লোটাকম্বল: ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল

লোটাকম্বল: ১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল

১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল

আপনার চেয়ে পর ভাল
পরের চেয়ে বন ভাল

গান গাইতেন, আপনার জন সতত আপন, পর কি কখনও হয় রে আপন। কনকের বাবা যেভাবে চলে গেছেন, নিতান্ত স্বার্থপর না হলে এভাবে কেউ যেতে পারে না। কুইক মার্চ অ্যান্ড এগজিট। জীবনে বড়সড় হতে গেলে নিজের কথাই ভাবতে হয়, অন্যের কথা ভাবতে গেলে চলে না। ভেবেছ। কী মরেছ। কে কার?

মাতামহ দরজার আড়াল থেকে ঘরে উঁকি মেরে বললেন, একী, এমন রাখাল রাজার বেশ কেন? মাথায় ফেট্টি। তুমি কি রাখালভাবে সাধনা করছ নাকি?

পিতা চোখ আধ-খোলা করে বললেন, ব্রেকডাউন। একশো তিনটিন হবে। ডান পা-টা ড্যামেজ করে ফেলেছি।

মাতামহ পিতার সামনে চেয়ার টেনে এনে সোজা হয়ে বসে বললেন, তোমার মঙ্গল কিঞ্চিৎ কুপিত। প্রায়ই রক্তপাত হচ্ছে। ফ্রন্টিয়ারে যুদ্ধ করতে গেলেও ঘনঘন এতবার আহত হতে হয় না। তোমার এই কাটা সৈনিকের অবস্থা দেখতে ভাল লাগে না। তুমি হলে আমাদের পুরুষসিংহ। সিংহ যদি গর্জন না করে বেড়ালের মতো মিউ মিউ করে, বড় মন খারাপ হয়ে যায়।

সংসারে চিরকালই আমি এক কাটা-সৈনিক। মাঝেমধ্যে তেড়েফুঁড়ে উঠি, সঙ্গে সঙ্গে ড্যাঙোস খেয়ে চিতপাত হয়ে পড়ি।

তোমাকে ড্যাঙোস মারে এমন পুরুষ মাতৃগর্ভে জন্মায়নি।

আমি তো আছি। নিজেই নিজেকে মেরে ফ্ল্যাট করে দিচ্ছি।

হরিদা আছেন? হরিদা?

অপরিচিত কণ্ঠস্বর। মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি। খদ্দরের খাটো ধুতি। একমাথা আধ-পাকা চুল চারপাশে ঝকড়া কঁকড়া হয়ে ঝুলছে। ধুলোমাখা দুটো খালি পা। অন্তত ফুট ছয়েক লম্বা। তেমনি বিশাল চেহারা। বুকের সবক’টা বোতাম খোলা। ভেতরে আবার গেঞ্জি নেই। বুকে একটাও লোম নেই। মসৃণ, তেলা। কোমলে কঠোরে মেশানো অদ্ভুত এক চেহারা।

হ্যাঁ, আছেন। আপনি আসুন।

কে, অক্ষয় নাকি? পিতা ক্ষীণ কণ্ঠে জানতে চাইলেন।

হ্যাঁ, আমি অক্ষয়। কী ব্যাপার আজ অফিসে গেলেন না?

এই যে পা খোঁড়া করে বসে আছি।

আমার মন বলছিল একটা কিছু হয়েছে। অকারণে বসে থাকার মানুষ আপনি নন।

তুমি ওই চেয়ারটায় বসে পড়ো। আমার শ্বশুরমশায়ের সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে?

না, আপনার মুখে ওঁর কথা আমি শুনেছি। আজ দর্শন হল। একটু পায়ের ধুলো নিই। শুনেছি আপনি অনেক দূর এগিয়েছেন।

মাতামহ পদযুগল কাপড়ের আড়ালে লুকোতে লুকোতে বললেন, না, না, প্রণাম কেন? আবার প্রণাম কেন?

তা বললে হয়, প্রণম্যকে প্রণাম করতেই হবে। অক্ষয়বাবু সামনে ঝুঁকে পড়ে চিকের আড়াল থেকে পা খুঁজে বের করার কসরত দেখাতে লাগলেন। মাতামহ ইজ্জত-যেতে বসা রমণীর মতো মুখভঙ্গি করে বসেই রইলেন।

পিতা বললেন, ধুলো নেবার মতো পা হল তোমার অক্ষয়। যেখান দিয়ে চলেছ সেইখানেই টন টন পদরেণু ঝরে ঝরে পড়ছে।

অক্ষয়বাবু খাড়া হয়ে বললেন, আমি ঝেড়ে দিচ্ছি হরিদা। একটা ঝাডুটাড়ু দিন।

আরে বোসো বোসো। আমি ধুলোর কথা বলেছি। ধুলো ঝাড়ার কথা বলিনি।

আপনার বাড়িতে লোকজন নেই, সারা শহরের ধুলো টেনে এনেছি, দিন না পরিষ্কার করে দিই।

মাতামহ মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, বাড়িতে এখন অনেক লোক। আমাদের সংসার ভরে উঠেছে।

পিতা বললেন, ভরে উঠেছিল, আবার খালি হয়ে গেছে।

সেকী? সব হাওয়া!

আজ্ঞে হ্যাঁ। তারা চলে গেছেন। আরও ভাল বাড়ি, আরও ভাল ব্যবস্থা। আরও সুখসুবিধে। যাক বাবা, বাঁচা গেছে। আর তা হলে জড়োসড়ো হয়ে থাকতে হবে না। আরে আমাদের পুরুষের সংসারে ওসব মানায় নাকি? আমরা নিজেদের মতো খাবদাব আর সানকি বাজাব। এ ক’দিন যেন আমাদের আক্কেল দাঁত উঠেছিল। তা হলে ঝেড়েই দাও।

না না, কোনও প্রয়োজন নেই, তুমি বোসো, আরাম করো। নিশ্চয় হেঁটে হেঁটে এসেছ!

আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার আছে চরণবাবুর জুড়িগাড়ি। তা হলে বাইরে গিয়ে একটু নেচে আসি। যা ঝরার ঝরে যাক।

কোনও দরকার নেই, তুমি শান্ত হয়ে বোসো।

অক্ষয়বাবু বসলেন। বসে বললেন, আমি আরও এলুম, একটা সুখবর আছে। আপনার প্রোমোশনের সেই অর্ডারটা আজ এসে গেছে।

বলো কী? ল্যাং তা হলে মারতে পারল না।

নাঃ ফেল করল। আপনাকে আমি বলেছিলুম, অ্যাস্ট্রোলজিক্যলি আপনার এই প্রমোশন কারুর আটকাবার ক্ষমতা নেই। আপনার ব্যাড ডেজ চলে গেল। এইবার ভাগ্যের রথ গড়গড়িয়ে চলবে।

মাতামহের ঘুমঘুম ভাব কেটে গেল। বড় বড় চোখে তাকিয়ে বললেন, ও, তুমি এনার কথাই বলেছিলে। বিরাট জ্যোতিষী। মর্গে গিয়ে মৃতদেহের হাত দেখে দেখে জ্যোতিষের সত্য অসত্য মেলান।

হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। জ্যোতিষে আমার বিশ্বাস নেই, তবে অক্ষয়ের অধ্যবসায়ে আমার গভীর বিশ্বাস। দেখা যাক ও এই বুজরুকিকে বিজ্ঞানের স্তরে নিয়ে যেতে পারে কি না। মর্গে তোমার সেই ভূত দর্শনের ঘটনাটা ভাবো অক্ষয়?

মাতামহ আরও সোজা হয়ে বসে বললেন, অ্যাঁ, ভূতের হাত? ইনি ভূতের হাত দেখেছেন?

ভূতের হাত নয়, ভূতের হাতে পড়েছিলেন।

আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে।

এসেছে যখন শুনবেন, তার আগে একটু জলযোগ করে নিক। খাইয়ে মানুষ। সারা মাসই তো ওকে নেমন্তন্ন খেয়ে খেয়ে বেড়াতে হয়। ও হল কলকাতার এক নম্বর প্রোফেশনাল খাইয়ে। বড় বড় বাড়ির রেজিস্টারে ওর নাম আছে।

উঃ, একেই বলে ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়। আমরা সারাবছর হাপিত্যেশ করে বসে থাকি, আর ইনি রোজ ভোজ মেরে বেড়ান। ভোজরাজ। কিন্তু ভূতের ব্যাপারটা সন্ধের মুখে সেরে নেওয়াই ভাল। বেশি রাতে ওসব আলোচনা না করাই উচিত। ছোটরা ভয় পেতে পারে।

আমরা তো সবাই বুড়ো দামড়া, ভয় পাবার মতো তো কেউ নেই। এক আপনি যদি ভয় পান তা হলে আলাদা কথা।

আমি একটু ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করি। তোমার মতো অবিশ্বাসী নই। বাগানের একপাশে পড়ে থাকি। বুঝলে কিনা?

আপনি তো তন্ত্রসাধক! আপনার আবার ভয় কীসের?

তা-আ ঠিক। মাতামহ আবার মাথা নিচু করলেন।

পিতা বললেন, নাও, এঁদের একটু জলযোগের ব্যবস্থা করো। আমি তো বেএক্তিয়ার হয়ে পড়েছি। তোমাকে সাহায্য করতে পারছি না।

থাক না হরিদাজলযোগের জন্যে ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? পরে আর একদিন হবে। অক্ষয়বাবু খুঁতখুঁত করে উঠলেন।

আমার ডিকশনরিতে পরে বলে কোনও কথা নেই। আমি জানি, নাও অর নেভার। ওর ট্রেনিংও সেইভাবেই হয়েছে। তুমি কিন্তু কিন্তু কোরো না।

মাতামহ বললেন, আমি সাহায্য করছি। আমরা সব অন্য জাতের মানুষ, কী বলল হরিশঙ্কর! আমরা হলুম গিয়ে অর্ধনারীশ্বর। বাড়িতে মেয়েরা নেই তো কী হয়েছে। আমরা হলুম গিয়ে মেয়েদের বাবা। গর্ভধারণ ছাড়া সবই পারি।

উঃ, আবার আপনার মুখ আলগা হয়েছে। সেদিন কী সারমন দিলুম?

গর্ভধারণ তো খারাপ কথা নয়। একেবারে শুদ্ধ সংস্কৃত।

শব্দটা খারাপ নয়, ভাবটা ভালগার।

তা হলে ওটা তুমি কেটে দাও।

বলা কথা আর ছোঁড়া পাথর আর ওলটানো দুধ হাতের বাইরে চলে যায়।

পিতার মনে হয় জ্বরের দাপট একটু কমেছে। সেই ঝিমুনি ভাবটা আর নেই। অনর্গল কথা বলছেন।

মাতামহ উঠে এলেন। মুখে সেই অনাবিল হাসিটি লেগে আছে। শুভ্র একটি রাজহংস। জীবনের কোনও কিছুই গায়ে মাখলেন না। একবার করে পালক ঝাড়েন আর সব ছিটকে পড়ে যায়। ফিসফিস করে বললেন, আসার সময় দেখে এলুম ওই মোড়ের দোকানে গরম গরম হিঙের কচুরি ভাজছে। এই ফুলোফুলো, লাল লাল।

আপনি যা ভাবছেন আমিও তাই ভাবছি। কচুরি, ঘুগনি, আর চা।

উঃ, তুই আমার নাতির মতো নাতি। তুলসী তোকে রেখে গেছে আমার জন্যে আর ওই দুর্দান্ত ছেলেটার জন্যে। পা-টাকে অমন ক্ষতবিক্ষত করল কী করে?

বাথরুমের দেয়াল ঝরাচ্ছিলেন, পায়ে প্লাসটারের চাঙড় ভেঙে পড়েছে।

নাঃ তুলসী ওকে ভুলতে পারেনি।

তার মানে?

সে তুই বুঝতে পারবি না। এই পৃথিবীর চারপাশে আর একটা জগৎ ঘুরপাক খাচ্ছে। ডাক্তারখানায় যেমন রুগিরা মুড়িসুড়ি দিয়ে বসে থাকে সেইরকম মৃত আত্মারা সেইখানে বসে আছে। ওখানের আলোটা কেমন জানিস?

না।

বিদ্যুৎ চমকালে যেমন নীল আলোলা হয় সবসময় সেইরকম নীল আলো স্থির হয়ে আছে।

কী করে জানলেন?

আমার মনে হয়। তা হলে কচুরি আর ঘুগনি?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

মোড়ের মাথায় দিনুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কী রে, সুখেন কোথায়?

খুব নিরাপদ জায়গায়। আচ্ছা, চুল বেরোতে ক’মাস সময় লাগে রে?

রাখ তোর চুল। জবা ছাত টপকে আমাদের বাড়ির খিড়কি দিয়ে সেই ন্যাড়ার সন্ধানে ছুটেছে।

অ্যাঁ, বলিস কী? পৃথিবীটা হঠাৎ পালটে গেল নাকি! যাই জবাকে খুঁজে বের করি। কেউ জানে?

না, কাউকে বলিনি।

দিনু আবার দৌড়োল। আমাদের গ্রেট দিন।

কচুরি আর ঘুগনি খেয়ে অক্ষয়বাবু একটু ধাতস্থ হলেন। এতটা পথ হেঁটে এসেছেন, বেশ খিদে পেয়েছিল মনে হয়। চায়ের কাপটা সামনে রাখতেই পকেট থেকে খানিকটা তুলো বের করে চায়ে ভেজাতে লাগলেন।

মাতামহ জিজ্ঞেস করলেন, চায়ে তো বিস্কুট ভিজিয়ে খায়, তুলোও খাওয়া যায় নাকি?

আজ্ঞে না, আসার পথে হোঁচট খেয়ে ডানপায়ের বুড়ো আঙুলের নখটা কৌটোর ঢাকা খোলার মতো হয়ে গেছে। চায়ে তুলো ভিজিয়ে একটু বেঁধে রাখি।

এটা কী ধরনের চিকিৎসা?

আজ্ঞে আসুরিক। মানুষ যখন জঙ্গলে থাকত, পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করত, তখন তাদের অনেক দাওয়াই জানা ছিল।

তখন কি চা ছিল?

না, চা-চিকিৎসা আমার আবিষ্কার। চা খেলে পেট মরে যায়, লিভার শুকিয়ে যায়, তা হলে ঘা কেন শুকোবে না, জীবাণু কেন মরবে না? কাটাছেঁড়ায় চা আমার দাওয়াই।

চা-টা যে নোংরা হয়ে গেল।

না, না, নোংরা আবার কী? নোংরা, পরিষ্কার সবই আমাদের মনের বিকার। ওঃ কত বড় সাধক আপনি! ভূত দেখেছেন, ভৌতিক চিকিৎসায় উপকার পেয়েছেন, ভগবান দেখেছেন?

আজ্ঞে না।

দেখবেন দেখবেন। কেউ আটকাতে পারবে না। ঠাকুর বলেছিলেন, যখন গঙ্গার জল আর নর্দমার জল এক মনে হবে তখন বুঝবে ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে। আপনার তো তাই হয়েছে। আপনি প্রকৃত ভাগ্যবান।

আমাকে আপনি আপনি করছেন কেন?

হ্যাঁ, তাও তো বটে। আমি তো বড় একটা কাউকে আপনি বলি না। আপনিটা তুমি নিজের গুণেই আদায় করে নিলে।

পিতা চায়ের কাপ রাখতে রাখতে বললেন, অক্ষয়ের সাহস কত জানেন? তোমার সেই ঘটনাটা বলো না।

কোনটা হরিদা?

সেই বালির ব্রিজে মুণ্ডু কাটা মানুষ।

উঃ, সে ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়।

কীরকম, কীরকম? মাতামহ উত্তেজনায় সামনে ঝুঁকে পড়লেন।

অক্ষয়বাবু বেশ আয়েশ করে বসে গল্প শুরু করলেন। আমি তখন উত্তরপাড়ায় থাকি। বউদির ভীষণ অসুখ। ডাক্তারবাবু এমন এক ওষুধ দিলেন যা কলকাতা ছাড়া পাওয়া যাবে না। রাত হয়ে গেছে। ওষুধ না পড়লে রুগির রাত কাটবে কি না সন্দেহ। বেরিয়ে পড়লুম সাইকেল নিয়ে। কোথাও না পাই শ্যামবাজারের রাইমারে পাবই। শীত পড়েছে জাঁকিয়ে! অমাবস্যা তিথি। যাবার সময় দেখে গেলুম গঙ্গা থেকে হিলহিল করে কুয়াশা উঠছে। ওষুধ পেয়ে গেলুম। ফেরার পথে টালার কাছে টায়ার পাংচার হয়ে গেল। সারাতে সারাতে বেজে গেল রাত দশটা। ফের যখন ব্রিজে উঠলুম তখন মাঝরাত। গঙ্গা অদৃশ্য। ব্রিজ পড়ে আছে নরকে যাবার একফালি রাস্তার মতন। কুয়াশায় ভেসে আছে। মনে হচ্ছে কুরে কুরে রাস্তা বের করতে হবে। সে দৃশ্য ভাবা যায় না। দু’হাত দূরেও দৃষ্টি চলে না। ব্রিজের মাঝামাঝি এসেছি। বাঁ পাশে তাকিয়ে দেখি লোহার গার্ডারে ঠেসান দিয়ে কে যেন বসে আছে। কে রে বাবা! এই শীতের রাত। থিকথিকে কুয়াশা। আত্মহত্যা করতে চায় নাকি! ব্রিজ হল আত্মহত্যার জায়গা। সাইকেল থেকে নেমে পড়লুম। ফুটপাথে ঠেসিয়ে রেখে কাছে গিয়ে। ডাকছি, ও মশাই শুনছেন, ও মশাই শুনছেন? কোনও উত্তর নেই? কাঁধে হাত দিয়ে বললুম, ও মশাই! যেই না নাড়া দিয়েছি, কাঁধ থেকে মুভুটা খুলে ঠাস করে গড়িয়ে পড়ল। কী সর্বনাশ! আমার তো খালি পা। এতক্ষণ পায়ে নরম নরম রবারের মতো কী লাগছিল। ভাল করে তাকিয়ে দেখি আলকাতরার মতো জমাট রক্ত। আর ঠিক সেই সময় একটা স্টিমার গম্ভীর সুরে ভোঁ দিয়ে উঠল। কুয়াশার সাদা চাদর কেঁপে গেল। এপাশ ওপাশ তাকিয়ে চট করে রাস্তা থেকে মুন্ডুটা তুলে নিয়ে আবার কাঁধে ফিট করে দিলুম। চেহারা দেখে মনে হল বেশ মানিড ম্যান। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মনে হল পিঠে কে যেন হাত রাখল। চমকে উঠেছি। পুলিশ নাকি! কেউ কোথাও নেই। অথচ পিঠে হাত রেখেছিল কেউ! ফিসফিস করে কানের কাছে কে বললে, তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও। ঝড়ের বেগে সাইকেল চালালুম। পড়ি কি মরি। বাড়ি ঢুকছি, ভাইপো ভাইঝিরা কেঁদে উঠল। বউদি মারা গেলেন।

পিতা মাতামহের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেমন শুনলেন? আপনি হলে কী করতেন?

মাতামহ ভয়ে জমে পাথর হয়ে গেছেন। নীচের ঠোঁট থিরথির করে কাঁপছে। চোখদুটো প্রায় উলটে গেছে।

পিতা বললেন, একটা ঠোঙা ফুলিয়ে কানের কাছে ফট করে ফাটাও। শক ট্রিটমেন্ট।

অক্ষয়বাবু বললেন, শকে শাক্যং সমাচরেৎ। ভীষণ ভিতু মানুষ।

না না, অন্য ব্যাপারে তেমন ভয় নেই। আগে খুব বাঘের ভয় ছিল। আমাদের সঙ্গে একবার জামতাড়া বেড়াতে গিয়ে রাতে বাঘের স্বপ্ন দেখে মশারিফশারি ছিঁড়ে এমন কাণ্ড করেছিলেন! সে আর এক কাহিনি। পরে তারাপীঠে শ্মশান জাগাতে গিয়ে ভূতের ভয় ধরিয়ে এসেছেন। ভ্রষ্ট তান্ত্রিক। মাঝরাতে ভূতে নাকি আঁচড়ে দিয়েছিল। আঁচড় দেখেই বুঝেছিলাম, খাকশেয়ালের কাজ। সঙ্গে সঙ্গে পাস্তুরে নিয়ে গিয়ে তলপেটে চব্বিশটা।

ফ্যাট করে ঠোঙা ফাটার শব্দ হতেই মাতামহ সংবিৎ ফিরে পেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন। অক্ষয়বাবু বললেন, তা হলে মর্গের গল্পটা না বলাই ভাল। কী বলেন হরিদা!

হ্যাঁ, না বলাই ভাল। সে তো আরও সাংঘাতিক।

মাতামহ বললেন, আমি কিন্তু ভয় পাইনি হরিশঙ্কর। তোমরা আমাকে ভুল বুঝো না। আমি একটা অন্য জগতে চলে গিয়েছিলুম। তুমি যার কাঁধে মুন্ডু ফিট করেছিলে, সে আমার শ্যালক প্রতীপ।

অ্যাঁ, বলেন কী! একই সঙ্গে দু’জনের বিস্ময় প্রকাশ।

হ্যাঁ গো, তোমাদের মনে নেই, সেই পদ্মিনী মামলার কথা?

হ্যাঁ হ্যাঁ, পদ্মিনী মামলা! মনে পড়েছে। বছরের পর বছর চলেছিল। এতদিন আপনি চেপে ছিলেন কেন?

সে যে বড় লজ্জার কথা ছিল।

হ্যাঁ, তা ছিল, লাস্ট, গ্রিড।

হ্যাঁ, একেবারে চটকাঁচটকি ব্যাপার। অক্ষয়বাবু ফোড়ন কাটলেন।

মাতামহ বললেন, প্রতীপ আজ বেঁচে থাকলে কত বড় গাইয়ে হত জানো? ওর মতন অমন ঠুংরি খুব কম গাইয়েই গাইতে পারত। একেবারে আবদুল করিম কেটে বসানো। আমি তোমার ভয়ে বাক্যহারা হয়ে গিয়েছিলুম।

আমার ভয়ে? অক্ষয়বাবু ভুরু কোচকালেন।

হ্যাঁ, খুব বাঁচা বেঁচে গেছ। মনে আছে, মৃতের পাশে একটা ইঞ্জেকশনের অ্যামপুলস্ পড়ে ছিল। সেটা তো তা হলে তোমার পকেট থেকেই পড়েছিল।

পিতা বললেন, যদুর মনে পড়ছে, সেটা তো ছিল মরফিয়া। তুমি কি রাইমার থেকে মরফিয়া কিনেছিলে?

কতদিন আগের কথা, আর কি মনে আছে! হতে পারে মরফিয়া। বউদির মাথায় হেমারেজ হচ্ছিল, এইটুকু মনে আছে।

মাতামহ বললেন, সেইসময় আমি পরপর চোদ্দোদিন টানা সাক্ষী দিয়েছিলুম। আসামিরা সব ওই অ্যামপুলসের জোরে একে একে খালাস পেয়ে গেল। প্রতীপ মরফিয়া নিত না। আসামিরাও নয়। তা হলে মরফিয়া এল কোথা থেকে? খুনির পকেট থেকে। আর তুমিই সেই খুনি। তখন খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজ পাওয়া গেল।

অক্ষয়বাবু শুকনো মুখে বললেন, আপনি কি আমাকে এতদিন পরে সেই খুনি ভাবলেন নাকি? মাতামহ হেসে বললেন, কী, ভয় পেয়েছ তো!

তা একটু পেয়েছি।

দেখলে তো, ভূতের ভয় ছাড়াও, অন্য ভয় আছে। প্রতীপও নেই, পদ্মিনীও নেই। যে খুন। করেছিল, সে এখনও বেঁচে আছে চন্দননগরে। সারাগায়ে শ্বেতী। প্রতীপের প্রেতাত্মা গায়ে হাত বুলিয়ে সাদা করে দিয়েছে। পদ্মিনী পুড়ে মারা গেছে।

পরের খবর কাগজে আর বেরোয়নি। পৃথিবীর আদালত থেকে মামলা গিয়ে উঠেছিল ভগবানের আদালতে। একেই বলে, ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট।

মাতামহ বললেন, জীবনে আমি বহু পাপী দেখেছি। মানুষের আদালতে পার পেয়ে গেলেও ঈশ্বরের আদালতে অন্যভাবে সাজা পেয়েছে। আশু রেল কোম্পানির ক্যাশ ভেঙেছিল। অনেক টাকা। জেলে গেল তার অ্যাসিসটেন্ট প্রভাত। বউটা গলায় দড়ি দিলে। দিন যায়। আশুর একমাত্র ছেলে। খুব বড় ঘরে বিয়ে দিলে। ছ’মাসের মাথায় বাস অ্যাকসিডেন্টে ছেলেটা মারা গেল। দিন যায়। আশুর চোখদুটো গেল। চুরি-টাকার বাড়ি নিলাম হয়ে গেল। তাই বলি, পাপ করার আগে ঈশ্বরের কথা একবার ভেবো। সে চোখকে তো ফাঁকি দিতে পারবে না।

পিতা ব্যান্ডেজ বাঁধা পা-টা সামনে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, এই দেখুন আমার ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট।

অক্ষয়বাবু বললেন, কী ক্রাইম করেছিলেন?

সামান্য অহংকার, একছিটে প্রত্যাশাভঙ্গের ক্রোধ, একটু ঘোলাটে বুদ্ধি, সব মিলে ঘণ্টা কয়েকের পশু। খুব লপচপানি, ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে পানিশমেন্ট। হাতে হাতে গীতার ফল প্রাপ্তি।

ক্রোধাদ্ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ।
স্মৃতিভ্রংশাঘুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশা প্রণশ্যতি ॥

মাতামহ মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, হে হেঃ ব্বাবা, পথে এসো ম্যান। খুব তো পুরুষকার পুরুষকার করতে, আমি কতদিন বলেছি, কারুর কাছে কিছু আশা কোরো না। না পেলেই মন খারাপ, মন খারাপ থেকে অভিমান, অভিমান থেকে রাগ। রাগ হল লাল লোহা। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পশুকে জাগিয়ে তোলে। অহঙ্কারং বলং দর্পং কামং ক্রোধং পরিগ্রহম্‌।

থাক থাক আর গীতা নয়। ও অনেক শুনেছি। মুখে আওড়ে কাঁচকলা হয়। মনকে বশে আনতে হবে।

এই তো, এই তো। তুমি ঘুরে গেছ। এইবার সাধনা। রত্নাকর থেকে বাল্মীকি।

রত্নাকর বাল্মীকি হয়। মিটমিটে মধ্যবিত্ত বাঙালি বাঙালিই থেকে যায়।

অক্ষয়বাবু বললেন, সবই হল গ্রহের প্রভাব। যে যা হবে, সে তা হবে। আগে থেকেই ঠিক করা আছে। সাধু সাধু হবে। চোর চোর হবে।

ওটা আবার তোমার লাইন। আমি বিশ্বাস করি না। ম্যান ইজ এ ক্রিচার অফ সারকামস্ট্যানসেস। তবে কালকের একটা ব্যাপারে আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি।

কীরকম, কীরকম? মাতামহ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন।

কাল আমি একটা স্বপ্ন দেখলুম। আমি যেন মাঝরাতে খোলা ছাতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আকাশটা খুব কাছে নেমে এসেছে।

আহা, কী ভাল স্বপ্ন। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।

দাঁড়ান দাঁড়ান। সবটা আগে শুনুন। আকাশটা খুব কাছে নেমে এসেছে। ধকধক করে তারা জ্বলছে। আমি বলছি, আরে ওই তো কালপুরুষ। যেই বলেছি কালপুরুষ, অমনি কালপুরুষ ঘুরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। অবাক হয়ে ভাবছি, এ আবার কী! কালপুরুষ অমনি হুহু করে নীচের দিকে নামতে লাগল। আলো, আলো। চারপাশ যেন ঝলসে যাচ্ছে। নেমে এল ছাতে। সঙ্গে সেই কুকুরটাও আছে। লোমে হিলহিল করছে আগুন। আমি ভয়ে বলছি, একী একী, আকাশ ছেড়ো না। কালপুরুষ ধনুকে তির জুড়ল। মারবে নাকি! বলতে না-বলতেই তির ছেড়ে দিল। এত আলো, মনে হল সারা পৃথিবী জ্বলে উঠেছে। পেট্রলে আগুন লাগার মতো আমি দপ করে জ্বলে উঠে এক খণ্ড পোড়া কাঠের মতো হয়ে গেলুম। সব দেখতে পাচ্ছি, সব বুঝতে পারছি। নিজেই নিজের সৎকার দেখছি। কালপুরুষ রকেটের মতো আকাশে উঠে গেল। আকাশ সরে গেল। চারপাশে থকথকে অন্ধকার। ছাদে সেই পোড়া কাঠ। হাওয়া লেগে ছাই হচ্ছে, আর পিটপিট শব্দ করছে।

মাতামহ পিতার পিঠে হাত রেখে বললেন, তোমার হয়ে গেছে। তুমি পেয়ে গেছ। তোমার আর দেরি নেই। দীক্ষাটা নিয়ে ফেলল। এখন গেরুয়া পরার দরকার নেই। সবসময় সঙ্গে একটা গেরুয়া রুমাল রাখো। সন্ন্যাসাশ্রমে তোমার নাম হোক, স্বামী হরিহরানন্দ। এই বাড়িটাকে আমরা আশ্রম বানাব। পাঁজিতে তোমার নাম তুলে দোব।

আহা উত্তেজিত হবেন না। কী স্বপ্নের কী ব্যাখ্যা! কাল রাতে ওই স্বপ্ন, আজ সকালে আহত, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। দুটোর মধ্যে কেমন যেন যোগসাজস খুঁজে পাচ্ছি। অক্ষয়, তুমি এর কী মানে করবে?

আজ্ঞে, আমি তো তেমন স্বপ্নতত্ত্ব জানি না। তবে, মনে হয়, আপনার এই প্রমোশনের সঙ্গে ওর কোনও যোগ আছে।

মাতামহ মানতে পারলেন না। আরে, না হে না, একেবারে আধ্যাত্মিক স্বপ্ন। নক্ষত্র জ্যোতিতে পুড়ে ছাই হয়ে হরিশঙ্কর নবীন জন্ম লাভ করে ঊর্ধ্বে আরোহণ করছে। এসব স্বপ্নের অর্থ তোমরা কী বুঝবে! আচ্ছা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব? হয়তো বলতে পারবে, জ্যোতিষ ট্যোতিষ করো তো।

অক্ষয়বাবু বললেন, বলুন, জ্ঞান থাকলে বলব।

এই বাড়িটা, বুঝলে অক্ষয়, এই বাড়িটায় একটা কিছু আছে। সংসারটা একেবারে ছারখার হয়ে গেল। এই দুটো সলতে কেবল টিমটিম করে জ্বলছে। নাতিটা তো একটা বদ্ধ পাগল। এই বয়েসের ছেলে, একটা সিগারেট খায় না, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেশে না, যাত্রা থিয়েটার দেখে না, আবার বেদবেদান্ত পড়ে। ব্যাটা মহাপুরুষ না কাপুরুষ বোঝা দায়। আমার কী মনে হয় জানো?

কী মনে হয়?

মাতামহ পিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, যাও, কুলকুচো করে এসো। কতদিন বলেছি, চা খাবার পর মুখ ধোবে। দাঁত ভাল থাকবে। শেষ বয়েসেও দোলের দিন মঠ আর ফুটকড়াই খেতে পারবে।

আপনিও তো চা খেলেন?

আমি? এই দেখো! মাতামহ পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে আস্ত দু’পাটি দাঁত বের করে দেখালেন। মাতামহ যেন নিজের হাতের তালুতেই পড়ে পড়ে খিলখিল করে হাসছেন।

এই যদি আপনার অবস্থা হয় তা হলে আমার আর নিয়ম মানার প্রয়োজন নেই। পা নিয়ে নড়তে পারছি না। আতুরে নিয়ম নাস্তি।

মাতামহ আবার পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরে গেলেন, আমার কী মনে হয় জানো, এই বাড়ির উত্তরের ওই বাগানে কোথাও একটা হাড় পোঁতা আছে।

শ্রোতারা সমস্বরে বললেন, হাড়?

হ্যাঁ, হাড়। সেই হাড়টা মাটি খুঁড়ে তুললে দেখা যাবে, সরু সরু কালো কালো লোম বেরিয়েছে।

শ্রোতারা বললেন, সে আবার কী?

মাতামহ বড় বড় চোখ করে বললেন, তোমরা এসবের কতটুকু জানো। দু’কলম ইংরেজি পড়ে সব পণ্ডিত হয়ে গেছ। নিশির ডাক শুনেছ?

ডাক শুনিনি, তবে আছে শুনেছি।

আমাদের শশাঙ্ক সাড়া দিয়ে চোখের সামনে মারা গেল। আড়াই প্রহর রাতে গুণিন এসে বাড়ির সামনে দাঁড়াল, হাতে একটা মুখ-খোলা ডাব। শশাঙ্ক, শশাঙ্ক, তিনবার ডাকল, শশাঙ্ক আছ! শশাঙ্ক ঘুমের ঘোরে উত্তর দিল, কে, যাই। ব্যস কপ করে ডাবের মুখে চাপা পড়ে গেল। শশাঙ্কর প্রাণবায়ু চলে এল ডাবের জলে। সেই জল খেয়ে বেঁচে উঠল মণি চাটুজ্জে। আজও বুড়ো বেঁচে আছে। তেজপক্ষের বউটা সংসার ছারখার করে দিলে। প্রথম পক্ষের বড় ছেলেটার সঙ্গে, সে আমি বলতে পারব না, তুমি আবার বকাবকি করবে।

বুঝতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি। সবসময় সবকথা বলার দরকার করে না। কবিদের মতে ব্যঞ্জনায় মেরে দিতে হয়।

তা হলে দেখো, তোমার ট্রেনিংয়ে কীরকম তৈরি হয়েছি। রেলের মালবাবু থেকে কবি কালিদাস। যাক যে কথা বলছিলুম, তুমিই তো শিখিয়েছ, বেশি লাইন চেঞ্জ করা খুব খারাপ। মেন লাইন ধরে থাকতে হয়। মাঝরাতে পৃথিবীর চেহারা কীরকম দাঁড়ায় জানো? তোমার স্বপ্নের মতো। মাপার উপায় নেই, তা হলে সত্যি সত্যিই দেখতে পেতে, আকাশ অনেকটা নীচে নেমে আসে। তারাদের চোখ ড্যাবড্যাবা হয়ে ওঠে। গাছ চুল এলো করে দেয়। গর্তে আগুন জ্বলে, নদীর জল রক্তগোলা হয়ে যায়, কবরে কবরে মৃতদেহ উঠে বসে। এ সব আমার দেখা। তারাপীঠের মহাশ্মশানে বসে দেখেছি।

আপনি দেখছি, আর এক মিলটন।

ও, সেই অন্ধ মহাকবি। অন্ধ না হলে মনের চোখ খোলে না। আচ্ছা, তোমার সেই হ্যাঁমিলটন সায়েবকে মনে আছে! রোজ কলকাতা থেকে প্লেনে চেপে দিঘার সমুদ্রে চান করতে যেতেন।

আবার লাইন চেঞ্জ করছেন।

মিলটনের নাম শুনে হঠাৎ মনে পড়ল, তাই জিজ্ঞেস করলুম। এই যে তুলসী, তুলসী আমার মেয়ে, তুলসী কেন মারা গেল?

পিতা বললেন, ওসব অসুখের এখনও কোনও চিকিৎসা বেরোয়নি।

ও তোমাদের কথা। আমি জানি, তুলসী কেন মারা গেল। মনে আছে, ওর তারে-মেলা শাড়ির আঁচলের খানিকটা কেটে নিয়ে গেল। তোমরা সন্দেহ করলে হাবুর মাকে। তুলসী আর ভাল হল না। হাবুর বউ কিন্তু এখনও বেঁচে আছে। দশ-দশটা ছেলেমেয়ে, এই গতর। মাছের ভেড়ি করে হাবু এখন ধনকুবের। লোকে বলে বেড়াচ্ছে, বিধান রায় মন্ত্রী হবার জন্যে ডেকে পাঠিয়েছেন। তার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। হাবুকে ডেকে পাঠাবেন। বাংলাদেশে যেন মানুষের অভাব।

লৌকিক জগৎটাকে আগে ভাল করে জানি, তারপর সময় থাকলে অলৌকিক নিয়ে মাথা ঘামানো যাবে।

পিতার কথায় মাতামহ কেমন যেন মিইয়ে গেলেন। অক্ষয়বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার নাতির হাতটা একবার দেখো না। বেশ বড়টড় একটা কিছু হতে পারবে কি না?

ওর হাত আমি দেখেছি। হরিদা অ্যালাউ করবেন না, তা না হলে ও খুব ভাল নাচিয়ে হতে পারত। ড্যান্সার।

মাতামহ বড় আনন্দ পেলেন, অ্যাঁ, বলো কী? উদয়শঙ্কর! কালই তা হলে নিয়ে যাই।

পিতা বললেন, কোথায়?

কেন? উদয়শঙ্করের আখড়ায়।

থাক, নাচিয়ে করে আর কাজ নেই। ছেলেরা হিলহিল করে মেয়েদের মতো পাছা দুলিয়ে দুলিয়ে নাচবে ভাবলেও কেমন যেন গা ঘিনঘিন করে।

এ তুমি কী বলছ? উদয়শঙ্করের নটরাজ নৃত্য দেখেছ!

উদয়শঙ্কর একটাই হয়, একশোটা হয় না। প্রতিভার ডুপ্লিকেট নেই।

অক্ষয়বাবু বললেন, আমাদের অফিসে একটা পোস্ট খালি হয়েছে। আপনি একবার বললেই ওর একটা চাকরি হয়ে যায়। ভাল ফিউচার।

একই অফিসে বাপ-ছেলে। মাপ করো রাজা। ওকে আমি সম্বলপুর পাঠাব।

সম্বলপুর? সেখানে কী করবে? হাতিখেদা? মাতামহ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন।

সেখানে আমার বন্ধু অমল আছে। বিড়ির পাতার ব্যাবসা করবে। একেবারে নিউ লাইন। অমলের মেয়েটি পরমাসুন্দরী।

মাতামহ বললেন, আঃ তা হলে তো কোনও কথাই নেই। আহার ঔষধ দুই-ই হয়ে গেল।

অক্ষয়বাবু বললেন, ব্যাবসা ওর হবে না হরিদা। ভাবুক টাইপের চরিত্র। ব্যাবসার দিকে যদি পাঠাতেই চান তা হলে মিউজিক্যাল ইনমেন্ট কিংবা গন্ধ দ্রব্যের লাইনে দিন।

বাদ্যযন্ত্র। সেতার, তানপুরা, হারমোনিয়াম, ফুলুট বাঁশি। বলেছ ভাল। আবার আতর। কানে তুলো, হাতে কাঠি, চামড়ার বাক্সে ছোট ছোট শিশি। আতরওয়ালা। বলেছ ভাল।

আমি বলছি না, বলছি ওর হাত যা বলছে।

মাতামহ বললেন, আমার মতে ওকে ইনশিয়োরেন্সের লাইনে দাও। বেশ পাকা পাকা কথা বলতে পারে। ঝপঝপ ক্লায়েন্ট ধরবে আর ফেঁপে ফুলে উঠবে।

বলেছেন ভাল, মৎস্য ধরিবে, খাইবে সুখে। ইনশিয়োরেন্স একটা লাইন হল?

কেন? আমাদের ভবেশকে দেখো। কী থেকে কী হয়েছে!

অক্ষয়বাবু বললেন, আমার অ্যাস্ট্রোলজি যদি ঠিক হয়, তা হলে এ ছেলে ফাইন আর্টসের লাইনে যাবেই। কেউ ঠেকাতে পারবে না। অভাব হবে না, তবে চোট খাবে।

চোট খাবে মানে?

সে আমি পরে আপনাকে বলব। সাদা কাগজে একফোঁটা কালি।

আই সি, আই সি, তুমি কী মিন করছ বুঝতে পেরেছি।

আমি আজ উঠি হরিদা। অক্ষয়বাবু উঠে পড়লেন।

কবে পা সামলে অফিসে বেরোতে পারব জানি না। পারলে একবার এসো।

অক্ষয়বাবু সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করলেন, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, হরিদা, গোটাকয়েক টাকা দিতে পারবেন! পকেট একেবারে খালি।

একেবারে খালি! মাতামহ যেন বেশ আনন্দ পেলেন।

পিতা চশমার খাপ থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে আমাকে বললেন, এই নাও দিয়ে দাও। এতে হবে তো?

হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব হবে। আমি আপনাকে মাস কাবারে শোধ করে দোব।

সে দেখা যাবে। তুমি আপাতত কাজ চালাও।

অক্ষয়বাবু সিঁড়ির কাছাকাছি গেছেন, হঠাৎ বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কে একজন জড়ানো জড়ানো গলায় চিৎকার করে উঠল, শালা হরিশঙ্কর, তুমি বড় বাড় বেড়েছ। তোমার বাপের নাম আমি ভুলিয়ে দোব।

পিতা তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে, টাল সামলাতে না পেরে আবার চেয়ারেই বসে পড়ে বললেন, এ ব্লাডিবাগারটা আবার কে?

আমরা তিনজনে জানলায় হুমড়ি খেয়ে পড়লুম। অক্ষয়বাবু বললেন, লোকটা কে? চেনা?

হ্যাঁ, জবার কাকা। জবা বলে একটা মেয়ে, তারই কাকা।

মাতামহ বললেন, ব্যাটা মদ খেয়েছে।

অক্ষয়বাবু বললেন, হরিদাকে গালাগাল দিচ্ছে।

জানলায় তিনটে মুখ দেখে বীরত্ব খুব বেড়ে গেল। পা টলছে, হাত ছুঁড়ে বললে, নেমে আয় শালা।

মাতামহ হুংকার ছেড়ে বললেন, ব্যাটাচ্ছেলে, নামলে যে তোর পুঁটকি প্যাক হয়ে যাবে।

জরার কাকা বেসামাল পায়ে নাচতে নাচতে বললে, নেমে আয় শালা পেঁড়িদারের দল।

মাতামহ অসহায় মুখে পিতার দিকে তাকালেন, কী করব হরিশঙ্কর? ঝেড়ে আসব এক লাথি?

অক্ষয়বাবু বললেন, আপনাকেই তো বলছে মনে হয়, একটা ধোপার আছাড় মেরে আসব?

তথাগতের মতো হাত তুলে পিতা বললেন, ভায়োলেন্স বিগেটস ভায়োলেন্স, খিস্তি বিগেটস খিস্তি। তুমি শুধু যাবার সময় একটা টুসকি মেরে খানায় শুইয়ে দাও। মাতালস্য কর্দম গতি।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত