০৭. রহস্য-সংকেতের কাগজ
ঘনাদা বললেন, রহস্য-সংকেতের কাগজ নিয়ে তার অর্থ বোঝার জন্য যে তিনজন খানিক আগে আমার ডেরায় এসেছিল, তাদের মধ্যে আসল ধুরন্ধরকে আমি চিনতে পেরেছি মনে হল। এখন প্রথম কাজ হল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে খুঁজে বার করে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা।
কিন্তু ডুগান আর কার্ভালোর আগে তা কি আমি পারব?
ছদ্মবেশ চেহারায় আসা আসল আসামিকে তারা ঠিক মতো চিনতে না পেরে থাকলেও সে যে তিনজনের একজন, এ বিষয়ে তো তাদের কোনও সন্দেহ নেই। আমি যখন বিশেষ একজনকে খুঁজব, তাদের তখন পরপর তিনজনের পেছনে লেগে থেকে আসল ধুরন্ধরকে খুঁজে বার করতে হবে।
কিন্তু তিনজনের বেশি চারজন তো নয়। ভাগ্য একটু সদয় হলে আমার আগেই তারা আসল লোককে পাকড়াও করতে পারবে নাই বা কেন?
যাকে আসল আসামি বলে চিনে ফেলেছি বলে আমার ধারণা, তাকে খুঁজে বার করাও আমার পক্ষে মোটেই সোজা নয়। তার ছদ্মচেহারাটাই আমি দেখেছি। সেই ছদ্মচেহারা যদি সে এখন চটপট পালটে না-ও ফেলে থাকে, তা হলেও তার আস্তানা খুঁজে বার করে তার সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যোগাযোগের ব্যবস্থা করার কী উপায় আছে?
ভাগ্য একটু সহায় বলে সেই উপায়ই হল। কার্ভালো আর ডুগান হন্যে হয়ে যাকে খুঁজছে, খুব বেশিদিন সে বিলেতে এসে নামেনি। হিথরোতে নেমেই সম্ভবত লকনেসের রহস্যের টানে ইনভারনেসে রওনা হলেও সেটা মাসখানেকের চেয়ে বেশি আগের ব্যাপার হতে পারে না। কার্ভালোদের শিকারের খোঁজ করতে হলে ইনভারনেসের গোনাগুনতি ছোটবড় হোটেলের রেজিস্টারে মাস-দেড়েকের মধ্যে আসা-যাওয়া বোর্ডারদের পরিচয়গুলো সংগ্রহ করতে হয়। আসল আসামির সে পরিচয় মিথ্যে হলেও তার হোটেলের বোর্ডার হওয়ার তারিখটা থেকে যা জানবার তা আঁচ করা যেতে পারে।
হোটেলের বদলে আমার মতো বাসা-ভাড়া করা মক্কেলের খবর এভাবে পাওয়া যাবে না জেনেই প্রথম দুটো বড় হোটেলে গিয়ে খোঁজ করতেই ভাগ্যের জোরে আসল মক্কেলেরই খোঁজ পেলাম বলে মনে হয়।
এ-হোটেলে ঠিক মাস-দেড়েক আগেই এই মক্কেলটি এসে বোর্ডার হয়েছে। আরও অনেকের মতো লকনেসের রহস্যভেদই আসল নেশা হলেও মানুষটার চালচলন একটু অদ্ভুত।
এই মানুষটার সঙ্গে দেখা করতে চাই শুনেই হোটেলের রিসেপশনিস্ট সোজাসুজি জানিয়ে দিয়েছে যে, সেটা কোনওমতেই সম্ভব নয়। কারণ এই অদ্ভুত মানুষটি কারও সঙ্গে দেখা করেন না, যে-কোনও দর্শনপ্রার্থীকে সেকথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেবার নির্দেশ তিনি হোটেলের ম্যানেজমেন্টকে দিয়ে রেখেছেন।
যাকে খুঁজছি, এমন আশাতীত ভাবে তার সন্ধান পাওয়ার পর এরকম নিষেধের বেড়ায় বাধা পেয়ে কী করব তাই ভাবছি, এমন সময়ে আমার মক্কেলই স্বয়ং হোটেলের লবিতে ঢুকে কাউন্টার থেকে তাঁর সুইট-এর চাবিটা চেয়ে নিয়ে গেছেন।
ভদ্রলোক হোটেলের কাউন্টারে আমারই পাশে দাঁড়িয়ে হোটেল-ক্লার্কের কাছ থেকে তাঁর চাবিটা নিয়ে গেলেও সে সময়টায় তাঁর সঙ্গে কোনওরকম আলাপের চেষ্টা করিনি। তিনি লবি থেকে হোটেলের লিফটে তাঁর ওপরতলার স্যুইটে উঠে যাবার পর হোটেলেরই নিজস্ব ছাপ-মারা একটা কাগজ চেয়ে নিয়ে তাতে যা লেখবার তা লিখে হোটেল-ক্লার্ককে সেটা ওপরে ওই ভদ্রলোকের কাছেই পাঠিয়ে দিতে বলেছি।
একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়েও হোটেল-ক্লার্ক একজন জ্যানিটরকে দিয়ে কাগজটা পাঠিয়ে যে রকম মুখভঙ্গি করেছে, তাতে বোঝা গেছে, এ চিঠির জবাবে আমার ওপরে যাবার ডাক আসবার কোনও আশাই নেই।
কিন্তু ডাক সত্যিই এসেছে হোটেলের সকলকে অন্তত অবাক করে।
আমি অবশ্য জানতাম যে ডাক আসবেই। কারণ চিঠিতে আমি শুধু মৎস্যাবতারের শ্লোকের প্রথম লাইনটুকু সংস্কৃতে লিখে তার নীচে ইংরেজিতে লিখেছিলাম, সামনে দারুণ বিপদ। তবু হারের খেলায় জেতার মন্ত্র শোনাতে এসেছি।
এ চিঠি পাঠাবার খানিক বাদেই চিঠি যাঁকে লিখেছি তাঁর হুকুম পেয়ে জ্যানিটর যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি নেমে এসে আমায় সঙ্গে করে ওপরের তলার স্যুইটে পৌঁছে দিয়েছে।
স্যুইটটা সত্যিই শৌখিন। আমির-ওমরাহের থাকার মতো। সাজসরঞ্জাম আর মালপত্র দেখে বর্তমান দখলকারী বোর্ডারের চালচলন, অবস্থা আর চরিত্র সম্বন্ধে বেশ কিছু হয়তো জানা যায়, কিন্তু সেসব দিকে নজর না দিয়ে আমি সোজাসুজি প্রথম থেকেই আমার আক্রমণ শুরু করেছি।
দেখা করার অনুমতি দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ, পাবলো জুহেনা, মাফ করবেন, নামটা যা নিয়েছেন তা ঠিক যেন খাপ খাচ্ছে না। নামটার মান রাখতে চেহারাটা যা পালটাবার চেষ্টা করেছেন তাতেও বড় গলদ থেকে গেছে। পাবলো জুহো বলে নামটা তো নিয়েছেন ফিনিশ মানে ফিনল্যান্ডের লোকের। কিন্তু তার জন্যে ছদ্ম চেহারা যা নিজেকে দিতে চেয়েছেন তা তো একেবারে নামের সঙ্গে মিলছে না।
নামটা যাদের নিয়েছেন, সেই ফিনদের মাথার চুল প্রায়ই লালচে আর চোখের তারা কিছুটা বাদামি সাধারণত হয় বটে, কিন্তু সত্যিকারের ব্লদ যাকে বলে, সেই ঈষৎ লালচে ধপধপে ফরসা তারা কখনও হয় না। তা ছাড়া, ফিনরা বেশির ভাগই সুইডিশ বা নরওয়ের লোকের তুলনায় একটু বেঁটেখাটো হয়ে থাকে। চোখের তারা তাদের একেবারে নীলও কখনও হয় না।
আপনি চোখের তারার রং লুকোতে বাদামি রঙের কনট্যাক্ট লেন্স লাগিয়ে খানিকটা ধোঁকা দিতে পেরেছেন সত্যি, মাথার সোনালি চুলেও বেশ একটু লালচে ছোপ ধরাতে পেরেছেন, কিন্তু লম্বা-পাতলা দেহটাকে বেঁটেখাটো করা যে ভোজবাজিতে ছাড়া সম্ভব হয় না। তার ওপর মুখ আর হাত-পার খোলা জায়গায় বেশ কয়েক পোঁচ পালিশ দিলেও ভেতরের পাকা ব্লদ মানে দুধে-আলতা আভাকে একেবারে চাপা দেওয়া যায়নি।
শুনুন, পালো জুহো, আসল নাম আপনার যা-ই হোক, আপাতত পাবলো জুহো নামেই আপনাকে ডেকে বলছি, এই নাম বদলে ছদ্ম-চেহারা নিয়ে আপনার লাভ কী হচ্ছে? সাধারণ গোলা লোককে আপনি ফাঁকি দিতে পারেন, তাদের আপনার আসল নাম আর পরিচয় নিয়ে মাথাব্যথা থাকবারও কথা নয়। কিন্তু সত্যিকার কাজের কাজ তাতে আপনার কিছু হচ্ছে কি?
বেশ ধৈর্য ধরেই ঘরের একটা সোফায় বসে আমার কথা শুনতে শুনতে মানুষটা হঠাৎ যেন খেপে গিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে কুকুর-তাড়ানোর মতো আমাকে তাড়া দিয়ে বললে, যান, যান, বেরিয়ে যান এ ঘর থেকে। কে আপনি যে, আমায় আমার ঘরে ঢুকে যত বাজে কথা শোনাতে এসেছেন! আমি যদি নাম ভাঁড়িয়ে থাকি, তা হলে সে আমার খুশি। আর কারও তাতে কী আসে যায়?
আর কারও নয়। আমি গলাটা আগের চেয়ে নামিয়ে শান্ত স্বরে বলেছি, আসে যায় আপনারই। এবং কেন যায় তা আপনি ভাল করেই এখন জানেন। যাদের জন্য নাম ভাঁড়িয়ে এমন করে লুকিয়ে বেড়িয়েছেন, তারা যে আপনার পেছনে এখনও কীভাবে লেগে আছে, আজ তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আপনি পেয়েছেন। তারা অতরকম খুঁত থাকলেও ছদ্ম-চেহারায় আপনাকে চিনতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু আজ না পারলেও কিছুদিন বাদেই তাদের চোখে ধূলো দেওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কারণ আর কিছু না বুঝে থাক, যে তিনজন আজ তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেছল, তাদের আসল শিকার যে সেই তিনজনেরই একজন, এটুকু তারা ঠিকই এখন বুঝে ফেলেছে। সুতরাং এক এক করে তিনজনকেই খুঁজে বার করবার জন্য তারা যা কিছু করা সম্ভব তা করতে বাকি রাখবে না। ইনভারনেস লন্ডন কি প্যারিসের মতো এত বড় শহর নয় যে বাড়িঘর আর মানুষের ভিড়ের জঙ্গলে সেখানে চিরকাল না-ও যদি হয়, বেশ কিছুদিন অন্তত লুকিয়ে থাকা যায়। তা ছাড়া আপনাকে যারা খুঁজছে তারা কী ধরনের মানুষ তা জানতে নিশ্চয় আপনার বাকি নেই। চটপট আপনাকে খুঁজে বার না করতে পারলেও তারা খোঁজায় ক্লান্ত হবে না। সহজে খোঁজ না পেলে তারা হন্যে হয়ে আপনার সন্ধানে যা কিছু সম্ভব তার কোনও ফন্দি খাটাতে বাদ রাখবে না। কিছুতে না পারলে তারা আপনার আসল পাসপোর্ট যে নামে আছে, সেই নামের যে-মানুষ হঠাৎই এই ইনভারনেস শহরে আসার পর নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে, তাকে খোঁজার জন্য পুলিশের সাহায্য চাইবে।
বিলেতের পুলিশ কী বস্তু, তা আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে। কোনও কিছু নিয়ে হেলাফেলা করা তাদের কুষ্ঠিতে লেখেনি। সুতরাং মেকিয়াভেলির বুদ্ধি নিয়ে যত ফন্দিফিকিরের ওস্তাদই আপনি হন না কেন, এখানে থাকলে ধরা আপনাকে পড়তেই হবে। আপনার একমাত্র বাঁচবার উপায় এখন এ শহর ছেড়ে চলে যাওয়া।
না, না। মঁসিয়ে জুতো প্রায় যেন আর্তনাদ করে উঠলেন, এ-শহর ছেড়ে এখন আমি যেতে পারব না। এখান থেকে এখন চলে যাওয়া মানে বেঁচে থাকার আর কোনও মানেই না থাকা।
কিন্তু এখানে কতদিন থাকতে পারবেন আপনাদের দুশমনদের দৃষ্টি এড়িয়ে? বেশিদিন যে পারবেন না, আর ওদের কাছে ধরা পড়লে কী দশা যে আপনার হবে, তা আপনি ভাল করেই জানেন।
জানি, জানি। সিয়ে জুহহা আমার দিকেই বিষদৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, সেই নরকযন্ত্রণার দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবার জন্যই পরিচয় আর চেহারা সবকিছু বদলাবার চেষ্টা করে এদেশে ওদেশে গা-ঢাকা দিয়ে ফিরতে ফিরতে শেষে এইখানে এসে এমন একটা কিছু করবার পেয়েছি, যাতে রহস্যভেদ করতে পারলে একটা আশ্চর্য কীর্তির সঙ্গে নিজের নাম জড়িয়ে রেখে যেতে পারব।
আমি যদি বলি এখান থেকে আপনি আর-এক বিশেষ জায়গায় চলে গেলেই সে আশ্চর্য কীর্তি আপনার নামের সঙ্গে জড়িত হতে বাধ্য?
তা হলে বলব, মঁসিয়ে জুতো বেশ একটু তেতো গলায় বললেন, আমায় ছেলে-ভোলানো ধাপ্পা দেবার চেষ্টা করছেন। শুনুন, আশ্চর্য কীর্তি বলতে কীসের কথা বলছি তা আপনি নিশ্চয় কিছুটা বুঝেছেন, তবু আমি কতদূর যে এগিয়েছি তা আপনি কেন, এ কাজে যারা মেতে আছে তারা কেউ বোধহয় কল্পনাই করতে পারবে না।
এগিয়ে যাওয়াটা কতদুর আর কোথায়, তা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার দরকার হল না। মঁসিয়ে জুহো নিজের উৎসাহের আবেগেই বলে চললেন, আমি যদি বলি, এতকাল ধরে এতবার লকনেসের মধ্যে জলচর দানবের মতো কিছু থাকার বহু প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও কেন কেউ তার জীবন্ত একটা ছবি বা তার দেহের কিছু হাড়গোড়ও সংগ্রহ করতে পারেনি? কেন এতদিনে বংশবৃদ্ধির দরুন অন্তত শ-দেড়েক ওই প্রাণী লকনেসে নিশ্চিত আছে বলে বিশ্বাস হলেও তাদের একটিকেও ঠিক মতো ধরাছোঁয়া যাচ্ছে না? তারা যে আছে, সে-বিষয়ে সন্দেহ না থাকলেও তারা কোন ভোজবাজিতে কনেসের মধ্যে কোথায় উধাও হয়ে যাচ্ছে? ধরাছোঁয়ার চেষ্টা হলেও এ সমস্ত রহস্যের সঠিক উত্তর কী হতে পারে, তা কেউ এখনও কল্পনাও করতে পেরেছে কি?
তা বোধহয় পেরেছে!
আমার কথায় চমকে উঠে মঁসিয়ে জুতো বেশ একটু অবিশ্বাসের সুরে কড়া গলায় জানতে চেয়েছেন, কে পেরেছে? কে?
যথোচিত বিনয়ের সঙ্গে বললাম, যদি বলি, আমি?
আপনি? মঁসিয়ে জুহোর গলায় অবজ্ঞার সঙ্গে একটু বিস্ময়ও মেশানো, কী, কী বুঝছেন আপনি? কী উত্তর পেয়েছেন ওই ধাঁধার?
আপনি যা পেয়েছেন, তা ছাড়া আর কিছু নয় বোধহয়। ইচ্ছে করেই মঁসিয়ে জুহোকে একটু জ্বালিয়ে বলেছি, ওই একটি ছাড়া রহস্যের সহজ ব্যাখ্যা আর কিছু আছে বলেই মনে হয় না।
কিন্তু ব্যাখ্যাটা কী? জুহো জ্বলে উঠেছেন, কী আপনি বুঝেছেন, সেইটে স্পষ্ট করে বলুন না!
স্পষ্ট করে বলতে হলে, যেন অত্যন্ত সনির্বন্ধ অনুরোধ রাখতে হচ্ছে এমনভাবে বলেছি, আর কিছু নয়, উত্তরটা শুধু এই যে, লকনেস নামে হ্রদটার বাইরের মাপ লম্বায় চল্লিশ মাইল হলেও আসল মাপ খুব সম্ভবত আরও অনেক বেশি। বাইরে যা দেখা যায়, তা বাদে এই হ্রদ পাতালসাগর হয়ে এই ইনভারনেস অঞ্চলের পাহাড়ি উপত্যকার নীচে বহুদূর পর্যন্ত গভীরভাবে ছড়িয়ে আছে। ওপরে যে হ্রদ আমরা দেখতে পাই, তার সঙ্গে সেই পাতালদের যোগাযোগ আছে ঠিকই, কিন্তু তা খুঁজে বার করতে হলে সমস্ত হ্রদটাই তন্নতন্ন করে জরিপ করতে হয় বলে তা আপনার আমার তো নয়ই, মার্কিন ধনকুবেরদেরও সাধ্য যদি বা হয়, শখ করে মেতে ওঠবার মতো কাজ হবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া আদ্যিকালের এক আজগুবি জানোয়ার সত্যি এখনও আছে কি নেই, তার প্রমাণ পাবার জন্য ব্রিটিশ সরকার তার দেশের পাহাড়-জঙ্গল অমন খোঁড়াখুঁড়ি করে তছনছ করার অনুমতি দেবে বলেও মনে হয় না।
মঁসিয়ে জুতোর মুখটা বেশ একটু করুণ হয়ে এসেছে, তা লক্ষ করে এবার বললাম, না, মঁসিয়ে জুহো, আপনার বৈজ্ঞানিক অনুমানটা যত সঠিকই হোক, নেহাত অচল টাকায় কেনা লটারির টিকিটে ডার্বি সুইপ পাওয়ার মতো ভাগ্যের অবিশ্বাস্য কৃপা না হলে বাকি জীবনভর আগাগোড়া লকনেসের বুকে ড়ুবুরি হয়ে খুঁজলেও পাতালসাগরের সঙ্গে কোথায় তার যোগাযোগ হয়েছে তা খুঁজে পাবেন না। আর খুঁজে পেলেও বা লাভ কী হবে? পাতালসাগরের খোঁজ পেলেই সেখান থেকে জ্যান্ত। কি মরা, বাচ্চা কি বুড়ো লকনেসের জলচর দানব ধরে আনতে পারবেন কি না, তা পারবার একমাত্র উপায় আমি যা পরামর্শ দিচ্ছি তা অগ্রাহ্য না করা। শুনুন মঁসিয়ে জুহো, লকনেসের রহস্য চিরকালের মতো যথার্থই ভেদ করবার গৌরব যদি না-ও চান, নিজেকে বাঁচাবার জন্য ইনভারনেস থেকে সম্ভব হলে এই মুহূর্তে আপনার চলে যাওয়া একান্ত দরকার। যাদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য আপনাকে এমনভাবে এখান থেকে তাড়াবার চেষ্টা করছি, তাদের আসল পরিচয় আপনি আমার চেয়ে ভাল করেই জানেন। ভারতবর্ষের জঙ্গলে কেঁদো বাঘেরা পর্যন্ত যাদের অন্তত ক্রোশখানেকের ফাঁক রেখে এড়িয়ে চলে, সেই জংলি কুকুরের পালের চেয়ে এরা বুঝি ভয়ানক। একবার নিজেদের দাঁতের কামড় যার ওপর এরা বসিয়েছে তার আর রক্ষে নেই। এরা কে—
জানি, জানি। আমার কথার মাঝে যেমন অধৈর্যের সঙ্গে তেমনই ভীত গলায় মঁসিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, সব আমি জানি। তবু বলছি, আপনি দয়া করে থামুন। আমার এখানে থাকা মানে যদি ওই শয়তানদের হাতে আবার পড়া হয়, তা হলে আমার এখন এখান থেকে পালানো মানেও এমন এক হার মানা, যার পর বাঁচবার কোনও মানেই আর থাকে না। না, না। কোথাও আমি এখন আর কিছুতেই যাব না। ওরা জংলি কুকুরের পালের মতো আমায় খুঁজছে এটা ঠিকই, কিন্তু তবু আমায় এখনও তো ধরতে পারেনি। আজ বলতে গেলে ওদের নিজেদের বাসা থেকেই। নিরাপদে আমি ঘুরে এসেছি। আপনি আমার ছদ্মবেশের ভুল দেখিয়ে দিয়েছেন বটে, কিন্তু সে ক্ষমতা ওদের হয়নি। এমনই করে আর কটা দিন যদি আমি ওদের হাত এড়িয়ে থাকতে পারি, তা হলে লকনেসের রহস্য হয়তো সত্যিই আর অজানা থাকবে না। আর তা যদি আমার দ্বারা সম্ভব হয়, তা হলে জংলি কুকুর কি বাঘ-সিংহের বদলে ওরা আমার কাছে নেংটি ইঁদুর হয়ে যাবে, তা কি বুঝতে পারছেন না?
তা পারছি। হতাশভাবে মঁসিয়ে জুতোকে বোঝাবার চেষ্টা করে বললাম, কিন্তু পুরোপুরি লকনেসের রহস্য-ভেদের উপায় সত্যিই যদি আপনি পেয়ে যান, তার সময় যে কিছুতেই আপনি আর পাবেন না। ওরা আজ আপনাকে সামনে পেয়েও চিনতে পারেনি আর পাবেন না। ওরা আজ আপনাকে সামনে পেয়েও চিনতে পারেনি তা ঠিক, কিন্তু ওরা তো তাতেই হার মেনে এখান থেকে চলে যাবে না। ওরা এইটুকু নিশ্চিত জানে যে, আজ যে তিনজন ওদের সঙ্গে দেখা করতে গেছল তাদের একজনই ওদের আসল শিকার। সেই একজনকে প্রথমে নিজেদের চেষ্টায় খুঁজে বার করতে না পারলে শেষ পর্যন্ত ওরা এখানকার ব্রিটিশ পুলিশের সাহায্য যে নিতে যাবে তাতে কোনও ভুল নেই।
পুলিশের সাহায্য? একসঙ্গে আতঙ্ক আর সন্দেহ-মেশানো গলায় ঘঁসিয়ে জুতো বললেন, পুলিশের সাহায্য ওরা কী করে নেবে? এদেশের পুলিশের নজর দেবার মতো কোন অপরাধ আমি করেছি?
না, তা করেননি, দুঃখের সঙ্গেই জানালাম, তাই ওরা আপনার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ জানিয়ে পুলিশের সাহায্য তো চাইবে না।
তা হলে? রীতিমত অবাক আর সেইসঙ্গে আমার মাথার সুস্থতা সম্বন্ধে স্পষ্ট সন্দেহের সুর নিয়েই মঁসিয়ে জুহো জানতে চাইলেন, কী বলে ওরা এখানকার পুলিশের সাহায্য চাইবে?
চাইবে, যতদূর সম্ভব সোজা করে কথাটা মঁসিয়ে জুহোকে বোঝাবার চেষ্টায় বললাম, ওদের তো বেশি কিছু হাঙ্গামা করতে হবে না। ওরা শুধু যে নামে বাইরের দুনিয়ায় এতকাল আপনি পরিচিত ছিলেন, সেইটি জানিয়ে আর আপনার আসল চেহারার একটা ফোটো দিয়ে পুলিশের কাছে জানাবে যে, তাদের সঙ্গী হিসেবে এই ইনভারনেসে আসার পথে আপনি হঠাৎ রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। তাই তারা–
না, না, না, না। আমার কথার মাঝেই অস্থির উত্তেজনায় বাধা দিয়ে মঁসিয়ে জুহো বললেন, আমার আসল নাম, আসল চেহারা—এসব কী বলছেন আপনি? পু-পুলিশ ওদের কথায় আমার খোঁজ করবে কেন?
একটু শান্ত হয়ে আমার কথাগুলো শুনুন মঁসিয়ে জুহে, বেশ শান্ত গলায় বোঝাবার চেষ্টা করলাম এবার, পুলিশ কোনওরকমের অপরাধী বলে আপনার খোঁজ করবে না। আপনার দুশমনদের চাল সেদিক দিয়ে খুব পাকাই হবে। কিন্তু অপরাধী
হলেও হঠাৎ নিরুদ্দেশ হওয়া মানুষকে খুঁজে বার করা তো পুলিশের একটা দায়। ওরা সেই দিক দিয়েই আপনার যথাসাধ্য খোঁজ করবে। তখন কেঁচো খুঁড়তে কী যে বার হতে পারে, তা আপনি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়।
না, না, না। আবার উত্তেজিত হয়ে উঠে একটু খাপছাড়া ভাবেই বলে উঠলেন জুতো, আমার আসল নাম কিছু নেই। আর এখানকার পুলিশ তা বার করতেই বা পারবে কী করে? আর যদি বারই বা করে, তার ভয়টা কী আমার? পুলিশ গ্রেফতার করে চালান দিতে পারে এমন কোনও কিছুর সঙ্গে সে নাম কি জড়ানো?
না, তা নয়। একটু দুঃখের হাসি হেসে বললাম, তবু ওই নামটা পচা খোলসের মতো খুলে ফেলে তার সঙ্গে যা কিছুর সংস্রব সব ছেড়ে দিয়ে নতুন একটা সুস্থ জীবন পাবার জন্য আপনি দেশ-দেশান্তরে পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে এই লকনেসের রহস্যের দেশে এসে হাজির হয়েছেন। আর এর মধ্যে নানা জায়গায়, কে জানে কোন ফাঁকির কারসাজিতে গাদা করা রাশি রাশি টাকা নানা সৎ কাজে দান করে নিজের মনের গ্লানি খানিকটা ধুয়ে ফেলতে চেয়েছেন।
হ্যাঁ, জুহো এবার স্বীকার করেন, দুঃখী মানুষের উপকারের কাজে অনেক টাকা আমি নানা জায়গায় নিজের নামটুকু পর্যন্ত না জানিয়ে দান করেছি। তবে বিশ্বাস করুন, নানা জায়গায় দান যা করেছি তা কোনওরকম সাধারণ চুরি-ডাকাতি-জালিয়াতির টাকা নয়। সাধারণ বলছি এই জন্য যে, পুলিশের হাতে ধরা পড়ে চোরাই মালের আসামি হবার মতো অপরাধ না হলেও তা এখনকার যুগের কোটিপতি শেঠেদের একরকম দুর্দান্ত জালিয়াতি। এ জালিয়াতি কোনও আইনের শাসনে পড়ে না, কিন্তু টাকার জোরের সঙ্গে বিশেষ এক ধরনের ধারালো বুদ্ধি থাকলে দুনিয়ার পয়সাকড়ির বাজার নির্ভয়ে নিজের খুশি মতো লুঠ করা যায়। বুদ্ধির সেরকম প্যাঁচালো ধার থাকলে টাকার জোরেরও দরকার হয় না। যেমন হয়নি আমার। ফাটকাবাজার যাকে বলে, দুনিয়ার সেই ব্যবসাদারির জুয়ার জগতের হাড়হদ্দ অতি সহজে বুঝে নিয়েই আমি সামান্য দু-চারটে নাড়াচাড়ার চালে যখন যেমন খুশি মুনাফা লুটতে পেরেছি। এ কাজে প্রথমে নামবার সময় আমার দুশমন বলে যাদের আপনি জেনেছেন, সেই দু-জনের সঙ্গে আমায় নিয়ম রাখতেই জোট বাঁধতে হয়েছিল। আমার বুদ্ধিতে এর পর অঢেল টাকা যখন উপায় হতে থাকে, তখন এই জোটের বন্ধন আমার গলায় ফাঁসি হয়ে ওঠে। আমার বুদ্ধিতে যত তাদের লাভের টাকা জমতে থাকে তাদের লোভও বাড়তে থাকে তত। আমার তখন সমস্ত ব্যাপারটায় ঘেন্না ধরে গেছে। কিন্তু আমি ছাড়তে চাইলেও তাদের ধুলো-মুঠোকে সোনা-মুঠো করবার পরশপাথর হিসেবে আমায় তারা কিছুতেই মুক্তি দেবে না। সেইজন্য শেষ পর্যন্ত নাম ভাঁড়িয়ে চেহারা লুকিয়ে এমন করে আমি পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি। এই অবস্থায় লকনেসের রহস্যভেদের মতো অসামান্য কিছু করলে আমি আমার সব অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে মনে করে আবার সজ্জন মানুষের সমাজে মুখ দেখাতে পারব। আমি—
শুনুন, মি. গুস্তাভ নুটসন— বলে বাধা দিয়ে যা বলতে যাচ্ছিলাম তা বলা আর হল না।
কী? কী বললেন? কী নাম? গুস্তাভ নুটসন? এতক্ষণ মঁসিয়ে জুহো বলে যাঁকে ডাকছিলাম, তিনি প্রায় চিৎকার করে বললেন, এ নাম আপনি কোথায় পেলেন? এ কার নাম?
নাম আপনারই, শান্তভাবেই জবাব দিলাম, আর এই-ই যে আপনার আসল নাম তা আপনি ভাল করেই জানেন। আপনার দুশমনদের এড়িয়ে পালিয়ে থাকবার জন্য আপনি নাম আর চেহারা দুইই বদলেছেন, তবে নামটা বদলাবার একটা অন্য বড় কারণও আছে।
কারণ! অন্য কারণ–বলে দুবার ঢোঁক গিলে আমার প্রতিপক্ষ থেমে যাবার পর বেশ সহানুভূতির স্বরেই এবার বললাম, হ্যাঁ, মি. নুটসন, আপনার দুশমনদেরই ফরমাশে আপনাকে খুঁজে বার করতে গিয়ে আপনার সবকিছুই আমি জানতে পেরেছি। আপনি যা এইমাত্র আমায় শুনিয়েছেন তার কিছুই মিথ্যে নয়। আপনি সত্যিই যে আপনার বিশেষ বুদ্ধির জোরে দেশ-বিদেশের কারবারি জগৎ তোলপাড় করে তুলে কড়িকাঁড়ি টাকা উপায়ের ব্যবস্থা করে দেন, আর শেষে এ কাজে অরুচি শুধু নয়, সত্যিকার ঘেন্না ধরায় এ জগৎ থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছেন, সে সব কথাই সত্যি। কিন্তু যে কথাটা আপনি এখনও বলেননি, তা হল এই যে, অনেক অনুরোধ উপরোধ আর তারপর ভয়টয় দেখিয়েও আপনাকে নিজেদের কথায় রাজি করাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ওরা একটা মিথ্যে জুয়াচুরির সাজানো মামলায় আপনাকে জড়িয়ে দেয়। সেই সাজানো মামলা মিথ্যে প্রমাণ করবার জন্য লড়বার ধৈর্যটুকুও না থাকায় আপনি তার দায় এড়াতে লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, দুঃখে রাগে তিক্ত স্বরে বললেন গুস্তাভ নুটসন, সেই জন্যই দেশে-দেশান্তরে এমন করে পালিয়ে বেড়াচ্ছি, আর সেই জন্যই লকনেসের রহস্যভেদের মতো এমন একটা কিছু করতে চাইছি যার জোবে সত্যিকার সজ্জন সভ্যসমাজে আমার কথা বুঝিয়ে বলতে পারার অধিকার পাব।
পাবেন, পাবেন, নুটসনকে আশ্বাস দিয়ে আমি বললাম, কিন্তু তার জন্যই আপনাকে এখান ছেড়ে আমি যেখানে বলছি সেখানে চলে যেতে হবে
থামুন, থামুন।নুটসন আবার যেন খেপে উঠলেন। বারবার শুধু আমায় এখান থেকে তাড়াবার চেষ্টা! এখান থেকে চলে যেতে হবে বললেই চলে যেতে হবে! কোথায় যেতে হবে? কোথায়? আমায় এখান থেকে তাড়াবার পিছনে আপনার আসল মতলবটা কী, বলুন তো? ক ধান্দায় আপনি আমার পেছনে ঘুরছেন?
বলছি শুনুন।
আগের পর্ব:
০১. প্রথম মহাপ্রলয়ের বন্যা
০২. কী হয়েছে তারপর থেকে
০৩. পাছে তিনি ধৈর্য হারান
০৪. ঘনাদা একটা সিগারেট ধরিয়ে
০৫. মানুষকে চিনতে হয় চরিত্র দেখে
০৬. চা এসে গিয়েছিল
পরের পর্ব :