০৬. চা এসে গিয়েছিল
চা এসে গিয়েছিল। ধীরেসুস্থে চা শেষ করে, সিগারেট ধরিয়ে, ঘনাদা ফের শুরু করলেন তাঁর গল্প: ভোর হবার পর ইনভারনেস স্টেশনে গিয়ে নামবার আগে ট্রেনের কামরায় আমার জামা আর প্যান্টের পকেট থেকে পাওয়া কাগজপত্র ইত্যাদি ঘাঁটাঘাঁটি করে নিয়ে তারা অন্য দু-চারটে দামি খবরাখবরের সঙ্গে মিসেস টডের দোকানের হদিস আর তাঁর কাছে আমার ভাড়া-নেওয়া কামরাটার ঠিকানা আর ল্যাচ-কি হাত করতে পেরেছে।
তারা তখনই মিসেস টডের দোকানে কি আমার ভাড়া-নেওয়া তাঁর বাড়ির কামরায় যায়নি। স্টেশনের একটি ওয়েটিংরুমেই সারারাত্রির ট্রেনযাত্রার পর একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে নিয়ে, শহরটায় একটু ঘুরে দরকারি ঠিকানাগুলো জেনে নিতে বেরিয়েছে।
আমার জামা ও প্যান্টের পকেট থেকে যেসব কাগজপত্র তারা বার করে নিয়েছিল, তার মধ্যে একটা বিশেষ আকর্ষণের ব্যাপার না থাকলে তারা হয়তো তখনকার মতো লন্ডনে ফিরে গিয়ে এখানকার বোঝাপড়ার জন্য একটু তৈরি হয়ে আসবারই চেষ্টা করত। কিন্তু সে সময় তখন তাদের নেই।
তাদের কাছে অমন বিশেষ আকর্ষণের ব্যাপারটা যে কী, তা বোধহয় বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। হ্যাঁ, ভারতীয় জ্যোতিষী হিসেবে সংস্কৃত শ্লোক দিয়ে শুরু করা মিসেস টডের দোকানে রাখা আমার সেই রহস্য-সংকেতগুলি কিনে যারা পড়ে আমার সঙ্গে দেখা করবার দিনক্ষণ লিখিয়ে নিয়েছিল, সেই তিনজন অজানা রহস্য-সন্ধানীর সাক্ষাতের আশাটাই ছিল ডুগান ও কার্ভালোর কাছে দুনির্বার আকর্ষণ। ব্যাপারটা নেহাত হুজুগের প্রলোভনের চেয়ে বেশি কিছু যাতে হয়, তারই জন্য সংস্কৃত শ্লোক দেওয়া রহস্য-সংকেত আর তার দরুন সুবিধের জন্য দামটা ধরা ছিল প্রায় গলাকাটা। সংস্কৃত শ্লোক লেখা ভারতীয় জ্যোতিষের চিহ্ন আঁকা এক-একটা রহস্য-সংকেতলিপির দামই ধরা ছিল পাঁচ পাউন্ড করে। সেই রহস্য-সংকেত কেনবার পর তারই জোরে মূল যোগী-জ্যোতিষীর সঙ্গে দেখা করবার সুযোগ আর তার নির্দিষ্ট সময় স্থির করে জেনে নেবার জন্য আরও দশ পাউন্ড খরচ।
শতকরা নিরানব্বইজন যে ব্যাপারটা বুজরুকি আর ধাপ্পা বলে ধরে নিয়ে কাছে ঘেঁষবে না, তারই জন্য যে তিনজন নিজে থেকে অমনভাবে এগিয়ে এসেছে, তাদের মধ্যেই ধড়িবাজ চূড়ামণি, দুনিয়ার ফাটকাবাজারের বাজিকর ভোজরাজকে পাওয়া যাবে, আমার দেওয়া এই ইঙ্গিত শুঁটকো ডুগান আর গোরিলা কার্ভালোর মনে বিশেষ করে ধরেছিল।
তাই লন্ডনে ফিরে না গিয়ে একটু বেলা হবার পর তারা প্রথমে মিসেস টডের দোকানটা সাধারণ খরিদ্দার হিসেবে একটু দেখে নিয়ে সেখান থেকে আমার ভাড়া করা বাসাটা খুঁজে বার করে আমার পকেট ঘেঁটে পাওয়া ল্যাচ-কি দিয়ে আমার কামরাটা খুলেছিল।
ছোট একটা বাসা। কিন্তু ব্যবস্থাটা তাদের পছন্দ হয়েছিল। ভারতীয় যোগী-জ্যোতিষীদের সঙ্গে দেখা করবার সুবিধের জন্য যে তিনজন অত চড়া দামের টিকিট কিনেছে, বিকেল তিনটে থেকে পাঁচটা পর্যন্ত পর পর তাদের আধ ঘণ্টা করে দেখা দেওয়া তো যাবেই, তারপর অবস্থাটা যেমন দাঁড়ায় সেই মতো এই কামরাটাই সেদিনকার রাতের মতো নিজেদের কাজে তারা ব্যবহার করবে।
কিন্তু মুশকিল হল একটা সমস্যা নিয়ে। গোরিলা কার্ভালো সেটা তুলে ভাবনায় ফেললে। কী এক বিদঘুটে হরফের ভারতীয় ভাষায় রহস্য-সংকেতের কাগজগুলোয় যা লেখা আছে তা-ই জানতে যারা আসছে তাদের কাছে তার কী ব্যাখ্যা তারা করবে? রহস্য-সংকেতের টিকিট নিয়ে যারা আসছে, তাদের মধ্যে নিজেদের শিকারকে খুঁজৈ বার করা তাদের আসল কাজ। কিন্তু সে-কাজ সারবার জন্যই পর পর এক-একজনকে ডেকে পাঠাতে হবে। উত্তরও দিতে হবে তাদের জিজ্ঞাসার। সে-জিজ্ঞাসা কী বিষয়ে হবে, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু উত্তরটা কি তারা দিতে পারবে?
ঠিক আছে। শুঁটকো ডুগানই বুদ্ধিটা বাতলালে। আসছে তোত পরপর তিনজন। তাদের মধ্যে নিজেদের শিকারকে খুঁজে নেওয়াই হল ডুগান আর কার্ভালোর উদ্দেশ্য। যাকে তারা খুঁজছে, সেই ধুরন্ধর যদি প্রথমেই আসে তা হলে তোত সব সমস্যা ওখানেই মিটে যাবে। আসল মানুষটিকে কবজা করে বাকি দুজনকে তারা বিদায়ই করে দেবে সরাসরি। কিন্তু অত সুবিধে যদি না-ই হয়, তাতেই বা কী? টিকিট নিয়ে যারা আসছে, তাদেরও, আসল শিকার না হলে, দেখা করতে আসার আর-একটা দিনক্ষণ জানিয়ে দিলেই চলবে। বললেই হবে যে, ভারতীয় জ্যোতিষের গণনা বড় কঠিন। আরও কিছু সময় লাগবে তা শেষ করতে। সেই জন্য আর-একটা তারিখ মায় সময় ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে।
নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা ঠিক করে নিয়ে দুজনে এর পর দুপুরের লাঞ্চ সেরে আসবার জন্য কিছুক্ষণের জন্যে বাইরের একটি রেস্তোরাঁয় গিয়েছিল।
ফিরে এসে অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খোলা দেখে তারা অবাক। দরজা খোলা হলেও ভেজানো ছিল ভেতর থেকে। সে দরজায় ঠেলা দিয়ে খুলে তারা একেবারে তাজ্জব।
তা তাজ্জব হবারই কথা। সেখানে আর কাউকে নয়, আমাকেই বসে থাকতে দেখার কথা তারা কল্পনাও করেনি।
তুমি—তুমি—কার্ভালো প্রায় তোতলা হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।
হ্যাঁ, আমি, আমি একটু হেসে বলেছিলাম, অশরীরী ছায়াটায়া নয়, একেবারে সশরীর হাজির। আর তাও বেশ অনেকক্ষণ থেকে আছি। আর তাই আছি বলেই তোমাদের পরামর্শটা জেনে গোলমেলে প্রশ্ন এড়াবার বুদ্ধিটার তারিফ করছি।
তারিফ করছ আমাদের বুদ্ধির? গোরিলা কার্ভালোর মাথায় কথাটা যেন ঠিক ঢুকছে না।
কী জন্য তারিফ করছ? শুঁটকো ডুগানের এবার কড়া গলায় সোজাসুজি প্রশ্ন, কী জানো আমাদের পরামর্শের?
তোমরা যা বলেছ, তার বেশি আর কী করে জানব? যে সোফাটায় বসে ছিলাম, তার একটা পায়ার পেছন থেকে কিছু একটা প্যাঁচ দিয়ে খুলতে খুলতে আমি বললাম, মক্কেলদের বেয়াড়া প্রশ্ন এড়াবার জন্য ভারতীয় জ্যোতিষ-গণনা কঠিন বলে যে দোহাই পাড়ার কথা তোমরা বলাবলি করেছিলে, সেইটে শুনেই তোমাদের বুদ্ধির প্রশংসার কথা মনে হয়েছিল। আর—
আমার কথার মধ্যেই থামিয়ে দিয়ে যেমন উত্তেজিত, তেমনই কেমন-একটু হতভম্বভাবে কার্ভালো বললে, কিন্তু আমাদের কথা তুমি শুনলে কী করে? তখন এখানে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ তো ছিল না!
তা ছিল না বটে, আমি যেন বাধ্য হয়ে স্বীকার করলাম।
তবে? প্রায় গর্জন করে উঠল কার্ভালো, আমাদের পরামর্শের কথা তুই—
আপনি তো নয়ই, সম্বোধন তুমি থেকে তুই-এ নামাতে কার্ভালোর গায়ের জ্বালা কত সেলসিয়াসে পৌঁছেছে তা বোঝা গেল। তার কথার মাঝখানে তাই বাধা দিয়ে বললাম, সাবধান! সাবধান! হঠাৎ অত গরম হয়ে উঠলে স্ট্রোক হয়ে যেতে পারে। তোমাদের কাছে যা ধাঁধা, তার উত্তরটা তাই শুনিয়ে দিচ্ছি। আমি নিজে সশরীর এখানে উপস্থিত না থাকলেও না, আমার আত্মাটাত্মা নয়, আমার প্রতিনিধিস্বরূপ এই যন্ত্রটা এখানেই সোফার পায়ার পেছনে লুকিয়ে লাগানো ছিল। দেখতে খুদে হলে কী হয়, এই রেকর্ডার যন্ত্রটা দারুণ কাজের। তোমাদের সব কথা তাই স্পষ্ট করে ধরে রেখেছে।
ধীরে বন্ধু, ধীরে! কার্ভালো আবার লাফিয়ে ওঠার উপক্রম করতেই তাকে একটু ঠেলা দিয়ে তার আসনে বসিয়ে দিয়ে বললাম, এ যন্ত্র এখানে কেমন করে এল, এই তো জানতে চাও? বলছি, শোনো। না, কোনও ভোজবাজিতে এটা এখানে আসেনি। আমিই ওটা এখানে লাগিয়ে রেখেছিলাম। কখন লাগিয়ে রেখেছিলাম? তোমরা এখানে এসে এ বাসার চাবি খুলে ভেতরে ঢুকে সব দেখেশুনে নিয়ে একবার কিছুক্ষণের জন্য দরজার ল্যাচ-কি লাগিয়ে বাইরে গেছলে। আমি সেই সুযোগেই এসে এটা লাগিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি ঠিক সেই সময়ে এখানে এলাম কী করে, এই ধাঁধাটার উত্তর পাচ্ছ না, কেমন? উত্তর শুনতে হলে একটু ধৈর্য ধরে খানিকক্ষণ শুনতে হবে। হ্যাঁ, ট্রেনের কামরায় আমার গর্দানে গোরিলা কার্ভালো যখন একটা রামরদ্দা চালায়, সেই তখন থেকে যা হয়েছে সব।
মোক্ষম রদ্দাই চালিয়েছিলে বটে তুমি, মানে গোরিলা কার্ভালো। ও রদ্দা খেয়ে আমার সত্যিই বেহুঁশ হবার কথা। কিন্তু তা যে আমি হইনি, তার কারণ তোমাদের মতো পেঁচি বদমাশদের আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। তাই তোমাদের সঙ্গে আলাপ চালাতে-চালাতে চোরা নজরটা আমি ঠিকই রেখেছিলাম তোমাদের ওপর। মাথায় রামটুসকির ধাক্কা সামলে উঠে আর-একটা রামরদ্দা পাড়বার জন্য মুঠো পাকানো থেকে হাত চালানো পর্যন্ত সবই আমি সজ্ঞানে ঘটতে দিয়েছি। রদ্দাটাকে এমন তাল মিলিয়ে ঘাড়ের ওপর নিয়েছি যে, মনে হয়েছে, তাইতেই আমি কাত আর বেহুশ হয়ে গেলাম। গোরিলা কার্ভালোর অবশ্য আর-একটা রদ্দা দিয়ে জখমটা পাকা করবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু কার্ভালো তা করতে গেলে ওকে একটু শিক্ষা দিয়ে আমার খেলাটা অন্যভাবে সাজাতে হত। তোমার, মানে শুঁটকো ডুগানের সুপরামর্শে তার অবশ্য দরকার হয়নি।
আমার পকেট-টকেট থেকে যা হাতড়াবার হাতড়ে আমায় বাঁধাছাঁদা করে, মুখে রুমাল গুঁজে বোবা করবার ব্যবস্থার মধ্যে ট্রেনটা মিনিট খানেকের জন্য একটা স্টেশনে থেমেছিল। এইটাই একটা পরম সুযোগ মনে করে প্রথমে আমায় নির্জন প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার মতলব করে পরে আবার তা পালটে প্ল্যাটফর্মের অন্য দিকের থেমে থাকা একটা উলটোমুখো মালগাড়ির একটা ফাঁকা কোচে ফেলে দিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলে। কিন্তু ধর্মের কল সত্যিই কখনও বাতাসে নড়ে। তোমাদের দেখা উলটোমুখো মালগাড়ি আমার খাতিরে সোজামুখো হয়ে গিয়েছিল খানিকবাদে। ইঞ্জিনটা মালগাড়ির মাথার থেকে সেটাকে সামনে টেনে নিয়ে যাওয়ার বদলে সেটা পিছন দিক থেকে গাড়িটাকে ঠেলে ইনভারনেস স্টেশনের মাল খালাসের রেলইয়ার্ডে পৌঁছে দিয়েছে।
পৌঁছে দিয়েছে রেল কোম্পানিরই নিজেদের দরকারে নিশ্চয়, পৌঁছেছে তোমাদের প্যাসেঞ্জার ট্রেনের অনেক পরে। কিন্তু তাতে আমার লাভই হয়েছে। যে খোলা-দরজার মালগাড়িটায় আমায় পুঁটলির মতো বেঁধে ফেলে আসার বন্দোবস্ত করেছিলে, তাতে তোমাদের গাড়ি ছাড়বার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই আমি আমার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে ফেলে উঠে বসেছিলাম। ইচ্ছে করলে মালগাড়িটা থেকে নেমে একটা ছুট দিয়ে তোমাদের গাড়িটার পেছনের কোনও কামরায় উঠতেও হয়তো পারতাম, কিন্তু সে চেষ্টা করিনি।
তার বদলে বেশ একটু দেরিতে স্টেশনের যাত্রীদের প্ল্যাটফর্মে নয়, মাল খালাসের গুডস ইয়ার্ডের এক জায়গায় ধীরেসুস্থে নেমে সেখান থেকে শহরে বেরিয়ে এসে তোমাদের খোঁজ করাটা সহজই হয়েছে।
এদিক ওদিক ঘুরে তোমরা তখন মিসেস টডের দোকানটা খুঁজে বার করে সেখানে ঢুকেছ। সেখান থেকে বেরিয়ে তোমরা আমার ভাড়া-নেওয়া এই বাসাটা খুঁজে বের করে এখানে আসার সময় আমি যে আগাগোড়া তোমাদের পেছনে ছিলাম তা তোমরা টের পাওনি। পাও না পাও, লোকসান তাতে তোমাদের এমন কিছু হয়নি। এখন তোমাদের আসল কাজ যদি উদ্ধার হয়, তা হলে আর আফশোসের কিছু নেই।
ঘড়িতে দেখছি তোমাদের মক্কেলদের আসবার সময় হয়ে গেছে। আমি তা হলে এখনকার মতো বাইরে যাচ্ছি—
না, গর্জন করে উঠল কার্ভালো।
যাবার জন্য উঠে পড়েও আমি আবার সোফার ওপর বসে পড়লাম। তবে সেটা গোরিলা কার্ভালোর গর্জনের জন্য নয়, এমনকী কোমরের বেল্ট থেকে যে পিস্তলটা টেনে বার করে সে তখন আমার দিকে তুলে ধরেছে, তার জন্যও নয়। তবে পিস্তল উঁচিয়ে ধরবার মতো স্পর্ধা যার হয়েছে, তার দৌড় কতটা তা আমি তখন দেখতে চাই।
বেশ একটু ভয়ের ভান করে তাই আমি চটপট আবার বসে পড়ে কাঁপা কাঁপা গলায় যেন নালিশ জানালাম, পিস্তল-টিস্তল দেখানো, এ আবার কী! সোজাসুজি আমায় এখান থেকে যেতে বারণ করলেই তো হয়। তাছাড়া আমায় এখানে ধরে রেখে তোমাদের লাভটা কী? তোমরা কাকে খুঁজছ না খুঁজছ তা কি আমি জানি?
ভয় পাওয়ার অভিনয়টা আমার ভালই হয়েছিল বোধহয়। কারণ, এর আগে বারকয়েক নাকাল হবার পর নিজের জবরদস্ত শাসানির ফল এবারে যেন হাতে হাতে পেয়ে কার্ভাললা তখন মুখে যেন বাঁকা হাসি মাখিয়ে পিস্তলটা ডান হাতে একটু ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, না, তুই কিছুই জানিস না। তবু তোকে কেন ধরে রাখছি, তা বুঝতে পারছিস না? তোকে ধরে রাখছি, যাতে এখন বাইরে গিয়ে তুই আমাদের মক্কেলদের কোনওরকম ভাঙচি না দিতে পারিস।
ভাঙচি দেব আমি? সত্যিই একেবারে আকাশ থেকে পড়ে আমি বললাম, কী ভাঙচি আমি দিতে পারি? আর দিয়ে আমার লাভটা কী, তাই তো বুঝতে পারছিনা।
অত কথা জানি না। কার্ভালোর আগে শুঁটকো ডুগানই এবার খিঁচিয়ে উঠল, তোমায় এখানে থাকতে বলা হয়েছে। তাই তুমি থাকবে। এ নিয়ে তর্ক করবার আর আমাদের সময় নেই।
বেশ, তোমাদের হুকুমই মানছি! অসহায় ভাবে ওদের কথা যেন মানতে বাধ্য হয়ে বললাম, কিন্তু থাকব কোথায়? এই এখানে, তোমাদের সঙ্গে? সে কি ঠিক হবে?
না, তা হবে না, কার্ভালো গর্জন করে উঠল, আমাদের মধ্যে নয়, তুই থাকবি ওই—ওই—
এদিক-ওদিক চেয়ে ঘরের ওয়ার্ডরোবটার দিকে চোখ পড়ায় সে খুশি হয়ে বললে, তুই থাকবি ওই ওয়ার্ডরোবের ভেতরে।
থাকবার জায়গার নির্দেশ দিয়ে গোরিলা কার্ভালো সাবধানও করে দিলে সেই সঙ্গে, ওখানে থাকবি, কিন্তু একেবারে সাড়াশব্দ না দিয়ে। ওখান থেকে কোনওরকমে বেয়াড়াপড়ার চেষ্টা করলে লুকিয়ে চোর ঢুকেছে মনে করার ছুতোয় পিস্তলের গুলি ছুঁড়ে একেবারে ঝাঁঝরা করে দেব, মনে থাকে যেন।
ওয়ার্ডরোবের ভিতর বা যেখানেই হোক, ওই কামরার মধ্যে উপস্থিত থাকবার সুযোগ পাওয়াটাই তখন আমার কাছে মস্ত লাভ।
সময় তখন হয়ে গেছে। কার্ভালোর সঙ্গে কোনও রকম তর্ক আর না করে সুবোধ ছেলের মতো ওয়ার্ডরোবের ভেতর গিয়ে ঢুকলাম। ছোটখাটো নয়, আমার মতো মানুষের বেশ স্বচ্ছন্দে থাকবার মতো প্রশস্ত জায়গা। আমাদের এখানে হলে ভ্যাপসা গরমে কষ্ট পাবার ভয় হয়তো ছিল। কিন্তু উত্তর স্কটল্যান্ডের তখনকার শীতে কোনওরকম কষ্টই হয়নি।
কিন্তু যার জন্য এতসব আয়োজন, সেই আসল কাজটাই যে গেল পুরোপুরি ভেস্তে। যাদের আসবার কথা তারা পর পর সময়মত তিনজন ঠিকই এসেছে। কিন্তু এই নিষ্ফল আসার হয়রানির জন্য গালমন্দ দিয়ে ঝগড়া যে কেউ তারা করেনি, সে নেহাত ওদেশের সহবত শিক্ষার গুণেই বলে মনে হয়।
যে তিনজন এসেছিল, তাদের মধ্যে একজন বয়স্কা মহিলা, একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক, আর তৃতীয়জন কিছুটা কম বয়সের, অবসর-নেওয়া মিলিটারি অফিসার। বলেই মনে হয়।
ওয়ার্ডরোবের দরজার চাবির ফুটোটা আমি আমার চাবির রিং-এ পরানো খুদে ছুরির ফলা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে একটু বড় করে নিয়েছিলাম। যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের চেহারাগুলো দেখতে আর কথাগুলো শুনতে বিশেষ কিছু অসুবিধে তাই হয়নি।
চেহারাগুলোর তফাত থাকলেও কথা তিনজনে যা বলেছে, তা সম্পূর্ণ একই বলতে হয়।
তাদের প্রথম জিজ্ঞাসা হল, তাদের কাছে বিক্রি করা রহস্য-সংকেতের কাগজে ভারতীয় ভাষায় যা লেখা আছে তার অর্থটা কী? আর সেটা যদি জ্যোতিষ গণনার মন্ত্র হয়, তা হলে তার সাহায্যে কী হদিস পাওয়া গেছে লকনেসের জল-দানবের রহস্যের?
দুই মূর্তিমান, শুঁটকো ডুগান আর গোরিলা কার্ভালো যে কোনও জবাবই এই দুটি প্রশ্নের দিতে পারেনি, তা বোধহয় বলতে হবে না। সময় লাগার অজুহাত যে তারা দেখিয়েছে, তা মানতে কেউ রাজি হয়নি। রহস্য সংকেত জানবার জন্য প্রার্থীদের দেওয়া মোটা দর্শনী তাই ফেরত দিতে হয়েছে ডুগান আর কার্ভাললাকে!
তাতে তারা খুব দুঃখ পেয়েছে কি?
না, তা পাবার তো কথা নয়। কারণ, আসল যা কাজ তা তাদের হাসিল হয়ে গেছে। সংকেতলিপির রহস্য জানতে যারা আসবে, কাছ থেকে তাদের খুঁটিয়ে দেখাই ছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য। সে-দেখার সুযোগও তাদের হয়েছে।
তবু তারা খুশি নয় কেন? তারা যাকে খুঁজছে সংকেতলিপির মানে বুঝতে চাওয়া তিন উমেদারদের মধ্যে সে কি ছিল না? ছদ্মবেশেও কি নয়? কথাটা জিজ্ঞেস করেছি আমি বেশ একটু হতাশ গলাতেই।
না, না, নেই! এবার ডুগানই খিঁচিয়ে উঠে বলেছে, তোমার জন্যই বুনো হাঁসের পেছনে ধাওয়া করে আমাদের এই নাকাল হওয়া। কিন্তু আমার ডালকুত্তার নাক। একটু গন্ধ যখন পেয়েছি তখন যেমন করে তোক আজ না হয় কাল খুঁজে বার করবই।
খুঁজে বার করবেই? যেন সত্যি উৎসাহিত হয়ে বললাম, তা হলে আসল বাসাটা বার করতে না পারলেও কোন মুলুকে সে চরে, সেটার হদিস দেবার বাহবাটা আমায় দাও।
হ্যাঁ, দেব, দেব। তার জন্য তোর গলায় মেডেল ঝুলিয়ে দেব।
মেডেলের আগে বকশিশ পেলে কিন্তু সুবিধে হত আমার। আমি একটু যেন মিনতির সুরে বলেছি।
বকশিশ! তুই বকশিশ চাইছিস? একেবারে যেন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল কার্ভালো। তারপর আমার ওয়ার্ডরোবে গিয়ে ঢোকার পর কোমরের বেল্টে গুঁজে রাখা পিস্তলটা আবার টেনে বার করে আমার দিকে উঁচিয়ে ধরে বলেছে, তোর হাওয়া খেলবার ফুটো করে দেওয়াই এখন তোর উপযুক্ত বকশিশ, তা জানিস কি?
না, না, ওসব কী অন্যায় কথা! আমি–আমি প্রায় করুণ স্বরে বলেছি, তোমাদের আসল কাজ এমন করে হাসিল করে দেবার পর মাথার খুলি ফুটো করতে চাওয়াটা–
থাম, থাম।অধৈর্যের উত্তেজনায় আমার কথাটা শেষ করতে না দিয়ে গোরিলা কার্ভালো গর্জে উঠেছে, আমাদের সঙ্গে ঠাজি করিস, এত বড় তোর সাহস! এই অখদ্যে শহরে আনা ছাড়া কী কাজ তুই আমাদের করেছিস? বড়াই করছিস কী আসল কাজের?
কী আসল কাজ তা এখনও বুঝতে পারোনি? আমি রীতিমত হতাশার সুরে বলেছি এবার। তা যদি না বুঝে থাকো, তা হলে আর বুঝে দরকার নেই। তোমাদের মতো মগজ যাদের নিরেট, তাদের কাজের ভার নেওয়াই আমার ভুল হয়েছে। যাক, তোমাদের বকশিশ দেবার দরকার নেই। আমারও কাজ নেই এখানে আর সময় নষ্ট করবার।
খবরদার, আমি উঠে পড়বার ভঙ্গি করার সঙ্গে সঙ্গে পিস্তলটা উঁচিয়ে ধরে কার্ভালো বজ্রস্বরে ধমকে দিয়েছে, আর একটু বেয়াড়াপনা করলে মাথার খুলি ফুটো করার আগে পাঁজরা দুটোই ঝাঁঝরা করে দেব! আর কিছু বলার সুযোগ কার্ভালো পায়নি। তার ডান হাতের কনুইয়ের নীচে বিদ্যুতের বেগে আমার বাঁ পায়ের হাঁটুর একটা মোক্ষম ঠোক্কর লাগার সঙ্গে সঙ্গে হাতটা অবশ হয়ে পিস্তলটা মেঝেতে ছিটকে পড়েছে।
তৎক্ষণাৎ সেটা তুলে নিয়ে ডান হাতে একটু লোফালুফি করতে করতে বলেছি, এসব বেয়াড়া জিনিস বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আলাপের সময় কাছে না থাকাই ভাল। আলাপটা আমাদের দু-পক্ষের মধ্যে কাজের ফরমাশ আর তার জন্যে বকশিশের দরাদরি নিয়ে, কেমন? আসল কাজ কিছু করিনি বলে তোমরা আমার বকশিশের দাবিটা মানতেও চাও না। এমনকী, আসল কাজ যে কী আমি করেছি, তা তোমরাও জানো না বলছ! তা জানতে যখন পারোনি, তখন তোমাদের যেমন আছ তেমনই অন্ধকারে রেখে আমি এখন চলে যেতে পারি তোমাদের কিছু না বোঝার ছটফটানির মধ্যে রেখে। কিন্তু তা আমি করব না। তোমাদের অন্য এক জাতের ছটফটানির মধ্যে রেখে এইটুকু শুধু বলে যাব যে, যাকে তোমরা খুঁজছ সে আজ এখানে তোমাদের সামনে এসে দেখা দিয়ে কথাও বলে গেছে। তার ছদ্মবেশ আর চেহারা শুধু তোমরা চিনতে পারোনি। এখন যে তিনজন আজ এসেছিল, তাদের মধ্যে কোনটি তোমাদের আসল শিকার তা ভেবে বার করতে মাথার চুল ঘেঁড়ো। আমি চললাম।
আমি ঘরের বাইরে এসে দরজাটা ভেজিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে প্রায় আকুল আর্তনাদের মতোই দুই মূর্তিমানের মিনতি শুনলাম, এই যে, এই শোেনো, শোনো– এরপর আর-একটু খাতির মাখানো গলায়, শুনুন, শুনুন মি. দাস! মিনতির উত্তরে গুলি বার করে নেওয়া পিস্তলটা শুধু বাইরের দরজার ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে আমি একটা গলি-পথে বাঁক নিয়ে চলে এলাম।
আগের পর্ব:
০১. প্রথম মহাপ্রলয়ের বন্যা
০২. কী হয়েছে তারপর থেকে
০৩. পাছে তিনি ধৈর্য হারান
০৪. ঘনাদা একটা সিগারেট ধরিয়ে
০৫. মানুষকে চিনতে হয় চরিত্র দেখে
পরের পর্ব :
০৭. রহস্য-সংকেতের কাগজ
০৮. ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল