১.২৭ আমার যেমন বেণী তেমনি রবে
আমার যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভেজাব না
ভীষণ মেঘ করেছে। দুপুরে রাত নেমেছে। প্রকৃতি থমকে আছে। বৃষ্টি এল বলে। ঝক ঝক চিল উড়ছে মন্দিরের মাথায়। সারা আকাশ ছেয়ে গেছে। দিগন্তের এক হাত ওপরে কালো মেঘের পুরু। রুটি ভাসছে। বছরের প্রথম বড় ধরনের বৃষ্টি আসছে খুব তোড়জোড় করে। একটা চাতক করুণ। সুরে ডাকছে– জল দাও, জল দাও।
এমন দিনে একটা কাজই করা চলে, বেশ আয়েশ করে শুয়ে শুয়ে বই পড়া। সুখেন নেই যে জ্বালাতে আসবে। দীনু চিরকালের জন্য চলে গেছে। দীনুর পিতা বিলেত থেকে ফিরে এসেছেন। দীনুর সেই খুনি মোটরসাইকেলটার কিচ্ছু হয়নি। আরোহীকে ছিটকে ফেলে দিয়ে যন্ত্রদানব এখন বেশ বহাল তবিয়তে গ্যারেজের একপাশে দু’পা ফেলে পঁড়িয়ে আছে।
মানুষ কত কী যে রটাতে পারে! আজকাল মাঝরাতে একটা মোটরসাইকেলের আওয়াজ পাওয়া যায়। হয়তো থানার অফিসার ইনচার্জ রোদে বেরোন। বেরোতেই পারেন। সেইটাই স্বাভাবিক। বিশেপাগলা মুদির দোকানের রকে শুয়ে থাকে। পাগলাদের কল্পনাশক্তি মনে হয় প্রবল। কেমন রটিয়ে দিয়েছে! লাল আগুনের মতো মোটরসাইকেল চেপে, জ্বলন্ত দীনু ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে নীল ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে। সোনার চামরের মতো মাথার চুল উড়ছে। টকটকে পেতলের মতো গায়ের রং। সে তোমরা না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না। আওয়াজ শুনে একদিন তাড়াতাড়ি উঠে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলুম। দেখেছিলুম, তবে মোটরসাইকেল আরোহী দীনুকে নয়, একঝলক বাতাস চলে গেল ছেঁড়া কাগজ আর শালপাতা টানতে টানতে।
সকালে যা হয় একটা কিছু রাঁধলেই চলে। নীচে থেকে প্রফুল্ল কাকিমা একটা না একটা কিছু দিয়ে যান। পিতৃদেব স্পর্শ করেন না। বলেন স্বপাকই বেস্ট পাক। সবটা একলা আমাকেই সাবড়াতে হয়। রাধেন ভাল তবে ঝালের হাতটা একটু বেশি। আজ করেছিলেন নারকেল কোরা দিয়ে মোচার ঘন্ট। ছোলাটোলা ছিল। বেশ তরিবাদি ব্যাপার। ঝালের চোটে পেট এখনও জ্বলছে।
মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে কত কথাই মনে আসছে। মাতামহ অনেকদিন আসেননি। আজ। বিকেলের দিকে একবার খবর নিতে পারলে ভাল হত। আকাশের যা ঘনঘটা আয়োজন, বিকেলের দিকে মেঘমল্লার জলসা শুরু হবেই। মেঘের পাখোয়াজ শুরু হয়ে গেছে।
কনকটা আচ্ছা ঘোটলোক। না, কনকের আর দোষ কী! মেসোমশাই যেমন চালাবেন, তেমনই তো চলবে। মেয়েরা হল গাড়ির মতো। চালক যেভাবে চালাবে, সেইভাবে, সেই দিকেই চলতে হবে। প্রতাপ রায় একজন মালদার লোক। ফকিরে কি আর সংসার করতে পারে! উপন্যাসেই প্রেমের জয়জয়কার। জীবনে শুধু লাভ-ক্ষতি, দেনা-পাওনা।
বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল। ঘর অন্ধকার। আলো জ্বালতে পারলে ভাল হয়। পাতলা চাদর মুড়ি দিয়ে এবার দিবানিদ্রা। সামনের বাড়ির টিনের চালে বৃষ্টি নাচছে। দরজার বাইরে ক্ষীণ চুড়ির শব্দ। হল। কনক এল নাকি! কাকিমা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
বাঃ বেশ মজা করে শুয়ে আছ! লেখাপড়া নেই?
থাকলেও করা যাবে না। বর্ষায় ঘুম।
কাকিমা ঘরে ঢুকে পড়লেন। বিছানার একপাশে বসে বললেন, আমার সব গুল ভিজে গেল।
তুলে ফেলুন।
তোলার উপায় নেই, একেবারে ভিজে।
বেশ বড় করে একটা হাই তুললেন। একে দুপুর, তায় বর্ষা। আলসে লেগেছে। বর্ষায় আমাদের নীচেটা যক্ষপুরীর মতো হয়ে ওঠে। অন্ধকার, ড্যাম্প, নোনা ধরা দেয়াল। ওপরে এসেছেন বেশ করেছেন, তবে খাটে না বসলেই পারতেন! বিছানায় বসা উচিত নয়। চেয়ার রয়েছে, সোফা রয়েছে। চক্ষুলজ্জায় কিছু বলতেও পারছি না।
পিন্টু, তোমার বাবার কাছে তো অনেক ওষুধ থাকে!
কী ওষুধ বলুন? হোমিওপ্যাথিক!
এই ধরো কেটেকুটে গেলে লাগাবার মতো কিছু।
হ্যাঁ আছে। দিচ্ছি দাঁড়ান। হাত কেটেছে বুঝি!
সেই উঠতে হল। শোবার উপায় কি ভগবান রেখেছেন! আয়োডিনের শিশিটা নিয়ে এলুম।
বলুন, কোথায় লাগাতে হবে?
কাকিমার ঠোঁটে লাজুক হাসি, তুমি একটু লাগিয়ে দেবে!
কেন দেব না।
কিছু মনে করবে না?
মনে করব কেন?
ধীরে ধীরে পিঠের আঁচল সরালেন। গায়ে যে জামা ছিল না, এতক্ষণ লক্ষ করিনি। মেয়েদের পিঠ, ফরসা ধবধবে। তেলা টানটান চামড়ার ওপর এপাশ থেকে ওপাশে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে একটা লাল দাগ। দেখলেই গা শিউরে ওঠে। চামড়া ফেটে দুফাঁক হয়ে গেছে।
ভয়ে, আতঙ্কে আর একটু হলেই হাত থেকে আয়োডিনের শিশি পড়ে যাচ্ছিল। কাকিমা সামনে ঝুঁকে বসে আছেন। এই ক্ষতের ওপর আয়োডিন পড়লে অসম্ভব জ্বলবে। সে জ্বালা আমি সহ্য করতে পারব না। কে এমন করলে! মানুষে না জানোয়ারে!
কাকিমা বললেন, কী হল, লাগিয়ে দাও।
এ আমি পারব না কাকিমা। অসম্ভব জ্বলবে।
এমনিই তো জ্বলছে, ওষুধে না হয় আর একটু জ্বলবে। তুমি নির্ভয়ে লাগিয়ে যাও।
কী করে এমন হল?
ও আমার মাঝে মাঝেই হয়। বরাতে হয়। কেন হয়, সে আর তোমাকে আমি বলতে পারব না।
সুখেনকে হেডমাস্টার মশাই একবার সপাসপ বেত মেরেছিলেন। সারাপিঠ এইভাবে ফেটে ফেটে, দাগড়া দাগড়া হয়ে গিয়েছিল। রেড়ির তেল লাগিয়ে সুখেন সেরেছিল। আয়োডিনের বদলে রেডির তেল লাগাতে পারলে, হয়তো আরাম পেতেন। পাব কোথায়!
যা থাকে বরাতে, আয়োডিনই লাগাই। কাঠিতে বেশ মোটা করে তুলো জড়িয়ে একটু একটু করে আয়োডিন লাগাচ্ছি। পিঠটা থিরথির করে কাঁপছে। চারপাশে শিশিরের দানার মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটছে। কাকিমার কী হচ্ছে জানি না, আমার কিন্তু চোখ ফেটে জল আসছে। এ ওই গোঁয়ারগোবিন্দ তবলচি ব্যাটার কাজ। জানোয়ার। কেন ব্লাউজ পরেননি এখন বুঝতে পারছি।
পিঠের দিকটা খুলে রাখলে তুমি কিছু মনে করবে পিন্টু?
না না, মনে করব কেন?
খাটে বসেছিলেন বলে, একটু আগে আমার খারাপ লেগেছিল। এখন আর লাগছে না। একটু বাতাস করে দিলে, মনে হয় আরাম পাবেন। পাখাটা নিয়ে আসতেই খপ করে হাত চেপে ধরলেন। মুখ দেখলে বোঝা যায়, খুব জ্বালা করছে। অন্য কেউ হলে চিৎকার করতেন। এ মহিলার অসম্ভব সহ্যশক্তি।
ছাড়ুন, একটু বাতাস করে দিই। জ্বালা কমবে।
দুর পাগল। জ্বালা কি কমে? সহ্য করতে হয়। নাও, তুমি শুয়ে পড়ো। আমি একটু বসে চলে যাই। কাজ পড়ে আছে।
অসম্ভব জোরে বৃষ্টি পড়ছে। এইরকম জোরে ঘণ্টাখানেক পড়লেই জল জমে যাবে। বিখ্যাত ঠনঠনেতে একবুক জল হবে। পিতৃদেবের বাড়ি ফিরে আসতে আজ জীবন বেরিয়ে যাবে। চাদর চাপা দিয়ে আবার জানলার ধারে গিয়ে বসলুম। গুঁড়িগুঁড়ি জলকণা উড়ে আসছে।
সারাআকাশ ফাটিয়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। ভয়ে কানে আঙুল দিলুম বিকট শব্দ হল বলে। না, তেমন শব্দ হল না। বহু দূরে আকাশের হুমকি বাজল গুমগুম করে।
কাকিমা বললেন, আওয়াজকে বড় ভয় করে। বৃষ্টি হয় তোক। তুমি বাজ পড়া দেখেছ?
না, শুনেছি বাজ পড়লে গোবর চাপা দিতে হয়, তা হলে নাকি নীলমতো একটা বল পাওয়া যায়।
ধুস, ওসব গল্পকথা। আমি কত সাপ দেখেছি, একটারও মাথায় মণি দেখিনি। আমার ভীষণ হিরের নাকছাবি পরার শখ। একটা মণি পেলে কাটিয়ে আংটি আর নাকছাবি করিয়ে নিতুম। গল্পের সেই দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেল বলো তো, সেই পক্ষীরাজ ঘোড়া, রাজপুত্র, সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি।
দিন হারায়নি কাকিমা, গল্প হারিয়ে গেছে। যত দিন যাচ্ছে, পৃথিবী তত সেয়ানা হয়ে উঠছে।
নাঃ, কাকিমাকে এক ডোজ আর্নিকা খাইয়ে দিই, ব্যথা অনেক কমে যাবে। চাদর ফেলে আমাকে উঠতে দেখে কাকিমা বললেন, কী হল আবার?
কিছু না, আপনাকে এক পুরিয়া ওষুধ খাইয়ে দিই। ব্যথা কমে যাবে।
মনে হচ্ছে, জ্বর আসছে পিন্টু। শীতশীত করছে।
আর্নিকার শিশি হাতে কাকিমার সামনে এসে দাঁড়ালুম। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছেন।
নিন, জিভটা বের করুন, গোটাকতক গুলি ঢেলে দিই।
শিশির পেছনে টুস টুস করে গোটাকতক টুসকি মেরে সাত-আট দানা ওষুধ জিভের ওপর সবে ছেড়েছি, বিদ্যুতের আলোয় আকাশে ঢেউ খেলে গেল। কানে আঙুল দেবার সময় নেই। প্রচণ্ড শব্দে কাছেই কোথাও বাজ পড়ল।
শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কাকিমা, ও মা, বলে দু’হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি বসে, আমি দাঁড়িয়ে। টাল সামলানো গেল না। হুমড়ি খেয়ে সামনে, মহিলার ঘাড়ে। দু’জনেই বিছানায় চিতপাত। কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়েছে। খুব কাছে। বাতাস গরম। নাকে পোড়াপোড়া গন্ধ।
আকাশ আবার চমকাল। আবার বজ্রপাতের শব্দ। মহিলার ভীত আলিঙ্গন আরও দৃঢ়। এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছেন! এভাবে না জড়ালেই ভাল হত। শরীরেরও তো চৌম্বক শক্তি আছে। এই মুহূর্তে নিজেকে আর পিন্টু বলে ভাবা যায় না। সেই পুরুষ ও প্রকৃতি। ঘনঘোর আকাশে, ঝোড়ো বাতাসে, মেঘ ছিঁড়ছে, মেঘ জুড়ছে, গাছের মাথা দুলছে উন্মত্ত আনন্দে, বিদ্যুৎ শিউরে শিউরে উঠছে, আকাশ কখনও চাপা, কখনও মুক্ত গর্জনে প্রকৃতিকে শাসন করছে।
সারা চাঁদরে ভিজেভিজে আর্নিকার গুলি। শিশি ছিটকে চলে গেছে বালিশের পাশে। রাত না দুপুর! পিন্টুর পিন্টুত্ব লুপ্ত। শরীরে বড় কষ্ট। কষ্টে আনন্দ, আনন্দে কষ্ট, চোখে আকাশ অদৃশ্য। মাতাল বর্ষায় বড় রমণীয় স্থানে আশ্রয় পেয়েছি। ছেড়ে যেতে চাই, মুক্তি নেই। মনে সে জোর নেই। নিজেকে এবার চিনতে পেরেছি। ভণ্ড তপস্বীকে।
যেমন হঠাৎ জড়িয়ে ধরেছিলেন, তেমনি হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে কাকিমা জানলার ধারে চলে গেলেন। বিছানায় পড়ে আছি চিতপাত। মনে একটু পাপের ফেঁসো এখনও লেগে আছে, তা না হলে এমন হতভম্ব হয়ে যাব কেন? মা কি সন্তানকে জড়িয়ে ধরতে পারেন না, খুব পারেন, একশোবার পারেন। ওই কথামৃত পড়ার ফলে, আমার এইরকম কলা খাইনি গোছের অবস্থা হয়েছে। কিন্তু ঠাকুর রামকৃষ্ণ যে বলেছেন, মেয়েদের সঙ্গে বসা কি বেশিক্ষণ আলাপ, সেও একপ্রকার রমণ। রমণ আট প্রকার,
স্মরণং কীর্তনম কেলিঃ প্রেক্ষণং গুহ্য ভাষণং।
সংকল্লোহধ্যাবসায়শ্চ ক্রিয়ানিষ্পত্তিরেব চ এতন্মৈথুনমষ্টাঙ্গং ॥
মেয়েদের কথা শুনছি; শুনতে শুনতে আনন্দ হচ্ছে, ও এক রকম রমণ। মেয়েদের কথা বলছি [কীর্তনম্], ও এক রকম রমণ; মেয়েদের সঙ্গে নির্জনে চুপিচুপি কথা কচ্ছি, ও এক রকম। মেয়েদের কোনও জিনিস কাছে রেখে দিয়েছি, আনন্দ হচ্ছে, ও এক রকম। স্পর্শ করা, আর এক রকম। তাই গুরুপত্নী যুবতী হলে পাদস্পর্শ করতে নেই।
অবশ্য, এ বিধিনিষেধ সবই হল সন্ন্যাসীদের জন্য। সংসারীদের আলাদা কথা; দু’-একটি ছেলে হলে ভাই-ভগ্নীর মতো থাকবে; তাদের অন্য সাত রকম রমণে তত দোষ নেই। কিন্তু, আমি তো সংসারীও নই, সন্ন্যাসীও নই। যখন সন্ন্যাসী হয়ে ছিটকে বেরিয়ে যাব, তখন আর মহিলাটহিলা কোথায়! বরফ ঢাকা হিমালয়। ছোট্ট একটা গুহা। যা হয়ে গেল, তাতে কি আমার আনন্দ হল! না, হয়নি। মনে হচ্ছে একটু হয়েছে। মরেছে। কাকিমা তো একটা পাতানো সম্পর্ক। আসলে তো রমণী। মধ্যবয়স্ক তরুণী ভার্যা।
জানলার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখি। দাঁড়িয়ে আছেন সেই একভাবে। উদাস চোখ। চোখের দু’কোলে জলের ধারা। কাঁদছেন কেন? আমি তো কিছু করিনি। চড়াক করে আবার একটা বাজ পড়ল। কাকিমা চমকে জানলার ধার থেকে সরে এলেন। আবার হালুম করে বুকে এসে পড়ার ভয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলুম।
কাকিমা খাটের বাজু ধরে দাঁড়ালেন।
কাঁদছেন কেন আপনি?
এই একটি কথায় নীরব অশ্রু সরবে বইতে শুরু করল। মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
কেউ কাঁদলে মন এমনিই দুর্বল হয়ে পড়ে, মহিলারা কাদলে তো কথাই নেই।
আমাদের দু’জনের দূরত্ব খুব বেশি নয়। ইঞ্চি দুয়েক কাঠের ব্যবধান। কান্নার আবেগে বুক ফুলে ফুলে উঠছে।
আপনি কাঁদছেন কেন?
আমাকে একটু বিষ জোগাড় করে দিতে পারো?
বিষ?
হ্যাঁ বিষ।
আপনার কীসের দুঃখ!
দুঃখু? বলো, কীসের সুখ!
আপনি এদিকে এসে বসুন। জীবন মানেই দুঃখ। তা হলে সব মানুষকেই তো আত্মহত্যা করতে হয়! কাকিমার হাত ধরে টেনে এনে খাটের পাশে বসিয়ে দিলুম। বেশ আপনজনের মতো বসেছেন। কী জানি কেন, মনে এখন আর তেমন কোনও ব্যবধান নেই। একটু আগে লজ্জা করছিল, এখন মায়া এসেছে। মমতা-মাখানো সরল মুখ, অপরূপ একটি শরীর! মাতুলের স্টুডিয়োতে সেদিন যে বাইজির দল এসেছিল তাদের থেকে এঁর চেহারায় কীসের কমতি! গৃহবধূ হয়ে পড়ে পড়ে মার খাচ্ছেন। বেঁচে থাকার ধরনটা সাহস করে পালটে ফেলতে পারলে, রানি মহেশ্বরী। সংস্কারে আটকে আছেন।
আপনার বাপের বাড়িতে কে কে আছেন?
কেউ নেই। সব খেয়ে বসে আছি। আর থাকলেই বা কী হত। বিয়ের পর মেয়েদের বাপের বাড়ি থাকে না।
এইরকম একটা মানুষকে বিয়ে করলেন কেন?
আমি করব কেন? আমার মামা করিয়ে দিলে। আমার মামা আর এর মামায় খুব আলাপ ছিল।
আপনার মামা কোথায়?
ওপারে।
এখানে আসার আগে কোথায় ছিলেন?
এর মামার বাড়িতে। এর মামার অবস্থা বেশ ভাল। একলা মানুষ। ব্যাবসাট্যাবসা আছে। ব্যায়লা বাজায়, একটু মদদ খায়। মানুষটা খুব উদার। বড় বাড়ি।
চলে এলেন কেন?
আমি আসব কেন? উনিই চলে এলেন। বুড়োকে মারধর করে।
মারধর করে কেন?
সে অনেক ব্যাপার। নোংরা ব্যাপার। তোমাকে বলতে আমার লজ্জা করবে। এতদিন পরে ওনার মনে হল, বুড়োর চরিত্র খারাপ। আর প্রথম থেকে আমাকে বলে এল, মামাকে একটু তোয়াজ করো, বুড়োর কেউ নেই, মরলে সব আমাদের। তুমিই বলো, বুড়োমানুষের কী চরিত্র খারাপ হবে! বুড়োরা তো এমনিই বুড়ো।
সে আপনি বলতে পারবেন।
আমি তো বলছি, মামাশ্বশুর দেবতার মতো মানুষ। বয়েস হয়েছে তাই বাতের রোগে ভোগেন। গা হাত পা বেশ কিছুক্ষণ টিপে না দিলে রাতে ঘুম আসত না। অ্যায় শুরু হল অশান্তি। মুখের তো কোনও বাঁধন নেই। রাগলে নালা নর্দমা। কেবলই বলে, তুমি টেপো না তোমাকে টেপে।
থাক থাক, আর শুনতে চাই না।
না, শুনে কাজ নেই। আমিও বলতুম না, যখন মারধর করে, তখন মনে হয় সত্যিই খারাপ হয়ে যাই। ওই মামাশ্বশুর আমাকে সাত ভরি সোনার গয়না করিয়ে দিয়েছিলেন, বাবু সব উড়িয়েছেন। মামার ভালটা পায়নি, মামার কাপ্তেনিটা পেয়েছে। তার অনেক আছে, তোমার কী আছে?
যাক গে, ছেড়ে দিন ওসব কথা।
ছাড়ব কেন? ছাড়ব কেন? তুমি করতে পারো, আমি বলতে পারি না। পেটে একটা বাচ্চা এল। বলে কিনা, এ কার? কে এর বাবা! কীরকম নোংরা মানুষ। সেই বাচ্চাটাকে আমার নষ্ট করিয়ে দিলে। মানুষ না জানোয়ার!
আবার কান্না এসে গেল। ফেঁপাতে ফেঁপাতে বললেন, জানো, আমি আর মা হতে পারব না। কেউ আর আসবে না আমাকে মা বলতে। দোষ আমার না, দোষ তোমার! এদিকে উঠতে বসতে গালাগাল দেবে, আঁটকুড়ো। জানে তো, এর কোথাও যাবার জায়গা নেই, তাই ধামসে যাচ্ছে।
আমি কিন্তু আপনাদের ভালবাসাও দেখেছি। সোহাগ যে করে তার শাসন করাও সাজে।
তুমি দেখেছ, তুমি বোঝেনি। স্বার্থ ছাড়া ও এক পা-ও চলে না। তুমি জানবে, ভালবাসা হিরের চেয়েও দামি। যে ভালবাসে তার চাবুকও হজম করা যায়। আমাকে কেউ কোনওদিন ভাল বাসেনি, ভাল বাসবেও না, আমি এক ক্রীতদাসী।
পাতকোতলায় দুম করে একটা শব্দ হল। কাকিমার মুখটা ছাইয়ের মতো হয়ে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সর্বনাশ! সদর খোলা ছিল নাকি? আমি তো বন্ধ করে এসেছিলুম, তা হলে!
তা হলে কী?
কখন এসে বসে আছে! হয়তো সব দেখেছে, সব শুনেছে। আজ আমায় খুন করে ফেলবে।
খুন করলেই হল! আমরা আছি!
আমি যাই।
পায়ে পায়ে ভয়ে ভয়ে কাকিমা চলে গেলেন। বৃষ্টি সামান্য কমেছে। আকাশ ঘুলিয়ে উঠেছে। এ সেই বৃষ্টি, যা চলবে সমানে তিন দিন। মহিলা মনটা বড় বিষণ্ণ করে দিয়ে গেলেন। পৃথিবীতে জানোয়ারের সংখ্যা এত বাড়ছে কেন! কিছু হান্টারওয়ালি জন্মালে বেশ হয়। চাবকে সব ঠান্ডা করে দেবে।
কাকিমার গলা শোনা গেল, পিন্টু, শিগগির এসো, শিগগির এসো।
কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে কাকিমা চিৎকার করছেন, আর জলে ভিজছেন। দোতলার বারান্দা থেকে। মুখ বের করে বললুম, কী হয়েছে!
ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়ছে। টিনের চালে অবিরাম বেজে চলেছে জলতরঙ্গ। নল বেয়ে জল বইছে দুধের ধারায়। প্রকৃতির অঝোর শব্দে মানুষের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিভেজা মুখ তুলে কাকিমা বললেন, নেমে এসো না। দেখে যাও আকাশ ভেঙে কী পড়েছে।
উঠোনে চিত হয়ে কী একটা পড়ে আছে। পাথর নয়। সরার মতো কী এক প্রাণী। মাছ বৃষ্টি হয়, আগুন বৃষ্টি হয়, এ আবার কী বস্তু রে বাবা! নড়েও না, চড়েও না অথচ ঠাসা মাল।
আমার পাশে হাঁটুর ওপর দু’হাত রেখে সামনে ঝুঁকে পড়ে কাকিমা বললেন, কী বলো তো!
ঠাকুর, আমাকে রক্ষা করো। এ মহিলার লজ্জাশরম বড় কম। বেহুঁশ উদাসী। শরীর ভিজে জাব। চুল ভেঙে পড়েছে পিঠে। দেহভঙ্গি তেমন ভাল নয়। আমি বস্তু দেখব, না মানবী দেখব! তুমিই আমাকে বলে দাও। আমি এক যুবক। শ্বাসপ্রশ্বাস পড়ে। দেহে রক্তস্রোত বইছে। কোনওরকমে বললুম, কী বলুন তো! ঠিক বুঝতে পারছি না। অনেকটা কচ্ছপের মতো।
ঠিক ধরেছ। কচ্ছপই। উলটে পড়ে আছে। শরীরটা ভিতরে ঢুকে আছে। কোত্থেকে এল বলো ততা!
আকাশ থেকে কচ্ছপ পড়বে কী করে?
তাই তো অবাক হচ্ছি।
আমার মনে হয় পাতকো থেকে এসেছে।
কুয়োয় কচ্ছপ আসবে কী করে?
আমাদের কুয়োর সঙ্গে গঙ্গার যোগ আছে।
হ্যাঃ!
হ্যাঃ নয়। সত্যিই আছে। দেখবেন চলুন।
সাঁওতাল রমণীদের মতো হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে কাকিমা কুয়োর পাড়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়লেন। আদুড় পিঠে ভিজে এলো চুল, এপাশে ওপাশে লাল সোঁটা দাগ। তবলচি কাকার সোহাগের তেহাই।
কই, কোথায় তোমার গঙ্গা?
ওই দেখুন, পাতকোর মাঝখানে সুড়ঙ্গের মুখ। হুহু করে জল আসছে।
বাঃ, কী মজা, কী মজা! এখুনি বড় বড় মাছ আসবে।
কাকিমা সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। ভিজে নার্গিসের মতো দেখাচ্ছে।
তুমি আচ্ছা বোকা! জামাকাপড় পরে ভিজছ। সব খুলে ফেলল।
না, না, সব খুলব কী?
আরে দুর, আন্ডারওয়ার আর গামছা পরে এসো। বিকেলের গা ধোয়া বৃষ্টির জলেই হয়ে যাক। আমার গান গাইতে ইচ্ছে করছে। আমার যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভেজাব না।
বাঃ বেশ সুরেলা গলা। বৃষ্টিতে সংসারের মলিনতা ধুয়ে গেছে। দুঃখ ভেসে গেছে। আসল মানুষটি ক্ষণিকের জন্যে বেরিয়ে পড়েছে বৃষ্টি-ভেজা উঠোনে। চারপাশে তোড়ে জল পড়ছে ছাদের নল থেকে। কলকল শব্দে জল খেলছে চারপাশে।
দাঁড়াও কচ্ছপটাকে বালতিতে তুলি।
তুলে কী করবেন?
পুষব।
যদি কামড়ায়, মেঘ না ডাকলে ছাড়বে না।
মেঘ তো অনবরতই ডাকছে।
বালতি এসে গেল। মহিলার অসম্ভব সাহস। দু’পাশ থেকে দু’হাতে ধরে কচ্ছপটাকে ঝপাং করে বালতিতে ফেলে দিলেন। তোলামাত্রই কচ্ছপটার লম্বা গলা, আর চারটে পা বেরিয়ে পড়ল। ভয়ে চোখ বুজিয়ে ফেললুম। শব্দ শুনে আবার চোখ খুললুম।
কাকিমা খিলখিল করে হাসছেন আর বলছেন, তুমি কী ভিতু, তুমি কী ভিতু!