১১-১৫. স্বামীর বাড়িতে বিশেষ সতর্কতা
একাদশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম : প্রিয় বন্ধু, স্বামীর বাড়িতে একটা বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা চাই।
হালিমা : সেটি কী?
কুলসুম : বাহুল্য ব্যয় করা যাবে না।
হালিমা : স্বামী যখন সংসারের ব্যয় নিজ হাতে করেন, তখন আর ব্যয় বাহুল্যের ভয় কী?
কুলসুম : স্বামী বাইরে থেকে যে জিনিস-পত্র নিয়ে আসবেন, তা দেখে শুনে খরচ করলে যে জিনিসে স্বামীর অবস্থা ভালো হলেও খরচ সম্বন্ধে বেপরোয়া হতে নেই। হিসাব করে খরচ করলে যে জিনিসে দুদিন চলতো সেই জিনিসেই তিন দিন চলবে। ভালো গৃহিণীর হাতে অল্প টাকাতে সংসার বিনা কষ্টে চলে। পরিবারে অন্য সকলে বেহিসেবী হতে পারে, গৃহিণী বেহিসেবী হলে বড়ই বিপদের কথা। তেল, লবণ, একটা মরিচ, একটা পেঁয়াজ বা নগণ্য দুই ফোঁটা কেরোসিন তেল নষ্ট হলে কি ক্ষতি, এ কখনোও ভেবো না। আমাদের মহানবীকে অনুকরণ করা সকল মুসলমান নারীর উচিত। তিনি পরিত্যক্ত বাতির পলতে টিপে তেল বের করতেন। স্বামী বাইর থেকে জিনিসপত্র কিনে আনতে পারেন, সেগুলি কীভাবে খরচ হবে তার হিসাব তিনি রাখেন না। সে হিসাব গৃহিণীর কাছে।
হালিমা : বাড়িতে কী প্রকারে খাবার জিনিসপত্র ব্যয় করতে হয়?
কুলসুম : সকাল বেলা উঠে সকলের কিছু নাস্তা চাই (দরিদ্র পরিবারে এজন্য বিশেষ কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় না, সুতরাং খরচও নাই)। মুড়ি, বিস্কুট, পাউরুটি, মোহনভোগ, চিড়ে, কলা, গুড়, চিনি, মিছরি, টাটকা দুধ বা বাসি দুধ সাধারণত নাস্তারূপে ব্যবহার করা যায়। সকালে ছেলেরা ঠাণ্ডা ভাতও খেয়ে থাকে-নাস্তার সুবিধা করতে পারলে বাসি ভাত
খাওয়াই ভালো। সকাল বেলায় ছেলেদের এই ভাত খাবার দৌরাত্মে কাজের ঝঞ্ঝাট বড় বেড়ে ওঠে। মুড়ি, বিস্কুট, পাউরুটি, চিনি নাস্তার জন্য ব্যবহার করলে বেশ হিসাব করে খরচ করতে হবে। চিনি ছেলেপেলেরা একদিনেই দু-সের শেষ করতে পারে। অথচ হিসাব করে খরচ করলে আড়াই সের চিনিতে একমাস চলে। মুড়ি, বিস্কুট, একজায়গায় বসে একা অনেক খেয়ে ফেলা যায়–নিয়ম মতো ব্যবহার করলে দুজনের তা পনর দিন চলে। খাওয়া দাওয়ার একটা নিয়ম থাকা চাই-রাতদিন মুখে হাত বেঁধেই আছে–এ ভালো নয়। সবাইকে নিয়ম ও পরিমাণ মতো খাওয়াবে। নাস্তার জিনিসপাতি দেওয়ালের আলমারির ভিতর বন্ধ করে রাখতে হয়। কোনো কোনো মা নীচতা ভেবে ছেলেদের খাওয়া-দাওয়ার হিসেব রাখেন না-এতে অনেকখানি অসুবিধা হয়। ছেলেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সংসারের ব্যয়ের উপর কড়া নজর রাখতে হবে। সপ্তাহে বা মাসে একদিন কোনো ভালো জিনিস যত খুশি পেট ভরে খাওয়া যায়-রোজ এমন করলে ফকির হতে হয়।
হালিমা : নাস্তায় ঘি, ডিম ও রুটি ব্যবহার কর কেমন?
কুলসুম : এগুলি গুরুপাক, তা ছাড়া সকল পরিবারের সংগ্রহ করাও কঠিন। যত ভালো খাওয়া যায় তত ভালো–আবার আয় বুঝে ব্যয় না করলে শেষকালে মন্দ খাবারও জোটে না। রুটি তৈরী করে নেওয়া যায় সুতরাং বিশেষ কোনো অসুবিধা হয় না। প্রত্যহ ডবল ডবল চুলো ধরান অসুবিধা, একটা স্টোভ কিনলে কাজ চলতে পারে। স্টোভেও যে বিরক্তি নাই তা বলা যায় না–যে নাস্তার সঙ্গে চুলো ধরানোর সম্বন্ধ নাই সেইরূপ নাস্তা ব্যবহার করাই ভালো। ছেলেদের জন্য কতকগুলি রুটি তৈরি করে রাখলে মন্দ হয় না। বারে বারে ভাতের জন্য হাঁড়িতে হাত দেওয়া বিরক্তি কর। যখন ইচ্ছে তখনই তারা নিজ হাতে রুটি নিয়ে খেতে পারে। এতে এটো কম হয়, ছেলের ক্ষুধা হলেই খাবে।
হালিমা : ভাত কোন সময় খাওয়া উচিত? কুলসুম : যার যার সময় মতো, তবে তা প্রত্যহ এক সময় হওয়া উচিত। হালিমা : খাবার আয়োজন কেমন হবে?
কুলসুম : খাবার আয়োজন কেমন হবে, তা ঠিক করে বলা কঠিন। সাধ্যমতো খাওয়া ভালো করতে পারলে লাভ ছাড়া লোকসান নেই। কারো কারো ধারণা যা তা খেয়ে দিন। গুজরিয়ে দিতে পারলেই হল। আয় বেশি না হলে যা তা খেতে পারা যায়। হাতে যদি টাকা। থাকে তবে খাবার বেলা কৃপণতা করতে নেই। বাবুগিরি করে টাকা উড়িয়ে দিয়ে খাবার বেলা মাটি খাওয়া ঠিক নয়। সংসারের জন্য সব খরচ কমিয়ে খাবার ব্যবস্থা ভালো করতে পারলে তাই করবে। আয় না থাকলে পক্ষান্তরে খাওয়া কমাতে হবে সেইটাই মনুষ্যত্ব। দেনা শোধ না দিয়ে ভালো খাবারের ব্যবস্থা অভদ্রতা। বধূ বাপের বাড়িতে খুব খরচ করে এসেছেন বলেই স্বামীর বাড়িতে সেইভাবে চলতে হবে, এমন কোনো কথা হতে পারে না। মেয়েরা স্বামীর বাড়িকেই নিজের বাড়ি মনে করবেন। স্বামীর যেমন অবস্থা, তেমনি করে চলতে হবে। মাসে কতখানি তেল খরচ করতে হবে, তা স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া। উচিত। এতে অপমান বোধ করতে নেই। নিজের ইচ্ছামত রান্নার ব্যবস্থা করবে না। মাছ,মাংস,তরকারি একেবারে শেষ করতে হবে না, কয়বার চালাতে হবে, তা নরম ভাষায় ভদ্রতার সঙ্গে স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া উচিত। অবজ্ঞাপূর্ণ ভাষায় এ সব জিজ্ঞাসা করা ভালো না। কোনো জিনিস রান্না হলে বা বাইর হতে কোনো জিনিস এলে একবারেই সে-সব শেষ না করে দিতে চেষ্টা করবে। গৃহিণী সব নিজে খেয়ে ফেলেন এ বলছি না। ফল কথা, স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা করবে।
হালিমা : জিনিসপত্র কীভাবে খরচ করতে হবে তা জিজ্ঞাসা করায় মেয়ে মানুষের। বিরক্তি জন্মে না কি?
কুলসুম : অনেকে বিরক্ত হন, যেমন ইচ্ছা খরচ করে যান, তাতে স্বামী জেলে যাক, স্ত্রীর তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। স্বামীর প্রতি সহানুভূতি রাখা নারীর কর্তব্য। অনেক রমণী স্বামীর খরচপত্রের প্রতি বিদ্রূপবাণ বর্ষণ করেন–এমন করতে নাই। এতে স্বামী বড় আঘাত পান।
হালিমা : গৃহিণীরা ইচ্ছামত রান্না করেন নাকি?
কুলসুম : অনেক মহিলা স্বামীর কোনো জিনিস খেতে যদি বিরক্তি হয় তবে গৃহিণীর নিজের কাছে যা ভালো লাগে তিনি তাই রান্না করেন। মন যাদের বড় তারা নিজের সুখের চেয়ে পরের সুখের দিকে দৃষ্টি রাখেন। পরকে খাইয়ে যেমন সুখ লাগে, নিজে খেয়ে কি তেমন সুখ লাগে?
হালিমা : তা তো ঠিক। আচ্ছা, পরিবারের মধ্যে তৈরি জিনিস কাকে কতটুকু দেওয়া হবে?
কুলসুম : এক পরিবারে বহু লোক থাকলে তৈরি জিনিস দেওয়া নিয়ে একটু বিপন্ন হতে হয়। বহুলোক একসঙ্গে না থাকাই আমার কাছে ভালো লাগে। একসঙ্গে থাকলে পরিবারের অনেকে মনে করে তাদের উপর গৃহিণীর অত্যাচার হচ্ছে। সুতরাং ভিন্ন ভিন্ন। হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবার সৃষ্টি করাই ভালো, এতে মেয়েদের কাজ কমে, পরিবারে সকলে আত্মনির্ভরশীল হয়ে গেলে কুড়ের মতো বসে না থেকে সকলে নতুন নতুন উপায়ের পন্থা অবলম্বন করেন।
হালিমা : কাজকর্মের সুবিধা হয়, অনেক ঝগড়া অশান্তির হাত থেকেও অব্যাহতি পাওয়া যায়। কিন্তু যেন কেমন লাগে! ভাগ ভাগ হয়ে যাওয়া–এর ভেতর যেমন। অনেকখানি নিষ্ঠুরতা আছে। যার যার মতো সেই সেই-কেউ কারো দিকে ফিরে তাকাবে না–কেমন কথা!
কুলসুম : এতে নিষ্ঠুরতার কিছুই নেই–ভিন্ন ভিন্ন হয়েও একজন অন্যজনের সহায়তা করতে পারেন। না করলে ভয়ানক অন্যায় হবে। কাজের সুবিধার জন্য স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র খাবার। ব্যবস্থা ছাড়া এ আর কি, ভাগ হয়ে গেলে মানুষের চৈতন্য হয়। কুঁড়েমি করে উদাসীনতা দ্বারা জীবনকে হীন করে দেবার লোভ দূর করে। পরের ঘাড়ে চড়ে খাওয়া আর একটু শুকিয়ে মরা নিজের কাছে বিরক্তিকর ও অন্যায়। বিলাতে ছেলেমেয়ের বিয়ে হলেই স্বতন্ত্র ব্যবস্থা বা পরিবারের সৃষ্টি হয়। আমরা অতদূর যেতেই পারি না। মা-বাপকে ছেড়ে নতুন ব্যবস্থা করা আমরা অধর্ম মনে করি। এদেশের মাতা-পিতা ছেলেপিলেকে লেখাপড়া শিখান, ভবিষ্যৎ জীবনে ছেলেদের সম্মান ও সুখের অংশী হবার জন্যে। উন্নত দেশে বাপেরা ছেলেকে সংসারে প্রতিষ্ঠিত হলে তারা সুখী হন–অধিক চান না। তাঁরা খাবার বা সম্মানের লোভ করেন না। কারণ তারা বড় মানুষ।
হালিমা : তৈরি জিনিস কাকে কতটুকু দিতে হবে?
কুলসুম : তার একটা বাধাধরা নিয়ম নেই। ছেলেরা বারে বারে চায় সুতরাং তাদের অল্প অল্প করেই দিতে হবে। গৃহিণী যাকে যা দেওয়া ঠিক মনে করেন, তাই দেবেন, এ সম্বন্ধে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম বলে দেওয়া যায় না। পরিবারের কর্তা যিনি, তিনি নিজে ইচ্ছা করে বেশি খেতে ন চাইলেও তার খাওয়া-দাওয়ার দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা উচিত। সব দিয়ে নিজে কিছু খাবে না তাও ভালো নয়। স্বামী অনিচ্ছা প্রকাশ করলে তাকে অনুরোধ করে খাওয়াবে। অন্তরের ভালবাসা কাজে প্রকাশ করে দেখাবে। অন্তরে-ভালবাসা। আছে–বাইরে কোনো কাজে তার প্রকাশ নেই-এরূপ ভালবাসার কোনোই মূল্য নেই। অকৃত্রিম বন্ধু যিনি, তাকে খাওয়াতে হবে–উপহার দিতে হবে। পরম অত্মীয় বা পরম বন্ধুকে, সামান্য হলেও উপহার দিয়ে এবং খাইয়ে মায়ার পরিচয় দিতে হবে।
হালিমা : অনেক বাড়ি দেখেছি-ভাত তরকারি পচে যাচ্ছে–বাইরে পড়ে থাকে–কাক-কুকুরে খেয়ে যায়।
কুলসুম : আহ, এ বড় অন্যায়-বড় গোনাহ্। ভাত তরকারি কখনও ফেলে দেবে না। নিজেরা না খেতে পার–যত্ন করে তুলে রেখে কোনো দরিদ্রকে দিয়ে দেবে। বস্তা বস্তা ভাত তরাকরি পচান-বড় অন্যায়। হিসাব করে রান্না করলে ভাত নষ্ট হতে পারে না। বাসি তরকারি ফেলে না দিয়ে গরম করে ব্যবহার করা যায়। শরীর খারাপ হবার সম্ভাবনা। হলে বাসি না খাওয়াই উচিত। ডাল, তরকারি পেয়ালা ছাড়া ভাতের উপর দিতে নেই, যাকে যতটুকু দেওয়া দরকার একবার দিয়ে বলে দেবে–এই শেষ। যে খায় তার মুখে অনবরত এ দাও, আর একটু চাই,-এ-সব ভালো নয়। যত পাওয়া যায় ততই খেতে ইচ্ছা হয়। প্রত্যেক কাজেই সীমা বা সংযম রক্ষা করতে হবে-সংযমই সুখ-শান্তির মূল।
হালিমা : ধান চালের বিনিময়ে জিনিসপত্র কেনা কি ভালো?
কুলসুম : সর্বনাশ, অমন কাজ করতে নেই! জুয়াচোর ফেরিওয়ালারা মূর্খ মেয়েদের কাছ থেকে চাল-ধান বা অন্যান্য দ্রব্য দিয়ে জিনিসের চতুগুণ দাম আদায় করে।
হালিমা : আবশ্যক না থাকলেও হাতে পয়সা থাকলে সস্তা পেলে কোনো জিনিস দেখলে, কোনো ভালো নয় কি?
কুলসুম : বড় খারাপ। মনে কর মাছ দরকার নেই, কেউ মাছ নিয়ে বাড়িতে হাজির হল। তুমি মাছ দেখে লোভ সংবরণ করতে না পেরে বললে মাছ দাও, নেবো। মিঠাইওয়ালা এসে হাজির হল–তুমি আর ঠিক থাকতে পারলে না–হাতে পয়সা আছে কিনা সে জ্ঞানও নেই, কিনে ফেললে দুই সের; এক চতুর মনোহরী দ্রব্য বিক্রেতা কতগুলি মনভুলানো জিনিসপত্র এনে তোমাকে সহজেই ভুলিয়ে ফেলতে পারে। সংসারের কত্রী হচ্ছেন গৃহিণী। যদি খরচপত্র সম্বন্ধে বেহিসাবী হন, তা হলে পরিবারের উন্নতি হয় না। বেহিসাবী গৃহিণীদের দোষে অনেক পরিবারের বড় শোচনীয় অবস্থা হয়।
হালিমা : ছেলেদের বা নিজের কখানা কাপড় থাকা দরকার?
কুলসুম : এ সম্বন্ধে ঠিক করে কিছু বলা কঠিন। অনেক কাপড় থাকা অন্যায়, এ আমি বলি না। অনেক মেয়ে আছে তারা প্রচুর কাপড় কেনে কিন্তু ব্যবহার করে না–নতুন নতুন কয়েকদিন ব্যবহার করে তারপর হয়ত শুধু শুধু বাক্সবন্দি করে রাখে! দরিদ্র স্বামীর পয়সা অপব্যবহারে তাদের একটুও কষ্ট হয় না। মূর্খ যেমন, তার মনে না আছে দয়া-না আছে তার হিসাব। ছেলের অনেক কাপড় আছে, তবুও গৃহিণী অনেক সময় হুকুম দেয়, আরো কাপড় চাই। কোনো কোনো মেয়েকে দেখেছি, তারা গায়ের জামা, সেমিজ এবং দামি শাড়ি দিয়ে থোকার বিছানা রচনা করেন। কখনও সেগুলি দিয়ে পা মুখ মোছা হয়। কী বিড়ম্বনা!
হালিমা : আশ্চর্য!
কুলসুম : লেখাপড়া না জানলে মানুষের কত যে মতিভ্রম হয় তার কি ইয়ত্তা আছে? জ্ঞান ব্যতীত মানুষ অসভ্য হয়। বাপ-মা মেয়েদের লেখাপড়া শিখান না, ফলে মেয়েরা পুরুষ সমাজের দুঃখ বাড়িয়ে দেয়। দুই-একটা মেয়ে আপনা-আপনি গুরুজনের মৌখিক শিক্ষা ও তাড়নার ফলে কিছু সভ্য হয় কিন্তু কয়েকটা মেয়ে তো আর বঙ্গের ঘরে ঘরে যেতে পারে না।
হালিমা : লেখাপড়া শিখলে প্রত্যেক কাজে বিবেচনা আসে–কী করতে হবে, কীভাবে চলতে হবে, ঠিক করে নেওয়া যায়।
কুলসুম : সব কাজে হিসাবের পরিচয় দিতে হবে যেমন আয় ঠিক তেমনি ব্যয় করা চাই। বিয়ে করে পুরুষ স্ত্রীর দাস হয় না, তার প্রতি স্ত্রীর সহানুভূতি থাকা আবশ্যক। নইলে স্ত্রীর জীবেনের সার্থকতা কী? পুরুষ গোল্লায় যাক, তাতে আমার কি-এরূপ চিন্তা করে রমণীর মনে স্থান দেওয়া ঠিক নয়! জিহ্বাকে প্রশ্রয় দাও, যখন যা মনে সে তাই কর, সংসারের ব্যয় সম্বন্ধে কোনো হিসাব রাখো না–এতে জীবনে দুঃখ বাড়বে বই কমবে না, সংসার রসাতলে যাবে। মাথায় কোনো ব্যারাম নেই তুবু শিশি শিশি গন্ধতেল কেনা কি দরকার? এত পয়সা আয়ের পথ কোথায়? অবশ্য সখ করে মাসের মধ্যে দু-একদিন ব্যবহার করা যেতে পারে স্ত্রীর বেহিসাবী চালচলনের জন্য স্বামীকে একজন আস্ত চোর হতে হয়। অনেক নারী আছেন যারা নিজের গয়না ও খরচের সুবিধের জন্যে প্রকারান্তরে স্বামীকে অত্যাচারী ও ঘুষখোর হতে উৎসাহ দেন। হিসেব মতো জিনিসপত্র করলে সংসারে দুঃখ প্রবেশ করে না। ঘরের জিনিস আছে-ফুরিয়ে গেলে ভারে ভারে আবার আসবে–অতএব ভয় কি-দেদার খরচ কর, ফেলে দাও-কাক-কুকুরে খেয়ে যাক–যে মেয়ে এইরূপ কাজ আরম্ভ করেন তিনি বড় অবোধ-অল্প দিনেই তিনি দুঃখে পড়েন।
হালিমা : নিশ্চয়ই।
কুলসুম : অনেক বাড়িতে পান, চুন ও সুপারির কী অবস্থা হয় জান?
হালিমা : না।
কুলসুম : গৃহিণীর সম্মুখে পান পচে, চুন শুকিয়ে যায় ও সুপারি গড়িয়ে বাইরে পড়তে থাকে, কেউ দেখে না।
হালিমা : গৃহিণী বুঝি পান খান না।
কুলসুম : ফরমাইস করলেই যখন নতুন আসে, তখন আর এতে চিন্তার কারণ কী?
হালিমা : আশ্চর্য কথা!
কুলসুম : আরো শোন–অনেক বাড়িতে সারারাত্রি বাতি জ্বলতে থাকে, গৃহিণী তা গ্রাহ্য করেন না। বৃথা তেল পোড়ান কী ভালো?
হালিমা : না, তাতে খরচ বাড়ে।
কুলসুম : নির্জন কামরায়–স্বামী-স্ত্রী ছাড়া যেখানে আর কেউ থাকে না–সেখানে রাত্রিকালে একটি ক্ষীণ প্রদীপ জ্বলতে থাকলে বিশেষ ক্ষতি নেই।
হালিমা : গ্রামে সেইরূপ হওয়া উচিত নয়।
কুলসুম : যে পরিবারে স্বামী স্ত্রীর সম্মানের প্রতি কারো বিশেষ লক্ষ্য নেই–সেখানে ভয় করেই চলতে হবে।
হালিমা : এটা বড় বিরক্তিকর।
কুলসুম হাসিয়া কহিলেন–মেয়েদের আর একটা অভ্যাস আছে তারা স্বামীকে সর্বদা পুরানো গয়না ভেঙ্গে নতুন রকমে গড়ে দেবার জন্য অনুরোধ করেন। নাকের ফুল, গলার হার, কানের মাকড়ি, হাতের বালা, কটির মেখলা যেমন করেই গড়ে দেওয়া হোক না–কিছুদিন ব্যবহার করে গৃহিণী স্বামীকে অনুরোধ করেন–এইরূপ নয় ঐ যে আমির মিঞার বিবির গায়ে যেরূপ দেখলাম, অমনধারা করে গড়ে দিতে হবে। কিছুদিন পরে আবার নতুন ফরমাইস হবে। বেচারা স্বামীকে জব্দ করা ছাড়া এ আর কি?
হালিমা : দাদীর একটা গায়ের কাপড় আছে, সেটা নাকি পনর বৎসর আগে কেনা হয়েছিল–কোনো দিন সেটা তিনি ব্যবহার করেন না। ব্যবহার যদি করা না হবে, তবে এইভাবে জিনিসপত্র কিনে পয়সা নষ্ট করে লাভ কী?
কুলসুম : কোনো লাভ নাই। মেয়েদের অভ্যাস, তারা জিনিসপত্র কিনবে, গয়না পরবে, কিন্তু ব্যবহার করবে না। বছরে এক বা দুই দিন তোক দেখানোর জন্য শাড়ী-গয়না পরা নীচতা। বাইরে সাত লোকের কাছে যত সাদাসিদে হয়ে বের হওয়া যায় ততই ভালো। শুধু লোককে দেখাবার জন্য পয়সা ব্যয় করা ঠিক নয়। অনেক মানুষ বিলাস উপকরণ যোগাড়ে পথের ফরিক হন–সম্মান চটকে বাড়ে না–সম্মান হয় জ্ঞানে, পবিত্রতায় ও মনের শান্তিতে। এ হতে আবার মনে করো না, শুধু সম্মানের জন্য মানুষকে জ্ঞানী ও পবিত্র হতে হবে। জ্ঞানী, চরিত্রবান ও নীতি-শক্তিতে বলীয়ান হলে সম্মান আপনি এসে জোটে।
হালিমা : চটক দেখাতে গিয়ে অনেকে ফকির হয় নাকি?
কুলসুম : গয়না পরে চটক দেখানোতে বিশেষ ভয়ের কারণ নেই। গয়নার পয়সা নষ্ট হয় না–ঘরেই থাকে। অনেকে স্ত্রীর গয়নাকে সম্পত্তির মধ্যে ধরেন। এইভাবে সম্পত্তি করার কোনো অর্থই নেই। স্ত্রীকে গয়না দিতে হবে না–এ আমি বলছি না। গয়নাকে সম্পত্তিরূপে মনে করা বোকামি।
হালিমা : গয়না পরে চমক দেখানোতে বিশেষ ভয় নেই কেন?
কুলসুম : না এতে ভয় নেই,তবে হরদম নতুন নতুন অলঙ্কার তৈরি হচ্ছে কেবল বাক্সে তুলে রাখবার জন্যে! গয়না তৈরির টাকা ব্যাঙ্কে রাখা হয় তবে তা দেশের ও দশের কাজে লাগে।
হালিমা : সব কাজেরই একটা সীমা আছে। যেগুলি মানায় এবং পরিমিত বলে মনে হয় এমন কতকগুলি গয়না গড়ালেই চলতে পারে।-কেমন?
কুলসুম : হ্যাঁ তাই কিরূপে চটক দেখাতে গিয়ে মানুষ ফকির হয় বলছি, শোন–সংসারে খাবার পরার দরকারই বেশি এই কথা ভুলে-ভবিষ্যতে খোদার ঘাড়ে সোপর্দ করে বোকার মতো অনেক মানুষ বাহুল্য ব্যয় করে। কাপড়ে-চোপড়ে, নাচে তামাসায়,বন্ধু মহলে অনেক নরনারী অজস্র টাকা ব্যয় করে সর্বস্বান্ত হয়। অবশ্য পয়সা থাকলে হিসেব মতো কাপড়-চোপড় বা কোমা-কালিয়া খাওয়া, তামাসা-উৎসবে বা বন্ধুমহলে ব্যয় করা দোষাবহ নয়; বিশেষ করে খাদ্য সম্বন্ধে ব্যয় যত বেশি সম্ভব তা করা উচিত। বলছি আয় বুঝে ব্যয় করতে হবে। অনেক নারী পরিবারের খাবার পরবার টাকা। কোথা হতে আসে কোন খবর রাখেন না। স্বামী যোগাড় করতে না পারলে স্ত্রী ভাবেন এটা স্বামীর চালাকি। ছেলেদের ছাতা, জামা, জুতা, নিজের গয়না, ময়দা, চিনি, লুচি, হালুয়া এবং মুরগীর ফরমাইস দেবার আগে বধূ যেন ভবিষ্যতের কথা ভাবেন, স্বামীর আয় সম্বন্ধে একটু হিসেব করে দেখেন!
.
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম কহিলেন–কার বাড়িতে কেমন রান্না হয়, গৃহিণী কত রকম খাদ্য ও আচার প্রস্তুত করতে পারেন, এই দেখে অনেক লোক পরিবারের কদর সম্বন্ধে ধারণা করে, এটা কিছু নয়। রান্নার মধ্যে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব খুঁজতে না যাওয়াই ভালো
হালিমা : তা ঠিক, রান্না করতে জানাই যদি মনুষ্যত্বের নিদর্শন হতো, তা হলে বাবুর্চির দলকে বেশি সম্মান করা কর্তব্য।
কুলসুম : কোনো কোনো মেয়ে অনেক রকম জিনিস তৈরি করতে জানে বলে লোকের কাছে গর্ব করেন। তাদের মন কত ছোট–তারা সংসার ও জ্ঞানের কোনো খবর রাখেন না, এজন্য লজ্জা বোধ করেন না। ভালো রান্না করতে পারা মেয়েদের এটা গুণ–তাই বলে এতে গৌরবের কিছু নেই।
হালিমা : আমার বোধ হয় অনেকে আজকাল কেবল খাবার চিন্তায় ব্যস্ত।
কুলসুম : কত রকম পেট ও জিহ্বার সেবা করা যায়, তার লিস্ট শুনলে হাসি পায়। জিহ্বা ও পেটের সেবা বেশি রকম আরম্ভ হয়–মানুষের যখন নৈতিক অধঃপতন হতে থাকে। মোটামুটি কয়েক রকম খাদ্য ব্যবহার করা যেতে পারে-তার বেশি একদম বাদ দেওয়া উচিত।
হালিমা : সে গুলি কী কী?
কুলসুম : ভাত, মাংস, ভাজি, এ তো সাধারণভালো খাবার বললে পোলাও, কোর্মা ক্ষীর, দুই একরকম মিষ্টান্ন-এর বেশি নয়।
হালিমা : রান্নার কাজ কে করবে! রান্না করলে কি সম্মান হানি হয়?
কুলসুম : রান্না করলে সম্মান হানি হয় না। দাস-দাসীর উপর ভর দিয়ে রান্নার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকা গৃহিণীর উচিত নয়। মন যাদের ছোট–যারা হীন স্বভাব, তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি বিশেষ নজর থাকে না। দাস-দাসীরা অশিক্ষিত নীচমনা–তাদের কাজ-কাম পরিষ্কার নয়। তাদের উপর যদি রান্নার ভার দেওয়া হয়, তা হলে অজ্ঞাতসারে তোমার পেটের ভিতর কত কি যাবে তা আর কি বলব। হীনা স্ত্রীলোক চাকরাণীকে মোটেই বিশ্বাস করতে নেই। পুরুষ খাসামাকেও বিশ্বাস করা উচিত নয়। শিক্ষিত বুদ্ধিমতী নারীর হাত ছাড়া অন্য কোনো রমণীর হাতের জিনিস খাওয়া ভালো নয়।
হালিমা : নওয়াব বাড়ির মেয়েরা কি নিজে রান্না করেন?
কুলসুম : অপদার্থ লোকেরা মনে করে, নওয়াব পরিবারের মতো মহাকুলীন আর কেউ নয়। আমি তাদের সঙ্গে মিশি নি–আমার মনে হয় নওয়াব পরিবারের কি পুরুষ, কি নারী, কারো মন উন্নত নয়। সেখানে মনুষ্যত্ব ও উচ্চচিন্তার বিশেষ আদর নেই। টাকার জোরে শান-শওকত রক্ষা করে তারা চলে–তাই দেখে মূর্খ লোকেরা ভয় পায়। নওয়াব বাড়ির মেয়েরা পান খায়, অলসের মতো পিকদানিতে থু থু ফেলে, বিছানায় বসেই হাত ধোয়। আমার বিশ্বাস তারা যেমন বোকা, তেমন সঙ্কীর্ণরূপে বেহিসেবী এবং অহঙ্কারী গাধার পিঠে জরির গদি যেমন, অশিক্ষিত নওয়াব নন্দিনী গায়ের গয়নাও তেমনি। নওয়াব বাড়ির মেয়েদের কথা বলো না, তারা সাধারণের কৃপার পাত্র।
হালিমা : রান্না মেটে হাঁড়িতে করা ভালো, না লোহা-তামার পাত্রে করা উচিত।
কুলসুম : মেটে হাঁড়ি আদৌ ব্যবহার করা উচিত নয়। গরিব লোক যারা তারা পয়সা জমিয়ে লোহা বা তামার দু-একখানা পাত্র ইচ্ছা করলে কিনতে পারে। যাদের হাতে দুপয়সা আছে, তাদের পক্ষে তো কথাই নেই। পানি ঠাণ্ডা রাখার জন্য কলসি রাখা যায়। পানি খাবার কলসি ছাড়া বাকি সব কলসিগুলি পিতলের হওয়া উচিত। মেটে হাঁড়ি-কলসি বছরে যে পয়সার কিনতে হয়, তার হিসেব রাখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। একটা পিলটার বোতল কিনলে খুব ভাল হয়, দাম বেশি নয়। একটা বোতল অনেক বছর চলে। ফিলটার বোতলে পানি ঠাণ্ডা ও পরিষ্কার দুই-ই হয়। পল্লী গ্রামের অপরিষ্কৃত পানিই অনেকের মৃত্যুর কারণ অথচ পল্লীবাসীরা একথা বিশ্বাস করে না। কলেরার সময় প্রত্যেক বাড়িতে এক একটা ফিলটারের বোতল থাকা চাইই-চাই। গরিবেরা অন্তত মেটে কলসির ফিলটার বানিয়ে নেবে।
হালিমা : শুনেছি মেড়োরা তেল খায় না, তেলের গন্ধ নাকি তারা সহ্য করতে পারে, কেবল ঘি খায়।
কুলসুম : ঘি যত ব্যবহার করা যায়, ততই ভালো। আজকালকার দিনে জিনিসপত্রে বড় ভেজাল আরম্ভ হয়েছে। কাউকে বিশ্বাস নেই; বাজারে ঘি. এর ভিতর মরা মানুষের চর্বি যে নেই, তা কে জানে? সাপের চর্বি যে নেই, তা কে জানে? চর্বি তো আছেই-গোয়ালাকেও বিশ্বাস নেই। সেদিন উমাচরণ গোয়ালা খানিকটা ঘি দিয়ে গিয়েছিল-তাতে এত দুর্গন্ধ যে আমি একেবারে বিস্মিত হয়ে গেলাম। প্রত্যেক পরিবারের দু-চারটি গাই পোষা উচিত। দুধ ও ঘি ছাড়া মানুষের শরীর ধ্বংস হয়ে যায়। বাঙালি সব কথা ভাবে, কিন্তু শরীরের কথা ভাবে না। রাতদিন পড়ে টাকা উপায় কর-সম্পত্তি বাড়াও, অবসর মতো দেশসেবা কর–সকলেই শুধু এই কথা বলে। শরীর রক্ষা কর এ কেউ বলে না। ভালো খাবার বা শরীর রক্ষা করার যে আবশ্যকতা এ কেউ জানে না। বাল্যে ভালো খাবার না পেলে শরীর ধ্বংস হয়ে যায়, সারা জীবন ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে থাকতে হয়। মেড়োরা। তেল ব্যবহার করে না। তার কারণ তারা মাছ খায় না। আমরা তেল ব্যবহার না করে পারি নে–এই সরিষার তেলেও ভেজাল আরম্ভ হয়েছে! জমিনে বেশি করে সরষে বপন করা। উচিত। কলুর বাড়ি থেকে সরষে ভাঙ্গিয়ে আনলে চমৎকার তেল পাওয়া যায়! বাজারের তেলে কোনো বিশ্বাস নেই। গোয়ালাকে দূর করে তাড়িয়ে দিয়ে ভদ্রলোকের ঘি তেলের ব্যবসা আরম্ভ করা উচিত। জাতির জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, এ বিষয়ে সকলেরই মনোযোগ দেওয়া উচিত। আমাদের খাবার উপকরণ, যা আমরা বাজার হতে সংগ্রহ করি–তা যদি শিক্ষিত ব্যবসায়ীর হাত থেকে পাবার সুবিধে পেতাম, তা হলে বড়ই ভালো হতো।
হালিমা : রান্না যাদি গৃহিণীকেই করতে হয়, তা হলে তাকে যে রাতদিনই ঐ কাজ করতে হবে, একটুও বিশ্রাম উপভোগ করবার উপায় থাকবে না। যে পরিবারে দশ-বারজন লোক, সে পরিবারের কাজের চাপ বড় বেশি, দাস-দাসী ছাড়া এক গৃহিণীর পক্ষে এতকাজ করা কি সম্ভব? কাজ করতে করতেই জান বেরিয়ে যাবে, স্বামীর সঙ্গে প্রণয় হবে কোন সময়? অবসন্ন ক্লান্ত শরীর ও মন নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হয় কি?
কুলসুম : যাদের ভালবাসি, যারা আমার অতি প্রিয়তম, তাদের জন্য কাজ করতে কোনো কষ্ট হয় না। স্বামীর প্রণয় চুম্বন, তাঁর প্রগাঢ় ভালবাসা নারীর হৃদয়ের সর্বদা শক্তি দান করে, কোনো কাজে স্ত্রীর কষ্ট হয় না। স্বামীরও কর্তব্য স্ত্রীর সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করা। নীচমনা দাসী না রাখাই ভালো, কিন্তু ছেলেপেলে হলে তাকে রাতদিন রাখার জন্যে-সামর্থে কুলায় এমন একটা চাকরাণী চাই। নইলে মায়ের জীবনে সুখ-শান্তি একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। রান্নার কাজে সাহায্য করবার জন্য একটা বালক ভৃত্য দরকার। জিনিসপত্র এগিয়ে দেওয়া, পানি ঢেলে দেওয়া, আবর্জনা জমা হওয়ামাত্র সেগুলি ফেলে দেওয়া, দোকান থেকে জিনিস আনা, মরিচ পেষা–এইসব কাজ সে করবে। শুধু রান্নাবান্নার কাজে সে সাহায্য করবে। একজনের দ্বারা যদি কাজের সুবিধা না হয়, তা হলে আরও একটা ছেলে চাকর রাখতে হবে। নিজের কোনো দরিদ্র আত্মীয় থাকলে তার দ্বারাও রান্না চলতে পারে।
হালিমা : রান্না স্টোভে করলে কেমন হয়?
কুলসুম : কোনো ক্ষতি নেই। দুই-একজনের রান্না স্টোভে চলতে পারে। যে স্টোভে কালি জমে তাতে রান্না চলে না। ভাত তরকারির জন্য না হোক দুধ ও চা তৈরির জন্য স্টোভ ব্যবহার করা সুবিধা।
.
এয়োদশ পরিচ্ছদ
হালিমা : ছোঁকরাদের দ্বারা সব কাজ কি সম্ভব? মেয়ে মানুষের চাকরাণী মেয়ে মানুষ হলেই তো সুবিধে হয়।
কুলসুম : দাসীদের দ্বারা পরিবারের মধ্যে অনেক কেলেঙ্কারি হয়। তা ছাড়া বড় নোংরা–তারা যে মানুষ এ জ্ঞানও তাদের নেই।
হালিমা : দেশে অনেক মেয়ে মানুষ আছে, পরের বাড়ি চাকরি পেলে তাদের অনেক উপকার হতে পারে।
কুলসুম : অনেক দরিদ্র মেয়ে মানুষ আছে সত্যি, কিন্তু তাই বলে নোংরা চোর মেয়ে মানুষকে কী করে বাড়িতে স্থান দেওয়া যায়? ভালো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মেয়ে পেলে আপত্তি নেই।
হালিমা : দাসীদের মাইনে অনেক জায়গায় মাত্র ৩ টাকা। শুনলে হাসি পায়।
কুলসুম : দরিদ্র দেশে সবই আশ্চর্য। অভাবে মানুষ হীন ও দুর্মতি হয়ে ওঠে। সকলেরই অভাব, দয়া মায়া ও মনুষ্যত্ব একদম দেশ থেকে উঠে যাচ্ছে। সমবেত জাতির কম আয়, কারণ দেশে শিল্প বাণিজ্যের অভাব। একমাত্র ধান ও পাটের টাকা থেকে জীবনের শত অভাব ও বিশাল উপকরণ সংগৃহীত হচ্ছে বলে দেশের দারিদ্র বাড়ছে বৈ কমছে না। ভালো দাসীর মাইনে অন্তত ৪০/৫০ টাকা হওয়া উচিত। দাসী কথাটা না বলাই ভালো, তাদের জন্য কোনো সম্মানসূচক আখ্যা দেওয়া উচিত। দাসীদের সম্মান যদি বাড়ে, তা হলে দরিদ্র ভদ্র লোকের মেয়েরাও পরিচারিকারূপে পরের বাড়িতে চাকরি গ্রহণ করতে পারে।
হালিমা : কুল-কন্যারা পরের বাড়িতে পর-পুরুষের সম্মুখে কী করে বের হয়ে কাজ করবে?
কুলসুম : মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র অন্তঃপুর থাকাই নিয়ম। তা ছাড়া অত অবরোধের কথা ভাবলে কাজ চলবে না। প্রয়োজন হলে ভাত না থাকলে পরদা টানিয়ে লাভ কি? কৃষক মেয়েরা কাজের খাতিরে বাইরে বের হলে দোষ কি? পেটের দায়ে কাজ করে পয়সা উপায় করবার সুবিধে না করতে পেরে, বহু রমণী পতিতা হতভাগিনীর জীবন গ্রহণ করে। আহ! তাদের কথা ভাবলে চোখে পনি আসে! পরদার অর্থ বাক্সের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকা নয়, পদার অর্থ শরম–গা ঢাকা ও পুরুষ হতে একটু দূরে থাকা। প্রয়োজন হলে মেয়েমানুষের পুরুষের মতো মাঠে কাজ করা উচিত–পথে পথে দোকান খোলা উচিত। কলকাতায় দেখেছি–ফেরিওয়ালা যে-সব মেয়েমানুষ তরিতরকারি নিয়ে বাসায় আসতে, তারা কি সব অসতী? সেদিন পাহাড়ে যে সব জুমিয়া যুবতী দেখলাম ওরা কি সব অসতী? অনেক মেয়েমানুষ ভয়ে অনিচ্ছায় বাধা দেবার শক্তি নেই বলে পাপ করে-তা জান? দেবর ভাজকে আক্রমণ করে–অন্তঃপুরে পরদার ভিতর! ভাই ভগ্নিকে কলঙ্কিত করে–সেও অন্তঃপুরে, পরদার ভিতর। অবিশ্বাস করো না এ সত্য। মেয়েমানুষকে শক্তি দেওয়া চাই–তাকে স্বাধীনতা দেওয়ার দরকার-তার মুখে ভাষা তুলে দেওয়া কর্তব্য–সে নিজের মর্যাদা নিজে বাঁচিয়ে রাখবে। কেউ খারাপ হয়-হোক-পুরুষও তো খারাপ হয়।
হালিমা : যারা পরিচারিকা হয়ে কাজ গ্রহণ করবে, তাদের সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করা উচিত?
কুলসুম : কোনো কোনো ভদ্রলোক চাকর-বাকরকে কুকুর অপেক্ষাও অধম মনে করেন। চাকর-বাকরেরা অমানুষ হতে পারে–কিন্তু এর কারণ হয়তো প্রভুর দুর্ব্যবহার। অনেক অসভ্যও সভ্য মনুষ্যত্ব সম্পন্ন হতে সক্ষম হয়েছে। চাকর বাকর যদি বিছানায় বসে তাতে রাগ করো না। চাকর ছাড়া বাইরের কোনো দরিদ্র কোনো ভদ্রলোকের বাড়িতে এসে চেয়ারে বসলে ভদ্রলোক তাতে অপমান কতো লজ্জা বোধ করেন। যারা হীন তারাই মানুষকে অপমান করেন। এইসব দরিদ্রের কর্তব্য এই প্রকৃতির ভদ্রলোকদের দাঁড় করে রেখে নিজেরা চেয়ারে বসে। আঘাত ছাড়া কোনো কালে কারো চৈতন্য হয় না–এটা সত্য কথা। চাকরের সাথে সদ্ব্যবহার করলে জাত যায় না। ঘৃণা করে ছোট বলে গালি দিয়ে মানুষকে সত্যকার ভালো করা যায় না। মানুষের মধ্যে যে সুবুদ্ধি আছে সব সময় তার দোহাই দিয়ে কাজ করতে হবে। চাকর যদি চেয়ারে বসে তাতে কি ক্ষতি হয়? চাকরাণী। যদি তোমার মখমলের বিছানায় শোয় তাতে মনে মনে কষ্ট বোধ করো না। চাকর-বাকর তাদের কাজ বা সেবার মূল্য নেই-সেবা করে বলেই সে ছোট হতে পারে না। জ্ঞান, বুদ্ধি ও ব্যবহারে সে ছোট হতে পারে-চাকর বলে সে ছোট নয়। যার জ্ঞান নেই, যার ব্যবহার অমার্জিত তার সঙ্গে ভালো কথা বলে তাকে সম্মান করলে দিন দিন তার মনের উন্নতি হয়। চরিত্র ও বুদ্ধিতে সে ছোট; এ কথা ঢেকে ফেলতে সে সচেষ্ট হবে দেশের শ্রেষ্ঠ লোকেরা যদি দেশের ছোট ও দীন-দরিদ্রের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন–যদি তাদের সুবুদ্ধির দোহাই দিয়ে কাজ করতে চেষ্টা করেন তা হলে জাতির উন্নতি অল্প সময়ে হওয়া সম্ভব।
হালিমা : দাস-দাসীদের পোশাক-পরিচ্ছেদ কীভাবে দিতে হবে? ছোঁকরা চাকর কাপড় পেলেই পালিয়ে যায়।
কুলসুম : দাস-দাসী শব্দ দুটি ব্যবহার না করাই ভালো। অপেক্ষাকৃত সম্মানসূচক দুটি শব্দ বেছে বের করতে পারলে ভালো হয়। খাদেম-খাদেমা বলা যেতে পারে। পরিচারক, সহচর, লাড়কা সহচরী, মেয়ে বাবুর্চী এইরূপ ধরনের নামও মন্দ নয়! কাপড়-চোপড় দাস দাসীকে না দেওয়াই উচিত। মাইনে কিছু বেশি ধরে দিলেই হয়, কাপড়, দেওয়ার দায় হতে মুক্তি পাওয়া যায়। পরের কাছ থেকে কাপড় পেলে দাস-দাসীদের মনের অবনতি ঘটে। ফলে তারা নীচ প্রবৃত্তি হয়ে পড়ে।
হালিমা : অনেক লোকের বাড়িতে অনেক যুবতী দাসী দেখেছি-তার যেকোথা থেকে এসেছে তার ঠিকানা নেই; তারা প্রভুর কাছ থেকে বেতন পায় না। কোনো কোনো গৃহিণী তাদের দয়া করে রঙ্গিন শাড়ি, হাতের চুড়ি ইত্যাদি কিনে দিয়ে থাকেন। এদের জীবনের ঠিক উদ্দেশ্য যে কী তা ভেবে কিনারা করতে পারি নে।
কুলসুম : এ সব বড় দুঃখের কথা! নিজেদের সুবিধার জন্য একটা মানুষের জীবনকে অর্থশূন্য করে দেবার নিষ্ঠুর চেষ্টা। নারী যে মানুষ, রক্ত-মাংসের শরীরে তার সুখ-দুঃখ বোধ আছে–এ অনেক মানুষই ভুলে যায়। মানুষ কেন? আমাদের দরিদ্র ভগিনীদের ব্যথা আমরা নারী হয়ে ভুলে যাই–মনে করি তারা কুকুরী অপেক্ষা ঘৃণিত। সংসারে তাদের কোনো স্থান নেই–আমাদের কাছেও না। যাক এই যে যুবতী দাসীর কথা বলছ, এরা নানা উপায়ে সংগৃহীত হয়ে থাকে। বড় লোকেরা অনেক সময় টাকা দিয়ে এদের সংগ্রহ করে। কোথাও মেয়েদের চুরি করা হয়–কোথাও দরিদ্র বাপের কাছ থেকে কিনে নেওয়া হয়। কোনো কোনো স্থানে স্বামীও টাকা পেলে বউকে বড় লোকের কাছে দাসীরূপে বিক্রি করে। সেইসব মেয়ে প্রায় নিদোষ কুমারী হয় না জীবনের প্রথমে কোনো মেয়ে হয়তো ভুলে বিপথে গিয়েছিল, কত বিচিত্র ঘটনার ভিতর দিয়ে শেষকালে সে দাসীর জীবন গ্রহণ করে দাসী হতে বাধ্য হয়। পশুর মতো খাওয়া ও পরের সেবা করা ছাড়া আর যে দাসীদের কোনো কাজ আছে একথা ভুলে যায়। একটা মানুষের জীবনকে এইভাবে ব্যর্থ করে দেওয়া কি পাপ নয়? এইসব দাসী যদি কোনো কেলেঙ্কারি করে, তবে তাদের যে মারে সে পশু। তাদের কারো সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সংসারী করে দেওয়া উচিত-কাজ নিজে করা ভালো তবুও মানুষের জীবনকে অর্থশূন্য করে দেওয়া ঠিক নয়। এই পাপে মানুষ জাতির পতন হয়েছে। অভিশাপে সুবর্ণ সিংহাসন ধুলোয় মিশেছে।
হালিমা : অনেকের বাড়িতে দাসী আছে বলে গৌরব করে।
কুলসুম : তারা বড় হীন। নিজেরাই নিজেদের কাজ করাতে গৌরব। কুঁড়ের মতো বসে থাকবে-দাসদাসীতে তোমার কাজ করবে এতে কি গৌরব? পরের কাছে হীনভাবে মাথা নত করতে দোষ-মূর্খের মতো পরকে বেদনা দেওয়া দোষ–ঘুষ খাওয়া, অন্যায়ের সমর্থন করা, দরিদ্রের পয়সা নিয়ে বাবুগিরি করাতে দোষ, কাপুরুষ যারা, যাদের সমান তালি দেওয়া, তারাই নিজের কাজ নিজে করতে লজ্জা বোধ করে। বাবু, তস্কর, অত্যাচারী দারোগার বউ-এর চেয়ে সৎস্বভাবা নামাজের সংসারে কর্ম ক্লিষ্টা দরজির বউ-এর সম্মান বেশি। মানুষ ছোট হয় নিজের অজ্ঞতায়, নীচ প্রবৃত্তিতে ও মনের সংকীর্ণতায়। যে নারী বুদ্ধিমতি, বাকপটু, চরিত্রবতী, শিক্ষিতা, সে যে কাজই করুক না, যে অবস্থায়ই থাকুক না, তার সম্মুখে স্বৰ্ণবরণ শোভিত সংকীর্ণ হৃদয়া; নিরক্ষরা, পরনিন্দা চর্চাকারিণী দাসদাসী পরিবৃতা নওয়াব বধূর কোনো মূল্য নেই।
হালিমা : শুনেছি দাসদাসীরা চুরি করে খায়।
কুলসুম : সেটা ঠিক কথা। তাদের খুব অল্প করে খেতে দেওয়া হয় বলে, তারা অনেক। সময় চোর হয়। মাঝে মাঝে তাদের ভালো জিনিস খেতে দেওয়া উচিত। মাঝে মাঝে কিছু কিছু করে পকেট খরচ দেওয়া উচিত–এতে তাদের মন ও প্রবৃত্তি উদার ও উন্নত হবে। হাটবাজার নিজে করা উচিত। অনেক অপদার্থ লোক আছে যারা হাট-বাজারে যায় না বলে গৌরব করে।
হালিমা : গ্রীষ্মকালে দাসীরা মশারির অভাবে অনেক সময় খালি গায়ে রাত্রি কাটায়। অন্ধকারের জানালাহীন মশা-ভরা রান্নাঘরে তাদের থাকতে দেওয়া হয়।
কুলসুম : অর্থাৎ তারা গরুর মতোই এক-প্রকার জীব, এইরূপ ধরে নেওয়া হয়। দাসীরা মানুষ তাদের রক্তমাংসের শরীর, এটা বিবেচনা করা উচিত। তাদের মশারি, পাখা, জানালাযুক্ত ঘরে থাকতে দিলে নিজেদের সম্মান বাড়ে বই কমে না। আমরা পরাধীন জাতি। শক্তিমান ও বিত্তশালী ব্যক্তির অত্যাচার ও অন্যায় ব্যবহার দরিদ্রকে সইতে নেই। নিজেদের মর্যাদা ও দাবি বুক ঠুকে আদায় করার শক্তি আমাদের সমাজের কোনো লোকের নেই। এখানে দরিদ্র মানুষ বড়কে ‘বাপ’ ‘মা’ বলেই মনে করতে বাধ্য হয়। শাস্ত্রে আছে–বাপ মায়ের অত্যাচার নীরবে সহ্য করলে পুণ্য হয়।
হালিমা : সত্যি গরিব লোকের মেয়েরা বড় ঘরের বউকে মা বলে ডেকে, পায়ে চুমো খেয়ে নিজেদের অস্তিত্বকে একেবারে মুছে ফেলে। বোন বলে সাহসের সঙ্গে বলবার অধিকার কারো নেই।
কুলসুম : এই ‘মা-বাপ’ বলে ডাকা আর পা ছুঁয়ে ছালাম করার ভেতরে তাদের মনে। যে কতখানি গভীর ব্যথা কাঁদতে থাকে, তা দৃষ্টিমান ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ টের পায় না। দাসীকে কখনও মা বলে ডাকতে দেবে না বা পা ছুঁয়ে ছালাম করতেও দেবে না, এটা অনৈসলামিক। ইসলাম ব্যক্তিত্বকে চূর্ণ করে ফেলা পাপ মনে করে। আহা, মানুষ পরিশ্রম করে দুটি অন্ন মুখে দেবে, তাতেও সে যেন কত অপরাধী! দাসীদের জীবন কত দুঃখময়। সে যে কোনোরূপ আমাদের সামনে দাঁড়াবার দাবী রাখে একথা মানি না। এদেশে দরিদ্র নরনারীর সংখ্যা খুব বেশি, সেই জন্য হয়তো দাস-দাসীর কপালে এত অসম্মান।
হালিমা : দাসী রাখতে হলে কী বয়সের দাসী রাখা হবে? কোন, দাসীটি ভালো হবে, কোটি মন্দ–জানবার উপায় কী?
কুলসুম : বুড়ো দাসী না রাখাই ভালো–তাদের ভালোমন্দ অভ্যাসগুলি এমন দৃঢ় হয়ে গেছে যে, সেগুলির আর পরিবর্তন হয় না। আশা-আনন্দহীন জীবন তাদের বড় শক্ত এবং কঠিন-ভালোমন্দ কোনো কথাই তাদের কানে পৌঁছায় না। নোংরা ম্লেচ্ছ কোনো মানুষকেও বাড়িতে স্থান দেওয়া ঠিক নয়। দাসী নিযুক্ত করবার আগে তার চেহারাটা একটু ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে, সে কিরূপ লোক; একটু কথা বললেও তার বুদ্ধি ও স্বভাব সম্বন্ধে অনেকটা ধারণা করতে পারা যায়। দাসী নিযুক্ত করবার সময় লজ্জা ফেলে তার কাজের সব কথা বলে দেবে। অনেক সময় দাসীদের সঙ্গে তার আত্মীয়-স্বজন এসে বাড়িতে দিকদারী করে। সেটা যাতে না ঘটে তা পূর্ব হতেই দাসীকে বলে দিতে হবে-হরদম নানা বিশৃঙ্খল আদেশ ও সমালোচনায় মানুষের বুদ্ধি লোপ পায়।
হালিমা : যুবতী দাসী দেখে বাড়ির কর্তা ভুলে যান’?
কুলসুম : বাড়ির কর্তা বা স্বামী কি ভদ্রলোক নন? এমন জঘন্য নীচ প্রকৃতিবিশিষ্ট স্বামীর সঙ্গ অবিলম্বে পরিত্যাগ করা উচিত। স্ত্রীলোক নিঃসহায়, দরিদ্র ও অশিক্ষিত বলে অনেক সময় এরূপ ঘটনা ঘটে থাকে। দাসীগুলি যদি পশু না হয়, তারা যদি আত্মজ্ঞানসম্পন্ন হয়, তা হলে তারা বাড়ির কর্তার এই নীচ প্রকৃতি দেখে তৎক্ষণাৎ চাকরি ত্যাগ করবে। বাইরে সমাজকে ভয় করে, আমাদের দেশের অনেক লোক পবিত্র জীবন যাপন করে–যাদের সমাজের ভয় নেই, তারা অনেক সময় পাপ করতে লজ্জা বোধ করে না। মানুষ সমাজ অপেক্ষা নিজের বিবেককে বেশি শ্রদ্ধা-ভিতর হতে পাপের প্রতি একটা ভীষণ ঘৃণা পোষণ করে, তখনই সে যথার্থ ভদ্রলোক হয়। স্ত্রী যদি বুদ্ধিমতী, জ্ঞানী ও শক্তিশালিনী হন, তা হলে স্বামীর এত বড় নীচ সাহস হয় না। দাসীদের কি ধর্ম জ্ঞান ও লোকলজ্জা নেই।
হালিমা : স্বামীর প্রতি ঘৃণা পোষণ করে স্ত্রীর কি স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করা সম্ভব?
কুলসুম : আমাদের দেশে নারী পুরুষের কৃপার পাত্র। সকলেই নারীকে পথে ভাসাতে চেষ্টা করে। বাপের সম্পত্তি বোনকে বাদ দিয়ে ভাইয়েরাই ভাগ করে নেয়। নারীর কোথাও স্থান নেই। স্বামীর অত্যাচার অনেক সময় স্ত্রীকে দায়ে পড়ে সহ্য করতে হয়। স্বামী হয়তো এক বেশ্যাকে ভালবাসে, স্ত্রী সেই বেশ্যাকে আদর করে, ভালবাসে, স্বামীর কৃপা লাভ করতে চেষ্টা করে, এ আমি জানি। এর চেয়ে দুঃখ আপমানের জীবন নারীর পক্ষে আর কি। হতে পারে? নারীকে শক্তি দেওয়া চাই–বিপদে পড়লে কোনো কাজ করে নিজের অন্ন নিজে সংগ্রহ করে খেতে পারে, সংগ্রাম করে বিবাহের সময় এরূপ শর্ত করে নিতে হবে-যাতে স্বামী লম্পট হয়ে স্ত্রীকে অপমান করতে না পারে। যাতে নারী ইচ্ছা করলে পুরুষকে তালাক দিতে পারে। লম্পট বলে প্রমাণ করতে পারলে সাহেব মেমকে, অথবা সাহেবকে আদালতের সাহায্যে যে-কোনো সময় পরিত্যাগ করতে পারে। শক্তি, ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের স্বাধীনতা ব্যতীত নারীর রূপের কোনো মূল্য আছে বলে মনে হয় না। তার পক্ষে প্রেম প্রণয় একটি জাজ্বল্যমান মিথ্যা কথা।
.
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম কহিলেন, বোন, রান্নাঘরের পার্শ্বেই পানি ফেলা মেয়েদের একটা খারাপ অভ্যাস।
হালিমা : নিরুপায় হয়ে তারা এরূপ করে কি?
কুলসুম : যে সব মেয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তারা রান্নাঘরের চারপার্শ্বে নোংরা করে রাখতে ভালবাসে না।
হালিমা : ময়লা-ধধায়া পানি কোথায় রাখা হবে?
কুলসুম : বড় হাঁড়ি কিংবা বালতিতে ময়লা জমা করে রাখা উচিত, তারপর স্নানের আগে দূরে ফেলে দিতে হয়। হাত ধোয়া পানি, হাঁড়ি ধোয়া পানি, সব এক জায়গায় জমা করে রাখবে। ঘরের পার্শ্বে পুনঃ পুনঃ একটু একটু করে পানি ফেললেই সেই জায়গা নোংরা। এবং দুর্গন্ধ হয়ে ওঠে। ভাতের ফেনাও ময়লা পানির হাঁড়িতে রেখে দিতে হয়।
হালিমা : গোছলখানার পানিতে কি ঘরের পার্শ্ব নোংরা হয়ে ওঠে না?
কুলসুম : গোছলখানার পানিতে জায়গা বড় নোংরা হয় না। দিনে একবার মাত্র এক জায়গায় অনেক পানি ঢাললেও ক্ষতি নেই। অনবরত সারাদিন এক জায়গায় একটু একটু করে পানি ফেলা দোষ এবং জঘন্য রুচির পরিচায়ক। ঘরের বারান্দায় বসে, অনেকের মুখ। ধোয়ার অভ্যাস আছে এও বড় জঘন্য অভ্যাস। রান্নাঘর বা ঘরের পার্শ্বে ময়লা পানি ফেলার মতোই এ কাজটা খারাপ। রান্নাঘরের পার্শ্বে ময়লা পানি ফেলা যেমন অন্যায়, তেমনি তরকারির খোসা, দস্তরখানার পরিত্যক্ত আবর্জনা, মাছের আঁইশ ফেলাও নোংরা কাজ। চাকর না থাকলেও নিজে সেই অপরিষ্কৃত পানি এবং আবর্জনা দূর করে ফেলে দিয়ে আসবে। রান্নাঘরের একেবারে পার্শ্বেই কাউকে হাতমুখ ধুতে দিবে না। কোনো কোনো কুড়ে চিলুমচীতে মুখ ধোয়, এতে হাত মুখ ধধায়া পানিতে জায়গা নষ্ট হয় না সত্য। এ কালেও অনেক কাপুরুষ মনে করে চিলুমচীর কাশ ও থুথু তাদের সামনে না ধরলে তাদের অপমান করা হলো।
হালিমা : খাওয়া-দাওয়া রান্নাঘরে হওয়া উচিত, না অন্য ঘরে হওয়া উচিত?
কুলসুম : অনেকে রান্নাঘরেই খেয়ে থাকেন। রান্নাঘরে খাওয়া ঠিক নয়, তাতে মেয়েদের কাজে অসুবিধা হয়। রান্নাঘরে কতকটা মেয়েদের ড্রইংরুম সুতরাং পুরুষ লোকের সেখানে না যাওয়াই ভালো। খাবার জন্য স্বতন্ত্র স্থান নির্দিষ্ট থাকা উচিত।
হালিমা : রান্না করা জিনিসপত্র কোথায় রাখবে? সেগুলি কি দাসী চাকরের হেফাজতে রান্নাঘরে রাখা উচিত?
কুলসুম : রান্নাকরা জিনিসপত্র সিকা, মিটসেফ বা আলমারিতে বন্ধ করে রাখাই ভালো। সবচেয়ে মিটসেফে রাখাই সুবিধা। চাকর-দাসীরা অনেক সময় চুরি করে খায়। ইঁদুর-বিড়াল-কুকুর সুযোগ পেলে ঘরে ঢুকে মাছ মাংসের সদ্ব্যবহার করতে পারে না।
হালিমা : মেয়েরা কোথায় খাবে?
কুলসুম : পুরুষের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খেতে পারেন–তাতে লজ্জা কি? মেয়ে মানুষ যে ভাত খেয়ে থাকেন এ কথা পুরুষ বিলক্ষণ জানেন। যদি স্বতন্ত্র খাবার ঘর থাকে তবে সেখানে বাড়ির সকলেই পুরুষ মেয়ে গৃহিণী এক সঙ্গে বসে খেতে পারেন। খাবার ঘরে একটি রেফ্রিজারেটর রাখতে পারলে খুবই ভালো হয়, এটা বৈজ্ঞানিক উপায়ে তৈরি। এতে খাবার জিনিস নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে না। নিজেদের খাওয়া হলে দাসীরা খাবে। গৃহিণী নিজে খেয়ে দাসীদের খাওয়াবেন। দাস-দাসীরা যখন খায়, তখন গৃহিণী যেন তাদের এটা ওটা চাই বলে আদর করতে না ভোলেন।
হালিমা : খাওয়া মাটিতে বসেই ভালো, না একটু উঁচুতে হলে ভালো হয়?
কুলসুম : একখানা লম্বা বড় তক্তপোষের উপর বসে খাওয়া যেতে পারে। একখানা উঁচু মাচা ও টেবিলের উপর খেলেও দোষ হয় না। এজন্য ছোট ছোট হাতবিহীন কয়েকখানি চেয়ার অথবা দুখানা লম্বা বেঞ্জ তৈরি করে নিলে ভালো হয়। খাবার জন্য টেবিল চেয়ার ব্যবহার করাও ভালো, তবে এতে অনেক অপদার্থ লোক গর্ব ও গৌরব অনুভব করে! এতে গর্ববোধ করার কিছুই নেই।
হালিমা : দাসীরা কি মাটিতে বসে খাবে?
কুলসুম : দাসীরা যদি বাড়ির প্রভুকীর আসনে বসে ভাত খায় তা হলে কীর সম্মান কমবে না। একটু থেমে কুলসুম আবার বললেন-তরকারি, মাংস পেয়ালায় আগেই তুলে রাখা মন্দ নয়। অনেক সময় বাড়ির সকলকে খাওয়াতে কিছুই বাকি থাকে না। এ ভারি অন্যায়। হাঁড়িতে কিছু রেখে–যে কজন মানুষ সেই কটা পেয়ালা তৈরি করা ভালো। কেউ যদি আবদার ধরে, তা হলে হাঁড়ি হতে সম্ভব হলে তাকে কিছু দেবে। বাড়ীর বৃদ্ধ বা কর্তাকে হিসেব করে কোন কিছু দেবে না। শাশুড়ী বা বাড়ির মেয়ে মুরুব্বী সম্বন্ধেও সেই কথা। এদের আলাদা করে পরিতোষপূর্বক আহার করাবে। যে সব জিনিস রান্না হবে তার পরিমাণ অল্প হলেও সকলকে দেবে। ভালো জিনিস সবশেষে খেতে দিতে হয়। আগে ভালো জিনিস খেতে দিলে মন্দ জিনিস কেউ খেতে চায় না। কোনো জিনিস বেশি পরিমাণে দেওয়া উচিত নয়, এতে রান্না ভালো হয় নি, এই কুৎসা শুনতে হয়।
হালিমা : কতকগুলি অসহিষ্ণু লোভী ছেলে আছে, যারা রান্নাঘরে যেয়ে পাখীর মতো চুপ করে থাকে।
কুলসুম : ছেলেদের রান্নাঘরে বসতে নেই–এইকথা বলে দেবে। ছোট শিশুর স্বতন্ত্র কথা। খাবার লোভ না করে যদি শুধু মায়ের সঙ্গ-সুখের জন্য ছেলেরা রান্নাঘরে বসে থাকে। তবে দোষ নেই।
হালিমা : রান্নাঘরে অনেক সময় কলিকা হাতে করে অনেকে উপস্থিত হয়।
কুলসুম : তাদের উপর বিরক্ত প্রকাশ না করাই উচিত। কোনো মুরুব্বী যদি আসেন, তা হলে সম্ভ্রমের সঙ্গে তার হাত থেকে কলিকাটি নিয়ে দাসীকে আগুন তুলে দিতে বলবে-দাসী না থাকলে নিজ হাতেই আগুন তুলে, সময় থাকলে ফুঁ দিয়ে দেবে–দূরে আগুন ফেলে দেবে না। কলকেতে অনেক আগুন দেবে, অল্প আগুনে তামাক খাওয়া হয় না। মুরুব্বী ছাড়া অন্য লোক সম্বন্ধে অন্য কথা।
হালি : রান্নাঘরের জিনিসপত্রগুলি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা উচিত নয় কি?
কুলসুম : নিশ্চয়ই–সুন্দর করে সার বেঁধে জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখবে। এলোমেলো কোনো জিনিস থাকলে দাসী চাকরের উপর বিরক্তি প্রকাশ করবে। যে চাকর বা দাসী তোমার ইচ্ছামতো কাজ করবে না, তাকে প্রথমে সাবধান করবে, সংশোধন না হলে বরখাস্ত করবে। গোলাম হারামজাদা বলে গালি দেওয়া ভালো নয়। জিরে, গোলমরিচ প্রভৃতি মসলা রাখবার জন্যে ছোট ছোট বয়েম অভাবে হাঁড়ি ব্যবহার করা ভালো। রান্নাঘরে কোনো জিনিসপত্র যেন আলগা না থাকে। খাবার পানির কলস সব সময় ঢাকা থাকা চাই। কোনো ঢাকনি ব্যবহার না করে পরিষ্কৃত গামছা দিয়ে ভরা কলসী ঢেকে রাখতে পার,সে গামছা মাথা মোছবার জন্যে ব্যবহৃত হবে না।
হালিমা : পুকুরে কিংবা কুপের পানি ফিলটার বা গরম না করে খাওয়া উচিত কি?
কুলসুম : লোকের পবিত্রতার প্রতি বিশেষ মনোযোগ নেই, এটা দুঃখের বিষয়।পানির প্রতি লোকে যে কত অত্যাচার করে, তার ইয়ত্তা নেই। পানি ফিলটার করে খাওয়া উচিত।
হালিমা : বাড়িতে মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র পায়খানা থাকা উচিত কি?
কুলসুম : নিশ্চয়ই।
হালিমা : এঁটো ঝুটো সম্বন্ধে খুব সাবধান হতে হবে, নয় কি?
কুলসুম : এক কণা এঁটো কোথাও যাতে পড়ে না থাকে, সে সম্বন্ধে সাবধান হতে হবে। জায়গা বাড়ি নষ্ট করে ছেলেরা বেশি। তাদের খাওয়া শেষ হওয়া মাত্রই পরিষ্কৃত করে ফেলতে হবে।
.
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম : বাল্যকালে বাপের বাড়িতে যখন মেয়েরা থাকবে তখন যেন তারা শুধু হেসে-খেলে না বেড়ায়।
হালিমা : বাপের বাড়ি তো হাসবার খেলবারই জায়গা।
কুলসুম : স্বামীর বাড়িও হাসবার খেলবার জায়গা। জীবনের সঙ্গে সব অবস্থায় হাসি খেলা জড়িয়ে থাকবে। শুধু হাসি-খেলাকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। স্বামীর ঘরে যেয়ে যাতে আদর্শ পত্নী হয়ে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-বন্ধুকে তুষ্ট করা যায়, তার বন্দোবস্ত বাপের বাড়ি হতেই করে নিতে হবে। কোনো মুরব্বী বলে থাকেন–দুদিন পরে যখন মেয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, তখন তাকে দিয়ে কোনো কাজ করান উচিত নয়। সে শুধু হেঁটে বেড়াবে, আর বসে খবে। এরূপ মুরুব্বী মেয়ের উপকার না করে বরং অপকার করেন।
হালিমা : মেয়ের দ্বারা তা হলে খুব কাজ করিয়ে নেওয়া উচিত?
কুলসুম : হ্যাঁ, দাসী থাকলেও মেয়েদের সংসারের সব কাজ করা উচিত। মেয়ে বড় মানুষের ঘরে পড়তে পারে, হয়ত শ্বশুরবাড়িতে মেয়েকে মোটেই কাম কাজ করতে হবে না–তবু বাপের বাড়িতে তাকে সব কাজ শিখিয়ে দেওয়া উচিত। কাজ করলে অসম্মান হয় না, এটা মেয়েকে শেখাতে হবে। মেয়ে কলেজ বা হাইস্কুলে পড়েছে বলে সে রান্না করতে শিখবে না এ হতে পারে না। বাবু মেয়ে জামায় ময়লা লাগে এই ভয়ে বাসন মাজবে
এও হতে পারে না। যেমন ঘরের হোক না, বাল্যকালে তাকে পরিশ্রমী জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত করে দিতে হবে। কুঁড়ে মেয়েরা মানুষের বেদনা বোঝে না-তারা বড় হলে নির্বোধ নিষ্ঠুর সংকীর্ণ হৃদয় এবং কটুভাষী হয়।
হালিমা : মা যদি মেয়ে দিয়ে বেশি কাজ করান, তা হলে মেয়ে মাকে নিষ্ঠুর মনে করতে পারে?
কুলসুম : মেয়েকে যদি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া শিখান যায়, তা হলে বাল্যজীবনে যে মায়ের কাছ থেকে তালিম পেয়েছে, এজন্য সেয়ানা হয়ে সে কৃতজ্ঞ হবে।
হালিমা : মেয়েদের কী কী কাজ শিখতে হবে?
কুলসুম : সংসার চালানোর জন্যে যত কাজ শেখা দরকার–সব। ঘর ঝাঁট দেওয়া, জিনিসপত্র যথাস্থানে রাখা, মাজা, কাপড় কাঁচা, রান্না করা, একটু রিপু-সেলাইয়ের অভ্যাস, একটু ঔষধের জ্ঞান, চুল বাঁধতে জানা, পানি তোলা–এ সব শিখে রাখা উচিত। বাড়িতে যদি দুই তিনটি মেয়ে থাকে, তা হলে একটা ছোঁকরা চাকর ছাড়া মেয়ে দাসী না রাখাই ভালো। বাল্যকালে মেয়েরা যাতে অলস বা বিলাসী না হয়, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।
হালিমা : লেখাপড়া এবং সংসারের কাজ এক সঙ্গে চালানো কি সম্ভব?
কুলসুম : কেন সম্ভব নয়? লেখাপড়া শেখার আজুহাতে কাজ করবার অভ্যাস ত্যাগ করা অন্যায়। কাজ করবে, সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া শিখবে। পড়াশুনা বা কোনো শিল্প শেখার জন্যে বেশি সময় দরকার হয় তা হলে অল্প হলেও সংসারের কাজ একেবারে ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। বিদেশী মেয়েদের জীবন অনুকরণ করলে চলবে না, নিজের দেশে কিন্তু তারা যথেষ্ট কাজ করে।
হালিমা : বাল্যকালে মেয়েদের প্রথম কর্তব্য কী?
কুলসুম : প্রথম কর্তব্য ধর্ম শেখা। বিদ্যালয়ে পড়ার সঙ্গে ধর্ম-পুস্তক পড়তে হবে। অন্তত নামাজ পড়ার মতো শিখতে হবে।
হালিমা : ইংরেজি পড়া কি দোষের?
কুলসুম : কে বলল দোষের? ইংরেজি, বাংলা, ফারসি, আরবী যে কোনো ভাষা শেখা যায়, তাই ভালো। অনেক স্ত্রীলোক আছেন, যারা মনে করেন, আরবী ও উর্দু পড়লেই বেহেস্তের পথ পরিষ্কার হয়–এটা মিথ্যা কথা। লেখাপড়া শেখবার উদ্দেশ্য-মনের উন্নতি ও জ্ঞান লাভ করা,ধর্ম, মনুষ্যত্ব ও স্রষ্টাকে ভালোরূপে বুঝতে পারা। মনের উন্নতি লাভ করার জন্যে মানব-সমাজ, মানব-চরিত্র, শাসন ও মনের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয় ভালো করে বুঝবার জন্যে, যতগুলি ভাষা শেখা দরকার, নারীকেও তা শিখতে হবে। শুধু আরবী ও উর্দু পড়লে বেহেস্তে যাওয়া যায়-এ বিশ্বাস করা বড়ই ভুল।
হালিমা : আরবী ফারসী পড়ে কি প্রভূত জ্ঞান হয় না।
কুলসুম : আরবীর সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজি পড়তে হবে, নইলে বর্তমান সময়ে অনেক কাজে বে-অকুফ হতে হয়। চতুর্দিকে বাংলা ইংরেজির ঢেউ বয়ে যাচ্ছে, আমি তুমি দেমাক করে বসে থাকলে চলবে না। কেউ কেউ বলেন, মেয়েদের জন্যে সামান্য একটু লেখাপড়াই যথেষ্ট। আমার মনে হয় পুরুষ ছেলের চেয়ে মেয়েছেলের লেখাপড়া বেশি দরকার! এতে জাতির মুক্তি অতি অল্প সময়ে হয়। রান্নাঘরে শিশু মায়ের কাছে যা শেখে–ভালো হোক, মন্দ হোক, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সে তা মনে করে রাখে-মারলে, কাটলে, টাকা দিলে কিছুতেই মানুষ যেন সে শিক্ষা ভুলতে পারে না। মায়ের বিশ্বাস ও, কুসংস্কারকে অবহেলা করতে পারে–অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত লোকে এরকম পারে না। মায়ের মহিমায় জগতে ইতরও শ্রেষ্ঠ পরিবারে প্রতিষ্ঠা হয়। নীচমনা লোকের ছেলে ছোট, ভদ্রঘরের ছেলে ভদ্র হয়। অবশ্য এই কথা অবিসংবাদী বলে মেনে নেওয়া কিন্তু নীচতা ও জাতির পক্ষে অকল্যাণকর। ছোটলোকের ছেলেও মহাপুরুষ হতে পারে। কাওকে ছোটলোক বলা পাপ।
হালিমা : মেয়েরা কোথায় পড়বে? কে পড়াবে?
কুলসুম : শিক্ষিত পরিবার হলে মেয়ে বাড়িতে ভাই বা বাপের কাছে পড়তে পারে। স্কুল-কলেজে পড়লেই সুবিধে হয়। অনেক মানুষের সঙ্গে মেলামেশা না করলে মন ও মাথায় বুদ্ধি খেলে না। ঘরের মধ্যে একই রকমের মানুষের সঙ্গে নিত্য মিশলে মনের জাতি হয় না, বুদ্ধির বিকাশ হয় না এবং চরিত্র এবং বিনয় ভূষিত হয় না। মেয়েরা অনেক মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না বলে, সাধারণত তারা বোকা দাম্ভিক প্রকৃতির হয়ে থাকে। এ দেশে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখার কোনো ভালো মেয়ে স্কুল বা কলেজ নেই–এটা বড়ই দুঃখের কথা। যে সমস্ত লোকের বহু অর্থ আছে তারা কি জন্য যে এত অর্থ জমা করে রাখে জানি। মানব মঙ্গলে যদি অর্থ ব্যয়িত না হয় তবে টাকাকড়ি উপায় করে বিশেষ লাভ কী?
হালিমা : শুনেছি বাংলাদেশে মেয়েদের জন্য বিদ্যালয়, কলেজ ও শিল্পাশ্রম খোলা হবে। মেয়েরা বোডিং-এ থাকবেন। কারো কিছু খরচ লাগবে না। বিদ্যালয়, কলেজ ও শিল্পাগারে দশ হাজার ছাত্রীর স্থান হবে। শিল্পাশ্রমে দরিদ্র, নিঃসহায়, যে-কোনো মেয়ে যে কোনো বয়সে শিল্প শিক্ষা করার সুবিধা পাবেন।
কুলসুম : এরূপ তো শুনেছি কত নরী খাবার অভাবে, পাপে চূর্ণ হচ্ছে। তাদের কথা ভাববার কারো অবসর নেই।
হালিমা : বিয়ে হবার আগে সাজসজ্জা করা কি ভালো?
কুলসুম : না, স্বামীর বাড়ি ছাড়া মেয়েমানুষের অন্য কোনো জায়গায় খুব সাজসজ্জা অকর্তব্য। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাই যথেষ্ট। তেড়ী কেটে গয়না পরে, বাইরে বের হওয়া। ঠিক নয়। এদেশে অবাধে নারীদের বাইরে বের হবার অবস্থা নাই বলে, তাদের সাজসজ্জা দেখে পুরুষের মনে তরল ভাব আসতে পারে।
হালিমা : মেয়েকে বাল্যকাল হতে সচ্চরিত্রা, শিক্ষিতা, মার্জিত, রুচি, মধুরস্বভাব করে তুলবে কে? এর জন্য কি বিশেষ দৃষ্টি আবশ্যক? দায়িত্ব বেশি কার?
কুলসুম : অধিকাংশ পরিবারে দেখতে পাওয়া যায়, মেয়েকে মধুরস্বভাব, ভদ্র ও বুদ্ধিমতি করে তোলার বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই। আপনা-আপনি মেয়ে যে শিক্ষা পায়, তাই যথেষ্ট মনে করা হয়। রীতিমতোভাবে উপদেশ ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। কাজে-কর্মে উঠা-বসায় তাই বলে মেয়েকে অনবরত গালি দেওয়া অবশ্য কর্তব্য নয়। কাজ-কামে একটু আধটু সমালোচনা করা যেতে পারে তবে তাকে সর্বগুণালঙ্কৃতা করতে হলে রীতিমতো শিক্ষা দিতে হবে। মেয়েকে বড় করে তোলবার জন্য মা-বাপ দায়ী। কানো কৈানো অপদার্থ বাপ মেয়েকে বিয়ে দিয়ে স্বামীর ঘাড়ে সব কর্তব্য ফেলে দেন। মেয়ের প্রতি যে নিজেদের কতখানি কর্তব্য আছে, তা তাঁরা জানেন না। কোনো কোনো পিতা বিয়ের জন্য মেয়েকে এক আধখানা পুঁথি পড়িয়ে দেন। এক আধখানা পুঁথি পড়তে পারলে বা জঘন্য অক্ষরে দুই এক লাইন লিখতে পারলে মেয়ে দেবী হয়ে বসেন।
হালিমা : সে তো ঠিক। আচ্ছা, আজকাল বাপ মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে পথের ফকির হচ্ছে। বিয়ের সময় বাপ কি মেয়েকে কিছুই দেবে না?
কুলসুম : পণপ্রথার কথা বলছো? মেয়ের বাপের কাছ থেকে পণ গ্রহণ করা ভালো কাজ বলে মনে হয় না। বাপ মেয়েকে গয়না দিতে বাধ্য নন। প্রয়োজন হলে মেয়েকে বাপের বাড়িতে এসে অতিথি বা ভাই-বউদের যাতে কৃপার পাত্রী না হয়ে থাকতে হয় সে সম্বন্ধে পিতার পূর্ব হতেই বিবেচনা করা উচিত। ভাই-বউরা স্বামীর ভগ্নীকে যে ঘৃণা করেন–এ বলছি না, তবুও প্রত্যেকের দাবি স্বাধীনতা বজায় রাখা দরকার। কোনো স্বামী যদি স্ত্রীকে কাবিনের টাকা মাফ করে দিতে বলেন বা স্ত্রীর সম্পত্তি বেচে ফেলতে ইচ্ছুক হন তবে তিনি স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুরের ন্যায় ব্যবহার করেন। বিশেষ ভালবাসা ও জুলুমের দ্বারা কাবিনের টাকা মাফ নিলেও আল্লাহর কাছে তা গৃহীত হয় না। স্বামী যদি বিবাহের আগে মনে করেন তিনি দেনমোহর আদায় করবেন না, মাফ লইবেন, তা হলে বিবাহ সিদ্ধ হয় না। স্ত্রী তার সম্পত্তি স্বামীকে ভোগ করতে দেবেন, কিন্তু নষ্ট করতে দেবেন না! বাপের বাড়ির সম্পত্তি যদি বিক্রয় করা দরকার হয়, তবে স্বামীর কর্তব্য সেই টাকা দিয়ে স্ত্রীর নামে নতুন সম্পত্তি ক্রয় করে দেওয়া। যদি কোনো স্বামী স্ত্রীর সম্পত্তি নষ্ট করে ফেলেন তবে তার জন্য স্ত্রী যেন স্বামীর সঙ্গে কলহ-বিবাদ না করেন! নিজের মনের দুঃখ গোপন করে রাখবে। বাপ যেন কোনো সময় মেয়েকে ভাগ প্রাপ্য অংশ হতে বঞ্চিত না করেন।
হালিমা : মেয়ের সঙ্গে শ্বশুরবাড়িতে থালা, ঘটি অর্থাৎ নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেওয়া উচিত নয় কি?
কুলসুম : সেসব জিনিস স্বামী দিতে বাধ্য। যেদিন স্বামী বিয়ে করলেন সেদিন হতে স্ত্রীর সকল সুখের ব্যবস্থা স্বামীকেই করতে হবে। অনেকে ইচ্ছা করেন বধূ, খাট, চেয়ার, বাক্স, বদনা, ঘটি, এ-সব বাপের বাড়ি হতে নিয়ে আসবেন। পরের বাড়িতে যখন থাকা, তখন সঙ্গে কিছু কিছু জিনিস না নিয়ে গেলেও অপ্রস্তুত হতে হয়। এসব জিনিস মেয়ে যদি সঙ্গে না নেন, তবে তাকে কিছু বলবার অধিকার কারো নেই। যেসব জায়গায় মেয়েকে খোশামোদ করে বিয়ে দিতে হয়, সেখানে অনেক বিড়ম্বনা ভোগ করতে হয়। মেয়েকে খোশামোদ করে বিয়ে দেওয়া অত্মমর্যদা জ্ঞানসম্পন্ন লোক পারেন না। বড় মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ করে বড় হতে চেষ্টা করা ভালো কাজ বলে বোধ হয় না; জ্ঞান, বিদ্যা, ও চরিত্রের দ্বারা বড় হতে চেষ্টা করা উচিত।
হালিমা : বাপ জামাইকে টাকা অর্থাৎ পণ, গয়না কিছু দিতে বাধ্য নয় কি?
কুলসুম : না, বাপ শুধু মেয়েকে মানুষ করে দিতে বাধ্য। যিনি বিয়ে করবেন, তিনি গয়না দিয়ে সজ্জা দিয়ে বধূ নিয়ে যাবেন। তার নিকট হতেও জোর করে গহনা আদায় করবার কারো অধিকার নেই। যার বউ তিনি ইচ্ছা হয় গয়না দেবেন, নইলে না দেবেন। এ সম্বন্ধে বাজে লোকের কোনো কথা না বলা উচিত। বধূরও উচিত নয় স্বামীর কাছ থেকে কিছু জোর করে আদায় করা। রূপ স্বামী দেখবেন। স্বামী যদি স্ত্রীকে রূপসী করে না তুলতে চান, তবে স্ত্রীর কি? গয়না অপেক্ষা, জ্ঞান, চরিত্রশক্তি ও মানসিক বলের ভিতরই রূপ বেশি আছে।
বাপের সম্পত্তির টাকা এক পয়সা হলেও, বিবাহিত মেয়েদের কাছে অংশমতো মাসে মাসে আত্মীয় বা ভাইদের কর্তব্য পাঠিয়ে দেয়। মেয়ে যেন এই অংশ আদায় করতে কোনোও রকমে সঙ্কোচ বোধ না করেন। যে পিতা মেয়ের অংশ শুধু ছেলেদের দিয়ে যান–তিনি অপদার্থ পিতা। যে ভাই ভগ্নীকে-বোন ভিন্ন মায়ের পেটের বা এক মায়ের পেটের-সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করতে চান, তিনি বড় অন্যায় কাজ করেন। তিনি পাপ করেন।
হালিমা : অনেকে পড়ার খরচ পাবার আশায় বিয়ে করে, পরে বাপ টাকা না দিলে চিরকাল মেয়েকে আপমান সইতে হয়।
কুলসুম : অনেক শ্বশুর জামাইকে টাকা দেওয়া হবে বলে মেয়ে দেন; এর ফল শেষে খারাপ হয়। এরূপ কোনো বন্দোবস্ত জামাই-শ্বশুরে না হওয়াই ভালো। কোনো দান শ্বশুরের কাছ থেকে না নেওয়াই উচিত। আগে বলেছি শ্বশুরের মাঝে মাঝে জামাইকে উপহার দেওয়া ভালো, জামাইয়ের কিন্তু উচিত শ্বশুরের কোনো কিছু গ্রহণ না করা।
হালিমা : বিবাহের পর মেয়েকে জামাই এবং শ্বশুরের হাতে সঁপে দেয়া কেমন প্রথা?
কুলসুম : মেয়ের হাতখানি জামাই এবং জামাই এর বাপের হাতে তুলে দেওয়ার কথা? এ একটা জঘন্য ব্যাপার। এতে যেন কত অপরাধী তাই দেখান হয়। মেয়ের যদি কোনো গুণ থাকে, তাহলে তার শ্বশুরবাড়ি যেয়ে অসম্মান হবে না। যেখানে মেয়েকে খোশামোদ করে বিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে বিয়ে না দেওয়াই উচিত। মেয়ের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অপরাধ স্বামী শ্বশুরের আদৌ লক্ষ করা উচিত নয়। তাদের নিজেদের অনেক ভুল আছে। সকলেরই ভুল হয়। কারো চরিত্রের যদি বিশেষ ভুল থাকে, তা হলে সেটা সম্ভবত মেনে নেওয়া উচিত। বধূ যদি শিক্ষিত ও বিত্তশালিনী হন, তা হলে তার উপর কারো প্রভুত্ব ও সমালোচনা বিশেষ চলে না। কাজের অনবরত বিরক্তিকর সমালোচনা হতে থাকলে মানুষের মনুষ্যত্ব নষ্ট হয়।
হালিমা : বিয়ের সময় পাত্রী ও বর নিয়ে অনেক কেলেঙ্কারি হয়! এমন হবার কারণ কী?
কুলসুম : এর জন্য পাত্রপক্ষ এবং পাত্রীপক্ষ উভয়েই দোষী। বিয়ের আগে সকল বিষয় ঠিক করে নিলে আর সেই কেলেঙ্কারী হয় না। পূর্বে সকল কথা ভালো করে মীমাংসা করে নিতে লজ্জা করলে চলবে না। কত টাকার কাবিন হবে, কি গয়না বা কি কি জিনিস লাগবে, আগেই ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। কাবিনের টাকা অনেক সময় আদায় হয় না, স্বামীর পিতা অর্থাৎ শ্বশুরের কর্তব্য বধূকে কিছু জমি দেয়া। বস্তুত টাকার কাবিন হয়ে যদি জমির কাবিন দেওয়া যায়, তাই ভালো। এতে স্বামীর বা স্বামীর পিতার কিছুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করা উচিত নয়। একটি কুলকন্যা কোন সাহসে বাপের সঙ্গে সকল সম্বন্ধ কেটে ফেলে পরের বাড়িতে আশ্রয় নেবে। সে সম্বন্ধে সকলেরই বিবেচনা করা উচিত। গয়না-পত্র সম্বন্ধে বিয়ের মজলিসে অনেক সময় কলহ-বিবাদ হয়। গয়নার জন্যে পাত্রী পক্ষই বেশি কলহ করেন। এ বড় অন্যায়। মেয়ে যার পত্নী হবে, সে যদি স্ত্রীকে গাছের বাকল পরিয়ে সুখী হয়, তাতে পাত্রীপক্ষের কোনো আপত্তি থাকা উচিত নয়। মেয়ে কি চায়?-স্বামীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ। বিবাহের দিন স্বামী যদি স্ত্রীকে মলিন বেশে ঘরে নিয়ে যেতে চান, তাতে অপরের কি ক্ষতি? এক সময়ে অনেক টাকা একসঙ্গে জমা করা অনেকের পক্ষে কঠিন। স্ত্রীর কর্তব্য নয় গয়না, কাপড়ের জন্য স্বামীকে ঋণজালে জাড়িত করা। গয়নার টাকা বা বাজে খরচ যোগাড় করতে না পারলে কি লোকে অবিবাহিত থাকবে? বলতে পরো, কেউ যদি টাকা জমা করতে না পারে, সে কি গুণহীন কন্যাকে বিয়ে করবে? আমি বলি ভদ্রলোকেরাই বেশি করে। যারা গরিব তাদের একসঙ্গে অনেক টাকা জমা করা কঠিন। সব ভদ্রলোকেরাই যে গরিব হবে এ আমি বলছি না।
হালিমা : কিন্তু খালি হাতে পুরুষের উচিত নয় বিয়ে করা। বিবাহের দিন স্বামীর . কর্তব্য স্ত্রীকে উপহার অর্থাৎ গয়না কাপড় যৌতুক দেয়া।
কুলসুম : নিশ্চয়ই কর্তব্য। স্ত্রীর মনে বিশ্বাস হওয়া চাই স্বামী তাকে ভালবাসবে। উপহার ছাড়া শুষ্ক মৌখিক ভালবাসার মূল্য নেই। বংশের সম্মানের জন্য অনেকে জামাই পক্ষ হতে নগদ টাকা চায়; এরূপ লোকের কন্যাকে ঘৃণার সঙ্গে যাদি লোকে প্রত্যাখ্যান করেন তবে তাতে রাগ করা কঠিন।
হালিমা : বিবাহের অযথা খরচের অর্থ কী?
কুলসুম : এই যেমন পান, তামাক, মিঠাই এবং অযথা কতকগুলি বরযাত্রী সমাগমে বিস্তর খরচ হয়। বিবাহের সময় কয়েকজন নিকট আত্মীয় ছাড়া বেশি বরযাত্রী সমাগম ভালো নয়। অনেকগুলি লোক একসঙ্গে এক সন্ধ্যায় কোনো জায়গায় গেলে গৃহস্থের অনেক টাকা খরচ হয়। এমনিভাবে টাকা বরবাদ না করে কোনো সৎ উদ্দেশ্যে যদি সেগুলি দান করা হয় তবে সমাজের বড়ই উপকার হবে।
হালিমা : সে কথা ঠিক। অনেক সময় বরযাত্রীদের প্রতি বড় অসম্মান দেখান হয়।
কুলসুম : নিকট আত্মীয় না হলে বরযাত্রী হওয়া ঠিক নয়।
হালিমা : বিয়ে মেয়ে বাড়িতে হওয়া উচিত না অন্য কোনো স্থানে হওয়া ভালো? বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত বরপক্ষ যখন সম্পূর্ণ অজানা লোক তখন তারা কি বলে মেয়ের বাড়িতে উপস্থিত হবে?
কুলসুম : খুব ভালো কথা বলেছ বোন। বিয়ে মেয়ের বাড়িতে হওয়া আদৌ ঠিক নয়। দূর দেশে অজানা অচেনা স্থানে উপস্থিত হয়ে অনেক সময় বরপক্ষকে যারপরনাই বিপন্ন হতে হয়। বিয়ে কোনো মসজিদে হওয়া ভালো। সেখানে কারো ব্যক্তিগত প্রাধান্য নেই। মেয়েকে সাজিয়ে মসজিদে উপস্থিত করার দরকর নেই। মেয়ের প্রতিনিধিরা মেয়ের হয়ে সব কাজ করতে পারেন।
হালিমা : রাত্রিতে বিয়ের প্রকৃষ্ট সময় নয় কি?
কুলসুম : রাত্রিতে বিয়ে না হওয়া উচিত–এতে রত্রি জাগরণ ভয়ঙ্কর অনিয়ম, ফলে স্বাস্থ্যনাশ ঘটে।
হালিমা : বিয়ে দূরদেশি হওয়াই উচিত, না খুব কাছে হওয়া ভালো?
কুলসুম : বিয়ে দূরদেশে না হওয়াই ভালো।
হালিমা : যদি ভালো বর না পাওয়া যায়।
কুলসুম : তবে অগত্যা দূরদেশেই যেতে হবে। একদল নতুন লোক যাদের রুচি ও সভ্যতা অন্য রকমের-তাদের মধ্যে পড়লে মেয়ের খুব কষ্ট হয় বলে মনে হয়, মেয়ে যেন বনবাসিনী হয়ে পড়ে। মেয়ের মত নিয়ে কাজ করলেও মন্দ হয় না। যাতায়াতের সুবিধা থাকলে দূরে বিয়ে হতে পারে। এতে সন্তান-সন্ততির দৃষ্টি ও মন উদার হয়। আবার কতগুলি লোক আছে, যারা নিজেদের আওতাধীন স্থানকেই পৃথিবী মনে করে।
হালিমা : বিয়ের জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া কেমন?
কুলসুম : বিজ্ঞাপন দেওয়া উচিত; এতে কারো আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে না। বিয়ের প্রস্তাব ব্যাপারে অনেক সময় অনেক অপমান সহ্য করতে হয়-মেয়ের মাতা বা পিতার পক্ষে যা সহ্য করা বড় কষ্টকর।
মেয়ে বা ছেলে নিজেরাই মেয়ে ঘটক দিয়ে নিজের নিজের ভাবি স্বামী বা পত্নীর কাছে বিয়ের প্রস্তাব করে পাঠাতে পারেন। পরস্পরে কথা ঠিক হলে, বাপ-মায়ের সম্মতি নিতে হবে। বিশেষ বাধা না থাকলে তাদের সম্মতি দেওয়া উচিত। এতে কোনো পক্ষেরই অসম্মান হয় না। স্বামী বা পত্নী ঠিক করে নেওয়া পাপ বা লজ্জাজনক কাজ নয়।
পরের পর্ব :
০১-০৫. বসন্তের নূতন বাতাসে
০৬-১০. আবদুল গণি শহরে
আগের পর্ব :
১৬-২০. স্ত্রীকে স্বামীর মত নিয়েই চলতে হবে
২১-২৩. কী করে সন্তান গঠন করতে হয়