রাত্রি যখন গভীর হয়: ০৮. পুঁটলি-রহস্য

রাত্রি যখন গভীর হয়: ০৮. পুঁটলি-রহস্য

০৮. পুঁটলি-রহস্য

সুব্রত এসে বাংলোয় নিজের ঘরে ঢুকল।

নানা এলোমেলো চিন্তায় সেও যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা নিছক একটা অ্যাকসিডেন্ট, না অন্য কিছু! কিন্তু সবচাইতে আশ্চর্য লোক গেল কী করে খাদের মধ্যে?

নাঃ, ব্যাপারটাকে যতটা সহজ ভাবা গিয়েছিল এখন দেখা যাচ্ছে ঠিক ততটা নয়। চাকরকে এক কাপ গরম চা দিতে বলে শঙ্কর ইজিচেয়ারটার ওপরে গা-টা ঢেলে দিয়ে চোখ বুজে চিন্তা করতে লাগল।

চিন্তা করতে করতে কখন একসময় জাগরণ-ক্লান্ত দুচোখের পাতায় ঘুমের দুলুনি নেমেছে তা ও টেরই পায়নি। ভৃত্যের ডাকে চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে বসল।

বাবুজি, চা!

ভৃত্যের হাত থেকে ধূমায়িত চায়ের কাপটা নিয়ে সামনের একটা টিপয়ের ওপরে সুব্রত নামিয়ে রাখল।

ভৃত্য ঘরে থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

খোলা জানালাপথে রৌদ্রঝলকিত শীতের সুন্দর প্রভাত। দূরে কালো পাহাড়ের অস্পষ্ট ইশারা। ওদিকে ট্রাম লাইনে পর পর কখানা খালি টবগাড়ি। কয়েকটা সাঁওতাল যুবক সেখানে, দাঁড়িয়ে জটলা পাকাচ্ছে। চা পান শেষ করে সুব্রত উঠে গিয়ে ঘরের দরজাটা এঁটে জামার পকেট থেকে খনির মধ্যে কুড়িয়ে পাওয়া নাকড়ার ছোট পুঁটলিটা বের করল।

একটা আধময়লা রুমালের ছোট পুঁটলি।

কম্পিত হস্তে সুব্রত পুঁটলিটা খুলে ফেলল।

পুঁটলিটা খুলতেই তার মধ্যকার কয়েকটা জিনিস চোখে পড়ল। একটা মাঝারি গোছের ডিনামাইট, একটা পলতে, একটা টর্চ।

আশ্চর্য, এগুলো খনির মধ্যে কেমন করে গেল!

ডিনামাইট কেন? সুব্রত ভাবতে লাগল। ডিনামাইট সাধারণত খাদের মধ্যে বড় বড় কয়লার চাংড়া ধসাবার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সঙ্গে পলতেও একটা দেখা যাচ্ছে। এই ডিনামাইটের সঙ্গে পলতের সাহায্যে আগুন ধরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বড় বড় কয়লার চাংড়া ধসানোর সুবিধা হয়।

টর্চ! এটা বোধ হয় অন্ধকারে পথ দেখাবার জন্য। তবে কি কেউ গোপনে রাত্রে এইসব সরঞ্জাম নিয়ে খাদে গিয়েছিল কয়লার চাংড়া ধসাতে? নিশ্চয়ই তাই। কিন্তু ধসাতেই যদি কেউ গিয়ে থাকবে, তবে এগুলো সেখানে ফেলে এল কেন? তবে কি ধসায়নি? না। ধসিয়ে চলে এসেছিল? কিন্তু এমনও তো হতে পারে, আরও ডিনামাইট আরও পলতে ছিল, একটায় যদি না হাসিল হয় তবে এটার দরকার হতে পারে এই ভেবে বেশী ডিনামাইট নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর হয়ত একটাতেই কাজ হয়ে যেতে এটার আর কোন দরকার হয়নি, তাড়াতাড়িতে এটা ফেলেই চলে এসেছে। কিন্তু কোন পথ দিয়ে লোকটা খনির মধ্যে ঢুকল। ঢোকবার তো মাত্র একটিই পথ! চানকের সাহায্যে? চানকের চাবি কার কাছে থাকে? আবদুল মিস্ত্রী বললে তার কাছেই থাকে। চাবিটা এমন কোন মূল্যবান চাবি নয়; টাকাকড়ির সিন্দুকের চাবি নয়, বা কোন প্রাইভেট ঘরের চাবি নয়, সামান্য চানকের চাবি। চাবিটা রাত্রে চুরি করা এমন কোন কঠিন ব্যাপার নয় এবং কাজ শেষ হয়ে যাবার পর যথাস্থানে চাবিটা আবার রেখে আসাও দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে ভূত নয়—মানুষেরই কাজ। কিন্তু এর সঙ্গে লোকগুলো মারা যাবার কী সম্পর্ক আছে? তবে কি—সহসা চিন্তার সূত্র ধরে একটা কথা সুব্রতর মনের কোঠায় এসে উঁকি দিতেই, সুব্রতর মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নিশ্চয়ই তাই। কিন্তু রুমালটা! রুমালটা কার? সুব্রত রুমালখানি সোজা দৃষ্টির সামনে তুলে ধরে পুত্থানুরূপে পরীক্ষা করতে লাগল।

রুমালখানি আকারে ছোটই। হাতে সেলাই করা সাধারণ লংক্লথের টুকরো দিয়ে তৈরী রুমাল। রুমালের একধারে ছোট অক্ষরে লাল সুতোয় লেখা ইংরাজী অক্ষর S. c.

এক কোণে ধোপর চিহু রয়েছে…।

সুব্রতর মাথার মধ্যে চিন্তাজাল জট পাকাতে লাগল। কার রুমাল! কার রুমাল! S.C. নামের initial যার তার পুরো নাম কি হতে পারে? শশাঙ্ক, শঙ্কর, শশধর, শরদিন্দু, শরৎ, শশী, শচীন, কিংবা শৈলেশ, কিংবা সনং, সুকুমার, সমীর, সুধাময়! কে, কে? কিন্তু এমনও তো হতে পারে, অন্য কারও রুমাল চুরি করে আনা হয়েছিল! তবে?

সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। যোগসূত্র এলোমলো হয়ে কেমন যেন জট পাকিয়ে যায়। হ্যাঁ, ঠিক ঠিক আসতেই হবে। সে আসবে! আসবে!

অবশ্যম্ভাবী একটা আশু ঘটনার সম্ভাবনায় সুব্রতর সর্বশরীর সহসা যেন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে।

সুব্রত চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করে দেয় দীর্ঘ পা ফেলে ফেলে। বাইরে গোলমাল শোনা গেল।

পুলিসের লোক এসে গেছে অদূরবর্তী কাতরাসগড় স্টেশন থেকে।

চঞ্চল পদে পুঁটলিয়া আবার পূর্বের মত বেঁধে সুব্রত সেটা নিজের সুটকেসের মধ্যে ভরে রেখে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এল।

দারোগাবাবু সকলের জবানবন্দি নিয়ে, ধাওড়ার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য চালান দিয়ে খাদের লাশগুলো উদ্ধারের একটা আশু ব্যবস্থা করবার জন্য শঙ্করবাবুকে আদেশ দিয়ে চলে গেলেন।

সুব্রত যাবার সময় তার পরিচয় দিয়ে দারোগাবাবুকে অনুরোধ জানাল, এখানে ইতিপূর্বে যেসব ম্যনেজার খুন হয়েছেন তাঁদের ময়নাতদন্তের রিপোর্টগুলি সংক্ষেপে মোটামুটি যদি জানান তবে তার বড় উপকার হয়। দারোগাবাবু সুব্রতর পরিচয় পেয়ে অত্যন্ত খুশী হলেন এবং যাবার সময় বলে গেলেন, নিশ্চয়ই, এ-কথা বলতে! আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচিত হয়ে কত যে সুখী হলাম! কালই আপনাকে রিপোর্ট একটা মোটামুটি সংগ্রহ করে লিখে পাঠাব।

সুব্রত বললে, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। পুলিসের লোক হয়েও যে আপনি এতখানি উদার, সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়। কিরীটী যদি এখানে আসে তবে নিশ্চয়ই আপনার কাছে সংবাদ পাঠাব। এসে আলাপ করবেন। আচ্ছা নমস্কার।

আগের পর্ব :
০১. নতুন ম্যানেজার
০২. ভয়ঙ্কর চারটি কালো ছিদ্র
০৩. মানুষ না ভূত
০৪. আঁধারে বাঘের ডাক
০৫. আবার ভয়ঙ্কর চারিটি ছিদ্র
০৬. খাদে রহস্যময় মৃত্যু
০৭. নেকড়ার পুঁটলি
পরের পর্ব :
০৯. আঁধার রাতের পাগল
১০. অদৃশ্য আততায়ী
১১. ময়না তদন্তের রিপোর্ট
১২. আরও বিস্ময়
১৩. মৃতদেহ
১৪. রাত্রি যখন গভীর হয়
১৫. রহস্যের মীমাংসা

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত