লোটাকম্বল: ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়

লোটাকম্বল: ১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়

১.২১ তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়

তিন বাতসে লট্‌পাট হেয়:
দাম্‌ড়ি, চাম্‌ড়ি, পেট

মাতুলের গাড়ির অবস্থা গ্রামের ট্যাক্সির মতো। এমন ঠাসা ঠেসেছেন সেই জজসাহেবেও হেরে যাবেন। গ্রামের ট্যাক্সি ড্রাইভারকে চৌকিদার ধরে এনেছে কোর্টে। গাড়িতে বাইশ জন লোক পুরেছিল হুজুর। ড্রাইভার অমায়িক হেসে বলেছিল, ওই তো আমার ধড়ে গাড়ি কোর্টের বটতলায় পড়ে আছে, আপনি হুজুর বাইশ জন লোক পুরে দেখিয়ে দিন, কেমন করে তা সম্ভব!

টালিগঞ্জের স্টুডিয়োতে গাড়ি ঢুকল। আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম। চিত্রাদেবীর চাপে নিম্নাঙ্গে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে পা দুটো ঝিনঝিন করছে! নারীশরীর কোমল হলেও তার একটা চাপ আছে। ভার আছে। অবশ্যই মধুর এবং সুখকর। এত দীর্ঘ সময় সুন্দরী কোনও মহিলার গাত্ৰলগ্ন হয়ে বসে থাকার অভিজ্ঞতা, এই আমার প্রথম। মন বিড়বিড় করে তখন থেকেই বলছে, সাহস করে বাড়ির বাইরে বেরোতে পেরেছিস, তাই না তোর এই অভিজ্ঞতা। আর্টের জগতে কত রোমান্স আছে দেখেছিস? গার্ডল অফ ভেনাসের খেলা।

একে একে আমরা খালাস পেলুম। চিত্রাদেবী নেমেই টলবল বলবল হয়ে গেলেন। পায়ে ঝিনঝিনি ধরেছে। দাদু বলতে থাকলেন, অমন করে নাচিসনি, আমার ছড়িতে ভর দিয়ে দাঁড়া। বেশি নাচানাচি করলে গলার মুড়কি খারাপ হয়ে যাবে।

মুড়কি আবার কী বস্তু, কে জানে বাবা! ফুটকড়াই মুড়কি দোলের দিন খাওয়া হয়। গলার আবার মুড়কি কী! গানের লাইনে কত কী যে আছে! আমি আর প্রবীরবাবু মহাভারতের চরিত্রের মতো মুগুর হাতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি।

বিশাল চেহারার এক ভদ্রলোক, জয়দা জয়দা বলতে বলতে এগিয়ে এলেন। পাঞ্জাবির খোলা বুকে বিশাল এক পদক ঝুলছে। ইনি যদি অভিনয়ের জগতের কেউ হন, তা হলে এঁর একমাত্র উপযুক্ত ভূমিকা হওয়া উচিত আবগারি দারোগার।

জয়দা জয়দা করছেন বটে, চোখদুটো খেলছে চিত্রাদেবীর শরীরে। মানুষের এই একটা বড় বদ অভ্যাস, মহিলারা যেন ময়রার দোকানের লাল ল্যাংচা। খাব খাব দৃষ্টিতে ওভাবে তাকানোটা কি ঠিক হচ্ছে! লোকে যে লোভী বলবে! দৃষ্টির ছ্যাকায় মহিলাদের অস্বস্তি হয় না!

প্রবীরবাবুও চোরা চাহুনি মারছেন, তবে বেশ কায়দা করে রেখেঢেকে। চারপাশে সবুজ গাছপালা, রোদ ঝলমল করছে, কড়া ছায়া লুটোপুটি করছে, তার মাঝে বেগুনি পোশাকে সুন্দরী এক মহিলা, পাশেই রুপোলি চুলের এক বৃদ্ধ, যৌবনের ব্যঙ্গ, পাঞ্জাবি পরা দারুশিল্প, সারেঙ্গি বাদক। একটা দার্শনিক দল।

লোলুপ দৈত্যকে কেন জানি না আমার কেবলই বলতে ইচ্ছে করছিল, মা যেমন শিশুকে বলে, ওই দেখ পাখি! শিশু পাখি উচ্চারণ করতে পারে না, বলে পাপী। আদো আদো বুলি, এত্তা পাপী।

ভাবতে ভাবতে মুখ ফসকে ওই শব্দটিই বেরিয়ে পড়ল। এত্তা পাপী।

প্রবীরবাবু বললেন, কী বলছ? কিছু বললে?

একটা পাখি।

হ্যাঁ, এখানে অনেক পাখি। গাছপালা বেশি তো! গাছ থাকলেই বেশি পাখি আসবে।

দৈত্য চিত্রাদেবীর সামনে গিয়ে সালাম আলেকুমের ভঙ্গিতে বললেন, চলুন ম্যাডাম। আমাদের অফিসে চলুন।

দাদু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হু আর ইউ। অফিসে যাবে কেন?

দৈত্য একটু ঘাবড়ে গেলেন। বেশ হয়েছে ব্যাটা। মহিলা দেখলেই হল! যেন নাকের চুল! সুড়সুড় করলেই ফাঁচাত হাঁচি।

মাতুল খুব কড়া সুরে বললেন, দামু, তোমার কাজ কী?

কেন দাদা! ম্যানেজমেন্ট আর প্রোকিউরমেন্ট।

গাড়ির পেছনে যেসব মালপত্তর আছে, সাবধানে নামিয়ে নিয়ে যাও। তোমার অন্য আর কোনও কাজ নেই। ওদের হাত থেকে মুগুর দুটো নিয়ে যাও।

কোথায় সুন্দরী, আর কোথায় দুটো কেঠো মুগুর! আমাদের হাতের মুগুর দৈত্যের হাতে যেন ছাত পেটার দুটো কাঠ। সটাক সাক করে দু’বার ভেঁজে নিয়ে বললেন, কোনও ওয়েট নেই। মুগুর দুটো পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে জিভের তলায় দুটো আঙুল পুরে, সিক করে একটা সিটি বাজালেন।

বোঝাই গেছে, পুরনো কলকাতার পায়রা-ওড়ানো বাবুদের শেষ বংশধর। মাতুলের স্কন্ধে ভর করেছেন। মাতামহ যদি একবার জানতে পারেন পুত্র সিনেমা করতে এসে এই সঙ্গে মিশছেন, তারা তারা বলে, দুনয়নে পড়বে ধারা। আর মাতুলানী যদি জানতে পারেন, ডানাকাটা পরিরা গুরুজি গুরুজি বলে চারপাশে লাট খেয়ে বেড়াচ্ছেন, রেগে হাফবয়েল হয়ে বসে থাকবেন।

সিটি শুনে, দূরের একটা ঘর থেকে খাকি হাফপ্যান্ট আর সাদা জামা পরা লোক, যাই ওস্তাদ, বলে এগিয়ে আসতে থাকলেন। পা দুটো ধনুকের মতো। বড় বড় লোম। কামিয়ে কম্বল করা চলে। মাতুল সিনেমা করছেন, না সার্কাস করছেন? মাতুলই জানেন।

দৈত্য দামুবাবু হাত চোখ মুখের বিচিত্র ভঙ্গি করে বললেন, ওস্তাদ এ দুটোকে লিয়ে যাও। তুরন্ত লে যাও, তুরন্ত লৌটকে আ যাও শাগরেদ।

ওস্তাদের ওস্তাদ মুগুর দুটো দুকাঁধে ফেলে শিম্পাঞ্জির মতো এগিয়ে চললেন। প্রবীরবাবু চাপা গলায় বললেন, দেখেছ?

কী বলুন তো?

ওই যে পুকুরপাড়ে, শানবাঁধানো ঘাটে কারা বসে আছেন?

গেরুয়া রঙের কাপড় আর পাঞ্জাবি পরে সুঠাম চেহারার দু’জন ভদ্রলোক বসে আছেন। সুন্দরী এক মহিলা এলোচুলে হাত পা নেড়ে কী যেন বলছেন। গাজন তো হয়ে গেছে, বাবা তারকনাথের এইসব সন্ন্যাসীরা কোথা থেকে এলেন, কে জানে? প্রবীরবাবু হয়তো জানেন।

ওঁরা কি সন্ন্যাসী?

তোমার মাথা।

তা হলে?

ওঁরা হলেন এক নম্বর ফিল্ম স্টার। দেখে চক্ষু সার্থক করো। ডান দিকে অহীন্দ্র চৌধুরী, পাশে পাহাড়ী সান্যাল। হাঁটুর ওপর একটা পা তুলে কেমন বসে আছেন দেখেছ?

আর ওই এলোকেশী?

আরে বাপ রে, ওঁকে চেনো না? কী চেনো হে ছোকরা! উনি হলেন তোমার গিয়ে, তোমার গিয়ে, আহা, নামটা মনে আসছে না, পরে বলছি। তুমি দেখে রাখো, ও হ্যাঁ সুনন্দা দেবী।

ওঁরা সব গেরুয়া পরেছেন কেন?

মনে হয় আনন্দমঠ হচ্ছে।

দামুবাবু গাড়ির পেছন থেকে মালপত্র বের করছিলেন, শুনতে পেয়েছেন আমাদের কথা। বললেন, আরে না মশাই, সিনেমায় গেরুয়া সাদা হয়ে যায়। এ লাইনে গেরুয়া বলে কিছু নেই, অল হোয়াইট। ক্যামেরার ব্যাপার মশাই। ওস্তাদ।

হাঁক মারলেন। পাহাড়ী সান্যাল চমকে উঠলেন।

দামুবাবু লক্ষ করে বললেন, পাহাড়ীদা, একটু জোরে হয়ে গেছে দাদা, মার্জনা করবেন।

পাহাড়ীদা গ্রাহ্যই করলেন না। আর একটা গাড়ি ঢুকল। দু-চারজন হইহই করে এগিয়ে গেলেন। লম্বা চওড়া, ভীষণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ সামনের আসন থেকে নেমে এলেন। দু-চারজন কাটা কলাগাছের মতো তাঁর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লেন। প্রবীরদা চাপা গলায় বললেন, দেখে রাখো, ইনি হলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নট, ছবি বিশ্বাস। দেখেছ এঁর অভিনয়?

মনে পড়ছে না।

অ্যাঃ তোমার জীবনটাই অসম্পূর্ণ। ছায়াছবির কিছুই জানো না।

পুকুরপাড়ে আর একজন অভিনেত্রী এসে পঁড়িয়েছেন। সাজগোজ দেখলে মনে হবে এইমাত্র বাসর ছেড়ে উঠে এসেছেন। কী সব চেহারা! প্রবীরবাবু চাপা গলায় বললেন, কী দেখছ?

অনুভদেবী। অভিনয় দেখলে তিন রাত্তির ঘুমোতে পারবে না।

মাতুল এতক্ষণ গাছতলায় দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন, সেইখান থেকেই হেঁকে বললেন, তোমরা চলে এসো।

নীল জামা পরা এক ভদ্রলোককে মাতুল বেশ রাগরাগ গলায় বলছেন, যতক্ষণ না আমি স্লিপে সই করে দিচ্ছি ততক্ষণ কাউকে এক কাপ চা-ও দেবেন না। ক্যান ইউ ইমাজিন, একজন সারাদিনে চল্লিশটা হাফবয়েল ডিম খেয়েছে!

আজ্ঞে, হাফবয়েল নয়, অমলেট।

ওই হল।

আজ্ঞে বৃহত্যজ্ঞে ওরকম তো হবেই। ফিল্ম লাইনে আপনি নতুন, তাই অবাক হচ্ছেন, এ লাইনে সবকিছু ওড়ে, পাখির মতো ওড়ে, টাকা ওড়ে, যৌবন ওড়ে, ডিম ওড়ে, চপ ওড়ে, লাল জল ওড়ে। এর নাম স্যার ছায়াবাজি, ভোজবাজি। কত কন্ট্রোল করবেন! এ কি র‍্যাশনের চাল।

আমার টাকা তো ছেলের হাতের মোয়া নয় যে, সবাই খেয়ে যাবে ভোগা দিয়ে।

আজ্ঞে তা নয়, তবে দুশো এক টাকা আপনি এখন আমাকে দেবেন, কালকের পাওনা।

মাতুল হাঁকলেন, দামু।

ইয়েস গুরুজি।

টাকা উড়ছে।

সে তো কথাতেই আছে, কলকাতায় টাকা ওড়ে, ধরতে পারলেই হয়। মাড়োয়ারিরা ধরছে।

তা হলে ধরে এনে, ক্যান্টিন ম্যানেজারকে দাও। দুশো এক টাকা।

দামুবাবু একগাল হেসে বললেন, আপনি ওড়ান, আমি ধরি।

পকেট থেকে গোটাকতক একশো টাকার নোট বের করে দামুবাবুর হাতে দিলেন। দিয়ে বললেন, কাজের নামে অষ্টরম্ভা, রোজ দুশো টাকার খানা উড়ছে। চলে এসো।

শেষ নির্দেশ আমাদের জন্যে। আমরা গুটিগুটি এগিয়ে চললুম। প্যান্টশার্ট পরা খড়খড়ে এক ভদ্রলোক পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে পড়লেন। তীক্ষ্ণ নজরে চিত্রাদেবীকে দেখলেন। ভদ্রলোকের গলায় সুতোয় বাঁধা কী একটা গোলমতো ঝুলছে। রেফারির গলার বাঁশির মতো। হঠাৎ থেমে পড়ে মাতুলকে ডাকলেন, জয়!

মাতুল ফিরে তাকালেন। মনে হয় এ জগতের বেশ সম্মানিত মানুষ। তা না হলে এত সম্ভ্রমে মাতুল উত্তর দিতেন না, বলুন রাখালদা!

তোমার আর্টিস্ট?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

সাইড রোল, না হিরোইন।

আজ্ঞে না, মিউজিক্যাল।

ভেরি ফোটোজেনিক ফেস। আমি একটা চান্স দিতে পারি। একেবারে লিডিং রোলে। আমি হিরোইন খুঁজছি।

আপনি তো ফ্লোরে নেমে গেছেন। কাস্টিং তো ঠিক হয়ে গেছে।

না, আমার নেকস্ট বইটার জন্যে। আগুনের ফুলকি। বাজারে আমি নতুন একটা জুটি ছাড়তে চাই। স্ক্রিপ্টটা বড় ভাল হে।

মিউজিক কে করছে?

ঠিক করিনি। তুমি করবে?

প্রবীরবাবু দুম করে বললেন, গান আমি লিখব।

রাখালবাবু বললেন, কেন?

প্রবীরবাবু ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, জয়ের বইয়ে আমি লিখছি তো!

আগুনের ফুলকি রোমান্টিক বই, বিরহের গান আপনি লিখতে পারবেন?

খুব পারব, আমি নিজে একজন ব্যর্থপ্রেমিক। আমার হিষ্ট্রি জয় জানে।

হিষ্ট্রি জিয়োগ্রাফির প্রয়োজন নেই, পরে দেখা করবেন।

রাখালবাবু সরাসরি চিত্রাদেবীকে জিজ্ঞেস করলেন, কী, অভিনয় করবেন?

চিত্রাদেবী হৃভঙ্গি করে বললেন, পারব? না বাবা, লজ্জা করে।

দাদু বললেন, অভিনয় করবে? কী বলছেন আপনি? ভদ্রঘরের মেয়ে অভিনয় করবে কী? নায়করা মদ খেয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরবে, আপনি লাইনের মেয়ে খোঁজ করুন।

আপনি বুঝি খুব কনজারভেটিভ! ফিল্ম লাইনে কত ভদ্রঘরের লেখাপড়া জানা ছেলেমেয়ে। এসেছে জানেন?

জেনে কাজ নেই, জেনে কাজ নেই। দাদু সুর করে টেনে টেনে বললেন। আমাদের ভোলার মেয়ে আজ পাঁচ বছর হল নিরুদ্দেশ। নায়িকা হবে বলে গয়নাগাটি নিয়ে বোম্বে পালিয়েছিল। ব্যস, একেবারে বেপাত্তা। ভোলার বউ রোজ রাতে মেয়েকে স্বপ্নে দেখে, কেঁদে কেঁদে বলছে, মা, মাগো, ওরা আমাকে সেলুলয়েডে ধরে রেখেছে, এই দেখো আমার ছায়া পড়ছে, কায়া নেই।

গাছতলায় দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল। চিত্রাদেবীর কান ঘেঁষে, কাধ বেয়ে একঝলক পক্ষীকৃত্য নেমে গেল। তিনি ধেইধেই করে নেচে বললেন, অ্যাম্মা, যতেঁরিকা, ভাল্লাগে না বাবা, কী হবে!

একসঙ্গে দু’জনে বললেন, যদি অনুমতি করেন!

দু’জনের একজন প্রবীরবাবু, অন্যজন দামুবাবু। যদি অনুমতি করেন!

দাদু বললেন, না, অনুমতি করবে না, আমি আছি কী করতে! অ্যায় এদিকে মাথা নিচু কর।

রাখালবাবু বললেন, খুব শুভ লক্ষণ। তুমি অভিনয়ে এলে, অনেক দুরে যাবে। টপ, টু দি টপ। তাড়া নেই। ভেবেচিন্তে জবাব দিয়ো। তোমার এই এক্সপ্রেশন এত ন্যাচারাল! দেখো, যদি বেরিয়ে আসতে পারো! কনজারভেটিভ ফ্যামিলি এইভাবে কত ট্যালেন্ট যে নষ্ট করছে। আই পিটি দেম, আই পিটি।

রাখালদা!

গাছের আড়াল থেকে বেশ লম্বা চওড়া এক মহিলা ডাকলেন। রাখালবাবু বললেন, যাই অনুভা। প্রবীরবাবু খপ করে আমার একটা হাত চেপে ধরে বললেন, দেখেছ, অনুভা, আরে ব্বাপ। আজ রাতে আর ঘুমোতে পারব না। অনুভা আমার এত কাছে! ফ্যানটাস্টিক!

ঘুমের ঘোরে মানুষ যেভাবে হেঁটে যায়, চিত্রাদেবী রাখালবাবুর পথে সেইভাবে দু’কদম হেঁটে গেলেন। দাদু খপ করে হাত চেপে ধরে বললেন, অ্যায়, যাচ্ছিস কোথা! একে একেবারে হিপনোটাইজ করে ফেলেছে। ওরে, তুই গান গাইতে এসেছিস, নায়িকা হতে আসিসনি৷

মাতুলের মুখ বেশ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। দুপাশে দু’সার গাছের মধ্যে তিনি এগোতে লাগলেন। দলবল চলল পেছন পেছন। সারেঙ্গি মিঞা বাতাসে মাথা কুটে কুটে চলেছেন, কী হয়, কী হয়! চিত্রাদেবী এখন মাতুলের পাশাপাশি হাঁটছেন। প্রবীরবাবু আমার কাঁধে হাত রেখে হাঁটছেন। ধীরে ধীরে আমাদের দুজনের বেশ একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়ে উঠছে। মানুষটি বেশ সহজ সরল। আমার কানে কানে আবার ফিসফিস করে বললেন, নায়িকা কীভাবে তৈরি হয় জানো?

আজ্ঞে না।

আমাকে এত আজ্ঞে আজ্ঞে কোরো না। ও তোমার না জানাই ভাল।

কেন?

সে অনেক ব্যাপার। অনেক ঝামেলা সহ্য করতে হয়। সেসব কথা তোমাকে আমি বলতে পারব না। তাকিয়ে দেখো, জয় আর চিত্রাকে কেমন মানিয়েছে! ওদের দু’জনকে নায়কনায়িকা করে দিলে হয়।

হ্যাঁ।

তোমার মামা বিয়ে করেছে?

হ্যাঁ।

কাকে?

মামিমাকে।

উঃ, তোমার মাথায় কি গোবর ভরা আছে! মামার বউ তো মামি হবেই। মামির নাম কী?

সীমা।

জয়া নয়, ঠিক জানো?

উনি তো সীমাই বলেন।

ইস! কাজটা খুব খারাপ করেছে।

কেন?

সে তুমি বুঝবে না। আমার খুব খারাপ লাগছে। কেমন যেন কান্নাকান্না পাচ্ছে।

কেন?

সে তুমি বুঝবে না। একজনের জন্যে। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি। কী বলল তো?

এমন কিছু, যা দেখলে মানুষের কান্না পায়।

ঠিক বলেছ। আমি একটা নদী দেখতে পাচ্ছি। মনে করো ঘাটশিলার সুবর্ণরেখা। সেই নদীর ধারে চাঁদিনি রাতে, একটা কালো পাথরের ওপর পাশাপাশি বসে আছে একটি ছেলে আর মেয়ে।

সামনে ধোঁয়াধোঁয়া আকাশ। মেয়েটি ছেলেটির কাঁধে মাখা রেখেছে।

ছেলেটি হঠাৎ উঠে চলে গেল। মেয়েটি এখন একা বসে আছে। দূরে কোথায় কোকিল ডাকছে বিধবার কান্নার মতো।

স্টার্ট সাউন্ড। স্টার্ট সাউন্ড। টেক ওয়ান।

আমরা দুজনেই চমকে উঠেছি। একটা বিশাল গাড়ির ভেতর থেকে শব্দটা ভেসে এল। একগাদা যন্ত্রপাতির সামনে কানে হেডফোন লাগিয়ে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। মাতুল চিত্রাদেবীকে হাতপা নেড়ে কী যেন বলছেন। সব কথা শোনা যাচ্ছে না। কেবল তুমি তুমি শুনছি। দু’জনেই বেশ উত্তেজিত।

প্রবীরবাবু বললেন, মনে হচ্ছে, জয় খুব রেগে গেছে। স্বাভাবিক। নায়িকা হবার জন্যে একেবারে খেপে উঠেছে। তুমি এলে জয়ের সঙ্গে, চললে রাখালবাবুর সঙ্গে। কোনও মানে হয়!

আমরা একটু পিছিয়ে পড়েছি। বুঝতে পারছি না গুরু শিষ্যায় কী হচ্ছে। তবে গুরুতর একটা কিছু হচ্ছে। চিত্রাদেবী হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মাতুল এগিয়ে চললেন হনহন করে। পেছনে ফিরেও তাকালেন না। আমরা চিত্রাদেবীর প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছি। জিজ্ঞেস করতে যাব, হল কী?

হঠাৎ তিনি সামনে দু’হাত বাড়িয়ে হেরে রে রে করে মাতুলের দিকে ছুটে চললেন। সেই নদের নিমাইয়ে দেখেছিলুম, শচীদেবী এইভাবে ছুটছিলেন নিমাই নিমাই করে।

প্রবীরবাবু বললেন, যাঃ শালা, সিনেমা দেখছি এইখানেই শুরু হয়ে গেল। মেয়েছেলের কারবার!

এই অবসরে আমরা খুব কাছাকাছি এসে গেছি। মাতুল বললেন, যাও না যাও, আমার কাছে কেন? নায়িকা হও গে যাও।

দাদু সঙ্গে দোহার দিয়ে চলেছেন, সমানে এক সুরে, আত্মসংযম চাই, ভেসে যাবে, ভেসে যাবে।

সারেঙ্গি মিঞা মাথা নাড়ছেন আর বলছেন, শোভানাল্লা, শোভানাল্লা।

ব্যাপারটা কতদূর গড়াত কে জানে! চিত্রাদেবীকে বাঁচিয়ে দিলেন লাটু ওস্তাদ। দামুবাবু ঘোষণা করলেন, ওস্তাদ এসে গেছে উইথ ফুল টিম।

প্রকৃতই ওস্তাদের মতো ওস্তাদ। কাপড় পরেছেন ঠিক লাটুবাবুর মতে, মালকোঁচা মেরে, দু’পাশে পেখম উড়ছে। প্রবীরবাবুর সবেতেই একটা কিছু বলা চাই। নিজের মনেই বলছেন, বাবা, কী ভঁসা, ডাসা চেহারার নাচনেওয়ালি।

সত্যিই তাই, নাচিয়ে মেয়েদের চলার ধরনই আলাদা। ডান হাত শরীরের ডান পাশে ছেতরে আছে। নড়ছে যেন নৌকোর বইঠা বাওয়া হচ্ছে। আর কোমর থেকে শরীরের নিম্নাঙ্গে এমন কায়দায় দুলছে, তওবা তওবা। সে কী ছন্দ! যাব কি যাব না। লটাকে চলানা। মুকুতা ঝুলানা। এতদিনে বুঝলুম, মা দেখেছি, মাইমা দেখেছি, মাসিমা দেখেছি, দিদি দেখেছি, রমণী দেখিনি। আজ দেখলুম। রমণীয় রম্যতাং। মাতামহ একদিন সন্ধ্যাকালে নারকেল গাছের তলায় উবু হয়ে বসে বলেছিলেন, পাস্তুরানি, যখনই দেখবে মন বড় চঞ্চল হয়েছে, রিরংসার ইচ্ছে হচ্ছে, তখনই ভর্তৃহরির বৈরাগ্যশতকের সেই শ্লোকটি আবৃত্তি করবে,

স্তনৌ মাংসগ্রন্থী কনককলসাবিত্যুপমিতৌ
মুখং শ্লেষমাগারং তদপি চ শশাঙ্কেন তুলিতং।
স্রবনূত্রক্লিন্নং করিবরকরস্পর্ধি জঘনং
মুহুনিন্দং রূপং কবিবরবিশেষৈগুরুকৃতম্‌।

ফ্যালফেলে দৃষ্টিতে তাকাচ্ছি, আর আবৃত্তি করছি। করলে কী হবে! খোস একবার চুলকে উঠলে আর রক্ষে আছে। স্থানকালের বিচার থাকে না। খামোর খামোর চুলকোতে থাকে। তিন বাতসে লট হেয়, দাড়ি চামড়ি, পেট। একেই আমি সহজে কেতরে পড়ি, চোখের সামনে এই ডুবে যৌবনের র‍্যালায় মনের মাচা মচমচ করছে। অক্ষয় কাকাবাবু বলেছিলেন, এ ছেলে আপনার নাচিয়ে হতে পারত! মা আমি নাচিয়ে হব। কলসি গেল ছলকে ছলকে। ভোলে বোম্বা উঠল দুলে।

লাটুবাবুকে দেখে মাতুল নেচে উঠলেন। এতক্ষণ চিত্রাদেবী চারপাশ আলো করে রেখেছিলেন, এখন একেবারে চাঁদের হাটবাজার। কনক কলসের কলকাকলিতে টলমল। সারেঙ্গি মিঞার ডাক পড়ল। প্রবীরবাবু বললেন, বাবা, জয় দেখছি পুরো বাইজি পাড়াটাকে উঠিয়ে এনেছে। সামলাবে কী করে! গাদা গাদা টাকার ব্যাপার!

এদের বাইজি বলে প্রবীরমামা?

হ্যাঁ গো! কত বড়লোকের বাড়িতে এখন ঘুঘু চরছে। জানো কি?

বিশাল একটা ঘরে আমরা ঢুকে পড়লুম। মাঝখানে আলো, চারপাশে অন্ধকার। শয়ে শয়ে ইলেকট্রিক তার এপাশ থেকে ওপাশে, ওপাশ থেকে এপাশে ছুটোছুটি করছে। উটমুখো হয়ে চললেই হুমড়ি খেয়ে পড়তে হবে। লাটুবাবু, মাতুল, দলবল, আলোর বৃত্তে চলে গেছেন। বেশ ভারী চেহারার এক ভদ্রলোক হাত নেড়ে নেড়ে নানা কথা বলছেন। প্রবীরবাবু বললেন, মনে হচ্ছে ইনিই জয়ের ছবির ডিরেক্টর।

একপাশে মেকআপ নিয়ে এক ভদ্রলোক, ভুল বলা হল, অভিনেতা বসে আছেন। বসে আছেন রাজার মতো। প্রবীরবাবু বললেন, চিনতে পারছ?

এ দেখি ভাল পরীক্ষায় পড়া গেছে। চিনতে পারছ? চিনতে পারছ?

জহর গাঙ্গুলী। প্রবীরবাবু হাত তুলে নমস্কার করলেন। সাংঘাতিক তারকাভক্ত মানুষ।

অন্ধকার থেকে চাপা গলায় কে যেন ডাকল, পিন্টু। খুব পরিচিত নারীকণ্ঠ। চেয়ারে বসে আছে। অন্ধকারে আবছা।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত