১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
মাগুর মাছের ঝোল,
যুবতী নারীর কোল
পণ্ডিতের ঘরেই মূর্খ জন্মায়। আবার মূর্খরাই পণ্ডিত হয়। সেই তিন পণ্ডিতের গবেষণার গল্প। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে চাষার কোদালে একটি তালের আঁটি উঠেছে। জটাজুটধারী। কী বস্তু কে জানে? কোনও দেবতাটেবতা নয় তো! তিন পণ্ডিত এলেন। টিকি নেড়ে, নস্যি নিয়ে, একজন বললেন, এ বস্তুটি হল শকুনের বাত্সা। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত দু’জন পণ্ডিত কখনও একমত হতে পারেননি। দ্বিতীয় পণ্ডিত বললেন, তুমি কসু জানো, এটা বাদুড়ের বাস। তৃতীয় পণ্ডিত বললেন, প্রণাম করো, ইনি হলেন ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির মাথা। চাষা ব্যাটা কোদালের কোপে ধড় থেকে নামিয়ে এনেছে। কুম্মাণ্ডকে নিয়ে চলো কোতোয়ালের কাছে, বিচার হবে। কারুর সর্বনাশের রাস্তা খোলা হলে। পণ্ডিতরা সঙ্গে সঙ্গে একমত। আহা ব্যাটা শূলে চড়বে। হাকিম শূলে প্রায় চড়িয়েই ফেলেছিলেন। হাকিমের স্ত্রী বললেন, আরে ওটা তো তালের আঁটি। আমাকে দাও, ভেঙে ফোঁপলটা খেয়ে ফেলি।
গামলার প্রাণীটি যে একটি নেংটি ইঁদুর দুই পণ্ডিতে বুঝে উঠতে পারিনি। কনকের কোল থেকে মেঝের ওপর তার পলায়নের রেখা টেনে জলচৌকির নীচে গিয়ে ঢুকেছে। আর তাকে পায় কে? এদিকে তিন বোতল কালির স্রোত মেঝের ঢাল বেয়ে নর্দমার দিকে গড়িয়ে চলে গেছে। নীল, কালো, নীলকালো, সব মিলেমিশে সর্বধর্ম সমন্বয়ের মতো একাকার। মাঝখানে আমি এক শ্রীরামকৃষ্ণ হাত ঊর্ধ্বাকাশে তুলে সমাধিস্থ। কনক এক মহামায়া, ভূমিশয্যায় আড়কাত হয়ে হেসে কুটোপুটি। দরজায় উঁকি মারছে আর এক মহাশক্তি মুকু। কে যেন বলেছিলেন, নারী নরকের দ্বার। আমার মাতামহ। মাতামহী যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন হয়তো বলেছেন, স্বর্গদ্বার। শৃগাল অনেক লম্ফঝম্ফর পর নাগাল না পেয়ে বলেছিল, দ্রাক্ষাফল টক। মাতামহী বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে সরে পড়ার পর সেই স্বর্গদ্বার হয়ে গেল নরকের দ্বার। আমার তেমন কোনও বন্ধন নেই, প্রায় নাঙ্গাবাবা, আমি ভেবেচিন্তেই বলছি, বাক্যটির মধ্যে কিঞ্চিৎ সত্য আছে। আমি যদি সরাইকেল্লার মহারাজা হতুম, তা হলে মায়ার কাছে যেতুম গজমোতির হার নিয়ে ঘোড়ায় চেপে। এক শিশি কালি তো সেই গজমোতির হার। কনট্রোলের শাড়ি পরা রাজকুমারীর মনে সামান্য আঁচড় কাটার চেষ্টা। মানুষের অভাব বেড়েছে, স্বভাব কিছুই পালটায়নি। তপস্যা করলেও বেড়াল বেড়ালই থেকে যাবে। উপনিষদ কত আগেই বলে রেখেছেন, নান্যঃপন্থা। আদি রিপুকে মালসায় ফেলে গন্ধকের আগুনে পোড়ালেও কিছু হবে না।
ছেঁড়া কাপড় দিয়ে নিংড়ে নিংড়ে ওই কালিকে যতটা সম্ভব বোতলে ফিরিয়ে আনতে হবে। তা হলে রাতে এই সুন্দরীদের সামনে আমার নাজেহাল অবস্থা হবে। বারেবারে শুনতে হবে তিন চরণ কবিতা,
Sons dangle their fathers with a rope, creation kills the creator,
even the Almighty Lord.
কার লেখা কে জানে, বারেবারে শুনে শুনে কান পচে গেছে। ঘরের নর্দমার ছোট্ট মুখে একটি গোল কাঠ গোঁজা। সেখানে তৈরি হয়েছে কালির আরব সাগর। এমন এক পাপ ছড়িয়েছে যাকে আর সহজে চাপা দেওয়া যাবে না। নর্দমা চুঁইয়ে ওপাশে সিঁড়ির দেয়াল দাগরাজি করবেই। এতক্ষণে করেও ফেলেছে। কতরকমের রসিকতা আছে! মুকু বললে, আহা আমার বড় ইচ্ছে করছে ওই কালি পুকুরে একটা কাগজের নৌকা ভাসাই। কনক বললে, থাক, বুড়ি বয়েসে আর ছেলেখেলার দরকার নেই। বাবা কোথায় রে?
বাথরুমে?
কনক বললে, এসো, দু’জনে মিলে যতটা পারি তুলি।
তুমি আবার হাতে কালি মুখে কালি করবে কেন?
আমার অপকর্ম আমাকেই সামলাতে হবে।
এতক্ষণ আমরা কেউই লক্ষ করিনি, কেমন সহজে তুমি-তে নেমে এসেছি! পাশাপাশি বসে কালি ভোলা হচ্ছে। বোতলের পাপ বোতলেই ফিরে যাচ্ছে একাকার হয়ে। ঘরে একটি মাত্র ছোট জানলা। তেমন আলো বাতাস আসে না। বেশ গরম হচ্ছে। এই প্রথম টের পেলুম, বেদান্তেও যা লেখা নেই, নারীদের শরীর থেকে অদ্ভুত একটা গরম হলকা বেরোয়। দীর্ঘ রৌদ্রদগ্ধ মাটিতে প্রথম বৃষ্টি পড়লে যেমন একটা সুবাস ছড়ায়, তেমনি একটা গন্ধও আছে। ওদিকে আমার মন যাবার কথা নয় তবু যাচ্ছে। এমনও মনে হচ্ছে, হে প্রভু, রোজই যেন একবার করে বোতল ওলটায় এইভাবে। আমার মনটা যেন কেমন কেমন করছে। গলায় চিকচিক করছে ছিলে কাটা সোনার হার। হাতের চুড়িতে রিনিঝিনি শব্দ। নাকছাবির পাথর এক একবার চমকে উঠছে। খেকুরে মনের পোড়া শ্মশানে। বসে, বিসমিল্লা খাঁ সানাইয়ে ধরেছেন পুরিয়া ধানেশ্রী। বৈশাখী সন্ধ্যায় ফুলওয়ালি হেঁকে চলেছে। বেলফুল। তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ উঠে। সুখেন ঠিকই বলে গেল, পৃথিবী বিশাল। বেরিয়ে পড়, বেরিয়ে পড়। পুরানা কাগজ বলে থলে কাঁধে হেঁকে বেড়ালে সের সের কাগজ মিলবে, লোহালক্কড়, শিশিবোতল, ভাঙা কাঁচ মিলবে। মন মিলবে না, স্নেহ ভালবাসা মিলবে না। যে পায়, সে পায়। এসব ভেসে ভেসে কোথায় চলে যাবে! ঘর থাকবে, বৈশাখ থাকবে, সন্ধ্যার নম্র অন্ধকার থাকবে, মানুষ থাকবে না। মেয়াদ এক মাস। তারে ঝোলা শাড়ি সরে যাবে, ফিতে, কাটা, চিরুনি, সাবান, তেলের সুবাস, চুড়ির শব্দ, সব, সব মিলিয়ে যাবে। আবার সেই শূন্য বাড়ি, শেষ বেলার ছায়া, দূরে বহু দূরে কোনও মায়ের চিৎকার– পিন্টু ঘরে আয়।
এই ঠোঁট-ফোলানো ন্যাকামির জন্যেই ছেলেটার কিছু হবে না। কাব্য করেই কেবল মোলো। কেউ বলেনি, নিজেকেই নিজের তিরস্কার। একটা দিনও পার হল না, মনেই মথুরা তৈরি করে নটঘট অবস্থা। একে কয়লার গোলায় চাকরি করে দাও। বোঝা মাথায় বাড়ি বাড়ি ঘুরলেই রস মরে পুরুষ হবে। আর্মিতে পাঠাও। প্যারেড করে জীবন যন্ত্রণা জুড়োবে। কালি বোতলে তোলো, মেঝে থেকে তুলে মেঝেতে নিংড়োচ্ছ কেন? স্বপ্ন দেখছ নাকি?
তাই তো! কনকের কথায় চমক ভাঙল। কোন কল্পনাজগতে ভাসছিল মন!
সন্ধে হয়ে আসছে। মায়াকে কালির শিশিটা দিয়ে আসতেই হবে। প্রায় সাত দিন হয়ে গেল, দেখা সাক্ষাৎ নেই। সুখেন যাই বলুক বিন্দুবালার গাধা হয়েও সুখ আছে। যে-সংসারে পুরুষ নেই সে সংসারে মেয়েদের স্বাধীনতার চেহারাই আলাদা। ভাল সারযুক্ত মাটিতে উপযুক্ত আবহাওয়ার ফুল যদি ফুটতে পায় সে ফুলের চেহারাই আলাদা। চেনাকেও অচেনা মনে হয়। মনে আছে। কালিম্পঙে গিয়ে গন্ধরাজ দেখে অবাক। কী ফুল? কী ফুল? মহা বিরক্ত হয়ে একজন বললেন, গর্দভ গন্ধরাজ চেনো না। এদিকে গন্ধরাজ পুরোটা ফোটেই না।
যেন কন্বমুনির আশ্রম। হরিণ ছাড়া সবই আছে। ছিটে বেড়া। গাব ভ্যারেন্ডার ঝোঁপ। সারি সারি কলকে, টগর, করবী। উঠোনের মাঝখানে তেলচুকচুকে পাতা, কাঁঠাল গাছ। তলায় বাঁধা হাবলা-গোবলা একটি ছাগশিশু, লোটা লোটা কান। পেছন দিকে একটা ডোবামতো আছে। বর্ষায় ভেসে উঠোন পর্যন্ত চলে আসে। মাটির উঠোনে একটা চৌকি পাতা আছে। মেঘশূন্য চাঁদিনি রাতে ব্যাপারটা ভীষণ জমে ওঠে। কাঁঠাল গাছের মাথার ওপর চাঁদ ওঠে। তারাদের জলসা। দক্ষিণের হৃদয় বিদারক বাতাস। ধূপধুনোর গন্ধ। ঘণ্টাধ্বনি। রাতচরা পাখির কটাস কটাস বন্ধন খোলা ডাক। চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত মায়ার পোড়-খাওয়া মুখ। বিন্দুবালার সাধনজগতের কথাবার্তা। ভিজে কাপড়ে ছায়ার চলে যাওয়া। কেমন করে বৈরাগ্য আসে প্রভু! জলে জাল ফেলে জেলে বসে আছে জলে।
সারাদিন রোদে পড়ে থেকে ডোবার জল এখন বাষ্প ছাড়ছে। গাছপালার পেছনটা নীল-নীল ধোঁয়া-ধোঁয়া। মায়াবিনীর আঁচল উড়ছে। ছাগলটা চোখ বুজিয়ে কাঁঠাল পাতা চিবোচ্ছে। বেতার গায়ে একটি নীল শাড়ি শুকোচ্ছে। মায়া ঘরের সামনের দাওয়ায় বসে, উরুতে ফেলে প্রদীপের সলতে পাকাচ্ছে। গোটা কুড়ি হয়ে গেছে। আর ক’টা হবে কে জানে! দৃশ্যটি দর্শনীয় হলেও উটকো পুরুষের দেখা উচিত হবে কি না বুঝতে পারা যাচ্ছে না। শাস্ত্র এ সম্পর্কে নীরব। অথচ প্রদীপের জন্যেই সলতে। সলতের জন্মস্থান মহিলাদেরই কলিকাণ্ড সদৃশ জঙ্ঘার তৈলাক্ত মসৃণ দেহভাগে। প্রদীপ না জ্বললে ধর্ম হয় না। সলতে না হলে প্রদীপ জ্বলে না। যুবতীর উরু না হলে সলতে হয় না। আমাদের মেনিদা যদি ঠ্যাং বের করে সলতে পাকাতে বসেন, তা হলে এক পাকেই তো চিৎকার উঠবে। কঁচি আন, ব্লেড আন। লোম রোল হয়ে সলতে সেঁটে আছে জেঁকের মতো। পরিণত পরিণতি লোমফোঁড়া।
তা হলেও, মায়া একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। অতটা অনাবৃত করার প্রয়োজন ছিল না। বাড়িতে কোনও পুরুষ না থাকলে মেয়েদের সাহস বড় বেড়ে যায়! এ যেন মশা মারতে কামান দাগা। দলমাদল সামনে পড়ে আছে। কোথাও এতটুকু মরচে নেই। যাহা অন্তঃপুরে থাকে তাহা কি এত বিস্ময়কর ভাবে শুভ্র হইয়া থাকে! বালক, প্রশ্নের উত্তর তোমার চক্ষুর সম্মুখেই প্রসারিত। লুকাইয়া, লম্পট জমিদারপুত্রের ন্যায় দেখিয়ো না। মহাবীরের মতো হুপ করিয়া লাফাইয়া সামনে গিয়া পড়ো। পাপ পুণ্য হইয়া যাইবে। শৃগাল সিংহের বলপ্রাপ্ত হইবে। বলদা, মোক্ষদা, মায়া, অষ্টপাশ ছিন্ন করিয়া দেবকার্য করিতেছে। তুমি বহুবার পাঠ করিয়াছ, দেবকার্য লজ্জা, ঘৃণা, ভয় তিন থাকিতে নয়।
বয়স্ক পুরুষদের দেখেছি অন্তঃপুরে ঢোকার সময় গলায় এক ধরনের শব্দ করেন, যা কাশিও নয়, চাপা হাঁচিও নয়। ছোট মাছের কাঁটা গলায় বিধে গেলে আমরা ওইরকম শব্দ করি। সঙ্গে সঙ্গে মহিলারা সচেতন হয়ে বক্ষদেশে আঁচল তুলে দেন। কাপড় গুছিয়ে নেন। ব্যতিক্রম স্থূলাঙ্গী মহিলারা। মেদ বিপরীত লিঙ্গিদের কেমন যেন উদম, উদাস করে রাখে।
গলার শব্দে মায়া সচেতন হল না। চেনা মানুষ আর ছাগলে তেমন উনিশ-বিশ নেই বলেই মনে হয়। সলতে পাক খেয়ে উপদখণ্ডের ছায়ায়, সুন্দরী এ কী করলে বলে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ছে। মুখ হয়ে উঠেছে মেঘৈমেদুরম্বরং-এর মতো। একেই কি বলে, কশ্চিৎ কান্তাবিরহগুরুণা!
আমি এলুম।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
রামগডুরের ছানার মতো, রামলীলার প্যান্ট পরা, খড়ের সোঁটা ন্যাজ ওঁচানো হনুমানের মতো, অশোককাননে নির্বাসিতা সীতার সামনে শিশি হাতে দণ্ডবৎ। বসতে বলছে না। অভিমান হয়েছে। হাম্বীর রাগে মাতুলের শেখানো সেই সংগীতের দু’চরণ গাইব নাকি, জানি না মানিনী, তড়াক, সম-এ এসে পড়লুম, কেন এ অভিমান, ফাঁক। তেটে ধিন ধিন তা, কৎ ধাগেনাগে, ধাগেনাগে, ধেরে কেটে, মেরে ধরে। জানি না মানিনী।
বসতে পারো।
বসতে তো পারি। বসার লোভে প্রাণ মৎস্যাশী হুলোর মতো ছোঁক ঘেঁক করছে। উচিত হবে কি। মায়া যে বিধাতার উদ্যানের প্রথম আপেলে এখনও কামড় লাগায়নি। যে-ভঙ্গিতে ছিল সেই ভঙ্গিতেই বসে আছে। তা ছাড়া এমন একটি কর্ম করে বসল যাতে হৃদয় হোঁচট খায়। এক ফোঁটা তেল দিয়ে মসৃণ ত্বককে মেজে ঘষে পলতে-বিলাসী করে ফেলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ভয়ে ভয়ে যতটা সম্ভব দূরে বসলুম। বসতে-না বসতেই কাঁঠালতলার ছাগলটা ব্যাঅ্যা করে ডেকে জানিয়ে দিলে, তুমিও এক বলির পাঁটা। ব্যাটা জ্ঞানপাপী হাজার বার পড়েছিস, পঞ্চভূতের ফাঁদে পড়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ কাঁদে। পৃথিবীটা যদি আমাদের দু’জনের হত, তা হলে কথা ছিল না। হঠাৎ যদি সন্ন্যাসিনী পিসি ডোবার ধার থেকে চ্যালা কাঠ হাতে তেড়ে আসেন। মানুষের মুখে পাপের ছায়া ইংরেজি সিক্সও ক্লক শেডের মতো ঘনিয়ে আসে। বোঝা যায় সুবোধ বালক মনে মনে পাঁয়তাড়া কষছে।
এই যে তোমার কালি।
ফেলে দাও।
শুধু শুধু রাগ করছ। জানো আমার কী হয়েছিল! অসুখে কাত হয়ে বিছানায় পড়েছিলুম তিন দিন। একবার খবর নিয়েছিলে?
তোমার খবর নেবার উপায় আমার আছে? তুমি না এলে জানব কী করে?
তা অবশ্য ঠিক। মা কোথায়?
ছেলে কম সেয়ানা নয়। মা শব্দটি এমন মিঠে করে উচ্চারণ করলুম, যেন আমার মা। দেখতে না পেয়ে গলা শুকিয়ে গেছে! ওঁয়া ওঁয়া করে উঠল বলে! আসলে ভয়ে মরছি। এ বাড়ির শাসন, অনুশাসন কোনওটাই তেমন জানা নেই। মায়া বললে, পিসিমা আর দিদি হালিশহর গেছে, ফিরতে রাত হবে।
ভেতরে ব্যাং লাফাল। একা। আমরা দু’জন। মনের কোণে কে যেন হালুম করে উঠল। আমি নই। আমি যে পবিত্র গঙ্গার জল। পাপ ধোয়া তুলসী পাতা। মায়ার সলতে পাকানো শেষ হয়ে গেল। পা ঢেকে বললে, তোমার মুখটা খুব শুকিয়ে গেছে। আমার কাছে দিন কতক থাকলে দুধ খাইয়ে মোটা করে দিতুম।
কীসের দুধ?
ফস করে বেরিয়ে গেছে। জিভ কাটলুম। মায়া কিছুই মনে করেনি। এ হল চরিত্রের ওপর সুখেনের প্রভাব! পিতা ঠিকই বলেন, সঙ্গদোষেই ভুজঙ্গ! প্রশ্নটা তেমন নিরীহ নয়।
[ওহে বর্ণচোরা আম! বেশি অশ্লীলতা করলে কান ধরে উপন্যাস থেকে বার করে দোব। বেশ পেকেছ। মনটাকে মানুষ করো। অবাক হবার কিছু নেই। এ কণ্ঠস্বর আমার। রাশ আলগা হয়েছে ভেবে কাটা ঘুড়ির মতো চেত্তা খেয়ো না, টানতে কতক্ষণ। জীবন একটা আধার। ধরলে অমৃত ধরা যায়, আবার বিষপাত্র হয়ে মৃত্যুকেও ডেকে আনা যায়। তুমি অমৃতের পুত্র হবে, না পুতনার স্তন! মনে মনে তিনবার বীজমন্ত্র জপ করে নাও। জিহ্বা শুদ্ধ হোক।
Truth never come where lust
and fame and greed
of gain reside. No man who
thinks of woman
As his wife can ever perfect be
Nor he who owns however little
nor he
Whom anger chains can ever pass
through Maya’s gates
so give these up, Sannyasm bold
Say Om Sat Om.
সন্ন্যাসীর গীত তোমাকে শুনিয়ে দিলুম। এই মায়া, আর ওই মায়ায় বিশেষ তফাত নেই। তা হলে আরও শোনো, আমেরিকায় তাহার প্রলোভন কম হয় নাই। কাহার? স্বামী বিবেকানন্দের। তুমি অবশ্য তাহার একগাছা কেশেরও যোগ্য নহ। একে জগদব্যাপী প্রতিষ্ঠা; তাহাতে সর্বদাই পরমাসুন্দরী উচ্চবংশীয়া সুশিক্ষিত মহিলাগণ আসিয়া আলাপ ও সেবা করিতেন। তাঁহার এত মোহিনী শক্তি যে, তাহাদের মধ্যে অনেকে তাহাকে বিবাহ করিতে চাহিতেন। একজন অতি ধনাচ্যের কন্যা সত্য সত্য একদিন আসিয়া তাহাকে বলিয়াছিলেন, স্বামী! আমার সর্বস্ব ও আমাকে আপনাকে সমর্পণ করিলাম। স্বামী তদুত্তরে বলিলেন, ‘ভদ্রে! আমি সন্ন্যাসী। আমার বিবাহ করিতে নাই। সকল স্ত্রীলোক আমার মাতৃস্বরূপা!’ তুই হলে কী করতিস ব্যাটা! তেত্রিশটা বউ নিয়ে লোটাকম্বল ফেলে, ন্যাজেগোবরে হয়ে বসে থাকতিস স্বামী পিনখাড়ানন্দ।]
মায়ার লম্বা ডান হাত আমার মুখের দিকে এগিয়ে আসছে। সরু সরু আঙুল। ওপর হাতে লাল সুতো দিয়ে একটা তাবিজ বাঁধা। ওই সর্বনেশে হাত আমার আমসির মতো গাল টিপতে আসছে। ওম তৎসৎ, ওম তৎসৎ! দু’আঙুল দিয়ে নীচে থেকে টিপে ধরেছে। আহা! আমার গালে যদি একটু মানুষের মতো মাংস থাকত! তত্ত্বজ্ঞান না, বৈরাগ্য নয়, পোয়াটাক মাংস দু’গালে।
তোমাকে আমি খাঁটি গোরুর দুধের সিন্নি খাইয়ে খাইয়ে ইয়া মোটা করে দিতুম। আহা রে! শাসনে শাসনে ছেলেটা আমার শুকিয়ে গেল।
চুলের ঝুটি ধরে কোলের দিকে টানছে। ওম তৎসৎ, ওম তৎসৎ। প্ল্যাটফর্ম এগিয়ে আসার মতো কোল এগিয়ে আসছে। মায়ার দরজা পার করে দাও প্রভু।
বাঘিনি বাঘ নিয়ে খেলে
সিংহ নতজানু বিশেষ সময়ে
শৃগালের হাহা হাসি
হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া, ক্যা হুয়া, কেয়া হুয়া ॥
আমি জানি, এখন কী হবে! মায়ার আবেগ বড় সাংঘাতিক! বারকয়েক ওই আটচালায় তার প্রমাণ মিলে গেছে। অপত্যস্নেহে কোলে ফেলে তাল চটকান চটকাতে থাকবে। সারাশরীর কাঁপতে থাকবে। দেহের অনাবৃত অংশ ঘর্মাক্ত হবে। কেবল বলবে, দুষ্টু দুষ্টু, চটকে শেষ করে দেব। সুখেন, বাঁচা। দৈহিক নয়, বড় নৈতিক যন্ত্রণা। আমার ধর্ম গেল। সতীত্ব গেল। ধ্যার মূর্খ। শাক্ত থেকে বৈষ্ণব হয়ে যা, মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল, বোল হরি বোল, বোল হরি বোল ॥
রূপসির কালো ওড়নার মতো সন্ধ্যা ঘিরে আসছে। লোম উসকোখুসকো দুটো কুকুরের মতো মায়া আর আমি পাশাপাশি বসে আছি। খুব একচোট হয়ে গেল। কী থেকে যে কী হয়ে যায়! মনের কাঁধে পা ঝুলিয়ে আর একটা কী বসে আছে! সে যে দৃষ্টি এড়ায়, পালিয়ে বেড়ায়, যায় না তারে ধরা।
মায়া ঘর থেকে একটা আধ-ভাঙা টিনের বাক্স নিয়ে এল। সাজের সাজসরঞ্জাম। দাঁড়া-ভাঙা চিরুনি। চুল বাঁধার ফিতে। সোনালি টিপ, কাঁচপোকার ডানা কাটা। চিরুনি হাতে নিয়ে মায়া আমার সামনে মাটিতে দু’হাঁটু ফেলে খাড়া হয়ে বসে, বুকের দিকে মাথাটা টেনে নিয়ে ঘাড়ের দিকের চুলে চিরুনি চালাতে লাগল।
চুল নয় তো, জটেবুড়ির জটা। কী করে রেখেছ মাথাটা। দেখি মাথা তোলো।
সামনে ঝুঁকিয়ে, পেছনে হেলিয়ে, পাশে ফিরিয়ে মায়া আমার চুল ঠিক করতে লাগল। গোল হাতে বাঁধা তাবিজের লাল সুতো সাপের মতো ঝুলছে। মাঝে মাঝে ছোবল মেরে যাচ্ছে। একটু বাসি তেলের গন্ধ, জলের গন্ধ, বুকের গন্ধ। সন্ধ্যা আসে ঘিরে। পাতায় বাতাস লেগেছে। পৃথিবীরও একটা মোহিনী আঁচল আছে। অদৃশ্য সব ফঁকফোকর থেকে সুখ নেমে আসে। মহাকাশের মহা অন্ধকারে মাথা তুলে আছে নির্জন পর্বতশ্রেণি। ফাটল চুঁইয়ে বেরিয়ে আসছে জলবিন্দু, ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুর মতো। জমে উঠছে টোপা টোপা মুক্তোর দানার মতো। সূর্যের আলোয় অশ্রু হয়ে উঠবে হীরকের হাসি। সবই অলক্ষে। কখন কোথায় কী হয়ে চলেছে এই বিরাট বিশ্বে কে আর নজর রাখছে।
মায়া কোল থেকে আঁচল তুলে নিয়ে তেলতেলে মুখটা মুছিয়ে দিতে দিতে বললে, তুমি অনেক দেরিতে বুড়ো হবে। আমি মরে যাবার অনেক পরে তুমি মরবে। এখনও একবারে কচি আছ। দেখি একটা কাঁচপোকার টিপ পরালে কেমন দেখায়?
ছোট্ট কৌটোয় ধুনোর আঠা। সেই আঠায় ঠেকিয়ে একটি টিপ ভুরুর মাঝখানে প্রথম আঙুলের চাপ দিয়ে পরাতে পরাতে বললে, তুমি আমার কে বলো তো!
এ বড় শক্ত প্রশ্ন! এই পৃথিবীতে কে যে কার। যার কেহ নাই, তুমি আছ তার। এই তো হালফিল যে ঘটনা ঘটে গেল পাড়ায়! হারু আর হারুর মা হারুর বাবাকে ঘাড় ধরে বাড়ির বার করে দিলে। বুড়ো ভাল দেখে না, কানে ভাল শোনে না। ঘষা কাঁচের ডাটি-ভাঙা চশমা চোখে। নাকের কাছে তুলো জড়ানো। বুড়ো কয়লার দোকানের পেছনে পড়ে রইল এক মাস। উঠতে পারে না, চলতে পারে না। দু’হাতে সেবা করে গেল কে? মেয়ে স্কুলের কর্মচারী মেনকাদি। বিয়ে করলে যে-কোনও রাজপুত্তুরকে বিয়ে করতে পারতেন। জীবন কাটাচ্ছেন আতুরের সেবায়। এক মাস সকাল বিকেল মেনকাদি জল, দুধবার্লি, কাঁথাকম্বল জোগালেন। বুড়ো দ্বিতীয়পক্ষের বউ প্রথমপক্ষের ছেলেকে রেখে একদিন শেষরাতে চলে গেলেন মহাযাত্রায়। কেউ এক ফোঁটা চোখের জল ফেলল না। মেনকাদি কেঁদে ভাসালেন। তবে? মায়া আমার কে? আমি মায়ার কে? কোথাও কোনও অদৃশ্য লিপিতে কি ভাগ্যবিধাতা লিখে রেখেছেন?
একটা ভাঙা আয়নায় পাকা বউয়ের মতো মুখ দেখতে দেখতে মায়া বললে, তোমার বাবার। তৈরি ব্রনর কোনও ওষুধ আছে?
বোরোফ্যাক্স আছে।
কাল একটু এনো তো।
ভাবতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কার ওষুধ কোন গালে এসে লাগবে? যদি একবার জানাজানি হয়ে যায়! ন্যাড়া করে মাথায় ঘোল ঢেলে, গাধার পিঠে উলটো করে বসিয়ে, ঢাক ঢোল ফেস্টুন সহকারে নগর প্রদক্ষিণ করাবেন।
কই বললে না তো তুমি আমার কে?
তুমি আমার ভৈরবী।
সে আবার কী?
আমার একটা পরিকল্পনা আছে মায়া। একদিন শেষরাতে তুমি আর আমি গৃহত্যাগ করব। আমার এই বড় বড় চুল। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। পরনে রক্তাম্বর। এক হাতে চিমটে, আর এক হাতে ত্রিশূল। পাশে তুমি আমার ভৈরবী। রুক্ষ, এলো চুল। লাল শাড়ি। কপালে এতখানি গোল সিঁদুরের টিপ। যেতে যেতে যেতে যেতে, কোনও এক মহাশ্মশানের পাশে দু’জনে ধুনি জ্বালিয়ে বসব। একটু একটু করে মহামায়াকে জয় করে সিদ্ধ সাধক হয়ে বসব। জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু সব আমাদের পায়ের তলায়।
তার মানে বউ!
ঠিক বউ নয়। সে কীরকম এক ধরনের ব্যাপার, তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। আমি নিজে বুঝে, তোমাকে বুঝিয়ে দেব।
ওসব সাধুটাধু হতে পারব না বাপু। আমার ভীষণ মাছের লোভ। চুনোমাছ বেশ সরষেবাটা আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে গরগরে ঝাল তৈরি করে একথালা গরমগরম ভাত। তারপর একখিলি পান। ডুরে শাড়ি। ও গেরুয়া মেরুয়া সব ভণ্ডামি। চটকলে অনেক লোক নেবে শুনলুম। চেষ্টা করে দেখো না। তা হলে বেশ পালানো যায়!
কী বলে রে? আমি কার ছেলে? কত বড় আমাদের বংশ। ইচ্ছে করলে আমি কী না হতে পারি! ওকালত, কালোয়াত। ইচ্ছে করি না তাই! নাবালিকা। লঘুগুরু-জ্ঞানশূন্য।
উঠে পড়ি বাবা! সন্ধেটন্ধে দিতে হবে।
টিনের বাক্স হাতে মায়া ঘরের দিকে চলেছে। আঁচল লুটোচ্ছে মাটিতে। শাড়ি একটু উঁচু করে পরা। কত পাপ যে করেছি! লুকিয়ে লুকিয়ে বিদ্যাসুন্দর পড়েছি। তাকাতে গিয়ে যে সেই লাইনটাই মনে আসছে,
নিবিড় বিপুল চারু যুগল নিতম্ব।
কাম-পারাবার-পার-সার-অবলম্ব ॥
মন্দ মন্দ গমনে যদ্যপি বাঁকা চায়।
মনোভাব পরাভব লইয়া পলায় ॥
বাড়ি ফিরতেই কনক বললে, তুমি তো আচ্ছা। কথা আটকে গেল। তোমার কপালে ওটা কী?
মরেছে। সেই কাঁচপোকার টিপ। বৈষ্ণব পদাবলির সেই দৃশ্য। অভিসার শেষে রাধা ফিরছেন কুঞ্জ হতে। অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে। ঘুমে ঢুলুঢুলু আঁখি। কপাল থেকে চট করে টিপটা খুলে নিয়ে পাকা অভিনেতার মতো বললুম, কিছু লেগেছিল বোধহয়! ভাগ্যিস সময়টা সন্ধে। নয়তো ধরা পড়ে যেতুম।
মেসোমশাই ডাকছেন, কনক, কনক। সন্ধে হল।
আসি বাবা। কনক যেতে যেতে বললে, তাড়াতাড়ি হাত পা ধুয়ে এসো। প্রার্থনায় বসতে হবে।
সে আবার কী? সে তো বহুকাল আগের কথা! অস্পষ্ট স্মৃতি। সকালে হাত জোড় করিয়ে হাঁটু মুড়ে বসিয়ে এক নারীমূর্তি আমাকে প্রার্থনা করাচ্ছেন,
সকালে উঠিয়া আমি মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।৷
তিনি হয়তো আমার মা ছিলেন কিংবা জ্যাঠাইমা। এই ছাড়া-গোরুকে কে আবার গোয়ালে তুলতে চায়! সাঁঝাল দিতে চায়। সব তো চুকেবুকে গেছে। আমার মনে যে বড় বেদনা! আমার যে কেউ কোথাও নেই। আমি ঈশ্বরকেই চাই, তবে পুরুষের বেশে নয়। নারীর বেশে। যত মত তত পথ। তুমি আমার প্রেমিকা হয়ে এসো।
তোমার দিন কি এইভাবেই কাটে পিন্টু! মেসোমশাই সামনে দাঁড়িয়ে। তুমি কি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছ?
আজ্ঞে না! এই একটু লাইন চেঞ্জের সময় তো!
তার মানে? তুমি রেলগাড়ি, না কলকাতার ট্রামগাড়ি! দুপুরবেলা বন্ধুবান্ধব নিয়ে হইহল্লা করছ। সন্ধে উতরে যাবার পর বাড়ি ফিরছ!হরিদা সারাদিন অফিসে থাকেন। ব্যাপারটা তাঁকে জানাতে হচ্ছে!
ডাক্তারবাবু বিকেলে আমাকে একটু বেড়াতেই বলেছেন।
ফাজিল ছেলেদের মতো মুখে মুখে তর্ক কোরো না। যাও ঠাকুরঘরে যাও।
প্রদীপের শিখা স্থির। ডগার দিক মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। গরদের কাপড় পরে মেসোমশাই আসনে বসেছেন। ধূপের ধোঁয়া উঠছে পাকিয়ে পাকিয়ে। পেছনে আমরা তিনজন। সামনে পেতলের ওঁ-এর মধ্যে রাধাকৃষ্ণ দাঁড়িয়ে আছেন। পটে মা লক্ষ্মী। মায়ের হাতে লাগানো সিদুরের দাগ এখনও লেগে আছে। নিস্তব্ধ। দূরে, বহুদূরে কোনও মন্দিরে আরতির ঘণ্টা বাজছে। প্রদীপের শিখা মাঝে মাঝে ফটফট করে উঠছে।
হঠাৎ আমরা সংগীতে ভেঙে পড়লুম, ভবসাগর তারণ কারণ হে, গুরুদেব দয়া করো দীন জনে। সুর ঢেউয়ের মতো একবার করে উঠছে, একবার করে পড়ছে। মন বলছে, ঈশ্বর, মেসোটি যেন রাতে ভিমরুলের চাকে খোঁচা না মারেন!