৫. কনিষ্ঠদের ব্যক্তিত্ব
কনিষ্ঠদের ব্যক্তিত্ব
বাবুর অসুখ ও মৃত্যু
২য় বন্ধু কহিলেন–সেয়ানা ছেলেদের বা কনিষ্ঠভ্রাতাদের ব্যক্তিত্ব বিকশিত হবার পথে কঠিন স্বরূপ হয়ো না-তাদেরকে মানুষ, স্বাধীন, পরিচিত ও সম্মানিত হতে দাও। তাদের উপর অত্যধিক শক্তি খরচ করে দেওয়া বড়ই অন্যায়।ছোটকে পাগল না বলে, তাকে বরং সম্মান করবে, ফলে অন্যালোকও তাদেরকে সম্মান করবে। প্রত্যেক মানুষের সে যতই তোমরা ছোট হোক হোক না কেন-Commercial value আছে–গাছের নিচে যেমন আর একটি গাছ বাড়ে না তেমনি একজনের প্রভাব, আর এজনের উপর বেশি পরিমাণে হতে থাকলে তার মূল্য নষ্ট হয়–তার Value-দাম কমে যায়। এক সঙ্গে খাও। এক জায়গায় থাক, কিন্তু প্রকাশ্যে পরিবারের কেউ কারো উপর অতিশয় প্রভাব বিস্তার করতে চেষ্টা করো না–তাতে দুর্বলের ছোটর অতিশয় ক্ষতি হয়।
ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতার অর্থ এ নয় যে, পরিবারের কেউ কাউকে মানবে না–কনিষ্ঠ বড়কে শ্রদ্ধ করবে না, ছোট-বড় সবাই এক জায়গায় বসে হল্লা করবে। সবাই একস্থানে বসে হুঁকা টানাটানি বা কনিষ্ঠ ভ্রাতা যদি ডাক্তার বা উকিল হয়, তাকে কখনও নিজ বাড়িতে বসাবে না–তাকে স্বতন্ত্র বসবার স্থান করে দেবে, যেন তার শক্তি–ব্যক্তিত্ব পূর্ণভাবে প্রকাশ পাবার পথ পায়। নিজের ক্ষমতা ও প্রভুত্বের চাপে তার সর্বনাশ করো না।
যারা ছোট তাদের উপর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেলেও নিজের শক্তি-সামর্থ্যে পরিপূর্ণ বিশ্বাস করা ঠিক নয়। প্রজ্ঞাবান মুরুব্বীদের পরামর্শমতো চলা তাদের পক্ষে ক্ষতির কারণ নয়। মুরুব্বীরা কখনও সেয়ানা কনিষ্ঠদের কাজের সমালোচনা দিনরাত্র করবেন না।-এটা বড়ই দোষের কথা। কনিষ্ঠদের প্রতি গোপনের কঠিন ক্রোধ ও বিদ্বেষ পোষণ করাও বড় অন্যায়। ছোটদের সঙ্গে সন্ধি করে সময়মতো ২/১টি জ্ঞানগর্ভ সমালোচনা করে চলাই ঠিক। তাতে সকল পক্ষেরই সুবিধা হয়–ছোটতে বড়তে বিরোধের সম্ভাবনা থাকে না। সংসার শান্তি-শৃঙ্খলার সঙ্গে চলতে থাকে।
কাছারী ঘরের বারান্দায় বসিয়া অনেক রাত্রে দুই বন্ধু এই সব কথা বলিতেছেন। এমন সময় বাড়ির দাসী সুধা আসিয়া অতিশয় ব্যস্ততার সঙ্গে সংবাদ দিল-বাবুর ভেদ-বমি হচ্ছে, এখনই আপনাকে যেতে হবে।
দ্বিতীয় বন্ধু অতিশয় বিচলিত হইলেন। বন্ধুকে বাসায় যাইতে বলিয়া তিনি সুধার সহিত জমিদার বাড়ি প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন-বাবু অতিশয় কাতর হইয়া বিছানায় পড়িযাছেন। পরী ও তিনটি বিধবা দাসী তাঁহার সেবায় ব্যস্ত–তিনি সেইখান হতে রাম সিংহকে ডাকিয়া কহিলেন–জলদি ডাক্তার ডেকে আন।
যে আজ্ঞে, বলে রাম সিং প্রস্থান করিল। বিশ মিনিটের মধ্যে ডাক্তার তাসিলেন। তিনি দাসী এবং অন্যান্য লোককে বিদায় করিয়া দিলেন। রহিলেন শুধু ২য় বন্ধু এবং ধীরেনের মাতা, বাবুর স্ত্রী।
ডাক্তার শিরা কাটিয়া Nedle পরাইলেন এবং Saline দিতে আরম্ভ করিলেন, তাহাতে বেশ ফল হইল। বাবু কথা কহিতে লাগিলেন। ২য় বন্ধু পার্শ্বে আসন লইয়া বাতাস করিতে লাগিলেন। ধীরেনের মাতা স্বামীর মুখে বরফের টুকরা দিতে লাগিলেন। ডাক্তার অদূরে বসিয়া চুরুট টানিতে লাগিলেন।
ধীরেনের মাতার অনুরোধ সত্ত্বেও ২য় বন্ধু শয্যা ছাড়িলেন না। সেই একইভাবে বন্ধুর শয্যাপার্শ্বে বসিয়া রহিলেন। রাত্রি ১টার সময় অবস্থা খারাপ হইল, পেট ফুলিয়া উঠিল–আবার ২/৩টা ইনজেকশন দেওয়া হইল, কোনো ফল হই না। ডাক্তার বলিলেন কোনো আশা নাই। নির্মল বাবুও বুঝিলেন, তাহার চক্ষু ও গণ্ডদ্বয় ভাসিয়া যাইতে লাগিল।
তথাপি শহরে ডাক্তার ডাকিতে পাঠান হইল। নির্মল বাবু বন্ধুর হাত ধরিয়া কহিলেন–যতদিন না ধীরেন মানুষ হয়, ততদিন এস্থান ত্যাগ করো না–আমার পত্নীকে। ভ্রাতার ন্যায় স্নেহ করো। ২য় বন্ধু স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিলেন–তাই হবে। শেষরাত্রে ডাক্তার আসিবার পূর্বেই নির্মল বাবু বন্ধুর হস্তে মাথা রাখিয়া প্রাণত্যাগ করিলেন।
২য় বন্ধু ভাবিলেন, কিছুমাত্র বিচলিত হইলে আর রক্ষা থাকিবে না। তিনি অবিচলিত দুঃখে আত্মসংবরণ করিলেন, ধীরেনের মাতাকে সান্ত্বনা দিলেন এবং শেষক্রিয়ার জন্য বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন। ধীরেনের আই-এ পরীক্ষার আর একমাস বাকি ছিল–তিনি তাহাকে কোনো সংবাদ দিলেন না এবং তাহার কাছে কোনো পত্র লিখিতে সকলকে নিষেধ করিলেন।
অতঃপর মৃতদেহ বাহির করা হইল। সমস্ত ঘরগুলি disinfect করা হইল–ব্রাহ্মণ আসিল। ২য় বন্ধু মৃতদেহের সহিত হিন্দুজাতির শেষ সকারের স্থান শ্মশানে গেলেন। সেখানকার সমস্ত কার্য শেষ করিয়া যখন তিনি গৃহে ফিরিলেন–ধীরেনের মাতা শোকে মথিত নয়ন তুলিয়া দেখিলেন, তাহার নয়ন অসীম করুণায় ভরিয়া উঠিয়াছে।-ইনি বুঝি নরদেবতা! তাহার নারীজাতির ব্যথা আজ আর এমন করিয়া কেহই অনুভব করিতে পারে নাই। বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিতেই নির্মল বাবুর স্ত্রী উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনে তাহার সম্মুখে মুছিতা হইয়া পড়িলেন। তিনি তাড়াতাড়ি একটি ঘরে প্রবেশ করিয়া দরজা ভেজাইয়া দিলেন।
.
ধীরেনের গৃহে প্রবেশ
ইহার পর তিন মাস অতিবাহিত হইয়াছে। শোকের বেগ অনেকটা প্রশমিত হইয়া গিয়াছে। ধীরেন পরীক্ষা দিয়া বাড়ি আসিলে ধীরেনের মাতার শোক দ্বিগুণ বর্ধিত হইল, পুত্রের মুখ দেখিয়া ক্রমে তিনি শোক ভুলিলেন। আবার তিনি হাসিলেন এবং দাস-দাসীর সহিত প্রফুল্লমুখে কথা কহিলেন।
ধীরেন পরীক্ষায় সফল হইয়াছে। ২য় বন্ধু বি-এ পড়িবার জন্য তাহাকে পুনরায় কলিকাতা পাঠাইলেন।
জমিদার বাড়ির কাজ যেমন চলিতেছিল–ঠিক তেমনি ভাবে চলিতে লাগিল।
.
আবার কথা
২য় বন্ধু একদিন ১ম বন্ধুকে কহিলেন–সালাম না করে কারো কাছে অগ্রসর হয়ো না-কেউ যদি ছালাম না করে, কখনও তার প্রতি বিরূপ হয়ো না–বরং অধিকতর স্নেহে তাকে নিকটে বসাও।
“কথার উত্তর মূখের মতো কখনও দিতে নাই। বাহাদুরির জন্যে অনেকে তর্ক করে, সেটাও বড় দোষের কথা। প্রতি মুহূর্তে ক্ষুদ্র-মহৎ সকল কাজে আত্মার সাক্ষ্য মেনে চল। অনেকে তর্ক করে–সেটাও দোষের কথা।
“বন্ধু, হাজার টাকা বা একশত টাকার অভাবে মানুষ অপ্রস্তুত হয় না–সামান্য ২/১ পয়সার জন্যে বরং অনেক সময় মানুষ অপ্রস্তুত হয়। অতএব কেউ কোনো সময় যদি সামান্য কিছু হাওলাত চায়, বিনা বাক্য-ব্যয়ে তাকে তা দেবে-কখনও কুণ্ঠিত হবে না। যে তা না দেয়, ভূমিকা ফাঁদে–সে ভালো লোক নয়।
১ম বন্ধু–যদি হাতে না থাকে?
২য় বন্ধু–নিজের কষ্ট বা নিজের অসুবিধা করে কাউকে দিতে হবে তা বলা হচ্ছে না। সামান্য ২/১ পয়সা, ২/১ টাকা প্রয়োজন হলেই মানুষকে অকুণ্ঠচিত্তে, বিনা বাক্য ব্যয়ে হাওলাত দিতে হবে।
২য় বন্ধু–তাদের ফেরত দেওয়া উচিত। যে দিয়ে সুখ পেতে চায়, কাউকে সুখী করতে চায় না তারা বড় অভদ্র। পয়সা হলেই ঋণ পরিশোধ কর–২০০/৫০ ঋণের কথা অবশ্য স্বতন্ত্র। ছোটখাট ঋণ, ২/১ আনা বা ২/১ পয়সা ফেরত দিতে কখনও ভুলো না। শোনা গেল, কাছারী ঘরে কে যেন চিৎকার করিতেছে। তাহারা কখন বাসায় কথা বলিতেছিলেন।-তাড়াতাড়ি উভয়ে কাছারি ঘরে আসিয়া দেখিলেন, রাম বাবু মুহুরী এক ব্যক্তিকে হাত বাঁধিয়া প্রহার করিতেছেন এবং গালি দিতেছেন। ২য় বন্ধু অতিশয় বিরক্ত হইয়া কহিলেন–এ কি মহাশয়, প্রজাকে আপনি প্রহার করছেন? থানা ঘর, আর জমিদারের কাছারি, দরিদ্রের পীড়িতের আশ্রয়স্থান, এখানে কারো প্রতি কোনো অত্যাচার হবে না।
রাম বাবু ক্রোধে কহিলেন–সাহেব, জমিদারিটি ছারখারে দেবার চেষ্টায় আপনি এখানে আছেন। আমি আজই ধীরেন বাবুকে পত্র লিখছি।
২য় বন্ধু বিরক্ত হয়ে কহিলেন, আপনাকে বরখাস্ত করলাম, দরবার করে যদি পারেন। চাকরি নেবেন। কালবিলম্ব না করে সমস্ত হিসাব দাখিল করে এখনই আপনাকে যেতে। হবে। বিকেল বেলায় পেয়াদা দিয়ে বিদায়ের চিঠি দিবো।
রাম বাবু থতমত খাইয়া বলিলেন-আজ্ঞা, এরূপ না করলে চলে না। কেন ক্রুদ্ধ হচ্ছেন?
‘কোনো কথা শোনা হবে না। আপনাকে বিদায় দিলাম। দরবার করে চাকরি নেবেন।’ রাম বাবু রাগে গর গর করিতে করিতে চলিয়া গেলেন। তিনি নির্মল বাবুর বিধবা পত্নীর কাছে অভিযোগ করিয়া জানাইলেন–আপনি কেন এই মুসলমানকে এতাটা ক্ষমতা দিয়েছেন, এ-ব্যক্তি জামিদারির সর্বনাশ করবে।
ধীরেনের মাতা কহিলেন–আমি তো কিছু জানি নে রাম বাবু, তোমাদের মনিব যা করে গেছেন, তার অবাধ্য আমি হতে পারব না। তিনি জমিদারি উড়িয়ে দিলেও আমি কিছু বলতে পারব না। তার কাছে ফিরে যেয়ে ক্ষমা চাও।
২য় বন্ধু কিছুতেই আর তাহার চাকরি দিলেন না। কহিলেন-অত্যাচারী ঘুষখোর, জুয়াচোর লোক জমিদারি কাছারিতে থাকতে পারবে না।
.
বস্ত্র ও খাদ্য
২য় বন্ধু বলিলেন-বন্ধু, উপযুক্ত খাদ্যাভাবে যেমন শরীর থাকে না, উপযুক্ত বস্ত্রাভাবে তেমনি শরীর ভেঙে পড়ে। কি নারী, কি পুরুষ, শরীরে কখনও ঠাণ্ডা লাগাবে না–ঠাণ্ডা মানবশরীরের ভয়ানক শক্র। তাই বলে নির্মল বাতাস সেবনে কখনও ইতস্তত করতে নাই, নির্মল বাতাস মানুষের জীবন; প্রচুর আলো এবং বাতাস–চাই-ই চাই। জানালা, বাতাস ও আলোক হীন ঘরে প্রাণ গেলেও বাস করবে না। বস্ত্রাবৃত রেখে ঝড়ের মাঝে শুয়ে থাক, কোনো ক্ষতি নেই।
১ম বন্ধু–মেয়েরা বড় ঠাণ্ডা লাগায়–
২য় বন্ধু–হা, ঠাণ্ডা লাগায়। ওষুধ খায় না। এই দুটিই পরম দোষ। একজনের অবহেলায় বাড়িসুদ্ধ লোকের কষ্ট হয়–স্বামীর প্রতি জুলুম করা হয়। মেয়েদের স্বাস্থ্যজ্ঞান নেই–এই জন্যেই তারা কি ছেলে-মেয়ে, কি নিজের শরীরে প্রতি বড় জুলুম করে।
বস্ত্রাঞ্চল গায়ে দিয়ে শীত কাটান, বৃষ্টিতে ভেজা, এসব ব্যাপার শরীরের পক্ষে বড়ই ক্ষতিজনক; অসুখের মধ্যে ভাত খাওয়া, এরকম অনেক মেয়ের অভ্যাস। স্বাস্থের নিয়ম পালন না করলে কঠিন ব্যাধি হয়–ফলে বাড়িসুদ্ধ লোক, ছেলেমেয়ে, স্বামী প্রভৃতি সকলেই কষ্ট পায়। এ বিষয়ে প্রত্যেক বুদ্ধিমতি বধূরই বিবেচনা করা উচিত নারী-পুরুষ সকলেরই গরম জামা ব্যবহার করা উচিত এবং কখনও ঠাণ্ডা লাগানো উচিত নয়; বয়স অধিক হলে, অধিক সন্তান প্রসব করলে মেয়েদের শরীরের বিশেষ ক্ষতি হয়, শয্যাশায়ী না হয়েও অকাল-বৃদ্ধতা নিবারণের জন্য ঔষধ সেবন আবশ্যক। গায়ের জোরে বা এক গুয়েমি করে শরীরের শ্রী নষ্ট করে ফেলা উচিত নয়।
১ম বন্ধু–খাদ্য সম্বন্ধে কিছু বলো।
২য় বন্ধু–ইঞ্জিনের যেমন জল-কয়লা চাই-মনুষ্য শরীরের জন্যও তেমনি খাদ্য চাই। জোড়াতালিতে শরীর চলে না। খাদ্যের মধ্য চার জাতীয় প্রধান বস্তু থাকে–১. মৎস্য, মাংস, এগুলি আমিষ জাতীয় পদার্থ; ডিম, ছানা ডাল এগুলিও আমিষ। এগুলির কাজ-মাংসপেশী গঠন, শরীরের ক্ষয় নিবারণ; ২. ডাল, চাল, ময়দা, কাঁঠালের বীজ, কচু, ওল, আলু, কলা–এসব শ্বেতসার। এতে শরীরের মেদ বৃদ্ধি পায়, শক্তি সংগৃহীত হয়। মাংসপেশীর ক্ষয়প্রাপ্তি নিবারণ করে; ৩. দুগ্ধ, ছানা, চর্বি, নারিকেল, সর্ষ তৈল–এগুলি তৈলময় পদার্থ-এদের গুণ শ্বেতসারের মতো। শরীরের মেদ বৃদ্ধি, শক্তিবর্ধনে ইহা শ্বেতসার অপেক্ষা শক্তিসম্পন্ন। ৪. খাবার লবণ, এছাড়া পটল, ডুমুর, বেগুন, কপি, লাউ, শশা কাকুড়, গোল আলু, পিঁয়াজ, লেবু, পালংশাক, নটেশাক, অম্লসাক্ত ফলসমূহ এবং আঙ্গুর, কিশমিস, ডালিমস, আপেল, নাসপতি প্রভৃতি ফলে যথেষ্ট পরিমাণ লবণ জাতীয় পদার্থ আছে। এসব না খেলে স্কার্ভি রোগ হয়। আর শরীরে প্রচুর পরিমাণ লবণ আছে তার। ক্ষয় নিবারণের জন্যে এসব বিশেষ প্রয়োজন। সব রকম খাদ্যই খাওয়া চাই। এ রকম খাদ্যের উপর নির্ভর করলে শরীর টেকে না। অপবিত্র দুগ্ধ, বেশি গরম দুগ্ধ, এসব অখাদ্য। দুধ শরীর রক্ষার জন্য বিশেষ প্রয়োজন, অথচ, এদিকে কারো লক্ষ্য নেই।-এর ফল, আকাল-মৃত্যু। আমাদের দেশে মাংস যত কম খাওয়া যায়, ততই ভালো–গো-মাংস অনেকের শরীরে সহ্য হয় না, তাদের এসব না খাওয়াই ভালো। প্রত্যেক গৃহস্থের গো মহিষ পালন করা নিতান্তই দরকার-প্রচুর দুগ্ধ ব্যতীত মানুষের দীর্ঘ জীবন লাভ হয় না–নানাপ্রকার পীড়ায় অকালে প্রাণ হারাতে হয়। ধূমপান অতি মন্দ অভ্যাস–শরীরের পক্ষে ইহা বিশেষ অনিষ্টজনক, মন স্বভাবকে অবনমিত করে–পারতপক্ষে ইহা খেতে নেই। ধূমপান করো না।
পরিশ্রুত পানি ব্যবহার করা উচিত। পানির বিশুদ্ধতা রক্ষা সম্বন্ধে সকলেই উদাসীন। পানির দ্বারা ষোল আনা রোগ সৃষ্টি হয়। অতএব, এ বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা চাই। কখনও অপবিত্র, নোংরা স্থানের পানি স্পর্শ করতে নেই। জ্বালানো পানির সমস্ত দোষই নষ্ট হয়। পানি ফুটিয়ে খাওয়াই ভালো। পচা, বাসি মাছ-মাংস কখনও ব্যবহার করতে নাই। এসব বিষবৎ ত্যাগ করবে। খাদ্যের উপর মাছি বসা বড়ই দোষেরএক একটা মাছির পায়ে ৬০,০০০ হাজার জীবাণু থাকে, চর্মচক্ষে আমরা তা দেখতে পাই নে; কিন্তু সেজন্য। অবিশ্বাসের কারণ নেই। খাবার পরে সাবান ব্যবহার করার চাইতে খাবার আগে উত্তমরূপে সাবান দিয়ে মুখ ধুয়ে নেবে। আমাদের হাতে অসংখ্য জীবাণু থাকে, সুতরাং অপবিত্র হস্তে কখনও কোনো খাবার জিনিস স্পর্শ করবে না।
বর্ষাকালে পিত্তের শান্তি হয় এমন জিনিস খাবে। ইহা ত্রিদোষনাশক। দুগ্ধের সঙ্গে আম, কলা এবং মাছ খাবে না, এর পরিণাম ফল খারাপ। এসব স্বতন্ত্রভাবে খেলে বড়ই উপকার হয়।
.
ক্ষয় রোগ
২য় বন্ধু কহিলেন–বন্ধু, ক্ষয় রোগ বলে একটা রোগ মানুষকে আক্রমণ করে-এ বিষয়ে সকলেরই সতর্ক হওয়া উচিত। অভাব, দুঃখ দারিদ্র্য, আলো-বাতাসের অভাব এবং পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে এই রোগ জন্মে, এ রোগ অতিশয় সাংঘাতিক। আস্তে আস্তে শরীর শুকোতে থাকে, ফুসফুস যন্ত্রে ক্ষত হয়, কাশি হয়, উদারাময় হয়-জ্বর হয়, ফলে রোগী ভুগে ভুগে মারা যায়।
১ম বন্ধু–তাই নাকি, কি বয়সে মানুষকে এ রোগ আক্রমণ করে।
২য় বন্ধু–যে কোনো বয়সে।
১ম বন্ধু–এর প্রতিকারের উপায় কী?
২য় বন্ধু–প্রতিকারের কথা বলছি, কিন্তু এ রোগ যাতে না হয়, সে বিষয়ে প্রথমে সতর্ক হওয়া উচিত, তা হলে অতিশয় দুঃখ ভোগ করবে না; কখনও অভাব ভোগ করতে নেই–অতি সামান্য কাজ করেও যদি পয়সা উপায় হয়, আত্মরক্ষার জন্যে তাই করবে। দুঃখ ভোগ করে ভদ্রলোক হবার দরকার নেই। অন্ধকার, আলো-বাতাসহীন ঘরে কখনও বাস করবে না। পারতপক্ষে শহরে বাস করবে না; বিশেষ করে, অপবিত্র, গরম ও নোংরা পল্লীতে। প্রচুর দুগ্ধ চাই-নারী-পুরুষ, শিশু সকলেই প্রচুর দুগ্ধ, ঘৃত, এবং ডিম আহার করবে; কাশি, উদারাময় এবং শরীর শীর্ণ হতেথাকলেই সতর্ক হবে, অবিলম্বে উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। চিকিৎসা ব্যাপারে কখনও কৃপণতা করো না–এর ফল কঠিন দুঃখ এবং অকালমৃত্যু।
মানোমালিন্য, মানসিক যাতনা বড়ই খারাপ। চিত্তের প্রসন্নতা রক্ষা করবে। কুরূপী, কটুভাষিণী পত্নীর সহবাসে মানুষের আয়ু ক্ষয় হয়। সুতরাং পত্নী নির্বাচনে বিশেষ সতর্কতা চাই-নইলে আয়ু, স্বাস্থ্য, সুখ, কল্যাণ, ইহকাল এবং পরকাল সমস্তই বিনষ্ট হয়।
১ম বন্ধু–তুমি যে রোগের কথা বললে, এ রোগ হলে সারে কী করে?
২য় বন্ধু–সম্পূর্ণ বিশ্রাম, প্রচুর আলো-বাতাস, মনের আনন্দে, পুষ্টিকর খাদ্য এবং উপযুক্ত ঔষধ সেবনে সম্পূর্ণরূপে ভালো হয়। তবে মনে যাতে অশান্তি ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়, এরূপ কাজ সর্ব প্রকারে বর্জন করতে হবে। একটি কথা সর্বদাই মনে রাখবে–যেখানে-সেখানে কেউ কখনও বাড়ির মধ্যে থুতু না ফেলে। থুতু শুষ্ক হলে বিষাক্ত হয় এবং মন-শরীরে বহুপ্রকার রোগ জন্মায়। সূর্যালোক বহু ব্যাধির জীবাণু ধ্বংস করে, অতএব অন্ধকার ও স্যাঁতসেঁতে নরক জ্ঞানে ত্যাগ করবে।
.
দুর্ঘটনা
২য় বন্ধু বলিলেন–হঠাৎ কোনো স্থান কেটে গেলে একটু তাৰ্পিন তেল লাগিয়ে দিতে হয়, তাতে রক্ত বন্ধ হবে।
কোন জায়গায় কাঁটা, খোঁচা, পেরেক বিধলে সেস্থান টিপে রক্ত বের করে দিতে হয়। তারপর ৪০ ভাগ জলে একভাগ কার্বলিক তেল দিয়ে ধুয়ে দিবে। তবু যদি যন্ত্রণা হতে থাকে এবং ভিতরে ধূলামাটি-ময়লা আটকে থাকে, তা হলে ডাক্তারকে দেখাবে, নইলে গুরুতর বিপদ হতে পারে। হাত-পা ভেঙে গেলে তৎক্ষণাৎ একটা বন্ধ করা ছাতি দিয়ে সে স্থানে জড়িয়ে বেঁধে দেবে, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের সাহয্য গ্রহণ করবে।
হঠাৎ গায়ের কাপড়-চোপড়ে আগুন ধরলে মোটা কাথা দিয়ে চেপে ধরতে হয়, দৌড়াদৌড়ি করলে বিপদের সম্ভাবনা। রোগীকে জবরদস্তি করে ধাক্কা মেরে মাটিতে শুইয়ে দিবে। দগ্ধস্থানে অবিলম্বে কিছু পুরাতন তাৰ্পিন তেল দিবে। ফোস্কার পরদা কখনও তুলে দিতে নেই, ফুঁ দিয়ে জল বের করে দেওয়া যায়। পরিষ্কার চুনের জল, নারিকেল তেল গরম করে ফুটিয়ে একত্রে মিশিয়ে দগ্ধ স্থানে লাগালে ঘা সেরে যায়। যে যা বলে তাই দিতে নেই ফোস্কা ওঠার আগে মাখন লেপন করলে ফোস্কা ওঠে না। গোলআলু বেঁটে তার পাতলা প্রলেপ দিরে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়।
কাঁকড়া, বিছা, তেঁতুলে বিছা কামড়ালে,সম্ভব হলে চাবির তাড়া চেপে ধরে জল বের করে দেবে এবং নিশাদল ও ভিজান চুন একত্রে করে ক্ষতস্থানে লাগাবে। আয়োডিন লাগালেও উপকার হয়। লবণ জল দিয়ে স্থানটি ধুয়ে দিলেও যন্ত্রণা কমে। বোলতা, ভীমরুল মৌমাছিতে কামড়ালে কোনো কোনো সময় মানুষ মারা যায়। ঠিক এ সব প্রক্রিয়া অবলম্বন করলে বেদনার উপশম হয়। পুঁইশাকের পাতা অথবা হাতি-শুড়ের পাতার রস দগ্ধস্থানে মর্দন করলে জ্বালা উপশম হয়। পাথুরে কয়লা জলের মধ্যে দিলেও উপকার হয়।
তারপর হাসপাতালে সর্প বিষের প্রতিষেধক একপ্রকার ঔষধ পাওয়া যায়। এতে বিশেষ উপকার হয়। সাপে কামড়ান ক্ষতস্থানটি বেঁধে ফেলতে হয় এবং খানিকটা মাংস কেটে তুলে দিয়ে সেখানে পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট-এর দানা ভরে দিতে হয়। বিষাক্ত সর্পের দংশনমাত্র স্থানটি জ্বলে ওঠে, দষ্ট স্থানটি ফুলে উঠে লাল হয় এবং সেখান হতে এক প্রকার জলের ন্যায় রক্ত গড়িয়ে আসতে থাকে। এ অতি নিশ্চিত চিহ্ন।
ক্ষেপা কুকুরে কামড়ালে দষ্ট স্থানটি চিরে ফেলতে হয়। লোহা গরম করে খুব লাল হবার দরকার নেই, দষ্ট স্থানে গর্তগুলির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেবে এবং তার পর কার্বলিক তেল দিয়ে পুড়িয়ে দেবে। কামড়ানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যে এই প্রতিক্রিয়া অবলম্বন করলে, আর কোনো ভয় থাকে না। দষ্ট ব্যক্তিকে হাসপাতালে একপ্রকার টীকা দেওয়া হয়। গরিব লোক আবেদন করলে জেলার ম্যাজিস্ট্রেট-হাসপাতালে যাতায়াতের খরচ ও খোরাকী দিয়ে থাকেন। সুতরাং কখনও আনাড়ী লোকের চিকিৎসার উপর নির্ভর করবে না।
.
বিশুদ্ধ পানীয় জল
২য় বন্ধু বলিলেন–মানুষের জীবন সম্বন্ধে বিশুদ্ধ পানি বিষয়ে অসর্তক হওয়া বড়ই মূর্খ। পল্লীগ্রামের মানুষ অতি অপবিত্র অবিশুদ্ধ পানি খায়, তার ফলে কলেরা, অজীর্ণ প্রভৃতি রোগে মারা যায়। অনেক অশিক্ষিত লোক, খোদা যা কর, এই কথা বলে কোনো নিয়ম মানে না। খোদা জ্ঞান দিয়েছেন, তার সৃষ্ট জিনিসে শরীরের ক্ষতি করবার ক্ষমতাও দিয়েছেন। জ্ঞানের অপব্যবহার করলে খোদার দানকে অবহেলা করা হবে।
যে সমস্ত জলাশয়ে মানুষ স্নান করে, তথাকথিত পানি পানীয়রূপে ব্যবহার করে না-থালাবাটিও ধোবে না–চাল, ডাল, শাক ধোবার জন্যও সে অপবিত্র পানি ব্যবহার করতে নেই। আমরা চোখে দেখতে পাই নে, নইলে নিয়ত কত অসংখ্য জীবাণু যে আমাদের শরীরের মধ্যে ঢুকছে তার ইয়ত্তা নেই।
বাড়ির কূপের চারিদিকে কোনো অপবিত্র ময়লা না জমে সেদিকে লক্ষ্য রাখবে। গোয়ালঘর পায়খানা কখনও কুয়ার কাছে না থাকে এবং সেই সব নোংরা স্থানের আবদ্ধ ময়লা পানি মাটির স্তর ভেদ করে কূপের পানিতে প্রবেশ না করে। কলেরার সময় বা বাড়ির পানি দুর্গন্ধযুক্ত হলে অর্ধ ছটাক পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের দানা বালতির ভিতর গুলিয়ে ইন্দারা বা কূপের মধ্যে ফেলে দেবে। প্রাতে কূপের পানি বিশুদ্ধ পরিষ্কার এবং পানের উপযুক্ত হবে। আজ রাত্রে আটটার সময় দিলে, কাল বেলা আটটার সময় সে পানি ব্যবহার করা চলে।
গ্রামের মধ্যে অনেক সময় একই পুকুরে মানুষ স্নান করে, গরু-মহিষকে জল দেয়, প্রস্রাব ও মলত্যাগ করে এবং ঠিক সেখানকার পানি সবাই তুলে খায়। ইহা যমকে ঘর ডেকে এনে প্রাণ তার হাতে সঁপে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। সাধারণ স্বাস্থ্যজ্ঞান এবং শিক্ষা ব্যতীত সাধারণ মানুষ নিজেদের বিপদ বুঝতে পারে না–ফলে নিজেরা বিপন্ন হয় এবং অন্যান্য মানুষকে বিপন্ন করে। গ্রামের ভদ্রলোকেরা মিলিত হয়ে গ্রামের কোনো পুকুর যদি পানির জন্য রিজার্ভ করে রাখেন এবং সেখান হতে সকলের জন্য পানি সরবরাহ হয়, তা হলে বড়ই ভালো হয়। যে পুকুরের জল লোকে পান করে সেখানে হাত-পা ধোয়া বা ‘কুলি ফেলাও নিষেধ।
বাড়ির কাছে যদি জঙ্গল ও গর্ত থাকে, বাশঝাড়ের ছায়া এবং দুর্গন্ধযুক্ত পায়খানা থাকে, তা হলে অন্যত্র উত্তম পানীয় জলের ব্যবস্থা করা উচিত। অন্যথায় সকলের গৃহ অস্বাস্থ্যকর হবার সম্ভাবনা।
.
সামান্য সামান্য চিকিৎসা
২য় বন্ধু কহিলেন–আমাদের দেশে জ্বর হয়। সাংঘাতিক অবস্থা না হলে, কুইনাইন ব্যবহার করলেই জ্বর সারে। কোষ্ঠ পরিস্কার না থাকলে কোষ্ঠ পরিষ্কারের জন্য মাঝে মাঝে কুইনাইন ব্যবহার করলে ম্যালেরিয়ার বিষ নষ্ট হয়। জ্বর উত্তরোত্তর বাড়তে থাকলে বা না সারলে ডাক্তারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বাড়ির কাছে গর্ত, পচা নর্দমা জঙ্গল না রাখা উচিত।
সামান্য সর্দি হলে শিশুদের জন্যে এক ফোঁটা ইউক্যালিপটাস্ তেল তিন চামচ মধুর সঙ্গে মিশিয়ে দিবসে তিনবার দিলে উপকার হয়। ইউক্যালিপটাস্ তেল রুমালে মেখে শুকিয়ে নেওয়াও ভালো। যে কোনো ওষুধ ডাক্তার খানায় গেলেই কিনতে পাওয়া যায়। ক্ষুদ্র শিশুদের পক্ষে তুলসীপাতার রস মধুসহ সেবন করতে দেবে। বয়স্করা চিনির সঙ্গে প্রতিবার ২/৩ ফোঁটা ইউক্যালিপটাস্ অয়েল খেলে উপকার পাবে। রুমালে মেখে উহা ব্যবহার করা যায়। এই তেল জীবাণুর আক্রমণ হতে বক্ষকে রক্ষা করে।
কাশি হলে একটা পানের মসৃণ পৃষ্ঠায় কালি চুন মাখিয়ে, আর একটা পান চাপা দিয়ে বাইরের পিঠে তেল মেখে, বেশ গরম করে গলার কাছে লাগিয়ে দেবে। এতে শিশুদের খুব উপকার হয় বুড়োদেরও উপকার হয়। ইউক্যালিপটাস্ তেল ব্যবহার করলেও উপকার হয়। সর্দি-কাশি হলে গরমে থাকা উচিত। কখনও স্নান করতে নেই।
অজীর্ণ ও উদরাময় রোগে ২০ গ্রেন সোডা জলে খেয়ে কিছু যোয়ান চিবিয়ে খেলে সেরে যায়। ভাত একবেলা বন্ধ দেওয়া উচিত। পানের সঙ্গে কর্পূর খেলেও বিলক্ষণ উপকার হয়। লবণের সঙ্গে বেশি করে যোয়ান চিবিয়ে খাওয়াতে পেট-ভার ও পেট কামড়ান সারে। শিশুর পেটের অসুখ হলে এক ছটাক দুধে ৪ গ্রেন সাইট্রেট অব সোডা মিশিয়ে খাওয়ালে দুধ সহজে হজম হয়।
আমাশয় হলে এরন্ড তেলের জোলাপ নেওয়া উচিত; কিংবা কাঁচা বেল পুড়িয়ে খেলে উপকার হয়।
শিশুদের কৃমি রোগে–বন্ বন্ নামক ঔষধ মাঝে মাঝে খাওয়া ভালো।
ম্যালেরিয়া হলে কিছু ‘মেন্থল’ নারিকেল তেলের সঙ্গে মিশিয়ে কপালে মালিশ করলে ম্যালেরিয়া সারে। শরীরের কোনো স্থানের বেদনায় ‘মেন্থল’ উত্তম প্রকারে মালিশ করলে উপকার হয়।
কান কামড়ানিতে একখানি চামচে খানিকটা সর্ষ তেল দিয়ে তাতে সর্ষ পরিমাণ অফিম দিয়ে গরম করে ২/১ বিন্দু কানে দিলে বেদনা উপশম হয়।
চক্ষু উঠলে বোরিক এসিডের গুঁড়া সামান্য পরিমাণ ২/৩ বার দিলে সেরে যায়। ঘামাচিতেও বোরিক এসিডের গুঁড়া মালিশ করলে উপকার হয়।
.
নারীর সতীত্ব
২য় বন্ধু বহিলেন–নারীর নয়ন যদি কোনো পুরুষের রূপ দেখবার জন্যে লালায়িত হয়, তবে বুঝতে হবে–সে হৃদয়ে পাপ আছে। মনুষ্য পাপ দেখুক আর না দেখুক, কী ক্ষতি! নিজের পাপে নিজে লজ্জিত হও। যদি ফুলের গন্ধে প্রাণ পুলকিত হয়, যদি আষাঢ়ের মেঘে মন ব্যাকুল–অধীর হয়, যদি বাঁশির গানে মন ক্রন্দন-ব্যাকুল হয়, তবে নারী আপন আপন দেহকে পবিত্র রাখুক। মনুষ্য না দেখুক, কী ক্ষতি? নারী স্বামী ছাড়া আপন দেহ কাউকে দেবে না–যদি প্রাণ যায় সেও ভালো। যদি শরীর ছিন্নভিন্ন হয়, তথাপি নারী আপন দেহকে কলঙ্কিত করবে না। নারী-পুরুষের সম্বন্ধে পবিত্র, স্বর্গীয়-এর মধ্যে গোপনে প্রকাশ্যে কোনো কলঙ্ক না আসুক। নারীর ও পুরুষের মিলন ও পরশ ক্ষণস্থায়ী নহে। সাময়িক ভোগের জন্য নারী-পুরুষ যদি মিলিত হয়, তবে সে স্থান রসাতলে যাক–তা নরক হতেও অপবিত্র স্থান, সেই স্থান লজ্জায় ক্রন্দন করে। পাপী ও পাপিনীরা ভার সইতে চায় না।
যে বন্ধন চিরদিনের, যা কখনও ভাঙ্গে না, যা স্থির, অটল, অচল, কখনও ভাঙ্গবে –তাই বৈধ। যে নারীকে একবার চুম্বন করেছ, যাকে একবার হৃদয়ের পরশ দিয়েছ–তাকে আর কখনও ত্যাগ করতে পার না।
যে নারী স্বামীকে অবৈধভাবে ত্যাগ করে, তার জীবনের সমস্ত ধর্ম-কর্ম-বৃথা–তার স্থান মহানরকে–যাবৎ না সেই স্বামী তাকে ক্ষমা করে–তাবৎ তার ক্ষমা নেই।
ভক্ত ও খোদাতে যে সম্বন্ধ, স্বামী ও পত্নীতে সেই সম্বন্ধ। কোনো কোনো সাধু বললেন–পত্নী আসলে এক-দুই পত্নী মানবাত্মার ধর্মবিরুদ্ধ! বিশেষ কারণে যদি এর ব্যতিক্রম হয়, তাবে তা অবৈধ না হলেও স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধের মর্যাদা সেখানে রক্ষিত হয় না।
বদমায়েশরা নারীর সতীত্ব হরণ করে-মূর্খ নারী আপন দেহকে অপবিত্র করে তারা জানে না, নারী-পুরুষের সম্বন্ধ কী; তা কত পবিত্র! নারীদেহের রূপ লুণ্ঠিত হবার জন্য সৃষ্টি হয় নাই।
যাকে ভালোবাসতে পাবে না-নারী তাকে বিয়ে না করুক। যাকে সে বিয়ে করেছে। তার জন্য সে আপন প্রাণ দিক–কোনো কলঙ্ক, কোনো দাগ তার পবিত্র দেহকে অপবিত্র না করুক।
সাবধান–ভোগের জন্য কোনো নারী দেহকে স্পর্শ করো না–কখনও না, কখনও –এর জন্যে মহাশক্তি–মহানরক অপেক্ষা করছে। যদি গোপনে কোনো অন্যায় কার্য করে থাক, তাহা প্রকাশ্যে স্বীকার কর-মহাপাপের অভিশাপ হতে রক্ষা পাবার জন্য বৈধভাবে বিবাহিত হও এবং পাপের ভার লঘু কর।
কেন তারা পরস্পরে পাপ করে-ধরণী ধ্বংস হবে–যদি না পাপী ও পাপীয়সীরা সতর্ক হয়। পৃথিবী কখনও এ অবিচার সইবে না–এই কথা সর্বত্র প্রচার কর; কেন নরনারী অবৈধূভাবে পাপ করে? তারা একে অন্যকে প্রেম করুক এবং বৈধভাবে মিলিত হোক–এতে খোদা তুষ্ট হন। যেখানে বিশ্বাস ও প্রেমে নর-নারী যুক্ত হয়, সেই স্থানে আল্লাহর আশীর্বাদ নেমে আসে।
কেউ জবরদস্তী করে নারীকে বিধবা করে না রাখুক–কোরানের বিরুদ্ধে জবরদস্তী করে নারীকে ‘কবুল’ বলতে বাধ্য না করুন–সে বিবাহ বৈধ হবে না।
কেউ যেন পাপ না করে অন্ধকারে, চক্ষুর অগোচরে, পাহাড়ে, সমুদ্রে কেউ যেন পাপ না করে। নর-নারী বৈধভাবে মিলিত হোক–মৃত্যু পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী আপন আপন চক্ষুকে সংযত করুক এবং পরস্পরকে প্রেম করুক।
যারা বিবাহিত হয়েছে তারা কখনও পরস্পরকে কটু কথা বলো না, কারণ আন্তরিকতার সঙ্গে এরূপ করলে বিবাহ-বন্ধন ভঙ্গ হয়। তাদের মিলন অবৈধ হয় এবং তারা পাপ করে। একজন আর একজনের জন্যে ভিক্ষা কর, তথাপি কেউ কাউকে ত্যাগ করো না–এরই নাম নারীধর্ম।
যে তোমার পত্নী নয়-তার দিকে কটাক্ষ করো না–তার রূপের দিকে তৃষিত প্রশংসা করো নাবরং আপন স্বামীর সৌন্দর্য প্রশংসা কর, যে ধর্মের তৃপ্তির জন্য গোপনে চোরের –মতো নারীর রূপ ভোগ করতে চায়–সে দস্যু নরপিশাচ ও নিষ্ঠুর।
.
স্বামীর ঘর
১ম বন্ধু কহিলেন–নারীর কর্তব্য, সে কখনও স্বামীকে দাস না ভাবে–সর্বদাই সে গোপনে, প্রকাশ্যে স্বামীর মঙ্গল কামনা করে। স্বামীর সুখ-দুঃখ বণ্টন করে নেয় তার অন্তরের ভাবের মধ্যে প্রবেশ করতে চেষ্টা করে, দুঃখে তাকে সান্ত্বনা, বিপদে তাকে প্রেরণা দেয়।
স্বামীর উপর অত্যাচার করা কোনো সতী নারীর পক্ষে শোভা পায় না–তার কর্তব্য স্বামীর চিত্তের বেদনা সে অনুভব করে এবং তার প্রতিকারের চেষ্টা করে। নারী স্বামীর বন্ধু হতে চেষ্টা করুক। অন্তরঙ্গ, প্রিয়তম অভেদাত্মা সুহৃদ হতে সে সাধনা করুক। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো ভেদ যেন না থাকে–কারো কাছে কেউ যেন কোনো বিষয় গোপন না করে।
স্বামীর মানসিকতা অনুসারে নারী নিজেকে গঠন করতে চেষ্টা করবে–নারী যেন কখনও স্বামীকে নিম্নস্তরে টেনে নিতে চেষ্টা না করে-যেই স্বামীর মতো তোক নিজের দোষ-ত্রুটি অনুভব করুক, নিজের মতা সম্বন্ধে অন্ধ না হোক, সে কখনও দাম্ভিক, কোন্দলপ্রিয় এবং অবিনয়ী না হোক। নারী যেন কখনও মিথ্যা কথা না বলে, মিথ্যা ব্যবহার না করে এবং মনে এক কথা ও মুখে আর এক কথা না বলে।
নারী যেন কখনও সম্পূর্ণরূপে স্বামীর উপর নির্ভর না করে কোনো না কোনো অর্থকরী শিল্প সে শিখে রাখবে, জীবনে কোন সময় কী হয় কে জানে–যে সম্পূর্ণভাবে পর প্রত্যাশী, নিঃসহায়, তার মনুষ্যত্ব থাকে না-তার প্রেমও সত্য নয়।
নারী যেন কখনও স্বামীকে ত্যাগ করে সন্তানদেরকে অধিক প্রেম না করে–কিংবা অর্থকরী আশ্রয় ভিক্ষা না করে। স্বামীকে ত্যাগ করে সে কখনও আপন মাতার অনুরোধও শুনবে না। নারীজীবনে স্বামীর বাক্য অপেক্ষা বড়বাক্য আর কারো নেই। দায়িত্বজ্ঞানহীন, অপরিচিত কোনো যুবককে নারী কখনও বিয়ে করবে না। . যুবতী নারী কখনও স্বামী ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে হেসে কথা বলবে না, (নিষ্ঠুর মুখ স্ত্রীও নারীর পক্ষে অশোভন), কারো সঙ্গে অশ্লীল রসিকতা করবে না, একাকী নির্জন ঘরে কারো সঙ্গে সে আলাপ করবে না–আপন পুত্র ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে নয়। বয়স্থা প্রৌঢ়া নারী সম্বন্ধে কোনো কথা নাই। স্বামী যেমন চরিত্রহীন পত্নীকে ত্যাগ করতে পারে, পত্নীও তেমনি চরিত্রহীন স্বামীকে ত্যাগ করতে পারে। দম্পতির যে কেউ একজন চরিত্রহীন হলে তৎক্ষণাৎ বিবাহবন্ধ ভঙ্গ হয়।
বধূ কখনও কুৎসিত, অসভ্য, আলুলায়িত কেশে কি স্বামী, কি অপর কেউ, কারো সমানে উপস্থিত হবে না। আত্মোন্নতির চিন্তা ত্যাগ করে অত্যাধিক কেশ-বিন্যাসে নিযুক্ত থাকা কি স্ত্রী, কি পুরুষ, সকলের পক্ষেই দোষের কথা।
.
পত্নীর সমাদর
২য় বন্ধু কহিলেন–পত্নী যদি উচ্চাসনে বসে, তবে তুমি নিম্নাসনেই বসো। পত্নীকে তুলে দিয়ে তার আসন অধিকার করো না।
পত্নীকে পদধূলি নিতে দিও না–নিজে উত্তম বস্ত্র পরে তাকে কদর্য বসনাদি দিও না। পত্নীকে কখনও দাসী ভেব না–সে নিজেকে যাই ভাবুক। পত্নীর হাতে কিছু টাকা দিও–সে তা দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করবে-কখনও তার হিসাব চেয়ো না।
কখনও কারো কাছে পত্নীর কুৎসা ও গ্লানি করো না–এটা বড়ই অভদ্রতা। পত্নী কখনও স্বামীর গ্লানি করবে না-অভিশাপ দেবে না–দিলে বড়ই অন্যায় হবে।
পত্নীর খাবার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না, সে নিজে কিছু খায় কি না সে সম্বন্ধে খবর রাখবে। পরিবারের সবাই নারী-পুরুষ একই সময়, একাসনে খান, তাতেও আপত্তি নেই।
কখনও পত্নীর কাজের সমালোচনা করো না-স্বামীর পক্ষে বড়ই অভদ্রতা। কোনো ক্রটি শৃঙ্খলা দেখলে নিজ হাতে তার বন্দোবস্ত করবে-কখনও সেজন্যে বকা-ঝকা, বা vulgar সমালোচনা করবে না। পরীর মনের উন্নতির স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করবে, মাসিক পত্রিকা, কাগজ-বই পড়াবার ব্যবস্থা করে দেবে।
দিবারাত্র হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের চাপে জীবন অতিষ্ঠ করে তুলো না। সঙ্গতি থাকলে বায়ু পরিবর্তন, স্থান পরিবর্তন, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ২/১ দিনের জন্য নিয়ে যাওয়া উত্তম। পত্নীর ওঠবার বসবার স্বতন্ত্র স্থান করে দিও; দিবারাত্র এক ঘরে থেকো না-প্রাতঃকালে তার কুশল জিজ্ঞাসা কর এবং অভিবাদন কর। তার সঙ্গে সর্বদাই ভদ্রভাবে কথা বল।
ছেলেমেয়ে হলে তাদের পালনের ভার শুধু পত্নীর ঘাড়ে ফেলে দিও না। সন্তান পালন অতিশয় কঠিন কাজ–এতে স্বাস্থ্য, শান্তি দুইই নষ্ট হয়। হয় অল্প বেতনে দাসী রাখ, না হয কোনো দূর সম্পর্কীয়া নারী-আত্মীয়কে গৃহে স্থান দাও।
নারীর বেশ বিন্যাসের সময় দিও এবং তাকে উত্তম উত্তম সুগন্ধি দ্রব্য, আতর, ফুল এইসব উপহার দিও। হঠাৎ অতর্কিতভাবে কারও ঘরে উপস্থিত হয়ো না।
বধূদের অনেক সময় মাথা ঘোরা, হাত-পা জ্বালা, স্নায়ুবিক দৌর্বল্য, শীর্ণতা, দুর্বলতা অজীর্ণ, বুকজ্বালা, কাশি প্রভৃতি স্ত্রী-ব্যাধি হয়, স্নানাহার বন্ধ হয় না বলে কখনও এ সবকে উপেক্ষা করো না। জ্বর, কলেরা, নিউমোনিয়া অপেক্ষা এসব ব্যাধি কোনো অংশে কম মারাত্মক নয়। বধূদের চিকিৎসার ত্রুটি কখনও কারো না। নারী অতিথির কখনও অযত্ন করো না। নারীর অসম্মান হলে সংসারের কখনও শ্রীবৃদ্ধি হয় না।
.
একখানি চিঠি
সন্ধ্যাকালে ২য় বন্ধু কাছারীর বারান্দায় একাকী বসিয়াছিলেন–এমন সময় সুবল আসিয়া তাহার হাতে একখানি চিঠি দিয়া গেল। চিঠিখানি এই
রায়বাড়ী
সোমবার, দুপুরবেলা
৪/৮/৩৬
পরম শ্রদ্ধাস্পদেষু, আজ কয়েকদিন হতে আপনাকে কিছু বলতে যাচ্ছি। কঠিন সঙ্কোচ এসে আমার হাতখানি চেপে ধরেছে। ভাগবান জানেন, এ হৃদয়ে কোনো পাপ নেই। আপনার মহত্ত্ব আমাকে দিন দিন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছে-এ আকর্ষণ অনেক চেষ্টা করেও আমি এড়াতে পারি নি। আমি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছি। আপনি আমার এই জমিদারির সমস্ত ভার গ্রহণ করুন। এ জমিদারি আমার-আমার ধীরেনের বাবার নয়, তা আপনি জানেন। আজ সন্ধ্যার পর আপনি আমার সহিত দেখা করবেনই আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।
.
পত্রখানি তিনবার, চারবার, পঁচবার পড়িলেন। তাঁহার নামাজ পড়া হইল না। তারপর একটা দুর্দমনীয় কঠিনতা তাহার চোখে-মুখে প্রকাশ হইল। তিনি শান্তির নিশ্বাস ফেলিলেন।
সন্ধ্যার কিছু পরে তিনি ধীরে ধীরে জমিদার বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করিলেন। নায়েবকে সকলেই জানিত-তাহার জন্য সর্বত্র অবারিত দ্বার ছিল–কেহ এতটুকু সন্দেহ করিত না। নির্মল বাবু বাঁচিয়া থাকিতেও ঠিক এমন ধারাই ছিল।
উপর তলায় উঠিয়া গিয়া দেখিলেন–জানালার শার্শি ধরিয়া নির্মলের বিধবা পত্নী দাঁড়াইয়া আছেন। তিনি প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিয়া একখানি আসনে উপবেশন করিলেন-কেহ কোনো কথা কহিলেন না। প্রায় আধ ঘণ্টা পরে ধীরেনের মাতা সাধারণ নীরবতা ভাঙ্গিয়া মাটির দিকে মাথা নত করিয়া কহিলেন, “আপনাকে আমি সম্মান করি, ভালবাসি, বস্তুত আপনার আকর্ষণ আমি কিছুতেই এড়াতে পারি নে-চুম্বকের মতো। আপনার মহিমা আমাকে আকর্ষণ করে। আমাকে ক্ষমা করুন। আমি মুসলমান হবই।”
“তা হলে আজ রাতেই আপনাকেও এ স্থান ত্যাগ করতে হবে। আপনি আমার অগোচরে যা ইচ্ছা তাই করবেন।” বিবেক অনুযায়ী কাজ করা উত্তম, কিন্তু বিবেকের নামে আত্মপ্রতারণার প্রশ্রয় কোনো রকমে দেওয়া যাবে না। ধর্ম পরিবর্তন করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম নয়-মনুষ্যত্ব অর্জন, মিথ্যা বর্জনই মানুষের প্রথম ধর্ম। ধর্মের জন্য যদি ধর্ম পরিবর্তন করতে চান, তবে (বেয়াদবি মাফ করবেন) আমার পত্নী হবার প্রস্তাব কেন করলেন? ও আমার পক্ষে কত বড় কাপুরুষতা তা আপনি বুঝতে পারছেন। পরনারীকে মুসলমান করা একটা আদেশ হতে পারে, কিন্তু কাপুরুষতা পরিচয় দেওয়া কি ইসলামের অন্তর্গত?
“ইসলাম ধর্ম কী জিনিস, তা আগে জানতাম না, আপনাকে দেখেই তা জানতে পেরেছি। আপনাকে ছেড়ে আমি মুসলমান হতে চাই নে।”
ইসলাম, কাপুরুষতা, বিশ্বাসঘাতকতা এবং বন্ধুর স্মৃতির প্রতি অমর্যাদা করতে শিক্ষা। দেয় না সুতরাং বুঝতে পারছেন, ইসলাম ধর্ম কি!
সহসা মাটিতে মাথা ঠেকাইয়া নির্মলের বিধবা পত্নী কহিলেন, আমাকে ক্ষমা করুন।
তাড়াতাড়ি আসন ছাড়িয়া কুণ্ঠানম্রভাবে ধীরেনের মাতার হাত ধরিয়া কহিলেন–এ কি দিদি, কী করছেন! আপনি আমার বড় বোন!
”সত্যি আমি আপনার বড় বোন?”
পকেট হইতে একখানি ছোট কোরান শরীফ বাহির করিযা তাহা ধরিয়া কহিলেন সত্য, এই কোরান ছুঁয়ে বলছি।
“কখনও এ কথা নড়বে না?”
“না–কখনও নয়।”
চোখ মুছিতে মুছিতে ২য় বন্ধু সিঁড়ি বাহিয়া নিম্নে অবতরণ করিলেন। তারপর সোজা ঘরে যাইয়া ধীরেনের কাছে তার করিলেন–তোমার মাতার অসুখ–এ সপ্তাহের জন্য বাড়ি আসিবে।
শোকদগ্ধ হৃদয়খানি মেঝের উপর রাখিয়া ধীরেনের মাতা অস্ফুট আর্তকণ্ঠে। কহিলেন–ওগো স্বামী, আমাকে আশীর্বাদ কর। আজ আর আমার কোনো দুঃখ নেই–আমি আমার হারানো ভাইকে ফিরে পেয়েছি–আমার সমস্ত প্রাণ আজ পূর্ণ হয়ে গেছে।
.
কর্মকার ও মিস্ত্রী
২য় বন্ধু কহিলেন–বন্ধু, আর দুবছর এখানে আছি।
১ম বন্ধু–কেন দুবছর কেন?
২য় বন্ধু–ধীরেন আর দুবছরে বি-এ পাস করবে, তার জিনিস তার হাতে দিয়ে বিদায় নেবো। এখানকার কর্তব্য আমার শেষ হবে।
১ম বন্ধু–তারপর কোথায় যাবে?
২য় বন্ধু–দেশে যাবো।
১ম বন্ধু–সেখানে যেয়ে কী করবে?
২য় বন্ধু–তুমি হবে লোহার কর্মকার, আর আমি হবো মিস্ত্রী। দুজনে দুই কারখানা খুলে বাকি জীবনটুকু কাটাব। নিম্নস্তরের লোককে উচ্চভাবে অনুপ্রাণিত করতে না পারলে জাতীয় কোনো কল্যাণ হবে না–অধর্ম ও দুঃখে মানুষ মরে যাচ্ছে, তাদেরকে রক্ষা করতে হবে–নিজেদেরকে নিম্নস্তরে নেমে যেতে হবে-এতে আমাদের বিলক্ষণ পয়সা হবে। খেয়ে-পরে লোককে দিয়ে বহু জনহিতকর কাজ করাতে পারব। অন্তঃসারশূন্য ভদ্র সমাজে আর থাকতে চাই নে–এখানে কেবল মিথ্যা। সময় হওয়াই মানুষের ধর্ম–এ ছাড়া দ্বিতীয় ধর্ম নাই।
১ম বন্ধু–বেশ মতলব। তা হলে কি আমাদের এ কল্পনা কাজে পরিণত করা যাবে?
২য় বন্ধু–আজই একটা মিস্ত্রী এবং একটা কর্মকারকে খবর দেব। প্রত্যেকে এক ঘণ্টা করে কাজ শিখিয়ে যাবে। দুবছর আমরা সব কাজ ভালোভাবে শিখতে পারব।
সেই দিনই জনৈক কর্মকার এবং মিস্ত্রীকে খবর দেওয়া হল। সাহেবের মহা প্রতিপত্তি-তার কথা ঠেলবার উপায় নাই। তার কাছে অবিচারও নেই। মিস্ত্রী ২০ টাকা এবং কর্মকার ১৫ টাকা বেতনে প্রত্যহ সন্ধ্যার পর একঘণ্টা কাজ শিখিয়ে যাবে–এই বন্দোবস্তে নিযুক্ত হল।
সেই দিন রাত্রি হইতেই দুই বন্ধু কাজ শুরু করিলেন। খোকার মাতা এই ব্যাপারকে একটি পরম কৌতুকরূপে গ্রহণ করিবেন, অথবা একটি সত্য বাস্তব ঘটনা বলিয়া গ্রহণ করিবেন, তাহা বুঝিলেন না। এমনটি তিনি কখনও শুনেন নাই, শুনিবেনও না। প্রথম এক মাস কাল এইভাবে চলিল। যখন বুঝিলেন, এই দুইটি লোক কৌতুক করিতেছেন না; তখন তাঁহার মতো সত্যই নিরতিশয় ঘৃণায় উত্তেজিত হইয়া উঠিল। এত মানুষের এত কাজ, তাহার একটিও জুটিল না। আর এই লোকটিই বা কে? যে নাকি বি-এ পাস করেছে। হয়তো ঘুষ দিয়ে পাস করে থাকবে। নইলে ইতর লোকের মতো মিস্ত্রীর বাটালিই বা ধরবে কেন? আর এই লোকটির এত প্রতাপই বা তাহার স্বামীর উপর কেন? তাহার স্বামী একটা বোকা গর্দভ ছাড়া আর কিছুই নহে। সে নারী হইয়া কী করিবে, এই অসহ্য অপমান সে কেমন করিয়া সহিবে? শেষকালে সে কর্মকারের স্ত্রী হবে? অপমানের অনুভূতিতে লাল হইয়া গেল। ইচ্ছা হইল সেই মুহূর্তেই স্বামীর গৃহ ত্যাগ করিয়া বাপের বাড়ি চলিয়া যায়। সেখানে তাহার কী নাই! তবে আর কেন, এই ভবঘুরে লোকটার সহিত ঘুরিয়া জীবন সূত্রটুকু হারাইয়া ফেলিবে, বাপের বাড়ির আনন্দ ত্যাগ করিয়া করিয়া কেন সে বিদেশে স্বামীর সহিত দুঃখ করিবে? একটি সামান্য লোকের যে মূল্য আছে, স্বামীর তাহা নাই। খোকার মুখের দিকে তাকাইয়া সে কাঁদিয়া ফেলিল। সে নাকি শেষকালে কর্মকারের পুত্র হইবে! এই সময় দেশ হইতে একটা লোক আসিয়া জামাতা বাবাজীর কীর্তি দেখিয়া গেল। দেশে যাইয়া রটনা করিয়া দিল, তোমাদের জামাই এক কর্মকারের চাকর হইয়াছে। মেয়েটির কষ্টের আর সীমা নাই।
.
চির বিদায়
১ম বন্ধু আজ ১৮ দিন জ্বরে ভুগিতেছেন। তাহার জীবনের আশা নাই। ডাক্তার বলিয়া গিয়াছেন, টাইফয়েড হইয়াছে–বিশেষ সাবধানে রাখিতে হইবে; নইলে অন্যকে আক্রমণ করিবে। টাইফয়েড জ্বর বিষাক্ত জ্বর-সতর্ক না হইলে সেবাকারিণীর প্রাণ সংশয় উপস্থিত হইতে পারে। পত্নী, স্বামীর অসুখে বিশেষ ব্যস্ত হন নাই–ডাক্তারের কথা শুনিয়া তিনি। আপন পুত্রের জীবনের মায়ায় স্বামীর নিকট হইতে আরও দূরে সরিয়া গেলেন। ২য় বন্ধু প্রাণপণে বন্ধুর সেবা করিতে লাগিলেন। সেদিন বিশেষ কোনো কাজে বাহিরে গিয়াছিলেন–জ্বরের বেগে প্রথম বন্ধু বড়ই অস্থির হইয়াছিলেন। ঝি বাহিরে গিয়াছে। খোকার মা ঘুমাইতেছিলেন।
এমন সময় দরজা ঠেলিয়া অতিথি আসিলেন–ইনি খোকার মামা। তিনি ১ম বন্ধুকে বিছানায় পড়িয়া থাকিতে দেখিলেন, ভালোমন্দ কিছুই বলিলেন না। সোজা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। পদশব্দে খোকার মাতা জাগিয়ে উঠিয়া দেখিলেন তার ভাই। অপরিসীম আনন্দে হাসি চাপিয়া রাখিয়া থোকার মাতা কহিলেন–হ্যাঁ, এসেছে।
খোকার মাতা আগ্রহ বলিলেন-তা হলে আর বিলম্ব কেন? যাবার যোগাড় করা যাক।
বাহিরে স্বামীর জ্বরের বেগ বাড়িল। ঝি তখন ফিরিয়া আসিয়াছিল, সে বিরক্ত হইয়া কহিল–তুমি মা বেশ লোক, খোকার বাবা জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে, আর তুমি বাপের। বাড়ি যাবার আয়োজন করছো!
রাগে গর গর করিয়া থোকার মা কহিলেন-কতদূর থেকে নৌকা এসেছে, এ নৌকা কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়?
।ঝিও চড়া সুরে, তোমার স্বামীকে দেখবে কে?
তাঁর বন্ধু রয়েছেন-তিনিই তো সব করছেন।
ঝি ভারি গলায় কহিল, এর মজা পরে টের পাবে মা-এখন বুঝবে না। ঝির কথায় আয়োজন বাধা হইল না।
শেষ বেলা।
২য় বন্ধু–তাড়াতাড়ি বাসায় প্রবেশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–তারা কোথায়?
তারা বাপের বাড়ি চলে গেছে; তার ভাই এসেছিল, তার সঙ্গে চলে গেছে।
এই সময় চলে গেল?
১ম বন্ধু–দুর্বলকণ্ঠে কহিলেন, বন্ধু, আর আনতে যাব না।
২য় বন্ধু–কঠিন কণ্ঠে কহিলেন, আচ্ছা।
বন্ধুর আরও ১০ দিনের সেবা-যত্নে ১ম বন্ধু অবশেষে সুস্থ হইলেন।
কাজ আবার রীতিমতো চলিতে লাগিল; কোনো বাধা হইল না।
.
নিকৃষ্ট মানুষ
আবার দুই বন্ধুর কথা আরম্ভ হইয়াছে, রাত্রে বিছানায় শুইয়া ২য় বন্ধু হকিলেন–
কতকগুলি লোক আছে তারা মিথ্যা কথা বলে। পাঁচ টাকা খরচ হলে বলে দশ টাকা। শত টাকা উপায় হলে বলে পাঁচশো টাকা উপায় হচ্ছে। এরা যেমন মিথ্যাবাদী, তেমনি নিন্দুক। এরা মানুষকে অতিশয় নিষ্ঠুর কথা বলে দুর্বলকে জব্দ করে, বড়লোক দেখলে তার সম্মুখে লুটিয়ে পড়ে। এরা তোষামোদে সিদ্ধহস্ত, মনে এক কথা, মুখে এক কথা, তর্ক করতে গিয়ে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এদের আল্লাহর দয়ার উপর কিছুমাত্র বিশ্বাস নেই।
পাপ ও হারামে এদের কোনো লজ্জা বা আপত্তি নেই। স্বার্থ দেখলে সামনে লাফিয়ে লাফিয়ে এগোয়, দুঃখ দেখলে আপন লোককেও ফেলে পালায়। এদের স্পর্শে যারা আসে, তাদের জীবনে সুখ থাকে না। এরা কোনো ধর্মকে বিশ্বাস করে না। নামাজ-রোজা যথেষ্ট করে। লোকে সাধু মনে করুক, এই ইচ্ছায় দরবেশদের পোশাক পরে। উত্তম বাক্যসমূহের প্রশংসা করে, কিন্তু নিজেদের জীবনকে উত্তম বাক অনুসারে নিয়ন্ত্রিত করে না। এরা সত্যকে লক্ষ্য করে কথা বলে না। সুতরাং যা মনে আসে, তাই বলে। পত্নী ও অধীনস্থদের উপর অসহনীয় অত্যাচার করে। সন্তানগণকে নিজের পাপ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করে; এদের বয়স যত বাড়তে থাকে, পাপ ও অন্ধতা ততই অত্যন্ত অহঙ্কারী, কোনো মহামানুষ বা সাধু প্রকৃতির লোকের কাছে নত হয় না। কেউ উত্তম উদ্দেশ্য কার্য করলেও তাতে নীচ অভিপ্রায় আরোপ করে। কোনো মহাজনকে এরা শ্রদ্ধা করে না। দেশ, সমাজ ও মানুষকে প্রেম করে না, না বুঝেই এরা নমস্কার করে; কর্তব্য, ন্যায় ও সত্যকে এরা মোটেই শ্রদ্ধা করে না।
এরা আল্লাহর বাণী পাঠ করে, আয়ত্ত করে না। এরা ক্ষমা করতে জানে না, এরা কাপুরুষ। বাইরে, মিত্র, ভিতরে শত্রু; এরা জগৎকে পরমস্থান মনে করে–এখানকার সাধনাকেই এরা সম্পূর্ণ মনে করে। ধর্ম কি, আল্লাহ কি, এসব বিষয় মোটেই পছন্দ করে না। দিন দিন গভীর অন্ধকারে পতিত হয়, আলোর সন্ধান জানে না, আলোর চেষ্টাও করে না। শয়তান এদের অন্তরে রাজত্ব করে।
.
ইতর লোক
২য় বন্ধু কহিলেন–চাষা, কামার, কুমোর, ধোপা, বাগদী, বেহারা আরও অনেকগুলি নিম্নজাতীয় ব্যবসায়ীকে হঠাৎ বিশ্বাস করো না–এদের উপর নির্ভর করো না। চাষা মানে, কৃষক তারা নয়-নীচ জাতীয় বা নিম্নস্তরের অশিক্ষিত লোককেই বুঝায়।
১ম বন্ধু–মনুষ্যকে যদি এইভাবে ঘৃণা করতে হয়, তা হলে প্রেমের অর্থ কি? এ তো বড় গুরুত্ব কথা।
২য় বন্ধু–না, একটুকুও নয়। মানব সমাজে ইতর নরাধম লোক থাকবেই-তাদেরকে প্রেম করতে নিষেধ করছি নে-ঘৃণা করতেও বলছি নে–ইতর নিম্নজাতীয় লোক হইতে সাবধান থাকবে। তাই বলছি, যদি এ তোমার অজানা থাকে তা হলে ইতর লোকের কোনো হীন ব্যবহার দেখে একেবারে বিদ্রোহী হয়ে উঠবে এবং চিরদিন তাদেরকে ঘৃণা করবে কখনও তাদের মঙ্গল করবে না–তাদের স্পর্শ করবে না। পশু জাতীয় ইতর লোক জগতে আছে, হয়তো যাকে চিরদিন উপকার করেছ, সেই তোমাকে আঘাত করবে। হয়তো বিনা কারণে কেউ তোমার সমূহ ক্ষতি করবে, তাদের মিথ্যা কথা ও ব্যবহারে তুমি বিলক্ষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব জেনেশুনেই তাদেরকে প্রেম করতে হবে। অন্তরে প্রেম পোষণ করে বাইরে অনেক সময় এইসব ইতর লোককে বেঁধে রাখতে হয়, নইলে গ্রামে বাস করা যায় না। ধর্মহীন মনুষ্য নানাভাবে তোমাকে বিপন্ন করে তুলতে চেষ্টা করে। একথা স্মরণ রেখ, এরা সব সময়েই ইতর নয়।
আভিজাত্য ও ভদ্রতার গর্বে মানুষ্যকে কথায় কথায় ইতর ছোটলোক বলাও খুব অন্যায় এবং মূর্খতা। তার শাস্তি খোদার কাছে হাতে হাতে পেতে হয়। অতএব খুব সাবধান অযথা গর্ব মনে পোষণ করো না, ইতর জাতিকে অস্পৃশ্য ও অধম বলে ত্যাগ করো না। হয়তো শীঘ্রই সে শুভদিন আসবে, সেদিন ইতর বলে কোনো বিশেষ শ্ৰেণী আর থাকবে না। মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্বের আলোক সবাই পাবে–মানুষ পাপ ও মিথ্যাকে ঘৃণা করতে শিখবে।
কাকে ইতর লোক বলি, কাকে দ্ৰ বলি? লোকদের ভিতর সত্যের শ্রদ্ধা চাই। মনুষ্যত্ব ন্যায়, ধর্ম, প্রেম ভদ্র সমাজের এই ভূষণ কোথায়! শুধু প্রতারণা, স্বার্থপরতা, মিথ্যা, জুয়েচুরি, হিংসা, অহঙ্কার এই সব মানব স্বভারের ভূষণ হয়ে পড়েছে। ধর্ম পালন করে, কিন্তু সে কেবল অন্তঃসার শূন্য বাইরের ক্রিয়া মাত্র। ধর্ম নাই, আছে আবৃত্তি, শুধু আবৃত্তি। কি দুঃখ? মানব-সমাজকে উদ্ধার করবার জন্যে প্রত্যেক ভদ্র কাজ আনুষঙ্গিক মাত্র। শুধু খাওয়া, পরা, স্বার্থপর, ধর্মাড়ম্বর, নিজের ছেলেমেয়ে, স্ত্রী স্বামীর মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখা আদর্শ ভদ্র পরিবারের ভাব নয়।
.
উপহার
২য় বন্ধু বলিলেন, আত্মীয় হোক, পরিবারের কেউ হোক বা বেগানা হোক সাধ্যে যতটা কুলায় উপহার স্বরূপ কিছু দিতে হবে। শুধু নিজে খাওয়া, নিজে পরা ঠিক নয়। পরিবারে মধ্যে যদি কেউ দরিদ্র থাকে তবে তাদের সামনে নিজের ছেলেমেয়েদেরকে উত্তম পোশাকে ভূষিত করে বের করো না–কারণ তারা চেয়ে দেখবে, তোমার ছেলেদের পোশাক, আর মনে মনে কষ্ট পাবে। যদি পার, সকল ছেলেপিলেকেই কিছু কিছু উপহার দিও, যাতে সবাই এক সঙ্গে আনন্দ করতে পারে। নিজের মাকে ভিখারিণী রেখে, নিজের পত্নীর গায়ে গহনার উপর গহনা দিও না। আর মাকে যদি কেউ দেয়, তাকে আশীর্বাদ করো, হিংসা করো না।
মাছ, মাংস উত্তম দ্রব্যসামগ্রী। একা একাই খেতে নেই, পরিবারের মধ্যে যাদের সঙ্গে কিছুদিন আগে, তোমার সঙ্গে গভীর যোগাযোগ ছিল–তাদেরকে কিছু কিছু দাও। আর যদি কেউ না দেয়, কিছু বলো না। কী দিয়েছে, কবে কী দিয়েছিলেন–কোনোদিন এক পয়সার মিসরী কিনে দেও নি, এইসব কথা কখনও মুখ দিয়ে প্রকাশ করো না এসব বড়ই অভদ্রতা; কারণ প্রেম জিনিসটি জবরদস্তিতে লাভ হয় না। জবরদস্তি প্রেম নয়, তা মেকি, তিক্ত। দরিদ্র আত্মীয়, বন্ধু বা স্বচ্ছল অবস্থায় আত্মীয়বন্ধুকে পুকুরের মাছ, গাছের কাঁঠাল, উত্তম দেওয়া মন্দ নয়। তবে, কথা কি, মনের অনিচ্ছায়, লজ্জার খাতির কিছু করো না। লোকে কী বলবে, লোকে কী ভাববে, এসব কথা, ভেবে কোনো কিছু করো না–লজ্জাবশত যা করা হয় তা সকলের পক্ষেই ক্ষতিজনক।
বুড়া হোক গুড়া হোক মনুষ্য মাত্রেই খাওয়া ও পরা, এ দুটি জিনিস বড় ভালবাসে। সুতরাং এ দুটি জিনিস দিয়ে যথাসম্ভব মানুষকে, পরম আত্মীয় জনকে সংবর্ধনা করতে হবে।
আত্মীয়দের মধ্যে যদি কোনো দরিদ্র নিঃসহায় বিধবা থাকে, তবে তার খবর নিতে হবে। তাকে ত্যাগ করো না। কাছে না রাখ, দূর হতে মাঝে মাঝেই তার খোঁজ নিও এবং যা কিছু সম্ভব তাই দিয়েই তার সাহায্য না নিয়ে চলবে; সাধনায় মানুষের দানকে অগ্রাহ্য করবে। পরের আশা করলেই জীবনে বহু প্রকার দুঃখ বাড়ে, একজনের অভাৰু, আর একজনের দ্বারা কখনও কুলায় না, শুধু বেদনা বেড়েই ওঠে। যে মানুষ শুধু ভয় করে, তার ভয় করার কিছুই নেই।
.
পুরাতন কুটুম্ব
২য় বন্ধু বলিলেন, বন্ধু কোনো লোক আছে, যারা নূতন আত্মীয় কাছে পুরাতন আত্মীয়ের কথা বলতে একেবারেই ভুলে যায়। আত্মীয়তা অনেক সময় প্রাণের টানে না হোক, কর্তব্যের খাতির করতে হয়, দেশসুদ্ধ লোককে কুটুম্ব বলে টানাটানি করা অবস্থায় কুলিয়ে ওঠে না, জানি; কিন্তু তবুও নূতনের গন্ধে পুরাতনকে ডেকে কথাটি পর্যন্ত জিজ্ঞাসা না করা ভদ্রলোকের কাজ নয়। যারা আজ নূতন, যাদের সঙ্গে ভারি মাখামাখি, এমন দিন আসবে, যখন পরিবারের কেউ তাদেরকে ডেকে জিজ্ঞাসা করবে না। যাদেরকে আজ পুরোনো ও বাজে বলে মনে হচ্ছে–এককালে তারা অতিশয় আপনার জন ছিল। পুরোনো দিনের সুখ দুঃখে সহানুভূতি জানিয়েছে, তাদের কথা মনে রাখতেই হবে, তারা যতই পুরোনো হোক। মানুষ্যমাত্রেই আত্মীয়, কিন্তু তবু প্রত্যেক পরিবারের একটা বংশ-তালিকা Genealogy রাখা ভালো-তাতে অনেক সময় ব্যবহারের ভুল-ত্রুটির সংশোধন হয়। যার সঙ্গে ভুলবশত নিতান্ত অপরিচিতের ন্যায় ব্যবহার করছি, কিছুকাল আগে তার দাদা আমার দাদার জন্যে প্রাণ দিয়েছে আজ তা একেবারেই ভুলে যাচ্ছি। নূতনের মাদকতায় পুরাতনকে একেবারে ভুলে যাওয়া কোনোমতে ঠিক নয়, তাতে মৃতদের অভিশাপ আমাদের মাথায় এসে পড়ে।
১ম বন্ধু–অবস্থা ভালো হলে মানুষ মানুষকে ভুলে যায়। আমি শুধু দেখেছি জগৎ স্বার্থে চলে। কেউ আত্মীয়ও নয়, বেগানাও নয়। আত্মীয় বলে কে কাকে জিজ্ঞাসা করে।
২য় বন্ধু তুমি যা বলছ তাই ঠিক। কিন্তু এরূপ হওয়া যে খুব দোষের, তারই আলোচনা আমি করছি। বড়লোক হলে ছোটদের কথা মনে থাকে না, বংশের গর্বিত ছেলেরা পুরাতন আত্মীয়দের দেখে চেনে না–এটি বড়ই খারাপ। বস্তুর স্বার্থের সন্ধান পশুতে সাজে, মানুষের মধ্যে প্রেমের বন্ধন শোভা পায়। যার যতটুকু ক্ষমতা, আপন আপন সাধ্যে যতটা কুলায়, মানুষের নিতে হবে। যতটুকু সম্ভব, সেইটুকু কর। একেবারে বলো না, আমি চিনি না, এখানে স্থান হবে না। যদি কোনো বড়লোক আত্মীয়ের প্রকৃতি এমন হবে, তবে তার সঙ্গে দরিদ্রের কোনো সম্বন্ধ না রাখাই ভালো। মনুষ্য যখনই স্বাধীন হয়, পরের উপর নির্ভর করে না, তখনই তার মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়, তার দুঃখ ঘুচে যায়। পরের আশা করা, সে নিতান্ত আত্মীয় হলেও পরের দিকে চেয়ে থাকা দুর্বল ও শক্তিহীনের লক্ষণ, তাতে লাভ যেটুকু হবে তার চেয়ে লোকসানই বেশি হয় আত্মীয়স্বজন মন্দ হলেও তাদের কুৎসা-গ্লানি করে বেড়ান ঠিক নয়।
.
সন্তান
২য় বন্ধু বলিলেন-বন্ধু ইতর প্রাণী পশুর মধ্যে দেখা যায়, সন্তানকে অতিশয় স্নেহ করে, একটু সেয়ানা হলে, তাকে নির্মম আঘাতে তাড়িয়ে দেওয়া হয়; তার সঙ্গে মাতা-পিতার কোনো সম্বন্ধ থাকে না। মনুষ্য সম্বন্ধে যে কথা সত্য নয়। সন্তান বুড়ো হলেও বাপ-মায়ের সঙ্গে গভীর যোগ থাকে।
১ম বন্ধু–কোনো কোনো পরিবারে তা থাকে না। সেই কথাই বলতে যাচ্ছি। সেয়ানা পুত্রকে, মাতা না হোক, কোনো কোনো হীন প্রকৃতির পিতা একেবারেই পর মনে করেন, তার সঙ্গে বিরোধ করেন। এক কথায় বিবাহ হয়ে গেলে তার সঙ্গে আর কোনো সম্বন্ধ রাখতে চান না। এটা ভদ্র পরিবারের লক্ষণ নয়। পিতা-পুত্রে যে একটা অচ্ছেদ্য গভীর প্রেমের বন্ধন থাকে তা কোনোকালেই ছিন্ন হবে না। চিরদিনই পিতা ও সন্তানদের মধ্যে সহানুভূতির বন্ধন থাকবেই। পুত্রের সঙ্গে ভাগ-বণ্টন, কলহ-বিরোধ এসব দেখতে বড় বিশ্রী দেখায়। পিতা পুত্রের বিরুদ্ধে-পুত্র পিতার বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করছেন, পিতা পুত্রকে অভিশাপ দিচ্ছেন; পুত্র প্রতিহিংসায় উত্তেজিত হয়ে আগেচরে পিতাকে গালি দিচ্ছেন, এসব বড় খারাপ। যাকে এতকাল মানুষ করেছে, সেয়ানা হলে তার স্পর্শ অসহ্য বোধ করা, তার সঙ্গে পাড়া-প্রতিবেশীর মতো ব্যবহার করা ভদ্রলোকের ক জ নয়।
১ম বন্ধু–কোনো কোনো পরিবারের দেখা যায় মেয়েদের আদর বেশি।
২য় বন্ধু–নিজের ছেলেমেয়েকে অধিক সোহাগ করা, জামাইকে প্রিয়তম ঠাকুর মনে করা ও অন্য যারা কাছে আছে তাহাদেরকে নিরন্তর আঘাত ভালো নয়। জামাই পরম প্রিয় বস্তু হলেও তার সঙ্গে জীবনের যোগ অতি অল্পই। সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে ছেলেই কাছে থাকে–ছেলের ছেলেরাই বংশের নাম রাখে। জামাই যদি সুযোগ্য হয়, ছেলেরা যদি অযোগ্য হয়, তবুও ছেলেদেরকে ত্যাগ করে, জামাতা ও কন্যার সঙ্গে মাখামাখি ভালো নয়। জামাই-কন্যাকে অশ্রদ্ধা করতে হবে তা বলছি নে, কারণ তারাও ধন। যা মানায়, যা দেখতে অশোভন নয়, তাই করা উচিত। পুত্রবধূদেরকে পরম মনে করে তাদের ছেলেমেয়েদেরকে অশ্রদ্ধা করে মেয়েকে অধিক আদর করা-মেয়ের ছেলেমেয়েদেরকে কলিজার টুকরো মনে করা ঠিক নয়। আর একটি কথা–সংসারে যার একটু শ্রীবৃদ্ধি হয়ে ওঠে, তাকে নিয়েই সবাই টানাটানি করে, তার প্রশংসাই করে তার ছেলেমেয়েকেই আদর করা হয়; যে অযোগ্য ও গরীব, তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করে না, তার ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে পাশ কাটিয়ে সকলে চলে যায়–এটা বড় অন্যায়।
পিতা-মাতার উচিত, যোগ্য-অযোগ্য সকলকে তারা ভালবাসেন-এক চোখে দেখেন; ঘরে-দুয়ার তুলে তাদের সংসার পেতে দেন।
ছেলেমেয়েরা সেয়ানা হলে তাদের অন্তরের ভাব অনুভব করতে চেষ্টা করা উচিত। ভৎর্সনাই পিতামাতার কর্তব্য পালনের একমাত্র পথ নয়। এর ফল অনেক সময় বড় বিস্ময় হয়, তারা সুখ-দুঃখে সহানুভূতি জানাতে হবে, নিবিড় স্নেহে তাঁকে বেঁধে রাখতে হবে, তার আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যোগ রাখতে হবে। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে ছেলেমেয়েদের মনের বিলক্ষণ পরিবর্তন হয়, সুতরাং চিরদিনই তাদেরকে অবোধ খোকাখুকি মনে করা মূর্খ পিতামাতার কাজ।
ছেলেমেয়েদের জীবনে এমন একটা সময় আসে যখন শুধু খাওয়া-পরায় তাদের তৃপ্তি হয় না। জীবনে আর একটা সুতীব্র অভাব অনুভব করে। বুড়ো হচ্ছে বলে প্রবীণের গর্বে ছেলেমেয়েদের অভাবের কথা ভুলে গেলে চলবে না, যৌবনকালে ছেলেমেয়েরা জীবনে যে বসন্ত উৎসব অনুভব করে বয়সের সেই মত্ততাকে জবরদস্তি করে যে ভুলে যেতে চায়, সে। পাগল। তাদের সে আনন্দ-অনুভূতির প্রতিবন্ধক হয়ো না, হতে গেলে শক্রর কাজ করা হবে। ছেলেমেয়েরা যাতে দাম্পত্য জীবনের আনন্দ উপভোগ করতে পারে, সে সম্বন্ধে বিশেষ সতর্ক এবং সজাগ থেকো।
যুবতী বিধবা ও সেয়ানা মেয়েকে কখনও ঘরে রেখ না, তাকে জবরদস্তি করে বিয়ে দেবে। কেউ নিন্দা করলেও গ্রাহ্য করো না।
.
বিদায়ের প্রস্তাব
ইহার পর দুই বৎসর কাটিয়ে গিয়াছে, ধীরেন পরীক্ষা দিয়া বাড়ি আসিয়াছে, ২য় বন্ধু নিজে উদ্যোগ করিয়া ধীরেনের বিবাহ ঠিক করিলেন। ধীরেনকে কন্যা দেখাইলেন, ধীরেন কন্যা পছন্দ করিল। মাতা বিবাহে সম্মতি দিলেন। অবশেষে, এক শুভ দিনে বিবাহ কার্য শেষ হইয়া গেল।
কর্তব্যের ভার অনেকটা কমিয়া গিয়াছে, ধীরেনকে জমিদারির সমস্ত কার্য তন্ন তন্ন করিয়া বুঝাইতে লাগিলেন। ধীরেন আপত্তি জানাইল, ২য় বন্ধু ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন–এভাবেই এদেশে হিন্দু মুসলমান জমিদারের সর্বনাশ হয়। ধীরেন সে কথা বুঝিল এবং রীতিমত জমিদারী কার্যে মন দিল। উপযুক্ত শিক্ষকের উপযুক্ত ছাত্র, প্রজারা ধীরেন বাবুর ব্যবহারে সন্তুষ্ট হইল। অবেশেষে ধীরেন বাবুর উপর সমস্ত কার্যভার দিয়ে ২য় বন্ধু তাহার কুশলতা পরীক্ষা করিতে লাগিলেন।
একদিন ১ম বন্ধুকে কহিলেন-নির্মলের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তা রক্ষা করতে পেরেছি–এখন এখান থেকে যেতে হবে। এখানকার কাজ শেষ হয়েছে–এইবার জীবনের ক্ষেত্র বৃহত্তর হবে। কাজ করবার সুবিধাও হবে।
সেদিনই ধীরেনের মাতার সহিত তিনি দেখা করিলেন। ধীরেনের মাতা কহিলেন-কেন তুমি দেশে যাবে? সেখানকার মানুষ তোমার আদর জানে না, সে স্থান তোমার আপন দেশ নয়। যেখানকার লোক তোমাকে সম্মান করে, ভালবাসে, সেইটাই তোমার আপন দেশ; এইখানেই থাক।
২য় বন্ধু কহিলেন–তুমি যা বলেছ, তা ঠিক। আমার মাতার নিঃসঙ্গ জীবনকে সফল করে তুলতে চাই। মুখে কিছু না প্রকাশ করলেও তিনি আমাকে পেলে আনন্দিত হন। বুড়ো মাতার শেষ জীবনকে তিক্ত ও নিঃসঙ্গ করে তোলা কোনো সন্তানেরই উচিত নয়। তিনি মারা গেলে আমি যতদিন বাঁচি, তার অস্তিত্বকে আমি সযত্নে রক্ষা করব।–এই আমার খেয়াল।
ধীরেনের মাতা আর কোনো কথা কহিলেন না, লোহার বাক্স খুলিয়া এক হাজার টাকার একটি তোড়া বাহির করিয়া ভ্রাতার সম্মুখে রাখিয়া কহিলেন-এ তোমার ভগ্নির উপহার।
২য় বন্ধু কহিলেন–না, আমার কাছে টাকা আছে। এ টাকার দরকার নেই। ধীরেনের মাতা বিস্মিত হইয়া কহিলেন–সে কি! তুমি টাকা জমা কর নাই?
২য় বন্ধু কহিলেন হ্যাঁ, টাকা কিছু কিছু রাখা আমি মনুষ্যত্ব ও ধার্মিকতার কার্য মনে করি। রিক্তহস্ত হলে তোমার দানের লোভ আমার করতে হতো, না পেলে দুঃখ ও কষ্ট পেতাম। হয়ত তোমায় ঘৃণা করতাম, আমার মনুষ্যত্ব খর্ব হতো।
টাকা লইবার জন্যে ধীরেনের মাতা পীড়াপীড়ি করিলেন। ২য় বন্ধু কিছুতেই তাহা লইলেন না।
ধীরেনের মাতা অপ্রস্তুত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–তা হলে কবে যাচ্ছ?
হঠাৎ যাবে না–তোমার আমার বিদায় সম্বন্ধে কিছু অভ্যস্ত হয়ে নাও, তার পর। একদিন হঠাৎ করে যেয়ো, আর বোনের কথা যদি মনে থাকে তবে তাকেও মনে করো।
এর দুইমাস পরে একদিন শুধু ধীরেনের মাতাকে বলে দুই বন্ধু দেশে যাত্রা করলেন।
কিছুদিন বাড়িতে বিশ্রাম করে, নদীর ধারে দু’খানা ছোট ঘরে নিয়ে দুই বন্ধু কাজ আরম্ভ করে দিলেন। এক ঘরে কাঠের জিনিসের কারবার আর এক ঘরে লৌহের যন্ত্রাদির কারবার সমানভাবে চলতে লগল।
কাজের জন্যে তাদের কথা বন্ধ হল না কথা বলতেই লাগলেন। কারখানার ভিতরে গোল টেবিলের উপর ইংরেজি-বাংলা খবরের কাগজ থাকত।
.
কয়েকটি কথা
২য় বন্ধু কহিলেন–বন্ধু যেখানে তাড়াতাড়ি সেখানেই বিপদ। যে কাজ করতে বাঁধ বাঁধ লাগে, যে কথা বলতে মনের সম্পূর্ণ সমর্থন নেই, সে কাজ করতে, সে কথা বলতে বিলম্ব করো। যতই তাড়াতাড়ি করবে, ততই পিছিয়ে পড়বে-হঠাৎ রাতারাতি বিয়ে, হঠাৎ দুটি মানুষের অচ্ছেদ্য বন্ধন, হঠাৎ কোনো কাজ করে ফেলা হঠাৎ উগ্র হয়ে ওঠা, এসব ভালো নয়। সৃষ্টির কোনো কাজে অস্বাভাবিক, তাড়াতাড়ি নেই। সৃষ্টি এবং বিনাশ, সবই ধীরে ধীরে হয়–যা ধীরে ধীরে হয় তাই স্বাভাবিক। যারা তাড়াতাড়ি করে বেশি অগ্রসর হতে চায় তারই তত পিছিয়ে পড়ে। ডবল প্রমোশান নিলে জীবনে সাধারণত আর লেখাপড়া হয় না, একটা অপ্রীতিকর কথা বলবার লোভ সংবরণ করতে না পারায় সমস্ত কাজই পণ্ড হয়। যে কথা কাল বললে চলে, সে কথা বলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ো না।
সংসারে যারা জীবনকে সার্থক করতে চায়, জীবনকে সফল করতে বাসনা করে, তারা জীবন সত্যময় স্রষ্টার উপর নির্ভর করুক। স্বাধীন, সত্যপরায়ণ মানুষের এ ছাড়া গতি নেই। কাপুরুষেরা খোদা প্রতিজ্ঞার উপর আস্থা স্থাপন করে না, পদে পদে তারা ভীরু কাপুরুষ, পদে পদে তারা বিড়ম্বিত হয়, লজ্জিত ও লাঞ্ছিত হয়।
কখনও বেশি কথা বলো না, যারা অনর্থক বেশি কথা বলে তারাই মূর্খ।তাদের কথার মূল্য খুব কম। বাক্যেই মনুষ্য মূর্খ এবং জ্ঞানী। যে জিহ্বাকে সংযত করতে পেরেছে, তার খোদা-প্রাপ্তির সাধনা অর্ধেক সিদ্ধ হয়েছে। সত্যকে লক্ষ্য রেখে যারা কথা বলে। না-সেদিক দিয়ে কথা বললে তাদের সুবিধা হয় তাদের সঙ্গে কখনও কথা বলো না। বন্ধু আঘাত পেয়ে প্রতিঘাত করো না। বরং প্রেম করো–এই-ই খোদাই ভাব। নিষ্ঠুরতার পরিবর্তে উত্তম ব্যবহার কর–কারণ, এই-ই আল্লাহর ভাব।
বন্ধু, নিতান্ত আত্মীয়-বন্ধু, পত্নী, মাতা যদি তাহারা দরিদ্র হন, তবে তাদের কাকেও নিজের Financial অবস্থার কথা জানতে দিও না। বাজে মিথ্যা আড়ম্বর। অযথা দীনতা প্রকাশ করার কোনো দরকার নেই।
যার অন্তরে চিন্তা এবং প্রজ্ঞা নেই-বাইরের কোনো শিক্ষা, জ্ঞান বা উপদেশ তাকে রক্ষা করতে পারে না। সে বিনষ্ট হবেই। পুস্তকের প্রথমে যে শ্লোকটি লেখা রয়েছে, তার মানেই এই।
জীবনে কখনো কোনো বিষয়ে কোনো সময় নিরাশ হয়ো না–লেগে থাক-একটা না একটা হয়ে যাবেই। বন্ধু সুদখোরের বাড়িতে এবং খেতে পার; কিন্তু ঘুষখোরের বাড়িতে কখনও খেয়ো না। এরা জগতের বিশ্বাসঘাতক, অপকৃষ্ট লোক। এদের ধর্ম এবং উপাসনা বৃথা।
বন্ধু সর্বত্রই আল্লাহর বাণী প্রচার কর–মনুষ্যকে পশু জীবন হতে ইদ্ধার কর–শুধু খেয়ে বেঁচে থাকা মনুষ্য জীবন নয়, পশু জীবন। ”যে নিকটে আছে, সে হয়তো বহু দূরে আছে; যার সঙ্গে পরিচয় নেই–সে হয়তো তোমার অতি নিকটে আছে।”
“বন্ধু Slave এবং tyrant একই জাতীয় জীব। যখন ক্ষমতা নাই–তখন নিরীহ, নির্জীব ভালোমানুষটি পদধূলি নিতে কুণ্ঠিত নয়, আভূমি নত হয়ে সালাম করতে সঙ্কোচ নেই। কিন্তু যখনই ক্ষমতা লাভ হয়েছে, তখন এরা মনুষ্যকে দ্বিপ্রহরে গলা টিপে মারে। আল্লাহ্ পাক, tyrant-দেরকে চূর্ণ করুক। এরা জগতের অভিশাপ।
কতকগুলি লোক আছে, তাদের খুব প্রতিপত্তি, কিন্তু মনুষ্যত্বের মাপকাঠিতে তারা খুব নিম্নস্তরের লোক–তা যত বড় লোকই তারা হোক না কেন।
বাল্যকালে যাদের ভালবাসা পেয়েছে, যারা আদর করেছে, স্নেহ করেছে, চুম্বন করেছে, তারা যত নিম্নস্তরের লোকই হোক না, বড় হয়ে তাদের কথা ভুলে যেয়ো না। বিপদকালে বা দুঃখের সময় যারা কোনো রকমে সাহায্য করেছে, তাদের দেখে গর্ব করো না। দুঃসময়ে যারা অন্ন দিয়েছে সুসময়ে তাদের কথা ভুলে যাওয়াও ঠিক নয়।
মনিবের কোনো জিনিস শেষ হলে বাকি পয়সা হিসাব করে জিজ্ঞাসা করবার আগে ফেরৎ দেওয়া চাই। দরিদ্র যা পাবে, তা যত শীঘ্র সম্ভব দিয়ে দিও। দরিদ্রের ঋণ পরিশোধ
করে নামাজ পড়তে যেয়ো না।”অন্তরের সাড়া না পেলে কখনও কথা বলো না।” যারা অবৈধ অন্ন ভোজন করে, তাদের বাড়ির নিমন্ত্রণ গ্রহণ করো না। পারতপক্ষে তাদের বাড়ি যেয়ো না। তাদের কাছ থেকে কোনো আর্থিক সাহায্য নিও না–তাদের লোভে পড়ে কোনো বিবাহ সম্বন্ধ করো না। কি আপন, কি পর কাখনও কাউকে–”জাত তুলে কথা বলো না, তাদের খোটা দিও না–কাউকে দূর হয়ে যাও’ এ কথা বলো না। এরূপ বলা মহাপাপ; বরং অন্য শাস্তির ব্যবস্থা করো।
.
স্বামী ও ছেলেমেয়ে
২য় বন্ধু বলিলেন, বন্ধু, নারীর ছেলেমেয়ে হলে তারা অনেক সময় জগৎকে পর্যন্ত ভুলে যায়–তারা ছেলেমেয়েতে এত মত্ত থাকে যে অনেক সময় স্বামীর সুখ-সুবিধা ও দাবির কথা তাদের মনে থাকে না। এ ভারি গুরুতর কথা। একদিকে স্বামী আর একদিকে সন্তান। সন্তান নারীর প্রিয় বস্তু। স্বামীকে ত্যাগ করা, তার সুখ-দুঃখের কোনো সংবাদ না রাখা সতী। নারীর কাজ নয়।
১ম বন্ধু–তাই তো।
২য় বন্ধু–কোনো কোনো সময় স্বামী এবং পত্নী উভয়ের চিত্তে প্রেম প্রচ্ছন্নভাবে থাকে–বাইরে তার পরস্পরের প্রতি অতিশয় রূঢ় ব্যবহার করেন। এমন কি আঘাত করতে ত্রুটি করেন না–যার প্রেম বাইরে তার প্রকাশ চাই। আর প্রকাশ যদি নাই থাকে, তবে অন্তত বিপরীতাচরণ হওয়া ঠিক নয়। বলতে কি, মানুষ চিরকালই মায়ের কোলে শিশুর মতো, সে চিরদিনই সোহাগ, মিষ্ট ব্যবহার, আদর-যত্ন, খাবার জন্য পীড়াপীড়ি এ সব চায়। সে যত বুড়ো এবং পণ্ডিত হোক না–এটা মানুষের দুর্বলতা। নারী শুধু পত্নী নয়-জননীর স্নেহে তাকে, কি সন্তান কি স্বামী সকলকে প্রেম করতে হবে যার সহবাসে সন্তান লাভ হয়েছ; যে-নারীর সন্তানের জন্যে কত দুঃখ, পরিশ্রম ও উদ্বেগ সহ্য করে-তার অনাদর করা, ভুলে যাওয়া, কোনোমতে মনুষ্যত্ব নয়। এ নীচ প্রকৃতির স্ত্রীলোকের কাজ।
আরেক কথাও বলে রাখছি–নারীর সন্তানকে অবহেলা করে কেউ যেন কোনো নারীকে ভালবাসতে না চায়। সেটা নিছক বাতুলের কাজ। নারী অগ্নিতে প্রবেশ করে, তবু সন্তানকে ত্যাগ করবে না। সুতরাং তাকে সত্যভাবে পেতে হলে, তার সন্তানকে গভীর প্রেম করতে হবে। বাইরে সে ধরা দিলেও, অন্তরে সে কিছুতেই ধরা দেবে না। শুধু সন্তান বলে নয়, নারীর যা কিছু প্রিয় বস্তু আছে তাকে ভালবাস, তা হলেই নারীকে পাবে, নইলে নয়।
নারী, অন্ধের মতো আপন আপন সন্তানকে ভালো যেন না বাসে, এর ফল বড়ই খারাপ। এর ফলে সন্তান উদ্ধত, বেয়াদব এবং কুস্বভাবের হয়। সৎ উদ্দেশ্যে যারা সন্তানকে ভর্ৎসনা করে, তাদের উপর কেই যেন কখনও অসন্তুষ্ট না হয়–বরং তাদের কাছে যেন কৃতজ্ঞ রয়। মূর্খের মতো সোহাগ করাই প্রেমের পরিচয নয়। প্রবীণ গুরু এবং পূজনীয়। স্বামীর শাসন-যত্নের আওতায় সন্তানদেরকে রেখে দেওয়া এবং তাদের উপদেশের উপর নির্ভর করা, বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতী নারীর কাজ।
.
বাধ্যতা ও শাসন-শৃঙ্খলা
পরিবারে অবাধ্যতা গুরুতর অপরাধ। পরিবারে যে কেউ অবাধ্য হবে, তার জন্যে কঠিন শাস্তি হওয়া আবশ্যক। ছোটর বড়র প্রতি অসম্মান, তার আজ্ঞার বা কথার প্রতিবাদ কোনোমতে বাঞ্ছনীয় নয়। শাসন-শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে হলে বড়রও বিচক্ষণতা, ধীরতা, বাক-সংযম এবং গাম্ভীর্যের প্রয়োজন। যে পরিবারে শাসন-শৃঙ্খলা নাই, একজন আর একজনকে সম্মান করে না, একজন আর একজনের কথা শোনে না, সে পরিবার অতি নিকৃষ্ট। কর্তাকত্রীর চরিত্রবলের অভাবেই পরিবারে ছোটরা অবাধ্য, অসভ্য ও বিদ্রোহী হয়। ছোটকে পাগলের মতো কোনো হুকুম দিও না-বা সম্ভব নয়, এমন কোনো আজ্ঞা দিও না। প্রকাশ্যে একগজন আর একজনের কাজের সমালোচনা করো না–পরিবারের কেউ যদি কোনো অন্যায় করে ফেলে, প্রকাশ্যে তার প্রতিবাদ করো না-তার কাজের সমালোচনা করো না।
পাগলের মতো অনবরত প্রলাপ বকা, চিৎকার করা, নিষ্ঠুরের ন্যায় অধীনস্থদিগকে
আঘাত করলে কর্তার সম্মান থাকে না। যে পরিবারে কর্তার প্রতি অধীনস্থদের কোনো শ্রদ্ধা থাকে না, সে পরিবারের কোনো মঙ্গল সম্ভব নয়। পরস্পরের তর্ক, বিবাদ, কথা কাটাকাটি, এসব মোটেই ভালো নয়। অনেক সময় অনেক অন্যায় ছোটদের নীরবে সইতে হবে-কথায় কথায় প্রতিবাদ করা, তর্কবাগীশ হওয়া ঠিক নয়। পাস্পরের মত নিয়ে, সহিষ্ণু সমালোচকের সাহায্য নিয়ে কাজ করা ভালো।
পরিবারে কেউ যদি ভদ্রভাবে কোনো কথার ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ করে, তা শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠো না–যেহেতু যারা স্তাবক এবং অন্যের মতো সমস্ত কথাই সমর্থন। করে-তাদের মূল্য খুব কম। বাহাদুরির জন্যে কোনো প্রতিবাদ করা কোনোমতে ভালো। নয়। বয়োজ্যেষ্ঠদের সকল প্রকার সুবিধার ব্যবস্থা ছোটদের করতে হবে এতে যদি ছোটদের কষ্ট হয় তাতে কষ্ট বোধ না করাই উচিত। ত্যাগ ও সেবাই মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এ-কথা পরিবারের লোকদেরও মনে রাখা উচিত।
ছোটদিগকে নিষ্ঠুর শাসনে লজ্জিত ও অপ্রস্তুত না করে তাদের মনুষ্যত্ব ও সুবুদ্ধির উপর নির্ভর কর। নিষ্ঠুর সহানুভূতি শূন্য সামান্য মানুষের ভিতর যে খোদাই ভাব আছে, তার ফুরণ হয় না। মানুষের সুবুদ্ধি ও মনুষ্যত্বের উপর নির্ভর করতে যেয়ে যদি প্রতারিত হতে হয়, তাতে দুঃখিত হয়ো না।
যাতে কষ্ট হয় তাতে কষ্ট বোধ না করাই উচিত। ত্যাগ ও সেবাই মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এ-কথা পরিবারের লোকদেরও মনে রাখা উচিত।
অসহিষ্ণু হয়ে কথা বলা কোনোমতে ভালো নয়। কথায় অধীর হওয়া, বেশি বলা এসবও ঠিক নয়। বলবার জন্যে গলা চুলকান, বাহাদুরির জন্যে কথা বলা, ক্রোধ ও গর্বিতভাবে কথা বলা, ভদ্রলোকের কাজ নয়। |||||||
||| যে বাস্তবিকই শয়তান, তাকে শয়তান না বলে বল-এ কাজটি বড় অন্যায় হয়েছে। হঠাৎ রূঢ় কথা বলা, বাক্যের সংযম না করতে পারা বড় দোষের কথা। সংযত হয়ে কথা বলো, না বলতে পারলে এ জগতে কোনো কাজ হয় না। নিতান্ত যখন কোনো উপায় নাই, তখনই রূঢ় হও।
তখনই রূঢ় ব্যবহার বা কথা বলতে পার”আমি কি তোমার খাই? তোমার দ্বারে হাত পাততে যাব?–আমি কারো ধার ধারিনে”-এই সমস্ত কথা বলো না, যেহেতু মানুষকে, সে নিজের জীবনের কাছে, মনুষ্যত্বের কাছে তার নিজের অপরাধের জন্যে লজ্জিত হয়। মানুষ নিজের বিচার নিজে করবে–কেউ তাকে ধরতে পারুক, আর না পারুক।
প্রত্যেক বাক্যে, প্রত্যেক লেখায় কখনও কঠিন, প্রাণে আঘাত লাগে এমন কথা বলতে নেই–এটা শয়তানী ভাব, শয়তান মানুষের শিরায় ঘুমিয়ে রয়েছে, সুযোগ পেলেই প্রবল উগ্রতায় সে মানুষকে মন্দ পথে চালিত করে।
বাক্যে মধুর হও-শুধু বাক্যে নয়, আত্মায়ও মধুর হও। যেহেতু প্রাণহীন মিষ্ট বাক্য দুরাচারদের ভাব মানুষের কুশল জিজ্ঞাসা, তাদের সুখ-দুঃখের কথা শোন, কথায় আশা, বিশ্বাস ও সান্ত্বনার কথা বলে। কেবল স্বার্থের খাতিরেই কথা বলো না। কেবল পয়সার গন্ধেই মানুষের সঙ্গে বাক্যালাপ করো না।
অতিশয় প্রগলভতা, মিথ্যা প্রেমের অভিনয়–যাকে সামনে পাই, তার সঙ্গে মাখামাখি, যে সামনে নাই তার নিন্দায় রসনা কলঙ্কিত করা–সব নারী পুরুষ সকলের পক্ষেই লজ্জজনক।
মিথ্যা ওয়াদা করা, ওয়াদা খেলাপ করা, এ বেলায় এক কথা ও বেলায় আর এক কথা বলা বড়ই নীচতা।
পরনিন্দা জিনিসটা অতিশয় ঘৃণিত। সময়ে অসময়ে সত্যকে লক্ষ্য রেখে কোনো কোনো মানুষ সম্বন্ধে কৃচিৎ ২/১টা সমালোচনা করা যেতে পারে, কিন্তু পরের সমালোচনা না করে নিজের সমালোচনা করাই ভালো যে যেমন আছে তা সবাই জানে-অনবরত বিশ্বশুদ্ধ মানুষের নিন্দা করা অভদ্র লোকেরই শোভা পায়।
পরের নিন্দা করে উপস্থিত লোকের সঙ্গে ভাব করা হীন ব্যক্তিদের কাজ। এই বন্ধুত্বের কোনো মূল্য নাই। স্বার্থের খাতির তোষামোদ করা, বড় লোক দেখলেই তার সঙ্গে নানা কথায় ভাল লাগান, দুর্বল-দুঃখিত শক্তিহনের প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ বাক্য প্রয়োগ করা ঠিক নয়।
যে ঠিকভাবে বাক্যালাপ করতে শিখেছে, তার ষোলআনা মনুষ্যত্ব লাভ হয়েছে।
.
ব্যথিত মনুষ্য-চিত্র
২য় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু, জগতের মানুষ বড় দুঃখী। বাক্যে সহানুভূতি দিয়ে মানুষের জীবনকে যতটা নরম, মধুর করে তুলতে পার, তার চেষ্টা করো। কি নারী, কি পুরুষ-কি দরিদ্র, কি ধনী সবাই পরস্পরকে সুখ দাও, আনন্দ দাও-দেখা হলেই হাসিমুখে আদর করে বসতে বল, সুখ-দুঃখের কথা জিজ্ঞাসা কর। কখনও উপহাস করো না, গম্ভীর হয়ে থেকো না এবং রূঢ় কথা বলো না।
বন্ধু, আল্লাহর এবাদত বহুভাবে করতে হবে। মনুষ্যকে, ছোটকে-বড়কে, দুষ্টকে সৎকে অন্তরের সঙ্গে প্রেম করতে হবে। একজনকে প্রেম করতে যেয়ে আর একজনের ক্ষতি করার নাম কিন্তু প্রেম নয়।
পাড়া-প্রতিবেশী, গ্রামের দরিদ্র ভিখারিনীকে অবস্থার গৌরবে দূর দূর করো না। বাড়ির চারিদিকে প্রাচীর ঘেরা হলেও, বাড়ির ভিতর মনুষ্য প্রবেশ করবার পথ রেখে দিও, স্ত্রীলোকদেরও বিপদ দেখে সাহায্য করতে নেই-এ হাদিস এ যুগে খাটবে না। পথ দিয়ে যে চলে যাচ্ছে-তাকে ডেকে কুশল জিজ্ঞাসা কর। পিপাসিত মানুষকে ডেকে পানি দাও। দরিদ্রের সন্তানকে অন্ন দাও, তাতে অপমানে কিছু নেই।
বন্ধু, জীবন এবং জগৎ অতিশয় তিক্ত, নীরস মরুময়। একে ক্রমশ যতখানি রসাল করে তোলা যায়, ততই ভালো। অন্তরে শঠতা, বাইরে প্রেমের অভিনয়, উহা শয়তানদেরই কাজ। এরূপ কৃত্রিম অভিনয় নারী-পুরুষ কেউ না করুক।
সময় নষ্ট হবে বলে, কিংবা স্বার্থ নাই বলে, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ত্রুটি করো না–সময় কিছু নষ্ট করো। প্রতি মুহূর্তেই কাজের জন্য ব্যয় করবার প্রয়োজনই নাই। দিবারাত্র ভিতর বাড়িতে বসে থাকা ঠিক নয়। বাইরে বৈঠকখানায় এসে বসো এবং সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করো।
বাড়ির মধ্যে যার যার মতো সেই সেই হয়ে থাকা বড়ই খারাপ। একে অন্যকে প্রেম কর-এক জনের ব্যথা-বেদনায় আর একজন আন্তরিক সহানুভূতি জানাও। দরিদ্রকে লোভ দেখিয়ে খাঁটিয়ে নিও না; এরূপ করা অনেক মানুষের স্বভাব। দরিদ্রের মধ্যে অনেক দোষ-ত্রুটি আছে, তা মনে করে দরিদ্রকে বা মানব সাধারণকে ঘৃণা করো না, তাদের সঙ্গ পরিহার করে চলো না।
গ্রামের মধ্যে দুঃখী মানুষকে, নির্যাতিত পীড়িতকে দশজনে মিলে সাহায্য কর। একজনের পক্ষে সাহায্য করা কঠিন, দশজনে মিলে এরূপ করলে কারো কোনো কষ্ট হয় না–অথচ পতিত মানুষের পরম মঙ্গল হয়–এরই নাম এবাদত। প্রেমহীন, নিষ্ঠুর হৃদয়, নিন্দুক, সঙ্কীর্ণ-চিত্ত মানুষের এবাদতের কোনো মূল্য নাই।
.
গরু-ছাগল
২য় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু, এমন গৃহ নেই যেখানে কিছু না কিছু গৃহপালিত পশু নেই। ঘরে খড়, খৈল দিয়ে গরু পোষা ভালো, কিন্তু দুগ্ধের লোভে গরু তাড়িয়ে দিয়ে পরের শস্য নষ্ট করা মহাপাপ। গরু-ছাগল-ঘোড়া দিয়ে দরিদ্রের উপর যে অত্যাচার করে–তার উপাসনার কোনো সার্থকতা নাই।
১ম বন্ধু–গরু, ছাগল পোষা দুনিয়াসুদ্ধ লোকের অভ্যাস।
২য় বন্ধু–অনেক দরিদ্র বিধবা ছাগল পোষে, পরের বিলক্ষণ ক্ষতি হলে তা না করাই ভাল। পরের ক্ষতি করে কোনো কাজ না করাই ভালো। দরিদ্রকে ক্ষমা করা যায় কিন্তু যারা সখ করে বা অবস্থার গর্বে গরু-বাছুর, ছাগল-ঘোড়া দিয়ে মানুষের বিরক্তি উৎপাদন করে, তারা নিশ্চয়ই দুরাচার প্রকৃতির লোক।
১ম বন্ধু–আমি নিজের কানে শুনেছি, কতকগুলি লোক আছে তারা বলে–আমার দাদা একজন মহাসম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন, তাঁর ঘোড়া সারামাঠে খেয়ে বেড়াত, কারো ক্ষমতা ছিল না যে প্রতিবাদ করে।
২য় বন্ধু–সে যে একজন মহা শয়তান ছিল, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
১ম বন্ধু–অত্যাচারীকে কেউ ঘৃণা করে না; বরং লোকে তারই জয়গান করে।
২য় বন্ধু–তার মানে লোকে কোরান আবৃত্তি করে–প্রকৃত পাঠ করে না। মানুষ নামাজ আবৃত্তি করে প্রকৃত পাঠ করে না। আল্লাহর বাণী আবৃত্তি করে, পালন করে না। যারা এরূপ করে তারা কখনও ধার্মিক নয়।
১ম বন্ধু–অনেক মানুষকে অযথা শোক করতে শুনেছি। হায়! আমার কপাল ছোট, নইলে আমার গরু-ঘোড়া কি খোয়াড়ে দিতে সাহস পায়?
২য় বন্ধু–জগতের কাজ-কাম দেখলে এখানে আর বাঁচতে ইচ্ছা হয় না–মনে হয় শয়তানই জগতের রাজা। অন্যায়, অসত্য ও অত্যাচারই জগতের শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে, এ-জগতে ন্যায় সত্য এবং দরিদ্রের আর্তনাদের কোনো মূল্য নেই।
১ম বন্ধু–বন্ধু, এ নিরাশার কথা কি তোমার মুখে শোভা পায়?
২য় বন্ধু–না, জাতি যতদিন না ন্যায় ও সত্যকে সম্মান করতে শিখবে, ততদিন এদের সমস্ত ধর্ম-কর্ম স্বজাতি প্রেমেরই অভাব। কোনোরকমে কোনোদিক দিয়ে এরা জয়লাভ করতে পারবে না। এসলাম ঢাল তলোয়ার। ইসলামের অর্থ–নয়নে অশ্রু, হৃদয়ে প্রেম-নিছক হক্কের উপাসনা কার্যে চিন্তায়, ব্যবহারে সত্য রক্ষা, সর্ববিধ অন্যায় বর্জন। ইসলাম শুধু আবৃত্তির ধর্ম নয়। কি কথায় কি বললাম।
.
স্বদেশ ও বিদেশ
২য় বন্ধু কহিলেন–যদি স্বদেশে মর্যাদা না হয়, মানুষ বিনা কারণে শক্র হয়–অথবা আর্থিক নানা প্রকার অসুবিধা হয়, তবে স্বদেশ ত্যাগ করে বিদেশে বা যেখানে সুবিধা হয়; সেখানে চলে যাওয়াই ভালো। বৃথা স্বদেশের মায়ায় জীবনকে বিতাড়িত করে দেওয়া মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। স্বদেশের মায়ায় জীবন জোড়া দুঃখ ভোগ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
১ম বন্ধু–দেশের মায়া ত্যাগ করা কি কঠিন নয়?
২য় বন্ধুদেশের মায়ায় মানব জীবনের দুর্বলতা বটে। এ দুর্বলতা কিছু নয়। যে প্রেম করে, সে বিদেশী ও অপরিচিত হলেও আত্মীয়, আর যে প্রেম করে না–সে স্বদেশী হলেও কিছু নয়। দেখা যায়, দেশের পয়গম্বরদেরও সম্মান হয় না। স্বদেশের লোক সম্মানের যোগ্য হলেও মানুষ তাকে আঘাত করে, তার ক্ষতির চেষ্টা করে।
১ম বন্ধু–এ কি পণ্ডিত সমাজের লক্ষণ নয়?
২য় বন্ধু–হ্যাঁ, তাই–আপন লোককে তারা নিরন্তর আঘাত করে, সম্মান করতে লজ্জা বোধ করে, বস্তুত গুণ সম্বন্ধে অন্ধ হয়। পরস্পরে মারামারি, কামড়া-কামড়ি করাই তাদের স্বভাব!
১ম বন্ধু–অজ্ঞাত অবজ্ঞাত হয়ে মরা কি কষ্টকর নয়?
২য় বন্ধু–স্বদেশের লোক যদি নাই জানল তাতে কী ক্ষতি?
১ম বন্ধু–শুনেছি, যার ভাগ্যে যে রুজি আছে, তা সে পাচ্ছে?
২য় বন্ধু–অনবরত এখান থেকে ওখানে দৌড়িয়ে বেড়ালে জীবনের দুঃখ বাড়ে, এজন্যই ও কথা বলা হয়েছে। এক জায়গায় ধীরভাবে বসে সাধনা না করলে কোনো কাজ করবার সুবিধা হয় না। বহু বৎসর ধরে কোনো কাজে লেগে থাকলে সে কাজের মর্যাদা বেড়েই ওঠে। পরিচিত জনের মধ্যে মান মর্যাদার ভয়ে অনেক সময় নিজের ইচ্ছামত কাজ করা যায় না। এজন্য অনেক সময় কোনো অপরিচিত স্থানে যেয়ে নিজ সংগ্রামে প্রবৃত্ত হওয়াই ভালো। মান-মর্যাদার ভয় ধরলে সাধনায় আন্তরিকতার অভাব হলে; ইতস্তত আসা-যাওয়া করলে কাজে সুবিধা হয় না, যারা ধনী ও শ্রেষ্ঠ হয়েছেন, তারা কখনও নিজের দেশে শ্ৰেষ্ঠ হন নাই। তথায় সকলেই বিদেশী লোক, কড়া পড়ায় বা সাধনায় মজুর লক্ষপতি হয়েছেন।
১ম বন্ধু–বড় লোক হবার আকাঙ্ক্ষা করা কী ভালো?
২য় বন্ধু–না, দুরাশা পোষণ করলে জীবনে কখনও সুখ হয় না–জীবনের সুখ-শান্তি নষ্ট হয়। কোনোরকমে সুখ-স্বচ্ছন্দে দুটি অন্ন করে খেতে পারলেই যথেষ্ট। অনেক সময় এইটুকুই হয়ে ওঠে না। পরের দরজায় যেয়ে ঘৃণা অবজ্ঞায় মুখে হাত পেতে বসে থাকতে। হয়, এরচেয়ে বিদেশে মাগী-মরদে মজুরী করে খাওয়া ভালো। অবস্থা যার ভালো হবে, তার জীবনের সমস্ত দাগ মুছে যায়। কবে কে কি ছিল–সে কথা আর কেউ ভাবে না। স্বদেশের মায়ায় যদি বিলেতের দরিদ্র সাধারণ বসে থাকত, তা হলে আজ আমেরিকার মতো এই মহাশক্তিশালী জাতির গঠন হতো না।
.
কুকুর ও মনিব
২য় বন্ধু বলিলেন-বন্ধু, নারী বিশ্বস্ততায় এবং প্রভুর প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগে কুকুরের তুল্য হবে। কোনো নারী যেন কখনও মনে না করে, নারীকে কুকুরের মতো হীন হতে হবে। কুকুরের বিশ্বস্ততা এবং তার স্বভাবজাত সে প্রবৃত্তি স্বার্থপর–যার তুলনা নাই। প্রভু ছিল বলে না, তবু প্রিয়তম ভক্ত কুকুর মনিবের অন্তরের ইচ্ছা অনুভব করা মাত্র তার সেবার জন্য খাড়া হয়। প্রভু উঠেছেন জানা মাত্র নিদ্রিত ভক্ত অমনি লাফিয়ে প্রভুর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে খেদমতে হাজির। প্রভুকে প্রেম করা ব্যতীত তার আর কোনো কাজ নেই। কোন চিন্তা, অন্য কোনো আশা আকাঙ্ক্ষাও নেই। স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গেও ঠিক এই সম্বন্ধ। স্বামী উঠেছেন তুমিও ওঠ-স্বামী যেদিকে তাকিয়েছেন তুমিও সেই দিকে বিনা কারণে, বিনা বাক্যব্যয়ে তাকাও। ঘুঘু এবং তার পত্নীর মধ্যে কখনও কোনো বচসা হয় না–কেউ। কাউকে হুকুম করে না, অথচ একজন মনোগত ভাব বোঝা মাত্র সেই অনুসারে কাজ করে। প্রেমালাপে একজন আর একজনের সঙ্গে লেগে থাকা ছাড়া আর তাদের কোনো কাজ নেই।
কাজ করতে হবে, দুজনাই কর-একজনের উপর হাড়ভাঙ্গা খাটুনির ভার দিয়ে নিজে বাদশাহী সুখভোগ করো না। এর নাম পত্নীর প্রতি প্রেম নয়-এর অর্থ, পত্নীকে খরিদা বাঁদীর মতো খাঁটিয়ে নেওয়া–হৃদয়হীন নিষ্ঠুরের মতো তার জীবনকে দুঃখময় করে তোলা। পত্নীকে হাসাবার, সোহাগ করবার, স্বামীর সঙ্গে প্রেমালাপ ও গল্প করবার সুযোগ দিও।তকে ভাড়াটে চাকরের মতো মনে করো না, তার সঙ্গে হৃদয়হানিকর ব্যবহার করো না। শুধু টাকার রূপ, শুধু কাজ, নীরস প্রাণহীন সঙ্গমে নারী বাঁচে না–প্রাণবান পুরুষও বাঁচে না। হাসি-খুশী, আমোদ-আহ্লাদ, প্রেম সেবা সহানুভূতি এবং ত্যাগ, এসবেরও দরকার আছে।
নিছক কাজের সম্বন্ধই যদি নারী, পুরুষের হতো, তা হলে মানুষের উচিত নয়–বিবাহিত হয়, তারা বেতনভুক চাকর এবং চাকরানী রাখুক।
স্বামী-স্ত্রী, কেউ কারো কাছে প্রেমের দাবি করো না। ভালবাসার জন্যে কেউ কাকেও খোশামোদ করো না। যেখানে ভালবাসা নেই–সেখানেই এইসব অভিনয়। আপন চিত্তের পিপাসায়, নিজের কর্তব্যবুদ্ধিতে একজন আর একজনকে ভালবাসবে, সমস্ত অন্তর দিয়ে একজন আর একজনের কাছে অগ্রসর হবে। এ করতে হবে নিজের তৃপ্তির জন্যে, নিজের আনন্দের জন্য। মানুষ লক্ষ টাকা পেয়েও যদি কাউকে সমস্ত প্রাণ দিয়ে প্রেম না করতে পারে-তা হলে তার কোনো তৃপ্তি হয় না। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে প্রেম করবে নিজের গরজে–যে দম্পতিতে প্রেমের এই ক্ষুধা নেই–সে দম্পতি খুব অপকৃষ্ট দম্পতি। তাদিগকে দুটি হিংস্র পশু বলা যায়।
.
স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা
২য় বন্ধু বলিলেন–স্বামীর প্রতি যে নারীর শ্রদ্ধা নেই–তার দুর্গতি হবেই। সতী নারী স্বামীকে সকলের চাইতে উত্তম, রূপবান এবং প্রাণবান মনে করবেন। নারী যখনই স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা হারায় তখনই তার মনের শান্তি নষ্ট হয়, স্বামীর সঙ্গে থাকায় তার আনন্দবোধ হয় না, স্বামী সহবাসে তার সুখ হয় না, অশান্তি ও কলহ-বিবাদে গৃহখানি স্বর্গের পরিবর্তে শ্মশানে পরিণত হয়।
১ম বন্ধু –আমি দেখেছি, স্বামীর প্রতি যাদের কোনো শ্রদ্ধা নেই-তারা কোন্দলপ্রিয়।
২য় বন্ধু –কোনো কোনো নারীর ঝগড়া করা স্বভাব হতে পারে–কিন্তু মনে মনে তাদের স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা থাকেই–যে মুহূর্তে নারী স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা হারায়-তখনই তার সর্বনাশ হয়।
১ম বন্ধু –স্বামী যদি শ্রদ্ধার যোগ্য না হন?
২য় বন্ধু –তখন আর তারা স্বামী-স্ত্রী থাকে না, যতক্ষণ স্বামী-স্ত্রী রূপে বাস করতে হবে, ততক্ষণ পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা থাকবেই; নইলে পরম অমঙ্গলের সূচনা হবে।
১ম বন্ধু –কেমন করে বোঝা যায়, কারো প্রতি কারো শ্রদ্ধা নেই?
২য় বন্ধু। পরী যদি অবাধ্য হয়, স্বামীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি কোনো দৃষ্টি না রাখেন, স্বামীর কথার উপর কথা বলেন, স্বামীর সকল কথার প্রতিবাদ করেন–স্বামীর আহার বিহার সম্বন্ধে কিছুমাত্র চিন্তিতা না হন, বেতনভুক্ত কর্মচারীর মতো প্রাণহীন পুতুলের মতো দাম্পত্য ধর্ম পালন করেন, তা হলে বুঝতে হবে কোন ভয়ানক বিপর্যয় চলেছে।
১ম বন্ধু–এর প্রতিকার কী?
২য় বন্ধু–এর কোনো প্রতিকার নেই।
১ম বন্ধু–এত বড় নিরাশ কথা বললে?
২য় বন্ধু–কারো উপর যদি কারো শ্রদ্ধা না থাকে, তা হলে পরের কথায় তা হবার জো নেই। ভালবাসা, প্রেম ও শ্রদ্ধা এগুলি অন্তরের জিনিস। এর উপর মানুষের কোনো হাত নেই। যদি কেহ ধর্মদ্রোহী হয়, তার সম্বন্ধে কি বলা যায়, তার কি উপকার করা যায়! যতক্ষণ
সে আত্মা হতে ভক্ত এবং বিশ্বাসী না হয়। স্বামীর প্রতি নারী যখনই শ্রদ্ধা হারিয়েছে, তখনই তার বিনাশের পথ সৃষ্টি হয়েছে–জীবনে তার সমূহ অকল্যাণ হবার সম্ভাবনা;–এ কথা যে নারী বুঝবে, সেই সতর্ক হবে। স্বামী বলে শুধু নয়–মহত্ত্ব, মনুষ্যত্ব জ্ঞানকে যারা অবহেলা, অবজ্ঞা এবং অশ্রদ্ধা করে, সাধুতা, সতোর সম্মুখে অবোধ মানুষ যখন অহঙ্কারী। এবং অবিনয়ী হয়–তখন সে ধ্বংস হয়; দুঃখের বিষয়, সে কথা সে বোঝে না।
.
কথার ঠিক
২য় বন্ধু কহিলেন–বহু মানুষেরই কথার ঠিক নেই। এ যে কত বড় অন্যায় কথা–তা আর বলবার নয়। বস্তুত যাদের কথার ঠিক নেই–তারা যতই ফর্সা কাপড় পরুক, তারা কখনো ভদ্রলোক নয়।
১ম বন্ধু–একটু বুঝিয়ে বলো।
২য় বন্ধু–বললাম, হাটের মধ্যে নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে দেখা হবে-হাটের মধ্যে সময়কালে আমার নাম-গন্ধ নেই। তুমি সারাবেলাটা আমার অপেক্ষায় এদিক-ওদিক চেয়ে কাটিয়ে দিলে। হয়তো তোমার সঙ্গে ঠিক হল, কাল সকালে তুমি আর আমি কলিকাতা যাবো। আমি সেজে-গুঁজে তৈরি হয়ে এলাম, তুমি সময়কালে বললে না হে! যাওয়া হল না। কথা হল, কোন জায়গায় যাবার সময় তুমি আমায় ডেকে নেবে, সময়কালে তুমি একাই গেলে, আমাকে কিছু জানালে না। হয়তো কোন সম্পত্তি আমি তোমার কাছ থেকে খরিদ করবো, তুমি দশদিন আমার বাড়িতে ঘুরলে, সময়কালে বললাম–না, হবে না। তুমি আমার কাছে টাকা পাবে, রোজই বলছি, কাল এস। হয়তো তখন আমি বাড়িতে নেই।–এসব চামারের কাজ। ভদ্রলোকের কাজ নয়। ভদ্রলোক কখনো মিথ্যা কথা বলবে না, মিথ্যা ওয়াদা করবে না, কাউকে মিথ্যা আশা দেবে না।
১ম বন্ধু–বাস্তবিক এরূপ করা বড় অন্যায়, অভদ্রতা।
২য় বন্ধু–এদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।
১ম বন্ধু–কার্যক্ষেত্রে অনেক সময় পারা যায় না।
২য় বন্ধু–তা ঠিক, তবে মিথ্যাবাদী লোক যারা, তাদের সংস্পর্শ পরিহার করে চলাই ভালো। কিছু পরে বলিলেন–মূর্খ লোকেরাই অসহিষ্ণুর মতো কথা বলে। কথা শ্রবণ কর, তার পর ধীরভাবে উত্তর দাও।
মূর্খেরাই কু-তর্ক করে।তাড়াতাড়ি চিন্তা না করেই উত্তর দেয়, কথার উত্তর দেওয়ায় বাহাদুরি নয় বরং মৌন থাকাই উত্তম।
যারা অহঙ্কারে বিদ্রোহচারণ করে, দেমাগ করে চলে–তারা নিকটবর্তী হয়ে প্রীতির কথা বললে তাদের সঙ্গে প্রীতির কথা বল। না, মগরুবীর কথা উল্লেখ করো না।
.
চালবাজী
২য় বন্ধু কহিলেন–যুবক বয়সে অনেক সময়, বড় মানসিকতা দেখাবার লোভ হয়। যুবকদের এ অপরাধ ক্ষমা করা যেতে পারে, কিন্তু বিবাহিতদের, বয়স্কদের এ অপরাদ ক্ষমার যোগ্য নয়। বড় মানুষ এ জগতে এত বেশি আছে যে, তোমার আমার মতো দরিদ্রমানুষ চাল দেখাতে গিয়ে বুদ্ধিমানের কাছে মুখ ও আহম্মক সাব্যস্ত হয়। যারা হাতে ২/৪ পয়সা হলে ধরাকে সরা জ্ঞান করে, নীচ লোকদের তোষামোদে দিশেহারা হয় এবং নওয়াবী করতে চায়, মাতব্বরী ফলাবার জন্যে পয়সা খরচ করে, তাদের দুঃখের দিন নিকটবর্তী। বন্ধু-বান্ধবকে খাওয়ান, গাড়ী-ঘোড়ায় চড়া, এক টাকার জায়গায় পাঁচ টাকা খরচ করে থিয়েটার দেখা, এ সব দোষের নয়, কিন্তু সকলের পক্ষে তা শোভা পায় না। হঠাৎ অতি বড়লোক হওয়া যায় না। হয়তো শীঘ্রই দুঃখের দিন আসবে, তখন ফেলে দেওয়া পয়সা রত্ন বলে মনে হবে। চালবাজী করতে গিয়ে, বড় মানসিকতা ফলাতে গিয়ে, বহু শ্রেষ্ঠ লোক পথের কাঙ্গাল হয়েছেন, এ কাজটি মোটেই ভালো নয়। অতিশয় কৃপণতা, অতিরিক্ত হিসাব-নিকাশ ভালো তা বলছি নে, লোক দেখানো প্রবৃত্তি, মানুষের কাছে বড় মানুষ বলে বাহবা নেবার আকাঙক্ষাটি খারাপ।
অতিথি দেখে পলায়ন ভালো নয়–কিন্তু বৃথা বেগানা লোককে বিনা প্রয়োজনে আপ্যায়িত করাও ঠিক নয়। কিংবা যতটুকু প্রয়োজন, তার বেশি করবারও দরকার নেই।
বন্দুক, গাড়ি, ঘোড়া, নৌকা, চাকর-বাকর, এগুলি অনাবশ্যক জিনিস নয়। কিন্তু যার সঙ্গতি নেই, তার এ সব না করাই ভালো, লোকের কাছে সম্মান না হয়, না হোক। এককালে। বড়লোক ছিলে, এখন লোকে গরিব বলবে? তাতে ক্ষতি! অতীতের অসার চিন্তার বশে সাবেক চাল বজায় রাখবার কোনো দরকার নেই। সহজ, সরলভাবে নিজের দীন অবস্থাকে মেনে নেওয়াই ভালো। সময় চিরদিন সমান থাকে না, আবার সুদিন আসতে পরে।
“বন্ধু, দিবারাত্র মানুষের সঙ্গে কে কি অবস্থায় আছে, কার কি আয়, কে কত টাকা বেতন পায়-এ সব চিন্তা করো না, ধীরভাবে জীবনের কর্তব্য পালন করে যাও-তাতে ধনী হও, দরিদ্র হও, সে সব ভেবো না।”
“আজ আর একটা কথা বলবো–মনে করে রেখ। তারপর চল, নৌকা বিহার করে আসি।”
“মানুষের মঙ্গল কর, মঙ্গল চিন্তা কর, অন্তরে যা উত্তম ও সৎ তা আঁকড়ে ধরে রাখ। চিন্তা কর, কারো উপকার কর, কিন্তু সে সম্বন্ধে মানুষের কাছে কোনো কথা না বলাই ভালো–এককালে আত্মার প্রবল আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ হয়। যে কোনো বিপদে, যে কোনো উত্তম কার্যের প্রারম্ভে সরল ভাষায় বুঝে আল্লার কাছে সাহায্য ভিক্ষা করো, প্রাণের ভাষায় প্রার্থনা করো!–চল এখন যাই।”
.
মিলাদ শরীফ
২য় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু, মিলাদ একটি সুন্দর অনুষ্ঠান। সমাজে অনেক দিন থেকে চলতি রয়েছে, কিন্তু এর এমনই অপব্যবহার হয়েছে যে, মিলাদ সভায় যোগ দেওয়া আর ভালো লাগে না।
১ম বন্ধু–একটু ভালো করে বুঝিয়ে বলো।
২য় বন্ধুমহাপুরুষদের জীবনী আলোচনার উদ্দেশ্য শিক্ষা লাভ করা, আত্মাকে জাগানো, কিন্তু মিলাদে এর একটা উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হয় না। কতগুলি আধ্যাত্মিক দৃষ্টি বঞ্চিত মানুষ অবোধ্যভাষায়, কল্পনা ও মিথ্যা কাহিনী আলোচনার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। কোনো শিক্ষা লাভ হয় না। কে কেমন গাইতে পারে, উর্দু গজল আবৃত্তি করে কেবল কৃতিত্বই দেখান হয়।
১ম বন্ধু–গান গাওয়া কি খারাপ?
২য় বন্ধু–গান গাওয়া খারাপ বলছি নে–গান গাইতে যদি হয়, তবে অবোধ্য ভাষায় কেন? বাংলা ভাষায় গাইলেই তো হয়–তাতে আল্লাহর এশকে চিত্ত পূর্ণ হতে পারে। শুধু সুরের মাদকতা কেন?-ভাবে মাদকতা ভক্ত সুফীর প্রাণকে কেমন বিগলিত করে; শুধু সুরে কি তা পারে? যা বলছিলাম-ভণ্ডের দল কিছুক্ষণ দরুদ শরীফ পাঠ করে, তার পর চিৎকার করে, “খাবার কী আছে, নিয়ে এস খাই।”
১ম বন্ধু–দরুদ পাঠ কি ভালো না?
২য় বন্ধু–খুব ভালো। তবে কথা কি-দরুদ হচ্ছে সুফীর প্রাণে অনুভূতি, হযরতের প্রশংসা গীতি বা স্তুতি অথবা প্রেমের অভিব্যক্তি। যে প্রশংসার সঙ্গে আত্মার যোগ নেই, তা ব্যভিচারিণী নারীর প্রেম-ছলনা ছাড়া কিছু নয়। যারা সভায় দরুদ পাঠ করে-তারা একবারের জন্যও হযরতের মহত্ত্ব, মনুষ্যত্ব, উচ্চ মানবতা, প্রেম, ত্যাগ, আল্লাহর দয়ায় বিশ্বাস এ সব কিছু মাত্র ভাবে না–অনুভব করে না। যেন একটা পাগলের কাণ্ড। এসলামের –পথে, হযরতের পথে এরা আরও নিষ্ঠুর, দাম্ভিক এবং মনুষ্যত্ববর্জিত হয়। যেহেতু মুসলমান–তবে আর কি, মানুষের সঙ্গে সাধু ব্যবহার কর, ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা করো, সত্যমিথ্যা দেখবার দরকার নেই, এই হল, তাদের মানসিকতা। কি পরিতাপের বিষয়!
১ম বন্ধু–তা হলে কি করতে হবে?
২য় বন্ধু–এরূপ ধরনের সভায় নিমন্ত্রণ করলে, সোজা বলে দেওয়া উচিত, মাফ করুন সাহেব।
১ম বন্ধু–তা হলে একটা অনুষ্ঠান কি এমন করে নষ্ট হবে? হযরতকে কি কেউ বুঝবে না–চিনবে না?
২য় বন্ধু–হ্যাঁ, এ একটা গুরুতর বিষয়।-আচ্ছা এস, আমরাই হযরতকে প্রচার করবার ভার গ্রহণ করি; শুধু কথা বললে চলবে না, যে বুঝেছে, তারই কাছে খোদার বাণী এসেছে, সে বাণী শুনে পালালে চলবে না।
অনেকক্ষণ থেমে বললেন–বন্ধু, কোথাও পত্র লিখতে হলে, পত্র পোস্ট করো না, চিঠি লিখে দু’দিন ফেলে রেখো। তার পর পোস্ট করো।
হঠাৎ কারো প্রশংসা করো না, হঠাৎ কারো গ্লানি রটনা করো না।
পারতপক্ষে চিকিৎসকের নিকট কখনো আর্থিক সুবিধার জন্য অনুযোগ করো না, এ করলে নিজের শরীরের ক্ষতি হবে। ডাক্তার কিছুতেই প্রাণ থেকে যত্ন নেয় না, সত্তাবে গ্রহণ করা এবং ধীরভাবে উত্তর দেওয়াই জিতবার পথ।
জবরদস্তি এবং বলপ্রয়োগ দ্বারা কাউকেও সাধু হতে বাধ্য করো না, আল্লাহ তা ভালবাসেন না। এরূপ করা শয়তানের কার্য।
.
পরপারে যাত্রা
২য় বন্ধু বলিলেন-বন্ধু, প্রত্যেক পরিবারের এক একটি কঠিন সময় আসে প্রিয়জনের মৃত্যুতে পরিবারে মেরুদণ্ড চূর্ণ হয়ে যায়।
১ম বন্ধু–তা ঠিক।
২য় বন্ধু–কিন্তু, এই আঘাত সহিষ্ণুতার সঙ্গে বহন করতে হবে। অতিশয় শোক করা এবং কারও মৃত্যুতে কিছুমাত্র বেদনা বোধ করা দুটিই খারাপ।
১ম বন্ধু–প্রিয়জনের মৃত্যুতে প্রাণ বিদীর্ণ হয়ে যায় বৈকি!
২য় বন্ধু–আমি তো বলেছি, সহিষ্ণুতার সঙ্গে শোক বহন করতে হবে, তা সে যত কঠিনই হোক। যিনি আল্লাকে প্রেম করেন, জগতের নশ্বরত্ব অনুভব করেন, তিনি মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েন না। মৃত্যু তার জীবনের অনন্ত যাত্রাবাস্তবিক এই কথাই ঠিক। আল্লাহকে যারা বিশ্বাস করে, তারা অনন্ত প্রেম এবং সত্তাকে সমস্ত প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করে, যে প্রভুকে সত্যরূপে ও প্রাণে প্রাণে অনুভব করতে শিখেছে, সে সন্তানের মৃত্যুতে বিচলিত হয় না-হাসি মুখে প্রভুর ব্যবসা মাথা পেতে নেয়। জগতের জন্যে কঠিন শোক করা কোনোমতে ঠিক নয়।
যতদিন বেঁচে থাক–পরস্পরের প্রতি যা কিছু কর্তব্য আছে, সম্পাদন করতে এতটুকু ত্রুটি করো না। মৃত্যুর পর আর কিছুমাত্র শোক করো না, ধীর-মৌন-গভীর সহিষ্ণুতায় সে বোঝা বেদনা সহ্য কর। মৃত্যুর কঠিন পাষাণ কিছুতেই সরানো যাবে না, সুতরাং সেজন্য। কাদাকাটি করা মূর্খতা।
১ম বন্ধু–মানুষের আঁখিজল কি পবিত্র নয়? হৃদয়হীনের নীরবতা কি অসহ্য নয়?
২য় বন্ধু–হ্যাঁ, বিচ্ছেদ বেদনা বোধ করা মানুষের স্বভাব।–কিন্তু তা নীরবে সহিষ্ণু হয়ে স্বীকার করে নেওয়াও মানুষের কাজ। নিষ্ঠুর প্রাণহীনের প্রিয়জন বিরহের প্রতি যে ঔদাসীন্য তাও বিরক্তিকর।
শোক না করলে লোকে কী ভাববে–সুতরাং কৃত্রিম শোক করা কোনোমতে বাঞ্ছনীয় নয়।
১ম বন্ধু–কোনো কোনো মানুষের মৃত্যুতে মন আনন্দিত হয়।
২য় বন্ধু–তা নিতান্তই ভুল। যেহেতু মৃত্যুর হাত থেকে কেউ অব্যাহতি পাবে না, দুদিন আগে আর দুদিন পরে। যতদিন জগতে বাস কর, পরস্পরকে প্রেম কর, ভালবাস। কেউ কাউকে বঞ্চিত করো না, কষ্ট দিও না। তার পর সময় হলে আমরা হাসিমুখে প্রভুর কাছে যেয়ে দাঁড়াব, সেখানে দুঃখ নাই, শোক নাই, •ালা নাই, যন্ত্রণা নাই, কেবল শান্তি ও আনন্দটা সে আনন্দ লাভ করবার আয়োজন করতে যেন আমরা না ভুলি। আত্মার। কল্যাণকে নষ্ট করে আমরা যেন কোনো কিছুতেই তুষ্ট না হই।
আভিজাত্যের অহঙ্কার
২য় বন্ধু, কহিলেন-বন্ধু আভিজ্বাত্যের অহঙ্কার করা কতকগুলি মানুষের পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি দরিদ্রকে ভালো না বাসি, পতিতকে ধরে টেনে না তুলি অজ্ঞানকে পথ না দেখাই, তবে বড় হয়ে আমার লাভ কী?–আমার মতো দাম্ভিক ভদ্রলোকের জগতে থাকবার কোনো সার্থকতা নেই। যে বংশমর্যাদা অবিনয়ী অহঙ্কারী, আত্মসর্বস্ব, নিষ্ঠুর পতিতের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে–তা হীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
১ম বন্ধু–ধার্মিক জীবনের বড়াই কেমন?
২য় বন্ধু–তাও মহাপাপ। ধার্মিকের কাজ বড়াই নয়। ধার্মিকের কাজ প্রেম করা, পতিতকে পথ দেখানো, শ্রদ্ধা করা নয়, উগ্র হওয়া নয়। মানুষকে শয়তান বলো না। যে ধার্মিকতা অহঙ্কার করে, তা কখনও ধার্মিকতা নয়, তা শয়তানী।
১ম বন্ধু–কি গুরুতর কথা!
২য় বন্ধু–হ্যাঁ, গুরুতর কথাই। আল্লাহর ভাব কি তা মানুষ জানে না, জানতে চেষ্টাও করে না, চিন্তাও করে না। মানুষ কেবল সংসারকে বিষয় এবং অন্য চিন্তায় মগ্ন থাকে। ইচ্ছা থাকলে সাংসারিক বিষয় এবং অন্নচিন্তার ভিতর দিয়েও আল্লাহকে অনুভব করা যায়–কারো সংসার ত্যাগ করবার দরকার নেই, বনে যাওয়ার দরাকার নেই। এই কর্ম ব্যস্ততার মাঝেই আল্লাহকে অনুভব করতে হবে, এর ভিতরেই তার পতাকা বহন করতে হবে, এটিই হচ্ছে তার সত্যিকারের এবাদত। সংসার ও মানব-সমাজ ত্যাগ করে তার এবাদত সিদ্ধ হবে না।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম–তুমি যে বড়, তুমি যে শ্রেষ্ঠ এ-কথা ভুলে যাও, কখনো চিন্তা করো না–এরূপ অতিশয় হীনতা ও মূঢ়তা।–শুধু জীবনের কর্তব্য সম্পাদন কর।-যদি সেইটুকু পাও, তা হলেই যথেষ্ট, কখনো মানুষের কাছে বড়াই করো না, আমার পিতা জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, আমার ভাই সাতশ টাকা বেতনে চাকরি করেন–এ সব বলা মূঢ় জনেরই কাজ। জীবনকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করে তুলবার সাধনা, জীবনের সমস্ত কর্তব্য সম্পাদন করবার সাধনা এত গুরুতর যে, কে কত বড় এ কথা ভাবার অবসর থাকে না। আমরা কেউ দুর্বল, শক্তিহীন, কতখানি লজ্জা আমাদের জন্য সঞ্চিত হয়েছে–এই চিন্তাতেই জীবনশেষ হয়। বড়াই-এর অবসর কোথায়?
দিবারাত্র মানুষের খুঁত ধরা, কার বংশমর্যাদা কতটুকু, এ সব আলাচনা ভদ্রলোকের শোভা পায় না। এ সব নীচ ব্যক্তিদেরই কাজ।
ফাতেহা
২য় বন্ধু কহিলেন–বন্ধু, মানুষ মরলে ফাতেহা করবার রীতি আছে। যারা সমাধি কার্যে যোগ দেন, তাহাদেরকে খাবার জন্যে অনুরোধ করা যেতে পারে, কিন্তু তাতে মৃত মানুষ বেহেশতে যাবেন, এরূপ আশা করা বড় ভুল। আয়ত্তের ফল মানুষ পাবেই তা যতই খানা মেহমানী হোক না কোনো; বেঁচে থাকতে বিদ্যালয় স্থাপন, চিকিৎসালয় স্থাপন, এ সব উত্তম। কিন্তু মরবার পর মৃত আত্মার উদ্দেশ্যে খানা-মেহমানী দেওয়ার বিশেষ ফল হয় বলে মনে হয় না। একজনের জন্য আর একজনের সকার্য কী করে গ্রাহ্য হবে? প্রত্যেকের আয়ত্তের জন্য প্রত্যেকে দায়ী। যে অসমর্থ, তার বাড়িতে কারো না খাওয়াই উচিত। বিবাহ উৎসবে খাবার জন্য পীড়াপীড়ি করলে তা দোষের হয় না। কিন্তু মৃতের জন্যে খাবার উদ্দেশ্যে জবরদস্তি করা বড়ই অন্যায়। মৃতের জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে আত্মীয় বা বন্ধুরা প্রার্থনা করতে পারেন–আন্তরিক প্রার্থনার পরিবর্তে টাকার জোরে পুণ্যলাভ সম্ভব নয়। দীন ভিক্ষুকের এক ফোঁটা অশ্রুর যা মূল্য, প্রাণহীন বড়লোকের লক্ষ টাকার সে মূল্য আল্লার কাছে নেই।
১ম বন্ধু–মসজিদ ঘর দেওয়া কেমন?
২য় বন্ধু–মসজিদ ঘর তৈরি করার চাইতে মানুষ যাতে প্রার্থনার মূল্য শেখে, সেই শিক্ষা দেওয়া অধিক উত্তম। যে গোমরাহ, শয়তান, সে তো মজজিদে আল্লাহর কাছে যাবেই না। আর যিনি সাধু তিনি তৃণাসনে বসে আল্লাহকে ডাকলেও তা গ্রাহ্য হবে। আল্লাহ চান ভক্তের প্রাণ, তিনি উপাসনা ঘর, সোনা-রূপার ঝাড়-লণ্ঠন চান না। মানুষ যাতে মানুষ হয়, মানুষ আল্লাহকে মেনে ধর্ম জানতে পারে, প্রেমিক, সাধু মহাজন হয়–সেই ব্যসস্থা করাই ভালো। অর্থাৎ শিক্ষা প্রচার, ধর্ম-প্রচার, এগুলিই অধিক উত্তম। মসজিদ দেওয়া অপেক্ষা এগুলির দ্বারা আল্লাহর অধিক সেবা হয়। . একটু থামিয়ে কহিলেন–মৃতের জন্য কোরান শরীফ খতম, তপস্যা, তস্বীহ্ তেলাওয়াত, হাজার হাজার লোক খাওয়ান অপেক্ষা বেঁচে থাকতে সকার্য, আমল এবং ধার্মিকতা আবশ্যকতা যদি না থাকে, তা হলে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করলে যে বিশেষ লাভ হয় তা মনে হয় না।
খাদ্য গ্রহণ
২য় বন্ধু কহিলেন–বন্ধু, অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন ব্যক্তি, দুর্মতি, শঠ, মুচি প্রভৃতি ব্যক্তির হাতে কখনো আহার করতে নেই। অশিক্ষিত বাবুর্চি বা এদের হাতের রান্না বিষবৎ বর্জন করবে। সাধ্বী নারী, ভদ্র, মার্জিত চিত্ত, খোদা ভক্ত সাধু ব্যক্তিদের হাতের রান্না খাওয়াই ভালো। চাকর-চাকরানী বা দাস-দাসী রান্নার ব্যবস্থা করে দিতে পারে, রান্নার ভার দেওয়া কোনোমতে ঠিক নয়, সময়াভাবে রান্নার ব্যবস্থা অনেক সময় ছোট লোকদের হাতে দিতে হয়–কিন্তু এর ফল বড়ই ভয়ানক। হিন্দুদের খাদ্য মানুষের স্পর্শে নষ্ট হয়, এই ব্যবস্থার মানে আর কিছু নয়, খাদ্যাদির বিশুদ্ধতা রক্ষা করা। অতিরিক্ত বড়াবাড়ি মূর্খতা এবং বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়।
নামে মুসলমান হলেই তার হাতের কোনো বস্তু নিঃসন্দেহে খাওয়া যায়, এ মনে করো। অপরিষ্কার ও নিম্নস্তরের কোনো মানুষের হাতের খাদ্য গ্রহণ করা স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ক্ষতিজনক। যাদের মন অপবিত্র তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জ্ঞান অতি কম। স্নেহময়ী নারী অথবা সাধা প্রকৃতির ব্যক্তির হাতে খাদ্য গ্রহণ করাই স্বাস্থ্যরক্ষার পক্ষে অনুকূল। নীচ জাতীয় লোকদের মধ্যেও যদি সাধুপ্রকৃতির সুরুচিসম্পন্ন মানুষ হয়, তার হাতে খাদ্য গ্রহণ করা যায়। সেখান থেকে মিষ্টান্ন খরিদ করা, হোটেল দেখলেই ঢুকে পড়া এগুলি যে কত বড় অন্যায় তা আর বলে কি হবে! সেই জন্যে হিন্দু পণ্ডিতেরা চালাকী করে ব্যবস্থা দিয়েছেন–অমুক অমুক লোকের হাতে, অমুক স্থানে গেলে জাত যাবে।
হিন্দু, ছোটলোক, বৌদ্ধ, যে কোনো জাতির হাতে খাওয়া যায়, যদি তারা ভদ্র এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হন। ভদ্রবংশীয় যে কোনো নারীর হস্তে খাওয়া যায়, কিন্তু নীচ, কোন্দলপ্রিয়, ব্যভিচারিণী, ইতর নারীর হস্তে কখনো খাবে না।
নীচ, ছোটলোক অপরিষ্কার, শয়তান ইত্যাদির কথা দিবারাত্র বলে বেড়ান ভদ্রতা নয়। ওটা মনে মনে অনুভব করে, সবিনয়ে আহার অস্বীকার করা কিংবা আদৌ গ্রহণ বা ক্রয় না করা উচিত খাদ্যাদি সম্বন্ধে কখনো অমনোযোগী হওয়া উচিত নয়। রান্নার পানি এ সব কখনো দাস-দাসী দিয়ে সংগ্রহ করা উচিত নয়। বাড়ির ইন্দারা বা কূয়া থেকে বাড়ির বধূরাই পান এবং রান্নার জল নিজ হস্তে সংগ্রহ করবেন, এ বিষয়ে কারো উপর নির্ভর করবে না। পরিবেশন করা, হাঁড়ির মধ্যে হস্ত দেওয়া এ সবও বাড়ির বধূ এবং প্রবীণা গৃহিণী ছাড়া কেউ পারবেন না।
গ্রাম্য দল
২য় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু গ্রামের মধ্যে ২/৩ টি দল থাকে-দেখতে খারাপ দেখা গেলেও এ জিনিসটি দরকার, আঘাত করবার, কথা বলবার কেউ না থাকলে ব্যক্তি বিশেষের প্রাধান্য, দাম্ভিকতা বেড়ে যায়–কেউ কেউ অত্যাচারীও হয়ে পড়েন। পৃথিবীতে বিভিন্ন। শক্তি, যেমন জাপান ও জার্মানি আছে, যেমন বিভিন্ন জগতে মুসলমান-খ্রিস্টান ইত্যাদি আছে, ঠিক তেমনি গ্রামের মধ্যে বিভিন্ন শক্তিশালী দল থাকা দরকার। নইলে গ্রামে বাস করা কঠিন।
১ম বন্ধু –গ্রামে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা না থাকলেও বাস করা কঠিন।
২য় বন্ধু –হ্যাঁ, একই কথা, প্রত্যেকের দাবি এবং স্বাধীনতা বজায় রাখবার জন্যে এই দল গঠিত হয়ে ওঠে। আল্লাহ মনুষ্য-প্রাণে কতকগুলি ভাব দিয়েছেন–যার ইঙ্গিতে মানুষ অজ্ঞাতসারে চলে। অন্যায় সে সয় না, উচিত কথা বলে, পীড়িতের এবং অত্যাচারীদের দিকে দাঁড়ায়। এ কারণেই জগতে ভিন্ন ভিন্ন দল গঠিত হয়ে উঠে! এটা দরকার। যারা কুকুরের সমান অন্যায় মাথা পেতে বহন করে–সমস্ত কথায় হ্যাঁ, হুজুর বলে যায়, তাদের মধ্যে দল না হলেও চলে।
১ম বন্ধু –প্রধান জিনিসটা কেমন?
২য় বন্ধু –হ্যাঁ, গ্রামে মণ্ডল বা প্রধান থাকেন, বিভিন্ন দল থাকলেও প্রত্যেক দলের একজন নেতা থাকেন। এই নেতা যদি জালেম হন, তা হলেও বিপদ। যিনি জালেম, নিষ্ঠুর তিনি নেতার আসন অধিক দিন অধিকার করে থাকতে পারেন না। মানুষ তাকে মানে না, তার শত্রু তৈরি হয়। আল্লাহ তাকে দমন করেন। সহৃদয় মানব-সেবক, মানুষের সুখ-দুঃখ যিনি বোঝেন, গ্রামে, শহরে, দেশে তিনিই নেতা।
পরস্পরে ঝগড়া-বিবাদ, কলহ, এ সব ভালো নয়। বিভিন্ন দল থাকলেও একসঙ্গে প্রীতি স্থাপন করে বাস করা ভাল। কর্তব্যের খাতিরে, নির্বিকার চিত্তে মানুষের সঙ্গে বিবাদ করা যায়, কিন্তু ক্রোধ প্রকাশ করা, একে অন্যের প্রতি ইতর ভাষা প্রয়োগ করা, ভদ্রলোকের কাজ নয়, সেটা পশুদের সাজে। পরস্পরে সম্মান জানাতে, শ্রদ্ধা করতে ত্রুটি করা উচিত নয়, কারো দাবির উপর অন্যায় আক্রমণ, এগুলিও ভালো নয়। প্রত্যেক মানুষের উচিত ভদ্র ও ন্যায়পথ অবলম্বন করে চলা, তা হলে আর জগতে ভিন্ন ভিন্ন দল প্রয়োজন হবে না, মানব-জাতির মাত্র একটি দল হবে।
পয়সার বল
২য় বন্ধু বলিলেন-বন্ধু, পয়সার বলকে অশ্রদ্ধা করো না। অর্থ শক্তি ব্যতীত জগতে কোনো শুভ ও বড় কাজ সম্ভব নয়। বন্ধু, পয়সার দাস কে না? মাতা-পিতা, ভাই-ভগ্নি সবাই পয়সার দাস। যে পয়সা দিতে পারে না তার কোনো মর্যাদা হয় না। তাকে অধিকাংশ মানুষই অশ্রদ্ধা করে।
১ম বন্ধু–তা করা কি ঠিক?
২য় বন্ধু–না, তা করা ঠিক নয়। মানুষের সব সময় সমান যায় না। কখনো, দুঃখ, কখনো সুখ, কখনো দারিদ্র্য, কখনো স্বচ্ছলতা। দারিদ্রের দিনে কাউকে অশ্রদ্ধা করা মোটেই ঠিক নয়। কে জানে, তার ভবিষ্যৎ কি–তার দ্বারা কোন মহৎ কার্য হবে কি না?–আত্মীয়জনের দরিদ্রতাকে আঘাত না করে, তাকে সর্বপ্রকারে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য চেষ্টা করা উচিত। অনাত্মীয় দরিদ্রকে উপহাস করাও ঠিক নয়।
১ম বন্ধু–অর্থ উপায়ের পথ কী?
২য় বন্ধু–কোনো বিশেষ সাধনায় সহিষ্ণুতার সঙ্গে লেগে থাকাই অবস্থা ভালো করবার পথ। যে পরমুখাপেক্ষী, সে কোনোকালে অর্থশালী হবে না।
১ম বন্ধু তুমি যে বললে, মাতা-পিতা, ভাই-ভগ্নি, সবাই দাস-তার মানে কী?
২য় বন্ধু–অন্ন-বস্ত্র উপহার এবং খরচপত্র দিলে, মাতা-পিতা, ভাই-ভগ্নি অতিশয় তুষ্ট হন। তাদের ভালোবাসা বাড়ে, তারা বাধ্য থাকেন। আর পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে না খেয়ে, নিজে যদি নিজের অন্ন-বস্ত্র ও খরচপত্রের সংস্থান করা যায়, তবে তা ভালোই। পরের খেতে গেলেই গরম কথা শুনতে হয়, এটি জগতের নিয়ম; সুতরাং পরের না খেয়ে যদি পারা যায়–নিজের খরচ যদি নিজে করা যায়, এটি খুব ভালো। সাংসারিক ও পারিবারিক অভাব-অভিযোগ পূরণ করা একার পক্ষে খুব কঠিন। দশ জন যদি এক জনের উপর ভর দিয়া চলেন, তবে তিনি পিতাই হন আর ভাই-ই হন, তিনি চূর্ণ হয়ে যান। সংসারের কর্তাকে যদি কিছু কিছু করে সবাই সাহায্য করেন, তবে সংসার খুব স্বচ্ছলতার সঙ্গে চলে। পরস্পরের মধ্যে স্নেহ-মমতাও বাড়ে। এক জনকে অতিমাত্রায় চাপ দিলে–মনোমানিল্য, অশান্তি, কলহ এবং বিপদের সৃষ্টি হয় এবং খুব অন্যায় হয় তাও বলা যায় না। পয়সার লোভে কখনো হীন পথ অবলম্বন করা উচিত নয়, কিংবা পয়সার জোরে অত্যাচারী, দাম্ভিক এবং অভদ্র হওয়া ভালো নয়–যেহেতু তা পতনের পথ।
পিতার সম্পত্তি
২য় বন্ধু বলিলেন-বন্ধু, যে সমস্ত পুত্র পিতার সম্পত্তির লোভ করে, পিতার টাকার লোভে বসে থাকে–তারা নিতান্তই হীন এবং অপদার্থ। পিতা যদি দিয়ে যান, সে আলাদা কথা–কিন্তু সন্তানদের কর্তব্য তারা বীরপুরুষের মতো জগতে আপন আপন স্থান করে নেয়া।
১ম বন্ধু–জামিদারদের ছেলের সঙ্গে সাধারণ লোকের তুলনা হয় না। মূর্খ-অকর্মণ্য, কাণ্ডজ্ঞানহীন যারা, তারা জমিদারি রাখতেও পারে না। সাধারণ লোক যারা, তারা অনেক সময় অহঙ্কারে নিজেকে ধনী মনে করে। যাদের বাৎসরিক দুই-চার লক্ষ টাকা আয়, তারাই নিজেদেরকে জমিদার মনে করতে পারে। কখনো কাপুরুষের মতো পরের উপর নির্ভর করতে নেই। আপনা থেকে যা আসে তা আসুক।
১ম বন্ধু–স্বাধীনভাবে জীবনকে কী করে প্রতিষ্ঠিত করা যায়?
২য় বন্ধু–হ্যাঁ, যায়। বিচক্ষণ অভিভাবকদের কর্তব্য নয়–তারা আপন আপন ছেলেকে মূর্খ করে রেখে, নিজের গলগ্রহ করে তোলে। ছেলেদেরকে শিক্ষা এবং মূলধন দিয়ে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র করে দেওয়া উচিত। বিপদে অভিভাবক সেয়ানা পুত্রদের পার্শ্বে এসে দাঁড়াবেন, কিন্তু যতক্ষণ তারা উড়ে চরে খেতে পারে, ততক্ষণ তারা তা করুক–দুর্বল পাখনা, দুর্বল হৃদয়, পরমুখাপেক্ষী হয়ে বাপের অন্ন বসে বসে ধ্বংস করুক–এটা মোটেই ভালো নয়। বাপদের এ-বিষয়ে বিশেষ সতর্ক হয়ে কাজ করতে হবে। রোজগারের জন্য ছেলেদিগকে শুধু ভর্ৎসনা করলে চলবে না; যাতে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। আর অভিভাবক যদি সেরূপ না করেন তা হলেও বুদ্ধিমান ও স্বাধীনচেতা ছেলেরা কখনো বাপের উপর নির্ভর করবে না–ভীষণ পরিশ্রম, চাকর থেকে যেমন করে তোক নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। সঙ্গতি থাকলে, পুত্রদেরকে সাহায্য করতে ক্রটি করা কোনো পিতার উচিত নয়। কোনো সন্তান যদি স্বক্ষমতায় জীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে থাকে, তবে তার কখনো অহঙ্কারী হওয়া উচিত নয় এবং আপন আপন আপরাধী (?) পিতা-মাতার প্রতি নিষ্ঠুরাচরণ করে সেটি বড়ই অভদ্রতা। নীরবে, গোপনে আত্মার গৌরব রক্ষা করাই হচ্ছে মানুষের মনুষ্যত্ব।
ভবিষ্যৎ
২য় বন্ধু কহিলেন–বন্ধু নিজের ছেলে-মেয়ে এবং পত্নীকে পরের আশ্রয় না নিতে হয়, এজন্য প্রত্যেকেরই চিন্তা করা উচিত।
১ম বন্ধু–মানুষ কী করে জানে, সে হঠাৎ মারা যাবে?
২য় বন্ধু–ভ্রাতা বা নিকট আত্মীয়ের অকাল মৃত্যুর ফলে বিপন্ন ছেলে-মেয়ে এবং বিধবা নারীর সর্বপ্রকার সাহায্য করো সর্বতোভাবে কর্তব্য। বুদ্ধিমানের ভেবে দেখা উচিত মৃত্যু-গালি একটা খোঁটা নয়। কচি ছেলে-মেয়ে এবং পত্নীর জন্য সর্বপ্রথমে যুবকদের এই চিন্তা করা কর্তব্য। একটা মূলধন, অন্ততপক্ষে একখানি বাড়ি বা দুইখানা ঘর বা কিছু জমি পত্নীর নামে খরিদ করে, শেষে বাহুল্য ব্যয় বা যা ইচ্ছা তা করো। ভবিষ্যতে টাকা জমা করে যা কিছু করা দরকার, করা যাবে, এরূপ চিন্তা কখনো করতে নেই, কিংবা ভবিষ্যতে একটা কিছু সুবিধা হয়ে উঠবে, এরূপ চিন্তা মনে পোষণ না করাই ভালো। সুযোগ-সুবিধা জীবনে মনে করে নেওয়া উচিত। পরের ঘাড়ে মাথা রাখা, পরের অন্নের প্রত্যাশী হওয়ার মতো কষ্ট আর নাই। পরম সহৃদয় নিকট আত্মীয়ের অন্ন গ্রহণ করা যায়, কিন্তু জগতে এরূপলোক দুর্লভ। মনে রেখ, যারা আপন, তারাই অধিক পর।
১ম বন্ধু–সন্তানহীনা নারীর পক্ষে কী টাকা এবং সম্পত্তি করা উচিত?
২য় বন্ধু–হা অনেকে মনে করেন, বিধবা পত্নী আবার বিয়ে করবে; সুতরাং কেন তাকে সম্পত্তির অধিকারিণী করে যাবে? এটি স্বার্থপর মানুষের চিন্তা। পত্নীর পর কি স্বামী মৃত পত্নীর গহনা দ্বিতীয় পত্নীর গায়ে পরায় না? বিয়ে করলেই কি মৃত পত্নীর স্মৃতিকে স্বামী পূজা করে না? বিবাহের অর্থ সঙ্গী গ্রহণ, এ পূর্বেই একদিন বলেছি। যদি স্বামীর মৃত্যুর পর পরী দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করে, তাকে নিজের প্রতি কি অমর্যাদা হয় তা বুঝি না। বিবাহিতা হলেই কি নারী তার পূর্ব স্বামীর স্মৃতি ভুলে যায়?–তাকে ভালবাসে না?–মৃত্যুর পর বালিকা বধূ অথবা তোমার প্রণয়িনী চিরদিন তোমার নামে থাকবে-এরূপ ইচ্ছা করা নিষ্ঠুরের কাজ। যথাসর্বস্বই যে পত্নীর নামে দিতে হবে, তাও বলছি না।
১ম বন্ধু–সকল নারীই যে নিঃসন্তান হন, তার কোনো মানে নাই।
২য় বন্ধু–তা তো ঠিক। যে সমস্ত নারী ছেলে-মেয়েসহ বিধবা হয় তাদের দুর্গতিই বেশি হয়। তারা যেন কখনো পরের ঘাড়ে না চাপে, পরের নিষ্ঠুর অশ্রদ্ধার পাত্র হয়ে জগতে বেঁচে না থাকে; প্রত্যেক বুদ্ধিমান যুবকের এ-বিষয়ে চিন্তা করা উচিত।
১ম বন্ধু–বাপে বেঁচে থাকতে, ছেলে-মেয়ে পত্নীরা নাকি কিছু পায় না?
২য় বন্ধু –হ্যাঁ, সেই জন্যেই পত্নীকে কিছু জমি লিখে-পড়ে দান করে যাওয়া উচিত। এজন্য কোনো শ্বশুরের অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয়, বরং শ্বশুরেরই কর্তব্য, পুত্রকে এ সম্বন্ধে স্নেহের উপদেশ দেন। কাবিনের টাকাটা পরীর নামে কোনো ব্যাঙ্কে রেখে দেওয়াও ভালো; অথবা সে টাকা দিয়ে নিজের নামে কিছু সম্পত্তি ক্রয় করে রাখাও ভালো। নগদ টাকা থাকে না। পত্নীর কাবিনের টাকার প্রতি কোনো স্বামীই যেন লোভ না করে–পত্নীর কাছে তা কখনো না চায়।
শিশুর সহিত আলাপ
২য় বন্ধু বলিলেন-যে শিশুকে শয়তান বলে, সে নিজেই শয়তান। শিশুর সুকোমল নিষ্কলঙ্ক চিত্ত। মানুষই আপন আপন পাপ-হৃদয়ের ছায়া অঙ্কিত করে এবং সব সময়ই তাকে ভর্ৎসনা করে। যখনই দেখবে শিশুর মন্দ হচ্ছে বুঝবে তুমি এবং যারা তার সঙ্গে আসছে, তারাই মন্দ। মানুষ বড় অন্যায় করে নির্দোষ শিশুকে ভর্ৎসনা করে–শিশু পূর্বে জানতো না, পাপ এবং নিষ্ঠুরতা কি? তোমাদের পাপ এবং নিষ্ঠুর মুখ তাদেরকে নিষ্ঠুর করে তোলে। নিষ্ঠুর মুখে দাঁত বের করে কখনো শিশুর দিকে চেয়ো না, তাকে দাঁত ঝাড়িতে দিও না। কেননা, এ শয়তানের কাজ। শিশু নির্মল, সুন্দর, নিষ্পপ–মানুষ তাঁর মতো হতে চেষ্টা করুক। কেন তার নিন্দা করবে? যে পরিবারের লোকেরা নিজে অসাধু, দুর্মতি, কলহপ্রিয়, অপ্রেমিক, পরনিন্দুক এবং শঠ, সে পরিবারের ছেলেরাও দুর্মতি, কলহপ্রিয়, অসাধু ও অপ্রেমিক হয়। শিশুদিগকে ভর্ৎসনা করবার পূর্বে পরিবারের লোকেরা নিজেদের দোষ সংশোধন করুক। যে পরিবারের লোকেরা সৎ, মিষ্টভাষী, ক্ষমাশীল, প্রেমিক সে পরিবারের লোকেরাও উত্তম স্বভাবের হয়। শিশু যদি অবাধ্য হয়, তা হলে বুঝতে হবে, অভিভাকদের চরিত্রবলের অভাব। একটু পরে বললেন-বন্ধু যোগ্য ব্যক্তির নাম অগোচরে ভদ্রভাবে উচ্চারণ করাই ভদ্রতা।
বুড়া বয়স
২য় বন্ধু বলিলেন-বন্ধু, বুড়া বয়সে অনেকের স্বভাব, দিবারাত্র, অধীনস্থদিগকে গালি দেওয়া। অর্থ-সম্পত্তির অহঙ্কারে তারা এরূপ করেন কিনা জানা যায় না। যারা মৃত্যুর শিয়রে দাঁড়িয়ে আছেন, এক পা কবরে দিয়ে বসে আছেন, তাঁদের সকলের সঙ্গে সঙ্গে সন্ধি করে-অধীনস্থদের অশ্রু আর মর্যাদা লাভ করে বিদায় গ্রহণ করাই উচিত। বুড়া বয়সে সংসারের সমস্ত ভার ছেলেদের উপর ছেড়ে দেওয়া ভালো। সাংসারিক কাজ-কর্ম নিয়ে মত্ত থাকা বা দিবারাত্রি জাগতিক বিষয়ে হৈ চৈ করা তাদের শোভা পায় না, দেখতেও ভালো দেখায় না।
১ম বন্ধু–ছেলেরা অর্থ-সম্পত্তি হাতে করে যদি বুড়া বা অভিভাবককে দুঃখ দেয়?
২য় বন্ধু–তা কি সম্ভব? বুড়ার তো সবই। তিনি মাত্র ছোটদের হাতে কাজের ভার দেবেন। ছোটদের দুর্ব্যবহার বা প্রবঞ্চনা দেখলে তো তিনি শাস্তি দিতে পারেন। বুড়াকালে বাজার খরচ, জমাজমি, মোকদ্দমা, ফ্যাসাদ নিয়ে মাথা ঘামানো মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। যে বয়েসে যেটি শোভা পায় তা করা কর্তব্য। বুড়ার পক্ষে এবাদত, ধর্মালোচনা, সজ্জন-সহবাস, এই সবই ভালো। অসদ্ব্যবহারে বাড়িশুদ্ধ মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলা, টাকার তহবিল সময় সময়ে কোমরে চেপে রাখা–এসব দেখতে শোভন নয়,–ওটি তো আজ হোক, কাল হোক ছাড়তেই হবে; মাঝখান থেকে ছোটদের অশ্রদ্ধার পাত্র হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। পরকে নিজের আসনে বসিয়ে, সমস্ত কাজ সুচারুরূপে চলছে–চোখে দেখে ভক্তি ও ভালবাসার অশ্রুর মাঝে বিদায় নেওয়াই ভালো।
১ম বন্ধু–সম্পত্তি কাকে দিয়ে যাওয়া উচিত।
২য় বন্ধু–সম্পত্তি পত্নীর নামে লিখে দেওয়াই ভালো। তবে ছেলেরাই বন্দোবস্ত করবে, ভোগ করবে। অল্পবুদ্ধি বালকদের হাতে টাকা-পয়সা, অর্থ সম্পত্তি পড়লে অতি। অল্পদিনেই শেষ হয়ে যেতে পারে।
খানিকক্ষণ পরে বলিলেন–স্বামী নেবার জন্য আগ্রহ না করলে পত্নী কখনো নিজ ইচ্ছায় স্বামীর কাছে যাবে না।
নমস্যা ও সম্মানিত ব্যক্তি
২য় বন্ধু কহিলেন–কতকগুলি লোক আছে, যারা ডেপুটি, দারোগা দেখে লাফিয়ে পড়ে, দেশের আর কোনো নোক এদের কাছে বরেণ্য নয়! এমনও আছে, যারা জিজ্ঞাসা করে আপনার বেতন কত, কত টাকা মাইনে পান, উপরি কত, উপরি কি-কি পাস করেছেন? কোথায় বিবাহ করেছেন? এরা যে নিম্নস্তরের লোক, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ডেপুটি, মুন্সেফ, উকিল ছাড়া দেশে বহু ভদ্রলোক আছে, যারা বরেণ্য এবং নমস্য। যারা স্বার্থের খাতিরে, দাসের মতো সরকারের সংসবে থাকে, ভালো করে বিবেচনা করে দেখলে এরা মানুষের আন্তরিক শ্রদ্ধার পাত্র মেটেই নয়; কারণ এদের অধিকাংশই মানব প্রেমিক নয়; দেশ সেবা, দুঃখীর, পীড়িতের সেবার উদ্দেশ্যে কাজ করে না। এরা অনেক ক্ষেত্রে দাম্ভিক ও সুদখোর। দেশ-প্রেমিক, মানব-সেবক পতিতজনকে উপেক্ষা করে কখনো স্বার্থের লোভে বা মিথ্যার ভয়ে রাজকর্মচারীদিগকে তোষামোদ করে। না–তাতে আল্লাহ্ নারাজ। বড় পাগড়ি, আমামা, জোব্বা দেখেই তাকে মহামানুষ মনে করো না–মানুষের বাক্য ও কাজ হতেই মানুষের মূল্য নিরুপিত হবে। সাহেবি পোশাক, বড় ঘোড়া, পাল্কি-বেহারা বৃহৎ দালান দেখেই আভূমি নত হয়ে সালাম করো না, কিন্তু রাজকর্মচারী এবং অট্টালিকাবাসী বা অবস্থাসম্পন্ন লোকদের মধ্যে যদি মনুষ্যত্ব দেখতে পাও, জেদের বসে বা গোঁড়ামি করে তার প্রতি অশ্রদ্ধা করো না। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ পরীক্ষায় উপস্থিত হন নাই, তারা অশিক্ষিত এবং নিম্নস্তরের লোক, এ যারা মনে করে তারাই নিম্নস্তরের লোক।
কখনো মনুষের বেতন জিজ্ঞাসা করো না। কোথায় বিবাহ করেছেন এসবও জিজ্ঞাসা করো না। এসব ভদ্র ব্যবহার বলে মনে হয় না। মানুষের সঙ্গে আলাপ কর, কার কি মূল্য তা বুঝতে একটুও বিলম্ব হবে না। মানুষের সাধনা ও পরিশ্রমকে কখনো অমর্যাদা করো না। গুণীর গুণকেও অবহেলা করো না। যেখানেই মনুষ্যত্ব, শক্তি, জ্ঞান ও সাধনা দেখ, সেখানেই নত হয়ে, সম্ভ্রমে স্থির হয়ে দাঁড়াও। অপরে সম্মান করে বলে তুমি সম্মান করো না। যে সম্মানের যোগ্য তাকে সম্মান জানাবে, তুমিই প্রথম স্থান অধিকার করো।
মানব-চিত্ত কত বিচিত্রভাবে কত দীনতার ভিতর দিয়ে মহত্ত্ব ও মঙ্গলের পথে অগ্রসর হতে থাকে তার ইয়ত্তা নাই। পরীক্ষা ও ডিপ্লোমার ভিতরই মানুষের সমস্ত মর্যাদা লুক্কায়িত আছে, এরূপ মনে করা বোকামি বলেই মনে হয়। বন্ধু, মানসিকতা, জগতকে চালিত করে। যার যেমন মানসিকতা সে মানব সমাজে তদনুরূপ স্থান অধিকার করে।
কখনো কাউকে জিজ্ঞাসা করো না–আপনারা? অর্থাৎ তোমরা কি জাতি?–এটা ভদ্রতা বিরুদ্ধ। মানুষ মুখে যাই বলুক, অন্তরে সমস্ত মানুষের মাত্র একটা মহত্ত্ব, গোপন ধর্ম-বিশ্বাস আছে এবং সেইটিই ঠিক।
শয্যাত্যাগ, স্নান, নৈশ আলাপ
২য় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু যুবক-যুবতীর পক্ষে অধিক বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকা কিন্তু অভদ্রতা বলেই মনে হয়। অন্ধকার থাকতে উঠে কিছু ফুল সংগ্রহ করে টেবিলের উপর রাখ, হাতমুখ ধুয়ে প্রার্থনা কর। প্রার্থনা সব সময় আন্তরিক হওয়াই নিয়ম।
১ম বন্ধু–প্রভাতে ধর্মপুস্তক পাঠ কী রকম?
২য় বন্ধু–খুব ভালো, অর্থ অনুভব করে খোদার কালাম পাঠ করা ছাড়া মানবাত্মার উন্নতির আর কোনো পথ নাই। কিন্তু না বুঝে সহস্র বৎসর পাঠ করলেও মনের মতা নষ্ট হয় না-মানবচিত্ত পথের সন্ধান পায় না, অর্থাৎ ছেফায়েত হয় না।
১ম বন্ধু–প্রাতঃকালে স্নান কেমন?
২য় বন্ধু–উত্তমরূপে সর্বশরীরে তেল মেখে, শীত-গ্রীষ্ম সব ঋতুতে ঊষাকালে স্নান করা ভালো। স্নানে ইচ্ছা ও আগ্রহ না হলে না করাই ভালো। কখনো উন্মুক্ত, আলগা স্থানে স্নান নিষধ। ঘরের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য স্নানের স্বতন্ত্র স্থান নির্দিষ্ট থাকা ভালো। বাইরে প্রকাশ্য স্থানে যুবক যুবতী কখনো স্নান করবে না।
১ম বন্ধু–সাবান মাখা কেমন?
২য় বন্ধু–মাঝে মাঝে সাবান মাখা ভালো। কিন্তু ফ্যাশন করে কখনো তেল মাখা ত্যাগ করা ভালো নয়। তেলে পিত্ত শান্তি থাকে, অকালে চুল পাকে না, চর্মের সৌন্দর্য ও মসৃণতা অনেক দিন অক্ষুণ্ণ থাকে।
১ম বন্ধু–প্রাতঃকালে উঠেই সংসারে কাজ আরম্ভ করা কেমন?
২য় বন্ধু–প্রাতঃকালে শয্যা ত্যাগ করে, স্নান, গাত্র মার্জনা, প্রার্থনা প্রভৃতি কাজে কিছু সময় ব্যয় করা আবশ্যক। শুধু দেহের কথা ভাবলে চলবে না। জাগতিক সমস্ত কাজের ভিতর দিয়ে নারী পুরুষ সকলেরই আত্মোন্নতি, দেশের কাজ, সমাজের কাজ, সাহিত্যালোচনা প্রভৃতি কাজে কিছু সময় ব্যয় করতে হবে। খাওয়া এবং অনবরত খাবার আয়োজনে ব্যস্ত থাকা আদর্শ জীবন নয়।
১ম বন্ধু–প্রাতঃকালে উঠে শব্দ কোলাহল করলে অন্যে বিরক্ত হয়।
২য় বন্ধু–ঊষাকালে শয্যা ত্যাগ করে নীরবে সমস্ত কাজ করে যাওয়া উচিত। চিৎকার, সোরশব্দ, কোলাহল, জোরে দরজা ধাক্কা দেওয়া, শব্দের সঙ্গে পা ফেলা এসব ভদ্রতা নয়। যে শুয়ে থাকে থাকুক, তাকে বিরক্ত করো না-কিছু বলল না। গভীর রাত্রে অপরকে বিরক্ত করে উচ্চৈঃস্বরে কোরান পাঠও নিষেধ। তাতে গোনাহ্গার হবার সম্ভাবনা।
১ম বন্ধু–শিশুরাও কি ঊষাকলে শয্যাত্যাগ করবে?
২য় বন্ধু–সকলের পক্ষেই প্রত্যুষে শয্যাত্যাগ উত্তম। ছেলেরা একটু পরে উঠলেও উঠতে পারে। প্রত্যহ তাদের নিয়ে সকালবেলা ডাকাডাকি করার চাইতে একটা ঘণ্টা তৈরি করে নেওয়া মন্দ নয়–ঘণ্টাধ্বনি করলেই তারা জাগবে।
রাত্রিকালে স্বামী যে কোনো সময় শয্যা ত্যাগ করবে, স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে শয্যা ত্যাগ করবে। যে ঘরে স্বামী জেগে আছে, সে ঘরে স্ত্রী কখনো শুয়ে থাকবে না। অজ্ঞাতসারে স্ত্রী যদি ঘুমিয়ে যায়, স্বামীর পদশব্দ পেলে ধড়মড় করে জেগে উঠবে।এতে কষ্টবোধ করা। কোনোমতে উচিত নয়, কারণ প্রেমের যা লক্ষণ তা বলছি। যার কষ্ট হয়, বুঝতে হবে তার চিত্তে প্রেম নেই। প্রেমের স্বাদ সে পায় নাই।
১ম বন্ধু–রাত্রিকালে স্বামী যদি পত্নীর সঙ্গে কথা বলেন?
২য় বন্ধু–নারীর কর্তব্য ঘুম ত্যাগ করে স্বামীর কথার উত্তর দেয়া। কখনো ঘুমে কাতর হয়ে চুপ করে না থাকে।
১ম বন্ধু–স্বামী যখন বাইরে প্রস্রাব করতে যায়, তখন কি সঙ্গে যাওয়া উচিত?
২য় বন্ধু–স্বামী নিষেধ করলে বা অনুরোধ না করলেও সঙ্গে যেতে হবে। যদি ঘুম থেকে না জাগায়, টের পেলেই তার সঙ্গে যেতে হবে এবং তাতে তার কোনোরকম কষ্ট হচ্ছে না, এইরকম ভাব দেখাতে হবে।
১ম বন্ধু–গভীর রাত্রে স্বামী-স্ত্রীতে কথা বলা কেমন?
২য় বন্ধু–তাতে কোনো দোষ নেই। যুবক-যুবতীর ঘর সর্বদা স্বতন্ত্র হবে-যে ঘরে অন্য লোকও শোয়, সেই ঘরে যুবক-যুবতী কখনো শোবে না। যারা পরের ঘরে শোয়, পরাধীন এবং পরমুখাপেক্ষী, তাদের গভীর রাত্রে কথা না বলাই ভালো। ক্রুর মানুষের তাদের প্রেমকে ঈর্ষা করে।
প্রবাসী স্বামী
১ম বন্ধু বলিলেন-স্বামী-স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি হয়ে থাকা, কোনোমতে বৈধ নয়, এ সম্বন্ধে পূর্বে। কিছু বলেছি। শয়তান সর্বদাই মানুষের নিকটে অবস্থান করে। সুযোগ পেলেই সে তার বিষদন্ত মানুষের হৃদপিণ্ডে আমূল বসিয়ে দেয়। স্ত্রী, স্বামীকে সব সময় প্রহরীর মতো সর্বনাশ হতে বাঁচিয়ে রাখবে। এজন্য নারীর সর্বপ্রকার সতর্কতা এবং কৌশল অলম্বন করা আবশ্যক, নারীর অ করতেই হবে। স্বামী কোনোমতে যেন পরীর উপর ক্রুদ্ধ হয়ে না থাকে। ক্রুদ্ধ হওয়া বড়ই দোষের কথা-এতে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে শহরে-বাজারে নারী আপন আপন স্বামী সম্বন্ধে খুবই সতর্ক থাকবে। তবে দিবারাত্র সন্দেহ করা ভালো হবে। শহরে-বাজারে স্বামী একাকী কখনো যেন থিয়েটারে না যায়, এতে স্বামীর চিত্ত অপবিত্র হবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা। সর্বদা ছায়ার মতো স্বামীর সঙ্গে লেগে থাকতে পারলেই ভালো–বিকৃত সমাজ যখন সেটি অনুমোদন করে না, তখন প্রত্যেক চতুরা সুন্দরী নারী–আপন আপন গুণ, ব্যবহার ও প্রণয়-রসে স্বামী-চিত্তকে এরূপভাবে পূর্ণ করে রাখবে, যাতে তারা লজ্জা, ভয় এবং কৃতজ্ঞতায় কখনো অন্য নারীর রূপ চিন্তা না করে, স্বামীর পক্ষে একাকী বহুদিনের জন্য প্রবাসী হওয়া নিরাপদের কথা নয়। তবে পত্নী সর্বদাই পরম অনুরাগ, প্রীতি ও কল্যাণ কামনা করে, স্বামীর কাছে পত্র লিখবেন। সপ্তাহে অন্তত একখানা চিঠি লিখবেন–যাতে তার নিজের ছবি পত্নীর বুকে জাগতে থাকে, তার সুগভীর ভালবাসা সম্বন্ধে স্বামীর মনে সংশয় উপস্থিত হওয়া বড় খারাপ কথা। স্বামী যদি কোনো কারণে পত্র না লেখে বা ক্রুদ্ধ হয় তা হলে আপন ভ্রাতা বা কোনো পরম আত্মীয়কে অবিলম্বে তার কাছে পাঠাবে, কোনোমতে তাকে নিখোঁজ হয়ে থাকতে দিতে নেই। প্রেম অনুরাগে একসঙ্গে দরিদ্র জীবনযাপন উত্তম, দাম্পত্য ধর্ম বিসর্জন দিয়ে বড়লোক হয়ে কোনো লাভ নেই।–তা একেবারেই বৃথা।
।তারপর বলিলেন,-মনুষ্য বিপদে পড়লে অনেকেই তাকে উপদেশ দেয়, উপদেশ না দিয়ে সাহায্য করাই বুদ্ধিমানের কাজ। জগতে মুরুব্বীর অভাব নেই, প্রকৃত সহানুভূতি দেখাবার লোকের অভাব সব সময় সবিনয় দান করা চাই-দানে মুরুব্বীয়ানা কখনো ভালো নয়।
স্বাস্থ্যহীন স্বামী
২য় বন্ধু বলিলেন–বন্ধু কোনো স্বামীর স্বাস্থ্য যদি নষ্ট হয়, সেজন্য ভয়ের কোনো কারণ নেই, আল্লাহ রোগ দিয়েছেন, তার ঔষধ দিয়েছেন। রোগ হলে যে আর তা কোনোকালে সারবে না, এর কোনো মানে নেই।
১ম বন্ধু–নারীর এ সময় কী করা কর্তব্য?
২য় বন্ধু–সংসারের সমস্ত কাজ ত্যাগ করে, স্বামীর সেবা করা কর্তব্য, নিজ হতে স্বামীর ঔষধের ব্যবস্থা করে দেবে। ঔষধ সম্বন্ধে পীড়িতের উপর কখনো নির্ভর করতে নেই–ওটি নিজেকে সব সময় করতে হবে। পীড়িত মানুষ শিশুর মতোই জ্ঞানশূন্য হয়, তখন তাকে জননীর স্নেহে পালন করতে হবে, রোগীর উপর রাগ করলে বা নির্ভর করলে চলবে না।
১ম বন্ধু –হ্যাঁ, চাই বই কি! ডাক্তারকে যেভাবে চলতে বলেন, যে উপদেশ দেন, সেই অনুসারে চললেই যথেষ্ট হবে। আনাড়ী ডাক্তারকে পরিহার করে চলাই ভালো। সহৃদয়-বিচক্ষণ দয়ালু চিকিৎসকের উপর রোগীর জীবন-মরণ নির্ভর করে। জ্ঞানশূন্য অর্থলোভী, বাক্যবাগীশ ডাক্তারকে কখনো বিশ্বাস করতে নেই।
১ম বন্ধু–রোগ সম্বন্ধে কী ব্যবস্থা?
২য় বন্ধু–ছোঁয়াচে রোগ সম্বন্ধে ডাক্তার যে ব্যবস্থা দেন, তাই মেনে চলতে হবে। রোগীদের ফেলে প্রাণভয়ে পলায়ন করা মহাপাতকীর কাজ।
খোদার কাজ আশ্চর্য! যে ভয় করে, সেই মরে। যে মরতে চায়, সেই বাঁচে। তাবে জোর করে ছোঁয়াচে রোগকে উপেক্ষা না করাই ভালো। যে সমস্ত নিয়ম মোটামুটি তা পালন করতে হবে-ডাক্তারের ব্যবস্থা মত সেইগুলি পালন করলেই যথেষ্ট হবে। যে সমস্ত নারী স্বামীকে বিপন্ন দেখে প্রাণভয়ে পলায়ন করে বুঝতে হবে, তাদের প্রাণে এক বিন্দুও প্রেম নেই, তারা ঝগড়ায় ওস্তাদ সুখের সাথী। এরূপ নারীকে পত্নী না করাই ভালো। পীড়িত স্বামীর শয্যাপার্শ্বে নাক ডেকে ঘুমানো ঠিক নয়। অনবরত ডাকাডাকিতে উত্তর না দেওয়া ভালো নয়। সেবা কার্যে বাড়িতে একজনের উপর ভার না দিয়ে পালা করে রাত্রি জাগাই ভালো। ছোঁয়াচে রোগীর ঘরে না শুয়ে ঘরের বারান্দায় শোয়া ভালো। কিন্তু জেগে। বসে থাকলে বিছানার কিছু নিকটে থাকাই নিয়ম। স্মরণ রেখো অত্যধিক মরণ ভয় কোনোমতে ভালো নয়।
সাময়িক বিবাহ
২য় বন্ধু বলিলেন–কোনো কোনো ব্যক্তি বাড়িতে বিবাহিত বিবি রেখে বিদেশে কিছুদিনের জন্য একটা স্ত্রীলোক বিবাহ করে, সেস্থান ত্যাগ করবার সময় বালিকাটিকে ত্যাগ করে, অনেকে সেইখানেই থাকে, ঘরের বিবির সঙ্গে আর কোনোকালে সাক্ষাৎ করে না। এরা কেউ কেউ নগণ্য লোক, বলতে কী এরা যাই হোক, এরা যে মহা পাতকী এবং দুরাচার সে বিষয়ে অর সন্দেহ নাই। কিছুদিনের জন্য বিবাহ করা এবং ত্যাগ করে আসা মহাপাপীর কাজ। নারী দেহকে নিয়ে এই তামাসা করা মানুষের কাজ নয়।
১ম বন্ধু–এরা কেন এমন করে?
২য় বন্ধু–হয়তো বিদেশে একা একা থাকতে পারে না, মন কুপথে ধাবিত হয়, তাই কিছুদিনের জন্য একটা নারীকে বিবাহের নামে রক্ষিতা করে রাখে।
১ম বন্ধু–ঘরের বৌ এনে রাখলেই হয়।
২য় বন্ধু–হয়তো পিতামাতা পাঠাচ্ছে না। কিংবা পত্নীর সঙ্গে মনোমালিন্য হয়, পত্নী হয়ত বিদেশে থাকতে চায় না। অথবা পত্নীকে ভদ্রভাবে রাখবার খরচে কুলোয় না।
১ম বন্ধু–বড় ঘৃণার কথা!
২য় বন্ধু–হ্যাঁ, ঘৃণার কথা, লজ্জার কথা। তারা বিদেশে নিজেদের চিত্তের তৃপ্তির জন্য একটা নারীকে পত্নীরূপে ব্যবহার করেন, তাদের বৌ যদি বাড়িতে একটা পুরুষকে স্বামীরূপে কলেমা সিদ্ধ করে, তা হলে কেমন হয়! পিতামাতা যদি পুত্র ও বধূর এক জায়গায় থাকবার পথে বাধা দেন, তা হলে সেটা দোষের কথাই বলতে হবে। একস্থানে না থাকলেই অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত। স্বামী-স্ত্রীতে মনোমালিন্য কত বড় দোষের কথা তা। পূর্বেই বলেছি।-এ হচ্ছে বিবাহিতদের অমার্জনীয় অপরাধ, বরং এদের বিবাহিত না হওয়াই উচিত ছিল। যেখানেই মানোমালিন্য-কলহ সেইখানেই বুঝতে হবে বিবাহ ভঙ্গ হয়েছে। যদি কোনো সময় কোনোরকমে মনোমালিন্যের কথা হয়, তবে তা যত শীঘ্র সম্ভব রোধ করতে হবে, নইলে সময় মতো তাদের বিচ্ছেদ বাঞ্ছনীয়। কোনো কোনো নারীর স্বামী স্ত্রীকে ভালবাসে না, অথচ বিদেশে স্বামীর সঙ্গে যেতে চায়, এদেরও অপরাধ গুরুতর।
যে বিবাহিতা হয়েছে, সে পত্নীর ভরণপোষণ সংগ্রহ করতে পারবে না। এরূপ শঙ্কা করা নিতান্তই কাপুরুষতা। ভয়ের কোনো কারণ নেই। নারী পুরুষ কখনও ভীত হয়ে একজন আর একজনকে ত্যাগ না করুক। নিজের দীনতাকে ঢেকে পত্নীর দাম্পত্য জীবনের দাবিকে উপেক্ষা করে, সমাজের কাছে মর্যাদা বজায় রাখবার কোনো দরকার নেই।
১ম বন্ধু–যদি পত্নীকে বিদেশে রাখবার বাস্তবিক ক্ষমতা না হয়ে ওঠে, তা হলে কী করা উচিত?
২য় বন্ধু–সে স্থান ত্যাগ করা উচিত। চাকরির ভরসা না করাই উচিত। চাকরি আজ আছে কাল নেই। ছোট চাকরির উপর ভরসা করে স্ত্রী-পুত্রের ভার মাথায় নিলে রাত্রে ঘুম হয় না, চোখে পানি আসে, ওর চাইতে মজুরেরা ভালো। মজুরের পয়সা খোদা দেয়, চাকরির পয়সা মানুষ দেয়।
অবস্থা নিতান্ত শোচনীয় হলে দশদিক অন্ধকার হয়ে উঠলেও স্বামী-স্ত্রী একজন আর একজনকে ত্যাগ করো না, কখনো নিজের স্থান ত্যাগ করে পিতামাতা বা শ্বশুর শাশুড়ীর আশ্রয় নিও না। কোনো ভয় নেই, ঠিক হয়ে যেখানে আছে, সেইখানেই একজন আর একজনকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকবলেছি তো, নারী-পুরুষের ভাগ্য এক সঙ্গে গ্রথিত হলেই আল্লাহর দায় তথায় এসে উপস্থিত হয়।
সোহাগ ও প্রেমের শক্তি
২য় বন্ধু বলিলেন-স্বামীর গাম্ভীর্য রক্ষা সম্বন্ধে বলেছি, এখন নারীর হাব-ভাব সম্বন্ধে বলি। নারীচরিত্রে কতগুলি বিশেষত্ব আছে, তাকে বলে ‘ঠ্যাকার’। কথাটি শুনতে অপ্রীতিকর হলেও এর মূল্য খুব বেশি। যে নারী ঠ্যাকার জানে না, স্বামীকে নানা প্রকার প্রেমনিবেদনে মুগ্ধ করতে জানে না; তার বার আনা সৌন্দর্য ব্যর্থ হয়ে যায়। নারী বেহায়া সোহাগে (?) স্বামীকে আদার জানাবে। হেসো না, নারী-জীবনের পক্ষে গুরতর সত্য প্রকাশ করছি, সে স্বামীর কণ্ঠ বেষ্টন করে চুম্বন করে, প্রেমের বাচালতা দিয়ে স্বামীর চিত্ত হরণ করবে। সতী। নারীর এই-ই ভালো–অসতী নারীর প্রেম, সোহাগ অবৈধ, তাকে ঘৃণায় লোকে ছেনালী বলে। অসতী নারীর সম্বন্ধে ছেনালী, সতী নারীর পক্ষে তা শোভা-সৌন্দর্য। স্বামী। ছেলেমানুষ অল্পবুদ্ধি পত্নী সম্বন্ধে গাম্ভীর্য নারীর পক্ষে গুরুতর ভয়ের কথা। পুরুষের প্রেমনিবেদন, আদর, হাসি, সোহাগ, প্রেম চুম্বন অতিশয় শ্রদ্ধা ও আনন্দের সঙ্গে বধূরা গ্রহণ করবে। স্বামীর গাম্ভীর্যে সে ভীত হবে, স্বামী যত শিশুর মতো সরল, পত্নীর কাছে যত ছ্যাবলাম হয়, ততই ভালো। স্বামী দার্শনিক পণ্ডিতের মতো পত্নীর সামনে বসে থাকুক।-পত্নীর যেন তা অন্তত নিজের গোপন কক্ষে মোটেই পছন্দ না করেন।
স্বামী যদি বাইরে যান, পত্নী তার জন্যে অপেক্ষা করবে। স্বামীর কণ্ঠস্বর শুনলে এগিয়ে যাবে। হাতে জিনিসপত্র থাকলে আপন হাতে গ্রহণ করবে। লোকজন না থাকলে তার কণ্ঠ বাহুবদ্ধ করবে, প্রেম নিবেদন ও সুযোগ পেলেই স্বামীকে চুম্বন করবে। চুম্বন জিনিসটা অতিশয় পবিত্র, অন্তরের গভীর প্রেমের প্রকাশ চুম্বনের দ্বারাই হয়–মাতা পুত্রকে, পুত্র কন্যাকে, শ্রদ্ধাভাজনদিগকে চুম্বন করে, অন্তরের ভালবাসার পরিচয় দেওয়া যায়।
নারীকে বলি,-স্বামীকে যতক্ষণ না প্রেমে তরল করতে সমর্থ হও, ততক্ষণ ছেড় না। প্রেম অভিনয়ে, প্রেমের নিবেদনে কখনো ক্লান্ত হয়ো না, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত চেষ্টা কর, কখনো আশা শূন্য হয়ো না। যেমন উপকূল ভাঙ্গে তেমনি যথার্থ প্রেমের আহ্বান করে সাধ্য নাই উপহাস করে। উপকূল ভেঙ্গে পানির সঙ্গে গেলে মিশে যাবেই। তাই বলি নারী কখনো হতাশ না হোক, সে তার স্বামীকে কোনোমতেই না ছাড়ুক। অভিমান ত্যাগ করলেই বিপদ হবে। সতী নারীর যথার্থ প্রেমের ডাকে পুরুষেরা দুর্বল হবেই। প্রেমের শক্তি ব্যর্থ হবার নয়। ভক্তের সম্মুখে আল্লাহতালা যেমন দুর্বল, প্রেমিকা নারীর সম্মুখে স্বামীও তেমনি দুর্বল। খোদাকে যেমন কোনো অবস্থায় ত্যাগ করতে নেই, আপন আপন স্বামীকেও তেমনি মেয়েরা কোনো অবস্থায় ত্যাগ না করুক।
নারী যদি অতিশয় বিদূষী হয়, স্বামী যদি অসভ্য বা মূর্খ হয়-নারী তাকে অতিশয় যত্ন করবে, যেহেতু পুরুষ, নারীর জীবন ও নিজের জীবনের জন্যে আদর করতে হবে,–পুরুষকে ত্যাগ করে, নারীর বেঁচে থাকা অসম্ভব।
পিতামাতার দুরাশা
২য় বন্ধু কহিলেন, কোন কোন পিতামাতা মনে দুরাশা পোষণ করে। পুত্র বড় হয়ে ভাড়ে ভাড়ে টাকা আনবে। চুরি করে আনুক, মানুষের মাথায় বাড়ি দিয়ে আনুক, সেদিকে তারা লক্ষ্য রাখে না। যে সমস্ত পুত্র ভয়ানক অধর্মচারী, মানুষকে অত্যাচার করে, মনুষ্যত্বের অমর্যাদা করে টাকা উপায় করে, তাদিগকে এরা প্রাণভরে আশীর্বাদ করে। তারা যে হীন ও স্বার্থপর পিতা-মাতা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
পুত্র মানুষ হয়ে, দেশপ্রেমিক, মানব-সেবক, সাহিত্যিক-পণ্ডিত হোক, এ ইচ্ছা তারা করেন না। তারা কেবল বোঝে, টাকা। পুত্রকে কখনও মানুষ হতে উপদেশ দেয় না, লজ্জার খাতিরে সদুপদেশ দিলেও তারা প্রাণ থেকে কখনও সাধু হতে বলে না। বেশ্যা নারী যেমন সতী কন্যা চায় না, তারা তেমনি সাধু, চরিত্রবান, জ্ঞানী পুত্র চায় না।
১ম বন্ধু–টাকা কি জগতে দরকার নেই?
২য় বন্ধু–হ্যাঁ, আছে। কিন্তু অল্পে তাদের তৃপ্তি নেই। ভাড়ে ভাড়ে টাকা চাই। দালান-কোঠা, জমিদারী, হসব-ননসব, মানুষের সঙ্গে মোকদ্দমা প্রভৃতি বহুবিধ কার্যে এদের টাকা দরকার।
১ম বন্ধু–হ্যাঁ, বড়ই দুঃখের বিষয়। এরূপ ক্ষেত্রে কি করা যায়?
২য় বন্ধু–এসব ক্ষেত্রে পিতামাতার কথা মোটেই শুনতে হবে না। তাতে জীবনে যে দুঃখ আসে আসুক।-তাতে জীবনে ক্ষতি সহ্য করতে হয়, সেজন্য দুঃখ করবার কিছু নেই। এররূ ক্ষেত্রে কঠিন চরিত্রবল আবশ্যক। জগতের পনেরো আনা লোক দুর্বল হয়ে পড়ে, পিতৃমাতৃভক্তির নামে তারা অভিনয় করে।
১ম বন্ধু–পিতা-মাতার সঙ্গে বিরোধ করে কি জীবনের সাধনা স্থির রাখা যায়? ২য় বন্ধু–যে সত্যের নিমন্ত্রণ পেয়েছে, তাকে কোনো বাধাই দমাতে পারে না।
১ম বন্ধু–পিতামাতা যদি পুত্রের মনুষ্যত্ব ও সাধনায় বাধা দেয়, তবে তা বড়ই দুঃখের বিষয়।
২য় বন্ধু আমাদের এই পতিত অবস্থা দেখে, মানব-চিত্তের উন্নততর অবস্থা সম্বন্ধে কেউ জ্ঞাত নন। অধিকাংশ বাপ-মায়ের আকাঙ্ক্ষা জাগতিক সুখ; অন্ন-বস্ত্র, সমাজে মান সম্মান, লোকের প্রশংসা এ ছাড়া জীবনে আর ও একটা বৃহৎ অবস্থা আছে, তা এদেশের অধিকাংশ লোক জানে না। যে শিক্ষা মানুষকে অবোধ করে রাখে, সে শিক্ষা শিক্ষাই নয়। পিতামাতার কাজ ছেলেমেয়ের জ্ঞান-চক্ষু খুলে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। ছেলেদের প্রতি বাপ-মায়ের এটি অবশ্য কর্তব্য কাজ। বাপ-মাকে সাহায্য করাও মনুষ্যত্ব, কিন্তু বাপ মায়ের পাপের সহায়তা করবার জন্যে বা তাদের অন্যায় মিথ্যা কথা বলবার জন্য যদি কেউ মনুষ্যত্ব বিসর্জন দেয়, সে নিতান্ত মূর্খ।
সদানুষ্ঠান
২য় বন্ধু বলিলেন-বন্ধু, সদানুষ্ঠানে টাকা দান করতে হবে। এই কারণেই মানুষকে জীবনে পরিশ্রম করতে হয়–অর্থ চিন্তায় ব্যস্ত হতে হয়। নিজের জন্য মানুষের অতিঅল্পই প্রয়োজন। নিজের অভাবও অল্প।
১ম বন্ধু–আমি তো দেখি মানুষ নিজের চিন্তাতেই ব্যস্ত। মানুষ যতই বড়লোক হয়;কিছুতেই তার অভাব মোচে না, সবই তার বিরাট উদরের জন্য অপ্রচুর।
২য় বন্ধু–বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, আশ্রম নির্মাণ, রোগীর আশ্রম, কুষ্ঠ আশ্রম, পীড়িত ও দুস্থের জন্য জ্ঞান প্রচার, আল্লাহর রাজ্য বিস্তার প্রভৃতি কার্যে টাকা দিতে হবে। এরই নাম এবাদত বা উপাসনা। মসজিদ ঘরে কাপড়ে দেহ ঢেকে এবাদত করা সহজ, কিন্তু ধর্মযুদ্দ করা বড় কঠিন। শরীর দিয়ে, অর্থ দিয়ে, ত্যাগ ও দুঃখের দ্বারা আত্মার এবাদত বড় শক্ত কথা–এইগুলিই যথার্থ এবাদত; আবৃত্তি প্রকৃত এবাদত নয়।
১ম বন্ধু তুমি যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে একাকী চুপ করে থাক, আল্লাহর এবাদত কর?
২য় বন্ধু–হ্যাঁ, তা করি।-একথাটি আর কাউকে বলো না। এ হচ্ছে ভক্তের ভাব! এতে কোনো পুণ্য নাই, এর দ্বারা সুফী আল্লাহর কাছে দাবিও করে না। এই যে এবাদত, এ হচ্ছে জীবন্ত, পরম সত্য প্রেমময় নিত্য মহীয়ান আল্লাহর কাছে আর্তনাদ, ক্ষমা, ভিক্ষা, আর কিছু নয়। এর দ্বারা যে স্বর্গে যেতে চায়, যে নিজেকে সাধু মনে করে, নিজের কর্তব্য শেষ হয়েছে বলে বিশ্বাস করে–সে ভক্ত।
১ম বন্ধু–যার অবস্থায় কুলায় না, সে কী করে দান করবে?
২য় বন্ধু–দরিদ্রের সামান্য দান, মহতের বিপুল দান অপেক্ষা উত্তম। একজনের দানে খোদার কোনো কাজ হয় না, কোনো মঙ্গল সাধিত হয় না। অল্প অল্প করে, বহু মানুষ কিছু কিছু দান করলে একটা মহৎ কার্য সাধিত হয়। যার যতটুক সাধ্য তাই দাও। ক্ষমতার অধিক দান করার প্রয়োজন নাই, কিন্তু দান করতে হবে, দানে যে কৃপণতা, অসন্তোষ এবং বিরক্তি প্রকাশ করে, তাকে ধার্মিক লোক বলে মনে হয় না।
১ম বন্ধু–দানের টাকা মানুষ অনেক সময় চুরি করে।
২য় বন্ধু–তা করুক। যথাসম্ভব সতর্ক হও। কিন্তু তবুও বালক-বৃদ্ধ যুবক-যুবতী, স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকেই দান করে। দান খুব সামান্য এবং অনেক ব্যয় করা ভালো, এতে কারো কোনো কষ্ট হয় না, কিন্তু কাজ হয় ভালো।
অভিমানী নারী
২য় বন্ধু বলিলেন–বন্ধু নারী উচ্চ শিক্ষিতা না হলে, তার মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ প্রকাশ না . হলে, কখনো প্রেমের ভাষা দিয়ে সোহাগ করো না।
১ম বন্ধু–এই যেমন বলা–’সোনামণি’ ‘যাদু চাঁদ’।
২য় বন্ধু–এসব কখনো বলো না নিজের গাম্ভীর্য রক্ষা করে চলবে। সময় অসময়ে কখনো তার কাছে প্রেম ভিক্ষা করবে না। এর শেষ ফল খুব খারাপ। দিনে দিনে পত্নীর স্বভাব খুব ভালো করে বুঝে যতটা দরকার ততটা ধরা দিও, তার বেশি নয়। করলেই নারী অভিমানী হবে, জীবনের অসুখ বেড়ে উঠবে। নিজের গরজে নারী ধরা দেয়–কারো কথায় নয়। নারীর অভাব ও পিপাসায় অপেক্ষা করে, তাকে প্রেম জানাতে যেয়ো না। শিক্ষিতা ও মার্জিত-হৃদয় নারী সম্বন্ধে বিশেষ কোনো সতর্কতা অবলম্বন করবার কোনো দরকার নেই।
১ম বন্ধু–মনের ভিতর আবেগ, প্রেমের উচ্ছ্বাস এ-সব চেপে রাখতে কি কষ্ট হয় না?
২য় বন্ধু–হা হয় বই কি!
১ম বন্ধু–তুমি এ-সব নিগূঢ় কথা কী করে অনুভব কর?
২য় বন্ধু–কী করে অনুভব করি, তা জানি না। নারীর সঙ্গ লাভ করি নি বলে অমান্য করো না। যা বলছিলাম, আজকালকার যুবকদের সৌন্দর্যবোধ অতি তীক্ষ্ণ, বিভিন্ন ভাষার কবি, সাহিত্যেকেরা সৌন্দর্য অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাদের প্রাণ নূতন রকমে গড়ে উঠেছে, তারা বিচিত্রভাবে নারীকে দেখতে চান, পেতে চান। একটা জড়মাংসপিণ্ড, আর তার ক্ষুধাকে নিবৃত্ত করতে পারে না। শিক্ষার অভাবে আমাদের মেয়েরা পুরুষের কাছে ধরা দিতে চান না। পদে পদে তারা স্বামী-চিত্তে বিষ উৎপাদন করেন, নিজেকে অসুখী করে তোলেন।
১ম বন্ধু–পুরুষ নারীকে ধরা দেবে না কেন, তা তো বললে না?
২য় বন্ধু–যে দান করে, সে প্রতিদান পেতে চায়। এ-যুগে সমাজের মেয়েদের দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তারা সমাজের অভিভাবকদের দোষে স্বামী চিত্তকে মুগ্ধ করতে জানেন না–বুদ্ধিমান স্বামী অবোধ পত্নীর কাছে বেশি ধরা দেবে না–কারণ তার ঋণ শোধ দেবার কোন যোগ্যতা নাই। সে বড় নিঃসহায়, তার অবস্থা বড় শোচনীয়। –একটু পরে বলিলেন : কেউ কথা বলতে থাকলে তার মধ্যে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করো না। দু’জন লোক দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, তাদের কাছে অপ্রয়োজনে যেয়ো না।
নারীর আবদার
২য় বন্ধু বলিলেন-বন্ধু সতী নারী কখনো স্বামীকে, কাপড়, বস্ত্র, অলঙ্কারের কথা বলবে না। কাপড় ছিঁড়ে গিয়েছে, টুকরা করা হয়ে গিয়েছে, সে একেবারই মৌন হয়ে তাকে;–কখনো সে দিবারত্রি নিজের অভাবের জন্য ঘ্যানর ঘ্যানর করবে না।
১ম বন্ধু–নারীর কি অভাব নাই, তার কি কিছুই আবশ্যকতা নাই?
২য় বন্ধু–হ্যাঁ আছে-ভক্ত খোদাতে যে সম্বন্ধ, আদর্শ দম্পতির মধ্যে ঠিক সেই সম্বন্ধ। মানুষ স্বামী-স্ত্রী, নারী-পুরুষের সম্বন্ধ ঠিক অনুভব করতে পারে না। প্রেমিক ও প্রেমিকার মধ্যে যে মহা সম্বন্ধ, তা মনুষ্যের ভাষায় ব্যক্ত হবে না। অন্ন, বস্ত্র ও অলঙ্কারে স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধ নির্ণীত হবে না। স্বামী এবং স্ত্রী পরস্পর পরস্পরকে অনুভব করবার এবং পরস্পরের সাধনা জীবন ব্যাপী–এ এক তপস্যা। উভয়ের মর্যাদা ও অর্থ নরনারী অনুভব করে না বলেই জগতে অশান্তি এবং কলহ উপস্থিত হয়। স্বামী-স্ত্রী নিজেদের জীবনের গুরুত্ব এবং অর্থ অনুভব করতে চেষ্টা করুক। এ সম্বন্ধে বাইরে কোনো লোক কিছু বলতে পারবে না।
১ম বন্ধু–কোনো কোনো নারী স্বামীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে।
২য় বন্ধু–এই সমস্ত নারী স্বামী চায় না-স্বামীর মর্যাদা, নিজের জীবনের গুরুত্ব এবং অর্থ অনুভব করে না। তারা শুধু অন্ন-বস্ত্র ও অলঙ্কার চায়। তারা নিকৃষ্ট প্রাণীর নারী।এরা স্বামীকে প্রেম করে না। এদের চিত্তে কোনো ভাব নাই–নিতান্ত কাজের মতো করেই সংসার করে। ওযে চিত্ত প্রেমের পরশ পায় নাই, তার সঙ্গ আত্মার পক্ষে ক্লান্তিদায়ক।
১ম বন্ধু–ঘরের নারী যদি অনবরত প্রাণহীন আবদার করতে থাকে, তাহলে কি করা যায়?
২য় বন্ধু–এ অবস্থায় কি যে করতে হবে, তা জানি না। সদ্ব্যবহার বিনয়, মধুর ব্যবহার–একটু সংযম, পরীর মনের উন্নতির চেষ্টা এবং তার জন্যে আল্লাহ-তালার কাছে নীরবে গোপন প্রার্থনা উত্তম। অবোধ, অত্যাচারী পত্নীকে কখনো গালি দেবে না। কোনো। কুবাক্যও বলো না। বাড়ির কাছে এমন কি এ-ঘর ও-ঘর হলেও স্বামীর গৃহ ত্যাগ করে। যখন-তখন বাপের বাড়ি বা মায়ের কাছে যাবে না, এটা বধূর পক্ষে বড়ই দোষের কথা।
কিছুক্ষণ পরে বলিলেন : কখনো হক কথা বলতে ভীত হয়ো না, তাতে প্রাণ যায়, আর থাকে তাই ভালো; অন্যায় সংযমহীন ক্রুদ্ধ বাক্যালাপ ভালো নয়।
লৌকিকতা
২য় বন্ধু বলিলেন-বন্ধু, মুচির মতো নিজের ছেলেমেয়ে নিয়ে বাস করা বধূর পক্ষে কোনোমতে শোভা পায়। পাঁচটা নিয়ে বাস করতে হয়, সবার মন রক্ষা করে চলতে হবে। প্রয়োজন হলে পরের ছেলেকে কোলে নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে একটা চুমা খেতে হবে, একটু সোহাগ করতে হবে। পাড়াপ্রতিবেশীকে দু’টি পান দিতে হবে। কুটুম্ব-সাক্ষাৎ পরিচিতজনকে খাতির করতে হবে, অতিথি ফকিরকে দুটি ভাত দিতে হবে। মানুষের মধ্যে বাস করতে হয়। বধূ বড় মানুষের বৌ হোক বা দরিদ্রের বৌ হোক, তাকে লৌকিকতা বজায় রাখতে হবে। বাড়িতে ভালো মাছ এসেছে, তার দু’খানা পার্শ্বে যারা আছেন, তাহাদেরকে বৌরা দেবে। উৎসবের সময় নিজের ছেলের হাতে দু’টি পয়সা দিয়ে, বাড়ির ভৃত্যটির হাতেও কিছু দিতে হবে। নিজের ছেলেকে বস্ত্রে সুসজ্জিত করলেই চলবে না। যারা নির্ভরশীল এবং আশ্রিত তাদেরকেও দেওয়া চাই। যারা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন তাদেরকে কিছু দিতে হলে খুব সম্ভ্রমের সঙ্গেই নিবেদন করতে হবে।
পাঁচজনকে আদর-যত্ন করা, পাঁচজন নিয়ে বসত করা, গম্ভীর, সুনিপুণা, বুদ্ধিমতী, মানসিক বরসম্পন্না গৃহিণীর কাজ। হালকা-ছ্যাবলা, ক্রোধী বউরা তা পারে না। ভারি ভক্ত, বুদ্ধিমতী গৃহিণীকেও সময়ে দুটি কথা শুনতে হয়, সময়ে দুটি ভর্ৎসনাও করতে হয়। ক্রুদ্ধ হওয়া, মনের বল হারিয়ে কেঁদে-কেটে অস্থির হওয়া–ছেলে মানুষের কাজ। পাকা ওস্তাদ গৃহিণী কখনো মনের বল হারাবে না, হঠাৎ ক্রুদ্ধ হবে না, বা হঠাৎ কেঁদেও অস্থির হবে না।
মেয়েরা বিপদে-সম্পদে হঠাৎ অস্থির হয়ে পড়ে, সেটি স্বভাবের দুর্বলতা ছাড়া আর কিছু নয়।
মেয়েরা কখনো নিঃসম্বল খালি হাত করবে না, স্বামীর কাছ থেকে মাঝে মাঝে কিছু ব্যক্তিগত খরচ আদায় করে নেবে-স্বামীরাও আপন আপন পত্নীকে মাঝে মাঝে কিছু কিছু দিবেন, সে পয়সা সম্বন্ধে স্বামী কোনো সময় কোনো কথা জিজ্ঞসা করবে না।
হাতের পয়সা যেন-তেন প্রকারে উড়িয়ে দেওয়া মেয়েদের পক্ষে ভালো নয়। জমা করে কোনো একখানা ভালো গহনা করা, বা একবারে জমা করে রাখা ভালো।
সহিষ্ণুতা
২য় বন্ধু বলিলেন–অসহিষ্ণুতা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পক্ষে গুরুতর অপরাধ। জীবনে কোনো কাজেই অসহিষ্ণু হওয়া ভালো নয়-এর ফল বড় খারাপ। যতই তাড়াতাড়ি করবে, ততই কাজ পিছিয়ে পড়বে, স্বামী-স্ত্রী দুজনারই যেন এ কথা মনে থাকে। মনে কোনো চিন্তা জেগেছে, অমনি অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে, অসহিষ্ণু হয়ে সেদিকে ঝাঁপিয়ে পড়া ঠিক নয়। যারা অসহিষ্ণু, তারা শয়তানের বন্ধু। এ জগৎ পর জগৎ সর্বত্রই তাদের জন্য বিড়ম্বনা।
১ম বন্ধু–শুভস্য শীঘ্রং কথাটির অর্থ কী?
২য় বন্ধু–প্রকৃত শুভ কি না, তা সহিষ্ণু হয়ে ভেবে দেখতে হবে।
১ম বন্ধু–অতিশয় ধীরতা কি ভালো?
২য় বন্ধু–মনেই বুঝতে পারা যায়, কোন কাজটি অন্যায় রকমে তাড়াতাড়ি করা হচ্ছে, কোন কাজটিতে ঢিলেমির পরিচয় দেওয়া হচ্ছে। রেলে সময় মতো যেয়ে উপস্থিত হতে হবে, সময় খুব অল্প, তখন ধীরে ধীরে হাঁটা কোনো রকমে বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তখন একটু হিসাব করেই চলতে হবে। বিদেশে কারো অসুখ, দু’তিন দিন বসে বসে চিন্তা করা পাগলের কাজ।
১ম বন্ধু–তা তো ঠিক।
২য় বন্ধু–ব্যবসার ব্যাপার জীবনের প্রতিষ্ঠায় ৬ গতিক দুরবস্থার ধৈর্য ধারণ করতে হয়। দুঃখ সহিষ্ণু হয়ে বহন করতে হবে, যতই মন বিদ্রোহী হবে ততই দুঃখ বেড়ে উঠবে। মানুষ কখনো বড় লোক হয় না, যতক্ষণ না সময় হয়! সুতরাং নীরব সহিষ্ণুতায় জীবনের সমস্ত অবস্থাকে স্বীকার করে চলাই বুদ্ধিমান দম্পতির কাজ। দুঃখের ভিতর আলোকের অপেক্ষা কর, আপন আপন অবস্থায় সন্তুষ্ট থেকে আল্লাহকে শোকর জানাও এবং জীবনের কর্তব্য করে যাও–প্রত্যেক দিনের চিন্তা দিনের জন্যই যথেষ্ট। বর্তমানকেই সুখের সময় মনে কর, অতীতের দুঃখ বা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা পোষণ করে জীবনের শান্তি নষ্ট করো না। কথা শেষ করিয়া কহিলেন–বন্ধু এ-জগতে দুঃখ-ব্যথা নিবেদনে কোনো কাজ হয় না। নিজের দাবিতে বেঁচে থাকতে চেষ্টা কর। একটা সামান্য তৃণ এ-জগতে অনাবশ্যক নয়। মানুষের জীবনে মূল্য আছে–দয়ায় মানুষ বাঁচে না, মানুষ বাঁচে নিজের মূল্যে। কখনো ভয়ও নিরাশায় পড়িয়া মানুষের কাছে কৃপা প্রার্থী হয়ো না–ভেঙ্গে পড়ো না। তাতে নিজের মূল্য কমে যায়। অবশ্য দাবি ন্যায় হলেও সাবধান হওয়া উচিত।
গৃহ
২য় বন্ধু বলিলেন-বন্ধু, মানুষ যেখানেই থাকুক, তা একটা স্থায়ী নির্দিষ্ট গৃহ থাকবেই। যার কোনো পরিবর্তন হবে না। পৃথিবীর আর এক প্রান্তে যাও-ক্ষতি নাই; জীবন শেষে যেন সেই আবাসস্থলে একটু শান্তি লাভ করতে পার কখনো গৃহহীন হয়ো না–পরিবারের প্রত্যেকেহ যেন গৃহকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে পার, পিরবারের কাউকে বলো না–দূর হও, চলে যাও। এক পরিবারে যারা জন্মেছে, তাদের প্রত্যেকের গৃহের স্নেহের দাবি আছে। যদি দাস-দাসী কোনো পরিবারে বহুদিন থাকে, তারও পরিবারের মাটির উপর দাবি জন্মে যায়–তারও ঠাঁই দিতে হবে। কোনো শর্তে পরিবারে কাউকে দূর করে দিও না–এটি বড়ই অন্যায়। কন্যাদের বিয়ে হয়ে গেলেও বাপের বাড়িতে বিলক্ষণ দাবি থাকে। বৎসরে বাপের বাড়িতে তারা একবার আসবে। বৃদ্ধকালেও যেন ছেলেবেলার মতো বাপের বাড়ি এসে, স্বাধীন উল্লাসে কয়েক দিন কাটাবে। কখনো নারীর এই দাবিকে উপেক্ষা করো না–বড়ই অন্যায়। যদি নারীর স্বামী এবং ছেলেমেয়ের পিতার সংসারে ভালো হয়–তাহলে অন্তত তাকে একা কিছুদিন বাপের বাড়িতে থাকবার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। স্বামীকে ত্যাগ করে হরদম বাপের বাড়িতে যাবার আকাঙ্ক্ষা নারীর পক্ষে ভালো নয়; কিন্তু তাহলেও নূতন অবস্থায় ঘন ঘন, শেষে মাঝে মাঝে ২/১ বৎসর পরে বাপেরবাড়ি যেয়ে কিছু দিন পিতামাতা, ভাই-বোনের স্নেহের মধ্যে থাকবার ন্যায্য অধিকার তার আছে। এ সুবিধা প্রত্যেক স্বামীকে করে দেওয়া কর্তব্য। বিবাহিত ননদকে বধূরা যেন ধুয়ে-মুছে ফেলতে ইচ্ছা না করে-সেটা ঘোর অধর্ম। জামাইদের জন্যে বোনদের জন্যে প্রত্যেক পরিবার এক একখানি স্বতন্ত্র ঘর থাকবে, নইলে তাদের উপস্থিতিতে মুখে না হোক, অন্তরে বধূরা বিরক্তি বোধ করে। এটি বড়ই খারাপ।
নারী ছেলেমেয়েকে প্রাণ অপেক্ষা প্রিয়তম মনে করে। তাদের রেখে কোথাও যেতে নারী বেদনা বোধ করে। কিন্তু এরূপ ভাবা ঠিক নয়। ছেলেমেয়ে স্বামীকে বাদ দিয়ে শুধু নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বুড়া বাপ-মায়ের কাছে ধরা দেওয়াই নারীর কর্তব্য। বাপ-মায়ের শুধু সন্তানের প্রতি শুধু কন্যাদের প্রতি মায়া গভীর। তারা তাদের প্রেম, সন্তান ছাড়া অন্য কাউকে নয়, এমন কি সন্তানের ছেলেমেয়েকেও দিতে চায় না। এটি পিতৃ এবং মাতৃ-হৃদয়ের ধর্ম। মা যদি কন্যাকে কোনো ভালো কিছু খেতে দেয়-কন্যা তা না খেয়ে যদি নিজের পেটের ছেলেমেয়েকে তুলে দেয়, তা হলে বাইরে না হলেও মা মনে মনে বিরক্ত হয়। এ-কথা প্রত্যেক বুদ্ধিমান ছেলেমেয়ের চিন্তা করা উচিত। এ সব অতি সূক্ষ্ম কথা। প্রাণে গোপনভাবে অনুভব করে নীরবে হাসিমুখে কাজ করে যেতে হবে, এ নিয়ে বাদানুবাদও ভালো নয়! ব্যাপারটি হালকা হলেও মানব হৃদয়ের সত্য আমি প্রকাশ করলাম।
নিন্দিত স্বামী
২য় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু নারীর স্বামী যদি নিন্দিত হয়, তার স্বভাব যদি বদ হয়, লোকে যদি তার গ্লানি করতে থাকে, তা হলে নারীর পক্ষে বড়উ দুঃখের ও লজ্জার কথা। সমঝদার নারী ভিতরে ভিতরে স্বামীকে অতিশয় ঘৃণা করে, তার বিরহিণী মন সরমে নুইয়ে পড়েন সে, এ না করে পারে না। পিশাচের পত্নীকে পিশাচী হতে হয়, নইলে প্রেম হয় না। জেনে শুনে, স্বজ্ঞানে কেউ এমন হতে পারে না? অথবা পিশাচী-শয়তানী নারীর স্বামীকে পিশাচ শয়তান হতে হয়। নইলে প্রেম অসম্ভব। কে এমন অবোধ আছে, যে জীবনের সমস্ত জ্ঞান, বিবেক ও মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিয়ে এ-হেন নারীর প্রেমে নিজেকে নষ্ট করে দেবে?
১ম বন্ধু–বিবাহের পর অনেকের মনুষ্যত্ব নষ্ট হয়।
২য় বন্ধু–হ্যাঁ তা হয়। অন্ধ ও অক্ষম মনুষ্য আত্মাকে যে অবনমিত করে, তার মনুষ্যত্ব থাকে না।
১ম বন্ধু–আর প্রতিকার কী?
২য় বন্ধু বিবাহে পরস্পরকে স্বজ্ঞানে, জেনে-শুনে যদি স্বামী বা স্ত্রী রূপে গ্রহণ করে, তাহলে আর কিছু বলবার থাকে না। হয়তো যে মন্দ সে মন্দ নারীকে নির্বাচন করে। যে সৎস্বভাবের সে সৎস্বভাবা নারীকে পছন্দ করে। নচেৎ বিবাহে কোনো সুখ হয় না। এতে কারো চরিত্রের অবনতি হবার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। পিতা-মাতা বা অভিভাবক যারা বিয়ে ঘটিয়ে দেয়, তাদেরকে অন্যায় বিবাহের জন্য দোষী হতে হয় না;-ব্যথিত নারী বা। অত্যাচারী স্বামী জীবনভরে অভিভাবকদেরকে অভিশাপ দেয় না। মানুষের আত্মার ঘৃণিত পতনের জন্য অন্য কেউ দায়ী হয় না। যে যেমন, সে তেমন মানুষকেই বিয়ে করে, পিশাচ পিশাচী, শয়তান-শয়তানীতে মিলন হয় ভালো।
১ম বন্ধু–বিয়ে যদি একবারে হয়ে যায়, তার পর স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকা কি ভালো?
২য় বন্ধু–না, পতিত শয়তান স্বামী বা পত্নীর প্রতি গভীর ক্ষমতা পোষণ করতে হবে। তার মঙ্গল কামনা করতে হবে। তার জন্য গোপনে খোদাতায়ালার কাছে প্রার্থনা করতে হবে। তার আঘাত সহিষ্ণু হয়ে সহ্য করতে হবে। বিদ্রোহিনী হয়ে বা অত্যাচারী স্বামী হয়ে কখনো বিরোধ করো না। অন্ধ আসক্তিতে কখনো প্রিয়তমার স্তরে নেমে যেয়ো না, নিজের চরিত্রশক্তিতে স্বামী বা পীকে নিজের স্তরে তুলে নেমে যেয়ো না, নিজের চরিত্রশক্তিতে স্বামী বা পত্নীকে নিজের স্তরে তুলে নিতে চেষ্টা করাই দাম্পত্য ধর্ম।
একটু পরে কহিলেন : একবার বলেছি, আবার বলছি, অন্তরের সমর্থন না পেলে কথা বলো না।
গোরস্থান
২য় বন্ধু কহিলেন–বন্ধু জন্মালে মরণ আছে–বিরহ-বেদনা আছেই। মরণের দৃশ্যকে যত সম্ভব, সহজ ও শান্ত করে তোলা যায়-তা করতে হবে। মৃত্যুকে যতটা সজীব করে তোলা যায়, তা করতে হবে।
নয়নের মণি, স্নেহের পুত্তলী যারা প্রেমের পাত্র, তাদেরকে ময়লার গর্তে ফেলে রাখা যার পর নাই হীনতা। গোরস্থানকে শ্রীমণ্ডিত কর, এই পবিত্র ক্ষেত্রকে সজীব, সবুজ, শ্রীভূষিত করে তোল।কখনো সমাধিস্থানকে অপবিত্র, অবহেলিত করে রেখো না। সে স্থান ফুল, লতা-পাতা, অঙ্কুর প্রভৃতি শ্যামলশোভায় স্বর্গ রচনা কর। সমস্ত গ্রামের না হোক, যেন প্রত্যেক পরিবারের জন্য এক একটি গোরস্থান থাকে। সেই স্থান অতিশয় যত্নে রাখবে। পুরুষানুক্রমে মৃতের সমাধিক্ষেত্র কখনো অপবিত্র করো না–আজ অবহেলায় যেখানে যার সমাধি দিচ্ছ, অযত্নে দশ পুরুষ পরে কেউ সেখানে পায়খানা তৈরি করবে, সমাধিক্ষেত্রকে এমন শোভাময় করবে, যেন জীবিতেরা না মনে করতে পারে, কেউ এখানে মরে আছে। যেন সেখানে গেলে সবাই ভাবতে পারে, সবাই মহাতপস্যায় মগ্ন আছে। সমাধিক্ষেত্রে যেয়ে মনুষ্যকে নীরবে শোক করতে দাও, তাপিত আত্মীয়েরা সেখানে যেয়ে শান্তি লাভ করুক, বুকভরা শান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে আসুক। মৃতদের কাছে যাবার জন্যে তারা ব্যাকুল হোক। যেখানে সেখানে মৃতকে সমাধিস্থ করা সমাধিক্ষেত্রকে অযত্নে রাখা মহাপাপ। পরিবারের সমাধিক্ষেত্রে যদি কোনো বিদেশী, কোনো দরিদ্র পরিবার স্থান ভিক্ষা করে, তাদেরকে আদরে স্থান দিতে হবে। কখনো বলো না এখানে স্থান হবে না।
বন্ধু, জীবনকে যে অবাধ্য করে, সে নিতান্ত পাগল। এই দুর্দিনের জন্য যে মানুষ আত্মাকে কলঙ্কিত করে, সে অবোধ। কখনো কাউকে ধিক দিও না, ফুলের মতো শুভ্র ও সুন্দর হও এবং ফুলের সঙ্গে মিশে থাক। পৃথিবীতে ফুল পবিত্র হাতের নির্মল উপহার।
সমাধিক্ষেত্রের পবিত্রতা কিছুতেই ভঙ্গ হবে না। মসজিদ ঘরের মতোই এই স্থানকে রক্ষা করতে হবে। এই স্থান দান-বিক্রয় কিছুই হবে না। ঘর দোকান বাড়ি কেউ এখানে। তুলতে পারবে না, তা কেয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক সমাধিক্ষেত্রের পবিত্রতা রাখতে হবে।
ছেলের উপার্জন
২য় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু আমাদের দেশে কতকগুলি বাপ-মা ছেলেদের লেখাপড়া শিখিয়ে ভবিষ্যতে তাদের কামাই খেতে আশা করেন। এ হয়ত অতি বড় দুঃখীর দেশ অথবা অবিচারের দেশ, কেন বলি, স্বামীর পত্নীকে অর্ধাঙ্গিনী বলে বাস্তবিক তাগিদকে কাম-বাসনা চরিতার্থ করবার একটা নারীকে নিজেদের অর্ধাঙ্গিনী মনে করতো তা হলে নারীর স্বামীর সম্পত্তির উপর অধিকার থাকতো। নারীর স্বামীর সংসারে তাদের কোনো অধিকার থাকে না, যে কোনো সময় স্বামী তাকে দূর হয়ে যেতে বলতে পারেন। তাই লাঞ্ছিত মাতা বাল্যকাল হতেই সন্তানের কাছে অনেক কিছু আশা করে, এর শেষ ফল বড়ই খারাপ। মনোমালিন্য, অভিশাপ এবং আঁখিজল। পরমুখাপেক্ষী হওয়াটা জীবনের পক্ষে দুঃখজনক।
মা হোক, আর পিতা হোক, পুত্রের আশা করাটা ঠিক নয়। বাপ-মাকে, আপন আপন ছেলেমেয়েকে শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত করে দিতে হবে। কামাই খাবার আশায় এসব করতে হবে না। দরিদ্র মাতা-পিতা অবস্থাপন্ন পুত্রের সাহায্য পেতে পারেন, কিন্তু ছেলেদের উপর হৃদয়হীন, নায়েবের মতো ট্যাক্স বসান, টাকা আদায়ের অন্যায়। জবরদস্তি করা কোনোমতে ঠিক নয়। জীবনে প্রত্যেকেরই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অভাব বেড়ে ওঠে, নিত্য ন্যূন অভাবে মানুষ জর্জরিত হয়ে উঠে। ছেলেরা যখন নূতন নূতন সন্তানের পিতা হয়ে পড়ে, তখন তাদের মাথা ও মেরুদণ্ড খরচ ও উদ্বেগে নত হয়ে পড়ে। তারা কিছু পারে দিক, না পারে না দিক, কোনো কিছু আশা করো না। অন্যায় করে, অভিশাপ দিও না, প্রেমহীনের মতো পরস্পরের সঙ্গে ব্যবহার করো না। যেখানে প্রেমের সহানুভূতি আছে। সেখানে কোনো বিরোধ বা অশান্তি নেই।
কোনো কোনো পিতা আশা করেন, তাদের ছেলে চাকরি করে, তাদের বংশকে ঊর্ধ্বে তুলে দেবে। টাকা উপায় করে দালান দিয়ে, পুকুর কাটে, পাল্কিতে চড়ে দেশ-বিদেশে নাম প্রচার করবে। ছেলে চাকরি পাওয়া মাত্র তার বেতন যদি ৫০০ টাকা হয়, তার কাছে ৫০০ টাকার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়। পিতৃভক্ত সন্তান মনুষ্যত্ব ও পরকাল মাটি করে অফুরন্ত অন্যায় পথ অবলম্বন করে টাকা উপায় করতে থাকে, পিতামাতার আশীর্বাদ লাভ করে। দেশের লোক তাকে বলে একটা লোকের মতো লোক!
বিদ্যা-শিক্ষা দিবার লক্ষ্য এই শয়তানী আশা নয়।
১ম বন্ধু–বিদ্যার উদ্দেশ্য কী?
২য় বন্ধু–চিত্তকে মার্জিত করা।
১ম বন্ধু–মানুষ হলে কি পয়সা হয় না?
২য় বন্ধু–নিশ্চয়ই হয়।
১ম বন্ধু–মানুষ ধৈর্যধারণ করতে চায় না।
২য় বন্ধু–শয়তানী, পৈশাচিক নিষিদ্ধপথে তারা পয়সা অর্জন করতে চায়। জগতে অতি অল্পলোকেই চাকরি করে, চাকরিই যে পয়সা উপায়ের পথ, এ মনে করতে নেই। নিষিদ্ধ পথে যারা পয়সা উপায় করে তাদের উচিত নয় নগরের পতিতাদেরকে নিন্দা করা।
সংযত ভালবাসা
২য় বন্ধু বলিলেন–নারী সন্তানকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন। কিন্তু জানি, তাদের এই ভালোবাসায় সংযম কিছু অভ্যাস করা বড় ভালো। এতে ছেলে মেয়েদের উপকার হয়।
১ম বন্ধু–ভালবাসায় সংযমের অর্থ কী–অল্প করে ভালবাসতে হবে না কি?
২য় বন্ধু–না তা নয়। ভালবাসতে গিয়ে অন্যায় দুর্বলতা দেখানো ভালো নয়, তাতে ছেলেমেয়েদের ক্ষতি হয়।
১ম বন্ধু–কী রকম?
২য় বন্ধু –ছেলেমেয়েদের স্বভাব-চরিত্র গঠনের জন্যে মাতার উচিত, একটু নিজে গঠিত হওয়া। তারা অন্যায় করলে শাসন করতে কুণ্ঠাবোধ করা জননীর কাজ নয়। তাদের অন্যায় আবদার শোনাও উচিত নয়। অন্যান্য ছেলেদের দাবি নষ্ট করে নিজের ছেলেমেয়েদের কথা বেশি ভাবলে তারা কালে বিবেচিত হয়। অতিশয় আদরে ছেলেরা কষ্ট সহিষ্ণু হয় না, হৃদয়ে মেহ রেখে মুখে একটু কঠিন হওয়া মন্দ নয়। অসুখ হলে, অনবরত শিয়েরে বসে না থেকে কিছু সময়ের জন্যে সেবার ভার অন্যের উপর দেওয়া ভাল। কোনো কোনো মাতা অত্যধিক সন্তান-প্রীতিতে স্বামীকেও ভুলে যান, এটিও ভালো নয়। ছেলেদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও সংযম অভ্যাস করতে হবে।
১ম বন্ধু–কী রকম?
২য় বন্ধু–দরিদ্রের সংসারে একটু রয়ে সয়ে না চললে চলে না। জিনিসপত্র আটকে রেখে আস্তে আস্তে দেওয়া ভালো, কিংবা তাড়া দিয়ে সবাইকে কিছু কিছু দেওয়া উচিত।
১ম বন্ধু–ছেলেমেয়েদের পেটে যখন এত ক্ষুধা, তখন অনবরত খেতে দেওয়া কিন্তু উচিত নয়।
২য় বন্ধু–খাবার একটা নিয়ম থাকা চাই। কিন্তু কম খেতে দেওয়া কোনোমতে ঠিক নয়, এতে শিশুদের শরীরের প্রতি বিলক্ষণ ক্ষতি করা হয়। অনেকবার খেতে দাও, কিন্তু তার মধ্যে কিছু নিয়ম থাকা চাই। মানুষের প্রতি কাজেই নিয়ম শৃঙ্খলা থাকা দরকার। দিবারাত্র খাই খাই করলে বাড়ির সকলের শান্তি নষ্ট হয়।
১ম বন্ধু–তা ঠিক।
২য় বন্ধু–সকালবেলা এক গাদা রুটি তৈয়ার করে, কোনো জায়গায় ফেলে রাখলে ছেলেরা যতবার ইচ্ছে খেতে পারে। এতে এঁটো হয় না, বাড়ির মেয়েরাও ত্যক্ত হয় না। বড় একটা কাঁঠাল ভেঙ্গে রাখলেও, তারা ঘরে যতবার আসে, ততবারই খেতে পাবে। শিশুকে উপযুক্ত পরিমাণে আহার দিতে না পারা বড়ই কষ্টের কথা।
মাতার অসংযত ভালবাসায় অনেক ছেলেমেয়ের জীবন নষ্ট হয়; তার কোনো প্রতিকার নাই।
সমাজের আকাঙ্খা
২য় বন্ধু কহিলেন–গ্রামের লোকের প্রধান আলোচনায় বিষয়, নিদ্রায় পর্যন্ত গ্রামের লোকেরা যে বিষয় চিন্তা করে, তা কী জান?
১ম বন্ধু–না।
২য় বন্ধু–মানুষের মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। জগতে মানুষ সত্য ও খোদাতালার রাজ্য বিস্তারের জন্য বেঁচে আছে। মানুষ জীবনের মহত্ত্বের অবস্থার কথা চিন্তা করবে, দীন পতিত মানুষকে আল্লাহর মহিমা গোচর করাবে, মানব সেবা করে, পীড়িত পতিতকে সেবা করে, জ্ঞান করে, ধন্য হবে না। সমাজের লোকগুলি, পিশাচের মতো শয়তানের মতো এক অর্থে এবং সামাজিক মর্যাদার শ্রেষ্ঠ এই বিতণ্ডার মতো থাকে। শয়তানের বড় ও অর্থশালী হতে চায়, কেবল সমাজে বড় সাহেবের কন্যার সঙ্গে ছেলে বিয়ে দিয়ে পদে উঠবার জন্যে। দেমাগে টান করে চলবার জন্যে, মানুষকে আঘাত করবার জন্যে। আল্লাহর কাজ করবো, সত্য প্রচার করবো, মানব সেবা করবো, জীবনে সত্য অনুভব করবো, এ আকাঙ্ক্ষা কারো নাই। কে কত ভালো মানুষ, কার ছেলে কার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। কার কত টাকা হয়েছে, কে দালান দিচ্ছে, কে মাকে কত টাকা উপায় করে দিচ্ছে। এই চিন্তায় দিবারাত্র কাটে। নামাজের আবৃত্তি করাই এরা ধর্ম মনে করে। মানুষকে প্রেম করে, সত্যের সাধনা করে, বিনয়ে এরা শ্রেষ্ঠ হতে চায় না। প্রত্যেক মানুষের কল্পনা উচ্চ ঘরে বিয়ে করবো, দালান দেবো, পুকুর কাটাবো, হসব-নসব করবো, মানুষকে জব্দ করবো, জমিদারি করবো-এই কল্পনা ও আকাক্ষার জন্য বিনষ্ট হবে, জাহান্নামের যাবে। যে কোনো লোকের সঙ্গে আলাপ করে দেখো, দেখবে কেবল অহমিকতা। প্রেমের কথা নাই, উদার ভাব নাই, জাতির মঙ্গল চিন্তা নাই। আল্লাহকে প্রচার করবার কোনো কথা নাই, কেবল ইতরের মতো কে কত অর্থশালী, কে জমিদারি কিনেছে, কার হাতে কত টাকা জমেছে, কে কত টাকার চাকরি পেয়েছে, কার বরাত কেছমত বেড়ে গেছে–এই সব আলোচনা। বড় হতে ছোট পর্যন্ত সকলের মানসিকতা প্রায় এইরূপ।
দারিদ্রের সম্মান
২য় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু, যদি লক্ষপতি হয়ে যাও তবুও নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করো না,গর্বের তৃপ্তিতে ভরে উঠো না। যারা দুঃখ করেছে, যারা অবজ্ঞার দীন জীবন যাপন। করে,-লাঞ্ছিতা পত্নীর নির্জন গৃহেরও একটা সম্মান আছে, সে বড় কি তুমি বড়, তা আল্লাহ্ জানেন। অর্থে এবং ইট-পাথরে মানুষের মর্যাদা সূচিত হয় না। দুঃখ ও অশ্রুকে উপহাস করো না। দুঃখ নগণ্য অজ্ঞান পীড়িতকে সম্মানিত করে আল্লাহর কাছে। তুমি আমি গর্বোন্নত হয়ে তাকে উপহাস করতে পারি। মানুষের সঙ্গে সাধনার কথা বল, কারো অপমান করো না, দেমাগ করো না, কারণ আল্লাহ্ সব সহ্য করেন, কিন্তু উদ্ধত মনুষ্যের ঔদ্ধত্য তিনি সহ্য করেন না। তিনি নিজ হস্তে মানুষকে শাস্তি দেন।
বন্ধু অবার বলিলেন–মানুষের দুঃখে আনন্দিত হয়ো না, মানুষের বেদনা অনুভব করতে ত্রুটি করো না। আত্মসর্বস্ব বোধহীন জীবন-যাপন করো না। নিজের সুখে নিজে পূর্ণ থেক না, নিজের সততা ও সাধুতার গর্ভ মনে মনেও অনুভব করো না। গরিবকে আঘাত করো না, উপহাস করো না। নিজের সুখের জন্য শোকর কর, মানুষকে দুঃখ দেয়া ও পাপের জন্য আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করো। আল্লাহ্ দরিদ্র ও পাপীকেও ক্ষমা করে।
বৃদ্ধ মা-বাপ
১ম বন্ধু–কোনো কোনো বাড়িতে বুড়ো মা-বাপের বড় কষ্ট হয়, বুড়াকালে মানুষ শিশুর মতোই নিঃসহায় হয়। শিশুকে যেমন করে লালন-পালন করতে হয়, তাদেরকে ঠিক তেমনি পালন করতে হবে।
২য় বন্ধু–এক পরিবারের কথা জানিঃ বাড়ির কর্তার মা বয়সের ভারে জীর্ণ হয়েছিল, তার কোনো জ্ঞান ছিল না, হুঁশ ছিল না, শুধু দুটি খেতে পারে; কানে শুনত না। কোনো অসুখ ছিল না, শুধু বার্ধক্যের নিঃসহায় অবস্থা। বুড়ি চোখে দেখে না, হয়তো ঘরেই বিষ্ঠা ত্যাগ করতো, কোনো কোনো সময় পথে মলত্যাগ করতো। চিন্তা করে দেখ, সে এক সময় শিশু ছিল, মাতার স্নেহে বেড়ে উঠেছিল, তার পর একদিন চেলী পরে নববধূর বেশে স্বামীর বাড়ি এসেছিল। বধূজীবনের সেই সোনালি-কল্পনা, তার পর ছেলেমেয়ে পরিবৃত গৃহিণী। তার পর একদিন তার জীবনের দোসর স্বামী মারা গেল। ছেলেরা সেয়ানা হল, তাদের বিয়ে দিল; ক্রমে চুল পাকা শুরু হল, দাঁত পড়তে আরম্ভ করলো, জরা-বার্ধক্য এসে আক্রমণ করলো, এখন এই অবস্থা!
এখন সেয়ানা চুলপাকা ছেলে মায়ের কাছে দুধ আর খেতে আসে না। বধূরা মুখ সিটকিয়ে বুড়িকে আপদ বলে ঘৃণা করে; পোতারা বুড়িকে ঘৃণা করে, তামাসা করে। এই অবস্থা!
১ম বন্ধু–এদের যত্ন কে নেবে?
২য় বন্ধু–যর সবাই নেবে। সবাই তার সঙ্গে অতি সম্ভ্রমের সহিত ব্যবহার করবে।তার মলমূত্র ত্যাগের সাহায্য করবে। এ কর্তব্য ছেলেদের,-বধূদের নয়। অন্যের উপর ভর দিয়ে অন্তত ছেলেরা দেখবে, কোনো অযত্ন হচ্ছে কি না। পরের উপর ভর দিয়ে চুপ করে বসে থাকবে না। সেবাকার্যে ভদ্র পরিবারের প্রতিযোগিতা হওয়াই উত্তম। এসব কাজে ঠেলাঠেলি বড়ই লজ্জার কথা। যদি নিজেদের শক্তিতে না কুলায় তা হলে তাদের সেবার জন্য টাকা দিয়ে তোক নিযুক্ত করতে হবে, তবুও ছেলেরা রীতিমতভাবে দেখবে কোনো অযত্ন হচ্ছে কি না এবং প্রয়োজন হলে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে নিজ হস্তে কিছুক্ষণ সেবা করবে। এটি করা চাই। নিজের ছেলেমেয়ে ও পত্নী নিয়ে মত্ত থেকো না। যে এরূপ না করে, সে কুলাঙ্গার ছাড়া আর কিছু নয়, তার এবাদত বৃথা!
বয়োজ্যষ্ঠদের সম্মান
২য় বন্ধু কহিলেন–বন্ধু সংসারে যারা বয়োজ্যেষ্ঠ, তারা যতই মূর্খ হোক তোদের সঙ্গে সম্রম করে চললে নিজের অসম্মান হয় না, বরং তাতে নিজের মর্যাদা বেড়েই যায়। সে অধিকতর মর্যাদাসম্পন্নকে মর্যাদা করে, গুণসম্পন্ন, বিচক্ষণ কনিষ্ঠ, বয়োজ্যেষ্ঠকে সম্মান করে, তাতে তাদের নিজের মর্যাদা বাড়ে বৈ কমে না। কোনো কোনো যুবক বয়সের গরমে বা একটু লেখা-পড়া শিখে, মূর্খ বয়োজ্যেষ্ঠদেরকে সম্মান করতে লজ্জাবোধ করে, এর মানে, তাদের মধ্যে বিবেক তখনো দেখা দেয় নাই।
সর্বদা বিনীতভাবে কথা বলাই উত্তম। অবিনয়, অসরলতায় কথা বলা বিবেকসম্পন্ন। লোকের কাজ নয়।
১ম বন্ধু–কী রকম?
২য় বন্ধু–কাউকে কোনো কথা বলতে হবে। সে কথায় সে অসন্তুষ্ট হতে পারে। পূর্ব হতে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে কথার সূচনা করাই ভালো।
আবার কহিলেন : কেউ যদি কোনো ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয় তার কাছে সরলভাবে। জিজ্ঞাসা করা উচিত, কি কারণে সে রুষ্ঠ হয়েছে। বাস্তবিক যদি রোষের কারণ থাকে, তবে সরলভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।
১ম বন্ধু–তাতে লজ্জা হয় না?
২য় বন্ধু–সে নিচুতে যায়, তবে তার স্থান শেষকালে উচ্চে হয়। জগতে বহু বাদশাহ্ জন্মেছেন, তাদের বহু প্রতাপ ছিল, তাদের নাম কেউ করে না। যারা বিনয়ে, জগতের ধুলার সঙ্গে মিশেছেন, নত মাথায় আল্লাহর মহিমা ও প্রেমের গান করেছে, তাদের আসন কোনোদিন নষ্ট হবে না। বিনয়, ক্রোধ বর্জন, অফুরন্ত-প্রেম ব্যতীত মানুষের হৃদয় অধিকার সম্ভব নয়, মানুষের হৃদয় জয় করা অসম্ভব।
নারীর লজ্জা
২য় বন্ধু কহিলেন–বাহির অপেক্ষা অন্তঃপুরেই নারীর লজ্জা বেশি এবং সে লজ্জা সম্ভ্রম গৃহে বজায় রাখতে হবে। মুক্ত স্থানে স্নান করা, ভিজা কাপড়ে মুক্ত প্রাঙ্গণে দাঁড়ান বা নগ্ন মূর্তিতে বধূদের শরীর কারো চোখের সামনে পড়া বড়ই অন্যায়। বলতে কি-বাইরে অপেক্ষা ভিতরে বেশি করে নারীর পর্দা রক্ষা করতে হবে। ভদ্রবেশে বাইরে বেশ হওয়া আজকালকার দিনে তত অশোভন নয়। কিন্তু বাড়ির ভিতর অসভ্যা বেশে খালি গায়ে ঘুরে বেড়ানো বড়ই অন্যায়।
১ম বন্ধু–তা হলে কী করতে হবে?
২য় বন্ধু–বাড়ির ভিতরে প্রত্যেক বধূর স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র অন্তঃপুর থাকা চাই। এক ভাই, আর এক ভাইয়ের বউকে অসাবধান অবস্থায় হামেসা দেখা যারপর নাই রুচিবিরুদ্ধ। এতে মনের শান্তি নষ্ট হয়। নারী-মূর্তি কখনো অতর্কিত অবস্থায় বৃদ্ধা শাশুড়ী, জা এবং স্বামীর দৃষ্টির সম্মুখ ছাড়া প্রকাশিত হওয়া বড় দোষের।
১ম বন্ধু–একখানি বাড়ির মধ্যে এতগুলি অন্তঃপুর কী প্রকারে সৃষ্টি হতে পারে?
২য় বন্ধুপ্রত্যেক বধূর ঘরের সম্মুখ দিয়ে বেড়া দিয়ে দেওয়া উচিত। বধূদের স্বতন্ত্র পায়খানা হওয়া উচিত।
১ম বন্ধু–বধূদের, বড় ভাই-এর পত্নীর রসিকতা করা কিরূপ?
২য় বন্ধু–যারা মুরুব্বী তাদের সঙ্গে কোনো প্রকার রসিকতা করা বড়ই অন্যায়। রসিকতা জিনিসটা খারাপ নয়, আবার অনেক সময় খারাপ। মনে যদি পাপ থাকে, তবে এ-জিনিসটি বর্জন করা উচিত। এ-হতে সংসারে অনেক বিপদ হয়।
১ম বন্ধু–কারো নির্জন ঘরে, কারো প্রবেশ করা কিরূপ?
২য় বন্ধু–অবস্থা বুঝে, মানুষের স্বভাব অনুভব করে কাজ করতে হবে। বাড়িতে যদি প্রত্যেক বধূ আপন আপন ঘরে থাকে, তবে বিশেষ ভাববার কিছু নেই। কোনো পুরুষের নির্জন খালি ঘরে, কোনো বধূর প্রবেশ না করাই উচিত।
শুধু পত্নী
২য় বন্ধু বলিলেন-বন্ধু মানুষ শুধু পত্নী বা শুধু স্বামী নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। তৃপ্তি পায় না। ভাই-বোন, মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে মানুষ নারীকে প্রেম করে, এদেরকে ত্যাগ করে নয়, সেটা অসম্ভব। মনুষ্যত্মা অতি শীঘ্রই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। নর-নারী প্রেমিক বা প্রেমিকাকে বুকে নিয়ে ভাবে, জগত সংসার ত্যাগ করে আমরা অনন্তাকল ”একজন আর একজনকে ভোগ করবো”–এটি অসম্ভব। সবাইকে নিয়ে প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে সম্বন্ধ–সবাইকে বর্জন করে নয়। আত্মীয়-স্বজন মাতাপিতার সঙ্গে সম্বন্ধহীন কোনো নর বা নারীর প্রেমকে বিশ্বাস করো না। প্রেমিক-প্রেমিকাকে ত্যাগ করে।
সে একদিন ছুটে পালাবেই। বন্ধু, মানুষের সুখ মানুষকে বাইরে রাখে। এই মৌন প্রকৃতি মনুষ্যের জন্য যথেষ্ট নয় মানুষের জন্য আশীর্বাদ। মানুষকে দেখে বিরক্ত হয়ো না, কারণ, সে তোমার কাছে আসে, তোমার জীবনীশক্তি বাড়াবার জন্যে, তোমাকে বাঁচাবার জন্যে। মানুষের হাসি এবং বাক্য, মানুষের জন্য আশীর্বাদ। মানুষ একজন, আর একজনকে অদৃশ্যভাবে জীবনীশক্তি দান করে।
জামাই বাড়ি
২য় বন্ধু কহিলেন–ছোট মেয়েরা নিতান্ত অপরিচিত শ্বশুর বাড়ি যেয়ে থাকতে ভয় পায়। মা-বাপকে হঠাৎ ত্যাগ করে একদল নূতন লোককে হঠাৎ পরম আত্মীয় মনে করা সম্ভব হয় না। এজন্য মা যদি নিতান্ত অল্প বয়সের না হন এবং বৈবাহিকের বাড়িতে যদি তার কোনো অসম্মান না হয়, তবে কন্যার সঙ্গে মাঝে মাঝে যেয়ে ছোট মেয়ের কাছে ১০/১৫ দিন থেকে আসা উচিত। এতে বধূদের মনের শান্তি হয়, শ্বশুর বাড়িকে আপনার বাড়ি মনে করে। বলেছি, যাদের পক্ষে মা-বাপ, আত্মীয়-স্বজনকে ত্যাগ করে একটা নারীকে ভালবাসা সম্ভব নয়, নারীও তেমনি পিতামাতা আত্মীয়-স্বজনকে ত্যাগ করে, একটা পুরুষকে ভালবাসতে পারে না। যেখানে এরূপ চেষ্টা হয়েছে, সেইখানেই ফল খারাপ হয়েছে।
১ম বন্ধু–যদি বৈবাহিক-বেহানকে সমাদর না করে, তবে কি জোর করে সেখানে মেয়ের মা যাবেন?
২য় বন্ধু–হ্যাঁ, তা তো ঠিক। বৈবাহিক এবং জামাতার উচিত, তারা শ্বাশুড়ী বা বেহানকে বাড়িতে অতি সমাদরে নিয়ে যায়।
১ম বন্ধু–কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভদ্র মহিলারা মেয়ের সঙ্গে যেতে অপমান বোধ করে।
২য় বন্ধু–হ্যাঁ, তা করে। তার মানে, জামাতার বাড়ি যারা যায়, তাদের কাছে নানা প্রকার প্রার্থনা জানানো হয়। সাধারণত দাসী শ্রেণীর লোক যায়। দাসীর পরিবর্তে মেয়ের সঙ্গে পরম আত্মীয়কে যেতে হবে। চুল খোলা, হাত ধোয়া, উপহার বলে টাকা দাবি করা, এ-সব বর্বরতা ছাড়া আর কিছু নয়।
১ম বন্ধু–মেয়েরা নূতন নূতন শ্বশুর বাড়িতে গেলে জেলের কয়েদির মতো তাদের শাস্তি হয়।
২য় বন্ধু–তা হয়, অনবরত লোক সমাগম। মুখ দেখা, লোকের ভিড়ে নব বধূর স্বাস্থ্যের বিলক্ষণ ক্ষতির সম্ভাবনা। প্রচুর আলো-বাতাস, স্বামীর বোনদের বা সমবয়স্কা আত্মীয়া-শ্রেণীর মেয়েদের সঙ্গে, নব-বধূর জন্য বিশেষ প্রয়োজন। What is joy to other, is death to the birde এ-কথা সকলকেই বুঝা চাই।
১ম বন্ধু–বিয়ের পর বধূদের বাপের বাড়ি ঘন ঘন কিছুদিন যেন আনা-নেওয়া হয়।
২য় বন্ধু–দূর জায়গা হলে অনর্থক যাতায়াতে অর্থ নষ্ট না করে একটু দেরিতে দেরিতে আনা নেওয়াই উত্তম। সমাজের বর্তমান ধারা অনুসারে বধূদের ছেলেমেয়ে না হওয়া পর্যন্ত, কিছুদিন এইরূপ আনা-নেওয়া উচিত। এতে বর-কনের পরস্পরের মধ্যে অনুরাগ বর্ধিত হয়। অনবরত এক জায়গায় থাকলে, পরস্পরের অশ্রদ্ধা হবার সম্ভাবনা। বর্তমান বিবাহ প্রথায়, পরস্পরের শ্রদ্ধার ফলে কারো বিয়ে হয় না। এটা বয়সের আবশ্যক অনুযায়ী হয়। সুতরাং নানাপ্রকার কৌশল অবলম্বন করে বর-কনের অনুরূপ কিছুকাল নূতন করে রাখতে হবে।
নির্দিষ্ট জায়গা
২য় বন্ধু বলিলেন-বন্ধু, পক্ষীদের মাথা রাখবার ঠাই আছে, শৃগালের বাস করবার গর্ত আছে, কিন্তু মানুষের জন্য এই বিস্তীর্ণ পৃথিবীতে একটু দাঁড়াবার, মাথা রাখবার জায়গা নাই। নিঃসহায় মানুষ যেখানেই দাঁড়াবে, সেইখান হতে তাড়া খাবে। তিল পরিমাণ স্থানকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রাখবার অধিকার তার নাই! মানুষ তাকে পাহারাওয়ালা, পাইক-পেয়াদা দিয়ে ধরে হাঁকিয়ে দিবে ও জেলে দিবে।
১ম বন্ধু–বড় দুঃখের বিষয়।
২য় বন্ধু–হ্যাঁ, এই-ই জগতের অবস্থা।
১ম বন্ধু–মানুষ তা হলে জগতে কি করে বাস করবে? দেশ হতে দেশান্তরে, গ্রাম হতে গ্রামান্তরে তাকে দৌড়ে বেড়াতে হবে। তাদের দাঁড়াবার একটু খানি অধিকার নেই।
২য় বন্ধু–হা, জগতের অবস্থাটা ভাবলে তাই করা দরকার মনে হয়। তবে এরূপ করলেও চলবে না। মনুষ্যকে অনেক ব্যথা-বেদনা সয়ে, অনেক দুঃখ সহ্য করে-এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটুখানি দাঁড়াবার ঠাই হয়, ঠিক সেই জায়গাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। ক্রমশ বিজিত স্থানে পরিসর বৃদ্ধি পেতে থাকে। পুরুষ-পুরুষানুক্রমে সেই স্থান অধিকার করে থাকতে হবে, নইলে উপায় নাই। নূতন স্থানে গেলে নূতন করে সংগ্রাম চাই, নূতন করে পরিশ্রম চাই। একস্থান থেকে অন্য স্থানে গেলে ক্ষতি ভোগ করতে হবে। জীবনের একটি অংশ পণ্ড হয়ে যায়।
২য় বন্ধু—হ্যাঁ, তাই-ভয় খেয়ে স্থান ত্যাগ করলেই বিপদ। মানবজীবনের এই নিঃস্ব অবস্থার মধ্যেই সফলতা ও জয়লাভ করতে হবে। যে দাঁড়িয়ে থাকে, ভয় পায় না, বাধাকে অতিক্রম করে আপন স্থান ঠিক রেখে পরিশ্রম করে, তার দিন দিন ভিত্তি সুদৃঢ় হতে থাকে। সে শুধু নিজে সুখী হয় না, অগণিত নিঃসহায় মানুষকেও আশ্রয় দিতে সমর্থ হয়। জগৎ খুব কঠিন স্থান জেনেও ভয় পেতে নেই।
১ম বন্ধু–কিন্তু এক ব্যক্তির সাধনার ফল খুব কম।
২য় বন্ধু–হ্যাঁ, এই জন্যেই পরিবারবদ্ধ হয়ে বাস করা নিয়ম। পরিবারের সবাই নানা দিকে যাও, নানা সাধনায় জীবনকে লাগিয়ে দাও, নানাস্থানে নানা অবস্থায় দ্রব্য-সামগ্রী আহরণ করে গৃহকে সমৃদ্ধশালী কর এবং সুগভীর প্রেম, সহানুভূতি ও প্রীতিরসে পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে বাস কর। কখনো প্রেমের বন্ধুত্ব ছিন্ন করে, অন্তরে ভাগ ভাগ হয়ে নিজেদের শক্তি ধ্বংস করে ফেলো না।
স্বামীর মানসিকতা
২য় বন্ধু বলিলেন-বন্ধু, নারী স্বামীর মানসিকতা লক্ষ্য করে চলবেন। স্বামী যেমন খেয়ালের মানুষ পত্নীকে তেমনি হতে হবে। স্বামী যাকে ভালবাসেন না, পত্নী তাকে ঘৃণা করুন বা না করুন, তাকে পরিহার করে চলবেন। স্বামী যে কাজ করেন, পত্নীর ঠিক সেই সমস্ত কাজকে ভালবাসতে হবে; নইলে বিরোধ হবার খুব সম্ভাবনা। স্বামী বক্তৃতা ভালবাসেন, পত্নী বক্তৃতা দিতে পারুন বা না পারুন, এইকাজে তার বিলক্ষণ সহানুভূতি থাকা চাই। স্বামী যদি মানব-প্রেমিক না হন, পত্নীকে ঠিক তেমনিভাবের মানসিকতা পোষণ করতে হবে। কখনো স্বামীর বিরুদ্ধ মানসিকতা পোষণ করবে না।
১ম বন্ধু–যার রুচি ও মানসিকতা অন্যরকমের, সে কী করে তা বদলে ফেলে দেবে।
২য় বন্ধু–বদলে না ফেলতে পারলে, প্রেমের বন্ধন অসম্ভব। যেমন শৃগাল এবং কুকুর মিলন সম্ভব নয়, বিরুদ্ধ মানসিকতার দুইটি প্রাণীর সঙ্গেও সেইরূপ প্রেম সম্ভব নয়। যারা। নিজকে সম্পূর্ণরূপে বদলে ফেলতে পারেন না, তাদের বিবাহের পূর্বেই সতর্ক হওয়া উচিত।
১ম বন্ধু–অন্তরে এক, বাইরে স্বামী ভুলান একটা মিথ্যা অভিনয় করা কি ভালো?
২য় বন্ধু–তা ভাল নয়? এই জন্যে বিরুদ্ধ রুচির ছেলেমেয়ের বিয়ে হওয়া ঠিক নয়। চোরের সঙ্গে চোর নারী এবং সাধুর সঙ্গে সাধ্বীর মিলন হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
একটু পরে : বন্ধু অভাবের জন্য দুঃখ করো না, যেহেতু অভাবের মীমাংসা হয় না। স্বাস্থ্যের জন্য প্রভুকে প্রত্যহ ধন্যবাদ জানাও। সমস্ত রাজকার্য করে যদি স্বাস্থ্যহীন হতে হয়, তবে তাতে কী লাভ? মূর্খেরাই জাগতিক অভাবে অকৃতজ্ঞ হয় দুঃখ প্রকাশ করে। অনেক অবিবেচক মানুষ ভীষণ পীড়ায় আক্রান্ত হয়–জগতে তার সুখ কোথায়? বাত, প্যারালিসিস, প্রমেহ, ক্ষয়, হাঁপানি, কুষ্ঠ প্রভৃতি সাংঘাতিক রোগ কাকে কোন সময়। আক্রমণ করে কে জানে? মানব-জীবনের এই সব ভীষণ শত্ৰু কখন যে কাকে আক্রমণ করে তার ঠিক নেই। অতএব স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। পবিত্র জীবন-যাপন, স্বচ্ছলতা, পরস্পরের প্রতি প্রেম ও সহানুভূতি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যের নিয়মাবলি পালন, শরীরকে বিনাশ হতে রক্ষা করে এবং পরিবারকে স্বর্গে পরিণত করে হয় অর্থ দিয়ে না হয় শরীর দিয়ে পীড়িতের সেবা করবে-কখনো তাকে ত্যাগ করো না, সে যেই হোক। সকল দেশ, সকল জাতির জন্য এই নিয়ম। পীড়িতের সম্বন্ধে কখনো বলো না এ পাপের। শাস্তি ভোগ করছে।
সন্তান কামনা
২য় বন্ধু বলিলেন–মানুষ পাপ উদ্দেশ্যে সন্তান কামনা করে, সন্তান হলে উৎসব এবং আল্লাহর মহিমা-বাণী ঘোষণা করে। যদি পাপ উদ্দেশ্যে সন্তান কামনা করে থাক, সন্তান জগতে খেয়ে পরে, দালান-কোঠা দিয়ে, মোকদ্দমা করে জীবন সার্থক করবে, এই আকাঙ্ক্ষা করে থাক তাহলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে আনন্দ করো না। মহিমা-বাণী প্রচার করো না।
বন্ধু, মানুষ যখন অতিথি হয়ে জগতে আসে, তখন আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন, আমার এই বান্দা আমার মহিমা প্রচার করবে। আমার জন্যে বেঁচে থাকবে। আমার দুঃখী বান্দাকেও প্রেম করবে।শয়তানের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করবে।
হায়! আল্লাহর আশাকে মানুষ কীভাবে ব্যর্থ করে দিয়েছেন।-মানবহৃদয় প্রেমকে, মানুষ অপ্রেমিক, শয়তান, নীচাশয় হয়ে, মানব-জীবনকে অপমান করছে। সে আত্মসর্বস্ব, স্বার্থপর, দাম্ভিক, জ্ঞানহীন হয়ে চোর পরস্বঅপহারী হয়ে মানব-জীবনকে ব্যর্থ করছে। ধিক তাকে!
১ম বন্ধু–মানুষকে হিংসা করে যারা?
২য় বন্ধু–হা, কী উদ্দেশ্যে মানুষ বেঁচে আছে তা জানে না বলেই এরা পরস্পরে হিংসা করে, যুদ্ধক্ষেত্রে যেয়ে সৈনিকেরা যদি পরস্পরের টুপি ও পোশাক নিয়ে হিংসা করে, তা হলে তারা কি কখনো যুদ্ধে জয়লাভ করে? তারা কি শয়তান নয়! মানুষ কী উদ্দেশ্যে মনুষ্য নাম ধারণ করে আছে তা জানে না। এরা শুধু.খাবার জন্যে, ভালো ঘরে বিয়ে করবার জন্যে, দালান দিবার জন্যে বেঁচে আছে: এই হচ্ছে এই মানুষগুলির লক্ষ্য। কাজেই এরা পরস্পরকে হিংসা করে। শয়তানকে ধ্বংস করা, পাপ-বেদনা, অন্যায়-দুঃখকে ধ্বংস করে জগতের প্রত্যেক মানবচিত্তে আল্লাহর আসন প্রতিষ্ঠিত করাই মনুষ্যের জীবন সাধনা, পৃথিবীর অনন্তরূপের সার্থকতা। এর চাইতে আর বড় কথা নাই। এক কথায়, জীবনে নারী পুরুষের এই-ই লক্ষ্য। এ কথা মানুষ জানে না বলেই দালান-কোঠা বিসম্বাদ নিয়ে পরস্পরের সহিত প্রতিযোগিতা করে। জাগিতিক গৌরব যাদের লক্ষ্য, তাদের পরস্পরের প্রেম সম্ভব নয়।
একটু পরে কহিলেন-বন্ধু, মানুষের যাবতীয় অপরাধ ভুলে তার অন্তর্নিহিত দুঃখ অনুভব করতে চেষ্টা কর। নিজেই সমস্ত দাবী ছেড়ে দাও, অপরাধীর নিজস্ব দুঃখের দাবী পূরণ কর। দুঃখে প্রেম করাই প্রেমিক তপস্বীর লক্ষণ।
“কোনো গুরুতর কথা প্রিয়জনকে লিখে বল। সুখের কথা অগ্রাহ্য কর।”
“জীবনের যাবতীয় প্রশ্ন টেনে এনে মীমাংসা করতে চেষ্টা করো না। যখন যে প্রশ্নটি সম্মুখে আসে সেই বিষয় মীমাংসা কর। জটিলতার অন্ত নাই, প্রশ্নের শেষ নাই, যখন যেটি সামনে আসে সেইটির মীমাংসা কর। কলকার কথা আজকে ভেবে জীবনের দুঃখ বাড়িয়ো না।”
কথা যেটুকু বলা দরকার সেইটুকু বল। অন্য কথার উত্তর দিও না।
অদ্যকার জন্য অদ্যকার চিন্তা, বর্তমানের মুহূর্তের জন্য বর্তমানের চিন্তা। ভবিষ্যতের উদ্বেগ টেনে এনে নিদ্রা নষ্ট করো না।
ধার্মিকতার অহঙ্কার কোনো মতে ভালো নয়।
নারী স্বামীর পিতামাতা, ভাই-ভগ্নীকে নিজের পিতামাতা এবং ভ্রাতা-ভগ্নী মনে করবে এবং সন্তানের ন্যায় তাদেরকে পালন করবে, স্বামীর আপনজনকে কখনো নিঃসহায় মনে করো না। এক কথায় বিবাহের পর নারীর আপন পিতৃগৃহের কোনো সম্বন্ধ নেই। সে স্বামীর বংশেরই শাখা।
নিঃস্বার্থভাবে লোকের কাজ করো না। কোনো ভালো কাজ করে মানুষকে জানাতে যেয়ো না।
হঠাৎ কারো উপর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠো না, এর ফল অপ্রীতিকর। যার উপর মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হচ্ছে, তার সঙ্গেও সহিষ্ণুতার সহিত কথা বলতে থাক! সাবধান! ধৈর্য রক্ষা কর। এর ফল খুব ভালো। –ঋণ যত শীঘ্র পরিশোধ করে ফেলতে পার, ততই ভাল। যতই দেরি করবে ততই মুশকিল। অভাবের অন্ত নাই। বড় ঋণ অপেক্ষা ছোট ঋণেরই গুরুত্ব অধিক। ঋণ ধীরে ধীরে অল্পে অল্পে পরিশোধ করতে লজ্জা করো না, ঋণ পরিশোদের এই উত্তম পন্থা। কারো কোনো পয়সা হাতে পড়লে সেটাকে গায়েব করে দেওয়া জীবনে বড়ই লজ্জার বিষয়, অল্প হোক আর বেশি হোক।
নিজের আত্মা যা সত্য বলে মনে করে, তা যতই অপ্রীতিকর হোক, সাহসের সঙ্গে প্রকাশ কর; ভয় করো না।
ছোট ছোট কথায়, ছোট বাক্যে, ছোট ছোট ব্যবহারে মানুষের মনুষ্যত্ব সূচিত হয়। ছোট ছোট কাজে, বাক্যে এবং ব্যবহারে সত্য ও সুন্দর হওয়া বড় কঠিন। এর দ্বারাই জীবনের মূল্য প্রকাশিত হয়। জগতের কাজ সাধারণত গরজে চলে, দয়ায় চলে না। মানবাত্মা সম্বন্ধে যতই ক্রোধ, অশ্রদ্ধা-বিরোধ ও আড়াআড়ি করবে ততই সে পতিত হবে। যে গালি দেয়, সে ক্ষতি করে, যে প্রেম করে, সেই মানব-চিত্তকে মঙলের পথে আকর্ষণ করে।
১ম বন্ধু –পতিত, অন্ধ, দুষ্ট আত্মা সম্বন্ধে কি ধৈর্য ধারণ সম্ভব?
২য় বন্ধু–এই-ই পথ, এ-ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো পথ নাই। ক্রোধ ও বিরোধে মানব-চিত্তের কোনো মঙ্গল হবে না।
আবার বলিলেন–নিজের স্বার্থের জন্য যারা নারীকে স্বামী গ্রহণ করতে বাধা দেয়, তারা পিশাচ।
কেউ কোনো পয়সা খরচের জন্য দিলে, হিসাবসহ পয়সা ফেরত দেওয়া উচিত। আপন মাতার পয়সাও বিনা অনুমতিতে গ্রহণ করা যায় না।
একজন কারো সঙ্গে কথা বলতে থাকলে, তার মধ্যে কথা বলো না, এরূপ করা ভালো নয়।
মানুষ সমাজ জীবনে, আপন পরিবারে পরস্পরের সঙ্গে উচিত কথা বলবে। কথা বলে এবং আলাপ করে, যার যার মতো মাথা গুঁজে চলে যাওয়া বড়ই দোষের। চোখের পানি যে ফেলে, সেই জানে তার ব্যথা–যে দেখে সে জানে না।
ঘুষের কথা
২য় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু, মনুষ্য ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না, মহাজনেরাও সাধারণ বাক্যালাপে ভুল করেন; তা ধরতে নেই। প্রত্যেক কথাই ধরলে জগতে কারো বাস করা অসম্ভব।
১ম বন্ধু–মুরব্বিরা অনেক ভৎর্সনা করেন, সে সম্বন্ধে কিছু বল।
২য় বন্ধু–ভর্ৎসনা জিনিসটা শিশু বা অবোধের জন্যে উত্তম। সেয়ানাদের কাজে বা যারা ভালমন্দ বুঝতে পেরেছে, তাদের কাছে ভৎর্সনার কোনো মূল্য নেই। মুরুব্বীরা ভর্ৎসনা করেন, তবে রুষ্ঠ হয়ে তার প্রতিবাদ না করাই ভালো। মুরুব্বীরা স্নেহে মানুষের ভক্তির পাত্র, জ্ঞানের নয়।
১ম বন্ধু–মুরুব্বীরা যদি স্নেহশীল না হন?
২য় বন্ধু তাদের মুরুব্বীদের কোনো অধিকার নেই। ধরতে গেলে জগতে মুরুব্বীর অভাব নেই, সবাইকে মেনে চলতে গেলে মানুষের মনুষ্যত্ব বজায় থাকে না।
১ম বন্ধুকে স্নেহশীল, কে স্নেহশীল নয়, তা কী করে জানা যায়?
২য় বন্ধু–ব্যবহারে তা বুঝতে পারা যায়। কেউ স্নেহের দাবি করে, যদি দু’টি কটু কথা বলেন, তবে তা সবিনয়ে শোনাই উচিত।
১ম বন্ধু–অনেক লোক কুতর্ক করে।
২য় বন্ধু –হ্যাঁ, করে, বইকি? অনেক লোক অসভ্য আছে, তাদের কথা সত্য বর্জিত দাম্ভিকতা ও অসভ্যতা তাদের যুক্তির প্রাণ। অসত্যের মতো বা সত্যকে লক্ষ্য না রেখে কি মুরুব্বী কি বাইরের কোনো ভদ্রলোক, কারো সঙ্গে বাদানুবাদ করা উচিত নয়।
১ম বন্ধু–যারা বাল্যকালে স্নেহ করেছে, তাদের কি রুষ্ট কথায় আপন করা উচিত? ২য় বন্ধু–স্নেহ একদিন করলে চলবে না, আজ স্নেহ করে কাল কান মলা দিলে চলবে। তবে যথাসম্ভব সহিষ্ণুতা অবলম্বন করে চলাই উচিত। রক্ত গরম করে হঠাৎ কারো উপর চটে ওঠা ভদ্রলোকের কাজ নয়।
১ম বন্ধুপত্নীকে অনেক সময় স্বামীর সঙ্গে বাদানুবাদ করতে দেখেছি।
২য় বন্ধু–অন্যায়ভাবে না বুঝে বাদানুবাদ করা উচিত নয়, এতে স্বামী বিরক্ত হন, তার মনের শান্তি নষ্ট হয়। ভদ্রভাবে সকলের সঙ্গেই বাদানুবাদ করা যায়, তর্কে জেতা বড় কথা নয়। অনেক লোক আছে, যারা মোড়লী হাছিল করবার জন্যে মরুব্বীয়ানা করে; ছোটদিগকে। ভালবাসে না,–উপহাস ও অপমান করতে আনন্দ বোধ করে। এটি ভালো নয়।
মান-অপমান
২য় বন্ধু বলিলেন–বন্ধু, জগতে বাস করতে হলে, কোনো কোনো সময় নিম্নস্তরের লোকদের কাছে অপমানিত হতে হয়। তা বলে দুঃখিত হলে চলবে না। আমার ওয়ালাদ সাহেবকে ফকির বলে দা দিয়ে কাটতে এসেছি। আমাদের বাড়িতে একটা কালা ও বোবা মেয়ে দেখেছ, এ তাই মেয়ে। সংসারে নিতান্ত নিরাশ্রয় হয়ে, শেষকালে আমাদের বাড়িতে সে মেয়েটিকে রেখে যায়। মা অনেককাল ধরে, তার মল-মূত্র ধুয়ে এত বড় করেছেন। বাংলার শাসনকর্তাকে এক সময় একটা কয়েদি খুন করেছিল। অনেক সময় ছোট লোকের কাছে অনেক ভদ্রলোকের অপমান হয়, তা বলে দুঃখ করলে চলবে না। কোনো ছোটলোক কোনো ভদ্রলোককে অপমান করলে রাজা হবে না, তার শাস্তি তাকে পেতে হবে। ভদ্রলোকের এজন্য দুঃখ করার কিছু নেই। যিনি ন্দ্র, খোদা তাকে উচ্চাসন দেবেনই।
বন্ধু! কোনো কোনো নিম্নস্তরের লোক অতিশয় ভদ্র ব্যবহার করে, নিতান্ত বিনয়ী হয়ে কথা বলে, সম্রম করে কিন্তু এদের ভিতরে একটা দুরন্ত শয়তান চুপ করে বসে থাকে। সামান্য বিঘ্ন পেলে অথবা বিনা কারণে সমস্ত বিনয় বর্জন করে এরা নিজ মূর্তি ধারণ করে। মানুষের ভদ্রতায় আশ্বাস করা উচিত নয়। কিন্তু জেন, মনুষ্যকে যথাসম্ভব সম্ভম করা উচিত। তা একটা সত্য কথা বটে। কিন্তু হীন লোককে কোনো কোনো সময়ে সম্মান করলে, তাদের ক্ষতি করা হয়। সত্যের মর্যাদা জগতের অতি অল্প লোকই স্বীকার করে জগতের শৃঙ্খলা অধিকাংশ ক্ষেত্রে রক্ষিত হয় শাসন ও ভয়ে। হীন লোককে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংযত শাসন চেপে রাখা দরকার। জ্ঞান ও বিবেকের ধার তারা ধারে না।
যাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে, যেখানে যেতে বা খেতে লজ্জা হয়–সেখানে আত্মীয়তা করো না, যেয়ো না, খেয়ো না। আত্মার এই লজ্জা আল্লাহর নিষেধ বাণী।
একই চিন্তার, এই স্তরের মানুষ ছাড়া বন্ধুত্ব ও আত্মীয়তা হয় না, বিরোধ হবেই।
গ্রাম্য সমাজে দল বেঁধে থাকা নিয়ম, নইলে টেকা কঠিন। কুলের গর্বে কারো উপর অত্যাচার করা, বা কাউকে অপমান করা উচিত নয়। তাতে খোদা নারাজ হয়।
১ম বন্ধু–দলকে নিয়ে গ্রাম্য-জীবনে বিবাহ ও ফাতেহা উপলক্ষে খাওয়া-দাওয়া কেমন?
২য় বন্ধু–হ্যাঁ, এটি দরকার। কিছু লাভ হোক, আর না হোক দলের লোককে তুষ্ট রাখতে হয়।
দাম্পত্য-জীবনে স্বাতন্ত্র
২য় বন্ধু কহিলেন–বন্ধু, দম্পতিরা একজন আর একজনকে আনন্দ দিতে চেষ্টা করেন। নারী স্বামীর ঘরে, যেমন করে মানুষ চাকরি করে, ঠিক সেইভাবে জীবন কাটাবে না। সেটা তার পক্ষে গুরুতর অপরাধ। সংসারের সমস্ত কাজ চলছে, ভাত রাধা, কাপড় ধোয়া, ছেলে মানুষ করা, দুধ জ্বাল দেওয়া-কাজের মতো, প্রাণহীন যন্ত্রের মতো রাত্রিকালে স্বামীর অঙ্কশায়িনী হওয়া–এই-ই নারী জীবনের আদর্শ ভাব নয়। নারীর প্রাণ পূর্ণ হবে, সমস্ত কাজের মধ্যেই সে স্বামীর-সঙ্গ লিপ্সা করবে। তার সঙ্গ ভালবাসবে, তার সঙ্গে কথা বলবে, আলাপ করবে, তাতে যে যা বলে বলুক। এই দুঃখপূর্ণ, অসহ্যপূর্ণ, মানব-জীবনে শুধু কাজ যথেষ্ট নয়, জীবনকে রসালো ও আনন্দময় করে তুলতে হবে। দাম্পত্য জীবনের এই-ই শ্রেষ্ঠ কাজ। কাজ না করলে চলে না বলেই স্বামী আর বধূ কাজ করবেন, নইলে তাদের কাজ করবার দরকার ছিল না। একজন আর একজনকে নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ ভোগ করতো। একজন অপর একজনের জীবনের কাজকে প্রেমের স্বর্গীয়ভাবে প্রেমে অনুরঞ্জিত করে তুলবে।-নারী কখনো জীবনকে কাজের মতো নীরস করে তুলবে না, তার জীবন একটি কবিতা বিশেষ। একথা প্রত্যেক নারীরই স্মরণ রাখা উচিত।
১ম বন্ধু–পুরুষেরাও জীবনকে অনেক সময় প্রেমহীন কাজের মতো নিষ্ঠুর করে তোলেন।
২য় বন্ধু–হ্যাঁ, তা তোলে বৈ কি! কাজের অন্ত নাই, দিন-রাত্র পত্নীর সঙ্গে হয়তো দেখাই হয় না। কথা বলা, গল্প করা তো দূরের কথা। দাম্পত্য জীবনের প্রতি একটা নিষ্ঠুর অত্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। একজন আর একজনের কাছ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করে, পত্নী বা স্বামীর জীবনকে নিতান্তই সঙ্গীহীন, নীরস নির্জন দুঃখময় করে তোলেন।-এটা খুব আপত্তির কথা স্বামী রাতদিন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আলাপ করে হেসে-খেলে জীবনকে উপভোগ করে, পত্নী বেচারীর নিঃসঙ্গ, দুঃখময় জীবনের দিকে, তার প্রেম পিপাসু অন্তরের আকাঙ্ক্ষাকে একটুও হ্রাস করবেন না। এটা মোটেই ভালো নয়। শুধু যৌন ক্রিয়াই মানব জীবনের জন্য যথেষ্ট নয়। মানুষের আত্মা আরও কিছু চায়। বুদ্ধিমান স্বামী-স্ত্রী এ কথা ভালো বিবেচনা করবে, কখনো নীরবে একজন আর একজনকে ত্যাগ করে থেকো না। স্বামী-স্ত্রীর যেদিনটা এমনিভাবে যায়, অথবা যেদিনটা শুধু প্রাণহীন কাজের আলাপে যায়, সেদিনটা বৃথাই গেল একথা প্রত্যেক দম্পতির স্মরণ রাখা উচিত। বিবাহ জিনিসটা একটা কর্তব্য পালন নয়; নীরস, কঠিন, সঙ্গীহীন জীবনে একটি সঙ্গী গ্রহণ ছাড়া আর কিছু নয়। মানব-জীবনকে সরস করে তোলবার জন্যে হাসির সৃষ্টি, সন্তানগুলির জন্য নয়।
শ্বশুর
১ম বন্ধু কহিলেন–বন্ধু, এক ব্যক্তিকে জানি সে যখন যুবক ছিল, তখন বাবুগিরি করতো, সিঁথি তুলতো, বেশ্যাসক্ত ছিল, দু-তিনটা উপপত্নী ছিল। যখন বুড়ো হল, তখন ছেলেদের আনন্দ-উল্লাস দেখতে পারত না,-বউদের সাজসজ্জা দেখলে জ্বলে যেতো, পিশাচের মতো বধূদের লজ্জাশীলতার উপর আঘাত করতো। বউদের সঙ্গে ছেলেদের কথা, হাসাহাসি সহ্য করতে পারত না! বউরা জুতা পায়ে দিলে, জামা গায়ে দিলে, উপহাস করত, ছেলেদের বধূর ঘরে যেতে দেখলে জ্বলে উঠতো।
২য় বন্ধু–এই লোকটি নিতান্তই পিশাচ। আপনজনের উপর, আত্মীয়ের সঙ্গে যে অত্যাচার করেসে মহাপিশাচ।
১ম বন্ধু–জগতে এরূপ হয় কি?
২য় বন্ধু–হা হয়, আত্মীয়ের এবং মুরুব্বী সেজে মানুষের উপর মহা অত্যাচার করে, এদের বিরুদ্ধে কিছু বলবার থাকে না–মানুষও কিছু বুঝতে পারে না। আল্লাহতালা মনুষ্য সমাজকে এই শ্রেণীর আত্মীয় নামধারী শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করুক।
১ম বন্ধ। বড়ই পরিতাপের বিষয়।
২য় বন্ধু–এই সব আত্মীয়ের মায়ায় যারা ঘোরে, এদের স্পর্শে যারা থাকে, তারা ধীরে ধীরে অজ্ঞাতসারে মরে যায়। এদের নাগপাশ বিষজ্ঞানে ত্যাগ করতে হবে, নইলে রক্ষা নেই। সাপুড়ে যেমন সাপকে মেসূমেরাইজ করে, এরাও তেমনি কৃপা-ভিখারী কনিষ্ঠদিগকে মেসমেরাইজ করে রাখে–সিন্দাবাদ দৈত্যের মতো ঘাড়ে চেপে থাকে, হৃৎপিণ্ডের রক্ত গুলিয়ে তোলে। কনিষ্ঠেরা ভয়ে জ্ঞানশূন্য হয়, ভালোমন্দ কিছু বুঝতে পারে না।-বৎসরের পর বৎসর ধরে অত্যাচারী মুরুব্বীদের হাত থেকে সরে পড়া ভালো।
১ম বন্ধু–স্বাধীন হওয়া কি বিপদের কথা নয়?
২য় বন্ধু–স্বাধীনতা এবং বিদ্রোহ এই-ই জীবন। যে পরমুখাপেক্ষী হয় পরের আশা করে, মানুষের মুরুব্বীয়ানা অত্যধিক স্বীকার করে সে মরে।
১ম বন্ধু–জীবনে আত্মীয় কে পরই বা কে?
২য় বন্ধ। যারা সত্যপন্থী, মহানুভব ব্যক্তি, তারা পর হলেও আপন। আপন লোকের স্বার্থে আঘাত পড়লেই নিষ্ঠুরের মতো ত্যাগ করে। পাপাত্মাদের সম্বন্ধ জাগতিক স্বার্থে। যাকে দেবে সেই পরম আত্মীয়, যাকে দেবে না, সে আপন ভ্রাতা হলেও সরে যাবে শুধু মাতার প্রেম নিঃস্বার্থ। সতী নারীর প্রেমও নিঃস্বার্থ। সত্যাশিত পরিবারের প্রত্যেক প্রত্যেকের পরম আত্মীয়, সুখ-দুঃখে এক হয়ে তারা আল্লাহর রাজ্য বিস্তার করে, আপন আপন কর্তব্য তারা পালন করে। তারা ছোটদের আনন্দে আনন্দিত হয়। কোনো ভুল-ত্রুটি দেখলে প্রবীণের ধীরতায়, স্নেহানুভূতিতে কনিষ্ঠকে পথ দেখায়।
১ম বন্ধু–মানব-জীবনে কেন এত ভুল, এত বিরোধ, এত স্বার্থ?
২য় বন্ধু–মানুষের লক্ষ্য সত্যময় ও প্রেমময় আল্লাহ্ নয়। পরম সত্যকে যারা জীবনের সমস্ত সাধনায় পেতে চায়-অনুভব করতে চায়, তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নাই, জীবনের কোথাও তাদের কোনো ত্রুটি নাই। নামাজ-রোজার ভিতর দিয়ে, সেই পরম সত্যকে জীবনে পেতে হবে। নামাজ-রোজাই যাদের জীবনের শেষ লক্ষ্য তাদের দুঃখের শেষ নাই। পরম ধার্মিক হলেও তাদের সমস্ত কাজে গলদ।
১ম বন্ধু–শুনেছি কোনো কোনো শ্বশুর, পুত্রবধূদের উপর কুদৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
২য় বন্ধু–হা, আমিও এরূপ শুনেছি। গৃহে প্রত্যেক মেয়ের স্বতন্ত্র অন্তঃপুর থাকা। ভালো। অতর্কিতভাবে স্বামী ছাড়া আর কারো দৃষ্টির সামনে পড়া ঠিক নয়। সতীর বিশেষ মানুষের দৃষ্টি তত ক্ষতিজনক নয়।
.
আঁখিজল, নারীর মহিমা
২য় বন্ধু কহিলেন–বন্ধু মানুষের আঁখিজলকে অভিবাদন কর। ইহা তীর্থ ভূমের পবিত্র সলিল বিন্দু। মানুষ যখন প্রেমে নীরবে আঁখিজল ত্যাগ করে, তখন সে পবিত্র হয়। মহাজনেরা প্রেমের বেদনায় দুই বিন্দু অশ্রু ত্যাগ করে। হৃদয়ের অনন্ত প্রেমে কিরণ-রেখার মতো মানব-চিত্তকে উজ্জ্বল করে। যে কাঁদতে কাজে না, সে আল্লাহকে বোঝে না।
১ম বন্ধু–কথায় কথায় কাদা কি ভালো?
২য় বন্ধু–তা জানি নে। তবে যে অশ্রু আত্মার বেদনায় বাহির হয়, তাই স্বর্গীয়। যে অশ্রু মিথ্যা হতে আসে, তা অপবিত্র।
১ম বন্ধু–হ্যাঁ তাই।
২য় বন্ধু–ডাকাত নরপিশাচ নিজের কন্যা মৃত্যুতে প্রেম বেদনায় গলে যায়, তখন আর সে মানুষ থাকে না। সে আল্লাহূকে মুহূর্তের জন্য ক্ষেপে যায়। মুহূর্তের জন্য স্বর্গের হাসি তাতে প্রকাশ পায়; বন্ধু ব্যথিত মানুষকে নমস্কার কর, তার শোক-দগ্ধ হৃদয়ে হৃদয় ধারণ কর। যেহেতু শোক এবং অশ্রু তাকে স্বার্থপর করে।
১ম বন্ধু–মানুষ মানুষের জন্য কাঁদে।
২য় বন্ধু–নারীর চিত্তে প্রেম বেশি। বলতে কি নারী জগতের অপূর্ব সামগ্রী। মমতা ও স্নেহের আধার নারী, তার স্পর্শে জগৎ ধন্য হয়েছে। নারী যখন নিষ্ঠুর, পিশাচী ও শয়তানী হয়, তখন আর সে নারী থাকে না। সে বিষাক্ত কালনাগিনীর মূর্তি ধারণ করে, তার স্পর্শ হতে তখন সরে যেয়ো।
১ম বন্ধু–নারী হওয়া ভাগ্যের কথা।
২য় বন্ধু–হ্যাঁ নারী-জীবন লাভ করা ভাগ্যের কথা বই কি! নারীকে সর্বদাই সম্ভ্রম কর। তাকে সর্বদাই পথ ছেড়ে দিও, সে যে জাতিরই হোক। নারীকে মা ভাবলে তিনি আপন কোলে মানবসন্তানকে স্থান দেন। তখন জাতি বিচার করেন না, কারো পরশে তার শরীর অপবিত্র হয় না। যে নারী হৃদয়ে বেদনা দেয়, সে শয়তান।
১ম বন্ধু–শুনেছি, প্রাচীনকালে নারীকে দাসীরূপে বিক্রয় করা হতো।
২য় বন্ধু–হা, সে কাজটি বড় অন্যায়। নারী-জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলবার প্রচেষ্টা কেবল মানব-জাতির করা উচিত। নারী সুন্দর, মধুর, উন্নত মার্জিত রুচি, নির্মল, আলো, সঙ্গীতের সুরের মতো স্বার্থপর হয়ে জগতের শোভা বর্ধন করে। মানুষকে জননী ও প্রেমিকা রূপে সে মানব সন্তানকে পালন করুক, বাইরে রাখুক। যেন নারীর সম্মুখে কোনো মানব সন্তান বিনষ্ট না হয়।
দিবসের কাজ
২য় বন্ধু কহিলেন–বন্ধু, নারীর জন্য দিবসের কত কাজ আছে, তার মধ্যে বড় কাজ কি জান?
১ম বন্ধুরান্না। ২য় বন্ধু–না, তা নয়–১ম বন্ধু–তবে কি?
২য় বন্ধু–নারীর প্রত্যেক দিনের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ কাজ প্রতিনিয়ত স্বামীর অভাব অনুভব; সুখ-সুবিধার সংবাদ রাখা। কাজে কাজে সমস্ত দিন শেষে হয়ে গেল, কিন্তু যার জন্যে সংসারের সমস্ত কাজ, তার খবর কিছুটা নেওয়া হলো না, এটা নারী জীবনের মস্ত বড় ভুল।
১ম বন্ধু–এগুলি কিছুই নয়। এর মাঝে প্রাণের পরিচয় নাও থাকতে পারে। এগুলি নিছক কাজের মতো করে নারী করে যেতে পারে, নারীর স্বামীর সংস্রবে এমন কতকগুলি কাজ করতে হবে, যাতে তার প্রাণ নিৰ্বরের মতো উৎক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে!
১ম বন্ধু–সে কিরূপ?
২য় বন্ধু–বিনা কাজে, বিনা কারণে স্বামীর সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করতে হবে। নারী-জীবনের কোনো সময় স্বামীর কাছে ভারী ভক্তি নির্লিপ্ত হবে না, স্বামীর কাছে চিরদিনই নব বিবাহিতা বধূর মতো থাকবে। কাজের জন্যে ছেলেমেয়েদের জুলুমে স্বামীর সঙ্গে দিনরাতে কোনো সময় দুটি স্নেহ মমতার কথা নাই, হাস্য-কৌতুক রসিকতা নাই–এ দাম্পত্য জীবনের লক্ষণ নয়।
১ম বন্ধু–মুরুব্বীদের সম্মুখে স্বামী-স্ত্রী আলাপ করা কিরূপ? ২য় বন্ধু–মুরুব্বী বলে নয়, কারো সম্মুখেই স্বামী-স্ত্রী তরল আলাপ করবে না।
১ম বন্ধু–স্বামী-স্ত্রীর দেখা-সাক্ষাৎ, স্নেহ-মমতার আদান-প্রদান, এসব চাই। দিনের মধ্যে দু’জনায় বিনা প্রয়োজনে, এমন কি, ক্ষুদ্র কার্য হলেও স্বামী-স্ত্রী এক জায়গায় কিছুক্ষণ কাটাবে। এতে কোনো লজ্জা নেই। দাম্পত্য জীবনের এটি ধর্ম এবং আবশ্যক। বধূ যতই প্রবীণা হউক, মাঝে মাঝে স্বামীর সঙ্গে দেখা করবে, প্রাতঃকালে উঠেই স্বামীর কুশল জিজ্ঞাসা করবে, শোবার আগে দেখা করে কিছু সময় কথা বলে বিদায় প্রার্থনা করবে না আপন শয্যা গ্রহণ করবে। যার যার মতো সেই সেই দম্পতিরা জীবনের এক দিনও যেন না কাটায়, এটা বড়ই দোষের। এতে দাম্পত্য-জীবনের অনেক বিপদ বিঘ্ন উপস্থিত হয়।
অবোধ নারী
২য় বন্ধু কহিলেন-অভিভাবকেরা আপন আপন মেয়ের শিক্ষার সুব্যবস্থা করে নাই, জুয়াচুরি করে একটা হতভাগাকে ধরে তার গলায় বেঁধে দিয়েছে। ভালোমন্দ কিছু জানে না–নিতান্ত একটা অসভ্য প্রভৃতি কথা ভেবে বধূর উপর ক্রুদ্ধ হয়ো না। সমাজের যা অবস্থা, তা তো দেখতে পাচ্ছ। সমাজ অপরাধী বলে, একটা অবোধ বালিকার উপর ক্রুদ্ধ হয়ে লাভ কি? তার কচি অবোধ প্রাণে ব্যথা দেয়া কোনোমতে উচিত নয়। তার দোষ-ত্রুটি নিয়েই তাকে বিয়ে করেছ-তার দোষ-ত্রুটি দেখে অগ্নিশর্মা হয়ো না। কেরোসিন তেলে জ্বলে মরা, আফিম খেয়ে মরা–হিন্দু সমাজের মেয়েদের দুঃখময় গোপন গৃহ ত্যাগের মূলে স্বামীর জুলুম। স্বামীকে বলি : আমরা যেমনটি চাই, ঠিক বউরা, তেমনটি হবে–এদিক ওদিক হলে কিছুতেই সন্তুষ্ট হবো না। আমি বলি। হৃদয়হীন মূর্খ শ্বশুর-শাশুড়ীর অবহেলা অপরাধের জন্যে কচি দুর্বল মেয়েদের উপর জুলুম করো না। যদি কিছু পড়ে থাকে, যদি ভিতরে মনুষ্যত্বের চিহ্ন থাকে, যদি তোমাদের যুবক-প্রাণে দয়া ধর্ম থাকে–তবে আপন আপন ছেলেমানুষ পরীকে ক্ষমা করো, আগুন হাতে তাকে পথ দেখাও। আঘাত করো না। আবার বলি। আঘাত করো না। ক্রোধ ও বিরোধ মানব মঙ্গলের পথ নয়।
দেশে সুদিন শীঘ্রই আসবে, চিন্তাশীল মানুষ, নারী-জীবনের দুর্গতির কথা ভেবেছেন, যুবকদের অন্তরও তারা বুঝেছেন, দেশে অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জাগবেই। কিছুদিন ত্যাগ স্বীকার কর-নারীকে কিছুদিন ক্ষমা কর নারীকে কিছুদিন দয়া কর। সে ভাত পুড়িয়ে ফেলুক, সে দুধ বিড়াল দিয়ে খাইয়ে দিক, জিনিসপত্র আলগা রেখে কুকুর-বিড়াল দিয়ে খাওয়াক, একখানা জিনিসকে দু’খানা করুক–তবু কিছু বলো না। বধূদের বলি। তাদের শত অপরাধ থাকুক, তাতে দোষ নাই। তারা যেন কখনো অবিনয়ী না হয়; প্রেম করতে তারা যেন ত্রুটি করে, প্রেম ও সতীত্ব নারীর মাথার মণি; আর কিছু তার কোনো দরকার নাই।
১ম বন্ধু–নারী কি প্রেমহীনা নহে?
২য় বন্ধু–নিজের দোষ সম্বন্ধে অন্ধ হয়ে অন্যায় করে নারীকে আঘাত করো না, তাকে প্রেমহীন, অবাধ্য ও অসভ্য বলো না। প্রেমের বলে পশু বাধ্য হয়, তোমরা আপন আপন পত্নীকে বাধ্য করতে পার না? মুখের কথায় এবং কাজেও তোমরা আপন আপন প্রেমের পরিচয় দাও।
নারী, আপন আপন স্বামীকে প্রেম করুক, তার বিপদকে আপন বিপদ মনে করুক, তার আনন্দে আনন্দ প্রকাশ করুক, তার চিন্তাক্লিষ্ট মুখ দেখে বেদনায় সহানুভূতি জানাক; তার সমস্ত অন্তরে প্রবেশ কর। পুরুষ আপন পত্নীকে ”এখান থেকে দূর হও” কখনো না বলুক; বিবাহের পর নারীর স্বামীর সংসারে, স্বামীর ধনসম্পত্তিতে অধিকার জন্মেছে, তাকে অন্যায় করে প্রভুর মতো বলো না-যাও, দূর হও।
পত্নীকে ভালবাস, সে তোমাকে ভালবাসবে, তাকে উত্তম বস্ত্র এবং অলঙ্কার দান কর। তবেই তার বিদ্রোহী মন কাবু হবে। নারী আপন স্বামীকে অন্ন-বস্ত্রের উপহারে ভাল না বাসুক। অলঙ্কারের খাতিরে প্রেম না করুক। সে নিঃস্বার্থভাবে স্বামীকে প্রেম করুক। সে। স্বামীর দয়ার উপর নির্ভর না করে, তার প্রেম ও শ্রদ্ধা লাভ করতে চেষ্টা করুক। দয়ায় বেঁচে থাকা যায় না। মানুষকে দয়া করে প্রেম দেওয়া যেমন কঠিন, প্রেমহীনা নারীকে প্রেম করাও পুরুষের পক্ষে তেমনি কঠিন; বরং অসম্ভব। প্রভুর মতো পত্নীর সঙ্গে ব্যবহার করো না। তাকে বন্ধু মনে কর।, বন্ধু। অনেক সময় সর্বুদ্ধির নামে আমরা শয়তান কর্তৃক প্রতারিত হই। অতএব, জীবনে যাতে চিন্তা-ব্যবহারে, কাজে সত্য শুদ্ধপূর্ণ ও সুন্দর হতে পার, সেজন্য লোকচক্ষুর অন্তরালে আল্লাহতালার কাছে নিরন্তর আন্তরিক প্রার্থনা চাই। সমস্ত জ্ঞান নিয়েও আমরা ক্ষুদ্র ও দরিদ্র, তিনি আমাদিগকে সকার্যে পথ না দেখালে কোনো উপায় নাই।
আল্লাহকে সত্যরূপে প্রেমরূপে যেন আমরা অনুভব করি এবং তাঁর মতো সত্যময় ও প্রেমময় হই।
.
বিরাট কারবার
মগরা রেল স্টেশনের ধারে কাঠের ও লোহার দুইটি বিরাট কারবার দশ বৎসর ধরে চলছে। চেয়ার, বেঞ্চ, আলমারি, খাট, পালঙ্ক অসংখ্য তৈরি হয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে চালান হয়।
লোহার কারখানায় দা, কুড়াল, ছুরি, কাঁচি, ক্ষুর, কড়ি-বড়গা লোহার বিবিধ অস্ত্র বহু পরিমাণে প্রস্তুত হয় এবং তাও সর্বত্র সরবরাহ করা হয়।
উভয বন্ধুর কারবার ও হিসাব স্বতন্ত্র। প্রত্যেকে স্বতন্ত্রভাবে আপন আপন বুদ্ধি ও শক্তি প্রয়োগ করছেন, কারও স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করেন না। অথচ, দুই বন্ধুতে গভীর যোগ এবং পরস্পরে সহানুভূতি আছে।
প্রত্যেক কারবারে ৪ জন করে লোক খাটে। দীর্ঘ সাত বত্সর পরিশ্রমের ফলে কারবারের এই শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। প্রথমত, তিন বৎসর যাবৎ উদ্বেগ পেতে হয়েছে। লোকসানও। গিয়েছে ঢের। কিন্তু তারা কখনও পশ্চাৎপদ হন নাই, কারণ তারা জানতেন কারবারের নিয়ম। প্রথম ধাক্কা সামলাতে না পারলে কারবারে কখনো লাভবান হতে পারা যায় না।
খবরের কাগজে সর্বত্র বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় এবং প্রত্যহ ভুরিভুরি অর্ডার আসে। প্রথম দুই বৎসর মানুষ দুই বন্ধুর কীর্তিকলাপ দেখে অতিশয় হেসেছিল, কিন্তু যারা হেসেছিল, তারাই এখন সাহায্যের জন্য অগ্রসর হয়েছেন। এই দুই বন্ধু তাদেরকে সাধ্যমতো সাহায্য করেন। প্রত্যেকের হস্তে প্রায় এক লক্ষ টাকা মূলধন জমেছে।
অনেক লোক কারখানায় খাটে। তাদের প্রচুর মাহিনা দিতে হয়। অধীনসস্থদর সঙ্গে প্রভু-ভৃত্যের সম্বন্ধ নেই। সকলকেই তারা ভালবাসে এবং প্রেম করে। কর্মচারীদের পরিবারে খুব দুঃখ, অভিযোগের কথা শোনে; তার প্রতিকারের চেষ্টা করে।
নিজেরাই সমস্ত কাজ পরিদর্শন করে। স্ত্রীলোকদেরকেও কাজে ভর্তি করেছে। শ্রমিকদের বেতন প্রতিবৎসর বাড়ে, লাভের অনুপাতে তারা স্বতন্ত্র পুরস্কার পায়। সমস্ত শ্রমিক প্রাণ দিয়ে কাজ করে।
প্রতি পনর দিন অন্তর তারা তাদের নিয়ে সভা করে। তারা সেখানে মহত্ত্ব ও মনুষ্যত্বের কথা প্রচার করে।
তাদের প্রেম অন্তঃসারশূন্য নয়-তারা সকলকে প্রেম করে। শ্রমিকদেরকে ভালবাসে। তাদের বিরুদ্ধে কারো কোনো অভিযোগ থাকলে তারা নিজে এসে তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের কেউ ভয় পায় না।
একদিন ২য় বন্ধু বললেন-বন্ধু, কতকগুলি প্রচারক নিযুক্ত করতে হবে।
১ম বন্ধু–কেন?
২য় বন্ধু–এক সত্য ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপাস্য নাই–
আল্লাহ্ সর্বব্যাপীজীবন ও চেতনা। তিনি সত্য। ‘সত্যেই’ তাঁর এবাদত হয়। কাব্যে, চিন্তায়, ব্যবহারে সত্য রক্ষা করা দরকার, তা হলে তার এবাদত সার্থক ও সুন্দর হবে। মানুষ না দেখুক, না বুঝুক সর্বপ্রকার মিথ্যা বর্জন কর। এই-ই মানুষের একমাত্র ধর্ম, বর্জিত বাইরের সমস্ত ধর্মানুষ্ঠান বৃথা। যা কিছু আত্মীয়পক্ষে অসম্মানজনক মর্যাদা হানিকর তা ত্যাগ করা উচিত।
মিথ্যাবাদী ও শয়তান মুসলমান বলেই নাজাত পাবে না, দুরাচার খ্রিষ্টানের পাপ ভার কখনো খৃষ্ট বহন করবে না-দুর্বৃত্ত হিন্দু শক্তিতে স্বর্গে রাজত্ব করবে না। প্রত্যেক ধর্মের লক্ষ্য এক, সত্যময় হওয়া। জীবনে কোনো জায়গায় কোনো গলদ থাকবে না; তিল তিল করে জীবনকে কলঙ্কমুক্ত করে গঠন করে তুলতে হবে, এর নাম ইসলাম।
২য় বন্ধু–মাঝে মাঝে নির্জনে ২/৩ ঘণ্টা প্রার্থনা করেন। বধূকে সঙ্গে নিয়ে ডোম, চাড়াল ও বাগদীপাড়ায় যেয়ে ধর্ম-কথা প্রচার করে মুনষ্যত্বের কথা শোনেন। কখনো বেশ্যাপাড়ার মেয়েদেরকে পাপজীবন ত্যাগ করতে অনুরোধ করেন। তাদেরকে সাবধান করেন। বলেন, এই মহাপাপের জীবন ত্যাগ কর। আমার কাছে এস, আমি তোমাদেরকে পবিত্র জীবন-যাপনের ব্যবস্থা করে দিব।
সাহিত্য প্রচার, বিদ্যালয় স্থাপন, হাসপাতাল নির্মাণ, কুষ্ঠ আশ্রয় স্থাপন প্রভৃতি বহু সত্ত্বার্যে অর্থ দান করেন। তিনি বলেন। এটা আমার এবাদতের অঙ্গ–শুধু আবৃত্তি আল্লাহর এবাদত নয়।
অনেক সময় আক্ষেপ করে বলেন : খোকা বেঁচে থাকলে, তাকে বিজ্ঞান শিখাতে ইউরোপ পাঠাতাম।
আর একখানি চিঠি
”স্বামী বলবার অধিকার আমার নাই। নারী ধর্মকে অপমান করে আমি যে কি অপরাধ করেছি-তার শাস্তি আমার ঢের হয়েছে। এখন বিদায়ের দিন কি আমায় ক্ষমা করবেন? আমার শয্যাপার্শ্বে এসে দাঁড়াবেন?
কতদিন, কতরাত্রিই না গিয়েছে আমার তোমার প্রতীক্ষায়। কতরাত্র আমি কাটিয়ে দিয়েছি তোমার আগমন। আশায়। আজ পাঁচ বৎসর হতে প্রতিমাসেই একখানা করে চিঠি তোমায়। লিখেছি, কী কঠিন অভিমান তোমার! অপরাধিনীর উপর যে অভিমান করেছ, তা ঠিকই হয়েছে। এইখানি নিয়ে আমার ষাটখানি চিঠি হবে, আর আমার চিঠি লেখা হবে না। খোদা আমার খোকাকে নিয়ে আমার অপরাধ স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল তখনো আমি বুঝিনি।-আজ বুঝেছি। আজ পাঁচ বৎসর হতে পলে পলে বুঝে এসেছি, কিন্তু যখন বুঝেছিলাম, তখন অশ্রু ছাড়া আর আমার সান্ত্বনার কিছু ছিল না।”
“খোকার মা”
আর লিখতে পারলেন না। তার দুর্বল হাতখানি বালিশের উপর পড়ে গেল। চক্ষুর অন্ধকার হয়ে উঠল। কোনো রকমে টানুকে (ভাইয়ের ছেলে) ডেকে তার হাতে চিঠিখানি দিয়ে বললেন–ডাকে ফেলে দিয়ে এস। সুবোধ টানু দ্বিরুক্তি করল না। খোকার মা স্বামীকে ত্যাগ করে আসবার সময় ছয়মাস পর তাহার মাতা মারা যান। তাহার কিছুদিন পর ছেলেটির পীড়া হয়, ও পীড়া সারল না। খোকা অকালে ঝরে পড়ল। সেজন্য খোকার মার মন সত্যিই দুঃসহ ব্যথার যন্ত্রণায় দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। অন্তরের অন্তঃস্থল হতে নিজের পূর্বকৃত ভুল বুঝতে পেরে খোকার বাবা চলে যাওয়ার পর যে জ্বালায় ভুগছিলেন, টানুর হাতে চিঠিখানি দিয়ে তার কিঞ্চিত যেন উপশম হল। আর সেই সঙ্গে স্বামীর গৃহে প্রত্যাগমনের আশায় অধীর আগ্রহে দিন গুণতে লাগলেন।
প্রেরিত চিঠিখানি যথাসময়ে খোকার বাবার হাতে পৌঁছল। কিন্তু এতদিনের অভিমান যেন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। গৃহে ফেরার জন্য আর কোনো আগ্রহ দেখা দিল না। খোকার বাবা চাইছিলেন, যে স্ত্রী স্বামীর কর্তব্যকর্মে মুগ্ধ নয়, এমনকি সময়ে তার বিরুদ্ধাচরণও করেছে তার কাছে আর ফিরে গিয়ে কি হবে? তবুও এ চিঠি তার মনে যথেষ্ট ভাবান্তর এনে দিল।
মানবমনের এমনি একটা স্বভাব ধর্ম যে নিজের মনের জ্বালা অন্যের কাছে বললেও কিছুটা স্বস্তি বোধ করা যায়। তাই খোকার বাবা তার সুখ-দুঃখের সহভাগিনী বলেই সে অর্ধাঙ্গিনী। রসুলুল্লাহ্ও স্ত্রীদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখতে বলেছেন। হয়তো বা অতীতে, বন্ধু-পরী নিজের সম্যক জ্ঞানাভাবে অথবা আপনার আদর্শে বিশ্বাসী না হয়ে আপনাকে ভুল বুঝেছিলেন। সেজন্যই মতান্তর হয়েছিল। তার পর যখন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন, তার পর সে ক্ষমাপ্রার্থিনী হয়ে বারবার চিঠি লিখেছেন। মনপ্রাণ থেকেই এখন আপনাকে চাইছেন। এছাড়াও মাতৃশোক ও পুত্রশোকে তার অন্তর জর্জরিত। এই অবস্থায় অবহেলা ভরে তার কাছ থেকে দূরে থাকাই তাকে শাস্তি দেওয়ার তুল্য। সেজন্য কালবিলম্ব না করে আপনার দেশে যাওয়া উচিত। বিরহের সমান ব্যথা নেই, অনুতাপের চেয়ে দণ্ড নেই। এতদিনকার অনুতাপানলে দগ্ধীভূত হয়ে তার হৃদয়ের সব মালিন্য মুছে গিয়ে আজ তিনি নিখাদ সোনায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্ত্রীকে দূরে রাখলে নিশ্চয়ই আপনি পাপী হবেন।
বন্ধুর উপদেশে যাবতীয় কালিমা মুছে গিয়ে এক স্বর্গীয় দীপ্তির আভাসে খোকার বাবার মন উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি আর বাক্য ব্যয় না করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেখান থেকে উঠে পড়লেন। পরদিন সকালে বাড়ি ফেরার জন্য তিনি ট্রেনে চেপে বসলেন।
আগের পর্ব :
১. দুই বন্ধু
২. পীড়িতের সেবা
৩. শিশুর উল্লাস
৪. প্রবীণের উপদেশ