১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট

১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট

১.১৯ মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট

মারকাটারি বগল চাপ কারবারে গুনচট

ডাকে একটা চিঠি এল। খামের বুকে পাতলা কাগজের জানলা বসান। সেখান থেকে উঁকি মারছে আমার নাম। ভেতরে টাইপ করা চিঠি। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান ইন্টারভিউতে ডেকেছেন। যাবতীয় কাগজপত্র নিয়ে সাত দিন পরে সকাল দশটার সময় উপস্থিত হবার সংক্ষিপ্ত আদেশ। যাক এতদিনে তবু একটা ডাক এল। জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ। খুবই আতঙ্কজনক ব্যাপার। কনে দেখার মতো। একটু হাঁচো তো মা। একটু কাশো তো মা। দু’লাইন কবিতা বলো তো মা। সামনে দিয়ে দু’পা হেঁটে যাও তো মা। সাধারণ চাকরি। কী আর এমন জিজ্ঞেস করবে। বি সি এস কি আই সি এস হলে চিন্তার ছিল। চাকরিটা যদি হয়ে যায়, তা হলে বেশ মজা হয়। গোঁফ বেরোলেই কি সাবালক হয়! বেড়াল তো গোঁফ নিয়েই জন্মায়। সাকার না হলে আকার আসে না।

টেবিলের ওপর গোল একটা আয়না বসিয়ে পিতা চিবুক উলটে দাড়ি কামাচ্ছেন। হাতে কায়দা করে ধরা সেই বাটলার ক্ষুর। বেঁটে ঝকঝকে ফলা। বাঁটটা ভারী সুন্দর। ওটা নাকি হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি। সোনালি পিন দিয়ে আঁটা। রূপসির নাকছাবির মতো ঝিলিক মারছে। সড়াক করে টান মারছেন। সাবানের ওপর দিয়ে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড তৈরি হচ্ছে। দাড়ি কামাতে বেশ সময় লাগে। সোজা টান, উলটো টান। মাঝে মাঝে হাত বুলোনো। কড়কড় করলেই উলটো টান।

প্রশ্ন করলেন, কার চিঠি? ইনশিয়োরেন্সের?

আজ্ঞে না, ইন্টারভিউ।

তাই নাকি? তা হলে জীবিকার জগতে ঢুকলে? কোন প্রতিষ্ঠান?

সি এইচ লরেন্স।

প্রাইভেট ফার্ম। একজন ডিরেক্টারের সঙ্গে আমার আলাপ আছে। সত্যিই যদি চাকরিটা চাও তা হলে একটা চিঠি লিখে দিতে পারি।

নিজের জোরে কী হয় দেখি না।

বাঃ, এই তো চাই। পুরুষকার তৈরি হচ্ছে।

উত্তর দিক থেকে একঝলক ধোঁয়া এসে ঘরে ঢুকল। নীচে প্রফুল্লকাকার স্ত্রী তোলা উনুনে আগুন দিয়েছেন। পিতা বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি যেন সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়েছি, সরাসরি তাঁর মুখে। আমতা আমতা করে বললুম, আজ্ঞে, ধোঁয়া।

হ্যাঁ, ধোঁয়া। স্মোক নুইসেন্স। সহ্য করা শক্ত।

রাঁধতে গেলে আগুন তো দিতেই হবে।

তুমি কি ও-তরফের অ্যাডভোকেট?

যা বাব্বা! নীচের তলায় থাকার জন্যে আমি ওঁদের ডেকে এনেছি নাকি! পিতা সুর পালটে বললেন, মহিলা রাঁধেন ভাল। সেদিন ধোঁকা কেমন খেলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, অসম্ভব ভাল বেঁধেছিলেন।

প্রায় বছর দশেক পরে আমি ধোঁকা খেলুম। তোমার মা রাঁধতেন ভাল। তবে জীবনটা তত বড় সংক্ষিপ্ত ছিল। খেলা না ফুরাতে, খেলাঘর ভেঙে সরে পড়ল। চলবে না।

আসা-যাওয়ায় তো মানুষের হাত নেই।

আরে দুর, উনুন না-ধরালেই ধোঁয়া আসবে না। এর চেয়ে সহজ সমাধান আর কী আছে।

না, আমি ভেবেছিলুম, আপনি মানুষের আসা-যাওয়ার কথা বলছেন।

আরে না না, মানুষ তো আসবে-যাবে। ইন্টারন্যাল প্রসেস।

একফালি চামড়ায় সটাসট বারকতক ক্ষুর শানিয়ে নিলেন। গালে আবার একবার সাবান চাপছে। হাত থামিয়ে বললেন, ডেকে আনো।

কাকে? কাকিমাকে?

গবেট। কোনও পুরুষ পরস্ত্রীকে ডাকতে পারে? প্রফুল্লকে ডেকে আনে।

প্রফুল্লকাকার স্ত্রীর নামে সাবেক কালের একটা গন্ধ আছে, আঙুরবালা। ভদ্রলোক আদুরে গলায় ডাকেন, আঙুর। ও আঙুর। মহিলার বরাতে স্বামীর আদরের চেয়ে অনাদরই বেশি জোটে। যেকদিন এসেছেন, তার মধ্যেই দু’-এক পক্কড় চড়চাপড়ও হয়ে গেছে। মহিলা সত্যিই অসম্ভব কাজের। নীচেটাকে কেমন তকতকে ঝকঝকে করে ফেলেছেন। পাতকোতলা থেকে যে নর্দমাটা সোজা সদর রাস্তার নর্দমার দিকে পড়েছে, সেটা এতকাল খোলাই থাকত। আঙুর কাকিমা লম্বা কাঠ পেতে নগ্নতা ঢেকেছেন। বিচিত্র বোদা গন্ধটা আর নেই।

হুট করে নীচে নেমে বড় অপ্রস্তুতে পড়ে গেলুম। সকালের দিকেই যে প্রফুল্লকাকার এমন সোহাগ পেয়ে বসে আছে, কী করে জানব। কিছু একটা করছিলেন, আমার ডাক শুনে চমকে ফিরে তাকালেন। একটু অপ্রস্তুত ভাব।

এই যে মাস্টার পিন্টু?

আঙুর কাকিমা তাড়াতাড়ি ঘরের অন্ধকার অংশে সরে গেলেন।

আপনাকে বাবা একবার ডাকছেন।

অ্যাঁ, ডাকছে! এ পোশাকে যাই কী করে। হাগা, এই ফুলফুল শাড়ি পরে যাওয়া যাবে।

স্ত্রী সমর্থন করলেন না। উনি রাগী মানুষ। শাড়ি পরে যাবে কী করে? ধুতি পরে যাও।

ভাঁজ করা শাড়ি ছেড়ে ধুতি পরতে হলেও যে বিড়ি ধরাতে হয় এই প্রথম দেখলুম। উনুন থেকে কাগজে করে আগুন তুলে নিলেন। মুখে এখনও দাঁত পরেননি। বিড়ির টানে চোপসানো গাল আরও চুপসে গেল। বাজপাখির ঠোঁটের মতো নাক আর ছিটেগুলির মতো দুটো চোখ ছাড়া মুখে আর কিছু আছে বলে মনে হল না। ঠোঁটের ফাঁকে বিড়ি, চামচের মতো দুটো চোখের রসগোল্লা তুলছে আর নামাচ্ছে। গায়ে হাতকাটা গেঞ্জি। সারাগায়ে গুলির বাহার। ঠেলে ঠেলে আছে। যারা উপযুক্ত আহার ছাড়া রিঙে ব্যায়াম করেন তাদের চেহারাই এইরকম পাকতেড়ে হয়।

কী বলছ হরি, কী বলছ হরি, করতে করতে সিঁড়ি ভাঙতে লাগলেন। হাতকাটা গেঞ্জিটা ছাড়লে পারতেন। স্যান্ডো গেঞ্জি পরলে পিতা বড় অসন্তুষ্ট হন। হাত তুললেই বাহুকেশ উঁকি মারে।

দাড়ি কামানো শেষ করে পিতা ক্ষুরের পরিচর্যায় ব্যস্ত। সামান্য ধোঁয়া তখনও ঘরে ইলিবিলি করছে। শোনো প্রফুল্ল, এ চলবে না।

প্রফুল্লকাকা কিছু না বুঝেই বললেন, ঠিক বলেছ এ আর চলে না।

তা হলে ব্যবস্থা করো।

দিয়ে দাও, আজই শান দিয়ে নিয়ে আসি।

শান? পিতা অবাক হলেন। কীসের শান?

ক্ষুর। ক্ষুরে ধার কমবেই। মাঝে মাঝে ধার দিতে হয়।

আমি ধোঁয়ার কথা বলছি। তোমার নীচের সমস্ত ধোঁয়া ওপরে আসছে। তার কী হবে?

আমাদের তো দুটি খেতে হবে, হরি।

তোমাকে আমি ধোঁয়ার কথা প্রথমেই বলেছি। তুমি বলেছিলে, আপনি আর কপনি, প্রাইমাস স্টোভেই মেরে দেবে। সে কথা তুমি রাখলে না।

বড্ড খরচ হরি। কয়লাতে একটু সাশ্রয় হবে। জানোই তো আমি কী কাজ করি। সামান্য মাইনে।

উটের নাক গলাবার গল্পটা তোমার মনে আছে? গিভ দেম অ্যান ইঞ্চ, দে উইল আস্ক ফর অ্যান এল। এমনি থাকো আমার আপত্তি নেই, ধূমায়িত অবস্থায় আমার আপত্তি আছে।

বেশ তাই হবে। প্রফুল্লকাকা করুণ মুখে উঠে দাঁড়ালেন। চলে যাচ্ছিলেন। পিতা গম্ভীর গলায় বললেন, যাও জিজ্ঞেস করে এসো।

কী জিজ্ঞেস করব হরি? কাকে করব?

তোমার স্ত্রীকে। আমাদের রান্নাঘরে রাঁধায় তার আপত্তি হবে কি না? ধোঁয়া বেরোবার চিমনি আছে। এক জাপটে সব হয়ে যাবে।

অ্যাঁ, বলো কী? তুমি তা হলে আমাদের রান্না খাবে?

না।

তা হলে?

তা হলে, ভেরি সিম্পল। পালা করে রান্না হবে। সকাল ন’টার মধ্যে আমাদের সব শেষ হয়ে যাবে। তোমাদের শুরু হবে। ইচ্ছে করলে বিকেল পর্যন্ত চালাও। রাত আটটায় আবার আমাদের পালা।

এখন আমরা কোন পালায় পড়ব? এখন তো প্রায় এগারোটা বাজে।

আজ তো তোমরা আগুন দিয়েই ফেলেছ! সকালটা সেরে নাও। বিকেলে যে-পালা বেঁধে দিলুম, সেই পালা অনুসারেই চলবে।

ভেরি গুড, ভেরি গুড। প্রফুল্লকাকা নীচের দিকে পা বাড়ালেন।

হ্যাঁ শোনো। আবার বাধা। পিতা আপাদমস্তক তবলচি বন্ধুকে দেখে নিলেন একবার।

এই ধরনের অঙ্গসজ্জা আমি অপছন্দ করি। ভবিষ্যতে আমার সামনে যখন আসবে, হয় আদুড় গায়ে, না হয় পুরোহাতা গেঞ্জি পরে। এই ধরনের গ্রহণ-লাগা গেঞ্জি চলবে না।

ও ইয়েস, ও ইয়েস। আই চেঞ্জ ক্লথ, নট চেঞ্জ গেঞ্জি। রিমেমবার। রিমেমবার।

এ কী ইংরিজি রে বাবা। পিতার বন্ধু, অথচ শীলন, পরিশীলন, শিক্ষা-দীক্ষা কিছুই তেমন নেই। এমন মানুষকে সহ্য করবেন কেমন করে! উনি আবার ফুসুর ফুসুর করে বিড়ি খান। গোদের ওপর বিষফোঁড়া।

ঊর্ধ্বশ্বাসে একটি গাড়ি আসার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলুম। আমাদেরই বাড়ির সামনে সশব্দে ব্রেক কষে থেমে গেল। দরজা বন্ধের শব্দ হল। মনে হয় প্রতাপ রায়। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। মাতুল এলেন। পিতা খাপে ক্ষুর ভরতে ভরতে বললেন, কী ব্যাপার হে, অমাবস্যায় চাঁদের উদয়।

অঙ্গে চাঁপাফুল রঙের পাঞ্জাবি। ফিনফিনে দিশি ধুতি। উঃ যা মানিয়েছে। একেবারে প্রিন্স অব ওয়েলস। মাতুলের হাসিটি ভারী চমৎকার। সোনার চশমার আড়ালে জ্বলজ্বলে টানা চোখ। চোখ হাসছে, মুখ হাসছে। সর্ব অঙ্গে হাসির হিল্লোল।

দুটো জিনিস চাইতে এলুম।

একটা নয়, একেবারে দুটো। বলো, কী বস্তু?

আপনার সেই মুগুর দুটো। আর আমার এই ভাগনেটিকে।

ফর গুড, না ফেরত দেবে।

না না, ফেরত দোব। ফাস্ট আইটেম, রিটার্নেবল হোয়েনেবল, সেকেন্ড আইটেম সন্ধের মুখেই ফিরিয়ে দেব।

হঠাৎ মুগুর নিয়ে কী করবে? ভাঁজবে?

চেয়ারে গুছিয়ে বসে মাতুল বললেন, আমার ছবি ফ্লোরে নেমে পড়েছে। তিন দিন কাজ হয়ে গেল। আজ চতুর্থ দিন। আজ যে-শটটা নেওয়া হবে, সেই শটে একটু মুগুরটুগুর ভাজার ব্যাপার আছে।

স্টোরি কার?

স্টোরি আমরা সবাই মিলে তৈরি করেছি।

সে আবার কী? বারোয়ারি দুর্গাপুজো!

ফিলমে ওইটাই চলে। একটু অ্যাকটিং, একটু গান, পারলে এক রাউন্ড নাচ, আবার একটু অ্যাকটিং। ফুটবলের মতো, পাস দিতে দিতে পাস দিতে দিতে এগিয়ে চলা।

তা তোমার এ কাহিনি কি লাভস্টোরি?

না, না, প্রেমফ্রেম খুব জোলো ব্যাপার। আমার হল দেশাত্মবোধ। ভারত জাগিল তবু কই? দেশ বিভাগ, দাঙ্গা, বিশ্বাসঘাতকতা, দুর্নীতি, চক্রান্ত, কালোবাজারি…

সব মিলিয়ে একটা ক্যাডাভ্যারাস কাণ্ড।

ক্যাডাভ্যারাস বলছেন কেন?

দেশাত্মবোধে আবার নাচ আসে কোথা থেকে। তা ছাড়া এ দেশে দেশাত্মবোধ ছিল স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত। আদর্শ ছিল, আত্মত্যাগ ছিল, স্বাদেশিকতা ছিল। এখন তো আবার সেই নীচের দিকে স্রোত বইছে। মেরি করেলির ভারত, চিকেনারি, পারজারি, ফোরজারি, বাফুনারি।

অ্যা, ঠিক ধরেছেন। আমাদের গণেশ উদ্বাস্তুদের নামে করোগেটেড শিট বের করে ব্ল্যাকে ঝেড়ে ঝেড়ে আটচালা থেকে তিনতলা বাড়ি হাঁকালে। আমাদের মেধো হল ভারী নেতা। আগে বাড়ি বাড়ি মাঝরাতে সিঁদ দিয়ে বেড়াত, এখন ওয়াগন ভাঙে। নেতা আবার ডাক্তারদের মতো চেম্বার খুলে বসেছে। সকাল, বিকেল দরবার বসে। A film not only entertains but it also educates. এইসব মূঢ়, স্নান, মূক মুখে দিতে হবে ভাষা। কোরাসে একটা গান রেখেছি, মুখোশ খোলো, মুখোশ খুলে মানুষ চেনো, মুখোশ খোলো। মুখের কথায় ভুল বুঝো না, চিনতে শেখো, কোন কথাটা কথার, কোন কথাটা মনের। মুখোশ খোলো। বাউলের সুরে নেচে নেচে ধরেছি একেবারে তেড়ে চড়া পরদায়। ফাটাফাটি ব্যাপার। মারকাটারি বগল চাপ।

এ আবার কী ল্যাঙ্গুয়েজ!

ভুল হয়ে গেছে। ককনি। দেশবিভাগের পর এইসব ল্যাঙ্গোয়েজ খুব চলছে। যেমন কারবারে গুনচট।

মাপ করো রাজা। মানে মানে এখন কেটে পড়তে পারলেই ভাল হয়। একে বলে বাস্টার্ড কালচার।

আপনিও ওই ফাঁদে পড়ে গেছেন। না জেনেই। এইমাত্র দুটো শব্দ ব্যবহার করে ফেললেন, মাপ করো রাজা, আর, কেটে পড়ো। আপনার পিতাঠাকুর এসব ভাষা ব্যবহার করতেন না।

করতেন না?

কখনওই না।

তা হলে আমি কোথা থেকে শিখলুম। আমি তো কারুর সঙ্গে তেমন মিশি না।

ওই যে জানলা। ওই জানলা দিয়ে আলো আসে, বাতাস আসে, শব্দ আসে, ধুলো আসে, ধোঁয়া আসে।

ঠিক বলেছ। গবাক্ষ পথেই স্ল্যাংয়ের আনাগোনা। The dogs did bark, the children screamed/up flew the windows all/And every soul bowled out. Po fra NTCST Taigi কীরকম মনে আছে দেখেছ?

আপনার মেমারি একেবারে ফোটোগ্রাফিক মেমারি।

তা, তোমার নায়ক না হয় মুগুর ভাঁজবে, তোমার ভাগনে কী করবে?

কোরাসে গান গাইবে। আজ গানের টেক আছে।

টেক মানে?

শট ফর টেকিং।

ও গানের কী জানে?

যা জানে তাইতেই মারকাটারি। একবার শুধু রিহার্স করিয়ে নোব।

কী লাভ?,

আহা, ওকে একটু মিশতে দিন, একেবারে ঘরকুনো করে রাখবেন না। এখন ডাকাবুকোর যুগ পড়েছে। যা-তা গান নয়, ডি এল রায়। একবার গালভরা মা ডাকে/মা বলে ডাক, মা বলে ডাক, মা বলে ডাক মাকে।

মাতুলের গলায় সুর এসে গেল। ভাবে বিভোর হয়ে গাইতে লাগলেন–

ডাক এমনি করে, আকাশ, ভুবন সেই ডাকে যাক ভরে,
আর ভয়ে ভয়ে এক হয়ে থাক যেখানে যে থাকে।

প্রফুল্লকাকা গুটিগুটি ওপরে উঠে এসেছেন। এবারে একেবারে আদুড় গা। ফরসা বুকে গুটিকতক লাজুক লোম। পিতার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বললেন, খুলে এসেছি। পুরোহাতা গেঞ্জি নেই। জামা কেচে দিয়েছে। মাতুল এদিকে উদাত্ত সুরে গাইছেন

দুটি বাহু তুলে নৃত্য করে
ডাক রে মা মা বলে,
আর নেচে নেচে আয় রে মায়ের
ঝাঁপিয়ে পড়ি কোলে

প্রফুল্লকাকা বললেন, আমাদের জয় এসেছে। একেবারে জমিয়ে দিয়েছে। তবলাটা নিয়ে আসি তা হলে, বউনি হয়ে যাক।

গান থেমে গেল। চোখ মুদে ছিলেন। চোখ খুলে বললেন, কে, প্রফুল্লদা। এখনও হাত ঠিক আছে?

তা, তোমার বাপ-মায়ের আশীর্বাদে হাত এখনও ভালই চলে।

আপনি এখন আছেন কোথায়?

হরি দয়া করে এই বাড়িতেই আশ্রয় দিয়েছে। খাবদাব আর দু’জনে বাজনা বাজাব।

না, আজ আমি উঠি। ওরে নে নে, চল মুগুর দুটো বের কর।

মাতুল উঠে পড়লেন। আমি এখন যাই কী করে? রান্না খাওয়ার কী হবে? আমার দ্বিধা দেখে পিতা বললেন, ভাবনা নেই। তুমি ঘুরে এসো। এক বেলা আমি চালিয়ে নিতে পারব।

মাতুল বললেন, যাচ্ছিস সিনেমাপাড়ায়, আমি তোকে সাজিয়ে নিয়ে যাব। দেখি তোর জামাকাপড় কী আছে। পাঞ্জাবি আছে?

আজ্ঞে না।

গোটা দুয়েক পাঞ্জাবি করা না! দাঁড়া, আমি তোকে করিয়ে দোব।

পিতা বললেন, উঁহু ভাইস ঢুকিয়ো না। অ্যাভারিস বিগেটস সিন, সিন বিগেটস ডেথ।

পাঞ্জাবিতে ভাইস?

না, তা নয়, তবে ফপিস টেনডেন্সি এসে গেলে ও আর কিছু করতে পারবে না। তুমি তো সব পেয়ে গেছ। তোমার যা সাজে, ওর তা সাজে না। ওকে যে এখনও অনেক দূর যেতে হবে, go thou forth weeping bearing precious seed, until the time comes.

কোন যাওয়ার কথা তিনি বললেন জানি না, তবে মাতুলের গাড়িতে প্রায় কেঁদে ফেলার মতোই পরিস্থিতি তৈরি হল। পেছনের আসনে বসে আছি। হাটুর দু’পাশে দারোয়ানের মতো খাড়া দুটো মুগুর। মাতুল বসেছেন, সামনে, চালকের পাশে।

গাড়িটা কিনে ফেললুম, বুঝলি? যদিও সেকেন্ড হ্যান্ড, তবু বাঘের বাচ্চা। খায় কম।

কী খায়?

তেল রে, তেল। কম তেলে বেশি রাস্তা খায়।

সিটটা এমন কেন? পেছনে খোঁচা মারছে।

গদিটা একটু তেবড়ে গেছে রে। ওসব পালটাতে হবে। দাঁড়া, ডিস্ট্রিবিউটরের টাকাটা হাতে এসে যাক, খোলনলচে সব বদলে রোলস রয়েস করে ফেলব। গাড়ি ছাড়া ফিল্ম হয়? কীরকম যাচ্ছি বল? রাজার মতো!

তা যাচ্ছি। তবে আপনার গাড়ি বড় শব্দ করে। এটা বোধহয় মিলিটারিতে ছিল।

না রে, গাড়িরও পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ আছে। এ হল পুরুষ গাড়ি। ক্ল্যাসিক্যাল আর্টিস্ট। গলা দিয়ে ধ্রুপদ বেরোচ্ছে, সঙ্গে পাখোয়াজের সংগত।

আপনার সেই বন্ধু প্রতাপবাবুর কী হল?

ও প্রতাপ! আর বলিসনি, প্রতাপ ফেঁসে গেছে।

ঘুড়ি ফেঁসে যায় শুনেছি, মানুষও ফেঁসে যায়!

ফাঁসে না। প্রতাপ প্রেমে ফেঁসেছে।

প্রেম?

হ্যাঁ রে ব্যাটা! সেই তোদের বাড়ির মেয়েটা, কী যেন নাম বড়টার।

কনক।

হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই কনক। কনকের সঙ্গে ওর বিয়ে লাগল বলে। তোর ওই মেসোমশাই। উঃ একটা ঘঘাডেল মাল।

আমি জানতুম।

জানবিই তো। ধোঁয়া দেখলেই বুঝবি আগুন আছে। প্রতাপ ছেলে ভাল, তবে কী জানিস, অঢেল পয়সা। পয়সাওলাদের চরিত্র বড় চঞ্চল হয়। আকাশে ভেসে থাকে, মাটিতে পা থাকে না।

আপনারও তো পয়সা আছে।

আমার পয়সা! গান ছাড়া আমার কিছু নেই। জানিস তো, ভাল একটা চাকরি করতুম, ইয়েস স্যার নো স্যারের ভয়ে ছেড়ে চলে এলুম। আমার দুটো গ আছে, গান আর গোঁ। দুটো র আছে, রাগ আর রসনা। আমি খেতে বড় ভালবাসি রে। বেশি না, অল্পঅল্প। কিন্তু বেশ তরিবাদি করে। দুটো ল আছে, লোভ আর লোভয়। দুটো ভ আছে, ভালবাসা আর ভাবনা। নিজেকে চিনতে শেখ ব্যাটা, জীবনে চলার রাস্তা খুঁজে পাবি। বাঁয়ে, বাঁয়ে।

মাতুল হাউমাউ করে পথনির্দেশ দিলেন। চালক বেচারা রাস্তা ছেড়ে যাবার ভয়ে বাঁ দিক হেলে অ্যায়সা স্টিয়ারিং ঘোরালেন দু’হাতে, কনুইয়ের কানকি লেগে মাতুলের সোনার চশমা নাক থেকে খুলে কোলে পড়ে গেল। এদিকে সাইকেলের পেছনে দুধের ক্যান চাপিয়ে এক হিন্দুস্থানি রাস্তায় বাঁক নিচ্ছিল, গাড়ির মাডগার্ডের ধাক্কায় বেসামাল হয়ে ছিটকে পড়ল। মোহনবাগানের গোলকিপার যেন বল বাঁচাতে বডি থ্রো করেছে। দুধের ক্যান রাস্তায় আপন মনে গড়গড়িয়ে চলেছে, ভলকে ভলকে দুধ বেরোচ্ছে, মায়ের করুণাধারার মতো। সাইকেল ঘাড়মুখ গুজড়ে একপাশে পড়ে আছে। শ্যামল মিত্রের সংগীতের মতো, আজ হৃদয়ের কামনা শান্ত, থাকে শুধু ব্যথাভার।

এইসব শৃঙ্খলিত ঘটনাপ্রবাহের দিকে মাতুলের চোখ ছিল। স্বভাববিরুদ্ধ গম্ভীর গলায় বললেন, স্টপ। গাড়ি থামব কি থামব না করছিল, থেমেই পড়ল। দরজা খুলে মাতুল ডান পা বাড়ালেন। চুনোট করা দিশি ধুতির কোঁচা, আসুন বাবু আসুনের ঢঙে ধবধবে সাদা, শৌখিন একটি পা-কে রাস্তায় পদপাতে আহ্বান জানাল।

দেশপ্রেমীর মতো চেহারার এক ভদ্রলোক ভূপাতিত মানুষটির ওকালতনামা নিয়ে তেরিয়া হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। মাতুলের চেহারা আর সাজপোশাক দেখে ঘাবড়ে গেলেন। চারপাশে জ্বলজ্বলে রোদ। সামনে ছ’ফুট লম্বা এক মানুষ। সারাগায়ে গোলাপি আভা। যেন কোনও কাশ্মীরি ললনা লিঙ্গ পরিবর্তন করে জাফরানের মাঠ থেকে উঠে এলেন। ঘাড়ের কাছে উদয়শঙ্করের মতো কোঁকড়ানো চুলে হাত বুলোবার জন্যে একবার আঙুল তুলেছিলেন, অনামিকার হিরের আংটি চড়াক। করে ঝিলিক মেরে উঠল। দুধঅলা গোল-খাওয়া গোলরক্ষকের মতো মুখ করে সামনে এসে দাঁড়াল, গরিব আদমি বড়াবাবু।

মাতুল বললেন, সমঝ গিয়া।

বুকপকেটে হাত দিয়ে চওড়া একটা একশো টাকার নোট বের করে হিন্দুস্থানির হাতে দিতে যাচ্ছেন–দেশপ্রেমী বাধা দিলেন, কে রে, তুই, আমাদের জয় না? দাঁড়া।

মাতুল ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললেন, প্রবীর! তুই আমাদের প্রবীর না!

ব্যস, দুই বন্ধুর মিলন। প্রবীর বলছেন, কী চেহারা করেছিস? একেবারে লেডিকিলার!

মাতুল বলছেন, কী চেহারা করেছিস, কুস্তির পালোয়ান!

হিন্দুস্থানি বলছে, বাবুজি গরিব আমি।

মুগুর দুটো শুয়ে পড়েছিল। সিটের মাঝখানে তাড়াতাড়ি আটকে গেছে। কিছুতেই সোজা করতে পারছি না।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত