১.৩০ বাংলার বধূ বুকে তার মধু
বাংলার বধূ বুকে তার মধু নয়নে নীরব ভাষা
স্বপ্ন বেশিক্ষণ মনে থাকে না। অনেক সময় জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই মন থেকে মিলিয়ে যায়। স্বপ্ন মনে রাখতে হলে ঘুম ভেঙে গেলেও ধড়মড় করে উঠতে নেই। চুপ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে হয়। তা হলে স্বপ্নের প্রতিটি দৃশ্য, কথা, শব্দ ছবির মতো মনে থাকে।
স্বপ্ন দেখছিলুম বিশাল এক বাগানে, চাঁদের আলোয় আমি আর ছবিতে দেখা সেই অপর্ণা নামক মেয়েটি বসে আছি পাশাপাশি, গাছতলায়। চাঁদমাখা রাত চার পাশে ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে মসলিনের মধ্যে দিয়ে, কিংবা মসলিনের মশারির ভেতর বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। মাঝে মাঝে চুমকি জ্বলছে। পাশে ওই মেয়েটি বসে থাকায় বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। এরই মাঝে, কোন ঝোপে বসে পাখি ডাকছে। স্বপ্নে অবাস্তব একটা কিছু থাকবেই। তা না হলে, মাতুলের সেই ছাত্রী, সুন্দরী চিত্রাদেবী, ঘাড় ঢগঢগে সারেঙ্গিঅলাকে নিয়ে আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবেন কেন। তিনি চলেছেন আগে আগে, নায়িকার মতো, বৃদ্ধ চলেছেন পেছন পেছন জিজ্ঞাসার চিহ্ন ধরে। চাঁদের আলোয় চরাচর ভেসে যাচ্ছে। স্বপ্নেই ভাবছি, আহা এ যেন স্বপ্ন! অপর্ণার দিকে তাকালেই সে মৃদু হেসে বলছে, কিছু বলো। হঠাৎ দূরে কোথাও গুড়গুড় করে মেঘ ডেকে উঠল। চাদিনি রাতে মেঘ। গর্জন! এলোমেলো হাওয়া বইতে শুরু করল। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা বাতাস। সিনেমা হলে যেভাবে ধীরে ধীরে আলো নিভে আসে, সেইভাবে চাঁদের আলো মৃদু হয়ে আসছে। ঢালু জায়গা দিয়ে যেভাবে জল গড়িয়ে পড়ে, সেইভাবে চারপাশ থেকে আঁধার গড়িয়ে আসছে। অপর্ণা ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছে, এ কী হল পলাশ? আমার ভীষণ ভয় করছে। কোথা থেকে হঠাৎ একটা পাহাড় গজিয়ে উঠল চোখের সামনে। দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। অন্ধকার নেমে আসছে কুলকুল করে জোয়ারের জলের মতো। স্বপ্নে কী যে সব হতে লাগল! ভয় ছাড়া যেন স্বপ্ন হয় না। ষোড়শী সুন্দরী গাত্ৰলগ্না। শ্বাসপ্রশ্বাসে তার শরীর ওঠা-নামা করছে। দূরে একটা সাদা মূর্তি দেখা গেল। বাতাসে আঁচল উড়ছে। কে? কনক! সেই মূর্তি যেন মুখ ফিরিয়ে একবার তাকাল। সারামুখে চন্দনের আলপনা। অপর্ণাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আমি ছুটতে লাগলুম। কনক যেন সাদা মেঘখণ্ডের মতো ভেসে চলেছে। আমি তার আঁচল ধরতে না পেরে ক্রমাগত চিৎকার করে চলেছি, কনক, কনক!
এর পরের দৃশ্য স্বপ্ন নয়, বাস্তব।
বিছানায় বসে আছি হাদাগঙ্গারামের মতো। বালিশে চিত হয়ে শুয়ে আছেন পিতা। চোখদুটো খোলা। আকাশে ভোরের আলো ফুটেছে। পিতার মুখে এক ধরনের শান্ত হাসি, যেন আকাশে চিড় ধরছে। তিনি বললেন, কী হল হে! যেভাবে হাত তুলে কনক, কনক করছিলে, মনে হচ্ছিল ভুস করে আকাশে উড়ে না যাও। তোমার পেটগরম হয়েছে, জোড়া ডাব খেয়ো। আজ পয়সা দিয়ে যাব। উঠে পড়েছ যখন আর শুয়ে কাজ নেই। বাইরে গিয়ে কঁকা বাতাসে একটু পায়চারি করো।
আজ প্রায় সাত দিন হয়ে গেল কনকের কোনও খবর নেই। মেয়েটা একেবারে উবে গেল। পুলিশ নাকি বলেছেন, আমরা সারা ভারতবর্ষে ছবি ছড়িয়ে দিয়েছি। খোঁজপাত চলছে। না পেলে আমরা কী করতে পারি। যারা হারিয়ে যায়, তাদের সকলকেই কি আর পাওয়া যায়!
ভাগ্যিস বলেননি, মারা গেলে কী করতেন?
প্রতাপ রায়ের স্বরূপ বেরিয়ে পড়েছে। মেসোমশাইয়ের সঙ্গে আর তেমন ভাল ব্যবহার করছেন না। মেয়ে নেই, তা ভাবী শ্বশুরের সঙ্গে অত খাতির কীসের! মেসোমশাই এতদিনে বুঝেছেন, মানুষ কান ধরে টানে, মাথাটা কাছে আনার জন্যে। শুধু কানের কোনও কদর নেই। মেসোমশাই আজ আবার ফিরে আসছেন এ বাড়িতে। ব্যাক টু মেথুসেলা। এখন তার মনে হয়েছে, হরিদার মতো মানুষ। হয় না। যতই হোক একটা কুটুম্বিতার সম্পর্ক রয়েছে।
কোথা থেকে কনক এল, এসে একটা দাগা দিয়ে চলে গেল। যখনই মনে হচ্ছে কনক আর বেঁচে নেই, তখনই ভেতরটা হুহু করে উঠছে। কনকের মতো মেয়ে, একা পরিব্রাজিকা হয়ে বেরিয়ে যেতে পারে না। অসম্ভব। সে তো সিস্টার নিবেদিতা নয়, কিংবা সেই ভৈরবীও নয়, যিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে। সাধনা করাবার জন্য হঠাৎ দক্ষিণেশ্বরে এসেছিলেন।
কনকের খোঁজে তিন জন তিন ভাবে এগোচ্ছেন।
পিতা চলেছেন বিজ্ঞানের রাস্তায়। তিনি রাতের পর রাত অঙ্ক কষে চলছেন। একটি মেয়েকে যদি জোর করে বিয়ে দেবার চেষ্টা হয়, আর সে মেয়ে যদি স্বাধীনচেতা এবং শিক্ষিতা হয়, এবং যুগটা যদি আধুনিক, নারী স্বাধীনতার যুগ হয়, তা হলে মেয়েটি কী করবে! রুল অফ থ্রি লাগাও। নানারকম কেস হিস্ট্রি ঘেঁটে দেখো। অনুরূপ অবস্থায় কোন মেয়ে কী করেছে অনুসন্ধান করো, খোঁজ নাও। নিজের মনেই থেকে থেকে বলছেন, ইনভেস্টিগেশন, ইনভেস্টিগেশন। এখন তার অবস্থা প্রায় শার্লক হোমসের মতো।
আমি একটা কেসই জানি, সেইটাই বলতে গিয়ে ধমক খেয়ে ফিরে এসেছি। সে হল আমাদের। পাশের বাড়ির জবা। যাকে নিয়ে সুখেন দুর্গাপুরে পালিয়েছিল। যার জন্যে দীনু আজ পরলোকে। পিতা বললেন, ওটা হল সিম্পল রুল অফ থ্রি। চেয়েছি পেয়েছি। ও হল, মিঞা বিবি রাজি তো কেয়া করে কাজি। ওটা কোনও কেস নয়, ও হল কেলেঙ্কারি। এক ফুটোঅলা চৌবাচ্চার অঙ্কে হবে। না। চাই ডবল ফুটো। একটা ভোলা, একটা বন্ধ। আমার তো তেমন কোনও কেস জানা নেই।
মাতামহ কখনও চলেছেন আধ্যাত্মিক রাস্তায়, কখনও চলেছেন ভৌতিক রাস্তায়। মেসোমশাই ভাবছেন আইনের কথা। প্রতাপ রায়ের নামে একটা কেস ঠুকে দেবেন। হয় মেয়েকে খুঁজে দাও, নয় জেলে যাও। এদিকে কনক কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে। আগামীকাল অমাবস্যা। সেই ঘুরঘুরে বাবা পঞ্চমুণ্ডীর আসনে বসে ভূত নামাবেন।
সকালের চায়ে চুমুক দিতে দিতে পিতা বললেন, যদি একটা মেয়ে পেতুম!
কী করতেন?
শুধু মেয়ে পেলেই হবে না, তার স্বভাবটি হওয়া চাই কনকের মতো। তা হলে সেটা আমি রিকনস্ট্রাকট করতুম। প্রতাপের মতো একটা থার্ডক্লাসের সঙ্গে বিয়ের কথা পাড়তুম, তারপর সবসময় চোখে চোখে রেখে দেখতুম সে কী করে। এর মধ্যে আমি তিন ভম অপরাধ বিজ্ঞান পড়ে ফেলেছি। জানো কি, একটা খুনের কিনারা করতে আর একটা খুন করতে হয়!
আজকের কাগজে কনকের ছবি দিয়ে আবার একটা বিজ্ঞাপন করা হয়েছে। কনক, ফিরে এসো। তুমি যা চাও তাই হবে। বাবা। ছবিটা দেখছি, আর রাতের স্বপ্ন মনে পড়ছে। জানি, স্বপ্নের কোনও অর্থ হয় না, তবু ভয় হচ্ছে, কনক হয়তো বেঁচে নেই।
আমার কেবলই মনে হচ্ছে নৌকোয় দেখা সেই সতীমার কাছে যদি একবার যাওয়া যেত, তা হলে হয়তো সঠিক খবর পাওয়া যেত। মাতামহ কেন যে হঠাৎ ঘুরঘুরে বাবাকে নিয়ে মেতে উঠলেন! আগামীকাল হয়তো আবার ঘুরঘুরে বাবার আশ্রমে যাওয়া হবে। এবার রাতের দিকে, থাকতে হবে সারারাত। যেতে হবে বাসে। মেসোমশাই আজই যদি এখানে চলে আসেন, তা হলে প্রতাপ রায়ের গাড়ি কি আর পাওয়া যাবে!
আজ আমার জীবনের সাংঘাতিক একটি দিন। আজ থেকে শুরু হবে দাসত্ব। চাকরিতে বহাল হবার চিঠি এসে গেছে। মাইনেটা খুব একটা খারাপ নয়। আপাতত শ’ছয়েক। ফ্রি লাঞ্চ। তিন মাস শিক্ষানবিশির পর চাকরি পাকা হবে। তখন শ’আটেক মিলবে। পিতা অবশ্য খুশি নন। তাঁর মতে চাকরি যদি করতেই হয়, চার অঙ্কের কমে করা উচিত নয়। সে যোগ্যতা আমার নেই। অ্যাডমিনস্ট্রেটিভ সার্ভিসের পরীক্ষায় বসলে গোল্লা পাব। যা হয়েছে, আমার মতো বুন্ধুর পক্ষে ভালই হয়েছে।
ল্যাবরেটরি মানেই কারখানা। কারখানার নিয়মেই চলতে হবে। আট ঘণ্টা ডিউটি, শুরু সকাল সাড়ে আটটায়। তানানানা করার মতো সময় নেই বললেই চলে। নীচে প্রফুল্ল কাকারা এসে একদিকে ভালই হয়েছে। আমরা সবাই বেরিয়ে গেলে, নীচে বাড়ি আগলাবার জন্যে একটি প্রাণী অন্তত থাকবেন।
সংসারের কাজে আজ আমার ছুটি। প্রথম দিন, ঠিক সময়ে হাজিরা দিতে হবে। যেতে, বাসটাস বদলে কতক্ষণ লাগবে জানা নেই। পিতা বললেন, দেখো, আমার নামটা যেন ডুবিয়ো না। বেরোবার আগে গুরুজনদের ছবিতে প্রণাম করবে। আশীর্বাদ চাইবে। আজ তোমার জীবনের একটি পরিবর্তনের দিন।
বেরোবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সদরের দরজার কাছে এসেছি, দেখি কাকিমা দাঁড়িয়ে আছেন সামনে। হাতে একটা লাল টকটকে জবা। ফুলটি কপালে চুঁইয়ে দিয়ে বললেন, পকেটে রেখে দাও, মায়ের পায়ের ফুল। দুর্গা, দুর্গা। ছুটি হলেই চলে আসবে। এখানে-ওখানে আড্ডা মারবে না। মনে থাকে যেন, আমি একলা থাকব। এত বড় বাড়ি, সন্ধের দিকে ভীষণ ভয়ভয় করে।
মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। কোন সুদূরের এক মহিলা, মাতৃস্নেহে দাঁড়িয়ে আছেন দরজার পাশে, হাতে একটি ফুল নিয়ে। এ দেশের ছেলে সহজে কি সন্ন্যাসী হতে পারে। প্রতি পদে পিছুটান।
সেদিনের সেই ম্যানেজিং ডিরেক্টারের ঘর। ঢুকতে আজ আর বুক কেঁপে গেল না। স্নিগ্ধ বৃদ্ধ, পরিচ্ছন্ন মটকার পাঞ্জাবি পরে বসে আছেন। সামনে একটি বিশাল টেবিল। পেছনে কাঁচ-ঢাকা বুককেসে মোটা মোটা কেমিস্ট্রির বই। পিতার মুখে এই মানুষটির পরিচয় সামান্য জেনেছি। একসময়কার সেরা ছাত্র, সেরা বিপ্লবী। নামে ইংরেজ সরকার সিংহাসনে বসে কঁপত। বিদেশ। থেকে বোমার ফর্মুলা এনে দেশে সন্ত্রাসবাদীদের হাত শক্ত করেছিলেন। স্বামী প্রণবানন্দের প্রিয় শিষ্য। এখন গৃহী সন্ন্যাসীর আদর্শ জীবন কাটাচ্ছেন। যদিও অকৃতদার, প্রতিপাল্যের সংখ্যা নেহাত কম নয়। একটি অনাথ আশ্রম করেছেন। উপার্জনের অর্ধেক টাকা সেই আশ্রমেই ঢেলে দেন।
এত বড় একজন মানুষ অথচ শিশুর মতো সরল। ব্যক্তিত্বের কোথাও এতটুকু অহংকারের আঁশ নেই। চোখদুটি স্নিগ্ধ। স্নেহ মাখা। চশমার আড়ালে চুলটুল করছে, যেন ঘোর লেগেছে। আমাকে দেখেই বললেন, বোসো, মনে মনে তোমার কথাই ভাবছিলুম। খুব সকালে বেরিয়েছ, নিশ্চয় খাওয়া হয়নি!
আজ্ঞে হ্যাঁ, জলখাবার খেয়ে বেরিয়েছি।
কী জলখাবার খেয়েছ?
আজ্ঞে পাউরুটি আর চা।
ডিম নয়, দুধ নয়, শুধু চা আর পাউরুটি!
ওইটাই যে বেশ সহজে হয়।
তা হয়, তবে তোমার বয়েসের ছেলের আর একটু পুষ্টির দরকার। একটা করে মুরগির ডিম খেলে কেমন হয়! কোনও বাধা আছে?
আজ্ঞে না, তা নেই।
তা হলে কাল থেকে তাই খাবে। এখানে তোমাকে খুব খাটতে হবে। লাঞ্চ পাবে তো সেই একটার সময়। দাঁড়াও, দেখি, তোমাকে কী খাওয়ানো যায়।
আপনি ব্যস্ত হবেন না, আমার পেট বেশ জয়ঢাক হয়ে আছে।
ল্যাবরেটরিতে একবার গিয়ে ঢুকলে, তোমার ঢাক চুপসে যাবে। বুঝতে পেরেছি, তোমার লজ্জা হচ্ছে। সংকোচ হচ্ছে। হতেই পারে। যেহেতু আমি তোমার এমপ্লয়ার। ভুলে যাও, তফাতটা ভুলে যাও।
তিনি কথা বলতে বলতে ঘরের কোণের দিকে চলে গেলেন। সাদা রঙের একটি ফ্রিজ সেই কোণে গুনগুন করছে। দরজাটা টেনে খুলতেই হা করে একটা শব্দ বেরোল, যেন কোনও সাধক প্রাণায়ামে বসে ‘রেচক’ করলেন। যতক্ষণ দরজাটা খোলা রইল ততক্ষণ জলতরঙ্গ বাজতে লাগল মৃদু সুরে।
সাদা একটা প্লাস্টিকের বাটিতে জমাটমতো কী একটা বস্তু এনে আমার সামনে রেখে বললেন, নাও, খেয়ে নাও। এর নাম ‘ইয়োগহার্ট’। যেমন উপকারী, তেমনি সুস্বাদু।
বাবা, এমন বস্তুর নাম জীবনে শুনিনি। হার্ট যুক্ত শব্দ, সঙ্গে আবার ইয়োগ। অর্থাৎ যোগ। বাংলা করলে দাঁড়াবে যোগহৃদয়। সঙ্গে একটি সুদৃশ্য কাঠের চামচ। লজ্জা করলে চলবে না। খেতেই হবে। ঠিক আইসক্রিম নয়, অনেকটা দইয়ের মতোই স্বাদ, তবে ভেতরে প্রচুর কিসমিস, খেজুর, কুমড়োর বরফি, আমসত্ত্ব ঠাসা। বেড়ে তরিবাদি ব্যাপার।
প্রবীণ ম্যানেজিং ডিরেক্টার সস্নেহে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি যত খাচ্ছি, তার তত। তৃপ্তি হচ্ছে। এমন স্নেহপ্রবণ মানুষ কীভাবে এত বড় প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন! বইয়ে পড়েছি, শোষণ আর শাসনই হল ধনতন্ত্রের মূল কথা। কই মিলছে না তো?
পাত্র যখন প্রায় সাফ করে ফেলেছি, তখন তিনি প্রশ্ন করলেন, জিনিসটা কেমন?
আজ্ঞে অসাধারণ। একেবারে অমৃতোপম।
তোমার খুব খিদে পেয়েছিল। বুঝতে পারোনি?
খিদের সময় কমদিনই খেতে পেয়েছি, তাই খিদে কাকে বলে তেমন বুঝতে পারি না।
জানি, জানি, আমার ফ্রেন্ড হরিকে আমি চিনি। অতিমানব হবার সব গুণ নিয়ে মানব হয়ে বসে আছে। জানো, ওর স্বপ্ন ছিল, এই ধরনের এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার। সে প্রতিভাও ছিল। আমার চেয়ে একশোগুণ ভাল ছাত্র। আর আমি চেয়েছিলুম দেশসেবক, মানবসেবক হতে। দু’জনেই আজ লক্ষ্যভ্রষ্ট। পয়সা করেছি, কিন্তু মানুষ হতে পারিনি। যাও, হাত ধুয়ে এসো। ওই দরজাটা খোলো। ওটা বাথরুম। কাপটা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দাও।
হাতমুখ ধুয়ে ফিরে এলুম। ম্যানেজিং ডিরেক্টার নিচু হয়ে বুককেসের তলা থেকে ঘড়ির মতো কী একটা বস্তু টেনে বের করলেন। কাটা বসানো।
এসো, এর ওপর দাঁড়াও, তোমার ওজনটা নিয়ে রাখি।
ওজন?
হ্যাঁ, ওজন। তুমি কতটা আন্ডারওয়েট, আমার দেখা দরকার। এক মাসের মধ্যে তোমাকে আমি মোটা করে দোব। শরীরম, আদ্যম, খলু ধর্ম সাধন।
যন্ত্রে উঠে দাঁড়ালুম। ঝুঁকে পড়ে কাটাটা দেখে বললেন, অনেকটা বাড়াতে হবে। শুধু দইয়ে হবে না, মধু চাই, মুরগি চাই, চিজ চাই, ছোলা চাই, ভিটামিন চাই, মিনারেলস চাই। আমাদের লাঞ্চ খুব ভাল, ব্রেকফাস্ট আর ডিনারটাকে যদি সামলাতে পারো, একমাসে তোমার উন্নতি হতে বাধ্য। আচ্ছা, এবার তা হলে চলো।
দুটো বাড়ির মাঝখানে সেতুর মতো ঝুলবারান্দা। বারান্দা শেষ হয়েছে জাহাজের ডেকের মতো একটা জায়গায়। মোটা মোটা লোহার চাদর। নীচের দিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছে বিশাল কারখানা। বিরাট একটা ভ্যাটে সাবান ফুটছে। ক্ষার ক্ষার ধোঁয়া উঠছে। এক দিকে একটা বয়লার। মাঝে মাঝে রেল ইঞ্জিনের মতো বাষ্প ছাড়ছে। নানারকম কেমিকেলসের গন্ধ ভেসে আসছে। সব গন্ধ ছাপিয়ে উঠছে ন্যাপথলিনের গন্ধ। ছোট ছোট ট্রলি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
একটা ছোট সিঁড়ি ভেঙে আমরা একটা নতুন ব্লকে চলে এলুম। এবার নাকে আসছে অন্য গন্ধ। এ গন্ধ আমার ভীষণ চেনা। কলেজ ল্যাবরেটরিতে এঁকে এসেছি। অ্যাসিড ইথার। ল্যাবরেটরিটি বেশ আধুনিক। নেহাত ছোট নয়। জনা দশেক কেমিস্ট এরই মধ্যে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। খাড়া খাড়া ব্যুরেট। র্যাকে র্যাকে সাজানো রি-এজেন্টের বোতল। ত্রিপদে গলা উঁচিয়ে আছে ডিস্টিলেশন জ্বার। বুনসেন বার্নার জ্বলছে। প্রতিটি টেবিলের শেষে বেসিন আর কল।
বই-ঠাসা কাঁচের ঘরে বসে আছেন ডিসপেপটিক চেহারার এক ভদ্রলোক। অ্যাপ্রন-পরা অবস্থায় তাকে ফাদারের মতো দেখাচ্ছে। ল্যাবরেটরিতে ম্যানেজিং ডিরেক্টার ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কর্মীরা বেশ চঞ্চল হয়ে উঠলেন। যিনি কিছুই করছিলেন না, তিনি হাতের কাছে কিছুই না পেয়ে একটা খালি টেস্টটিউব চোখের সামনে তুলে ধরে গভীর মনোযোগে ভেতরের বাতাস দেখতে লাগলেন।
এম ডি ডাকলেন, প্রদ্যোত, উঠে এসো।
ইনিই সেই প্রদ্যোতবাবু, যাঁর হাতে আমাকে ফেলে দিলে একমাসেই মানুষ করে দেবেন। প্রদ্যোতবাবুর চোখে যে-চশমাটা ছিল, সেটা খুলে, দ্বিতীয় আর একটা চশমা পরে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। সামনের দিকে ঝুঁকে ছিলেন। কোমরের পেছন দিকে দু’হাত রেখে শরীরটাকে সোজা করতেই ঢেউ করে একটা সেঁকুর উঠল। মুখে হাত চাপা দিয়ে বললেন, সরি। বুড়ো আঙুল ছাড়া সব আঙুলেই একটা করে আংটি। ভাগ্যকে পাথরের চেন দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছেন।
এম ডি বললেন, পেটে মনে হচ্ছে শুম্ভনিশুম্ভের লড়াই চলেছে।
আজ্ঞে হ্যাঁ, মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হল পেট। এইবার একটু হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড খাই। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের টেবিলের এক ভদ্রলোককে বললেন, সুধীর, অ্যানালার এইচ সি এল কয়েক ফোঁটা জলে গুলে দাও তো!
সুধীরের চেহারাটি বেশ হৃষ্টপুষ্ট। তিনি বার্নারের ওপর বিশাল একটি কেটলি বসিয়ে নল দিয়ে বাষ্প বেরোনো দেখছিলেন। তিনি বললেন, চা খাবেন না স্যার?
চা-ও খাব, অ্যাসিডও খাব। এবার থেকে আমি সব খাব।
এম ডি বললেন, এ ভেরি গুড ডিসিশন। না-খেয়ে মরার চেয়ে খেয়ে মরা ভাল। আচ্ছা, এই নাও, এই ছেলেটিকে তৈরি করো। পলাশ চট্টোপাধ্যায়। নাড়াচাড়া করলেই বুঝতে পারবে কী জিনিস! ভেতরে একটু আগুনটাগুন আছে! শোনো পলাশ।
বলুন।
প্রদ্যোত বেসিকেলি বড় ভাল ছেলে। তবে একটা দপ্তর চালায় তো, চিফ কেমিস্ট, তার ওপর পেটরোগা, তাই মেজাজটা তেমন সুবিধের নয়। মাঝে মাঝে আমাকেও দাঁতমুখ খিচোয়। তা নিয়মটা হল, ও খিচোলে তুমি খিচোবে না। চুপ করে থাকবে। মনে মনে প্রার্থনা করবে, ঈশ্বর, তুমি এঁর ক্রনিক ডিসপেপসিয়া ভাল করে দাও। আচ্ছা প্রদ্যোত?
আজ্ঞে বলুন!
আমি তোমাকে কী বলেছিলুম?
আজ্ঞে যোগাসন।
হচ্ছে?
মাঝে মাঝে।
কই দেখি, অর্ধমৎস্যেন্দ্রাসনটা করে দেখাও তো?
এখানে?
বেশ, আমার ঘরে চলো। কার্পেটের ওপর করবে।
ওটা বড় কঠিন। আমার পক্ষে শবাসনটাই বেস্ট।
সুধীরবাবু আধ গেলাস জল প্রদ্যোতবাবুর হাতে দিলেন। ঢকঢক করে খেয়ে গেলাসটা ফিরিয়ে দিলেন। এম ডি বললেন, বাঁচতে যদি চাও আসন করো প্রদ্যোত, আসন করো।
আসন করো, সাধন করো, বলতে বলতে এম ডি ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে গেলেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমাকে বললেন, পলাশ, মন খারাপ লাগলে আমার কাছে চলে এসো। আর হ্যাঁ, রোজ সকালে আমার সঙ্গে দেখা করে, তবে এখানে আসবে। জানো তো, সব পুজোর আগে গণেশ পুজো?
চিফ কেমিস্ট ভদ্রলোক বললেন, সুধীর, এক গেলাস চা বেশি হবে?
হ্যাঁ স্যার, জল ঢেলে দিয়েছি।
নতুন একটা অ্যাপ্রন বের করে দিয়ে, একটা ভোয়ালে।
দিচ্ছি স্যার।
রবিবাবু?
বলুন।
দীর্ঘ চেহারার মিষ্টি একজন মানুষ এগিয়ে এলেন। পোশাক পরিচ্ছদে একেবারে টিপটপ। মুখে চোখে সুস্বাস্থ্যের ঝিলিক। হাসিহাসি মুখ।
পলাশকে আপনার হাতে তুলে দিলুম। তৈরি করে নিন।
রবিবাবু আমার কাঁধে একটি হাত রাখলেন। আমার দাদা নেই। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, দাদা যেন কাঁধে হাত রেখেছেন। সেই জয়ামাতা আমাকে একটি দৃষ্টি দান করেছিলেন, চোখের ভেতর দিয়ে মানুষের অন্দরমহল দেখার ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা এখনও হারায়নি। রবিবাবুর ভেতরটা দেখতে পাচ্ছি। ঊষার আকাশের মতো বর্ণময়, শুদ্ধ, সাত্ত্বিক। আমার ভেতরে যেন আনন্দের হিল্লোল বইছে। এত ভাল লোক এক জায়গায় এসে মিললেন কী করে?
বাতাসের মতো মৃদু স্বরে রবিবাবু বললেন, এসো। এসো বললুম বলে রাগ করলে না তো!
আজ্ঞে না।
আজকে আমি সারাদিন কাজ করব, তুমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে দেখবে। তুমি হবে তন্ত্রধারক। গোটাকতক জিনিস তোমাকে অবশ্য শিখতে হবে। তার মধ্যে প্রথম হল সেফটি। কোন জিনিস কার সঙ্গে কীভাবে মেশাবে! কীভাবে তাতাবে। কেউ স্বভাবে রাগী, কেউ ঠান্ডা। অ্যাসিড, অ্যালক্যালি আর নিউট্রাল, এই নিয়েই আমাদের কারবার। আচ্ছা, এসো, এখন আমাদের টি ব্রেক।
গেলাসে গেলাসে চা নিয়ে শুরু হল আমাদের চা-পর্ব। কেউ বসেছেন চেয়ারে, কেউ উঁচু টুলে। সকলের সঙ্গে আলাপ পরিচয় জমে গেল। রবিবাবু হলেন কেমিস্ট-ইনচার্জ। আর একজন ইনচার্জের নাম সমীরবাবু। গোলগাল, বেঁটেখাটো মানুষ। আপেলের মতো গায়ের রং। কুচকুচে কালো চুল। ইনিও খুব আস্তে কথা বলেন। জমিদার ফ্যামিলির ছেলে। এই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন কাজ করছেন।
চারদিকে বুনসেন বার্নার জ্বলছে। বাইরে গরম, ভেতরে আরও গরম। তার ওপর গরম চা? রবিবাবু বললেন, প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে। পরে সবই সহ্য হয়ে যাবে। মানুষ কী না পারে! নাও, ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়া কোডেক্সটা খোলো। আমরা এখন টেস্ট করব, সোডিয়াম স্যালিসিলেট। তুমি পড়ে পড়ে বললো, আমি তোমার সামনে স্টেপ বাই স্টেপ এগোতে থাকি।
বেলা এগারোটার সময় ল্যাবরেটরি কাঁপয়ে এক ভদ্রলোক এলেন। দৈত্যের মতো বিশাল চেহারা। শালপ্রাংশু মহাভুজ। এই প্রথম একজনকে পেলুম, যিনি গলা ছেড়ে কথা বলেন, ঘর ফাটিয়ে হাসেন। এনার নাম জিমূতবাবু। ইনি মাল তৈরি করার কেমিস্ট। নীচের বিশাল কারখানায় এনার সাম্রাজ্য। সেখানে সারাদিন জলদস্যুর মতো হাঁকডাক করে ঘুরে বেড়ান।
জিমূতবাবু করমর্দনের জন্যে আমার সামনে হাত বাড়িয়ে দিলেন। বাঘের থাবায় আমার বেড়ালের থাবা তিনবার নেচে উঠতেই মনে হল কাঁধের কাছ থেকে আমার হাত খুলে বেরিয়ে যাবে। হাত ছেড়ে দিয়ে তিনি বলতে লাগলেন, আজ মাংস, আজ মাংস।
জিমূতবাবু আমাদের লাঞ্চ ইনচার্জ। যেদিন মাংস হয়, জিমূতবাবু সেদিন নিজে মাংস রাঁধেন। সে রান্না হয় নীচের কারখানায়, স্টিমে।
জিমূতবাবু বললেন, আজ তা হলে পরিমাণটা একটু বাড়িয়ে দিতে হবে। খেয়ে বলবেন, কেমন হয়েছে। সুবীর, তুমি তা হলে পৌনে একটার সময় নীচে যাবে।
জিমূতবাবু চলে গেলেন। ল্যাবরেটরি নিস্তব্ধ। বিকারে ফোঁটা ফোঁটা রি-এজেন্ট পড়ার শব্দ। ফ্লাস্কে জল ফোঁটার শব্দ। ফিল্টার পেপার লাগানো ফানেল থেকে টিপটিপ করে নেমে চলেছে তরল পদার্থ। সার সার বোতলে টলটল করছে নানা রঙের রি-এজেন্ট। বাতাসে উত্তাপ কঁপছে, ইথার আর ক্লোরোফর্মের গন্ধ ভাসছে।
রবিবাবু বললেন, চলো, সেনসিটিভ ব্যালান্সে কীভাবে ওজন করতে হয় তোমাকে শেখাই।
ঘণ্টা তিনেক হয়ে গেল, ঠায় একভাবে দাঁড়িয়ে আছি। এখানে বসার উপায় নেই। পা দুটো ইতিমধ্যেই বেশ ভারী হয়ে উঠেছে। ফুলোফুলো লাগছে। আলাদা একটা ঘরে, কাঁচের আধারে সারি সারি ওজন যন্ত্র। এর মধ্যে একটা-দুটো এত সূক্ষ্ম যে হাওয়া ওজন করা যায়। এই একটি মাত্র জায়গা যেখানে একটু বসা চলে।
সাড়ে চারটের সময় রাস্তায় নেমে মনে হল, আর এক পা-ও হাঁটতে পারব না। পা দুটো থামের মতো ভারী হয়ে উঠেছে। জুতো দু’পাটি কাপ হয়ে বসে গেছে। মাথা টলছে। একটা জিনিসই মুখে লেগে আছে, জিমূতবাবুর রান্না করা বাষ্পপক্ক মাংস। বেশ বড় মাপের মাটির ভাড়ে সেই মাংস যখন। ঘরে এসে ঢুকল, গন্ধেই আমি কুপোকাত। যেমন তার বর্ণ, তেমনি তার স্বাদ। পাঁঠার মতো একটা জিনিস যে এইভাবে রূপান্তরিত হতে পারে আমার জানা ছিল না। আজ এই খেয়ে বুঝলুম। না, প্রতিষ্ঠানটি সত্যিই সর্বাঙ্গসুন্দর। জয় বাঙালি। ভাগ্য এতদিনে মুচকি হেসেছে। শেষরক্ষে হলে হয়।
সামনেই সেদিনের সেই পার্কটা। একটু বসে যাই। অনেকটা গেলে, তবে বাস কি ট্রাম মিলবে। আয়ারা প্যারাম্বুলেটরে চাপিয়ে ফুটফুটে সব বাচ্চা নিয়ে এসেছে। আগামী পৃথিবী মনে হয় খুব সুন্দর হবে। আজকের মতো সূর্য বিদায় নিচ্ছে। বাতাসে রাতের শীতল ওড়না উড়ছে। সবুজ ঘাসের দিকে তাকিয়ে কনকের কথা মনে পড়ে গেল। কনক এখন কোথায়?