বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্চা ভয়ংকর: ০৯. বসার ঘরে শিরিন বানু

বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্চা ভয়ংকর: ০৯. বসার ঘরে শিরিন বানু

০৯. বসার ঘরে শিরিন বানু

বসার ঘরে শিরিন বানু গাগুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন, ছোট বাচ্চা নিয়ে কী করতে হয় তিনি খুব ভালো করে জানেন। বল্টু অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছে এতক্ষণ হয়ে গেল গাগু একবারও তাকে ভিজিয়ে দেয়নি। রইসউদ্দিন সন্ধ্যে

সাতটার সময় বিউটি নার্সিং হোমটাকে দেখার জন্যে বের হয়ে গেছেন, যাবার আগে বলেছেন কিছুক্ষণের মাঝেই চলে আসবেন। ফোরকান আলির পকেটের সব কাগজপত্র অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করেছেন, সেখানে নাকি নানা এলাকার মা বাবা নেই সেরকম ছেলেমেয়ের নাম-ঠিকানা লেখা। কোন বাচ্চাকে কত টাকায় বিক্রি করা হবে সেগুলোও লেখা রয়েছে। বিউটি নার্সিং হোমের কয়েকজন ডাক্তারের নাম লেখা আছে, তাদেরকে কাকে কত দিতে হয় তাও লেখা আছে।

রইসউদ্দিন বলে গেছেন কিছুক্ষণের মাঝে ফিরে আসবেন, কিন্তু তিন ঘণ্টা হলে গেল এখনও তার দেখা নেই। শিরিন বানু বেশ চিন্তিত হয়ে গেছেন, কী করবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। শিউলির কেমন জানি ভয় লাগতে শুরু করেছে, বল্টু আর খোকনও একটু পরেপরে জানালার কাছে গিয়ে দেখছে রইসউদ্দিনকে দেখা যায় কি না। শুধুমাত্র গাগু এবং মতলুব মিয়ার কোনোরকম দুশ্চিন্তা হচ্ছে না। গাণ্ড শিরিন বানুর কোলে বসে তার নাকটা কামড়ানোর চেষ্টা করছে, মতলুব মিয়া কয়েকবার হাই তুলে ঘুমাতে চলে গিয়েছে।

রাত সাড়ে দশটার সময় শিউলি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “রইস চাচার নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে।”

খোকন কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “এখন কী হবে?”

বল্টু বলল, “আমাদের যেতে হবে।”

শিরিন বানু চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী বলছ তোমাদের যেতে হবে?”

“তোমরা গিয়ে কী করবে?”

“দেখি কী করা যায়।”

শিরিন বানু কঠিনমুখে বললেন, “না শিউলি, বড়দের ব্যাপারে তোমরা মাথা ঘামাবে না। তোমরা সেখানে গিয়ে নতুন ঝামেলা তৈরি করা ছাড়া আর কিছু করবে না।”

শিউলি কিছু বলল না, শিরিন বানুর সাথে সোজাসুজি তর্ক করা সম্ভব নয়, বল্টু তাঁকে যে দারোগা আপা ডাকে, তার মাঝে খানিকটা সত্যতা রয়েছে। ঠিক এরকম সময়ে গাগুর নড়াচড়া দেখে কীভাবে জানি শিরিন বানু বুঝে গেলেন তাকে এক্ষুনি বাথরুমে নিয়ে যেতে হবে, তাকে বাথরুম করিয়ে ফিরে এসে দেখলেন ঘর খালি। শিউলি তার মাঝে বল্টু আর খোকনকে নিয়ে বের হয়ে গেছে।

.

রাত সাড়ে দশটা বেজে গেলেও রাস্তায় বেশ লোকজন। শিউলি, বল্টু আর খোকন বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে নিল। বিউটি নার্সিং হোমে পৌঁছে দেখতে পেল পুরো বিল্ডিংটা বন্ধ হলেও নার্সিং হোমের বেশ কয়েকটা ঘরে আলো জ্বলছে। শিউলি উপরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “রইস চাচা মনে হয় ঐ ঘরগুলো কোনো-একটাতে আছেন।”

খোকন ভয়ে ভয়ে বলল, “তা হলে বের হয়ে আসছেন না কেন?”

“কে জানে, হয়তো বদমাইশগুলো বেঁধে রেখেছে।”

“বেঁধে রেখেছে? বেঁধে রেখেছে কেন?”

“তা তো জানি না, গিয়ে দেখতে হবে।”

“কেমন করে দেখবে শিউলি আপা?”

শিউলি উপরের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকাতে থাকে, বিউটি নার্সিং হোমের মানুষজনের চোখ এড়িয়ে কীভাবে ঘরের ভেতরে দেখা যায় সে চিন্তা করে পেল না। বল্টু পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, “আমি দেখে আসি।”

“তুই দেখে আসবি?” শিউলি অবাক হয়ে বলল, “তুই কীভাবে দেখে আসবি?”

“আগে বিল্ডিঙের ছাদে উঠে যাব, তারপর পানির পাইপ বেয়ে কার্নিসে নেমে আসব। কার্নিসে হেঁটে হেঁটে জানালার সামনে এসে দেখব ভিতরে রইস চাচা আছে কি না।”

শিউলি আঁতকে উঠে বলল, “কী? কী বললি? পানির পাইপ বেয়ে নেমে আসবি?”

“হ্যাঁ।”

“ভয় করবে না?”

“আমার ভয় করে না। মনে নাই আমি ঠিক করেছিলাম বড় হয়ে বিখ্যাত চোর হব?”

“তা ঠিক।”

কাজেই কিছুক্ষণের মাঝে দেখা গেল বল্টু সিঁড়ি বেয়ে বিল্ডিঙের ছাদে উঠে গিয়ে কিছুক্ষণের মাঝে পাইপ বেয়ে নামতে শুরু করেছে। বিউটি নার্সিং হোমের কার্নিসে নেমে সে গুঁড়ি মেরে জানালাগুলো দিকে এগিয়ে যায়। নিচে থেকে অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না, রাস্তা থেকে উপরের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, রাস্তাঘাটে এখনও লোকজন হাঁটাহাঁটি করছে, সবাই কৌতূহলী হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকলে বলুর বিপদ হয়ে যাবে।

শিউলি আর খোকন নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে, মাঝে মাঝে চোখের কোণা দিয়ে উপরে তাকায়। আবছা অন্ধকারে মনে হল বল্টু একটা জানালার সামনে থমকে দাঁড়িয়েছে। ভেতরে তাকাচ্ছে, এমনকি হাত ভিতরে ঢুকিয়ে কিছু-একটা করছে। শিউলির বুক ধুকধুক করতে থাকে, বল্টু নিশ্চয়ই রইস চাচাকে খুঁজে পেয়েছে।

শিউলি বিনা কারণেই গলা নামিয়ে খোকনকে বলল, “চল, ওপরে যাই।”

“ওপরে?”

“হ্যাঁ। রাস্তায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে লোকজন সন্দেহ করবে। ছাদে উঠে যাই।”

খোকন ভয়ে ভয়ে বলল, “কিছু হবে না তো?”

“কী আর হবে? বল্টু গেল না!”

শিউলি আর বল্টু সিঁড়ি বেয়ে একেবারে বিল্ডিঙের ছাদে উঠে যায়। ছয়তলা বিল্ডিং, বিউটি নার্সিং হোমটা তিনতলায়। চারতলায় একটা কম্পিউটারের দোকান, পাঁচ আর ছয়তলায় নানারকম অফিস, বেশির ভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। নিচের তলাগুলো মোটামুটি আলো-ঝলমল হলেও পাঁচ আর ছয়তলা প্রায় অন্ধকার। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে শিউলির ভয় ভয় করতে থাকে। বিল্ডিংটা নিচে থেকে খুব সুন্দর দেখালেও ছাদটা একেবারে জঘন্য, ময়লা আবর্জনায় ভরা। অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে শিউলি আর খোকন ছাদের কিনারায় এসে দাঁড়াল। বৃষ্টির পানি যাওয়ার পাইপটা এখানেই রয়েছে, বল্টু এদিক দিয়েই উঠে আসবে।

কিছুক্ষণের মাঝেই বল্টু পাইপ বেয়ে উপরে উঠে এল, যেভাবে তরতর করে পাইপ বেয়ে উঠে এল যে দেখে মনে হল বল্টু বুঝি এভাবেই বিল্ডিঙে ওঠানামা করে। শিউলি বল্টুকে টেনে ছাদে নামিয়ে এনে বলল, “পেয়েছিস রইস চাচাকে?”

“হ্যাঁ।”

“কোথায়?”

“মাঝখানের ছোট ঘরটার মাঝে। খোকন জিজ্ঞেস করল, “বেঁধে রেখেছে নাকি?”

“না।” বল্টু মাথা নেড়ে বলল, “তবে মারধর করেছে মনে হল। কপালে আর পিঠে রক্ত দেখলাম।”

শিউলি জিজ্ঞেস করল, “তোর সাথে কথা হয়েছে?”

“হ্যাঁ। বেশি কথা বলতে পারি নাই, একটা লোক চলে এসেছিল।”

“তোকে দেখেছে লোকটা?”

বল্টু মাথা চুলকে বলল, “মনে হয় দেখেছে।”

“সর্বনাশ!”

কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ খোকন শিউলির হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, “শিউলি আপু!”

“কী হয়েছে?!”

“ঐ দেখো।”

শিউলি এবং বল্টু ঘুরে তাকিয়ে একেবারে জমে গেল। সিঁড়ির মুখে দুইজন বিশাল লোক দাঁড়িয়ে আছে, মানুষগুলোর এক হাতে মনে হল পিস্তল বা ছোরা–অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না, অন্য হাতে টর্চলাইট, সেটা জ্বালিয়ে মনে হল কাউকে খুঁজছে।

শিউলি ফিসফিস করে বলল, “পানির ট্যাংকের পেছনে লুকিয়ে যা।”

সাবধানে গুঁড়ি মেরে তারা পানির ট্যাংকের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল হঠাৎ খোকনের পায়ে লেগে কী-একটা নিচে পড়ে গিয়ে ঝনঝন করে ভেঙে গেল, সাথে সাথে দুটি ছয়-ব্যাটারির টর্চলাইটের উজ্জ্বল আলোতে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মোটা গলায় একজন বলল, “দাঁড়া, খবরদার নড়বি না।”

শিউলি, বল্টু আর খোকন থমকে দাঁড়িয়ে গেল। মোটা-গলার মানুষটা বলল, “হারামজাদা পোলাটা একলা আসে নাই, দল নিয়ে এসেছে।”

চিকন গলায় আরেকজন সুর করে বলল, “পিপীলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে। এই পিপীলিকাঁদের পাখা উঠেছে।”

“ধর শালাদের” বলে লোক দুইজন এসে তাদেরকে ধরে ফেলল। ছুটে যাবার চেষ্টা করে লাভ নেই, হাতে অস্ত্র থাকলে কিছু-একটা বিপদ হতে পারে জেনেও তিনজনেই খানিকক্ষণ হুটোপুটি করল, শেষ পর্যন্ত মানুষগুলো শক্ত করে শার্টের কলার এবং হাতের কবজি ধরে তিনজনকে কাবু করে ফেলল।

শিউলি চিকন গলায় একটা চিৎকার দেবে কি না ভাবছিল তখন মোটা-গলার মানুষটা তাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মুখে একটা টু শব্দ করেছিস তো লাশ ফেলে দেব। ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেব।”

আসলেই লাশ ফেলে দেবে কি না কে জানে, কিন্তু তারা আর কোনো ঝুঁকি নিল না।

দুজন মানুষ মিলে শিউলি বল্টু আর খোকনকে নিচে নামিয়ে এনে বিউটি নার্সিং হোমের নানা দরজা খুলে ছোট একটা ঘরে ধাক্কা মেরে ঢুকিয়ে দিল। ঘরের মেঝেতে এক কোণায় গালে হাত দিয়ে রইসউদ্দিন বসেছিলেন, তাদের দেখে মনে হল খুব বেশি অবাক হলেন না, একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমাদেরকেও ধরে ফেলেছে?

“হ্যাঁ।”

যে-মানুষ দুইজন তাদের তিনজনকে ধরে এনেছে তারা বাইরে থেকে তালা মেরে চলে যাবার পর রইসউদ্দিন নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “এরা একেবারে অর্গানাইজড ক্রিমিনালের দল।”

খোকন শুকনোমুখে জিজ্ঞেস করল,”তার মানে কী?”

“তার মানে এরা কঠিন বদমাইশ।” খোকন কাঁচুমাচু-মুখে বলল, “এখন কী হবে আমাদের?”

রইসউদ্দিন খোকনের মুখের দিকে তাকালেন, বাচ্চাটির জন্যে হঠাৎ তাঁর মায়া হল, মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তুমি কোন চিন্তা কোরো না।”

“চিন্তা করব না?”

“না। আমি কিছু-একটা ব্যবস্থা করব।”

রইসউদ্দিন কী ব্যবস্থা করবেন খোকন ঠিক জানে না, কিন্তু তাঁর কথায় সে সত্যি সত্যি ভরসা পেল।

রউসউদ্দিন সারা ঘর খুব চিন্তিতভাবে পায়চারি করতে লাগলেন। তাঁর কপালের কাছে খানিকটা কেটে রক্ত পড়ছে, শার্টেরও খানিকটা জায়গা রক্তে ভেজা, তাঁকে দেখে খুব ভয়ংকর দেখাতে থাকে। তিনি কী করবেন কেউ জানে না, কিন্তু কেউ কিছু জিজ্ঞেস করারও সাহস পেল না।

রইসউদ্দিন বেশ খানিকক্ষণ পায়চারি করে শেষ পর্যন্ত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সেখানে জোরে জোরে কয়েকটা লাথি দিলেন, তারপর হুংকার দিয়ে বললেন, “এই বদমাইশের দল, জানোয়ারের বাচ্চারা, দরজা খোল।”

দরজার লাথির শব্দেই হোক আর তাঁর বাজখাই ধমকের কারণেই হোক খুট করে দরজা খুলে গেল, দরজার অন্যপাশে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, একটু আগে তারা শিউলিদের ছাদ থেকে ধরে এনেছে। দুজনের মাঝে যে-হালকা পাতলা সে মোটা গলায় বলল, “কী হয়েছে?”

রইসউদ্দিন এগিয়ে গিয়ে কথা নেই বার্তা নেই মানুষটাকে একটা ঘুসি বসিয়ে দিলেন। শক্ত ঘুসি, মানুষটা একেবারে ছিটকে গিয়ে পড়ল। অন্য মানুষটা সাথে সাথে কোমরে গোঁজা একটা জংধরা ছোট রিভলবার বের করে চিৎকার করে বলল, “খবরদার আর কাছে এলে গুলি করে খুলি ফুটো করে দেব।”

রইসউদ্দিন তবু ছুটে গিয়ে সেই মানুষটাকেও একটা রদ্দা লাগতেন, কিন্তু তার আগেই শিউলি, বল্টু আর খোকন রইসউদ্দিনকে জাপটে ধরে ফেলল। মানুষটার মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হল সত্যি সত্যি গুলি করে দেবে।

যে-লোকটার মুখে রইসউদ্দিন ঘুসি মেরেছেন সেই মানুষটা মুখে হাত বুলাতে বুলাতে উঠে দাঁড়িয়ে বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে রইসউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রইল। হুটোপুটি এবং চিৎকার শুনে ঘরে আরও কয়েকজন মানুষ চলে এসেছে, একজন একটু বয়স্ক, মুখে কাঁচাপাকা চাপদাড়ি। জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে বদি?”

যে-মানুষটা ঘুসি খেয়েছে সে গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “বড় তাঁদড় মানুষ। এখনও মারপিট করছে।”

চাপদাড়িওয়ালা মানুষটা দুশ্চিন্তার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “এখানে এত হৈচৈ হলে তো মুশকিল! লোকজনের ভিড় জমে যাবে।”

“কী করব ডাক্তার সাহেব, মাথা-খারাপ মানুষ, মারপিট ছাড়া কিছু বোঝে না।”

“ধরো শক্ত করে, একটা ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই।” বেশ কয়েকজন মানুষ এগিয়ে এল, রইসউদ্দিনকে চেপে ধরা খুব সহজ হল না, তিনি হাত-পা ছুঁড়ে কিল ঘুসি লাথি মেরে মানুষগুলোর সাথে ধস্তাধস্তি করে গেলেন। ছোট ঘর, ধস্তাধস্তির ধাক্কায় শিউলি, বল্টু আর খোকন একেকজন একেকবার একেকদিকে ছিটকে পড়ল। তার মাঝেই তারাও রইসউদ্দিনকে পক্ষ নিয়ে খানিকক্ষণ ধস্তাধস্তি করল কিন্তু লাভ হল না, ছয়জন মানুষ মিলে রইসউদ্দিনকে চেপে ধরে রাখল আর চাপদাড়িওয়ালা ডাক্তার একটা সিরিঞ্জ নিয়ে পুট করে তার হাতে একটা ইনজেকশন ঢুকিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মাঝেই রইসউদ্দিন নেতিয়ে পড়লেন, সবাই তখন তাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

যে-ছয়জন মানুষ রইসউদ্দিনকে চেপে ধরে রাখার চেষ্টা করছিল তাদের সবার দেখার মতো একটা চেহারা হয়েছে। একজনের বাম চোখটা বুজে এসেছে, একজনের নাক দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। দুজন ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে হেঁটে গেল। মোটামতন মানুষটা থু করে থুতু ফেলল, সেখানে তার একটা দাঁত বের হয়ে গেল। শুকনোমতো মানুষটা তার ঘাড় নাড়াতে পারছিল না। চাপদাড়িওয়ালা মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, “এই মানুষটা তো দেখি ডেঞ্জারাস মানুষ!”

যে-লোকটার মার খেয়ে একটা দাঁত পড়ে গেছে সে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “এইরকম মানুষ হলে আমি কোনো অ্যাকশানে নাই।”

যে-মানুষটা ঘাড় নাড়াতে পারছিল না সে পুরো শরীর ঘুরিয়ে বলল, “কোথা থেকে এসেছে এই মোষ?”

“বুঝতে পারছি না। কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলির পার্টি থেকে খোঁজ পেয়েছে মনে হল।”

যে-মানুষটার নাক থেকে ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে সে হাতের তালু দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করে বলল, “আজেবাজে পার্টির সাথে কাজ করা ঠিক না। কোনদিন কী বিপদ হয়!”

চাপদাড়ি বলল, “এই পার্টি এতদিন তো রিলায়েবল ছিল। গত দুইটা কেস গোলমাল করেছে।”

“এখন কী করবেন ডাক্তার সাহেব?”

“দেখি চিন্তা করে। নিচে অ্যামবুলেন্সটা রেডি রাখতে বলল, এইগুলোকে যদি সরাতে হয় যেন গোলমাল না হয়।”

“জি আচ্ছা।” যে-দুজন ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে হেঁটে যাচ্ছিল তাদের একজন রইসউদ্দিনকে দেখিয়ে বলল, “এই পাগল আবার জেগে উঠবে না তো?”

চাপদাড়ি মাথা নাড়ল, “আরে না! এত সহজে উঠবে না।”

“এই লোক যদি জেগে যায় আমি কিন্তু তা হলে ধারেকাছে নাই।”

দাঁত-পড়ে যাওয়া মানুষটা কাঁদোকাঁদো মুখে বলল, “আমিও নাই।”

বাম চোখ বুজে-যাওয়া লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “আমিও এর একশো হাতের মাঝে নাই।”

চাপদাড়ি মাথা নেড়ে বলল, “আরে না! ভয় পেয়ো না, এত সহজে এর ঘুম ভাঙবে না। কড়া এনস্থিশিয়া দিয়েছি।”

মানুষগুলো আবার তাদেরকে ঘরে তালা মেরে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার পর খোকন ফ্যাসফাস করে একটু কেঁদে ফেলে বলল, “এখন কী হবে?”

বল্টু বলল, “ভয় পাসনে। এই দেখ”

শিউলি অবাক হয়ে দেখল শার্টের নিচে বল্টুর প্যান্টে গোঁজা একটা রিভলবার। একটা চিৎকার দিতে গিয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে নিচু গলায় বলল, “রিভলবার! কোথায় পেলি?”

“যখন ধস্তাধস্তি করছিলাম তখন সবার পকেট মেরে দিয়েছি।”

“আর কী কী পেয়েছিস?

বল্টু সবকিছু বের করে দেখাল, কুড়ি টাকার নোটের একটা বান্ডিল, ময়লা একটা রুমাল, একটা সিগারেটের প্যাকেট, একটা কালো সানগ্লাস, একপাতা মাথা ধরার ট্যাবলেট, এবং পাগলের তেলের একটা বিজ্ঞাপন।

বল্টু মাথা নেড়ে বলল, “রিভলবার ছাড়া আর কোনো জিনিস কাজে লাগবে না।”

খোকন জিজ্ঞেস করল, “টাকা?”

“এই ঘরের ভেতরে আটকা থাকলে টাকা কী কাজে লাগবে?”

বল্টু চিন্তিতমুখে বলল, “তা ঠিক।”

খোকন মাথা নেড়ে বলল, “এখন কী করবে?”

শিউলি বলল, “রইস চাচাকে যদি ঘুম থেকে তোলা যেত তা হলেই চিন্তা ছিল না। এই রিভলবার নিয়ে একটা হুংকার দিতেন–সবাই ঠাণ্ডা হয়ে যেত!”

বল্টু মাথা নাড়ল, “গাগুর মতো কাপড়ে পিশাব করে দিত।”

ওরা রইসউদ্দিনের কাছে গিয়ে তাঁকে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করল, কিন্তু। রইসউদ্দিন একেবারে গভীর ঘুমে, ধাক্কাধাক্কি করেও কোনো লাভ হল না। হাল। ছেড়ে দিয়ে বল্টু বলল, “আমাদেরকেই চেষ্টা করতে হবে।”

“কীভাবে?”

“আমি রিভলবারটা হাতে নিয়ে চিৎকার করব, তোমরাও চিৎকার করবে।”

শিউলি বল্টুর দিকে তাকাল, এইটুকুন মানুষ হাতে রিভলবার কেন, একটা মেশিনগান নিয়ে দাঁড়ালেও কেউ তাকে দেখে ভয় পাবে বলে মনে হয় না। কী করা যায় সেটা নিয়ে যখন চিন্তা করছে তখন খোকন বলল, “এক কাজ করলে হয় না?”

“কী কাজ?”

“আমরা কোনোমতে ঠেলেঠুলে রইস চাচাকে দাঁড় করিয়ে রাখি, ভান করি চাচা জেগে আছেন।”

“সেটা করে কী লাভ?”

“দেখ নাই চাচাকে কেমন ভয় পায়।”

“কিন্তু দেখেই বুঝে যাবে!”

“আমি রইস চাচার গলায় কথা বলব। ঐ যে ভেন্টি-কুন্টি না কী যে বলে সেইভাবে!”

শিউলি হঠাৎ করে চমকে উঠল, এটি সত্যি একটি উপায় হতে পারে। খোকনের দিকে তাকিয়ে বলল, “পারবি তুই?”

নিচে শুয়ে থাকা রইসউদ্দিন হঠাৎ কথা বলে উঠলেন, “না পারার কী আছে!”

শিউলি আর বল্টু চমকে উঠল, এক মুহূর্ত লাগে বুঝতে যে আসলে খোকনই কথা বলছে। শিউলি হাততালি দিয়ে বলল, “ফাস্ট ক্লাস!”

পরিকল্পনার প্রথম অংশটা নিয়ে অবিশ্যি খুব সমস্যা হল, ঘুমিয়ে-থাকা একজন মানুষকে দাঁড় করিয়ে রাখাই অসম্ভব, হাতে রিভলবার ধরানোর তো কোনো প্রশ্নই আসে না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করের তারা হাল ছেড়ে দিল। বল্টু বলল, “উঁহু। দাঁড় করানো যাবে না।”

শিউলি বলল, “তা হলে বসিয়েই রাখি।”

“ঠিক আছে।”

তিনজন মিলে রইসউদ্দিনকে টেনে ঘরের কোণায় নিয়ে সেখানে তাঁকে কোনোমতে বসিয়ে দেওয়া হল। একটা পা ভাঁজ করে সেখানে একটা হাত রেখে সেই হাতে রিভলবারটা ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হল–ঘুমের মাঝে একটু পরেপরে হাতটি এলিয়ে পড়ে যাচ্ছিল, কাজেই সেটাকে স্থির রাখতে ওদের জান বের হয়ে গেল। তবুও অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত রইসউদ্দিনকে রিভলবার হাতে বসানো হল, কিন্তু ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আছে দেখে দৃশ্যটাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না। বল্টু বলল, “কালো চশমাটা পরিয়ে দিই।”

শিউলি হাতে কিল দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস!”

রইসউদ্দিনের চোখে কালো চশমা পরানোর পর দেখে মোটামুটিভাবে মনে হতে থাকে মানুষটা একটি রিভলবার হাতে ঘরের কোণায় বসে আছে। এইবারে নার্সিং হোমের লোকজনকে ডেকে আনার কাজ। দরজায় জোরে জোরে কয়েকটা লাথি দিলেই সেটা হয়ে যাবে বলে মনে হয়। কিন্তু তার দরকার হল না, হঠাৎ করে দরজা খুলে গেল এবং একটু আগে যারা রইসউদ্দিনের সাথে মারামারি করেছে তাদের কয়েকজন দরজায় উঁকি দিল। মনে হয় ধস্তাধস্তির সময়ে বল্টু যাদের পকেট মেরে দিয়েছে তারা তাদের জিনিসপত্র খুঁজতে এসেছে।

দরজা খোলামাত্রই শোনা গেল রইসউদ্দিন একটা প্রচণ্ড ধমক দিয়েছেন, “দুই হাত ওপরে তুলে দাঁড়াও বদমাইশের দল।“

মানুষগুলো হকচকিয়ে উঠে দৌড় দিতে গিয়ে থেমে গেল, হঠাৎ আবিষ্কার করল ঘরের কোণায় রইসউদ্দিন তাদের দিকে রিভলবার তাক করে বসে আছেন। রাত্রিবেলা কেন কালো চশমা করে আছেন, একেবারেই কেন নড়াচড়া করছেন না। এবং ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবার পরও মানুষটা কেমন করে এত তাড়াতাড়ি জেগে উঠল এই ব্যাপারগুলো নিয়ে তাদের মনে সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কোনো সন্দেহ হল না। একটু আগে রইসউদ্দিনের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে তার সম্পর্কে একটা ভীতি জন্মে গেছে, তার ধমক খাবার পর তারা কেউ পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারছিল না।

রইসউদ্দিন আবার ধমক দিলেন, “হাত তুলে দাঁড়াও বদমাইশের দল। না হলে গুলি করে খুলি ফুটো করে দেব।”

কথা বলার সময় রইসউদ্দিনের কেন ঠোঁট নড়ছে না সেটা নিয়েও তাদের মনে কোনো সন্দেহ হল না। তারা হাত তুলে দাঁড়াল।

“শিউলি আর বল্টু, তোমরা বেঁধে ফেলো বদমাইশগুলোকে।”

“কী দিয়ে বাঁধব? বল্টু মাথা চুলকে বলল, “দড়ি কই? তার চেয়ে এক কাজ করি।”

“কী কাজ?”

“এদের প্যান্ট খুলে ফেলি। প্যান্ট খুলে রাখলে দৌড়ে পালাতে পারবে না।”

রইসউদ্দিন কিছু বলার আগেই চাপদাড়ি ডাক্তার হাজির হল, রইসউদ্দিন একটা হুংকার দিলেন, “ধর ব্যাটা বদমাইশকে। কত বড় সাহস, আমাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়নোর চেষ্টা করে!”

চাপদাড়ি ডাক্তার ঠিক বুঝতে পারছিল না, কী হচ্ছে, তখন চোখ-বুঝে যাওয়া মানুষটা ফিসফিস করে বলল, “মানুষটা জেগে গেছে।”

“জেগে গেছে! কী আশ্চর্য!”

“কথা বলে কে? হাত তোলো উপরে। না হলে গুলি করে ঘিলু বের করে ফেলব।”

চাপদাড়ি ডাক্তার পালানোর চেষ্টা করল কিন্তু ততক্ষণে শিউলি আর বল্টু তার উপরে লাফিয়ে পড়েছে, পা তুলে হাঁটুতে প্রচণ্ড লাথি মেরে তাকে শুইয়ে দিল।

“ভেরি গুড! রইসউদ্দিন বললেন, “তোমরা এখন বাইরে গিয়ে কয়েকজন মানুষকে ডেনে আনো।”

“এরা যদি পালিয়ে যায়?”

“পালাবে না। আমি দেখছি, একটু নড়লেই হুঁড়ি ফাঁসিয়ে দেব গুলি করে।”

শিউলি আর বল্টু ঘর থেকে বের হয়ে একটা ওয়েটিংরুমের মতো এলাকায় এল, সেখান থেকে একেবারে নার্সিং হোমের বাইরে। কাকে ডেকে আনা যায় চিন্তা করছে ঠিক, তখন সিঁড়িতে বুটের শব্দ শোনা গেল, শিউলি আর বল্টু দেখল পুলিশ এসেছে। এমনিতে পুলিশ দেখলেই বল্টুর বুক কেঁপে ওঠে, আজ অবিশ্যি ভিন্ন কথা। সে শিউলির সাথে সাথে ছুটে গেল পুলিশের কাছে। যখন হড়হড় করে পুলিশকে ব্যাপারটা বোঝনোর চেষ্টা করছে তখন দেখতে পেল পিছুপিছু গাগুকে কোলে নিয়ে শিরিন বানু এসেছেন। শিরিন বানুই নিয়ে এসেছেন পুলিশকে। আর কোনো ভয় নেই, শিউলি আনন্দে চিৎকার করে উঠল।

মার্সিং হোমের ভেতরে মানুষগুলোকে যখন পুলিশ অ্যারেস্ট করছে তখন শিরিন বানু রইসউদ্দিনের কাছে গিয়ে বললেন, “আপনি রাত্রিবেলা এই সানগ্লাস পরে বসেন আছেন কেন?”

রইসউদ্দিন কোনো কথা বললেন না। শিরিন বানু একটু কাছে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ রইসউদ্দিনের নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেলেন। শিরিন বানু আরেকটু কাছে গিয়ে রইসউদ্দিনকে ডাকলেন, “রইস সাহেব!–”

রইসউদ্দিন এবারেও কোনো কথা বললেন না। শিরিন বানু হাত দিয়ে রইসউদ্দিনকে ছোট একটা ধাক্কা দিতেই হঠাৎ রইসউদ্দিন গড়িয়ে পড়ে গেলেন। ভয় পেয়ে চিৎকার করে শিরিন বানু লাফ দিয়ে পেছনে সরে গেলেন। শিউলি হি হি করে হেসে বলল, “রইস চাচা ঘুমাচ্ছেন আপা!”

“ঘুমাচ্ছেন! রিভলবার হাতে নিয়ে ঘুমাচ্ছেন?”

“হ্যাঁ আপা।”

ব্যাপারটা কী বুঝিয়ে বলার সময় চাপদাড়ি এবং তার সব সাঙ্গোপাঙ্গ কান খাড়া করে রাখল। একজন মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কীভাবে এতগুলো মানুষকে কাবু করে ফেলতে পারে সেটি নিজের কানে শুনেও তারা ঠিক বিশ্বাস করতে পারল বলে মনে হয় না।

আগের পর্ব :

০১. রইসউদ্দিনকে দেখলে মনে হবে
০২. রইসউদ্দিন যখন মোল্লা
০৩. খেতে বসে প্লেটের দিকে তাকিয়ে
০৪. শিউলির স্কুল বাসা থেকে
০৫. একটু সুস্থ হয়েই বল্টু চলে যাবে
০৬. খোকনের চলে যাবার কথা
০৭. সকালবেলা শিউলি যখন স্কুলে যায়
০৮. বিকালবেলা শিউলি, বল্টু আর খোকন
পরের পর্ব :
১০. দুপুরবেলা বসার ঘরে রইসউদ্দিন

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত