১৬-২০. সে সমস্ত দিন
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
সে সমস্ত দিন আমাকে তালা দিয়ে বন্ধ করে রেখেছিল। একটু জলও আমায় খেতে দেয়
নাই। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছিল। সন্ধ্যাকালে অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
অনেক রাতে দরজার সামনে কীসের শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলাম দরজা খুলে যাচ্ছে! এক অতি বলিষ্ঠ ভীষণকায় মানুষ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলে, ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল।
লোকটা মোটা গলায় বললে-‘ঠাকুর, দরজা একেবারে বন্ধ করবেন না! চাবি ফেলে যান। যা করাবার আমি করবো। আপনি এখান থকে চলে যান। নইলে কিছু হবে না।’
বাহির হইতে গম্ভীর আওয়াজে কে বললে, “আচ্ছা।’
লোকটি তাহার দৈত্যির মতো চেহারা নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু এ কি? সেই ভীষণকায় দৈত্য দেবতার মতো বললে, ‘মা উঠে পড়, উঠে পড়। তোমাকে বাঁচাতে এসেছি। ব্রাহ্মণ অতি ভীষণ লোক, ফাঁকি দিয়ে বাঁচাতে এসেছি। খবরদার! পাগলামি করিস না। চুপে চুপে বেরিয়ে পড়।’
আমি কথা না বলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম।
সেই লোকটি আর দেরি করল না। বহিরে এসে সে আমাকে বললে, ‘আমার সঙ্গে আয়।’ এই কথা বলেই সে মাঠের দিকে রওনা হল, আমি তার পেছনে পেছনে দৌড়াতে আরম্ভ করলাম।
গভীর নিশা, চারিদিক অন্ধকার। লোকটা বললে, তুই আমাকে তো চিনিস না। কোনো ভয় নাই। আমার বাড়ি এক ক্রোশ দূরে। এই রাত কালেই আমার বাড়ি ছেড়ে আরও তিন ক্রোশ পথ যেতে হবে; নইলে উপায় নেই। আমার বোনের বাড়ি লাহিড়ীপাড়া। সেখানে তোকে রেখে তোর সোয়ামীকে খবর দেবো।
আমি কহিলাম, ‘সোয়ামীর ঘর যে কোনো কারণেই হোক ছাড়লে আর সেখানে যাওয়া ঠিক নয়। ঘরে যদি আগুন লাগলে বাড়ির ভিতর পুড়ে মরা ভালো, তবুও বাড়ি ছেড়ে বেরোনা ঠিক নয়। তাতে স্বামী সতীত্ব সম্বন্ধে অবিশ্বাস করতে পারেন। আমার মাথা একটু খারাপ হয়েছে, পাগল হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছি, স্বামীর ঘরে আর আমার যাওয়া। হবে না।’
লোকটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, আচ্ছা, খোদা যা করেন, তাই হবে। আমি একজন লেঠেল, শয়তান ব্রাহ্মণ মনে করেছিলো আমি লেঠেল এবং মুসলমান, যে কোনো পাপ আমি করতে পারি। তোর সর্বনাশ করাবার জন্য আমাকে টাকা দিয়েছে। দশটা টাকার কথা বলেই ঘৃণার সঙ্গে মাঠের মধ্যে টাকাগুলি সে ফেলে দিয়ে বললে—’হারামি টাকা মুসলমান শূকরের গোস্ত মনে করে। চাইনে অমন শয়তানি টাকা! ব্রাহ্মণ মনে করেছিলো সামান্য দশটা টাকার লোভে আমি যে কোনো পাপ করতে পারবো। আমার ধর্ম কী? তা সে জানে না! আমাদের মহারাজ মোহাম্মদের মহিমা কে বুঝে? মুসলমান কি? তা। সেই কাফের কি করে জানবে?’
আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তির সহিত বলিলাম–’সর্দার, তুমি আমার পুত্র, তুমি আমার পিতা, তুমি দেবতা; এই কথা বলে আমি সর্দারের পদধূলি গ্রহণ করলাম।‘
সর্দার বাধা দিয়ে বললে, ‘মা তোমার সালামের দরকার নাই। আমি যে তোমাকে বাঁচাতে পেরেছি এ জন্য খোদার কাছে হাজার শোকর।’
আনন্দে ভক্তিতে আমার চোখে জল আসল। ইচ্ছা হল সর্দারকে দেবতা বলে পূজা করি। তার পা দুখানি বারে বারে চুম্বন করি।
প্রভাত হতে একটু দেরি ছিল। আমরা এক নদীর ধারে এসে দাঁড়ালাম! দেরি করবার সময় ছিল না। গন্তব্যপথ আর এক ক্রোশ দূরে। কাছে কোনো নৌকা ছিল না। নদীটি বিশেষ বড় নয়! সর্দার বললে, ‘যেমন করে তোক আমাদের নদী পার হতেই হবে। কোনো নৌকাও তো দেখতে পাচ্ছি না।’
আমি বললাম, ‘ছোট নদী যখন, আমি সাঁতার দিয়েই পার হতে পারবো।’ ভালো করে কাপড় এঁটে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সর্দার আমার কাছে কাছেই রইল। ভয় পাছে আমি ডুবে যাই।
দুমিনিটের ভিতর পার হয়ে আবার একটা মাঠ পার হতে আরম্ভ করলাম। মাঠ পার হতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগলো। গ্রামের দক্ষিণ পার্শ্বে একটা বাড়িতে আমরা উপস্থিত হলাম। চারখানি ঘর! সর্দার দেরি না করে বোনকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন।
সর্দারের বোন দেখতে খুব কালো, সে অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। সর্দার তার বোনের ভাব বুঝতে পেরে বললে, ‘বুবু তুমি বিস্মিত হয়ো না। ইনি হচ্ছেন আমার মা। দক্ষিণদোয়ারী ঘরখানি ছেড়ে দাও। উনি হিন্দু, উহার পাক আলাদা হবে। দেখো যেন। মার কোনো কষ্ট না হয়। আমার আর দেরি করবার যো নাই, আপাত এ দুটাকা নাও।‘
সর্দারের বোন টাকা নিলো না। সে বললে, ‘সে কি কথা? উনি তোমার মেয়ে তা হলে আমারও মেয়ে। আমাদের কোনোও অভাব নাই, আমরা একটা লোককে সারা বছর বসিয়ে খাওয়াতে পারি।’
সর্দার বললে, ‘আচ্ছা, আমার আর সময় নাই। আমি আবার কাল আসবো। দেখো যেন মায়ের কোনো কষ্ট না হয়।’
কথা বলে সর্দার আমার দিকে একবার আশ্বাস ও স্নেহভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেল।
সর্দারের বোন আমাকে যত্ন করে বসতে দিল। ভিজে কাপড় দেখে তাদের বাড়ির কাঁচা জোলার তৈরি একখানা মোটা কাপড় এনে দিলে, আমি তাই দিয়ে কাপড় ছাড়লাম।
.
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
‘এক মাস কেটে গেল। সর্দার প্রায়ই আমাকে দেখে যেতো, আমার কোনো কষ্ট ছিলো। একদিন বিকাল বেলা সর্দার মুখখানা ভার করে বলে, ‘মা’ বড় বিপদ উপস্থিত!’ আমি বলিলাম—’কী বিপদ সর্দার?’
সর্দার। সেই কাফের ব্রাহ্মণ জমিদারের কাঁচারীতে নালিশ করেছে। নায়েব তার শিষ্য।
আমি নাকি একটা হিন্দুর মেয়েকে বের করে কোথায় সরিয়ে রেখেছি। দেখেছো ব্রাহ্মণের ধর্ম? বেটা মনে করেছে কাঁচারীতে আমাকে অপমান করবে। তা হবে না। যদি তাই হয় তবে ব্রাহ্মণের জান নেবো। নায়েবের ঘাড়েও মাথা থাকবে না। এতে যদি আমার। ফাঁসি হয় তাতেও আমি রাজি আছি। তবুও এই হারামজাদা জাল দেবতাকে আমি দেখবো।
আমার মাথা যেন কেমন হয়ে এলো। আমি কহিলাম, ‘সংসারে ধর্ম নাই। অধার্মিক বেঁচে থাকে। তাদেরই প্রতিপত্তি বেশি। অধর্মের বিরুদ্ধে কেই দাঁড়ায় না। শয়তাকে সবাই সম্মান করে। ধর্ম নাই! হৃদয় পবিত্র না করেই অন্যায়ের মধ্যে ডুবে থেকে মানুষ উপাসনা করে, আর স্বর্গে যেতে চায়। কী আশ্চর্য!
সর্দার বল্লে, কোনো শালাকে ভয় করি নে। যদি বামুনের কথা নায়েব বিশ্বাস করে। তা হলে তার ভালো হবে না। এই বলে সর্দার সেদিন কার মতো চলে গেল। এর। কয়েকদিন পরে সংবাদ পেলাম সর্দারকে নায়েব মশাই বেঁধে রেখেছে। মনটা বড় খারাপ। হয়ে উঠলো। ক্ষমতার এই ঘৃণিত অপব্যবহার দেখে হাড়ে হাড়ে জ্বলে গেলাম। মাথার ভিতর বন বন করতে লাগল।
আমি পাগল হয়ে জমিদারের কাঁচারির দিকে ছুটে চলোম। যে আমাকে এমন করে উপকার করেছে, তাকে আমারই জন্য এত লজ্জা ও অপমান ভোগ করতে হবে এ আমার। সহ্য হল না।
যেয়ে যা দেখলাম তাতে আমার মন কেঁপে উঠল। নায়েব একটা লম্বা ফুরশি হুঁকোর নল মুখে দিয়ে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসেছিল সামনে সর্দার! হাত বাঁধা। মাথা নত করে সে দাঁড়িয়েছিল।
আমাকে দেখেই ব্ৰহ্মণ! লাফিয়ে উঠে বললে, এই সে মেয়ে, একেই ও বের করে এনেছে। হিন্দু পরিবারের জাতি নাশ! এর একটা বিহিত–ব্যবস্থা হওয়া আবশ্যক।
আমি কহিলাম–ব্রাহ্মণ! নিজের পাপ ও বদমায়েশী ঢাকবার জন্য এই নীচ ষড়যন্ত্র কেন?’
নায়েব বিরক্ত হইয়া কহিল–“সাবধানে কথা বল। উনি আমাদের দেশের গুরু। তুমিও কম বদমায়েশ নও।”
আমি কহিলাম–নায়েব! তুমি আমাকে কি মনে করো? প্রজার টাকা চুরি করে সুখলিপসু বোকা জমিদার বাবুদিগকে ফাঁকি দিয়ে খুঁড়ি মোটা করে আমাকে বদমায়েশ বলছো।
নায়েব বলল–“দেখতে পাচ্ছি মেয়েটা সর্দারের পিরিতে পাগল হয়ে গিয়েছে। জাত তো আর ফিরে পাবে না।”
আমি হো-হো করে হেসে উঠে বললাম,–“ঠিক! ঠিক! কি ধর্ম! কি ব্রাহ্মণত্ব। আর কি তোমার শাস্ত্রজ্ঞান! তোমাদের অধার্মিক লম্পটের আর চোরের জাতি যাবে না আর আমার জাতি যাবে! এমন সমাজের সঙ্গে আমার কোনো সম্বন্ধ নাই।
নায়েব কি জানি কি কারণে একটু অনুগ্রহপ্রবণ হয়ে পড়লো।
বরকান্দাজ কুকুরগুলো লাঠি হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে, নায়েবের হুকুমের আশায় দাঁড়িয়েছিলো। নায়েব হেঁকে বললে–“রামা,সর্দারকে ছেড়ে দাও।
রামা বলল–“হুজুর ওর বিচার হল না? বাহির হইতে একজন চাপ–স্বরে বললে–শিকার তো মিলেছে! আর বিচারের দরকার কী?’
নায়েব আমার দিকে তাকিয়ে রুক্ষস্বরে বললে–“মুসলমানের বাড়িতে যেয়ে আর জাতি নষ্ট করো না। আমার বাসায় যাও।”
অতঃপর ব্রাহ্মণ নায়েবের দিকে তাকিয়ে বলল–“তোমার ওখানে থাকার জায়গা আছে তো? না হয় মেয়েটি আমার ওখানে গেলেও পারে।
একটা স্ত্রী লোককে নিয়ে ব্রাহ্মণ শিষ্যের ভিতর এই দ্বন্দ্ব দেখে আমি হাস্য সংবরণ করতে পারলাম না। কী বদান্যতা! কী অভিনয়!
মাথা আমার কেমন হয়ে উঠলো! হেসে হেসে খুন হয়ে আমি মাঠের দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করালাম। দুই-একজন বরকান্দাজ ধরবার জন্য আমার পিছনে পিছনে এসেছিলো কিন্তু খানিক এলেই আমার উম্মাদনাপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি দেখে অবাক হয়ে তারা ফিরে গেল।”
.
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
চারিদিন হেঁটে সাজাহানপুর স্টীমার স্টেশন ঘাটে এসেছি। একটা যুবক সেখানকার বাবু। স্টেশনে এসেই একটা আশ্চর্য কাণ্ড দেখলাম। ঢাকার এক বাঙাল অসময়ে টিকিট চেয়েছিল। বাবু ঘরের মধ্যেই মুখ ধুচ্ছিলেন। সমস্ত রাত ঘুমিয়ে ঘুমিয় বাবুর মাথা বোধ হয় খুব গরম হয়ে উঠেছিল। নিষ্ঠীবন ভরা মুখে জল বেচারার মাথায় ফেলে দিয়ে বললেন–“টিকস চাইছো, বাপ্পা?’।
মাথা যেন কেমন হয়ে উঠলো। ইচ্ছা হল ছোটলোকটাকে কান ধরে ঠিক করে দেই। পথ-ঘাটে মানুষের নির্মমতা দেখে দেখে ক্রমেই আমি বেশি করে পাগল হচ্ছিলাম। সমস্ত জাতিটার ভিতর, পল্লীতে, শহরে রাস্তায়, গলিতে, স্টীমারে, গাড়িতে মানুষের একি নীচতা ও মানুষ্যত্বের অবমাননা। প্রাণ ভেঙ্গে বের হল–ভাবলাম, কাজ নাই এ সংসারে।
ভাবলাম পাগল হয়ে সারা জীবন ঘুরে বেড়াব। ঘৃণিত ভণ্ড পিশাচদের সঙ্গে আর আমার কোনো সম্বন্ধ নাই। একটা যুক্তির আস্বাদ পেয়ে হো-হো করে হেসে উঠলাম।
আমার হাসি শুনে কতকগুলি লোক এসে আমার চতুর্দিকে দাঁড়াল, আমি আরও হাসতে আরম্ভ করলাম। তার সকলেই বললে, আমি পাগল।
ক্রমে যাত্রী এসে জমা হল। আমার পয়সা ছিল না। মনে করলাম কত জায়গা পড়ে থাকে, একজন ভিখারির ভারে জাহাজ ডোবো-ডোবো হবে না। জাহাজে উঠতে যাচ্ছিলাম, কেরানি টিকিট দেখতে চাইলো। আমি বললাম, ‘টিকিট নাই পয়সা নাই।’ কেরানি হেসে বললে, আচ্ছা বিনা টিকিটে যদি যেতে চাও তা হলে সবার পরে যাবে, অপেক্ষা করো।’ সকলেই স্টীমারে উঠে গেল। চট্টগ্রামের খালাসীগুলি সিঁড়ি টানতে আরম্ভ করলো। কেরানিকে বললাম–“বাবু যেতে দাও আমাকে। জাহাজে অনেক জায়গা পড়ে আছে। আমার কাছ থেকে কোম্পানি পয়সা আদায় না করলে তো তার কিছু ক্ষতি হবে না।’
কেরানি তাড়াতাড়ি আমাকে তার কামরার ভিতর যেতে বললে। আমি টিকিটের আশায় টিকিট-ঘরে প্রবেশ করিলাম।
জাহাজ ছাড়-ছাড় হল বাবুকে মিনতি করে বললাম, বাবু, আমি পাগল মানুষ যেতে দাও আমাকে। জাহাজে অনেক মানুষ যাচ্ছে। একজন বিনা টিকিটে গেলে কারো কোনো ক্ষতি হবে না।
বাবুব হেসে বললে, “আজ আমার কছেই থাকো। রূপ তোমার ঢের আছে। কাল টিকিট ও নূতন কাপড় দিয়ে তোমাকে পাঠিয়ে দেবো। হ্যাঁ তুমি কোথায় যাবে?’
আমি হো হো করে হেসে উঠলাম, মাথা আমার কেমন খারাপ হয়ে উঠলো। আমি বললাম–’সাগরে যাবো।‘
এইকথা বলেই আমি ক্ষিপ্রগতিতে তার কামরা থেকে বেরিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সকলে তীর থেকে ‘ধরো ধরো একটি মেয়ে মারা পড়লো। মেয়েটি পাগল বুঝি’ এই সব কথা বলে চিৎকার করতে লাগলো। আমি নদীর বুকে লাফিয়ে পড়লাম।
.
ভাসতে ভাসতে এক মাঠের কূলে এসে উপস্থিত হলাম। প্রকাণ্ড মাঠ, ইচ্ছা হল সমুদ্রের মতো এই নদীকে সামনে করে মরুর মতো বালির মাঠে সীমাহীনতায় ছবি দেখে,এই নিবিড় নির্জনতার ভিতর পড়ে থাকি।
কিন্তু এ কি! এখানেও মানুষ! একটা ধীবর-কন্যা মাছ ধরছিল। একটা মেয়ে তার। পাশে বসে খেলা করছিল।
এগিয়ে যেতে দেখতে পেলাম মেয়েটির হাত বাড়িয়ে আমার কোলে আসবার জন্য মা! মা! করছে। জানি না কেন? মায়ের স্নেহে প্রাণ ভরে উঠলো। ইচ্ছা হল মানুষের ভিতর একটা কুঁড়েঘর বেঁধে আমার হরিঠাকুর আর এই মেয়েটিকে নিয়ে আবার সোনার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু হায়! অনেক দিন আগেই সে স্বপ্নে আমার আগুন ধরে গিয়েছিল।
ধীবর বধূ মাছ ধরা ফেলে ছুটে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলে–“তুমি কে বোন।‘
আমি বললাম—’আমি তোমারই জাতি আমার একটি মেয়ে ছিল। কোথায় হারিয়ে গেছে। তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। মাঝগাঙ্গে নৌকা ডুবে আমার আর আর সঙ্গীরা কোথায় ভেসে গিয়েছে, তা জানি না। ভাসতে ভাসতে এখানে উঠে পড়েছি।‘
ধীবর-বধূ কাদ কাঁদ হয়ে বললে–“আহা! এমন বজ্রঘাত তোমার মাথার উপর পড়েছে। কবে তোমার মেয়েটি হারিয়েছিল? আমি বললাম–সে অনেক তথা প্রজাপতি নিয়ে সে খেলা করছিল, আমি অমনোযোগী হয়ে আপন মনে কাজ করছিলাম–মেয়ে আমার প্রজাপতি ধরাবার জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে কোথায় চলে গেছে তার ঠিকানা নেই।‘
ধীবর-বধূ জাল ফেলিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। বলিল–একে এই শোক তার উপরে নৌকা ডুবে সকলকেই হারালে। কোথায় তোমার বাড়ি তাও তুমি জান না। মেয়েমানুষ যখন তুমি কেমন করেই বা জানবে!
মনে মনে একটু হাসিয়া গম্ভীরভাবে বলিলাম-হ্যাঁ সতী যারা তাদের পক্ষে স্বামীর নাম, বাপের নাম, জেলার নাম এসব জানা বেহায়ামি, তা আমি জানি; নইলে আমি জেনে রাখতাম।
ধীবর বধূ বলিল–আহা তোমার এত দুঃখ! তোমাই এই রূপ, এই বয়স–তোমার মাথায় এমন বিপদ! কী করা যায় বোন? ভগবান আমাদিগকে যেভাবে রাখেন তাই ভালো। তুমি ধীবরের মেয়ে, আমিও ধীবরের মেয়ে। আমার মেয়েটি ছাড়া আর কেউ নাই। স্বামী আমার বহুদিন মারা গেছে, এই সংসারে একাকী নিঃসঙ্গ জীবন আমি অতিবাহিত করি। আজ হতে তুমি আমার বোন হও। দুটি দুঃখিনী স্ত্রীলোক একসঙ্গে থাকবো। দু’জনের দুঃখ এক করে সমানভাবে ভাগ করে নেবো, দু’জনের মনই হালকা হয়ে যাবে। চল আজ হতে তুমি আমার বোন। লোকে জিজ্ঞাসা করলে বলবো তুমি আমার কোনো দুরসম্পর্কীয়া বোন।
আমি কহিলাম–’বেশ, আর ঐ সোনার মেয়েটির মা দুজনেই হবো! দুজনেই ওকে মাতৃস্নেহে ভরে ফেলবো।
ধীবর বধু বলিল–আজ হতে ও মেয়ে তোমারই। ভগবানের নাম করে বলছি, আজ হতে ওর মা তুমি।
আমি কহিলাম–“তুমি তো আমাকে বসিয়ে খাওয়াতে পারবে না। কেমন করে জীবিকা নির্বাহ হবে?
‘কেন ধীবরের মেয়ের আবার ভাবনা কী? আমরা তো আর বামন কায়েত বা মুসলমানের মেয়ে নই, যে পেটের দায়ে মরবো। মিথ্যা মানের ভড়ং করে পরদা টানিয়ে পাপ করতে বাধ্য হবো! আমরা ধীবরের মেয়ে, পেটের ভাবনা ভাবতে হবে না। জাল বুনে মাছ ধরে আমরা দশটা লোককে পোষাতে পারি। ভদ্রলোকের বৌ-কি ঘরের কোণে ভাতের জ্বালায় কুকুরের মতো ঝাটা লাথি খেয়ে কেঁদে মরুক। আমরা দুই বোনে জাল বুনবো–মাছ ধরবো, সুখে কাল কাটিয়ে দেবো। তা ছাড়া তুমি দুই দশ দিনকাজ না করলেও কিছু বয়ে যাবে না। আমি এত দুঃখিনী নই। মাথা যেন আমার কেমন হয়ে এসেছিল। পরক্ষণেই মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে সে ভাবটা দূর হয়ে গেল। আমি বললাম–যখন খুব ছোট ছিলাম তখনই ঠাকুর দিদির কাছে বসে জাল বুনোনা শিখেছিলাম। বিয়ে হবার পর থেকেই আর কোনো কালে জালে হাত দিই নি। সব বোধহয় ভুলে গেছি। আমাকে জাল বুনোনো শিখিয়ে দিতে হবে। মাছ ধরার কৌশলগুলি আমাকে বলে দিতে হবে।
ধীবর বধূ বিস্মিত হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি একটু ভীত হলাম।
কে কহিল–“আচ্ছা সব ঠিকঠাক হবে। তুমি তোমার মেয়েকে কোলে নাও। আমি আমার জালখানা আর মাছের ঝাঁকা কাঁখে নেই।”
সেই মাঠ পার হয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে আমরা লোকালয়ে আসিলাম। একখানা ঘর আর একখানা রান্নাঘর। আমাদেরকে দেখে পাড়ার কয়েকটা মেয়ে এসে ধীবর-বধূকে জিজ্ঞাসা করেলে, ‘এ মেয়েটি কে?’ সে বললে ‘আমার দিদি। আমাকে দেখতে এসেছে। আর যাবে না, এখানেই থাকবে।’
.
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
কয়েক মাসের ভিতর আমি জাল বোনা আর মাছ ধরতে বেশ পটু হলাম। তুমি হয়তো বিস্মিত হতে পার, আমি কেমন করে ধর্ম বিসর্জন করে জেলেনী হয়ে পড়লাম। ধর্ম আমার ‘মনের ভিতর ছিল। আমার ধর্ম আমার কাছেই ছিল। কেউ তো কেড়ে নিতে পারে নি। আমার বিশ্বাস ধর্ম অপবিত্রতা আর পাপে নষ্ট হয়; কারোর জল খেলে ধর্ম নষ্ট হয় না। যে আমাকে ভালবাসে, যার কাছে আমার উপকার পাই তাকে ঘৃণা করলেই আমার জাতি যায়।
মাঠ থেকে আর ডোবা থেকে আমরা মাছ ধরাতাম আর বাজারে বিক্রয় করতাম! কোনো দিন আমার এই নূতন বোনটির সহিত ঝগড়া হয় নাই। যে পয়সা উপায় করতাম সব জেলে-বধূকে দিতাম। তার মেয়েটির নাম রেখেছিলাম ‘আলতা’।
আলতা তার আপন মাকে ভুলে আমাকেই বেশি ভালবাসতে আরম্ভ করলে। আমার তাকে কোলে করতে কোনো ঘৃণা হতো না। নিজেকে আমি বেশ করে ভুলে তাকে আঁকড়ে বরতে শিখেছিলাম।
সব ভেদ নষ্ট হয়ে গেল। দুই জনের খাটুনীর ফলে আমাদের প্রচুর আয় হতে লাগলো। কোনো কষ্ট ছিল না।
সাত বছর আমার এখানে কাটে। তার পর একটা ঘটনা ঘটেছিলো যাতে আমার মাথা আবার খারাপ হয়ে উঠলো।
গ্রামে কয়েকটা ছোঁকড়া যুবক আমাদের উপর বিশেষ অনুগ্রহ দেখাতে আরম্ভ করলে। হাটের ভিতর মাছ নিয়ে এলে তারা আমার মুখপানে চেয়ে চেয়ে থাকত।
এর পর দিনে-দুপুরে কত পুরুষ আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে আরম্ভ করলে। বিধাতার সংসারে যেন একটুকু নিরাপদ স্থান নাই।
একটা যুবক–তার নাম রমেন্দ্র বোস। অনর্থক একদিন সে আমাকে মামি বলে ডাকলে। বিরক্ত হলেও আমি তার উপর একটু স্নেহপ্রাণ হয়ে উঠলাম। আলতার মা একদিন আমায় বললে, দিদি, এই যুবকটি বোসেদের বাড়ির ছেলে। কিছু বলবার যো নাই। তুমি সাবধানে থেকো, ওর মামি বলাকে বিশ্বাস করো না। মামি বলতে সে একদিন তোমার বুকে ছুরি বসাতে পারে।
আমি আলতার মাকে তার সতর্কতার জন্য খুব আশীর্বাদ করে বললাম ”দিদি, সে সম্বন্ধে তুই কিছু ভয় করিস না। মেয়ে মানুষ যদি তার সতীত্বের জন্য একবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, তা হলে কেউ তাকে কুপথে নিতে পারে না।”
মাথার কাছে একখানা বঁটি রেখে আমরা শুয়ে থাকতাম। একদিন দুপুর রাতে শুয়ে আছি সহসা শুনতে পেলাম কে যেন বেড়া কাটছে। ব্যাপারখানা ভালো করে বুঝবার জন্য ধীরে ধীরে আলতার মাকে তুলে বেড়ায় ছিদ্র দিয়ে দেখতে পেলাম সাতজন যুবক, তাদের পাণ্ডা আমার ভাগিনা রমেন্দ্র বোস।
রমেন্দ্র বোস ধনীর সন্তান। সে এই রাত্রে তার এয়ার-বন্ধুকে নিয়ে কেন এসেছে তা আমার বুঝতে বাকি রইল না।
আলতার মা ভয়ে কাঁপছিল আমি তাকে সাহস দিয়ে বলল–“কোনো ভয় নাই।” ধীরে বেড়ায় পাশ খুলে গেল। স্বচ্ছ আঁধারে দেখতে পেলাম রমেন্দ্র আমার দিকে এলো। আর একটি যুবক তার পরেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে আলতার মায়ের দিকে গেল। তার পর যা দেখলেম তাতে আর মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব না করে রমেন্দ্রের ঘাড়ে বঁটি দিয়ে এক প্রচণ্ড আঘাত করিলাম।
প্রচণ্ড আঘাত ব্যর্থ হল না। রমেন্দ্রের মাথা দেহ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
‘বাপরে মলুম’ বলে অন্য যুবকটি কুকুরের মতো বেগে কাটা পথ দিয়ে পালাল; সঙ্গে সঙ্গে অন্য যুবকটি ভীত হয়ে কে কোথায় কোনো পথ দিয়ে পালিয়ে গেল।
আলতার মা ভয়ে চাপা গলা কেঁদে উঠলো।আমি বললাম–“তুমি ভীত হয়ো না। যত বিপদ সব আমার ঘাড়ে।”
তাড়াতাড়ি আলো জ্বলে দেখলাম রমেন্দ্রনাথ বিচ্ছিন্ন মাথা বেড়ার পাশে পড়ে আছে। কী বিকট চাহনী! সমস্ত ঘর রক্তময়! গায়ে রক্ত লেগে গিয়েছিল। দুইজনে বাহির হয়ে গা ধুয়ে এলাম। আলতার মা কাঁদছিলো।
.
বিংশ পরিচ্ছেদ
সকাল বেলা বাড়ি লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। আমি কিছুমাত্র ভীত না হয়ে বল্লাম–সতীর সর্বনাশ করতে এলে এমনি করে শাস্তি ভোগ করতে হয়। রমেন্দ্রকে আমি খুন করেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে চৌকিদার, জমাদার, দারোগা ও রমেন্দ্রের বৃদ্ধ বাপ এসে শান্তভাবে হাজির হল।
আমি সকলের কাছে স্বীকার করলাম আমি খুন করেছি। সকলে অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
আলতার মা তখনও কাঁদতেছিল। রমেন্দ্রের বৃদ্ধ পিতা চোখে একটুও জল দেখলাম। ঘৃণায়, লজ্জায় তার মুখ কালি হয়ে গিয়েছিল।
বৃদ্ধ আমার দিকে চেয়ে বললো–’বেশ করেছ মা। আমাদের দেশে এখনও যে এমন বীর রমণী আছে তাতে আমি সুখী হচ্ছি। পুত্র-শোকের দারুণ আঘাতের মধ্যে তোমাকে আমি আশীর্বাদ করছি।’
দারোগা কিন্তু তার শান্তভাব বেশিক্ষণ বজায় রাখল না। সে এবং তার বন্ধু চৌকিদার ও সিপাই আমাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে আরম্ভ করলে। ক্রোধে আমার সর্বশরীর জ্বলে গেল, মাথা আমার কেমন হয়ে উঠলো। আমি দারোগাকে লক্ষ্য করে বল্লাম-দেখ দারোগা! দুঃখিত ও উৎপীড়িতের সেবার জন্যই তুমি নিযুক্ত হয়েছ। অসৎ উপায়ে অর্থ উপায়ের জন্য তোমার গালি দিবার কোনো ক্ষমতা নাই! দারোগা আমার মুখের উপর লাথি নিয়ে এলো। তার দেশওয়ালী কুকুরগুলো আমাকে পৈশাচিক ভাষায় সম্বোধন করতে আরম্ভ করলো। দারোগাকে কহিলাম–’দারোগা! তোমার মতো নরপিশাচকে সরকার কেন নিযুক্ত করেছেন? সকল কর্মচারী অপেক্ষা তোমাদের অধিক মনুষ্যত্ব আবশ্যক! আর এই কুকুর সিপইগুলিকেই বা সত্য ও ন্যায়ের রক্ষকরূপে কেন নিযুক্ত করা হয়েছে। আমার প্রতি এই দুর্ব্যবহার উপস্থিত নিরীহ ধীবরেরা দেখছিলো। তারা আমার কথায় অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়লো।
দারোগা আর সিপাইগুলি তাদেরকে ধমক দিলে। ফলে একজন মোটা সোটা পালোয়ান ধীবর দারোগার মাথার উপর লাফাইয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে সিপাইগুলিও আক্রান্ত হল। বাড়িখানা শন্তি ও বিচারের স্থান না হয়ে, মারামরি ও সোরগোলের আড্ডায় পরিণত হলো। দারোগার নাক ভেঙ্গে রক্ত বেরোতে লাগলো। তাড়াতাড়ি একখানা মাদুর পেতে দারোগার মাথায় জল ঢালতে লাগলাম। প্রায় এক ঘণ্টা অতীত হবার পর দারোগা চৌকিদারকে ডেকে ঘোড়া আনতে বললে। ইতোমধ্যে অন্যান্য ধীবরেরা আপন আপন বাড়িতে চলে গিয়েছিল। দারোগা যাবার সময় বললেন, তোমাদের কোনো ভয় নাই, আমি শালাগুলোকে একবার দেখাবো!’ চারজন লোক রমেন্দ্রর শবদেহকে ঘাড়ে করে দারোগার পিছনে পিছনে চললে।
দুদিন পরেই শুনতে পেলাম এক শত সিপাই বন্দুক আর তলোয়ার নিয়ে গ্রাম ঘেরাও করেছে। আলতার মা আবার কাঁদতে আরম্ভ করলো। আমি হাসিয়া কহিলাম–“খুন করলাম আমি। সিপাই এসেছে সেদিন যারা তাদের কাজে বাধা দিয়েছিলো তাহাদের ধরতে। তুমি কাঁদ কেন?”
ধীবরেরা দমিবার পাত্র নয়। তারা বন্দুকের গুলিকে রোধ করবার জন্য কাপড়-কাচা পাট আর কুঠার দা চবক্, কেহ-বা সড়কি নিয়ে সিপাইদের সম্মুখীন হল। তার পর ভীষণ লড়াই বেঁধে গেল। সে ভীষণ লড়াইয়ের কথা কী বলবো! কী ভয়ানক রক্তারক্তি!
ভয়ানক চিৎকার! কী ভীষণ আর্তনাদ! সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই হল। সন্ধ্যার নিবিড় আঁধারের সঙ্গে সঙ্গে লড়াই থেমে গেল।
সিপাইরা রাত্রির জন্য কোথায় গেল জানি না, পরদিন সকাল বেলা দেখতে পেলাম সমস্ত গ্রামখানি শূন্য। একটা প্রাণী সেখানে নাই। গ্রামের সমস্ত লোক ঘরবাড়ি খালি করে। কোথায় চলে গেছে।