লোটাকম্বল: ১.৪৮ I MAY LOAD AND UNLOAD

লোটাকম্বল: ১.৪৮ I MAY LOAD AND UNLOAD

১.৪৮ I MAY LOAD AND UNLOAD

I may load and unload
Again and again
Till I fill the whole shed,
And what have I then.

মুকুর খামটা আর খোলার অবসর পাচ্ছি না। একটু নির্জনতা চাই। সে তো মধ্যরাতের আগে আসবে না। দুপুরের দিকে একটু অবসর মিলতে পারে। মাতুলের বাড়িতে যে-নেপালি যুবকটি কাজ করে, সেই বাহাদুর এসেছে একটি চিঠি নিয়ে।

স্নেহভাজনেষু, অদ্যই এই শহরে আমার শেষ রজনী। কাল আমি লোটাকম্বল নিয়ে সরে পড়ছি। ভেবো না যেন আমি পরাজিত। একে তুমি বলতে পারো সাময়িক বাধা, এ টেম্পোরারি সেট ব্যাক। যাবার আগে তোমার সঙ্গে একটু কাব্য করে যাই। রবার্ট ফ্রস্ট পড়ছিলুম, কাল রাতে। তোমার প্রিয় গায়ক ধনঞ্জয়বাবুর সেই গানের লাইন ভাসছিল মনে, কাল সারারাত চোখে ঘুম ছিল না। ছিল না চোখে। আমার ছবিতে উনি যে দুটি গান করেছেন অনবদ্য হয়েছে। রেকর্ড কোম্পানি মাসখানেকের মধ্যেই ডিস্ক বাজারে ছাড়বেন, পারলে শুনে নিয়ে। একটি গান আছে দরবারিতে। আমার বিশ্বাস, ওই গান বহুকাল বাংলার আকাশে বাতাসে ঘুরবে। বড় বেদনার গান।

কাল রাতে প্রথম টের পেলুম প্রবাসী হবার কী বেদনা! মানুষ দীর্ঘকাল যেখানে বসবাস করে, গাছের মতো সেখানে তার শিকড় নেমে যায়। গৃহীমানুষ আর যাযাবর মানুষে এই তফাত। জিপসি হলে এইসব ছোটখাটো বন্ধন আমাকে আর এভাবে পীড়া দিতে পারত না। এই সাজানো সংসার। ওরা সব ঘুমিয়ে পড়েছিল, আর আমি এক যক্ষের মতো এ ঘর থেকে ও ঘর, ও ঘর থেকে সে ঘরে দুঃস্বপ্নের মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম। কেবলই মনে হচ্ছিল, প্রদীপের তেল ফুরিয়ে আসছে, এখুনি নিবে যাবে, যতটা পারি, যতক্ষণ পারি দেখে নিই। একটা জিনিস বড় বেদনার হে, মানুষ চলে যাবার পরও এই পৃথিবী থাকবে। গাছপালা, চাঁদ তারা সব থাকবে, সুর থাকবে সংগীত থাকবে। কালকের রাত বড় গোলমেলে ছিল। জানি না বিদায়ের আগের রাত এইরকমই হয় হয়তো! বর্তমান মানুষকে খুব একটা কষ্ট দিতে পারে না, যত কষ্ট দেয় স্মৃতি। তা ধরো বছর তিরিশ ধরে এই জমিতে আমার শিকড় নেমেছে, তাকে উপড়ে ফেলতে একটু কষ্ট হবে না! তুমি কি জীবনকে অত সহজ ভাবো নাকি! বেঁচে থাকার একটা স্পন্দন নেই! মানুষ যেখানে থাকে সেখানে তার সঙ্গে আরও অনেক কিছু থাকে, দৃশ্য অদৃশ্য। দেহের যেমন ছায়া আছে, মনেরও তেমনি ছায়া আছে। শুধু মাটিতে নয়, মানুষ বেঁচে থাকে আকাশে বাতাসে মাটির গভীরে। চারপাশে বলয়ের মতো অদৃশ্য একটা ব্যাপার তৈরি হয়ে যায়। মাকড়সার জালের মতো অদৃশ্য জাল তৈরি হয়। সেই জাল ছিঁড়ে আমাকে বেরোতে হবে। মনের অবস্থাটা তা হলে একবার বোঝে। তুমি হলে কেঁদে ফেলতে। বসার ঘরের সোফাটোফা সব বিক্রি হয়ে গেছে, কাল সকালেই ক্রেতা এসে ঘর খালি করে সব নিয়ে যাবে। আমার সেই চাকা লাগানো সাধের রুপোলি খাট, যেটা আমাকে এক মহারাজা প্রেজেন্ট করেছিলেন, সেটাকেও বেচে দিলুম। অনেক পাওনাদার বাজারে, বুঝলে! এ ছাড়া অন্য আর কোনও রাস্তা চোখে পড়ছে না। সঙ্গে রইল আমার সাধের তম্বুরা আর স্কেল চেঞ্জ হারমোনিয়ম। এ জিনিস সহজে পাওয়া যাবে না। এক গাদা ভাল ভাল ফুলগাছের টব আছে। তোমার যদি নেবার ইচ্ছে থাকে জানাও। বাহাদুরকে দিয়ে ঠেলায় চাপিয়ে পাঠিয়ে দোব। সাত-আট রকমের গোলাপ আছে। ফুল ফুটলে তবু আমার কথা মনে পড়বে। ছেড়ে চলে যেতে মন কি চায়! কী করব বলো? সাধারণ চাকরি আমি করতে পারব না, অসম্ভব। কলকাতার সংগীত জগতে বড় দলাদলি। এখানে থাকলে, দেহ আর মন দুটোতেই শুকিয়ে মরতে হবে। যাই কিছুদিন ঘুরে আসি।

হ্যাঁ যে কারণে চিঠি, এক, আজ সন্ধেবেলা ইনস্টিট্যুটে গুরুজি সংগীত পরিবেশন করবেন। সঙ্গে আমিও আছি। পারলে তোমরা এসো। ধরে নিতে পারো, কলকাতার আসরে এই আমার সোয়ান সং। দুই, তোমার পিতৃদেবকে জিজ্ঞেস করো, বাহাদুর ছেলেটি বড় ভাল, ভীষণ কাজের, তোমাদের সংসারে ওর একটু স্থান হতে পারে কি? সঙ্গে নিয়ে যাবার ইচ্ছে ছিল। যদি না পারি তোমরা ওকে রাখবে কি?

যদি গান শুনতে আসো, গেটে আমার নাম করলেই হবে।

মন ভীষণ খারাপ, সাংঘাতিক আবেগ আসছে। এ আমার জয় না পরাজয়? শোনো তো রবার্ট ফ্রস্ট কী বলছেন:

The tree the tempest with a crash of wood
Throws down in front of us is not to bar
Our passage to our journey’s end for good
But just to ask us who we think we are.

চলি রে। ইতি তোর মামা ।।

চিঠিটা পিতার হাতে তুলে দিলুম। পড়তে পড়তে ক্রমশই তার মুখের ভাব গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হল। চিঠিটা টেবিলের ওপর চশমা চাপা দিয়ে রেখে বাহাদুরের দিকে তাকালেন, তোমার বাবু এখন কী করছেন?

গান করছেন।

পিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, আমাকে বললেন, গেট রেডি।

আপনি কি এখন ও বাড়িতে যাবেন?

অফকোর্স! একটা সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, শেষ চেষ্টা একবার করে দেখা যাক। তোমার কাকিমা নিশ্চয়ই বাড়িটা একটু আগলাতে পারবেন?

কাকিমার নাম শুনে বুক হঁত করে উঠল। কণ্ঠতালু শুকিয়ে এল। লোহা তপ্ত হয়েছিল, ভোরবেলায় জলে ডুবিয়ে এনেছি। গুরুজনের মুখের দিকে সোজা তাকাতে পারছি না। ভুলতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। আদৌ ভোলা যাবে কি? চরিত্রের স্ফটিক গোলক হাত ফসকে পড়ে গেছে। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। যা ঘটে গেছে, তা আর কেউ জানে না, জানে রাত আর জানে দুটি মাত্র প্রাণী। রাতের স্রোতে ভাসতে ভাসতে ঘটনা চলে যাবে দূর থেকে দূরে, অতীত থেকে অতীতে। ঘটনা কোথায় চলে যায়! মানুষের ক্রিয়াকাণ্ড কি সময়ের নদীর কোনওখানে গিয়ে পলির মতো সঞ্চিত হয়? চর জেগে থাকে? যেখানে মানুষ আবার কোনওদিন ফিরে গিয়ে খুঁজে খুঁজে দেখতে পারে, জীবনের পর জীবন ধরে সে কী করেছে! সুকর্ম কুকর্মের নুড়ি নুড়ি সঞ্চয়। জানা নেই আমার প্রারব্ধ কী, আর আরব্ধ কী?

পিতা বললেন, কী হল, মনে হচ্ছে তুমি যেন ঘোরে আছ? তোমার গালটা অমন করে আঁচড়ে দিলে কে? বাড়িতে তো বেড়াল নেই!

মিথ্যে যেন জিভের ডগায় ছত্রীসেনার মতো প্রস্তুত ছিল। তড়াক করে লাফিয়ে পড়ল, আজ্ঞে, সকালে গঙ্গার স্নানে গিয়েছিলুম, মাছে কাটা মেরে দিয়েছে।

সে কী? ওষুধ লাগিয়েছ?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

এক মিথ্যে আর এক মিথ্যেকে টেনে আনে। নিজের সাহসে নিজেই অবাক।

তুমি তা হলে কাকিমাকে বলে এসো, আমি ততক্ষণ কাপড়জামা পরে নিই।

নীচে নামতে পা কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল অপরাধী যেন অপরাধের জায়গায় ফিরে চলেছে। গিয়ে দেখব ক্ষতবিক্ষত পড়ে আছে পবিত্রতা। আবার ভালও লাগছে। কারা যেন জিভে সাপের ছোবলের নেশা করে! বারেবারে ফিরে ফিরে যায়। শরীর ভেঙে যায়, মৃতমাছের মতো চোখের দৃষ্টি হয়, গাল ভেঙে যায়, তবু যায়। বিষের এতই মাদকতা। গালিবের মতো বলতে ইচ্ছে করছে:

পিনহাঁ থা দাম সখৎ করিব আশিয়াঁ কে,
উড়নে নহ্ পায়ে থে কেহ্ গিরিফতার হম হুয়ে ॥

পাখি ফাঁদ পাতা ছিল বাসার খুব কাছে। ধরা পড়ে গেলে উড়তে-না-উড়তেই ॥

নীচের দৃশ্যটি ভারী চমৎকার। তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সিঁথিতে সিঁদুর পরছেন। আঙুল দিয়ে একবার করে লাগাচ্ছেন। মাথার পেছনের চুলে আঙুল মুছে আবার সিঁদুর তুলে আবার পরছেন। দরজার আড়াল থেকে আমি দেখছি আর ভাবছি, ভাগ্যের এ কী পরিহাস! কিছু বলতে পারছি না, ছুটে গিয়ে হাত চেপে ধরতে পারছি না। বেদান্তবাদী বলতেন, কী মায়া! যা নেই তা আছে। মনে করে কী বিভ্রান্তি।

ঘাড় ঘুরিয়ে কাকিমা বললেন, থাক আর চুরি করে দেখতে হবে না, ঘরে এসো দুষ্টু ছেলে।

কথা শুনে অপরাধবোধ অনেক কমে গেল। এ জগতের বিশেষ কিছুই তো জানি না! কীসে কী হয়! কার মনে কী থাকে! মহিলাকে এই মুহূর্তে ভীষণ তাজা দেখাচ্ছে। বহুদিন আগে এক ফসলের বাগানে শীতের ভোরে বাঁধাকপি দেখেছিলুম। পাতার ফাঁকে কপির ঠাস মুখটি উঁকি দিচ্ছে। সুন্দরী মহিলার নাকের ডগার ঘামের মতো ফুটে আছে সারারাতের শিশির। সেদিন সেই দেখেছিলুম, আজ দেখছি কাকিমার মুখ। সারা পৃথিবীটা ঈশ্বরের কী সুন্দর সৃষ্টি! কোথা থেকে একটু দুঃখ এসে সব মাটি করে দিয়ে যায়।

সিঁথিতে সিঁদুরের শেষ টান মেরে, মাথার পেছনে আঙুল মুছলেন। কৌটোর ঢাকা বন্ধ করে আয়নার সামনে রাখলেন। এ ঘরে বাতাস তো তেমন আসে না। শরীরের কয়েকটি জায়গা এরই মধ্যে অল্প অল্প ঘেমে উঠেছে। এক রাশ ভিজে কালো চুল পিঠ ছেয়ে পড়ে আছে। আজ যেন পটে আঁকা ছবির মতো দেখাচ্ছে। না কি আমার মনের ভুল! ভাল লাগার দৃষ্টিতে দেখছি বলেই কি ভাল লাগছে? যেমন পরকলা পরে পৃথিবীকে দেখবে পৃথিবী ঠিক তেমন দেখাবে। মায়ের স্নেহের দৃষ্টিতে যেমন সব সন্তানই সুন্দর!

কাকিমা ধীরে ধীরে আমার সামনে এগিয়ে এলেন, কাছে, খুব কাছে। বললেন, তুমি কী! তোমার কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই!

ভীষণ ভয় পেয়ে গেলুম। কী বলতে চাইছেন? এমন কিছু, যা শোনার জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলুম না। কাকিমা আঁচলের গেরো খুলে, দলা পাকানো একটা সুতোর তাল বের করলেন। সুতোর দলা কপালে ঠেকিয়ে আমার সামনে ধরলেন।

ছি ছি, তোমার পইতে খুলে পড়ে গেছে খেয়াল নেই। আর একটু হলেই আমার পায়ে ঠেকে যেত। আজকালকার ছেলে তো, কোনও কিছু মানামানি নেই। নাও এখুনি পরে নাও।

অবাক হয়ে যাবার মতো ঘটনা। গলা থেকে পইতে খুলে পড়ে গেছে টের পাইনি। উন্মত্ততার শেষ সীমায় পৌঁছেলে মানুষের এইরকমই হয়। শুনেছি হাঙরে জলের তলায় পা কেটে নিয়ে গেলে মানুষ তখনই টের পায় না। পইতেটা নিয়ে বললুম, এটা আর পরা যাবে না। গঙ্গায় বিসর্জন দিতে হবে। নতুন পইতে চাই।

ব্রাহ্মণ মানুষ, গলা খালি রেখো না। নতুন পইতে আছে তো?

তা আছে। তৈরি করে পরে নোব। আমি আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি। আমরা একবার মামার বাড়ি যাচ্ছি। ওপর খোলা থাকছে।

থাক না। আমি তো এখুনি রান্না চাপাব। কী হবে, কিছু বলেছেন?

না, আপনার যা খুশি।

ওপরে আসতেই পিতা বললেন, তুমি এই বাক্সটা সাবধানে ধরো, বেশি ভারী নয়। আচ্ছা, এখন কি রিকশা পাওয়া যাবে?

কেন যাবে না। ওই তো মোড়ে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে।

তা হলে চলল। দেরি করে লাভ নেই।

রিকশা চলেছে প্যাকোর প্যাকোর করে। রাস্তায় নোক থইথই করছে। নিজেকে কেমন যেন বিবাহিত বিবাহিত লাগছে। কেমন যেন পাকাঁপাকা। পিতার গায়ে গা লেগে গেলে মনে হচ্ছে, একটা মন্দির অপবিত্র করে দিলুম। আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন পুরুষ এই মুহূর্তে আমার মুখের দিকে তাকালেই বলে দিতে পারতেন, এই ছোকরাটি কুমারত্ব হারিয়েছে। আমি সব দেখছি; কিন্তু কেমন ফেন নেশায় বুঁদ হয়ে। সাপের ছোবল খেয়েছি আমার পরিষ্কার জিভে।

বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মাতুলের গাড়ি। গাড়িতে স্টার্ট রয়েছে। ইঞ্জিন আদুরে বেড়ালের মতো ঘড়ঘড় করছে। স্টিয়ারিং-এ বসে আছেন চোখা এক ভদ্রলোক। গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে মাতুল সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছেন। আমরা রিকশা থেকে নামতে নানামতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। রাস্তার একপাশে মাতুল এমন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন যেন তার মেয়েকে নিয়ে জামাই চলে গেল। গাড়িটার সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। মানুষ কত কষ্ট করে একটা কিছু গড়ে তোলে, সেই গড়া জিনিস ভেঙে গেলে মন তো খারাপ হবেই। আমারই হচ্ছে।

পিতৃদেব এগিয়ে গিয়ে মাতুলের কাঁধে হাত রাখলেন, মন খারাপ কোরো না জয়। এর চেয়ে ভাল গাড়ি তোমার হবে।

মাতুল দুঃখের হাসি হেসে বললেন, যাহা যায়, তাহা যায়। চলুন, ভেতরে চলুন। আমার কী সৌভাগ্য!

সিঁড়ির একেবারে ওপরের ধাপে একটি সাদা লোমওলা কুকুর দাঁড়িয়ে আছে। তার যেন সবেতেই মহানন্দ। আমাদের দেখে ধেই ধেই নাচ শুরু হল। আমরা বসার ঘরে এসে যে-সোফাগুলো একটু পরেই বিক্রি হয়ে যাবে তারই একটায় বসলুম। কিছু দূরে মেঝেতে গালচে পাতা, শোয়ানো রয়েছে বিশাল একটি তম্বুরা। বসে আছে সেই হারমোনিয়ম। রুপোর পাত আর মাদার অফ পার্লসের কাজ করা।

মাতুল বললেন, বসুন, আমি একটু চায়ের কথা বলে আসি।

শুধু চা, সঙ্গে আর কিছু নয় কিন্তু!

কেন আর কিছু নয় কেন?

আমরা মুখ তুলে দরজার দিকে তাকালুম। মাতামহ এসে দাঁড়িয়েছেন। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। সাদা একটি পইতে প্রশস্ত বক্ষদেশের এ কোণ থেকে ও কোণে চলে গেছে। পায়ে খড়ম। খুটুর খুটুর আওয়াজ হচ্ছে। কপালে বেশ বড় মাপের একটি লাল চন্দন-টিপ।

পিতা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, আসুন, আসুন, এতক্ষণ ছিলেন কোথায়? এতদিন ছিলেন কোথায়?

মাতামহ চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঘরে এলেন, খড়াস করে খড়মের শব্দ হল। মাতামহ বললেন, একটু ভাঙাগড়ার মধ্যে রয়েছি হরিশঙ্কর। অনেক কিছু ভাঙতে হচ্ছে, অনেক কিছু গড়তে হচ্ছে। তোমাকে একটা কথা বলি।

মাতামহ সামনের সোফায় বসলেন, মাতুল বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। কুকুর চলল পেছনে পেছনে।

মাতামহ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, বুঝলে, অত সহজ নয়। অনেক সময় লাগে। সবসময় সময়েও হয় না। আলাদা একটা মন চাই।

কীসের কথা বলছেন বলুন তো!

ছাড়ব বললেই সব ছাড়া যায় না। হাসিহাসি মুখে ভাঙা যায় না। বড় কষ্ট হয় বুঝলে, সবচেয়ে কষ্ট দেয় স্মৃতি। এই ঘরটা তোমার মনে পড়ে হরিশঙ্কর!

আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব পড়ে।

মনে পড়ে, ওই গালচেটা এখন যে জায়গায় পাতা আছে, ঠিক ওই জায়গায়!

আজ্ঞে হ্যাঁ ওই জায়গায়, ওই কোণটায় আমি বসেছিলুম।

আচ্ছা বলো তো, কত বছর, কত বছর পেছোলে আবার সেই রাত ফিরে আসবে? সেই সানাইয়ের সুর, সেই ফুলের গন্ধ। সময়ের চেয়ে মানুষের আর বড় শত্রু কে? দেখো না, এই দশ মিনিট আগেও আমার বয়েস দশ মিনিট কম ছিল। জয়ের গাড়িটা ছিল। আমাদের বয়েসে দশ মিনিট যোগ হল, পরমায়ু দশ মিনিট ক্ষয় হল, একটা সম্পদ চলে গেল। সময়কে আর একটু এগোতে দাও, দেখবে এই ঘর খালি, আর একটু এগোতে দাও, সব ভোঁ ভাঁ। শূন্য ঘরে, ঘুলঘুলির চড়াইয়ের ডাক ঝনঝন করছে, যেন শাখার ওপর শাঁখারির আধ-খাওয়া চাঁদের মতো করাত চলছে। এ বড় শক্ত ঠাই হে হরিশঙ্কর। এত দেখেও মনটাকে বাঁধতে পারলুম না!

মাতামহ সোফা ছেড়ে গালচের ওপর স্থান নিলেন। ভীষণ ব্যস্ততায় কাঁধে তুলে নিলেন তম্বুরা, সুর বাঁধাই ছিল, আঙুল ঠেকাতেই বাতাস ভরে গেল। গান ধরলেন:

উঠো গো করুণাময়ী
খোলো গো কুটিরদ্বার
আঁধারে হেরিতে নারি
হৃদি কাঁদে অনিবার ॥

মাতামহ ওস্তাদের মতো হাঁটু মুড়ে বসেছেন। সামনে খাড়া হয়ে আছে তম্বুরা। চোখদুটি মুদিত। মুখ জবাফুলের মতো লাল। চোখের কোল বেয়ে নামছে জলের ধারা। এত সুন্দর গান কদাচিৎ শোনা যায়। এ যেন মাতামহের ‘সোয়ান সং’।

পিতা বললেন, নেমে বোসা, নেমে বোসো।

দু’জনেই নেমে বসলুম। চারপাশ তকতকে পরিষ্কার। মাতুল এ ব্যাপারে একটু শুচিবায়ুগ্রস্ত। যা কাল ছেড়ে যেতে হবে, তাকে আজও সুন্দর করে রেখেছেন। অবহেলায় এলোমেলো নয়। মাতুল এসে আসরে বসেই মাতামহের সঙ্গে হারমোনিয়ম ধরলেন। এ যেন এক মণিকাঞ্চন যোগ। বাইরে প্রথম শরতের রোদ ঝলমল করছে। গোটাকতক হলদে আর সাদা প্রজাপতি খুব নাচানাচি করছে।

পিতা আপন মনেই বললেন, আহা এ লীলা কি ভাঙা যায়!

মাতামহ প্রথম গান শেষ করে, দ্বিতীয় গান ধরলেন,

রাজরাজেশ্বর দেখা দাও।
করুণা-ভিখারি আমি, করুণা-নয়নে চাও।।

পিতা বললেন, আহা সকালেও কাফি কী সুন্দর লাগে!

মাতুল সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন,

চরণে উৎসর্গ দান, করিয়াছি এই প্রাণ,
সংসার-অনলকুণ্ডে ঝলসি গিয়াছে তাও ॥
কলুষ কলঙ্কে ভরা আবরিত এ হৃদয়,
মোহে মুগ্ধ মৃতপ্রায়, হয়ে আছি দয়াময়,
মৃতসঞ্জীবনী দানে শোধন করিয়া লও ।।

একটি সুন্দর ট্রে-তে বেশ দামি কাপডিশ সাজিয়ে মাইমা ঘরে এসেছেন। মাথায় পরিমিত ঘোমটা। গরম শিঙাড়ার গন্ধ ভাসছে। চায়ের পট তোয়ালের জামা পরেছে। বাহাদুর ট্রে-টি মেঝেতে সাবধানে নামিয়ে রাখল। ভোজনরসিক মাতুল আজও আয়োজনের কোনও ত্রুটি রাখেননি। রাতে নিশ্চয়ই লুচিমাংসের ব্যবস্থা হয়েছে। মাতুল প্রায়ই ঠাকুরের একটি কথা বলেন, রাজার ছেলের মাসোহারার অভাব হয় না।

রাজরাজেশ্বর দেখা দাও।

প্রথম চরণটি গেয়ে, গান শেষ হল। তম্বুরা রেখে মাতামহ উঠে দাঁড়ালেন। পিতা বললেন, চললেন কোথায়? বসুন স্থির হয়ে।

আমি, আমি বসব? আমি যে একটা পেঁয়ো লোক, হেটো লোক!

আমিও তো তাই, আমি বসলে আপনিও বসবেন।

মাতুল মাথা নিচু করে আছেন। মাইমা একপাশে জড়োসড়ো। বাহাদুর নিলডাউন। পিতার কথা অমান্য করার সাহস মাতামহের নেই। তিনি বসলেন।

পিতা বললেন, বউমা, দাও, এবার সবাইকে দাও। শিঙাড়া কি তুমি ভাজলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আমাদের সামনে ডিশ ধরে দেবার জন্যে মাইমা যেই হাত বাড়ালেন, তখনই নজরে পড়ল, হাতে শাখা ছাড়া আর কিছু নেই। সব অলংকার ছায়াছবিতে ভোজবাজি হয়ে গেছে।

প্লেটে প্লেটে সকলকে শিঙাড়া এগিয়ে দিয়ে মাইমা উঠে যাচ্ছিলেন, পিতা বললেন, বউমা, বোসো।

তিনি মেঝেতে ভব্য হয়ে বসে আদেশ পালন করলেন। পিতা আমাকে বললেন, দেখি বাক্সটা।

খড়খড়ে কুমিরের চামড়ার সুদৃশ্য বাক্স খুলে তিনি দু’গাছা মোটা মোটা রুলি বের করলেন। সোনার রংটা যেন সকালের প্রথম রোদের মতো। রুলিদুটো মাইমার দিকে এগিয়ে ধরে তিনি বললেন, নাও, পরে নাও। মেয়েদের হাত খালি রাখতে নেই।

মাইমা ভীষণ বিপদে পড়েছেন, একবার মাতুলের মুখের দিকে, একবার মাতামহের মুখের দিকে, একবার পিতার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন আর ঠুটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছেন।

মাতামহ শেষে বললেন, এ কী করছ হরিশঙ্কর, ও যে সোনার, অনেক দাম!

হ্যাঁ, অনেক দাম, তাতে কী হয়েছে? তার চেয়েও দামি আমাদের দিতে পারার মন। লাখোপতি কোটিপতিও দরিদ্র, যদি তার মনটা ক্ষুদ্র হয়।

তুমি এ কী হঠকারিতা করছ হরিশঙ্কর! আমার নাতিটার বিয়ে এসে গেল, এসব তখন তোমার খুব লাগবে।

হ্যাঁ, তা লাগবে, তবে একটা কথা জেনে নিন, ঘুড়ি দু’ভাবে ওড়ে। এক, কেউ ধরাই দিয়ে তুলে দেয়। দুই, নিজেই হেঁচকে হেঁচকে আকাশে ভোলা যায়। নাতি নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নেবে, না পারলে আপনার নাতবউ নিরালংকারাই থাকবে। তা ছাড়া, বউমা যে-ঘর থেকে আসবে, তারা মেয়েকে সাজিয়েই পাঠাবেন।

মাতামহ নীরব। মাইমা মৃদু গলায় মাতুলকে বললেন, তুমি কিছু বলছ না কেন?

মাতুল উদাস মুখে বললেন, এ তো আমারই অক্ষমতা!

পিতা গম্ভীর গলায় বললেন, ভুল কোরো না, আমার উপর কারুর কিছু বলার নেই। বাধ্য মেয়ের মতো নিয়ে আমার সামনেই হাতে পরে ফেলো। অবাধ্যতা আমি ভীষণ অপছন্দ করি।

মাতুল নিজের মনেই বললেন, ছি ছি, এ আমার অক্ষমতা।

পিতা বললেন, অক্ষমতা অক্ষমতা করে পেন্ডুলামের মতো দুলছ কেন? যুদ্ধে হেরে গিয়ে কম্যান্ডার ফিরে এলেও দেশের মানুষ তাঁকে মালা দিয়ে অভ্যর্থনা করে, বলে হিরোইক-ডিফিট। স্পেকুলেশনে হার-জিত থাকবেই। নাও, পরে নাও। নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই।

মাতামহ বললেন, বউমা, পরে ফেলল। জামাইকে আমার চিনি। বাধা পেলেই সে পাহাড়ি নদী।

মাইমা রুলিদুটি মাথায় ঠেকালেন, তারপর মর্যাদা অনুসারে সকলকে একে একে প্রণাম করলেন। দরজার সামনে বাহাদুর। তার মুখে অদ্ভুত এক ধরনের হাসি ফুটে উঠেছে। যেন হিমালয়ে রোদ পড়েছে।

সদর থেকে ধরাধরা গলায় কে ডাক ছাড়লেন, জয়বাবু আছেন, জয়বাবু!

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত