১.৫০ THE ROAD OF EXCESS
The road of excess leads to the Palace of Wisdom.
পিঁক পিঁক করে বারকতক হর্ন বাজল। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হবার শব্দ হল। বাথরুমে চান করতে করতে শুনছি। এই অবেলায় কে আবার এলেন! তিনজন গাড়িধারী আসতেন এ বাড়িতে। প্রতাপ রায়। তার খেলা শেষ। ফুল ঝরে গেছে, ভ্রমর উড়ে গেছে। মাতুল, তাঁর গাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। পড়ে রইলেন পঙ্কজবাবু। মনে হয় তিনিই এসেছেন। পিতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হঠাৎ ভীষণ বেড়ে গেছে। মানুষে মানুষে সম্পর্কে নদীর মতো জোয়ার ভাটা খেলে। দিনকতক খুব আসা-যাওয়া চলে। মাখামাখি, আহার-বিহার, তারপর মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, কারুর সঙ্গে কারুর আর দেখাসাক্ষাৎ নেই।
সিঁড়ি দিয়ে একটা গলা উঠে আসছে, সঙ্গে জুতোর সংগত। পঙ্কজবাবুই এলেন। আজ বেশ একটু একা একা থাকতে ইচ্ছে করছিল। ভেবেছিলুম নিস্তব্ধ দুপুরের নির্জনতায় মুকুর খামটা খুলব। সূর্যের আলোর দিকে তুলে ধরে দেখেছি, ভেতরে একটা আংটি আছে। পাট করা পুরু এক খণ্ড কাগজ আছে। সব ভেস্তে গেল। এইবার শুরু হবে চা আনো, কিছু খাবার ব্যবস্থা করো।
স্নান করে বেরোতেই পিতা বললেন, কী ব্যাপার বলল তো! আজ এতবার চান করছ! ঋতু পরিবর্তনের সময়, অসুখবিসুখে পড়বে নাকি?
ভীষণ গরম লাগছিল, তাই!
তোমাদের সহ্যশক্তি বড় কম।
পঙ্কজবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, কার সহ্যশক্তি?
আজকালকাল ছেলেমেয়েদের।
ও সে আমাদের জন্যেই, আমরাই দায়ী। আমরা সব শিখিয়েছি, সহ্য করতে শেখাইনি। দ্যাট ইজ নট এ পার্ট অফ আওয়ার এডুকেশন।
বাট দ্যাট ইজ অ্যান্ড ওয়াজ এ পার্ট অফ মাই এডুকেশন। আমাদের বাড়িতে তুমি একটা পাখা খুঁজে পাবে না। গরমে গরম সহ্য করো, শীতে শীত। তুমি মানুষ, জীবজগতের জীব, নিজেকে অ্যাডজাস্ট করো ঋতুর সঙ্গে। বাঘ পাখার বাতাস খায়!
তোমার আবার সবকিছু একস্ট্রিম। বাঘ থাকে জঙ্গলে, গাছের ঠান্ডায়, মানুষ থাকে শহরে কংক্রিটের জঙ্গলে। বাতাসের জন্যে একটু বাতাসের প্রয়োজন হতেই পারে। সহ্য জিনিসটা একটু অন্যধরনের।
যেমন?
সহ্য মানে উতলা না হওয়া। সহ্য মানে নেগেশন নয়। সব আসুক। আমার পাত্র কানায় কানায় ভরে উঠুক অমৃতে গরলে, আমি কিন্তু অটল।
রাইট ইউ আর। খুব ভাল বলেছ। আমরা বলি ভাল, করি তার উলটো।
আঃ সে তুমি ঠিক বলেছ। মানুষের আধখানা শয়তানের দখলে, আধখানা দেবতার দখলে। একবার এ চুলের মুঠি ধরে, একবার উনি ধরেন। আর আমরা চিৎকার করে বলি, প্রাণ যায় রে পাঁচু।
দার্শনিক আলোচনা হঠাৎ থামিয়ে পঙ্কজবাবু বললেন, নাও বাবা রেডি হয়ে নাও, রেডি হয়ে নাও, ভীষণ দেরি হয়ে গেছে। দেরি হত না, টায়ার ফেঁসে গিয়ে এমন বিপদে ফেলে দিয়েছিল!
আমি কিছুই না বুঝে, দুই গুরুজনের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। পিতা বললেন, নাও নাও, জামাকাপড় পরে তৈরি হয়ে নাও, উনি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন?
কোথাও যেতে হবে?
হ্যাঁ, তোমাকে নিতে এসেছেন।
পঙ্কজবাবু বললেন, বিলেত থেকে হঠাৎ আমার ভায়রা এসেছে, তারা তোমাকে দেখার জন্যে একেবারে পাগল। কিছুতেই শুনবে না।
আমাকে আর দেখার কী আছে? আমি তো তেমন কেউ নই।
পিতা একটু রুষ্ট হয়ে বললেন, তোমার সব ভাল, তোমার ওই ঠোঁট-ফোলানো অভিমানের কথা শুনলে গা জ্বলে যায়।
পঙ্কজবাবু বললেন, আহা, ওকে তুমি শুধু শুধু বকছ। তোমার রসকষশূন্য জীবন, অত রুক্ষ কি সবাই হতে পারবে! এসব কথা আসে অ্যামবিশন থেকে। আমাকে সবাই দেখুক এই ইচ্ছে পূর্ণ না হলেই অভিমানে মানুষ বলে, আমাকে দেখে কী হবে! বিজ্ঞান নিয়েই জীবন কাটালে, এইবার একটু সাইকোলজি নাড়াচাড়া করো। আমি এখন খুব সাইকোলজি পড়ছি, মেয়ে বড় হয়েছে তো, স্ত্রীর বয়েস হচ্ছে। যাও বাবা, যাও, একটু সাজগোজ করে এসো।
ঘরে এসে জামাকাপড় পালটাতে পালটাতে মেজাজটা ভীষণ খিঁচড়ে গেল। সারারাত জেগে, তালগোল পাকিয়ে শরীরটা তেমন ভাল নেই। চোখদুটো ভেতরে টানছে। জ্বালা করছে। ঘুমঘুম পাচ্ছে। এখন সেজেগুঁজে আদিখ্যেতা করতে যাও! কতরকমের বিপদ যে পৃথিবীতে আছে! নিজেকে নিয়ে মানুষ কতটুকু সময় বাঁচতে পারে। সব সময় দানখয়রাত করে দাও। ইনি আবার সাইকোলজি ধরেছেন, মনের ভেতর শুঁড় চালিয়ে কখন কী টেনে বের করে আনবেন কে জানে! আমার সাইকোলজি এখন খুব একটা সোজা রাস্তায় চলছে না।
গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে পঙ্কজবাবু বললেন, সামনে বোসো, সামনে বোসো। তোমাকে ছোট্ট একটু জ্ঞান দিই। এ গুড পিস অফ অ্যাডভাইস। ডোন্ট মাইন্ড মাই বয়।
আজ্ঞে হ্যাঁ বলুন। কিছু মনে করব না।
সহ্যশক্তি আছে তো!
নিশ্চয় আছে।
ওয়েল। উঠে বোসো, বলছি।
সামনের আসনে বসলুম। পঙ্কজবাবুর আসনের পেছন দিকে একটি তোয়ালে ঝুলছে। তিনি খুব শান্ত মেজাজে, ধীরে সুস্থে স্টিয়ারিং-এ বসলেন। নিচু হয়ে সামনে ঝুঁকে পাশে হেলে পড়ে, গাড়ির কলকবজা দেখলেন, তারপর সোজা হয়ে আমার দিকে তাকালেন। মুখে একঝলক হাসি। এতক্ষণ মাথা নিচু করে ছিলেন। এত ফরসা, শরীরে এত রক্ত, চোখমুখ গোলাপি হয়ে গেছে। হাসির রেখা আরও দীর্ঘ হল। মৃদু স্নেহের গলায় বললেন, ড্রাইভারে যখন গাড়ি চালায়, তখন তুমি সামনে বসো, পিছনে বসো, কিছু এসে যায় না। কিন্তু গাড়ি যখন এমন কেউ চালান, যিনি তোমার আত্মীয়, বন্ধু, কি প্রিয়জন, তখন তোমাকে সামনে চালকের পাশে বসতে হবে। ভদ্রতা। পেছনে বসলে মনে হবে তিনি ড্রাইভার, মনিবকে নিয়ে চলছেন। খুবই তুচ্ছ ব্যাপার। হলে কী হবে! এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেন্টিমেন্ট।
চাবি ঘোরাতেই ইঞ্জিন শব্দ করে উঠল। গাড়ি চলতে শুরু করল। বাতাসে ঘুম এসে যাচ্ছে।
রোদ, ছায়া, লোকজন, কলরব, কোলাহল, সব যেন চলেছে স্বপ্নের ভেতর দিয়ে। শরীরে বেশ একটা আমেজ আসছে। শীতকালে গরমজলে স্নান করলে এইরকমের একটা আরাম হয়।
বুঝলে, গাড়িটাকে এবার সার্ভিসিং-এ পাঠাতে হবে।
জড়িয়ে জড়িয়ে বললুম, আজ্ঞে হ্যাঁ।
তুমি ঘুমোচ্ছ নাকি?
ঘুমঘুম পাচ্ছে।
অত রাত জেগে পড়ার অভ্যাস ছাড়ো। খুব তাড়াতাড়ি হজমশক্তি নষ্ট হয়ে যাবে। ভোরে উঠে পড়বে। ভোরের মতো ভাল সময় আর কিছু নেই। তুমি আবার ভীষণ স্টুডিয়াস।
লাজুক লাজুক ভাবে বললুম, না না।
তোমার বাবার মুখে সব শুনেছি। তুমি একটু ইনট্রোভার্ট, তাই না?
সেরেছে, সদ্য-পড়া সাইকোলজির জ্ঞান তেড়ে আসছে। বললুম, মাঝে মাঝে ইনট্রোভার্ট, মাঝে মাঝে একসট্রোভার্ট।
তার মানে, তোমার সপ্লিট পার্সোনালিটি। দুটো ব্যক্তিত্ব, দুটো চরিত্র। একই শরীরে দু’ধরনের মানুষ। এটা মনে হয় তোমাদের বংশগত বৈশিষ্ট্য। হরিরও দুটো পার্সোনালিটি। কখনও বিমর্ষ, কখনও উচ্ছ্বসিত, কখনও ভীষণ হিসেবি, কখনও ভীষণ বেহিসেবি। আমরা সবাই তাই, বুঝলে! নানারকম বুদ্ধি প্যাক করে ঈশ্বর আমাদের এইখানে পাঠিয়েছেন। যখন যেটা ঠেলে ওঠে, তখন আমরা সেইভাবে কাজ করি। শুনেছি তোমার খুব ধর্মভাব, ভগবৎ বিশ্বাস। খুব ভাল কথা। আজকালকার ছেলেরা সব অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। দেশে যেন একটা মর্যাল ফেমিন এসেছে। তবে কী জানো, ধর্ম মানে কিন্তু সংসার ত্যাগ নয়। আমার মাকে দেখলে তো সেদিন! ওঁর দর্শনটর্শন হয়। ঠাকুর ওঁর সঙ্গে কথা বলেন। কিছু ক্ষমতাও লাভ হয়েছে। মুখ দেখে মানুষের স্বভাব, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব বলতে পারেন। ভালমানুষ খারাপমানুষ চিনতে পারেন। যাকে যা বলেন সব মিলে যায়। সবাই বলেন বাকসিদ্ধা।
গাড়ি চালাতে চালাতে বেশি কথা বলা ঠিক নয়। অন্যমনস্ক হয়ে যেতে হয়। আর একটু হলেই রিকশার পেছনে ভিড়িয়ে দিয়েছিলেন। খ্যাক করে ব্রেক কষে কোনওরকমে দুর্ঘটনা এড়িয়ে গেলেন। এইবার রাস্তার দিকে মন চলে গেছে। কথা বন্ধ। ঘুমঘুম ভাব কেটে গেছে। নানারকম চিন্তা আসছে। নানারকম আশঙ্কা। কেবলই মনে পড়ছে ঠাকুরের সেই গল্প:
এক জেলে রোজই অন্যের পুকুরে মাছ চুরি করতে যায়। চোরকে ধরার জন্যে একদিন সবাই খুব সতর্ক হয়ে রইল। গভীর রাত, জেলে জাল ফেলেছে জলে। ঝপাত করে যেই না শব্দ হওয়া, সবাই তেড়ে এল ধর ধর করে। জেলে দেখলে মহা বিপদ। পালাবার সব পথ বন্ধ। সে তখন ঢুকে পড়ল এক মানকচুর জঙ্গলে। ছাইগাদা। সর্বঅঙ্গে ছাই লেগে গেল। হঠাৎ তার মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল। সারাগায়ে বেশ করে ছাই মেখে সে গিয়ে বসল এক গাছতলায়। চোখ বুজিয়ে ধ্যানস্থ। যারা চোর ধরতে এসেছিল তারা চোর পেল না, পেল ধ্যানমগ্ন এক সাধুকে। খবর ছড়িয়ে পড়ল। সবাই এসে সাধুকে প্রণাম করতে লাগল। ফলমূল মিষ্টি পয়সা প্রণামী পড়তে লাগল। সাধু কিন্তু চোখ খোলে না, কিছু গ্রহণ করে না। এতে সকলের শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। সাধু চোখ বুজিয়ে সেই কপট ধ্যানে ভাবতে লাগল, ছিলুম চোর, সাধুর ভান করাতেই আমার এত খাতির। সত্যি সাধু হলে আমার কী অবস্থা হবে! বলা যায় না ঈশ্বরকেও হয়তো পেয়ে যেতে পারি।
আমি কি সেই চোর! বসে আছি সাধুর আসনে! দুদিন আগে হলে জোরগলায় বলতে পারতুম, না, আমি সাধুই। আজ আর বলার ক্ষমতা নেই। মেফিস্টোফিলিস অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছে। চুরুট আর ওডিকোলোনের গন্ধ। ফাউস্ট এখন ক্রীতদাস। ব্লেক হলে বুক ফুলিয়ে বলতে পারতুম:
The pride of the peacock
is the glory of God
The lust of the goat
is the bounty of God
The wrath of the lion
is the wisdom of God
The nakedness of woman
is the work of God.
The road of excess
leads to the palace of wisdom.
গাড়ি ঢুকল বাড়িতে। সেই রাতের চেয়ে বাড়িটিকে আরও বিশাল মনে হচ্ছে। আরও সুন্দর। আজ মনে হচ্ছে, অনেকের মধ্যে থাকলে মানুষ খুব একটা বেচালে চলতে পারে না। যে ফাঁক গলে শয়তান ঢোকে, সেইসব প্রবেশপথে প্রহরী মোতায়েন হয়ে যায়।
আরে এসো এসো, বলে যিনি আমাকে অভ্যর্থনা করলেন, তিনিই মনে হয় সেই বিলাতবাসী ভদ্রলোক। আমাকে একটু বাজিয়ে দেখতে চান, সুরে বলব না বেসুরো বাজব! কঁচায় পাকায় মেশানো একমাথা চুল। চোখে সোনার ফ্রেমের ধোঁয়াটে চশমা। পরনে বিলিতি সুট। সাদা শার্টে অদ্ভুত সুন্দর ডোরা কাটা। দেখলেই বোঝা যায় এ দেশের জামাকাপড় নয়। কেটেছে সায়েব দরজি।
সেদিন ভাল বুঝতে পারিনি, নীচের দিকে সেভাবে তাকিয়ে দেখা হয়নি, মেঝেটেঝে পুরো মার্বেল পাথরে মোড়া। পা দিতে ভয় করে। ভয়ে জুতোজোড়া খুলে ফেললুম। আমার পায়ের চেয়ে মেঝে অনেক দামি। পঙ্কজবাবুর ভায়রাভাই কিন্তু জুতো পরেই চলাফেরা করছেন। সে জুতোর কী বাহার! বাদামি রং, মুখটা সরু, পালিশ পেয়ে আয়নার মতো ঝকঝক করছে।
স্টেশনের প্রথম শ্রেণির ওয়েটিং রুমে যেরকম হাতলঅলা বড় ডেকচেয়ার থাকে সেইরকম চেয়ারে বিলিতি ভদ্রলোক বসলেন। পায়ের ওপর পা তুলে। ভেবেছিলুম তোলা পা-টা থিরথির করে নাচাতে থাকবেন। ইংলিশ এটিকেট। পা পক্ষাঘাতের পায়ের মতো অনড় রইল। পিতা উপস্থিত থাকলে বলতেন, দেখেছ কী সংযম! দেখে শেখো।
সোনালি প্যাকেট থেকে সাধারণ মাপের চেয়ে বড় একটি সিগারেট বের করে ঠোঁটে চাপতে চাপতে বললেন, তোমার নাম?
পলাশ চট্টোপাধ্যায়।
প্যাট করে লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট ধরালেন। একমুখ ধোয়া রিং রিং করে বাতাসে ছেড়ে দিয়ে বললেন, কী করো!
আজ্ঞে কেমিস্ট।
হাউ নাইস, হাউ নাইস! তোমার সঙ্গে মিলবে ভাল। আমি ডাক্তার, তুমি কেমিস্ট।
পঙ্কজবাবু ভেতরে গিয়েছিলেন, এক হাতে একটা বোতল, আর এক হাতে একটা গেলাস নিয়ে বেরিয়ে এলেন। বোতল আর গেলাস টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, আপনি জল চেয়েছিলেন দাদা?
হ্যাঁ, সে প্রায় এক যুগ আগে।
এই যে, এইমাত্র নিয়ে এল। এ তল্লাটে মিনারেল ওয়াটার কেউ রাখেই না। সেই পার্ক স্ট্রিট থেকে নিয়ে এল।
যাক, পেয়েছে এই যথেষ্ট। এ দেশে এলে, একটাই আমার অসুবিধে, জল। জলাতঙ্ক বলতে পারো।
কই আমাদের তো কিছু হয় না!
হয় না মানে, হয়েই তো আছে। তোমরা গ্রাহ্য করো না।
গেলাসে জল ঢালব দাদা?
থাক, প্রয়োজন হলে আমিই ঢেলে নোব। সিগারেটটা শেষ করে নিই। আচ্ছা, কফির কী হল!
আসছে। তৈরি হচ্ছে। ভেতরে জটলা হচ্ছে। অনেকদিন পরে দুই বোনে দেখা হয়েছে। কলরবলর খুব চলেছে।
শোনো শোনো, বলতে বলতে এক ভদ্রমহিলা ভেতর থেকে বাইরে আসছিলেন, আমাকে দেখেই গম্ভীর হয়ে গেলেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বারকয়েক তাকালেন। বিলেতের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। এঁরা দু’বোনেই অসাধারণ সুন্দরী। বিলেতে থাকার ফলে আরও ফরসা হয়েছেন। ঠান্ডা দেশ গালে আপেলের রং তুলে দিয়েছে। চুলে ববছাট। ঘাড়ের কাছে রেশমের চামরের মতো দুলছে। মেয়েদের বিউটি কেমন বুঝতে শিখেছি। এক রাতেই পেকে ঝানু। হায় হায় সন্ন্যাসার্থ! কী তোমার অধঃপতন! মহিলা কিছু একটা মেখেছেন। বিলিতি সেন্ট। ইংল্যান্ড হল ইয়ার্ডলের জায়গা। তারই সুবাসে ঘর আমোদিত।
মহিলা সংযত গলায় বললেন, অঞ্জু অপর্ণার চেয়ে কত বড় হবে?
তুমি আবার ওইসব মেয়েলি হিসেব নিয়ে এলে! আমার কি আর খেয়াল আছে! কফির কী হল বলো তো!
আসছে আসছে। মিনু বলছে, অঞ্জু অপর্ণার চেয়ে আট বছরের বড়। ইমপসিবল, আমার মনে হচ্ছে, হয় তিন না হয় চার।
তোমার ছেলে, তুমিই ভাল জানবে। হঠাৎ তোমাদের এত হিসেব নিকেশ শুরু হয়ে গেল!
পঙ্কজবাবু বললেন, মেয়েদের নিয়মই ওই, এমন এমন সমস্যা টেনে বের করবে! ডায়েরি রাখার অভ্যাস না থাকলে উত্তর দেওয়া অসম্ভব। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করে, তোমার কত সালে কত তারিখে বিয়ে হয়েছিল, বলতে পারব না।’মাসটা মনে আছে ঋতুর জন্যে। ফাল্গুন মাস, বসন্তের বাতাস, কোকিলের ডাক।
ভায়রাভাই যোগ করলেন, চাঁদের আলো।
চাঁদ? চাঁদ কি ছিল? মনে পড়ছে না।
অপর্ণার মা কফির ট্রে হাতে ঘরে ঢুকলেন। মাথায় অল্প একটু শাড়ির আঁচল টানা। সকালেই স্নান করেছেন। এলো চুল ছড়িয়ে আছে পিঠে। কোথায় নেমেছে! কোমর ছাপিয়ে আরও কত দূরে। এই বয়সেও এত চুল! কেমন করে এমন স্বাস্থ্য সৌন্দর্য বজায় রেখেছেন! আনন্দে থাকলে মানুষ মনে হয় অমর হতে পারে। জীবন থেকে চিমটে দিয়ে একে একে অশান্তির কাটা তুলে তুলে ফেলে দাও, মৃত্যু চিন্তা, অর্থ চিন্তা, স্বার্থ চিন্তা, পারস্পরিক সম্পর্ককে মখমলের মতো মসৃণ করে দাও, জীবনের দৈর্ঘ্য, যৌবনের দৈর্ঘ্য অনেক বেড়ে যাবে। এ পরিবারে সেটা সম্ভব হয়েছে। সব পরিবারে তা তো আর হয় না। নরম আঁচে, মুখ চাপা হাড়িতে, আঙুল মাপ জলে, জীবনের বিরিয়ানি গুমসোচ্ছে। জাফরান, জায়ফল, গরমমশলা, আবার এক ফোঁটা আতর। খুব সুতার; কিন্তু খাদ্য।
অপর্ণার মা বললেন, তুমি লক্ষ্মীছেলে হয়ে এখানে বসে আছ! বড় লাজুক ছেলে।
কফির পেয়ালা চামচে সমেত তুলে নিতে নিতে ডাক্তারবাবু বললেন, লাজুক হলে কী হবে, ভীষণ বুদ্ধিমান। আমি এতক্ষণ বসে বসে ওর ওপর নজর রেখেছিলুম, হি ইজ ওয়েল কম্পোজড, বয়েসের তুলনায় অনেক বেশি ম্যাচিয়োর্ড। সামহাও হি ইজ ভেরি ডিস্টার্বড, ডিপ্রেস্ট, সাইকোলজিক্যালি শে।
পঙ্কজবাবু বললেন, কী করে বুঝলেন দাদা?
বুঝব না? লাস্ট টোয়েন্টি ইয়ার্স আমি যে ওই করছি। অবজার্ভ এ পেশেন্ট, সাজেস্ট এ রেমিডি। হি হ্যাঁজ এ ক্লোজড টাইপ অফ পার্সোন্যালিটি। ওর বাইরে যতটা আছে তার চেয়ে দশগুণ আছে। ভেতরে। ফ্লোটিং লাইক অ্যান আইসবার্জ।
কাপেতে চামচেতে টিং করে একটা শব্দ হল। বাইরের সিঁড়িতে দ্রুত পদশব্দ। একজোড়া নারীপুরুষের কলকণ্ঠ। দ্বারপথে সেই যুবক। বুকের কাছে একটি ফুলের তোড়া, পাশেই গায়ে গা ঘেঁষে অপর্ণা। কী বিচিত্র চিত্র।