লোটাকম্বল: ১.২২ যে হও সে হও প্রভু

লোটাকম্বল: ১.২২ যে হও সে হও প্রভু

১.২২ যে হও সে হও প্রভু

যে হও সে হও প্রভু
তুমি তো সোয়ামি
যত কাল দেহ তোমার
তত কাল আমি ॥

বুকে ছলাত করে একটা শব্দ হল। বুকের শব্দ কানে আসে না। ধরা পড়ে ডাক্তারের বুক-দেখা যন্ত্রে। বলতে হয় তাই বললুম। উপন্যাসে পড়েছি, এইরকম পরিস্থিতিতে বুক ছলাত করে ওঠে। কনক বসে আছে আবছা অন্ধকারে গালে হাত দিয়ে, পায়ের ওপর পা তুলে। সে এক দৃশ্য। কেন জানি না, রঘুবংশের সেই স্বয়ংবর সভার কথা মনে পড়ে গেল। কোথা থেকে একচিলতে আলো এসে কনকের আঙুলে পড়েছে। আমি মাথা ঘোরালেই আঙুলের পাথর ঝিলিক মেরে উঠেছে। এ আংটি তো কনকের আঙুলে আগে দেখিনি। নিশ্চয় প্রতাপ রায় কোনও এক রাতে সোহাগ করে পরিয়ে দিয়েছে। পরাবেই। পরাবার মুরোদ রাখে রায়মহাশয়। আমার মতো ফেকলু নয়। আবার আমার কথা আসছে কেন? আমি কনকের আঙুলে আংটি পরাতে যাব কোন আনন্দে। আমার আবার অত মাতন কীসের! পাগলা দাশু। তবে কনককে অসাধারণ দেখাচ্ছে। রঘুবংশ ছাড়া অন্য কোথাও এর তুলনা নেই,

বজ্রাংশু-গর্ভাঙ্গুলি রন্ধ্রমেকং ব্যাপারায়মাস করং কিরীটে ॥

কালিদাস লিখেছেন, কোন রাজা আবার, যথাস্থানে স্থাপিত থাকা সত্ত্বেও যেন কিঞ্চিৎ স্থানচ্যুত হইয়াছে,–এমনই ভাব দেখাইয়া স্বহস্তে মস্তকের রত্নময় কিরীটটি তুলিয়া ঠিক করিয়া বসাইতে লাগিলেন। কিরীটখচিত উজ্জ্বল হীরকখণ্ডর প্রভায় তাহার অঙ্গুলির রসমূহ পরিপূর্ণ হইল।

প্রবীরবাবু বললেন, তোমাকে ডাকছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

বাব্বা বলো কী! ভদ্রমহিলা কে?

আমার মেসোমশাইয়ের মেয়ে।

উঃ। তোমাদের কত কী যে আছে। আমার শালা, আমি ছাড়া আর কেউ নেই। যাও যাও, শুনে এসো।

কনকের পাশে একটা চেয়ার খালি পড়ে আছে। বসা উচিত হবে কি না ভাবছি, কনক চাপাস্বরে বললে, বোসোনা।

তুমি কি সিনেমা করতে এসেছ, কনক?

আমার একটা হাত মুঠোয় ধরে কনক বললে, আমায় ভুলে গেছ?

ভুলে যাব কেন? ভোলা কি অত সহজ। মানুষ কোনও কিছুই ভুলতে পারে না। মনের অতলে স্মৃতি হয়ে তলিয়ে থাকে। সুযোগ পেলেই ঠেলেঠুলে ওঠে।

আমার হাতে কনকের মুঠোর চাপ কখনও জোর হচ্ছে, কখনও আলগা হচ্ছে। মেয়েছেলের ভালবাসায় আমার আর বিশ্বাস নেই, ঘেন্না ধরে গেছে। এবার আমি ঈশ্বরকে ভালবাসব। একতরফা ভালবাসা। দেনাপাওনার ব্যাপার নেই। প্রীত প্রীত সত্ কোই কহত, কঠিন তাসু কি রীত। আদি অন্ত নিব নাহি, বালকি সি ভীত ॥ প্রেম, প্রেম! প্রেম তো বালির বাঁধ। আজ আছ, কাল নেই। সাচ্চা প্রেম ঈশ্বরে। আমি ঈশ্বরকেই ভালবাসব। আমার হাত খামচালে কী হবে কনক। আমি যে জেগে উঠেছি। মোহনিদ্রা ভেঙে গেছে। দুনিয়ার হালচাল এই বোকাটা বুঝে ফেলেছে।

হম যাকো চিন্তন করে মোহি মানত নহি।
সো চাহভ জন অন্যকো সো নহি মানত তাহি ॥
হমকো চিন্তত হয় অরু নারী।
ধিক্ হৈ কাম ধিকধিক নর-নারী ॥

আমি যার জন্য অধীর, তার মনে বাসা বেঁধে বসে আছে অন্য পাখি। সে পাখি আবার এ ডালে। বসে, উড়ে যায় অন্য বাগিচায়। পরস্ত্রী আর পরপুরুষ, এ ওকে, ও তাকে, বিশ্বাসঘাতকের দল। ধিক কামনা, ধিক বাসনা, নারীকে ধিক, আমাকে ধিক।

কানের কাছে মুখ এনে কনক ফিসফিস করে বলল, কী, তোমার অভিমান হয়েছে?

কী জানি, কনকের কথা বলার ধরনে কী ছিল, গলা যেন বুজে এল আবেগে। উত্তর দেবার ক্ষমতাই নেই তো উত্তর দেব কী! আশেপাশে সাংঘাতিক সাংঘাতিক সব লোক ঘোরাফেরা করছে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলব নাকি, কেন, কেন তুমি চলে গেলে? হাতের তাস অত সহজে দেখাতে নেই।

কনক বললে, বুঝেছি, তোমার অভিমান হয়েছে।

আলোর বৃত্তে দাঁড়িয়ে বেঁটেমতো কে একজন হেঁকে বললেন, সাইলেন্স, সাইলেন্স। স্টার্ট ক্যামেরা, স্টার্ট সাউন্ড।

কনকের হাতের মুঠোয় আমার শির-বেরকরা শীর্ণ আঙুল ধরাই রইল। কথা বন্ধ হয়ে গেল। আলোর বৃত্তে তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে বসেছেন সেই বিখ্যাত অভিনেতা, ছবি বিশ্বাস। এরই মধ্যে কখন গেরুয়া পরে ফেলেছেন। মেকআপে চেহারা একেবারে বদলে গেছে। ঘাড়ে নেমেছে কাঁচাপাকা চুলের বাবরি। ঠোঁটের ওপর পাকানো গোঁফ। এই জিনিসকেই ইংরেজিতে বলে, হ্যান্ডল বার মুশট্যাশ। জমিদারবাবু বসেছেন ফরাশে। সামনে বোতল আর গ্লাস। পাশেই উঁচিয়ে আছে আলবোলা। নলটা সামনে পড়ে আছে বাঘের ন্যাজের মতো। সেই বেঁটে মানুষটি ঘুড়ি ওড়াবার কায়দায় একপাশে পঁড়িয়ে, দুটো হাত নীচে থেকে ওপর দিয়ে তুলে ছেড়ে দিলেন। সংকেত জানালেন, শুরু। ঝলঝলে প্যান্ট পরা এক ভদ্রলোক ছবিবাবুর মুখের সামনে দুটো কাঠের টুকরো ধরলেন। কালো রং করা। খড়ি দিয়ে কী সব লেখা। চিৎকার করে বললেন, শট থ্রি, টেক ওয়ান। কাঠদুটো দুহাতে ফাঁক করে ঠাস করে ঠুকে দিয়ে, গুঁড়ি মেরে সরে এলেন।

শুরু হল ছবিবাবুর খেলা। নিমেষে তার চেহারা পালটে গেল। চোখমুখ দেখলেই মনে হবে, কতক্ষণ যেন বসে বসে মদ্যপান করে বেশ একটু নেশাগ্রস্ত হয়েছেন। একেই বলে বড় অভিনেতা। বাস্তব থেকে কল্পজগতে যেতে পারেন চোখের পলকে। শূন্য দৃষ্টিতে এধার-ওধার তাকালেন। বোতল থেকে গেলাসে লাল জল ঢাললেন। অদ্ভুত কায়দায় সুদৃশ্য গেলাসটি ঠোঁটের ফাঁকে তুলে ধরে ছোট্ট একটি চুমুক মারলেন। হাত সামান্য কাঁপছে। এইবার গেলাসটিকে চোখের সামনে তুলে ধরে বলতে লাগলেন,

জীবন, জীবন! মহাশূন্যে নক্ষত্রের হাহাকার! উল্কা, উল্কা! জ্বলে যাও, পুড়ে যাও। নীলাদ্রিশেখর, মৃত্যুর আর কত দেরি। সবাই তো চলে গেল, একী, আমি একা! এই জলসাঘরে আমি একা! ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, কোই হ্যায়? বাঁ দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে হাঁকলেন, কোই হ্যায়?

মহা উল্লাসে পাশ থেকে কে একজন চিৎকার করে উঠলেন, ওকে, ওকে, স্টপ। ছবিবাবু। গেলাসটি সহজ হাতে সামনে নামিয়ে রেখে তাকিয়ায় কাত হয়ে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন। সেই বেঁটে ভদ্রলোক নাচতে নাচতে এগিয়ে এসে বলতে লাগলেন, ছবিদা, ফাটিয়ে দিয়েছেন। লা জবাব। লা জবাব।

কনকের ওপাশের চেয়ারে অন্ধকারে কে যেন এসে বসলেন। কনকের মুঠো থেকে আমার আঙুল খুলে এল। বন্ধনের এই হল ধর্ম, কখন যে খুলে পড়ে! এই আকর্ষণ, এই বিকর্ষণ। কে এসে। বসলেন, দেখার চেষ্টা করতে গিয়ে চমকে উঠলুম। প্রতাপ রায়। একেবারে সাহেবি পোশাক। চোখে ছাইছাই রঙের গগলস। ও, প্রতাপ রায় আসায় কনক আমার হাত ছেড়ে দিলে! বেশ ভাই বেশ, শাবাশ! লা জবাব। মেয়েরা বুঝি এইভাবেই ক্ষমতাশালী পুরুষের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেয়। যে হও সে হও প্রভু তুমি তো সোয়ামি/যত কাল দেহ তোমার তত কাল আমি।

প্রতাপ রায় কনকের কানে কানে ফিসফিস করে কী যেন বললেন। তেমন বোঝা গেল না, শুধু কানে এল, ‘জয়টা হোপলেস, জয়টা হোপলেস।নক ফিসফিস করে বললে, পিন্টু, পিন্টু।

আড়চোখে দেখছি, প্রতাপ রায় কনকের পাশ থেকে আমাকে একবার উঁকি মেরে দেখে নিলেন। সোজা হয়ে বসে বললেন, কী ভাগনে, কেমন আছ?

ভাল আছি। আপনি? (দেখতেই পাচ্ছি বেশ মজায় আছেন, তবু আমড়াগাছি।)

চলছে একরকম, বড় ঝামেলায় আছি। (তাই নাকি? রসে হাবুডুবু রসগোল্লার একটাই ঝামেলা, রসিকে খেয়ে ফেলে।)

কী ঝামেলা?

সে তুমি বুঝবে না। তোমার বোঝার বয়স হয়নি। বিষয়সম্পত্তি। মামলা মোকর্দমা। তোমার বাবা কেমন আছেন?

ভাল।

ভাল থাকলেই ভাল।

কনকের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, জয়ের সঙ্গে আজ আমার একচোট হয়ে যাবে।

কনক বললে, শুধু শুধু মানুষের সঙ্গে ঝগড়া করবেন না। আপনার সব ভাল, একটাই খারাপ। বড় তাড়াতাড়ি রেগে যান। ওটা ঠিক নয়।

কী বলছ তুমি? পুরুষমানুষের রাগই হল ভূষণ। জড়োয়ার গয়না।

সাইলেন্স, সাইলেন্স।

আবার সেই নির্দেশ ভেসে এল। আড়চোখে দেখছি, কনকের হাতের মুঠোয় এখন প্রতাপ রায়ের হীরকভূষিত আঙুল। ধ্যাততেরিকা, মেয়েছেলের নিকুচি করেছে। আমার অবশ্য রাগ বা অভিমান করার কোনও মানে হয় না। কনক আমার কে। সম্পর্কে বোন। দূর সম্পর্কের বোন। এমন কিছু প্রেমের সম্পর্ক নয়। বাতাসে নিজেই অট্টালিকা তৈরি করছি, নিজেই ভেঙে ফেলছি। ওঃ মন কী জিনিস! চেয়ার ঠেলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতে গেলুম, পেছন থেকে কে একজন মাথায় গাঁট্টা মেরে বসিয়ে দিলে। ও মনে ছিল না, সামনে ছায়াছবি তৈরি হচ্ছে। কায়াকে ছায়া করে সেলুলয়েডে চ্যাপটা করে ধরা হচ্ছে। শব্দ করা চলবে না। গাঁট্টা খেয়ে গোটাকতক কবিতার লাইন মনে পড়ে গেল, চলে মুসাফির গাহি/এ জীবনে তার ব্যথা আছে শুধু, ব্যথার দোসর নাহি!/নয়ন ভরিয়া আছে আঁখিজল কেহ নাই মুছাবার,/হৃদয় ভরিয়া কথার কাকলি, কেহ নাই শুনিবার।

শট ফোর, টেক ওয়ান। খটাস করে কাঠের শব্দ।

ছবিবাবু আবার অন্যরকম হয়ে গেছেন। সেই মাতাল জমিদার। কোই হ্যায়? কে আছে? শশী, শশী। ফতুয়া পরা একটা লোক, খাটো ধুতি পরে, কাঁপতে কাঁপতে সামনে এসে দাঁড়াল, হুজুর।

কাট, কাট। পরিচালক নৃত্য করতে করতে এগিয়ে এলেন।

এই আমার সুযোগ। চেয়ার ঠেলে উঠে, প্রবীরবাবু যেখানে ছিলেন সেই দিকে এগিয়ে গেলুম। ধনী ব্যক্তিদের পাশাপাশি বেশিক্ষণ থাকা উচিত নয়। বড় উত্তাপ, বড় অস্বস্তি। আমার প্রবীরবাবুই ভাল। মাতুলও কেমন যেন অস্বস্তিকর। বেশ একটু ধনগর্ব আছে।

আবছা অন্ধকারে প্রবীরবাবুকে প্রথমে খুঁজে পাচ্ছিলুম না। বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম। মাতুল দলবল সহ কোথায় যে অদৃশ্য হয়েছেন। কার ভেতর ঢুকে বসে আছেন, কে জানে? প্রবীরবাবুই ফিসফিস করে ডেকে জানান দিলেন। ছোট একটা প্যাকিং বাক্সের ওপর চুপ করে বসে আছেন।

এত নিচু, মাটির প্রায় কাছাকাছি, তাই চোখে পড়েননি।

প্রবীরবাবু বললেন, চলো, বাইরে যাবে?

হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন, এখানে হাপিয়ে উঠেছি।

দু’জনে সেই কল্পজগৎ থেকে বাইরের জগতে মুক্তি পেয়ে যেন প্রাণে বাঁচলুম। রোদের আলোয় চোখ ঝাঁঝিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলুম, মামা কোথায় বলুন তো?

প্রবীরবাবু বললেন, অদ্ভুত ছেলে, আমাদের ফেলে কোথায় যে চলে গেল। ভীষণ জলতেষ্টা পেয়েছে। চলো না, বাইরে গিয়ে দেখি, কোনও দোকানটোকান পাওয়া যায় নাকি!

উনি যদি হঠাৎ আবার খোঁজ করেন?

তাও তো বটে। তা হলে তুমি থাকো, আমি যাই।

আমি যাই মানে?

আমি চলে যাই। এ জগৎটা আর আমার ভাল লাগছে না। এ যেন সব সঁাড়ে বসা টিয়া। রাধেকৃষ্ণ বলো পাখি, কৃষ্ণ কথা বলো। এখানে আমার কিছু করার নেই। বুঝলে ভাগনে। এ হল গিলটি সোনার জগৎ। আর জয়! জয়কে আমি চিনি। কল্পলোকের মানুষ। ওর কথায় যে নাচবে তার ভরাডুবি হবে। যখন যা নিয়ে মাতবে তখন একেবারে চূড়ান্ত করে ছেড়ে দেবে। তারপরে নেতিয়ে পড়বে। ভোরের ফুলের মতো। ফুটল যখন, বাগান মাত, তারপরেই ন্যাতা। তুমি এখানে ঘুরেফিরে বেড়াও। খেয়াল হলে ডেকে পাঠাবে। ঘুরে ঘুরে ভুইতারা দেখো।

আমারও আর ভাল লাগছে না। চলুন পালাই।

তা হলে তো কোনও কথাই নেই। তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব। আমার বোন বড় সুন্দর গান গায়। কিন্তু আগেই বলে রাখছি, আমরা বড়লোক নই। ভাঙাচোরা বাড়ি। অন্ধকার। তেমন বাতাস খেলে না।

প্রবীরমামা, আমরাও বড়লোক নই। যাবার আগে মামাকে কোনওভাবে জানিয়ে যেতে পারলে শান্তি পাওয়া যেত।

দাঁড়াও, ওই দেখো দামুবাবু আসছে।

দৈত্য দামু চাবি ঘঘারাতে ঘোরাতে, শিস দিতে দিতে আসছেন। প্রবীরবাবু বললেন, এই যে স্যার, শুনছেন?

দামুবাবু থেমে পড়ে, ভুরু কুঁচকে, টেরিয়ে তাকালেন। আর্টের চাহুনি। বলুন।

আজ্ঞে, জয়বাবুর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।

কেন? আর কোনও একা নেওয়া হবে না।

আমরা একা নই। আমি জয়ের বন্ধু, আর এ হল ভাগনে।

সিনেমা লাইনে অনেক ভাগনে-ভাগনি ঘোরে। ও কায়দায় সুবিধে হবে না।

আরে কী আশ্চর্য, আচ্ছা বেহেড মানুষ, আমরা তো একসঙ্গে জয়ের গাড়িতে এলুম, আপনি এরই মধ্যে ভুলে গেলেন। ব্রাহ্মী শাক খান।

আরে খুব লম্বা চওড়া বাত বলছ ছোকরা। গলা টিপে তোমার দুধ বের করে দেব।

প্রবীরবাবু বললেন, তা তুমি পারো। তোমার যা চেহারা। আমি তো ছারপোকা।

তবে, শালা অত ফুটুনি কীসের?

তোমার শ্যালক হবার ইচ্ছে নেই গো ভীম ভবানী। আমার ভগিনী তো তোমার কোলের শিশু।

টেম্পার যা চড়েছে থামাতে না পারলে প্রবীরমামা ছাতু। কিছু না, দামুবাবু একবার ওপর দিয়ে গড়িয়ে গেলেই রোড রোলারের কাজ হবে। আমি খুব আদুরে গলায় বললুম, দামুমামা, আমার মামা সত্যিই মামা। তাঁকে বলবেন, আমরা চলে গেছি।

কথাটায় বেশ কাজ হল। এতগুলো মামা একসঙ্গে ছেড়েছি। অনেকটা ‘রবিমামা দেয় হামা গায়ে রাঙা জামা ঐ’র মতো। সবেতেই মা। মা দিয়ে মাত।

দামুবাবু নরম হয়ে বললেন, তোমাকে প্রথম থেকেই আমার চেনাচেনা মনে হচ্ছে।

আজ্ঞে তা তো হবেই। আমার আর মামার মুখ প্রায় একই রকম।

আই সি, আই সি। তা গুরুজি তো এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন।

প্রবীরবাবু আঁতকে উঠলেন, অ্যাঁ, কোথায় বেরোলেন?

টাকার খোঁজে। সিক্স পাওনাদার ঘুরঘুর করে ঘুরছে, হ্যান্ডসরা সব বসে আছে, আগাম টাকা না। দিলে কেউ পা করবে না। যে-বন্ধুর টাকা দেবার কথা ছিল, সে বলছে, সিনেমা করবে না। এ সব

ভেতরের কথা। বাইরে যেন লিক না করে। মালুম!

হাঁ মালুম, কিন্তু গেল কোথায়?

এক মহারাজের বাড়ি। টাকা না পান, কিছু মার্বেল পাথর তো পাবেন। একটা মেঝেতে ছবি দশ হাত এগোবে। লাঃ লা ট্রালা, ট্রালা। দামুবাবু গুরুজির রেস্ত ফুরিয়ে যাবার আনন্দে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চললেন।

প্রবীরবাবু বললেন, তোমায় বলেছিলুম না, জয় বড় বিচিত্র চরিত্রের ছেলে। শিল্পী, তাই লোকে। বলে আত্মভোলা, তা না হলে বলত স্বার্থপর। সময়ে ও সবকিছু ভুলে যেতে পারে, স্ত্রী, পুত্র,

পরিবার, এমনকী নিজের মঙ্গল অমঙ্গল।

প্রবীরমামা, আমরা তা হলে এখন কী করব?

এ জগৎ থেকে পালিয়ে চলো। এ আমাদের জায়গা নয়। নাম-পাগলদের আখড়া। চলো তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাই। মুখ দেখে মনে হচ্ছে তোমার খুব খিদে পেয়েছে।

তা পেয়েছে।

আমার পকেটে পয়সা থাকলে তোমাকে দোকানে খাওয়াতুম। না না খাওয়াতুম না। দোকানে খাওয়া খুব খারাপ। বাইরে খাওয়া উচিত নয়। শরীর খারাপ হয়। আমাদের বাড়িতে চলো।

উনি যদি ফিরে এসে আমাদের খোঁজ করেন।

তুমিও যেমন! তোমার মামাকে তোমার চেয়ে আমি ভাল চিনি। চলে এসো, চলে এসো।

ডান দিকে একটা খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে কোমরে গামছা বাঁধা একদল লোক আগুন আগুন বলে চিৎকার করছে। নকল দাড়িগোঁফ লাগানো এক ভদ্রলোক নাচতে নাচতে বলছেন, সব জ্বলে যাক, পুড়ে যাক, শ্মশান হয়ে যাক। আহা তোমার কী রূপ, আহা তোমার কী রূপ, লকলক করছে, লকলক করছে।

এ আবার কী ব্যাপার!

প্রবীরবাবু বললেন, শুটিং হচ্ছে শুটিং।

আগুন লাগলে এইভাবে কেউ নাচে।

বাস্তবে না নাচলেও সিনেমায় নাচতে হয়।

একটা ঠ্যালাগাড়ির ওপর ক্যামেরা। খড়খড় করে ফিল্ম ঘোরার আওয়াজ হচ্ছে। দু’জন মানুষ গাড়িটাকে ধীরে ধীরে ঠেলে নিয়ে চলেছেন। আগুনের হলকায় উত্যক্ত হয়ে একগাদা পাখি গাছের ডালে ডালে উড়ছে আর ডাকছে।

আমরা রাস্তায় এসে পড়লুম। চারপাশে বড় বড় গাছ। রাস্তাটা বেশ ছায়াছায়া, নির্জন। হাঁটতে হাঁটতে আমরা ট্রাম ডিপোর কাছে চলে এলুম। প্রবীরবাবু বীরের মতো হাঁটছেন। গুনগুন গাইছেন, মুক্তির মন্দির সোপান তলে, কত প্রাণ হল বলিদান।

আবার আমরা সকালবেলার সেই দুধ পড়ে যাবার জায়গায় চলে এলুম। ইতিমধ্যে সময় সরে গেছে। দীর্ঘ ছায়া নেমেছে। চারপাশের জেল্লা অনেক কমে গেছে। বড় রাস্তা ছেড়ে আমরা একটা ছোট রাস্তায় পড়েছি। হঠাৎ মনে হল, আমি কী কারণে বোকার মতো প্রবীরবাবুর বাড়ি চলেছি। চেনা নেই, জানা নেই। ভদ্রলোক শিল্পী, দু’-একটা ছবি দেখা যাবে। একসময় আমার খুব শিল্পী হবার ইচ্ছে ছিল। আর্ট কলেজে ভরতি হবার জন্যে পাগল হয়েছিলুম। পিতা বলেছিলেন, তোমাকে বড়লোকি নেশায় পেয়েছে। গরিবের ঘোড়া রোগ। না খেয়ে মরার ফিকির।

প্রবীরবাবু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে পেছন ফিরে তাকালেন, কী হে, পেছিয়ে পড়লে কেন?

পা চালিয়ে পাশাপাশি আসতেই আমার কাঁধে হাত রাখলেন পরম বন্ধুর মতো। রাস্তা ক্রমশই দু’পাশে চেপে আসছে। ক্রমশই যেন কলকাতার জঠরে প্রবেশ করছি। আলো-বাতাস কমে আসছে। এই শহরে মানুষ কীভাবেই না বাস করে। প্রবীরবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী, খুব কষ্ট হচ্ছে?

আজ্ঞে না, আমার হাঁটা অভ্যাস আছে।

হ্যাঁ, পুরুষমানুষ, সবরকম অভ্যাস রাখবে। জীবন তা হলে দেখবে, তোমার কাছে হেরে গেছে। যত ব্যথা পাই, তত গান গাই, গাঁথি যে সুরের মালা, ওগো সুন্দর নয়নে তোমার নীল কাজলের মায়া। শরীরটাকে একেবারে পাথরের মতো লোহার মতো করে ফেলবে। কোনও কিছুর প্রত্যাশা রাখবে না। দুঃখ পেলে হেসে উঠবে, সুখ দেখলে সরে আসবে। শূন্য সংখ্যাটার কিছু নেই, একেবারেই শূন্য, অথচ সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। শূন্য না হলে দর্শক হবে না, শতক হবে না, সহস্র হবে, অযুত, নিযুত কিছুই হবে না। আমি সেই শূন্য রে ভাই। মহাশূন্যে ভাসছে জগৎ, ঘুরছে তারা, ঘুরছে চন্দ্র, শূন্য আছে সৃষ্টি আছে, গোলেমালে মাল রয়েছে, গোল ছেড়ে মাল বেছে নে।

এই গলির মধ্যেও ছোট্ট একটা মুদিখানা মতো রয়েছে। প্রবীরবাবু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, দাঁড়াও দু’পাতা চা কিনে নিই। বাড়িতে আছে কি না কে জানে? চা না খেলে আচ্ছা ঠিক জমবে না।

প্রবীরবাবু যে-চা কিনলেন, আমি জানি সে চা খাওয়া ভীষণ শক্ত। কেমন একটা বুনো বুনো গন্ধ বেরোয়। আবার আমার কাঁধে হাত রেখে হাঁটা শুরু হল। রাস্তা বর্শার ফলার মতো ক্রমশই তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে। অবশেষে আমরা একটা ভাঙাভাঙা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালুম। আমালাগা ইটের দোতলা হুমড়ি খেয়ে রাস্তায় নেমে আসতে চাইছে। বাড়িটা এমনই বসে গেছে। ওপর দিকে তাকালেই দোতলার জানলা। খয়া খয়া কাঠের পিঞ্জর। সারা বাড়িটার যেন যক্ষ্মা হয়েছে। সারা দিন রাত নীরবে কেশে চলেছে।

দরজায় বিরাট বড় একটা কড়া। নিজের ভারে হেলে পড়েছে। কোনদিন উপড়ে চলে আসবে। প্রায় অসংলগ্ন সেই কড়া ধরে প্রবীরবাবু ঠকাস ঠাস করে তিনবার শব্দ করলেন। এ কড়া তেমন মুখরা স্ত্রীর মতো বাজে না, উদাসী বৃদ্ধার মতো হরি দিন তো গেল’র সুরে জরাজীর্ণ বিদায়ী ব্যথায় বাজে থেমে থেমে।

প্রবীরবাবু ডাকলেন, ঊষা, ঊষা।

সেই ডাক চারপাশের নোনা-লাগা বাড়িতে ধাক্কা খেয়ে ধ্বনিতে, প্রতিধ্বনিতে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। বহু ওপরে এক টুকরো আকাশে আলোর পাখনা উড়ছে। হড়াস, একটা শব্দ হল। দরজার হুড়কো সরল। ইনিই কি ঊষা! প্রথমে নজরেই প্রেমে পড়ে যাবার মতো অবস্থা। কদর্য প্রেম নয়, শুদ্ধ, সাত্ত্বিক প্রেম। ঊষা না হয়ে, আমার মায়ের তুলসী নামটা যদি এঁকে দেওয়া যেত! অবশ্যই আমার পিতৃদেবের অনুমতি নিয়ে।

প্রবীরবাবু একগাল হেসে বললেন, দেখ ঊষা, কাকে এনেছি!

প্রবীরবাবু এখনও আমার কাঁধে হাত রেখে পঁড়িয়ে আছেন। আমরা যেন দুই মানিকজোড় মাঝরাতে মাল খেয়ে বাড়ি ফিরছি। কর্পোরেশনের হেলথ অফিসার আমাদের পরিদর্শন করছেন। প্রবীরবাবুকে আমার আর মামা বলতে ইচ্ছে করছে না, দাদা বলতে ইচ্ছে করছে।

ঊষাদেবীর ঘাড়ের কাছে এলো খোঁপা। আয়তন দেখলেই বোঝা যায়, খুলে দিলেই পাহাড়ি নদীর মতো কোমর ছাপিয়ে লাফিয়ে পড়বে। সাদা শাড়ি, চওড়া নীল পাড়। হালকা নীল ব্লাউজ। দেহ আর মুখের গড়ন দেখার মতো। এ যেন নালন্দা আবিষ্কার। কোনারকের মন্দির থেকে অপরাহু বেলায় নেমে এসেছেন অপরূপা। কলকাতা ছুঁড়লে এমনি সব বিস্ময় কত যে পাওয়া যেতে পারে, কেউ জানে না।

প্রবীরবাবু কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে বললেন, আমার একমাত্র বোন ঊষা। পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই। আমি আর ঊষা। ঊষী, এ হল আমার বাল্যবন্ধু জয়নারায়ণের ভাগনে। ছেলেটা বড় ভাল, ঠিক তোর মতো।

আগে তোমরা ভেতরে এসো তো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কী করছ?

প্রবীরবাবু ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ঊষী, আমাদের খুব খিদে পেয়েছে, জল-তেষ্টা, চা-তেষ্টা সব একসঙ্গে পেয়েছে। এই নে চা।

এঃ দাদা, তুমি এই চা নিয়ে এলে। এ চা খেতে পারবে না তোমার–কী নাম? নামটা তো জানা হল না।

প্রবীরবাবু বললেন, তোমার নাম?

পিন্টু।

বাঃ, ফাসক্লাস নাম। খুব পারবে, খুব পারবে, ও তো আর বর্ধমানের মহারাজার বাড়িতে আসেনি। আমরা যখন খেতে পারি, ও-ও পারবে।

বাড়ির নীচের তলাটা একেবারেই জখম হয়ে গেছে। আহত অন্ধকার যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত সৈনিকের মতো তালগোল পাকিয়ে পড়ে আছে। ভাঙা উঠোন থেকে একটা নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। বারান্দায় ঝলঝল করছে কাঠের রেলিং। কিচ কিচ করে কোথায় একগাদা পাখি ডাকছে।

দোতলায় উঠতেই প্রাণটা ভরে গেল। দেবালয়ের মতো পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন। ভারী মিষ্টি একটা গন্ধ। নাকে এল। ধূপ হতে পারে। বারান্দার শেষকোণে মাঝারি আকারের একটা তারের খাঁচা। খাঁচায় গোটা দশেক ছোট ছোট রঙিন পাখি, উড়ছে, দোল খাচ্ছে। এদেরই বোধহয় ক্যানারি বলে। একটা ফুটফুটে সাদা খরগোশ, থেবড়ে বসে আছে আপন মনে। মাঝে মাঝে মুখ তুলে পাখি দেখছে।

ঊষা বললেন, তুমি জুতোটা এইখানে খুলে রাখো। দাদা, তোমরা ঘরে গিয়ে বোসো।

ঘরে খাটফাট কিছুই নেই। অনাবশ্যক কোনও ফার্নিচার নেই। একপাশে সুন্দর একটা মাদুর সমান করে পাতা। তার ওপর ঝকঝকে একটা জলচৌকি। পাশেই নকশা করা ফুলদানিতে ছোট বড় অসংখ্য তুলি। গোটাকতক পরিষ্কার প্যালেট। দেয়ালে স্মরি সারি ছবি ঝুলছে, জল রং, তেল রং। আর একপাশে, আর একটা ছোট মাদুর। তার ওপর একটা হারমোনিয়ম, পাশেই একটা তানপুরা ঝুলছে। ঘরের আর এক কোণে বেশ বড় আকারের ফুলদানিতে রজনীগন্ধার গুচ্ছ গোঁজা। ফুলের গন্ধ সারাঘরে প্রজাপতির মতো ভাসছে।

প্রবীরবাবু প্রথমেই পাঞ্জাবিটা খুলে ফেললেন। একটা দেখার মতো স্বাস্থ্য। দু-চারবার হাতের গুলি ভেঁজে নিয়ে আমাকে বললেন, তুমি ব্যায়াম করো?

আজ্ঞে না, আমার বাবা করেন।

হা হা করে ঘর-ফাটানো হাসি হেসে বললেন, এ যে দেখি সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য। ওসব চালাকি চলবে না, বোজ ব্যায়াম করবে।

আমার বাবার ব্যায়ামে খুব বিশ্বাস। উনি বলেন, যখনই দেখবে শরীর ম্যাজম্যাজ করছে, মন ঝিমিয়ে পড়ছে, তখনই মারবে পঁচিশটা ডন, পঞ্চাশটা বৈঠক।

ঠিক বলেন, ঠিক বলেন। আমি ওঁকেই আমার গুরু করব। জীবনে গুরু চাই পিন্টু, গুরু চাই। সাধন করনা চাহি রে মনুয়া, ভজন করনা চাই। উষী-ই, কোথায় গেলি রে!

প্রবীরবাবু নাচতে নাচতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তখনও গান চলছে, সাধন করনা চাহি রে মনুয়া। জলরঙে আঁকা একটা নিসর্গ দৃশ্য তখন থেকেই বড় টানছে। অমন একটা জায়গায় এখুনি যদি দৌড়ে চলে যাওয়া যেত।

প্রবীরবাবু ওপাশ থেকে ডাকলেন, পিন্টু, চলে আয়।

ডাকটা বড় ভাল লাগল। হঠাৎ যেন খুব কাছাকাছি করে নিলেন। উঁচু ডালে ফল ঝুলছে। কোনওরকমে সেই ফলের নাগাল পেয়ে গেলে যেমন আনন্দ হয়, সেইরকম একটা আনন্দের অনুভূতি হল।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত