ক্রন্দসী প্রিয়া: ২. নির্দিষ্ট দিনে পার্কে যাওয়ার সময়

ক্রন্দসী প্রিয়া: ২. নির্দিষ্ট দিনে পার্কে যাওয়ার সময়

২. নির্দিষ্ট দিনে পার্কে যাওয়ার সময়

নির্দিষ্ট দিনে পার্কে যাওয়ার সময় স্ত্রীকে বললাম, আমার ফিরতে হয়তো একটু রাত হতে পারে, তুমি কোনো চিন্তা করো না।

সে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি তো এভাবে বলে কখন কোথাও যাওনি? মনে হচ্ছে এই কদিন যেন কিছু ভাবছ?

আমি তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললাম, পাগলী, তোমাকে কি করে সুখী করব সেই কথা ভাবছি। এই অকাট্য মিথ্যা বলতেই আমার মনের মধ্যে সুঁচের মতো বিঁধল।

আদরের প্রতিদান দিয়ে আমার স্ত্রী বলল, আমি এর চেয়ে বেশি সুখ চাইনি। তোমার হাসি মুখ দেখলেই শান্তিতে আমার মন ভরে যায়। আল্লাহপাক যেভাবে রেখেছেন তাতেই আমরা শোকর করে থাকব। আমার জন্য তোমাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না।

স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনটের অনেক আগেই পার্কের গেটে পৌঁছলাম। ইচ্ছা ছিল পার্কটা একটু ঘুরে দেখব। কিন্তু রিকশা থেকে নেমেই সেলিনাকে একটি মেয়ের সঙ্গে গেটের ভিতর কথা বলতে দেখলাম। তাদের সঙ্গে একজন বয়স্ক ভদ্রলোকও রয়েছেন।

আমাকে দেখতে পেয়ে সেলিনা তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে আমাকে সালাম দিয়ে বলল, এখন আড়াইটা বাজে। আমি জানতাম, আপনি ঠিক তিনটেয় আসবেন। কেমন আছেন?

সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। সবুজ রং এর শাড়ী ও ব্লাউজে খুব সুন্দর মানিয়েছে।

চোখে চোখ পড়তে সেলিনা বলল, কি দেখছেন? কথা বলছেন না কেন?

বললাম, ওরা কারা?

ভদ্রলোক আমার খালু, আর মেয়েটি খালাতো বোন। গতকাল সিলেট থেকে আমাদের বাড়িতে এসেছে। ওরা পার্ক দেখে কোথায় যেন যাবে। আমাকে সঙ্গে থাকতে বলেছিল। আমি রাজি হইনি। বলেছি একজনকে তিনটের সময় এখানে। আসতে বলেছি, তার সঙ্গে বিশেষ দরকার আছে। রেষ্টুরেণ্টে যাই চলুন।

না, বরং কোনো নির্জন জায়গায় বসা যাক। হাঁটতে হাঁটতে লেকের ধারে আড়াল দেখে ঘাসের উপর দুজনে পাশাপাশি বসে পড়লাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, চিন্তা ভাবনা করে কি ঠিক করলেন?

সেলিনা লেকের পানির দিকে কয়েক মুহুর্ত চুপ করে চেয়ে রইল। তারপর ঘুরে আমার মুখোমুখি বসে বলল, আমি আমার ফাইন্যাল মতামত বলছি শুনুন, মরে গেলেও আমি আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে পারব না। আমাকে কোনো কারণ দেখিয়ে ভুলাতে পারবেন না। আমি আপনাকে ভালবেসেছি, আপনার পরিচয়কে নয়। সে জন্য যত ত্যাগ স্বীকার করতে হয় করব, যত দুঃখ সহ্য করতে হয় করব, তবু আপনাকে হারাতে পারব না।

অবাক হয়ে বললাম, আপনি পাগলের প্রলাপের মত কথা বলছেন। কোনো সুস্থ মানুষ এই রকম কথা বলতে পারে না। আমার কাছ থেকে আপনি দৈহিক, মানষিক ও আর্থিক কোনো দিক থেকেই এতটুকু সুখ-শান্তি পাবেন না, বরং পাবেন শুধু অবহেলা আর অশেষ দুঃখ। আপনি ধনীর দুলালী, এইসব সহ্য করতে পারবেন না। পৃথিবীর কোনো মেয়েই প্রেম দিয়ে এইগুলো ক্রয় করতে চাইবে না। অনেকে শত দুঃখ সহ্য করতে পারলেও স্বামীর অবহেলা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা আছে। আমি সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না।

সেলিনা আমাকে থামিয়ে দিয়ে কাঁদ কাঁদ স্বরে বলল, আপনি এইসব কথা বলবেন না। পৃথিবীর মেয়েরা প্রেম দিয়ে কি খরিদ করে তা আমি জানি না। আমি শুধু জানি, প্রেম দিয়ে প্রেম খরিদ করব। সে জন্য আপনি আমাকে যত দুঃখ দেন, যত অবহেলা করুন না কেন, সবকিছু আমি নীরবে সহ্য করব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনাকে আমি প্রেম দিয়ে একদিন না একদিন জয় করবই করব। পৃথিবীর কোনো বাধাই আমি মানব না। প্রয়োজন হলে চির কুমারী থাকব। যদি তা না পারি অন্যের অঙ্কশায়িনী হওয়ার আগে আত্মহত্যা করব। জানব, এটাই আমার তকৃদির। দেশী বিদেশী অনেক বই পড়েছি। জেনেছি, প্রেম মানেই দুঃখ। লাভ অলওয়েজ টিয়ার্স। সুতরাং দুঃখের কথা বলবেন না। আমাকে বিয়ে করতে হয়তো আপনার অনেক বাধা থাকতে পারে। অথবা আমাকে নষ্ট চরিত্রের মেয়ে ভেবে ঘৃণা করে দূরে সরে যেতে পারেন। তবু আমি আমার প্রেমকে চিরকাল বাচিয়ে রাখব। তাতে অক্ষম হলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেব।

ভাবলাম, ও আমাকে এত বেশি ভাল বেসে ফেলেছে যে, যদি আমাকে না পায়, তাহলে হয়তো সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করে ফেলবে। খুব চিন্তিত হলাম। কিছুক্ষণ পর বললাম, বিয়ের কথা পরে ভাবা যাবে। আমি আপনাকে একটা চিঠি দেব, তার উত্তর পাওয়ার পর ভবিষ্যতে কি করব জানব। কথাগুলো বলে ওর মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, আমার মুখের দিকে ছল ছল চোখে তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ সেলিনা আমার ডান হাতটা দুহাতে ধরে প্রথমে চুমো খেল, তারপর নিজের দুগালে ঘষতে লাগল।

আমার হাত তার চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছিল। আমার কাছ থেকে নাম মাত্র আশ্বস পেয়ে সেলিনা আনন্দ অশ্রু ফেলতে লাগল। তার গভীর প্রেমের পরিচয় পেয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। অনুভব করলাম, আমি তার গভীর প্রেমের সাগরে তলিয়ে যাচ্ছি? পরক্ষণে আমার স্ত্রীর মুখ মনে পড়তে স্বজ্ঞানে ফিরে এলাম। হাতটা টেনে নিয়ে বললাম, ইসলাম এইজন্য মেয়েদেরকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে নিষেধ করেছে। আর নির্জনে যুবক যুবতীর সাক্ষাৎও হারাম। করেছে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কখনও কোনো বেগানা মেয়েকে স্পর্শ করি নি। জানি না, আল্লাহপাক আমাকে ক্ষমা করবেন কি না। আমি আপনার ডাকে আসতাম না। যদি না আপনি বারবার আমাকে বিরক্ত করতেন। আর এই যোগাযোগ বন্ধ করার জন্যই আজ এসেছি। ভেবেছিলাম, আমার পরিচয় পেয়ে ঘৃণা করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু এখন দেখছি সে ধারণা ভূল। আপনাকে আমার সত্য পরিচয় দিয়ে শত বাধা বিপত্তির কথা বলে যতই দুরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছি, আপনি ততই প্রেমের জাল বিস্তার করে আমাকে ঘিরে ফেলছেন। উপরের মালিকই জানেন আমার কি হবে?

সেলিনা রুমালে চোখ মুখ মুছে বাদাম ওয়ালার দিকে গেল। আমি লেকের। পানিতে অজু করে ঐখানেই ঘাসের উপর আসরের নামায পড়লাম। সেলিনা ফিরে এসে আমার নামায পড়া দেখছিল। নামায শেষ করে টুপিটা পকেটে রেখে বললাম, যাবেন না বসবেন?

কিছু না বলে সেলিনা বসে পড়ল। তারপর বাদামের ঠোঙাটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, নিন খান।

বাদাম নিয়ে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা নামায পড়েন?

আমি ছাড়া আর কেউ পড়ে না।

আসরের নামায পড়বে না?

কথাটা শুনে সেলিনা প্রথমে চমকে উঠল। তারপর আমার দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, এখানে কেমন করে পড়ব? বাসায় গিয়ে পড়ব।

তার চমকে উঠার কারণটা বুঝতে পারলাম না। আবার জিজ্ঞেস করলাম, কবে থেকে নামায পড়ছ?

যখন থেকে আপনার প্রেমে পড়েছি।

প্রেমের সঙ্গে নামাযের কি সম্পর্ক?

তা বলতে পারব না। শুধু এইটুকু মনে হয়েছে, নামায পড়া আল্লাহপাকের হুকুম। তার হুকুম পালন করলে আপনি নিশ্চয় খুশী হবেন। তাই আমার প্রেম নামায পড়তে বলেছে।

মেয়েদের মাথায় কাপড় বা রুমাল দিয়ে চুল ঢেকে রাখাওতো আল্লাহপাকের হুকুম।

আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সেলিনা শাড়ীর আঁচল মাথায় দিল। তারপর থেকে তাকে কোনোদিন মুহুর্তের জন্যও খালি মাথায় দেখিনি। তারপর বললাম, চল উঠা যাক, নচেৎ তোমার আসরের নামায কাযা হয়ে যাবে। কেউ যদি ইচ্ছা করে এক ওয়াক্ত নামায কাযা করে (না পড়ে), তবে তাকে আশী হোকবা দোজখে জ্বলতে হবে। (এক হোকবা সমান দুই কোটি অষ্টআশী লক্ষ বছর)।

সেলিনা, উঠে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করে বলল, একটা অনুরোধ করব রাখবেন?

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালাম।

এতক্ষণ যে সম্বোধনে আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন, সব সময় সেই সম্বোধনে বললে খুব খুশী হব।

চিন্তা করলাম, সে আমার অন্তরের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে। ফলে মনের অজান্তে তাকে এতক্ষণ তুমি করে সম্বোধন করেছি। আর সেই কারণে সেলিনা বোধ হয় তখন চমকে উঠেছিল।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কিছু খাবেন?

বললাম না, আমার মাথার মধ্যে তখন চিন্তার পোকাগুলো কিলবিল করতে আরম্ভ করেছে। নিজেকে ধিক্কার দিলাম, সেলিনা বুঝতে পেরেছে যে, সে আমার অন্তরে প্রবেশ করেছে। নিজের উপর খুব রাগ হতে লাগল এবং তার সূত্রটা খুঁজতে গিয়ে সেলিনাই দায়ী বলে মনে হল। তখন সমস্ত রাগটা তার উপর গিয়ে পড়ল। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলাম না। কারণ রাগের সঙ্গে কিছু বললে, তার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়তে থাকে। আর সেলিনার ক্রন্দসী মুখটা আমাকে বড় বেশি ব্যথা দেয়। অনেক কষ্টে সম্বরণ করে নিলাম।

গেটে এসে সেলিনা বলল, আপনাকে কোথায় পৌঁছে দেব বলুন?

আচ্ছা, আপনি আমাকে কি মনে করেন? কোথাও পৌঁছাতে হবে না, আমি নিজেই যেতে পারব। রাগান্বিত অবস্থায় চিন্তিত ছিলাম বলে কথাগুলো একটু রাগের সঙ্গে বলে ফেলেছি। পরক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তার মুখের দিকে তাকালাম। চোখ দুটো বর্ষায় পুরিপূর্ণ। নিজেকে সংযত করে বললাম, আমি দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। অন্যমনস্কতায় একটু রেগে বলে ফেলেছি। এবার আসি, আল্লাহ হাফেজ বলে একটা রিকশায় উঠে বায়তুল মোকাররাম যেতে বললাম। সেলিনার দিকে চেয়ে দেখি, আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, আর তার চোখ থেকে শ্রাবণের ধারা ঝরছে। বায়তুল মোকাররামে মাগরিবের নামায পড়ে অনেকক্ষণ কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করে মোনাজাত করলাম

আয় পরওয়ারদেগার রহমানুর রাহিম, তোমার মোবারক নামে শুরু করিতেছি। তুমি অনাদি অনন্ত, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। তুমি সর্বত্র সব সময় বিরাজমান, তুমি অসীম করুণাময়, ধৈৰ্য্য ও ক্ষমার আধার। আমি তোমার আঠার হাজার মাখলুকের শ্রেষ্ঠ মাখলুকের একজন নাদান বান্দা। তোমাকে আমার রেজেক যোগাতে হবে, আমার আশা-আকাঙ্খার কথাও শুনতে হবে। সর্ব প্রথম পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর রুহমোবারকের উপর তোমার রহমতের ধারা বর্ষণ কর। তারপর দুনিয়ার সমস্ত মুসলমান নর-নারীর উপর তোমার রহমতের দরজা উম্মুক্ত করিয়া দাও। দয়াময়, তুমি আমার মনের খবর জান। এই পাপী বান্দা বিবাহতি হইয়াও একটি নারীর প্রেমে দিন দিন আসক্ত হইয়া পড়িতেছি। তুমি উত্তম ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাস, আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তুমি উত্তম সৎপথ প্রদর্শনকারী, আমাকে সৎপথে চলার তওফিক দান কর। হে রাব্বল আলামিন, আমি কি করব বলে দাও। একদিকে আমার স্ত্রীর গভীর ভালবাসা, আর অন্যদিকে একটি মেয়ে প্রেমের দাবীতে আত্মহত্যা করতে চাইছে। তুমি উত্তম ফায়সালাকারী, আমি তোমার কাছে ফায়সালা প্রার্থনা করিতেছি, তুমি ফায়সালা করে দাও। জানি তোমার আইন : অনুযায়ী চারটে পর্যন্ত বিবাহ হালাল। কিন্তু সেটাও তো প্রয়োজনের তাগিদে। আরও জানি তুমি বলেছ বান্দা যদি সব স্ত্রীকে সমানভাবে রাখতে না পারে তবে যেন সে একটাতে সন্তুষ্ট থাকে। হে গাফুরুর রাহিম, তুমি সবকিছু জান, সারা জাহানে যা কিছু হচ্ছে তোমার হুকুমেই হচ্ছে। তুমি আমার দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করে আমার এই দোয়াকে কবুল কর। তোমার পেয়ারা হাবিবের উপর এবং সমস্ত আম্বিয়া (আঃ)-এর উপর শান্তি বর্ষণ কর। আমিন সুম্মা আমিন।

তারপর এশার নামায পড়ে বাসায় ফিরি।

দোকানে কয়েকদিন ধরে অবসর সময়ে সেলিনাকে একটা চিঠি লিখলাম— সেলিনা,

এই চিঠি পড়ে তুমি যদি আমাকে ঘৃণা করে ও কাপুরুষ ভেবে তোমার মন থেকে দূরে সরিয়ে দাও, তাহলে আমি অত্যন্ত খুশী হয়ে আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া আদায় করব। অনেক চিন্তা করে দেখেছি, তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। আমার স্ত্রীর ভালবাসাকে অপমান করে তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। তোমাকে বিয়ে করলে আমি, আমার স্ত্রী ও তুমি, তিনজনেই সারাজীবন অশান্তির আগুনে জ্বলব। মেয়ে হয়ে তুমি নিশ্চয় জান, মেয়েরা সবকিছু। দিতে পারে; কিন্তু স্বামীর ভাগ কিছুতেই দিতে চায় না। তাছাড়া এই বিয়ে হলে তোমার সব গার্জেন তোমার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। বিয়ের প্র হয়তো তোমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। তুমিই বল, তোমাকে তখন আমি রাখব কোথায়? নিজের বাসাতে নিয়ে আসা সম্ভব নয়; আর বাসা ভাড়া করে অন্য জায়গায় রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হলেও আমি তা পারব না। এই কয়েকদিনের মধ্যে বুঝেছি তুমি বড় একরোখা। যা মনে আসে তাই কর। একরোখা স্বভাবটা ভাল, তবে সবক্ষেত্রে নয়। তোমার বয়স কম, দুনিয়াদারীর অভিজ্ঞতাও কম। সংসার এমন জটিল জায়গা যে, সেখানে সব ক্ষেত্রে একরোখা ভাবে চললে বহু ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। যা সারাজীবনেও পুরণ করা যায় না। আমি স্বীকার করছি, তুমি নিষ্কলুসভাবে আমাকে ভালবাস। তাই বলে আমাকে বিয়ে করতে হবে এমন কথা ভাবছ কেন? অন্য যে কোনো সম্পর্কে আমরা আবদ্ধ হতে পারি। তুমি ধনী ঘরের মেয়ে। তোমার চাল-চলন, খাওয়া-দাওয়া, পোষাক-পরিচ্ছদ সবকিছু আমাদের সঙ্গে আকাশ পাতাল তফাৎ। তুমি লেখাপড়া করেছ, তোমার একরোখা ভাবটা দূরে সরিয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে চিন্তা করে দেখ, আমি তোমার ভাল চাই, না মন্দ চাই? যদি জানতে চাও আমি তোমাকে ভালবাসি কি-না? তার উত্তরে বলব, তোমার মত মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। উপন্যাসের নায়িকাদেরকেও তুমি হার মানিয়েছ।

বিয়ের আগে কোনো মেয়েকে ভালবাসার সৌভাগ্য আমার হয়নি। বিয়ের পর, নিজের স্ত্রীকে মনে প্রাণে ভালবেসেছি। কিন্তু এই কয়েকদিনের মধ্যে তুমিও আমার অন্তরে কিছুটা জায়গা দখল করে নিয়েছ। এটা হয়তো নিয়তির একটা নির্মম পরিহাস। তোমাকে কিছুটা ভালবেসে ফেলেছি বলে আন্তরিকভাবে তোমার ভালো চাই। আমার সঙ্গে তোমাকে জড়ালে আমার ভালবাসাকে বিষপান করান হবে। তাই তোমাকে সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে। ভালবাসার খাতিরে তোমার কিসে ভালো হবে আমি যেমন চিন্তা করছি, তুমিও তো আমাকে ভালবেসেছ, তোমারও কী চিন্তা করা উচিত না, কিসে আমার ভালো হবে? এই সমস্ত কারণে তোমাকে তোমার একগুয়েমী জিদ ছাড়তে হবে। জানি, তুমি এই চিঠি পড়ে কাঁদবে, তবু লিখলাম। ফারণ না লিখে আমার আর কোনো উপায় নেই। সবশেষে আর একটা কথা বলি, আমাকে যদি তুমি সত্যিই ভালবেসে থাক, তবে যা মনে আসে তা করো, কিন্তু আত্মঘাতিনী হয়ো না। এটা তোমার প্রেমের কসম। কেন না যারা আত্মহত্যা করে, তারা চির জাহান্নামী। আমি চাই না, আমার কারণে তুমি আত্মঘাতী হও।

আশা করি, চিঠিটা ধৈৰ্য্য ধরে পড়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে আমাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করবে এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে।
ইতি—

চিঠিটা শেষ করে দোকানে আমার নিজস্ব ড্রয়ারে চাবি দিয়ে রাখলাম। প্রায় দশ বার দিন পর একদিন আমি জোহরের নামায পড়ার জন্য মার্কেটের ভিতরের মসজিদে যাওয়ার পথে সেলিনাদের ড্রাইভারের সাথে দেখা। সে আমাকে একটা ছোট কাগজ দিয়ে বলল, খুকীভাই গেটের বাঁ দিকে গাড়িতে বসে আছে। কথা শেষ করে ড্রাইভার চলে গেল। আমি কাগজটা পকেটে রেখে অযু করে নামায পড়লাম। তারপর মসজিদ থেকে বের হয়ে কাগজটা পড়লাম

সালামান্তে আপনার কাছে আরজ, এক্ষুনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন।
ইতি–
আপনার সেলিনা

দোকানে এসে ড্রয়ার থেকে চিঠিটা নিয়ে গাড়ির কাছে গিয়ে সালাম বিনিময়। করলাম তারপর চিঠিটা সেলিনার হাতে দিয়ে বললাম, সোজা বাড়ি চলে যাও।

আমাকে দেখে তার চোখে মুখে আনন্দের ঢেউ উঠেছিল; কিন্তু আমার কথা শুনে তা ম্লান হয়ে গেল। তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমি দোকানে। ফিরে আসি।

এরপর প্রায় এক মাস সেলিনা আমার সঙ্গে দেখা করেনি। তাতে করে মনটা বেশ হালকা হয়ে এল। ভাবলাম, চিঠিটা পড়ে হয়তো আমাকে কাপুরুষ ভেবে ভুলে যেতে চেষ্টা করছে।

সাহেবদের গাড়ি খারাপ থাকায় স্কুটারে করে তীতুমীর কলেজে একদিন বেলা দশটার সময় বই সাপ্লাইয়ের বিল আদায় করার জন্য যাচ্ছিলাম। মহাখালির রেল ক্রসিং পার হওয়ার আগে ট্রেন আসছিল বলে গেট বন্ধ ছিল। থামার সময় স্কুটারের স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। গেট খুলে যাওয়ার পর আর স্টার্ট নিল না। তখন ড্রাইভার একটা রিকশা ঠিক করে দিল। রিকশা যখন মহাখালির দিকে বাঁক নেবে, ঠিক সেই সময় একটা প্রাইভেট কারকে আমার রিকশার দিকে দ্রুত আসতে দেখে খুব ভয় পেলাম। মনে হয়েছিল ভীষণ এ্যাকসিডেন্ট হবে। কিন্তু যখন গাড়িটা নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে গেল তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। তবু ড্রাইভারের উপর খুব রাগ হওয়ায় তাকিয়ে দেখি, সেলিনাদের গাড়ি। পিছনের সীট থেকে সে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

রিকশাওয়ালা ড্রাইভারের সঙ্গে ঝগড়া করতে উদ্যত হলে, তাকে থামিয়ে তার ভাড়া দিয়ে বললাম, ঝগড়া করে কাজ নেই। তারপর গাড়ির কাছে যেতে সেলিনা দরজা খুলে সালাম দিয়ে বলল, উঠে আসুন।

আমি সালামের জওয়াব দিয়ে গাড়িতে উঠে বললাম, তীতুমীর কলেজে যাব। ড্রাইভার তা শুনতে পেয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল। কলেজে পৌঁছে আমি একাই ভিতরে গেলাম। কাজ সেরে ফিরে এসে গাড়িতে বসার পর সেলিনা বলল, দাদু কন্টিনেন্টাল (বর্তমানে শেরাটন) হোটেলে চলুন।

দাদু গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর বললাম, এখন কোথাও যেতে পারব না। আমাকে দোকানে যেতে হবে। গাড়ি যখন ক্যন্টনমেন্টের গেট পার হয়ে পুরান এয়ারপোর্টের কাছে এল তখন সেলিনা দাদুকে বলল, বাঁদিকের ঐ হোটেলটার সামনে রাখুন।

গাড়ি থামার পর নামার সময় জিজ্ঞেস করলাম, কোথা থেকে আসা হচ্ছে?

টুঙ্গী থেকে। খালার সঙ্গে তার দেওরের বাড়ি গিয়েছিলাম। উনি কুর্মিটোলা, এয়ারপোর্টে কন্ট্রাকটারী করেন। সেখানে একটা বাড়ি করে স্বপরিবারে থাকেন। আমরা কেবিনে গিয়ে বসলাম। সেলিনা বলল, খালাআম্মা নাস্তা করে আসতে বলেছিল। অত সকালে আমি কিছু খেতে পারি না, তাই চা বিস্কুট খেয়ে এসেছি। এখন নাস্তা করব বলে বেয়ারাকে দুপ্লেট মুরগীর মাংস ও পরোটার অর্ডার দিল।

বললাম, আমি কিছু খাব না, নাস্তা খেয়েছি।

আপনি না খেলে আমিও কিছু খাব না। আমার জন্য না হয় অল্প কিছু খান। বেয়ারাকে মুরগীর মাংস ও পরোটার বদলে দুটো করে বড় মিষ্টি ও স্লাইস রুটি দিতে বলল।

নাস্তা শেষে চা খেতে খেতে বলল, জানেন, আপনার চিঠি পড়ে কোনো কাজ হয়নি। বরং আপনাকে আরও বেশি ভালবেসে ফেলেছি। মনে হয়েছে আমাকে কাঁদাবার জন্য আর পরীক্ষা করার জন্য এই চিঠি দিয়েছেন। চিঠিটা পড়ার সময়। আল্লামা ইকবালের একটা বয়েত আমার মনে পড়ে

জফা জো ইস্কমে হোতা হ্যায়
ওহ জফাহি নেহী,
সিতম না হো তো মহব্বত মে
কুছ মজা হি নেহী।

আমি ইডেন কলেজে পড়ি। অতএব আপনি সারাদিন আমার কাছেই থাকেন। যখন মন চায়, ক্লাসের অফ পিরীয়ডে মার্কেটে গিয়ে দূর থেকে আপনাকে দেখে আসি। আপনি যে এই রকম, চিঠি দেবেন। তা অনেক আগেই জানতাম। আমার প্রেম আপনার মনের সকল খবর বলে দেয়।

সেলিনার কথা শুনে খুব আশ্বৰ্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এখন আমি কি ভাবছি বল তো?

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ঐ চিঠি লেখার সময় যা ভেবেছিলেন, এখনও তাই ভাবছেন।

আরও বেশি আশ্বৰ্য্য বোধ করে আবার জিজ্ঞেস করলাম, সেটা কী?

কেন, আপনি কী ঐ চিঠি লেখার সময় ভাবেন নি? এই চিঠিতে যদি কাজ না : হয়, তবে আরও একটা চিঠিতে জঘন্যতর কিছু লিখে আমার মনে ঘৃণা তৈরি করার চেষ্টা করবেন। এখনও আপনি সেই কথা ভাবছেন। কী? আমি সত্য বললাম কিনা বলুন?

আশ্চর্য ক্রমশঃ বেড়েই চলল। বললাম, তুমি নিশ্চয় সাইকোলজী ও এ্যাসট্রোলজীর অনেক বই পড়েছ?

আমি ঐ সব কিছুই পড়িনি। আমার প্রেম আমাকে সবকিছু জানিয়ে দেয়। বলুন না, আমার কথা ঠিক কিনা?

স্বীকার করে বললাম, চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি ড্রাইভারের পাশে বসলাম। মাথার মধ্যে তখন সেলিনার চিন্তা শক্তির কথা ঘুরপাক খাচ্ছে।মনে হল। তার কাছে সব দিক থেকে হেরে যাচ্ছি। কিন্তু কেন? তবে কি সেলিনার গভীর প্রেম এর জন্য দায়ী? না আমিও তাকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলছি? আমি যখন, ঐসব ভাবছি তখন সেলিনা ড্রাইভার দাদুকে বলল, ওঁকে নিউ মার্কেটে নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলুন।

তারপর প্রায় তিন মাস হয়ে গেল এর মধ্যে তেমন কিছু ঘটেনি। মাঝে মাঝে সেলিনা দোকানে এসে বই কিনে নিয়ে গেছে।

একদিন এসে বলল, আমাকে কয়েকটা ধর্মীয় বই দিন।

আমি মাওলানা আসরাফ আলি থানভীর (রা:) এর কুরআনের তফসীর ও গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী দিলাম। সেলিনা দুটোই কিনল। সে যখন দোকানে। আসত তখন আমি তাকে আপনি বলে সম্বোধন করতাম, আর তার মুখের দিকে মোটেই তাকাতাম না।কারণ হঠাৎ করে যদি কিছু বলে বসে। তবে তাকে দেখার খুব ইচ্ছা হত। ইচ্ছাটাকে কঠোরভাবে দমন করে রাখতাম।

একদিন কাউন্টারের উপর বই দেখতে দেখতে ঝুকে মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বলল,প্রতিজ্ঞা করেছেন বুঝি আমার মুখ দেখবেনা না? আমার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে আবার বলল, আমাকে আপনি বাইরের চোখে না দেখলে কি হবে, অন্তরের চোখে সব সময় দেখেন। তাই বাইরের দৃষ্টিকে সংযত রাখতে পেরেছেন। একটা কথাও বলবেন না? শেষের কথাটা কান্নার মত, শোনাল।

আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাতের বইটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নেবেন?

ছলছল চোখে সেলিনা বলল, হ্যাঁ।

আমি বইটা মেমো করে তার পিছনে লিখলাম, তোমার হাতের বইটি তো। তোমার সঙ্গে কথা বলছে না, কিন্তু তুমি ইচ্ছা করলে ওটা থেতে অনেক কিছু। জানতে পার। তারপর মেমোটা তার হাতে দিলাম।

কিছু না বলে মেমো ও বইটা নিয়ে সেলিনা চলে গেল।

এই ঘটনার কিছুদিন পর ড্রাইভার একদিন আমাকে একটা বড় খাম দিয়ে গেল। দুপুরে খাওয়ার পর খুলে দেখি বেশ বড় চিঠি পড়তে শুরু করলাম—

প্রিয়তম,
প্রথমে এই দীনহীনার শতকোটি সালাম নেবেন। আশা করি, পরম করুণাময় আল্লাহপাকের রহমতে আপনি ও আপামনি ছেলেমেয়েসহ ভালো আছেন। এই চিঠি পড়ে আপনি আমাকে হয়তো স্বার্থপুর ভেবে গৃণা করবেন। তবু আপনাকে আমার ইতিহাস বলা দরকার, তাই লিখছি। এর আগে অনেকবার বলতে ইচ্ছা হয়েছে, কিন্তু এতকথা শোনার সময় আপনার ছিল না, তাই বলিনি।

আমাদের আসল বাড়ি সিলেট শহরে। আব্বা পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। দাদুর আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল ছিল। ছোট বেলা থেকে আব্বা খুব মেধাবী ছিলেন। স্কুল কলেজে সব সময় প্রথম সারিতে স্থান পেয়েছেন। উনি যখন ডিগ্রীতে পড়েন। তখন তার ফুপাতো বোনের সঙ্গে মন দেওয়া নেওয়া হয়। দুজনে একই কলেজে পড়তেন। আব্বা যখন ফাইনাল ইয়ারে আম্মা তখন ইন্টারমিডিয়েটে। আমাদের বাড়ির কাছে আব্বার ফুপার বাড়ি। মেয়েকে ভর্তি করে এসে উনি আব্বাকে বললেন, তুমি সময় করে আমার মেয়ে আয়েশাকে পড়াশুনার ব্যাপারে একট সাহায্য করো। তারপর থেকে দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। এই ব্যাপারটা উভয় ফ্যামিলির সবাই জানত। আব্বা যখন ব্যারিষ্টারী, পড়ার জন্য বিলেতে যেতে চাইলেন তখন দাদু বললেন, এত টাকা আমার নেই। তারচেয়ে তুমি বরং এল, এল, বি পাশ করে ঢাকায় প্রাকটীস কর। কথাটা আব্বার ফুপার কানে যায়। তাদের অবস্থা খুব ভালো। কিসের যেন ব্যবসা ছিল। একদিন তিনি এসে দাদুকে বললেন, মিঞা ভাই, আমার মেয়ে আয়েশার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে মাঈনুলকে আর্মি রিলেত পাঠাব। আশা করি, আপনি দ্বিমত করবেন না। দাদু এই প্রস্তাবে সম্মতি দেন। আর আব্বার কথাই তো আলাদা। বিয়ের তিন মাস পর আব্বা বিলেত চলে যান। আম্মাও পরের বছর ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে আব্বার কাছে চলে যায়। ব্যারিষ্টারী পাশ করে আব্বা সেখানে প্র্যাকটীস শুরু করেন। আর আম্মাও গ্রাজুয়েসন নিয়ে একটা নার্সারী স্কুলে মাষ্টারী করত। আমাদের দুই বোনের জন্ম লন্ডনে। আমি সেখানে প্রায় দশ বছর বয়স পর্যন্ত পড়াশোনা করি। দাদু মারা যাওয়ার খবর পেয়ে আব্বা আমাদের সবাইকে নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। তারপর ঢাকায় হাইকোর্টে ওকালতি করতে থাকেন। বছর দুইয়েকের মধ্যে মালিবাগে জায়গা কিনে এই বাড়িটা করেন। বিলেত থেকে আসার সময় এই গাড়িটাও আনেন। আব্বা আমাকে বেশি আদর করতেন। যখন যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। আমাদের কোনো ভাই নেই। আব্বা আমাদের দুই বোনের নামে এক লাখ টাকা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট রাখেন। উনি মারা যাবেন বলে হয়তো উইলও করে গেছেন। ব্যাংকের টাকা বিয়ের পর আমরা দুবোন স্বত্ত্বাধিকারী হব। তার আগে নয়। বাড়িটা আম্মার নামে হেবানামা করে গেছেন। আম্মা যত দিন বেঁচে থাকবে ততদিন আমরা এই বাড়িতে কোনো দাবী করতে পারব না। আম্মার মৃত্যুর পর আমরা দুবোন পাব। আম্মা ইচ্ছা করলে বাড়ি বিক্রী অথবা দানপত্র কোনোটাই করতে পারবে না। বাড়ির আয় থেকে প্রতি মাসে আমারা দুবোন প্রত্যেকে হাত খরচ বাবদ দুইশত টাকা পাই।

বিলেত থেকে এসে আমরা কিছুদিন দেশের বাড়িতে ছিলাম। আব্বা একা ঢাকায় থাকতেন। সেই সময় আম্মা দাদির সঙ্গে যুক্তি করে আব্বাকে না জানিয়ে তার বড় ভাইয়ের ছেলে সহিদের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দেয়। তখন আমার বয়স। এগার বছর হবে। বিয়ে কি জিনিস আমি তখন জানতাম না। তবে কেমন যেন একটু কৌতূহল হয়েছিল। কানাঘুসো শুনেছিলাম, আব্বা বাড়িতে এলে খুব গোলমাল হবে। সে সব অনেকদিন আগের কথা; তবু কিছু কিছু মনে আছে! আব্বা ঢাকায় বাসা ভাড়া ঠিক করে আমাদেরকে নিয়ে যেতে আসলেন। রাত্রে খাওয়ার পর আব্বা দাদির ঘরে গেলেন। আমিও আব্বার সঙ্গে ছিলাম। দাদি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, খুকীর বিয়ে আমি তোমার বড় সমন্ধির ছেলে সহিদের সঙ্গে দিয়েছি।

কথাটা শুনে আব্বা চমকে উঠলেন। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমাকে না জানিয়ে এই কাজ করা ঠিক হযনি। তারপর দাদির ঘর থেকে আব্বা যখন নিজের ঘরে এলেন তখন আম্মা আব্বার পায়ে ধরে বলল, এই কাজ তোমাকে না জানিয়ে করে মস্ত বড় অন্যায় করেছি। তুমি আমাকে। ক্ষমা করে দাও।

আব্বা ভিজে গলায় বললেন, আমাদের কোনো পুত্র সন্তান নেই। খুকীকে বেশি লেখাপড়া করার জন্য বিলেত পাঠাব বলে ভেবে রেখেছিলাম। সে আশা তুমি ভেঙ্গে চুরমার করে দিলে। তোমাকে আর কি বলব, সবই তকদিরের লিখন।

আম্মা বলল, সহিদ খুব মেধাবী। এ বছর ম্যাট্রিক দেবে। তারপর তাকে আমাদের কাছে রেখে মানুষ করব। ওদের দুজনের যাতে পড়াশোনার ক্ষতি না হয়, সেই রকম ব্যবস্থা করে আমাদের মত ওদেরকেও বিলেত পাঠাব।

আব্বা বললেন, ম্যান প্রপোজেস গড ডিসপোজেস। যেমন আমি ভেবে ছিলাম এক আর হয়ে গেল এক। জানি না, তোমার ইচ্ছা কতদূর সফল হবে। তারপর আর তেমন কিছু ঘটল না।

কয়েকদিন পর আমাদের সকলকে নিয়ে আব্বা ঢাকায় চলে আসেন। দাদিকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে চাইলে উনি বললেন, আমি আমার স্বামীর ভিটে ছেড়ে কোথাও যাব না।

পরের বছর আমি অষ্টম শ্রেণীতে উঠলাম। এদিকে সহিদ ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতেই ছিল। আম্মা চিঠি দিয়ে ঢাকায় ডেকে পাঠায়। আল্লাহপাকের ইচ্ছা অন্য রকম। তাই সহিদ যেদিন ঢাকায় আসবে বলে ঠিক করেছিল, তার আগের দিন। রাত্রে হঠাৎ কলেরা হয়ে মারা যায়। ট্রাংকলে খবর পেয়ে আব্বা আমাদের সবাইকে নিয়ে সিলেটে যান। আম্মার সেকি কান্না। সকলের কান্না দেখে আমিও কেঁদেছিলাম। আব্বা আমাদের রেখে পরের দিন প্লেনে ঢাকায় চলে আসেন। কারণ তখন তার একটা মাডার কেসের হিয়ারিং চলছিল। সহিদের কুলখানি হয়ে যাওয়ার পর যে দিন আমরা ঢাকায় চলে আসব, সেদিন আম্মাকে দাদির সঙ্গে কথা বলছে। দেখে আমি দরজার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম। শুনতে পেলাম আম্মা দাদিকে বলছে, আমি সহিদের ভাই জহিরের সঙ্গে আবার খুকীর বিয়ে দেব। দাদি বললেন, সে দেখা যাবে। এব্যাপারে কোনো কথা এখন উচ্চারণ কর না। ঢাকায় আসার সময় আম্মা দাদিকে বলল, জহিরকে মাঝে মাঝে আমাদের কাছে পাঠাবেন। দাদি কোনো কথা বলেন নি। এরপর আমি আর দেশের বাড়িতে যাইনি,। আব্বা বোধ হয় কিছু বুঝতে পেরেছিলেন, তাই আম্মা যখন দাদির কাছে দেশের বাড়ি যেত তখন আমাকে যেতে দিতেন না। আব্বা আমাকে বেশি ভাল বাসতেন। চিঠি খুব বড় হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সব কথা না জানিয়েও শান্তি পাচ্ছি না। সে জন্য মাফ চাইছি।

অষ্টম শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা যেদিন শেষ হল, সেদিন আমরা ভাড়া বাসা ছেড়ে আমাদের এই নতুন বাড়িতে আসি। কয়েকদিন পর জহির ভাই আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসে। রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর সবাই ঘুমাতে গেল। আমি প্রতি দিনের মতো আব্বার চেম্বারে তার পাশের চেয়ারে বসলাম। একটা কেসের ব্যাপারে উনি খুব ব্যস্ত ছিলেন, তাই আমার সঙ্গে কোনো কথা বলেন নি। আমি চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়ি। আব্বার ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যেতে নিজের রুমে গিয়ে ঘুমাই। তখন গ্রীষ্মকাল। অনেক রাত্রে কার গরম নিশ্বাস মুখের উপর পড়তে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখলাম, কে যেন আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে। প্রথমে আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। মাথার কাছে বেড সুইচ টিপে আলো জ্বালতে দেখি, জহির ভাই। ততক্ষণে সে খাটের উপর আমার পাশে বসেছে। আমিও উঠে বসে বললাম, জহির ভাই, তুমি এত রাতে এখানে কেন?

সে আমার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আলো নিভিয়ে দাও।
আমি বললাম না, তুমি আগে চলে যাও।
জহির ভাই বলল, আমি কেন এসেছি, তুমি কি বোঝনি?

আমি কিছু বুঝতে না পেরে বললাম, তুমি কি বলতে চাইছ? (কারণ সেক্স সমন্ধে আমার তখনও কোনো জ্ঞান হয়নি।)
সে তখন নিজে আলো নিভিয়ে দিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে তো কিছু দিন পরে আমার বিয়ে হবে। তাই একটু আনন্দ করতে এসেছি। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরতে এল। আমি তখন খাট থেকে নেমে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে আম্মার দরজায় ধাক্কা দিতে থাকি। প্রথমে আব্বা দরজা খুলে আমাকে দেখে বললেন, কি হয়েছে মা? তুই অমন করসি কেন? ততক্ষণে আম্মাও বেরিয়ে এসেছে। আমি বললাম, আপনার কাছ থেকে এসে ঘুমের ঘোরে দরজা না লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। তারপর যা ঘটেছিল সব কথা বললাম।
আম্মা আমার ঘর থেকে জহির ভাইকে ডেকে এনে তার ঘরে পৌঁছে দিয়ে এসে আমাকে বলল, তুমি দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়।
পরের দিন ভোরে এক টুকরো কাগজে, আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি এই কথা লিখে রেখে জহির ভাই চলে যায়। এরপর প্রায় দু বছর পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। আব্বা মারা যাওয়ার পর তার কুলখানির সময় আমরা সকলে দেশের বাড়িতে যাই। সেই সময় দাদি জহির ভাই এর সঙ্গে বিয়ের কথা বলে আমার মতামত জানতে চান। বিয়ের কথা শুনে ধক করে মনের পর্দায় আপনার ছবি ভেসে উঠে। বললাম, আমি কলেজে পড়ব, এখন বিয়ে করব না। তার সঙ্গে বিয়ে দিলে বিষ খেয়ে মরব। সেই বছর আমি ম্যাট্রিক পাশ করি।

ওখানে গিয়ে জুহির ভাইয়ের নারী ঘটিত কুকীর্তির কথা অনেক শুনলাম। বড় মামার শুধু দুই ছেলে। সহিদ মারা যাওয়ার পর জহির ভাই আদর পেয়ে চরিত্রহীন হয়ে পড়ে। সেইজন্য বড় মামা তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়ার জন্য আম্মাকে বলেন। দাদির কাছ থেকে আমার অমতের কথা শুনে আম্মা রেগে গিয়ে আমাকে প্রথমে খুব বকাবকি করে। পরে বুঝিয়ে বলে, জহির বাপ-মার এক ছেলে। ওদের অনেক সম্পত্তি, সবই তোর হবে। তাছাড়া অন্য ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে হলে সে কি আর আমাদেরকে জহিরের মত দেখাশুনা করবে? আমি বললাম, এখন আমি বিয়ে করব না। দরকার হলে চিরকুমারী থেকে চাকরি করে তোমাদের দেখাশুনা করব। তখন পর্যন্ত ব্যাংকের টাকা ও উইলের কথা জানতাম না। মাত্র মাস খানেক আগে মেজ মামার কাছ থেকে জেনেছি। আর যদি তোমরা আমাকে জোর করে বিয়ে দাও তবে তার পরিণতির জন্য তোমরাই দায়ী হবে। দাদি আম্মাকে বললেন, ওকে এখন বিয়ে করার জন্য বেশি চাপ দিও না। তদিরে থাকলে একাজ হবে। তারপর আমরা ঢাকার বাড়িতে চলে আসি। সেই থেকে আম্মা জহির ভাইকে বিয়ে করার জন্য মাঝে মাঝে আমাকে বোঝাত। কিন্ত ইদানিং আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হতে দেখে তাকে বিয়ে করার জন্য খুব বেশি চাপ দিচ্ছে। আমিও স্পষ্ট বলে দিয়েছি, বেশি চাপা চাপি করলে আত্মহত্যা করব।

আমাদের চারতলা বাড়ির উপরের তলা ছাড়া সব ভাড়া দেওয়া আছে। আব্বা নিজে গাড়ি চালাতেন। তিনিই আমাকে ড্রাইভিং শিখিয়েছেন। তিনি মারা যাওয়ার পর বড় মামা তার এক গরিব আত্মীয়কে অর্থাৎ এই দাদুকে ঠিক করে দেন। উনি খুব ভালো লোক। আমাদের সংসারের যাবতীয় কাজ দেখাশোনা করেন। আপনার সঙ্গে মেলামেশা করি বলে আপনার উপর খুব রাগ। তবে তা কোনোদিন প্রকাশ করেন না। শুধু একদিন বলেছিলেন, খুকি ভাই, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, এত রাজপুত্র থাকতে তুমি একজন দোকানের কর্মচারীর পিছনে ছুটছ কেন?

আমি বলেছিলাম, আপনি যাদের রাজপুত্র বলে জানেন, তাদের চেয়ে দোকানের ঐ সামান্য কর্মচারী চরিত্রের দিক দিয়ে অসামান্য। রাজপুত্ররা প্রায় সবাই চরিত্রহীন। তারা নারীকে প্রেম দিতে জানে না। জানে শুধু অত্যাচার করে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে। নারীকে তারা ভোগের সামগ্রী মনে করে।

তারপর থেকে আপনার বিষয়ে আর কোনো দিন কোনো কথা বলেন নি। লেখায় অনেক ভুল-ত্রুটি হয়েছে। সে জন্য ক্ষমা চাইছি। আল্লাহপাকের দরবারে আপনাদের সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করে শেষ করছি।

ইতি
হতভাগী সেলিনা

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত