একটি খসড়া গল্প – তিনি—অর্থাৎ
না, তিনি নেই।
নেই মানে কী, তা বুঝতে যদি কষ্ট হয় তো স্পষ্ট করেই বলছি—তিনি বেপাত্তা, অর্থাৎ নিরুদ্দেশ।
হ্যাঁ, যথার্থ নিরুদ্দেশ যাকে বলে, অর্থাৎ কোথাও কেউ তাঁর হদিস পাচ্ছে না।
অথচ চেষ্টার কি কোনও কসুর আছে!
তিনি বলে কথা! সারা পৃথিবীময় পাহাড় পর্বত সাগর নদী ডিঙিয়ে সমস্ত হটলাইন এমন গন গন করছে যে বুঝি গলেই যায়।
হট-লাইন কী বস্তু জানা নেই বুঝি?
বুঝিয়ে দিচ্ছি তাহলে–
পৃথিবীতে আজ যারা মহাশক্তি, ওই শক্তি-ই হয়েছে তাদের এক অভিশাপ। কেউ তারা কারও চেয়ে তো কম যায় না। একজন যদি এক হাতিয়ারে হয় উনিশ, তাহলে আর-একজন সাড়ে আঠারোর কম কখনও নয়। আর এ হাতিয়ারে যে সাড়ে আঠারো সেই আর-এক হাতিয়ারে অন্য জনের উনিশ ছাড়িয়ে প্রায় সাড়ে উনিশ।
এই উনিশ বিশের রেষারেষিতে সব তরফই সব সময়ে তটস্থ হয়ে আছে, পাছে জিভ ফসকানো কোনও কথার ভুলে বা চটপট কিছু শোনার দোষে এক লহমার কিছু উলটো বোঝাবুঝিতে একের বদলে আর বোতাম টেপার আহাম্মকিতে পলকে প্রলয় না ঘটে যায়।
তেমন কিছু গোলমেলে ব্যাপার হতে পারার একটু আঁচ পেলেই প্রতি তরফের যাঁরা মাথা তাঁরা আর পাঁচ কানে খবর পাবার জন্যে অপেক্ষা করেন না। একেবারে সরাসরি মাথায় মাথায় কথা চালাচালির ব্যবস্থা করেন।
এ ব্যবস্থা এমন পাকা নিখুঁত যে তার মধ্যে এনগেজড, নো-রিপ্লাই কি রংনম্বর হবার জো নেই।
সমুদ্রের এপারের মুল্লুকের চাঁই হটলাইনের ফোনটি তোলামাত্র ওপারের খোদ কর্তার ফোন টনক নড়ার মতো বেজে উঠবে। কথাবার্তা যা হবে তা একেবারে সাফসুফ কাটছাঁটা পরিষ্কার। তার মধ্যে বাইরের কারও একটুও টু শব্দ করারও উপায় নেই।
অবশ্য যখন তখন যেমন তেমন ব্যাপারে এ হট লাইন কখনও চালু হয় না। হয় অতি গুরুতর পৃথিবী জোড়া সমস্যা কি সংকটের ব্যাপারে।
এখন যেমন হচ্ছে।
হ্যালো! হ্যালো!–হট লাইন গুমরোচ্ছে-কোনও খবর আপনারাও পাচ্ছেন? আপনাদের কে.জি.থুড়ি, গোয়েন্দা পুলিশ সারা মুল্লুক চষে ফেলছে বাল্টিক আর মেডিটারেনিয়ন থেকে আর্কটিক প্যাসিফিক পর্যন্ত! আমরাও পাচ্ছি না। কী? কী? একটু ধরতে বলছেন? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ধরে আছি! কী খবর? বলুন, বলুন। হ্যাঁ চুচিদের মুলুকে দেখা গেছে একজনকে। চিমসে মর্কটের মতো? ওখান থেকে বেরিং স্ট্রেট পেরিয়ে যাবার তালে আছে? আমরা যেন হুশিয়ার থাকি! থাক, থাক— আর বলতে হবে না। আমি এখনই আলাস্কায় হুকুম পাঠাচ্ছি। বর্ডার গার্ড সবকটা জাহাজ লঞ্চ স্টিমবোট নিয়ে যেন দিনরাত খাড়া পাহারায় থাকে। ওপার থেকে লঞ্চ, স্টিমার জেলেডিঙি তো বটেই, মায় ওয়ালরস কি সী-লায়নের যদি একটা ভেসে আসে সেটাও পাকড়াও করতে ছাড়বে না। কে জানে কী তাঁর প্যাঁচ। ওরই ভেতর লুকিয়ে আসা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয়—অ্যাঁ!! কী বলছেন!মানে—মানে— ওরকম হুকুম যেন না দিই,—দিয়ে থাকলে যেন খারিজ করি এক্ষুনি-কেন? কেন?—মানে চুকচিদের মুল্লুকে যাঁকে দেখা গেছে তিনি চুচি ভাষাই ভাল জানেন না। দু-চারটে কথা শুধু বলতে পারেন। তাও ভুল উচ্চারণ!
না। তাহলে এ তিনি সে তিনি নন কখখনই।
কিন্তু তিনি, সেই আসল তিনি তাহলে কোথায়?
দেখা যাক আর-এক হটলাইনে কিছু হদিস মেলে কি না!
এ হটলাইন চলছে পশ্চিম সাগরের এক মহাদ্বীপ থেকে পূর্ব দক্ষিণ সাগরের আর-এক মহাদেশ প্রমাণ দ্বীপে।
এ হটলাইনে আলাপ যা চলছে তা অতি গোপন সাংকেতিক ভাষায়।
যদি কোনওরকমে কোথাও কিছু গলে বেরিয়ে গিয়ে শোনা-ও যায় তা বোঝার সাধ্য নেই কারও।
শুনতে যা পাওয়া যাবে তা তো এই—না, মুদি দেবে না। তবে হ্যাঁ, গোয়ালা ইঁদুর পুষছে। চুপ চাপ চুপ চাপ
মানে আছে এসব আবোল তাবোলের? হ্যাঁ, আছে। তবে কথা ধরে নয়। কথাগুলো বলতে যে শব্দের যেসব অক্ষর লাগে সেই অক্ষরের সঙ্গে অক্ষরের জোড়ায় সাংকেতিক অর্থ যা, কথাগুলো আসার সঙ্গে সঙ্গে সুপার কম্পিউটারে কষে বার হয়ে চলন্ত টেপ-এ ছাপা হয়ে যাচ্ছে।
দু তরফের দুই মাথা ওই রকম এক-একটি সুপার কম্পিউটার টেলিফোনের হট লাইনের সঙ্গে জুড়ে নিয়ে বসে আছেন। এপার ওপারে ধাঁধার ভাষায় কথা চালাচালি হবার সঙ্গে সঙ্গে সেই চলন্ত টেপ-এ তার মানে পেয়ে যাচ্ছেন।
মানেটা সামান্য একটু ফাঁস করেই না হয় দেওয়া যাক। মোটমাট আলাপটা যখন শূন্যেই গিয়ে পৌঁছচ্ছে তখন ওই কটা কথায় কম্পিউটারে ভেদ করা মানেটুকু জানিয়ে দিলে কোনও ক্ষতি নেই।
পশ্চিম আর পুবের দুই ছোটবড় দ্বীপরাজ্যের হট লাইনের আলাপের সোজা বাংলাটা এই রকম,—হ্যাঁ, আমরা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি। দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত বাদ নেই, সুতরাং মেনে নাও, তিনি নেই, তিনি নেই। যিনি নেই বলে এত হতাশা সেই তিনিটা কে? আর সে তিনি যেই হোন, তাঁকে সারা দুনিয়ায় এত খোঁজাখুঁজি কেন?
খোঁজাখুঁজি—পৃথিবীতে এক দারুণ সংকট উপস্থিত হয়েছে বলে। এমন সংকট যার কিনারা করতে গিয়ে দুনিয়ার সব বাঘাবাঘা দেশ প্রায় কুপোকাৎ।
তাই খোঁজ পড়েছে সেই তিনি-র। পারলে এক তিনিই এখন এ বিপদ থেকে। উদ্ধার করতে পারবেন।
কিন্তু তাঁকে পাওয়া যাবে কোথায়? তিনি হঠাৎ একেবারে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। হাওয়ায় না মিলিয়ে গেলে এত করেও কেউ তাঁর হদিস পায় না।
কোথায় না তাঁকে খোঁজা হয়েছে? শহরে বাজারে গ্রামে গঞ্জে হাটে মাঠে পাহাড়ে জঙ্গলে নদীতে সাগরে তুষার-ঢাকা দুই মেরু থেকে তপ্ত বালুর টাকলামাকান গোবি সাহারা পর্যন্ত। কোথাও তাঁর চুলের টিকিটি পর্যন্ত দেখা যায়নি।
তাহলে এখন উপায়?
***
সেই প্রথম শিশির থেকে শুরু করে পালা করে রিলে রেসের মতো গৌর শিবুর পর গল্পের খেই ধরে আমি এখানে বেশ একটু কাহিল অবস্থাতেই থামলাম।
তাহলে এখন উপায়?-টা শুধু গল্পের নয়, আমাদেরও সত্যিকার উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসা।
যখন থেকে যেভাবে কাঠকুটো যা পারি জোগাড় করে চকমকি ঠুকে ফুঁ দিতে শুরু করেছি তাতে এতক্ষণে আগুন তো বেশ ধরে আসবার কথা।
তার জায়গায় একটু ধোঁয়াও তো দেখা যাচ্ছে না।
চালটা কি তাহলে ভুল হয়ে গেছে একটু?
নিজেদের গল্পের বুনুনিতেই যেন মশগুল হয়ে মৌরসি পাট্টার আরাম কেদারায় যিনি সেই তখন থেকে বসে আছেন তাঁকে একেবারে গ্রাহ্যই না করার ভানটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে?
এখন এ গল্পের জট যা পাকিয়েছি তা সামলাব কী করে?
আরাম কেদারার উনি কি সেই মজাই দেখছেন? যাঁকে জব্দ করবার জন্য এত প্যাঁচ তাঁর কাছেই নিজেদের প্যাঁচে জড়িয়ে মরতে বসেছি যে!
তবু হাল ছাড়লে চলবে না। আরম্ভ যখন করেছি তখন যা করে পারি চালিয়ে যেতেই হবে।
ন্যাড়া ছাদের সিঁড়িতে বিদ্যাসাগরী চটির আওয়াজ পাবার পরই আমাদের আগের রাতের ছকে নেওয়া ফন্দি অনুসারে শিশিরের ওপরই প্রথম গাওনা শুরু করবার বরাত ছিল।
ঠিক করা ছিল যে আগে থাকতে কিছু ভাবাভাবি নয়। একেবারে ঠিক সময়টিতে চটজলদি যা মাথায় আসে তাই দিয়ে সে গল্প শুরু করে দেবে। সে গল্প যত আজগুবি যত আষাঢ়ে তোক তত ভাল।
যাঁকে কাত করতে এত তোড়জোড় তিনি সাদাসিধে প্যাঁচে তত কাবু হবার নয়। তাঁর মাথাতেও চক্কর দেবার মতো জবর কিছু তাই চাই।
তিনি বেশ কিছুদিন ধরে যা আমাদের জ্বালাচ্ছেন সে কথাটাও মনে রেখে তার শোধ নেবার চেষ্টা করতে ছাড়ব কেন?
এ ক-দিন কী তিনি করেছেন?
আমাদের সঙ্গে অসহযোগ? মেসের খাওয়া বন্ধ?
না। ওসব কিছু না। বরং আরও যেন আপনভোলা ভালমানুষ হয়ে উঠেছেন।
প্যাঁচটা তাঁর ওই ভালমানুষিতেই। গায়ে জ্বালা-ধরানো আপনভোলা ভালোমানুষি!
আমরা হয়তো শনিবারের বিকেলের জমায়েতে একথা সেকথার পর আলাপটা উগ্যান্ডার ইদি আমিনের বিষয়ে ঘুরিয়ে এনেছি। মতলবটা এই যে ইদি আমিনের শয়তানি দত্যিপনার দু-চারটে সত্যি মিথ্যে চুটকি দিয়ে তাতিয়ে ওঁর কাছ থেকে গরম গরম কিছু একটা বার করব।
উনি সে ধার দিয়েই যাননি। হঠাৎ যেন আধকালা হয়ে গিয়ে কান শুনতে ধান শুনে ইদি আমিনের কথা থেকে মণ দরে আদা কেনার ব্যাপারে চলে গেছেন।
আমাদের তোড়জোড় তো বটেই বনোয়ারির আনা ভুরভুরে গন্ধ-ছাড়া প্লেট-আলোকরা চিংড়ির কাটলেটগুলো যেন ভস্মে ঘি ঢালা হয়েছে।
টঙের ঘরের তার এই কায়দাটাই নতুন। চেপে ধরব যে তার কোনও উপায় নেই। তিনি তো মেজাজ করে ফারাক হয়ে যাননি। দু-বেলা আমাদের সঙ্গেই আছেন একেবারে সদাশিব হয়ে।
শুধু তাঁকে আসরে নামাবার সব ফন্দি এক সস্তা বেয়াড়া প্যাঁচে দিচ্ছেন ভেস্তে।
সোজাসুজি নিউট্রন বোমার কথা তুলে তাঁর মতামত চাইলে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়েছেন! ওসব বিদঘুটে নাম তাঁর যেন কানেই যায়নি কখনও।
খানিক কেমন একটু হতভম্ব হয়ে চেয়ে থেকে প্রসঙ্গটা যেন ঠিক বুঝেছেন ভাব দেখিয়ে মুলতানি গোরুর দুধ সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছেন।
এ সব পিত্তি-জ্বালানো চালাকির জবাব দেবার জন্যে আমাদের ওই আবোল। তাবোল প্যাঁচ।
যা খুশি একটা কিছু ধরে যত পারো আহাম্মকির গুল ঝেড়ে যাও। আরাম কেদারার তিনি যেন চিড়বিড়িয়ে উঠে আমাদের এক হাত না নিয়ে পারেন না।
কিন্তু একটানা আবোল তাবোল শুনে যাওয়াও তো চারটিখানি কথা নয়। যেটুকু গলাবাজি করেছি তাতেই তো আমাদের জিভ বেরিয়ে এসেছে।
শিশির তাই যেন কতকটা কাঁদো কাঁদো গলায় দিশাহারা অবস্থায় আরম্ভ করে—
তাহলে এখন উপায়?—ভাবছে সারা দুনিয়া। উপায় সত্যিই বুঝি নেই। কিন্তু তাহলেও হাল ছাড়া তো চলবে না।
বাঘা বাঘা সব মাতব্বর দেশ নয়, তাদের সামান্য একটা নখকুনির মতো পুঁচকে একটা ফুটকির মতো দ্বীপ, ব্রিটেন আর আয়ারল্যান্ডের মাঝখানের আইল অফ ম্যান-এর প্রেসিডেন্ট তাঁর লাইব্রেরি ঘরে বসে তাঁর আদরের বেড়ালটার মোটা ল্যাজে হাত বুলোতে বুলোতে হঠাৎ যেন জিভ কামড়ে চমকে লাফিয়ে উঠলেন!
ঠিক! ঠিক! এই কথাটা তো কারও মনে হয়নি।
বাঘা বাঘা দেশের বিশ্বজোড়া খোঁজাখুঁজির মধ্যে ওই তুচ্ছ ঠিকানাটাই ফাঁক পড়ে গেছে।
প্রেসিডেন্ট তখই ফোন করলেন তার সেক্রেটারিকে—শিগগির! শিগগির! এই ঠিকানায় এখুনি কেবল পাঠাও-বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেন—
মূর্খ!! ইডিয়ট!
অ্যাঃ—আমরা চমকিত। এ কার গলা? শিশিরের এই যা থাকে কপালে বলে ঝাঁপ দেওয়া প্যাঁচেই শেষ পর্যন্ত কাজ হল?
অসমাপ্ত