১১-১৫. ইমাম বাড়ির হাসপাতালের খাতা
একাদশ পরিচ্ছেদ
”১৮–” সালের ইমাম বাড়ির হাসপাতালের খাতা খুলে দেখতে দেখতে পাওয়া যাবে একটি কলেজের ছেলের নাম।
আবু মহম্মদ আবদার রহমানের নিউমোনিয়া হয়েছিলো, চিকিৎসার জন্য কলেজ থেকে তাকে হাসপাতালে পাঠান হয়েছিল। এক মাস কেটে গেছে। একটু ভালো হয়েছে। হাসপাতালে যে দিকে মেয়েমহল তাহারই অতি নিকটে অবদার রহমানের সিট। হাসান সেখানে প্রায়ই আসেন। বন্ধুর নীরব-হাসপাতালের দিনগুলি সরস করবার জন্য হাছান বই, খবরের কাগজ প্রত্যহ দুই-তিন ঘণ্টা করে আবুর শিয়রে বসে পড়েন।
বন্ধু এত পরিশ্রম ও যত্ন লইলেও তার দিনগুলি বড় বিরক্তিকর হইয়া উঠিয়াছিল। সম্প্রতি আজ কয়েকদিন হল একটা জোছনার মতো ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে তাহারই পাশের কামরায় এসে বাস করিতেছেন। যুবতাঁকে দেখলে খুব বড় ঘরের মেয়ে বলেই বোধ হয়। তাহার মায়ের হাত পচে গিয়েছিল। কারণ কি তা আবু জানতে পারেন নি। মায়ের শিয়রে একখানা চেয়ার পেতে মেয়েটি রাতদিন বসিয়া থাকে। একটুও তার মুখে বিরক্তির ভাহার নাই।
যুবতী অসাধারণ সুন্দরী। রানীর মতো তাহার সর্বাঙ্গ মহিমা ও সম্পদে ঘেরা। রাতদিন সে মায়ের শিয়রে বসিয়া মাতৃভক্তির পরিচয় দিতেছিল। আবুর মনে ধীরে ধীরে এই মেয়েটির প্রতি একটা শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়া উঠিল।
মাঝে মাঝে দুই তিন ঘণ্টা একযোগে বসিয়া থাকিয়া যখন সে ক্লান্ত হইয়া পড়ে তখন চেয়ারখানি টানিয়া বারান্দার রেলিঙ্গের ধারে বসিয়া বই পড়ে। আবুর মনে কৌতূহল উপস্থিত হইল। এমন সুন্দরী মেয়ে লেখাপড়াও জানে, অথচ কোনো পুরুষ মানুষ সঙ্গে নাই। একদিন সন্ধ্যাবেলা আবু ধীরে ধীরে লাঠিতে ভর দিয়ে রেলিঙ্গের পার্শ্বে যাইয়া দাঁড়াইলেন। মেয়েটিকে কি বলিয়া কি জিজ্ঞাসা করিবেন বুঝিতেছিলেন না। অনেক ভাবিয়া জিহ্বার আড়ষ্টতা অতি কষ্টে দূর করিয়া আবু ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিলেন ”আপনি ওখানা কী বই পড়ছেন?”
যুবতী সম্ভ্রমের সহিত উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল ”একখানা কোনো কাজের বই নয়। গল্পের বই মাত্র।”
আবু যুবতীর ভদ্রতায় অত্যন্ত মুগ্ধ হইয়া গেলেন। তিনি মধুর স্বরে বলিলেন ”গল্পের বই তো বাজে বই নয়। ভালো গল্পের বই চরিত্রগঠনে বিশেষ সহায়তা করে। মানবচরিত্রের বিপুল জ্ঞান জন্মে। সংসারের, মানব সমাজের ও মনের অনেক খবর গল্পের বইয়ের ভিতর দিয়ে লাভ করা যায়।”
যুবতী কহিলেন–“তা ঠিক–অনেক দৃষ্টি লাভ হয়।”
আবু পরিচয়ের একটু সুবিধা পেয়ে বললেন–“ইনি আপনার কে?”
সুরী কি বলিবে। তাহার সর্বাঙ্গ দিয়া বিদ্যুতের একটা প্রবাহ বহিয়া গেল। মুহূর্তের মধ্যে সুরী ভাবিয়া লইল–সব কথা আপাতত গোপন করিতে হইবে।
সুরী ধীর ভাবে বলিল, “উনি আমার মা।” সুরী মুহূর্তের মধ্যে ভাবিয়া লইল ভদ্রলোক কি কি কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। উচ্চমনা মানুষের সহিত মেশা সুরীর ভাগ্যে কখনও ঘটে নাই। সেও মানুষ। যদি এই সুযোগে একটা ভদ্রলোকের সহিত বা একটা উন্নত আত্মার সহিত সে একটু পরিচয় করিতে পারে তাহাও তাহার পক্ষে লাভ। সমস্ত পৃথিবীর কাছে সে ঘৃণার পাত্র। এই যুবকই যদি জানিতে পারেন তিনি একজন পতিতার সহিত কথা বলিতেছেন, তাহা হইলে লজ্জায় ঘৃণায় তিনি সরিয়া যাইবেন।
সুরী বলিয়া গেল–“এই রুগ্ন মহিলা তাহার মা, এ সংসারে তাদের কেউ নাই। বড় বিপদে তারা পড়েছে। যারা ছিল সবাই মরে গেছে, এক মা ছাড়া তার আর কেউ নাই।”
আবু হৃদয়ে অত্যন্ত দুঃখ অনুভব করিলেন। সহানুভূতিতে তার প্রাণ ভরিয়া উঠিল। সমস্ত রাত্রি সে একা মায়ের শিয়রে জেগে থাকে, কেউ তাকে একটু অবসর দিবার নাই। আবুর ইচ্ছা হইতেছিল এই রুগ্ন দেহেই সে যুবতীর মায়ের সেবায় একটু পরিশ্রম করে।
যুবতী আবুর মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া কহিলেন–“আপনি হয়তো আমার কষ্টের কথা ভেবে দুঃখিত হচ্ছেন। আমি একটুও কষ্ট অনুভব করি না। আপনি যদি আমার ভাই হতেন তবে আমি একা আপনাদের দুই জনের সেবা করতে বিরক্ত হতাম না।”
আবু যুবতীর এই অযাচিত স্নেহপূর্ণ হৃদয়ের পরিচয় পাইয়া একেবারে মুগ্ধ হইয়া গেলেন। ভাবিলেন, ঐরূপ দেব-বালিকার সন্ধান তিনি জীবনে কখনও পান নাই।
ক্রমে আর এক মাস কাটিয়া গেল। আবু সহিত সুরীর একটা অপার্থিব সম্বন্ধ জন্মিয়া গেল। প্রথম প্রথম আবু একটু লজ্জা অনুভব করিতেন। কিন্তু তাহার পর একটা প্রগাঢ় মমতার বলে আবু দু’টি নিঃসহায় ভদ্রলোককে অত্যন্ত আপনার জানিয়া ফেলিলেন।
আবুর স্বাস্থ্য ফিরিয়া আসিল। মোহিনীর অবস্থা ক্রমে অত্যন্ত শোচনীয় হইতে লাগিল। তার পর একদিন প্রাতঃকালে আবু হাসপাতাল ছাড়িয়া গেলেন।
হাসপাতাল একটা বিরক্তিকর স্থান হইলেও আবু এই দুই মাসের অবস্থানে এই বিশ্রী স্থানকেও অত্যন্ত ভালবাসিয়া ফেলিয়াছিলেন। আসিবার সময় সুরী তাহার জলে ভরা আঁখি অবনত করিয়া বলিয়াছিল–“আপনাকে ভাইয়ের মতো ভালবেসে ফেলেছি। আমাদের। খবর নিতে ভুলবেন না। আমাদের বাড়ি ৮নং … বাগানে।”
.
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
আজমপুরে আবু মহম্মদ আবদার রহমান তাহাদের পুরানো ছোট দালানের রকের উপর বসিয়া কাগজ পড়িতেছিলেন। বৈকাল বেলার শীতল বাতাস থাকিয়া থাকিয়া প্রবাহিত হইতেছিল। আবুর ছোট বোন আসিয়া বলিল–ভাইজান, চাচি আপনার সঙ্গে কি কথা বলতে চান। তিনি মায়ের কাছে অপেক্ষা কচ্ছেন।”
গ্রাম্য সম্পর্কে এমদাদ আলী মিঞার স্ত্রী আবদার রহমানের চাচি। বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নয়। তা ছাড়া দূর দেশ হইলে সামান্য সম্পর্কেও যেমন ঘনিষ্ঠতা হয়, গ্রামে আবার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা বলিয়া কেউ কাকেও স্বীকার করে না। কেউ কাকেও ঘনিষ্ঠ পরিচয় দিতেও ইচ্ছা করে না।
আবু বুঝিতে পারিয়াছিলেন–তাঁর চাচি কি জন্য তার কাছে আসিয়াছেন। তিনি এমদাদ আলী সাহেবের স্ত্রীর নিকট যাইয়া সালাম করিয়া কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন।
এমদাদ মিঞার স্ত্রী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বল্লেন–“বাবা! ঘরে যার সেয়ানা মেয়ে, তার কাছে কুশল জিজ্ঞাসা করো না! বুকের রক্ত ভাবতে ভাবতে পানি হয়ে গেল।”
আবু দুঃখপূর্ণ স্বরে বলিলেন–“তা ঠিক চাচি! আমার যতদূর সাধ্য তা আমি কচ্ছি এবং করবো।”
এমদাদ মিঞার স্ত্রী জলে চক্ষু ভারিয়া আবুকে আর্শীবাদ করিয়া বলিলেন–“তোরা তো পর নস বাবা। আমার মেয়েও যা, তোর বোনও তাই।”
আবু জিজ্ঞাসা করিলেন–“সম্প্রতি হাছানের বাপের সঙ্গে আর কোনো কথা হয়েছে কি?”
এম-স্ত্রী-তিনি তো অনেক দিন থেকেই আশা দিয়ে আসছেন। তত্রাচ ভরসা পাই না। মেয়ে ক্রমশ বেড়ে উঠছে, চিন্তায় রাত্রে ঘুম হয় না। তুমি বাবা প্রাণপণে একটু চেষ্টা করো। যেন দু’কূল না হারাই।
আবু–আমেনা-লেখাপড়া জানে, কোরান পড়তে পারে, ফারসিও সে বেশ বুঝে। বাংলা-ইংরেজিও তার বাপের কাছে পড়েছে। মেয়ে আপনার সম্পূর্ণ উপযুক্ত। যারা মেয়েকে উপযুক্ত না করে ভালো বর খোঁজে তারা যার পর নাই অন্যায় করে। মেয়ে যার সঙ্গে সারাজীবন বসবাস করবে, তাকে একটু ভালো করেই পরীক্ষা করে, শিক্ষিত লোক বিয়ে করে। যা-তা একটা মেয়েকে একটা শিক্ষিত লোকের গলায় বেঁধে দিয়ে তার সারাজীবনের অভিশাপের পাত্র হওয়া ঠিক নয়। রান্না-সংসার ছাড়া আরও একটা সংসার আছে, সেটা আমাদের গ্রামের লোক বুঝে না, এটা বড় অন্যায় কথা।
এমদাদ মিঞার স্ত্রী আবুর মুখের দিকে তাকাইয়াছিলেন। তিনি সার জীবনের অভিশাপ–আর একটি জগৎ ইত্যাদি কথা বুঝতে না পারিয়া বলিলেন, “বাবা তোরা কত কি বই পড়েছিস–তোরা কত কথা জানিস–তুই যদি চেষ্টা করিস তা হলে তোর বোনের বিয়ে হতে দেরি হবে না। আমেনা লেখাপড়া জানে বাবা! তোরা ছাড়া আর তোর চাচির কেউ নাই। মৌলবী সাহেবের কথা ছেড়ে দাও। মেয়ের কথা বলে বলেন–আল্লাহ মানুষের সুখ-দুঃখের কথা সর্বদা চিন্তা কচ্ছেন। খোদার হাতে সব সঁপে দাও। তুমি আমি চিন্তা করে কী করবো।” কথা তো ঠিক-তাই বলে কি চিন্তা ছেড়ে বসে থাকা যায়।
আবু–তা তো ঠিক চাচি-আচ্ছা আপনি অত চিন্তা করবেন না। আমেনাকে আমি নিজের বোনের মতোই জানি। আমার দ্বারা যা হয় করবো।
এমদাদ–স্ত্রী–আচ্ছা তুমি মধুপুর কবে যাবে।
আবু ডাক্তার বলেছেন যত শীঘ্র সম্ভব যাওয়া আবশ্যক। এবার তো আর বাঁচবার আশা ছিল না।
এমদাদ মিঞার স্ত্রীর চক্ষু জলসিক্ত হইয়া উঠিল।
আবু–মাকে একবার দেখতে এলাম, নইলে ঐ পথ দিয়েই চলে যেতাম। দুই একদিনের মধ্যেই আমি যাত্রা করবো।
এম-স্ত্রী-আচ্ছা, তোমার যাওয়ার আগিই একবার হাছানের সঙ্গে দেখা করে গেলে ভালো হয় না। মুধুপুর গেলে৩/৪ মাসের মধ্যে তো তুমি ফিরে আসতে পারবে না।
আবু–আপনি ব্যস্ত হবেন না। প্রাণপণে আমি চেষ্টা করবো।
এমন সময় বাহির হইতে পিয়ন আসিয়া “সাহেব বাড়ি আছেন?” বলিয়া চিৎকার করিতে লাগিল। আবু এমদাদ মিঞার স্ত্রীকে পুনরায় ছালাম করিয়া বহিরে আসিলেন।
পিয়নের নিকট হইতে একখানি চিঠি গ্রহণ করিয়া আবদার রহমান দেখিলেন, পত্রখানি বন্ধু আহমদ হাছান লিখিয়াছেন।
চেয়ারখানি টানিয়া লাইয়া আৰু পড়িলেন। পত্রে লেখা আছে : ‘প্রিয় বন্ধু, অনেকদিন বাড়ি গিয়াছ। কোনো সংবাদ না পাইযা দুঃখিত আছি। সত্বর কুশল-কথা লিখিয়া চিন্তা দূর করিবা। পরীক্ষা শেষ হইয়া গিয়াছে। ভালোই লিখিয়াছি। খোদার ফজলে পরীক্ষায় কৃতকার্য হইব, কোনো সন্দেহ নাই। তোমার মধুপুরে যাইবার দেরি কত? অনর্থক বাড়ি যাইয়া বসিয়া থাকা অপেক্ষা ইচ্ছা করিয়াছি তোমার সঙ্গে মধুপুরে যাইব!
ইহাতে দুইটি সুবিধা বুঝিতেছি। প্রথম আমার দেশ দেখা হইবে, দ্বিতীয় তোমাকে একটু সেবা করিবার সুবিধা পাইব। আমি প্রস্তুত রহিলাম। তুমি কোনো দিন আসিবে জানিতে পারিলেই আমি ঠিকঠাক থাকিতে পারি।”
বন্ধু হাছানের সহানুভূতি ও প্রেমপূর্ণ পত্র পাইয়া আবদার রহমান যার পর নাই আহলাদিত হইলেন।
কালবিলম্ব না করিয়া পর দিন প্রাতঃকালেই তিনি টেলিগ্রাম করিয়া দিলেন ”আমি অদ্যই সন্ধ্যাকালে রওনা হইতেছি।”
.
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
হাওড়ার স্টেশন লোকে লোকারণ্য। মধুপুরের ট্রেনে রাত্রি আটটার সময় ছাড়ে। সেদিন জ্যোৎস্নায় সমস্ত জগৎ প্লাবিত। পূর্ব হইতেই দুইটি সেকেন্ড ক্লাস সিট রিজার্ভ করা হইয়াছিল। সঙ্গে একটি মাত্র চাকর।
হাছানের তামাক টানিবার অভ্যাস ছিল। দিনরাত্রি সমানভাবে চলিত। আবু তামাক পান কিছুই স্পর্শ করিতেন না, বন্ধুর বিরক্তি উৎপাদনের ভয়ে হাছান জানালার পার্শ্বে যাইয়া অনবরত ধূমপান আরম্ভ করিলেন।
গাড়ি যখন আসানসোলে পৌঁছিল তখন একটা বাঙালি প্রৌঢ়া পাগলী গাড়ির দরজায় ধাক্কা দিতে লাগিল। তাহার চেহারা দেখিয়া মনে হয় সে কোনো উচ্চ বংশের মেয়ে ছিল। তাহার আঁখিতে যেন একটা উদাস ও গভীর দৃষ্টি মাখান। সে আসিয়া অত্যন্ত দৃঢ়স্বরে দরজা। খুলিতে বলিল। হাছান তামাকের নল হাতে করিয়া ঘুমাইয়া গিয়াছিলেন। সে গাড়িতে আর কোনোও আরোহী নাই। সুতরাং বাধা দিবার কেহ ছিল না। আবু যন্ত্রচালিতের মতো অগ্র পশ্চাৎ না ভাবিয়া দরজা খুলিয়া দিল।
পাগল যে রূপ করে এই প্রৌঢ়া রমণী সেরূপ বিশেষ কিছু করিল না। গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়াই সে বললে, “বাবা। আমি পাগল, সময়ে সময়ে আমার মাথা ঠিক হয়।”
আবু জিজ্ঞাসা করিলেন–“তোমার বাড়ি?”
পাগলী কহিল–“নদীয়া।”
আবু অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া কহিলেন–“নদীয়ায়?”
পাগলী ধীরভাবে কহিল–“হ্যাঁ, নদীয়ায়।”
পাগলী ভীতিহীন মনে জিজ্ঞাসা করিল–“তোমার বাড়ি?”
আবু বিরক্তি প্রকাশ না করিয়াই উত্তর দিলেন ”নদীয়া, আজমপুরে!”
পাগলী অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া কহিল–“আজমপুরের হরিঠাকুরকে চেন? তার বৌকে চেন?”
আবু কহিলেন ”হ্যাঁ চিনি, নাম তার শান্তা; তার মেয়ে নদীর ঘাটে হরিয়ে গিয়েছিলো। তিনি যখন বাড়ি ফিরে এলেন তখন থেকে আর কেউ তাঁকে কথা বলতে বা হাসতে দেখে নি। একদিন তিনি বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গেলেন! আর সন্ধান হল না। তখন তাঁর যুবতী বয়স। এখনো তাঁর কথা মনে হলে আমাদের দুঃখ হয়। আমাদের অনেকখানি শ্রদ্ধার পাত্র তিনি ছিলেন।”
প্রৌঢ়া বলিল–“আমি সেই!”
বর্ষাকালে মাঠের মাঝে কোনো বালকের মাথার কাছে বজ্রনিনাদ হইলে সে যেমন চমকিত হয়, আবু তেমন চমকিত হইলেন। এই সেই হরিদয়লের বৌ। আবুর সর্বাঙ্গ দিয়া একটা স্পন্দন ছুটিয়া গেল। এই চলন্ত গাড়ির মাঝে কত বছর আগেকার সেই বৌটি, কতকাল ব্যাপী হাজার বিচিত্রতার দাগ নিয়ে, আপ তারই সম্মুখে উপস্থিত। কী বিস্ময়! কী আশ্চর্য!
আবু তাড়াতাড়ি বেঞ্চ ছাড়িয়া মাটিতে বসিয়া পড়িলেন। তার পর তিনি বিছানা হইতে কম্বল টানিয়া মাটিতে বিছাইয়া রমণীকে বসিতে অনুরোধ করিলেন। রমণী কম্বল সরাইয়া রাখিয়া কহিল–“আর সম্মান চাহি না।”
আবু কথা বলিতে পারিতেছিলেন না। শুধু ভাবিতেছিলেন,এত বছর পর হরি ঠাকুরের বৌয়ের তার সঙ্গে এই চলন্ত গাড়ির ভিতর দেখা হইবার কারণ কি? আর এক কথা–সে তো পাগল। এত শৃঙখলা মতো সে কেমন করিয়া কথা কহিতে পারিতেছে?
রমণী বলিলেন–“আজ বহু বৎসর তোমার সন্ধানে আছি–তুমি আমার মেয়ের খবর জান। বল আমার মেয়ে কোথায়?”
আবু ভীত হইয়া পড়িলেন–হরিদয়ালের মেয়ের সঙ্গে তার কী সম্বন্ধ? তার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আজ বহু বৎসর রমণী ঘুরিতেছে–তারই বা অর্থ কী?
আবু একটু ভীতির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করিলেন–“আমি আপনার মেয়ের সংবাদ জানিলাম কেমন করিয়া?” আবু বিস্ময়ে পুনরায় ভাবিলেন–এক গ্রামের লোক, হরিদয়াল ঠাকুরের স্ত্রী আজ এত দীন ও মলিন বেশে তার সম্মুখে। কোনো কালে শান্তার সঙ্গে সামনাসামনি তার দেখাশুনা বা পরিচয় না থাকিলেও দুঃখে ও সহানুভূতিতে আবুর মন ভরিয়া উঠিতেছিল।
আবু অত্যন্ত বিনীত শ্রদ্ধার কণ্ঠে বলিলেন–“আমি আপনার মেয়ের সংবাদ জানি কেমন করিয়া, দয়া করে বলুন।”
রমণী বলিলেন–“শোন–যেদিন হুগলী থেকে বাড়ি ফিরে যাই সেদিন মনে হচ্ছিল–সংসারে ধর্ম নাই। সংসারের সকল লোকগুলোকে নাপিশাচ বলে মনে হচ্ছিল–ভাবছিলাম মিথ্যা ধর্ম-মিথ্যা ঈশ্বর-মিথ্যা দেবতা-মিথ্যা পূজা!
একটা ভীষণ যাতনায় আমার গলা বন্ধ হয়ে আসছিল–চোখে আমার জল ছিল না। একখানি ছোরা হাতে করে সংসারে সব মানুষগুলোকে খুন করার দারুণ বাসনা হচ্ছিল। ভাবছিলাম যাবৎ একটা মানুষ এ জগতের অত্যাচার ভোগ করে তাবৎ মানুষ কেন উপাসনা করে? এ পূজাগুলিই বা কী? আমাকে এমনি করে পাগল করে ভগবানের কি সুখ হয়েছিল? এটা কি পরীক্ষা? রাক্ষসী আমি; এ পরীক্ষার কোনো মূল্য বুঝি না। এ জগতে এত দুঃখ ও বেদনা কেন? জগৎ যদি সৃষ্টি না হতো তা হলে কে এত দুঃখ ভোগ করতো, কোথায়ও মানুষ স্বর্ণসিংহাসনে বসে স্বর্গসুখ অনুভব করছে,কোথায় মানুষ দুঃখ ও বেদনায় চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
আমি সেদিন কী যাতনা ভোগ করছিলাম তা কয়েকজন যুবক ছাড়া আর কেউ তো জিজ্ঞাসা করলে না! চন্দ্রসূর্য তেমনি করে উঠেছিল। মানুষের সমাজ তেমনি করে বয়ে যাচ্ছিল। সমস্ত সংসারটা সেদিন পাপ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠলো না কেন? মানুষ কি উপাসনা করে! সে জ্বালার মীমাংসা কোথায় ছিল? চোখের সামনে আমার সোনার শিশুকে চুরি করে নিলে! তখন আকাশ থেকে বজঘাত হল না! কিন্তু আমার শিশুর হাসি,তার সুষমা অমার বুকের কোণায় বেঁধে ছিল। কোনো পাষণ্ড আমায় এমনি করে শ্মশানে বসবার আদেশ দিয়ে গেল?
মানুষ অন্যায় ও পাপ করে। তাদের বুক কাঁপে না, তাদের হাত অবশ হয়ে যায় না। আরও বিচিত্র এই অন্যায় ও পাপের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে মানুষ উপাসনা করে। এরই বা অর্থ কী?
বাড়ি এলেম, কিন্তু কী বিস্ময়? শাশুড়ি এলেন আমাকে মারতে। আমারই অমনোযোগিতায় খুকি হারিয়ে গিয়েছে–এই তিনি বল্লেন। আমি হাসি সংবরণ করতে পারলাম না। আমার হাসি দেখে শাশুড়ী আমাকে ঝাঁটা দিয়ে মারলেন। তিনি বললেন–হৃদয়হীনা রাক্ষসী! বুকে তোমার কিছুমাত্র মায়া নেই।”
এতক্ষণে রমণী ‘ভগবান’ বলিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন।
তার পর আবার বলিতে আরম্ভ করিলেন–“স্বামী হরিদয়াল বুঝেছিলেন আমার সেই হাসির অর্থ কী? দেখতে পেলাম আমার হাসি দেখে তিনি কেঁপে উঠলেন। মায়ের সামনে তিনি কোনো কথা বলতে সাহস করলেন না। তাঁর কথা মনে হলে আমি পাগলী হয়েছি তবুও আমার বুক ফেটে যায়! বালিকা বয়সের স্বামী তিনি আমার। যেদিন বিবাহ হয়, সেদিন প্রাণের শত আশা-আকাক্ষার সিংহাসন গড়ে তাকে সেখানে বসিয়েছিলেন। কোথায় আমার হরি? কয়েকদিন তার সঙ্গে স্বপ্নের ঘর বেঁধেছিলাম। জীবনটা পথে পথে কেটে গেল।
শাশুড়ীর সঙ্গে সঙ্গে কয়েকদিনের মধ্যে আমি সকলেরই শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছিলাম, শ্রদ্ধা হারিয়েছিলেন না কেবল তারা। আমার দিকে চাইতেই তিনি কেঁদে ফেলতেন। পাছে কেউ দেখে তাকে দুর্বল বলে নিন্দা করে; এই ভয়ে তিনে তাড়াতাড়ি আমার সম্মুখ হতে সরে যেতেন।
বলতে ভুলেছি, বাড়ি আসাবার দুদিন পর থেকে শাশুড়ী আমার শোবার জন্য স্বতন্ত্র ঘর করে দিলেন। সকলে বললে, আমি পাপী না হলে এমন বজ্রাঘাত আমার মাথার উপর পড়ে? শাশুড়ী বল্লেন, প্রায়শ্চিত্ত না করে তার বিছানার ত্রিসীমানায় আমি না যাই। আমার নিশ্বাসে অমঙ্গল আছে। আমি রাক্ষসী। আমি পূর্বজন্মে ডাইনী ছিলাম। নইলে দিনে-দুপুরে কোলের মেয়েকে হারিয়ে ফেলি? সেদিন আমি কাউকে গ্রাহ্য না করে খুব করে হেসেছিলাম।
নিশীথে একাকী নিঃসঙ্গ হয়ে শুয়ে আছি। দুপুর-রাতে দেখতে পেলাম শিয়রে দাঁড়িয়ে স্বামী কাঁদছেন। একটা দ্বিতীয় রকমের যাতনায় মন আমার অস্থির হয়ে উঠেছিল–সংসারের একি অত্যাচার? অধর্ম, মূর্খতা আর অন্যায়-মুরুব্বী এবং ধর্মের সাজে এত মানুষকে পশু করে তুলেছে। মানুষের জন্য এত দুঃখ রচনা করছে।
মনে হল এই পাপে ভরা সংসারে আর থেকে কাজ নাই। কয়েকদিনের ভেতর দেখতে পেলাম, স্বামীও যেন কেমন হয়ে গেছে। যে আসে সেই বলে এই ডাইনীকে ঘরে রেখে ভালো হবে না। একে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দাও। মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে একেও গঙ্গার ঘাটে রেখে আসতে পার না। যদি ভালো চাও তবে বৌয়ের সঙ্গে সমস্ত সম্বন্ধ ত্যাগ কর।
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো! স্ত্রীলোকের মনের উপর এত অত্যাচার! সমস্ত সংসারটা যেন একটা অগ্নিময় নরক বলে আমার বোধ হল। বেশ বুঝলাম সংসারে ধর্মের নাম গন্ধ নাই। সব মানুষই শয়তানের উপাসনা করে।
মাথা ক্রমেই খারাপ হয়ে উঠলো। মানসিক অবস্থা ক্রমে অতি ভয়ানক হল। একটি মানুষও সহানুভূতি জানাতে থাকলো না। স্বামী মানুষের কথায় অত্মশক্তি বজায় রাখতে পারলেন না। সেই ধর্মহীন পশুগুলোর কথায় আমার আত্মা নূতন চিন্তা ও বিদ্রোহে অতি ভীষণ হয়ে উঠলো।
আমি পাগল হয়ে একদিন বেরিয়ে পড়লাম। আমি ঠিক পাগল হয়েছিলাম না। সকলে আমাকে নূতন রকমের দেখে পাগল বলতে আরম্ভ করলে। পাগল মানি কী? যার চিন্তা ও ভাবের সহিত সংসারের দশজলে সহিত মিল খায় না, সেই তো সমাজে পাগল বলে পরিচিত হয়।
একটা নূতন রকমের ভাবে ও উত্তেজনায় আমি উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠলাম।
পাপ সংসার হতে একটা অসীম বেদনায়, একটা প্রচণ্ড আশাতে, একটা নূতন শক্তির উত্তেজনায় যাকে পাই তাকেই গালি দিয়ে–চোখে একটা ভীষণ ও রুদ্রভাব মেলে বেরিয়ে পড়লাম।
.
চুতুর্দশ পরিচ্ছেদ
”তখন দুপুর বেলা–মাঠ ধু-ধু করছিল। প্রখর সূর্যতাপে মাঠের ভিতর মরুর অভিনয় হচ্ছিল। আমি হন হন করে সেই পথ দিয়ে চলতে লাগলাম।
ধীরে ধীরে স্বামীর বাড়িখানি দূরে মিশে গেল। কোনো মায়া হচ্ছিল না। আমার অকৃত্রিম স্বামী প্রেম দারুণ ঘৃণায় পরিণত হয়েছিলো। হায়, মানুষের মন কী বিচিত্র! এত প্রেম দুদিনেই ছাই হয়ে গেল।
তারা মনে করেছিলো–আমি ফিরে যাব। কিন্তু ফিরলাম না। মানুষের সোজা পথ ফেলে বন অতিক্রম করতে করতে ঘুরে ঘুরে দ্রুতপদে চলতে আরম্ভ করালাম কোনো ভয় হল না।
দিন চলে গেল! ক্রমে বনে বনে অন্ধকার জমাট বেঁধে উঠতে লাগল। ক্ষুধা ছিল না। মনে হচ্ছিল, ক্ষুধা হতে আমি মুক্ত হয়েছি। আর কোনোকালে ক্ষুধা হবে না। জঙ্গলের মধ্যে পাতা বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। রাত কোন পথে কেটে গেল।
সকাল বেলায় উঠে দেখি গাছের আগায় পাখিরা সব গান গাচ্ছে। মনে আনন্দ হল–একটা বিচিত্র ধরনের পাখি দেখে তাকে পেতে ইচ্ছা হল। অমনি পাখি ধরবার জন্য গাছের আগায় উঠে পড়লাম। আমি পূর্বে কখনো গাছে উঠি নি–তাতে কোনো অসুবিধা বোধ করলাম না।
নিষ্ঠুর পাখি আমার দেহকে অবহেলা করে, অথবা মানুষের মূল্যহীন পরিবর্তনশীল প্রেমকে ভয় করে উড়ে গেল। গাছের শীর্ষে দাঁড়িয়ে দেখলাম সীমাহীন উদার আকাশ, কতদূর আকাশ ও পৃথিবী একসঙ্গে মিশেছে! শ্যামল মাঠ। উত্তর-পশ্চিম দিকে একটা ছোট নদী বয়ে যাচ্ছিল। একটা ছোট গ্রাম তার পার্শ্বে অর একটা দেবতার মন্দির।
গাছ থেকে নেমে সেই দিকে চল্লাম। একটা বড় মাঠ হতে হলো। হাঁটতে হাঁটতে বেলা অনেক হয়ে গেল। গত দিন সন্ধ্যাকালে একটু ক্লান্তি অনুভব করেছিলাম, আজ সে ক্লান্তি নাই। আবার দ্বিগুণ উৎসাহ ফিরে আসিয়াছে।
গ্রামে ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছিল–সেইটাই মন্দির। মন্দিরের সামনে যেয়ে দাঁড়াতেই পূজারী বামন আমার দিকে একটা তীব্র কটাক্ষ নিক্ষেপ করলেন। যাঁরা দেবতার সামনে বসেছিলেন তারা দেবতার চিন্তা ছেড়ে, আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে আমার চিন্তা আরম্ভ করলেন। আমি সব বুঝতে পাচ্ছিলাম।
পূজা হতে আরও দু’ঘণ্টা লাগল। ব্রাহ্মণ মন্ত্র পাঠ করতে অনেকবার এদিক ওদিক চাইবার ভানে আমার রূপ দেখছিলেন। আমি তা বুঝে মনে মনে হাসছিলাম।
পূজা শেষ হল, ধর্ম-জনতা ভেঙ্গে আমার চারিপাশে নূতন জনতার সৃষ্টি হল–আমি অবাক হয়ে তাদের বিচিত্র ধর্মভক্তির কথা ভাবতে লাগলাম।
একজন জিজ্ঞাসা করলে, সুন্দরী! তোমার নাম?
আমি কহিলাম—”আমি কী তোমার ঘরের বৌ? সুন্দরী বলে আমাকে সম্বোধন করবার তোমার কী অধিকার আছে?”
আর একজন একটু বিরক্ত হইয়া একটু দয়ার সহিত জিজ্ঞাসা করলে, বাছা তোমার বাড়ি?
আমি কহিলাম-বাড়ি আমার বাংলাদেশে। সে আবার জিজ্ঞাসা করিল–“জাতি? আমি বিরক্ত হইয়া বলিলাম কী জাতি? তা দিয়ে তোমার কী? আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে?”
সকলেই হেসে উঠলো–একজন বললে ”তোমার বাবা কী জাতি ছিল?”
আমি কহিলাম “মানুষের জাতি কী? ঈশ্বর আছেন, মানুষ আছে। অমনুষের পিতা ঈশ্বর। আমি কোনো জাতির ধার ধারি না।“ ব্রাহ্মণ আসিয়া চিৎকার করিয়া বলিলেন, ‘মেয়েটিকে এত বিরক্ত করেছো কেন? পাগল মানুষ নিয়ে পূজার বাড়িতে রহস্য করা পাপ! যাও সকলে বাড়ি যাও।’
জনতা ভেঙ্গে গেল। তার পর ব্রাহ্মণ আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন–’বাছা, এই পূজার ঘরের সামনে বসে থাক। কারুর সঙ্গে কথা বলো না। মায়ের প্রসাদ এলে খেতে পাবে।
ব্রাহ্মণের অনুগ্রহে মুগ্ধ হলাম। মুহূর্তের মধ্যে যেন সংসারকে আপনার বলে মনে হল। আমি পূজা দালানের রকে বসে পড়লাম।
.
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
”কয়েক দিন সেখানে কেটে গেল। ব্রাহ্মণের স্নেহে মাথার গোলামাল অনেকটা কমে গেল।
একদিন নিশীথকালে শুয়ে আছি, দেখলাম–ধীরে দরজা খুলে যাচ্ছে। বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইলাম। সম্মুখে পূজারী ব্রাহ্মণ। কিছু কথা না বলে চুপ করে পরে থাকলাম। ভাবলাম ব্রাহ্মণের কোনো কাজ আছে।
কী আশ্চর্য! ব্রাহ্মণ ধীরে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো, তার পর যা দেখলাম তাতে মাথাটা আবার কেমন হয়ে যেতে লাগল, সহসা সংসারের উপর দারুণ ঘৃণা জমে এলো, বাঘিনীর মতো লাফিয়ে উঠে বললাম, ব্রাহ্মণ এ কি?”
সে যেন সহসা কেমন হয়ে উঠলেন। মাথা তার নুয়ে পড়লো! সে কাঁপতে কাঁপতে বল্লে–‘আমি ব্রাহ্মণ, দেবতার অংশ! আমাকে সন্তুষ্টি করলে পুণ্যি হবে। আমার বিরুদ্ধে কাজ করবার তোমার অধিকার নাই।’
সিংহিনীর মতো বললাম—’তুমি চণ্ডাল, ব্রাহ্মণ বলে যে তোমাকে স্বীকার করে সেও চণ্ডাল।’
ব্রাহ্মণ মৃদুভাবে উত্তর দিলো–’ব্রাহ্মণের কাজে সমালোচনা করতে যাবার তোমার কি ক্ষমতা আছে? আমি ব্রাহ্মণ! তুমি আমাকে ভক্তি করবে। আমার পাপ আমার কাছে। তোমাকে শুধু মানতে হবে আমাকে। শুধু আমাকে সেবা করবে।’
আমি কহিলাম—’কোন গর্দভ তোমাকে এ জ্ঞান শিখিয়েছে? এরি নাম ব্রাহ্মণত্ব! ব্রাহ্মণ কাকে বলে তা তুমি জান? পৈতা দিলেই ব্রাহ্মণ হয় না! যারা তোমাকে ব্রাহ্মণ বলে মানে, তারা ধর্ম না করে অধর্ম করে।’
ব্রাহ্মণ দৃঢ়স্বরে বলিল-‘বটে! আমি ব্রাহ্মণ নই! দেবতাকে অসন্তুষ্ট করে তুমি বেঁচে যাবে? এখনও বলছি আমাকে সন্তুষ্ট করো।’ এই কথা বলেই সে দুই হাত তুলিয়া আমার দিকে অগ্রসর হল? আমি প্রচণ্ড পদাঘাতে তাকে দূরে ফেলে দিলাম। তার মাথা ভেঙ্গে গেল।
ব্রাহ্মণ ক্রোধে কাঁপিতেছিল। সে হাত তুলে বললে—’দেখ মাগি, তুই কে তা আমি জানি, আমার সঙ্গে চালাকি! প্রতিজ্ঞা করলাম কাল রাতে মুসলমানের দ্বারা তোর জাতি নষ্ট করে ছাড়বো।’
আমি বলিলাম, তুমি ব্রাহ্মণ। তোমার অভিশাপে ফুলের বাগান শ্মশান হয়। আমাকে অভিশাপে ভস্ম করে দাও। মুসলমানকে ডাকা কেন?