১.৪২ পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
পার করো দয়াল, আমায় কেশে ধরে
পড়েছি এবার আমি ঘোর সাগরে
বাড়ির সামনে গাড়ি থামার শব্দ হল। পরক্ষণেই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। মাতুল আসছেন। একটু যেন ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মুখে সেই মনোরম হাসিটি লেগে নেই। সাজপোশাক অবশ্য রাজপুত্রের মতোই। আছে। শরীর ঘিরে ফুরফুরে সুবাস।
চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, কী খবর তোমাদের?
আজ্ঞে, মোটামুটি ভাল। আপনার খবর?
তোর লজ্জা করে না, এলেই যত খবর নেবার ঘটা। কেন, একবার যেতে পারিস না!
সেই সাতসকালে বেরিয়ে যাই। সারাদিন ল্যাবরেটরিতে বার্নারের সামনে, অ্যাসিড, অ্যালক্যালি ফিউমস। ফিরি যখন শরীরে আর কিছু থাকে না।
বাবা, তুই যে দেখি বুড়োদের মতো কথা বলছিস! পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর চাকরি করবি কী করে? রবিবারেও তো আসতে পারিস।
আপনি থাকেন?
আমি না থাকলে, আর কেউ নেই? তোর দাদুর খবর জানিস?
কী খবর?
তিনি বানপ্রস্থে যাবার জন্যে প্রস্তুত। গেরুয়া ছাপানো হয়ে গেছে। রংটা মনে হয় ভাল ছিল না, তাই। তেমন লাল হয়নি।
হঠাৎ বানপ্রস্থ! রাগারাগি হয়েছে বুঝি!
না, রাগারাগি হবে কেন, বৈরাগ্য এসেছে!
কোন বনে যাবেন? বন আর আছে, তেমন ফলমূলঅলা ভাল বন?
সারাভারতে ওঁর তো একটাই ফেভারিট জায়গা আছে রে, হরিদ্বার। কংখল, হর-কি-প্যারী, লছমনঝুলা, কালী কমলিকা ধরমশালা। বার তিরিশ হরিদ্বার গেছেন আর একবার না হয় যাবেন। পিতৃদেব কোথায়?
বাজারে গেছেন।
এত রাতে বাজারে!
আজ্ঞে রাত সম্পর্কে ওঁর ধারণা অন্য। ওঁর জীবনে রাত নেই। যত রাত বাড়ে, তত কাজ বাড়ে।
একটু চা-টা খাওয়াবি, না, সেসব পাট উঠে গেছে?
না উঠবে কেন? এ তো চায়েরই বাড়ি। টি হাউস।
তা হলে কড়া করে এক কাপ নামা দেখি। হৃদয়ে যেন লাথি মারে।
সে আবার কী?
ও ইংরিজি করে না বললে বোঝা যায় না বুঝি! চায়ে যেন বেশ কিক থাকে। কিকিং টি।
রান্নাঘরে গিয়ে খুটুর খুটুর করছি। মুকু পাশে এসে দাঁড়াল। আজকাল একটু ঘনিষ্ঠ হতে চাইছে। ক’দিন থেকেই লক্ষ করছি, মুকু কী যেন একটা বলতে চায়। গভীর গোপন কোনও কথা। মনে আতঙ্ক পুষে রেখেছি। সরলকেও জটিল মনে হচ্ছে। হয়তো কিছুই বলার নেই। যাবার দিন এগিয়ে আসছে, তাই হয়তো কাছাকাছি এসে, এতদিনের দুর্ব্যবহারের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছে।
চুলে আজ তেল পড়েছে। টানটান খোঁপা। দু’চোখে কি একটু কাজল টেনেছে? মুকুর মেকআপে নিশ্চয়ই আজ কাকিমার হাত গড়েছে। কোথায় তিনি? কয়েকদিনের দুশ্চিন্তায় মুকুর মেদ এখন বেশ
ঝরে গেছে। চেহারায় কনকের আদল এসেছে। কনক এতকাল মেদভারে মুকু হয়ে ছিল।
মুকু বললে, তুমি সরো, আমি চা করে দিচ্ছি। শুধু চা? আর কিছু খাবেন না?
তুমি জিজ্ঞেস করে এসো তো, তা হলে আচ্ছা করে ডবল ডিমের ওমলেট বানিয়ে দিই।
মুকুকে আর যেতে হল না। আমার মামা কি এক জায়গায় চুপ করে গোমড়া মুখে বসে থাকার ছেলে, চুপিচুপি মুকুর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। মুকু টের পায়নি। ইশারায় জানালেন, বোলো না। তারপর মুকুর কানের পেছন দিকে ফুস করে ফুঁ মারলেন।
মুকু চমকে উঠেছে। মাতুলের সে কী হাসি! হোহো, হাহা, হিহি।
লাফাতে গিয়ে মাতুলের পায়ে বোধহয় মুকুর পা ঠেকেছিল। তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে প্রণাম করল। কেউ প্রণাম করলে, কেউ ভক্তি শ্রদ্ধা দেখালে, মাতুল একেবারে মহাদেব। চিবুক ছুঁয়ে বললেন, বেঁচে থাক মা। জীবনে সুখী হ।
শুকনো আশীর্বাদে মাতুল সন্তুষ্ট হবেন। তিনি কি আমার মায়ের তেমন ভাই! বুকপকেট থেকে খুলে নিলেন সোনার পার্কার কলম, এই নাও, পুয়োর ম্যানের পুয়োর প্রেজেন্টেশন। এমনি করেই স্মৃতি ছড়িয়ে যাই।
মুকু কলমটা হাতে নিয়ে ভাবছে, নেওয়া উচিত হবে কি না? কেমন যেন অবাক হয়ে গেছে।
মাতুল গান ধরেছেন,
এই কথাটি মনে রেখো,
তোমাদের এই হাসি খেলায়
আমি যে গান গেয়েছিলাম
জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়
শুকনো ঘাসে শূন্য বনে আপন-মনে
অনাদরে অবহেলায় ॥
মাতুলের গলা সামান্য ধরে এল। তবু গাইলেন, দিনের পথিক মনে রেখো, আমি চলেছিলেম রাতে/সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে হাতে।
পরের লাইন আর উচ্চারণ করতে পারলেন না। ফুঁপিয়ে কান্না বেরিয়ে এল। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ ঢেকে মুখ নিচু করলেন। একটা হাত লম্বা টেবিলে, শরীর হেলে গেছে বাঁ পাশে।
এমন আবেগ আগে কখনও দেখিনি। আজ কী হল! কথা বলতেও সাহস হচ্ছে না। পিতৃদেব পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, হাতে বাজারের ব্যাগ। এত বড় ব্যাগ একমাত্র তিনিই তুলতে পারেন, বইতে পারেন।
ব্যাগটা কোনওমতে মাটিতে নামিয়ে, তিনি বললেন, কী হল জয়?
মাতুল চোখে রুমাল চাপা অবস্থায় মুখ তুলে বললেন, আই অ্যাম এ ব্রোক।
ব্রোক? তার মানে?
আই অ্যাম ফিনিশড্।
ফিনিশড্? তার মানে?
চোখ থেকে রুমাল সরিয়ে বললেন, চলুন, বলছি।
আমরা সেই শোকের মুহূর্তেও নিজেদের কর্তব্য ভুলিনি। সমস্বরে জিজ্ঞেস করলুম, আদা আর পেঁয়াজকুচি দিয়ে ডবল ডিমের ওমলেট চলবে তো মামা! ঘাড় নাড়লেন। তার মানে, হয়ে যাক। বাজার ব্যাগ থেকে লকলকে সবুজ পেঁয়াজকলি বেরিয়ে আছে।
মুকু কলমটা আমার হাতে দিয়ে বললে, কী হবে?
কী আবার হবে! তুমি রেখে দেবে যত্ন করে, দামি জিনিস। মাঝে মাঝে লিখবে।
কোনও কিছু নিতে আমার ভীষণ লজ্জা করে। এটা তুমি নাও। ওনার মন ভাল হলে, পরে বরং ফেরত দিয়ো।
তা কখনও হয়? মামাকে তুমি চেনো না। রাগলে একেবারে অন্য মানুষ। মুকু, কাকিমা কোথায়?
ও, তোমাকে বলা হয়নি, আমাকে বলে গেলেন, মনটা বড় খারাপ, একবার মামাশ্বশুরের ওখান থেকে ঘুরে আসি।
কখন গেছেন?
তা বেশ কিছুক্ষণ হল। পাঁচটা নাগাদ গেছেন।
একা একা চলে গেলেন?
হ্যাঁ, আমাকে বললেন, হাতে নাকি একটাও পয়সা নেই।
পয়সা নেই, তা আমাকে বলতে কী হয়!
তুমি আমার ওপর রাগ করছ কেন? আমি কী জানি বলো?
তোমার ওপর রাগ করিনি। মানুষের জন্যে যতই করো না, পর কখনও আপন হয় না, নেভার!
সে যদি বলল, কাকিমা যেমন তোমার পর, ওদিক থেকে তুমিও তো কাকিমার পর! সম্পর্ক। হাওয়ায় ভেসে আসতে পারে না। সম্পর্ক রক্তের, সম্পর্ক দাবির। এক হয় জন্মসূত্রে, আর এক হয়। আইনের বাঁধনে। তুমি কি একবারও কাকিমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে?
না, তা অবশ্য করিনি। মানে আমার ভাবনায় আসেনি।
তবে! শুধু শুধু অভিমান!
আমাকে আপনার লোক ভাবতে পারলে, নিজেই চাইতেন।
তা হয় না। টাকাপয়সার ব্যাপারটা অত সহজ নয়! অনেকে পাওনা টাকাই মুখ ফুটে চাইতে পারে না। লোককে ধার দিয়ে নিজে উপোস করে মরে।
ঠিক আছে, আজ উনি আসুন। কত বড় কাকিমা হয়েছেন আমিও দেখছি!
মুকু পেঁয়াজ আর আদা কুচোতে বসে গেল। পেছন থেকে দেখলে অবিকল কনক। কোথায় যে গেল মেয়েটা? যদি কোনওদিন দেখা হয়, বাপের নাম ভুলিয়ে দোব! যদি মারা গিয়ে থাকে! কী হবে কনকের কথা ভেবে? চলতে চলতে হঠাৎ দেখা হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া। এ জগতে কে কার?
ওমলেট নিয়ে বসার ঘরে ঢুকতেই শুনলাম, পিতা বলছেন, তোমাকে আমি বারবার বারণ করেছিলুম কি না?
মাতুল বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, করেছিলেন।
শুনেছিলে?
না।
তা হলে এখন ভোগো। তুমি তো জীবনে কারুর কথা শোনো না, জয়। তোমার তালে তাল না দিলে তুমি রেগে অগ্নিশর্মা হও। তুমি যখন কারুর কথা শোনো না, তোমার কথা আমরা শুনব কেন?
আমি এখন তা হলে কী করব?
যেখানে যা যেমন আছে পড়ে থাক, তুমি আবার তোমার জগতে ফিরে যাও। জীবন থেকে এই ক’টা পাতা ছিঁড়ে ফেলে দাও।
আমার এত টাকা ইনভেস্টমেন্ট সব যাবে?
যাবে, কী আর করা যাবে! আবার নতুন করে শুরু করো। Remember the faith that took men from home.
পিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ওমলেট দেখিয়ে বললেন, নাও খেয়ে নাও, তোমাকে আজ বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ইউ আর নট ইয়োর ফর্মার সেলফ।
মাতুল ডিমটা টেনে নিলেন। চামচেটা আর একটু হলেই মেঝেতে পড়ে যেত। পিতা পায়চারি করতে করতে আর একটি লাইন বললেন, At the call of a wandering preacher. ঘরের ও মাথা CRICS sytent orico OICO 70107a, Our age is an age of moderate virtue/And of moder ate vice/When men will not lay down the cross/Because they will never assume it/Yet noth ing is impossible nothing. To men of faith and conviction. Let us therefore make perfect our will/O god, help us.
পিতা মাঝে মাঝে শিশির ভাদুড়ি হয়ে যান। থামতেই জিজ্ঞেস করলুম, চা খাবেন?
নিশ্চয় খাব।
চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, আবার নতুন করে শুরু করো। সংগীতই তোমার জীবন, নট দ্যাট সিনেমা। মাতুল কঁচালঙ্কা চিবিয়েছেন। মুখ বিকৃত করে বললেন, শিগগির এক গেলাস জল।
চায়ে চুমুক দিয়েই মাতুল বাপ বলে উঠলেন। ঝালের মুখে চা, ব্রহ্মরন্ধ্র ছ্যাঁদা করে দেয়।
পিতা বললেন, তোমার খাবার কম্বিনেশনটা তেমন ভাল হল না। ডিমের পরে চা। অ্যান্টি প্রোটিন হয়ে গেল।
ও আমি প্রায়ই খাই। কিছু হবে না।
যখন হবে তখন আর সামলাতে পারবে না, এই সিনেমা করার মতো হবে। আচ্ছা, তোমার তো একটা বাজেট ছিল?
ছিল বই কী?
তা হলে এমন ভাড়ে মা ভবানী হয়ে গেলে কী করে?
এ লাইনে এত জোচ্চোর ঘোরে কে জানত! সেট সাজাবার জন্যে একটা শুকনো গাছের ডাল সাপ্লাই করে, দুশো টাকা বিল করে দিলে। একটা স্টেথিসকোপের ভাড়া তিনশো টাকা। নতুন কিনলে তিরিশ টাকা।
তুমি এসব জানতে না?
কী করে জানব, আমি তো এ লাইনে একেবারে নতুন!
তুমি ঈশপস্ ফেটাও যদি একবার ভাল করে পড়তে, লুক বিফোর ইউ লিপ।
আমার এক লাখ টাকা ভুষ্টিনাশ হয়ে গেল। ছবি হয়েছে ওয়ান ফোর্থ।
এইভাবে ওড়াতে ওড়াতে চললে, কত লাখে গিয়ে শেষ হবে?
তিনের কমে নামবে না।
তুমি ফিরে এসো, জয়। এর চেয়ে তুমি আসামের জঙ্গল থেকে একটা হাতি কিনে পুষলে, অনেক বেশি রোজগার করতে। তোমাকে আমি সম্বলপুরে, আমার বন্ধুর ফরেস্টে পাঠিয়ে দিতুম, সেখানে কাঠ ক্যারি করে তোমার হাতি তোমাকে সারাজীবন খাওয়াত। বউমার গয়না সব গেছে তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ইস, ইস। বাড়ি মর্টগেজ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
বহত আচ্ছা। তুমি তো তা হলে অনেক দূর এগিয়ে গেছ হে!
কোন দিকে?
লোটাকম্বলের দিকে। একতারা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হয়। ভগবানদত্ত গলা, চেহারাটিও রাজপুত্তুরের মতো। নেচে নেচে গাও, নেচে নেচে গাও,
পার করো দয়াল,
আমায় কেশে ধরে।
পড়েছি এবার আমি
ঘোর সাগরে।।
ওমলেট আর চায়ের অ্যাকশন অন্যভাবে শুরু হল। মাতুল বলেন, রাইজ আই মাস্ট। বই আমি শেষ করবই।
তাই যদি করবে, তা হলে আমার কাছে ছুটে এলে কেন?
বড় আপন ভাবি বলে, পিতার চেয়েও আপনজন।
সাঁই করে তির ছেড়েছেন পিতার সেন্টিমেন্টে। পিতার কাছে কেউ সারেন্ডার করলে, তিনি পর্বতের মতো তাকে আগলে রাখবেন।
শেষ করতে গেলে, তোমার দু’লাখ চাই।
দেড়ে আমি ম্যানেজ করব।
দেড় পাবে কোথায়?
মধুপুরের বাগানবাড়িটা বেচে দোব।
অসম্ভব! মধুপুরের বাড়ি বেচবে কী হে! সে বাড়িতে কত স্মৃতি থইথই করছে! ইমপসিবল! বাঙালির এমনই নাম হয়েছে, বাড়ি-বেচা বাঙালি! সারা কলকাতাটা বেচে দিয়ে বসে আছে।
মধুপুরে আমরা বছরে ক’বার যাই! এরপর ওই মালির ফ্যামিলিই বাড়িটা দখল করে নেবে।
তুমি যখন বেচবে ভেবেছ, তখন তুমি থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান যুক্তি খাড়া করবে। আমার মত নেই। আমি কনস্ট্রাকটিভ, ডেস্ট্রাকটিভ নই।
আহা, আপনি একটা জিনিস ভুল করছেন, ছবিটা লেগে গেলে কত লাখ আসবে একবার ভেবে দেখুন। তখন ওই বাহান্ন বিঘের দিকে, আপনার সেই প্রিয় বাগানবাড়িটা এককথায় কেনা যাবে। অনেক বেশি জায়গা, অনেক ভাল এলাকা।
এ বার্ড ইন হ্যান্ড ইজ ওয়ার্থ টেন ইন দি বুশ। গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেলে আমি বিশ্বাসী নই।
এ ছাড়া টাকা তোলার আমার দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই।
টাকা টাকা করছ, মধুপুরের বাগান বেচে তুমি কত পাবে বলে মনে করো! কে কিনবে?
আমার এক অ্যাটর্নি বন্ধু।
অফার কত?
বাড়িটা আগে দেখুক।
তোমার কী মনে হয়?
হাজার চল্লিশ।
অ্যাবসার্ড। ওখানে অত দাম পাবে না। এ কি তোমার কলকাতা।
জমিজায়গার দাম সব জায়গাতেই বাড়ছে।
যতই বাড়ুক, তোমাকে ছাড়তে হলে থ্রো-অ্যাওয়ে প্রাইসেই ছাড়তে হবে। একে বলে ডিস্ট্রেস সেল। ধরলুম তুমি চল্লিশই পেলে, বাকি এক লাখ ষাট? তোমার তো লাখ-লাখের ব্যাপার।
আমাদের বাড়িটাকে সেকেন্ড মর্টগেজ।
বহুত আচ্ছা। শুধু ভোবা নয়, একেবারে ভড়ভড় করে ডোবার ব্যবস্থা! বেশ বেশ তারপর?
তারপর আপনি।
আমি? আমার ঝুলিতে কী আছে জয়! সবই তো ডাক্তার আর পাওনাদারে শেষ করে দিয়েছে। পরপর মৃত্যুর মিছিল চলে গেল জীবনের ওপর দিয়ে।
ক্যাশ না থাক, গোল্ড আছে।
সোনা?
হ্যাঁ সোনা, দিদির কম-সেকম বিশ-পঁচিশ ভরি সোনার গয়না ছিল।
তুমি বলছ কী জয়? ওসব অলংকার, এক একটা মাস্টার পিস। এ যুগে ও সোনাও পাবে না, অমন কারিগরও মিলবে না। সেই জিনিস তুমি ছায়াছবির পেছনে ওড়াবে?
ওড়াব কেন? সব আবার ফিরিয়ে আনব। ছবি রিলিজ হওয়া মানেই টাকা আসতে থাকা। পরপর সাত দিন হাউসফুল হলেই তো হয়ে গেল।
আমি তোমার মতো ওই কাঁচের ফেরিওলার স্বপ্ন দেখতে পারব না, যা এক লাথিতে চুরমার হয়ে যায়। ওসব গয়না আমি আমৃত্যু যক্ষের মতো আগলে রাখব। চাও তো এই বাড়িটা বেচে দিই।
মাতুল মাথা নিচু করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। চারপাশ নিস্তব্ধ। সেই নিস্তব্ধতায় দূর থেকে ভেসে আসছে একটা রিকশার ঘণ্টার শব্দ। টুং টুং করে বাজতে বাজতে এগিয়ে আসছে। মনে হয় কাকিমা আসছেন।
মাতুল মাথা তুলে চারপাশে তাকালেন। বড় অসহায় মুখের ছবি। করুণ কণ্ঠে বললেন, বইটা হাফ কমপ্লিট করতে পারলে ডিস্ট্রিবিউটর ধরে বাকি টাকাটা আদায় করা যেত।
তোমার তো অনেক বড়লোক ছাত্রছাত্রী, তাদের ধরো না জয়।
আপনার লোকই আমাকে ফেলে দিচ্ছেন, তারা তো পর! আচ্ছা, আমি এখন যাই।
মাতুল উঠে দাঁড়ালেন। সেই কেঁচা-লোটানো রাজপুত্তুর। শরীরটাকে টানটান করে বললেন, আপনি কোনও ফাঁইনানসার জোগাড় করে দিতে পারেন? একজন বিজনেস পার্টনার!
আমার পরিচিতরা সবাই স্মলমিসের মধ্যবিত্ত। তারা হাজার হাজার টাকা পাবে কোথায়?
মাতুল বললেন, এই হল বাঙালি। মাড়োয়ারি কি গুজরাতি হলে আমার এসব সমস্যাই হত না। বাঙালি লটারির টাকা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। সিকিউরিটি, সেফটি–এর বাইরে বাঙালির কোনও শব্দ জানা নেই।
ধীরে ধীরে বিয়োগান্ত দৃশ্যের নায়কের মতো মাতুল ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
রাত নামছে, রাত। চারপাশের দোরতাড়া বন্ধের আয়োজন চলেছে। দরজা জানলার সংখ্যা তো কম নয়। নীচের দায়িত্বে কাকিমা, ওপরের দায়িত্বে আমরা। ছাদের সিঁড়ির দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখি, কাকিমা বসে আছে আলসের একপাশে চুপ করে।
মধ্যরাত। চারপাশে হুহু করছে শূন্যতা। দূরে, বহু দূরে কুকুরের পাল রাত কাঁপাচ্ছে। যারা জাগার তারা ঠিক জেগে আছে ঝকঝকে চোখ মেলে, অসীম কৌতূহলে তাকিয়ে আছে পৃথিবীর দিকে। দেশলাইয়ের বাক্সে মানুষের নাচা কাদা-ওঠাবসা। অত উধ্ব থেকে পৃথিবীর বিশাল বিটপীও আগাছার মতো।
কাকিমা খুব শান্তগলায় বললেন, কে, পিন্টু?
আমি যেই হই, আজ আর আমি সাড়া দোব না। আমারও তো অভিমান থাকতে পারে!
***
মেসোমশাই মুকুকে নিয়ে আজ রাতের ট্রেনে চলে যাবেন।
প্রথমে বলেছিলেন প্লেনে যাবেন। কী কারণে হঠাৎ মতের পরিবর্তন হয়েছে। আমার অগোচরে কোথাও একটা কিছু ঘটে গেছে। ঠিক ধরতে পারছি না, তবে অনুমানে নানা সম্ভাবনা ভেসে ভেসে আসছে। কাকিমা মেসোমশাইকে কেন জানি না এড়িয়ে এড়িয়ে চলছেন। কেমন যেন একটা ভয়ভয় ভাব। আর মুকু যেন প্রহরীর মতো বাবাকে চোখে চোখে রেখেছে। গুরুজন। সন্দেহ করা উচিত নয়, কিন্তু বিশ্রী একটা সন্দেহে মন কুঁকড়ে আছে। পৃথিবীর কিছুই দেখিনি, তবু যা দেখেছি, যা শুনেছি তাইতেই চোখ খুলে গেছে। এ বড় বিচিত্র স্থান। এখানে কী যে হয়, আর কী যে হয় না! এখানে জলেও ডিঙি চলে, ড্যাঙাতেও ডিঙি চলে।
এতদিন পরে আমার সেই পুরনো ডায়েরিটা বেরিয়ে পড়েছে। সেই ডায়েরি যেটা কনক লুকিয়ে রেখে আমাকে সেই জবা-পালানো রাতে ভীষণ বাঁচিয়েছিল। যে-ডায়েরির পাতায় মায়াকে নিয়ে ভট্টিকাব্য লিখে নিজের মৃত্যুবাণ নিজেই তৈরি করেছিলুম। ডায়েরি ওলটাচ্ছি, কত কী পাগলামিই যে বেরোচ্ছে। একটা পাতায় কনকের হাতের লেখা স্মৃতি হয়ে রয়ে গেল। আমাকে কেমন লাগে কনক লিখেছে। প্রধানশিক্ষকের ক্যারেক্টার-সার্টিফিকেট যেন! তোমার সবই ভাল, গোটাকতক বস্তু ছাড়া। তোমার ভেতরে একটা অহংকারের ভাব প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। তুমি ধরতে পারো না। তুমি অনেকটা তোমার মামার মতো। নিজেকে কখনই অত শ্রেষ্ঠ ভাবা উচিত নয়। এ ছাড়া, তোমার অভিমান! অত অভিমানী হলে পৃথিবী থেকে সরতে সরতে ক্রমে একঘরে হয়ে যেতে হয়।
কনক প্রচণ্ড জ্ঞানীর মতো কত কীই যে লিখে রেখে গেছে! একটা পাতায় অদ্ভুত একটা গান লিখে। রেখেছি। কোথা থেকে পেয়েছিলুম জানি না। মানুষের কাণ্ডকারখানার সঙ্গে বড় মিলে যায়। উপায় থাকলে মেসোমশাইকে পড়তে দিয়ে, মুকুর মতো তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতুম।
কোন দেশে যাবি মনা চল দেখি যাই
আমি দেখব, কোথায় পির হও তুমি রে,
তীর্থে যাবে সেখানে কি পাপী নাই রে ॥
বিবাদী তোর দেহে সকল,
অহর্নিশি করছে রে গোল
যথা যাবি, তথায় পাগল করবে তোরে ॥
নারী ছেড়ে জঙ্গলে যায়,
স্বপ্নদোষ কি হয় না তথায়,
সাথের বাঘে সবারে খায়,
তখন আর কে ঠেকায় রে ॥
সঙ্গে আছে রিপু ছয় জন,
তারা সদাই করে জ্বালাতন
যথা যাবি তথায় জঞ্জাল ঘটাবে রে ॥
মেসোমশাই মাঝেমধ্যেই বারান্দায় এসে গাছপালা দেখার ছলে নীচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। মুকু এসে বলত, এখানে কেন? এখানে কেন? বাবা, আপনি ভেতরে যান। মেসোমশাই বলতেন, দাঁড়া না, দাঁড়া না, একটু সবুজ দেখি। কাকিমা আড়াল থেকে বারেবারে ওপর দিকে তাকাতেন, আর সরে সরে যেতেন। কাজ থাকলেও কুয়োতলায় আসতেন না।
এসব আমি দূর থেকে দেখতুম। সবাই ভাবত, আমি কিছু বুঝছিনা। সাথের বাঘে সবারে খায়, তখন আর কে ঠেকায় রে। মেসোমশাইকে সামনে রেখে মানুষ সম্পর্কে আমার এই খেয়ালখাতায় আরও দু’চার কথা লিখতে ইচ্ছে করছে। আমার কথা নয়। আমার একজন প্রিয় দার্শনিকের কথা। জীবনের মধ্যভাগে যিনি ঘোর উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। Man is a rope, tied between beast and overman. পশু আর অতিমানব যে-দড়িতে বাঁধা, সেই দড়িটি হল মানুষ। সেই দড়ি চলে গেছে অতি গভীর এক খাদের ওপর দিয়ে। A dangerous across, অতি বিপজ্জনক এক পারাপার। সাংঘাতিক এক চলার পথ। ফিরে তাকালেই বিপদ। দোদুল্যমান এক রঞ্জু। দাঁড়াবারও উপায় নেই। Man is something that shall be overcome. মানুষ এমন এক জীব যাকে পেরিয়ে যেতে হবে। মানুষকে অতিক্রম করতে না পারলে মানুষ হওয়া যাবে না। এ দেশের এক সাঁই লণ্ঠন হাতে মানুষ খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। মানুষ হয়ে মানুষের কী জ্বালা!
মুকুরা চলে যাবে। আর মনে হয় কোনওদিনই দেখাসাক্ষাৎ হবে না। কী করে হবে? বড় দুর সম্পর্কের আত্মীয়। থাকেও বহু দুরে। মুকু খুবই ব্যস্ত। বাঁধাছাদা চলছে। আমার সেইদিনটির কথা মনে পড়ছে, যেদিন তিনজনে হইহই করে এলেন। এসেছিলেন এক মেসোমশাই ফিরে যাচ্ছেন আর এক মেসোমশাই। দিনকতক বাড়িটা বেশ ভরে ছিল। কত কীই যে ঘটে গেল। কাল থেকে আবার সেই শূন্যতা, সেই নির্জনতা। দ্বিপ্রহরের ছায়াঘেরা বাগানে উদাস সুরে ঘুঘু ডাকবে। ফঁকা রান্নাঘরে বেড়াল চেষ্টা করবে দুধের ডেকচির ঢাকা খুলতে। ফোকরে শুরু হবে চড়ুই পাখিদের পারিবারিক কলহ। ঘরের মাঝখানে মুকুদের বাঁধাছাঁদা জিনিস এখন থেকেই, যাই যাই, বিদায় বিদায় করছে। মুকুই সব করছে। মেসোমশাই গম্ভীর মুখে ইজিচেয়ারে বসে কাগজ পড়ছেন, মনোযোগী পরীক্ষার্থীর মতো।
আজ আর বেরোনো হল না। শনিবার অর্ধদিবস অফিস মানে বেলা তিনটের সময় ছুটি। পুরো ছুটিই করে নিলুম। চিরবিদায়ের আগে এই পরিবারের সঙ্গে শেষ সঙ্গ করে নিই। মুকু মাঝে মাঝে আসছে। এটা ওটা জিজ্ঞেস করে চলে যাচ্ছে। নিচু হয়ে সুটকেস গুছোচ্ছে। বেডিং-এর দড়ি ধরে টানছে। মেসোমশাইয়ের দুটি মেয়েই বেশ কাজের। ভদ্রলোক বড় রহস্যময়। দুটি মেয়ে যে আছে, নিজের চোখেই দেখলুম। আর কে আছেন তেমন পরিষ্কার হল না এতদিনেও। কাউকে তো একটা চিঠিও লিখতে দেখলুম না। আর কয়েকদিন থেকে গেলেই পারতেন। মুকুর রেজাল্ট বেরোবার সময় হয়েছে। বলার কিছু নেই। রহস্যময় পুরুষের রহস্যময় আচরণ।
রবিবাবু সেদিন আমার মনে অন্য এক ধরনের অ্যামবিশন জাগিয়ে দিয়েছেন। সেই লিটল ম্যাগাজিনের গল্পটা পড়ে বলেছিলেন, চালিয়ে যাও, তোমার হতে পারে। রবিবাবুকে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছি। এত ধীরে, এত আস্তে কথা বলেন, কানের কাছে মুখ না নিয়ে গেলে শোনাই যায় না। সবসময় হাসিহাসি মুখ। দীর্ঘ, একহারা চেহারা। সাদা ট্রাউজার, জামা ভেতরে খুঁজে পরা। বেশ একটা ইংলিশম্যান ইংলিশম্যান ভাব। কিছু মানুষ আছেন যাঁরা একই তরঙ্গে ভাইব্রেট করেন। সেইসব মানুষের নিজেদের মধ্যে বেশ একটা মিল থাকে। তাদের একই সঙ্গে মন ভাল হয়, মন খারাপ হয়, সর্দি হয়, কাশিতয়, জ্বর হয়, পেট খারাপ হয়। এঁদের বায়োলজিক্যাল ক্লক একই সময় দেয়। রবিবাবু আর আমি মনে হয় একই ভাইব্রেশনের মানুষ। স্বভাবের মিলও যথেষ্ট।
মানুষকে মানুষই এগিয়ে দেয়। মানুষই পেছিয়ে দেয়। কেউ উৎসাহিত করেন, কেউ হতাশা আনেন। কেউ মিইয়ে দেন, কেউ তাজা করে দেন। কেউ বলেন তোমার হবে, কেউ বলেন ব্যর্থ চেষ্টা, তোমার দ্বারা কিছু হবে না বাপু।
রবিবাবুর উৎসাহে একটা গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ কেঁদে ফেলেছি। জীবনে দেখা তো কম হল না! কতরকমের মানুষ। কতরকমের অসুখ! কতরকমের বিচিত্র পরিস্থিতি! জীবনে আনন্দের ভাগের চেয়ে,, দুঃখের ভাগই বেশি। এক পোয়া দুধে তিন পোয়া জল। কে যেন বলেছিলেন, আমাদের সাহিত্যে প্রবন্ধের বড় অভাব হে! গল্প পাবে, টন টন কবিতা পাবে, প্রবন্ধের দিকে কেউ বড় একটা যেতে চায় না। কোথায় রামেন্দ্রসুন্দর! কোথায় জগদীশচন্দ্র, কোথায় জগদিন্দ্র! প্রবন্ধভূমি তৃণহীন। খাঁখাঁ করছে।
পাতা দুয়েক লিখে ফেলেছি। বিষয়বস্তু মানুষ। মানুষের হাতে কম দিন হল মার খেয়ে মরছি! খাবলে খুবলে শেষ করে দিলে। প্রবন্ধটা মনে হয় ভালই জমছে। মানুষের পিন্ডি চটকে ছেড়ে দাও। একবার জন্মে গেলে, মানুষ নিজেকে আর মানুষ বলেই মনে করে না। মানুষ বলে ভাবতেই ভুলে যায়। নিজেকে মনে করে এক সেট অভ্যাস, আহার, নিদ্রা, মৈথুন, জীবিকা, শত্রুতা, পরশ্রীকাতরতা। ইন্দ্রিয়ের টংকারের এমন ঝংকার, অন্য সুর শোনার উপায় নেই।
কমলনেত্র রাম, শিক্ষা শেষ করে কিছুকাল রাজগৃহে অলস সময় কাটাতে কাটাতে বিরক্ত হয়ে পড়লেন। শেষে মনস্থ করলেন, তীর্থ দর্শনে যাবেন। রাজা দশরথ বললেন, অতি উত্তম প্রস্তাব। পড়ে গেল, সাজো সাজো রব। রাজকুমার রাম যাবেন তীর্থপর্যটনে। সঙ্গে চললেন লক্ষ্মণ, শত্রুঘ্ন। পর্যটন শেষ করে রাম যথাসময়ে ফিরে এলেন।
রাম গেলেন এক মানুষ, ফিরে এলেন আর এক মানুষ। মুখে হাসি নেই। আহার বিহার সব ত্যাগ। পদ্মাসনে বসে আছেন সারাদিন। গালে হাত। শরীর কৃশকায়। ক্রমশই রোগা হয়ে যাচ্ছেন। রাজকুমারের এ কী হল? রাজা দশরথ বড়ই চিন্তিত। ডেকে পাঠালেন বশিষ্ঠদেবকে। হেমুনি! আমার পুত্র কেন এমন। খেদান্বিত! দিনদিন কৃশ থেকে কৃশতর হয়ে চলেছে! বশিষ্ঠ বললেন, রাজন! চিন্তিত হবেন না। এ অতি শুভলক্ষণ। রাজকুমারের বৈরাগ্যোদয় হয়েছে।
রামচন্দ্রের যখন এই অবস্থা, তখন রাজসভায় এলেন বিশ্বামিত্র। রাজা দশরথ, তোমার জ্যেষ্ঠপুত্রকে। আমার প্রয়োজন। রাক্ষসের উৎপাতে আশ্রমে টিকতে পারছি না। রাক্ষস-নিধনের প্রয়োজন। রাজা বললেন, রামের অবস্থা অতি শোচনীয়। বিষণ্ণ রামচন্দ্র মুনির সামনে এসে বিরসমুখে দাঁড়ালেন।
রাম বললেন, মুনিশ্রেষ্ঠ, অবয়ববিশিষ্ট এই স্থূল শরীরেই মানুষের আত্মবোধের জন্ম। সংসাররূপ মেঘমালার ক্ষণবিধ্বংসী বিদ্যুতের ন্যায় ক্ষণভঙ্গুর জীবনে আমার শান্তিলাভের আশা নেই। এ জীবন শরতের মেঘ, নিঃশেষিত তৈল প্রদীপ, জলতরঙ্গের মতো চঞ্চল। পত্রের অগ্রভাগে অবস্থিত জলবিন্দুর মতো এই ক্ষণ শরীর যত তাড়াতাড়ি চলে যায় ততই ভাল। দীর্ঘায়ুব্যক্তি বৃদ্ধ গর্দভ। আয়ুতেই আপদ, অশান্তি, আর বৃথা শ্রমের পুঞ্জীভূত জঞ্জাল। কালরূপ মূষিক আয়ু কর্তন করে চলেছে। বায়ুভক্ষক সর্পের মতো কালসর্প আয়ু হরণ করে চলেছে। ব্যাধিঘুণ কুরে কুরে ক্ষয় সাধন করছে। মূষিক-আয়ুর সামনে বসে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মৃত্যু-বিড়াল।
আহা! শ্রীরামচন্দ্রের কী সুন্দর কথা! গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। প্রবন্ধ লেখার এই মজা, র্যানডাম কোটেশন মেরে যাও। এ যেন পড়তে পড়তে লেখা, লিখতে লিখতে পড়া। শ্রীরামচন্দ্রের কী হয়েছিল জানি না, আমি হাতে হাতে ফল পাচ্ছি। উদাসীর একতারা বাজছে মনের কোণে কোণে। পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের এক একটা হিটলারের মতো সায়ানাইড ক্যাপসুল চিবিয়ে, চোখ উলটে উলটে পড়ে যাচ্ছে। যশ-খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা কোন রিপুর এক্তিয়ারে পড়ে জানা নেই। সেইটা এই মুহূর্তে বেশ প্রবল হয়েছে।
দেখি, রামচন্দ্র কী বলছেন? বালক যেমন বল নিয়ে খেলা করে, কালও সেইরকম নভোমণ্ডলে চন্দ্র ও সূর্যকে নিয়ে উদয় অস্তের খেলা খেলছে। কলপান্তে এই প্রাণীমণ্ডলকে সংহার করে, তাদের ভূতপঞ্চকময় অস্থিমাল্য গলায় ধারণ করে, কালপুরুষ মহানন্দে নৃত্য করতে থাকবেন। প্রলয়ের সময় নৃত্যপর এই কালপুরুষের নিশ্বাসে ভূর্জপত্রের মতো সুমেরু পর্বতও উড়ে যাবে। এই কালই ইন্দ্র, কালই রুদ্র, কালই কুবের, অথচ কালের কোনও রূপ নেই।
হে ঋষি! অগণিত ব্রহ্মাণ্ডমালা যেন পতনশীল ডুমুর ফল, অনন্ত প্রাণীমণ্ডল যেন মশা, আর কাল সেই ডুমুরফলপ্রসবকারী বৃক্ষ।
ত্রেতা ছেড়ে কলিতে চলে আসি। আমিই রাম, আমিই বিশ্বামিত্র। নিজেকেই প্রশ্ন করি, নিজেকে নিজে চিনিস? আলোকিত কাঁচের আধারে সাজিয়ে রাখা জিনিসের মতো নিজের ভেতরটা স্পষ্ট দেখতে পাস, ইডিয়েট! প্রকৃতি তোকে নির্বোধ করে রেখেছে। চুষিকাঠি দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছে। অহংয়ের খোলে পুরে ভ্রান্ত জ্ঞানের ছলনায় ভুলিয়ে রেখেছে। নিজের শরীরটাকেই ভাল করে চিনিস না, রাসকেল। অন্ত্রের জটিল মারপ্যাঁচ শিরায় শিরায় রক্তের কুলুকুলু প্রবাহ, টের পাস! স্নায়ু কখন কীভাবে, কেন কেঁপে কেঁপে ওঠে, জানিস কি? এই নে চাবি, জ্ঞান-প্রকোষ্ঠের দরজার ফাঁক দিয়ে একবার তাকিয়ে দেখ নীচের দিকে। আহা, চমকে উঠিস না। কার ওপর দাঁড়িয়ে আছিস! The merciless, the greedy, the insatiable, the murderous. অজ্ঞান উদাসীনতায় ভাসমান স্বপ্নখণ্ড। Hanging in dreams, as it were, upon the back of a tiger. বাঘের পিঠে চেপে স্বপ্ন দেখেছিস!
You that have seen man
As god and sheep.
Tearing to pieces the God in man
No less than the sheep in man
And laughing while tearing
This, this is your bliss
A poet’s and fool’s bliss.
পথে যে কন্টক আছে কী ভাবিলি তার?/কত শুষ্ক জলাশয়, কত মাঠ মরুময়/পর্বত শিখর শায়ী বিস্তৃত তুষার/কত শত বক্ৰগতি নদী খরস্রোত অতি/ঘুরিছে দারুণ বেগে আবর্তের জল/হা দুর্বল তুই তার কী ভাবিলি বল।
চমকে উঠেছি। মুকু পেছন থেকে এসে পিঠে হাত রেখেছে।
কী হল? অমন চমকে উঠলে?
না, অন্য একটা জগতে ছিলুম তো!
কী লিখেছ অত, পাতার পর পাতা?
মানুষ।
তুমি লেখো নাকি?
সম্প্রতি চেষ্টা করছি।
চেপে গেলুম। গর্ব খর্ব করার প্রবন্ধ লিখছি, তা না হলে বলতে পারতুম, আমার একটা গল্প বেরিয়েছে। রবিবাবু বলেছেন, বেশ লিখেছ।
মুকু কাঁধের ওপর দিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়েছে। মেয়েটি হঠাৎ কেন এমন সহজ হয়ে গেল! এই শেষ মুহূর্তে! যাবার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে! মুকুর চিবুক আমার ডান কাঁধের ওপর। ঘাড়ের কাছে দেহের উত্তাপ। শাড়ির আঁচলের হালকা স্পর্শ। আমি যেন মুকুর ভেতরে চলে গেছি!
মুকু বললে, তুমি যে লেখো, আগে জানলে শুনে যেতুম। নিশ্চয়ই ছাপা হবে! কাগজের নামটা জানালে যেখানেই থাকি জোগাড় করে পড়ে নিতুম।
লেখা সহজ, লেখা ছাপানো খুবই কঠিন কাজ। ফিরে আসতে আসতে হঠাৎ একদিন ছাপা হয়। কারুর কারুর ভাগ্যে সারাজীবন শুধুই ফিরে আসা। কেউ কেউ আবার এমন অপয়া, না মরলে লেখা ছাপা হয় না। নিজেই নিজের ব্যাডস্টার। যেই সরল, অমনি হুড়হুড় করে লেখা ছাপা হতে লাগল। যশ, খ্যাতি, এমনকী পসথুমাস অ্যাওয়ার্ড। ফ্রানজ কাকার কী হয়েছিল ভাবো? মেটামরফসিস পড়েছ?
না।
পেলে পড়ে দেখো।
একবার উঠবে?
কেন?
একটু নীচে চলো, কাকিমা ডাকছেন।
ইমপসিবল! আমি যাব না।
যেতে আমার ইচ্ছে করে। এটা একটা ছুতো। কাকিমার সামনে যেতে ভীষণ ভয় করে। একসঙ্গে অনেককথা মনে পড়ে গিয়ে কণ্ঠতালু শুকিয়ে আসে। সামনে আয়না না থাকলেও বেশ বুঝতে পারি, চোখেমুখে কেমন যেন একটা অপরাধীর ভাব ফুটে ওঠে। চোখের সামনে ফিনফিনে পাঞ্জাবি পরা অদ্ভুত চেহারার সেই লোকটিকে দেখতে পাই। বিষ্টুদার কথামতো কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কোনওদিন সম্ভব হবে বলে মনেও হয় না।
মুকু বললে, ছিঃ অভিমান করতে নেই। ভদ্রমহিলা কাল তোমার কথা বলতে বলতে চোখের জল ফেলেছেন। প্লিজ অভিমান কোরো না। আজ আমি চলে যাচ্ছি না? বেশ ভালই জানো, তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।
এককথায় মুকু আমাকে স্তব্ধ করে দিলে। এই যে কিছুকাল মানুষের পাশাপাশি থাকা, আবার চলে যাওয়া, পৃথিবী জুড়ে এই যে বিচ্ছেদের খেলা চলেছে, এই খেলা থেকে নিষ্কৃতি পাবার কোনও উপায় নেই। মুকুর সঙ্গে নীচে নামতেই হল। যাবার বেলায় তার একটা অনুরোধ রাখতেই হয়।
কাকিমা দরজার পাশে ডাকপিয়নের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। যেন রেজিষ্ট্রি চিঠি এনেছেন, সই করিয়ে ডেলিভারি দিয়ে যাবেন।
কাকিমা বললেন, আমি কী করেছি গো, তুমি আমার সঙ্গে হঠাৎ কথা বন্ধ করে দিয়েছ?
মুকু বললে, বাবুর অভিমান হয়েছে। আপনি বাবুকে না বলে মামাশ্বশুরের বাড়িতে কেন গিয়েছিলেন! বাবুর রাগ হয়েছে।
তুমি তো বাড়ি ছিলে না পিন্টু। তোমার কাকাবাবুর কোনও খবর নেই। আমাকে কোথাও তো একটা যেতেই হবে। তোমাদের আর কত কষ্ট দোব বলো! আমার ওপর রাগ কোরো না। এমনিই তো আমি আধমরা হয়ে আছি।
আপনার টাকাপয়সা ফুরিয়ে গেছে, আমাকে বলতে কী হয়েছিল?
আমি তো টাকাপয়সার জন্যে যাইনি, আমি তোমার কাকাবাবুর কথা বলতে গিয়েছিলুম। এতদিন হয়ে গেল, মানুষটা আসছে না কেন! মনে অনবরতই খারাপ চিন্তা আসছে।
মুকু বললে, আমি ডবল দুশ্চিন্তা নিয়ে চলেছি। এক আমার দিদির চিন্তা, দুই আপনার চিন্তা। মনে থাকলে একটা চিঠি দিয়ে জানাবেন।
কাকিমা বললেন, হ্যাঁরে, মেয়েটা আজ চলে যাবে, কিছু ভালমন্দ একটা খাওয়ার ব্যবস্থা কর।
মাংস?
মাছই ভাল, ট্রেনে রাত জাগবে। নিয়ে যাবার জন্যে কিছু জলখাবার করে দিই। লুচি, আলুর ঘি-মরিচ। তুই কিছু ভাল মিষ্টি এনে দে। বটঠাকুর আজ বেরোলেন কেন?
আজ শনিবার, দুটো কি তিনটের মধ্যেই ফিরে আসবেন। বলে গেছেন আসার সময় সন্দেশ আনবেন।
কাকিমা বললেন, আয় ঘরে আয়।
চৌকির ওপর ভাজ করা একটা শাড়ি। আকাশের মতো জমিতে, ছোট ছোট সাদা ফুল ছড়িয়ে আছে। কোনও শিশু যেন প্রকৃতির পায়ে অঞ্জলি দিয়ে গেছে। কাকিমা শাড়িটা মুকুর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, বড় গরিব ভাই। তেমন দামি নয়। ফেলে দিয়ো না, পোরো। মনে রেখো, অনেক দূরে এমন কেউ আছে, যে তোমার কথা ভাবে। কত ইচ্ছে মানুষের! কোনটাই বা পূর্ণ করা যায়। বলো পরবে? দামি নয় বলে টান মেরে ফেলে দেবে না!
কাকিমা মুকুর হাতদুটো চেপে ধরলেন। চোখদুটো ছলছলে হয়ে গেছে। ধরাধরা গলায় মুকু বললে, ভালবাসায় এ কাপড় সোনার চেয়েও দামি, কাকিমা। আপনাকে আমি কোনওদিন ভুলতে পারব না। এই বাড়ির কাউকেই আমি ভুলতে পারব না। আপনারা হয়তো আমাকে ভুলে যাবেন!
আমরা তিনটি প্রাণী পোডড়া বাড়ির সেই অন্ধকার ঘরে, চোখে টলটল জল নিয়ে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলুম।