লোটাকম্বল: ১.৬০ THERE IS NO PATH IN THE SKY

লোটাকম্বল: ১.৬০ THERE IS NO PATH IN THE SKY

১.৬০ THERE IS NO PATH IN THE SKY

There is no path in the sky and a monk must
find the inner path.

তুমি তা হলে কী করবে পলাশ?

আজ্ঞে, বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ না হলে আমি দেরাদুন যাই কী করে?

আমিও তোমাকে এখুনি যাবার জন্যে পেড়াপেড়ি করছি না। আমি বরং আগে ওদের দুজনকে পাঠিয়ে দিই। অ্যাডভান্স পার্টি। তারপর তুমি আর আমি দু’জনে যাওয়া যাবে। ইতিমধ্যে আমি দু’চারদিনের জন্যে চট করে একবার সিঙ্গাপুর থেকে ঘুরে আসি।

সে মন্দ হবে না। বাবা প্রায় সুস্থ হয়ে এসেছেন।

তোমার দাদু কেমন আছেন?

মোটামুটি ভালই, তবে অসুখটা তো তেমন সুবিধের নয়। দুটো কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছে।

দুই রুগিকে তুমি একা সামলাচ্ছ কী করে?

আমি ঠিক একা নই। একজন মহিলা আছেন। বাবার এক পরিচিত ভদ্রলোকের স্ত্রী। আমাদের বাড়ির নীচের তলায় এসে উঠেছিলেন। ভদ্রলোক সুন্দর তবলা বাজাতেন।

অতীতকালে চলে গেলে কেন?

আজ্ঞে, তিনি আর নেই। মারা গেছেন।

কবে মারা গেলেন? ওই বাড়িতেই?

আজ্ঞে না। তিনি কোথায় কোন রাজ এস্টেটে যেন বাজাতে গিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ফেরার নাম : নেই। এই দিন কয়েক আগে এক সি আই ডি অফিসার এসে খবর দিলেন ভদ্রলোক খুন হয়েছেন। মর্গে পড়ে ছিলেন আনক্লেমড হয়ে। ডেডবডি যথাসময়ে পাচার হয়ে গেছে।

বলো কী?

আজ্ঞে হ্যাঁ। মহিলার কেউ কোথাও নেই। তিনিও বিপদে পড়েছেন আমরাও সমস্যায় পড়েছি। মহিলা অসম্ভব কাজের, সংসার মাথায় করে রেখেছেন। তিনি না থাকলে আমরা ভীষণ বিপদে পড়ে যেতুম।

যাক ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান বইছেন। কিন্তু এরপর তো থানা-পুলিশ হবে। হবে না?

আজ্ঞে হ্যাঁ, পুলিশ তিনজনকে পাকড়াও করেছে। বলেও গেছে কোর্টে কেস উঠলে মহিলাকে হাজিরা দিতে হবে।

দেখো দিকিনি হরিটা আবার এক উলটো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল। ওইজন্যে সংসার খালি রাখতে নেই। তোমার জন্যে বিরাট এক স্যাক্রিফাইস করতে গিয়ে বেচারার জীবনে ঝামেলা ছাড়া আর কিছুই জুটল না। তোমরা সব সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসী করো, এত বড় একজন সর্বত্যাগী গৃহী সন্ন্যাসী হিমালয় চষে ফেললেও পাবে কি না সন্দেহ! নির্লোভ, আদর্শবাদী, জিতেন্দ্রিয়। সংকল্পের কী দৃঢ়তা! তুমি খুব ভাগ্যবান পলাশ! হরির রক্ত তোমার শরীরে, সেইজন্যে তোমাকে আমি শুধু ভালবাসি না, শ্রদ্ধাও করি। দেখো এই মানুষটির প্রতি কখনও কোনও অবিচার যেন না হয়। হিরের মতো যত্ন করে রাখবে। বেশ ওই কথাই তা হলে রইল। আর হ্যাঁ, তুমি রোজ সকাল সকাল বাড়ি চলে যেয়ো। ওই আটঘণ্টা থাকার কোনও প্রয়োজন নেই। আমি ফ্যাক্টরিকে বলে দিচ্ছি, দশ-বারো বোতল ভিটামিন নিয়ে যাও, বাবাকে নিয়মমাফিক খাওয়াও, শরীরটা তাড়াতাড়ি সারবে।

পিতার প্রশংসায় সন্তান খুশি হয়, সন্তানের প্রশংসায় পিতা। কিন্তু এম ডি’র একটা কথা কাটার মতো বিধে রইল মনে। স্যাক্রিফাইস। আমার জন্যেই আমার পিতা আজ নিঃসঙ্গ। জীবধর্ম ত্যাগ করে ঊর্ধ্বচারী সন্ন্যাসী। সুদীর্ঘ বিশ বছর লোটাকম্বল সম্বল করে ওই ভগ্নপ্রাসাদে স্মৃতির স্কুপে বসবাস করছেন। নিজের কণ্ঠস্বরই দ্বিতীয় কণ্ঠস্বর। স্বপ্ন যদি কিছু থেকে থাকে, সে স্বপ্ন আমাকে ঘিরে। পিতার সন্তান-স্বপ্ন বাঁধা-রাস্তাতেই চলবে। সফল জীবিকা, সম্পদ, সুখের সংসার, সন্তান সন্ততি পিতৃআজ্ঞাপালনকারী। জীবনের পালে বাতাস যখন মৃদু হয়ে আসবে তখন বৃদ্ধ হরিশঙ্কর, ত্যাগী সংযত হরিশঙ্কর, ক্যামেরার সামনে হাসিহাসি মুখে এসে বসবেন, কোলে একটি দেবশিশু, ঊ্যাপা উঁাপা গোলাপি গাল, কুঁচফলের মতো চকচকে চোখ, সদ্যোজাত দাতে হাসির জলতরঙ্গ, এপাশে আধঘোমটা টানা টইটম্বুর যুবতী, ওপাশে ঈষৎ গর্বিত একটি যুবক, অগ্রগামী হরিশঙ্করের পশ্চাদগামী যুবক হরিশঙ্কর। সুখের সংসারের ছায়া ধরা রইল ব্রোমাইড কাগজে। বসে আছেন পক্ককেশ পিতামহ হরিশঙ্কর, দাঁড়িয়ে যুবক হরিশঙ্কর, কোলে শিশু হরিশঙ্কর। তিনটি জেনারেশন সময়ের আঙিনায় কুচকাওয়াজ করে চলেছে। মানুষের টানে সোনপাপড়ির সুতোর মতো সময় লম্বা হয়ে চলেছে। ট্র্যাডিশনের ছায়া লম্বা হয়ে চলেছে মানব-মনুমেন্টের দিকে।

বেলাবেলি অফিস ছেড়ে বেরিয়ে পড়লুম। মনের অবস্থা তেমন ভাল নয়। জীবনটা কেমন যেন মিইয়ে আসছে আবার। ভবিষ্যতের দিকে একটা রাস্তা খুলছিল। কোথা থেকে কোথায় চলে যাওয়া যেত! দেরাদুনে প্রবাস। পদোন্নতি। সুন্দরী স্ত্রী। মাঝে মাঝে মুসৌরি। গানহিল লালটিব্বা থেকে হিমালয় দর্শন। চাকরিটা নেহাত খারাপ ছিল না। এ লাইনে পাকা হাত, কাজ-জানা লোকের বেশ ডিম্যান্ড আছে। সবচেয়ে বড় কথা খোদ মালিকের স্নেহ ভালবাসা।

হাতে বারো ফাঁইল ভিটামিন বি কমপ্লেক্স প্যাক করা একটা কার্টুন। ওজন নেহাত কম নয়। নড়বড় নড়বড় করতে করতে চলেছি। আজ আমি সেই পত্রিকা অফিসে যাবই। স্বামী নির্মলানন্দের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। মনে হচ্ছে জীবনে আবার গ্রহণ লাগবে। তার আগেই সব কাজ সেরে। ফেলতে হবে। আমার চিন্তায় ভবিষ্যৎ যখন উঁকি মেরে যায়, ভালই হোক আর খারাপই হোক, তখন তা ফলবেই। এ আমার কী ধরনের শক্তি ঈশ্বরই জানেন।

আজ শহরে খুব হাওয়া ছেড়েছে। সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। বাতাসের দাপটে পড়ন্ত বেলার রোদ যেন গুঁড়ো হলুদের মতো উড়ছে। আকাশের মাঝখানটা মরকতমণির মতো নীলচে সবুজ। বিন্দু বিন্দু চিল উড়ছে। বিকেল যেন গিলে-করা পাঞ্জাবি পরে ছড়ি হাতে বেড়াতে বেরিয়েছে ফুরফুরে মেজাজে।

ওষুধের কার্টুনটা আজ অফিসে রেখে এলেই হত। একটা হাত জোড়া হয়ে আছে। এমন কাউকে দেখছি না যাকে ভিটামিন দেওয়া যায়। দিতে চাইলেও নেবার লোক নেই। কত দাতা এইভাবে জগৎ জুড়ে ফ্যাফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পার্কের কোনায় অন্যদিন এক অসুস্থ বৃদ্ধকে বসে থাকতে দেখি, আজ সেও নেই। কাল রাতে মারাই গেল কি না কে জানে।

পত্রিকার অফিস আর আশ্রম একই বাড়িতে। বড় মনোরম জায়গা। পশ্চিমে গঙ্গা। একপাশে ভদ্রগোছের ছোট একটা বস্তি। বস্তির ঘরে ঘরে শিল্পকর্ম চলেছে। টেলারিং, বই বাঁধাই, শাল রিপেয়ারিং। কালো পিচের রাস্তা এইবার সারাদিনের উত্তাপ ছাড়তে শুরু করেছে। একটা চাপাকলের সামনে মেয়েরা জল নিচ্ছে। একজনের খোঁপায় আবার ফুলের মালা। জল, যৌবন, মালা, বৈরাগ্য সবকিছুর পাশাপাশি অবস্থান। সময় সময় মানুষের কীরকম অদ্ভুত অদ্ভুত ইচ্ছে হয়। পাছাপাড় শাড়ি পরা খলবলে এক মহিলাকে দেখে ভীষণ ইচ্ছে হল ভিটামিনের শিশিগুলো সব দিয়ে দিই। তাজা শরীর আরও একটু তাজা হোক। হাসির ধার আরও একটু বাড়ুক। যারা আনন্দে আছে, তারা আরও একটু শক্তি লাভ করুক। দিতে গিয়ে মার খেয়ে মরি আর কী!

আশ্রমের দরজার সামনে কালো রঙের একটা মোটর পঁড়িয়ে। বাড়িটার ওপরদিকে পশ্চিমের রোদ লেগেছে। বড় হবার এই মজা। অনেকক্ষণ আলোয় থাকা যায়। অফিসঘরে সুন্দর চেহারার এক সন্ন্যাসী বসে আছেন। স্বাস্থ্য দেখলে তাক লেগে যায়। মুখে অপূর্ব এক জ্যোতি। অন্তরে সবসময় যেন। হাসছেন। সেই হাসির ঝিলিক লেগে আছে চোখে। সন্ন্যাসীর সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল, গান-ফুরোনো জলসাঘর। গান থামলেও ঝংকার ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। এঁর সামনে আমার এই ভিটামিনের কার্টুন যেন এক উপহাস!

সন্ন্যাসী চোখ তুলে তাকালেন। সামনে পড়ে আছে হিসেবের জাবদা খাতা। প্রশ্ন করলেন না, তবু প্রশ্ন রয়েছে। ভাবের ভাণ্ডারীর ভাষায় প্রয়োজন খুব কম। আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললুম, মহারাজ, স্বামী নির্মলানন্দের সঙ্গে দেখা করব। এই যে তার চিঠি, আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন।

একনজরে চিঠিটা পড়ে ফেলে মহারাজ বললেন, আপনি বসুন।

কালো রঙের পালিশ করা চার-পাঁচখানা চেয়ার। একটায় ধীরে ধীরে সংযত হয়ে বসে পড়লুম। ভেতরে বেশ এক ধরনের গাম্ভীর্য আসছে। শান্তি নামছে। তেমন আর ভয় করছে না। চতুর্দিকে রাশি রাশি বই। স্বামীজির ওপর, রামকৃষ্ণের ওপর। ধর্ম আছে, দর্শন আছে। সম্পূর্ণ অন্য এক জগৎ। দেয়ালে ঝুলছে স্বামী বিবেকানন্দের বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবি। সমাধিস্থ রামকৃষ্ণ, ধ্যানস্থ রামকৃষ্ণ। আমার একেবারে চোখের সামনে থাউজান্ড আইল্যান্ড পার্কে ভোলা স্বামীজির সেই ছবিটি। বড় বড় চুল। মুখে স্মিত হাসি। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। তেজের সঙ্গে প্রেম মিশে অদ্ভুত এক মুখচ্ছবি। জলে যেন আগুন লেগেছে। সারাঘরে ধূপের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। মহারাজের শরীরেও সুন্দর একটা গন্ধ। সারাশরীরে যেন হোমের গন্ধ। গোস্বামীজি কুলদানন্দ ব্রহ্মচারীজিকে বলেছিলেন, গায়ে হোমের ধোঁয়া মাখবে, শরীর পবিত্র হবে। মন ঘুরে যাবে। নির্দেশ পালন করে মাসখানেকের মধ্যে ব্রহ্মচারীজির তাই হয়েছিল। আমার কী হল? মন বলছে, আজ যেখানে এসেছ তোমাকে তোমার। ভবিতব্য সেখানে টেনে এনেছে। জীবনের গতি এবার ঘুরে যাবে। গোলকধাঁধা থেকে বেরোবার পথ। পেয়ে যাবে। আজকের দিনটা খেয়াল করে রাখিস।

মহারাজ ইন্টারন্যাল ফোনে স্বামী নির্মলানন্দের সঙ্গে কথা বলে রিসিভার নামাতে নামাতে বললেন, বসুন, আসছেন।

চিঠিটা ফেরত দিতে দিতে একনজরে আমাকে আর একবার দেখে নিলেন। মনে হচ্ছে কত কালের চেনা। মানুষ যেমন নিজের হাতের কি পায়ের দিকে ভাল করে তাকায় না, কোনওদিন ভাল করে তাকালে অবাক হয়ে ভাবতে থাকে, এই আমার হাত, হাতের আঙুল! কী আশ্চর্য! আমারও সেইরকম মনে হতে লাগল, এ সবই আমার চেনা, ভীষণ চেনা। কোনওদিন ছেড়ে চলে গিয়েছিলুম, আজ আবার ফিরে এসেছি। তাই হইহই অভ্যর্থনা নেই। ঘরের লোক ঘরে ফিরে এসেছে। এই কিছুদিন আগে চিৎপুরে বড় মসজিদের সামনে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল, আমার ভীষণ চেনা জায়গা। খুব অস্বস্তি হয়েছিল। চুলকোচ্ছে অথচ শত চেষ্টাতেও ঠিক জায়গাটা খুঁজে পাচ্ছি না।

ডান পাশে ঘাড় ঘোরালেই আমি একটা সিঁড়ি দেখতে পাচ্ছি। ধাপে ধাপে উঠে গেছে ওপরে। মহারাজ হাসিহাসি মুখে আবার কাজে মন দিয়েছেন। স্বামীজি সামনের ছবি থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কী যেন বলতে চাইছেন! হয়তো বুঝেছি! বলছেন, উত্তিষ্ঠিত, জাগ্রত, প্রাপ্যবরান নিবোধত। মাঝে মাঝে সিঁড়ির দিকে তাকাচ্ছি। স্বামী নির্মলানন্দ ওই সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসবেন। আর তখনই আমার জীবনের গতি পালটে যাবে। গলিঘুজির পথিক হঠাৎ বেরিয়ে পড়ব দিগন্ত ঘেরা মহাপ্রান্তরে। বিশাল এক ঈগল ইঁদুরের মতো ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাবে একেবারে পাহাড় চুড়ায়।

তরতর করে নেমে আসছেন স্বামী নির্মলানন্দ। জলের ছন্দে নেমে-আসা দুটি পা, গৈরিক বসনের নেচে-ওঠা প্রান্ত দেখতে পাচ্ছি। সাধকের শরীর যোগ-প্রভাবে এইরকমই লঘু গতিময় হয়। আমি পড়েছি। নামার এই ধরনও একপ্রকার প্রাণায়াম। ব্রহ্মচারীজির ডায়েরিতেই আছে। সাধকদের ক্ষিপ্ত হাত-পা ছোঁড়া অকারণ নয়। গুহ্যকারণে ভরা।

সিঁড়ির শেষ ধাপ লাফিয়ে নেমে স্বামীজি ঝড়ের গতিতে অফিসঘরে ঢুকলেন। ঢুকেই বললেন, কোথায় সেই ভদ্রলোক?

যে-ঘরে আমি একাই বসে আছি, সেখানে ভদ্রলোক কোথায় জিজ্ঞেস করার মানেটা কী? তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলুম, আজ্ঞে, আমি।

স্বামী নির্মলানন্দের ক্ষুরধার চেহারা। শরীরে মেদ নেই। মাঝারি উচ্চতার মানুষ। গায়ে ঢোলা হাতা পাঞ্জাবি, গেরুয়া রঙে ছোপানো। তার ওপর একটি উত্তরীয়। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। চোখে গোল্ড ফ্রেমের চশমা। উজ্জ্বল দুটি অনুসন্ধানী চোখ আমার দিকে স্থির হয়ে আছে।

মহারাজ হঠাৎ হোহো করে হেসে উঠলেন। বলশালী ভোগী মানুষের লোলুপ হাসি নয়। সাধকের স্ফটিক-স্বচ্ছ, জল কল্লোলের হাসি। যেমন হঠাৎ শুরু, তেমনই হঠাৎ থেমে যাওয়া। ঠোঁটে শেষ সূর্যের আভার মতো সামান্য একটু লেগে রইল।

তুমি পলাশ চট্টোপাধ্যায়?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

দু’হাতে আমার দুটো কাধ ধরে শরীরটাকে কঁকিয়ে দিলেন। পড়েছিলুম শার্লক হোমস কৃশকায় ছিলেন। কিন্তু শরীরে অসাধারণ শক্তি ছিল। স্বামী নির্মলানন্দের ঝকানিতে সবকিছু যেন ঝরে পড়ে গেল। বিশ্বাস, অবিশ্বাস, সংস্কার, মলিনতা, নীচ চিন্তা। সব ঝরঝর করে ঝরে পড়ে গেল। পায়ের নীচে। যেন সহস্র ধারার উষ্ণ জলে স্নান করে উঠলুম। ধ্বংসস্তূপে জেগে উঠল স্বর্গীয় পাখি, ফিনিক।

স্বামীজি বললেন, ভেবেছিলুম ষাট বছরের কোনও বৃদ্ধকে দেখব। তুমি তো যুবক হে! চলো ওপরে আমার ঘরে চলো।

স্বামী নির্মলানন্দ সিঁড়ি বেয়ে আগে আগে উঠছেন, আমি পেছনে পেছনে। উঠতে উঠতে ভাবছি, আমার এই আরোহণ যেন অবরোহণ না হয়। ক্রমশই উঠে যাব, ওপরে আরও ওপরে। দোতলায় ঠাকুরঘর। বেদির ওপর সারদামায়ের ছবি। মাৰ্বল পাথরের সাদা মেঝে। স্বামীজি বললেন, যাও আগে প্রণাম করে এসো।

মায়ের দিকে তাকিয়ে একপাশে একজন অল্পবয়সি মহিলা বসে আছেন। দৃষ্টি স্থির। দু’গাল বেয়ে জলের ধারা নেমেছে। মহিলার দিকে তাকিয়ে বুকটা হুঁত করে উঠল। কনক নাকি! অনেকটা, সেইরকম দেখতে!

মহিলার দিক থেকে তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে মাটিতে মাথা ঠেকালুম। মনে মনে বললুম, মা, ক্ষমা করো। পুরো মনটা তোমাকে দিতে পারলুম না। সামান্য একটু টলে গেছে। চোখ বুজিয়ে মাকে দেখার চেষ্টাও সফল হল। তরুণীর অশ্রুসজল দুটি চোখ, বেদনা-মাখা মুখচ্ছবি বারেবারে, ফিরে ফিরে এল। এ কি কোনও কিছু হারানোর বেদনা, না না-পাওয়ার বেদনা!

দশ হাত পেছনে স্বামী নির্মলানন্দ আমার জন্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আরও ওপরে উঠতে হবে। বাঁ পাশে আর একটি সিঁড়ি তিন তলায় উঠে গেছে। তিন তলায় একটি মাত্র ঘর, সেই ঘরটিই স্বামী নির্মলানন্দের। একটি টেবিল, একটি চেয়ার, অসংখ্য বই। ঘরে শোওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। সন্ন্যাসীর ভূমিশয্যাই শাস্ত্রের বিধান।

একটা মোড়া দেখিয়ে স্বামীজি বললেন, বোসো।

আদেশ পালন করলুম। স্বামীজি চেয়ারে বসে আমাকে দেখতে লাগলেন। তার সেই অনুসন্ধানী দৃষ্টির সামনে বসে বড় অস্বস্তি শুরু হল। শোকেসে দাঁড় করানো ম্যানিকুইন হঠাৎ প্রাণ পেয়ে গেলে কাঁচের ওধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে দেখলে আমার মতোই মনের অবস্থা হত। ছুটে পালাবারও উপায় নেই। নিজেকে মনে হচ্ছে স্বচ্ছ মানুষ। ধরা না পড়ে যাই। লোভ, লালসা, কুচোকুচো কামনা, বাসনা, অ্যাকোয়ারিয়ামের রঙিন মাছের মতো কিলবিল করছে।

মহারাজ বললেন, দেখি, আমার হাতে তোমার ডান হাত রাখো।

নিক্তিতে ওজন করার মতো করে তিনি আমার হাতের ওজন নিলেন। জানি, এ এক আধ্যাত্মিক পরীক্ষা। ঠাকুর স্বামী বিবেকানন্দকে করেছিলেন। হালকা হাতের মালিকের মনও হালকা। হৃদয় অগভীর, সংকীর্ণ। পরীক্ষায় পাশ না ফেল? প্রশ্নও করতে পারছি না।

স্বামীজি বললেন, যাও বোসো।

মোড়ায় বসে পড়লুম। স্মিত হেসে স্বামীজি প্রশ্ন করলেন, কী করো?

আজ্ঞে চাকরি। কেমিস্ট।

বিজ্ঞানের ছাত্র? খুব ভাল। এরকম একটা দার্শনিক প্রবন্ধ লিখলে কী করে? ডেকার্ট পড়েছ? কান্ট, হিউম, হেগেল, স্পিনোজা, হবস্?

কিছু কিছু।

প্রবন্ধটা ভালই লিখেছ! একটা কাজ কেবল বাকি, আর একটু খাটতে হবে।

বলুন, প্রস্তুত আছি।

এই তো চাই। সবসময় নিজেকে তৈরি রাখবে সৈনিকের মতো। মনে মনে সবসময় বলবে, আমাকে যেতে হবে, আমাকে যেতে হবে। আমি থাকার জন্যে আসিনি, আমি যাবার জন্যে এসেছি।

আপনি মৃত্যুর কথা বলছেন?

মৃত্যু? মৃত্যু তো দুর্বলের কথা, ভীরুর কথা। মৃত্যু বলে কিছু নেই। ট্র্যানজিশন। রূপান্তর। তুমি তো গীতা পড়েছ?

আজ্ঞে হ্যাঁ, রোজই এক অধ্যায় করে পড়ার চেষ্টা করি।

তা হলে সেই শ্লোকটি মনে করার চেষ্টা করো,

অবক্তাদ্‌ব্যক্তয়ঃ সৰ্ব্বাঃ প্রভব্যহরাগমে।
রাত্রাগমে প্রলীয়ন্তে তত্রৈবাব্যক্তসংজ্ঞকে ॥
ভূতগ্রামঃ স এবায়ং ভূত্বা ভূত্ব প্রলীয়তে।
রাত্রাগমেহবশঃ পার্থ প্রভবত্যহরাগমে ॥

অব্যক্ত হইতে সব দিনে ব্যক্ত হয়/রাত্রিতে আবার হয় অব্যক্তেই লয়/ এইরূপ ভূতগণ যায় আর আসে/ রাত্রিতে বিলীন হয়, দিবায় প্রকাশে। মৃত্যুর এর চেয়ে সুন্দর ব্যাখ্যা তুমি আর কোথায় পাবে? মৃত্যু নিয়ে বেশি মাথা ঘামাবে না। ও হল এক ধরনের চিন্তাবিলাস। দুটো কথা মনে রেখো, ডেথ-ইন- লাইফ, আর লাইফ ফিল্ড উইথ লিভিং। জীবনকে বেঁচে থাকায় ভরপুর করে তোলে। কাজে কাজে বেলা বেড়ে গেলে হঠাৎ ঘড়ি দেখে আমরা লাফিয়ে উঠি, আরে এরই মধ্যে বারোটা বেজে গেল! জলের বিম্ব একদিন জলেই মিলিয়ে যাবে। কী? খুব খিদে পেয়েছে?

আজ্ঞে না।

তোমার মুখ বলছে। দাঁড়াও একটা সন্দেশ খাও। শরীর আদ্যং খলু ধর্ম সাধনং।

মহারাজ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। ঘরের ও প্রান্তে একটি কাঠের আলমারি। চারচৌকো সুদৃশ্য একটা টিনের কৌটো নিয়ে তিনি ফিরে এলেন আসনে।

কী সন্দেশ খাবে বলো? কড়াপাক? না নরমপাক?

আপনি যা দেবেন।

তোমার নিজের কোনও ইচ্ছে নেই?

আজ্ঞে না।

তুমি কি সব ব্যাপারেই নিজেকে এইভাবে সমর্পণ করে দিতে পারো?

নির্ভর করে ব্যক্তির ওপর, তাঁর ব্যক্তিত্বের ওপর। সকলের হাতে নিজেকে ছাড়তে পারি না।

গুরুকরণের ওপর তোমার বিশ্বাস আছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব আছে।

কথামৃত পড়েছ?

আজ্ঞে হ্যাঁ। রোজই পড়ি।

আর কী পড়ো?

শ্রীশ্রীকুলদানন্দ ব্রহ্মচারীজির শ্রীশ্রীসদগুরুসঙ্গ।

উপনিষদ?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তা হলে তুমি নরমপাক খাও। নাও হাত পাততা। সন্ন্যাসী মানুষ কোথায় পাব তোমার জন্যে প্লেট?

মহারাজ আমার হাতে বড় বড় দুটো সন্দেশ দিলেন। আকার আকৃতি দেখে খাবার আগেই প্রাণ ভরে গেল। ওপরে কুচো কুচো পেস্তা ছড়ানো। মহাপুরুষের সামনে হাউহাউ করে খেতেও লজ্জা করছে। খাদ্যগ্রহণকারী মানুষের চোখমুখের চেহারা পালটে যায়। লোভের ছায়া নামে। একটু একটু করে ভেঙে ভেঙে মুখে পুরছি। অতি সুস্বাদু। এমন জিনিস কোথায় পাওয়া যায়? দোকানের নাম জানা থাকলে পিতা আর মাতামহের জন্যে নিয়ে যেতুম।

স্বামী নির্মলানন্দ মহারাজ আমার দিকে আর তাকাচ্ছেন না। একটি পাণ্ডুলিপিতে মন দিয়েছেন। ধীরে ধীরে দুটোকেই শেষ করে ফেললুম। মহারাজ মুখ না তুলেই বললেন, বাইরে ছাদের ওপাশে কল আছে, যাও হাত ধুয়ে এসো।

হাত ধুয়ে এসে বসতেই মহারাজ পাণ্ডুলিপি থেকে মুখ তুলে বললেন, দেখি, হ্যাঁ, এবার তোমার মুখের চেহারা পালটে গেছে। বেশ একটা স্নিগ্ধ ভাব এসেছে। বুদ্ধদেবের ধম্মপদ পড়েছ?

আজ্ঞে মাঝেমধ্যে উলটে দেখি।

তুমি করেছ কী? সব পড়ে বসে আছ? ইমিটেশন অফ ক্রাইস্ট?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

শঙ্করের বিবেকচূড়ামণি?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

বাঃ জমিতে ভালই সার পড়েছে। এবার তা হলে ফুল ফুটবে!

ধীরে ধীরে আমার সাহস বাড়ছে। মহারাজের চোখের জ্যোতি লাইট হাউসের মতো ঝড়ের রাতের নাবিককে স্থলের সংকেত জানাচ্ছে। সাহস করে বলেই ফেললুম, স্বামীজি, বুদ্ধ কিন্তু বলেছেন, মূর্খ সারাজীবন জ্ঞানীর সঙ্গ করলেও জ্ঞানের পথের সন্ধান পায় না, যেমন চামচে কোনওদিন পায় না সুপের স্বাদ। বাংলা ঠিক হল কি না জানি না, ইংরেজি অনুবাদ আরও সুন্দর, If during the whole of his life a fool lives with a wise man, he never knows the path of wis dom as the spoon never knows the taste of the soup.

পলাশ, তুমি তো মূর্খ নও। তোমার জন্যে বুদ্ধের সেই উপদেশ, যে-মানুষ জাগ্রত সে যদি জ্ঞানী মানুষের সঙ্গে মুহূর্তকাল কাটায় সে কিছুদিনের মধ্যেই জ্ঞানের পথ চিনতে পারে, যেমন জিভ চুমুকের সঙ্গে সঙ্গেই সুপের স্বাদ পায়। বুদ্ধের ওই উপদেশটিও মনে রেখো, অনাবৃত শরীর, জটাধারণ, পরিচ্ছন্নতায় উদাসীনতা, উপবাস, ভূমিশয্যা, ভস্মলেপন, আসন, কিছুতেই কিছু হবার নয়। বিশুদ্ধ হবার একমাত্র পথ সংশয় আর কামনা থেকে মুক্তি। এইবার তোমার বিবেকচূড়ামণি কী বলছেন–

অর্থস্য নিশ্চয়ো দুষ্টো বিচারেণ হিতোক্তিতঃ।
ন স্নানেন ন দানেন প্রাণায়ামশতেন বা ॥

বিচার, সৎ আর অসতের পার্থক্য বুঝে অসৎকে ত্যাগ করতে হবে। সাহায্য করবেন কে? গুরু। স্থান দান, শত শত প্রাণায়াম, যাই করো না কেন, বিচার আর গুরুর উপদেশ ছাড়া পথ খুলবে না।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আকাশে তালচটকা পাখির ঝক দিন-শেষের ওড়া উড়ছে। মহারাজ বললেন, আর না, একটু পরেই আরতি শুরু হবে, আমাকে প্রেয়ারে বসতে হবে। তোমার বাড়ির খবর বলল, কে কে আছেন?

থাকার মধ্যে আছেন আমার বাবা, আর আমার দাদু। এ ছাড়া আমার আর কেউ নেই।

মহারাজ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর আমার নিতান্ত আপনজনের মতো মৃদু হেসে বললেন, ভাগ্যবান, ভাগ্যবান। এই সুযোগ কাজে লাগাও। তোমার পথ ঈশ্বরই পরিষ্কার করে রেখেছেন। মায়ের স্নেহ যখন পাওনি, তখন অন্য আর কারুর স্নেহ-ভালবাসার আশা কোরো না। বিবাহ করার ইচ্ছে আছে নাকি?

একেবারেই না।

চাপাবার চেষ্টা চলছে?

অল্পস্বল্প।

কেটে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করো, রেশমকীট যেমন গুটি কেটে বেরিয়ে যায়–

কোথা হতে আসিয়াছি, নাহি পড়ে মনে
অগণ্য যাত্রীর সাথে তীর্থদরশনে
এই বসুন্ধরাতলে! লাগিয়াছে তরী
নীলাকাশসমুদ্রের ঘাটের উপরি।

কার লেখা?

রবীন্দ্রনাথ। নৈবেদ্য।

পরের স্তবক?

ভাগ্য ভাল, মনে ছিল। কাল রাতেই মাতামহকে আবৃত্তি করে শুনিয়েছি। অশ্রুধারায় সিক্ত হয়ে শুনেছেন,

শুনা যায় চারিদিকে দিবসরজনী
বাজিতেছে বিরাট সংসার শঙ্খধ্বনি।
লক্ষ লক্ষ জীবনফুকারে। এত বেলা
যাত্রী নরনারী সাথে করিয়াছি মেলা
পুরীপ্রান্তে পান্থশালা’-পরে। স্নানে পানে
অপরাহ হয়ে এল গল্পে হাসি গানে।

মহারাজ শেষ স্তবকটি আবৃত্তি করতে করতে উঠে দাঁড়ালেন,

এখন মন্দিরে তব এসেছি হে নাথ
নির্জনে চরণতলে করি প্রণিপাত
এ জন্মের পূজা সমাপিব। তারপর
নবতীর্থে যেতে হবে হে বসুধৈশ্বর।

টেবিলের ডান দিকের ট্রে থেকে আমার লেখাটি তুলে নিলেন। শোনো, সবই ঠিক আছে, একটা কাজ কেবল বাকি, অনেক উদ্ধৃতি আছে, সব ক’টার ফুটনোট দিতে হবে। প্রথমে নম্বর দেবে, এক, দুই, তিন, চার, তারপর তলায় তলায় উল্লেখ করবে সোর্স। পারবে তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ। যত তাড়াতাড়ি পারো দিয়ে যেয়ো। মনোনীত করে রেখেছি। পারলে সামনের মাসেই ছেপে দোব। হ্যাঁ, তোমাকে একটা বইও দিচ্ছি, রোজ নিয়ম করে দু’চার পাতা পড়বে।

বই আর পাণ্ডুলিপি দুটোই আমার হাতে এসে গেল। বইটির নাম স্বামী-শিষ্য সংবাদ। প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই মহারাজ বললেন, এত বড় বড় চুল রেখেছ কেন?

ভীষণ অপ্রস্তুতে পড়ে গেলুম। শরীরে একমাত্র এই চুলই দর্শনীয়। আর তো দেখাবার মতো কিছু নেই। না বুকের ছাতি, না হাতের গুলো। মিউ মিউ করে বললুম, বড় হয়ে গেছে, এইবার কাটব।

হ্যাঁ কেটে ফেলল। দুর্বলতার সেবা কোরো না। পুরুষ হও, তবেই না পৌরুষ আসবে।

স্বামীজি হঠাৎ ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলেন। ধীর পায়ে আমার সঙ্গে ঘরের দরজা পর্যন্ত এলেন। চৌকাঠ পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা ভেজিয়ে দিলেন। দোতলার ঠাকুরঘর আলোয় আলোকময়। মেঝেতে ঢালাও কার্পেট। ধূপের গন্ধ। একটি হারমোনিয়ম। সারদামায়ের পুজো শুরু হয়েছে। সেই তরুণী এখনও একইভাবে স্থির। আরও অনেক ভক্ত এসেছেন। নীচের অফিসঘর বন্ধ। নির্জন একটি বেঞ্চের তলায় অসংখ্য জুতো। একটি শিশু একা বসে।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত