বাসর উপহার: ৪. প্রবীণের উপদেশ

বাসর উপহার: ৪. প্রবীণের উপদেশ

৪. প্রবীণের উপদেশ

প্রবীণের উপদেশ
সাংসারিক জ্ঞান

২য় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু, যতই জ্ঞানী হও বা নবীনের উপদেশকে উপহাস করো না, প্রবীণেরা জগতে কত ধাক্কা খেয়ে শিখেন, প্রথম বয়সে তা তুমি কল্পনা করতে পার না। অনেক জ্ঞান, অনেক চিন্তা তোমাকে সংসারের সফলতা দেয় না–যেমন দেয় একটা বোকা মানুষের ঠেকে শেখা অভিজ্ঞতা। ঠেকে শিখে জগতে উন্নতি লাভ করতে হলে একটা জীবনে কুলাবে না, সুতরাং বৃদ্ধ, বয়োজ্যেষ্ঠ, প্রবীণের উপদেশ নিয়ে কাজ করা ক্ষতির কথা নয়।

১ম বন্ধু–কোনো কোনো প্রবীণ শিশু অপেক্ষা অবোধ।

২য় বন্ধু বন্ধু, প্রবীণ বলে নয়–সমস্ত মানুষের সঙ্গে আলাপ কর, জিজ্ঞাসা কর–নিজের জ্ঞানের গর্বে চুপ করে থেক না।মানুষের কাছে কোনো কিছুই গোপন নাই–জিজ্ঞাসা করলেই অবগত হবে পুস্তকের জ্ঞান এবং সাংরারিক জ্ঞান স্বতন্ত্র। মানব। সমাজ পুস্তকের জ্ঞানের পরীক্ষার স্থল। পূর্ব হতে যারা জগতের জ্ঞান লাভ করেছে তাদের লব্ধ জ্ঞান যত পার, সংগ্রহ কর-কখনও লজ্জাবোধ করো না–তাহলে লাভবান হবে না। পিতা-মাতা এবং জ্ঞানবৃদ্ধ বয়োজ্যেষ্ঠ্যের উপদেশ এই জন্যই মেনে চলা নিয়ম। তারা পূর্ব হতেই অনেক কিছু জানেন, শোনেন। যারা জ্ঞানবৃদ্ধ তাদেরও স্মরণ রাখা উচিত। তাদের জ্ঞান, ঘৃণা, উপহাস, ক্রোধ ও কর্কশ ভাষা কেউ গ্রহণ করতে চায় না। এমন কি ছেলে মেয়েরাও তা গ্রহণ করে না। মনুষ্য বিনয় এবং প্রেমে তার কল্যাণের কথা শুনতে চায়-অন্য ভাষায় সে কোনো কিছু শুনতে চায় না।

পরের উপর অতিশয় নির্ভর করাও ভালো নয়–নিজের শক্তিতে বিশ্বাসও আবশ্যক-নইলে কোনো কাজে সফলতা লাভ করা যায় না। যে যা বলে তাই শোনা যাচ্ছে, নিজের স্বাধীনতা চিত্ত ও শক্তির উপর নির্ভর না করায় মানুষের মনুষ্যত্ব নষ্ট হয়।

মনুষ্যকে জিজ্ঞাসা কর, আলোচনা কর।-গ্রাহ্য কর না কর তা পরের কথা, যার যে বিষয়ে অভিজ্ঞতা নেই, সে বিষয়ে তার কাছে জিজ্ঞাসা করা বা উপদেশ দেওয়া এ দুটিই খারাপ।

অধ্যতা

২য় বন্ধু–হুকুম প্রত্যাহার করে না? যা বল তো বলই। হুকুমের ব্যাখ্যা ছোটদের কাছে করো না। একটা হুকুম দিয়ে, তখনই দ্বিতীয় হুকুম দিও না বা এক হুকুমের মধ্যে দ্বিতীয় হুকুমও দিও না। হুকুম মুহূর্তের মধ্যে পালিত হওয়া চাই। এই অভ্যাসটি ছেলেরা শিখবে মাকে দেখে।

১ম বন্ধু–বধূরা যদি স্বামীর অবাধ্য হন, তাহলে বাড়ি সুদ্ধ ছেলে-মেয়েরা অবাধ্য এবং অভদ্র হয়।

২য় বন্ধু–যা বলেছ তা ঠিক। বধূদের উচিত কালবিলম্ব না করে স্বামীর কথা শোনা মাত্র তখনই তা কথাটিই না বলে পালন করা, এতে ছেলেদের চরিত্রে বড্ড সুফল ফলে। ছেলে-মেয়েরা মাকে যা করতে দেখে তা অনুকরণ করে-মা যদি অবশ্য দ্বন্দ্বপ্রিয় ও ঢিলে হন, ছেলে-মেয়েরাও তাই হবে। ফলে, ভবিষ্যৎ জীবন তারা নিজেদের জীবন এবং যাদের স্পর্শে তারা থাকবে, তাদের জীবন দুঃখময় করে তোলে।

১ম বন্ধু –স্বামী যদি অভদ্র হন, তবে পরীর পক্ষে তার কথা তখনই পালন করা কঠিন হয়ে ওঠে।

২য় বন্ধু–হ্যাঁ, তা হয়। অভদ্র মানুষের কথা যখন তখন পালন করতে একটু লজ্জাবোধ হয়–কিন্তু সমস্ত স্বামী সকল সময়েই যে অভদ্র হন, তেমন মনে হয় না। আসল কথা হচ্ছে, কোনো কোনো বন্ধু আসলেই অভদ্র এবং অবাধ্য। এরা পরিবারের সুখ-শান্তি নষ্ট করেন। সংসারের কলহ-অশান্তি সৃষ্টি করেন। বাধ্যতার মধ্যে কোনো সময়েই গোলামের হীনতা নেই–এর মধ্যে একটা স্বার্থপর ভাব আছে। বাধ্যতার অর্থ-সেবা, খেদমত এবং প্রেম।

কথা যখন তখনই পালন করা চাই। ভালোমন্দের ভেব না, কোনো কৈফিয়ৎ ও তলব করো না।

১ম বন্ধুপত্নী যদি কোনো সময় স্বামীকে কোনো কথা বলেন?

২য় বন্ধু–হ্যাঁ, সেবার প্রাণ নিয়ে তিনিও তা পালন করবেন। তবে এখানে স্মরণ রাখতে হবে–সংসারের কত্রী বধূ-সকলকে সুখ দেওয়াই তার কাজ–তার পক্ষে চুপটি করে বসে থাকা এবং স্বামীকে হুকুম করা শোভা পায় না। পত্নীর যদি অসুখ হয়, তার সাহায্য করবার কেউ না থাকে, স্বামী তখন আজ্ঞাবহ ভৃত্যের ন্যায় পীর আজ্ঞা পালন করবেন। স্বামীর পক্ষে উচিত নয়, পত্নীকে অন্যায় ও অসম্ভব হুকুম করেন। পানি দাও, বাতাস কর, ভাত দাও, এরূপ করে না বলে আমার পিপাসা লেগেছে, বড় গরম লেগেছে, বড় ক্ষুধা পেয়েছে ইত্যাদি রকমে কথা বলাই উত্তম। যদি স্বামী-স্ত্রী উভয়কে প্রেম করেন, তাহলে উভয়ে উভয়কে সেবা করতে আনন্দ বোধ করবেনকারো হুকুমের অপেক্ষা কেউ করবেন না।

বিবিধ ফল

১ম বন্ধু কহিলেন-বাড়ির কর্তা অনেক সময় আপন দোষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বাড়ির নির্দোষীদের উপর চটে ওঠেন, তাদের গালি দেন-এটি বড়ই অন্যায় বরং অত্যাচার। যে পরিবারে কর্তার বিবেচনা নেই, কর্তা যথেচ্ছাচারী এবং তার একাধিপত্য চলতে থাকে, সে পরিবার শীঘ্রই ধ্বংস হবে। পরিবারের সমবেত শক্তিতে পারিবারিক শ্রীবৃদ্ধি সাধিত হয়। সকলকে অবহেলা করে ঘৃণা করে, চূর্ণ করে একা কর্তার পক্ষে কোনো উন্নতি সম্ভব নয়।

“বন্ধু যে পরিবার আত্মসুখসর্বস্ব, প্রতিবেশীর সুখ-দুঃখের সঙ্গে যাদের যোগ নাই–তারা যতই বড়লোক হোক–তারা অতিশয় নীচ ও হীন। মনুষ্য মাত্রেই প্রেমিক হবে, পরের কথা ভাববে, প্রতিবেশীর সুখ-দুঃখের কথা চিন্তা করবে, শুধু নিজের সুখের কথা বলতেই ভাবে।”

“মনুষ্য দুঃখে পড়লে হেসো না, ঠাট্টা করো না–মনুষ্য জীবন উত্থান পতন দিয়ে গড়া।

“কতকগুলি লোক আছে, কথা বলবার জন্যে তাদের গলা চুলকায়, কিন্তু বলবার নাই, যা কিছু অপ্রীতিকর কথা বলে মনুষ্যকে আঘাত করে–এটি বড় খারাপ।”

“মানুষ যখন দুঃখে পড়ে, তখন অনেক লোকই তাকে উপদেশ দিয়ে যায়। কারোর অযাচিত মুরুব্বী না হওয়া ভালো।”

“নিন্দুককেও কখনও বিশ্বাস করো না-তাকে কখনও আমল দিও না বরং মানব সমাজের শত্রু মনে কর, তারা সকল মানুষেরই নিন্দা করে।”

“বন্ধু, কখনো মিথ্যা বলো না–এটি নীচ লোকদেরই স্বভাব।”

“সস্তা জিনিস পেলেই অপ্রয়োজনীয় কিনো না–কিনো না-আপাতত যা প্রয়োজন নেই, তাও ক্রয় করো না।”

“যৌবনকালে বালক-বালিকার মনে খুবই অহঙ্কার জাগে, মানুষকে অসভ্য বলতে খুব ইচ্ছা হয়–কিন্তু কিছুদিন অপেক্ষা করলেই আর একটা সময় আসে, যখন মনের অহঙ্কার –আর থাকে না। অহঙ্কার করে, জবরদস্তি করে কেউ বড় হতে পারে না। ঋণ পরিশোধ করতে কখনও ইতস্তত করো না-যতোই দেরি করবে, ততই অন্যায় করবে। ততই ঋণ পরিশোধ করবার ক্ষমতা কমে আসবে।”

“বন্ধু, যারা অধিক কথা বলে, তাড়াতাড়ি কথা বলে, চিন্তা না করে কথা বলে–তাদের কথা না বলাই ভালো।”

১ম বন্ধু–সংসারকে ঘরতুল্য করে তুলতে চাও না কি?

২য় বন্ধু–না, তা নয়, ব্যর্থতার ভিতর, হাসির ভিতরও বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। যারা অন্তর দিয়ে কথা না বলে, তাদের মূল্য খুব কম তাদের কথা শোনা অযথা কালক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নয়।

প্রথম বন্ধুর দুঃখ

আশ্বিন মাসের প্রথম তারিখে একদিন সকালবেলা, প্রথম বন্ধুর শ্বশুর বাড়িতে একখানি নৌকা উপস্থিত হইল। খোকা করতালি দিয়া বাবার কাছে যাইয়া উপস্থিত হইল। আর কেহই কোনো কথা কহিল না। কেহ সম্বধনা করে না–১ম বন্ধু বাহির বাড়ির উঠোনে যাইয়া দাঁড়াইলেন এবং খোকার সহিত কথা বলিতে লাগিলেন।

প্রায় এক ঘণ্টা এইভাবে অতিবাহিত হইল। অতঃপর বড় শ্যালক মহাশয় বাড়ির ভিতর হইতে বাহির হইয়া কহিলেন–শালা, কোথায় এসেছিস, যা দূর হ।

খোকা পিতার অপমানে তার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

শ্যালকর কহিলেন–ভদ্র ঘরের কন্যাকে এইভাবে অপমান করে–তুমি যে ভাবে বৌ রেখেছিলে এইভাবে কেউ রাখে না। এই সময় শ্বশুর চড়া গলায় কহিলেন, এই কি ভালো মানুষের কাজি। আমার মেয়েকে এই তুমি দিবারাত্র কষ্ট দিয়েছ, তিরস্কার করেছ; শেষকালে টিকতে না পেরে চলে এসেছে। এখন উচিত তোমাকে উত্তম-মধ্যম দেওয়া।

শাশুড়ী ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন–জামাই-এর সঙ্গে তোমরা কি ব্যবহার করছো? দেখতে পাচ্ছি, তোমরা কতকগুলি ডাকাত।

১ম বন্ধু মর্মান্তিক দুঃখ পাইলেন প্রতি মুহূর্তে ইচ্ছা হইতেছিল–তাহার পত্নী দৌড়াইয়া আসিয়া তাহার এই নিদারুণ দুঃখ অনুভব করে, ভর্ৎসনার প্রত্যুত্তর দেয় এবং চিরদিনের জন্যে স্বামীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিয়া আসে।

বশাশুড়ী জামাতাকে বাড়ির মধ্যে যাইতে অনুরোধ করিলেন। খোকা হাত ধরিয়া টানিতে লাগিল। প্রথম বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলেন।

একটু ঠাণ্ডা হইয়া শ্বশুর অপেক্ষাকৃত শান্ত কণ্ঠে কহিলেন–জমিদারি কাছারীর চাকরি কি একটা চাকুরি! সেটা একটা লেঠেল হবার স্থান-সেখানে কি কেউ ভদ্রঘরের মেয়ে নিয়ে থাকে? কেন, একটা Head Constable নিলেই তো হয়–বারো পোয়া। তিন শো টাকা-এর উপরি আর তিনশত টাকা।-বেশ সম্মানের চাকুরি।-কেন এমনভাবে জীবন মাটি করছে। সন্ধ্যা লাগিতেই ১ম বন্ধু কহিলেন তোমাকে এই বেলা যেতে হবে। কি জানি কেন খোকার মাতা স্বামীর সঙ্গে যাইতে স্বীকৃত হইলেন। খোকাও নাছোড় বান্দা হইল।

ফিরিবার কালে প্রথম বন্ধু অনেক আশা করিয়াছিলেন পিতা ও ভ্রাতার অন্যায় ব্যবহারের জন্যে পত্নী নিশ্চয়ই দুঃখ প্রকাশ করবেন, কিন্তু সে সম্বন্ধে খোকার মা সারা পথে একটা কথাও বলিলেন না, প্রথম বন্ধুও কোনো কথা কহিলেন।

অর্থ শক্তি

খোকা ও খোকার মাতা বাসায় আসিয়াছেন। দুই বন্ধুতে আবার গল্প আরম্ভ হইয়াছে। রাস্তায় বেড়াইতে বেড়াইতে ২য় বন্ধু কহিলেন–জগতে অর্থ শক্তি একটা সামান্য শক্তি নয়। মানব-মঙ্গল উদ্দেশ্যে, আল্লাহর কাজ করবার জন্যে অর্থ সঞ্চয় করো–এর নাম এবাদত। অর্থ ব্যতীত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সগ্রাম কিছুতেই হবে না। নিজের দাম্ভিকতা প্রতিষ্ঠার জন্যে অর্থ সঞ্চয় করো না–পদে পদে মানুষকে জব্দ করবার জন্যে অর্থ সঞ্চয় করো না। ধর্ম ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যেই অর্থ সঞ্চয় করো।

১ম বন্ধু–ধর্মের জন্যে কি চুরি ডাকাতি করা যায়?

২য় বন্ধু–না, কোনো কোনো সম্রাট, দার্শনিব ও ধর্মগুরু ধর্ম ন্যায় স্থাপনের জন্য ডাকাতি, নরহত্যা ও যুদ্ধ সমর্থন করেছেন বটে–কিন্তু এ সত্য পথ নয়। মনুষ্য ধর্ম ও সত্যের ভিতর দিয়েই ধর্ম ও ন্যায় স্থাপন করবে। এক জনের দ্বারা এ সম্ভব হতে পারে-ধর্ম ও ন্যায়ের পতাকাতলে মানুষ মিলিত হয়ে কাজ করবে। এক জনের দ্বারা সম্ভব হতে পারে–ধর্ম ও ন্যায়ের পতাকাতলে মানুষ মিলিত হয়ে কাজ করবে। সত্য ও ন্যায়ের সেবক যারা, তারা একজন আর একজনকে প্রাণ অপেক্ষা প্রেম করবে, সুখ দুঃখ সমান ভাগে বিভক্ত করে নেবে। জগতে ন্যায় ও সত্য স্থাপনের নামই ধর্ম।-এর জন্যে যা কিছু কর–সবই পুণ্যজনক। এ সাধনার শ্রেষ্ঠ বল অর্থ এবং সত্যের প্রতি অচল অটল শ্রদ্ধা।

পেট মোটা করবার জন্যে, মানুষের সঙ্গে ফ্যাসাদ করবার জন্যে, মানুষের সালাম-শ্রদ্ধার আশায় বড়লোক হয়ো না-এ আকাক্ষা পশুর আকাঙ্ক্ষা। সত্য। বলছি-এ আকাক্ষা পশুর আকাক্ষা! নীচ, হীন, দুর্মতি, শঠ, প্রতারক, কাপুরুষ, মিথ্যাবাদী এবং স্তাবক হয়ে বড়লোক হবার কোনো দরকার নেই।

১ম বন্ধু–বড়লোক কি মানুষ ইচ্ছা করে হয়?

২য় বন্ধু তুমি যা বলেছ তা অনেকাংশে সত্য। অবস্থার চক্রে কতকগুলি অযোগ্য মানুষও বড়লোক হয়। অর্থের সঙ্গে অনেক সময় যোগ্যতা ও মনুষ্যত্বের কোনো সম্বন্ধ থাকে না।

১ম বন্ধু–মানুষ কি accidentally বড়লোক হয়?

২য় বন্ধু–অনেকটা তাই।–অবস্থার বিরুদ্ধে অনুযোগ–অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই। চুপ করে বসে থাকতে হবে, অপেক্ষা করতে হবে–যদি কখনও অবস্থা তোমাকে ধনী ও অর্থশালী করে, সে ধন-সম্পদ আল্লাহর কার্যে ব্যয় কর। দরিদ্রের দাবি রক্ষা, দুঃখীর দুঃখ মোচন, অত্যাচারের অবসান পতিতের উদ্ধার, পীড়িতের সেবা, জ্ঞান প্রচার, এরই নাম কার্য।

আইনও সংসারের জ্ঞান

২য় বন্ধু কহিলেন–প্রত্যেক ভদ্রলোকের চাই, যিনি সংসারে বাস করেন, কিছু আইন-জ্ঞান লাভ করা, নইলে বোকা হয়ে থাকতে হয়। কোনো পথ বলা চলে না।

১ম বন্ধু–কী ধরনের আইন-জ্ঞান? সংসারের এত হাঙ্গামার মধ্যে কি আবার ওকালতি পড়া চলে?

২য় বন্ধু–না, তা বলছি নে। Penal Code, Mohammedan Law, Bengal Tenancy Act and Criminal Code এই কখানি আইনের জ্ঞান প্রত্যেকের খুব ভালোভাবেই থাকা উচিত।

১ম বন্ধু–সত্য ছাড়া মিথ্য না জানলে, সাধু আত্মা, চরিত্রবান ধার্মিক যে, তার আবার আইন জ্ঞানের কী প্রয়োজন?

২য় বন্ধু–হ্যাঁ, খোদার মতো একটা Law অর্থাৎ The law of Love and Truth এইটেই বড় কথা, তাহলেও দেশের আইন জানতে হবে। দুষ্টের হাত থেকে আত্মরক্ষা তো চাই। আঘাত করো না, কিন্তু যে আঘাত করে তার হাত থেকে বাঁচা তো চাই–ধড়িবাজ লোকদের চালবাজিও খুব অসহ-আইন জ্ঞান না থাকলে পদে পদে বিড়ম্বিত হতে হয়। অনেক লোকের রক্ত চক্ষু ও অন্যায় ব্যবহার দেখে চুপ করে থাকতে হয়–সেটা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়!

সাধু আত্মা এবং ধার্মিক কখনও বোকা নয়। যে ধার্মিক এবং সৎলোক, তার সংসার ঠেলে আনা জ্ঞান থাকা চাই-ই। পরের ক্ষতি করবো, ছিদ্র অন্বেষণে সর্বদা ব্যস্ত থাকব, লোককে জব্দ করবো, এইসব হীন উদ্দেশ্য নিয়ে সাংসারিক জ্ঞান লাভ করতে হবে তা নয়। এ জ্ঞান থাকা সকলেরই উচিত, নইলে জীবনের শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সাংসারিক বিচক্ষণতার অভাবে অনেক লোক জীবনে বহু দুঃখ পায়-ঠক প্রতারকেরা ঠকিয়ে। যায় কিছু বলবার বা করবার উপায় থাকে না। কত বড়লোক সাংসারিক জ্ঞানের অভাবে-তাদের জমিদারি হারিয়েছেন, বে-আইনী কাজ করে বিপদে পড়েছেন। কত কর্মচারী আইন-জ্ঞানহীন নিরীহ গ্রামবাসীর উপর কত অত্যাচার করে ফাঁকি দিয়ে কত পয়সা তাদের কাছ থেকে আদায় করে। কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না।

১ম বন্ধু–এ সব শেখা কি কঠিন কাজ নয়?

২য় বন্ধু–সাংসারিক জ্ঞান লাভ করবার জন্যে বাজারে অনেক বই আছে–তবে কারো কারো মাথায় এ সব ব্যাপার অতি সহজে ঢোকে, কারো বুঝতে কিছু বিলম্ব হয়–একটু একটু করে চেষ্টা করলে কিছু না কিছু শেখা যায়।

গোপন প্রেম

বন্ধু, নারী-পুরুষের গোপন, অভদ্র লজ্জাজনক ব্যবহারের নাম প্রেম নয়-এর শেষ ফল বড়ই খারাপ। কটাক্ষ, গোপন হাসি, এগুলি বিষের মতো যুবক যুবতী বর্জন করবে। অবোধ যুবক-যুবতীরা যখন পশুভাবে কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়, তখনই তারা নানা অশ্লীল পথে নিজ নিজ কাম কলুষের পরিচয় দেয়, এই প্রেমকে যে বিশ্বাস করেছে সেই মরেছে। সমূহ অপমান, দুঃখ, বিড়ম্বনা এর ফল। খবরদার, খুব সাবধান! প্রেম যা তা সর্বদাই সুন্দর, কুসুমের মতো নির্মল, গন্ধময়–অতি পবিত্র-হৃদয়ের গোপন গুহায় তা ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হতে থাকে। প্রেম কখনও প্রতারণা করে না তা নির্ভীক। প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পরকে অপমান করে না। অবৈধভাবে কেউ কাউকে ভোগ করে না–তা কখনও প্রেম নয়–তা ইতর পশুবৃত্তি। প্রেমের নামে, যে সব পৈশাচিক ঘটনা মানব সমাজে ঘটে তা অতিশয় ভয়াবহ। পিশাচ প্রকৃতির লোকেরা নারীজাতিকে অতি নিকৃষ্টভাবে আনয়ন করে-নারী শয়তানী ও পিশাচী হয়। সে ভয়ঙ্করী মূর্তি ধারণ করে মানবী নামের অযোগ্য হয়। যা আরম্ভ হয় প্রেমের নামে, শেষ হয় বিষে জ্বালায়। প্রেমের এই অপব্যবহার হয় বলেই মনুষ্য প্রেমের নামে লজ্জা পায়, প্রেমকে ঘৃণা ও ভয় করে।

নারী হও, পুরুষ হও, অভিভাবকদের অমতে গোপনে কখনও একে অন্যকে অবৈধভাবে ভোগ করতে যেয়ো না–যেখানে এরূপ সন্দেহ হয়, সেখান হইতে তীরের মতো পলায়ন করবে। কটাক্ষ বা হাসি, এ সবের সঙ্গে প্রেমের কোনো সম্বন্ধ নেই এসব শয়তান নর-নারীর পাপ বাসনা তৃপ্তির অস্ত্র মাত্র। এগুলিকে কখনও বিশ্বাস করো না। প্রেম যেখানে সত্য, সেখানে দুইটি আমাকে স্বর্গীয় গাম্ভীর্যে পরস্পরের দিকে আকর্ষণ করে। একজন আর একজনের সামনে সভয়ে দণ্ডায়মান হয়। একজন আর একজনকে আঁখিজলে। নমস্কার করে দেবতা ভেবে পূজা করে।

।প্রেম কখনও যুবক-যুবতাঁকে গোপনে বাড়ির বাহির করে না–অহঙ্কার নিশীথে প্রেমিক প্রেমিকা কখনও যায় না ও টাকা চুরি করে পলায়ন করে না–এ সব শয়তানের কাজ। পূর্বেই বলেছি প্রেম কখনও কাপুরুষ, ভীরু নয়–সে তার দাবি সাহসের সঙ্গে আদায় করে। যেখানেই গোপন কানাকানি, লজ্জাসঙ্কোচ হবে, সেইখানে পাপ আছে–তা বিষবৎ ত্যাগ করবে–তা কখনও প্রেম নয়-তা মাংসের উত্তেজনা মাত্র।

আগের পর্ব :
১. দুই বন্ধু
২. পীড়িতের সেবা
৩. শিশুর উল্লাস
পরের পর্ব :
৫. কনিষ্ঠদের ব্যক্তিত্ব

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত