাধা হলে নিজেকে ভিটোর নির্জীব, নিঃশেষিত বলে মনে না হলেও দুর্বল লাগে তার–যেন একটা ভায়োলিন অতিরিক্ত বাজানো হয়েছে, ফলে চিল হয়ে গেছে তারগুলো।

এক হাতে বেলুন গ্লাসে কনিয়াক, আরেক হাতে সিগারেট নিয়ে ফিরে এল লরা। গ্লাসটা স্বামীর হাতে দিয়ে বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে দুটো সিগারেটে আগুন ধরাল সে। নিরাবরণ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ভিটোর মনে হল, এখনও ও যেন সদ্য ফোঁটা একটা গোলাপ, কিন্তু সবগুলো কাটাসহ। লরার ঘামের গন্ধ ঢুকল তার। নাকে। বাস্তবে ফিরে আসতে মনের ওপর জোর খাটাতে হল ভিটোকে।

লুবনাঃ.., খানিক ইতস্তত করে সরাসরি প্রসঙ্গটা পাড়ল সে, ওকে আবার স্কুলে পাঠানো দরকার। গভর্নেস বুদলালেও বাড়িতে বসে ওর লেখাপড়া হবে না। বারোয় পা দিয়েছে ও, তাই না, কিন্তু পিছিয়ে পড়ছে।

বিছানায় উঠল লরা, স্বামীর হাতে একটা সিগারেট দিল। ভিটোকে অবাক করে দিয়ে বলল সে, শুধু বারোয় পা দেয়নি, দিনে দিনে আমাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, ওকে আর বাড়িতে আটকে রাখা চলে না। কালই তো লোরান আর অলিভার সাথে কথা হচ্ছিল। জান, ওরা আরাসিয়া আর কালডোকে জেনেভায় পাঠাচ্ছে। স্কুলটা নাকি খুব ভাল, লেখাপড়াও শেখানো হয় আমাদের ভাষায়। ইতালীর। অনেক ছেলেমেয়ে পড়ে ওখানে।

বসে পড়ল ভিটো। কিন্তু লরা, এর কোন মানে হয় না। লোরান দেশের একজন নামকরা লইয়ার, আমার মত শিল্পপতিকে দুদশবার কিনতে পারে সে। বিদেশী ব্যাঙ্কে প্রচুর টাকা আছে তার। তাছাড়া, বছরে দুএকবার জেনেভায়। এমনিতেও বেড়াতে যায় ওরা, ওদের ছেলেময়েরা ওখানে পড়তেই পারে। তাই বলে…

শান্ত ভাবে সিগারেটে টান দিল লরা। তাকে বিচলিত হতে না দেখে আবার মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠল ভিটো। ভিটো, বলল লরা। আমি কি ঠিক করেছি, বলি তোমাকে। রোমের অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে দেব আমরা। রোম আমার কাছে একঘেয়ে লাগে। ঠিক এই সময় ভাল দামও পাওয়া যাবে। ওই টাকা দিয়ে জেনেভায় একটা বাড়ি কিনব। মিলান থেকে প্লেনে মাত্র ত্রিশ মিনিটের পথ, কোনমতেই দূর বলতে পার না। মিলান থেকে গাড়িতে করে এখানে পৌঁছুতেও ওই আধ ঘন্টাই লাগে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভিটো, কিন্তু লরা থামল না। তাছাড়া, শীতের সময়টা তুমি এত বেশি বাইরে বাইরে থাক যে আমারও এখানে সময় কাটতে চায় না। জেনেভায় আমার সময় কাটানর কোন সমস্যা হবে না। হপ্তা শেষে মিলান থেকে যাবে তুমি, লুবনাকেও আনিয়ে নেব…

লরা, ধৈর্য হারিয়ে বাধা দিল ভিটো, তোমাকে আমি বলেছি রোমের। অ্যাপার্টমেন্ট মর্টগেজ রাখা হয়েছে। ওটা যদি বিক্রি করি, সব টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিতে হবে। আর ভুলে যাচ্ছ, রোমের চেয়ে জেনেভায় বাড়ির দাম অনেক বেশি, প্রায় ডাবল।

ব্যাপারটা হজম করতে অনেক সময় নিল লরা। এক সময় শুয়ে পড়ল সে, গায়ে চাদর টানল। ঠিক আছে, ভেবেচিন্তে অন্য কোন উপায় বের করতে হবে। আমার মেয়ের নিরাপত্তার দিকটা সবচেয়ে আগে দেখব আমি। ওকে আমি বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি না। মন্তে ফ্যাকন-এর ছেলের কি হল দেখলে তো! স্কুলের গেট থেকে তাকে ধরে নিয়ে গেল। তার গলা চড়ল, স্কুলের গেট থেকে, ভর দুপুরবেলা! মিলানের মত শহরে! আশ্চর্য, তুমি কি তোমার নিজের মেয়ের নিরাপত্তার দিকটাও চিন্তা করবে না!

অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রাখল ভিটো। লরা, এসব নিয়ে আগেও আমরা আলোচনা করেছি। মন্তে ফ্যাকন মিলানের সবচেয়ে ধনী তিনজনের একজন। তোমার লুবনাকে কেউ কিডন্যাপ করতে যাচ্ছে না। এসব কাজ যারা করে তারা। জানে কার আর্থিক অবস্থা কেমন যাচ্ছে। শেষদিকে তার সুরে তিক্ততা প্রকাশ পেল। সে জানে, ব্যবসায়ী মহলে তার আর্থিক দুরবস্থার কথা গোপন নেই।

তর্ক ছাড়ল না লরা। যারা কিডন্যাপ করে তারা অ্যামেচার নয়। কিডন্যাপিং বিশাল এক জটিল ব্যাপার, শুধু প্রফেশনালরাই জড়িত। ইনফরমেশন পাবার বহু উৎস আছে ওদের। দেউলিয়া হতে বসেছে এমন বাপের মেয়েকে কিডন্যাপ করে। ওরা সময় আর এনার্জি নষ্ট করবে না।

তাহলে বল টারকোর মেয়েটাকে কিডন্যাপ করা হল কেন?

বেছে বেছে ঠিক প্রশ্নটাই করেছে লরা। আট বছরের টারকো নোবিলিকে ছমাস আগে কিডন্যাপ করা হয়। টারকো পরিবার নির্মাণ ব্যবসায় আছে, কিন্তু তাদের ব্যবসা মন্দা যাচ্ছিল। মেয়েটাকে দুমাস আটক রাখা হয়, এই দুমাসে কিডন্যাপাররা তাদের প্রথম দাবি এক বিলিয়ন লিরা থেকে নামতে নামতে শেষ পর্যন্ত দুশো মিলিয়ন লিরায় এসে ঠেকে। অনেক কষ্টে টাকাটা জোগাড় করে। মেয়েকে উদ্ধার করে টারকো পরিবার। ওটা একটা আলাদা ব্যাপার ছিল, বলল ভিটো। কিডন্যাপাররা ছিল ফ্রেঞ্চ, মার্সেলেস থেকে এসেছিল। টারকো পরিবার। সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানত না তারা। তাছাড়া, ওরা ঠিক প্রফেশনালও ছিল না। টাকা পাবার দুহপ্তার মধ্যে ধরা পড়ে যায়।

হয়ত তাই, বলল লরা। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটার একটা আঙুল কেটে নিয়েছিল ওরা, সেই থেকে বেচারি একটা মেন্টাল কেস হয়ে গেছে। তুমি চাও লুবনার। সেরকম কিছু একটা হোক?

এভাবে তর্ক করা কঠিন, ভিটোর রাগ বাড়তেই থাকল। স্ত্রীর দিকে তাকাল সে। গায়ের চাদরটা গলা থেকে কোমরে নেমে এসেছে, চিত হয়ে শুয়ে থাকলেও লরার স্তনের আকৃতি বদলায়নি, গম্বুজের মত, নিটোল আর নিভাঁজ। স্বামী তার দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে পাশ ফিরে শুলো সে।

বলল, মিলানের স্কুলে, লুবনাকে আমি পাঠাতে পারি, কিন্তু তার আগে ওর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।

কি বলছ? ভুরু কুঁচকে উঠল ভিটোর।

বডিগার্ড।

কি? দুহাতে ধরে স্ত্রীকে নিজের দিকে ফেরাল ভিটো।

বডিগার্ড। লরার চেহারা থমথম করছে। এমন একজন লোক, যে লুবনার সাথে সারাক্ষণ থাকবে, বিপদ থেকে রক্ষা করবে ওকে।

স্ত্রীকে ছেড়ে ধপাস করে বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল ভিটো। আলোচনাটা সম্পূর্ণ ভুল পথে এগোচ্ছে। লরা, এটা কোন যুক্তির কথা হল না। একজন বডিগার্ডের বেতন কত জান তুমি? আর বডিগার্ড রাখা মানে লুবনার দিকে কিডন্যাপারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা…

– তুমি কি শুধু খরচার দিকটাই দেখবে? আমার লুবনার নিরাপত্তার চেয়ে। তোমার কাছে টাকাটাই বড় হল?

ভিটো বুঝল, এভাবে হবে না। কিভাবে কি বললে লরা বুঝবে, ভাবছে। লরার আচরণে এমন কিছু একটা লুকিয়ে আছে যার কোন অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না সে। শান্ত ভাবে যুক্তির পথে লরাকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করল এবার। আমার টাকা নেই, এটা তোমাকে মেনে নিতে হবে। এবার তুমিই বল, বডিগার্ড রাখার মত একটা বাজে খরচ কোত্থেকে আমি যোগাব?

স্বামীর দিকে সরাসরি তাকাল লরা। কি ভাষার ছিরি! মেয়ের নিরাপত্তার জন্যে কিছু টাকা খরচ হবে, সেটা তোমার কাছে বাজে খরচ হয়ে গেল? কেন, ক্যাপরোটা পরিবার তাদের মেয়ের জন্যে বডিগার্ড রাখেনি? মোজারেলা, মল্টিনি, পোলেন্তা এরা? এমনকি পভেলোরাও তাদের ছেলের জন্যে বডিগার্ড রেখেছে।

এতক্ষণে ব্যাপারটা উপলব্ধি করল ভিটো লুবনার নিরাপত্তার দিকটাই বড় কথা নয়। ওদের ছেলেমেয়েদের জন্যে বডিগার্ড আছে, কাজেই তার মেয়ের জন্যেও একটা রাখতে হবে, তা না হলে ভাট বজায় থাকে না। শুধু হতাশ হল ভিটো তা নয়, অসহায় বোধ করল সে। জানে, এই জেদ থেকে এক চুল নড়ানো। যাবে না লরাকে।

ক্লান্তবোধ করল সে। বলল, এ নিয়ে পরে কথা বলব আমরা।

এ-ব্যাপারে লোরানের সাথে কথা বলতে পার, বলল লরা।

এ-সব ব্যাপার ভাল বোঝে সে, লোকে তার কাছে পরামর্শ চায়।

চোখ মেলে দ্রুত জানতে চাইল ভিটো, বডিগার্ডের কথা লোরানকে বলেছ তুমি?

না। তবে কাল লাঞ্চে বসে অলিভা বলল, মোজারেলা বডিগার্ড রাখার জন্যে, লোরানের কাছে পরামর্শ নিতে এসেছিল। সবাই জানে, সব ধরনের লোকের সাথে যোগাযোগ আছে লোরানের। ওর ফার্ম ছোট বড় কোন কাজই ফিরিয়ে দেয় না।

ভিটো চুপ করে থাকল, চিন্তা করছে।

কি, রাগ করলে? স্বামীর গায়ের কাছে সরে এল লরা

না।

লোরানের সাথে তাহলে কথা বলবে?

ঠিক আছে।

ভিটোর গলায় গাল ঘষল লরা। বিজয়ের আনন্দে আপন মনে হাসছে। জেনেভার কথা তুলে চমকে দিয়েছিল ভিটোকে, ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। আর তাই দ্বিতীয় দাবিটা আদায় করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি নির্জীব সুইসদের মাঝখানে বসবাস করার কোন ইচ্ছেই তার নেই।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত