পথহারা (উপন্যাস)
প্রথম পরিচ্ছেদ
হরিদয়াল ঠাকুর তাঁর স্ত্রী একটা শিশু-কন্যাকে লইয়া গঙ্গার ঘাটে স্নানে আসিয়াছিলেন। অসংখ্য লোকের ভিড়–কে কার খোঁজ রাখে।
স্নান শেষে হরিদয়ালের স্ত্রী কন্যা বুকে করিয়া বিশ্রাম করিতেছিলেন। ঠাকুর কিছু জলযোগ করিয়া ঘাটে জল খাইতে গিয়াছেন, এমন সময় শান্তা কাঁদিয়া চিৎকার করয়া উঠিলেন–“আমার খুকি কই?”।
ঘাটে ঘটি ফেলিয়া ঠাকুর ফিরিয়া আসিলেন। যাহা দেখিলেন তাহাতে মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। কই তাঁহার খুকি? সেই হাসিমাখা সুন্দর খুকি–যাহাকে কোলে করিয়া একঘণ্টা আগে তিনি আদর করিয়াছেন–সে কোথায় গেল! শান্তা কহিলেন–তাঁহার একটু তন্দ্রা আসিয়াছিল–সহসা একখানা কঠিন হস্তের স্পর্শ তিনি অনুভব করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলিয়া দেখিলেন তাঁহার খুকি নাই। তখনও বুকেতে শিশুর মুখের ক্ষীরধার লাগিয়াছিল। জননী আকুল আর্তনাদে গঙ্গার ঘাট কাঁপাইয়া তুলিলেন। কে কাহার কথা শুনে–সকলেই স্নানে ও ধর্মকর্মে ব্যস্ত।
বুকের বেদনা কণ্ঠ ভাঙ্গিয়া বাহির হইতে ছিল। সমস্ত দৃশ্যটা তাহার কাছে সহসা বিষাদে ভরিয়া উঠিল। যে প্রকৃতি এই মাত্র তাঁহার মাতৃ-হৃদয়ে আনন্দ ও হাসির ধারা বহাইয়া দিতেছিল, সহসা একি তাহার মৌন মলিন বদন।
কী ভীষণ বেদনা! মাতৃহৃদয়ের অসীম জ্বালা কে বুঝিবে তখন? জনকতক লোক শুষ্ক সহানুভূতি ও কৌতূহল লইয়া শান্তার উপর বিরক্তি প্রকাশ করিয়া জ্ঞানেরও অধিক স্নেহের পরিচয় দিতেছিল।
সহসা একটি টুপিপরা যুবক জনতা হইতে মাথা ঠেলিয়া বলিয়া উঠিল, “কী বাছা! কী হয়েছে?”
পথের লোক স্নান শেষ করিয়া সেখানে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়াছিল, অপবিত্র হইবে ভয়ে তাহারা সরিয়া গেল। যুবক সেদিকে আদৌ লক্ষ্য না করিয়া আবার জিজ্ঞাসা করিল–“কী মা, কী হইয়াছে?”
শান্তা কাঁদিয়া বলিয়া উঠিলেন–বাবা! সর্বনাশ হইয়াছে। গুণ্ডায় আমার মেয়েকে চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে। ওগো আমার কী হবে? কেন গঙ্গার ঘাটে পুণ্যি করতে এসিছিলাম!” বলে শান্তা মূৰ্ছিতা হইয়া পড়িলেন।
যুবক ব্রাহ্মণকে সেই স্থানে দাঁড়াইয়া থাকিতে বলিয়া ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেলেন।
সেবক-সমিতির ছেলেদের সহিত মোয়াজ্জেম বেড়াইতে আসিয়াছিল। সে এই হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখিয়া অত্যন্ত বেদনা অনুভব করিল। সেবক-সমিতির নেতা হেমেন্দ্র তাহার –বন্ধু। হেমেন্দ্র লাঠি হাতে করিয়া চতুর্দিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। এমন সময় মোয়াজ্জেম যাইয়া কহিল–“হেমেন্দ্র, সর্বনাশ হইয়াছে। শান্তা নাম্নী এক ব্রাহ্মণ মহিলার মেয়ে চুরি হইয়া গিয়াছে।”
ভাবিবার সময় ছিল না। তড়িত বার্তার মতো ছেলেদের সাহায্যে এই আকস্মিক দুর্ঘটনার সংবাদ সর্বত্র প্রচারিত হইয়া পড়িল। প্রায় পঞ্চাশজন কলেজের ছাত্র ঘাটে পথে যাত্রীদের মধ্যে কোনো বিপদ হয় এই ভয়ে সর্বত্র পাহারা দিতেছিল।
ছেলেদের আশ্বাস বাক্যে শান্তার বুকে বল আসিল। হরিদয়াল ও শান্তা মনে করিলেন শীঘ্রই তাঁহারা তাহাদের শিশুকে ফিরাইয়া পাইবেন।
সমস্ত দিন অতিবাহিত হইল। কোনোও খবর পাওয়া গেল না। সন্ধ্যার আঁধারের সঙ্গে সঙ্গে শান্তার হৃদয়ে পুনরায় আঁধার ও বেদনায় ভরিয়া উঠিল। ধীরে ধীরে যাত্রীদের ভিড়ও কম হইয়া আসিল। আপনাদের ক্ষুদ্র ছোট কথা লইয়া চলিয়া যাইতে লাগিল।
আজই সন্ধ্যায় তাঁহারা বাড়ি ফিরিয়া যাইবেন, ইহাই সকাল বেলা শান্তা স্বামীর সহিত ঠিক করিয়াছিলেন। কিন্তু একি বজ্রাঘাত! যাহা স্বপ্নেও তিনি কখনো ভাবেন নাই তাহাই আজ তাহার ভাগ্যে ঘটিল। দেবতাকে তিনি কি এইরূপে পূজা করিতে আসিয়াছিলেন? ইহাই কি সেবার ফল?
সারা বছরের ছোট-বড় ভুল মুছিতে তিনি স্বামীর সহিত মন্দাকিনী-নীরে অবগাহন করিতে আসিয়াছিলেন। এমন করিয়া তাহার বুকের মানিক হারাইয়া যাইবে–যদি তিনি। জানিতেন, তাহা হইলে কখনো গঙ্গাস্নানে আসিতেন না।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দশ বছর পরেকার কথা। হুগলীর মুসলমান-বোর্ডিং-গৃহের যে পার্শ্বে গঙ্গা সেইদিকের একটি স্তম্ভে বসিয়া দুই বন্ধু হাসিয়া হাসিয়া খুন হইতেছিলেন।
সমস্ত রাত্রি মোয়াজ্জেম হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গে শহর ঘুরিল–কিন্তু কোনো ফল হইল না।
বোর্ডিং-গৃহের এই দিককার দৃশ্য অতি চমৎকার। নদীর ভিতর হইতে সারি সারি স্তম্ভ শ্ৰেণী, সুরক্ষিত দীর্ঘ প্রাচীরের উপর প্রাচীর। যখন দৈনন্দিন জোয়ার আসিয়া এই প্রাচীর পাদমূলে আছড়াইয়া পড়ে, তখন স্তম্ভের উপর দাঁড়াইয়া মনে হয় সমুদ্রকে জয় করিবার জন্যই তাহার বুকের উপর দাঁড়াইয়া আছি। যখন রাত্রিকালে গগনে চন্দ্রোদয় হয় তখন সেই নৈশ শোভাই বা কী সুন্দর! সংসার-তাপক্লিষ্ট মানুষ পিনিসে চড়িয়া যখন সেই চন্দ্রকরোজ্জ্বল গঙ্গার বুকের উপর দিয়ে ভাসিতে ভাসিতে যায়, তখন মনে হয়–এই পাপ ও নীচতা ভরা সংসার ছাড়িয়া অনির্বচনীয় আধ্যাত্মিক আনন্দে গঙ্গার শীতল বুকে সাঁতরাইতে সাঁতরাইতে অনন্তের সন্ধানে আকাশ ও সমুদ্রের যেখানে মিলন সেই দূর-অতি নির্জন গম্ভীর ভাবময় প্রান্তে চলিয়া যাই।
দুই বন্ধু হাসিয়া কথা কহিতেছিলেন। প্রত্যেক স্তম্ভের মাথার উপর দুইজন বা তিনজন করিয়া বালক বসিয়া আছেন। ছাত্রেরা নিত্যই এখানে বসিয়া থাকেন। কেহ কেহ বা দুই। প্রাচীরের মধ্যস্থিত ভূমিতে খেলা করেন। যুবক-হৃদয়ে সে কী উল্লাস ও আনন্দ! কেহবা সুপারিন্টেণ্ডেটের ভয়ে চাপা গলায় গান করেন–
“আজ এ নিশিথে
কারে মজাইতে”–ইত্যাদি।
বন্ধু দুইটির বাড়ি নদীয়ায়। যে হুগলীর বোর্ডিং-গৃহের কথা আমরা বলিতেছি এখানে প্রথমে কলেজ, মাদ্রাসা ও স্কুলের ছাত্র একসঙ্গে থাকিত।
একজনের নাম আবু মহম্মদ আবদার রাহমান। তিনি মাদ্রাসার পাঠ শেষ করিয়া ইংরেজি পড়িতেছিলেন। যথাসময়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া আই-এ ক্লাশে ভর্তি হইয়াছেন। অন্য যুবকের নাম আহমদ হাছান। ইনি বি-এ ক্লাশে পড়েন। দুইজনের একস্থানে বাড়ি বলিয়া অত্যন্ত বন্ধুত্ব।
সম্প্রতি আহমদ হাছানের পিতা পুত্রের নিকট পত্র লিখিয়াছেন। বন্ধুকে সেই পত্রখানি পড়াইয়া শুনান হইবে। তাহার বিবাহের কথা লেখা, তাই বন্ধুদ্বয়ের মধ্যে এত হাসাহাসি চলিতেছিল। পত্রে লেখা ছিল–
বাবা!
আমরা এখন বুড়ো হয়েছি, এ বয়সে পুত্রবধূর মুখ দেখা সকল বাপ-মায়ের সাধ। বিশেষত, তোমার মা এ বিষয়ে জেদ করিতেছেন, আর তিনি আজমপুরের মৌলবী এমদাদ। আলী সাহেবের কনিষ্ঠা কন্যা পছন্দ করিয়া কথা দিয়াছেন। তোমার আত্মীয়-স্বজন সকলেই মেয়ে দেখিয়া এক বাক্যে বলিতেছেন–মেয়ে রূপেগুণে খুব ভালো, এ কাজ করিতেই হইবে। আশা করি, তোমার অমত হইবে না।
তোমার চিরশুভাকাক্ষী
–পিতা।
আবু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল–“কেমন, বিবাহের নামে প্রাণটা নাচিয়া উঠিতেছে তো? আশা করি, অতীতে কথা ভুলিয়া যাইবে।”
শেষ কথাটিতে যে গুপ্ত উপহাস ছিল তাহা হাছান বুঝিতে পারিয়া কহিল–“বন্ধু কী করি, বুঝিতে পারি ইহা অত্যন্ত অন্যায়। কিন্তু ইহাতে কি আমার দোষ আছে? যখনই জানালা খুলি তখনই দেখি সেই মেয়েটি আমার দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকে।”
আবু বলিলেন–“তুমি সে দিকে না চাহিলেই পার। পাপের পথে যে টানিয়া লইতে চায় তাহাকে মিত্র না ভাবিয়া শত্রু মনে করা উচিত।”
হাছান কহিল–“পাপ তাহা কেমন করিয়া বুঝি? একটি মেয়ে তাহার আত্মার স্বভাবে বৃত্তিবশে একটি যুবকের প্রতি আসক্ত হইতেছে, তাহাতে কি অপরাধ?”
“অপরাধ নাই! সে হিন্দু মেয়ে, সংসারের জটিলতা ও বিপদ সম্বন্ধে সে কিছুমাত্র জানে না। তাহাকে উৎসাহিত করা তোমার কিছু মাত্র কর্তব্য নহে।”
“তোমার আত্মার প্রেমের পার্শ্বটা একেবারে মরিয়া গিয়াছে। আমি তো একজন যুবক। আমারই কামরার পার্শ্বে একটি যুবতী বালিকা নিত্য নির্জনে তাহার কোমল ও দারুণ আকাক্ষাপূর্ণ আঁখি দুইটি আমার দিকে নিক্ষেপ করিয়া থাকিবে, আর আমি নিশ্চল হইয়া পড়িয়া থাকিব। তোমাকে যদি এই অবস্থায় পড়িতে হইত তাহা হইলে বুঝিতাম কতখানি বীরত্ব। আমার মনে হয় মেয়েটির পিতা জজকোর্টের উকিল। এমন রূপ আমি কখনো দেখি নাই। কী করি ভাই, পড়াশুনা সব মাটি হইল।
“তুমি ঐ কামনা পরিত্যাগ কর।”
“ইচ্ছা করিলেও উহা অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে। জানি না, কী প্রকারে তাহার দৃষ্টি আমাকে একেবারে পাগল করিয়াছে। সে অত্যন্ত সরলা, নচেৎ ধীরে ধীরে সে নিজেকে এই কণ্টকময় পথে তুলিয়া ধরিত না। মনে কর যদি, তাহার বাড়ির কেহ জানিতে পারে–তাহাদের মেয়ে বোর্ডিংগৃহের এক যুবকের প্রতি আসক্ত হইয়াছে, তাহা হইলে হয়তো তাহারা তাহাকে জীবন্ত পুড়াইয়া মারিবে।
“তুমি ভালো করিয়া খুলিয়া বল! কেমন করিয়া এই হিন্দু বালিকার সহিত তোমার প্রেম হইল?”
হাছান কহিল–“শোন বলিতেছি। রোজার মাসে একদিন কামরায় আর কেহ ছিল না। আমি জানালা খুলিয়া পাশের বাড়ির দিকে চাহিয়া আছি, এমন সময় সহসা একখানি ঘুড়ি আসিয়া আমাদের জানালায় বাঁধিয়া গেল। দেখিলাম এক কিশোরী ঐ বাড়ির ছাদ হইতে অপর পার্শ্বে জানালার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল; সে হাঁপাইতেছিল। বুঝিলাম; সে ছাদের উপর ঘুড়ি উড়াইতেছিল। হঠাৎ সূতা কাটিয়া ঘুড়িখান নিচে পড়িয়া আমারই জানালায় বাঁধিয়া গেল। সে মনে করিয়াছিল তাহাদেরই বাড়ির জানালায় ঘুড়ি পড়িয়াছে। তুমি তো দেখিয়ায় দুই জানালা খুব নিকটে। অপরিচিতা যুবতাঁকে দেখিয়া একটু সঙ্কোচের সহিত জানালা ঠেলিয়া দিলাম। সে অত্যন্ত আশা করিয়াছিল; অনুভবে বুঝিলাম সে উহা ধরিবার জন্য হাত বাড়াইয়া দিল। সে পুনঃপুনঃ হাত বাড়াইয়া দিতেছিল। তাহার নিষ্ফল ব্যর্থ চেষ্টা দেখিয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছিলাম। কিছুক্ষণ পরে সে একখানা লাঠি লইয়া আসিল; কিন্তু লাঠিতে কোনো সুবিধা হইল না। আমি একটু দুঃখিত হইতেছিলাম। আমারি হাতের কাছে একটা জিনিস পড়িয়া আছে, যাহার জন্য একটা বালিকা এক ঘণ্টা ধরিয়া বিষম কষ্ট করিয়াও কিছু করিতে পারিতেছে না। মনে ভাবিলাম, এরূপ সঙ্কোচের মূল্য কী? হাত বাড়াইয়া ঘুড়িখানি তুলিয়া দিলে তো আমার জাতি যাইবে না। জানালা খুলিয়া কহিলাম, ‘যদি আপত্তি না থাকে, আমিই ঘুড়িখানি আপনার হাতে দিতেছি।’ বালিকা কৃতজ্ঞতার সহিত মাথা নাড়িল। মৌনতা অবলম্বন করিল।
ঘুড়িখানি লইয়া যখন সে ফিরিয়া গেল, তখন তাহার আঁখির দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়াছিলাম। দেখিলাম, তাহাতে যেন কত কৃতজ্ঞতা, কত দুঃখ! শিরায় শিরায় একটা অনির্বচনীয় স্পন্দন অনুভব করিলাম। পরমুহূর্তেই অত্যন্ত লজ্জিত ও অনুতপ্ত ভাবিলাম, একি! রোজার মাসে রোজা করিয়া মুসলমানের হৃদয়ে পরস্ত্রীর রূপ দেখিয়া চাঞ্চল্য! কী ঘৃণা! কী লজ্জা! তাড়াতাড়ি ওজু করিয়া কোরান পাঠ করিতে বসিলাম। কিন্তু কী বলিব, হৃদয়ে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বালিকার কৃতজ্ঞতাভরা করুণ দৃষ্টি ভাসিয়া উঠিতে লাগিল। বিরক্ত হইয়া গঙ্গার ঘাটে আসিলাম। গঙ্গার অনির্বচনীয় শোভা দেখিলাম। সীমাহীন বিস্তারে মন গম্ভীর ও ভাবময় হইয়া উঠিল। তরঙ্গের প্রতি আস্ফালনে দেখিতে পাইলাম বালিকার কৃতজ্ঞতাভরা সে করুণ আঁখির দৃষ্টি। পুনরায় ঈশ্বরকে ডাকিবার জন্য মসজিদে আসিলাম। তোমরা নামাজ পড়িলে, আমি নামাজ না পড়িয়াই এক মনে এক প্রান্তে বসিয়া আল্লাহকে ডাকিতেছিলাম। পরস্ত্রীর রূপ লইয়া আত্মার একি ঢালাঢলি। কী ঘৃণা! কী লজ্জা! ধীরে ধীরে হৃদয়ে শান্তি আসিল। অতঃপর কামরার ফিরিয়া আসিলাম।”
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ইচ্ছা করে যুবকটির সহিত যাইয়া গল্প করি। তার মূর্তিখানি যেন কার্তিকের মতো। যত দেখি ততই আমার দেখিতে ইচ্ছা করে। এতে দোষ কী? আমার মনে তো কোনো পাপ নাই। আমি এক বিধবা, তাতে সে ভিন্ন জাতি। হৃদয়ের মধ্যেই পাপ। আমার হৃদয়ে তো কোনো পাপ নাই। যাই, দূর হইতে একবার দেখিয়া আসি। সন্ধ্যাকালে নিতুই দেখি সে যেন আমার প্রতীক্ষায় বসিয়া থাকে। সেখানে কেউ নাই এখন।
এমন সময় দাসী কমলা আসিয়া সংবাদ দিল, মা তাহাকে ডাকিতেছেন। মায়ের নামে বালিকা শিহরিয়া উঠিল। সে বুঝিল, মা যেমন রোজই তাহাকে সামান্য সামান্য কারণে বকেন, আজও তাহাই করিবেন!
বালিকা কিছু জিজ্ঞাসা না করিয়া ভাড়ার ঘরের কাছে যাইয়া দেখিল তাহারই বয়সের আর একটি মেয়ে দাঁড়াইয়া আছে। সর্বাঙ্গ অলঙ্কারে মোড়া। ক্রোধ ও ঘৃণায় তাহার চক্ষু। দুটি জ্বলিতেছিল।
যদুনাথ বাবুর প্রতিপত্তি হুগলীর সকলেই জানিত। একমাত্র কন্যা ললিতাকে রাখিয়া যখন তাহার ছেলে বয়সের স্ত্রী কলেরায় প্রাণ ত্যাগ করেন, তখন উকিল বাবুর প্রাণ ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল।
বহুবার বহুলোক তাঁহাকে পুনর্বার বিবাহ করিতে বলিয়াছিলেন। তিনি বহু বৎসর ধরিয়া অস্বীকার করেন। জীবনের এই শেষ বেলা যখন ললিতা বিধবা হইয়া বাপের বাড়ি আসিল, তখন উকিলবাবু একটি মেয়ের বয়স কাঁচা বালিকাকে সধবা করিয়া গৃহে আনিলেন।
উঠিতে বসিতে বিবাহের দুমাস পরেই ললিতা ও তাহার নূতন মায়ে দ্বন্দ্ব আরম্ভ হইল।
ললিতা যেন এই নবীনার কাছে একটা বাজে লোক বলিয়া পরিগণিতা হইল। সারা জীবনের অনুগ্রহপ্রার্থিনী ললিতা উঠিতে বসিতে নিগৃহতা হইতে লাগিল।
সে কী করিয়াছে? ঈশ্বর কেন তাহাকে অকালে বিধবা করিয়া তাহার জীবনটাকে এমন আবর্জনা বিশেষ করিয়া তুলিলেন! সবই তাহার বাপের অথচ সে এই দু’দিনেই একবারে পর হইয়া গিয়াছে। কোথা হইতে সে যেন উড়িয়া আসিয়া পরের অনুগ্রহের ভিখারি হইয়াছে! সে আর এখন জোর করিয়া বলিতে পারে না, “এ জায়গাটুকু আমার।”
সেদিন উকিল বাবু অফিসে কাজ সারিয়া বাসায় আসিলেন, তখন গৃহিণী ও বিধবা মেয়ে কলহে ব্যস্ত। গৃহিণী তাড়াতাড়ি ঘোমটা টানিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। উকিল বাবুর ইচ্ছা ছিল সারাদিনের অবসাদ ও পরিশ্রমের পর গৃহিণীর কাঁচা মুখ দেখিয়া মনটাকে আবার সরস করিয়া লইবেন।
কিন্তু আনন্দের আহ্বানের পরিবর্তে শুনিলেন গৃহিণী কাঁদিয়া কাঁদিয়া কহিতেছেন, “ওগো আর এত জ্বালা সয় না! হয় আমাকে নিয়ে থাক, না হয় তোমার মেয়েকে নিয়ে থাক।”
ক্রোধে উকিল বাবুর শরীর জ্বলিয়া গেল। তিনি ললিতাকে অজস্র গালি দিতে দিতে কহিলেন, “স্বামীকে খেয়ে বাপকে খেতে এসেছে; পরের মেয়েকে এনেছি, তার সঙ্গে রাতদিন এ কি প্রকার ব্যবহার!”
ললিতার বুকে শেলের মতো কথাগুলি বাজিল। ইচ্ছা করিতেছিল সে কোথাও চলিয়া যায়। সে আর তাহার বাপের সুখের কাটা হইয়া থাকিবে না। কিন্তু কোথায় সে যাইবে! ভগবানের এই বিশাল রাজ্যে তার এতটুকুও মাথা রাখিবার স্থান নাই। তার পর একদিন তাহার জ্বর হইয়াছিল। সমস্ত রাত্রি সে জ্বরের ঘোরে তাহার মৃত মায়ের কথা বলিয়াছিল। প্রত্যুষে ঝঙ্কার দিয়া তাহার নূতন মাতা বলিলেন–“পুরোনো মা যদি এত মিষ্টি হয় তবে শ্মশানে গিয়ে বসে থাক না কেন? মা কি কাহারো মরে না! আমরা কি এতই পর? এত পর যদি হই তবে উকিল বাবু আমাকে বিয়ে কল্লেন কেন?”
বিবাহের সময় ললিতার অনেক গহনা ছিল। একদিন ললিতা দেখিল সেগুলি তাহার মায়ের ভগ্নির গায়ে উঠিয়াছে। ললিতা বলিল, “গহনা গায়ে দিবার শক্তি নাই বলে কি ওগুলির উপর আমার কোনো স্বত্ব নাই?” নূতন মা বলিলেন–“এখনো তোমার এত গহনার সাধ! যদি গহনার সাধ এত হয় তবে আর বিধবার ব্রত পালন কেন? শাড়ি পর, গহনা গায়ে দাও, চুলে তেল মাখ, আর একটি মানুষ খুঁজে নিও, মন ঠাণ্ডা হবে!”
কতকাল আগে ললিতার স্বামী মরিয়া গিয়াছেন। মাঝে মাঝে তার এই মৃত স্বামীর বিরুদ্ধে মন বিদ্রোহী হইয়া উঠিত। সে মরিয়া গিয়াছে, কিন্তু আর একটি লোককে জীবন্ত করিয়া রাখিবার তার কি অধিকার ছিল! মানুষ কি স্নেহ ভালবাসা ব্যতীত বাঁচিতে পারে! স্নেহের এক রত্তিও তাহার প্রাণকে কখনও শীতল করে নাই। মনে পড়িত তাহার মৃত মায়ের মুখোনি। আহা! এ জীবনে আর ললিতাকে কেহ ডাকিয়াও একটা কথা কহিবে না। এ সংসারে আর তাহার কাজ কী? এত অবহেলা ও বেদনার মধ্যে সে কেমন করিয়া বাঁচে?
সেদিন অকস্মাৎ একটি যুবকের অযাচিত ভদ্রতায় কি যেন স্বর্গীয় এক স্নেহের স্পর্শ। সে হৃদয়ে তাহার অন্তরে অনুভব করিল। এমন মধুর করিয়া আর তো তাহাকে কেহ কখনো। সম্বোধন করে নাই। ললিতার ইচ্ছা করে হৃদয় যখন একটি অজানিত বেদনায় ভরিয়া উঠে, রৌদ্রতাপদগ্ধ পৃথিবী যখন বেদনাভরা মধ্যাহ্নে আর্তনাদ করে, তখন একটিবার এই যুবকের পানে তাকাইয়া আসে। সেই মুখে যেন কত স্নেহ তাহাতে কত সহানুভূতি! ইহার অধিক সে ভাবিত না।
শুধু কল্পনা নয়–সত্য সত্য যখন তীব্র যাতনায় প্রাণ তাহার বাহির হইতে চাহিত, সে ধীরে অতি ধীরে জানালার কাছে আসিয়া দাঁড়াইত।
তখন সন্ধ্যাকাল, বোর্ডিং-ঘরে কেহ ছিল না। হাছান চেয়ারে বসিয়া ললিতার জানালার দিকে চাহিয়াছিল। সে প্রায়ই দেখিত এ মেয়েটির মুখে একটা বেদনার ছায়া টানা। অন্তরে সহানুভূতি অনুভব করিলেও কখনও কথা কহিত না। একটি অবিবাহিত যুবকের পক্ষে এই প্রকার আলাপ করা অন্যায় হইতে পারে। সমাজের কাছে অন্তত ইহা জঘন্য বলিয়া সহজেই অনুমিত হইবে। তা ছাড়া স্বাভাবিক সঙ্কোচে তাহার জিহ্বা আড়ষ্ট হইয়া উঠিত।
হাছান চাহিয়া দেখিল, ধীরে ধীরে ললিতা তাহার দিকেই আসিতেছে। সেই ঘুড়ি ধরিয়া দেওয়া ব্যাপার আজ ছয় মাসের কথা। কোনো কথা কাহারো মধ্যে না হইলেও হাছানের প্রাণে যেন এত দিনে একটা স্নেহ ও বন্ধুত্বের ভাব জাগিয়া উঠিয়াছে। ললিতা যেন তাহার পরিচিত শত বন্ধুদের মধ্যে একজন।
সহসা হাছানের ইচ্ছা হইল সঙ্কোচ ফেলিয়া একবার সে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি। কেমন আছেন?”
ললিতা ধীরে ধীরে আসিয়া জানালার পার্শ্বে দাঁড়াইল।
হাছান কথা বলিতে পারিতেছিল না, তাই অতিকষ্টে অত্যন্ত বিনীতভাবে ভয়ে ভয়ে সে জিজ্ঞাসা করিল,–“আপনি কেমন আছেন?”
ললিতার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল। সে কহিল, “ভগবান আপনার মঙ্গল করুন, আপনি তবু জিজ্ঞাসা করিলেন। কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করে না আমি কেমন থাকি।”
“প্রায়ই দেখি আপনার চোখে-মুখে একটা বিষাদের ছায়া। আপনার এ বালিকা বয়স!”“যাতনায় জীবন আমার ভরা। এ সংসারে এমন কেহ নাই, আমার দুঃখ বুঝেন!”
“কেন, কীসের আপনার দুঃখ? আপনি পিতার বাড়িতেই থাকেন ইহার কারণ কী? আপনার স্বামী কোথায় থাকেন?”
বালিকা কাঁদিয়া ফেলিল। কাঁদিয়া কাঁদিয়া সে কহিল–তাহার স্বামী নাই। বালিকা বয়সে সে বিধবা হইয়াছে। সারাজীবন তাহাকে দুঃখে ও বেদনায় কাটাইয়া দিতে হইবে। এ সংসারে এতটুকু তাহার জন্য স্নেহ নাই। এ সংসারে একটি মানুষ নাই, ডাকিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করে–সে কেমন আছে।
হাছানের প্রাণ ব্যথায় ভরিয়া গেল; তাহার এই অপরিচিতা বন্ধুর এত দুঃখ! কথা না। বলিলেও আবু আজ বুঝিল অজানিত অবস্থায় কতখানি শ্রদ্ধা, সহানুভূতি দিয়া সে এই সুবর্ণ প্রতিমাকে আত্মার অজ্ঞাতে পূজা করিয়া আসিয়াছে। আত্মার গভীর প্রদেশে আজ যেন কে কঠিন আঘাতে জিজ্ঞাসা করিতেছে “হাছান! তুমি একটা অসহায় আত্মাকে কি বাঁচাইতে পারো না?” কিন্তু কেমন করিয়া?
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
পরদিন সন্ধ্যাকালে হাছান ললিতার নিকট হইতে একখানি দীর্ঘ পত্র পাইল। পত্রের প্রতিছত্রে একটা অসহায় আত্মার করুণ আর্তনাদ গুমরিয়া গুমরিয়া উঠিতেছিল। বিপুল আগ্রহে নির্জনে হাছান পড়িয়া দেখিল :
“কী বলিয়া সম্বোধন করিব বুঝিতেছি না। এই অবহেলা-ভরা সংসারে আমার প্রাণ বাঁচিতেছে না। বিমাতার দারুণ বাক্যবাণ, পিতার নির্মম অবহেলা, সংসারের দারুণ রুদ্রতা আমাকে বলিতেছে তুমি চলিয়া যাও-জানি না কি কারণে, আপনাকে এত নিভৃতে কথা বলিতে প্রলুব্ধ হইতেছি। আপনি আমার কি করিতে পারেন? তবুও ইচ্ছা এই নিদারুণ সংসারের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিবার পূর্বে আপনাকে আমার প্রাণের কথা বলিয়া যাই। এই জ্বালাময় সংসারের মাঝে একটা সহানুভূতিময় মানুষের কাছে যদি থাকিতে পারিতাম, তাহা হইলে আর এ কঠিন সংকল্প করিতাম না। কিন্তু কে আছে আমার এ। সংসারে?” তাহার পর সংসারের শত কথা। তাও এক এক করিয়া সব কথা পড়িল।
শেষে যাহা পড়িল তাহাতে তাহার আত্মা শিহরিয়া উঠিল। অবহেলা ও নির্মম আঘাতে ললিতা আত্মহত্যা করিবে?
কেন? এত বড় দীর্ঘ তাহার দেহ। এই বাইশ বৎসর ধরিয়া সে কত বড় মানুষের গ্রন্থ। পড়িয়াছে। সে কি একটা অসহায় আত্মার কিছুই করিতে পারে না। হাছান মনে মনে বলিয়া উঠিল–এই বালিকাকে রক্ষা করিতে হইবে। এই কার্যের জন্য তাহাকে যে ক্ষতি, যে বেদনা, যে কষ্ট সহ্য করিতে হয় সে করিবে। নচেৎ সে মিথ্যা, মিথ্যা তার শিক্ষা ও জীবন, মিথ্যা তার ধর্ম।
হাছান কাগজ লইয়া পত্র লিখিতে বসিল। সে লিখিল :
শ্রদ্ধেয়া ভগিনী, আপনার পত্র পড়িয়া গভীর বেদনা অনুভব করিলাম আমি আপনার কী উপকার করিতে পারি বুঝিতেছি না। তবুও ঈশ্বরের নামে আজ প্রতিজ্ঞা করিলাম, আপনার জন্য যাহা করিতে হয় করিব। আপনি বিশ্বাস করুন, আজি হইতে আমি আপনার ভাই হইলাম। অন্তরে যখন বেদনা অনুভব করিবেন তখন একটা নীরব হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধা ও স্নেহের চিন্তা করিবেন। আত্মহত্যা করিবার ঘৃণিত প্রবৃত্তি দূর হইবে। বাহিরের লজ্জা ও সঙ্কোচ আমাকে কর্তব্য-পথচ্যুত করিতে পারিবে না। এই প্রতিজ্ঞার জন্য হয়তো ভবিষ্যতে আমার বিপদ হইতে পারে। কিন্তু তজ্জন্য আপনি দুঃখিত হইবেন না। আপনার অকৃত্রিম সহৃদয়তায় আমি মনে মনে বিপুল গৌরব অনুভব করিতেছি।
হাছানের মনে যে পাপটুকু ছিল তাহা সেই দিনই বেশ করিয়া ধুইয়া গেল।
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
”আমি তোমাকে ভালবাসি। আমাকে কি তুমি ঘৃণা কর? আমি কুৎসিত হইতে পারি কিন্তু আমার অর্থ আছে। অনেক লোক আমাকে খুব ভয় করে। বল, তুমি কি আমাকে ঘৃণা কর!”
হুগলীর পাড়া-বিশেষের এক প্রকোষ্ঠে এক যুবতী এক বাবুর সম্মুখে দাঁড়াইয়া, যুবতীর নিখুঁত সৌন্দর্য সমস্ত ঘরখানি আলোকময় করিয়া তুলিয়াছিল।
বাবু যুবতীর করুণা ভিক্ষা করিতেছিলেন। তাঁহার চোখে সোনার চশমা, পরনে। মূল্যবান পোশাক।
তখন রাত্রি দশটা। রাস্তায় জন-কোলাহল ছিল না। শান্তস্বরে যুবতী কহিল–“বাবু, আপনার ন্যায় ভদ্রলোকের কি আমাদের ন্যায় ইতর লোকের করুণা ভিক্ষা ভালো? ঘরে আপনার সতী স্ত্রী আছেন। আমাদের এই পাপ স্থানের স্পর্শে আপনার দেহ অপবিত্র করিবেন না। আপনার দেবী প্রতিমা সত্য স্ত্রীর অভিশাপে আমাদের নরকেও স্থান হইবে না। দয়া করে ক্ষমা করুন। আমি আপনার পায়ে ধরি।”
শহরের হতভাগিনীদের মধ্যে মোহিনী পতিতার মেয়ে, তেমন সুন্দর এমন আর কেউ নয়। মোহিনীর বয়স ষাটের কাছাকাছি। ৫ খানি বাড়ি তার। বাড়ি ভাড়ার আয় মাসিক ৩০০.০০ টাকার কম নহে। তাহা ছাড়া নগদ ৮০,০০০.০০ টাকা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ছিল। তাহার একমাত্র মেয়ে সুরী।
সুরী আদৌ তাহার মায়ের কথা শুনে না। একটি বাবু এই সুরীর জন্য পাগল হইয়াছেন। মোহিনী তার কন্যাকে বহুবার অনুরোধ করিয়াছে, কিছুতেই কিছু হয় নাই। কতবার এই বাবুটি ভিখারির মতো সুরীর গৃহপার্শ্বে দিনরাত্রি দাঁড়াইয়া থাকিত তার হিসাব নাই।
আজ প্রকোষ্ঠের মধ্যে সুরী এই বাবুটিকে নানা প্রকার অনুরোধে ব্যস্ত করিয়া তুলিতেছিল।
মেয়ের এই অস্বাভাবিক ব্যবহারে মোহিনী বিস্মিত হইলে সে বাহিরে কিছু বলিত না। অতি নম্রতাবশে মাঝে মাঝে সুরীকে কি যেন কহিতে যাইত, কিন্তু পারিত না। বারবিলাসিনীর কন্যার পক্ষে পুরুষ মানুষের প্রতি অবহেলা দারুণ অধর্ম। মোহিনী সুরীকে পাপ-পথে লইবার জন্য ভগবানের কাছে বহু পাঠা মানত করিয়াছে। মদনমোহনের সম্মুখে গালায় বস্ত্র লইয়া সে কত কাঁদিয়াছে। কিন্তু তবুও দেবতা সদয় হন নাই।
সুরী পতিতা রমণীর সন্তান, কিন্তু তবুও, তাহার ভিতরে একটা অস্বাভাবিকত্ব পরিলক্ষিত হইত, যাহা হতভাগিনীদের জীবনে একেবারেই নূতন, একেবারেই বিস্ময় উৎপাদক। বহুদিন সে তাহার মাকে দেখিয়াছে–কত পুরুষকে লইয়া নৃত্য ও গান করিতে। সে অনেক দিনের কথা। তাহার মায়ের এই জঘন্য রুচির পরিচয় যখনই সে পাইত তখনই তাহার বালিকা হৃদয় বেদনা ও ঘৃণায় ভরিয়া উঠিত।
সে কখনও মাতার সহিত দুই তিন দিন কথা কহিত না। মোহিনী কন্যার বিরক্তি বুঝিতে পারিয়া শেষ বয়সে সকল রকম আনন্দ পরিত্যাগ করিয়াছিল।
মোহিনী ইচ্ছা করিয়া তাহার কন্যাকে লেখাপড়া শিখাইয়াছিল। সুরীর পড়িবার ঘর কত বইয়ে ভরা। বই পুস্তকের মধ্যে সে সর্বদা ডুবিয়া থাকিত। কিন্তু হইলে কি হয়, সে। যে বেশ্যার মেয়ে। বাবুদের আনন্দ বর্ধন করাই যে তাহার জীবনের কাজ। তাই পূর্ব পরিচিত বাবুটি আসিয়া প্রায়ই তাহার কর্তব্য স্মরণ করাইয়া দিতেন। আজও তিনি তাহাকে পথে আনিবার জন্য নানা রকম কথায় ফাঁদ পাতিতেছিলেন। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সুরী বলিল–“মহাশয়, আপনার কতখানি ভুল হইতেছে তাহা আপনি বুঝিতেছেন না। আমার ন্যায় অস্পৃশ্যার সংসর্গে এসে নিজেকে এত হীন কাজে আপনার একটুও লজ্জাবোধ। হইতেছে না? আপনার এই ভালবাসার কোনো মূল্যই নাই। পাপের ভিতর আপনি সান্ত্বনা। খোঁজেন কেমন করিয়া? একটা মিথ্যা ভুলে আপনার মতিভ্রম ঘটিয়াছে। রূপ বলিয়া কোনো কিছু পদার্থ আছে কিনা সন্দেহ। আপনার স্ত্রীর সহিত আমার তুলনা করুন, কীসে আমি তার চেয়ে বড়? তিনি পবিত্র, আমি অপবিত্র, সেই জন্য? তাঁর প্রেম সংযত, আমাদের ভালবাসা উদ্দাম, তার ভালবাসা স্বর্গীয় এবং বিশ্বাসে ভরা, আমাদের প্রেম অস্থির ও বিশ্বাসহীনতায় কলঙ্কিত। তিনি আপনার সুখ ও দুঃখের সহচরী, আর আমরা মধুলুব্ধ ভ্রমরের ন্যায় আপনার সম্পদের চাটুকার। ক্ষমা করুন মহাশয়। এই পাপ হতে ফিরিয়া পড়ুন সতীর বুকে ছুরি হানিবেন না।” কথায় কথায় রাত্রি ১২টা হইয়া গেল। সকলেই ঘুমাইয়া গিয়াছে। মোহিনী আপনার প্রকোষ্ঠে নিদ্রাভিভূতা। শুধু সুরীর ঘরে আলো জ্বলিতেছিল। বাবু বলিলেন, যাদের জাতি নাই, তাদের মুখে এমন উপদেশ শোভা পায় না। আমার স্ত্রীর নাম করিও না। তাহাকে আমি অত্যন্ত ঘৃণা করি; তার রূপ থাকিলেও আমি তাহাকে ঘৃণা করি। আমি তোমাকে ভালবাসি। আমার প্রতি দয়া প্রকাশ কর। বিপুল অর্থের বিনিময়ে আমি তোমার কৃপাভিক্ষা করি।”
সুরী কহিল–“আপনি আপনার স্ত্রীকে ঘৃণা করেন? একথা বলিতে আপনার লজ্জা হল। সত্য কথা বলিতে কী? আপনার বর্তমান অবস্থা যদি তিনি জেনে থাকেন, তা হলে। আপনার তাঁহাকে ঘৃণা করবার তো কোনো অধিকার থাকিবেই না। পারন্তু আপনিই অধিক করিয়া তাহার কাছে ঘৃণার পাত্র হইবেন। আপনার ঘৃণা কি কারণহীন?”
বাবু বলিলেন–“কারণহীন নয়। সে অত্যন্ত অসভ্য।”
সুরী হাসিয়া বলিল–“তাই বুঝি আপনি অসভ্য স্ত্রীকে রাখিয়া অপেক্ষাকৃত সভ্য রমণীর কাছে আসিয়াছেন? আপনার স্ত্রী অসভ্য, তিনি আপনার ভালবাসা লাভের অযোগ্য! আর আমি যোগ্য! আমি অধিক সভ্য! আমার কৌলীন্য-গৌরব বেশি?”
বাবু ধৈর্যশূন্য হইয়া বলিলেন,–“সুরী, অত বিরক্তিকর কথা বলিয়া সময় নষ্ট করিতেছ কেন? এসব বাচালতা পরিত্যাগ কর। ধর্মকথার স্থান ইহা নহে। আমি তোমাকে ভালবাসি। নিষ্ঠুরের মতো তুমি আমার সহিত ব্যবহার করিও না।”
সুরী কহিল–“ইহা ধর্ম-মন্দির নয় স্বীকার করিলাম। কিন্তু মহাশয়! স্মরণ করিবেন ইহা প্রেমেরও স্থান নহে। এখানে দিবারাত্র বাসনায় আগুন জ্বলে। আপনি মনে করিতেছেন আপনার প্রস্তাবে আমি আত্মহারা হইব, তাহা কখনও নহে! যে স্বামী স্ত্রীকে ভালবাসে না সে আমাদের মতো রমণীকে ভালবাসিবে? আপনাকে আমি বিশ্বাস করি না। আপনি অন্ধ হইয়া গিয়াছেন। কিন্তু যখন জ্ঞান হইবে তখন আঘাতে পদাঘাতে দূরে নিক্ষেপ করিবেন; কিংবা যখন আপনার জ্ঞান হইবে তখন আপনি পথের ভিখারি। আমাদের দয়ায় অনেক মানুষ পথের ভিখারি হইয়াছেন। আপনি ফিরিয়া যান। এখানে সুখ নাই। কেবল বাসনার আগুন। কেবল একটা বিরাট ভুলের মধ্যে আপনি চৈতন্যশূন্য হইয়াছেন।
বাবু বলিলেন–“আমি চৈতন্যশূন্য হই নাই। আমার জ্ঞান আছে। জ্ঞান যার নাই সে কখনও এমন করিয়া কাহাকেও ভালবাসিতে পারে না। আমি নিজের সম্পত্তি তোমায় দান করিব।”
সুরী হো হো করিয়া হাসিয়া বলিল–“মহাশয়! এই আপনার জ্ঞান? জিজ্ঞাসা করি, এ সম্পত্তি কার? ইহা কি আপনার নিজের অর্জিত? না, আপনার পিতা পিতামহের? যদি আপনার অর্জিত ধন না হয়, তাহা হইলে পরের দেওয়া দানকে এমন করিয়া পথে ফেলিয়া দিবার আপনার কি অধিকার আছে? এই বিরাট সম্পত্তি আমার ন্যায় অপাত্রে দান না করিয়া, কোনো সকার্যে ব্যয় করুন।”
বাবু বলিলেন–“শয়তানের কাছে আমি নিজেকে বিক্রয় করিতে রাজি আছি। সত্য করিয়া বলিতেছি তোমার মুখে এসব বাজে কথা শোভা পায় না। ভালো কথা বলিয়া দয়া করিয়া আমাকে সুখী কর।”
সুরী আবার কহিল–“আপনার স্ত্রীর সহিত যদি কোনো অপরিচিত লোক এই প্রকার প্রেমালাপ করে, তবে আপনার কি মনে হয়?”
বাবু কহিলে–“স্ত্রীকে তাহা হইলে আমি হত্যা করিব।”
“কেন?”
আমার সম্মুখে, আমার স্ত্রী পরপুরুষের সহিত প্রেমাভিনয় করিবে, আর আমি তাহা দেখিব?
সুরী বলিল–“আর আপনি আপনার স্ত্রীর সম্মুখে পর-রমণীকে লইয়া যে প্রেমাভিনয় করিতেছেন। ইহাতে তিনি কী ভাবিতে পারেন?”
বাবু বলিলেন–“কিছু না।”
সুরী বলিল–“আপনার মাতাকে চরিত্রহীনা বলে জানেন আর তারই উদরে আপনার জন্ম হইয়া থাকে, তা হলে আপনি কী করবেন?
বাবু কোনো কথা না বলিয়া সে স্থান পরিত্যাগ করিয়া গেলেন।