১.৩৩ অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে ঘুমে ঢুলুঢুলু আঁখি
সিঁড়ি ভেঙে যিনি উঠে আসছেন, তাঁকে আগে আমি কখনও দেখিনি। গোলগাল, আদুরে আদুরে চেহারা। টকটকে গায়ের রং। ডান গালে বেশ বড় লাল একটি আঁচিল। কেঁকড়া চুল, একমাথা, বাতাসে এলোমেলো। গিলে করা মিহি পাঞ্জাবি। এত মিহি নয় যে গেঞ্জি দেখা যায়। দুধের মতো ধবধবে সাদা। কালোপাড় ধুতি। পায়ে কালো ভেলভেটের চটি। গৌরবর্ণ পায়ে কালো চটি বড় আচ্ছা মানিয়েছে। কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, মুখের লাল আভার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
আর পেছনে যিনি উঠছেন? দেখেই বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠল। ইনিই সেই বর্ষারাতের ছবি। জীবন্ত হয়ে উঠে আসছেন? সিল্কের শাড়িতে বসন্তের পুষ্পিত উদ্যান। পাখি নেই তবু পাখি ডাকছে। ঈশ্বর কী যে একটা জিনিস তৈরি করে ফেলেছেন। নাকে আবার হিরের নাকছাবি। কানে ঝাড়লণ্ঠন। ননির হাতে মিছরির ছিলে-কাটা কয়েক সার চুড়ি। গলায় সোনার ইঁদুর-দাত, সৃষ্টিকর্তার তৃপ্তির হাসির মতো হারে মূৰ্হিত। সেই হারের গতি উপত্যকা বেয়ে পর্বতচূড়ার দিকে চলে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন যেন মোলায়েম একটি ছন্দ! প্রতি পদক্ষেপে সিঁড়ির ধাপ রোমাঞ্চিত হচ্ছে। দু’পাশের দেয়াল যেন বলছে দেখো, দেখো। মানুষের পা কেমন করে এমন নিটোল হয়! নিতম্ব কেমন করে এমন দুঃসাহসী হয়ে ওঠে। মানুষের মুখে দেবতা কীভাবে এমন করে হাসেন, শরীর কেমন করে এমন কবিতা হয়, হাত কেমন করে এমন মৃণালকাণ্ডের মতো মহাপ্রভুকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
আমাকে আর রিসিভ করতে হল না। আমি হাঁ করা গঙ্গারামের মতো সিঁড়ির মাথায় বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। মন বলতে লাগল, পালা ব্যাটা, বড় সুন্দরী, মনে গেঁথে গেলে, বঁড়শি-বেঁধা মাছের মতো অবস্থা হবে। পায়ে পক্ষাঘাত। পালাব কী, পা জমে গেছে। দুটো পাথরের স্তম্ভ।
হাঁ-করা আমার সামনে দাঁড়িয়ে, সেই সুগৌর গিরিগোপাল বালামচালের মতো মিহি গলায়, মুখ থেকে বিরিয়ানির আতরের সুবাস ছড়াতে ছড়াতে বললেন, বাবা কোথায়?
প্রশ্ন শুনে, শরীরের সাময়িক পঙ্গুভাব কেটে গেল। হঠাৎ মনে হল অতিশয় চাঙ্গা হয়ে উঠেছি। বললুম, বাবার এক্সপেরিমেন্ট ফেল করেছে। রং মেখে হতাশ হয়ে বসে আছেন।
অ্যাঁ বলো কী? হরি, ঘাবড়ানি, ফেলিয়োর ইজ দি পিলার অফ সাকসেস!
গলা যতটা তুলেছিলেন ঠিক ততটা নামিয়ে বললেন, রং নিয়ে কী করছে?
এ প্রশ্নের উত্তর আমাকে আর দিতে হল না। পিতৃদেব এসে গেছেন। দেবতার মতোই দেখাচ্ছে। একেবারে লালবাবা। হাতে সেইসব ভজঘট। ছিপি, কাঁচের টিউব, রবারের নল। বিশ্বকর্মা শেকড় সমভিব্যাহারে উঠে এলেন।
ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বললেন, একেবারে ফ্রেশ ফ্রম গার্ডেন, কাশ্মীরি আপেলের মতো চেহারা। অ্যাঁ, তোকে ঠিক ড্যানি কে, বাস্টার কিটনের মতো দেখাচ্ছে যে রে!
মেয়েটি টুক করে পিতার চরণে প্রণাম নিবেদন করলেন। এসো মা এসো মা বলে চিবুক ছুঁতেই ব্যাপারটি বেশ মনোরম হল। অধরের তাম্বুল যেন শ্রীরাধিকার বয়ানে লেগেছে। পিতার হাতের লাল রঙে চিবুক লাল, গালের একাংশ লাল।
ভদ্রলোক বললেন, গিয়েছিলুম দক্ষিণেশ্বরে মেয়েকে নিয়ে। আঃ, দর্শন করে মন ভরে গেল। আহা মায়ের কী রূপ। নে মা, প্রসাদটা কোথাও রাখ। তা বুঝলি হরি, হঠাৎ তুই যেন টানলি। মনে হল, যাই একবার বিজ্ঞানীকে দেখে যাই। তা ভাই, তোমার হাতে এই জলকলমি, শাপলা, শালুকের মতো বস্তুগুলি কী?
আর বলিস কেন পঙ্কজ, কমপ্লিট ফেলিয়োর, টোটাল ডেস্ট্রাকশন, লস অফ মানি, মেটিরিয়েল, ম্যান পাওয়ার। খাওয়াদাওয়া?
মন যা বলছে বলব?
ইয়েস।
ভয়ে না নির্ভয়ে।
নির্ভয়ে।
এইখানেই হয়ে যাক।
হয়ে যাক।
একটা প্রস্তাব। আমি রাঁধব। এবং মাংস রাঁধব।
পাবে কোথায়?
এই যে আমার হাতে। হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই কি আমায় এতই মূর্খ ভাবিস?
ত্যাদোটা নয়।
নিজেদের রসিকতায় নিজেরাই হইহই করে হেসে উঠলেন। মরা ডালে যেন ফুল ফুটছে। কড়িকাঠের ঘুলঘুলিতে চড়াইছানা চমকে জেগে চিচি করছে।
তা হলে, পঙ্কজবাবু টেবিলে চাপড় মেরে বললেন, লেগে পড়া যাক। বুড়ি?
মেয়ে প্রসাদের ঠোঙা হাতে এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সামনে এসে বললে, বলো বাবা?
নাও মা, লেগে পড়ো। তোমার এই রাজবেশটি ছাড়ো। প্রসাদটা রাখো না, মা।
রাখার জায়গাটা যে কেউ দেখিয়ে দিচ্ছেন না আমাকে।
আহা, তুমি নিজে দেখে নাও।
অলরাইট।
অপর্ণা আপনজনের মতো সহজ ভঙ্গিতে ভেতরে চলে গেল। পিতা বললেন, যাও যাও, তুমি সাহায্য করো। কোথায় কী আছে দেখিয়ে দাও।
পঙ্কজবাবু বললেন, তোর ছেলেটিকে বেশ দেখতে হয়েছে, হরি। মায়ের মুখটি একেবারে কেটে বসানো। খালি গায়ে সের দশেক মাংস লাগাতে পারলে একেবারে মাউন্টব্যাটেনের মতো দেখতে হত।
কী আশ্চর্য মিল, পঙ্কজ। একবার ভেবে দেখেছিস?
ওই মুখের মিলের কথা বলছিস!
তোর মেয়ের মুখের সঙ্গে পিন্টুর মায়ের মুখ।
উঃ, একেবারে সেন্টপারসেন্ট। সেন্টপারসেন্ট মিল। পৃথিবী জুড়ে কী যে সব হতে থাকে। কোথা থেকে কী যে হয়ে যায়। আমার তো মাঝে মাঝে রাতে ঘুম হয় না। ভাবতে ভাবতেই রাত কেটে যায়। দেখ হরি, সব মানুষই দার্শনিক। যার যার নিজের মতো। একটু চা হবে না!
চা হবে না মানে! চা-ই তো আমাদের জীবন। একশো ফোঁটা রক্তে পঞ্চাশ ফোঁটা চা।
পঙ্কজবাবু অট্টহাসি হেসে বললেন, রাক্ষসের প্রাণ যেমন ভোমরায়, তোর আর আমার জীবন তেমনি চায়ের পাতায়। বুঝলি হরি, বড় দুঃখ হয় রে!
কীসের দুঃখ বল! তোর কীসের দুঃখ।
দেখ, তোর বউ মারা গেল, মানে বউঠান মারা গেলেন, তুই সংসারে বড় একা, আমার কিন্তু সবাই আছে, একেবারে পরিপূর্ণ সংসার। আমার সব থাকবে, তোর কিছু থাকবে না, এরকম কেন হবে? খোদার এ কী বিচার! তোর কথা ভাবলেই আমার ভীষণ লজ্জা করে। তুই যোগী, আমি ভোগী। আমি কত ক্ষুদ্র, তুই কত বিশাল।
দেখ পঙ্কজ, আমিও তোর কথা ভীষণ চিন্তা করি। আর যখনই চিন্তা করি, মনে ভীষণ বল পেয়ে যাই, ভাবি পঙ্কজ আমার পাশে আছে। সত্যি কথা বলতে কী, তুই আমার ভায়ের মতো।
শুধু ভাই নয়, বল যমজ ভাই। একটু চা হলে মন্দ হয় না, কী বল?
অফ কোর্স। চা ছাড়া জীবন অচল।
বাট ওয়ান থিং, চা কে করবে?
কেন আমি।
না, তুই নয়, করবে বুড়ি।
তোর মেয়ের কটা নাম?
আমি বাপু বুড়ি বলেই ডাকি। তোর মেয়ে নেই বুঝবি না। মেয়েই হল বুড়ো বাপের একমাত্র ভরসা। কী শাসন! সবসময় আগলে আগলে রাখে।
ভেতরের বারান্দায় অদ্ভুত এক দৃশ্য। দুটি মেয়ে দু’জনের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। মুকু আর অপর্ণা। কারুর মুখে কোনও কথা নেই। বেড়াল যেন বেড়াল দেখেছে। এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে দু’জনকে মুক্তি দেবার জন্যে পরিচয়টা আমাকেই করাতে হল, ইনি আমার মেসোমশাইয়ের মেয়ে, নাম মুকুলিকা, আমরা ছোট্ট করে ডাকি মুকু। মুকু, এঁর নাম অপর্ণা, আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে।
দু’জনেরই খুব সহবত। হাত তুলে নমস্কার বিনিময় হল।
পেছনের সিঁড়ি দিয়ে কাকিমা গুটিগুটি উঠে এসেছেন। পানের মতো মুখ ঘামতেলে চকচক করছে। আমার পাশে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, কে গো?
ফিসফিস উত্তর, বাবার বন্ধুর মেয়ে।
কী নাম?
অপর্ণা।
একটা চোখ ছোট করে কাকিমা বললেন, খুব সাবধান, তোমার উপযুক্ত ফাঁদ।
অপর্ণা কাকিমার দিকে তাকাতেই, কাকিমা বললেন, বেশ মেয়েটি।
মেয়েটির দিকে এগিয়ে গিয়ে কাকিমা চুলের বিনুনি নাড়তে নাড়তে বললেন, বাঃ, কী সুন্দর চুল! নাকটা নেড়ে দিয়ে বললেন, টিকোলো নাক। চোখদুটো দেখে বললেন, প্রতিমার মতো চোখ, ভুরু দেখে বললেন, ধনুকের মতো ভুরু, সবশেষে বললেন, গড়নটি কী সুন্দর! ভগবান তোমাকে। একেবারে ঢেলে দিয়েছেন।
কাকিমা যত প্রশংসা করছেন, অপর্ণা ততই কুঁচকে যাচ্ছে। কাকিমা বললেন, তুমি যার হাতে পড়বে তার রাজার ভাগ্য।
অপর্ণা অতি কষ্টে বললে, আপনি?
আমি পিন্টুর কাকিমা।
অপর্ণা প্রণাম করতে গেল। কাকিমা দু’হাত ধরে বুকের কাছে টেনে এনে বললেন, আমি ব্রাহ্মণ নই, মা।
পিতা আর পঙ্কজবাবুর গলা পাওয়া গেল। কাকিমা তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে নীচের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন।
পিতা বললেন, একী অপর্ণা, তুমি এখনও ডাঙা পাওনি, জলেই পড়ে আছ? কই হে অবতার?
আজ্ঞে বলুন।
যাও দেরাজ খুলে দাও। পছন্দ করে একটা শাড়ি বেছে নাও। একেবারে নতুন শাড়িও আছে। এর মা পরার সময় পায়নি। জীবনটা তো খুব ছোট ছিল। লজ্জা কোরো না, লজ্জা কোরো না। এ তোমার নিজের বাড়ি।
পঙ্কজবাবু বললেন, তুই জানিস না বুড়ি, আমরা দু’জনে হরিহর আত্মা। কত রাত এ বাড়িতে কাটিয়ে গেছি। হরি, তোর মনে আছে, সেই মহিষাদল রাজস্টেটের গাইয়ে অগস্তিমশাইকে। আঃ, কী গানই গাইতেন! এ বাড়িতে বহুকাল কোনও আসর বসেনি। জীবনটা কী হয়ে গেল!
আর জীবন? এই তো জীবন। যেতে যেতে সবই চলে যায়। যে শেষে যায় তার বড় জ্বালা। সব দোরতাড়া দিয়ে চাবি বন্ধ করে, বারেবারে পেছন ফিরে তাকাতে তাকাতে যাওয়া।
অগস্তিমশাই এখন কোথায়?
জানি না রে। আছেন না গেছেন তাও জানি না। শিল্পীরা বেশিদিন বাঁচেন না।
না না বেঁচে আছেন। বয়েস খুব বেশি নয়।
পঙ্কজবাবু হঠাৎ মুকুকে দেখলেন, মেয়েটি কে?
মেজদার ভায়েরাভাইয়ের মেয়ে, এখানে এসেছিল পরীক্ষা দিতে। ভেরি স্যাড, ভেরি স্যাড।
স্যাড কেন?
এর বড় বোনটি নিরুদ্দিষ্টা হয়েছে।
সেকী? তল্লাশ চলছে?
কিছু বাকি নেই, তোলপাড় চলছে।
আঃ, এইজন্যই সংসার করতে নেই। একটানা-একটা অশান্তি পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে থাকবেই। একটু চা হলে মন্দ হত না, কী বল হরি?
অফকোর্স!
কাকিমা সিঁড়ির বাঁকে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বললেন, আমি করে দোব বটঠাকুর? আমার উনুনে আঁচ গনগন করছে।
পিতা চমকে ফিরে তাকালেন, অ্যাঁ, তুমি, আচ্ছা করবে করো। সেই ভাল চা-টা নিয়ে যাও।
পঙ্কজবাবু বললেন, ইনি?
আমার বাল্যবন্ধুর স্ত্রী। নীচেটা নো-ম্যানস ল্যান্ড হয়ে ছিল, তাই থাকতে দিয়েছি। স্বামীটি গুণী, সুন্দর তবলার হাত, তবে স্বভাবটি তেমন সুবিধের নয়। উড়োপাখি।
সংসার কী জিনিস, হরি! দুটো পাখি কখনও এক ডালে বসতে পারে না। তোর বাগানের গাছগুলো বেশ বড় হয়েছে। বয়েস কীভাবে বাড়ছে, হরি?
শশিকলার মতো।
পঙ্কজবাবু আবার হইহই করে হেসে উঠলেন, দারুণ বলেছিস। তার মানে অমাবস্যা আসছে। ওটা কী গাছ রে? ওই যে কোণের দিকে। বিউটিফুল হলদে হলদে পাতা।
ও, ওটা হল রিঠে গাছ। কী হল তোমরা এখনও পঁড়িয়ে? যাও দেরাজটা খুলে দাও।
আজ্ঞে, ইনি গেলে তবেই তো খুলব?
পঙ্কজবাবু আবার হোহো করে হাসলেন, বুড়ি, তোর কী রেসপেক্ট! ইনি৷ দুর, বোকা ছেলে। ইনি কী? ইনি? শাড়ি পরেছে বলে এত সম্মান! তুমি বলো, তুমি।
দেরাজে থরে থরে সাজানো মায়ের স্মৃতি। বেনারসি, সিল্ক, ব্লাউজ, সোয়েটার, সোনা বাঁধানো পাশচিরুনি। ব্রহ্মদেশের বাঁশের তৈরি কারুকাজ করা গোল চৌকো বাক্স। সবই ছিল মায়ের। আর এক মা, আমার পাশে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছে। ঘরে একটা আলোআঁধারের খেলা চলেছে। দেরাজ থেকে কেমন একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। স্মৃতির একটা সুন্দর মন-কেমন-করানো গন্ধ আছে।
অপর্ণা দেখার জন্যে মাথা সামনে নোয়াল। ওর শরীর থেকে কেমন একটা উত্তাপ বেরোচ্ছে, ফুলের গন্ধ। দেরাজের ভেতরটা ঠান্ডা। একগুচ্ছ চুল কপালের ওপর দুলছে। দু’কানে ঝুলে থাকা দুটো দুল, আর পারি না, আর পারি না, ছন্দে দুলছে। নাকের নাকছাবি মাঝে মাঝে শিউরে উঠছে। পরনের সিল্কের শাড়ি নানা ষড়যন্ত্রে খিসখিস শব্দ করছে। আমার মন বলছে, চেয়ে দেখ, তোর জীবনসঙ্গিনী হতেও পারে, শুধু তুমি ঘাড়টি একটু কাত করবে, মুখে একটু লাজুক লাজুক হাসি টেনে আনবে। ব্যবধান মাত্র এক হাত।
বুকের ভেতর এমন চেঁকিপড়ার শব্দ হচ্ছে কেন? কণ্ঠতালু কেন শুকিয়ে আসছে?
তোর ঘোর লেগেছে। পৃথিবীতে এইরকমই হয়। এটা টপকাতে পারলেই মুক্তি। বড় শক্ত কাজ হে৷ এ যে বিশালাক্ষীর দ।
কাকিমা তখন সৌন্দর্য দেখাচ্ছিলেন, নাক চোখ মুখ গড়ন রং। আমি গড়ন দেখছি। মাথায় আমার মতোই লম্বা। কিন্তু কী সুন্দর! মেয়েটির খুব জীবন আছে। সেই বলে না, এ অনেক দূর যাবে, এই মেয়েটিও আরও অনেক বাড়বে। সবে তো মুকুলিকা! ফুল হয়ে ফুটবে যেদিন! সিল্কের শাড়ি শরীর বেয়ে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নেমে গেছে। কোথাও ক্ষীণ হয়েছে, কোথাও গুরু। নদীর মতো। স্থানে স্থানে শীর্ণ, স্ফীত। মানুষ মারার কল তৈরি করেছেন ঈশ্বর। ফাঁদ পেতেছেন বিশ্বজুড়ে।
এক একটা শাড়িতে আলতো আঙুল বুলোত বুলোতে অপর্ণা বলছে, কী সুন্দর! কী সুন্দর! এসব আর দেখাই যায় না। সব আপনার মায়ের!
মেয়েটির গলাও কী সুন্দর। মৃদু বাতাসে যেন ঝাড়লণ্ঠনের কাঁচ দুলছে।
আজ্ঞে হ্যাঁ, সবই ছিল আমার মায়ের।
আমাকে আপনি বলছেন কেন?
বোকার মতো হাসলুম। চিরকালই আমি একটু বোকাবোকা। আমার পেটে খিদে, মুখে লাজ। বোকা বদমাশ।
আমাকে তুমিই বলবেন। ওমা! এটা কী? ছোট ছোট ঘন্টা লাগানো ভেলভেটের সেই হাতপাখাটা অপর্ণা খুঁজে পেয়েছে। কোন দেশে তৈরি তা জানি না। তবে বড় সুন্দর জিনিস। নাড়লে বহু দূর থেকে ভেসে আসা প্যাগোডার ঘণ্টার শব্দ ঘুম পাড়িয়ে দিতে চায়।
পাখা রেখে অপর্ণা বললে, উনি বললেন বটে, এসব শাড়ি আমি পরতে পারব না। সে যুগের দামি দামি শাড়ি পরলে নষ্ট হয়ে যাবে। আমার পরার অধিকার জন্মায়নি।
দাঁড়ান, আমি তলার ড্রয়ারটা খুলি। অনেক আটপৌরে আছে। একটু সরুন।
অপর্ণা একপাশে সরে গেল। হাঁটু গেড়ে বসে নীচের ড্রয়ারটা টেনে খুললুম। আমার ডান পাশ দিয়ে রমণীয় বৃক্ষের মতো উঠে গেছে রমণী-শরীর। যেন বসে আছি গাছের ছায়ায়। মাথার কাছে ঝুলে আছে পাতার মতো আঁচল। ব্ৰহ্মতালু ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
ফিকে গোলাপি রঙের একটা শাড়ি তুলে নিয়ে অপর্ণার হাতে দিয়ে বললুম, এইটা আপনি পরুন। একেবারে নতুন।
শাড়িটা হাতে নিয়ে অপর্ণা বললে, আশ্চর্য সুতো। কত বছরের পুরনো, এখনও ঠিক আছে। তবে পরে বসতে গেলে ফেঁসে না যায়।
ফেঁসে যাবার কথায় ঘাড় তুলে, আড়চোখে অপর্ণাকে একবার দেখে নিলুম। সেদিন ঘর মোছার সময় বসতে গিয়ে আমার অন্তর্বাস ফেঁসেছিল। বসার সময় কোথায় চাপ পড়ে আমি জানি। একযুগ আগের শাড়ি, ফঁসতেও পারে। অপর্ণার আয়তন আর ওজন দুটোই আমার চেয়ে বেশি।
দরজার ওপাশ থেকে মুকু বললে, আমার একটা শাড়ি পরবে ভাই? কাঁচা পরিষ্কার।
হ্যাঁ, সেই ভাল।
মায়ের গোলাপি শাড়ি আবার স্মৃতির ভাণ্ডারে ফিরে এল। আমারও মন চাইছিল না। যাক, মেয়েতে মেয়েতে এবার বোঝাঁপড়া থোক।
পুবের বারান্দায় বসে, দুই বন্ধুর চা চলছে। রকমসকম দেখে মনে হচ্ছে, এঁরা দু’জনেই ঘড়িটড়ির ধার ধারেন না। চা শেষ হবে। মাংস বাছা হবে, ধোয়া হবে। মশলা পেষা হবে। তারপর কষা হবে, সেদ্ধ হবে। ভাত চাপবে। আজ বরাতে লাঞ্চ নেই। একেবারে সেই ডিনার?
ওপাশের ঘরে অপর্ণার চিৎকার শোনা গেল, ও মা গো, এটা কী রে বাবা? পিতা বললেন, দেখো দেখো, কী হল?
মুকু মৃদু গলায় বলছে, কী হল ভাই, দরজাটা খোলো না!
অপর্ণা তিড়বিড় করে বললে, মেঝেতে মালসার মতো কী একটা চলে বেড়াচ্ছে!
উত্তরের ঘরে দরজা দিয়ে অপর্ণা শাড়ি ছাড়ছিল। বুঝেছি, ভয়ের বস্তুটি কী। বলাইবাবু। বড় রসিক মানুষ। সাহস দেবার জন্যে বললুম, ভয় নেই আপনার, ওটা একটা কচ্ছপ। আমাদের পোষা।
ও মা, কচ্ছপ? কচ্ছপ আবার কেউ পোষে? কামড়াবে না?
ও কামড়ায় না, ভারী ভাল ছেলে।
ঘরের ভেতর দুদ্দাড় করে একটা শব্দ হল। বলাইবাবু অপর্ণা দেবীকে নাচ শেখাচ্ছেন। খটাস করে খিল খুলে উত্তরের ঘর থেকে অপর্ণা প্রায় ছুটে বেরিয়ে এল। মুকুর দেওয়া শাড়িটা কোনওরকমে গায়ে জড়িয়েছে। ছাড়া সিল্কের শাড়ি মেঝেতে ফুলে ফেঁপে পড়ে আছে। বলাইবাবু বেশ আরাম করে তার ওপরে চেপে বসেছেন। বলা যায় না,হঠাৎ যদি টেস্ট করে দেখার ইচ্ছে হয়। মুভুটি মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসছে।
শাড়িটাকে উদ্ধার করে এনে অপর্ণার হাতে দিলুম। এইসব মন-চঞ্চল করা কাজই তো আমাকে করতে হবে। এর নাম পরীক্ষা।
শাড়িটা হাতে করে নিয়ে অপর্ণা বললে, ইস, ছি ছি, আপনাকে তুলে আনতে হল? কী লজ্জা? কচ্ছপ পুষেছেন কেন? কচ্ছপ কেউ পোষে! কামড়ালে, মেঘ না ডাকলে ছাড়বে না।
বাজে কথা। কচ্ছপ নিরীহ প্রাণী। কখনও কামড়ায় না।
শাড়ি পরার ধরনে অপর্ণাকে আশ্রমবালিকার মতো দেখতে হয়েছে। বড় বড় চোখে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। না, আর এখানে থাকা উচিত নয়। মুকু যেভাবে তাকাচ্ছে! অপর্ণা একটু এলোমলো হয়ে আছে। ঠিক ততটাই এলোমেলো, যতটায় যুবকের মতিভ্রম হতে পারে। আমাকে চরিত্রহীন ভাবছে। চরিত্র আবার কাঁচের গেলাসের মতো। কখন যে ঠুন করে ভেঙে যায়, কোন আঘাতে!
মেসোমশাই গম্ভীর গলায় মেয়েকে ডাকলেন, মুকু।
আসি বাবা, বলে মুকু প্রায় দৌড়ে চলে গেল। অপর্ণা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, কে, কে?
মেসোমশাই। মুকুর বাবা।
মেসোমশাইয়ের গলা শোনা গেল। মেয়েকে বলছেন, বড় গোলমাল হচ্ছে। কীসের এই উৎসব! তুমি দরজাটা ভেজিয়ে দাও। আমার জ্বর আসছে। একটু শুয়ে পড়ি।
মেয়ে বললে, চলো বাবা, আমরা ফিরে যাই। এখানে পড়ে থাকার কোনও মানে হয় না। যা করার ওখানে বসেই করা যাবে।
হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি। শুধু শুধু এঁদের কষ্ট দিয়ে লাভ কী?
মুকু দরজাটা ভেজিয়ে দিল। অপর্ণা অপরাধীর মতো মুখ করে বললে, আমি কি খুব জোরে চিৎকার করে ফেলেছি?
না না। খুব আস্তে কথাও ওঁর এখন অসহ্য লাগে। বুঝতেই পারছেন, মনের অবস্থা খুব খারাপ।
আমরা খুব বাজে দিনে এসে পড়েছি। বাবা যখন কোনও কিছু নিয়ে মেতে ওঠেন, তখন যেন
সামলানোই দায়। যাই বলে আসি, অত হইচই করছ কেন?
না না। অপর্ণার হাতটা প্রায় চেপেই ধরেছিলুম, খুব জোর সামলে নিয়েছি। একেই বলে সংযম!
অপর্ণা বললে, মেসোমশাইয়ের জ্বর আসছে বলছেন, ওঁকে কিছু খাইয়ে দিলে হত না? এঁদের রান্না হতে তো সেই বিকেল পাঁচটা। যেমন আমার বাবা, তেমনি কাকাবাবু!
আমার বাবার জীবনে তো কোনও আনন্দ নেই। শুধুই কর্তব্য। আজ আপনার বাবাকে পেয়ে তবু একটু মেতে উঠেছেন। এ মাতন তত বেশিক্ষণ থাকবে না। ম্যালেরিয়ার মতো, এই ছাড়ে, এই আসে। কী হবে বলে! সব আয়োজন এখুনি থেমে যাবে!
মুকুকে তা হলে ডাকুন না। মেসোমশাইকে যা হোক কিছু খাইয়ে দিক।
মুকুকে আমি ডাকতে পারব না, আপনি ডাকুন। আমার সঙ্গে কথা বলে না।
কেন, ঝগড়া হয়েছে?
না, ঝগড়া নয়। বড়লোকের মেয়ে। বেশ একটু গরব আছে।
কই, আমি তো তেমন কিছু বুঝলুম না। আচ্ছা, দাঁড়ান দেখছি।
অপর্ণা ভেজানো দরজা ঠেলে খুলতে খুলতে ডাকল, মুকু, মুকু। ঘরে একটা পা রেখেছে। মেসোমশাই চিৎকার করে উঠলেন, কে, কনক এলি, কনক? কনক?
বড় হৃদয়বিদারক দৃশ্য। মুখ দেখলেই বোঝা যায়, মেসোমশাইয়ের বেশ জ্বর এসেছে। চোখদুটো ঘোর লাল। কনক, কনক করে, দু’হাত সামনে বাড়িয়ে এগিয়ে আসছেন। অপর্ণা এক পা এক পা করে পিছু হটছে।