লোটাকম্বল: ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়

লোটাকম্বল: ১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়

১.৫১ বিশাল ধরার চতুঃসীমায়

বিশাল ধরার চতুঃসীমায় যা কিছু পাও, স্বপ্ন শুধু

বুক জ্বলে গেল। দরজার সামনে অপর্ণা ওই বিলিতি যুবকটির পাশে লেফাফার গায়ে ডাকটিকিটের মতো কেমন সেঁটে আছে। ছেলেটির হাতে আবার ফুলের তোড়া। ম্যারেজ রেজিস্টারের অফিস থেকে এল, না চার্চ থেকে? আমার এমন হিংসে হবার তো তেমন কোনও কারণ নেই। তবু হচ্ছে কেন? পঙ্কজবাবুর ডাক্তার ভায়রাভাই ঠিকই বলেছেন, এ ছোকরার প্রকাশিত অংশের চেয়ে অপ্রকাশিত অংশই বেশি। ব্যাটা ডুবসাঁতার কাটছে।

ঠিক টেনিস খেলোয়াড়দের মতো লম্বা চওড়া চেহারা। ইংরেজ নবাবদের মতো বাদামি চুল, ঘাড়ের ওপর কানের ওপর লুটোপুটি খাচ্ছে। ঝুলপির কী বাহার! বিলেতে মানুষকে কী জিনিস বানিয়ে দেয় রে বাবা! প্যান্ট, শার্ট, জুতো, নেকটাই এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ। হাতের কবজি আমার পায়ের গোছের মতো। টকটকে ফরসা। মণিবন্ধে কালো ব্যান্ডে সোনার রিস্টওয়াচ। একেবারে ছবির নায়ক। মুখ সামান্য লম্বাটে হলেও, অসম্ভব ধারালো। গ্রিসিয়ান নাক, স্পার্টান চোখ, স্প্যানিশ গোঁফ। আমি গোহারান হেরেছি। স্বয়ংবর সভা হলে রাজকন্যে আমার গলায় ঘেঁটুফুলের মালা ঝুলিয়ে, গাধার পিঠে উলটো বসিয়ে রাজ্যছাড়া করে দিত।

পঙ্কজবাবুর ভায়রাভাই বললেন, কী হল, ফিরে এলে? দিয়ে এলে না?

যুবক খটখট করে জুতোর শব্দ তুলে এগিয়ে এলেন। চলনের কী দৃপ্ত ভঙ্গি। যেন লর্ড ক্লাইভ পলাশীর যুদ্ধের পর বিজয় সেনানীর পুরোভাগে মুর্শিদাবাদে ঢুকছেন। এ হাঁটা আমার কাঠামোয় সম্ভব হবে না। ঠ্যাং খুলে যাবে। যুবক বললেন, মিসেস পার্কার কলকাতা ছেড়ে চলে গেছেন।

সেকী, কোথায়?

নেপাল।

ফিরবেন কবে?

কেউ জানে না।

তা ফুল রেখে এলে না কেন?

কার কাছে রাখব! ফ্ল্যাটে চাবি।

জানলে কী করে নেপাল গেছেন!

ওঁর টেলার বললেন। সামনেই তার টেলারিং শপ।

দেন প্রেজেন্ট ইট টু অপর্ণা।

যুবক সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ফুলের তোড়া হাসিহাসি মুখে আমার পিতার বন্ধুমাতার হাতে তুলে দিলেন। তিনি তার স্বপ্নে মশগুল হয়ে বসে আছেন ওদিকে, এদিকে এইসব হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে চলেছে। অপর্ণা ফুল নিতে নিতে বললে, কার জিনিস কে পায়!

অপর্ণা এই কথাটি বেশ বলেছে। কথার মধ্যে অল্প একটু দংশন আছে। পিঁপড়ের কুটুস কামড়। নিরাশ মনে আলোর সামান্য ঝিলিক খেলে গেল।

পঙ্কজবাবু বললেন, একেই বলে মানুষ বরাতে খায়। যাও মা ফুলদানে জল দিয়ে যত্ন করে রেখে এসো। দেখাশোনা করলে সাত দিন ঠিক থাকবে। জলে একটু নুন ফেলে দিয়ো।

বুকের কাছে নীল সাদা লাল হলুদ ফুলের স্তবক ধরে দেবী অপর্ণা এতক্ষণে আমার দিকে তাকাবার অবসর পেলেন। মানুষের মুখ যে কত উজ্জ্বল হতে পারে, আমার ধারণা ছিল না। হাসি যে কত স্বর্গীয় হতে পারে দেখা ছিল না। ভেতরে এতক্ষণ যে অভিমান গুমরোচ্ছিল এই হাসিতে সব শান্ত হয়ে গেল। আমার হাসি আমাকে ছেড়ে ঠোঁটে গিয়ে বসল। বেশ বুঝলাম আমার নিয়ন্ত্রণ এখন ওই ফুলওয়ালির হাতে। সেদিন কীভাবে দেখেছিলুম জানি না, আজ দেখছি সম্পূর্ণ অন্যভাবে। মনের নানারকম রসে জারিয়ে আচারের মতো করে।

অপর্ণা হেসে ভেতরে চলে গেল। তার আসা, তার দাঁড়ানো, তার চলে যাওয়া, শরীরে সূক্ষ্ম শাড়ির বাঁধন, ভেতর থেকে ফুটে ওঠা অন্তর্বাসের আভাস, সবকিছুরই আজ কেমন যেন অন্য এক জগতের ইশারা। একই জগৎ, শিশুর চোখে একরকম, সাধকের চোখে একরকম, লম্পটের চোখে একরকম।

পঙ্কজবাবু বললেন, তোমার সঙ্গে অঞ্জনের পরিচয় করিয়ে দিই। অঞ্জন, পলাশ চট্টোপাধ্যায়, আমার এক নিকট বন্ধুপুত্র। তোমার মতোই ভাল ছেলে। তবে তুমি বর্ন অ্যান্ড ব্ৰট আপ ইন বিলেত, তোমার ‘শিন অ্যান্ড লাসচার’ এই দিশি বস্তুটির চেয়ে অনেক বেশি।

পঙ্কজবাবুর ভায়রা বললেন, ও দেশে মানুষের ভেতর থেকে ঠিক মানুষটিকে বের করে আনার কতরকম ব্যবস্থা। এ দেশের মতো ও দেশে গাধা পিটে ঘোড়া বানাবার চেষ্টা হয় না। গাধাকে দেওয়া হয় গাধার ট্রেনিং, ঘোড়াকে দেওয়া হয় ঘোড়ার ট্রেনিং। সাধে ওরা অত বড় হয়েছে।

অঞ্জন সোফা ছেড়ে উঠে এসে, আমার দু’হাত ধরে করমর্দন করলেন। হাতের পাঞ্জায় বেশ জোর। উঠে দাঁড়াতে হয়েছিল, আবার যে যার আসনে বসে পড়লুম। সারাদিন এইভাবেই বসে বসে কাটাতে হবে নাকি? সে তো হবে মহা শাস্তি।

অঞ্জনের দিকে তাকালেই সে মৃদু হাসছে। একটা কিছু বলতে হয়, কিন্তু হীনম্মন্যতা গলা চেপে ধরছে। নিজেকে ভীষণ ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে। বোকার মতো বসে থাকা যায় না, তাই বললুম, আপনি কী করেন?

আমি রোলস রয়েস ফ্যাক্টরিতে অ্যারোনটিক্সের ট্রেনিং নিচ্ছি।

পঙ্কজবাবু বললেন, যাকে বলে অ্যাভিয়েশন টেকনোলজি। দারুণ লাইন। তোমার আর ক’বছর বাকি আছে?

এক বছর।

তারপর কী করবে?

তারপর হল্যান্ডে যাব হায়ার ট্রেনিং-এ ফ্রানসেও একবার যেতে হবে।

ব্রাইট ফিউচার, ব্রাইট প্রসপেক্ট।

অঞ্জনের বাবা বসে বসে পাইপ খাচ্ছেন। বিদেশি টোব্যাকোর গন্ধ বাতাসে ভাসছে। কী সুন্দর এঁদের জীবন! বড় হতে হতে কত বড় হয়ে যাবেন। তুলনায় সত্যি আমি এক পিগমি। কী দেহে, কী মেধায়, আমার কোনও বিকাশই হল না। এ পরিবারে আমার কোনও স্থান হওয়া উচিত নয়। এঁদের এত বড় বড় আত্মীয়স্বজন! গর্ব না থাকলেও ধনী। আমাকে উপেক্ষার চোখে দেখলে কিছু বলার নেই। যেমন করেই হোক সরে পড়তে হবে।

অপর্ণার মা এসে আমাদের দু’জনকে ডাকলেন, তোমরা ভেতরে এসো বাবা। একটু মেলামেশা করো। সবই যে কেমন ঝিমিয়ে পড়ছে!

অঞ্জন জুতোর ফিতে খোলার জন্যে নিচু হচ্ছিল, অপর্ণার মা বারণ করলেন, থাক থাক, তুমি জুতো পরেই এসো, পরেই এসো। সায়েব মানুষ।

অঞ্জন জুতো খুলেই ফেলল। মোজা পরাই রইল। মাথা তুলে বললে, না না, বাইরের জুতো ভেতরে না ঢোকানোই উচিত। আমার কোনও অসুবিধে হবে না। অঞ্জনের বাবা বললেন, সায়েব তখন যখন বিলেতে। এখন বাঙালি।

সেই বারান্দা পেরিয়ে, উঠোন পেরিয়ে, চওড়া সিঁড়ি বেয়ে আমরা দোতলায় উঠে এলুম। ঢাকা বারান্দায় জাফরির ফাঁকে ফাঁকে রোদ এসে পড়েছে। চারদিক মন্দিরের মতো পরিচ্ছন্ন সুন্দর। কোথা থেকে মৃদু ধূপের গন্ধ আসছে।

যে-ঘরে আমরা এলুম, সে ঘর আগে দেখিনি। মেঝেতে সুন্দর একটা কার্পেট পাতা। ঘরটা বেশ বড়। গোটা তিনেক ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে। সুন্দর সুন্দর আলমারিতে রাশিরাশি বই। একপাশে একটা ঝকঝকে রিডিং টেবল। গোটা দুয়েক সোফা। ঘরে আর কিছু নেই।

সেই ঘরের মধ্যে আমাদের দুজনকে ছেড়ে দিয়ে অপর্ণার মা বললেন, নাও তোমাদের মনের খোরাক রয়েছে। বসে বসে বইয়ের পাতা ওলটাও। আমরা আসব যাব। আজ আর বসে গল্প করার সময় নেই। ইচ্ছে হলে, তোমরা ঘুরেও বেড়াতে পারো। ছাদেও যেতে পারো। বাগানেও নামতে পারো। ওই যে রেডিয়ো, গান শুনতে পারো।

অঞ্জন বললে, ঠিক আছে মাসিমা। আপনার কোনও দুশ্চিন্তা নেই।

অঞ্জন আমার চেয়ে হাজার গুণ স্মার্ট। চালচলনে কোনও জড়তা নেই। আমার যেন সবসময় পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। লাজুকলতা লজ্জাবতী। অঞ্জনকে আদৌ দাম্ভিক অহংকারী বলে মনে হচ্ছে না আর। অপর্ণার পাশে প্রথম দেখাটা ছিল হিংসের দেখা। কুৎসিত দৃষ্টিতে দেখেছিলুম বলেই কুৎসিত লেগেছিল। আমার চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ।

অঞ্জন সারাঘরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে বললে, মেসোমশাইয়ের বেশ টেস্ট আছে দেখেছেন! সাধারণ বাঙালির মতো নয়।

সবই হল পয়সার ব্যাপার।

পয়সায় হয় না জানেন। কালচার একটা বড় জিনিস। এখনকার ইনডাস্ট্রিয়ালিস্টদের অনেকেই। বেশ বড়লোক, ক’জনের রুচি আছে! কাল বাবার সঙ্গে বেলেঘাটায় এক ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়েছিলুম। কী ব্যাড টেস্ট। ইউ কান্ট ইম্যাজিন। গায়ে এমন পারফিউম ঢেলেছেন পাশে বসা যায় না। বিদেশি জিনিস। হলে কী হবে, কোনটা ছেলেদের পারফিউম, কোনটা মেয়েদের সে জ্ঞান নেই, সেনস অফ প্রোপোরশন নেই। এমন কাপড়ের সুট বানিয়েছেন, যা আমেরিকান গ্যাংস্টারদেরই মানায়। একটা কুকুর পুষেছেন, যাকে ট্রেনিং দিতে ভুলে গেছেন। সারাবাড়ি অপ্রয়োজনীয় জিনিসে বোঝাই। যেমন লাউড, তেমনি ভালগার।

তা ঠিক। আগেকার জমিদার আর এখনকার নিউ রিচদের মধ্যে অনেক পার্থক্য। তাদের আলাদা একটা মেজাজ ছিল। মন অনেক বড় ছিল।

এই ঘরটাই দেখুন। কত নিট! অন্য কেউ হলে এর মধ্যে রাজ্যের জিনিস ঢুকিয়ে আগলি করে ফেলতেন। আসলে মা আর মাসিমা দুজনেই তো শান্তিনিকেতনের মেয়ে। গুরুদেবের ট্রেনিং-এ রুচিবান।

অপর্ণা একজোড়া চটি এনে অঞ্জনের পায়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে বললে, নিন পরে নিন, মা পাঠিয়ে দিলেন। মোজা ময়লা হয়ে যাবে।

অঞ্জন পা গলাতে গলাতে বললে, মাপে একটু বড়।

বাবার পায়ের মাপ সাধারণের চেয়ে একটু বড়।

অপর্ণা বসল না, চলে গেল। শাড়ি পালটেছে। চুল এলো ছিল, এখন খোঁপা করেছে। আমার দিকে একবার মাত্র তাকিয়েছিল। সে তাকানোয় কোনও প্রাণ ছিল না। ইট কাঠ পাথর পুতুলের দিকে মানুষ অমন দৃষ্টিতে তাকায়।

মন আবার ধোঁয়াটে ঘরের মতো ভারী হয়ে উঠল। আমিও তো খালি পায়ে রয়েছি, চটি এল না কেন? দিশি ছেলে শুধু পায়ে ঘুরতে পারে, বিদেশি ছেলের মোজা ময়লা হয়ে যায়। অদ্ভুত বিচার! আমি রোলস রয়েস থেকে এলে আমারও খাতির হত।

অঞ্জন বললে, আপনি কী করেন?

চাকরি, একটা কেমিকেল ফার্মে কেমিস্ট হিসেবে সবে ঢুকেছি।

ও আপনারও টেকনিক্যাল লাইন? আমি ভেবেছিলুম লিটারেচার।

কেন?

আপনাকে দেখলে তাই মনে হয়, কেমন একটা ড্রিমি পোয়েটিক লুক।

বাংলাদেশের এই বয়েসের সব ছেলেকেই মনে হয় ওইরকম দেখতে।

আপনারা অনেক আরামে থাকেন তো? ওদেশে ভীষণ খাটতে হয়। এতটুকু বসবার কি তাকাবার সময় পাওয়া যায় না। আপনি আমাদের ওখানে চলে আসুন। এ দেশে কোনও কিছুরই তেমন ফিউচার নেই। বাবাকে বললে আপনার আই সি আইতে একটা পোজিশন হয়ে যেতে পারে। বিরাট ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি।

ওঁরা অনেক ভাল ছেলে চাইবেন, অনেক বেশি কোয়ালিফায়েড।

আপনি কি খারাপ ছেলে নাকি! তা ছাড়া এক্সপিরিয়েন্স হয়েছে।

অঞ্জনের মা পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন এই ঘরের আরও তিনটে দরজা। কোনটা দিয়ে কোথায় যাওয়া যায়, না গেলে বোঝা যাবে না। অঞ্জনের মা ঢুকতেই আমি উঠে দাঁড়ালুম।

তিনি বললেন, বোসো বোসো, উঠলে কেন?

আমি প্রণাম করার জন্যে নিচু হতেই, তিনি খপ করে আমার হাত চেপে ধরলেন, না না, পায়ে হাত দিতে হবে না, কেউ আমাকে প্রণাম করলে মনে হয় আমি বুড়ি হয়ে গেছি। তুমি বোসো। আমি বসলে ওই চেয়ারে বসব।

হাত ছেড়ে দিলেন। নিজেকে কেমন যেন বোকাবোকা লাগছে। মহিলার চেহারা প্রবীণা ফিল্মস্টারের মতো। বার্ধক্য আসছে বেশ বোঝা যায় হাতের দিকে তাকালে। চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। অল্প অল্প। তবে চোখদুটো দেখার মতো। টানাটানা বিশাল। অলস চোখ নয়। প্রতিটি কথার সঙ্গে চোখ হেলছে, দুলছে, ছোট হচ্ছে, বড় হচ্ছে। একই সঙ্গে দু’ধরনের ভাষায় তিনি কথা বলছেন। ভদ্রমহিলা নিশ্চয় নাচ জানেন। যারা নৃত্যশিল্পী একমাত্র তারাই চোখে কথা বলতে পারেন। সারা শরীরের বাঁধুনি দেখে মনে হচ্ছে নাচার অভ্যাস এখনও আছে। হাতের আঙুল মুদ্রা খেলছে।

আমি আমার জায়গায় বসে পড়লুম। অঞ্জন বললে, মা, মাসিমাকে তুমি বলে দিয়েছ তো আমরা ঝালমশলা এসব একেবারে সহ্য করতে পারি না?

ও জানে। নতুন করে বলার দরকার হবে না। তুই একবার ভেতরে আয় না! দরকার আছে।

ও তোমাদের মেয়েমহল আমার ভাল লাগে না মা। বেশ তো এখানে বসে আছি দু’জনে।

আয় না একবার। চলে আসবি এখুনি।

অঞ্জন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, একটু বসুন, শুনে আসি কী বলছেন। মায়ের দিকে তাকিয়ে বললে, মা, আমি কিন্তু আগে থেকেই তোমাকে বলে রাখছি, ম্যাজিক আমি দেখাতে পারব না। আমার মুড নেই।

ম্যাজিক তোকে দেখাতে হবে না।

দু’জনেই দ্বিতীয় দরজা দিয়ে ভেতরে কোথাও চলে গেলেন। পাশাপাশি দু’জনকে মা আর ছেলে বলে মনেই হয় না। যেন অন্য কোনও জুটি। ম্যাজিক আবার কী? অঞ্জন ম্যাজিক দেখাতে পারে নাকি! গুণের ঘাট নেই। আবার এক ধাক্কা! এক পাল্লায় আমি, আর এক পাল্লায় অঞ্জন। অঞ্জনের দিকটা ভারে ভূমি স্পর্শ করবে।

আচ্ছা, আমাকেও তো ভেতরে যেতে বলতে পারত। অপর্ণাও তো একবার আসতে পারত। মানুষকে যত দেখা যায় তত চেনা যায় নিত্য নতুন রূপে। এই বোকার মতো বসে না থেকে, আমার কিছু একটা করা উচিত। বেশ বুঝতে পেরেছি, আমার স্ট্যাটাসে যদি কেউ মিলতে পারে সে হল মায়া। সে হল ওই কাকিমার মতো কোনও মহিলা। অ্যারিস্টোক্র্যাট আমার ধাতে সইবে না। এইরকম জড়পিণ্ড করে চেয়ারে বসিয়ে রেখে দেবে। এখন আমার মনে হচ্ছে, সমস্ত ব্যাপারটাই খাড়া হয়েছে আমার পিতৃদেবের অনুরোধে। এঁরা ভদ্র। কোনও এক দূর অতীতে বন্ধুকে কথা দিয়েছিলেন, তোর ছেলে আর আমার মেয়ে। তখন জানতেন না ছেলে কী আকার আকৃতি নেবে, মেয়েই বা কী চেহারা পাবে বড় হয়ে। এখন সাপের ছুঁচো গেলার অবস্থা।

না, এভাবে বসে থাকা যায় না। নিজেকেই নিজের ইডিয়েট বলতে ইচ্ছে করছে। আমি এই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। ঘরের বাইরে যাই। করিডর ধরে ফিরে চলি সিঁড়ির দিকে। ধাপে ধাপে নীচে। উপেক্ষায় শরীর জ্বলছে।

সিঁড়িতে কারুর সঙ্গে দেখা হল না। রোদের রেখা সরে গেছে। নীচের ঘরে টোব্যাকোর গন্ধ ভাসছে। গ্র্যান্ডফাদার চেয়ারের হাতলে সোনার ঠোঁট লাগানো পাইপ কাত হয়ে পড়ে আছে। স্ত্রী-পুরুষ-শিশু সবাই এখন কীসের প্রবল আকর্ষণে অন্দরমহলে। হাওয়াই জাহাজের ইঞ্জিনিয়ার সেখানে হাতের খেলা দেখাচ্ছেন।

ছ’ধাপ সিঁড়ি ভেঙে আরও নীচে। পঙ্কজবাবুর গাড়িটা নেই। তার মানে ভায়রাকে নিয়ে কোথাও বেরিয়েছেন। দু’সার সাবু গাছের ভেতর দিয়ে পথ এগিয়ে গেছে গেটের দিকে। বাইরের পথে দাঁড়িয়ে মুক্তি আমাকে ডাকছে, পালিয়ে আয়। শিকল সোনার হলেও শিকল।

গেট আর প্রায় হাতখানেক দূরে। এখনও কারুর সঙ্গে দেখা হয়নি। ভেতরটা কেমন যেন ধুকপুক করছে। যেন চুরি করে চোর পালাচ্ছে।! আর মাত্র দু’পা।

পলাশদা, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

নিজের হাতফসকে নিজেই পড়ে গেলুম। দূর আকাশের গায়ে, ছাদের আলসেতে অপর্ণা। ভিজে শাড়ি ভাঁজে ভাঁজে খুলে খুলে নেমে আসছে। নীল জমিতে ঝরছে শিউলি।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত