লোটাকম্বল: ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন

লোটাকম্বল: ১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন

১.৩৪ আরে সত্যঘাতী মন

আরে সত্যঘাতী মন! কেন হও বিচঞ্চল?

অপর্ণা পায়ে পায়ে পিছু হটছে। মেসোমশাই পায়ে পায়ে এগোচ্ছেন। মুকু বলছে, বাবা, বাবা, ও দিদি নয়, এ বাড়িতে বেড়াতে এসেছে।

মেসোমশাই দরজা ধরে পঁড়িয়ে পড়লেন। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। অপর্ণা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বেচারা ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। ফিসফিস করে বললে, এমন জানলে, আমি সামনে যেতুম না। কনককে কি আমার মতো দেখতে ছিল?

অনেকটা। তবে আপনি আরও সুন্দর।

মেয়েদের মুখের ওপর সুন্দর বললে, বড় লজ্জা পেয়ে যায়। খুব পরিচিত হলে, ধ্যাত বলে চড় মারতে আসে। ধরতে পারলে খামচে দেয়। অপর্ণা মুখ নিচু করল।

আমাদের দুই পিতাই ছুটে এসেছেন। আমার পিতা বলছেন, কী হল বিনয়দার! বিনয়দার কী হল!

পঙ্কজবাবু বললেন, ভদ্রলোককে ভীষণ অসুস্থ মনে হচ্ছে।

মুকু মেসোমশাইকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। পিতা জিজ্ঞেস করলেন, কী, হয়েছিল কী?

উনি অপর্ণাকে কনক ভেবে ছুটে এসেছিলেন। তা ছাড়া খুব জ্বর এসেছে।

পঙ্কজবাবু বললেন, জ্বর এসেছে? তা হলে তো ডাক্তার ডাকতে হয়!

পিতা বললেন, উনি বড় বেশি ভেঙে পড়েছেন।

পঙ্কজবাবু বললেন, তুমি কী বুঝবে বলল ভাই! তোমার মেয়ে থাকলে বুঝতে! কী যে করা যায়, আমার মাথায় আসছে না। এত বড় একটা দেশে মেয়ে হারানো মানে, খড়ের গাদায় ছুঁচ হারানো। কীভাবে হারাল হরি?

সে একটা স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার। পুরো ঘটনা তোকে দুপুরে বলব।

অপর্ণা বললে, বাবা, এঁদের মন, মেজাজ, শরীর, কোনওটাই যখন ভাল নেই, তখন তোমার ওই রান্নাটান্না আজ থাক। পরে আর একদিন হবেন।

ঠিক বলেছিস মা। চল, আজ আমরা চলে যাই।

কাকিমা দরজার ওপাশ থেকে নিচু গলায় বললেন, আমি একটা কথা বলব?

পঙ্কজবাবু ঘুরে গিয়ে বললেন, নিশ্চয় বলবেন।

মাংসটা আমিই বেঁধে দিই। সহজে হয়ে যাবে। আপনারা ততক্ষণ চানটান করে নিন। আমি খুব একটা খারাপ রাঁধি না।

পিতা সার্টিফিকেট দিলেন, না না, তুমি ভালই রাবধা। বরং পঙ্কজ রাঁধলে কী হত, বলা শক্ত।

অপর্ণা বললে, না না, বাবা খুব ভালই রাঁধে। মা বলেন, আগের জন্মে তুমি ছিলে বাবুর্চি। আর মা ছিলেন মুরগি।

পঙ্কজবাবু বললেন, এঃ, বেটি আমার সব সিক্রেট আউট করে দিলে।

কাকিমা বললেন, আমি তা হলে লেগে যাই?

পিতা বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, লেগে যাও। আমরা ততক্ষণ রুগির সেবার ব্যবস্থা করি। দূর থেকেই মনে হচ্ছে, জ্বরটা বেশ ফুটেছে। মুখ দেখে বোঝা যায়–এ হল ব্রেনফিভার। ভগবান করুন, খারাপ দিকে না চলে যায়।

পঙ্কজবাবু বললেন, ভূতের মুখে রাম নাম? তুমি তো বাবা নাস্তিক!

ও আমার কথার কথা। ভগবান কি আর কিছু করবেন! করবে মানুষ। ভাল ডাক্তার চাই। তেমন বুঝলে, টেলিগ্রাম করে স্ত্রীকে এখানে আনাতে হবে। সেবা চাই।

মেসোমশাই ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, ওই উপকারটি আর করবেন না, হরিদা। তাকে আমি কিছুই জানাইনি। এই অবস্থায় জানাতেও চাই না। তার শরীর খুবই খারাপ। আপনাদের আমি খুব বেশি ভোগাব না। আজ বড় কাবু। কাল সোজা হয়ে যাব। সোজা হতে পারলেই আমি চলে যাব।

পিতা বললেন, আপনি বড় অভিমানী। আমি তো সে ভেবে বলিনি। তুমি একবার থার্মোমিটারটা নিয়ে এসো ততো! আঃ মনটা বড় ছটফট করছে।

পঙ্কজবাবু বললেন, কেন, ছটফট করছে কেন?

ওর দাদুকে একবার খবর দিতে পারলে বড় শান্তি পেতুম। শাক্ত মানুষ, মাংস হচ্ছে।

তা দিলেই হয়! যাবে কে?

আমরা সবাই তো ব্যস্ত!

সিঁড়িতে ভরাট গলায় কে যেন তিনবার বললেন, জয় রাম, জয় রাম, জয় রাম। সঙ্গে সঙ্গে মাতামহের গলা পাওয়া গেল, শঙ্কর, দেখো দেখো, কে এসেছেন! কাকে এনেছি একবার দেখো।

মাতামহ পাখির আনন্দে উড়ে এসেছেন। সন্ধেবেলা ডালে বসে পাখি বাসায় ফেরার এমনই আনন্দে কিচির মিচির করতে থাকে। মাতামহের আগে আগে উঠে আসছেন এক সন্ন্যাসী। মুখে মৃদু ধ্বনি, জয় রাম, জয় রাম। বড় সুন্দর, সাত্ত্বিক চেহারা। নাতিদীর্ঘ শরীর। গৌরকান্তি। মুখে একটা জ্যোতি খেলছে। চোখে অদ্ভুত এক প্রেমিকের দৃষ্টি। তাকিয়ে আছেন, অথচ দৃষ্টি কাউকে স্পর্শ করছে না। খেলে যাচ্ছে সুদূরে। যেন দিগন্তের পারে কেউ দাঁড়িয়ে আছেন। বিষয়ীভূত নয়।

আমরা তিনজনেই ছুটে গেলুম। অপর্ণা সবার পেছনে। মুখ-গোমড়া মুকু ধারে কাছে নেই। না থাকুক। ও এক আলাদা স্বভাবের মেয়ে। পিতার দিকে গেছে। সন্ন্যাসী দেখলে বড় আনন্দ হয়। কেন হয় তা জানি না। মন বলতে থাকে, ওরে, সংসারেই মুক্তি আছে। কায়দাটা ওঁদের কাছে শিখে নে।

পিতা বললেন, আসুন আসুন, আপনার কথাই হচ্ছিল, ভাবছিলুম, একে পাঠাব ডাকতে।

সত্যি! মাতামহের গলায় কীরকম এক ধরনের আবেগ এসে গেল, আমাকে ভাবার মানুষ, আমাকে ডাকার মানুষ এখনও আছে! রাজা, আরও কয়েক বছর বাঁচা চাই। রাজা, এখনও সব ডাল শুকোয়নি।

উচ্ছ্বাসের মধ্যেই সন্ন্যাসীর কথা মনে পড়ল, বইঠিয়ে গুরুজি, ও হ্যাঁ, একটা আসন চাই, কম্বলের আসন।

আসন এল। সেই আসন পেতে, গুরুজি চেয়ারে বসলেন। বসার ধরনটি বড় সুন্দর। একেবারে খাড়া। আমার নজর তার বুকের দিকে। ধীরে ধীরে সমান তালে বুক উঠছে আর নামছে। খাস যতটা দীর্ঘ, প্রশ্বাসও ততটা দীর্ঘ। আমার দৃষ্টি তার চোখের দিকে। সকলের মাঝে থেকেও, কী অদ্ভুত নিঃসঙ্গ। কীসের আনন্দে যেন মশগুল। যে-আনন্দ এখানে নেই, অন্য কোথাও আছে, অন্যভাবে।

মাতামহ বললেন, শঙ্কর, ইনি আমার গুরুদেব, হৃষীকেশে থাকেন।

হঠাৎ পঙ্কজবাবুর দিকে দৃষ্টি পড়ায়, এতক্ষণে জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কে?

পিতা বললেন, আমার একমাত্র বন্ধু, সহকর্মী পঙ্কজ।

মাতামহ পরিবেশ সচেতন হয়েছেন। চোখ বেড়াতে বেড়াতে অপর্ণাকে ধরে ফেলেছে। দুষ্টু হাসি হেসে বললেন, বুঝেছি, বুঝেছি, আন্ডারস্ট্যান্ড, আন্ডারস্ট্যান্ড, ওই যে বঁড়শি বেটি দাঁড়িয়ে আছে। এক যায়, এক আসে, পাখি তুই ঠিক বসে থাক, ঠিক বসে থাক, হরি নামের মাস্তুলে। ব্যাটার আমার কপাল ভাল।

বয়েস বাড়লে, মানুষের রসের ভাণ্ডার যেন উপচে পড়ে। এমন করলেন অপর্ণা সরে পড়ল। মাতামহ এইবার অপূর্ব হিন্দিতে সন্ন্যাসীর সঙ্গে আমাদের পরিচয়পর্ব শুরু করলেন, বাবা, এ মেরা জামাই, হরিশঙ্কর, বহুত চরিত্রবান, যৌবনমে দোনো এক সাথ ব্যায়াম কিয়া। ও দিন তো চলা গিয়া। আভি, আঁধার আ রাহা হই, সুর্য অস্ত হো যায়ে গা। আশীর্বাদ কিজিয়ে, কী, সামনা জনমমে, ফির দোনো এক সাথ মিলে। লীলা এইসি চলে, জনম জনম মে।

বাবার ঠোঁট কাঁপছে। তার মানে জপ চলছে।

পিতা কখনও কারওকে প্রণাম করেন না। আজ করলেন। করলেন বড় ভক্তিভরে।

সন্ন্যাসী পিতার মাথায় হাত রেখে শুধু বললেন, জয় রাম, হো যায়ে গা।

সামান্য ব্যাপার, সামান্য কথা, কী জানি কী হয়ে গেল, আমার কঠোর পিতা ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলেন। আর আমার মাতামহ উল্লাসে বলতে লাগলেন, ভাঙছে, ভাঙছে, নামছে নামছে। বলতে বলতে তিনিও কেঁদে ফেললেন। কাঁদছেন আর বলছেন, আবার আমাদের দেখা হবে, লীলা লীলা।

সন্ন্যাসী আবার বললেন, জয় রাম, জয় রাম। দৃষ্টি সুদূরে। পিতার মাথায় আবার স্নেহের হাত রেখে বললেন, দীক্ষা মিলা বেটা?

মাতামহ বললেন, নেহি হুয়া। উ সব মানতাই নেহি, আতাই নেহি, বিজ্ঞানী হো।

সন্ন্যাসীর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলে গেল। তিনি বললেন, জয় রাম, সব কুছ আ যায়েগা।

পিতা প্রণামের জন্যে অবনত হয়েছিলেন, এতক্ষণ সেইভাবেই ছিলেন। সোজা উঠে দাঁড়ালেন।

মুখচোখ দেখে মনে হচ্ছে, এখনও ফিরে আসেননি। চরিত্রে চরিত্র আসেনি। আমার অভিজ্ঞতায় জানি, মানুষ কীভাবে মানুষের ভেতর থেকে বেরিয়ে চলে যায়। কেমন করে অনন্তের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়। যখন আবার ফিরে আসে তখন অন্য মানুষ। নাম যা ছিল তা রইল, কর্মও একই রইল, মানুষ কিছু জানল না, বুঝল না। আমি বদলে গেলুম। আমার বিষয়, ধ্যান-ধারণা সব বদলে গেল।

পিতা বললেন, আপনি আমাকে দীক্ষা দেবেন?

জয় রাম। হোগা, হো যায়েগা।

মাতামহ বললেন, কব হোগা গুরুজি?

একদিন হোগা।

কোন দিন গুরুজি?

বেটা, তুমহারা বোখার হোগা। বহত ভারী, ঘাবড়াও মাত। আরোগ্য মিল যায়েগা। তুম তো বেটা বিজ্ঞানী হো। দেহ শুধ হো যায়েগা। কভি ঘুমতে ঘুমতে হাম আ সেকতা, তুম ভি হামারা পাশ আ সেকতা। রামজিকা মর্জি।

মাতামহ আকুল হয়ে প্রশ্ন করলেন, বোখার কাহে হোগা?

হোগা, ওইসাই হোগা।

সন্ন্যাসীকে আমার ভীষণ ভাল লেগে গেল। অসম্ভব শান্ত। বড় কম কথা বলেন। কম কথা বলেন। বলেই, সব কথার অসম্ভব ওজন। সুযোগ পেয়ে প্রণাম করলুম। মাতামহ পরিচয় করালেন, হামারা নাতি, কন্যাকা লেড়কা।

সাধুজি প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকালেন। শুধু বললেন, জয় রাম।

আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, আমাকে দীক্ষা দেবেন?

মাতামহ সার্টিফিকেট দিলেন, বহুৎ শুদ্ধ আত্মা।

সাধুজি মৃদু হেসে বললেন, হে সেকতা। জয় রাম।

মাতামহ বললেন, দীক্ষা হোগা গুরুজি?

হোগা বেটা, লেকিন হিয়াসে নেহি।

নিজের শরীর আঙুল দিয়ে দেখালেন।

তব হোগা ক্যায়সে, হোগা ক্যায়সে? মাতামহ ভীষণ উতলা হলেন।

হ্যায়, হ্যায়, ইসকা গুরু হ্যায়, সময় হোনেসে আ যায়গা, মিল যায়গা। জয় রাম, জয় রাম।

মুকু উদভ্রান্তের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে এল, একজন ডাক্তার পাওয়া যাবে, ডাক্তার? জ্বরটা ভীষণ বেড়েছে। ভুল বকছেন।

মাতামহ জিজ্ঞেস করলেন, কার জ্বর? কার আবার জ্বর হল, শঙ্কর!

আজ মাতামহ পিতাকে সেই তখন থেকে শঙ্কর শঙ্কর বলে ডাকছেন। আদরের ডাক ছোটই হয়।

পিতা বললেন, বিনয়দার ভীষণ জ্বর। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে– ব্রেনফিভার।

মেয়ের কোনও খবর নেই, শঙ্কর?

নাঃ, কোথায় খবর?

আশ্চর্য, পুলিশ কি ঘুমিয়ে পড়েছে? গুরুজি, আপনি একবার দেখবেন? বহত আফসোস কি বাত, লেড়কি খো গিয়া। বেমার হো চুকা।

কাঁহা হায় বেটা! চলিয়ে।

সাধুজিকে নিয়ে সদলে আমরা মেসোমশাইয়ের ঘরে গেলুম। তিনি তখন জ্বরের ঘোরে অনেকটা গানের মতো করে বলছেন, জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারায় এসো। পুরো লাইনটা একবারে বলা সম্ভব হচ্ছে না, ভেঙে ভেঙে, থেমে থেমে বলছেন।

সাধুজি মেসোমশাইয়ের মাথার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। মহাপুরুষদের শরীর থেকে সুন্দর একটা গন্ধ বেরোয়। ওঁরা নিশ্চয়ই সেন্ট মাখেন না। হোমের আগুনে ঘৃতাহুতি পড়লে যেরকম গন্ধ বেরোয় ঠিক সেইরকম। ঠাকুরঘরে ঢুকলে যেরকম গন্ধ বেরোয় অনেকটা সেইরকম।

মেসোমশাই জ্বরের ঘোরে দুবার, মি. লর্ড, মি. লর্ড করলেন।

মেসোমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সংসার মানুষকে কীভাবে দগ্ধ করে দেয়! চেহারা কেমন যেন ঝামার মতো কালো হয়ে গেছে। এক একবার চোখ খুলছেন, রং দেখলে চমকে যেতে হয়। ঘোর রক্তবর্ণ। বড় ব্যারিস্টার, যথেষ্ট পসার, প্রচুর অর্থ, কিন্তু কেমন যেন হাতপা বাঁধা কয়েদির মতো জীবন। অথচ মাথার কাছে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন? সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, কোনও ঐশ্বর্যই নেই, আপনি আর কপনি, তিনি যেন রাজা! অসীম আকাশ যাঁর প্রজা। মুক্ত পুরুষ আর বদ্ধ পুরুষে এই হল তফাত?

ঘরের বিভিন্ন জায়গায় আমরা সব থমকে থমকে দাঁড়িয়ে আছি। সাধুজি চোখ বুজিয়ে, হাত জোড় করে মাথার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন দেবদূতের মতো। ঠোঁটদুটো অনবরতই কাঁপছে। বেশ কিছুক্ষণ স্থির থেকে তিনি মেসোমশাইয়ের কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন। জয় রাম, জয় রাম বললেন বার তিনেক। শেষে বললেন, সব কুছ ঠিক হো যায়েগা।

আমরা সদলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলুম। সাধূজি কম্বল-পাতা চেয়ারে আসন নিলেন। মাতামহ প্রশ্ন করলেন, বাবা, ডাক্তারের কি আর প্রয়োজন হবে?

জরুর। বোলাইয়ে।

মাতামহ বললেন, মেয়ে কি ফিরে আসবে বাবা?

মুছে মালুম নেহি, বেটা। কেইসে বোলেগা?

না, আপনি সাধক মানুষ, সাধকরা অনেক কিছু জানতে পারেন, দেখতে পান, বলতে পারেন!

বিভূতি? সাধুজি অনন্তের দিকে তাকালেন। বিভূতি? মেরা কুছ নেহি হ্যায় বেটা। মেরা সিরিফ রামজি হয়। চলতি চক্কি সব কোই দেখে, কীল না দেখে কোই। যো কীলকো পাকড়কে রহে, সাবেৎ রহা হেয় ওই ॥ হামারা বিভূতি নেহি বেটে। হামারা কুছ নেহি।

সাধুজির মুখচোখ কেমন যেন করুণ হয়ে এল। উদাস চোখদুটি যেন জলে ভরে আসছে। হায় রাম বলে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। কী সুন্দর ভাব! কোথায় যেন নিয়ে চলেছেন আমাদের।

মাতামহ জিজ্ঞেস করলেন আবার, বোখার সারবে তো বাবা?

সাধুজি বললেন, রামকৃপা নাশহি সব রোগা।

আমার কানের কাছে অপর্ণা ফিসফিস করে বললে, আপনাকে আপনার কাকিমা ডাকছেন।

কোথা থেকে কোথায় ফিরে এলুম! এই পতন এড়াবার জন্যেই মানুষ সংসার ছেড়ে পালায়। চলতি চকি ছেড়ে, কীলকে জাপটে ধরে। কাকিমা গরমমশলা খুঁজে পাচ্ছেন না। গরমমশলা না দিলে মাংস বেতার হয়ে যাবে।

কাকিমা বললেন, তোমরা এখনও কী করছ বলো তো? বেলা কত হল জানো? তোমাদের সবই অদ্ভুত! মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে গেছে।

অপর্ণা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সন্ন্যাসী দেখে কেমন যেন হয়ে গেছে। বসার ঘরে ভাবের বন্যা বইছে।

আমি বললুম, আজ আবার খাওয়াদাওয়া কীসের? জানেন কত বড় সাধু এসেছেন!

কাকিমা লাফিয়ে উঠলেন, অ্যাঁ, সেই ঘুরঘুরে বাবা?

না না, ইনি আমার দাদুর গুরুদেব। হিমালয়ে থাকেন।

আমি একবার যাই। বটঠাকুর রাগ করবেন?

রাগ করবেন কেন?

তা হলে আমি একবার যাই। আমি কেবল একটা জিনিস চাইব। পয়সাকড়ি নয়, সুখটুখ নয়, শুধু একটা জিনিস। বুঝতে পেরেছ?

কাকিমা ফোঁসফোঁস করে চোখ মুছতে লাগলেন। আজ যেন দিকে দিকে কান্নার মহোৎসব পড়ে গেছে।

আপনি যেতে পারেন, তবে একঘর লোকের সামনে কেমন করে আপনি সেই জিনিস চাইবেন। তবে হ্যাঁ, মহাপুরুষরা সব বুঝতে পারেন। সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই মনের কথা পড়ে ফেলবেন।

তুমি বলো আমি তা হলে কী করব! একবার বলছ এগোতে, একবার বলছ পেছোতে। ঠিক করে বলল, কী করব?

যান, ঘুরে আসুন। সাধু দর্শনের পুণ্যটা তো হবে!

কিন্তু শুধু হাতে যাই কী করে! তুমি আমাকে একটু মিষ্টি কিনে এনে দাও।

আপনি তা হলে নীচে যান, আমি আসছি। হয়তো আমাদেরও কিছু আনতে হবে।

অপর্ণা বললে, আমি যাব আপনার সঙ্গে নীচে? একটা যা হয় কিছু আমাকেও করতে দিন।

চলো না মা, তবে নীচেটা বড় অন্ধকার। তোমাকে এতক্ষণ ভয়ে বলিনি।

অপর্ণা বললে, অন্ধকার! তাতে কী হয়েছে? সব জায়গায় কি আলো থাকে?

দুই মহিলা নীচে নামতে লাগলেন। অপর্ণা না ভেবেই বড় ভাল কথা বলে ফেলেছে। বসার ঘরে পঙ্কজবাবু আর এক মহাপুরুষের মতো বসে পড়েছেন। খালি গা, চাপাফুলের মতো রং। বুকের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি চলে গেছে মোটা পইতে। সবাই চুপচাপ, কেউ কোনও কথা বলছেন না। প্রকৃত সন্ন্যাসীর এই ঠিক লক্ষণ। মুখে বাক্য সরে না, ভাবেই বিভোর।

পঙ্কজবাবু হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডেকে, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, ধূমপান করা যায়?

দাঁড়ান, দাদুকে জিজ্ঞেস করে আসি।

ভাবস্থ অবস্থায় মাতামহ এক শুনতে আর এক শোনেন, না না, সন্ন্যাসীরা ধূমপান করেন না। তবে বাবার কিছু সেবার ব্যবস্থা করতে হবে।

আমি সাধুজির ধূমপানের কথা জিজ্ঞেস করিনি। পঙ্কজবাবু ধূমপান করতে পারেন কি না জিজ্ঞেস করছেন।

অ, উনি, না করলেই ভাল হয়। তুই একচামচে ভাল দই আর এক চামচে মধুর ব্যবস্থা কর। এই হল বাবার সারাদিনের আহার।

দই আমি দোকানে পাব, মধু কোথায় পাই? নীচে বেশ উঁকিয়ে মহিলামহল বসেছে। দু’জনকে দেখে মনে হচ্ছে কতকালের পরিচয়। অপর্ণা শিলে কী একটা বাটছে। কাকিমা বসেছেন পেঁয়াজ নিয়ে। দু’চোখে হাপুস হুপুস জল। মাঝে মাঝে হয় এ হাতের ওপর বাহু, না হয় ও হাতের ওপর বাহু দিয়ে চোখের জল মোছার চেষ্টা করছেন। বেশ অন্তরঙ্গ কোনও আলোচনা চলেছে নিচু গলায়। মানুষ ইচ্ছে করলে সংসারকে কত সুখে রাখতে পারে, কিন্তু করবে না। এই কাকাবাবু এসে হাজির হবেন দু-একদিনের মধ্যে। কাকিমার মুখের হাসি শুষে নেবেন ব্লটিং পেপারের মতো। উট যেমন কাটাগাছ খায়। মুখ রক্তারক্তি তবু খেয়ে চলেছে। কোনও কোনও মানুষের অশান্তিই পরম প্রিয় খাদ্য হয়ে ওঠে। তাইতেই ধৃতি, তাইতেই পুষ্টি।

কাকিমা বললেন, দেখে নাও, অপর্ণা বউ হলে কীরকম দেখাবে! এমনি করে শিলে ফেলে নোড়া দিয়ে থেঁতো করবে। বুঝেছ ছোকরা!

কাকিমার কথা শুনে অপর্ণা লজ্জায় মুখ নিচু করে রইল। মেয়েদের জগতে বিয়ের চেয়ে বড় ঘটনা যেন আর কিছু নেই।

আপনার কাছে একটু মধু হবে কাকিমা?

মধু! বাবা, তুমি যে একেবারে ভবিষ্যতে চলে গেলে। আগে হোক, তারপর তো মধু লাগবে।

এখনই তোমার মধু কী হবে!

অপর্ণা নোড়াটাকে শিলের ওপর ঠকাস করে নামিয়ে রেখে, দ্রুত পায়ে আমার পাশ দিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। যেতে যেতে বললে, ধ্যাত, আপনি বড় অসভ্য।

কীসের যে কী অর্থ, কিছুই বোঝা গেল না। মধুর সঙ্গে ভবিষ্যতের কী সম্পর্ক! অপর্ণাই বা অমন করে চলে গেল কেন? কাকিমা খিলখিল করে হাসছেন আর বলছেন, ভারী সুন্দর মেয়ে, বড় সুন্দর মেয়ে।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত