লোটাকম্বল: ১.১৫ INSIDE MY BRAIN A DULL TOM-TOM BEGINS

লোটাকম্বল: ১.১৫ INSIDE MY BRAIN A DULL TOM-TOM BEGINS

১.১৫ INSIDE MY BRAIN A DULL TOM-TOM BEGINS

Inside my brain a dull tom-tom begins

কোয়ারেনটাইন চলেছে। পুত্র ইনফেকশাস ডিজিজে আক্রান্ত। আমগাছে মুকুল ধরেছে। প্রেমের মুকুল। গন্ধে চারপাশ ম ম করছে। ভ্রমর উড়ছে ভ্যানভ্যান করে। কোণের ঘরে আশ্রয় মিলেছে। বড় ঘরের, পিতার বাঘথাবা পালঙ্ক থেকে বিতাড়িত। এ ঘরটা মন্দ নয়, তবে একটু একপেশে। মাঝরাতে ভয়ভয় করে। এ বাড়িতে শরীরীর চেয়ে অশরীরী বেশি। রাতবিরেতে তাদের আনাগোনার প্রমাণ মেলে নানাভাবে। ছাতে পদশব্দে, জনপ্ৰাণীহীন একতলার অন্ধকার সাম্রাজ্যে ফিসফিস শলাপরামর্শে। মাঝরাতে বাড়িটা আমাদের হাতের বাইরে চলে যায়। আর তখনই মনে হয় পৃথিবীতে আমি বড় একা। তখনই মনে হয় পৃথিবীর কী-ই বা জানি। পৃথিবীর বাইরেটা তো সম্পূর্ণ অজানা! ভাবতে বেশ ভাল লাগে! জ্ঞানীরা বলেন, ভেবে কী হবে, কাজ করে যাও। কীরকম কাজ! যে কাজে কর্মফল নেই। He, to whom the eternal world speaketh, is relieved of much questioning.

অনেকক্ষণ সকাল হয়েছে। আকাশ আমার মনের মতোই ঘোলাটে। ঘরের বাইরে একবার বেরিয়েছিলুম। হাওয়া তেমন সুবিধের মনে হল না। কনক আড়চোখে তাকিয়ে সরে গেল। মুকু তো তেমন কথাই বলে না। মুখ খুললে বিদ্যে লিক করে বেরিয়ে যেতে পারে। মেসোমশাই ব্রাশ ছেড়ে নিম দাঁতন ধরেছেন। বারান্দায় মুখ ঝুলিয়ে চিবোচ্ছিলেন, আর থুথু করে নীচের বাগানে ছিটোচ্ছিলেন। পিতা অসম্ভব রকমের গম্ভীর মুখে হাতে একটা হাতুড়ি নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিলেন। বেশ কঠিন কোনও কাজ শুরু করার মতলব। আমি জানি, আগেও দেখেছি, মন তখন তোলপাড় করে তখন বিচিত্র কোনও কাজ নিয়ে ভীষণ মেতে ওঠেন। একে বলে, কাজের বাঁধন দিয়ে মন-তুরঙ্গকে বশে রাখা।

এক কাপ চা জুটেছে। অন্য কোনও কাজের ফরমাশ এদিকে আসছে না। অন্যদিন এতক্ষণে হরেক রকম কর্তব্যকর্ম ঘাড়ে চেপে বসত। আজ একেবারে স্বামী মুক্তানন্দ হয়ে চৌকিতে পা তুলে বসে থাকার সুযোগ মিলে গেছে। জানি না, কোথাকার জল কোথায় গড়াবে। মন বলছে, খেলা বেশ ভালই জমবে। কেমন উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে এসে গেল। নাও এখন ম্যাও সামলাও। সুখেনের সঙ্গে একবার দেখা হোক, ব্যাটার পিন্ডি চটকাব।

মাতামহ ভোর না-হতেই চলে গেছেন। যাবার সময় বলে গেছেন, তেমন ঝামেলা দেখলে চলে আসিস। আমার খুপরিতে দু’জনে মজা করে থাকব। একটা খাবার যা আবিষ্কার করেছি! একেবারে পাহাড়িবাবার ফর্মুলা। একদিন খেলে তিনদিন আর হাঁ করতে হবে না। লাউ সেদ্ধ করে, গুড় আর একটু গাওয়া ঘি দিয়ে চটকে, এক ড্যালা মেরে দাও। কে কার পরোয়া করে না বলে বললেন, কে কার পরোটা ভাজে! পেট নিয়েই তো মানুষ নাকাল। পেটটাকে ম্যাকাডামাইজ করতে পারলে কার দাসত্ব! হু কেয়ারস হুম। তোমার চোখ তুমি রাঙিয়েই রাখো, আমি শিস দিয়ে যাই ডালে বসে। পাখি হয়ে ডাক দিতে থাকি পরমপিতাকে। মনে হচ্ছে একেবারে একা লড়তে হবে না। পক্ষে মাতামহ আর মাতুলকে পাব।

হাতুড়ির শব্দ হচ্ছে। কিছু একটা ভাঙা হচ্ছে। তুলো ধোনার যন্ত্র পড়ে রইল তুলোর অভাবে, তাই কি পিতা দেয়াল ভাঙার দিকে চলে গেলেন সব ছেড়ে। ভাঙার মতো দেয়াল এ বাড়িতে অনেক। আমার ওপর রেগে গিয়ে বাড়িটাকে অংশে অংশে ভেঙে মাঠময়দান করে তাঁবুর ব্যবস্থা হবে নাকি? বলা যায় না, কোন পরিকল্পনায় কী কাজ শুরু হল! কার ক্রোধ কখন কীভাবে কীসের ওপর যে গিয়ে পড়বে। আমাদের বিখ্যাত মেনিদা একবার মেয়ের ওপর রেগে হাঁটাপথে হরিদ্বার চলে গিয়েছিলেন। মাসখানেক বেপাত্তা। ফিরে এলেন ন্যাড়া হয়ে। গয়ায় নিজের নামে নিজেই পিণ্ড উৎসর্গ করে। বললেন, আমি আর বেঁচে নেই, আমাকে কারুর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। যার যা খুশি করে যাও। পাড়ায় পেছনে লাগার মানুষের তো অভাব নেই। তারা সস্ত্রীক মেনিদাকে রাস্তায়। দেখলেই জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, দাদা ইনি কি আপনার বিধবা স্ত্রী! বিয়েটা কি বিদ্যাসাগর মশাই দিয়ে গিয়েছিলেন?

মেসোমশাইয়ের গলা ভেসে এল, হরিদা, আজ বেরোবেন না? ছুটি নাকি?

না, ছুটি হবে কেন?

তা হলে সাতসকালে বাথরুমের দেয়াল ভাঙতে বসলেন?

কাজটা অনেকদিন পড়ে আছে। করব করব করে করা হচ্ছে না। খানিকটা এগিয়ে রাখি। রবিবার এসে গেল।

কী করতে চাইছেন?

পুরনো প্লাস্টার ঝরিয়ে ফেলব। শিলে গুঁড়ো করে অ্যাগ্রিগেট বের করব।

সে আবার কী?

আপনারা যাকে বালি বলেন, কনস্ট্রাকশনের ভাষায় তার নাম অ্যাগ্রিগেট।

সেকী মশাই! পুরনো প্লাস্টার গুঁড়ো করে আবার প্লাস্টার করবেন? ধরবে? ঝরে পড়ে যাবে। আমার লাইফে শুনিনি। পণ্ডশ্রম হবে।

ওর বাপ ধরবে। ধরাতে জানলেই ধরবে।

কিছু বালি কিনলেই তো হয়।

সে তো সবাই করে। তাতে আর নতুনত্ব কী আছে! সবসময় নতুন কিছুর অন্বেষণ করুন। সামথিং নিউ। সামথিং নিউ।

ঠাঁই, ঠাস, ধাঁই, ধাস। হাতুড়ির শব্দ উঠল। ঝড়াস ঝড়াস প্লাস্টার খসছে। বাথরুমের বারোটা বেজে গেল। আর তো একপাশে বসে থাকা যায় না। এসব অদ্ভুত কাজের একমাত্র দোসর আমি। এগোতেই হয়। এগিয়ে গিয়ে বলতে হয়, কী করতে হবে বলুন?

দরজার কাছে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে বললুম, কোনও সাহায্যে লাগতে পারি?

প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, ও, নো নো। গো, অ্যান্ড রাইট ইয়োর লেটার্স। লাভ লেটার্স। সংসারে যুবতীর অভাব নেই। যুবকের কর্তব্য করে যাও। বোতল বোতল কালি আছে। দিস্তে দিস্তে কাগজ আছে। কোকিলের ডাকে সাড়া দাও। কাননে বসন্ত এসেছে, বসন্ত।

ধাই ধাস, ঠাই ঠাস। হাতুড়ির শব্দ শুরু হল। আবার কোণের ঘরে প্রত্যাবর্তন। চেনা মানুষ অচেনা হয়ে গেলে, নিকট দূর হয়ে গেলে বড় দুঃখ হয়। বেশ জোরে মনের মতো কয়েক চরণ কবিতা আবৃত্তি করলে কী হয়। বেশ জুতসই কয়েক লাইন:

Among the windings
of the violins
And the ariettes
of cracked cornets
Inside my brain a
dull tom-tom begins
Absurdly hammering
a prelude of its own
Capricious monotone
That is at least one
definite false note.

রাস্তায় হইহই উঠেছে। ভাল্লুক টাল্লুক বেরোলে এরকম হতে পারে। সাতসকালে ভাল্লুক আসবে কোথা থেকে। চিৎকার, চেঁচামেচি। বারান্দার দিকে কনক দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে সরে গেল। বয়েই গেল। তুমি আজ আছ কাল নেই। তোমার ভালবাসা, ঘৃণা কোনও কিছুরই পরোয়া করি না।

রাস্তায় প্রবল উত্তেজনা। সবাই একমুখো দৌড়াচ্ছে আর বলছে, ধরেচে, ধরেছে। কী ধরেছে রে বাবা! চোর না ডাকাত! বারান্দায় আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দীনু ডাকলে, শিগগির নেমে আয়।

নীচে নামতেই যাঁড়ের গলায় চিৎকার করে উঠল, শালা চিকের আড়াল থেকে বেনারসি বাইজিদের মতো মুখ বের করে রাস্তা দেখছিস, এদিকে কী হয়েছে জানিস?

আস্তে বল, আস্তে। কী হয়েছে? আস্তে!

শালা, সুখেনকে ধরে ধোলাই দিচ্ছে।

কী করেছিল?

জবাকে নিয়ে মাসির বাড়ি লুকিয়ে বসে ছিল। সকালে দুর্গাপুর পালাবে বলে যেই বেরিয়েছে, ক্যাচ, কট, কট।

তা আমরা কী করব? আমাদের কী করার আছে?

তার মানে? প্রেমের যূপকাষ্ঠে একটা ছেলেকে বলি দেওয়া হচ্ছে, একজন রিয়েল প্রেমিক, আমাদের কিছু করার নেই! দুনিয়ার প্রেমিক এক হও। আমরা শুধু প্রেমের কথা বলি। ও করে দেখিয়ে দিলে। আমরা থিয়োরিটিক্যাল, ও প্র্যাকটিক্যাল। কাল কালীঘাটে গিয়ে জবাকে বিয়ে করে এসেছে। কপালে পাঁঠার রক্তের মতো এখনও এতটা সিঁদুর লেগে আছে। সেই প্রেমিককে পাঁঠাবলি দেবে, আর আমরা প্রেমের সাপোর্টার হয়ে চুপ করে বসে থাকব! চলবে না, চলবে না।

ভাগ্য ভাল, ওপরে হাতুড়ি চলছে, নয়তো দীনুর এই গলা ওপরের কানে গিয়ে আর এক নতুন ঝামেলা তৈরি করত। দীনু তো জানে না সুখেনের কলকাঠি কে নেড়েছিল। সুখেনের আগেই তো আমি বলি হয়ে গেছি। দীনুপাঠা সে খবর রাখে! সারাজীবন চেঁচিয়েই মোলো।

আমি গেলে আর এক কাণ্ড হবে।

তুই ভীষণ স্বার্থপর। তোদের ফ্যামিলিটাই স্বার্থপরের ফ্যামিলি।

হ্যাঁ রে, তাই তো বলবি। জানিস আমার কী হয়েছে?

দীনুকে অল্প কথায় ঘটনার আভাস দিতেই দীনু লাফিয়ে উঠল, শালা, কামাল করে দিয়েছিস। সাধে বলে, পেন ইজ মাইটিয়ার দ্যান সোর্ড। এক কলমের খোঁচায় টসকে দিয়েছিস। কী লিখেছিলিস মাইরি। জবা তো তা হলে তোরই বউ রে। মেয়েটা মাইরি…।

দীনু একটা চোখ অ্যায়সা বোজাল, মনে হল সারাজীবনের মতো দেড়চোখো হয়ে গেছে। দীনু চোখ খুলে বললে, এ অপমান, আমাদের সকলের অপমান। কেমন করে পকেটে পুরি, একটা কিছু তো করতেই হয়।

কী করতে চায় ওরা সুখেনকে নিয়ে?

আরে জবার সেই কাকাটা, জানিস তো কী জিনিস! সেই মাল, আর সুখেনের দাদা, দুটো পয়মালে মিলে প্রথমে সুখেনের মাথার অর্ধেকটা কামাবে, তারপর এক গালে চুন আর এক গালে কালি মাখাবে, মাখিয়ে ইজের পরিয়ে পেছনে ক্যানেস্তারা পেটাতে পেটাতে পাড়ায় পাড়ায়। ঘোরাবে। আর হ্যাঁ, একগাদা ছেঁড়া জুতো জোগাড় করেছে। মালা করে গলায় ঝোলাবে। দেশে ব্যর্থ প্রেমিকের তো অভাব নেই। প্রেমে সাকসেস দেখলে জ্বলে পুড়ে মরে। সেই মালেরা জুটেছে। তারাই মদত দিচ্ছে।

কী করা যায় বল তো? রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।

আর একটা সিক্রেট খবর আছে। সুখেনের দাদা। মালকে চিনিস?

দেখেছি, তবে তুই কোন চেনার কথা বলছিস কে জানে!

দীনু আবার দেড়চোখো হয়ে বললে, মেয়েছেলে আছে।

তার মানে? মেয়েছেলে তো থাকবেই। বিয়ে তো লোকে মেয়েছেলেকেই করে।

তোর মাথা। এ মেয়েছেলে সে মেয়েছেলে নয়। যে-মেয়েছেলে বাজারে থাকে। বুঝলে চাঁদু। যারা নিজেরা পাপ করে তারাই সবচেয়ে বড় মর্যাল গার্জেন হবার চেষ্টা করে। সব গেল সব গেল। বলে তারাই সবচেয়ে বেশি চেল্লামিল্লি করে। আমার কী মনে হয় জানিস, ব্যাটা জবাকে হাতাবার। তালে আছে।

কী করে?

খুব সোজা। রক্ষকই ভক্ষক হয়ে বসবে। ইতিহাস পড়ে দেখ, প্রেমিকরা চিরকাল ফ্যা ফ্যা করে বেড়ায়। কিন্তু লম্পটদের কখনও মেয়ের অভাব হয় না। মেয়েরা মাইরি লম্পটদেরই ভালবাসে।

তুই বড় শালা আর মাইরি বলিস। ভদ্রসমাজে মিশবি কী করে?

রাখ তোর ভদ্রসমাজ! ওই তো ভদ্রসমাজের ব্যাপার। সুখেনের চে খারাপ ছেলের সঙ্গে জবার বিয়ে দেবে সেও ভি আচ্ছা, তবু একটা ছেলে যেচে একটা মেয়েকে বিয়ে করলে গাধার পিঠে চড়াবে। এই তোর ভদ্রসমাজ। এর চেয়ে বিলাসপুরের আদিবাসীরা ঢের ভাল। সুখেনটাকে কী করে তা হলে বাঁচানো যায়?

ব্যাটা পালাল যখন আরও দূরে পালাতে পারল না?

মনে হয় ঝড়বৃষ্টির জন্যে আটকে গিয়েছিল।

আমাদের দলে কাকে কাকে পাবি?

বুঝতে পারছি না। সুখেনেরও তো রাইভ্যাল ছিল অনেক। জবার পেছনে ক’টা ঘুরছিল কে। জানে? তবে শিবুদাকে আমাদের দলে পাবই।

কী করে বুঝলি?

এ পাড়ায় শিবুদাই একমাত্র সাকসেসফুল প্রেমিক। থিয়েটারের মেয়েকে বিয়ে করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এলেবেলে বিয়ে নয়, একটা ফলও হয়েছে। তা ছাড়া লড়িয়ে মানুষ। একবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই সব শালা ঠান্ডা।

আবার শালা?

শালাদের শালা বলব না তো কি ভগিনীপতি বলব! তুই শালা আচ্ছা এক নীতিবাগীশ হয়েছিস। এরপর বলবি, গোরু গলিতে বাথরুম করে গেছে।

ওপরে হুড়মুড় করে একটা শব্দ হল। মেসোমশাই আর কনক দু’জনেরই গলা একসঙ্গে পাওয়া গেল, কী হল, কী হল?

দীনু বললে, তোদের কিছু একটা ড্যামেজ হয়ে গেল। ভূত ছেড়ে যাবার সময় এইরকম শব্দ হয়।

মেসোমশাই বলছেন, লেগেছে আপনার? খুব লেগেছে! কেন যে সাতসকালে ওটার পেছনে লাগতে গেলেন। বেশ তো ছিল।

দীনু বললে, তোদের বোধহয় ছাদ ভেঙে পড়ল।

দাঁড়া আমি দেখে আসি।

হাতুড়িহীন পিতা কুঠারহীন পরশুরামের মতো উত্তরের বারান্দায় ছোট একটা মোড়ায় ডান পা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে স্থির হয়ে বসে আছেন। চুন আর বালির প্রলেপ ভেদ করে কুঁচফলের মতো অনবরতই নতুন নতুন রক্তের দানা ফুটে ফুটে বেরোচ্ছে। মুখে যন্ত্রণার কোনও রেখা নেই। টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখার মতো পায়ে রক্ত ফুটে ওঠার শোভা দেখছেন।

মেসোমশাই উদ্বেগ-মাখানো গলায় বলছেন, কিছু তো একটা করতে হয় হরিদা। বালিতে চুনেতে রক্তে মাখামাখি।

হ্যাঁ, কিছু তো একটা করবই। তবে যতটা বেরোবার, আগে বেরিয়ে যাক। আপনারা ব্যস্ত হবেন না। এরকম দুর্ঘটনা আমার প্রায়ই হয়। একে বলে প্রোফেশনাল হ্যাজার্ড।

দীনু আমার পেছন পেছন ওপরে উঠে এসেছে। একমাথা কোকড়ানো কোঁকড়ানো চুল। ফরসা টকটকে রং। বুক-খোলা টি শার্ট। এতখানি চওড়া বুক। এ পাড়ার সবচেয়ে শিক্ষিত পরিবারের ছেলে। কিছুকাল পিতার কাছে অঙ্ক বুঝে নিতে আসত। লেটারফেটার নিয়ে পাশ করেছে। এখন সি এ পড়ছে। পাশ করেই নিজেদের ফার্মে বসে পড়বে।

দীনু পায়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললে, পিন্টু, শিগগির গরম জল আর বোরিক তুলে নিয়ে আয়।

পিতা হাসিহাসি মুখে বললেন, আরে, দীনু যে, কেমন আছ?

আমি তো ভাল আছি কাকাবাবু, আপনি এ কী কাণ্ড করেছেন?

তোমার বাবা কেমন আছেন?

চিঠি দিয়েছেন। ভালই আছেন।

তিনি এখন কোথায়?

লন্ডনে।

আই সি।

আমি ডক্টর সেনকে ডেকে আনি।

প্রয়োজন হবে না। মাইনর ব্যাপার। লেট মি ব্লিড। সবকিছুরই একটা শেষ আছে। অত বড় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও একসময় শেষ হয়েছিল।

তা হয়েছিল, কিন্তু আহতদের এখনও ফেলে রাখা হয়নি। পিন্টু, তুই ডাক্তারবাবুকে ডেকে নিয়ে আয়। আমি ড্রেসিংটা করে রাখি।

তুই পারবি?

পারব না মানে? রেডক্রসের ট্রেনিং নিয়ে রেখেছি কী জন্যে! তুই ডাক্তারবাবুকে একেবারে ধরে নিয়ে আয়। বলবি এ টি এস নিয়ে আসতে।

পিতা বললেন, ডাক্তার, এ টি এস কিছুই লাগবে না। এমন একটা মারাত্মক কিছু হয়নি। সামান্য একটু বরইজ, একটু ব্লিডিং।

এখন আপনি আমাদের হাতে। আমাদের মতে চলতে হবে। পিন্টু তুই চলে যা।

সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে শুনলাম দীনু কনককে বলছে, দিদি, গরম জল বসিয়েছেন?

রাস্তায় বেরিয়ে মনে হল, পাড়া আজ বিশেষভাবে জেগে উঠেছে। পাড়ায় সাড়া পড়ে গেছে। মোহনদার সেলুনের সামনে বিশাল ভিড়। সুখেনের মাথা কামানো হচ্ছে। সমাজের চোখ লাল হয়েছে, পেট গরম হয়েছে। কোথা থেকে একদল দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ নীতির হাতিয়ার নিয়ে নিরস্ত্র একটি ছেলেকে চেপে ধরেছে। বাধা দেবার কেউ নেই। সুখেন কী এমন অন্যায় করেছে! এমনি সব নাকে কেঁদে অস্থির, মেয়ে বড় হয়েছে, পাত্র জুটছে না, জুটলেও কাড়ি টাকা চাইছে, আর পাত্র যখন নিজে যেচে এসে মাথা মুড়োতে চাইছে, তখন সব বেঁকে বসছেন। মানুষ এক আজব চিজ।

দু-চারজন রুগি বসে আছেন চেম্বারে। ডাক্তারবাবু এক অল্পবয়সি মহিলার বুকে স্টেথিস্কোপ চেপে ধরে বলছেন, জোরে জোরে নিশ্বাস নাও, আরও জোরে, হাঁ করে। হাঁ করে নিয়ে ভস করে ছাড়ো। টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে এক তিরিক্ষি চেহারার ভদ্রলোক ক্রমাগত বলে চলেছেন, ছ’টা ক্যাপসুল পড়ে গেল ডাক্তারবাবু, এখনও ভসভসে ভাবটা যে গেল না।

ডাক্তারবাবু নির্বিকার। বুক থেকে পিঠে চলে গেছেন। মহিলা হাপরের মতো ভসভস করে চলেছেন। পিঠ পরীক্ষা করতে করতেই চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। মুচকি হাসি খেলে গেল মুখে। স্টেথিস্কোপ তুলে নিয়ে সোজা হয়ে বসে বললেন, কী সংবাদ বিদুর?

তিরিক্ষি ভদ্রলোক মরিয়া হয়ে বললেন, ভসভসে ডাক্তারবাবু।

আরে দুর মশাই। আপনার ভসভসের নিকুচি করেছে। রোজ মাংসর স্টু খাওয়াচ্ছেন?

আপনি তো বলেই খালাস। অত পয়সা কোথায়?

তা হলে ভসভসেই হবে। কারও বাবার ক্ষমতা নেই জিয়ার্ডিয়ার রুগিকে হাই প্রোটিন ছাড়া ভাল করে।

ভদ্রলোক বললেন, ডাক্তারবাবুদের এই এক দোষ, বড়লোক, গরিবলোক আলাদা করতে পারেন না। সব যেন সমান। মুড়িমিছরির এক দর।

বড়লোকের অসুখ বাধিয়ে গরিব গরিব করে চেল্লালে আমি কী করব? ভগবানের দরবারে নালিশ পেশ করুন। ওই হলদে ট্যাবলেট তিরিশটা খাওয়ান। শাকপাতা একদম চলবে না।

আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কী খবর?

একবার যেতে হবে ডাক্তারবাবু। বাবার পায়ে প্লাস্টার ভেঙে পড়েছে।

প্লাস্টার করতে হবে?

আজ্ঞে না, কেটেকুটে গেছে। এ টি এস দিতে হবে।

তোমার বাবার চিকিৎসা করতে সাহস হয় না। আমার জ্ঞান বেরিয়ে পড়বে। উনি হলেন ডাক্তারের ডাক্তার। চলো, দেখি কী করা যায়!

কোঁত পেড়ে চেয়ার থেকে নিজেকে ঠেলে তুললেন। বয়েসের ভার, মেদের ভার। মেয়েরা মিউমিউ করে বললেন, বেরিয়ে যাচ্ছেন! আমরা অনেকক্ষণ বসে আছি।

আরও একটু বসুন। সবুরে ম্যাওয়া ফলে। ওষুধের গন্ধে অসুখ অর্ধেক ভাল হয়ে যাবে।

রিকশার তিনের চার ভাগে ডাক্তারবাবু। একের চার ভাগে আমি। ঈশ্বরের কী সুন্দর ব্যালেন্স। মানুষের শরীরেও জোয়ার-ভাটা। এদিক ফোলে তো ওদিক চোপসায়। রিকশাঅলা টানতে পারছে না। লোড তো কম নয়। ডাক্তারবাবু নস্যি নিতে নিতে বললেন, তোমার বাবার একটা বিয়ে দাও। বেশ রণচণ্ডী-মার্কা একটা মেয়ের সঙ্গে। মা ছাড়া এ মানুষকে সামলাবে কে? এই নিয়ে ক’বার হল? এই হাত উড়ে যাচ্ছে, এই পা উড়ে যাচ্ছে। সেই বেলাটাটা বেরিয়েছে?

আজ্ঞে না মনে হয়।

বুঝবে ঠ্যালা পরে। ওই কাঁটা এখন ব্লাডস্ট্রিমে ঘুরছে। সোজা যেদিন হার্টে গিয়ে ঢুকবে সেদিন ফিনিশ।

উনি বলেন, সে হজম হয়ে গেছে।

হ্যাঁ, হজমা হজম। তবে বলা যায় না, ওঁর রক্ত তো সবসময় ফুটছে। কাঁটা হয়তো ভেপার হয়ে নাক দিয়ে বেরিয়ে গেছে।

ওদিকে মনে হয় সুখেনকে নিয়ে প্রসেশন বেরিয়ে পড়েছে। মোহনদার সেলুনের সামনে ক্যানেস্তারা বাজছে মহরমের বোলে। এসব কাজে লোকের অভাব হয় না। কারও সর্বনাশ করার চেয়ে উৎসাহের কাজ আর কী আছে!

ওদিককার জটলার দিকে তাকিয়ে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী হচ্ছে বলো তো? আজ কি কোনও পুজোপার্বণ আছে? ছট পুজোটুজো!

আজ্ঞে না। সুখেনের মাথা ন্যাড়া করা হচ্ছে।

ও, মানসিক ছিল!

মানসিক নয়। কাল রাতে জবা বলে একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে।

ও, ট্রাইব্যাল ম্যারেজ।

না, রাক্ষস বিবাহ।

খেয়ে ফেলেছে।

খাবে কেন? সুখেন আমাদের চক্রবর্তী বাড়ির ছেলে। জবাকে হরণ করে নিয়ে কাল রাতে কালীঘাটে গিয়ে বিয়ে করেছিল, আজ সকালে ধরা পড়েছে। এখন মেয়ের কাকা আর ছেলের দাদা দুজনে মিলে ধরে ন্যাড়া করে, মুখে চুনকালি মাখিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘোরাবে।

জবা কোন বাড়ির মেয়ে বলো তো?

ওই তো যার বাবার দু’বার বিয়ে, অনেকদিন হল নিরুদ্দেশ।

ও, বিশুবাবুর মেয়ে। আরে সে মেয়েটার তো খুব খারাপ একটা অসুখ আছে গো! ছেলেটা রামছাগল।

পায়ের ধপাস ধপাস শব্দ করে ডাক্তারবাবু সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগলেন। দীনু পাকা ডাক্তারের মতো কাজ করেছে। ওই কড়কড়ে বালি আর চুন একটু একটু করে ক্ষতস্থান থেকে ছাড়িয়েছে। পায়ের অবস্থা দেখে গা শিরশির করে ওঠে। নুনছাল গুটিয়ে পাকিয়ে গেছে। সাদা দগদগে। ঘামের মতো বিন্দু বিন্দু রক্ত বেরোচ্ছে। কনক পাকা নার্সের মতো দীনু ডাক্তারের হুকুম তামিল করছে। আমি কোথায় প্রভু! এই এক্সপার্টদের জগতে আমি এক কুণ্ড। কিছুই পারি না, কিছুই জানি না। তফাত যাও তফাত যাও বলে সবাই হড়হড় করে এগিয়ে চলেছে। দীনুতে কনকেতে যেরকম মাখামাখি, ‘ব্রেড অ্যান্ড বাটার’ অবস্থা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে শুভযোগ মেসোমশাইয়ের দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। কনকের বাবাও বিলেত-ফেরত, দীনুর বাবাও বিলেত-মারা মানুষ। দুই বেয়াইয়ে জমবে ভাল। মিথ্যে বলে লাভ নেই। দু’জনকে পাশাপাশি দারুণ মানিয়েছে। দীনু একটা জামাইয়ের। মতো জামাই। কনক একটা বউয়ের মতো বউ। গন্ধর্ব আর কিন্নরী। চোখের সামনে, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। না, আমার মনে কোনও ক্ষোভ নেই। আমি নিজে ঈশ্বরের দরবারে প্রার্থনা জানাচ্ছি, নকের যেন দীনুর সঙ্গেই বিয়ে হয়। আজ হোক, কাল হোক, ছমাস পরে তোক, যেন হয়। মেসোমশাই কাঁচা ছেলে নন। দু’মেয়ের বাপ। জামাই চেনেন।

ডাক্তারবাবু দীনুকে ভালই চেনেন। বললেন, বাঃ তুমি তো আমার কাজ অনেকটা এগিয়েই রেখেছ। সি এ না হয়ে ডাক্তার হলেই তো পারতে।

মেসোমশাই বললেন, তুমি বুঝি সি এ পড়ছ? খুব ভাল লাইন। যেমন রেসপেক্টবল তেমনই রিওয়ার্ডিং।

এই তো, এই তো মাছে টোপ গিলেছে। ঈশ্বর আমার কথা শুনেছেন। ডাক্তারবাবু পিতার পায়ের সামনে মোড়ায় বসলেন। বসে বললেন, বাঃ, এই তো বেশ জট পাকিয়েছেন। বালিতে, চুনেতে, চামড়াতে, রক্ততে একেবারে ক্যাডাভারাস কাণ্ড।

ডাক্তারি ব্যাগটা বেশ প্রাচীন হয়েছে। চামড়ায় কোচ ধরেছে। যৌবনের বাঁধুনি নেই। মেঝের ওপর পড়ে আছে থেকে। নিচু হয়ে একটা সার্জিক্যাল কাচি বের করতে করতে ডাক্তারবাবু বললেন, হরিবাবু, আপনি হলেন আমাদের পরীক্ষা। অঙ্কে যেমন কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট, রুগিদের মধ্যে সেইরকম আপনি। একেবারে জটিল জলতরঙ্গ। কী কায়দায় এমন করলেন? পা দিয়ে পিলার ভাঙছিলেন, নৃসিংহ অবতারের খোঁজে?

পিতা মৃদু মৃদু হাসছেন। মুখে একটু গর্বের ভাব। হেঁ হেঁ বাবা করেছি একটা কাণ্ড। আমার কী! আমি তো পা ছড়িয়ে বসে আছি। ম্যাও সামলান আপনি। কাঁচি দিয়ে কুট কুট করে চামড়া কাটছেন। গা শিরশির করছে। দীনুর কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। পাশেই হেলেন কেলার। তিনিও নির্বিকার।

ক্যানেস্তারা বাদ্য বাড়ির সামনে এসে পড়েছে। ইস, সুখেন চলেছে। একগালে চুন, একগালে কালি। ডাক্তারবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কলির কেষ্ট চলেছে হে। শ্রীরাধিকা কি সঙ্গেই আছেন?

পিতা মুখ তুলে তাকালেন। নীরব প্রশ্নে জানতে চান, কী হচ্ছে রাস্তায়। রাধাকৃষ্ণ আবার কোথা থেকে এলেন। দীনু তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। আমি এক্ষুনি আসছি, বলে, তিরবেগে দৌড়োল সিঁড়ির দিকে।

ইঞ্জেকশনের অ্যাম্পুলে ছোট্ট করাত ঘষতে ঘষতে ডাক্তারবাবু বললেন, আজকালকার ছেলেপুলে যা হয়েছে, শান্তিতে আর সংসার করা যাবে না হরিবাবু। ছেলে থাকলেও মুশকিল, মেয়ে থাকলেও মুশকিল।

উত্তরে পিতা একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, বলা হল না। রাস্তায় ঘুসোঘুসির শব্দ হচ্ছে। কে কাকে ধরে প্রচণ্ড পেটাচ্ছে।

সিরিঞ্জের নিডলটি হাতে ঢোকাতে ঢোকাতে ডাক্তারবাবু বললেন, দীনুকে বিশ্বাস নেই। গিয়েই মনে হয় মারামারি শুরু করেছে।

পিতা লাফিয়ে উঠলেন, অ্যাঁ, বলেন কী! দীনু মারামারি করছে।

ডাক্তারবাবু বলছেন, করেন কী, করেন কী! নিডল ভেঙে যাবে।

.

দীনু ধরাধধড় ঘুসি চালাচ্ছে। যে ব্যাটা নেচে নেচে টিন পেটাচ্ছিল সে টিন ফেলে দৌড় মেরেছে। সুখেনের দাদাটা একপাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জবার কাকা, সেই পালের গোদাটা হাতের আস্তিন গুটিয়ে দূর থেকে একবার করে ঘুসি তুলছে আর বলছে, হু আর ইউ? হু আর ইউ?

দীনুর শুধু হাত নয়, পা-ও চলছে সমানে। পিতার ওপর-বাহুতে এ টি এস সামান্যই ঢুকেছে। ডাক্তারবাবু তাড়াতাড়ি নিডলটা বের করে নিয়েছেন। নইলে ভেঙে ঢুকে যেত। রক্তের স্রোতে বেলকাঁটা ঘুরছে, সঙ্গে দোসর জুটত ভাঙা উঁচ। রাস্তার দিকে জানলায় দাঁড়িয়ে উত্তেজনায় পিতা পা ঠুকছেন, আর একসময়ের কৃতী ছাত্র দীনুকে উৎসাহ দিচ্ছেন, শাবাশ! শাবাশ! চালিয়ে যাও। মেরে ফ্ল্যাট করে দাও। সব বাড়ির জানলাতেই সারি সারি মুখ।

পিতৃদেবের একপাশে মেসোমশাই আর একপাশে ডাক্তারবাবু, হাতে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ। দুই বোন আর এক জানলায় পাশাপাশি। আমি ফাঁকেফোকরে চোখ রেখেছি। দীনুর বীরত্ব যত বাড়ছে আমার ভেতরটা তত হুহু করে জ্বলছে। শামুকের মতো বীরত্বের ডান্ডা বেয়ে দীনু ওপরে উঠছে। হিরো, সুপার হিরো, সুপ্রিম হিরো, ক্রমশই ঝান্ডা উঁচু হচ্ছে আর আমি ক্রমশই ঠান্ডা হয়ে আসছি। আড়ে আড়ে তাকাচ্ছি কনকের মুখের দিকে। চোখ ক্রমশই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। কনকের মনের দেয়ালে দীনুর বীরত্বের গজাল পেরেক এক এক ঘুসিতে ইঞ্চি ইঞ্চি করে ঢুকছে। সাধে বলে বীরভোগ্যা বসুন্ধরা!

বৃত্তাকার একটা জায়গায় চুনকালি মাখা, আধ-মাথা কামানো, ছেঁড়া প্যান্ট পরা সুখেন আমাদের ‘ফক্‌স সাহেবে’র মতো দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমধ্যে ফক্‌স সাহেব এখনও এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। বেঁটেখাটো মানুষ। মাথায় শোলার টুপি। পরনে ঢোলা কোটপ্যান্ট। প্যান্টের তলা ছিঁড়েখুঁড়ে ঝুলঝুলে। পায়ে গোড়ালি খয়ে যাওয়া তালিমারা বুট জুতো। মুখে চুন আর কালি। প্রেমের নয়, জীবিকার। পেছনে এক হাফপ্যান্ট পরা কিশোরের মাথায় বিশাল কাঠের সিন্দুক। সাহেব চলেছে হুপ হাপ শব্দ করতে করতে। ম্যাজিক ফ্যাজিক দেখায়। কোনওদিন দেখা হয়নি।

দীনু তাল ঠুকে বললে, আর কে আছিস চলে আয়।

পিতৃদেব বললেন, আমারও ইচ্ছে করছে গোটাকতক ঘুসি হাঁকড়ে আসি।

ডাক্তারবাবু বললেন, ব্যাপারটা কী তা জানা আছে?

অনুমান করতে পারি, এ ফর্ম অফ সোশ্যাল র‍্যাগিং।

কেন, সে খবর রাখেন? পুলিশ কেসে পড়ে যাবেন যে!

কেন?

ওই ছেলেটা কাল একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছিল। আজ ধরা পড়েছে। সেই অপরাধের উচিত শাস্তি চলেছে। এর মধ্যে দীনুর নাক গলাবার কোনও প্রয়োজন ছিল না।

আই সি! আমাদের পাশের বাড়ির সেই মেয়েটি। বেশ, ছেলেটাকে ধরে পুলিশে দিক। দেশে আইন আছে, আদালত আছে। কতকগুলো অর্বাচীন ইডিয়েটস হাতে আইন তুলে নেবে, আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাধার মতো দেখব! সে তো হতে পারে না। সভ্য মানুষ সভ্য উপায়ে বিচার করবে। আমরা জঙ্গলে বাস করছি না। আমরা একদল হনুমান নই? কিল হিম। কিল দ্যাট বাস্টার্ড।

জবার কাকা আধলা একটা ইট তুলে দীনুর দিকে এগিয়ে আসছিল। আহত পা নিয়ে পিঅ দুদ্দাড় করে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিলেন। মেসোমশাই চেপে ধরলেন, করছেন কী? আপনার সে বয়েস আছে?

পিতা রুখে দাঁড়ালেন, অন্যায়ের প্রতিবাদে বয়েস আবার কীসের বাধা?

অন্যায় বলছেন কেন? ওরা যা করছে ঠিকই করছে, এগজাম্পল ইজ বেটার দ্যান প্রিসেপ্ট।

একে এগজাম্পল বলে না। এ হল চরম অসভ্যতা। মনুষ্যত্বের অবমাননা। আই মাস্ট রেজিস্টার মাই প্রোটেস্ট উইথ এ ব্লো।

ডাক্তারবাবু বললেন, আপনার পায়ের অবস্থা খুব ভাল নয় হরিবাবু। তা ছাড়া এই উটকো ঝামেলায় আপনার মতো মানুষের জড়িয়ে পড়াটা ঠিক নয়।

এসকেপিস্ট। ইউ আর অল এসকেপিস্ট। মধ্যবিত্তের মিন মেন্টালিটিতে ভুগছেন।

দীনু হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, পালাচ্ছিস কেন শালারা? পালাচ্ছিস কেন?

পিতা বললেন, ইস, ইস, শালাটা না বললেই পারত।

উত্তেজনার ছোঁয়া কনকের মনেও লেগেছে। জানলার ধার থেকে রিলে করলে, সব ব্যাটা পালাচ্ছে। মেসোমশাই বললেন, দিজ জানলাজ, অফুল উইনডোজ, ভদ্রবাড়িতে জানলা থাকা উচিত নয়। ভেতরে যাও। তোমরা ভেতরে যাও।

ডাক্তারবাবু বললেন, চেম্বারে রুগি বসিয়ে এসেছি। বি সেনসিব। আমাকে আমার কাজটা সেরে নিতে দিন।

পিতা হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, নিন ফুঁড়ে নিন।

বসুন। মাথা ঘুরে যেতে পারে।

আমার সে মাথা নয় ডাক্তার। অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই আমার তিন-তিনটে দাঁত তুলিয়েছি।

নীচে থেকে দীনু বীরের মতো হাঁক ছাড়ল, পিন্টু, নেমে আয়।

সুখেন আমাদের গলিতে এসে বসেছে। সারাশরীর থিরথির করে কাঁপছে। দু’চোখে দু’রঙের জল গড়াচ্ছে। চুন-মাখানো গালে মুক্তোর দানা, আলকাতরা-মাখানো গালে কয়লার রস। দীনু এক ধমক লাগিয়ে বললে, তুই আমাদের একবারও বললি না কেন ইডিয়েট? আমরা দলবল নিয়ে রেডি থাকতুম। এবার তুই পাড়ায় মুখ দেখাবি কী করে?

পিতৃদেব নীচে নেমে এলেন। প্রথমে ডাক্তারবাবু, সবশেষে মেসোমশাই। ডাক্তারবাবু যেন পালিয়ে বাঁচলেন। পিতা সুখেনকে ভাল করে দেখে বললেন, তুমি তো চক্রবর্তী বাড়ির ছেলে?

উত্তর দিল দীনু, আজ্ঞে হ্যাঁ।

তুমিই তো ট্র্যাপিজের খেলা দেখাও ব্যায়াম সমিতিতে?

দীনু বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ।

তোমার এই দুর্মতি হল কেন? দেশে কি মেয়ের অভাব!

সুখেন ধরাধরা গলায় বললে, কাকাবাবু, আমার একলার দোষ নয়। জবা বললে, কলিতেও আর একবার অহল্যা উদ্ধার হোক। দুটো মা আর একটা কাকাতে মিলে আমার জীবন শেষ করে দিলে।

এই বাজারে একটি বাঙালি মেয়েকে উদ্ধার করার চেষ্টা অহল্যা উদ্ধারের চেয়েও মহৎ কাজ। জজেও মানবে। কী বলেন বিনয়দা?

মেসোমশাই হিসেবির হাসি হাসলেন। স্বাভাবিক। মাথায় মাথায় যাঁর দুই মেয়ে তাঁকে এই ব্যাপারে রায় দিতে হলে অবশ্যই অনেক ভাবতে হবে। বলা যায় না, আবার কোনও রামচন্দ্র যদি এদিকে হঠাৎ পা বাড়ান, তা হলে জয় রাম না বলে ছিছি রামই বলতে হবে।

পিতা সুখেনকে বললেন, তোমার দাদা হঠাৎ ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে তোমাকে নিয়ে বাঁদর নাচ করল কেন?

সে কাকাবাবু এক নোংরা ব্যাপার। দাদাকে তো আপনি চেনেন না। অতি নোংরা মানুষ। বউদিকে তো প্রায় ত্যাগই করেছে। নিত্য কিল, চড়, ঘুসি, লাথি। বাইরে আসা যাওয়া আছে। রেস আছে। নেশা আছে। আর আছে, আমাকে ফাঁকি দিয়ে বিষয়সম্পত্তি একা গ্রাস করার ইচ্ছে। জবার কাকার হাতে কালোবাজারির পয়সা। বাড়িটা তাকে বেচতে পারলে, দু’তরফেরই লাভ। এর ফুর্তি, ওর সম্পত্তি। রতনে রতন চিনেছে।

আই সি। জবার বয়েস কত? সাবালিকা?

কুড়ি-একুশ তো হবেই।

বহত আচ্ছা! তবে তো কোনও ভয়ই নেই। কী বলেন বিনয়দা?

হ্যাঁ, আইন বলে, সাবালিকা স্বেচ্ছায় তার পছন্দমতো ছেলেকে বিয়ে করতে পারে।

তা হলে, আমরা লড়ে যাই। গেট রেডি ফর এ লিগ্যাল ফাঁইট। দীনুর অ্যাগেনস্টে ওরা ফৌজদারি করবেই। পয়সা আছে, ছেড়ে কথা বলবে না। সুখেনকেও ফাসাবার চেষ্টা করবে।

মেসোমশাই হু হু করে হেসে বললেন, আপনি একটা লিগ্যাল এড সোসাইটি খুলুন হরিদা। যেভাবে হুড়হুড় করে কে আসছে, আমি এখানেই পার্মানেন্টলি থেকে যাই।

কথার মধ্যে ব্যঙ্গের ছোঁয়াটুকু পিতা ধরতে পারলেন না। উত্তেজনায় মেতে আছেন। আমাকে বললেন, টারপেন্টাইনের বোতল আর একফালি ন্যাকড়া নিয়ে এসো। আর হ্যাঁ, আমার বাটলারের ক্ষুরটাও নিয়ে এসো। মাথাটা পুরো চেঁচে দিই।

মেসোমশাই ওপরে উঠতে উঠতে বললেন, কখন কী নিয়ে যে মেতে ওঠেন আপনি! নিজের পা-টা আগে সামলান। নিজের ছেলেটাকে আগে মানুষ করুন।

তার মানে? পিতা ফোঁস করে উঠলেন, ও কি অমানুষ হয়ে আছে?

মানুষ বলতে যা বোঝায় তা কি হয়েছে? যদি মনে করেন হয়েছে, আমার কিছু বলার নেই।

মানুষ বলতে আপনি কী বোঝেন?

এডুকেশন। এম এ করুক। পি আর এস, পি এইচ ডি করুক। বড় ডাক্তার, কি ইঞ্জিনিয়ার হোক। সারাদিন বাড়ি বসে আছে, ফস্টিনস্টি করছে। বড় বড় কথা বলছে। এটা কি মানুষ হবার লক্ষণ!

বিনয়দা, মানুষ বলতে আপনি বোঝেন তোতাপাখি, আমি বুঝি মানুষ। চরিত্রে, আচারে, আচরণে, সংস্কৃতিতে, সহবতে একটা পরিপূর্ণ মানুষ ইউনিভার্সিটির দরজা গলে বেরোয় না, বেরোয়। পরিবারের ফার্নেস থেকে। একদিন ইংরিজি নিয়ে ওর মুখোমুখি বসবেন নাকি? বসবেন সাহিত্য আর সংস্কৃতি নিয়ে? ধর্ম নিয়ে একদিন একটু আলোচনা হোক না। পরীক্ষা করুন না ওর ধৈর্য, সংযম, লোভ, সহিষ্ণুতা।

ওতে জাগতিক কিছু হয় না হরিদা। ছাপ চাই, ছাপা নামের পেছনে এত বড় একটা ন্যাজ চাই, ন্যাজ। আপনার ছেলে আপনার কাছে হিরের টুকরো হতে পারে, জগতের বিচারে কয়লা।

মেসোমশাই দুমদুম করে ওপরে উঠে গেলেন, সিনেমার ব্যারিস্টারের ভঙ্গিতে। হঠাৎ আমার বয়েস যেন বিশ বছর বেড়ে গেল। এতসব গুণের কোনও ঘনঘটাই আমার নেই। আমি মহাপুরুষ? কাপুরুষ বললে শোভা পায়। ধৈর্য? ছুঁচে সুতো পরাবার সময়েই ধৈর্য বোঝা যায়। সহিষ্ণুতা? একটার বেশি দুটো কাজের কথায় যার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, সে হল সহিষ্ণু? সকালে বিছানা ছেড়ে ওঠার সময় যে বেতো ঘোড়ার মতো আর্তনাদ করে সে হল সহিষ্ণু? আমার লজ্জা বাড়াবার। জন্যে কেন এসব বললেন? মেসোমশাই ঠিকই বলেছেন আমার দ্বিভুজে এমন কোনও হাতিয়ার নেই যা দিয়ে জগতের সঙ্গে লড়তে পারি। ময়লা পইতেতে চাবি বেঁধে, হাতে শালগ্রাম নিয়ে বাড়ি বাড়ি পুরুতগিরি করে যাকে দূর ভবিষ্যতে পেট চালাতে হবে, তার জন্যে পিতার এত গর্ব মানায় না। লোকে বলবে, লাভ ইজ ব্লাইন্ড। অহংকারী মানুষটি বড় অপমান করে গেলেন। ন্যাজ নেই বলে এত অসম্মান?

তারপিন দিয়ে সুখেনের মুখের আলকাতরা তোলা হল ন্যাকড়া দিয়ে ঘষে ঘষে। মাথা তেল চুকচুকে করে কামানো। বেশ সাধু সাধু দেখাচ্ছে। ব্যাপার অনেক দূর গড়াবে। দীনু এক সেট প্যান্ট, জামা আর টুপি এনে দিয়েছে। বাথরুমে ঢুকে সুখেন চান করে নিয়েছে। রাস্তায় বেরোতে লজ্জা পাচ্ছে। মানুষের ভুলতে সময় তো লাগবেই। রাত ছাড়া এ প্যাচার আর রাস্তায় বেরোবার উপায় নেই। কাকে ঠোকরাবে।

সুখেন বললে, আমি আজই দুর্গাপুর চলে যাব।

দীনু বললে, মামার বাড়ি। তোর বউয়ের কী হবে?

এক রাতের বউ ভাই। তাকে আর পাব কোথায়? চিরাগ কাহা, রোশনি কাঁহা। তাকে বোধহয় উলঙ্গ করে ঘরে চাবি দিয়ে রেখেছে।

সেকী রে!

আরে ওটা একটা পাপের বাড়ি।

সুযোগ পেলেই তাল বুঝে পাখি দেখবি উড়ে আসবে তোর খাঁচায়। সবুরে ম্যাওয়া ফলে রাজা।

কোনও পরিখাই খুব প্রশস্ত নয় এবং কোনও দেয়ালই খুব উঁচু নয়। ভালবাসা যদি থাকে, দু’জনে এসে মিলবেই। কোনও ঝড়ই খুব ভয়ংকর নয় এবং কোনও রাত্রিই খুব অন্ধকার নয়। ভালবাসা যদি থাকে, দু’জনে পরস্পরকে দেখবেই। যেমন ভাবেই হোক জ্যোৎস্না আসবে, তারার আলো ঝরবে, যেমন ভাবেই হোক মোমবাতি, আলো বা একটি লণ্ঠন জ্বলবেই।

কার কবিতা রে? পরে আমাকে লিখে দিস তো। বাঁধিয়ে রেখে দোব। আমার জন্যেই লেখা মনে

যে-গাড়ায় পড়েছিস, সেই গাড়া থেকে আগে ঠেলে ওঠ। মাথায় সেই কোকড়ানো চুল আবার ফিরে আসুক, তারপর আবার প্রেমের গর্তে পা দিবি। ব্যাটা ন্যাজ কাটা শেয়াল।

প্রেম হল ফলন্ত গাছের ফুলের মতো। গাছ যতদিন না মরছে ততদিন ঋতুতে ঋতুতে ফুল ফুটবেই।

এখনও তোর কাব্য আসছে রে দামড়া! নাঃ তুই রিয়েল প্রেমের ধাতুতে তৈরি। বোস, মোটরবাইকটা বের করে আনি। তোকে এ পাড়া থেকে পগারপার করে দিয়ে আসি।

দীনু বীরদর্পে বেরিয়ে গেল। সুখেন প্রেমের ধাতুতে তৈরি হলে, দীনু বীরের ধাতুতে। সুখেন ন্যাড়া মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললে, ইস, কী করে দিয়েছে মাইরি। সুযোগ পেলে এর বদলা একদিন আমি নেবই।

একা ভাল কাজ করা যায় সুখেন, অন্যায় কাজে দল চাই। একা তুই মঠ, মন্দির, মিশন করতে পারিস, পরনের কাপড় খুলে দান করে দিতে পারিস, কিন্তু অন্যায়ের প্রতিকার করতে পারবি না। রোজ কত অন্যায়ই তো মানুষ করছে, কোথায় তার প্রতিকার! সৎ কাজের চেয়ে পৃথিবী জুড়ে অসৎ কাজের পরিমাণ হাজার গুণ বেশি।

যা যা, বুড়োদের মতো ভিজেভিজে কথা আর বলিসনি তো! তুই ব্যাটা একেবারে বুড়ো হয়ে গেছিস। কাকাবাবু এখনও তোর চেয়ে ইয়ং আছেন।

দীনুর মোটরসাইকেল বাড়ির সামনে এসে থামল। এরই মধ্যে পোশাক পালটে এসেছে। ছোকরার শরীরে রাজপুত্তুরের রক্ত বইছে। তা না হলে এমন ‘লেডি-কিলারের’ মতো চেহারা হয়? পুলিশ কি পাড়ার লোক দীনুর টিকিও ছুঁতে পারবে না। দীনুর বাবার যা ইনফ্লুয়েন্স। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ওঠাবসা করেন। আমাদের অনেক ক্ষতি অনেকে করতে পারে। বাঁচাবার কেউ নেই।

সুখেনকে পেছনে বসিয়ে দীনু সশব্দে পাড়া কাপিয়ে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল, ন্যাড়াকে বেলতলায় ছেড়ে দিয়ে আসি।

সুখেনের ছেঁড়া ঝুলঝুলে প্যান্ট, কালিঝুলি মাখা জামা, ফেলে যাওয়া উৎকণ্ঠার মতো গলিতে পড়ে রইল। ওই সাজ এবার তোমাকে না পরিয়ে ছাড়ে। প্রেমের কাঁঠাল কোথায় পাকছে মানিক। শীতলাতলার আটচালায়। মায়ার সঙ্গে আর বেশি মাখামাখি করতে যেয়ো না। ওখানে ভোদার নজর পড়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী বড় প্রবল হে।

সিঁড়ির মাথায় পিতৃদেব। প্রশ্ন করলেন, ওরা কোথায় গেল?

কিছু বলে গেল না তো।

একবার জিজ্ঞেস করলে না! তোমার কি মনে হয় চ্যাপ্টার ক্লোজড হয়ে গেল?

আজ্ঞে না। এই তো সবে শুরু।

দ্যাটস রাইট। এই তো বুদ্ধি পাকছে। কে বলে, তুমি আমার পুঁয়ে পাওয়া ছেলে? আশঙ্কা নিয়ে বাঁচতে শেখো। বিপদের ঢেউ কেটে কেটে চালাও তোমার জীবনের জাহাজ। ছেঁড়াখোঁড়া ওগুলো কী?

সুখেনের জামাপ্যান্ট।

ফেলো না, ছাতে নিয়ে চলো।

কী করবেন?

কাকতাড়ুয়া তৈরি করব। প্রেমের কাকতাড়ুয়া। ও পাশের ছাতে, যে-পাশে গাছের টব, হতচ্ছাড়াদের বাড়ি, সেই ছাতে থাকবে কাকতাড়ুয়া। একে কী বলে জানো?

আজ্ঞে স্কেয়ার ক্রো।

তোমার মাথা। একে বলে সাইকোলজিক্যাল টর্চার। ওরা ঘুরবে ফিরবে আর দেখবে। ক্রমশই মেন্টালি সিক হয়ে পড়বে। ম্যাকবেথের ভোজসভায় ব্যাঙ্কোর ভূত। রাজার আসন দখল করে বসে আছে। কেউ দেখতে পাচ্ছে না, পাচ্ছে খুনি ম্যাকবেথ। চিৎকার করে বলছে, তুমি মাথা নাড়তে পারো না, তুমি কথা বলতে পারো না, তোমাকে আবার ভয় কীসের! পরমুহূর্তেই আর্তনাদ, ঈশ্বর, মর্গ থেকে যদি মৃতদেহ বেরিয়ে আসে, যাদের কবরে রেখে এসেছি তারা যদি কফিনের ডালা খুলে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে, old mouments, shall be the maws of kites. তোমার কেমন লেগেছিল কাল?

কী লাগার কথা বলছেন?

যখন বালিশটালিশ বের করতে করতে বললুম, তোমার সঙ্গে এক বিছানায় শুতে আমার ঘেন্না করছে।

খুব খারাপ।

মনটা কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে যায়নি?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

দেহ ঠিক রইল, মনটা কুঁচকে এতটুকু হয়ে গেল। কী ভীষণ যন্ত্রণা, তাই না? একে বলে সাইকোলজিক্যাল টর্চার। মানুষকে সংযত রাখার জন্যে মনের মধ্যে ভূত ঢোকাতে হয়। তা না হলে শয়তান বাড়তে বাড়তে দেবতাকে গ্রাস করে ফেলে। রান্না মনে আছে, না ক’দিনের সুখে ভুলে বসে আছ

না, মনে আছে।

তা হলে চলে এসো ওপরে। পুরনো অভ্যাস আজ আবার ঝালাই হবে।

উত্তরের বারান্দার একপাশে কনক উদাস মুখে বাগানের গাছপালার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কীসের যেন প্রত্যাশা! গ্রহান্তরের কোনও জীব এসে নামবে বাগানের কোণে। বড়ঘরে মেসোমশাই পায়চারি করছেন। পিতৃদেবের হাঁটাচলা করতে অসুবিধা হচ্ছে। সামান্য খোঁড়াতে হচ্ছে।

মেসোমশাই বললেন, হরিদা, আপনার হঠাৎ এই সিদ্ধান্তের কোনও কারণ খুঁজে পেলুম না।

কারণ দেখিয়ে কোনও কাজ করার অভ্যাস আমার কোনওকালে ছিল না, আজও নেই। আমাদের রান্না আমরাই করে নোব, যেমন করে আসছি এতকাল।

কেন, বলনে তো!

আবার কেন? কোনও কেন নেই। সিদ্ধান্ত ইজ সিদ্ধান্ত।

তার মানে আমাদের এখান থেকে চলে যেতে বলছেন।

তা তো বলিনি। কনক কথা কাটাকাটি শুনে ঘরে এসেছে। ছলছলে চোখে বললে, আপনি কেন এত রেগে গেলেন মেসোমশাই। এই তো কালই বললেন, তোমার মতো মেয়ে পাশে থাকলে সংসারে ফুল ফুটিয়ে ছেড়ে দিতুম।

হ্যাঁ বলেছিলুম। যে-আকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা সূর্যের প্রত্যাশা করি, সে আকাশেও হঠাৎ মেঘ আসে, সূর্য ঢাকা পড়ে যায়, দিনে ছাতল ধরে। আশা আর প্রত্যাশার মাঝখানে অনিশ্চয়তার বিশাল ব্যবধান। অনেক বাধা দিতে চাইলেও দেওয়া যায় না, নিতে চাইলেও নেওয়া যায় না। সাইকোলজিক্যাল ম্যানের এই হল ট্র্যাজেডি। মনের বিশুদ্ধ নীল আকাশে অহংকারের মিশকালো মেঘ।

মেসোমশাই বললেন, আপনি ভয়ংকর ইমোশানাল। সামান্যকে অসামান্য করে তুলে নাটক। করতে চান।

কী বললেন, ইমোশান! এই চেয়ারের ইমোশান নেই, ওই টেবিলের নেই, দেয়ালের নেই। ইমোশান আছে বলেই আমরা মানুষ। ইমোশানই আমাদের মোশান। আবেগই আমাদের প্রাণ। বিশাল এই রঙ্গমঞ্চে সারাজীবন আমি নাটক করে যাব।

তা হলে তাই করুন। আপনার ছেলে সম্পর্কে এমন কিছু অন্যায় বলিনি। যা দেখছি হিতৈষী হিসেবে তাই বলেছি। পুত্রস্নেহে আপনি অন্ধ হয়ে আছেন। আপনি ওর মঙ্গল চান, না অমঙ্গল চান?

আপনি যেভাবে চান, আমি সেভাবে চাই না। আমি ক্রীতদাস তৈরি করতে চাই না। আমি চাই মানুষ। পরিপূর্ণ একটি মানুষ। তর্ক করে লাভ নেই। তর্কে বিবেকানন্দ আসবেন, রবীন্দ্রনাথ আসবেন। আপনাদের শিক্ষার মূল নড়ে যাবে। চুপ করে থাকাই ভাল। কাল পর্যন্ত আপনি আমার আত্মীয় ছিলেন, আজ আপনি একজন শিক্ষাগর্বী মদগর্বী ব্যারিস্টার। অনেক টাকা, অনেক ক্ষমতা, অনেক উচ্চাশা। আমরা রিক্ত ফকির। আদর্শ নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টাই আমার যৎসামান্য। বিলাসিতা।

কী আপনার আদর্শ? গাছ তৈরিটা আদর্শ না আগাছা গজিয়ে তোলা আদর্শ?

কনক এগিয়ে এসে বললে, আপনাদের এই কথা কাটাকাটি আমার একদম ভাল লাগছে না।

বাবা, আপনি চুপ করুন না। মুকুকে পড়াতে বসুন। বই খুলে বসে আছে অনেকক্ষণ।

মেয়ের কথায় মেসোমশাই সরে গেলেন। কনক শান্ত নরম গলায় জিজ্ঞেস করলে, একটু চা খাবেন মেসোমশাই?

চা? হ্যাঁ, তা খেলে হয়। না থাক।

কনক কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। চোখ ছলছল করে উঠছে। একটু ধরাধরা গলায় বললে, আপনারা বড় নিষ্ঠুর।

নিষ্ঠুর কেন? নিষ্ঠুরতার কী দেখলে?

আমরা কী সুন্দর ছিলুম, কী বিচ্ছিরি হয়ে গেলুম। বাইরে কী একটা ঝামেলা হল, আমাদের ভেতরটা সব ওলটপালট হয়ে গেল।

পিতা শব্দ করে হাসলেন, জীবন মানেই ঝোড়ো হাওয়া কনক, জীবন মানেই ঝড়। করার কিছু নেই।

সকাল থেকেই সংসারের চাতালে চড়া নাটক চলেছে। হাত নড়ছে, মাথা দুলছে, চোখ ছলছল হচ্ছে। দেয়ালের দিকে মুখ করে, অদৃশ্য কোনও শ্রোতাকে পিতা বললেন,

When the wind works, against us in the dark
come out, come out
It costs no inward struggle not to go.

বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। শব্দ শুনে পিতা বললেন, পুলিশ এল। গেট রেডি। শোনো তোমাকে বলে যাই, জেলখানার খাবার আমার গলা দিয়ে গলবে না, তুমি আমাকে রোজ একটু দুধ আর পাউরুটি দিয়ে আসবে। পারবে না?

আজ্ঞে হ্যাঁ। কেন পারব না? কিন্তু আপনাকে ছাড়িয়ে আনার কী হবে?

তোমার মাতামহের সাহায্য নিয়ো। তিনিই আমার রিয়েল ফ্রেন্ড। দুজনেই আমরা ঘরপোড়া। গোরু।

গাড়ির দরজা বন্ধ হল। এইবার জোড়া জোড়া বুটের শব্দ তুলে সিঁড়ি বেয়ে পুলিশের দল উঠে আসবে। আমাদের অপরাধটা কী? পুলিশ আসবে কেন?

সিঁড়িতে খুড়স খুডুস করে জুতোর শব্দ হচ্ছে। পুলিশ তো এমন ভদ্রভাবে আসে না। এ যেন পাঁচির ছাগল ছাড়া পেয়ে ওপরে উঠে আসছে। খোলা দরজার সামনে প্রতাপ রায়। আমাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, নাটকের মহড়া চলছে নাকি?

পিতা বললেন, কী ব্যাপার, তুমি?

চলে এলুম। ওই কিছু লিগ্যাল পরামর্শ, তা ছাড়া মেডিকেল চেকআপ। বিষয় বিষ! বিষয় বিষ! প্রতাপ রায়ের গলা শুনে মেসোমশাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। হাল-ভাঙা নাবিক যেন তীর দেখতে পেয়েছেন। কোস্ট অ্যাহয় কোস্ট অ্যাহয় বলে চিৎকার করে উঠলেন।

প্রতাপ রায় উদ্ভাসিত মুখে বললেন, কিছু আগেই এসে পড়লুম দুটো কারণে। কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজ কোনটা কী লাগে জানা নেই, আমার ওখানে বসেই যদি দেখেন বড় বাধিত হই। তা ছাড়া কোনও কাজের দায়িত্ব নিলে, যতক্ষণ সেটা করতে না পারছি, ততক্ষণ ভেতরটা এত ছটফট করে, খেয়ে নেয়ে শুয়ে স্বস্তি পাই না। ওই মেডিকেল চেকআপ! আমার বন্ধু বললে, বেলাবেলি পেশেন্টকে নিয়ে আয়।

মেসোমশাই একমুখ হেসে বললেন, কর্তব্যপরায়ণ মানুষের লক্ষণ। এ এক দুর্লভ লক্ষণ। ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।

আপনি আমাকে তুমিই বলবেন। আমি আপনার ছেলের বয়সি। চেহারাটাই যা একটু মোটাসোটা হয়ে গেছে।

মোটাসোটাই তো ভাল। বেশ ম্যানলি। পুরুষের চেহারা ফিনফিনে হলে মানায় না। মানুষ হবে হেলদি, ওয়েলদি অ্যান্ড ওয়াইজ।

ঘুঘুক ঘুঘুক করে হেসে প্রতাপ রায় বললেন, তা হলে চলুন।

কিন্তু বাবা খাওয়াদাওয়া যে হয়নি এখনও!

খাওয়াদাওয়া! ওটা একটা কথা হল! আপনারা যাচ্ছেন কলকাতার বিখ্যাত রায়বাড়িতে। যে-পরিবার অতিথি সৎকারে ইতিহাস তৈরি করে রেখে গেছে। যার পিতাকে জনৈক নিমন্ত্রিত, তবে রে শালা বলে, পঙক্তি থেকে উঠে খড়ম নিয়ে তাড়া করেছিলেন।

কেন গো!

এত খাইয়েছেন যে আর হাঁ করতে পারছেন না, সেই অবস্থায় জোর করে পাতে গোটাকতক একেবারে গাছপাকা ল্যাংড়া আম ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আপনি মেসোমশাই সেই বাড়িতে যাচ্ছেন।

পিতৃদেব এতক্ষণ একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, তুমি লেখাপড়া কতদূর করেছ প্রতাপ?

প্রতাপ রায় আমতা আমতা করে বললেন, স্কটিশে পড়তুম। ফোর্থ ইয়ারে বাবা মারা গেলেন। বিষয়সম্পত্তির চাপ এসে গেল। তাই ছেড়ে দিতে হল।

এমনভাবে, ‘ছেড়ে দিতে হল’, বললেন যেন খাঁচা খুলে পাখি ছাড়লেন।

পিতা বললেন, এটা তুমি আজ কী পরে এসেছ?

কেন? চিকনের কাজ করা পাঞ্জাবি।

মেয়েদের অন্তর্বাসে এই ধরনের কাজ দেখা যায় বটে।

তা যা বলেন।

এতে কিন্তু তোমাকে তেমন ম্যানলি ম্যানলি দেখাচ্ছে না। কীরকম যেন লোফার লোফার দেখাচ্ছে।

মেসোমশাই বললেন, রহিস আদমিরা এইরকম পাঞ্জাবিই পরেন। চমৎকার মানিয়েছে।

ওঃ, তা হবে।

পিতা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। মেসোমশাই বললেন, হরিদা, আমি তা হলে মেয়েদের নিয়ে একবার ঘুরে আসি। রথ দেখা, কলা বেচা দুই-ই হবে।

অ্যাজ ইউ লাইক।

কনক চাপা সুরে বললে, এঁদের খাওয়াদাওয়ার কোনও ব্যবস্থা না করেই চলে যাব?

আমরা যখন আসিনি তখন এঁরা কী করতেন? এঁদের বেঁধে খাওয়াবার জন্যে তো আমরা আসিনি।

পিতার কথায় কনক কেমন যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। বড়দের জগৎ স্বার্থের চাকায় ঘোরে। রাধে, তুমি কি তা জানতে না!

সেজেগুজে তৈরি হয়ে, কনক পিতৃদেবের সামনে ছলছলে চোখে এসে দাঁড়াল, মেসোমশাই, কী করব বলুন, আমি তা হলে আসছি।

পিতা মাথায় হাত রেখে বললেন, হ্যাঁ মা, সেরে এসো।

মুকুকে নিয়ে মেসোমশাই এসে দাঁড়ালেন, হরিদা, ঘুরে আসছি।

হ্যাঁ, আসুন।

প্রতাপ রায় দূর থেকে হেঁকে বললেন, আমরা আসছি।

অতি ক্ষীণ গলায় পিতা বললেন, এসো।

শুনতে পেল কি পেল না, কেউ বিশেষ গ্রাহ্য করল না। গাড়ির দরজা বন্ধ হল। ইঞ্জিনের শব্দ দূর থেকে দূরে মিলিয়ে গেল। বারান্দার রেলিংয়ে ভর রেখে, রোদ ঝলমলে গাছপালার দিকে তাকিয়ে পিতা বললেন, কী বুঝলে?

আজ্ঞে?

কী বুঝলে? আপনার জন সতত আপন/পর কি কখনও আপন হয়।

আপনার সেই গান!

ইয়েস। আমার সেই ইন্টারন্যাল মিউজিক। একলা চলো রে!

দখিনা বাতাস হু হু করে বয়ে এল। এলোপাতা খসে পড়ল গাছ থেকে। তারে কনকের নীল শাড়ি আমার অভিমানে ফুলে উঠল।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত