১.৩৬ খরবায়ু বয় বেগে
খরবায়ু বয় বেগে, চারিদিক ছায় মেঘে
ওগো নেয়ে, নাওখানি বাইয়ো ॥
পুলিশের ছাপা ছবি থেকে কাউকে শনাক্ত করা খুব সহজ কাজ নয়। তবু কোথাও সামান্য মিল খুঁজে পেলে বুকটা কেমন যেন হুঁত করে ওঠে। হাতপা অবশ হয়ে আসে। পিতা কাগজটা সরিয়ে ফেলতে ফেলতে বললেন, খুব সাবধান, বিনয়দা বা মুকু কারুর কানে যেন না যায়।
খুব চাপাস্বরে কথা হচ্ছে। পিতা মাঝে মাঝে দরজার দিকে তাকাচ্ছেন।
পঙ্কজবাবু বললেন, পুলিশের একজন ওপরঅলার সঙ্গে আমার খুব আলাপ আছে। বলিস তো আজই যা হয় একটা কিছু করা যায়।
ডাক ভেসে এল, হরিদা আছেন, হরিদা!
সব আলোচনা থেমে গেল। গলাটা খুবই চেনাচেনা। আর একবার ডাক আসতেই পিতা বললেন, হ্যাঁ, আছি। এসো, এসো অক্ষয়, এসো অক্ষয়।
পিতার সেই সহকর্মী বন্ধু, অক্ষয়কাকা, যিনি ভীষণ ভাল হাত দেখেন।
পঙ্কজবাবু বললেন, আরে, কী আশ্চর্য! ত ক্ষয়, তুমি এইসময়?
ভদ্রলোকের সেই এক পোশাক। খালি পা, বুক খোলা হাফহাতা মোটা পাঞ্জাবি, মোটা ধুতি। ঝাকড়া ঝাকড়া চুল। বড় বড় লাল চোখ।
পা দুটো পাপোশে ঝেড়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, কাছাকাছি একজনের হাত দেখতে এসেছিলুম, ভাবলুম একবার ঘুরে যাই।
পিতা বললেন, বোসো বোসো, তোমাকে ভাবান পাঠিয়েছেন।
কাকিমা আর অপর্ণা চা নিয়ে এসেছেন। পিতা বললেন, আর এক কাপ চাই। কিছু খাবার আছে?
অক্ষয়বাবু বললেন, এখন শুধু চা-তেই হবে। আছি তো, যাবার সময় হবে।
পঙ্কজবাবু বললেন, এই আমার মেয়ে, অক্ষয়। অপর্ণা।
অপর্ণা হাত তুলে নমস্কার করল।
বাঃ একেবারে লক্ষ্মী প্রতিমা। চন্দ্র তুঙ্গী। বুধ প্রবল। আপনি অতি ভাগ্যবান। মনে আছে, এই মেয়ে হবার পরই আপনার চড়চড় করে উন্নতি হতে লাগল। বউদিও অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন, আপনিও সুন্দর। তবে ইদানীং একটু মোটা হয়েছেন।
সে অক্ষয়, তোমার বউদির যত্নে। তা ছাড়া বয়েসও তো বাড়ছে।
সে তো হরিদারও বাড়ছে। দেখুন তো কেমন পাথর-কোঁদা শরীর। একচ্ছটাক মেদ নেই।
আহা, ও হল সাধক। ওর সঙ্গে তুলনা চলে না।
চা আসার পর, পিতা নিজে উঠে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিলেন। ভেতরের কথা যেন বাইরে না। যায়।
শোনো অক্ষয়, ঈশ্বরই আজ তোমাকে এখানে পাঠিয়েছেন।
কেন বলুন তো? বেশ সশব্দে চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে, অক্ষয়বাবু সামলে নিলেন। মৃদু চুমুক মেরে বললেন, আজ আপনার মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখছি। থেকে থেকেই ঈশ্বরের নাম করছেন। যা আগে কখনও করতেন না।
মাতামহ নীরবে মাথা নাড়তে লাগলেন, মাদ্রাজি কায়দায়।
পিতা বললেন, আমার মনোজগতে একটা বিপ্লব হয়ে গেছে, অক্ষয়। মানুষের মন! কখন যে কীভাবে ভেঙেচুরে যায়। মৃত্যু আমাকে নাস্তিক করেছিল, জীবন আমাকে আবার আস্তিক করে তুলেছে। যাক সেসব কথা এখন চাপা থাক। কাজের কথায় আসা যাক। তোমার তো মর্গে খুব আসা-যাওয়া আছে।
মর্গ?
হ্যাঁ মর্গ, যেখানে অশনাক্ত মৃতদেহ থাকে।
হ্যাঁ তা আছে। প্রায়ই যাই। টেনে টেনে হাত দেখি, কেস হিস্ট্রি তৈরি করি, তারপর মেলাই।
তা হলে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। খুব সাবধানে, চুপিচুপি। তুমি এই কাগজটা দেখো।
অক্ষয় কাকাবাবু সামনে ঝুঁকে পড়লেন।
এই যে ছবিটা ছাপা হয়েছে, এটা মনে হচ্ছে, আমাদের সন্দেহ বলতে পারো।
কী সন্দেহ? এর সঙ্গে আপনাদের কী সম্পর্ক?
আছে আছে। আমাদের বিনয়দার বড় মেয়ে, কনক, দক্ষিণেশ্বরে বেড়াতে গিয়েছিল। সে আর ফিরে আসেনি। তার কোনও ট্রেস নেই। আজ এই ছবিটা বেরিয়েছে।
মিলছে?
ছবিটা তো তেমন স্পষ্ট নয়। কালি ধ্যাবড়ানো। তবু মনে হচ্ছে কেমন যেন মিল আছে।
পঙ্কজবাবু বললেন, পুলিশে আমার এক মাসতুতো ভাই বড় অফিসার, ভাবছিলুম আজই একবার তাকে গিয়ে ধরি। সামনাসামনি দেখলে সন্দেহটা আর থাকবে না।
অক্ষয় কাকাবাবু বললেন, এই অসময়ে কি আর দেখাতে চাইবে? ওদের অনেক বায়নাক্কা। ঘুষঘাষের ব্যাপার আছে। সব ব্যবস্থা সারতেই তো রাত কাবার হয়ে যাবে। আজকে দেখতে হলে। আমাদের অন্য রাস্তায় যেতে হবে।
কীরকম?
চিফ মিনিস্টারের পলিটিক্যাল ডানহাত আমার খাতিরের লোক। হাতটাত দেখি। মাঝেমধ্যে ওষুধবিষুধও দিই। কলকাতা তার নামে কঁপে। তাকে একবার ধরতে পারলে এখুনি কাজ হয়ে যাবে।
কোথায় তাঁকে পাওয়া যাবে?
সে ঘাঁটি আছে।
তা হলে চলো, এখুনি একবার বেরিয়ে পড়া যাক।
আপনাকে যেতে হবে না। আপনার ছেলেকে নিয়ে যাই। দেখলেই চিনতে পারবে।
অক্ষয় কাকাবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী, তোমার ভয় করবে?
না, ভয় করবে কেন?
সত্যিই তো, ভয়ের কী আছে! দিনুর ডেডবডি দেখেছি। বরফের স্ল্যাবে শোয়ানো। মাথাটা চুরমার।
তা হলে তুমি আমার সঙ্গে চলো।
পঙ্কজবাবু বললেন, অক্ষয়, এক কাজ করা যাক। প্রথমে আমার বাড়িতে চলো। হুডখোলা আমার সেই ছ্যাকড়া গাড়িটা বের করি। যেমনই হোক চারটে চাকা তো আছে। ঘোরাঘুরির সুবিধে হবে।
হ্যাঁ, গাড়ি থাকলে তো খুব সুবিধেই হবে। চলুন তা হলে।
জাস্ট এ মিনিট। একটু তৈরি হয়ে নিই।
পিতা বললেন, তোমরা যাবে, আর আমি আরাম করে বাড়ি বসে থাকব!
অক্ষয় কাকাবাবু বললেন, আমরা তো রয়েছি। এ বড় ঝামেলার কাজ। আপনি শান্তিপ্রিয় মানুষ। বাড়ি সামলান, আমরা ঘুরে আসি।
মাতামহ বললেন, আমি তা হলে থেকেই যাই। কী হল জানতে না পারলে, সারারাত বড় উদ্বেগে কাটবে।
মিনিট পনেরোর মধ্যে আমরা সদলে রাস্তায় নেমে এলুম।
পঙ্কজবাবু বললেন, একটা ট্যাক্সি ধরতে হবে। বাস ঠেঙাতে আর ভাল লাগছে না।
অক্ষয় কাকাবাবু বললেন, ওই মোড়ে গেলেই পেট্রলপাম্পের কাছে অনেক গাড়ি পাওয়া যাবে।
একটু দূরত্ব রেখে পেছন পেছন হাঁটছি। পঙ্কজবাবুরা মনে হয় ভীষণ বড়লোক। নিজেদের গাড়ি। আত্মীয়স্বজনরা বড় বড় চাকরে। চেহারায় সাংঘাতিক চেকনাই। অপর্ণা পঙ্কজবাবুর পাশাপাশি হাঁটছে। যুবকরা যুবতী দেখলেই তাকাবে। চায়ের দোকানের সামনে থেকে হারু এগিয়ে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, কে রে পিন্টু?
আমাদের আত্মীয়।
আগে তো কোনওদিন দেখিনি।
বিদেশে ছিলেন।
প্রশ্নের জবাব পেয়েও হারু আমার পাশে পাশে বোকার মতো হাঁটতে লাগল। জিজ্ঞেস করলুম, যাবি কোথায়?
তুই কোথায় চললি?
আমি কলকাতায় যাব।
চল তোকে স্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিই। একলা একলা যাবি!
একলা কী রে? আমার সঙ্গে এতজন রয়েছেন।
কতদিন তোর সঙ্গে দেখাটেখা হয় না। চাকরিবাকরি করছিস! আড্ডা মারার আর সময়ই নেই। মেসোমশাই কেমন আছেন?
ভাল আছেন।
তুই কোথায় বেরোচ্ছিস?
একটা মার্চেন্ট অফিসে।
মেসোমশাইয়ের অফিসে ঢুকতে পারলি না! সরকারি অফিসে একবার ঢুকতে পারলে, জীবনে আর কোনও দুশ্চিন্তা থাকে না। বিয়েথা করে একেবারে উঁকিয়ে বসো।
হারু কথা বলছে আমার সঙ্গে, তাকিয়ে আছে অপর্ণার দিকে। আচ্ছা বিপদ তো! হে ঈশ্বর, পাঠাটার হাত থেকে মুক্তি দাও। ঈশ্বর সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রার্থনার উত্তর দিলেন। হারু মোক্ষম একটা হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছিল। সামলে নিল। চলতে গিয়ে বললে, যাঃ শালা, চটি ছিঁড়ে গেল।
তুই পারবি তো একা যেতে?
মনে হয় পারব।
হারু চটি টানতে টানতে ফিরে চলল। ট্যাক্সি তৈরিই ছিল। অক্ষয় কাকাবাবু ড্রাইভারের পাশে বসলেন। আমরা তিনজন পেছনে। আমি আর অপর্ণা দু’ধারে, মাঝখানে পঙ্কজবাবু। সারাদিন আমার সঙ্গে তেমন কথা হয়নি। এইবার আমাকে পাশে পেয়েছেন।
চাকরি কেমন লাগছে?
বেশ ভালই।
আমার একটা কথা শুনে ভীষণ ভাল লাগল। ভেরি ভেরি প্রেজওয়ার্দি। তুমি নাকি বলেছিলে, বাবার অফিসে ঢুকবে না, নিজের জোরে চাকরি জোগাড় করবে, এবং করেছ! ব্র্যাভো মাই সান। শেষ পর্যন্ত তোমার এই স্পিরিট যেন থাকে। বাঙালি প্রতিষ্ঠান হলেও, ভেরি গুড কনসার্ন। চুপ করে আছ কেন? কথা বলে। তুমি ভীষণ শাই।
আজ্ঞে না, কী আর কথা বলব? আপনিই তো সব বলছেন।
তুমি কিছু বলছ না বলেই, আমাকে বকবক করতে হচ্ছে। তোমার বাবা বলছিলেন, তোমার নাকি উড়ুউড়ু সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসী ভাব।
অক্ষয়বাবু সামনের আসন থেকে বললেন, ওর হাত আমি দেখেছি পঙ্কজদা, সন্ন্যাসযোগ আছে। সংসার ছাড়লে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
অপর্ণা বললে, সন্ন্যাসী হতে হলে কী করতে হয় বাবা?
উত্তর দিলেন অক্ষয় কাকাবাবু, সব ছেড়ে চলে যেতে হয় মা।
কোথায়?
কোনও আশ্রমে, পাহাড়ের গুহায়।
পঙ্কজবাবু বললেন, গৃহী সন্ন্যাসীও হওয়া যায়। আমাদের গুরুদেব গৃহী সন্ন্যাসী।
হ্যাঁ, তারা হলেন অবধূত।
অপর্ণা বললে, গৃহী সন্ন্যাসী হওয়াই ভাল।
অক্ষয় কাকাবাবু শব্দ করে হাসলেন।
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে সোজা গিয়ে, গাড়ি বাঁয়ে বাঁক নিয়ে যে রাস্তায় চুল, সেটা হল বিডন স্ট্রিট। সাবেক আমলের বড় বড় থাম-অলা বিশাল বাড়ি। গেট আছে। গেটের বাইরে একটি প্রস্তর ফলক। সেই ফলকে ডক্টর বি. ডি পর্যন্ত পড়া যায়, বাকি সব ধুয়েমুছে গেছে।
বিশাল বাড়ি মানেই ভাঙা বাড়ি হওয়া উচিত। এ বাড়ি কিন্তু সেরকম নয়। বেশ ভালই আছে। দেখলে মনে হয় লক্ষ্মীছাড়া হয়নি। বাগান, গাড়িবারান্দা, বাগানঘর, সাবুগাছ, ঝিলমিল লাগানো– গভীর বারান্দা, ঝাড়লণ্ঠন। অতীত এখনও আঁকিয়ে বসে আছে, হিসেবি বৃদ্ধের মতো।
গেটে চাকা লাগানো আছে। ঠেলতেই ঘড়ঘড় করে খুলে গেল। গম্ভীর গলায় কুকুরের ডাক। পুরুষকণ্ঠের ধমক, অ্যাস্টার, অ্যাস্টার। মেয়েদের দমকা হাসি। রেডিয়ো থেকে উপচে-পড়া বেহাগে খেয়াল। সাবুগাছের পাতায় রাতের বাতাসের পাখা নাড়া-শব্দ। সব যেন কেমন স্বপ্নের মতো। এই বুঝি নিয়ম। এই বুঝি তার খেলা। কোথাও স্বপ্ন, কোথাও বাস্তব।
বসার ঘরে গোল একটা শ্বেতপাথরের টেবিল। কোণে কোণে ছোট ছোট টেবিল। কোনওটায় পাথরের মূর্তি, কোনওটায় পোর্সিলেন ভাস। এলাহি ব্যাপার। দেয়ালে বিশাল বিশাল ছবি। মনটা কেমন যেন করে ওঠে। ফিনফিনে গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি পরে, সুন্দর চেহারার এক ভদ্রলোক জুতো মসমঁসিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, দাদা এলে? তোমার দেরি দেখে বউদি ছটফট করছে।
ভদ্রলোক চলে গেলেন। বাতাসে একটা সুবাস ঘুরপাক খেতে লাগল।
ঘরে এইবার যে-মহিলা এসে ঢুকলেন, তাঁর কাছে ঘরের বাতিও ম্লান হয়ে গেল। জীবনে অতবড় খোঁপা আমি দেখিনি। মহিলা ভীষণ আবেগে কিছু বলতে গিয়েছিলেন, আমাদের দেখে রাশ টানলেন। মাথায় এক চিলতে ঘোমটা টেনে দিয়ে বললেন, এত দেরি হল?
পঙ্কজবাবু বললেন, কী এমন দেরি গো, এই তো সবে সন্ধে হল। ছোটবাবু ইভনিং ওয়াকে গেলেন। ছোটবাবুকে দেখে ঘড়ি মেলাতে যেয়ো না।
অক্ষয় কাকাবাবু আগেও মনে হয় এ বাড়িতে এসেছেন। মহিলা বললেন, কী অক্ষয় ঠাকুরপো, পথ ভুলে!
অক্ষয়বাবু উত্তরে শুধু হাসলেন। হেসে বিশাল একটা সোফায় শরীরের ভার ফেলে দিলেন। স্প্রিং তাকে দোলাতে লাগল। যেন ঢেউয়ে ভাসছেন।
আমি পড়েছি মহা বিপদে। এত বড় ঘর, সুন্দর সুন্দর চেহারা। নিজেকে মনে হচ্ছে লেড়ি কুকুর। হঠাৎ তাড়া খেয়ে ঢুকে পড়েছি।
পঙ্কজবাবু বললেন, তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। এই সেই বালক, মায়ের মৃত্যুর পর যাকে তুমি দত্তক নিতে চেয়েছিলে।
অ্যাঁ, এই সেই পিন্টু। ও মা কত বড় হয়ে গেছিস রে তুই?
মহিলা আবেগে উচ্ছ্বাসে, আমাকে বুকে টেনে নিলেন। মাথাটা বুকের ওপর। যে-চোখটা খোলা, সেই চোখের সামনে হারের লকেটে লাগানো লাল একটা পাথর, আলো পড়ে ধকধক করছে।
মহিলার একটা হাত আমার মাথার চুলে খেলা করছে।
তুই আমার কাছে থাকলে এতদিনে আরও সুন্দর করে দিতুম।
পঙ্কজবাবু বললেন, সুধা, ওকে ছাড়ো। এখন আমাদের অনেক কাজ। তুমি চট করে গাড়ির চাবিটা এনে দাও।
এখন আবার বেরোবে?
হ্যাঁ, আমাদের ভীষণ একটা কাজ পড়েছে। ফিরতে রাত হলে ভেবো না।
পিন্টুও যাবে?
হ্যাঁ, ওকে তো যেতেই হবে।
ওমা। ছেলেটাকে একটুও বসতে দেবে না?
ফিরে এসে বসবে। আগে কাজ।
টুক করে একটা প্রণাম সেরে নিলুম ফাঁক পেয়ে। ভাবাই যায় না, ইনি আমাকে মায়ের স্নেহে মানুষ করতে চেয়েছিলেন। মরুভূমি আর নদী একই পৃথিবীর দুটি দিক।
অপর্ণা কেমন টুক করে ভেতরে চলে গেছে। কী জানি কেমন মেয়ে। চালিয়াত বলে তো মনে হল না। তবে এঁরা বেশ বড়লোক। বড়লোকি চাল থাকলে কিছু বলার নেই।
পঙ্কজবাবুর গাড়িটা বেশ মজার। মাথাটা খোলা যায় আবার বন্ধ করা যায়। কী যেন একটা নাম বললেন, সান বিম। মাথার ওপর শহর ছুটে চলেছে হুহু করে। বাড়ি, ছাদ, বারান্দা, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ। আকাশও ছুটছে। পঙ্কজবাবুই গাড়ি চালাচ্ছেন। অক্ষয়বাবু পাশে বসে আছেন দৈত্যের মতো। আমি এক লিলিপুট পেছনের আসনে।
পঙ্কজবাবুর কবজিতে সোনার চেনে বাঁধা সোনার হাতঘড়ি চিকচিক করছে।
আমরা প্রথমে তা হলে কোথায় যাব! লালবাজারে?
অক্ষয় কাকাবাবু বললেন, অসময়ে লালবাজারে গিয়ে শুধু শুধু সময় নষ্ট করে লাভ নেই।
তা হলে ভবানীপুরে আমার সেই আত্মীয়ের বাড়ি যাব?
আগে মলঙ্গা লেনে আমার সেই বন্ধুর ডেরায় যাওয়াই ভাল। এখন তাকে পাবই।
সরু গলি। গাড়ি ঢুকবে না। একটা তিনকোনা পার্কের পাশে গাড়ি রেখে, আমাদের পদযাত্রা শুরু হল। ভাঙাভাঙা একটা বাড়ির দোতলা থেকে আর্ত চিৎকার উঠল, খুন খুন।
পঙ্কজবাবু আর আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলুম। এরকম অন্ধকার-অন্ধকার গলিতে যে-কোনও সময়েই খুন হতে পারে। রক্তনদীর ধারার খোকাগুন্ডার গলি।
অক্ষয়বাবু হেসে বললেন, ভয় নেই, চলে আসুন। নাটকের মহলা হচ্ছে।
গলির মধ্যে সবচেয়ে যেটা চটকদার বাড়ি, সেই বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে অক্ষয়বাবু ডাকতে লাগলেন, সরোজ, সরোজ। দু’ডাকে সাড়া না পেয়ে নাম বদলে ডাকতে লাগলেন, পটোল, পটোল।
মানুষের কী দুর্গতি! যার ভাল নাম সরোজ, তার ডাক নাম পটোল।
দোতলার জানলায় একটা বিরাট মুখ ঘরের আলোয় কালো হয়ে দেখা দিল। হেঁড়ে গলায় উত্তর এল, কে?
আমি অক্ষয়।
কে অক্ষয়?
আরে আবলুস।
ও হোঃ, অক্ষয়দা? দরজা ঠেলে ওপরে চলে আসুন।
ভেতরে মার্বেল পাথর বাঁধানো একটা উঠোন। সামনেই ঠাকুরদালান। দালানে মা কালীর বিশাল মূর্তি। একটু আগেই পুজো হয়েছে। ধুনোর ধোঁয়ায় আলো এখনও ঝাঁপসা। সেই ঝাঁপসা পরদায় মা কখনও স্পষ্ট, কখনও অস্পষ্ট। হঠাৎ দেখলে চমকে উঠতে হয়।
বাঁ পাশ দিয়ে বেশ একটা চওড়া সিঁড়ি, দোতলায় উঠে গেছে। পালিশ করা কাঠের হাতল ঝকঝক করছে। সিঁড়ির ওপরের মাথায় অসম্ভব সাজগোজ করা এক মহিলা হাসিহাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের দেখে বললেন, আসুন দাদা, আসুন।
মহিলার একটু স-এর দোষ আছে। বাঙালি বলে মনে হল না। ইরানি হতে পারেন, ভূপালি হতে পারেন।
লম্বা ঝকঝকে একটা দালান সোজা উত্তরে চলে গেছে। ডান পাশে একটা কাঠের স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে স্টাফ-করা বাঘ। জীবন্ত। মাঝরাতে ঘুমচোখে দেখলে, বাপ বলে দৌড় মারতে হবে। চোরেদের কী খোয়র।
একপাশে জুতো খুলে, পালিশ করা মেঝের ওপর দিয়ে প্রায় হড়কাতে হড়কাতে, আমরা যে-ঘরে এলুম সেটাকে হলঘর বলা চলে। বিশেষ কোনও ফার্নিচার নেই। মাঝখানে একটা লাল কার্পেট। সেই কার্পেটে লাল লুঙ্গি, আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে সরোজবাবু বসে আছেন। দেয়ালে। খাপ সমেত একটা রিভলভার ঝুলছে। আর এক দিকে ঝুলছে একটা রাইফেল।
আসুন দাদা আসুন দাদা বলে আমাদের অভ্যর্থনা হল।
অক্ষয়বাবু বললেন, নাও, আসন ছেড়ে উঠে পড়ো। পরোপকার করতে হবে। এঁরা আমার। আত্মীয়ের মতো। বড় বিপদে পড়েছেন।
কী হয়েছে? কারুর অসুখ? ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না? না, পকেট মারা গেছে?
ওসব তো তোমার কাছে সামান্য জিনিস।
আমরা তিনজনেই বসে পড়েছি।
একটি মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
একটা কী দাদা! কলকাতায় কত মেয়ে যে বেপাত্তা, আপনাদের কোনও ধারণাই নেই। মিসিং পার্সনস ডিপার্টমেন্টে মেয়ের বাপেদের দু’বেলা হাহাকার। সব দেখবেন, বোম্বাই গিয়ে বসে আছে। সব ফিমস্টার হবে। আপনার মেয়ে?
প্রশ্নটা পঙ্কজবাবুকে। অক্ষয়বাবু বললেন, না না, ওনার মেয়ে নয়। আমার এক পরিচিত ভদ্রলোকের মেয়ে। আজকের কাগজে একটা আন-আইডেন্টিফায়েড ডেডবডির ছবি বেরিয়েছে। ভাল বোঝা যাচ্ছে না। সেইটাই আমরা একবার দেখতে চাই।
সারা সকাল কী করছিলেন অক্ষয়দা? এই শেষরাতে এসব ঝামেলা?
একটু উপকার করো ভাই। তোমার তো সবে সন্ধে। তুমি একবার গিয়ে দাঁড়ালে, কারুর বাপের ক্ষমতা নেই না বলে।
বসুন তা হলে, তৈরি হয়ে আসি। কিছু খাবেন?
না না, আমরা খেয়েই এসেছি।
কাগজটা সঙ্গে এনেছেন?
উত্তর আমিই দিলাম, আজ্ঞে হ্যাঁ, এনেছি।
ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে সরোজবাবু বললেন, দেশে প্রেমের বন্যা বইছে রে বাবা!
ভেতর থেকে অর্গানের সুর ভেসে এল। রবীন্দ্রসংগীত বাজছে। পঙ্কজবাবু বললেন, কে বাজাচ্ছে অক্ষয়? বড় মার্ভেলাস হাত।
সরোজের স্ত্রী। মারাঠি মেয়ে। ভীষণ ভাল নাচে। লোকে টিকিট কেটে দেখতে যায়।
মারাঠি মেয়ে বাঙালিকে বিয়ে করেছে? স্ট্রেঞ্জ!
স্বাধীনতার পর সবেতেই স্বাধীনতা এসেছে, পঙ্কজদা।
দু’জনের বয়েসের অনেক ডিফারেন্স!
ওসব কিছু না। মনের মিল হলে বয়েসফয়েস কিছু না।
সরোজবাবু বেশ পালটে ঘরে এলেন। ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো চুল। সাদা প্যান্ট, সাদা জামা। প্রায় ফুট ছয়েক লম্বা। ক্রিকেট ক্যাপ্টেনের মতো দেখাচ্ছে। দেয়াল থেকে রিভলভারটা নিয়ে কোমরের বেল্টে খুঁজছেন, অক্ষয়বাবু বললেন, তুমি কি যুদ্ধে যাচ্ছ? রিভলভার কী হবে?
সরোজবাবু হাসলেন, অক্ষয়দা, কয়েক হাজার শত্রু এই শহরে ঘুরছে। মরার আগে একটু বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। অর্গানে বাজতে লাগল, খর বায়ু বয় বেগে, চারিদিক ছায় মেঘে, ওগো নেয়ে নাওখানি বাইয়ো।