লোটাকম্বল: ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে

লোটাকম্বল: ১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে

১.৪০ এই মানুষে সেই মানুষ আছে

এই মানুষে সেই মানুষ আছে
কত মুনি ঋষি চার যুগ ধরে বেড়াচ্ছে খুঁজে।

কয়েকদিন ধরে কেবলই মনে হচ্ছে, আমি খুনি। লাশ চাপা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। যে-কোনও মুহূর্তে ধরা পড়ে যেতে পারি। কাকিমাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছি। কাজটা খুব সহজ নয়। কাকিমা আর দুরের মানুষ নন। আমাদের পরিবারেরই একজন। প্রফুল্লকাকার অবর্তমানে এই কাছাকাছি সরে আসা সহজ হয়েছে। পিতাও আর আগের মতো দেখলেই লাফিয়ে ওঠেন না। তফাত যাও ভাবটা সংযত করেছেন। কাকিমা এতদিনে বেশ উতলা হয়ে পড়েছেন। ঘুরতে ফিরতে প্রায়ই জিজ্ঞেস করছেন, কী হল বলো তো! কোনওবার এতদিন তো বাইরে থাকে না। আমার রাতে ভাল করে ঘুম হয় না। দুঃস্বপ্ন দেখি, আর জেগে জেগে উঠি। তুমি একটু খোঁজখবর করো না, পিন্টু। কাকিমাকে এখন আর আমি আপনি বলি না। তুমির সম্পর্কে নেমে এসেছি। কোথায় খোঁজখবর করব, তুমিই বলে দাও। কোথায় গেছেন তুমিই তো জানো না।

ওর যাবার একটা জায়গা আছে। ওই যে সব গাইয়ে মেয়েছেলে আছে না? গাইয়ে মেয়েছেলে অনেক আছে, নাম ঠিকানা না বললে হয়?

তারা সব কলকাতার একটা জায়গায় থাকে। রাতের বেলা সেজেগুঁজে সব বাবুদের গান শোনায়।

তাও জানি। তুমি নাম বলতে পারবে?

না।

তা হলে হয়ে গেল। ওসব জায়গায় ঘরে ঘরে ঘোরার ক্ষমতা কারুর নেই।

কাকিমা উদাস হয়ে কখনও রাস্তার দিকে তাকিয়ে, কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। আর আমার ভেতরটা কেঁপে কেঁপে ওঠে। মনে হয় আমিই যেন জলজ্যান্ত একটা মানুষকে খুন করে চোরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি।

সুবিধে একটাই, খুব সকালে অফিস, একবার বাইরের জগতে বেরিয়ে পড়তে পারলে, আমায় আর পায় কে! মেসোমশাই মোটামুটি সুস্থ। তবে কনক যদি না ফেরে, ভদ্রলোকের হাসিখুশির দিন আর ফিরবে না। মুকুর কপালের ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে। সামান্য একটু সাদা দাগ আছে, পরে মিলিয়ে যাবে। মেসোমশাই ঠিক করেই ফেলেছেন, সামনের শনিবার, সকালের প্লেনে চলে যাবেন। আর এখানে পড়ে থাকার কোনও মানে হয় না।

মানুষের জীবন নদীর মতো হঠাৎ হঠাৎ কীরকম বাঁক নিয়ে ঘুরে যায়! মুকু যেন হঠাৎ কীরকম বদলে গেছে। সেই গুমোরে ভাব আর নেই। সুযোগ পেলেই কথা বলে। সময় সময় জিনিসপত্র এগিয়ে দেয়। এক গেলাস জল। রুমাল। চিরুনি। মাঝে মাঝে নীচে নেমে গিয়ে কাকিমার সঙ্গে গল্প করে আসে। এই পরিবর্তনটা যদি আগেই আসত। মুকু একটু রোগা হয়ে গেছে। চেহারায় কনকের আদল আসছে।

সেদিন সকালে অফিস বেরোবার আগে মুকু বললে, আর তো আমরা মাত্র দু’দিন আছি, তুমি আমাকে দক্ষিণেশ্বরটা একবার দেখিয়ে আনবে? আর কি আসা হবে! হয়তো হবে না। দিদি যেখান থেকে চিরকালের মতো চলে গেল, সেই জায়গাটা শেষবারের মতো একবার দেখে যাই।

আমি নিয়ে যেতে পারি, তোমার বাবা যাবার অনুমতি দেবেন না।

অনুমতি আমি চেয়ে নেব।

মনে হয় পাবে না। যে-জায়গা থেকে একটি মেয়ে চলে গেছে, সেখানে আর একটি মেয়েকে যেতে দেন কখনও!

সে আমি বলে দেখব। কাকিমাকে দিয়ে বলাব। ওঁর কথা বাবা নিশ্চয়ই শুনবেন।

ওঁর কথা শুনবেন কেন?

কী জানি কেন?

তার মানে?

আমার মনে হয় কাকিমার কথা ঠেলতে পারবেন না। অসুখের সময় সেবা করতেন, শাসনও করতেন। সেই থেকে কাকিমার সঙ্গে ওঁর অনেক সুখদুঃখের কথা হয়।

তা হলে তো ভালই, তুমি কাকিমাকে দিয়ে বলাও। বলবে, কাকিমাও আমাদের সঙ্গে যাবেন।

.

অফিসটা আমার বেশ জমে উঠেছে। পরিবেশটা এখন অফিস বলে মনেই হয় না। তেমন কোনও শাসন নেই। কেবল চিফ কেমিস্ট ভদ্রলোক মাঝেমধ্যে একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েন। সে ওই পেটের জন্যে। মুড়ির সঙ্গে ভুঁড়ির ভীষণ যোগ। দু’ফোঁটা হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড জলে গুলে সুধীর যেই খাইয়ে দেয়, অমনি মেজাজ শান্ত। তখন মুখে হাসি ফোটে। রবিবাবুর শিক্ষায় অল্পদিনের মধ্যেই অ্যানালিসিসের হাত বেশ পেকে উঠেছে। ফোঁড়ার মতো আরও কত কী যে পাকে! চুল পাকে, ছেলে পাকে, সম্পর্ক পাকে। ম্যানেজিং ডিরেক্টারের সঙ্গে সম্পর্কও বেশ পেকেছে। অনেকটা ছেলের মতো হয়ে গেছি। আসলে চাওয়া আর পাওয়ার তুচ্ছ জগৎ থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ হতে পারে। একেবারে উনুনে হাঁড়ি চাপিয়ে চাকরিতে না এলে যেটা সম্ভব। বিয়ে করে সংসারে ঢোকা মানেই দাস হয়ে ঘুরে বেড়ানো।

আজ আকাশ একটু মেঘলা মেঘলা। মাঝে মাঝে দমকা বাতাসে গাছপালা পাগলের মতো দুলে দুলে উঠছে। বিকেলের দিকে জোর নামবে মনে হয়। আজ ক্যালকাটা ভেসে যাবে। ময়দানে দুই বড় দলের খেলা আছে। বিকেলে আজ জমবে ভাল।

লেবরেটরিতে ঢুকতেই সুধীরবাবু বললেন, শিগগির যান, এম ডি খুঁজছেন। লেবরেটরিতে যখন কেউ থাকেন না, তখন বেশ দেখায়। রহস্য, রোমাঞ্চ, কল্পনা সব মিলেমিশে জগতের ভেতর একটা জগৎ তৈরি হয়ে যায়। মানুষ যেমন তিনটে! একই মানুষ নানা স্তরে বিভক্ত। এক হল তার হাড়ের খাঁচা, কঙ্কাল। মৃত একটা স্তর। তার ওপর, মেদ মাংসের একটি অবয়ব। ধুধুলের খোসার মতো শিরা উপশিরার জালি। বুকের খাঁচায় দুটো যন্ত্র, হরতনের মতো হৃদয়, বেলুনের মতো ফুসফুস। গর্ভে লিভার, পিলে, অন্ত্র, বৃহদন্ত্র, প্রভৃতি পোঁটলাপুঁটলি। দুপায়ের ফাঁকে মানুষের কদিচ্ছার কোষ। যার সামনে দাঁড়িয়ে আলিবাবা অষ্টপ্রহর হেঁকে চলেছে, চিচিং ফাঁক, ঝিঙে ফাঁক, তাঁড়স ফক, উচ্ছে ফাঁক। এই সজীৰ কম্পন ঘিরে তৈরি হয়ে আছে একটি চেতন আধার, অবয়বহীন একটা ব্যাপার, যেখানে প্রেম আছে, অনুভূতি আছে, কল্পনা আছে, হিংসা আছে। মাতামহ সেই গাইছিলেন একদিন নেচে নেচে,

এই মানুষে সেই মানুষ আছে
কত মুনি ঋষি চারযুগ ধরে বেড়াচ্ছে খুঁজে ॥
জলে যেমন চাঁদ দেখা যায়
ধরতে গেলে হাতে কে পায়,
তেমনি সে থাকে সদায় আলোকে বসে ॥

এম ডি ঘরে পায়চারি করছেন। টেবিলের ওপর একটা নকশা খোলা, পেপার ওয়েট চাপা। দূরে আর একটা টেবিলে রয়েছে একটি মডেল। মনে হয় কোনও কারখানার। আমি যখন ঘরে ঢুকলুম, এম ডি তখন আমার দিকে পেছন ফিরে, জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। জানলার বাইরে একটা কদমফুলের গাছ। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে সাদা সাদা ফুল এসেছে। দুটো হাত পেছন দিকে। মুখ। সামনের দিকে তোলা। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, মেঘলা আকাশের চাপা আলো পড়ে চিকচিক করছে। একমাথা সাদা চুলে তার বৈজ্ঞানিক চেহারাকে বড় স্পষ্ট করে তুলেছে। মাঝে মাঝে এই। মানুষটিকে বড় নিঃসঙ্গ মনে হয়। সব থেকেও যেন কিছু নেই। সবেতে থেকেও যেন সবকিছু থেকে অনুপস্থিত।

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াতেই আমাকে দেখতে পেলেন। এমন একটি হাসি খেলে গেল মুখে, যে-হাসির সঙ্গে একঝাক উড়ন্ত শঙ্খচিলের তুলনা চলে।

খুব কাজের লোক হয়েছ, না?

না, তা নয়।

তা নয় মানে? তিন দিন তুমি আমার সঙ্গে দেখা করোনি।

ওই তিন দিনই অফিসে আসতে আমার একটু দেরি হয়েছিল। সোজা ল্যাবরেটরিতে উঠে গিয়েছিলুম।

এদিকে এসো, এই জানলার কাছে সরে এসো। প্রকৃতির খেলা দেখে যাও।

বিশাল জানলা পা থেকে মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে। কদমগাছের সবুজ পাতা সবুজ আলো ছড়াচ্ছে। এম ডি গাছটা দেখিয়ে বললেন, দেখেছ, সবুজের কী খেলা চলেছে। গাছের ধর্ম দেখো। আমাদের মতোই বয়েস বাড়ে; কিন্তু বৃদ্ধ হতে জানে না। প্রতি বছরই পাতা ঝরিয়ে, আবার নতুন পাতায় সেজে ওঠে। আমরা কেন পারি না পলাশ!

কী জানি? আমরা কেবল বুড়ো হতেই শিখেছি।

দেখেছ, প্রকৃতিতে বার্ধক্য নেই।

সেভাবে দেখলে, মানুষেরও বার্ধক্য নেই, মৃত্যু নেই। ওপর থেকে চলে যাচ্ছে, তলা থেকে ভরে উঠছে।

তা উঠছে। তবে একই মানুষ গাছের মতো বছরে বছরে নবীন হতে শেখেনি।

মানুষের তেমনই অভিজ্ঞতা বাড়ে, জ্ঞান বাড়ে। গাছের মতোই প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন পাতা গজায়।

জ্ঞানপত্র! বলেছ ঠিক, তবে সব মানুষের নয়। এই গাছটাকে আমি কত বছর ধরে দেখছি। এই কারখানার ফিউমসে এতদিনে মরে যাওয়া উচিত ছিল। অসীম জীবনীশক্তি। প্রতি বছরই সবুজ পাতায় সেজে, ফুল ফুটিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ব্যঙ্গ করে, বৃদ্ধ, তুমি আরও বৃদ্ধ হও, আমি সবুজে সবুজ হয়ে তোমার মৃত্যুর পাশে দাঁড়িয়ে জীবনের কথা বলি।

মৃত্যু বলে কিছু আছে কি?

এম ডি গাছের দিক থেকে ঘুরে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।

এ তোমার বইয়ের কথা, না বিশ্বাসের কথা?

বিশ্বাস বলতে পারেন, যে-বিশ্বাসের জন্ম অভিজ্ঞতা থেকে।

অভিজ্ঞতা থেকে?

এম ডি চেয়ারে বসলেন। সোনার চশমা খুলে রাখলেন নকশার ওপর। মুখে একটা রক্তাভ দ্যুতি খেলছে। হঠাৎ মনে পড়ল, মানুষ বৃদ্ধ না হইলে সুন্দর হয় না। ইশারায় বললেন, বোসো।

অভিজ্ঞতা মানে? মৃত্যু নেই এমন অভিজ্ঞতা কী করে হতে পারে? না না, তুমি ঠিক বলছ না। এমন একটা বিশ্বাস কষ্টেসৃষ্টে গড়ে তোলা যায়। অভিজ্ঞতায় আসে কী করে? ৩১৮

অভিজ্ঞতা একটা নিজস্ব ব্যাপার। আপনার জানলার কাছে এই গাছটা আছে, আমাদের জানলার কাছে নেই। টেবিলের তলায় আপনার পায়ের কাছে একটা পাদানি রয়েছে, সকলের পায়ের কাছে নেই।

এর সঙ্গে মৃত্যু নেই, এই অভিজ্ঞতার কী সম্পর্ক?

আছে। আমি যদি বলি, আমাকে ছেড়ে যাঁরা চলে গেছেন, তাঁরা প্রতি মুহূর্তেই আমার সঙ্গে আছেন, জানলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওই কদমগাছের মতো। আপনি বিশ্বাস করবেন না, কারণ আপনাকে দেখানো যাবে না। জাগতিক স্তর থেকে তারা অনুভূতির স্তরে উঠে গেছেন। এ এমন একটা ব্যাপার, যা লেবরেটরিতে ডেমনস্ট্রেট করা যায় না। ঈশ্বরকে যেমন দেখানো যায় না। কোনওদিন বিজ্ঞান হয়তো পারবে।

কী জানি তুমি কী বলতে চাইছ!

তা হলে, আর একভাবে বলি। এই মুহূর্তে এই ঘরে বহু শব্দতরঙ্গ ঘুরে বেড়াচ্ছে। গান, বাজনা, বক্তৃতা। বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন দেশ থেকে ভেসে আসছে। লন্ডন থেকে, রাশিয়া থেকে, চিন থেকে। কোনওটাই আমরা শুনতে পাচ্ছি না। আমাকে একটা ভাল রেডিয়ো দিন। আমি সবকটা ধরে ধরে শুনিয়ে দোব। শব্দের মতো মানুষও এক তরঙ্গ থেকে আর এক তরঙ্গে চলে যেতে পারে। টেলিভিশন বিভিন্ন তরঙ্গের আলো ধরে এ তথ্য প্রমাণ করেছে।

তোমার অভিজ্ঞতা কী করে আমার অভিজ্ঞতা হতে পারে?

বিশ্বাস। বিশ্বাসে অনুভূতি তৈরি হয়, অনুভূতিতে অভিজ্ঞতা আসে। কেউ যদি বলেন, এই ঘরে এখন বেগম আখতার গান গাইছেন, তাতে আমার অনুভূতি তৈরি হবে বিশ্বাসে। হ্যাঁ হয়তো গাইছেন। অনুভূতি তেমন প্রখর হলে শুনতেও পাব। তারপর কেউ হয়তো রেডিয়ো খুলে অভিজ্ঞতার সঙ্গে প্রমাণ মিলিয়ে দেবেন।

নাঃ ব্যাপারটা বড় জটিল হে। আমার জমি এখনও তৈরি হয়নি। এই নিয়ে তোমার সঙ্গে একদিন বসব। এপার তো দেখা হল, ওপারটা একবার দেখতে ইচ্ছে করে। অবশ্য এপার থেকে। ওপারে গেলে তো এপারে ফিরতে পারব না। মাথায় একটা লাইন এসে গেল:

যখন নিঃশব্দে শব্দেরে খাবে
তখন ভবের খেলা ভেঙে যাবে–

কার লেখা?

ঠিক মনে পড়ছে না।

লালন কয়, দেখবি ফিরে কী গতি। লালন ফকিরের লেখা। তুমি এসব পড়ো? না হরিশঙ্কর কেবল অঙ্ক কষায়?

আজ্ঞে ওইটাই আমি ভাল পারি না বলে, জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেল। তা না হলে এতদিনে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে, কোথায় কোন দেশে চলে যেতুম!

তোমার কি মনে হয় জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে?

বাবার তাই ধারণা।

হরির কথা ছেড়ে দাও। ও একটা র্যাংলার। একটা পরীক্ষায় ও অঙ্কে একশোর মধ্যে একশো এক পেয়েছিল।

সে কি সম্ভব?

সম্ভব হয়েছিল। একটা অঙ্ক ভুল ছিল। অঙ্কটাই ভুল। ও সেটা পয়েন্ট আউট করে, অঙ্কটা কী হওয়া উচিত, শুদ্ধ করে, একটা নোট সমেত খাতা জমা দিয়েছিল। হইহই ব্যাপার। পরীক্ষক যে-বই থেকে অঙ্কটা নিয়েছিলেন, সে বই বাতিল হয়ে গেল। হরিশঙ্করের মাথার দাম অন্য দেশ হলে কত হাজার টাকা হত জানো? এ দেশে মুড়ি মিছরির এক দর।

আমার মাথাটা ভগবান কেন যে এমন করে দিলেন!দুই আর দুইয়ে চার ছাড়া কিছুই সহ্য করতে পারে না।

তোমার মাথায় কেমিস্ট্রিটা ভালই খেলে। রবিবাবু বলছিলেন, এই অল্পদিনেই হাত বেশ পেকেছে।

আজ্ঞে, ওতে তো মাথা নেই।

মাথা ছাড়া হাত হয়! সবই মাথার খেলা। আচ্ছা শোনো, আমার একটা পরিকল্পনার কথা তোমাকে বলি। এই হল সেই পরিকল্পনার ব্লু-প্রিন্ট। এপাশে সরে এসো, আমার চেয়ারের পাশে। দেরাদুনে আমরা আর একটা কারখানা করছি। সেখানে তৈরি হবে শুধু ওষুধ। পাশেই হিমালয়, গাছগাছড়ার অভাব হবে না। ক্লাইমেটও খুব সুন্দর। কী, কেমন হবে?

আজ্ঞে, সাংঘাতিক হবে।

এই দেখো মুসৌরি-চক্রাতা রোড। এর পাশে দু’একর জমি। চমৎকার স্পট। ডান পাশে ঘাড় ঘোরালেই মুসৌরি হিলস। ওই হল কারখানার মডেল।

আজ্ঞে হ্যাঁ, ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়েছে।

বুঝলে, একেবারে আধুনিক ডিজাইনের ব্যাপার। বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি এসে, ডকে পড়ে আছে। আমার একটা ভীষণ ইচ্ছে। বলব?

হ্যাঁ, বলুন।

তোমাকে আমি দেরাদুন পাঠাব। কেমন হবে?

আজ্ঞে ভীষণ হবে।

আমি বেছে বেছে এখানকার কয়েকজনকে ওখানে পাঠাব। তার মধ্যে নাম্বার ওয়ান, তুমি। নাম্বার টু, রবিবাবু। নাম্বার থ্রি, জীমূতবাবু। কেমন হবে টিমটা!

খুব ভাল।

আমিও থাকব তোমাদের সঙ্গে। তবে আমাকে তো দুটো দিকই দেখতে হবে। আমি আসা। যাওয়া করব। হ্যাঁ, এই কয়েকদিন আগে হরিশঙ্করকে ফোন করেছিলুম, মাই গুড ওলড ফ্রেন্ড। ওর খুব ইচ্ছে, তাড়াতাড়ি তোমাকে সংসারী করার। পারলে এই ফাল্গুনে। ফাল্গুন ওর প্রিয় মাস। শিল্পী মানুষ তো! বসন্তের দূত। নিজেও বিয়ে করেছিল ফাল্গনে। সেই স্মৃতিটাকেই আবার জাগিয়ে তুলতে চায়। জানো তো, নিজের জীবনের অপূর্ণ আশা আকাঙ্ক্ষা মানুষ সন্তানের জীবনে ফুটিয়ে তুলতে চায়। তুমি ওকে দুঃখ দিয়ো না। অমন নীতিবাদী আদর্শপরায়ণ মানুষ, তুমি আর দুটি পাবে না। একেবারে পারফেক্ট ম্যান। অমন কামনাশুন্য নির্লোভ মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। পঙ্কজকেও আমি চিনি। কলেজে আমরা সব সহপাঠী ছিলুম। দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না। সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।

টেলিফোনটা দু’বার কিড়কিড় করে থেমে গেল। হাত বাড়াতে গিয়ে এম ডি হাত টেনে নিলেন। হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়। পঙ্কজ একটা জেনুইন বনেদি ঘরের ছেলে। ওরা তিনপুরুষে ডাক্তার। পঙ্কজের বাবা ছিলেন নামকরা সার্জেন।

এইবার কড়কড় করে ফোন বেজে উঠল। এম ডি রিসিভার তুললেন।

ও প্রান্তে কে আছেন বোঝা গেল না, তবে এইটুকু বোঝা গেল, তার-পথে উত্তেজক কিছু খবর আসছে। এম ডি বলছেন, না, চোরকে আমি কোনওমতে প্রশ্রয় দিতে পারব না। সে যত বড়লোকই হোক। থানাপুলিশের দরকার নেই। দেনাপাওনা মিটিয়ে বিদায় করে দাও। অমন পণ্ডিতে আমার কাজ নেই। তস্কর পণ্ডিতের চেয়ে মূর্খ সাধু ঢের ভাল। না না, নো মার্সি। নো মার্সি। নো মার্সি। বলো রেজিগনেশন সাবমিট করতে। তা না হলে আমরা পুলিসে কেস হ্যান্ডওভার করব।

রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। মুখের লাল আভা সামান্য বেড়েছিল। দেখতে দেখতে স্বাভাবিক হয়ে এল। নকশাটা কোলের দিকে টেনে নিয়ে বললেন, তোমাকে দেরাদুন পাঠাব ইনচার্জ করে। তোমাকে আমি পারচেজ অফিসার করব। খুবই দায়িত্বপূর্ণ পদ। তোমার বয়েস আর অভিজ্ঞতার তুলনায় বেশি ভারী। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি পেডিগ্রি, বিশ্বাস করি সততায়, সাধনায়, আন্তরিকতায়। তুমি ওই পদের অমর্যাদা করবে না, এ বিশ্বাস আমার আছে।

কিন্তু ওই পদে তো কেমিস্ট্রি নেই!

আছে আছে। পারচেজ ডিপার্টমেন্টের আন্ডারে আলাদা একটা লেবরেটরি থাকবে। প্রতিটি জিনিস কেনার আগে অ্যানালিসিস করতে হবে। স্পেসিফিকেশন ঠিক থাকলে, তবেই তুমি কিনবে। পঙ্কজের মেয়েকে তুমি বিয়ে করবে, তোমার পজিশন সেইভাবে বাড়িয়ে দিতে না পারলে, সমানে সমান হবে কী করে? ফাঁইভ ডেজ এ উইক। উইকএন্ডে দু’জনে বেড়াতে চলে যাবে মুসৌরি। তোমাদের দু’জনের সুখের জীবন আমার চোখের সামনে ভাসছে। বিদায় নেবার সময় এসে গেছে বাবা। মানুষ কেন আসে জানো? যে আগে আসে, সে বন কেটে বসত বসায়, ফল ফুলের গাছ তৈরি করে। দিঘি কাটায়। রাস্তা তৈরি করে। সে জানে, পেছনে আসছে তার উত্তরপুরুষেরা। পূর্বপুরুষ যদি তার কর্তব্য পালন না করে, উত্তরপুরুষ কেন তাকে মনে রাখবে? তুমি বলছিলে না, মৃত্যু বলে কিছু নেই। সত্যিই নেই। আমি যখন নেই, তুমি তখন আছ। আমার মৃত্যু আছে। মানুষের মৃত্যু নেই। তোমাদের বিবাহে এই আমার যৌতুক। যাও, তোমার অনেকটা সময় আমি নিয়ে নিলুম। বুড়ো হচ্ছি, কথা বলতে বড় ভাল লাগে। একটা কথা, আমার এই পরিকল্পনার কথা তুমি কাউকে বলবে না।

দরজার কাছে চলে এসেছি, এম ডি ডাকলেন, হ্যাঁ শোনো। তুমি প্রবীর বলে কাউকে চেনো? আর্টিস্ট।

আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার মামার বন্ধু।

ওঁর বোন খুব ভাল গান করেন, ভক্তিমতী মহিলা?

আজ্ঞে হ্যাঁ। তাকেও আমি চিনি।

হ্যাঁ, ওঁরা তোমার খুব প্রশংসা করছিলেন। প্রবীরবাবুকে আমি আমাদের পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্টে চাকরি দিচ্ছি। আর ওঁর বোন ঊষাকে দিচ্ছি, আমাদের সেই অরফানেজের। কেমন হবে?

উঃ সাংঘাতিক হবে। এর চেয়ে ভাল কিছু ভাবা যায় না।

তুমি আজ যাবে আমার সঙ্গে, সেই অনাথ আশ্রমে?

আজ্ঞে হ্যাঁ। কেন যাব না!

তা হলে তোমাকে আমি ঠিক সময়ে ডেকে পাঠাব।

লেবরেটরিতে চা-পর্ব চলেছে। জীমূতবাবু শিকারের গল্প বলছেন। সবাই চোখ বড় বড় করে শুনছেন। জীবনের প্রথম শিকার। চিফ কেমিস্ট দূরের একটা টেবিলে বার্নারে কী একটা চাপিয়েছেন। বিকারে সেই নীলমত পদার্থটির মেজাজ তেমন শান্ত নয়। কাঁচের রড দিয়ে চমকে দিলেই ফাস ফোঁস করে উঠছে।

জীমূতবাবুর বাবা ছিলেন ফরেস্ট অফিসার। উত্তর ভারতের জঙ্গলে গিয়েছিলেন বাঘ শিকারে। মাচা বেঁধে পিতাপুত্রে বসেছেন। নীচে খোঁটায় বাঁধা কিল মাঝে মাঝে ব্ল্যা ব্ল্যা করে ডাক ছাড়ছে। চাঁদের আলোর রাত। যথাসময়ে বাঘ এলেন।

এই পর্যন্ত বলে জীমূতবাবু গেলাসে বেশ লম্বা একটি চুমুক মারলেন। সবাই একসঙ্গে ‘তারপর? তারপর?’ করে উঠলেন।

তারপর বাঘ এসে, আমাদের দিকে মুখ করে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল, ছাগলটা ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। তারপর আমারও আর মনে নেই।

আমরা একসঙ্গে প্রশ্ন করলুম, মনে নেই কেন? এমন একটা ঘটনা ভুলে গেলেন?

ভুলে যাব কেন? আমি অজ্ঞান হয়ে গেলুম। যখন জ্ঞান হল, তখন শেষরাত। চাঁদ ঢলে পড়েছে। পশ্চিমে গাছের আড়ালে। ছাগলটা অজ্ঞান অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।

আর বাঘটা?

বাঘ ফিরে গেছে জঙ্গলে। বাঘ এসেছিল ভরাপেটে। ছাগল স্পর্শ করেনি। আর চাঁদের আলোয় বাঘের ওই সৌন্দর্য দেখে, বাবা আর গুলি করতে পারেননি। সামনাসামনি বাঘ দেখলে মনুষ্যজন্মে ঘেন্না ধরে যাবে। এই হল আমার প্রথম ব্যাঘ্র দর্শন।

জীমূতবাবু উঁচু টুল ছেড়ে উঠে পড়লেন। মনে হল, দেরাদুনে আমাদের জমবে ভাল। একটু এগোলেই জিম করবেটের কুমায়ুন। সঙ্গে থাকবেন রবিবাবু।

রবিবাবু ব্যাগ থেকে পাতলা একটা ম্যগাজিন বের করে আনলেন। পাতা উলটে আমার চোখের সামনে ধরে বললেন, তোমার লেখা?

আশ্চর্য! আমারই তো লেখা! অনেক দিন আগে পাঠিয়েছিলুম। একটা ছোট গল্প। আমার কাছে। এখনও কপি আসেনি। আমারই নাম, বড় বড় হরফে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত এক অনুভূতি।

আমার পিঠে হাত রেখে, কানের কাছে মুখ এনে রবিবাবু ফিসফিস করে বললেন, বেশ লিখেছ। ছেড়ো না, চালিয়ে যাও। ওপাশে বুম করে একটা শব্দ হল। চিফ কেমিস্ট ভয়ে পিছু হটতে শুরু করেছেন। বিকারের সেই নীল পদার্থ উষ্ণ পীতাভ রং ধারণ করে ফুটতে শুরু করেছে।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত