০৩. বকুনি খেয়ে বকুলের মন-খারাপ
বকুনি খেয়ে আজকে বকুলের খুব মন-খারাপ হল। বকুনিটা প্রথমে শুরু করলেন বাবা, সেটাকে বড়চাচা লুফে নিলেন, বকতে বকতে যখন বড়চাচার দম ফুরিয়ে গেল তখন মা শুরু করলেন। বকুনি খেতে খেতে বকুলের এমন অবস্থা হয়েছে যে আজকাল সে ভালো করে খেয়ালও করে না কেন সে বকুনি খাচ্ছে। তাকে উদ্দেশ্য করে যে-কথাগুলো বলা হয় তার প্রত্যেকটা শুরু হয় এভাবে—’একটা মেয়ে হয়ে তুই—’ ভাবখানা মেয়ে হওয়াটাই অপরাধ, ছেলে হলেই তার সাত খুন মাপ করে দেওয়া হত। বকুনির শেষ পর্যায়ে যখন সবাই মিলে বলতে লাগল তাকে স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে এসে ঘর-সংসারের কাজে লাগানো হবে তখন তার প্রথমে রাগ এবং শেষের দিকে খুব মন-খারাপ হয়ে গেল। সেইসময় বকুল তার মন-খারাপ লুকিয়ে রেখে শুধু রাগটা দেখিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে।
নদীর তীরে এসে বকুলের মনটা একটু শান্ত হল। নদীর মাঝে মনে হয় কোন ধরনের জাদু থাকে, রাগ দুঃখ যেটাই থাকুক কেমন করে জানি সেটা কমে আসে। বকুল একা একা নদীর তীরে ধরে হেঁটে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেল, এদিকে কুমোরপাড়া, তার পরে খানিকটা ফাঁকা মাঠ, এরপর সর্ষেক্ষেত, কিছু ঝোঁপঝাড় এবং বড় বড় গাছপালা। বছর দুয়েক আগে এখানে একটা গাছে তারাপদ মাস্টার গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল বলে কেউ সহজে আসতে চায় না। বকুল নিজেও এদিকে খুব আসে না। কিন্তু আজ মন-খারাপ করে অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে এখানে চলে এসেছে। গ্রামের অনেকেই মাঝরাতে এখানে তারাপদ মাস্টারকে বইপত্র নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে দেখেছে কথাটা মনে পড়তেই বকুলের কেমন জানি ভয়-ভয় করতে লাগল। সে যখন ফিরে চলে আসছিল হঠাৎ মনে হল নদীর কাছে ঝোঁপের মাঝ থেকে কেউ তাকে শব্দ করে ডাকল। বকুল ভয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠতে গিয়ে কোনমতে নিজেকে সামলে নিল, দূরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
কেউ তার কথার উত্তর দিল না, কিন্তু মনে হল কেউ যেন এবারে পানিতে একটা শব্দ করল। বকুল খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, দৌড়ে পালিয়ে যাবার একটা প্রবল ইচ্ছেকে অনেক কষ্ট করে আটকে রেখে সে সাবধানে এগিয়ে যায়। পা টিপে টিপে ঝোঁপটার কাছে গিয়ে উঁকি মেরে সে চমকে ওঠে, একজন মানুষ নদীর পানিতে অর্ধেক শরীর ডুবিয়ে তীরের কাদাপানিতে শুয়ে আছে। বকুল ভয়ে ভয়ে ডাকল, “কে?”
মানুষটা কোন কথা না বলে নিঃশ্বাস ফেলার মতো একটা শব্দ করল এবং বকুল হঠাৎ চমকে উঠে আবিষ্কার করল এটি মানুষ নয়, এটি একটি শুশুক।
বকুল জন্মের পর থেকে নদীর তীরে তীরে মানুষ হয়েছে, সে অসংখ্যবার শুশুককে পানি থেকে লাফিয়ে উঠতে দেখেছে, এক-দুইবার জেলের জালেও শুশুককে আটকা পড়তে দেখেছে, কিন্তু কখনোই এভাবে ডাঙায় মাথা রেখে কোনো শুশুককে শুয়ে থাকতে দেখেনি। বকুল প্রায় দৌড়ে শুশুকটার কাছে ছুটে গেল, ভেবেছিল শুশুকটা বুঝি সাথে সাথে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে–কিন্তু তা হল না, যেভাবে শুয়েছিল সেভাবেই শুয়ে রইল। বকুল পা টিপে টিপে এগিয়ে যায়, শুশুকটার মাথাটা দেখে কেমন জানি হাসিহাসি মুখের একজন মানুষের মাথার মতো মনে হয়, চোখ দুটি এত ছোট সেটা দিয়ে কিছু দেখতে পায় বলেই মনে হয় না। ধূসর চকচকে মসৃণ দেহে শুশুকটা নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে। বকুল কাছে গিয়ে সাবধানে শুশুকটাকে স্পর্শ করতেই সেটি তার লেজ নেড়ে পানিতে একটা শব্দ করল, শুশুকটাকে দেখে মরে গেছে বলে মনে হলেও সেটা আসলে এখনও মরেনি।
বকুল ভালো করে শুশুকটাকে দেখল, সে জানে এটা পানিতে থাকলেও এবং মাছের সাথে চেহারায় একধরনের মিল থাকলেও এটা মাছ না। এটা কুকুর বেড়াল বা গরু-ছাগলের মতো একটা প্রাণী। কুকুর-বেড়াল বা গরু-ছাগলের যেরকম অসুখ হয় এটার মনে হয় কোনরকম অসুখ হয়েছে। বকুল আবার সাবধানে শুশুকটার শরীর স্পর্শ করল, মসৃণ চামড়া কেমন যেন শুকিয়ে আছে। যে-প্রাণী পানিতে থাকে তার শরীর এভাবে শুকিয়ে থাকা নিশ্চয়ই ভালো ব্যাপার না, শরীরটা ভিজিয়ে দিলে শুশুকটা হয়তো একটু আরাম পাবে। বকুল সাবধানে পাশে গিয়ে দুই হাতে আঁজলা করে পানি এনে শুশুকটার শরীরে ভিজিয়ে দিতে থাকে। শুশুকটা আবার একটা নিঃশ্বাস নেবার শব্দ করে দুর্বলভাবে একটু নড়ে উঠল এবং ঠিক তখন সে শুশুকটার সমস্যাটা বুঝতে পারল। তার পিঠের কাছে এক জায়গায় একটা ধাতব কী যেন লেগে আছে। শুকনো রক্তের ধারা দুই পাশে শুকিয়ে আছে। বকুল জিব দিয়ে চুকচক করে বলল, “আহা বেচারা!”
শুশুকটা মনে হল তার কথা বুঝতে পারল এবং হঠাৎ মুখটা একটু খুলে নিচু একধরনের শব্দ করল, বকুলের একেবারে পরিষ্কার মনে হল যেন সেটি তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। একটা ছোট বাচ্চা পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলে যেরকম মায়া হয় হঠাৎ করে বকুলের শুশুকটার জন্যে সেরকম মায়া হতে লাগল। সে ভিজে হাত দিয়ে শুশুকটার শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বলল, “তোমার কোনো চিন্তা নেই শুশুক সোনা, আমি তোমার পিঠ থেকে এই লোহার টুকরোটা তুলে দেব। একেবারে ভালো হয়ে যাবে তুমি, তখন আবার নদীর মাঝে সাঁতার কাটতে পারবে–”
কথা বলতে বলতে সে শুশুকটার পিঠে হাত দিয়ে ধাতব টুকরোটা ধরে একটা হ্যাঁচকা টানে সেটা খুলে আনল, সাথে সাথে গলগল করে খানিকটা রক্ত বের হয়ে এল। শুশুকটা হঠাৎ ছটফট করে উঠে শিস দেওয়ার মতো একটা শব্দ করল, বকুলের মনে হল সেটা পানিতে চলে যাবার চেষ্টা করছে। বকুল শুশুকাকে ধরে রাখার চেষ্টা করতে করতে আদর করার ভঙ্গিতে বলল, “আহা রে শুশুক সোনা, তোমার ব্যথা লেগেছে? আমি তো ব্যথা দিতে চাইনি, শুধু এটা খুলে দিতে চাইছি! এই তো এখন খুলে গেছে, আর কোন ভয় নেই!”
বকুলের কথা মনে হয় শুশুকটা বুঝতে পারল, এক-দুবার লেজ দিয়ে পানিতে ঝাঁপটা দিয়ে আবার শান্ত হয়ে গেল। পিঠ দিয়ে এখনও রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে মনে হচ্ছে থেমে আসবে একটু পরেই। বকুল আপার হাত দিয়ে আঁজলা করে পানি এনে শুশুকটাকে ভিজিয়ে দিল। একবার চেষ্টা করল সেটাকে ঠেলে পানিতে নামিয়ে দিতে, কিন্তু পারল না, মনে হচ্ছে কোন কারণে এটা পানিতে নামতে চাইছে না।
.
শুশুকের যত্ন করে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে বকুলের দেরি হয়ে গেল, সেজন্যে আবার তার বকুনি খেতে হল। এবারে শুরু হল উলটো দিক দিয়ে প্রথমে মা তারপর বড়চাচা সবশেষে বাবা। বিকেলে বকুনি খেয়ে তার যেরকম মন-খারাপ হয়েছিল এখন সেরকম কিছু হল না, পুরো বকুনিটা সে তার এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিল। তার মাথায় তখন শুশুকটির জন্যে চিন্তা। কীভাবে এই ব্যথা-পাওয়া শুশুকটিকে সারিয়ে তোলা যায় সেটা নিয়ে ভাবনা।
পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে গেল বকুল। পা টিপে টিপে ঘর থেকে বের হয়ে সে নদীর তীর ধরে হেঁটে যেতে থাকে। ভোরবেলা নদীর ওপরে কেমন কুয়াশা কুয়াশা ভাব, দূরে গাছপালাগুলো আবছা দেখা যাচ্ছে। এখনও সূর্য ওঠেনি, পূর্ব দিকে আকাশে লালচে হয়ে আসছে। এক-দুজন মানুষ দাঁতন দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে ইতস্তত হাঁটছে। এত ভোরবেলা বকুলকে দেখে একজন বলল, “কী বকুল? তুই এত ভোরে কী করিস?”
বকুল আমতা আমতা করে বলল, “সকালে ঘুম থেকে ওঠা স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো চাচা। শরীর ভালো থাকে।”
“যাচ্ছিস কোথায়?”
“এই তো হেঁটে আসছি। সকালে হাঁটাহাটি করলে শরীর ভালো থাকে।”
মানুষটি অবাক হয়ে বকুলের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর বকুল সকালে উঠে হাঁটাহাঁটি করার ভঙ্গি করে কুমোরপাড়ার দিকে অদৃশ্য হয়ে যায়।
যে-গাছটায় তারাপদ মাস্টার ফাঁসি নিয়েছিল বকুল তার নিচে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখল শুশুকটা এখনও আগের জায়গায় নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে। বকুলের বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে, মরে গিয়েছে নাকি? পা টিপে টিপে কাছে গিয়ে সে শুশুকটাকে স্পর্শ করল, সাথে সাথে সেটি ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল–না, এখনও বেঁচে আছে। বকুল পানিতে নেমে দুই হাতে আঁজলা করে পানি এনে শুশুবটার শুকনো শরীরটা ভিজিয়ে দিতে শুরু করল। শরীরটা ভিজিয়ে বকুল শুশুকটার পিঠের কাটার জায়গাটার দিকে তাকায়, এখনও লাল হয়ে ফুলে আছে। যে-লোহার টুকরাটা গেঁথেছিল সেটা মনে হয় শ্যালো ইঞ্জিন লাগানো নৌকার প্রপেলরের টুকরা। বকুল পানি দিয়ে শুশুকটার শরীর ভেজাতে ভেজাতে আবার নরম গলায় কথা বলতে থাকে, “আহা বেচারা আমার শুশুক সোনা, কত ব্যথা পেয়েছ তুমি! পিঠের মাঝে গেঁথে গিয়েছে প্রপেলর। এখন আর ভয় কী! এই তো দেখতে দেখতে ভালো হয়ে যাবে। আহা বেচারা, খাওয়া হয়নি কতদিন! কী খাও তুমি? নিয়ে আসব তোমার জন্যে খাবার?”
দুপুরবেলা বকুল শুশুকটার জন্যে খাবার নিয়ে এল। শুশুক কী খায় সে জানে না, তবে পানিতে যখন থাকে নিশ্চয়ই মাছ খায়। এখন নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে, মাছ কী চিবিয়ে খেতে পারবে? অনেক চিন্তা-ভাবনা করে শুশুকের জন্যে সে আলাদা একটা খাবার তৈরি করল। গরুর জন্যে সরিয়ে রাখা ভাতের মাড় রান্নাঘর থেকে চুরি করা এক গ্লাস দুধ এবং মাছের কুটোকাটা–যেটাকে সে থেঁতলে পিষে একেবারে হালুয়া করে ফেলেছে। তিনটি জিনিস একসাথে মিশিয়ে তার মাঝে সে দুটি প্যারাসিটামল গুঁড়ো করে দিল। মাথাব্যথায় মানুষের জন্যে যদি কাজ করে শুশুকের পিঠের ব্যথার কেন কাজ করবে না? শুশুকটাকে কেমন করে খাওয়াবে সে জানে না, তাই সাথে করে একটা ছোট বাটি নিয়ে এল। শুশুকটার মুখ হাঁ করিয়ে সাবধানে সে তার বিশেষ খাবার বাটিতে করে ঢেলে দিতে থাকে। প্রথম এক দুবার মুখের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল, কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই সে বেশ ভালো করে খাইয়ে দিতে শুরু করে। শুধু তাই না, মনে হতে থাকে শুশুকটা যেন বেশ আগ্রহ নিয়েই খাচ্ছে। কয়েকদিন থেকেই নিশ্চয়ই না খেয়ে আছে। বকুলের শুশুকটার জন্য এত মায়া হল সেটি আর বলার মতো নয়। খাওয়ানো শেষ করে সে পানি দিয়ে আবার শুশুকটার সারা শরীর ভিজিয়ে দিতে শুরু করে, মাথায় গলায় হাত বুলাতে বুলাতে নরম গলায় আদর করে কথা বলতে থাকে।
বিকেলবেলা বকুল আবার খাবার নিয়ে এল। দুপুরবেলা পাড়ার সব বাচ্চাকাচ্চাদের মাছ ধরতে লাগিয়ে দিয়েছিল। তারা ছাঁকা জালে নদীর পাশে খাল এবং ডোবার ছোট মাছ ধরেছে, মাছের সাথে কাঁকড়া, ব্যাং, শামুক, গুগলিও উঠে এসেছে। সবগুলিকে থেঁতলে পিষে নিয়ে তার সাথে আবার মিশিয়েছে ভাতের মাড়, দুধ আর প্যারাসিটামল। বাবার তোশকের নিচে ফোড়ার কী-একটা ওষুধ ছিল সেটাও সে গুড়ো করে মিশিয়ে দিল, মানুষের ঘা যদি এই ওষুধ খেলে ভালো হতে পারে তাহলে শুশুকের কেন ভালো হবে না? যেসব বাচ্চাকাচ্চা মহাউৎসাহে মাছ ধরেছে, সেগুলোকে পিষতে বকুলকে সাহায্য করেছে তারা সবাই খুব উৎসাহী ছিল জিনিসটা নিয়ে কী করা হয় সেটা দেখার জন্যে। কিন্তু বকুল এই মুহূর্তে ঠিক তাদের বিশ্বাস করতে পারল না। সবাইকে নিয়ে মাঠে দাড়িয়াবান্দা খেলা শুরু করিয়ে সে সটকে পড়র। প্লাস্টিকের একটা বোতলে এই বিশেষ খাবার নিয়ে সে আবার ছুটে গেল শুশুকের কাছে। এবারে সে একটা পরিবর্তন লক্ষ করল, শুশুকটা তার শরীরের বেশির ভাগ পানিতে ডুবিয়ে রেখে শুধু মাথাটা শুকনো ডাঙায় ঠেকিয়ে রেখেছে। বকুল কাছে বসে শুশুকটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে মুখ হাঁ করিয়ে আবার তাকে খাইয়ে দিল। বকুল বেশ উৎসাহ নিয়ে আবিষ্কার করল সে এবার শুশুকটার মাঝে খানিকটা জীবনের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে–এটা এর লেজ নাড়ছে এবং খাবারের বাটিটা মুখের কাছে আনতেই সেটা খাবার জন্যে নিজেই মুখটা অল্প খুলে ফেলছে। বকুল শুশুকটার মাথায় গলায় হাত বুলিয়ে আবার অনেকক্ষণ আদর করে নরম গলায় কথা বলল। বকুলের ভুলও হতে পারে কিন্তু তার কেন জানি স্পষ্ট মন হল শুশুকটা তার কথা একটু একটু বুঝতে পারছে।
পরদিন ভোরে আবার কেউ ঘুম থেকে জাগার আগেই বকুল ছুটে ছুটে শুশুকটাকে দেখতে এল। তারাপদ মাস্টার যে-গাছে গলায় দড়ি দিয়েছিল তার নিচে দাঁড়িয়ে বকুল নদীর তীরে উঁকি দিয়ে দেখল শুশুকটা সেখানে নেই। শুশুকটা নিশ্চয়ই ভালো হয়ে চলে গেছে, বকুলের আনন্দ হবার কথা ছিল, কিন্তু কেন জানি আনন্দ না হয়ে তার একটু মনখারাপ হয়ে গেল, শুশুকটার উপরে তার এত মায়া পড়ে গিয়েছে যে, সে আর বলার নয়। বকুল খানিকক্ষণ নদীতে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, পা দিয়ে পানিতে শব্দ করল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে নদী থেকে উঠে এল। শুশুকটা চলেই গেল শেষ পর্যন্ত, তাকে শেষবারের মতো ভালো করে একবার আদরও করে দিতে পারল না!
বকুল মন-খারাপ করে নদীর তীর ধরে হাঁটতে থাকে, সামনে কিছু ঝোঁপঝাড়, তারপর সর্ষেক্ষেত, সর্ষেক্ষেতের পর কুমোরপাড়া শুরু হয়েছে। বকুল সর্ষে ক্ষেতের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ নদীর পানিতে ছলাৎ করে একটা শব্দ শুনতে পেয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, পানিতে আধডোবা হয়ে শুশুকটা ভেসে আছে, দেখে মনে হচ্ছে বকুলকে কিছু বলার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে।
বকুল ছোট একটা চিৎকার দিয়ে পানিতে ছুটে গেল, শুশুকটা ভয় পেয়ে সরে গেল না, বরং লেজ নেড়ে একটু এগিয়ে এল। বকুল হাত দিয়ে শুশুকটার মাথায় থাবা দিয়ে বলল, “আরে শুশুক সোনা! তুই এসেছিস? এসেছিস আমার কাছে?”
শুশুকটা আরেকটু এগিয়ে এসে তার মাথা দিয়ে বকুলকে একটা ছোট ধাক্কা দেয়, মনে হয় এটা তার ভালোবাসা প্রকাশের একটা ভঙ্গি। বকুল গলায় হাত বুলিয়ে আদর করার মতো গলায় বলল, “আরে আমার শুশকি টুশকি! আমি ভাবলাম তুই আর কোনদিন আসবি না! ভালো হয়ে চলে গেছিস!”
শুশুকটা আবার তার মাথা দিয়ে বকুলকে ছোট একটা ধাক্কা দিল। বকুল তার গলায় মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বলল, “খুব সাবধানে থাকিস শুশকি টুশকি। শ্যালো নৌকার নিচে আর যাবি না, লঞ্চের ধারেকাছে আসিস না। যখন বড় জাল দিয়ে মাছ ধরবে তুই দূরে দূরে থাকিস। ভালো করে খাবি। তুই কি খাস সেটা তো জানি না তবে যেটাই খাস ভালো করে খাবি। পেট ভরে খাবি। ঠিক আছে?”
শুশুকটা পানি থেকে মাথা উপরে তুলে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। বকুল শুশুকটার মসৃণ চকচকে শরীরে হাত বুলিয়ে বলল, “দুষ্টুমি করবি না শুশুকি টুশকি। মারপিট করবি না। পিঠের ঘা’টা সারতে মনে হয় সময় নেবে, লক্ষ রাখিস। কোনকিছু দরকার হলে চলে আসিস আমার কাছে, ঠিক আছে টুশকি?”
হঠাৎ দূর থেকে কে যেন বলল, “কী রে বকুল, এত সকালে পানিতে নেমে কী করছিস?”
বকুল মাথা তুলে দেখল, গরু নিয়ে যাচ্ছেন রহমত চাচা। এত দূর থেকে শুশুকটাকে নিশ্চয়ই দেখেননি। বকুল ফিসফিস করে শুশুকটাকে বলল, “যা টুশকি যা। চলে যা এখন। কেউ দেখলে সমস্যা হয়ে যাবে!”
বকুল পানি থেকে উঠে আসতে শুরু করতেই শুশুকটা লেজ নেড়ে নদীর গভীর চলে যেতে শুরু করল। রহমত চাচা কাছাকাছি গরুটার লেজ মুচড়ে দিয়ে বললেন, “একলা একলা কার সাথে কথা বলিস?”
“কারও সাথে না। পায়ে গোরব লেগেছিল তাই ধুতে গিয়েছিলাম।”
রহমত চাচা হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে বললেন, “পাগলি মেয়ে! আমি দেখলাম তুই বিড়বিড় করে কথা বলছিস। বড় হয়ে তুইও আরেকটা জমিলা বুড়ি হবি নাকি?”
বকুল দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে শুরু করল।
আগের পর্ব :
০১. ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল এভাবে
০২. নীলা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে
পরের পর্ব :
০৪. নীলা বিছানায় হেলান দিয়ে
০৫. বকুল আর নীলা পাশাপাশি
০৬. প্রিয় বকুল, তুমি কেমন আছ
০৭. বকুল হিজল গাছটার মাঝামাঝি
০৮. প্রথম দিন বকুল
০৯. ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে টুশকি
১০. শেষ খবর অনুযায়ী