হীরকাঙ্গুরীয়: ০৫. মোতির চিৎকারে বাড়ির সবাই জেগে উঠে

হীরকাঙ্গুরীয়: ০৫. মোতির চিৎকারে বাড়ির সবাই জেগে উঠে

০৫. মোতির চিৎকারে বাড়ির সবাই জেগে উঠে

খুন—খুন!

মোতির চিৎকারে বাড়ির সবাই জেগে উঠে এল। মধ্যরাত্রে বাড়িটার মধ্যে যেন একটা চকিত সাড়া পড়ে যায়। আলী সাহেব—অন্যান্য দুই বেগম ঘুম ভেঙ্গে উঠে আসে। নাসির হোসেন ঐ সময় ফিরে আসে বাড়িতে।

কেন-সে কি বাড়িতে ছিল না? কিরীটী প্রশ্ন করে।

না। মানিক চাটুয্যে বলে।

কোথায় ছিল তবে?

বেলগাছিয়ায় তার এক বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল বিকেলেই চলে গিয়েছিল।

তারপর?

সবাই বিহ্বল–সবাই বিমূঢ়–অতঃপর কি কর্তব্য—ঐ সময় নীচ থেকে সৌমেন কুণ্ডুকে আলী সাহেব ডেকে পাঠান।

সৌমেন ঘুমোচ্ছিল, উঠে এসে সব শুনে সে তো বোবা।

অবশেষে সৌমেন কুণ্ডুই থানায় খবর দেয়। থানার ও.সি. সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সংবাদ দেয়—দিয়েই সে চলে আসে।

এ তল্লাটের ও.সি. কে?

সুশীলবাবু—সুশীল মুখার্জী–

তাঁকে দেখছি না যে?

আছে সে।

কোথায়?

আলী সাহেবের ঘরে বসে বোধ হয় জবানবন্দি নিচ্ছে।

কিরীটী আর কোন কথা না বলে ধীরে ধীরে মৃতদেহের সামনে এগিয়ে যায়।

শব স্পর্শ করে। ঠাণ্ডা—হিম। অন্তত কয়েক ঘন্টা আগে যে মৃত্যু হয়েছে সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই।

চেয়ে থাকে মৃতদেহের দিকে কিরীটী। সহসা ডান হাতের অনামিকার প্রতি নজর পড়ে—আঙুলে সুস্পষ্ট অঙ্গুরীর দাগ—অথচ আঙ্গুলে কোন অঙ্গুরী নেই

কিরীটী অতঃপর মৃতদেহের কাছ থেকে সরে এসে ঘরটার চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভাল করে দেখতে লাগল।

খোলা জানলাপথে ঠাণ্ডা জলে হাওয়া আসছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্নই ছিল—আবার বোধ হয় বৃষ্টি নামল। এ বৃষ্টি সহজে থামবে বলে মনে হচ্ছে না। কিরীটী খোলা জানলাটার সামনে এসে দাঁড়াল।

ঘরের মধ্যে পা দিয়েই দেখেছে জানলাটা খোলা ছিল—জানলাটা দিয়ে সারাটা রাত ধরে বেশ বৃষ্টির ছাট এসেছে বোঝা যায়। মেঝের গালিচার অনেকটা পর্যন্ত সেই ছাটে ভিজে গিয়েছে জানলাপথে বাড়ির পশ্চাৎ দিকটা দেখা যায়—ঐটাই দক্ষিণ দিক।

অনেকখানি খোলা জায়গা বাগান—গাছপালা নানা জাতের জানলাটার একেবারে দেওয়াল ঘেঁষে হাত দুই মাত্র ব্যবধানে একটা স্বর্ণচাঁপা ফুলের গাছ।

বিরাট উঁচু লম্বা গাছটা। হাওয়ায় ডালপালা ও পাতাগুলো যেন ওলট-পালট করছে। জানলার হাততিনেক নীচে চওড়াকার্নিশ। বরাবর আছে কার্নিশটা—অনায়াসেই ঐকার্নিশপথে এই জানলার কাছে এসে হাত বাড়িয়ে জানলাটা ধরে এই ঘরে উঠে আসা যেতে পারে।

মানিকবাবু—

কিছু বলবেন? মানিক চাটুয্যে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

এই জানলাটা কি খোলাই ছিল?

তা তো বলতে পারি না।

জাহানারার দাসী মোতিকে জিজ্ঞাসা করেননি কথাটা?

না তো–

হুঁ–খুব সম্ভবতঃ জানলাটা খোলাই ছিল—ঐ দরজাটা তো খোলাই ছিল, তাই না?

হ্যাঁ—ভেজানো ছিল। ও.সি.কে সংবাদ দেন থানায় সৌমেন কুণ্ডুই—

হুঁ। কিরীটী যেন কেমন অন্যমনস্ক হস্তধৃত জ্বলন্ত চুরুটটা ঠোঁটে চেপে ধরে ঘরের এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

ঘরের মধ্যে গোটা চারেক জানলাসবই বাইরের মানে দক্ষিণমুখী বাগানের দিকে—তিনটি জানলা বন্ধ, একটি মাত্র খোলা। দরজা তিনটে মনে হচ্ছে ওরা একটা দরজা-পথে ঐ ঘরে ঢুকেছে—অন্য দুটো বন্ধ—এবং দরজার গায়ে ভারী পুঁতির পর্দা ঝুলছে। নানা রঙয়ের নানা আকারের পুঁতি।

ঐ দরজাটা বন্ধ দেখছি? কিরীটী মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করে একটা দরজার দিকে তাকিয়ে—

হ্যাঁ-ওটা নাকি বন্ধই থাকে।

ব্যবহার করা হয় না বুঝি?

না—ওটা পাশের ঘরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।

পাশের ঘরটায় কে থাকে?

কেউ থাকে না—ও ঘরটার মধ্যে পুরাতন জিনিসপত্র থাকে এখন—আগে অবিশ্যি নবাব সাহেবের বৃদ্ধা ফুপু থাকতেন।

ফুপু-মানে পিসি?

হ্যাঁ।

আর ঐ দরজাটা?

ওটা বাথরুমে যাবার দরজা।

ঘরের সঙ্গে বাথরুম আছে?

হ্যাঁ।

আশ্চর্য—এতদিনকার পুরাতন আমলের বাড়িতে—

কিরীটী কতকটা স্বগতোক্তির মতই মৃদুকণ্ঠে কথাগুলো উচ্চারণ করে।

মানিক চাটুয্যে জিজ্ঞাসা করে, কিছু বলবেন?

না। আচ্ছা চাটুয্যে সাহেব—

বলুন।

আচ্ছা, আলী সাহেবের বেগমদের কার কত বয়েস জানেন—মানে অনুমান আপনার—আপনি তো সকলেরই জবানবন্দি নিয়েছেন–

হ্যাঁ–রৌশনারার বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্নর কম হবে না—

দ্বিতীয়া—হিন্দু নারী মাণিক বেগমেরতার বয়সও চল্লিশের ঊর্ধ্বে তো হবেই–

দেখতে কেমন? Dont mind-বেগম সাহেবানরা?

রৌশনারা এককালে সুন্দরী ছিলেন বোঝা যায় তবে দেহে এখন বার্ধক্যের ছাপ পড়ায়—

বুঝেছি—আর মানিক বেগম সাহেবা?

রূপের দিক থেকে তিনি যে খুব একটা—তা কিছু নয় কালো বোগা চেহারা, তবে চোখে মুখে প্রখর একটা বুদ্ধির দীপ্তি আছে দেখলেই বোঝা যায়।

আপনি তো বলছিলেন নবাব সাহেব ও তাঁর বেগম সাহেবরা ছাড়াও এখানে আলীর কে একজন আত্মীয় আছেন

হ্যাঁ–নাসির হোসেন সাহেব–

কে সে?

একটু আগে যে বললাম, নবাব সাহেবের ভাগ্নে—

হ্যাঁ, মনে পড়েছে।

একটু থেমে আবার কিরীটী প্রশ্ন করে, দাসদাসী এখানে কজন আছে?

পাঁচজন দাসী ও চারজন ভৃত্য—

মোতি তো জাহানারার খাস দাসী ছিল, তাই না?

হ্যাঁ।

বয়স কত, দেখতে কেমন?

বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে–দেখতে তেমন ভালো নয়–তবে মনে হয় খুব চালাক-চতুর আর–

বলুন, থামলেন কেন?

আর একটা দাসী আছে এ বাড়িতে–নাম কুলসম—

কুলসম?

হ্যাঁ।

কার দাসী?

মানিক বেগমের খাস দাসী। অল্প বয়স–কুড়ি-পঁচিশের বেশী হবে না—দেখতে বেশ। কুলসম।

সুন্দর বলুন।

তা বলতে পারেন।

হুঁ–দেখেই মনে হয়েছিল—

কাকে–কাকে দেখে মনে হয়েছিল?

সেকথার জবাব না দিয়ে কিরীটীবলে, চলুন—এ ঘরের্যাদেখবার দেখা হয়ে গিয়েছে—অন্য একটা ঘরে গিয়ে বসা যাক–

বেশ, আলী সাহেবের বসবার ঘরে গিয়ে বসা যাক চলুন—

চলুন—ঐ ঘরে বসেই এ বাড়ির মানুষগুলোকে কিছু কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাই।

আলি সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন না?

আগের পর্ব :

০১. বাইরে ঝম্‌ ঝম্ করে বৃষ্টি
০২. বারান্দার শেষপ্রান্তে
০৩. বাইরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ
০৪. মানিক চাটুয্যেই প্রথমে কথা বলে
পরের পর্ব :
০৬. প্রয়োজন বুঝলে সবার সঙ্গেই দেখা করব
০৭. তোমার নাম মোতি
০৮. তুমি যে বলছিলে
০৯. কিরীটী একটু থেমে
১০. বারান্দার এক কোণে ফোনটা
১১. বাথরুম দুটির মধ্যে একটি
১২. নবাব সাহেব সেই পদশব্দে
১৩. এখন বুঝতে পারছি
১৪. রোশন আলী আপনার ছেলে
১৫. নবাব সাহেব প্রশ্ন করেন
১৬. মেহেরউন্নিসার দিকে তাকিয়ে
১৭. মোতির কথাটা শেষ হল না

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত