৪. চতুর্থ দিন
রাজুর রাত্রে ঘুমাতে অনেক দেরি হয়েছিল, সকালে উঠতেও অনেক দেরি হল। ঘুম থেকে উঠে দেখে সাগর বারান্দায় একটা মুড়ির টিন নিয়ে বসে চিবিয়ে চিবিয়ে মুড়ি খাচ্ছে। রাজুকে দেখে বলল, “আমি আর জন্মেও মামার সাথে কথা বলব না।”
“কেন?”
“মামা আমাদের এখানে এনে নিজে চলে গেছে। বলেছে চান মিয়া আসবে, সেও আসেনি। কোনোকিছুর ঠিক নেই মামার–”
রাজু মামার পক্ষ টেনে একটু কথা বলার চেষ্টা করল, “কী করবে মামা, হঠাৎ করে যেতে হল!”
সাগর মুখ শক্ত করে মাথা নাড়ল, “না, মামা খুব ভুল কাজ করেছে। আমি মামাকে সেজন্য শাস্তি দেব, কঠিন শাস্তি।”
“শাস্তি দিবি? তুই?”
“হ্যাঁ।”
“কী শাস্তি দিবি?”
“এখনও ঠিক করিনি, চিন্তা করছি। একটা হতে পারে মামার যত বই আছে সবগুলি ছিঁড়ে ফেলা–”
রাজু চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বলছিস তুই, মাথা-খারাপ হয়েছে?”
সাগর মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, মামার সবগুলি বই যদি ছিঁড়ে ফেলে দিই তা হলে মামার উচিত শাস্তি হবে। তা হলে মামা আর জন্মেও আমাদের ফেলে রেখে চলে যাবে না–”
রাজু একটু এগিয়ে বলল, “দেখ, তুই ওসব কিছু করিস না। মামাকে শাস্তি দিতে চাস ভালো কথা, এমনভাবে দে যেন কোনো ক্ষতি না হয়”
“সেটা আবার কী রকম?”
রাজু মাথা চুলকে বলল, “যেমন মনে কর মামার তেলের বোতলে কালি ভরে রাখলাম, মামা যেই গোসল করে এসে মাথায় তেল দেবে কালিতে সারা মুখ মাখামাখি হয়ে যাবে”
ব্যাপারটা চিন্তা করে মুহূর্তে সাগরের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। দাঁত বের করে হেসে বলল, “হ্যাঁ, তা হলে মামার উচিত শাস্তি হবে। উচিত শাস্তি!–”
“তারপর মনে কর মামার যে চিনির বয়াম আছে সেখানে লবণ ভরে রাখলাম। মামা যখন রাত্রে চা বানিয়ে খাবে তখন চা মুখে দিয়েই থু থু করে উঠবে—”
সাগর এবার আনন্দে হেসে ফেলে বলল, “উচিত শাস্তি, উচিত শাস্তি!”
“তারপর মনে কর মামার যে টুথপেস্ট আছে সেটা পিছন থেকে খুলে সব টুথপেস্ট বের করে ভিতরে আমাদের ল্যাদাল্যাদা খিচুড়ি ভরে রাখতে পারি। মামা এসে যেই টুথপেস্ট টিপে ধরবে পিচিক করে হলুদ রঙের খিচুড়ি বের হয়ে আসবে–”
সাগর এবারে হাততালি দিয়ে মাথা নাড়তে থাকে। রাজু বলল, “আগেই বই-টই ছিঁড়িস না।”
রাজু হাতমুখ ধুয়ে এসে সাগরের পাশে বসে মুড়ি খেতে থাকে। মুড়ি জিনিসটা খেতে খারাপ না, কিন্তু এটা কখন খাওয়া বন্ধ করতে হবে বোঝা যায় না। অল্প কিছু মুড়ি নিয়ে বসলে একসময় সেটা শেষ হলে খাওয়া বন্ধ করা যায়। কিন্তু সাগর খুঁজে খুঁজে আস্ত মুড়ির টিন বের করে এনেছে। রাজু মুড়ি খেতে খেতে বলল, “আজকের দিনটা দেখব। যদি মামা না আসে কিংবা চান মিয়া না আসে তা হলে বাসায় চলে যাব।”
সাগর গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ চলে যাব। মামার সবগুলি শাস্তি রেডি করে বাসায় চলে যাব।”
রাজু মুড়ি খেতে খেতে দূরে টিলার দিকে তাকাল–কাল রাতে সেখানে কী ভয়ানক দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিল, আর কী আশ্চর্যভাবে একটা ছেলে নেচে যাচ্ছিল। রাত্রিবেলা সেটা দেখে তার কী ভয়টাই না লেগেছিল, অথচ এখন ব্যাপারটাকে মোটেও সেরকম ভয়ের মনে হচ্ছে না, বরং মজার একটা জিনিস বলে মনে হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কি, জায়গাটা গিয়ে একবার দেখে আসতে ইচ্ছে করছে। রাজু সাগরের দিকে তাকিয়ে বলল, “চল সাগর ঘুরে আসি।”
“কোথায় যাবে?”
“ঐ যে দূরে টিলা দেখা যায় সেখানে।”
“টিলার উপরে?”
“হ্যাঁ।”
“কেমন করে উঠবে?”
“হেঁটে হেঁটে, আবার কীভাবে? উড়ে তো আর যেতে পারব না!”
“টিলার উপরে বাঘ-সিংহ নেই তো?”
রাজু হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো ভঙ্গি করে বলল, “আরে গাধা, আজকাল সুন্দরবনে বাঘ-সিংহ নেই!”
“কোথায় গেছে বাঘ-সিংহ?”
রাজু মুখ ভেংচে বলল, “পিএইচ. ডি. করতে আমেরিকা গেছে। গাধা কোথাকার–এত কথা কিসের! যেতে চাইলে আয়, না হলে থাক।”
“যেতে চাই না। সাগর মুখ বাঁকা করে বলল, তোমার সাথে আমি কোথাও যেতে চাই না।”
রাজু অবিশ্যি সাগরকে একা একা ফেলে রেখে যাচ্ছিল না, তাই গলা নরম করে বলল, “ঠিক আছে, যদি না যেতে চাস তা হলে একলা একলা থাক এখানে। আর যদি আমার সাথে যাস তা হলে তোকে বলব কাল রাত্রে তুই যখন ঘুমাচ্ছিলি তখন আমি কী দেখেছিলাম।”
সাথে সাথে সাগর কৌতূহলী হয়ে উঠল, “কী দেখেছিলে?”
“ঐ টিলার উপরে দাউদাউ আগুন আর তার সামনে তান্ত্রিক সন্ন্যাসী হাতে নরমুণ্ড নিয়ে নাচছে।”
“সত্যি?”
“সত্যি। স্পষ্ট দেখা যায়নি, তবু সেরকমই মনে হল। মামার বাইনোকুলার দিয়ে দেখেছি। তান্ত্রিক সন্ন্যাসী অবশ্য সাইজে বেশি বড় না। ছোটখাটো–”
“আমাকে ডাকলে না কেন? আমি দেখতাম–”
“হ্যাঁ! রাজু নাক দিয়ে তাচ্ছিল্যের মতো একটা শব্দ করে বলল, তোকে ডেকে তুলব! তা হলেই হয়েছে! তুই যখন ঘুমাস কার সাধ্যি আছে তোকে ডেকে তোলে! এখন যদি দেখতে চাস তা হলে চলে–”
সাগর উৎসাহে উঠে দাঁড়াল, বলল, “চলো যাই। কিন্তু আমাদের কিছু করবে না তো?”
“ধুর! কী করবে? দিনের বেলা ফটফটে আলো, রোদ–এর মাঝে সন্ন্যাসীরা কিছু করে না। সন্ন্যাসীদের সব কাজকারবার রাত্রের অন্ধকারে।”
কিছুক্ষণের মাঝে সাগর আর রাজু মামার বাসার পিছনের মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে টিলার দিকে যেতে থাকে। কী সুন্দর একটা দিন, চারিদিকে ঝকঝক করছে আয়নার মতো। রোদটা কী চমৎকার! একটুও গরম না, কী সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি ঠাণ্ডা একটা ভাব–এর মাঝে হাঁটলে সারা শরীরে কেমন জানি আরাম লাগতে থাকে। রাজু আর সাগর হেঁটে হেঁটে গাছগাছালির মাঝে দিয়ে ছোট একটা খাল পার হয়ে টিলার উপর উঠতে থাকে। রাজু বাইরে খুব সাহস দেখালেও তার ভিতরে ভিতরে একটু ভয়-ভয় করছিল। কাল রাতেই সেই বিচিত্র ছেলেটা যদি এখনও থাকে?
টিলার উপরে উঠে অবিশ্যি রাজুর ভয় কেটে গেল, কেউ কোথাও নেই। উপরে ফাঁকা জায়গাটাতে, যেখানে কাল রাতে আগুন জ্বলছিল–কিছু পোড়া কাঠ আর ছাই পড়ে আছে। চারপাশে গাছগাছালির উপর কেউ-একজন নেচেকুঁদে পুরো জায়গাটাকে সমান করে ফেলেছে। রাজু যখন নিচু হয়ে জায়গাটা ভালো করে দেখার চেষ্টাটা করছিল ঠিক তখন কে যেন চিকন গলায় চিৎকার করে উঠল, “আ-গুন-গুন-গুন আগুন-গুন …”
রাজু চমকে উঠে দাঁড়াল, সাগর ভয় পেয়ে ছুটে এল রাজুর কাছে, আর ঠিক তখন তাদের ডান পাশ দিয়ে সরসর করে আগুনের একটা হলকা ছুটে গেল। রাজু আর সাগর একসাথে চিৎকার করে উঠে একজন আরেকজনকে ধরে সামনে তাকাল, দেখল ঠিক তাদের সামনে কালোমতন একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, মাথায় একটা লাল ফিতা বাঁধা। ছেলেটার হাতে পিচকারির মতো কী-একটা জিনিস, আগুনটা সেখানে থেকেই বের হয়েছে।
ছেলেটা তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে আবার চিকন গলায় চিৎকার করে বলল, “খা খা খা, আগুন ধইরা খা!”
সাথে সাথে আরেকটা আগুনের হলকা তাদের গা-ঘেঁষে ছুটে গেল। রাজু কী করবে বুঝতে পারছিল না, শক্ত করে সাগরের হাত ধরে রেখে জোর করে গলায় জোর এনে বলল, “কে? কে তুমি? কী চাও?”
ছেলেটা হঠাৎ হি হি করে হাসতে থাকে, যেন খুব মজার একটা ব্যাপার হয়েছে। হাসতে হাসতেই কাছে এসে গলা নামিয়ে বলল, “ভয় পেয়েছ?”
রাজুর বুকের ভিতর তখনও ধকধক করে শব্দ করছে, সাগর তো প্রায় কেঁদেই দিয়েছে। কোনো কথা না বলে রাজু অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। কালো প্যান্ট আর বোতাম খোলা একটা রংচঙে শার্ট পরে আছে। খালি পা ধুলায় ধূসর, মাথার এলোমেলো চুল একটা লাল কাপড় দিয়ে বাঁধা। ছেলেটা পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, “হঠাৎ দেখে মজা করার শখ হল।”
রাজু কোনো কথা না বলে ছেলেটার দিকে এবং তার হাতের বিচিত্র জিনিসটার দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটা রাজুর হতচকিত ভাব দেখে খুব আনন্দ পেল বলে মনে হল। একগাল হেসে বলল, “ভয়ের কিছু নাই। এইটা মজা করার মেশিন। তোমার বাড়ি কই?” আগে তো দেখি নাই।”
রাজু শেষ পর্যন্ত কথা বলার মতো একটু জোর পেল, নিঃশ্বাস ফেল বলল, “আমি এখানে থাকি না। বেড়াতে এসেছি মামার কাছে।”
“কে তোমার মামা?”
টিলার ওপর থেকে দূরে আজগর মামার ছবির মতো বাসাটা দেখা যাচ্ছিল। রাজু হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, “ঐ যে আজগর মামার বাসা।”
ছেলেটার চোখগুলি হঠাৎ গোল গোল হয়ে গেল। মুখ দিয়ে শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে বলল, “তুমি মাস্টার সাহেবের ভাগনা?”
আজগর মামা কোনো স্কুল-কলেজে পড়ান না, তাকে কেন মাস্টার বলছে রাজু বুঝতে পারল না। অন্য কারও সাথে গোলমাল করেছে কি না সন্দেহ হচ্ছিল, কিন্তু ছেলেটার পরের কথা শুনে তার সন্দেহ দূর হয়ে গেল। ছেলেটা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “আজগর স্যার আমাদের সবার মাস্টার সাহেব–একেবারে ফিরিশতা কিসিমের মানুষ। তার ভাগনা তোমরাও তো আধা–ফিরিশতা। তোমাদের ভয় দেখানো ঠিক হয় নাই। একেবারেই ঠিক হয় নাই।”
ছেলেটি এমন গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়তে লাগল যেন সে ভুল করে কাউকে খুন করে ফেলেছে। রাজু কী বলবে বুঝতে পারছিল না, ছেলেটা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “তোমরা কিছু মনে নাও নাই তো? বুকেহাত দিয়ে বলো।”
বুকে হাত দিয়ে বললে কী হয় রাজু জানে না, কিন্তু তবু সে বুকে হাত দিয়ে বলল, “না, আমি কিছু মনে নিইনি।”
সাগর অবিশ্যি বুকে হাত দিয়ে কিছু বলতে রাজি হল না। উলটো মুখ শক্ত করে বলল, “আমি আজগর মামাকে বলে দেব, তুমি আমাদের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছ–”
ছেলেটা হাহা করে উঠে বলল, “কী বলছ তুমি? আমি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি? আমি?”
“নয়তো কী? এই যে এটা দিয়ে–”
ছেলেটা সাগরের দিকে হাতের পিচকারির মতো জিনিসটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “দেখো, এইটা শুধু মজা করবার জিনিস।”
“কী এটা?”
“এটার নাম দিয়েছি আগুনি পাখুনি।”
“আগুনি পাখুনি?”
“হ্যাঁ।” ছেলেটা আবার রাজুর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল, “এইটা আমার আবিষ্কার, আগুন পাখির মতো উড়াল দিয়া যায় বলে নাম আগুনি পাখুনি। এই যে পিচকারির এইখানে থাকে পেট্রোল, মুখে সিগারেট-লাইটার। ঠিক পিচকারির সময় সিগারেট-লাইটার ফট করে ধরায়ে দিতে হয়, তা হলে ভক করে আগুন জ্বলে ওঠে। এই যে এইভাবে-” বলে কিছু বোঝার আগেই পিচকারি ঠেলে ধরে লাইটার চাপ দিয়ে ছেলেটা বিশাল একটা আগুনের হলকা তৈরি করে ফেলল। রাজু আর সাগর লাফিয়ে পিছনে সরে এল সাথে সাথে।
ছেলেটা মাথা নেড়ে বলে, “ভয়ের কিছু নাই। পাতলা পেট্রোলের আগুনে কোনো তাপ নাই।”
রাজু চোখ বড় বড় করে বলল, “তুমি আগুন দিয়ে খেল?”
ছেলেটা আবার দাঁত বের করে হেসে বলল, “খেলি। আমার আসল নাম ছিল তৈয়ব আলি, এখন সেই নামে আমাকে কেউ চেনে না। এখন সবাই আমাকে ডাকে আগুনালি।”
“আগুনালি?”
“হ্যাঁ, আগুন আলি, তাড়াতাড়ি বললে আগুনালি।”
“সবাই জানে তুমি আগুন নিয়ে খেল? কেউ না করে না?”
“আগে করত, এখন বুঝে গেছে না করে লাভ নাই। এখন আর করে না। তা ছাড়া বুঝে গেছে আমি কারও ক্ষতি করি না। আগুন আমার খুব ভালো লাগে। আগুন ছাড়া আমি থাকতে পারি না–” বলেই তার কথাটা প্রমাণ করার জন্যেই সে ধক করে বিশাল একটা আগুনের হলকা উপরে পাঠিয়ে দিল।
সাগর মুখ হাঁ করে আগুনালির দিকে তাকিয়েছিল। এবার ঢোক গিলে বলল, “তোমার আগুন ভাল লাগে?”
“রসগোল্লার মতো।”
“কাল রাত্রে তুমি এখানে আগুন জ্বালিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ, তোমরা দেখেছিলে?” সাগর মাথা নাড়ল, “না, আমি দেখিনি, ভাইয়া দেখেছিল।
আগুনালি উজ্জ্বল মুখে বলল, “ফাস্ট ক্লাস একটা আগুন হয়েছিল। শুকনা কাঠ, কড়কড় করে পোড়ে, শোঁ-শোঁ করে উপরে ওঠে–কী তেজ আগুনে! কিন্তু কোনো উলটাপালটা কাজ নাই। আমার তো দেখে নাচার ইচ্ছা করছিল।”
রাজু মাথা নাড়ল, “আমি দেখেছি তুমি নাচছিলে।”
ছেলেটা একটু লজ্জা পেয়ে গেল। থতমত খেয়ে বলল, “তুমি কেমন করে দেখেছ?”
“বাইনোকুলার দিয়ে।”
“ও! দুরবিন দিয়া? মাস্টার সাহেবের দুরবিন?”
“হ্যাঁ। তুমি যে এত বড় আগুন করেছিলে, যদি সারা পাহাড়ে সেই আগুন ছড়িয়ে যেত?”
“আগুনালি বুকে থাবা দিয়ে বলল, “আমি যেরকম আগুনকে ভালোবাসি আগুনও আমাকে সেইরকম ভালোবাসে। আগুন আমার কথা ছাড়া এক পা নড়ে না।”
“আগুন এক পা নড়ে না?”
“না। এক ড্রাম পেট্রোল রাখো, তার এক হাত দূরে আমি দুই-মানুষ সমান উঁচু আগুন করে দেব, আগুন পেট্রোলকে ছোঁবে না।”
রাজু অবাক হয়ে বলল, “কেমন করে সেটা করবে?”
“আগুনকে বুঝতে হয়। যখন ভালো করে আগুন ধরে তখন গরম বাতাস ওপরে ওঠে। তখন চারপাশ থেকে বাতাস আসে, সেই বাতাসে আগুন নড়েচড়ে। সেই বাতাস দিয়ে বোঝা যায় আগুন কোন দিকে যাবে। তখন ইচ্ছা করলে আগুনকে কন্ট্রোল করা যায়।
“তুমি কন্ট্রোল করতে পার?”
“পারি।” কথা বলতে বলতে আগুনালি অন্যমনস্কভাবে পকেট থেকে একটা ম্যাচ বের করে একসাথে চারটা ম্যাচের কাঠি দিয়ে ফস করে আগুন ধরিয়ে সেটার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, “আমি আগুন কন্ট্রোল করতে পারি। আজকাল এই এলাকায় যখন আগুন লাগে তখন দমকল বাহিনীকে খবর পাঠাবার আগে আমাকে খবর পাঠায়। দমকল বাহিনী যাবার আগে হাজির হয় এই আগুনালি!”
“তুমি গিয়ে কী কর?”
“আগুনের সাথে কথা বলি।”
“ধুর! আগুনের সাথে আবার কথা বলে কেমন করে?”
আগুনালি আবার দাঁত বের করে হেসে বলল, “সেটা তোমরা বুঝবা না। আলাউদ্দিন ব্যাপারির পাটের গুদামে যখন আগুন লেগেছিল তখন আমাকে ডাকল। গিয়ে দেখি উলটা জায়গায় পানি দিচ্ছে। আমি বললাম, কোনো লাভ নাই, আগুনের তেজ অনেক বেশি দক্ষিণ দিকে বাঁচাতে পারবা না। একটু পরেই পিছন-ঝাঁপটা দেবে, ভুম করে আগুন আকাশে উঠে যাবে। দেখবে তখন আগুন কতদূর যায়! উত্তর দিকে পানি দাও, অন্তত দুইটা গুদাম বাঁচবে। আমার কথা শুনল না, তিনটা গুদাম পুড়ে শেষ।”
কথা বলতে বলতে আগুনালি মুখে লোল টেনে বলল, “আহ্, কী একটা আগুন! লকলক করে উপরে উঠছে, ঠাস-ঠাস করে ফুটছে, দাউদাউ করে জ্বলছে। আর শাই-শাই করে বাতাস–কী দৃশ্য! আহ!”
রাজু আর সাগর অবাক হয়ে আগুনালির দিকে তাকিয়েছিল। আগুনালি হঠাৎ একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “এখন তোমাদের কথা বলো। কয়দিন থাকবে এখানে?”
রাজু সাগরের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “মনে হয় আজকেই চলে যাব।”
“আজকেই চলে যাবে? কেন? থাকো কয়দিন।”
“নাহ্!”
“কেন? আমাদের জায়গা ভালো লাগে না তোমাদের?”
“ভালো লাগে। ভালো লাগবে না কেন?”
“তা হলে?”
“আসলে আজগর মামা কয়দিনের জন্যে বাইরে গেছেন। চান মিয়াও নেই। খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট।”
“খাওয়ার কষ্ট? হোটেলে খাও না কেন?”
“হোটেলে?”
“হ্যাঁ, আমার সাথে ইস্পিশাল খাতির, আমি বললেই দেখবা এই বড় বড় গোশতের টুকরা দেবে।”
শুধু খাওয়ার কষ্ট না–রাজু মাথা নেড়ে বলল, “অন্য ঝামেলাও আছে।”
“কী ঝামেলা?”
“মামার এত বড় বাসা, একলা একলা থাকতে ভয় করে।”
“কিসের ভয়?”
রাজু কিছু বলার আগেই সাগর বলল, “ভূতের।”
রাজু ভেবেছিল সাগরের কথা শুনে আগুনালি হো হো করে হেসে উঠবে, কিন্তু আগুনালি একটুও হাসল না, বরং মুখটা খুব গম্ভীর করে ফেলে বলল, “তা ঠিক, পাহাড়ি জায়গায় ভূতপ্রেতের বড় ঝামেলা। তালতলার পীর এক নম্বর তাবিজ দেন, জিন-ভূতের আবার সাধ্য নাই কাছে আসে। কিন্তু একটা সমস্যা”।
“কী সমস্যা?”
“পীর সাহেব বাচ্চা পোলাপান দেখলে খুব রাগ করেন। শরিফুদ্দি গিয়েছিল গতবার, খড়ম ছুঁড়ে মারলেন। চানদিতে লেগে একেবারে ফাটাফাটি অবস্থা! বড় কাউকে নিয়ে যেতে হবে।” আগুনালি চোখ ছোট ছোট করে চিন্তা করতে করতে অন্যমনস্কভাবে বলল, “একটা উপায় অবশ্যি আছে।”
“কী উপায়?”
“গফুরের একটা তাবিজ আছে–ভাড়া দেয়। ভাড়া নিয়ে আসা যায়। আমি বললে মনে হয় বেশি দরদাম করবে না।”
রাজু অবাক হয়ে আগুনালির দিকে তাকিয়ে রইল। তার বয়সী একটা ছেলে তাবিজ ঝাড়ফুক বিশ্বাস করে, সেই ব্যাপারটাই তার বিশ্বাস হচ্ছে না–এখন সে তাবিজ ভাড়া করার কথা বলছে! তার হঠাৎ হাসি পেয় গেল, কিন্তু সে হাসল না। মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি তাবিজ বিশ্বাস করি না।”
আগুনালি চোখ কপালে তুলে বলল, “বিশ্বাস কর না?”
“না।“
“আমার আপন ফুপাতো বোন, আপন ফুপাতো বোন–”বেশি উত্তেজনায় কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ আগুনালির মুখে কথা আটকে গেল। কয়েকবার চেষ্টা করে হঠাৎ হাল ছেড়ে দিলে পাথরের মতো মুখ করে বলল, “তার মানে তুমি বলতে চাও যে তুমি ভূতও বিশ্বাস কর না?”
রাজু মাথা নাড়ল, “না।”
আগুনালির পাথরের মতো শক্ত মুখ এবার আষাঢ়ের মেঘের মতো কালো হয়ে থমথম করতে লাগল। সে আবার অন্যমস্কের মতো পকেট থেকে একটা ম্যাচ বের করে এবারে একসাথে ছয়টা কাঠি নিয়ে ফস করে আগুন ধরিয়ে নিয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে রইল, আগুনটা জ্বলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে কাঠিগুলি ধরে রেখে যখন আঙুলে ছ্যাঁকা লাগার অবস্থা হল তখন দূরে ছুঁড়ে ফেলল। তারপর মুখ তুলে রাজুর দিকে তাকিয়ে বলল, “এক লাখ টাকা।”
“এক লাখ টাকা কী?”
“এক লাখ টাকা বাজি।”
“কিসের জন্য?”
“ভূতের জন্য।”
“ভূতের জন্য?”
“হ্যাঁ।”
রাজু ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতে পারল না, “বলল, ভূতের জন্য বাজি মানে। কী?”
“আমি তোমাকে ভূত দেখাব।”
“দেখাতে না পারলে তুমি আমাকে এক লাখ টাকা দেবে?”
“হ্যাঁ, আর দেখাতে পারলে তোমার আমাকে এক লাখ টাকা দিতে হবে।”
রাজু মাথা নাড়ল, “আমার এক লাখ টাকা নেই, কোনোদিন হবেও না।”
“আমারও নাই এক লাখ টাকা।” আগুনালি বাজির দর কমিয়ে আনে, “দশ টাকা বাজি।”
“এক লাখ থেকে একবারে দশ?”
আগুনালি বিরক্ত হয়ে বলল, “টাকাটা তো আর বড় কথা না–বড় কথা হচ্ছে মুখের জবান।”
“তুমি জবান দিচ্ছ যে তুমি আমাকে ভূত দেখাবে?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি নিজে দেখেছ ভূত?”
আগুনালি বুকে থাবা দিয়ে বলল, “এই বান্দা কোনো জিনিস নিজে না দেখে মুখ খোলে না।”
‘কীরকম দেখতে?”
“যখন দেখবে তখন জানবে। এই বান্দা আগে থেকে কোনো জিনিস বলে।”
“কোথায় ভূতটা?” আগুনালি আবার বুকে থাবা দিয়ে বলল, “এই বান্দা আগে থেকে কিছু বলবে।”
সাগর খুব অবাক হয়ে দুজনের কথাবার্তা শুনছিল, এবার গলা বাড়িয়ে বলল, “তুমি কি ভূতটা ধরে একটা শিশিতে ভরে দিতে পারবে?”
আগুনালি খানিকক্ষণ হাঁ করে সাগরের দিকে তাকিয়ে রইল, রাজুর মনে হল রেগেমেগে কিছু একটা বলবে, কিন্তু কিছু বলল না। যখন সাগর তার অভ্যাসমতো আবার জিজ্ঞেস করল, তখন মাথা নেড়ে বলল, “না, আমি পারব না।”
“কেন পারবে না? তুমি যদি দেখতে পার তা হলে কেন ধরতে পারবে না?”
“একটা জিনিস দেখা গেলেই সেটা ধরা যায় না। মাছি তো দেখছ, কোনোদিন একটা মাছি ধরতে পেরেছ?”
সাগর এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, “কিন্তু মশা ধরেছি। মশা ধরা তো অনেক সোজা।”
“ভূত আর মশা এক জিনিস না–”আগুনালি সাগরের সাথে কথায় বেশি সুবিধে করতে পারছিল না বলে রাজুর দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন বলো ভূত দেখতে চাও কি না।”
রাজু মাথা চুলকে বলল, “কিন্তু ভাবছিলাম বাসায় ফিরে যাব।”
সাগর মাথা নাড়ল, “না ভাইয়া, চলো ভূতটা দেখে যাই। যদি ধরতে পারি তা হলে আরও মজা হবে।”
আগুনালি বলল, “শুধু ভূত! এখানে কত কী দেখার আছে, দুই মাথাওয়ালা গোরু, মাকড়শা কন্যা, মাটির নিচের গুহা, ঝুলন্ত ব্রিজ, নরবলি মন্দির, মৌনি সাধু–”
“কোথায় সেগুলি?”
“এই তো আশেপাশে। কত দূর দূর থেকে লোকজন দেখতে আসে, আর তুমি এখানে থেকেও না দেখে চলে যেতে চাও? থেকে যাও, আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।”
রাজু আগুনালির দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু সবার আগে দেখাবে ভূত।”
আগুনালি আবার দাঁত বের করে হাসল, হয় তার দাঁত বেশি, নাহয় অল্পতেই দাঁত বের হয়ে যায়–কিন্তু ছেলেটা মজার তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
.
কিছুক্ষণ পর দেখা গেল আগুনালির সাথে রাজু আর সাগর বের হয়েছে। প্রথমে দেখতে যাবে দুই মাথাওয়ালা গোরু। জায়গাটা বেশ দূর। প্রথমে খানিকটা জায়গা রিকশা করে যেতে হয়। রিকশা থেকে নেমে বাকি রাস্তা হেঁটে। গ্রামের সড়ক, দুপাশে ধানক্ষেত আর গ্রাম দেখতে ভারি সুন্দর দেখায়। সড়কের মাঝে নরম একধরনের ধুলা, পা ফেললে গেঁথে যায়, ভারি আরাম লাগে তখন। রাজুর ধারণা ছিল সাগর একটু পরেই মেজাজ খারাপ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেবে, কিন্তু দেখা গেল তার উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। রাস্তায় দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে, পাশে ঝোঁপঝাড় থেকে ফুল তুল আনছে, পানিতে ঢিল ছুঁড়ছে। এক জায়গায় ঝোঁপঝাড় স্বর্ণলতায় ঢেকে আছে, সেটা খুব কৌতূহল নিয়ে দেখল। আগুনালি স্বর্ণলতা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তাকে একটা চশমা তৈরি করে দিল, এই চশমা পেয়ে তার আনন্দ দেখে কে! তিনজন তিনটা চশমা পরে হেঁটে যেতে যেতে হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছিল।
দুই মাথাওয়ালার গোরুর জায়গাটা খুঁজে বের করতে বেশি অসুবিধে হল না, আগুনালি আগে এসেছে। একটা গৃহস্থের বাড়ি, বাসার সামনে গাছ, সেই গাছে একটা সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডে খুব কাঁচা হাতে দুই মাথাওয়ালা একটা গোরুর ছবি আঁকা, তার পাশে গোরুর বৃত্তান্ত। এই গোরুর নাকি আল্লার বিশেষ কুদরত এবং এর সাথে শরীর ঘষে দিলেই নাকি বাতের ব্যথা উপশম হয়। এর গোবর পেটে লেপে দিলে গর্ভবতী মহিলাদের প্রসব বেদনা ছাড়া বাচ্চা হয়, এর পেশাব মধুর সাথে মিশিয়ে খেলে নাকি কালাজ্বর এবং ম্যালেরিয়া রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়। সাইবোর্ডের নিচে বিভিন্ন রকম মূল্য-তালিকা রয়েছে। বাসার সামনে মানুষজনের ভিড়–সবার হাতে শিশি নাহয় কৌটা রয়েছে, মনে হচ্ছে গোরুর গোবর এবং পেশাব কিনতে এসেছে। এইরকম একটা ব্যাপার যে ঘটতে পারে নিজের চোখে না দেখলে রাজু বিশ্বাস করত কি না সন্দেহ।
এক টাকা করে টিকেট কিনে তারা একটা চালাঘরে ঢুকল। ঘরের ভিতরে আবছা অন্ধকার, তার মাঝে আগরবাতি জ্বলছে। ঘরের মেঝেতে একটা কথা বিছানা, সেখানে একটা গোরু দাঁড়িয়ে আছে। গোরুর গলার এক পাশে টিউমারের মতো একটা জিনিস বের হয়ে আছে। সেখানে কাঁচা হাতে চুন এবং আলকাতরা দিয়ে দুটো চোখ আঁকা হয়েছে। হঠাৎ দেখলে একটু চমকে উঠতে হয়, কিন্তু সেটি যে সত্যিকারের মাথা নয় সেটি বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না। উপস্থিত লোকজন কিছু কেউ সেটা নিয়ে একটা কথাও বলছে না। গোরুর কাছে চাপ দাড়িওলা একজন মানুষ দাঁড়িয়েছিল, সে এই গোরুর জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে একটা বড় বক্তৃতা দিল–বক্তৃতার মাঝেই হঠাৎ গোরুর বাথরুম করার প্রয়োজন হল, মানুষটি তখন বক্তৃতা বন্ধ করে এক ছুটে একটা বালতি এনে সেটাতে গোরুর মূল্যবান গোবরটাকে রক্ষা করে ফেলল। পুরো ব্যাপারটা এত বিচিত্র যে রাজু হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে। বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর কয়েকজন বুড়ো মানুষ শার্ট গেঞ্জি খুলে খালি গা হয়ে গোরুর সাথে শরীর ঘষে নিল, তাদের মুখ দেখে সত্যিই মনে হল তাদের বাতের ব্যথা বুঝি পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে।
রাজু আগুনালিতে খোঁচা দিয়ে বলল, “চলো যাই।”
“আর দেখবে না?”
“না।”
সাগর বের হওয়ার সময় চাপ দাড়িওয়ালা মানুষটাকে গোরুর দুই নম্বর মাথাটা দেখিয়ে বলল, “এইটা তো সত্যিকার মাথা নয়–”
সাগরের কথা শুনে চাপ দাড়িওয়ালা মানুষটা একেবারে থতমত খেয়ে যায়। কী-একটা কথা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই আগুনালি সাগরের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে চালাঘর থেকে বের করে আনে।
বাইরে বের হয়ে সাগর বলল, “কালি দিয়ে চোখ এঁকেছে! নকল মাথা!”
বাইরে যারা দাঁড়িয়েছিল তাদের যে-কয়জন সাগরের কথা শুনতে পারল সবাই মাথা ঘুরিয়ে সাগরের দিকে চোখ-গরম করে তাকাল। আগুনালি মানুষগুলির দিকে তাকিয়ে কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গি করে বলল, “ছোট গোলাপান তো, কী বলতে কী বলে তার ঠিক নাই–”
তারপর সাগর আর রাজুকে নিয়ে সড়ক ধরে হাঁটতে শুরু করে। বেশ খানিক যাবার পর রাজু বলল, “তোমার ভূত কি এইরকম দুই মাথাওয়ালা গোরুর মতো?”
“মানে?”
“এইরকম ফাঁকিবাজি?”
“এটা ফাঁকিবাজি ছিল?”
“ফাঁকিবাজি নয়তো কী! আলকাতরা দিয়ে চোখ এঁকে রেখেছে।”
“তা হলে মানুষ আসছে কেন দেখতে?”
“মানুষ না জেনে আসছে।”
আগুনালি কোনো কথা না বলে খামোখাই তার পিচকারিটা হাতে নিয়ে আকাশের দিকে একটা আগুনের হলকা পাঠিয়ে দিল–বোঝা গেল সে একটু রেগে গেছে।
.
হেঁটে এবং রিকশা করে তারা যখন ফিরে এল তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। বাজারের কাছে একটা হোটেলের সামনে তারা রিকশা থামিয়ে নেমে গেল। আগুনালি বলল, এটা নাকি তার পরিচিত হোটেল। ভিতরের দিকে একটা খালি টেবিলে বসে আগুনালি হাঁক দিল, “কাউলা ভাই, এই টেবিলটা ভালো করে মুছে দেন, এরা মাস্টার সাহেবের ভাগনা।”
আগুনালির খাতিরেই হোক আর আজগর মামার ভাগনে বলেই হোক, কাউলা নামের মানুষটা টেবিল মুছ ধোয়া গ্লাসে পানি এনে দিল। আগুনালি জানতে চাইল খাবার কী আছে। কাউলা নামের মানুষটা যন্ত্রের মতো কী কী মাছ-তরকারি আছে বলে গেল। তার মাঝে কী কী খাওয়া যায় সেটা নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা করে শেষ পর্যন্ত খাবার অর্ডার দেওয়া হল।
কিছুক্ষণের মাঝেই খাবার চলে এল। থালাবাসন সবই খুব পরিষ্কার, মাছ তরকারি দেখতেও খুব সুন্দর লাগছে, কিন্তু খেতে গিয়ে দেখা গেল খুব ঝাল। রাজু তবু কষ্ট করে খেয়ে নিচ্ছিল। সাগরের খুব ঝামেলা হল, চোখে-নাকে পানি এসে যাচ্ছিল। আগুনালি তখন সাগরের মাছ-তরকারি ডালের মাঝে ধুয়ে দিল, এবং সত্যি সত্যি তখন ঝাল কমে গিয়ে মোটামুটিভাবে খাবারের মতো অবস্থায় এসে গেল।
আগুনালি খুব কাজের মানুষ, খাওয়া-দাওয়ার পর হোটেলে ম্যানেজারের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করে নিল, প্রত্যেকদিন দুপুরে আর রাত্রে আজগর মামার বাসায় খাবার পৌঁছে দেবে। আগে থেকে কিছু টাকা দিতে হবে কি না রাজু জিজ্ঞেস করতে চাইছিল, ম্যানেজার সাথে সাথে জিবে কামড় দিয়ে বলল, “মাস্টার সাহেবের বাসায় খাবার পাঠাব, তার জন্য অ্যাডভান্স নিলে দোজখেও জায়গা হবে না।”
আজগর মামা ঠিক কী করেন কে জানে, কিন্তু এই এলাকার মানুষজন তাঁকে সত্যি সত্যি ফিরিশতার মতো মনে করে।
হোটেল থেকে বের হয়ে বাজারটা ওরা একটু ঘুরে দেখল। ছোট ছোট নানারকম দোকানপাট আছে, তার মাঝে নানা ধরনের জিনিসপত্র। একপাশে কিছু বেদেনি চুড়ি নিয়ে বসেছে, অন্য পাশে মাটির খেলনা, শোলার পাখি। সাগর একটা শোলার পাখি এবং গলায় স্প্রিং লাগানো মাটির রবীন্দ্রনাথ কিনল, রবীন্দ্রনাথের মাথায় টোকা দিলেই তিনি মাথা নাড়তে থাকেন। আব্বা আর আম্মা দুজনেই রবীন্দ্রনাথের এত বড় ভক্ত যে তারা এটা দেখলে মনে হয় চটে যেতে পারেন।
রাজু আর সাগরকে আগুনালি যখন বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল তখন বিকেল হয়ে গেছে। আগুনালি আর বসল না, সাথে সাথেই চলে গেল, রাত্রিবেলা আবার আসবে ভূত দেখাতে নেওয়ার জন্য। বাসা ওরা যেভাবে তালা মেরে রেখেছিল ঠিক সেভাবেই আছে, চান মিয়ার এখনও দেখা নেই। রাজু অবিশ্যি সেটা নিয়ে ঘাবড়ে গেল না, এখন মনে হচ্ছে চান মিয়াকে ছাড়াই তারা কয়েকদিন চালিয়ে নিতে পারবে।
সারাদিন হেঁটে হেঁটে ওরা খুব ক্লান্ত হয় ফিরে এসেছে। সাগর শোলার পাখিটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ খেলে সোফায় বসে বসেই হঠাৎ ঘুমিয়ে গেল। ঘুম জিনিসটা মনে হয় সংক্রামক, তাই রাজু ঘুমাবে না ঘুমাবে না করেও শেষ পর্যন্ত চোখ ভোলা রাখতে পারল না। সাগরের দেখাদেখি সেও একটা সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
অসময়ে অজায়গায় ঘুমিয়ে গেলে সাধারণত বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখা যায়, রাজু সেটা হাড়েহাড়ে টের পেল। সোফায় শুয়ে শুয়ে এমন সব স্বপ্ন দেখতে লাগল যে বলার নয়! স্বপ্নে দেখল দুই মাথাওয়ালা গোরু শিং উঁচিয়ে তাদের তাড়া করে আসছে, রাজু প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটছে। তখন হঠাৎ গোরুটা মুখ হাঁ করে বিদঘুঁটে একটা আওয়াজ করল–সাথে সাথে গোরুর মুখ দিয়ে আগুনের হলকা বের হয়ে এল। তখন হঠাৎ আগুনালিকেও দেখা গেল, সে তার আগুনের পিচকারি নিয়ে হাজির হয়ে দুই মাথাওয়ালা গোরুর সাথে যুদ্ধ করতে শুরু করেছে। ঠিক তখন তার আগুনের পিচকারি থেকে আগুন বের না হয়ে ঝাল মাছের ঝোল বের হতে শুরু করেছে স্বপ্নে সেটাও খুব বিচিত্র মনে হচ্ছে না, তাই নিয়েই আগুনালি যুদ্ধ করছে। ওদেরকে ঘিরে লোকজনের ভিড় জমে গেছে আর তাদের চাচামেচিতে রাজুর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে উঠে দেখে হোটেল থেকে একটা ছেলে খাবার নিয়ে এসে ডাকাডাকি করছে। ছেলেটা ছোট, সে প্রায় তার সমান-সমান একটা টিফিন-ক্যারিয়ার ভরে খাবার নিয়ে এসেছে। রাজু রান্নাঘরে গিয়ে খোঁজাখুজি করে কিছু বাসনপত্র বের করে সেখানে খাবার ঢেলে রাখল।
ছেলেটা চলে যাবার পর রাজু খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। অসময়ে ঘুমিয়েছে বলে মনটা কেমন জানি ভালো লাগছে না, শুধু আম্মা-আব্বার কথা মনে হচ্ছে। চুপচাপ খানিকক্ষণ মন খারাপ করে বসে থেকে সে সাগরকে ডেকে তুলল। ঘুমের মাঝে ওলটপালট করে তার শোলার পাখিটা ভেঙেচুরে গেছে, ঘুম থেকে উঠে সে সেটা নিয়ে খানিকক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করল। কিন্তু নিজেই ভেঙেছে, বলার কিছু নেই। তার উপর কদিন থেকে কান্নাকাটি করে খুব সুবিধে করতে পারছে না, কেউ শোনার নেই, তাই খামোখা আর কাঁদল না।
দুজনে হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে খেতে বসল। আগুনালি হোটেলের ম্যানেজারকে অনেকবার বলে দিয়েছিল যেন ঝাল কম করে দেয়, কিন্তু তবু লাভ হয়নি। সবকিছুতেই আগুনের মতো ঝাল।
আগুনালির শিখিয়ে দেওয়া কায়দায় সবকিছু ডালের মাঝে ধুয়ে নেওয়ার পর তারা মোটামুটি শখ করেই খাওয়া শেষ করল। যে-পরিমাণ খাবার এনেছে সেটা দুজনেই শেষ করার মতো নয়, খাবার বেশির ভাগই পড়ে রইল বাটিতে।
খাওয়া শেষ করে রাজু আর সাগর জুতোমোজা পরে আগুনালির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। দিনের বেলা ভূত দেখার ব্যাপারটা নিয়ে হাসি-তামাশা করেছে, পুরোটাই একটা মজার জিনিস বলে মনে হয়েছে। কিন্তু রাত্রিবেলা যখন চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে, এমনিতেই একটা গা-ছমছমানি ভাব–তখন হঠাৎ করে ভূত দেখতে পাওয়ার ব্যাপারটা থেকে মজার অংশটুকু উধাও হয়ে গিয়ে সেটাকে ভয়ের জিনিস মনে হতে শুরু করেছে।
আগুনালি এসে পৌঁছাল বেশ রাতে। তার সাথে পিচকারির মতো জিনিসটা নেই, হাতে ছোট ছোট দুটো বাঁশের কঞ্চি। রাজু জিজ্ঞেস করল, “এই কঞ্চি দিয়ে কী করবে?”
“তোমাদের জন্যে।”
“আমাদের জন্যে?”
“হ্যাঁ। তোমাদের তো জিন-ভূতের তাবিজ নাই সেইজন্যে। বাঁশের কঞ্চি একটু পুড়িয়ে নিয়ে সাথে রাখলে জিন-ভূত আসে না।”
দিনের বেলা হলে রাজু পুরো ব্যাপারটা নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিত, কিন্তু এই রাত্রিবেলা সেটা নিয়ে সে হাসাহাসি করল না। কঞ্চি দুটো নিয়ে নিজেদের পকেটে রেখে দিল।
যখন রাজু আর সাগর আগুনালির সাথে বের হল তখন রাত সাড়ে দশটা। ঘর থেকে বের হতেই মনে হল চারিদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। রাজুর হাতে মামার বড় টর্চলাইটটা ছিল, সেটা জ্বালাতেই আগুনালি বলল, “লাইট জ্বালিও না।”
“কেন?”
“সাথে আলো থাকলে ভূত আসে না। তা ছাড়া আলো না জ্বালালে চোখে আস্তে আস্তে অন্ধকার সয়ে যায়, তখন অন্ধকারেই সব স্পষ্ট দেখা যায়।”
রাজু প্রথম আগুনালির কথা বিশ্বাস করেনি, কিন্তু একটু পরেই দেখল তার কথা সত্যি। প্রথম যখন ঘর থেকে বের হয়েছিল মনে হচ্ছিল চারপাশে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার–এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কিছুক্ষণেই চারপাশের সবকিছু বেশ স্পষ্ট হয়ে এল। রাস্তা, রাস্তার পাশে গাছপালা–সবকিছু আবছাভাবে বোঝা যায়। আকাশে ছোট একটা চাঁদ, সেটা থেকে অল্প একটু আলো ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু সেই অল্প আলোতেই যে এত কিছু দেখা সম্ভব কে জানত!
হাঁটতে হাঁটতে রাজু জিজ্ঞেস করল, “আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? কারও বাড়িতে?”
আগুনালি মাথা নাড়ল, “না, ঠিক বাড়িতে না।”
“তা হলে কি শ্মশানে?”
“না। ঐসব জায়গায় যাওয়া ঠিক না। খারাপ রকমের জিনিস থাকে। তাবিজেও কাজ হয় না।”
“তা হলে কোথায়?”
“এই এলাকায় একটা বড় বাড়ি ছিল। নাম ছিল নাহার মঞ্জিল। বড় বাড়ি, বিশাল এলাকা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সেই বাড়িতে থাকত কাশেম আলি চৌধুরী। বড় রাজাকার ছিল কাশেম আলি। এই এলাকায় যখন পাকিস্তানি মিলিটারি আসত তার বাড়িতে ঘাঁটি করত। মানুষজনকে ধরে নিত তার বাড়িতে, অত্যাচার করে গুলি করে মারত তাদেরকে। অনেক মেয়েকেও মেরেছে–অনেকে নিজের গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেছে।”
“কেউ কিছু বলেনি?”
“যুদ্ধের সময় ভয়ে কিছু বলে নাই। যখন যুদ্ধ শেষ হয়েছে তখন এলাকার মানুষেরা পুরো বাড়িটা পুড়িয়ে দিয়েছে।”
“আর কাশেম আলি?”
“সেই ব্যাটা পাকিস্তানে পালিয়ে গেছে। তাকে ধরতে পারে নাই। ধরতে পারলে জ্যান্ত তার চামড়া ছিলে ফেলত।”
“এখন তো সব রাজাকার পাকিস্তান থেকে ফেরত আসছে, সেই ব্যাটা ফিরে আসেনি?”
“জানি না। যা-ই হোক, সেই নাহার মঞ্জিল এখন ভেঙেচুরে পড়ে আছে–বলতে গেলে ভূতের বাড়ি। সেই বাড়িতে এত মানুষ মেরেছে যে জায়গাটা আর ঠিক হয় নাই। রাত গম্ভীর হলেই নানারকম চিৎকার শোনা যায়। মানুষজন এদিক দিয়ে গেলে অনেক কিছু দেখে
“অনেক কিছু কী?”
“এখন বলতে চাই না। শুনলে তোমরা ভয় পাবে।”
শুনেই হঠাৎ রাজুর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সাগর ভয় পেল আরও বেশি, হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, “আমি যেতে চাই না। বাসায় যাব।”
আগুনালি বলল, “ভয়ের কিছু নাই, আমরা তো আর নাহার মঞ্জিলের ভিতরে ঢুকব না। দূর থেকে দেখব।”
“দূর থেকে?”
“হ্যাঁ, অনেক দূর থেকে।”
“যখন রাত হবে তখন কথা শুনতে পারবে, ছায়ার মতো জিনিস দেখবে–”
সাগর আবার দাঁড়িয়ে গেল, ভয়-পাওয়া গলায় বলল, “যেতে চাই না। আমি।”
এতদূর এসে ফিরে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। রাজু সাগরকে বুঝিয়ে রাজি করাল, কানে-কানে বলল, “আমার কাছে টর্চলাইট রয়েছে না? জ্বালিয়ে দেব, সাথে সাথে সব চলে যাবে।
শেষ পর্যন্ত সাগর যেতে রাজি হল। নাহার মঞ্জিল রাস্তা থেকে একটু ভিতরে, একসময়ে নিশ্চয়ই রাস্তা ছিল, দীর্ঘ দিন রাস্তা ব্যবহার করা হয়নি বলে ঝোঁপঝাড়ে ঢেকে আছে। ঝোঁপঝাড় ভেঙে রাজু আর সাগর আগুনালির পিছনে পিছনে যেতে থাকে। নাহার মঞ্জিলের কাছাকাছি পৌঁছে আগুনালি ফিসফিস করে বলল, “এইখানে থামো।”
রাজু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “বাসাটা কই?”
আগুনালি হাত দিয়ে দূরে একটা টিবির মত জিনিস দেখিয়ে দিল। অন্ধকারে ভালো বোঝা যায় না, কিন্তু একসময় নিশ্চয়ই অনেক বড় বাসা ছিল। রাজু চেষ্টা করেও বাসাটা ভালো করে দেখতে পেল না।
সাগর রাজু আর আগুনালি দুজনের মাঝখানে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়েছিল, কাঁপা গলায় বলল, “কখন আসবে ভূত?”
“কোনো ঠিক নাই। আগুনালি ফিসফিস করে বলল, “এখনও আসতে পারে, আবার দেরিও হতে পারে।”
“আমরা এইখানে দাঁড়িয়ে থাকব?”
“ইচ্ছা হলে বসতেও পার। এই গাছে হেলান দিয়ে।”
রাজু, সাগর আর আগুনালি বড় একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে থাকে। কপাল ভাল মশা খুব বেশি নেই, তা না হলে ভূত দেখার শখ মিটে যেত। মাঝে মাঝে একটু-দুইটা মশা পিনপিন করে খোঁজখবর নিয়ে চলে যাচ্ছে, খুব সাহসী হলে টুকুস করে একটা কামড় দিচ্ছে, তার বেশি কিছু নয়।
ওরা কতক্ষণ বসেছিল কে জানে, হঠাৎ আগুনালি ফিসফিস করে বলল, “ঐ দেখো”
রাজু আর সাগর চমকে উঠল, “কোথায়?”
“ঐ যে ওপরে দেখছ সাদামতো কী-একটা নড়ছে–”
রাজু ভালো করে তাকিয়ে হঠাৎ শিউরে উঠল, সত্যি সত্যি সাদামতো কী একটা যেন উপরে ভেসে বেড়াচ্ছে। শক্ত করে সাগরকে ধরে রেখে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে–ঠিক তখন সে একটা শব্দ শুনতে পেল মনে হল–একটা মেয়ের গলার স্বর। প্রথমে মনে হল কেউ যেন কিছু-একটা বলছে, তারপর মনে হল কথা বলছে না–কেউ একজন কাঁদছে। একটু পর মনে হল, না কাঁদছে না, কেউ একজন গান গাইছে।
ভয়ে আর আতঙ্কে রাজুর শরীর অল্প অল্প কাঁপতে থাকে। আগুনালি ফিসফিস করে বলল, “ভয়ের কিছু নাই, আমার কাছে পীর সাহেবের তাবিজ আছে।”
সাগর গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ভূতেরা কি আমাদের দেখতে পাচ্ছে?”
আগুনালি বলল, “ভূতেরা সবকিছু দেখতে পায়।”
“তা হলে কি আমাদের কাছে আসবে?”
“না, আসবে না।”
রাজু তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে, আবছা সাদামতো জিনিসটা যেন ভেসে বেড়াচ্ছে, সাথে মেয়েলি গলার একটা শব্দ। হঠাৎ করে শব্দটা থেমে গেল–কোথাও কোনো শব্দ নেই। সাগর ভয়-পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী হল? শব্দ বন্ধ হয়ে গেল কেন?”
হঠাৎ পুরুষকণ্ঠের একটা চিৎকার শোনা গেল। কেউ যেন খুব রেগে কিছু একটা বলছে, তারপর মেয়েলি গলায় একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। রাজুর সারা শরীর আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে ওঠে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো যাই।”
আগুনালি ফিসফিস করে বলল, “আর দেখবে না?”
“না।”
“চলো তা হলে। ভয়ের কিছু নাই। খবরদার কেউ দৌড় দিও না। দৌড় দিলে ভয় বেশি লাগে। হেঁটে হেঁটে চলল।”
আগুনালির পিছনে সাগর, সাগরের পিছনে রাজু। খুব কাছাকাছি থেকে একজন আরেকজনকে ধরে তাড়াতাড়ি হেঁটে জায়গাটা পার হয়ে এল। ঝোঁপঝাড় ভেঙে যখন তারা বড় সড়কটাতে উঠে পড়ল তখন অন্ধ-ভয়টা একটু কমে এল–রাজু শেষবারের মতো পিছনে তাকাল–তার ভুলও হতে পারে, কিন্তু মনে হল পিছনে নাহার মঞ্জিল থেকে ক্ষীণ একটা আলোর রেখা বের হয়ে আসছে।
সারা রাস্তায় কেউ কোনো কথা বলল না। বাসায় পৌঁছানার পর তালা খুলে ঘরের ভিতরে ঢোকার পর আগুনালি দাঁত বের করে হেসে বলল, “ভূত দেখলে?”
রাজু আর সাগর মাথা নাড়ল।
”ভয় পেয়েছিলে?”
“পেয়েছিলাম।”
সাগর ফ্যাকাশে মুখে বলল, “এখনও ভয় লাগছে।”
“একা একা থাকতে পারবে?”
রাজু ভীত মুখে একবার সাগরের দিকে তাকাল, তারপর আগুনালির দিকে তাকাল। আগুনালি সাহস দেওয়ার মতো করে বলল, “কোনো ভয় নাই। যদি চাও তো আমার তাবিজটা দিয়ে যাই”
“তাবিজ লাগবে না–রাজু ইতস্তত করে বলল, তুমি আজকে এখানে থেকে যাও।”
“আমি?”
“হ্যাঁ।”
আগুনালি মাথা চুলকে বলল, “বাড়িতে বলে আসি নাই, কিন্তু সেইটা নিয়ে অসুবিধে নাই। তবে–”
“তবে কী?”
“খাওয়া হয় নাই–”
“আমাদের অনেক খাবার বেঁচে গেছে। তোমাকে গরম করে দিই।”
“আরে ধুর! খাবার আবার গরম করতে হয় নাকি?”
খেয়েদেয়ে শোবার আগে আগুনালি দাঁত বের করে হেসে বলল, “আমার বাজির টাকাটা?”
রাজু কোনো কথা না বলে ব্যাগ খুলে সেখান থেকে দশ টাকার বের করে আগুনালির হাতে দেয়। সে কখনও চিন্তা করেনি এরকম একটা বাজিতে সে হেরে যাবে।