০৬-১০. ঢাকা জেলার এক দ্বিতল গৃহে
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ঢাকা জেলার এক দ্বিতল গৃহে এক বিংশতি বর্ষীয় যুবক তাহার ভাবির সহিত রহস্য করিতেছিল।
সদাগর এবাদত আলী ঢাকা জেলার শ্রেষ্ঠ সদাগর। পুত্র এবাদ আলী বি. এ. পাস করিয়া জাপানে শিল্প শিক্ষা করিতে গিয়াছেন। ছোট ভাই এরশাদ স্কুলে পড়ে। এবাদত আলী আজ দুই বৎসর হইল পুত্রকে জাপানে পাঠাইয়াছেন। সদাশয় এবাদত অতিশয় অমায়িক ভদ্রলোক। পুত্রবধূ কুলসুম বাড়িতেই থাকেন। এরশাদের এখনও বিবাহ হয় নাই। সে স্কুলে পড়ে।
এরশাদ প্রাতঃকালে উপর-তলায় তাহার ভাবির ঘরে নাস্তা করিতে গিয়াছিল। খাইতে খাইতে এরশাদ ভাবিকে কহিল–“ভাবি, বড় ভাইয়ের আর আসবার দেরি কত? এই দুই বছর গিয়াছেন। বড় ভাই কেমন লোক ভাবি আপনার কষ্টের কোনো ধার তিনি ধারেন না।”
কুলসুম কহিলেন–“তোর তা দিয়ে দরকার কী? স্বামী ছাড়া হয়ে থাকলে বৌয়ের কষ্ট হয় কি না, যখন বিয়ে করবি বৌকে জিজ্ঞাসা করিস। এখন তার কী?”
“না ভাবি! রাগেন কেন? আমি কি আর মিথ্যে কথা বলছি।”
দেবরের রহস্য বুঝতে পেরে এরশাদের ভাবি বলিলেন–“সেটা কি আর মিছে কথা! কষ্ট? দারুণ কষ্ট। যখন বিয়ে করবে তখন যেন বৌয়ের কষ্ট বুঝতে ভুল না। স্বামী ছাড়া হয়ে থাকলে মেয়ে মানুষের যে কষ্ট হয় সেটা কি আর ঢাকবার কথা। দেখো তোমার বৌ যেন ১৫ দিনও তোমার অদেখা হয়ে না থাকে। নইলে সে লুকিয়ে লুকিয়ে কাদবে। লোকে জিজ্ঞেস করলে বলবে চোখে ধোয়া লেগেছে।”
“ভাবি আব্বা তো আমার বিয়ে দেবার নামও করেন না। তুমি তবে দেখ, মা কী বলেন? কুড়ি বছর তো কম বয়স নয়! রাত্রে ভাবি, বড় লজ্জার কথা। কী বলবো আপনাকে! মন কেমন করে। কাকে বলি, কিছু ভাল লাগে না। রাগে আমার গা জলে যায়। সকলেই মেয়েদের বিয়ের জন্য ব্যস্ত, আমরা যেন কেউ নয়।”
“তোমার পড়াশুনা খুব হবে! রাতদিন বৌয়ের ভাবনা ভাবে, না বইয়ের ভাবনা ভাবে? মাকে বলবো, এরশাদের আর পড়াশুনা হবে না একটা ফুটফুটে দেখে বিয়ে দাও। কেন আর বুড়ো বয়সে প্রাইভেট মাস্টারের তাড়না।”
“ভাবি! আপনার পায়ে পড়ি, অমন করে বলবেন না। ওতে বড় লজ্জা পাব, একটু ভালো করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলবেন। আচ্ছা ভাবি, আপনি যে ফুটফুটে একটা মেয়ের কথা বললেন, সে কি আপনার মতই সুন্দরী হবে?”
মেয়েমানুষ যেমন প্রকৃতির হউক না কেন, নিজের রূপের প্রশংসা শুনলে মনে মনে সে একটু আনন্দ অনুভব না করে পারে না। কুলসুম মনের ভাব গোপন করিয়া একটু উৎসাহিত হইয়া জিজ্ঞেস করিলেন–“কেন, তোমার ভাবি কি বড় সুন্দর?”
“কী বলেন ভাবি? আপনার মতো সুন্দরী মেয়ে ঢাকা শহরে নাই।”
কুলসুম দেবরের কাছে মনে মনে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হইয়া গেলেন। এমন করিয়া তাহার সৌন্দর্যের তারিফ এর আগে আর কেউ করে নাই। তাঁর স্বামীও কখনও তাহাকে মুখ ফুটিয়া বলেন নাই। ”কুলসুম! তুমি কত সুন্দর তুমি কত মধুর।”
চাঞ্চল্য ও ভালবাসার প্রকাশ কখনও তাঁর মুখে দেখা যেতো না। হাসির একটা রেখাও তাহার মুখে ফুটিয়া উঠিত না। সম্পূর্ণ কাজের ও সংসারী লোক বলতে যা বুঝায় তাই তিনি। প্রতিদিন অন্ধকারে দুইজনের দেখাশুনা–তাড়াতাড়ি হয়তো একটা ব্যস্ততা ভরা প্রণয়-সম্ভাষণ, তার পর সব শেষ! কেবল কাজ।
আজ এই দুই বৎসর যে সব চিঠি আসিয়াছে তাহাতে কেবল কঠিন পাথরের কুচির মতো কতকগুলি কথা সাজান। কোথাও একটু গন্ধ নাই। সবগুলিতেই লেখা থাকে–কাজের ভিড়ে পত্র লেখবার সময় হয় না। আব্বাকে আর আম্মাকে আমার সেলাম জানাইও। এখনো অনেক কাজ শিখিতে বাকি আছে। বাড়িতে থাকবে, আমাকে না বলে কোথাও যেও না–আর কিছু নহে।
এরশাদ আবার কহিল–“ভাবি, আপনার মতো সুন্দরী মেয়ে আমি কখনও দেখি নাই।”
কুলসুম কহিলেন–“থাম থাম ও ছোট মিঞা, আমার চেয়েও ভালো বৌ পাবে!”
“ভাবি, আপনার চুলগুলি জমাট বাঁধা মেঘের মতো। ইচ্ছা করে চুলের দিকে চেয়ে থাকি। আপনার মুখোনি দেখলে মনে হয় চাঁদের কথা।”
কুলসুম লজ্জিত হইতেছিলেন বটে কিন্তু মনে মনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও খুশি হইয়া উঠিতেছিলেন। তিনি বিরক্তির ভান করিয়া কহিলেন–“ঠাট্টা করো না। ভাবি বলে কি এত ঠাট্টা ভালো!”
এরশাদ কহিল–“ঠাট্টা! এসব ঠাট্টা। যদি মিছে কথা বলে থাকি তবে জিভ যেন আমার খসে পড়ে।”
.
সপ্তম পরিচ্ছেদ
এবাদ বড় লোকের ছেলে। টাকার অভাব নাই। জাপানের হুইট, হং স্ট্রীটে তাঁর বাসা। একটা ক্ষুদ্র সাজান কামরা।তার এ দূর জাপনে আসার আদৌ ইচ্ছা ছিল না। প্রথম প্রথম তাঁহার মন আদৌ টিকিত না। Tannery শিখিতে সেখানে গিয়াছিলেন। কাজ অনেক শেখা হইয়াছে। বন্ধুবান্ধব তার অনেক জুটিয়াছে। পুরুষ মেয়ে দু-ই।
পৌষ মাস। সন্ধ্যাবেলা র্যাপার গায়ে দিয়ে তিনি নিজের ছোট কামরায় বসিয়া আছেন, এমন সময় শুনিলেন, কে যেন তার দরজায় মৃদু মৃদু আঘাত করিতেছে। তাড়াতাড়ি দরজা খুরিয়া ফেলিলেন, একজন যুবতী জাপানি মহিলা তাহাকে নমস্কার করিলেন। যুবতীর পরনে মূল্যবান পোশাক। কোনো উচ্চ-বংশের কন্যা ভাবিয়া এবাদ ব্যস্তসমস্ত হইয়া সম্ভ্রমের সহিত তাহাকে একটা চেয়ারে উপবেশন করিতে বলিলেন। যুবতী বাক্য ব্যয় না করিয়া চেয়ারে উপবেশন কিরলেন।
অতঃপর কয়েক মিনিট উভয়ের মধ্যে, কোনো কথা হইল না। কি বলিয়া কি কথা আরম্ভ করিতে হইবে এবাদ বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না। অধিক্ষণ নীরবে বসিয়া থাক অসঙ্গত বিবেচনা করিয়া, এবাদ অত্যন্ত ভদ্রতা ও নম্রতা জানাইয়া যুবতাঁকে বলিলেন–“মহাশয়া! এই দীনের পর্ণকুটীরেতে আসিয়া অধীনকে অত্যন্ত সম্মানিত করিয়াছেন। আপনার এই আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি?”।
যুবতী ধীরভাবে কহিলেন–“হ্যাঁ, পারেন। নিকটেই আমার বাড়ি। আপনি আমাকে চিনলেও আমি আপনাকে চিনি।”
এবাদ আরও বিনীতভাবে কহিলেন–“আপনাকে আমি জানি না, সে জন্য আমি দুঃখিত। আপনি আমাকে জানেন শুনিয়া যার-পর-নাই আনন্দলাভ করিলাম অতঃপর আপনার আগমনের কারণ জানিতে পারিলে আরও আনন্দ লাভ করিব।”
যুবতী কহিলেন, “আপনার মিস্ ফিনির সহিত পরিচয় আছে কি?”
“হ্যাঁ আছে, তিনি আমার একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু।”
“তাহার অত্যন্ত অসুখ। তাঁহার বাঁচিবার আর আশা নাই। একবার তিনি আপনাকে দেখিতে চান।”
এবাদ অত্যন্ত দুঃখিত হইয়া কহিলেন–“বটে! মিস্ ফিনির অসুখ! এই সংবাদটি দিয়া আপনি আমাকে অত্যন্ত বাধিত করিলেন। অনুগ্রহ পূর্বক আমার সঙ্গে একটু যাবেন কি?”
“হ্যা! সেই উদ্দেশেই আমি এখানে আসিয়াছি। বাহিরে গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে। আপনি সতুর বেশ পরিধান করিয়া লউন। আমি বাহিরে অপেক্ষা করিতেছি।”
এই স্থানে মিস ফিনির একটু পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। সিঙ্গাপুর হইতে আসিবার সময় এই মেয়েটির সহিত এবাদের পরিচয় হয়। তিনি জাপানের এক প্রসিদ্ধ ডাক্তারের কন্যা। এই কুমারীর সাহয্যে মিস্টার এবাদের বাসা ঠিক হইয়াছিল। নূতন দেশে আসিয়া প্রথম যে অসুবধা ঘটিয়া থাকে, তার মীমাংসা মিস্ ফিনিই করিয়া দিয়াছিলেন। দিনে দিনে উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব জমিয়া উঠিল। মিস্ ফিনি ইউরোপীয়ান পোশাক পরিধান করিতেন।স্বর্ণবর্ণ উজ্জ্বল কেশগুচ্ছ, কোমল গণ্ডের রক্ত বিভা তাঁহাকে এবাদের চোখে বেশ সুন্দর করিয়াই দেখাইয়াছিল।
যে সুন্দরী মহিলা মিস্ ফিনির পীড়ার সংবাদ আনিয়াছিলেন তাঁহার পোশাকও ইউরোপীয়ান ধরনের। ঢেউ তোলা গাউন। শুভ্র মুখের উপর লাল রুমালখানি তাহাকে অভিনব করিয়া তুলিয়াছিল।
উভয়েই গাড়িতে যাইয়া বসিলেন। এবাদ তাহার বন্ধু মিস্ ফিনির পীড়ার কথা ভাবিতেছিলেন।
গাড়ির মধ্যে সুন্দরী অপর পার্শ্বে না বসিয়া মিস্টার এবাদের পার্শ্বেই বসিলেন। এবাদ বিস্মিত হইলেও কিছু বলিতে পরিলে না।
সুন্দরী যেন এবাদের মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া কহিলেন–“মহাশয় বিস্মিত হইবেন। আপনাকে দূরে রাখিয়া আমি নিজের মতো বসিয়া আরাম করিতে চাহি না। ইহাতে কোনো লজ্জা অনুভব করিবেন না।”
এবাদ বিস্মিত হইয়া ভাবিলেন–“কী জানি, হইতে পারে–জাপানের ইহাও একটা ভদ্রতার নিয়ম হইতে পারে।”
এবাদ অজ্ঞতার ভান করিয়া কহিলেন–“মহাশয়া! ক্ষমা করিবেন। জাপানি সভ্যতার সকল অংশের সহিত এখনও আমি পরিচিত হই নাই। আপনার সহিত আমার পরিচয় হইল। আশা করি, এ বন্ধুত্ব এক দিনের হইবে না। এতদিন আপনার সহিত আমার পরিচয় হয় নাই, তজ্জন্য আমি যথেষ্ট দুঃখিত। মিস্ ফিনির কাছে একদিনেও আপনার কথা শুনি নাই। আমার দুর্ভাগ্য বলিতে হইবে।”
এবাদ লক্ষ্য করিলেন যুবতীর আঁখি ক্রমশ সহজ দৃষ্টি হারাইল। সে যেন একটা অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে যুবতীর দিকে আকর্ষিত হইতেছে।
যুবতী কহিলেন–“জাপানি সুন্দরীরা মন হরণ করিতে পারে কিনা? তাদের সৌন্দর্য আপনার চোখে কেমন দেখায়?”
এবাদ কি উত্তর দিবেন ভাবিয়া পাইতেছিলেন না। দৃষ্টি অবনত করিয়া তিনি কহিলেন–“জাপানি মহিলারা বেশ সুন্দরী। তাহাদিগকে দেখলে মনে খুব তৃপ্তি জন্মে।”
যুবতী আবার কহিল–“বটে! আমাদের দেশের সুন্দরীকে দেখলে আপনার তৃপ্তি জন্মে। আচ্ছা, তাহাদিগকে আপনার ভালবাসতে ইচ্ছা হয়?”
এবাদ কি উত্তর দিবেন ভাবিয়া পাইতেছিলেন না। পাছে অদ্রার পরিচয় দেওয়া হয় এই ভয়ে তিনি কহিলেন–“নিশ্চয়ই আমি জাপানি মহিলাদের সৌন্দর্যকে প্রশংসা না করিয়া পারি না। তাহার দেখিতে চমৎকার!”
যুবতী সহসা এবাদের মুখের কাছে মুখ লইয়া কহিলেন–“আপনার সৌন্দর্য জ্ঞান আছে। ইউরোপীয়ান মহিলারা আমাদের দেশের মহিলাদের কাছে সৌন্দর্য হিসাবে কত ছোট তা আপনি বেশ বুঝিতে পারেন?”
এবাদের চরিত্র কোনো কালে কলুষিত নহে। তিনি কোনোও দিন তাহার মনে কোনো তরল ভাবের প্রশ্রয় দেন নাই। পাপের বিরুদ্ধে হৃদয়ে তাঁর কোনোও দারুণ ঘৃণাও ছিল না তবে ইচ্ছা করিয়া পাপে প্রবৃত্ত হইতেন না।
এই দূর জাপানে আসিয়া তিনি কোনো দিন রমণীর কথা চিন্তা করেন নাই। রমণীর সৌন্দর্য তাঁহাকে কল্পনাময় করিতে পারিত না। তিনি একটা কলের মতো। মন্দই হোক আর ভালোই হোক কোনোও প্রকার চিন্তা তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারিত না। তার ও চিন্তার অংশটা একেবারে মৃত।
.
অষ্টম পরিচ্ছেদ
মিস্ ফিনি উচ্চবংশদ্ভুতা। যে দিন সিঙ্গাপুর হইতে বাড়ি আসিতেছিল সেইদিন সে দেখিল একটা ভারতবর্ষীয় যুবক জাপানে যাইতেছেন। মিস্ ফিনির চোখে এমন সুন্দর যুবক আর কখনও পড়ে নাই। জাপানের অসংখ্য নাসিকা শূন্য পুরুষগুলোর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়া সে ভুলিয়া গিয়াছিল। সভ্য দেশ ফ্রান্সে বহুদিন ছিল বলিয়া বোধ হয় তার মনের এই পরিবর্তন। সর্বদা মি. এবাদের সঙ্গে মিশিলেও জাপানি লজ্জাহীনতা লইয়া অপেক্ষাকৃত সভ্য ফিনি কখনও এবাদের কাছে তাহার প্রাণের দারুণ তৃষ্ণার কথা মুখ ফুটিয়া বলে নাই। সাধারণ জাপানি নাচগৃহে, সমুদ্রপার্শ্বস্থ রাস্তায়, রাজধানীর সাধারণ উদ্যানে মিস্ ফিনি বহুবার এবাদের সহিত বেড়াইয়াছে। কিন্তু কখনও সে বলে নাই।–“মিস্টার এবাদ, আমি আপনাকে ভালবাসি।” মিস ফিনি যদি তাহার এই আকাঙ্ক্ষার কথা এবাদকে বলিত তাহা হইলে সম্ভবত তাহার প্রস্তাব ব্যর্থ হইত না। কতদিন সন্ধ্যার ঈষৎ আঁধারে সমুদ্র পার্শ্বে দাঁড়াইয়া সে ইচ্ছা করিয়া তাহার মদিরাসক্ত রক্তবর্ণ ওষ্ঠ দু’খানি এবাদের কাছে ধরিয়া বলিয়াছে–ঐ সমুদ্রের নীলজল কত উল্লাস ও আনন্দ ভরা। কিন্তু একটি বারও ভয়েই হউক বা সঙ্কোচেই হউক মি. এবাদ তার অতি সুন্দর মুখোনি একটুখানি বাড়াইয়া দিয়া একটা দারুণ তৃষিত হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন নাই।
একদিন জাহাজে চড়িয়া সমুদ্র-বিহারের জন্য সে এবাদকে লইয়া বাহির হইয়াছিল। জাহাজের ডেকের উপর দাঁড়াইয়া সে এবাদের সহিত কত রহস্য করিয়াছে, হেলিয়া হাসিয়া সে কত রকমে এবাদকে তাহার অকৃত্রিম ভালবাসার পরিচয় দিতে চাহিয়াছে। কিন্তু মূর্খ এবাদ তাহার কিছুই বুঝে নাই।
একবার নাচগৃহে এবাদকে লইয়া ফিনি কত চাপা হাস্যে জানাইতে চেষ্টা করিয়াছে–সে তাহার সোহাগের বস্তু। কিন্তু মুখ ভারতবাসী মোটেই বুঝিতে পারে নাই–জাপানি রমণীর রূপসুধা ভারতবাসীর পক্ষে অনধিগম্য নহে।
একদিন ফিনির পিতা বাড়িতে ছিলেন না। সে সন্ধ্যাকালে গল্প করিতে এবাদের ঘরে আসিয়া বলে–“মি. এবাদ, আজ আপনাকে নিমন্ত্রণ করতে চাই। বাবা বাড়িতে নাই, আপনার ইচ্ছা কি?” মিস্টার এবাদ বলিলেন–মুসলমানেরা জাপানিদের হাতে খায় না। তাতে তাদের ধর্ম নষ্ট হয়। অতএব ক্ষমা করবেন।”
ফিনির মাঝে মাঝে সন্দেহ হইত হয়তো এই ভারতবাসী নিতান্ত বোকা। কিন্তু এই সান্ত্বনা তাহাকে শান্ত করিতে পারিল না। যেমন করিয়া হউক এই যুবককে আপনার করা চাই।
এবাদের উন্নত ললাট, দীর্ঘ দেহ, স্বর্ণবর্ণের কেশদাম এবং নীল বিস্তৃত আঁখি মিস ফিনিকে দিনে দিনে একেবারে পাগল করিয়া তুলিতেছিল।
শহরের ”হায়ার্টলঙ্গ” পল্লীতে মিস্ ”হেনা হন” একজন বিখ্যাত নাচনওয়ালী, কুমারী মহলে তার যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল।
বৎসরে যেদিন জাপানি মেয়েরা জোনাকী পোক ধরে ভালো স্বামী পাবার জন্য। ”ককং” দেবতার কাছে বলি দেয়, সেই দিন নাচওয়ালী হেনা হনের বাড়িতে শহরের কুমারীদের ভিড়।
সেটা যে একটা সাধারণ নাচওয়ালীর ঘর একথা সেদিন ভদ্র ও অভদ্র ঘরের কোনো কুমারীই মনে করে না। চুপে চুপে হেনা হনকে বলে আসতে হয় কেন যুবকেরে দেখে কোনো যুবতীর মন চুরি হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে একটু বেশি করে টাকা খরচ করলে কুমারীকে আর তার প্রণয়ীর জন্য চিন্তান্বিত হতে হয় না। শিকার ধরবার জন্য হেনা হনকে যদি প্রাণ দিতে হয় তাও সে দিতে পারে–জাপানি কুমারী-মহলের বিশ্বাস এই প্রকার।
ধীরে ধীরে গাড়িখানি একবাড়ির সামনে এসে দাঁড়াইল। যুবতী এবাদের হাত ধরে। বললেন, “নেমে পড়ুন।”
এবাদ কথা বলিল না। সে শুধু দেখলো এটা মিস্ ফিনির বাড়ি নয়!
একটা দীর্ঘ অন্ধকারময় সিঁড়ি! তার পর একটা খোলা হল। তার পর আবার একটা দীর্ঘ আঁধার ভরা পথ। তার পর একটা সিঁড়ি। সিঁড়ির দুইধারে ফুলের মতো স্তবকের মতো কতকগুলি মেয়ে! তাদের হাসি বাঁধশূন্য। হাসিয়া হাসিয়া এ ওর গায়ে বরফের জলের মতো গলিয়া কুটি কুটি হইতেছিল। আঁখিতে বিস্মৃতির আনন্দময় হিম-কণা আর মাদকতা ভরা হিল্লোল। সমস্ত সংসারটাকে উড়িয়ে নিয়ে আকাশ দিয়ে তার চলছিল। ফুলবাগানে এলিয়ে পড়া লতার মতো সুখের আবেগমাখা বাতাসের মাঝে তারা খেলছিল।
এবাদ চাহিয়া দেখিল, কথা কহিল না।
তার পর আর একটি ঘর, সাদা ফরাস পাতা। জাপানি মেয়েরা ধধবে আলোর মাঝে গা এলিয়া মানুষের মন চুরি করবার ফন্দিতে ব্যস্ত ছিল। তারপর একটা ঘর। সেখানে কেই নাই। দূর হতে বীণার ঝঙ্কার মানুষের তরল মনকে আরও তরল করে সুন্দরীদের আলতা পরা পায়ের তলে ফেলিয়া যাইতেছিল।
এবাদ কথা বলিল না। তার পর আর একখানা ঘর। বাজারের পাশেই খোলা জানালা দিয়ে শহরের জাপানি জনতা দেখা যাচ্ছিল।
ঘরখানি ফুল আর পাতায় ভরা, কৃত্রিম ঝরনা আর গোলাপ পুষ্পে সাজান। কয়েকখানি আসন আর দুইখানা কাউচ। যুবতী তার একখানিতে এবাদকে বসিতে বললেন–এবাদ হ্যাঁট রেখে একখানা চেয়ারে বসে জনতার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। এবাদকে বন্দি করিয়া হেনা হন ঘর বন্ধ করিয়া বাহিরে চলিয়া গেলেন। ধীরে ধীরে গভীর নিবিড় আঁধারে ঘরখানি ভরিয়া উঠিল।
.
নবম পরিচ্ছেদ
রাত্রি ন’টার সময় একটি যুবক এসে সুরীকে জিজ্ঞাসা করিল–“আপনি কেমন আছেন?”
সুরী চেয়ারে বসে একখানা পত্রিকা পড়িতেছিল–কভার খুলিয়া সে পড়িয়া দেখিল একটা কবিতা। বারে বারে সে পড়িল–
ধরণীর একপ্রান্তে আছে সে দাঁড়ায়ে
ওষ্ঠে হাসি রক্ত দীপ্তি, কটাক্ষে মাখায়ে,
আছিল সে একদিন কোমল মধুর
মাতৃত্ব মহিমা আর গন্ধে ভরপুর।
বিধাতার হাসি নিয়ে একদা ঊষায়
জন্মেছিল মার কোলে মৌন বরষায়।
ফিরে এস, ফিরে এস, হে সুন্দর! হে মধু!
বিকাইতে পথে পথে জন্মেছিলে তুমি শুধু?
উঠিবে না? চাহিবে না? গাহিবে না গান?
আঁধারেই রয়ে যাবে? জানিব না প্রাণ?
এ জনম মিছে বলল, হে মাতঃ পাষাণী
বিধাতার একরূপে দিলে এত গ্লানি?
ছুঁড়ে ফেল দূর কর, ভোগের বাঁধন,
হলাহলে ভরে দিলে সারাটা জীবন?
ছোট বড় সব সুখ জীবনের মাঝে।
বিস্মৃতি হারায়ে ফেলে আপনার মাঝে
দৃষ্টি যবে ভেঙ্গে যাবে, আসিবে মরণ
শেষ হবে সব খেলা সকল স্বপন।
উঠিবে কি ডাকি বল সেই শেষ দিন
স্মরণে একটু সুখ, ওরে দীনহীন!
আসিবে কি স্মৃতিপথে একটু ভাসিয়া!
জীবনের গত লঘু-সুখ হাসি-ছায়া
মদিরা অলস চোখে, হে দুঃখিনী বালা
তুলিয়াছ দীন প্রাণে সীমাহীন জ্বালা।
মূর্খতা আঁধার আর অধীনতা ভার
রমণীরে করিয়াছে পাষাণী অসাড়।
সুরীর কণ্ঠস্বর বাধিয়া আসিতেছিল। একটা অজানা গভীর ব্যথা তাহার কণ্ঠ ফাটিয়া বাহির হইতেছিল। এমন সময় একটি যুবক জিজ্ঞাসা করিল–“আপনি কেমন আছেন?”
সুরী কি কহিতেছিল–এমন সময় মোহিনী সুরীর প্রকোষ্ঠের সম্মুখ দিয়ে চলে গেল। সুরী কথা বলিল না। অতঃপর সে দেখিল–একটি অষ্টাদশবর্ষীয় যুবক তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। সুরীর অঙ্গ দিয়া একটি স্পন্দন বহিয়া গেল। যুবকের দিকে চাহিয়া সে বলিল–“আপনি কী চান? আপনি জানেন, এ কাঁদের বাড়ি?”
যুবক কথা বলিল না। সে মৌন হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিল।
সুরী আবার কহিল–“আপনার এই দিব্য মূর্তি! দেবতার মহিমা ও গৌরব আপনার দেহ দিয়ে ফুটে বেরুচ্ছে, আর আপনার এই প্রবৃত্তি! কোনো পিতা-মাতার বুকে আগুন জ্বালবার জন্য আপনি এসেছেন?”
যুবক কথা বলিল না।
সুরী আবার কহিল–“সারা জীবনটা মরুভূমি করে তুলবার ব্যবস্থা কে দিয়েছে? কোনো পিশাচ সে? এই স্বর্গীয় জীবনের প্রতি আপনার একটু মায়া নাই। এই পথে যে হাঁটে তার জীবনে অপরিসীম দুঃখ। সারাজীবন আপনার বুকের ভিতর আগুন জ্বলবে। যান যান, ফিরে যান। নিজে অস্পৃশ্য বলে ভগবানের ও মানুষের কাছে আপনাকে অস্পৃশ্য করতে চাই না। আপনি ছেলে মানুষ, কিছু বোঝেন না। মা-বাপের বুকে ছুরি দেবেন না। মা-বাপ আপনার কাছ থেকে অনেকখানি আশা করে। যুবকের আঁখিতে ঈশ্বরের জ্যোতি প্রতিভাত হতে থাকে। আপনি সে আলোককে শয়তানের আঁধার দিয়ে ঢেকে ফেলবেন না। এখানে সুখ নাই। আপনার ভিতরে এর পরে যে পাপের আগুন জ্বলে উঠবে, তা সমস্ত সাগরের জল দিয়ে নিভাতে পারবেন না।”
যুবক ভাবিতেছিল, সে কথা কহিতে পারিতেছিল না। চরণ তাহার উঠিতে ছিল না।
সুরী আবার কহিল–“যুবক, কে তোমাকে এই পথের পথিক করিয়াছে? তাহাকে যাইয়া হত্যা কর। সে তোমার সারা জীবনের শত্রু।”
যুবক সহসা কাঁদিয়া ফেলিল। সে বলিল–“আপনি কে তা জানি না। আমার জ্ঞানলাভ হইয়াছে, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি চলিলাম।” আমি প্রতিজ্ঞা করিলাম–কোনো নরপিশাচ আমাকে আর পথভ্রষ্ট করিতে পারিবে না। আমি কে তাহা বলিব না। –আপনি আমার যে উপকার করিলেন, তজ্জন্য ভগবানের কাছে সারাজীবন আপনার মঙ্গল প্রার্থনা করবো।”
যুবক দ্রুতপদে সে স্থান পরিত্যাগ করিল। বহুলোকের উপদেশ সে পাইয়াছে। কিন্তু কিছু সে গ্রাহ্য করে নাই। আজ যেন কে তার ভিতরে একটা ভীষণ তেজ সৃষ্টি করিয়া দিল। সে রাস্তায় যাইয়া এই অস্পৃশ্য বালিকার উদ্দেশ্যে শতবার নমস্কার করিল।
.
দশম পরিচ্ছেদ
শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন প্রভাত। দিবালোকে দৃষ্টি চলিতেছিল না। জীবনের আড়ষ্টতা ও অন্ধকার বিশ্বজোড়া মৌন কুহেলির পার্শ্বে স্পষ্ট হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছিল–এই বিস্তীর্ণ ধরা–কত মানুষ! কোথায়–কত মানুষ কল্পনা ও দুঃখ লইয়া পড়িয়া আছে। পাপ ও বেদনার ভিতর কত মানুষ সান্ত্বনা খুঁজিতেছে।
সুরীর মায়ের বড় অসুখ। সে আর বাঁচিবে না। ডাক্তার বলিয়া গিয়াছেন, তাহার মাকে হাসপাতালে পাঠানো আবশ্যক; বাড়িতে তার উপযুক্ত সেবা হইতেছে না। টাকার জোরে ডাক্তার বাবু, সুরী ও সুরীর মাকে চিরকালই তার মস্ত মুরুব্বী বলিয়া মনে করিতেন।
মোহিনী আকুল চিৎকারে সুরীকে ডাকিল–“মা! কই তুমি।”
সুরীর চোখে জল! দৌড়াইয়া সে মায়ের কাছে যাইয়া উপস্থিত হইল। যাতনায় মোহিনীর কণ্ঠ শুকাইয়া আসিতেছিল। বেদনাতুর কণ্ঠে মোহিনী কহিল, “মা, আর সহ্য হয় না। অসীম জ্বালা। গত জীবনের এত সুখ একটুও আজ আমাকে সান্ত্বনা প্রদান করতে পারছে না। অনেক টাকা সঞ্চয় করেছি–অনন্ত সুখে সারা জীবনকে উজ্জ্বল করে রাখতে চেষ্টা করেছি। আজ–সে সব কোথায় গেল? লক্ষ যুবকের মূর্তি লক্ষ শয়তানের মতো আজ আমার সামনে ভেসে আসছে। ভগবান কি আছেন?”
মোহিনী আকুল আবেগে আবার জিজ্ঞাসা করিল–“সত্যি কি ভগবান আছে?”
সুরী দৃড়কণ্ঠে কহিল–“হ্যাঁ আছেন।”
মোহিনীর চোখে জল। সে আবার কহিতে লাগিল। ”সুরী! আট বছরের সময় বিধবা হয়েছিলাম। যখন ষোল বছর আমার বয়স তখন চোখের সম্মুখে দেখতে পেতাম–সমস্ত সংসারটায় আগুন ধরে উঠেছে। সেই আগুন নিবাতে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ওঃ তারপর দীর্ঘ এক বিস্মৃতির যুগ কামনার আগুন যখন মুহূর্তের জন্য শান্ত হতো–ধরণীর রক্ত যখন একটু হিম হয়ে আসতো–তখন কী দারুণ মানসিক জ্বালা আমাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতো। বিস্মৃতির মোহিনী শক্তিকে ফিরিয়ে আনবার জন্য সুরা পান করতাম। মানবীয় সমস্ত কোমল বৃত্তিকে বলি দিবার জন্য কেবল পান করতাম সুরা। আর ফিরে যাবার জো ছিল না। আর অনুতাপ করার সময় ছিল না। সুরী, আমরা তো মানুষ, শিরায় কি রক্ত নাই? আলো ও গন্ধে ভরা পৃথিবীর বুকে ভাই-বোন একই জায়গায় বেড়ে উঠে মুহূর্তের ভুলে মেয়েমানুষকে জীবন সন্ধ্যা পর্যন্ত, অনন্তের জন্য কেন নরক বরণ করে নিতে হয়? এরা এত নিগৃহিতা কেন? এদের ফিরে যাবার আর পথ থাকে না কেন? সমস্ত সংসার এদের সামনে একটা অভেদ্য পাথরের দেওয়াল টেনে দেয় কেন? মানুষ কি পিচ্ছিল খেয়ে পড়ে না? তাই বলে কি চিরকাল তাকে কাদায় পড়ে থাকতে হবে? লম্পট, দস্যু মাতাল ভাইকে লোকে যত্ন করে তুলে নেয়, একদিনের ভুলের জন্য বোনের মাথায় তারা পাথর ছুঁড়ে মারে। সুরী, বল মা–জীবনের এই সীমাহীন পাপের জন্য কি আমি দায়ী?”
মোহিনী আবার কি বলিতে যাইতেছিল–কিন্তু একটা ভীষণ ব্যথায় সে দুমড়াইয়া পড়িল।
সুরী তাড়াতাড়ি আর এক দাগ ঔষধ মাতাকে খাওয়াইল।
মোহিনী একটু শান্ত হইয়া আবার কহিতে লাগিল–“ভগবান আমার চিন্তা নিয়ে কাজ করবেন না। যখন আমার বয়স ত্রিশ তখন সাংঘাতিক একটা আঘাত পেয়িছিলাম–সেই সময় একটা যুবককে আমি ভালবেসেছিলাম। তার মূর্তিখানি মনে হলে এখনও আমার প্রাণ স্পন্দিত হয়ে ওঠে। তার অতর্শনে প্রাণ আমার জ্বলে যেতো। জানি না, পথের রমণী হয়ে কেন তাকে ভালবাসতে গিয়েছিলাম। সুরী আমাদেরও তো প্রাণ আছে–খালি কাঠাম নিয়ে। শূন্যকে আঁকড়িয়ে ধরে কেউ বাঁচতে পারে না। আমি তো তাই পারি নাই। পরের জিনিসকে চুরি করতে গিয়েছিলাম।
তারপর কয়েকমাসের জন্য তার সঙ্গে দেখা হয় নাই। তাকে না দেখতে পেয়ে জীবনে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। জানতাম, তার বাড়ি গঙ্গার অপর পারে। একদিনে ঘোর অন্ধকার-প্রাণের জ্বালায় বেরিয়ে গঙ্গার বুকে ঝাঁপ দিলাম। বাঞ্ছিতকে পাবার জন্য অসীম বল এসেছিল। বিপুল বলে গঙ্গ পার হয়ে ওপারে গিয়ে উঠলাম। তার প্রকাণ্ড বাড়ি খুঁজে বের করে অনেক কষ্টে বাবুর কাছে যেয়ে তার পা জড়িয়ে ধরে বললাম”দাসীকে আর পায়ে রাখেন না কেন? পথের রমণী বলে কি ঘৃণা করেবেন?” তার পর এক সিংহীর মতো রমণী এসে অমার ঘার আর চুল ধরে বের করে দিয়ে বলেন, “পরের জিনিসের উপর তোমার এত লোভ? লজ্জা করে না?”
দারুণ লজ্জা ও ঘৃণায় ফিরে এলাম বুক ভেঙ্গে গেল। তারপর এক কাজ করেছিলাম। তা অতি ভয়ানক। সে পাপের জন্য ভগবানের কাছে আমাকে অনন্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে।
মোহিনীর চোখ ফাটিয়া জল আসিল। আবেগে তার বুক ভাঙ্গিয়া যাইতেছিল।
মোহিনী চাপ দুর্দমনীয় উচ্ছ্বাসে আবার কহিল–“প্রাণের জ্বালা জুড়াইবার জন্য এক কাজ করেছিলাম। এরূপ পৈচাশিক কাজ আমার ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। একটা যুবতাঁকে পথের ভিখারিণী করেছিলাম। তার অভিশাপ পলে পলে নরকের মাঝে লক্ষ সাপ হয়ে আমাকে কামড়াবে।
একদিন গঙ্গার ঘাটে যুবতী শুয়েছিল–জানি না-কি জাতি, তার বুকের শিশুকে চুরি করেছিলাম। মনে করেছিলাম, কাছে একটা শিশু পেলে প্রাণের জ্বালা কমবে। বেঁচে থাকবার সুবিধা হবে।
সুরী! সুরী! তোমাকে মা বলতে আমার সাহস হয় না। তোমার কাছে আমি অমার্জনীয় পাপ করেছি। তুমিই সেই মেয়ে। তুমি আমার গর্ভে জন্ম লও নই। তুমি ফুলের মতো পবিত্র ছিলে! তুমি দেবতার গানের মতো স্বর্গীয় ছিলে।”
সুরী লাফাইয়া উঠিল। ”আমি তোমার মেয়ে নই, আমার বাপ-মা থেকে তুমি চুরি করে এখানে এনেছ?”–বলিয়া সুরী মূৰ্ছিতা হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল।