১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
ক্যামনে আসে যায়
সব স্থির। সমস্ত মুখ গম্ভীর। এমনকী প্রতাপ রায়ের মুখ থেকেও সেই বিচিত্র হাসি অদৃশ্য হয়েছে। মাতামহ মাথা নিচু করে হাতের আঙুল নিয়ে পুর-মুঠ খেলছেন। এসরাজ একপাশে অভিমানী স্ত্রীর মতো পাশ ফিরে শুয়ে আছে। হারমোনিয়ম বেলো খোলা, সুরহারা। বাঁয়া আর তবলা মাথা ঠোকাঠুকি করে ফাটকের দুই রাতজাগা আসামির মতো নিজেদের ভাগ্য নিয়ে যেন বড়ই বিব্রত। দুই উরুতে হাত রেখে পিতা এত সোজা হয়ে বসেছেন, মনে হচ্ছে অমরনাথের তুষারলিঙ্গ। মাতুল ওপর-ঠোঁট দিয়ে নীচের ঠোঁট চেপে বসে আছেন। বোঝাই যায় সুর বেরিয়ে আসতে চাইছে, কোনওরকমে চেপে রেখেছেন। নিজেকে মনে হচ্ছে ইঁদুরকলে পড়ে গেছি। কেউ-না-কেউ এইবার তুলে নিয়ে বাইরে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আসবে। এক ঝক কালো কালো কাক, ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে তেড়ে আসবে। প্রাণভয়ে ন্যাজ তুলে শুরু হবে আমার দৌড়োদৌড়ি।
প্যাঁচ ঘুরিয়ে এসরাজের ছড়ির ছড় আলগা করতে করতে পিতা বললেন, আর কী রইল? কিছুই রইল না।
মাতামহ মাথা তুলে প্রশ্ন করলেন, তার মানে?
মানে অতি সহজ। চরিত্র গেল তো আর কী রইল? কিছুই রইল না।
ছড়িটা শূন্যে তুলে দেখাতে লাগলেন, এই হল মাথা, লম্বা লম্বা চুল, দুটো লিকলিকে হাত, কঞ্চির মতো বাঁকা বাঁকা দুটো পা, এই ধনুকের মতো পিঠ। এই দুর্বল স্ত্রীর কীসের জোরে জগতের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত?
ছাত্রের মতো সমস্বরে সকলের জবাব, চরিত্র, চরিত্র।
উত্তেজনায় পিতা উঠে দাঁড়ালেন, রাইট ইউ আর। সেই চরিত্রটাই যার থ্রেডবেয়ার হয়ে গেল, তার আর রইল কী! প্রবৃত্তির ড্যাঙোস মাথায় পড়বে। ঘা খেতে খেতে, ঘা খেতে খেতে ও তো কেঁচো হয়ে যাবে। হি ইজ মাই লস্ট সন। আমি এখন পৃথিবীর শেষ সীমায় এসে অন্ধকারে পথ খুঁজছি৷ ইস, ইস, এই ছেলে যখন পিতার নাম বলবে লেট হরিশঙ্কর, আমি তো তখন কবরেও ঘৃণায় যন্ত্রণায় কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠব।
মাতামহ উদাস গলায় প্রশ্ন করলেন, লেট বলছ কেন? তুমি তো প্রেজেন্ট।
আমি সিদ্ধান্ত করেছি, আই উইল কমিট স্যুসাইড।
সভাসদরা সমস্বরে বললেন, সেকী? আত্মহত্যা।
ইয়েস আত্মহত্যা! দুষ্ট গোরুর চেয়ে, শূন্য গোয়াল ভাল।
মাতামহ বললেন, দুষ্ট গোরু তো ও, তুমি কেন গোয়াল শূন্য করে চলে যাবে? এ আবার কেমন বিচার? অঙ্ক আর ইংরেজিতে তুমি মাস্টার, আইনে তুমি একেবারে গবেট।
প্রতাপ রায় বললেন, একে বলে ট্র্যানসফারড এপিথেট। পিতা চড়াক করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ঠিক বলেছ। যে-চড় ওর গালে মারা উচিত ছিল, সেই চড় আমি নিজের গালে মারব। সেলফ ইমমলেশন। ওই উঠোনে কাঠের পিড়েতে বসব। গায়ে ঢালব একটিন কেরোসিন, তারপর একটি দেশলাই কাঠি। যতক্ষণ গলা দিয়ে স্বর বেরোবে, ততক্ষণ বলতে থাকব, তোমার লেলিহান কামনায় আমি পুড়ছি, তোমার লেলিহান কামনায় তোমার পিতা পুড়ছে।
মাতামহ বললেন, আমরা তখন কোথায় থাকব?
কাছাকাছিই থাকবেন।
তুমি পুড়বে আমরা দেখব! কী তোমার বুদ্ধি হরিশঙ্কর। হিন্দুস্থানিরা তোমাকে বুদ্ধ বলবে। এ কি সতীদাহনাকি! আমরা চট, কম্বল, বালি এনে তার ওপর, তার ওপর চাপাব। দমকল ডেকে আনব। তারপর হরিশঙ্কর, পুলিশ এসে তোমাকে ধরবে। কোমরে কাছি বেঁধে টানতে টানতে হাজতে। তোমার হাইপার অ্যাটিচিউড বেরিয়ে যাবে।
প্রতাপ রায় বললেন, হাইপার অ্যাটিচিউড নয়, ট্রানসফারড এপিথেট।
পিতা বললেন, আপনারা কি আমার সঙ্গে তামাশা করছেন? অ্যাম আই এ লাফিং স্টক? ভুলে যাবেন না সেই প্রবাদ, খুঁটে পোড়ে গোবর হাসে। তমসা এগিয়ে আসছে, তামাশা বেরিয়ে যাবে।
যতবারই আমি কিছু বলতে চাইছি মাতুল আমাকে চেপে চেপে ধরছেন। ফিসফিস করে বলছেন, একটাও কথা নয়, উত্তাপ বেরিয়ে যাক। গ্রহ আগে শান্ত থোক।
মেসোমশাই বললেন, পেশেন্স হরিদা, পেশেন্স। অপরাধীকে ডিফেন্ড করার সুযোগ দিন। এটা একটা ফাঁদ হতে পারে।
প্রতাপ রায় বললেন, ভাগনে, চিঠির রহস্যটা কী!
মাতামহ বললেন, তোমার পিতৃদেবকে সত্যি কথা বলে শান্ত করো। আমি জানি, তুমি আমাদের সে ছেলে নও।
আমার বন্ধু সুখেন।
মেসোমশাই বললেন, সে তোমার বন্ধু নয়, শত্রু।
মাতুল বললেন, নো ইন্টারাপশন। হি ইজ কামিং আউট।
মাতামহ বললেন, ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোচ্ছে।
আমার বন্ধু সুখেন আমাকে বলেছিল একটা চিঠি লিখে দে। তোর বাংলাটা ভাল আসে। লেখাটা আমি চিঠি হিসেবে লিখিনি, লিখেছিলুম সাহিত্য হিসেবে।
মাতুল বললেন, বেলেলেটারস আর কী!
মাতামহ বললেন, তার মানে এলেবেলে।
সুখেন বলেছিল একটা মেয়েকে লেখার কথা। আমি লিখেছি প্রকৃতিকে। সত্তাকে ভেঙে দু’খণ্ড করেছি, পুরুষ আর প্রকৃতি। বৈষ্ণবের মধুরভাব আর কী? প্রকৃতিভাবে উপাসনা। আমিই কৃষ্ণ, আমিই রাধা। নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ। রূপ দেখি আপনার/কৃষ্ণের হয় চমৎকার/আস্বাদিতে মনে উঠে কাম ॥ এ চিঠিতে যে নায়ক সেই নায়িকা। সেই বেদনা, যার লাগি কান্দে প্রাণ তারে পাব কীসে।
পিতা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না।
আজ্ঞে না, দুরাত্মা নই, আসল আত্মা। আত্মাকে দু’টুকরো করেছি ভেঙে। একটা পুরুষ আর একটা প্রকৃতি। দু’জানলা দিয়ে দু’জনে উঁকি মারছে। খাঁচার ভিতর অচিন পাখি…
মাতুল বললেন, অ্যাঁ, বলিস কী? খাঁচার ভিতর অচিন পাখি। প্রতাপ, ধরো ধরো।
পাখি নয়, প্রতাপ রায় তবলা ধরলেন। মাতুল ধরলেন,
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
ক্যামনে আসে যায়
ধরতে পারলে মনো বেড়ি…
নে ধর, ধর। গলা দে না ব্যাটা,
ধরতে পারলে মনো বেড়ি
দিতাম তাহার পায়।
মাতামহ উঠে দাঁড়িয়ে বাউলের মতো নাচতে আরম্ভ করেছেন। বারেবারে বলছেন, আহা, খাঁচার ভিতর অচিন পাখি। পিতা বসে পড়েছেন। ছড়ির ছড় টান করতে করতে বলছেন, থেমো না, থেমে না, চালিয়ে যাও। এসরাজ সুরে ককিয়ে উঠল,
ধরতে পারলে মনো বেড়ি
দিতাম তাহার পায়ে।
আট কুঠারি নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝালকা কাটা
উপরে আছে সদর কোঠা
আয়না মহল তায়।
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, বলে মাতুল যখন সুরে উঠছেন, ভেতর কেঁপে যাচ্ছে। মাতামহ নৃত্য করছেন, হাসি পাচ্ছে না। চোখে তাঁর ভাবাশ্রু। গানের ফাঁকে ফাঁকে মন বলে উঠছে, বেরিয়ে পড় পিন্টু। চার দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে পড়। অচিন পাখি ধরতে। কামিনী কাঞ্চনের দাসত্ব, অস্থিমজ্জার দাবি, সব পাশ কাটিয়ে, সেই অনন্তের মুখোমুখি দাঁড়া।
গান থামল, মেসোমশাই বললেন, ছেলে আপনার ব্যারিস্টার হবে। পরিস্থিতি কেমন বদলে দিলে দেখলেন? ভেতরটা কেমন তুলতুলে হয়ে গেল দেখছ হরিদা? কেমন যেন আনচান করছে।
মাতুল বললেন, কার ভাগনে দেখতে হবে তো।
পিতা বললেন, সেইজন্যেই তো ভয় পাই। জালালুদ্দিন রুমির নাম নিশ্চয়ই শুনেছ?
হ্যাঁ শুনেছি।
তা হলে তার একটা গল্প শোনো। গল্প নয়, রূপক। রাজার বাজপাখি একদিন এক ভাঙা আস্তানায় উড়ে এসে বসল। সেখানে গোটাকতক প্যাচা বাস করত। বাজ বললে, তোমরা কি এই জায়গাটাকে খুব উন্নত বলে মনে করো? আমার স্থান কোথায় জানো কি? রাজার হাতের কবজির ওপরে। বুদ্ধিমান পাচারা চিৎকার করে অন্য পাচাঁদের সতর্ক করে দিলে, সাবধান। ওকে বিশ্বাস কোরো না। ওর ছলে ভুলো না। আমাদের আস্তানা দখলের তালে এসেছে। তুমি হলে সেই রাজকীয় বাজ। আমার এই প্যাচাটিকে কোটর-ছাড়া কোরো না।
মাতুল বললেন, আমার নাকটা সামনের দিকে সামান্য বাঁকা বলে বাজ বলছেন? তা বলুন। কিন্তু ওকে প্যাঁচা বলছেন?
আপত্তি কীসের? রুমি কী বলছেন শোনো, only Sweet-voiced birds are imprisoned/Owls are not kept in cages. যারা মেয়েছেলের সোনার খাঁচায় ঝোঁটন পাখি হয়ে বারান্দায় দোল খায়, তাদের গায়ে মুতো কাঁথার গন্ধ। তাদের মন শ্যাওলা-ধরা উঠোনের মতো। মানুষ যদি পুঁটলির মতো সংসারের চাতালে পড়ে থাকে তা হলে তার কী হবে? নৌকোর পাটাতনে নিদ্রিত মানুষের মতো অবস্থা হবে। এক দুলুনিতেই ছিটকে পড়বে অগাধ জলে। Seek a Pearl/brother/within a shell/And seek skill from among the men of words.
মাতুল বললেন, আমি কি তা হলে কিছুই না?
তুমি তোমার ক্ষেত্রে বিরাট। তবে কী জানো, তোমার লাইনে কিছু পাপ সহজাত। সুর, সুরা আর সুন্দরী। তুমি ধরবে। তোমার লিভার শুকোবে। তোমার কণ্ঠ হারাবে। শেষে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরবে। তোমার ভাগনের হাতে গার্ডল অফ ভেনাস আছে। জানো কি?
প্রতাপ রায় বললেন, গার্ডল অফ ভেনাস? ভাগনে আমাদের শিল্পী হবে। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে অভিনয়ের লাইনে যাবে। দুর্গাদাস, নির্মলেন্দু, প্রমথেশ, দানিবাবু কি গিরিশ ঘোষ বলছি না, তাঁদের কাঠামোই আলাদা ছিল। এর একটা কীরকম প্রেমিক-প্রেমিক, গার্ডল অফ ভেনাস-ভেনাস চেহারা। ব্যর্থ প্রেমিকের ভূমিকায় ফাটিয়ে ছেড়ে দেবে। মেকআপ পর্যন্ত লাগবে না। আমাদের ছবিতে একজোড়া নতুন হিরো-হিরোইন লাগালে মন্দ হয় না। বই তো এমনিতেই ফ্লপ করবে, তবুলাখখানেক টাকা বাঁচবে।
অক্ষয় ওর হাত দেখে আমার কানে কানে বলেছিল, হরিদা, খুব সাবধান, শুক্রবন্ধনী ছিঁড়ে ঝলঝলে হয়ে ঝুলছে, সরু সরু, লম্বা লম্বা, গাইনোকোলজিস্টদের মতো হাতের আঙুল, শুক্রের ক্ষেত্র ঢিবির মতো উঁচু, তাতে আবার জাল চিহ্ন, এ ছেলে ডন জোয়ান হবে। প্রমোদ আর প্রমদা, এই হবে ওর জীবনের পারস্যুট। চুলের কেয়ারি, সাজপোশাকের বাহার আর চাঁদনি রাতের বেড়ালের স্বভাব।
মাতামহ বললেন, সে আবার কী?
ফাল্গুন আসুক বুঝতে পারবেন। মাঝরাতে চাঁদের আলোয় পাঁচিলে বসে হুলো ডাকছে বুকফাটা গলায় মিঞাও, মিঞাও।
কাকে ডাকবে হরিশঙ্কর? সুখে ডালে বসি, ডাকিছ পাখিরে, ডাকিছ কি সেই পরমপিতারে?
আজ্ঞে না, হুলোর জীবনে পিতা নেই, মাতা নেই, পরমপিতা নেই, আছে শুধু প্রমদা। বালস্তাবক্রীড়াসক্ত-স্তরুণস্তাবৎ তরুণীরক্তঃ।
মাতামহ বললেন, কী যে বলো তুমি? এ হুলো সে হুলো নয়। আজ এর সমাধি হয়েছিল, সে খবর রাখো কি?
পিতা বললেন, সমাধি আর লো প্রেশারের একই লক্ষণ। ওকে নিয়ে আমি চেঞ্জে যাব।
যাক, তা হলে তোমার রাগ পড়েছে।
হ্যাঁ, একে বলে সেকেন্ড থট। কোনও কিছু করার আগে দু’বার চিন্তা করা উচিত। আমি সরে গেলে ও আরও চিঠি লিখবে। প্রেমের বন্যা বইয়ে দেবে। প্রেমের ডিসেন্ট্রি ডায়েরিয়ায় জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
তা যা বলেছ। ব্যাটা যেন ডিসপেপটিক শ্রীকৃষ্ণ। ফুয়ে তেমন জোর নেই তাই বাঁশি ছেড়ে কলম ধরেছে। তুমি হবে ওর বেলপোড়া।
আজ্ঞে হ্যাঁ, বেলপোড়াই হব। বাঁশি তবু বাজে, হুলোরা ডাকে, কলম বড় সাংঘাতিক জিনিস। নিঃশব্দ প্রাণঘাতিকা। বাঁশি শুনে গোপীরা বলত, কেষ্ট মুখপোড়া ছটফট করছে, কলমের খোঁচায় তেড়ে আসে মশলার কারবারিরা। চিঠিটা পুড়ে গেল, তা না হলে ভাষাটা ভাল করে অ্যানালিসিস করা যেত। বোঝা যেত কতদূর এগিয়েছে আর কতদূর এগোবে।
প্রতাপ রায় বললেন, কী লিখেছিলে ভাগনে?
মেসোমশাই বললেন, সে কি আর মনে আছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ, মনে আছে। ও তো চোরাই মাল।
মাতুল বললেন, সে কী? প্রেমেও প্লেজিয়ারিজম। কোথা থেকে ঝেড়েছ?
আজ্ঞে খালিল জিব্রান থেকে। আমার সুখে তুমিই অসুখ। কেন? সে প্রশ্নের জবাব শুনে তোমার হৃদয় কি টলবে? যাকে ভালবাসি, যাকে জীবনের সঙ্গী হিসেবে পেতে চাই, যার জন্যে আমার দিবসের শ্রম, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, রাতের অনিদ্রা, সে যদি হৃদয়টি অন্যকে দান করে দিয়ে বসে থাকে তা হলে। সুখের আর কিছু থাকে কি? আমি ধীরে ধীরে বাতির মতো গলে যাচ্ছি। বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছি আতরের সুবাসের মতো। কী আর অবশিষ্ট রইল আমার? এ দিন কবে শেষ হবে! এ রাত কখন ভোর হবে!
মাতুল বললেন, দারুণ লিখেছিস তো। আমার আবার একটু গাইতে ইচ্ছে করছে।
হারমোনিয়মে ভাঙা কাঁচের মতো সুরে চুরমার চুরমার বেজে উঠল। একেবারে চড়া পরদায় গান ধরলেন।
থি বো ইক শখসকে তসব্বর সে।
অব. বো রানাই এ খয়াল কহাঁ।
দু-চার পাক খেয়ে বাংলা করলেন, একজনের রূপের কল্পনায় আমি মশগুল ছিলাম। মনে এখন আর সে নেশা খুঁজে পাই না কেন?
তেরি ফুরসত কে মুকাবিল ওই উমর।
বর্ককো পাব হিনা বাঁধতে হেঁ ।।
হায় রে জীবন, বিদ্যুতের পায়ে মেহেদি আঁকার মোকাবেলাতেই তো ফুরিয়ে যাবি!
বাইরে আবার উতলা বাতাস বইতে শুরু করেছে। মনে হয় আবার বৃষ্টি হবে। প্রতাপ রায় বললেন, এবার ওঠো। অনেক দূর যেতে হবে।
হারমোনিয়মের বেলো আঁটতে আঁটতে মাতুল বললেন, কতদূরে আর যাবে, মৃত্যুর চেয়ে দূরে তো আর যেতে পারবে না ভাই। নজর ঘেঁ হেঁ হমারি জাদএ রাহে ফনা গালিব। কি য়ে শিরোজা হৈ, আলমকে অজজাএ পৃরিশাঁকা। আমার দৃষ্টিতে মৃত্যুর পথই ধরা পড়ে, গালিব। নিয়মহারা সংসারে মৃত্যুই তো একমাত্র শৃঙ্খলা, প্রতাপ।
এসরাজে শেমিজ পরিয়ে পিতা নিজেই হুকে ঝোলাতে গেলেন। আমাকে আর কোনও আদেশ হল না। খুব রেগে আছেন। মেসোমশাই বেশ নিশ্চেষ্ট হয়ে দেয়ালে পিঠ দিয়ে আরামে বসে আছেন। প্রতাপ রায় হাতে ঘড়ি বাঁধতে বাঁধতে বললেন, আপনি আইনজ্ঞ?
মাতামহ উত্তর দিলেন, আরে বাপ রে বিরাট ব্যারিস্টার। ইনি উঠে দাঁড়ালে জজসাহেবরা ভয়ে কাঁপেন। মেসোমশাই ওজন বাড়াবার জন্যে মুখটাকে আরও গম্ভীর করলেন। মাতুল কানে কানে বললেন, তুই একটা কবজ ধারণ কর। সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে।
প্রতাপ রায় বললেন, ওঃ ভগবান আপনাকে পাইয়ে দিলেন। এখানে ক’দিন আছেন?
মেসোমশাই অকারণে কেশে, ব্যক্তিত্বের কুচকাওয়াজ তুলে বললেন, কিছুদিন আছি। ছোট মেয়ের পরীক্ষা, বড় মেয়েটাকে একবার বড় ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করাব।
কী হয়েছে?
মনে হয় সেপটিক টনসিল। প্রায়ই ভোগে।
তাই নাকি? কাকে দেখাবেন ঠিক করেছেন?
নাঃ।
আমার এক বন্ধু বড় ডাক্তার, এফ আর সি এস। বলেন তো ঠিক করে দিতে পারি। এক পয়সা লাগবে না। আমার বাড়ির নীচেই চেম্বার।
মেসোমশাই সোজা হয়ে বসে বললেন, তা হলে তো খুবই ভাল হয়। আপনাকে ঈশ্বরই মনে হয় পাইয়ে দিলেন।
দু’জনে কোরাসে বললেন, ভগবানের অসীম কৃপা!
মাতামহ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ভগবান কখন কী যে করেন!
এসরাজকে ফাঁসিতে লটকাতে লটকাতে পিতা বললেন, হি ইজ দি রিয়েল কালপ্রিট।
প্রতাপ রায় বললেন, আমি আপনার কাছে কিছু আইনের পরামর্শ নিতে চাই।
অবশ্য, অবশ্য।
কলকাতায় আপনি কেস করতে পারবেন না?
কেন পারব না। তেমন জটিল কিছু হলে অবশ্যই করব। সহজ হলে জুনিয়ার দিয়ে করানোই ভাল, খরচ কম হয়।
প্রতাপ রায় বললেন, ফি ইজ নো প্রবলেম।
দ্যাট আই নো, দ্যাট আই নো!
কাল দুপুরের দিকে একবার আসব? আপনাদের দু’জনকেই একবার নিয়ে যাব। লিগ্যাল এগজামিনেশন, মেডিক্যাল চেক আপ একসঙ্গে হয়ে যাবে।
পিতা এসরাজ ঝুলিয়ে ঘরের বাইরে চলে যাচ্ছিলেন, মেসোমশাই ডাকলেন, হরিদা, আপনি কী বলেন?
অতি উত্তম প্রস্তাব। তা ছাড়া গাড়ি আছে, যাওয়া-আসার অসুবিধে হবে না।
মেসোমশাই প্রতাপ রায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেন সেটল্ড?
মাতুল উঠে দাঁড়িয়ে কাছাকোঁচা ঝেড়েঝুড়ে পাট পাট করে নিলেন। সিনেমা টিনেমার কথা মনে হয় ভুলেই গেছেন। মুখে একটা অদ্ভুত প্রেমিক ভাব। কোথায়, কই রে তোরা, বলে ভেতর বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন।
কাদের খুঁজছেন? সময় তো সব নিয়ে চলে গেছে! কাল ভুল হয়ে গেছে? দিদিকে খুঁজছেন নাকি? তিনি তো মৃত্যুপারের জগতে? একটি ছবি কেবল দেয়ালে ঝুলছে। মুকু ফোলাফোলা মুখে একপাশে দাঁড়িয়ে বেশ আয়েশ করে একটি হাই তুলছিল। ছোট্ট, এতটুকু এতটুকু এক সার দাঁত লাল একটি জিভ হাইয়ের আকর্ষণে ভেতর দিকে এলিয়ে পড়ছে। মাতুল টুস টুস করে দু’বার টুসকি বাজিয়ে নিজেই একটি বিশাল আকারের হাই তুললেন ইমন কল্যাণে। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই কত রকম রাগিণীতে হাই তুলতে পারিস?
চেষ্টা করে দেখিনি তো?
কনক আলু ভাজছিল। থালায় গোল গোল আলুভাজা। তেল মরছে পিটির পিটির শব্দে। টুক করে দু’খণ্ড মুখে ফেলেই হা হা করতে লাগলেন। ভীষণ গরম। কোনওরকমে সামলে নিয়ে বললেন, এটা রাগিণী নয়, রাগ, রাগভৈরব।
কনক তাড়াতাড়ি বললে, ডিশে করে দোব? খাবেন আলুভাজা?
কনকের নাকটা ধরে নেড়ে দিয়ে বললেন, তোমার গান আজ আর শোনা হল না। আর একদিন হবে। এর সঙ্গে একদিন আমাদের বাড়িতে এসো না?
পাঞ্জাবির পকেটে হাত পুরে এতটুকু একটা সেন্টের শিশি বের করে কনকের হাতে দিয়ে বললেন, বিলিতি। জুনো। তোমার সৌরভ বাড়ক।
কনক ভ্যাবাচ্যাকা। লাল একটা লঙ্কা হাতে তুলে নিয়ে, গোলাপ ফুলের মতো নাকের কাছে ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে মাতুল ফিরে চললেন। সাজাহান যেন তাজমহল দেখে গোলাপ ফুল শুঁকতে শুঁকতে খাসমহলে ফিরে চলেছেন। বারমহলে ঢোকার মুখে থমকে দাঁড়িয়ে আমাকে বললেন, বুড়ো দেখেছিস?
কীরকম বুড়ো?
একেবারে থুথুরে বুড়ো। বিছানায় কাপড়েচোপড়ে হয়ে পড়ে আছে।
আজ্ঞে না।
জীবনের কোনও কিছু তেমন করে গায়ে মাখবি না। মাখামাখি করে, কাপড়েচোপড়ে, ন্যাজেগোবরে হয়ে পড়ে থাকবি না। লাইফ ইজ এ গেম। হারজিত দুই-ই আছে। দুঃখ আছে। সুখ আছে। আমাদের দুটো পা, একটা সুখের, একটা দুঃখের। দুটো চোখ, এক চোখে হাসি, এক চোখে জল। গলা কিন্তু একটাই, কখনও ফুলের মালা, কখনও জুতোর মালা। কাটা আর ফুল, ফুল আর কাটা। গো অন মেরিলি ভাগনে। ইউ গো ইয়োর ওয়ে, আই গো মাই ওন। শিমুলের বীজ ফাটা দেখেছিস?
আজ্ঞে না।
কী দেখেছিস? কুনো ব্যাং? সরু সরু তুলোর পাখায় ভর করে ছোট ছোট বীজ উড়ে আসছে। আমাদের কর্মফল। ফুঁ দিয়ে দিয়ে উড়িয়ে দে, উড়িয়ে দে। ব্রাশ অ্যাসাইড, লাভ অ্যান্ড হেট/মি বিসাইড মি/ লাফটার আফটার/ হলটার, ফলটার/ রাইজ টু দি অলটার/ নান টু লুক আফটার দিই।
ভরাট গলায় ইংরেজি গান শুনিয়ে মাথায় গোটাকতক টুসকি মেরে মাতুল নেমে গেলেন নীচে। গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ হল। শব্দ মিলিয়ে গেল দূর থেকে দূরে। বেশ রাত হয়েছে। চারপাশ কেমন যেন সিমসিম করছে। অশরীরীরা নেমে আসছে রাতের জলসায়। মানুষের নাচঘর ঝিমিয়ে এল?
বিরাট কার্পেটে মাতামহ মাথা নিচু করে মাঝখানে একা বসে আছেন। মাথা মৃদু মৃদু দুলছে। ঠোঁটে সেই বাঁকা হাসি। যে-হাসির অর্থ দেখেছি অনেক, দেখছি অনেক, দেখব অনেক। পক্ষহীন শোনো বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ পালাবার।
খুব মৃদু স্বরে বললেন, তোমার সেই সারমনের খাতায় লিখে নাও, নাচালে নাচব না। হুঁশ নিয়ে মানহুশ হব। আরও লিখে নাও, প্রেমের ডিসেন্ট্রিতে পিতার বেলপোড়া। কিন্তু আমি এখন যাই কোথা?
মাতামহকে আর তেমন সাহস করে বলতে পারছি না, কেন? এখানেই থাকবেন? আমার নিজের আসনই টলে গেছে। কনক এসে হাঁটু গেড়ে বসল। মাতামহের মুখের দিকে নিচু হয়ে তাকিয়ে বলল, কী, খাওয়াদাওয়া হবে? রাত তো অনেক হল?
মাতামহ সেইভাবেই দুলতে দুলতে বললেন, কে কী অবস্থায় আছে?
কনককে আর উত্তর দিতে হল না। মেসোমশাই মেঘ গর্জনের গলায় ডাকলেন, কনক, তুমি এদিকে চলে এসো। কনক করুণ মুখে আমার দিকে তাকিয়ে উঠে গেল। মেসোমশাইয়ের এই ডাকের অর্থ আমি বুঝি। ঘৃণা-মেশানো ডাক। মেয়েকে বলছেন চলে এসো। সন্দেহজনক চরিত্রের ছেলের কাছাকাছি থেকো না। দাগ লেগে যাবে। যৌবন বড় ছোঁয়াচে। বসন্তের টিকে হয়, যৌবন ব্যাধির যে কোনও প্রতিষেধক নেই।
মাতামহ মুখ তুলে তাকালেন। সর্ববোদ্ধার সেই হাসিটি আরও জোরদার হয়েছে। মাথা নড়ছে। কী বুঝলে, কী বুঝলে না? পাথরের মতো মুখ করে খাওয়া শেষ হল। রাত জানে না, কী হবে, কী হবে না। দিনের আলোয় বোঝা যাবে, আমি প্যাঁচা না অন্য কোনও পাখি। আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ছাড়াছাড়া, টুপটাপ। গাছপালার গন্ধ ভেসে আসছে। অন্ধকার বাগানের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, দূর কোণে আমি দাঁড়িয়ে আছি, নিজেই নিজের কবর খুঁড়ছি। মাটি তোলার শব্দ হচ্ছে ঝুপঝাঁপ৷ সতীমার চেহারা ভাসছে চোখের সামনে। চোখদুটো যেন পেতলের।
এদিক-ওদিক তাকিয়ে কনক পাশে এসে দাঁড়াল ভয়ে ভয়ে। এত দুঃখেও হাসি পেল। এ যেন শ্রীরাধার অভিসার। চরিত্রহীন কেষ্ট বারান্দার কোণে দাঁড়িয়ে। হাতে বাঁশির বদলে ব্রাশ। তার ওপর আধ ইঞ্চি টুথপেস্ট।
বুকের কাছে ব্লাউজের ভেতর থেকে খানচারেক ডায়েরির পাতা বের করে কনক আমার বাঁ হাতে গুঁজে দিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেল। একটাও কথা বললে না। বোঝাই গেল পিতার নিষেধ। ছেলে বখে গেছে। পাশের বাড়ির আইবুড়ো মেয়েকে প্রেমপত্র লিখেছে। খলিফাঁদের দেশ হলে ব্যাটাকে শূলে চাপানো হত। শুধু শূল নয়, গরম শূল।
উত্তর মহল অন্ধকারে ডুবে গেছে। সংসার নিস্তব্ধ। যে-ঘরে আসর বসেছিল, সেই ঘরেই মাতামহর বিছানা পড়েছে। পদ্মাসনে খাড়া বসে আছেন। রাত বাড়ছে। এইবার বেটির সঙ্গে যত মনের কথা প্রাণের কথা হবে। মশারিতে ঢোকার সময় আমার মাথায় হাত রেখে মন্ত্র জপ করে। দিয়ে বলেছেন, কোনও ভয় নেই। মেঘ আসে মেঘ কেটে যায়। সূর্য চাপা পড়ে গেছে দেখে ভেবো না যেন সূর্য আর উঠবে না। রাত আসে দিন হবে বলে।
পিতা ঘরের দরজা বন্ধ করে দ্রুত পায়চারি শুরু করলেন। মশারির ভেতর মটকা মেরে পড়ে আছি। ডায়েরির যে-পাতায় মায়া আর কনক সম্পর্কে আমার জ্ঞানগর্ভ কথা লেখা ছিল কনক বুদ্ধি করে সেই ক’খানির পাতা ছিঁড়ে রেখেছিল। নইলে কী যে হত! সেসব যা কথা, যে-কোনও পিতা পড়লেই পুত্রকে দ্বিতীয় কোনও কথা না বলে পা থেকে জুতো খুলে প্রহার। ব্যাটার ডস্টয়েভস্কি হবার শখ হয়েছে। ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট।
সবচেয়ে অপমানের মেসোমশাইয়ের ব্যবহার। আমার যেন লেপ্রসি হয়েছে। মেয়ের ছোঁয়াচ লাগলে গলে গলে অঙ্গ খসে যাবে। প্রেম কি লেপ্রসি! বয়স্ক মানুষরা বিবাহ বোঝেন, প্রেম বোঝেন না কেন? এই মাঝরাতে একবার গলা ছেড়ে ধরব নাকি? বেশ একটু খেপু-খেপু ভাব আসছে ভাঙ ভাঙ কারার মতো।
তুণ্ডে তাণ্ডবিনীং রতিং
বিতনুতে তাবলীলব্ধয়ে
কর্ণক্রোড় কড়বিমনী ঘটয়তে
কর্ণাৱঁদেভ্য স্পৃহাং।
চেতঃপ্রাঙ্গণ-সঙ্গিনী বিজয়তে
সৰ্বেন্দ্ৰিয়াণাং কৃতিম
নো জানে জনিতা কিয়দ্ভিরম্তৈঃ
কৃষ্ণেতিবর্ণদ্বয়ী ॥
মশারির ভিতর গাট হয়ে বসে কীর্তনীয়া প্রেমদাস বাবাজির মতো ধরব নাকি, তুণ্ডে তাণ্ডবিনীং!
পিতা মশারির সামনে এসে দাঁড়ালেন। মশারির পাশ তুলে প্রথমে টেনে নিলেন পাশবালিশ। মাথার বালিশ ধরে টানছেন, ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলুম, কী হল, শোবেন না?
এক্সকিউজ মি। তোমার পাশে শুতে আমার গা রি রি করছে, ভেতরটা ছি ছি করছে। দেহের খবর জানি না, তোমার মন অপবিত্র হয়ে গেছে। তুমি শুধু অপবিত্র নও, তুমি ভণ্ড। তোমার পঞ্চেন্দ্রিয় নৃত্য করছে থই থই, তাতা থই থই।
বালিশ ধরে এক টান মারলেন। তলায় ছিল দু’সেলের ছোট্ট একটা টর্চলাইট। ঠিকরে পড়ল মেঝেতে। পিতা বললেন, যাঃ ফিনিশ।