১.৩৮ মরণ মরিতে চায়
মরণ মরিতে চায়, মরিছে না তবু
চিরদিন মৃত্যুরূপে রয়েছে বাঁচিয়া।
এই বাড়ির কোথাও একটা গ্র্যান্ডফাদার ঘড়ি আছে। সময় চলে যাবার সময় বড় সুন্দর শব্দ করে যায়। রাত নটা বাজল। গ্রীষ্মকাল। শীতকাল হলে চারপাশ নিশুতি হয়ে যেত। সরোজবাবু বললেন, এ নিয়ে খুব একটা পরামর্শের দরকার আছে কি! ভদ্রলোক আপনাদের কীরকম আত্মীয়!
আমি বললুম, আমার বাবার বন্ধু। খুব ভাল, মনে হয় নামকরা তবলচি। বাড়ির নীচেটা খালি পড়ে ছিল বলে, উনি যেখানে থাকতেন সেখান থেকে উঠে এসেছিলেন।
আত্মীয়স্বজন কে কে আছেন?
মনে হয় কেউ নেই। স্বামী-স্ত্রীর সংসার। একজন মামা বোধহয় আছেন।
ব্যস, তা হলে তো কোনও সমস্যাই নেই। মামাকে খবর দিলেই হয়ে যাবে। তিনি এসে লাশ নিয়ে যান। আমি পুলিশকে বলে দিচ্ছি, যেন হ্যারাস না করে।
অক্ষয়বাবু বললেন, খুব ভাল বলেছ। এর চেয়ে ভাল কিছু ভাবা যায় না।
পঙ্কজবাবু বললেন, দি ওয়ে।
অপর্ণা এসে বাবার কানে কানে কী যেন “লল। পঙ্কজবাবু বললেন, ও হ্যাঁ, নিশ্চয় নিশ্চয়। উঠে দাঁড়ালেন। অক্ষয় কাকাবাবু বললেন, কোথায় চললেন?
একবার অন্দরমহল থেকে ঘুরে আসি, ক পড়েছে। তোমার জন্যে একটা ধুতি নিয়ে আসি।
না না, পঙ্কজদা, ধুতির দরকার হবে না। এই বেশ আছি। আপনি তো আমাকে চেনেন। বউদি চা আনলে কুকুরের আঁচড় মাচড় একটু ওয়াশ করে দোব।
চা দিয়ে কেন? আমি অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে ড্রেস করিয়ে দিচ্ছি। আমার ছোটভাই রাখাল এইসব। ব্যাপারে ভীষণ এক্সপার্ট।
কথা বলতে বলতে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। কাঁধে হাত রেখে বললেন, চলো, ভেতর থেকে ঘুরে আসি। ভেতরে যেতে হবে শুনেই, নিজের আকার আকৃতি সাজপোশাক সম্পর্কে মনে মনে ভীষণ সচেতন হয়ে পড়লুম। মনের অদৃশ্য আয়নায় বারেবারে ভেসে উঠতে লাগল আমার অবিন্যস্ত চেহারা।
ঢাকা একটা বারান্দা এপাশ থেকে ওপাশ চলে গেছে। সুন্দর করে বাঁধানো একটা উঠোন। পাশে পাশে পাতাবাহার গাছের অপূর্ব শোভা। একপাশ দিয়ে একটা নারকেল গাছ সোজা আকাশের দিকে উঠে গেছে। চারপাশ তকতকে পরিষ্কার। পরিবেশটা এতই সুন্দর, দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়। দূরে বাঁ পাশ দিয়ে চওড়া একটা সিঁড়ি ধাপে ধাপে উঠে গেছে কোনও স্বপ্নলোকের দিকে। পঙ্কজবাবু আমাকে বলতে লাগলেন, এসো বাবা এসো। চলে এসো, লজ্জা কীসের? এ তো তোমারই বাড়ি। উঠোনের শেষ প্রান্তে রান্নাঘর। রান্নার ঘঁাকছেক, টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসছে। দোতলার ছাদে কুকুর ডাকছে গম্ভীর গলায়।
পঙ্কজবাবু হাঁকলেন, কই গো, কোথায় গেলে তোমরা!
স্বাস্থ্যবান একটি ছেলে, হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে, পাশের একটা ঘর থেকে হাতের গুলি ঘোরাতে ঘোরাতে বেরিয়ে এল। পঙ্কজবাবু বললেন, এই যে, জনি উইসমুলার, তোমার বডি বিলডিং ওয়ার্কশপ এত রাতেও খোলা?
ছেলেটি হাসতে হাসতে বললে, জেঠু, কাল আমরা রাঁচি যাচ্ছি।
হঠাৎ এইসময় রাঁচি?
কলেজ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। সাত দিনের ক্যাম্প। তোমার জন্যে কিছু আনতে হবে?
রাঁচির পেঁপে খুব ভাল। পারিস তো কিছু বীজ নিয়ে আসিস।
তোমার কিটব্যাগটা কিন্তু নিয়ে যাব। জ্যাঠাইমাকে বলেছি।
ওটাতে বোধহয় একটা তাপ্পি লাগাতে হবে।
সে আমি ঠিকঠাক করে নোব।
দু’জনের কথার ফাঁকে ঘরটা দেখে নিলুম। মেঝেতে বারবেল, ডাম্বেল গড়াগড়ি যাচ্ছে। দেয়ালে ব্যায়ামবীরদের বিভিন্ন ভঙ্গির ছবি।
পঙ্কজবাবু বললেন, আমার বন্ধু অক্ষয়কে কুকুরে আঁচড়েছে, তুই একটু ড্রেস করে দিয়ে আসতে পারবি?
খুব পারব।
পঙ্কজবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এসো, সব ওপরে আছে মনে হচ্ছে। দোতলাটা একতলার চেয়ে আরও সুন্দর। জাফরি বসানো ঢাকা বারান্দা। ঝকঝকে মেঝেতে আলো ঠিকরোচ্ছে। জায়গায় জায়গায় জোড়া জোড়া সোফা পাতা। যুঁই ঝাড় জানলার বাইরে ফুলে ফুলে সাদা, বাতাসে দুলছে। মোড়ায় সৌম্যচেহারার এক বৃদ্ধা বসে আছেন। যার সবকিছুই শুভ্র। কেশ, অঙ্গবাস, দেহত্বক, এমনকী পায়ের চটি। পায়ের কাছে থেবড়ে বসে আছে সাদা একটা বেড়াল। পশমের গোলার মতো।
বৃদ্ধার হাতে একটি জপের মালা আপন মনে ঘুরছে। পঙ্কজবাবু বললেন, আমার মা। বয়েস অনেক। এমনি খুবই শক্তসমর্থ। কেবল কানে একটু কম শোনেন।
পঙ্কজবাবু গলা দু’ধাপ তুলে বললেন, মা, এই আমার সেই বন্ধুপুত্র, পলাশ।
জপের মন্ত্রে ঠোঁটদুটি নড়ছে। মুখ ভেসে গেল উদ্ভাসিত হাসিতে। পবিত্র মুখে হাসি খেলে কোজাগরী রাতের চাঁদের আলোর মতো চরাচর ব্যাপ্ত করে।
অদ্ভুত স্নেহজড়ানো সুরে বললেন, আয় আয়, কাছে আয়। তোকে একবার ভাল করে প্রাণভরে দেখি।
কাছে এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করতেই, দু’হাতে মাথার চুল ধরে বেশ করে নেড়ে দিলেন। নাড়তে নাড়তে বললেন, চান করেছিস, ভাল করে মাথা মুছিসনি? সর্দি হবে যে রে ভাই! এত বড় বড় চুল করেছিস! ও খোকা, এর মাথাটা যে ভিজে সপসপ করছে। একটা কিছু দে আগে, ভাল করে
পঙ্কজবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, দিচ্ছি মা। কই গো কোথায় সব গেলে!
বারান্দা ধরে তিনি এগোতে লাগলেন। হঠাৎ বাড়িটা যেন জনশূন্য হয়ে গেছে। এই বারান্দা ওপাশে পাক মেরে কোথায় যে চলে গেছে। কোন স্বপ্নলোকে।
দূরে অপর্ণা আসছে। কী হল বাবা?
আরে তোরা কোথায় যে চলে যাস! এই আছিস এই নেই যেন মরীচিকা!
অপর্ণা বললে, ওদিকে যে এক কাণ্ড হয়েছে। বাবলু নাকে ন্যাপথালিনের গুলি ঢুকিয়েছে, আর বেরোচ্ছে না। মা কাকিমারা সবাই সেই নিয়ে ব্যস্ত।
অ্যাঁ, সেকী রে?
দু’জনেই বারান্দার বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সার সার, সাদাসাদা আলোর ডোম বাতাসে দুলতে লাগল। যুঁই ফুলের ভিজেভিজে গন্ধ।
বৃদ্ধা মোড়া থেকে মেঝেতে নেমে বসলেন, আয়, আমার পাশে বোস। সারাদিন ওরা কী যে এত হইহই করে! বড় সংসার তো? কত লোক দেখ না? বাড়ি একেবারে গিজগিজ করছে।
ভেতরের হট্টগোলে ঢোকার চেয়ে এইখানে বসতে পেয়ে যেন প্রাণে বাঁচলুম। অনেক মহিলার মধ্যে নিজেকে কেমন যেন অসহায় মনে হয়।
বৃদ্ধা বললেন, কী করিস তুই?
এই তো সবে একটা চাকরি পেয়েছি।
চাকরিতে গেলি ভাই! ডাক্তার কি ইঞ্জিনিয়ার হতে পারলি না?
আমার যে তেমন বুদ্ধিসুদ্ধি নেই। বাবা বলেন, মানুষের খোলসে একটা গাধা পোরা।
বৃদ্ধা হাসলেন। বড় মাপা হাসি। অভিজাত মহিলারা এইভাবেই হাসেন। অপর্ণা একটা পাটভাঙা তোয়ালে এনেছে।
ওমা, একী! আপনি মাটিতে বসে পড়েছেন?
নাক থেকে সেই জিনিসটা বেরিয়েছে?
চেষ্টা চলছে। কাকা বলছেন, ভয় পাবার কিছু নেই, ও ধীরে ধীরে উড়ে যাবে। নিন মাথাটা মুছে ফেলুন। ভেজালেন কী করে?
ভিজে গেল।
কী করে ভিজল?
উত্তরে বোকার মতো হাসলুম।
বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করলেন, বুড়ি কী বলছে?
অপর্ণা চিৎকার করে বললে, মাথা কী করে ভিজল?
চান করলে মাথা ভিজবে না? চান করে এসেছে। মাথা মোছর সময় পায়নি।
অনেক দূরে সমবেত উল্লাসধ্বনি উঠল। অপর্ণা বললে, যাক বেরিয়ে গেছে মনে হয়। চলুন, চলুন, এখানে দিদার কাছে বসে থাকলেই হবে?
মেঝে থেকে আমাকে ওঠাবার জন্যে অপর্ণা হাত ধরে টানতে লাগল। এই কাজটা মনে হয় সে ঠিক করছে না। একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধা দেখছেন দেখুন, অন্য কেউ দেখলে ভাববেন, বাবা, এখনই এত!
বৃদ্ধা বললেন, যাও ভাই ঘুরে এসো। যাবার সময় একবার আমার কাছে হয়ে যেয়ো। আমার ঠাকুরঘর দেখাব, একটু প্রসাদ খেয়ে যাবে।
অপর্ণার পেছন পেছন চলেছি। হাতে তোয়ালে। হঠাৎ মনে হল, ব্যাপারটা নিয়ে অপর্ণার সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়। বারান্দার নির্জন অংশে এসে মৃদু গলায় ডাকলুম, অপর্ণা! বেশ লাগল ডাকতে।
অপর্ণা প্রশ্নের মুখ নিয়ে ঘুরে তাকাল, কী বলুন?
শোনো, একটা খুব বিপদ হয়েছে।
কী বিপদ? দেয়ালে পিঠ রেখে থেমে পড়ল। মুখে আলো পড়েছে। নাকছাবি কানের দুল চিকচিক করছে। মনে হচ্ছে আমার ভীষণ কাছের মানুষ। আমার এই উতলা উৎকণ্ঠিত মন সামনে মেলে ধরতে পারলে একটু শান্তি পাব।
আমরা এইমাত্র মর্গ থেকে আসছি।
মর্গ?
আর কিছু বলার সুযোগ হল না। পঙ্কজবাবু আর অপর্ণার মা মার্চ করে আসছেন।
অপর্ণার মা এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, কী বিপদ বাবা! ছিছি, তোমাকে একলা এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। চলো চলো, ঘরে চলো।
পঙ্কজবাবু বললেন, আজ কিন্তু বেশিক্ষণ আটকানো চলবে না। বেশ ঝামেলার একটা কাজ এখনও সারা হয়নি।
তোমাদের হঠাৎ এত কাজ কোথা থেকে এল। কাজের যেন বন্যা বইছে! তুমি একবার দেখো, ওঁরা চা পেলেন কি না?
সেকী, নীচে চা যায়নি!
পটাস পটাস চটির শব্দ তুলে তিনি চলে গেলেন। অপর্ণার মা বললেন, পিন্টুকে ঘরে বসা। আমি আসছি এখুনি। তিনিও নীচের দিকে চললেন। অপর্ণা বললে, আসুন।
আমার কথাটা!
ঘরে হবে। বসে বসে বলবেন।
বারান্দা ডান দিকে বাঁক নিয়ে আর এক মহলে ঢুকে পড়েছে। একজায়গায় তিনধাপ সিঁড়ি ভেঙে আমরা একটা উঁচু চাতালে চলে এলুম। অনেকের কথা শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না কাউকে। অদ্ভুত রহস্যময় বাড়ি। চাতালের তিন পাশ ঘেরা। মৃদু একটা আলো জ্বলছে মাথার ওপর, ঘেরাটোপের মধ্যে। সামনে একটা সুন্দর পালিশ করা দরজা। কোথা থেকে হুহু করে হাওয়া আসছে। এই বাড়িতে সারাজীবন আমি বন্দি হয়ে কাটাতে পারি।
অপর্ণা ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল। একটু আগেও ধূপের গন্ধ পাচ্ছিলুম, এখন গন্ধ আরও বেশি পাওয়া গেল। হলঘরের মতো বিরাট একটা ঘর। ঐশ্বর্য দেখলে চোখ ঠিকরে যায়। মহিলাদের স্পর্শে এইভাবেই মনে হয় ইন্দ্রলোক তৈরি হয়! একেই বলে, ম্যাজিকটাচ। তা না হলে, সবই ছন্নছাড়া। সব থেকেও কিছু নেই।
ঘরের শেষ মাথায় একটি পালঙ্ক, যেন স্বপ্নে ভেসে আছে। ডান পাশে একটা অর্গান। সামনেই বাঁ পাশে জানলা ঘেঁষে একটি চৌকো কার্পেট। ধারে ধারে সোফা। ছিমছাম বইয়ের আলমারি। দাঁড়িয়ে লেখার ডেস্ক। বসে লেখাপড়া করার কাঁচ-পাতা ঝকঝকে টেবিল। বুকস্ট্যান্ড। শেড-লাগানো টেবিল ল্যাম্প। এ যেন রাজার ঘর।
দু’জনে মুখোমুখি বসলুম।
অপর্ণা বললে, মর্গে গিয়েছিলেন বলে চান করেছেন? হঠাৎ মর্গে গেলেন?
ওই যে কনক। একটা ছবি দেখে সন্দেহ হয়েছিল। তবে সে কনক নয়, কিন্তু আর একটা সাংঘাতিক জিনিস দেখে এলুম। কাকিমার স্বামীর মৃতদেহ।
যাঃ, তা কী করে হয়! তিনি ওখানে কী করতে যাবেন? তিনি তো কোথায় যেন বাজাতে গেছেন।
আমি স্বচক্ষে দেখলুম, তিনি ওখানে শুয়ে আছেন।
বলতে বলতে কাকিমার মতো একজন সুন্দর মহিলার অসহায় অবস্থার কথা ভেবে গলা ধরে এল। অপর্ণার দু’চোখে জল টলটল করছে।
ধরাধরা গলায় বললুম, কী হবে অপর্ণা!
অপর্ণার চোখের জল গালে নেমে এসেছে। অতি কষ্টে বললে, আপনি দেখলেন কেন?
ইচ্ছে করে দেখিনি, হঠাৎ বেরিয়ে এল।
ইস! ছিছি। এই তো একটু আগে রাঁধলেন, খাওয়ালেন। আমরা লুডো খেললুম বসে বসে। কী হবে তা হলে?
আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না, অপর্ণা। আমার কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছি না। আচ্ছা, আমি কি ভুল দেখলুম, অপর্ণা?
হ্যাঁ, তাও হতে পারে। অনেক সময় একই রকম দেখতে দু’জন লোক থাকে। হয়তো যমজ নয়; কিন্তু চেহারায় অদ্ভুত মিল।
অপর্ণার মা এলেন। দু’জনকে পাশাপাশি দেখলে মনে হয়, ছোট অপর্ণা, বড় অপর্ণা। তাঁর পেছনে আর একজন মহিলা, হাতে ট্রে, একটা শরবতের গেলাস বসানো তার ওপর। যেন কুয়াশা তরল টলটল করছে গেলাসে। অপর্ণার মা অবাক হয়ে আমাদের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, কী হয়েছে রে? দু’জনে কাদোক্কাদো মুখে বসে আছিস?
অপর্ণা আঁচলে চোখ মুছে বললে, কিছু হয়নি, মা।
তোরা আমার চোখকে ফাঁকি দিবি? নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। প্রভা, ওটা আমার হাতে দিয়ে তুমি যাও।
প্রভা ট্রে-টা সাইড টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে চলে গেল। আমার স্বভাবটা আবার মেয়েদের মতো। পেটে কথা রাখতে পারি না। বেরোবার জন্যে দরজার কাছে মুখিয়ে বসে থাকে।
অপর্ণার মা আমার ডান পাশের সোফায় বসে বললেন, কী হয়েছে বাবা! তোমার চেহারা দেখে প্রথম থেকেই কেমন যেন মনে হচ্ছে। গেলে একরকম, ফিরে এলে আর একরকম। চুল উসকোখুসকো, জামা ভিজেভিজে। কী হয়েছে বলল, আমাকে লুকিয়ো না। বুড়ি, তুই ট্রে-টা এনে সামনে ধর।
এই প্রশ্নটার জন্যেই অপেক্ষা করেছিল আমার জমা কথা। হুড়হুড় করে বেরোতে লাগল। সব শুনে মা বললেন, কী সর্বনাশ! তুমি ঠিক দেখেছ তো!
অপর্ণা বললে, আমিও সেই কথাই বলছি, অনেক সময় দেখার ভুল হয়। দু’জন লোককে একই রকম দেখতে হয়। আর একবার ভাল করে দেখে এলে হয়।
না, ওখানে গিয়ে দরকার নেই। ও যদি হঠাৎ ওখানে না যেত, তা হলে কী হত?
কিছুই হত না।
ব্যস, সেইরকম কিছুই হবে না।
ওই কাকিমার কী হবে? তিনি তো কিছুই জানতে পারবেন না।
আর তুমি জানাবার পর যদি দেখা যায়, তোমার দেখার ভুল, তা হলে কী হবে? আজ রাতে আর হইচই করে দরকার নেই। ওঁদের ওপর ছেড়ে দাও। ধীরেসুস্থে সব খবর নিন।
অপর্ণা বললে, সেই ভাল। দুঃসংবাদ যত দেরিতে জানা যায়।
পঙ্কজবাবু ঘরে এলেন, বলতে বলতে আসছেন, রাত বাড়ছে, এখনও অনেক কাজ বাকি।
অপর্ণার মা বললেন, ছটফট কোরো না তো। এখানে স্থির হয়ে বোসো। আমি সব শুনেছি।
শুনেছ? পঙ্কজবাবু হাপ ছেড়ে বাচলেন। হাতপা ছড়িয়ে বসে পড়লেন খালি সোফায়।
বললেন, নীচে ওঁরা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
ব্যস্ত হলে তো চলবে না, ভেবেচিন্তে ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। আজকের রাতটা চলে যেতে দাও। সরোজবাবু আর অক্ষয় ঠাকুরপোকে বলো সব খবর নিতে। পুলিশের খাতা দেখলেই বেরিয়ে পড়বে পরিচয়।
কিছুই বেরোবে না। আনোন ডেডবডিই মর্গে পড়ে থাকে। শেষে চলে যায় লাশকাটা ঘরে। কঙ্কালটা বিক্রি হয়ে যায়।
আঃ রাখো তো ওসব কথা। মনে করো তোমরা কিছু জানো না।
তোমার সেই ইংরিজি প্রোভাব, হোয়্যার ইগনোরেন্স ইজ ব্লিস, দেয়ার ইট ইজ ফলি টু বি ওয়াইজ।
ছেলেটার কী অবস্থা হয়েছে দেখেছ? গেল একরকম, ফিরে এল আর একরকম।
তুমি বলেছ ঠিক, আমরা না গেলে কী হত! কিছুই জানতে পারতুম না। আচ্ছা পিন্টু, তুমি কি সত্যিই তোমার প্রফুল্লকাকাকে দেখেছ?
একবার মনে হচ্ছে, হ্যাঁ, আবার মনে হচ্ছে, না।
মনটাকে স্থির করে যে-কোনও একটা কিছু বলো, পজিটিভ নেগেটিভ একসঙ্গে দুটো কী করে হয়?
তা ঠিক। তবে, এ তো মনের ব্যাপার নয়, চোখের ব্যাপার।
তা হলে আজকের মতো চেপে যাও। বেশ রাত হয়েছে।
অপর্ণার মা বললেন, তুমি আজ থেকে যাও।
করুণ মুখে বললুম, উপায় নেই। বাবা কনকের খবরের জন্যে উদগ্রীব হয়ে বসে আছেন।
তা হলে কথা দাও, তুমি শিগগির আর একদিন আসবে।
পঙ্কজবাবু বললেন, আরে, তুমি ঘাবড়াচ্ছ কেন, সামনের রোববার আমি দু’জনকেই ধরে আনব।
অপর্ণা বললে, চলুন, দিদা ঠাকুরঘরে আপনার জন্যে বসে আছে। বাবা, তুমি নীচে নামো, আমরা এখুনি আসছি।
এবার আমরা বাড়িটার আরও রহস্যময় অংশে চলে এলুম। একেবারে বাগানের দিকে। ছাদ মন্দিরের চূড়ার মতো ওপর দিকে উঠে গেছে। মার্বেল পাথরের মেঝে সোজা চলে গেছে ঠাকুরের সিংহাসনে। আমাদের দিকে পেছন ফিরে বৃদ্ধা আসনে বসে আছেন। শুভ্র কেশ মৃদু বাতাসে উড়ছে। সামনেই রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি।
আমরা দু’পাশ থেকে দু’জনে হাঁটু গেড়ে প্রণামের জন্যে মাথা হেঁট করতেই, মাথার পেছন দিকে একটি স্নেহের হাতের স্পর্শ পেলুম। হাত যেন কত কথাই বলতে চাইছে। সময় যেমন কথা বলে ঘড়ির শব্দে। দু’জনে প্রায় একই সঙ্গে মাথা তুলেছি। বৃদ্ধার দুটি হাত আমাদের দুজনের মাথায়। দুটি অনড় চোখে জলের ধারা। রাধাকৃষ্ণের সঙ্গে এতক্ষণ কী কথা হচ্ছিল ভক্তই জানেন। তিনি যার কাছে আছেন, তার কাছে যোলো আনাই আছেন, যার কাছে নেই তার কাছেও আছেন, একজন দেখেন, আর একজন দেখেন না।
অপর্ণা বললে, দিদা, তাড়াতাড়ি ছেড়ে দাও, অনেক রাত হয়েছে, বাড়ি ফিরবেন।
বৃদ্ধা আসন ছেড়ে উঠলেন। প্রসাদের থালা থেকে ধবধবে সাদা সন্দেশ তুলে আমাদের হাতে দিলেন। মুখে কোনও কথা নেই। মৃদু হাসি লেগে আছে। দু’চোখে জলের ধারা সমানে বইছে। বেশ বোঝাই গেল আবেগে রুদ্ধকণ্ঠ।
ফিরে আসার পথে অপর্ণা বললে, আমাদের ঠাকুর বড় জাগ্রত। দিদার নানারকম দর্শন হয়। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, আমরা গভীর রাতে মাঝে মাঝে বাঁশির শব্দ শুনি। এই দেখুন, বলতে বলতে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে।
অপর্ণা তার হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। কী করব, প্রথমে আমার মাথায় এল না। হ্যাঁ, তাই তো তাই তো বলে ছেড়ে দিলে, লঘু করা হয়। তাই কম্পাউন্ডার যেভাবে ইন্টারভেনাস ইঞ্জেকশন দেয়, সেই কায়দায় দু’হাতে সেই সুন্দর হাত ধরে, ত্বকে ভাবাবেগের কাটা দর্শন করলুম। একেই বলে ভাগ্য। কেউ ঈশ্বর দেখেন, কেউ অতীন্দ্রিয় ধ্বনি শোনেন। আর কেউ সুন্দরীর দেহত্বকে কাটা দর্শন করে, হায় হায় করে। ওপাশে মৃত্যু শুয়ে আছে মর্গে, এপাশে যুবতীর দেহবল্লরী।
অপর্ণার হাত সাবধানে ধীরে ধীরে তার দেহের পাশে নামিয়ে রাখলুম। ধপাস করে ছেড়ে দিতে সাহস হল না। এসব ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা বড় কম। পুতুলে মানুষে তফাত বুঝি না। শুনেছি বিখ্যাত এক বিদেশি শিল্পী সারাজীবন শুধু এঁকে গেছেন নানা ভঙ্গিমায়।
অপর্ণা বললে, এই দেখুন আমার গালেও কীরকম কাটা দিয়েছে।
একটা গাল আমার চোখের কাছাকাছি নিয়ে এল। মনে হল আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে দেখি, সাহস হল না। নিজের ভেতরে ডামাডোলের শব্দ পেলুম। বুকে যেন ঢাক বাজছে।
নীচের ঘরে তিনজনে ঝিমিয়ে পড়েছেন। আরও পড়তেন, যদি না অপর্ণার মা কথায় কথায় বেশ মশগুল করে রাখতেন।
সরোজবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, কী করবে তা হলে?
কিছুই ভেবে না পেয়ে বললুম, আজ থাক।
সেটা কি ঠিক হবে? তুমি অত ভয় পাচ্ছ কেন? ওনার স্ত্রীকে একবার নিয়ে এলেই তো হয়।
না, না।
না, না আবার কী? স্বামী মারা যেতে পারে জেনেই তো মেয়েরা বিয়ে করে। প্লেন ভেঙে পড়তে পারে জেনেই তো মানুষ বিমানে চড়ে। স্টোভ ফাটতে পারে জেনেই তো মানুষ পাম্প করে।
তা হলেও যতটা দেরিতে জানা যায়।
যা ভাল বোঝো করো।
সরোজবাবু বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছেন। সেইভাবেই উঠে দাঁড়ালেন, আমি তা হলে চলি।
পঙ্কজবাবু বিনীতভাবে বললেন, প্রয়োজন হলে যেন সাহায্য পাই।
সেই ঘড়ি, কোথায় আছে জানি না, গম্ভীর সুরে বাজতে লাগল। রাত এগারোটা।
পঙ্কজবাবু বললেন, সর্বনাশ! অনেক রাত হয়ে গেল। ইস, হরি ভীষণ ছটফট করছে। এই তোমার জন্যেই দেরি হল।
অপর্ণার মা বললেন, কী এমন রাত! গ্রীষ্মকাল, এই তো সবে সন্ধে।
পঙ্কজবাবু বললেন, চলো চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
আমি বললুম, না, না, আপনাকে আর কষ্ট করে যেতে হবে না। আবার এতটা পথ একা একা ফিরতে হবে।
অক্ষয়বাবু বললেন, কোনও প্রয়োজন নেই। ভাববেন না। ছেলেদের একটু সাহসী করুন। আমি ওই পথেই ফিরব, পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছি।
বাগানের পথ দিয়ে হেঁটে চলেছি। রাতকা রানি গন্ধে একেবারে পাগল করে দিচ্ছে। কোথাও কেউ ঠুমরি গাইছে।