অগ্রন্থিত ঘনাদা: ঘনাদার বাঘ

অগ্রন্থিত ঘনাদা: ঘনাদার বাঘ

ঘনাদার বাঘ

শিবু প্যাঁচটা ভাল কষেছে।

ক-দিন ধরে হাওয়াটা বেয়াড়া বইছিল।

বাহাত্তর নম্বরের সময়টা এরকম মাঝেমধ্যে একটু আধটু যায় না এমন নয়। যা কিছু করি, গুমোট যেন আর কাটতে চায় না। টঙের ঘরে তাঁকে তখন কিছুতেই বাগ মানানো যায় না। কখনও তিনি কোনও কিছু ঘোষণা ছাড়াই পূর্ণ অসহযোগ চালিয়ে ন্যাড়া ছাদের সিঁড়িতে তাঁর বিদ্যাসাগরি চটি ছোঁয়ানই না। আবার কখনও সকাল বিকেল দুবেলা আমাদের সঙ্গে ওঠবোস করেও মুখে যেন কুলুপ দিয়ে রাখেন। কুলুপ খোলাতে মোগলাই চাইনিজ ফরাসি কতরকম রসুইয়ের কেরামতি যে লাগে তার হিসেব দেওয়া শক্ত।

কিন্তু এবার অবস্থাটা একেবারে আলাদা। আমাদের সেই টঙের ঘরের তিনি নন, তাঁরই চেহারা জাল করে আর যেন কে আমাদের বাহাত্তর নম্বরের উপর ভর করেছেন। চেহারা এক, কিন্তু ভাবগতিক ধরনধারণ সব যেন আলাদা। খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে তো সে মানুষের পছন্দ অপছন্দের কোনও হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না।

যা রাবড়ি পাকিয়েছে দেখে এলাম মোড়ের মিঠাইওয়ালা—আমি হয়তো ক-দিন ধরে চপ কাটলেট কাবাব চিনা-চপসুয়ে ইত্যাদি হার মানবার পর বাইরে থেকে প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে এসে ফলাও করে বর্ণনা করেছি। আমার রসালো বর্ণনা আরও মারাত্মক করে তোলবার জন্য গৌর যেন আমার ওপর খাপ্পা হয়ে ভেংচি কেটে বলেছে, রাবড়ি পাকিয়েছে মিঠাইওয়ালা, তুমি দেখে এলে! তাতেই আমরা কৃতার্থ হয়ে গেলাম, কেমন!

কেন? কেন? আমি যেন বোকা সেজে অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ হয়ে বলেছি, গণেশ হালুইকরের সদ্য উনুন থেকে নামানো রাবড়ির কড়াইয়ের ভুরভুরে গন্ধে সারা মিঠাইপাড়া মাত হয়ে গেছে। তাই দেখে এসে আমার বলাটা কী অন্যায় হয়েছে,

শুনি?

দোষের এই হয়েছে যে, শিশির গৌরের হয়ে কাটা ঘায়ে নুন ছড়িয়ে বলেছে, তোমার বর্ণনা শুনে আমাদের এখন বুক চাপড়ানো ছাড়া আর কিছু করবার নেই। গণেশ হালুইকরের রাবড়ির কড়াইয়ের বর্ণনা দিতে হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে আসার বদলে দু-কিলো কিনে আনতে পারলে না। গণেশ হালুইকরের রাবড়ির কড়াই একবার ভিয়েন থেকে নামবার পর কতক্ষণ দোকানে পড়ে থাকে। এতক্ষণে কড়াই চাঁছাপোছা হয়ে সব বিক্রি হয়ে গেছে দেখো গিয়ে! তবু পাঠিয়ে দেখি একবার বনোয়ারিকে, কী বলেন ঘনাদা?

শেষ কথাগুলো ঘনাদার দিকে চেয়ে যেন তাঁর অনুমতি নেওয়া।

কী বলেছেন তাতে ঘনাদা? অনুমতি দিয়েছেন, না জানিয়েছেন আপত্তি?

কী যে করেছেন সেইটে বোঝাই শক্ত।

আপত্তি ঠিক করেছেন তা বলা যায় না, কিন্তু যা বলেছেন, সেটাকে সানন্দ না হোক, কোনওরকম অনুমতিই বলা চলে কি?

নিজের মৌরসি আরামকেদারায় বসে হাতের কাগজটা থেকে মুখ না তুলেই নির্লিপ্ত গলায় তিনি বলেছেন, রাবড়ি আনাবে? তা ইচ্ছে হয়, আনাও। আর কিছু না হোক গায়ে চর্বি জমবে, ভুঁড়ি বাড়বে। মানে—

ঘনাদাকে আর কিছু বলতে হয়নি। তিনি পরের কথাটা আরম্ভ না করতেই মেজাজটা বুঝে নিয়ে শিবু চাল বদলে ফেলেছে।

রাবড়ি খাবে, রাবড়ি? সে আমাদের ভেংচিয়ে বলেছে, রাবড়ি খায় কারা? যত নিষ্কর্মা পেটুক। রাবড়ি খায় আর কুমড়োপটাশ হয়ে একদিন ফুটিফাটা হয়ে মারা যায়। না, না, ওসব রাবড়ি-টাবড়ি বাহাত্তর নম্বরে আর চলবে না।

ওদিকে কোপ্তা কাবাব মোগলাই পরোটাও নয়, আবার তার বদলে রাবড়িও না। তাহলে চলবেটা কী? সে জিজ্ঞাসাটা জিভের ডগায় এলেও কেউ আর আমরা করিনি। যাঁর জন্য এত পাঁয়তারা সেই তিনিই হঠাৎ কী যেন একটা অত্যন্ত দরকারি কথা মনে পড়ায় ব্যস্ত হয়ে উঠে ন্যাড়া ছাদের সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছেন।

ওদিকে যাচ্ছেন কোথায়, ঘনাদা? আমাদের ব্যাকুল প্রশ্ন যেন ভাল করে শুনতেই না পেয়ে কী একটা অস্পষ্ট জবাব দিয়ে ন্যাড়া ছাদের সিঁড়ি বেয়ে তাঁর টঙের ঘরে চলে গেছেন।

তা চলুন। মুশকিল আসানের চাবিকাঠি আমরা বোধহয় পেয়ে গেছি। অন্তত শিবুর তা-ই ধারণা। টঙের ঘরে উধাও হবার পর সেদিনই আড্ডাঘর থেকে তার নিজের কামরায় নিয়ে গিয়ে চাপা গলায় হলেও কেল্লাফতের মতো উত্তেজনা নিয়ে বলেছে, আর বোধহয় ভাবনা নেই। এবারকার ফুসমন্তর মনে হচ্ছে পেয়ে গেছি।

এবারকার ফুসমন্তর? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছি। সে আবার কী?

সে আবার কী বুঝিয়ে বলতে হবে? শিবু আমার বুদ্ধির স্থূলতায় হতাশ হয়ে বলেছে, ওঁর মেজাজ তাতিয়ে সুরে বেঁধে টঙ্কার ছাড়াতে কখন কী মোচড় লাগে তার ঠিক আছে? ওই মোচড়কেই বলছি ফুসমন্তর। কখনও তা কুলপির বদলে গরম কফি, আবার কখনও রাবড়ির বদলে মাথা না ঘামানো কিছু মানে অ্যাকশন। হ্যাঁ, এবারের ফুসমন্তর হল তাই।

তা সেই ফুসমন্তরই শিবু প্রয়োগ করল পরের দিন সকালে। দিনটা ছিল রবিবার। তাই সকাল থেকেই আমরা যথাস্থানে জমায়েত হয়েছি। টঙের তিনি আসতে একটু দেরি করে আমাদের উদ্বেগ বাড়ালেও শেষ পর্যন্ত উদাস উদাস কেমন একটু অন্যমনস্কভাবে নিজের মৌরসি চেয়ারটি দখল করেছেন। আসরটায় নেহাত ছাতা না ধরে যায় সেইজন্য আমরা ফুটবল নিয়ে হাওয়া গরম রাখবার চেষ্টা করতে করতে শিবুর নাটকীয় প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছি।

কিন্তু কোথায় শিবু? ফুটবল আর স্টেডিয়াম নিয়ে ঝগড়ার সব পুরনো খোঁচাখুঁচিগুলো যখন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে তখন শিবু এসে ঘরে ঢুকেছে সত্যিই নাটকীয় ভাবে।

তবে তার প্রবেশের চিত্রনাট্যটা একটু আলাদা বলে প্রথমে একটু ভড়কেই যে গেছলাম তা অস্বীকার করব না।

ঠিক ছিল যে ফুটবল নিয়ে আমাদের নকল ঝগড়ার মাঝে শিবু একেবারে ঝড়ের মতো ঘরে এসে ঢুকে একপাক নেচে নিয়েই—তারপর ঘোষণা করবে—মার দিয়া! মার দিয়া কেল্লা।

কী মার দিয়া? কোন কেল্লা আবার মেরে এলে? আমাদের গলায় উঠবে সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসা। আবার তোমার সেই বাহাত্তর নম্বরের বদলে নতুন কোনও বাসা-টাসার খোঁজ নয় তো?

না, না—শিবু আমাদের আশ্বস্ত করে জানাবে—নতুন বাসা-টাসা নয়, বাহাত্তর নম্বর ছেড়ে খাস অমরাবতীর জোড়া ফ্ল্যাট পেলেও যে কেউ তোমরা নড়বে না তা জানি। ওসব কিছুর বদলে কোন কেল্লা ফতে করেছি একটু আন্দাজ করো তো দেখি?

এরপর প্যারিসের ভারত মেলায় যাবার ফ্রি টিকিট থেকে স্বয়ং পেলেকে একদিন বাহাত্তর নম্বরে এনে খানাপিনা করানো পর্যন্ত আন্দাজ করে হার মানবার পর শিবু তার কেল্লা ফতেটা ব্যাখ্যা করে আমাদের অবাক করে দেবে এই ছিল কথা।

তার জায়গায় শিবুর একী নাটকীয় প্রবেশ! সে যেন পালহেঁড়া হালভাঙা নৌকোর মতো কোনওরকমে বন্দরে এসে ভিড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে হতাশ গলায় বলেছে, না, আর হল না।

সিনারিও বদলেছে। কিন্তু পরের সংলাপটা আপনা থেকেই মুখে এসে গেল। সত্যি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কী, হল না-টা কী?

সে আর বলে কী হবে? শিবু একটু বেশি পাঁয়তারা কষে বললে, যা সুবিধেটা হয়েছিল!

কী সুবিধেটা হয়েছিল, কী? ভান না করে বিরক্তি নিয়েই এবার বললাম, অত ধোঁয়া-টোঁয়া না ছেড়ে সাফ কথাটা বল দেখি।

সাফ কথা বলব? শিবুর যেন বলতে গিয়ে গলা ধরে এল দুঃখে। সাফ কথাটা হল, সুন্দরবন।

সুন্দরবন! আমরা সত্যিই হতভম্ব। সুন্দরবনে আবার কী?

সুন্দরবনের ব্যাঘ্র প্রকল্পের নাম শুনেছ! শিবু যেন আমাদের ওপরেই গরম হয়ে বলেছে, লাট-বেলাট হলেও সেখানে যাবার হুকুম মেলে না। এক কাঠুরে কি মধু-জোগাড়ে সেখানে যেতে পারে প্রাণ হাতে নিয়ে, গেলে অবশ্য প্রাণটি তার হাতেও বেশিক্ষণ থাকবে না। কাঠ কাটতে কি মধু জোগাড় করতে যারা যায় তারা যাবার আগে নিজেদের শ্রাদ্ধ-টাদ্ধ সেরেই যায় বলে শুনেছি। সরকারি বনবিভাগের তাই সেখানে কড়া পাহারা। অনুমতি না নিয়ে কেউ যেন সেখানে না যায়, আর অনুমতি কেউ যেন না পায় সেদিকেও কড়া নজর।

শিবুর নতুন চালটা এতক্ষণে কিছুটা বুঝে ফেলেছি। তাই সবজান্তার চালে বললাম, তা কড়া নজর তো হবেই। দুনিয়া থেকে বাঘ প্রাণীটা যাতে লোপ না পায় তাই জন্যেই এই ব্যবস্থা। বাঘ যেখানে গিজগিজ করত সেই সুন্দরবনে বাঘ মাত্র এখন এই কত—মানে বড় জোর কত হবে—এই ধরো হাজারখানেক।

এদিক থেকে নাসিকাধ্বনির মতো একটা যেন শব্দ শুনলাম, সেটা ঘনাদারই কি

তা বোঝবার আগেই শিবুর ভেংচিকাটা ঠাট্টা শোনা গেল—হাজার-হাজার! সুন্দরবনে হাজার দু-হাজার বাঘ! প্রমাণ করতে পারলে রয়্যাল জুয়োলজিক্যাল সোসাইটির সভ্যপদ তো বটেই, চাইকী প্রাণীতত্ত্বে নোবেল প্রাইজও পেয়ে যেতে পারিস।

মারটা এবার ইংরেজিতে যাকে বলে বিলো দ্য বেল্ট মানে কোমরের নীচে হয়ে যাচ্ছে না? চটে উঠেই বললাম, হাজার দু-হাজার না তো কত, তুই জানিস? ঠিক কি কেউ জানে, না জানতে পারে?

হ্যাঁ, পারে, আর পেরেছে। শিবু এবার আসর জমিয়ে বললে, বারো বছর আগে উনিশশো তিয়াত্তরে সুন্দরবনে বাঘ কত ছিল জানো? মাত্র একশো পঁয়ত্রিশ। হ্যাঁ, খুশি মতো অবাধ শিকার করার অত্যাচারে বাঘ তখন প্রায় লোপ পেতে বসেছে পৃথিবী থেকে। বাঘ তো শুধু এশিয়ারই প্রাণী। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেই সাইবেরিয়া থেকে এই দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বর্মা মালয় থেকে সুমাত্রা ফিলিপাইন ইত্যাদি দ্বীপে। যা আছে তাও ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে এখানেও, যা তাদের আসল আস্তানা সেই ভারতবর্ষেই।

শিবুর বক্তৃতার দিকে কানটা রাখলেও আড়চোখের দৃষ্টিটা আছে ঘনাদার দিকে, কখন তিনি শিবুর মাতব্বরির মাপসই জবাবটা দেন।

কিন্তু কই? তিনি তো বেশ নির্বিকারভাবে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে সিগারেট টেনে যাচ্ছেন।

শিবুর প্যাঁচটা কি তাহলে ভেস্তে গেল? না, তার পটকার বারুদ ভিজে। ভাল করে ধরতে চাইছে না।

শিবু তখন বলে যাচ্ছে, হ্যাঁ, এই ভারতবর্ষে বারো বছর আগে মোট মাত্র এক হাজার আটশোটি বাঘ ছিল। তা-ও সেই ১৯৫৫-র গোড়ায়। বন্দুক হাতে পেলেই ট্রিগার টানার আঙুল সুড়সুড় করা এক খ্যাপা শিকারির গুলিতে ত্রিশ-ত্রিশটা তাগড়া বাঘ মারা যাবার পর মধ্যপ্রদেশের অনেকটা জায়গা ন্যাশনাল পার্ক বলে ঘোষিত হবার পরও—

তা যা সব হবার তা তো হয়েছে, শিবুকে একটু থামিয়ে হুঁশিয়ার করবার জন্যই এবার বলতে হল, কিন্তু সুন্দরবনের কথা হঠাৎ এল কেন? আর নাম করতে গলাটা অমন করুণ হল কীসে?

করুণ হল কীসে? শিবু দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে বললে, হল যে মওকাটা মিলছিল সেট ফসকে গেল বলে।

মওকাটা কী? এবার শিবুর সঙ্গে সঙ্গত চলল আমাদের—ওই সুন্দরবনে যাওয়ার? সে তত ইচ্ছে করলেই যাওয়া যায়। শুধু বনবিভাগ দপ্তর থেকে একটা পাশ জোগাড় করলেই হল।

হ্যাঁ, তাই হয় বটে? শিবু ভারিক্কি চালে বলল, কিন্তু পাশ দেওয়া এখন এক্কেবারে বন্ধ বললেই হয়।

কেন, হঠাৎ এত কড়াকড়ি কেন? আমাদের কৌতূহল।

কড়াকড়ি শুধু ওই কানকাটার জন্য! শিবু প্রায় কাঁপা গলায় জানাল।

কানকাটা? কানকাটা আবার কে?

কে বা কী তা ঠিক কেউ কি জানে? কেউ যে তাকে দেখেছে তাও জোর করে বলতে পারে না, শিবু গলাটা কেমন একটু নামিয়ে বললে, শুধু নানান সব আজগুবি কথা তাকে নিয়ে কানাকানি হয়। সোঁদরবনের জঙ্গলে সে কখন কোথায় হানা দেবে তার কোনও হদিস পাবার উপায় নেই। এই নাকি সেদিন এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটেছে হাঁসখালির চাষিগাঁয়ের মাইল দুয়েক মাত্র দূরে। চার কাঠুরে আর মধু-জোগাড়ে মিলে গাদা-বন্দুক আর কাস্তে বল্লম নিয়ে অতি হুশিয়ার হয়ে ছোট একটা খাল পেরিয়ে ওদিকের লাট অঞ্চলে যাচ্ছিল। খালটা নেহাত ছোট, হাঁটুজলও হবে না। সেইটুকু পার হয়ে ওদিকে শুকনো ডাঙায় উঠে সবাই একেবারে থ। ছিল তারা চারজন। চারজন একসঙ্গে খালে নেমেছিল, তা আর-একজন গেল কোথায়? তা খালে চোরাবালি কি গাঢ়াগর্ত নেই যে তলিয়ে যাবে। কুমির নেই যে টেনে নিয়ে যাবে। আর তা নিলেও ঝটপটানির আওয়াজ পাওয়া যেত! সাড়া নেই, শব্দ নেই, হঠাৎ একটা মানুষ হাওয়া হয়ে গেল কী করে?

এ সেই কানকাটা ছাড়া আর কেউ নয়। মুখ দিয়ে ভয়ে না বার হোক, সকলের মনে সেই এক কথা। কানকাটা মানে সোঁদরবনের সেই দুশমন শয়তান যাকে চোখে কেউ দেখেছে কি না ঠিক নেই। কিন্তু ওই কানকাটা বর্ণনাটাই কেমন করে তার সঙ্গে জুড়ে গেছে। কানকাটা বলতে যে ভয়ংকর এক প্রাণীর মুখের ইঙ্গিত দেওয়া হয় সেটার সঙ্গে নাকি বাঘেরই কিছু মিল আছে। মিল চেহারায় একটু থাকলেও আর-কিছুতে নয়। এ শয়তান দুশমন নাকি যেখানে যখন খুশি দেখা দিতে পারে। জমিতে নাকি তার থাবার দাগ পড়ে না। ছায়াও পড়ে না কোথাও তার শরীরের।

এই কানকাটার যে সব ভয়ংকর ব্যাপারের কথা সুন্দরবনের এক অঞ্চলে মুখে মুখে ফিরছে তা আজগুবি গল্প,না তার মধ্যে কিছু সত্য আছে এখনও স্থির করতে না পারলেও আমাদের বনবিভাগের সাবধানের একটু কড়াকড়ি বাড়াতে হয়েছে, এই হয়েছে। মুশকিল। শিবু শেষ কথাগুলি বলে যেন হতাশ হয়ে থামল। না, আজ শিবুকে সত্যিই বাহাদুরি দিতে হয়। এতক্ষণ ধরে আসর দখল করে রাখলেও সে খেলাটা সাজিয়েছে। ভাল। এখন আমরা ঠিক মতো দু-একটা খুঁটি নাড়তে পারলেই বাজিমাত হতে পারে।

শিবুর এগিয়ে দেওয়া খুঁটিটাই তাই নাড়লাম। বললাম, কড়াক্কড়ি বাড়িয়েছে, মুশকিল তো এই? পাশ দেওয়া বন্ধ তো করেনি? তা কড়াকড়িটা কী বাড়িয়েছে? কী তারা চায়, কী?

কী চায়? শিবুর গলায় গভীর হতাশা। তারা চায় সঙ্গে একজন শিকারি নিতে হবে।

হাসব না কাঁদব এমন গলায় বললাম, এই শুনে তুই এমন একটা মওকা নষ্ট করে এলি? একটা শিকারির অভাবে?

না হে, না। শিবু যেন তার সমালোচনায় জ্বলে উঠে বললে, বন্দুক হাতে পেলেই ঘোড়া টেনে ছুড়তে পারে তেমন শিকারি ভাবছ নাকি! ওরা যা চায় তা অন্য জাতের শিকারি। চোখের দৃষ্টি আর বন্দুকের গুলিতে যার গাঁটছড়া বাঁধা। ডান বাঁ, যে দিকে হোক, যা যখনই দেখে তক্ষুনি তা ফুটো করে দিতে পারে গুলিতে এমন শিকারি ওরা চায়। নইলে ওই কানকাটার তল্লাটে পাঠাবে কোন ভরসায়?

এই ব্যাপার! আমরা এবার অবাক হয়ে শিবুর দিকে তাকালাম-এমন শিকারি দরকার শুনে তুই পিছিয়ে এলি? এমন কারও কথা তোর মনে পড়ল না যে–

অ্যাঃ, ছিঃ ছিঃ—আমাদের কথা শেষ হবার আগেই শিবু লজ্জায় দুঃখে জিব কেটে নিজের কানদুটো মলতে মলতে বললে, হ্যাঁ, তোরা আমার কান দুটো মলে দিতে পারিস। আমার কিনা ঘনাদার কথাটাই মনে হয়নি। ছি–ছি—

থাম! থাম! শিবুর আত্মধিক্কারে বাধা দিয়ে বললাম, তা মওকা তো এখনও শেষ হয়ে যায়নি। ঘনাদাও সশরীরে হাজির। ঘনাদাকে নিয়ে গেলেই তো হয়। কী। বলেন, ঘনাদা?।

প্রশ্নটা সবাই মিলে যাঁর দিকে ফিরে করলাম তাঁর মুখে তখন কোনও ভাবান্তর নেই। ফুরিয়ে আসা সিগারেটটায় শেষ টানের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, সুন্দরবনে যাবার কথা বলছ? হ্যাঁ, শেষ গেছলাম বটে ১৯৭৩-এ। বাঘ তখন সেখানে মাত্র ১৩৫টা। তার পরের বছরই আবার মধ্যপ্রদেশের কানহার ন্যাশনাল পার্কে ভারতের প্রথম ব্যাঘ্র প্রকল্প চালু হওয়ার ব্যাপার দেখতে গিয়ে দেখি, ১৯৫৪-তে যে-প্যাঁচ দিয়ে কানহার ন্যাশনাল পার্কের পত্তন করিয়ে বন্দুক ধরা চিরকালের মতো ছেড়ে দিই বনবিভাগের হিসেবে সেই সাজানো ভুলটা কুড়ি বছরেও ধরা পড়েনি।

দাঁড়ান! দাঁড়ান! আমরা আকুল প্রার্থনা জানিয়ে বললাম, যা বললেন সেই প্যাঁচালো জটে বুদ্ধিশুদ্ধি সব জড়িয়ে গেছে। ধরবার মতো কোনও খেইই পাচ্ছি না। ব্যাপারটা একটু ভাল করে বুঝতে দিন। এই যেমন প্রথম কথা হল, আপনি বন্দুক ছোঁড়া ছেড়ে দিয়েছেন সেই ১৯৫৪-তে! আর এমন একটা প্যাঁচ কষেছিলেন যার দরুন ন্যাশনাল পার্কের পত্তন হলেও বনবিভাগের হিসেবে একটা ভুল থেকে যায়।

নির্বোধের প্রতি অনুকম্পাভরে দুবার মাথা নেড়ে ঘনাদা বললেন, হ্যাঁ, ১৯৫৪-তেই বন্দুক ছোঁড়া চিরকালের মতো ছেড়ে দিই। আর আমার প্যাঁচের দরুন হিসেবের যে ভুলটা সেদিন হয়েছিল বনবিভাগ এখনও তা শোধরাতে পারেনি।

বনবিভাগের হিসেবে ভুল! এবার আমাদের জিজ্ঞাসা—ভুলটা কী?

ভুলটা মোট বাঘের হিসেবের, ঘনাদা জানালেন, ১৯৭২-এ বনবিভাগের মতে কানহাতে বাঘের সংখ্যা হল ১৮০০া ওই অঙ্কটাই ভুল!

তার মানে?—আমাদের সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসা—ওটা যদি ভুল হয় তাহলে ঠিক সংখ্যাটা কত?

ঠিক সংখ্যাটি হল ১৮০২—ঘনাদা যেন অনিচ্ছার সঙ্গে জানালেন—এ ভুল সেই ১৯৭২-এরই নয়, ভুলটা চলে আসছে সেই ১৯৫৪ থেকে। যখন সেই এক খুনে সাহেবের হাতে গণ্ডা গণ্ডা বাঘ মারা যাবার পর দেশময় সোরগোল ওঠার পর মধ্যপ্রদেশের ওই অঞ্চলটা কানহা ন্যাশনাল পার্ক বলে সরকারি ভাবে ঘোষিত হয়। গণ্ডা গণ্ডা বাঘ মারা নিয়ে দেশময় শোরগোল তোলার পেছনে কার কতটুকু হাত ছিল। সে আর ক-জন জানে!

তার মানে? আমরা উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলাম, ওই শোরগোল তোলার মধ্যে আপনিই ছিলেন আর ওই গুনতির ভুলের মধ্যে—

ব্যাপারটা হয়েছিল কী?

ব্যাপারটা এই যে, ঘনাদা যেন নেহাত অনিচ্ছার সঙ্গে বিস্তারিত করে বললেন, তখনকার দিনে এক খুনে মেজাজের সাহেব কল-টল নেড়ে একসঙ্গে একবারে ত্রিশটা বাঘ মারবার লাইসেন্স জোগাড় করেছিল। দুনিয়া থেকে তখনই বাঘের বংশ লোপ পাবার অবস্থা হয়েছে। আজ যেখানে ২৬৪, সেই সুন্দরবনেই বাঘ তখন ১৩৫-এরও নীচে নেমে গেছে। আর বনবিভাগের হিসেবেই যেখানে তিন হাজার বাঘ মধ্যপ্রদেশের সেই কানহায় তখন ১৮০০-রও অনেক কম। দুনিয়ার শিকারি মহলে তো বটেই, সব মানুষদের মধ্যেও বাঘের মতো প্রাণীকে বিলুপ্তি থেকে বাঁচাবার জন্য সংরক্ষণের উপায়ের কথা ভাবা হচ্ছে। সেই সময়ে একটা-দুটো নয় একেবারে ত্রিশ-ত্রিশটা বাঘ খুশি মতো সাবাড়! প্রথমে একটা দুটো থেকে দেখতে দেখতে দেশের সব অঞ্চলের কাগজে এই নিয়ে লেখালেখি শুরু হল। দেশ তখন স্বাধীন। সরকারি মহলে, বিধানসভায়, লোকসভায় প্রশ্ন উঠল এই নিয়ে।

তারপর ক্রমেই ব্যাঘ্র-প্রকল্প শুরু না হলেও মধ্যপ্রদেশের ওই অঞ্চলটা কানহা ন্যাশনাল পার্ক নামে আলাদা করা হল। খুনে মেজাজের সেই ব্যাঘ্রমেধ বিলাসী সাহেবের পাপে শেষ পর্যন্ত কিন্তু সুফলই ফলেছিল ব্যাঘ্র-প্রকল্পের সূত্রপাত হয়ে। মজার কথা এই যে সেই খুনে শিকারি সাহেব কিন্তু তার পুরো লাইসেন্স-এর বরাদ্দমত ত্রিশটা বাঘ মারেনি, মেরেছিল মাত্র আটাশটা।

তাহলে? তাহলে?—আমাদের প্রশ্ন করতেই হল—সরকারি গুনতিতে সেই আটাশটাই লেখা আছে তো?

না। ঘনাদা একটু হেসে জানলেন, সরকারি গুনতিতেই পুরোপুরি ত্রিশটা শিকার করা বাঘের কথাই লেখা আছে। আটাশের জায়গায় ত্রিশ ধরার ওই ভুলের জন্যই বনবিভাগের মোট হিসেবে ওই সংখ্যার ভুল থেকে গেছে।

কিন্তু গুনতিতে অমন ভুল হবে কেন? আমরা নাছোড়বান্দা হয়ে জানতে চাইলাম, বনবিভাগের লোকেরা তো শিকার করা বাঘ না দেখে আন্দাজে সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়নি।

না, তা দেয়নি। ঘনাদা ধৈর্য ধরে বললেন, মিথ্যে করেও কিছু লেখেনি। তারা বনের মধ্যে শিকার করা বাঘ স্বচক্ষে দেখে দেখেই হিসেব লিখেছে।

তা কী করে হয়?—আমরা সন্দিগ্ধ-আটাশের পর আরও দুটো শিকার করা বাঘ এল কোথা থেকে, গেলই বা কোথায়?

কোথা থেকে এল আর কোথায় গেল তা জানে শুধু একজনই।—ঘনাদা হাতের সিগারেটের শেষটুকু ফেলে ওঠবার উপক্রম করলেন।

তাঁকে চেপে ধরে বসিয়ে আর একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বসিয়ে বললাম, সে একজন তো আপনি বলুন, ওটা কি ম্যাজিক-এর ব্যাপার?

না, ম্যাজিক নয়—ঘনাদা করুণা করে বিশদ হলেন—আমি তখন বারশিঙ্গা হরিণের খোঁজে ওই কানহার জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বারশিঙ্গা হল ডালপালা মেলা শিং-এর এক অপরূপ হরিণ। আজ সরকারি কড়াকড়িতে সে হরিণের সংখ্যা চারশো ছাড়াতে চলেছে আর সেই ১৯৫৪-তে সে হরিণ গোটা পঞ্চাশ-ষাটটা ছিল কিনা। সন্দেহ! বারশিঙ্গার সন্ধানে ওখানকার জঙ্গলে ঘোরার সময়েই ওই খুনে বাঘ শিকারির কথা কানে আসে। ওই জাতের বেপরোয়া খুনে শিকারিদের অত্যাচারে বাঘ বলে প্রাণীবংশটাই যে লোপ পেতে বসেছে তাই নিয়ে সব দেশের সহৃদয় জ্ঞানীগুণী বৈজ্ঞানিক মহলে জোর আন্দোলন চলছে। অবাধ বাঘ শিকার বন্ধ না করলে ভারতবর্ষে এই প্রাণীটি কিছুদিন বাদে আর দেখা যাবে না তাই জানিয়ে সরকারি ওপর মহলে লেখালেখিও কম হচ্ছে না। তারই ভেতর ত্রিশ-ত্রিশটা বাঘ মারবার লাইসেন্স দেবার মতো এমন অন্যায় কী করে হল তা নিয়ে দিল্লি ছোটাছুটিতে তখন কোনও লাভ নেই, আর তার সময়ও নেই জেনে খোদ খুনে শিকারির সঙ্গেই দেখা করবার চেষ্টা করলাম। দেখা করা শক্তও ছিল না। কারণ ত্রিশটা বাঘ মারার হুকুম যে জোগাড় করেছে সে তো শিকারে নয়, যেন ঘটা করে বিয়ে করতে এসেছে এমনই তার সমারোহ। জঙ্গলের মধ্যে চাকর-বাকর-বাবুর্চি-খানসামা নিয়ে তাঁবুই পড়েছে তিনটে। তার মধ্যে বড় তাঁবুটা যেন রাজদরবার।

অন্য দুই তাঁবুর খবরদারির পর সেখানে যাবার তখন অনুমতি পেলাম যেন ভিখিরির মতো। ভেতরে যখন ঢুকলাম তখন শিকারি সাহেব বিকেলের নাস্তা করছেন। সামনের টেবিলে পাখ-পাখালি আর খরগোশ হরিণের মতো হরেক রকম জংলি শিকারের মাংসের সব প্লেট সাজানো। শিকারির হাতে কিন্তু তরল বস্তুর গেলাসই ধরা।

যা শিকার করতে এসেছেন সেই বাঘের মতোই চেহারা। সেই রকমই গলায় আমায় বললে, কী? কী চাস তুই? এই জঙ্গলেও তোদের হাত থেকে রেহাই নেই? এখানেও এসেছিস ভিক্ষে করতে?

হ্যাঁ, ভিক্ষে করতেই এসেছি, সবিনয়ে বললাম, দয়া করে যদি সে ভিক্ষা দেন।

কী? কী ভিক্ষা চাস এই জঙ্গলে? শিকারি সাহেব গর্জন করে বললো।

আজ্ঞে, সবিনয়ে বললাম, শুধু দশটা বাঘ।

দশটা বাঘ! তার সঙ্গে রসিকতা ভেবে সাহেব রাগে প্রায় ফেটে পড়ে আর কী! আমার সঙ্গে চালাকি করতে এসেছিস? আভূভি নিকালো—

দোহাই আপনার হাতজোড় করে একবার বললাম, আমার কথাটা দয়া করে একটু শুনুন। আপনি এ পর্যন্ত কুড়িটা বাঘ মেরেছেন। আরও দশটা মারবার আপনার হুকুম আছে। আমাদের ভারতবর্ষের খাতিরে, বাঘের বংশের খাতিরে ওই দশটা বাঘ আর মারবেন না। ওগুলো দুনিয়াকে ভিক্ষে দিন।

কে কার কথা শোনে? আভি নিকালো হিয়াসে! বলে সাহেব যেন খ্যাপা গণ্ডারের মতোই আমার দিকে তখন ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

সেই ঝোঁকেই তাঁবুর মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ার পর টেবিলে খানার প্লেটগুলো তার গায়ের ওপর ছুড়ে দিয়ে তার গেলাসটার তরল বস্তুও তার ওপর ঢেলে দিয়ে। চলে এলাম।

সাহেব তখন মেঝে থেকে উঠে রাগে চিৎকার করছে, পাকড়ো উসকো, পাকড়ো উ বদমাস কো—

কিন্তু কে পাকড়াবে! জঙ্গলে মিলিয়ে যাবার আগে সাহেবের লোকজন তাঁবু থেকে বেরিয়েছিল বটে, কিন্তু ওই বার হওয়া পর্যন্তই।

সাহেবকে একটু শিক্ষা দিয়ে আসার পর জঙ্গল যেন আমার কাছে বিষ হয়ে উঠল। একদিন যায়, দুদিন যায়, আর সাহেবের, একটা একটা করে নতুন বাঘ শিকারের খবর পাই। রাগে দুঃখে আমার যেন হাত-পা কামড়াতে ইচ্ছে হয়।

এই অবস্থায় বনবিভাগের সদর দপ্তরে গিয়ে দেখা করলাম। তারা যে নিরুপায় তা জেনেও আইন কেউ ভাঙলে তাদের কতদূর এক্তিয়ার তা জেনে নিলাম।

তারপর কিছুদিনের জন্য জঙ্গল ছাড়লাম। ফিরে যখন এলাম তখন সাহেবের সাতাশটা বাঘ মারা হয়ে গেছে। ক-দিন বাদে আটাশটাও পূর্ণ হল। তারপরই বনবিভাগের স্থানীয় কর্তা আর সেপাই সান্ত্রীদের ডেকে শিকার করা বাঘের লাশ দেখালাম।

বনের মধ্যে এক জংলা ঝোপের ধারে শিকার করা বাঘের লাশ পড়ে আছে। খুনে শিকারি সাহেব সেটা তখনও সরিয়ে নিয়ে যাবার সময় পায়নি। সেটার কথা বনবিভাগের দপ্তরে জানায়ওনি।

প্রমাণের জন্য শিকারির মারা বাঘটার পেটের ওপর পা রেখে দাঁড়িয়ে একটা ফটো তোলালাম। বেপরোয়া খুনে হলেও সাহেব যে অব্যর্থ শিকারি তা তার বাঘটার কানের ভেতর দিয়ে নির্ভুল গুলি চালানোতেই প্রমাণ করে বোঝাতে ফুটো কানের যেটা দিয়ে গুলি যাওয়ার দরুন রক্ত ঝরে পড়েছে সেই কানটা টেনে দেখালাম। বাঘটার বয়স বুঝতে তার মুখটা হাঁ করে দাঁতগুলোর অবস্থাও দেখলাম।

এই বাঘটা খুঁজে পাবার দুদিন বাদেই আবার বনবিভাগের অফিসার আর সেপাইদের ডাকতে হল। আবার একটা বাঘের লাশ পাওয়া গেছে। এবার জঙ্গলের আধা-শুকনো ঝিলের ধারে। বাঘের পেছনের দুটো পা ঝিলের কাদা জলের মধ্যে আধ-ডোবা হয়ে আছে।

বাঘের লাশটা দেখিয়ে অফিসারকে একটু অবাক হয়েই বললাম, আশ্চর্য ব্যাপার দেখেছেন। এ বাঘটা যেন আগের বাঘটার ঠিক যমজ। শুধু হলদে কালো ডোরাগুলো আরও স্পষ্ট আর মাথাটা যেন আরও ঘোট। সে অবশ্য মাথায় লোমগুলো এখনও তেমন বাড়েনি বলে। এটার দেখুন কানের ভেতর দিয়ে গুলি গেছে আর

এরপর যা বলে গেলাম অফিসারের তাতে তেমন কান আছে বলেই মনে হল না। বাঘ যে শিকার করা হয়েছে লাশ দেখে তার প্রমাণ পেয়েই তিনি ব্যাপারটা যেন চুকিয়ে ফেলতে পারলে বাঁচেন।

ব্যাপারটা পুরোপুরি চুকোবার ব্যবস্থা তার পরদিনই হল। বনবিভাগের অফিসার আর রক্ষী সেপাই-টেপাই মিলে সেদিন ভোর হবার পরই খুনে শিকারির তাঁবুতে গিয়ে হাজির।

সাহেব তখন সাজগোজ করে শিকারে বার হবার জন্য তৈরি হয়েছে। বনবিভাগের অফিসার, সেপাই আর সেই সঙ্গে আমায় দেখে একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললে, ব্যাপার কী? এই সকালে আমাকে বিরক্ত করতে আসার মানে?

মানে আর কিছু নয়, অফিসার আমাদের আগেকার বোঝাপড়া মতো ভদ্রভাবেই বললেন, আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন তাই জিজ্ঞাসা করা।

কোথায় যাচ্ছি তাই জিজ্ঞেস করতে এসেছ? সাহেব একেবারে খাপ্পা হয়ে বললে, তোমরা কি কানা? দেখতে পাচ্ছ না, শিকারে যাচ্ছি?

শিকারে যাচ্ছেন তা দেখতে পাচ্ছি, অফিসার তখন একটু কড়া গলায় বললেন, কিন্তু কী শিকারে সেইটেই জানতে চাই। কারণ আপনার সঙ্গে যে বড় শিকারের ভারী রাইফেল রয়েছে তা নেওয়ার আর কোনও দরকার তো আপনার নেই।

দরকার নেই মানে? সাহেব একেবারে অগ্নিমূর্তি হয়ে বললেন, বাঘ শিকার কি আমি এয়ার গান দিয়ে করব নাকি?

তা কেন করবেন?—অফিসার এখনও ধৈর্যের অবতার—কিন্তু বাঘ শিকারই যে আপনার শেষ হয়ে গেছে!

শেষ হয়ে গেছে মানে! সাহেব পারলে যেন আমাদেরই গুলি করে এমন গলায় বললে, আমি আটাশটা বাঘ মেরেছি। এখনও দুটো আমার বাকি।

অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে বলছি, অফিসার কড়া গলায় বললেন, আপনার গণনা আমরা মানতে পারব না। আপনি যে ত্রিশটা বাঘই মেরেছেন তার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। সুতরাং দরকার হলে জোর করেই আপনার শিকার আমাদের বন্ধ করতে হবে।

শিকার বন্ধ করবে তোমরা! সাহেব রাগে খেপে গিয়ে হাতের বন্দুকটা সত্যিই আমাদের দিকে তুলেছিল। আমি এক ঝটকায় তার কাছ থেকে সেটা কেড়ে নিতে অফিসার কড়া গলায় বললেন, এই বেয়াদবির জন্য আপনাকে এখনই হাতকড়া পরাতে পারি। কিন্তু তা করব না। আপনি ইচ্ছে করলে দিল্লি থেকে নতুন করে হুকুম আনিয়ে এ জঙ্গলে বাঘ শিকার করতে পারেন। নইলে এখান থেকে আপনাকে বিদায় নিতে হবে।

খুনে সাহেব রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে সেই বিদায়ই নিয়েছিল। আর তারপর আসেনি।

অফিসারকে ধন্যবাদ দিয়ে আমিও কানহার জঙ্গল ছেড়ে এর পর বালাঘাটে গিয়ে যার সঙ্গে দেখা করি তার নাম শশী নায়ার। নায়ারকে থোক হাজার টাকা দিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু সে তা নেয়নি।

বলেছিলাম, এ তো আপনার পাওনা, তবু নেবেন না কেন? আপনার সাহায্য ছাড়া এ কাজ হাসিল করতে পারতাম কি!

কাজ তো শুধু আপনার নয়।নায়ার আমার হাত ধরে নাড়া দিয়ে বলেছিল, কাজ সমস্ত দেশের হয়েই করেছি। তার জন্য টাকা নেওয়া আমার পাপ হবে। প্রার্থনা করি আমাদের এই ব্যাপার থেকেই অবাধ বাঘ শিকার বন্ধ হবে।

নায়ারকে সাদরে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, তোমাকে আর কী ধন্যবাদ দেব, নায়ার! তবে তুমি না সাহায্য করলে ওই খুনে শিকারিকে এমন করে জব্দ করতে পারতাম না। তবে তোমার এই উপকারের কথা মনে করে আমিও একটা প্রতিজ্ঞা আজ করছি নায়ার। একমাত্র মানুষখেকো বাঘের বেলায় ছাড়া বাঘ কেন, কোনও শিকার করতেই আর বন্দুক ধরব না।

দুজনে করমর্দন করে পরস্পরের কাছে বিদায় নিলাম। নায়ার তার সঙ্গে তার পোষা তালিম দেওয়া বাঘটাকে অবশ্য নিয়ে গেল। নায়ার ম্যাঙ্গোলোরের এক মস্ত সার্কাস কোম্পানির বাঘ-সিংহের ট্রেনার। কানহার জঙ্গল থেকে ক-দিনের জন্যে ওর কাছেই গিয়েছিলাম দু-চার দিনের জন্য বাঘটা ধার নিতে। এই বাঘটাই নিখুঁতভাবে শিকার করা মরা বাঘের অভিনয় করে আমাদের কাজ হাসিল করে দিল।

ঘনাদা উঠে যেতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তা আর হল না। বনোয়ারি আর রামভুজ তখন দুটো বড় বড় ট্রেতে যেসব গরম গরম সদ্য ভাজা আহার্যের প্লেট নিয়ে ঢুকছে তার গন্ধে সমস্তটা ঘর তখন আমোদিত।

প্রথমে শামিকাবাবের প্লেটটা হাতে তুলে নিয়ে তার প্রতি যথোচিত মনোযোগ দেবার আগে ঘনাদাকে আর একটা জিজ্ঞাসার জবাব দিতে হল।

সুন্দরবন থেকে যা শুরু হয়েছিল কানহার জঙ্গলে শিকারের হিসাব রাখতে তার কথাটা যে ভুলেই যাওয়া হয়েছে সেই কথাটা স্মরণ করিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু সুন্দরবনের ওই কানকাটার রহস্যের কোনও জবাব তো মিলল না। জবাব কিছু নেই বোধহয়না ঘনাদা?

আছে! আছে! কাঁটায় গাঁথা কাবাবের টুকরো প্লেট থেকে মুখে তোলার আগে, থেমে, ঘনাদা যত সংক্ষেপে হোক সেরে বললেন, প্রথমত ওই কানটা সোঁদরবনের কেঁদো বাঘের কীর্তি ভূতপ্রেত কি বানানো গল্প নয়। সুন্দরবনের মানুষখেকো বাঘ অমনই আজগুবি ভয়ংকরই হয়। তাদের চলাফেরার কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। অমন চার-পাঁচজনের দল থেকে একজনকে কেমন করে সে তুলে নিয়ে যায় পাশের সাথীও তার হদিস পায় না। তবে শিকারির গুলিটুলিতে নয়, এ মানুষখেকোদের ঢিট করবার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এমন শিক্ষা দেবার প্যাঁচ হয়েছে যে মধু-জোগাড়ে কি কাঠুরে কাউকে কোলের কাছে পেলেও তারা না ছুঁয়ে ছুটে পালাবে। উপায়টা হল সুন্দরবনের নানা জায়গায় লোভনীয় টোপের মতো করে কাঠুরে আর মধু-জোগাড়েদের জ্যান্ত মানুষদের মতো মূর্তি রেখে দেওয়া। মানুষখেকো বাঘ লোভে পড়ে একবার সে রকম কোনও মূর্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে ইলেকট্রিক শক খেয়ে আধমরা হয়ে ছিটকে পড়বে। এরপর মানুষের চেহারার কোনও কিছুর ধারেকাছে সে কখনও ঘেঁষবে কি! সুন্দরবনে এরকম মূর্তি এখন সারা জঙ্গলে ছড়িয়ে রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে।

কিন্তু সেখানে আবার লোডশেডিং থাকবে না তো?

কাবাব গাঁথা টুকরো তখন ঘনাদা মুখে তুলেছেন। তাঁর কাছে কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত