২৬-৩০. জবনহাটী গ্রামের এক বুড়ি
ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ
যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার অধীন জবনহাটী গ্রামের এক বুড়ি আর তার সেয়ানা মেয়ে তাদের স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে মেজের উপর বসেছিল।
মা তার মেয়েকে বলিল–মা ফেলী! তিন জায়গায় তোর নিকে দিলাম। তিন জনই তোকে তাড়িয়ে দিল। নাড়ী কাটায় দুই আনা চারি আনার বেশি কেউ তো দিতে চায় না। কেমন করে চলে?
ফেলী। সেই কালেই তো বলেছিলাম, পরের ছেলেকে বিশ্বাস নাই। তুই কেন নিকে দিলি?
“নিকে না দিয়ে কি করি মা, কি খাব? নিজে না হয় মরে গেলাম, তুই কি করে বাঁচবি? আর তোর তো রক্তমাংসের শরীর, এই বয়স। কী করে তোকে ঘরে পুষে রাখি বল দেখি।“
“আচ্ছা, মা, নিকে যখন করতে আসে, তখন তারা কত ভালবাসা জানায়। এক মাস যেতে যেতেই রাতদিন মারতে থাকে। মেয়েমানুষের এত দুর্গতি কেন? যদি পুরুষমানুষ হতাম তাহলে তো এই অপমান, এত লজ্জা সহ্য করতে হতো না। কি করে ধর্ম রক্ষা করা যায়?”
“মা কি বলবো। পৃথিবীতে ধর্ম নাই। যার গায়ে জোর সেই সম্পদশালী, সেই ধার্মিক। আমরা দরিদ্র লোক, পরনে কাপড় নাই, ভাত নাই, ধর্মও নাই। আয় আমরা বিষ খেয়ে মরি। ধীরে ধীরে একটু একটু করে মরার চেয়ে আয় একবারে মরে যাই।”
“মা, মরা কথাটা বলতে যত সোজা কাজে তত সোজা নয়। আর তা ছাড়া বিষ খেলে মরলে পরকালে তার আর জায়গা হয় না।”
আজ তিন দিন খাওয়া হয় না। মিঞাদের বাড়িতে মিঞার যায়ের মৃত্যু উপলক্ষে ফাতেহা হইতেছিল। ফেলীর মা যুবতী কন্যা ফেলীকে লইয়া খানাবাড়িতে যাইয়া উপস্থিত হইল। ক্ষুধায় তারা পথ চলিতে পারিতেছিল না। বড় দুঃখে, বড় বেদনায় চরণ তাহাদের ভাঙ্গিয়া পড়িতেছিল।
খানাবাড়িতে অসংখ্য মানুষ। কত মূল্যবান, কত বিচিত্র পোশাকে তাদের দেহ সজ্জিত। আলবোলার গন্ধে ধূমে মজলিসে ধূমায়িত। থাকে থাকে, পানের খিলি। যুবকের উচ্চ হাসি, আর বুদ্ধদেব চিন্তাপূর্ণ সংসারজ্ঞানে সভাগৃহ কম্পিত।
মৌলবীরা তর্ক করতেছিল–দাড়ি রাখা সুন্নত। অতএব যাহারা দাড়ী রাখে না তাহারা কাফের, কি না?
এমন সময় শততালিযুক্ত কাপড়-পরা ফেলীকে লইয়া ফেলীর মা সেখানে উপস্থিত হইল। আত্মার মঙ্গলই যখন উৎসবের মূল কারণ, দরিদ্র ও দুঃখীর আশীর্বাদেই যখন পূণ্য, তখন আজি এই সহস্র মুদ্রা আয়ের মধ্যে ফেলীর মায়ের জন্যে কি একটি টাকাও জুটিবে না! একটি টাকাতে যে তাদের দশ দিন চলে। আহা! একটি টাকা তাহাদের কাছে কত মূল্যবান! ফেলীর মা ভাবিতেছে–এমন বিজ্ঞ বিজ্ঞ মৌলবী বসিয়া আছেন ইহারা কি এই সামান্য কথা বুঝিতেছেন না? নিশ্চয় তাঁহারা এই কথার আলোচনা করিতেছেন।
সে আরও ভাবতেছিল–এই সব সম্পদশালী মানুষকে খাওয়াইলে কি লাভ হয়? আমাদের মতো দারিদ্র মানুষকে যদি এই অর্থে ও বস্ত্র দেওয়া হয় তবে আমরা মৃত্যু হইতে বাঁচিতে পারি। আহা! এই সামান্য কথা কি কেউ বুঝবে না? অন্নের জন্য আমরা একটু একটু করিয়া মরিতেছি, আর এইসব মানুষ যাহাদের এখানে আহার করিয়া কোনো লাভ হইবে না, কাহাদের দাবি অধিক? কে খাইলে অধিক পূণ্য লাভ হইবে?
বলিয়াছি ফেলী যুবতী। বক্ষে তাহার ছেঁড়া কাপড়, অনেক টানাটানি করিয়া পরিয়াছে। ফেলী ভালোরূপে তাহার লজ্জা রক্ষা করিতে পারিতেছিল না। তার মলিন বসনের সব জায়গাই যে জীর্ণ। টানিলেই যে ছিঁড়িয়া যায়। মা ও মেয়ে মজলিসের সম্মুখে যাইয়া হাত পাতিয়া দাঁড়াইল।
মজলিসের দৃষ্টি সেদিকে পড়িতে না পড়িতেই একজন বলিয়া উঠিলেন–ছিঃ ছিঃ, বেহায়া স্ত্রীলোক! একেবারে উলঙ্গ!
আর একজন বলিলেন–আরে তাড়াও, তাড়াও, বেহায়া পর্দাহীন ছোট লোক। একেবারে উলঙ্গ হয়ে সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। এ শয়তান দৃশ্যে ধর্ম রক্ষা হয় না।
তৃতীয় ব্যক্তি বলিলেন–এইসব লোকই সমাজে ব্যভিচার স্রোত বহাইয়া দেয়। এদের তাড়িয়ে দাও।
এক চাকর আসিয়া ফেলীর মাকে রুক্ষস্বরে বলিল,–বেহায়া বেটী! সম্মুখ থেকে দূর হ’। ছোটলোক কোথাকার!
ফেলী বলিল–আমরা কয়েকদিন খাই নাই। চাকরটি বলিল–হারামজাদি, বাজারে যেয়ে পয়সা উপায় কর। ভদ্রলোকের জাত মারতে এসেছি। সকলেরই ওজু নষ্ট করুলি!
ফেলীর মা আবার বলিল–কিছু ভিক্ষা চাই। চাকরটি বিলম্ব না করিয়া ঘাড় ধরিয়া তাহাকে এক প্রচণ্ড আঘাত করিল।
ফেলী বলিল–মা, চল যাই, ফিরে যাই। আমরা দাই। দাই, ছোট লোকের কোথাও স্থান নেই।
.
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
রাত্রি তখন তিনটা। সহসা তিনটা মেয়ে তিনখানা থালা লইয়া এদের ঘরে প্রবেশ করিল।
এই গভীর রাতে আকাশ হইতে তিনটি সুরবালা তিনখানি অমৃত থালা লইয়া এবাদের সম্মুখে উপস্থিত। প্রত্যেক থালায় নানাবিধ মিষ্টান্ন, সঙ্গে তিনটি কাঁচের গ্লাসে স্বর্গীয় গন্ধামোদিত সরবৎ।
একটি বৃদ্ধা নারী একটা তীব্র আলোকবিশিষ্ট প্রদীপ রাখিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরখানি গন্ধে ও আলোতে ভরিয়া উঠিল।
কামরার ভিতরে ঘরে–টেবিলের উপর মিষ্টান্ন রাখিয়া প্রথম সুন্দরী এবাদের মুখে জল ছিটাইয়া দিয়া কহিল–জামাই শ্রেষ্ঠ! মুখ ধোও।
সন্ধ্যা হইতে একাকী জনমানবহীন প্রকোষ্ঠে বসিয়া থাকিতে এবাদের ঘুম। পাইতেছিল। এবাদ চিন্তার কোনো ধার ধারে না। পার্শ্বের চৌকিতে সে গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইয়াছিল।
মুখ দেওয়া হইলে তিনখানি মিষ্টান্ন থালা এবাদের সম্মুখে রাখা হইল। এবাদ নির্বিকারচিত্তে সেগুলি গলাধঃকরণ করিতে লাগিল।
প্রকোষ্ঠ কার্পেট মোড়া। অতঃপর কার্পেটজড়িত মেঝের উপর তালে তালে পা ফেলিয়া বিচিত্র ভঙ্গিতে এ উহার গায়ে হেলিয়া সুরবালার নর্তন আরম্ভ করিল।
এবাদের মুখে কথা নাই। তিনি নয়ন ভরিয়া দেখিতে লাগিলেন। যুবতীরা গান ধরিল। এস, এস, বিদেশী দেবতা, তুমি আমাদের মহারানী ফিনির প্রাণ কেড়ে নিয়েছ। মিস্ ফিনি আজ গলায় ফুলের মালা পরবে না! মিস্ ফিনি কুয়াশাময় মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়েছিলেন।
সহসা তার মাথার উপর একরাশ ফুলের বাহার ঝরে পড়েছে। রানী ফিনি আজ তাঁর প্রিয়কে নিয়ে চাঁদের আলোতে খেলা করবেন।
এবাদ একটি কথাও বলিতেছিল না। সমস্ত জীবন সে আর এমন উন্মাদনা কখনও অনুভব করে নাই। একখানি সম্পদ ভরা দেহের কল্পনায় সে সহসা উদ্বেল হইয়া উঠিল। সে সকল কথা ভুলিয়া গেল! কে সে, তাহার বাড়ি কোথায়? কেন তাহার এই বর্তমান অবস্থা? কিছুই তাহার খেয়াল আসিল না।
ওঃ! যে মিস ফিনি তাঁহার অপূর্ব যৌবনমাধুরী লইয়া তাহার আশে-পাশে কত ঘুরিয়া বেড়াইয়াছেন, আজ সেই ফুলরানী মিস্ ফিনির সহিত তাহার বিবাহ! এবাদ ভাবিল, মিস ফিনিকে লইয়া সে চিরজীবী বন্দি থাকিতে পারে না! অন্ধ অন্তর যেন আজ তাহার খুলিয়া গেল। তাহার জীবনের একটা পাশ এতকাল একেবারে ঘুমাইয়াছিল।
আজ যেন তার নূপুর শিজ্ঞনে সমস্ত লুপ্ত আকাঙ্ক্ষা বাধাহীন উত্তেজনায় তাহার শিরায় শিরায় নাচিয়া উঠিল।
মৌন, ভাবহীন কল্পনাহীন এবাদ মধুর হাসি হাসিয়া সেবিকা ও নাচওয়ালী সুন্দরীর দিকে তাকাইয়া কহিল–সুন্দরী, আর এক পেয়ালা শরবত। সেবিকা স্বর্ণাধারে আরও খানিক লালরক্ত ঢালিয়া দিল।
এবাদ তাহা পান করিল। আহা! সংসার কী মধুর! এখানে দুঃখ নাই, বেদনা নাই–কেবল আনন্দ! কেবল সুখ। এবাদ আরও ভাবিল–পৃথিবীর এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত। পর্যন্ত কেবল ফুলের বাগান। অনন্ত সুন্দরী তাহাদের নগ্ন সৌন্দর্যমুক্ত করিয়া হাসিয়া খেলিয়া বেড়াইতেছে। যে এই আনন্দ ও সৌন্দর্য ভোগ করে না সে নিতান্তই অপদার্থ। এবাদ ছোখ পুঁজিয়া দেখিল রমণীরা কুসুমের মালা রচিয়া এ উহার গায়ে হানিতেছে। তাহাদের হাসিতে সুধা ঝরিয়া পড়িতেছে। ওহে! কে এমন নরাধম আছে যে, এইসব সুন্দরীদের পায়ের তলে সুখের আবেশে আপনাকে চূর্ণ করিয়া দেয় না?
কীসের মনুষ্যত্ব? কীসের ঈশ্বর? রমণীই ঈশ্বর!!
আহা, রমণীর চুলগুলি কী সুন্দর! কী মাদকতাভরা! উহা অনুভব করিবার বলিবার নহে। এক একটা চুলের জন্য এক একটা রাজত্ব দেওয়া যাইতে পারে। রমণী বেলীর তীব্র মধুর বিষ কী মহাআবেগে সমস্ত আত্মাটাকে গ্রাস করিয়া ফেলে। রমণীর মুখোনিতে ধরার তাবৎ মধু-মাখান। ওষ্ঠের বঙ্কিম হাসি কামানের গোলা অপেক্ষা ভয়ঙ্করী। নিতম্বে তার আত্মার জীবন-রস তরঙ্গায়িত হইতে থাকে। পা দিয়া সে সমস্ত সংসারটা চূর্ণ করিয়া দিতে পারে। যখন সে সংসার বুকে বিচরণ করিতে থাকে তখন মাটি অসীম পুলকে কাঁপিয়া উঠে। তাহার তীব্র কটাক্ষে পৃথিবীর গতি সৃষ্টি হইয়াছে। তাহার মাদকতা ভরা রামধনুর মতো সমস্ত আলো-বাতাসে রঙ ফলায়। রমণী রানী! রমণী মহারানী!
এবাদ চোখ খুলিয়া চাহিল দেখিল মিস্ ফিনি মহারানীর বেশে তাঁহার সম্মুখে দণ্ডায়মান। সারা বিশ্বের সৌন্দর্য সংগ্রহ করিয়া মিস ফিনির চারু মোহিনী মূর্তি নির্মিত। পরণে রক্তবস্ত্র। এবাদের বুকের ভিতর কামনার আগুন দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। স্বর্গের শ্রেষ্ঠ ও সুখ ও সৌন্দর্য পরী-মূর্তি গ্রহণ করিয়া তাহার সম্মুখে উপস্থিত।
বৃদ্ধ পুরোহিত মিস্ ফিনিকে এক রৌপ্যনির্মিত আসনে বসাইলেন। অতঃপর পুরোহিতের নির্দেশমতো নর্তকী বালিকারা এবাদের পোশাক খুলিয়া ফেলিল।
কোনো সময়ে পুরোহিত তাহার পবিত্র পুস্তক ও মন্ত্রপুত দণ্ড লইয়া তাহাদের বিবাহ কার্য সুসম্পন্ন করিতে আসিয়াছেন এবাদ তাহা জানে না। তাহার হৃদয় আনন্দে চিত্তে নাচিয়া উঠিল। কোনো পুণ্য কার্যপ্রভাবে এবাদের আজ এত সুখ? স্বর্গ যেন আপন ইচ্ছায় তাহার মাথার উপর ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। গর্বে ও উল্লাসে এবাদের মন ভরিয়া উঠিল।
এবাদ তাড়াতাড়ি পুরোহিতের পদধূলি লইয়া কহিল–আজ্ঞা করুন! কী করিতে হইবে?
পুরোহিত আশীর্বাদ করিয়া কহিলেন–মিস ফিনির জন্য উপযুক্ত পাত্র হইয়াছে। বৎস, তোমাকে প্রথমত স্নান করিয়া দেবতার পায়ে আপনাকে উৎসর্গ করিতে হইবে। এবাদ ইতস্তত করিতেছিল। সে যে মুসলমান, দেবতার পায়ে সে নিজেকে উৎসর্গ করিবে?
এমন সময় মিস্ ফিনি কহিলেন–প্রয়তম আর দেরি কেন? দূরাগত বাঁশির সুরের ন্যায় এবাদের কানে সে স্বর প্রবেশ করিল। কীসের ধর্ম?
এবাদ তাড়াতাড়ি তাহার আসন্ন প্রিয়তমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করিরয়া নর্তকীদিগকে ইঙ্গিত করিল।
পার্শ্বের বেদির উপর বসাইয়া অতঃপর তাহারা এবাদকে স্নান করাইল। তিনটা অপ্সরার কোমল হস্তের মধুর স্পর্শে এবাদ ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানের সকল কথা ভূলিয়া গেল।
তারপর বিবাহ। পুরোহিত পবিত্র জল’ এবাদের মাথার উপর ছিটাইয়া দিলেন। অসংখ্য দেবদেবীকে সাক্ষ্য করিয়া মন্ত্র পাঠ করাইয়া পুরোহিত মিস্ ফিনিকে মিস্টার এবাদের সহিত বাঁধিয়া দিলেন।
বাসরঘরে ফুলশয্যা রচনা করিয়া নর্তকীত্রয় দম্পতিযুগলকে দুর্বা দিয়া আশীর্বাদ করিল। অতঃপর তাহারা দেবতার নামে গান করিতে করিতে দরজা বন্ধ করিয়া বাহির হইয়া পড়িল।
.
অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ
মধুপুরে যাইয়াই রহমানের, শরীর আবার খারাপ হইয়া পড়িল। মি. আবু রহমানের মায়ের কাছে তার করিয়া দিলেন–বন্ধু রহমানের অসুখ বাড়িয়াছে। সত্বর কয়েকজন আপনার লোক লইয়া এখানে আসা চাই।
তিনদিন পরেই মৌলবী এমদাদ আলী সাহেব তাঁহার স্ত্রী ও কন্যা, আবদুর রহমানের মাতা ও ভগ্নি আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
ডাক্তার বলিলেন–কোনো আকস্মিক মানসিক উত্তেজনায় ব্যাধি ফিরিয়া আসিয়াছে। আবদুর রহমানের মাতা দিবারাত্র ক্রন্দন করিতে আরম্ভ করিলেন।
এমদাদ মিঞার কন্যা আমেনা এবং রহমানের ভগ্নি হামিদার উপর সেবার ভার পড়িল। এমদাদ মিঞার স্ত্রী পথ্যের ও আহারের ভার লইলেন। রোগীর তত্ত্বাবধান আবু সাইদ প্রাণপণে করিতে লাগিলেন।
গাড়ির ভিতর কী কাণ্ড হইয়া গিয়াছে তাহা রহমান কাহাকেও জানায় নাই। সেই ঘটনার পর কয়েকদিন রহমান কাহারো সহিত কথা বলে নাই। চিন্তায় তাহার রাত্রিতে ঘুম পর্যন্ত হইত না। আবু সাইদ একবার কারণ জিজ্ঞাসা করায় রহমান বলিয়াছিল, “মন খারাপ হইয়া উঠিয়াছে। কারণ বুঝিতে পারিতেছি না।”
প্রায় একমাস অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। ডাক্তারের ঔষধে এবং তিনটি প্রাণী অক্লান্ত সেবায় রহমান এবার সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করিল।
এই বিপদের সুযোগে আবুর সহিত এমদাদ মিঞার কন্যার যথেষ্ট পরিচয় হইয়া গিয়াছে। মাথার উপর বিপদ লইয়া আমেনার পানে একবারও আবু অন্যভাবে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতে পারে নাই। যখন সেবার পরিশ্রম করিয়া গেল, তখন সহসা একদিন আমেনার মনে হইল–এই একমাস ধরিয়া সে আবুর সহিত কী আশ্চর্য রকমে মিশিয়াছে। লজ্জায় সঙ্কোচে তাহার মন ও মুখ লাল হইয়া উঠিল। যে দিন সে রহমানের কঠিন ব্যাধির সংবাদ শুনিতে পায় সেদিন তাহার বালি-হৃদয়ে একটা গভীর বেদনা জাগিয়া উঠিয়াছিল। সেইদিন আমেনা বুঝিয়াছিল, আপন ভাই না হইলেও সে রহমানকে কতখানি ভালবাসে ও শ্রদ্ধা করে। রহমানকে সেবা করিবার একটা লিপ্সা তাহার প্রাণের মধ্যে জাগিয়া উঠে। সুতরাং রহমানের মাতার সামান্য অনুরোধেই নিজের মায়ের সহিত বিপুল উৎসাহে সে মধুপুরে চলিয়া আসিয়াছে। কিন্তু আজ যখন সকল বিপদ কাটিয়া গেল, তখন সে তার গত মাসের সমস্ত ঘটনা, সমস্ত কথার সমালোচনা আরম্ভ করিল।
অস্তগমনোমুখ সূর্যের সমালোচনা আরম্ভ করিল।
অন্তগমনোম্মুখ সূর্যের রক্তরাগ তাহার পেলব গণ্ডে পড়িয়া এক অভিনব দৃশ্য সৃষ্টি করিয়াছিল। রাকের থাকের ঈষৎ ঠেস দিয়া সে ইত্ৰময় এটঠফ-এর ছবির দিকে তাকাইয়াছিল। এক বর্ণও সে বুঝিতেছিল না।
মনে মনে সে প্রশ্ন করিল,–“সেদিন এত ঘণ্টা করিয়া কেন এখানে আসিলাম? রহমান ভাইয়ের মা হয়তো মনে করিতেছিল, মিস্টার আবুর করুণা ভিক্ষা করিতেই, এখানে আমার আসিয়াছি? সে মানুষ, আমি মানুষী, তাহার করুণা কেন আমি ভিক্ষা করিতে যাইব? আমি কী একটা মর্যাদা নাই। তাহার পা ধরিয়া বলিতে হইবে কী, দয়া করিয়া আমায় গ্রহণ কর। ছিঃ ছিঃ ছিঃ কি ঘৃণা! মিস্টার আবু কি মনে করিতেছেন? তিনি হয়তো কত ঘৃণার . সহিত ভাবিতেছেন, আমেনা সেবার ভানে আমার করুণা ভিক্ষা করিতে আসিয়াছে।”
তারপর এই দীর্ঘ একমাস কত ভাবে কত রকমে সে আবু সাহেবের সঙ্গে মিশিয়াছে। সেদিন কামরার ভিতর ঈষৎ অন্ধকারে ডাক্তারের ঔষধটা তাড়াতাড়ি ধরিতে গিয়া সে মিস্টার আবুর গায়ে উপর যাইয়া পড়িয়াছিল। তখন তাহার মনে কিছুমাত্র সঙ্কোচ বা লজ্জাবোধ হয় নাই। কিন্তু আজ যখন সেই ভয়ানক দৃশ্যটি তাহার চোখের সামনে আসিয়া উঠিল। তখন সে দারুণ আত্মগ্লানিতে একেবারে মুহ্যমান হইয়া পড়িল। আমেনা ভাবিল–ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এমন করিয়া নিজেকে ছোট করিয়া ফেলিয়াছে! মিস্টার আবু কী মনে করিয়াছিলেন? তিনি হয়তো ভাবিয়াছেন–এই বেহায়া মেয়েটি কেমন করিয়া উঠিতে বসিতে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করিতে ব্যস্ত। আমেনার ধৃষ্টতা অসহ্য।
আমেনার সহসা ইচ্ছা হইল, সে তার দেহটাকে মাথা হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলে। একটা দুর্জয় উত্তেজনায় সে বহিখানি মেঝের উপর ফেলিয়া দিল।
তারপর একদিন আবু সারাদিন পরিশ্রম করিয়া যখন রহমানকে বাতাস করিতেছিল তখন আমেনা তাহার অস্বাভাবিক ভদ্রতা বশে বলিয়া উঠিয়াছিল–“মিস্টার আবু, সেবাকার্যে স্ত্রীলোকের দাবিই অধিক। আপনি আর কষ্ট করিবেন না।” মিস্টার আবু বলিয়াছিলেন–“আমার কোনো কষ্ট হইতেছে না।”
প্রত্যুত্তরে আমেনা বলিয়াছিলেন–“মিস্টার আপনাকে অমন করিয়া বাতাস করিতে দিয়া আমি নিজে কিছুতেই বসিয়া থাকিতে পারিব না। উহাতে আমার অধিক কষ্ট হইবে।”
আমেনা আজ এতদিন পরে ভাবিতেছিল–ছিঃ ছিঃ! হয়তো মিস্টার আবু সে-সময়ে মনে মনে কতই না হাসিয়াছিলেন!
ব্যথায় বুক চাপিয়া ধরিয়া আমেনা বলিয়া উঠিল–খোদা!
আমেনা কঠিনভাবে প্রতিজ্ঞা করিয়া ফেলিল–আজ হইতে আর মিস্টার আবুর সম্মুখে যাইবে না; তাহার সম্মুখে সে আর কথা কহিবে না। এই সময়ে একজন দরজার ফাঁক দিয়া
আমেনার উজ্জ্বল মুখোনি দেখিয়া বলিয়া উঠিল–“কী সুন্দর!” সে আবু সাইদ।
.
ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ
জামালপুরের এক ঘড়ির দোকানে ঘড়িওয়ালা লোহারামের সঙ্গে তাহার বন্ধু রমাকান্তের কথা হইতেছিল।
রমাকান্ত লোহারামের হাত হইতে ঘড়িটা লইয়া বলিল–আরে, এটার স্প্রিং নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ছয় টাকা দেবে বলেছে?
লোহারাম বলিল–ঘড়িটে বেশ। মাত্র স্পিংটা ভাঙ্গা। বলেছে, পাঁচ টাকা দিবে। ঘড়ির কথা ফেলে রাখ। শুনলাম, বাজারে একটা মেয়ে এসেছে। সে নাকি ভারি সুন্দরী। চল, আজ দুপুর বেলা মেয়েটাকে দেখে আসি।
“আরে, এ কাজ! মালিক বলেছে, তার আজই কলকাতা যেতে হবে। নইলে তার ৫০০ টাকা ক্ষতি হবে। এই ঘড়িটার জন্যে সে তো দু’দিন বসে আছে তার খরব রাখন?”
“আরে ফেলে রাখ! মনের সুখের চেয়ে তার ৫০০ টাকা বড় নয়।”
“বেশ তো তোমার ধর্ম! এক ব্যক্তির ৫০০ টাকার ক্ষতি, আর তোমার বাজারে যেয়ে মদ খাওয়া, আর অশ্লীল আমোদে মত্ত হওয়া! এই না ভদ্র লোককে সকাল বেলা বললে–দুপুরেই ঘড়ি ঠিক হয়ে যাবে। বেচারা কত অনুনয়-বিনয় করে বলে গেল। তুমি কী রকমের লোক বল তো লোহারাম?”
লোহারাম হাসিয়া কহিল–“আরে মনটা বড় খারাপ হয়েছে। মন যাতে ভালো হয়। তার চেষ্টা করা আবশ্যক! যখন সে আশা করে দুপুর বেলা ঘড়িটি নিতে আসবে তখন দেখবে আমাদের দোকান বন্ধ। হা করে খানিক তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে ঘড়ি ফেলে থুয়েই সে বাড়ি ফিরে যাবে। অন্তত ছয় মাসের মধ্যে সে আর ফিরবে না। আমিও ইত্যবসরে অর্ধের দামে কোনো গ্রাহকের কাছে বেচে ফেলবো।”
”যখন ছ’মাস পরে আবার সে ঘড়ির তাগাদায় আসবে?”
“বলবো, সবাই ঠিক হয়েছিল বাবু! সেইবারেই আর দু’ঘণ্টা দেরি করলেই ঘড়ি নিয়ে যেতে পারতেন। একেবারে ছয় মাস আপনার দেখা নাই। কী বলবো, হঠাৎ পরশু দিন ধা করে স্পিংটা কেটে গেল। যে সে-স্প্রিং দিয়ে আর এবার হবে না। ভাল স্প্রিং আনতে কলকাতা চিঠি পাঠিয়েছি।”
“আর সে বুঝি তোমার স্প্রিং আর ঘড়ির জন্য শহরে বসে বসে দশ দিন কাটিয়ে দেবে?”“সে কি করবে তা জানি!”
“কী করবে”।
“সে, তোমার সব-কথা বেদবাক্য বলে মেনে নেবে। বলবে, লোহারাম বাবু, কাজের ভিড়ে, আর ঘড়ির আশায় শহরে বসে থাকতে পাচ্ছি না। আপনি দয়া করে ভি.পি.-তে বাড়ির ঠিকানায় ঘড়িটি পাঠিয়ে দেবেন।”
“বেশ বটে, তোমার জ্ঞান।” লোহারাম একটু হাসিয়া বলিল, একটু জ্ঞান ট্যান না থাকলে কি সংসারে বেঁচে থাকা যায় ভাই! এ-কালে ধর্ম ধর্ম করলে কি আর চলে? দেখিয়ে দাও তো একটা ধার্মিক লোক!” এমন সময় ঘড়িতে ১১টা বাজিল। লোহারাম হাতের কাজ ফেলে রেখে রমাকান্তকে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিতে বললে–তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে চলো, একবার ঘুরে আসা যাক। যতদিন বেঁচে থাকি ভাই, একটু আরাম করে নেওয়া যাক। সংসারে কে ক’দিন সুখ করে যেতে পারি তাই সঙ্গে যাবে। করে মরে যাব! রোগ-শয্যায় শুয়ে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষ রসগোল্লা খেতে চায়, তা জানত?”
রমাকান্ত বলিল–“লোহারাম বাবু, আচ্ছা ক’ বৎসর বাড়ি যান না? বাড়িতে খরচ টরচ পাঠিয়ে থাকেন তো? আপনার কেদির চলে কি করে?”
লোহরাম শয়তানের মতো সহজভাবে বলিলন–“কাদম্বিনীর কথা বলছ? সে আর টাকা পয়সা কি করবে? সাত বছর বাড়ি থেকে আসছি। এর মধ্যে নিজেই খরচ কুলিয়ে উঠতে পারি না। ফুর্তির প্রাণ ভাই! কী করি বল?”
ধরণীতে যদি কোনো বিপদ থাকে তবে সে পতিতাদের আড্ডা। চাঞ্চলচিত্ত ক্ষুদ্রমতি যুবকগণ এই পৈশাচিক নরককে স্বর্গের সোপান মনে করে। একটা অতি পৈশাচিক ও ভয়ানক আনন্দ এই স্থানের আলো-বাতাসকে ভরিয়া রাখে চাঁদের জ্যোতির্মণ্ডলের মতো প্রত্যেক পতিতার অঙ্গ ঘিরিয়া একটা পৈশাচিক মহিমা বিরাজ করে। কুলবধূদের সতীত্ব গৌরব ভরা মুখের সম্মুখে মানুষের মাথা শ্রদ্ধা ও ভয়ে নত হয়। পতিতাদের দৃষ্টি মানুষের মনে একটা জঘন্য বেদনাময় লালসা সৃষ্টি করে।
লোহারাম ও রমাকান্ত তাম্বুল রাগরঞ্জিত অধরে জামালপুরের পতিতাদের আড্ডায় যাইয়া উপনীত হইল। কলঙ্কিনীরা হাসিয়া হাসিয়া রূপের ঢালি লইয়া নামজাদা মহাজন লোহারামের নিকট যাইয়া উপনীত হইল। অহে, সমস্ত পৃথিবী বিনিময়ে মানুষ যে সম্মানকে টানিয়া রাখে ইহারা হাসিয়া হাসিয়া তাহাই সর্বসাধারণের কাছে বিক্রয় করে। কী ভয়ানক কথা।
.
ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
যথাসময়ে আবু সাইদ ও আবদুর রহমান বাড়ি আসিয়াছেন। তার পর রহমান বন্ধুকে বাড়ি লইয়া গিয়াছেন।
আবু বলিলেন–“ভাই, যেদিন থেকে আমেনাকে দেখেছি সেই দিন হতেই মনটা যেন আমার কেমন হয়ে গিয়েছে। যেমন দেখতে, তেমনি তার গুণ। আমেনাকে স্ত্রীরূপে পেলে আমি খুশি হবো।”
রহমান বলিল–“আর বেশি দেরি হবে না, শীঘ্রই তাকে তুমি পাবে।” ঠিক এই সময় আর এক জায়গায় আমেনা আর তার মায়ের কথা হইতেছিল।
আমেনা বলিল–“মা, শুনতে পেলাম আমাকে নাকি আবুর সহিত বিয়ে দেবার জন্য খুব চেষ্টা করছো?”
মা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন–“তোর কপাল কি তত বড় হবে আমেনা?”
“কেন আমি কি একটা পশু?”
মা বিস্মিত হইয়া বলিলেন–“কি বলিস মা? তোর কথা, তো বুঝতে পারছি না?”
আমেনা কহিল–“বলছি ছাই। বলি আমরা গরিব মানুষ, গরিবের মতো থাকাই ভালো।
“আবু সাঈদ বড় ঘরের ছেলে। তার উপর সে শীঘ্রই পুলিশ সাহেব হবে। আমরা কি বিনা কারণে এত পরিশ্রম করছি। মা-বাপের মন বুঝি না তো! যদি খোদা তোকে কোনো দিন ‘মা’ করে, তাহলে বুঝতে পারবি মেয়ের জন্য মার প্রাণ কেমন করে।”
আমেনা আমি কী কথা বলছি আর আপনি কী কথা বলছেন! আমি বলছি–আমরা গরিব মানুষ। আমি খুব বড় দরের লোকের সঙ্গে ওঠা-বসা করি নাই। তার মতো শিক্ষিত যুবকের সঙ্গে ওঠা-বসা করতে আমি পারবো না।
“সে খুব ভালো লোক।”
“ভালো লোক মানে সে আমাকে ঘৃণা করে। ভালবাসার বর্ষা দু’দিনেই কেটে গিয়ে যখন সরল ও সহজ জীবনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হবে তখন সে আমাকে ঘৃণা করবে।”
“তোর কথা কিছুই বুঝি না!”
“এত সহজ করে বলছি তাও আপনি বুঝেন না যে যেমন তার তেমনি থাকা চাই, নইলে মিল হয় না।”
‘আমরা মিল চাই না। তোরা সুখে থাকলেই আমরা সুখী হবো।”
“স্ত্রীর মা-বাপকে ও আত্মীয়-স্বজনকে বাদ দিয়ে কোনো যুবক কোনো স্ত্রীলোককে ভালবাসতে পারে না।”
“ছেলে খুব ভালো। এরূপ ছেলের সঙ্গে বিয়ে হওয়া ভাগ্যের কথা।”
আমেনা যাহা বলিতে চায় তাহা তাহার মা আদৌ বুঝিতেছিলেন না। আমেনা কয়েক দিন ধরিয়া যতই ভাবিতেছিল, ততই তার মন বিদ্রোহী হইয়া উঠিতেছিল। কেন তাহাকে এতটা হীন করিয়া বিবাহ দেওয়া হইতেছে? মিস্টার আবুর কাছে কেন সে এত কৃপার পাত্রী হইতে যাইবে? সে ছোট–সে দরিদ্র। দরিদ্র ও ছোটর ঘরে যাওয়াই তার পক্ষে শ্রেয়। বড়লোকের সহিত দরিদ্রেরা উঠা-বসা, আর মূখের পক্ষে জ্ঞানী সঙ্গস্পৃহা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কেন পিতা-মাতা এই সত্য কথা বুঝিতেছেন না। সারাটা জীবন একটা অপমান ও বেদনার ভার লইয়া তাহাকে শ্বশুরের ঘর করিতে হইবে। একটু অপেক্ষাকৃত বেশি সুখের জন্য দুইখানা বেশি গয়নার খাতিরে কেন সে এত আত্মমর্যাদা–জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজেকে দীর্ঘ অপমানের পথে দাঁড় করে দেবে। সুখ কি গয়নায়? সুখ সম্মানে; সুখ প্রেমে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! পেটের ছেলেগুলিও তো তাকে বাপের কৃপার পাত্র বলে মনে করবে। ছোট ঘরের মেয়ে বলে বাইরে ঘৃণা না করলেও অন্তর তাদের বেশ করে অনুভব করবে, তাদের মা খুব ছোট।
রহমান হাসিয়া বলিলেন–“বলি, অকস্মাৎ এত আগ্রহ বেড়ে উঠলো! এর মানে কি ভাই?” মি, আবু বলিলেন–“জানি না কেন। একদিন বৈকালবেলা মধুপুরে দরজার ফাঁক দিয়ে তার মুখখানা দেখেছিলাম। কেন যেন এক অপূর্ব মাধুরী তখন তার মুখে জড়িয়ে উঠেছিল। মনে হল, এমন মধুর মুখ জীবনেও কখনও দেখি নাই। সেই দিন হতে মনের ভিতর একটা তীব্র বেদনা জাগ্রত শুরু হয়েছে। সব সময়েই কি যেন ভাবি! খাবার সময় কি দিয়ে ভাত খাই ঠিক থাকে না।”
রহমান কহিলেন–“আমেনার কপাল আর তোমার অনুগ্রহ! এই বিবাহে এমদাদ মিয়া আর তার স্ত্রী তোমার কাছে চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকবে। আমিও অল্প কৃতজ্ঞ হবো না।”
“বটে! তোমার স্বার্থ আছে নাকি?”“এই বিবাহের কর্তা আমি। তোমার সঙ্গে তাকে বিবাহ দিবার প্রধান পাণ্ডা আমি।”
“আমার ভালবাসা না থাকলেও, তোমার খাতিরে তাকে বিবাহ করতাম। বন্ধুর কাছে বন্ধুর মর্যাদা খুব বেশি।”
রহমান বলিলেন–“আমার কপাল!” এমন সময় পিয়ন কাগজ দিয়ে গেল। কাগজ খুলিয়াই একস্থানে রহমানের নজর পড়িল। বিস্ময়াবিষ্ট ও ভীত হইয়া রহমান বলিয়া উঠিল–“সর্বনাশ! এ কি দারুণ সংবাদ!”
রহমানের হাত হইতে আবু কাগজ লইয়া পড়িয়া দেখিলেন :
গতকাল্য মুনসেফ শ্রীযুক্ত বাবু শ্যামচরণ মিত্র তাঁহার স্ত্রীকে লইয়া কর্মস্থানে যাইতেছিলেন! ভয়ঙ্কর বৃষ্টি হইতেছিল। বাতাসও অল্প বহিতেছিল না। বর্ষার জল নদীর কোণায় কোণায় ভরা, শ্যামচরণ বাবু তাহার স্ত্রী লইয়া স্টীমারে উঠিতেছিলেন, এমন সময় দুইজন মুটে সেই পথ দিয়ে নামিতে থাকে। তাড়াতাড়িতে মুনসেফ বাবুর গায়ে ধাক্কা লাগে। তিনি জলের মধ্যে পড়িয়া যাইতেছিলেন। তাঁহার স্ত্রী তাঁহাকে রক্ষা করিতে যাইয়া নিজেই জলের মধ্যে পড়িয়া যান। অন্য সংবাদ–স্টীমারের খালাসীগুলি নাকি সিঁড়ি টান দিয়াছিল। সংবাদ যাই হোক, ব্যাপারটা যেন অত্যন্ত সাংঘাতিক তদ্বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। পরন্তু গোয়ল ও চাঁদপুরের স্টীমার ঘাটের মজুরিগুলি ও কর্মচারীরা যে বিদেশী ভদ্রলোকের উপর অত্যন্ত অত্যাচার করে তদ্বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। উপরিবন কর্মচারীরা ইহার প্রতিবিধানও করেন না। শুনা যায়, মজুর-মুটেরা কর্মচারীদিগকে রীতিমত ঘুষ প্রদান করে এবং কর্মচারীরাও মোটবাহকদিগকে স্নেহের চোখে দেখেন। এই শোচনীয় ঘটনার জন্য কে দায়ী? স্টীমারের খালাসীরাও যাত্রীদের উপর কম অত্যাচার করে না। কাহাকেও কিছু বলিবার যো নাই। প্রত্যেকেই নিজেকে এক একজন রাজা মনে করে। প্রয়োজন হইলে তাহারা যে কোনো বিদেশী লোককে হত্যা পর্যন্ত করিতে পারে।
ঘটনা আরও ভয়ানক বিচিত্র যে, এই রমণীকে রক্ষা করিবার জন্য কেহ অগ্রসর হয় নাই। মুনসেফ বাবু সিঁড়ির উপর দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া শুধু কাঁদিতে থাকেন।
আবু বলিলেন–“ভয়ানক কথা! অত্যন্ত ভয়ানক!
“দেশের লোকগুলি কী পিশাচ! কাহারো পানে কেউ তাকায় না। এ উহার মাথা ভাঙ্গিয়া খায়। কীসের ধর্ম, কীসের মনুষ্যত্ব!”