মঙ্গলগ্রহে ঘনাদা : ০৯. কাঠের ছাই একটু করে

মঙ্গলগ্রহে ঘনাদা : ০৯. কাঠের ছাই একটু করে

০৯. কাঠের ছাই একটু করে

কাঠের ছাই একটু করে মুখে নিয়ে নিজেরা চাঙ্গা হবার পর ব্যস্ত হয়ে উঠলাম লুটভিক-এর জন্য।

ওই তো হাডিউসার চেহারা। এতক্ষণে কেঁসে গেছে কি না কে জানে।

মাসখানেক যে দরজা বন্ধ ছিল, চেয়ার-টেবিল ঠেকে সরিয়ে তা খুলে ছুটলাম কন্ট্রোল মের দিকে।

ভয় ছিল, ভেতর থেকে দরজা না বন্ধ করে দিয়ে থাকে। তাহলে ভেঙে খোলা ছাড়া উপায় নেই। অত সবুর কি তখন সইবে?

না, বন্ধ নয়, দরজা খোলাই। আর লুটভিক ওই রোগা হাড়েই তখনও টিকে আছে।

তবে অবস্থা কাহিল। কী সব অদ্ভুত ঘড়ি-টড়ি আর নানা রঙয়ের বোতাম বসানো কন্ট্রোল বোর্ডের টেবিলটা ধরে কোনওমতে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে।

আমরা ঘরে ঢোকার পর চমকে মুখ তুলেও ঘাড়টা সোজা রাখতে পারল না। কিন্তু মাথাটা আবার বুকের ওপর ঝুলে পড়ার আগে চোখে যে দৃষ্টিটা হানল তাতে যেন সাতটা কেউটের বিষের জ্বালা।

আমাদের যত বড় দুশমনই হোক, তাকে এমন করে মরতে দিতে তো পারি না। তাই তাড়াতাড়ি কাঠের ছাইটা তার মুখে দিতে গিয়েও কিন্তু থমকে দাঁড়ালাম।

ঠিক তো! আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যার সমাধান তো এখন আমারই হাতের মুঠোয়। কাঠ-পোড়া ছাই যার দাওয়াই সেই অসুখই তো আমাদের শাপে বর হয়ে গেছে।

শিগগির একটা দড়ি আনো তাড়া দিলাম বটুককে। অন্য কেউ হলে কী দড়ি, কেন দড়ি জানতে চেয়ে কিছুটা সময় নষ্ট করত। বটুকেশ্বরের ওসব দোষ নেই। হুকুম শোনা মানে সাধ্য থাকলে তামিল করা।

চোখের নিমেষে দড়ি হাতে নিয়ে সে হাজির। এবার সুরঞ্জনকেই বললাম, বাঁধে ওকে।

বাঁধব?

সুরঞ্জন দড়ি হাতে নিয়ে হতভম্ব।

হ্যাঁ, বাঁধবে।

ধমকে বোঝালাম এবার, এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। এই কাবু অবস্থায় একে বাঁধতে পারলে শেষ পর্যন্ত আমাদের রক্ষা পাওয়ার কিছু আশা থাকবে।

এর পর আর দুবার বলতে হল না।

সুরঞ্জন যখন উৎসাহভরে হাতে পায়ে দড়ির বাঁধন দিচ্ছে, লুটভিক-এর মুখে তখন একটু ছাই ভরে দিলাম।

চাঙ্গা হয়ে উঠতে তার দেরি হল না। কী তখন তার মুখের হোড়! ফরাসি জার্মান ইংরেজি রুশ এমন কী এদেশে থাকার দরুন দেহাতি রাজস্থানি ভাষাতেও কোন গালাগাল দিতে সে বাকি রাখলে না।

বটুকেশ্বর নির্বিকার–

সুরঞ্জন রেগে তখন ফুলতে শুরু করেছে। বললে, দেব মুখটায় একটা কিছু খুঁজে?

কন্ট্রোল বোর্ডটা তখন ভাল করে লক্ষ করছি! এটা দেখতে দেখতেই বললাম, না, ওকে কথা বলাবার দরকার হবে। মুখ বন্ধ করলে তাই চলবে না।

গালাগাল ছেড়ে কথা কি সহজে বলে! ভালভাবে অনেক চেষ্টা করেও বিফল হয়ে শেষে চালাকি করে বলাতে হল।

যন্ত্রপাতিগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা চাবি ঘুরিয়ে দিতে গেলাম।

নেকড়ের দৃষ্টি নিয়ে লুটভিক আমায় লক্ষ করছে তা জানি! আমার কাণ্ড দেখে একেবারে রেগে আগুন হয়ে চিৎকার করে উঠল, সর্বনাশ! ওটা ছুঁসনি আহাম্মক জানোয়ার কোথাকার! এখুনি উলটো বেগের যন্ত্র চালু হয়ে যাবে।

তাহলে এই বোতামটা টিপে দেখি, বলে আরেকটা খুদে বালবের মতো উজ্জ্বল বোতাম টিপতে গেলাম।

না, না, না!—এবার লুটভিকের প্রায় আর্তনাদ—ও বোতাম টিপলে আর রক্ষা নেই। দশগুণ বেগ বেড়ে শূন্যযান ওই ফোবস কি ডিমস-এর ওপরেই আছড়ে পড়বে।

ফোবস? ডিমস?

বিস্মিত প্রশ্নটা লুটভিক-এর কাছে ঘনাদার নয়, ঘনাদারই কাছে আমাদের। এতক্ষণ বাদে ধরা-ছোঁয়ার মতো দুটো নাম শুনে আর চুপ করে থাকতে পারা যায়!

ফোবস ডিমস মানে তো সেই দুটো চাঁদ? শিবু ঘনাদার সমর্থন চাইলে।

ও চাঁদ দুটো তো মঙ্গলগ্রহের! আমি জোরের সঙ্গেই জানালাম।

তার মানে আপনারা তখন মঙ্গলগ্রহের কাছে পৌঁছে গেছেন? শিশির সবিস্ময়ে জানতে চাইলে।

হ্যাঁ, ঘনাদা শিশিরের টিন থেকে নতুন সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে তিনটে সুখটান না শেষ করা পর্যন্ত আমাদের মহাশূন্যেই একরকম ঝুলিয়ে রেখে দিলেন।

কিন্তু শেষ টানের পর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে নিজেই যেন তার মধ্যে হারিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী যেন বলছিলাম?।

কী বলছিলেন ধরিয়ে দেবার জন্য সব কটা গলা মুখর হয়ে উঠল।

বলছিলেন ফোবস আর ডিমস-এর কথা।

লুটভিক বলে সেই পাজি পাগলটাকে তখন বেঁধে ফেলেছেন।

নিজেরা চাঙ্গা হয়েছেন কাঠের ছাই খেয়ে।

যন্তর-টন্তর আনাড়ি হাতে নাড়তে গিয়ে প্রায় আছড়ে ভেঙে ফেলেছেন। উড়োজাহাজটা।

উড়োজাহাজ নয়, আহাম্মক কোথাকার! মহাশূন্যে কি হাওয়া আছে যে উড়োজাহাজ চলবে। জেট প্লেনও সেখানে পাত্তা পায় না।

শুনলি না ঘনাদার সে এক আজব পুষ্পক রথ! পৃথিবী থেকে যেতে-আসতে হাওয়ার ঘর্ষণে পোড়ে না, আর আমাদের ঘরবাড়ির মতোই তার আসবাবপত্র।

আরে, উনি কি সত্যিই যন্তর-টন্তরে আনাড়ি হাত লাগাচ্ছিলেন নাকি। ওই ভান করে ওই পাগলা বদমাশটার পেটের কথা সব বার করে নিলেন, বুঝলে না?

আমাদের তিন ভাড়াটে সহায় এমন জ্বালা হয়ে উঠবে আগে কি জানতাম! কোনওরকমে তাদের কোরাস গলার ফাঁকে নিজেদের কথাটা গলিয়ে দিয়ে বললাম, লুটভিক-এর কথায় কোথায় পৌঁছেছেন তার যেন একটু আভাস পেয়েছেন।

ঠিক! ঘনাদা যেন লাইন ধরতে পেরে খুশি হলেন, ফোবস ডিমস-এর নাম শুনেই বুঝলাম নির্ঘাত মঙ্গলগ্রহের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। আনাড়ি আহাম্মক সেজে প্যাঁচ করে লুটভিক-এর কাছে যন্ত্র চালাবার মোটামুটি কায়দাও তখন জানা হয়ে গেছে।

এবার জরুরি একটা পরামর্শের বৈঠক বসাতেই হয়।

লুটভিককে বাঁধা অবস্থায় তার চেয়ারেই বসিয়ে রেখে নিজেদের কামরায় ফিরে এলাম।

সুরঞ্জন দারুণ উত্তেজিত—ছোকরা শুধু গানই গায় না, জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধে পড়াশোনাও যে আছে তা প্রথম কথাতেই টের পেলাম। প্রশ্ন যা করলে তা কিন্তু একটু ভড়কে দেবার মতো!

জিজ্ঞাসা করলে, আপনি লুটভিক-এর কথা বিশ্বাস করেন?

তার মানে? বিশ্বাস না করবার কী আছে? অবাক হয়ে বললাম, ও মিথ্যে বলবে কেন? বিশেষ ওই রকম আঁতকে-ওঠা অবস্থায়?

ওর মতো শয়তান সব পারে! সুরঞ্জন গম্ভীরভাবে জানালে, আমাদের গুলিয়ে দেবার জন্যই যে ডিমস ফোবস-এর নাম করেনি তার ঠিক কী?

বেশ একটু ভাবনায় পড়েই বললাম, কিন্তু একটা চাঁদ আমরা তো চোখেই দেখতে পাচ্ছি। মাপে-টাপে ফোবস-এর সঙ্গেই মিলছে!

ঠিক মিলছে কী? সুরঞ্জন সন্দেহ প্রকাশ করলে, চাঁদ বলতে যত ছোটই হোক বলের মতো গোল একটা কিছু তো হবে। যা দেখছি তা তো একটা পাহাড়ের ভাঙা টুকরো বলা যায়। তা ছাড়া আমার তো মনে হয় মঙ্গলগ্রহের সত্যিকারের চাঁদ বলে কিছু নেই। যা আছে তা কৃত্রিম উপগ্রহ। মঙ্গলগ্রহের কাছাকাছি পৌঁছলে আমরা সেই

স্যাটেলাইট দুটোই দেখতে পেতাম।

এবার একটু হাসলাম। বললাম, বুঝেছি, কোথা থেকে তোমার এ ধারণা হয়েছে। তুমি সক্লোভস্কি পড়েছ?

হ্যাঁ, পড়েছিই তো! সুরঞ্জন উৎসাহিত হয়ে উঠল, তিনি স্পষ্ট হিসেব করে দেখিয়ে গেছেন যে, ষোলো আর নয় কিলোমিটার ব্যাসের ওই উপগ্রহ দুটো স্বাভাবিক চাঁদ হতে পারে না। আমাদের চেয়ে কোনও সভ্য বৈজ্ঞানিক জাত কোনও কালে ওই দুটো স্যাটেলাইট তৈরি করে আকাশে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল। সে জাত এখন না থাকতে পারে, কিন্তু তাদের উপগ্রহ এখনও চাঁদের মতো মঙ্গলগ্রহকে প্রদক্ষিণ করে ঘুরছে।

তুমি ঠিকই বলেছ। হেসে বললাম, বিখ্যাত রুশ বৈজ্ঞানিক সক্লোভস্কি ওই রকমই লিখে গিয়েছিলেন বটে। তাঁর কথায় তখনকার বৈজ্ঞানিক মহলে সাড়া পড়ে গিয়েছিল, যেমন পড়েছিল ১৮৭৭-এ, গত শতাব্দীতে, ইটালির জ্যোতির্বিদ জোভানি স্কিয়াপারেললি-র মঙ্গলগ্রহের বুকে কাটা খালের রেখা আবিষ্কারের ঘোষণার পর।

স্কিয়াপারেললি-র কাটা খালের রেখা দেখা, আর সূক্লোভস্কির কথার তফাত আছে। কাটা খালের রেখা তো পরে ভাল উন্নত দূরবিনের দেখায় ভুল বলে জানা গেছে, সুরঞ্জন আমার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতটার প্রতিবাদ জানালে, কিন্তু মঙ্গলগ্রহের চাঁদ যে কৃত্রিম তার অন্য প্রমাণও আছে। প্রথম হল ফোবস যার নাম সে চাঁদের গতি। সে উপগ্রহটা মঙ্গলের দিনরাত্রির অর্ধেক সময়ের মধ্যে মঙ্গলকে এক চক্কর দিয়ে আসে। মঙ্গলের দিন আমাদের পৃথিবীর দিন-রাত্তিরের চব্বিশ ঘণ্টার সামান্য কয়েক মিনিট বেশি। ফোবস-এর মঙ্গল ঘুরে আসতে লাগে মাত্র এগারো ঘণ্টা। ডিমস-এর ব্যাপার আবার একেবারে উলটো। সমস্ত সৌরমণ্ডলে সব গ্রহের মোট বত্রিশটি চাঁদ আছে। ফোবস-এর মতো এত বেগে কোনও চাঁদ ঘোরে না। ডিমস আবার একেবারে সৃষ্টিছাড়া। তার গতি, আর সব চাঁদ যে দিকে ঘোরে, তার উলটো মুখে।

না, এবার সুরঞ্জনকে থামাতে হল। তুমি এত কিছু জেনেও একেবারে হালের খবর জানো না। ফোর্বস যে মঙ্গলগ্রহকে এত তাড়াতাড়ি কেন চক্কর দেয় তার হদিস না পেলেও জ্যোতির্বিদরা এখন জানেন যে ফোবস-এর আকার এমন গোল নয় যে তার ব্যাস সঠিক হিসেব করা যায়। সূক্ষ্ম আধুনিক পর্যবেক্ষণ জানা গেছে যে ফোবস লম্বায় ২৪.৮ কিলোমিটার আর চওড়ায় ২০.৮ একটা পাথরের চাংড়া। সুতরাং আমরা যা দেখেছি সেটা ফোবস বলেই মনে হয়। ডিমস যে উলটোদিকে ঘোরে এ ধারণাও ভুল। ফোবস যেমন অত্যন্ত চটপটে, ডিমস তেমনই একেবারে গদাইলস্করি চালে মঙ্গলকে প্রদক্ষিণ করে। এ প্রদক্ষিণে তার চব্বিশের চেয়ে আরও ঘণ্টা তিনেক বেশি লাগে বলে মনে হয় সে যেন উলটোদিকে যাচ্ছে। মঙ্গলগ্রহের ওপর থেকে দেখলে তো তাকে শামুকের গতিতে আড়াই দিনে উলটো দিকে অস্ত যেতে দেখা যাবে। ডিমস সম্বন্ধে ভুল ধারণাটা এই থেকেই গড়ে উঠেছে।

ওখানে তো ঝড় হচ্ছে!

চমকে উঠলাম। যার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম নিজেদের তর্কে মশগুল হয়ে সেই বটুকেশ্বরের গলা। কিন্তু সে বলছে কী?

ঝড়! ঝড় আবার কোথায়?

ওই তো ওখানে!

বটুককে আর আঙুল দেখাতে হল না। তার ঘাড় ঘোরানো দেখেই জানলার দিকে আমরা দুজনেই তখন ছুটে গেছি। নিজেদের অত্যন্ত আহাম্মক ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না! হাতে পাঁজি থাকতে মঙ্গলবার নিয়ে তর্ক নইলে করে!

ওই তো সামনে মঙ্গলগ্রহ! অন্তত তাই বলেই আমার ধারণা। কিন্তু বটুক যা বলেছে তাও তো মিথ্যে নয়! সত্যিই ওখানে ঝড় উঠেছে। এমন প্রচণ্ড ঝড় যে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রচণ্ড সাইক্লোনও যার কাছে ছেলেখেলা।

ভাল করে কিছু দেখবারই তো উপায় নেই। ধুলোয় সমস্ত গ্রহ আচ্ছন্ন।

এত ঝড় যেখানে ওঠে সেখানে হওয়া আছে নিশ্চয়! সুরঞ্জন নিজেকেই বোঝাবার জন্য যেন বলেছে, আর হাওয়া মানে কী?

হাওয়া মানেই প্রাণ নাও হতে পারে! সত্যের খাতিরে সুরঞ্জনকে বলতে বাধ্য হয়েছি, মঙ্গলগ্রহের হাওয়া যা আছে তা অত্যন্ত পাতলা। তাতে প্রাণধারণের উপযুক্ত অক্সিজেন আছে কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ আছে। একমাত্র যা বৈজ্ঞানিকদের উৎসাহ বাড়িয়েছে তা হল মঙ্গলগ্রহের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে বেশ যথেষ্ট জলীয় বাষ্পের অস্তিত্ব। জল থাকার লক্ষণ মঙ্গলগ্রহের অন্য জায়গাতেও নাকি পাওয়া গেছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও বৈজ্ঞানিকরা ওই গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তেমন আশান্বিত নন। ওই একান্ত প্রতিকূল আবহাওয়ায় প্রাণ যদি বা থাকে, তা ভাইরাস কি লিচেন-এর চেয়ে উঁচু পর্যায়ের হতে পারে না বলে তাঁদের ধারণা। কেউ কেউ তো সে সম্ভাবনাও স্বীকার করেন না। সৌরমণ্ডলে তো নয়ই, সমস্ত নীহারিকামণ্ডলীতেও কোথাও পৃথিবীর মতো প্রাণের উদ্ভব ও বিবর্তন হয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন না।

আপনার বিশ্বাসও যেন তা-ই মনে হচ্ছে। কিন্তু সুরঞ্জন বেশ ক্ষুণ্ণ স্বরেই আরও কিছু বুঝি বলতে যাচ্ছিল।

হ্যাঁ, তাকে বাধা দিয়ে বললাম, একটা কিন্তুর ওপরই আমারও ভরসা।

কিন্তু-র ওপর ভরসা!

সুরঞ্জনের নয়, আমাদেরই বিমূঢ় জিজ্ঞাসা।

কিন্তু হল একটা উল্কা। মর্চিসন মিটিওরাইট নামে যা বিখ্যাত হয়ে আছে। অস্ট্রেলিয়ার এক চাষির খামারে সেটা পড়েছিল। ঘনাদার কাছে এ-ই হয়তো প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা। কিন্তু আমরা যে তিমিরে সেই তিমিরে।

উল্কা পড়েছিল তাতে হয়েছে কী? জিজ্ঞাসা করতে হল—কত উল্কাই তো পৃথিবীতে পড়ছে। আমাদের কলকাতার মিউজিয়মে গেলেই অমন কত উল্কা দেখা যাবে।

এ উল্কা সে সব থেকে আলাদা! ঘনাদা বিশদ হলেন, এ উল্কার ভেতর এমন জিনিস পাওয়া গেছে যার দ্বারা প্রাণের অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়। জিনিসটা হল প্রাণের প্রধান উপাদান অ্যামিনো অ্যাসিড। উল্কা আসে পৃথিবীর বাইরের কোনও মহাশূন্য থেকে। কোনও উল্কায় অ্যামিনো অ্যাসিডের চিহ্ন পেলে পৃথিবীর বাইরেও কোথাও প্রাণের অস্তিত্ব আছে বলেই তাই মনে হয়। বৈজ্ঞানিকেরা অবশ্য যেমন খুঁতখুঁতে, তেমনই সন্দিগ্ধ। অ্যামিনো অ্যাসিডের চিহ্ন পেয়েও তাঁরা সন্তুষ্ট নন। তাঁরা খটকা লাগাতে চেয়েছেন এই বলে যে অ্যামিনো অ্যাসিডের চিহ্ন মানেই অপার্থিব অন্য কোনও গ্রহের প্রাণের প্রমাণ মনে করব কেন? উল্কা পৃথিবীতে এসে পড়বার পর তাতে এখানকার প্রাণেরই কেমন করে একটু ছোঁয়া যে লাগেনি তার ঠিক কী? এ সন্দেহের জবাব একমাত্র ওই মর্চিসন মিটিওরাইট-এই আছে।

উল্কার মধ্যে সে আবার কী জবাব?

জবাব এই যে ওই উল্কাপিণ্ডের মধ্যে যে অ্যামিনো অ্যাসিড পাওয়া গেছে তা ডান-হাতি।

ডান হাতি!

ঘনাদা কি আমাদের আবোল-তাবোল পড়াচ্ছেন?

না, আবোল-তাবোল নয়। ঘনাদা করুণা করে আমাদের তারপর বুঝিয়ে দিলেন, পৃথিবীর প্রাণবস্তুর যে অ্যামিনো অ্যাসিড, তার অণুর গঠন বাঁ-হাতি, অর্থাৎ অণুগুলো বাঁ দিক দিয়ে ঘুরিয়ে সাজানো। আর মর্চিসন উল্কায় তা ডান-হাতি। এইখানেই আমার কিন্তু আর এই কিন্তুর ওপরই ভরসা। এ প্রমাণও সন্দেহে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। কেউ কেউ বলছেন, ও ডান-হাতি অণু দিয়েও কিছু প্রমাণ হয় না। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকবার পর প্রচণ্ড উত্তাপে বাঁ-হাতি গড়ন ডান-হাতি হয়ে গেছে। অবিশ্বাসীরা যে যাই বলুক, এই মর্চিসন মিটিওরাইট-এর কিন্তুর ভরসা আমি ছাড়িনি।

আগের পর্ব:

০১. বাহাত্তর নম্বরের একেবারে চক্ষুস্থির
০২. এক পুরিয়া ছাই
০৩. আট কোটি কিলোমিটার
০৪. অনুমান ভুল হয়নি
০৫. প্রচণ্ড একটা ঝাপটা
০৬. দূরের ঢিবির আলোর রেখা
০৭. কী বা করবার থাকতে পারে
০৮. লুটভিক যা বলে গেছে
পরের পর্ব :
১০. মঙ্গলগ্রহে গিয়ে নামবার পর
১১. বিরাট একটা ফোকর
১২. ঘনাদা থেমে নতুন সিগারেট ধরালেন

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত