হাড়ের পাশা: ৪. রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা

হাড়ের পাশা: ৪. রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা

৪. রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা

ঐদিনই রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা হবে।

নিত্যনৈমিত্তিক রাতের টহল সেরে কিরীটী ন্যায়রত্ন লেনের বাসায় ফিরছিল। নিঝুম নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে পাড়াটা। গলির মুখে গ্যাসের বাতিটাও যেন স্তিমিত মধ্যরাত্রির ক্লান্ত রাতজাগা প্রহরীর মত একচক্ষু, মেলে পিট পিট করে তাকিয়ে আছে একান্ত নির্লিপ্ত ভাবে।

গলিপথের শেষ পর্যন্ত শেষ গ্যাসের আলোটি পর্যাপ্ত নয়। অস্পষ্ট ধোঁয়াটে একটা আলোছায়ায় যেন রহস্য ঘনিয়ে উঠেছে গলিপথের শেষপ্রান্তে।

মধ্যগ্রীষ্ম রাতের আকাশের যে অংশটুকু মাথা তুলে উপরের দিকে তাকালে চোখে পড়ে সেখানে শুধু, ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কয়েকটি ঝকঝকে তারা।

অন্যমনস্ক ভাবে শ্লথ পায়ে কিরীটী ফিরছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কিরীটী। গলিপথের শেষ প্রান্তের প্রায় সমস্তটাই জড়ে একটা কালো রঙের সিডন বডি গাড়ির পশ্চাৎ দিকের অংশটা যেন সামনের শেষ পথটুকুর সবটাই প্রায় রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে।

আবছা আলো-আঁধারিতে গাড়ির পেছনের প্রজলিত লাল আলোটা যেন শয়তানের রক্তচক্ষুর মত ধকধক করে জ্বলছে।

এবং পথের মাঝখানে হঠাৎ দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন কিরীটীর অন্যমনস্ক নিষ্ক্রিয়তাটা কেটে যায়।

সমস্ত ইন্দ্রিয় তার সজাগ ও সক্রিয় হয়ে ওঠে মুহূর্তে।

এই পরিচিত অপ্রশস্ত গলির মধ্যে এত রাত্রে অত বড় চকচকে গাড়িতে চেপে কার আবার আবির্ভাব ঘটলো!

সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর মনে পড়ে, ইতিপূর্বে আরো দুদিন এই গলিপথেই কোন গাড়ি ঠিক আসতে বা যেতে তার নজরে না পড়লেও গাড়ির টায়ারের কাদা-মাখা ছাপ তার চোখে পড়েছে।

তবে হয়ত এই গাড়িরই টায়ারের ছাপ ও দেখেছে! গাড়ির পিছনের নাম্বার প্লেটটার দিকে ও তাকাল।

W. B. B. 6690।

আবছা আলো-অন্ধকারেও গাড়ির কালো মসৃণ বডিটা চকচক করছে।

হঠাৎ কিরীটী আবার সর্তক হয়ে ওঠে গাড়ির দরজা খোলা ও বন্ধ করার শব্দে।

তারপরই কানে এলো দুটি কথা। আচ্ছা, তাহলে ঐ কথাই রইল। একটি চাপা পুরুষ-কণ্ঠ। দ্বিতীয় কণ্ঠটি কোন নারীর হলেও কথাগুলো স্পষ্ট শোনা গেল না। সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যায়। গাড়িটা ব্যাক করছে।

দ্রুতপদে কিরীটী পিছিয়ে গিয়ে ঐ গলির মধ্যেই বাড়ির মধ্যবতী সরু অন্ধকার প্যাসেজটার মধ্যে আত্মগোপন করে দাঁড়াল।

গাড়িটা ধীরে ধীরে ব্যাক করে গলিপথ থেকে বের হয়ে গেল। দামী গাড়ি, ইঞ্জিনের বিশেষ কোন শব্দই শোনা গেল না।

আরো চার-পাঁচ মিনিট বাদে কিরীটী আবার অগ্রসর হল বাসার দিকে অন্যমনস্কভাবে ভাবতে ভাবতে।

এবং একটু এগিয়ে যেতেই তার নজরে পড়লো নীচের তলায় কবিরাজ মশাইয়ের বাইরের ঘরের খোলা জানালাপথে তখনও আসছে আলোর একটা আভাস।

সদর দরজাটা বন্ধ কিন্তু গলির দিককার জানালা খোলা।

হঠাৎ কৌতুহলকে দমন করতে না পেরে কিছুমাত্র দ্বিধা না করে সতক পদসঞ্চারে শিকারী বিড়ালের মত পা টিপে টিপে আলোকিত বাইরের ঘরের জানালাটার সামনে এগিয়ে গেল কিরীটী।

জানালার নীচের পাট বন্ধ, উপরের পাটটা খোলা।

রাস্তা থেকে জানালা এমন কিছু উঁচু নয়, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাকালেই ভিতরের সব কিছু সহজেই নজরে পড়ে।

জানালার কোণ ঘেষে দাঁড়িয়ে ত্যারচাভাবে কিরীটী আলোকিত কক্ষমধ্যে দৃষ্টিপাত করল। রোমশ ভল্লকের মত উদলো গায়ে জোড়াসন হয়ে কবিরাজ ভিষগরত্ন ফরাসের উপরে বসে আছেন।

আর তাঁর অদূরে ঘরের মধ্যেকার পার্টিশনের পর্দাটা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন চিত্রাপিতের মত অপরূপ লাবণ্যময়ী এক নারী। বয়স কিছুতেই ত্রিশ-বত্রিশের বেশী হবে না বলেই মনে হয়।

পরিধানে ধবধবে সাদা কালো চওড়া শান্তিপুরী শাড়ি। মাথার অবগুণ্ঠন খসে কাঁধের উপরে এসে পড়েছে।

গলার চকচকে সোনার হারের কিয়দংশ দেখা যায়। হাতে সোনার চুড়ি। কপালে দুই টানা বঙ্কিম সুর ঠিক মধ্যস্থলে একটি সিন্দূরের টিপ, কিন্তু ঐ সামান্য বেশভূষাতেও তার রূপ যেন ছাপিয়ে যাচ্ছে।

কোন মানুষ নয়, যেন পটে আঁকা নিখুত একখানি চিত্র। মুগ্ধ কিরীটীর দুচোখের দৃষ্টি যেন বোবা স্থির হয়ে থাকে।

হঠাৎ চাপাকণ্ঠে সেই নারীচিত্র যেন কথা বলে উঠলো, যথেষ্ট তো হয়েছে, আর কেন! এবারে ক্ষমা দাও।

নিঃশব্দ কুৎসিত হাসিতে ভল্লুকসদৃশ ভিষগরত্নের মুখখানা যেন আরো বীভৎস হয়ে উঠলো মুহর্তে। কেবল একটি কথা সেই নিঃশব্দ কুৎসিত হাসির মধ্যে শোনা গেল, পাগল!

আচ্ছা তুমি কি! শয়তান না মানুষ!

আবার সেই কুৎসিত নিঃশব্দ হাসি ও সেই পুর্বোচ্চারিত একটিমাত্র শব্দ, পাগলী!

ছিঃ ছিঃ, গলায় দড়ি জোটে না তোমার!

দুঃসহ ঘৃণা ও লজ্জায় যেন ছিঃ ছিঃ শব্দ দুটি নারীকণ্ঠ হতে উচ্চারিত হল।

এবারে আর প্রত্যুত্তরে হাসি নয়। সেই পরিচিত দুটি কথা। মাগো! করালবদনী নৃমুণ্ডমালিনী সবই তোর ইচ্ছা মা

কবিরাজ মশাইয়ের কণ্ঠস্বর আবার শোনা গেল, যাও। যাও-ভিতরে যাও। পাগলামি করো না, আমার পূজার সময় হল।

এরপর আর ভদ্রমহিলা, দাঁড়ালেন না। কেবলমাত্র তীব্র তীক্ষ্ণ একটা কটাক্ষ হেনে মাথায় ঘোমটাটা তুলে দিয়ে নিঃশব্দে অন্দরেই বোধ হয় প্রস্থান করলেন। এবং যাবার সময় তাঁর দুচোখের দৃষ্টিটা যেন মুহূর্তের জন্য ধারালো ছুরির ফলার মত ঝিকিয়ে উঠলো বলে কিরীটীর মনে হলো।

ভিষগরত্ন মহিলাটির গমনপথের দিকে বারেকমাত্র তাকিয়ে আবার সেই নিঃশব্দ কুৎসিত হাসি হাসলেন দন্তপাটি বিকশিত করে। এবং নিম্নকণ্ঠে বললেন, মাগো করালবদনী নৃমুণ্ডমালিনী!

ভদ্রমহিলাটি কে? ইতিপূর্বে কিরীটী ওঁকে কখনও দেখেনি।

তবে কি উনিই কবিরাজ মশাইয়ের সেই অন্তঃপুরচারিণী সদা-অবগুণ্ঠনবতী সহধর্মিণী! কিন্তু যদি তাই হয়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খুব একটা প্রীতির সম্পর্ক আছে বলে তো মনে হল না কিরীটীর, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ক্ষণপূর্বের কথাগুলো শুনে!

আর অতবুড় চকচকে গাড়ি হাঁকিয়েই বা এই গভীর রাত্রে কে এসেছিল কবিরাজগৃহে!

দিনের বেলায় তো কখনো কাউকে অতবড় গাড়ি হাঁকিয়ে কবিরাজ-ভবনে কিরীটী আসতে দেখেনি আজ পর্যন্ত। এবং যেই হোক আগন্তুক, তাকে গাড়িতে বিদায় দিতে গিয়েছিল নিশ্চয়ই ঐ মহিলাই। কবিরাজ মশাই যাননি।

তিনি ঘরের মধ্যেই ছিলেন।

অনেক রাত পর্যন্ত কিরীটীর মাথায় ঐ চিন্তাগুলোই ঘোরাফেরা করতে থাকে বারংবার। কে ঐ মহিলা!

আর কেই বা সেই আগন্তুক নিশীথ রাত্রে গাড়ি হাঁকিয়ে এসেছিলেন কবিরাজ-ভবনে!

কিরীটী এই কয়দিনে পাড়ার দুচারজনের কাছ থেকে ও অন্নপূর্ণা রেস্তোরাঁয় চায়ের কাপ নিয়ে বসে বসে কবিরাজ মশাইয়ের সম্পর্কে যে সংবাদটকু আজ পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পেরেছে তাতে করে এইটাই বোঝা যায় যে ভিষগরত্ন লোকটি মন্দ নয়। নির্বিবাদী, শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক; পাড়ায় কারো সঙ্গে কোন ঝগড়া-বিবাদ নেই। কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই। নিজের কবিরাজী ব্যবসা ও ঔষধপত্র নিয়েই সর্বদা ব্যস্ত।

মিতভাষী কবিরাজ মশাই পাড়ার কারো সঙ্গেই বড় একটা মেশামেশি করেন না। যদিও তাঁর পুত্রকন্যার সঙ্গে অনেকেরই আলাপ-পরিচয় আছে পাড়ার মধ্যে।

কবিরাজ মশাইয়ের কথা ভাবতে ভাবতে নতুন করে আবার কিরীটীর অনিলবাবুর কথা মনে পড়ে।

কিরীটীর ঘরেই ভদ্রলোক ছিলেন।

ঐ মধ্যরাত্রির শান্ত নিস্তব্ধতায় একাকী ঐ ঘরের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভূতি যেন কিরীটীর মনকে অক্টোপাশের ক্লেদাক্ত অষ্টবাহুর মত চারপাশ থেকে জড়িয়ে ধরতে থাকে।

মাত্র মাস দেড়েক আগে হঠাৎ একদিন প্রত্যুষে তাঁকে এ ঘরে আর দেখা গেল না এবং পরে তাঁর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হল শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর পিছনের রাস্তায়। ভদ্রলোকের প্রেম ছিল একটি তরুণীর সঙ্গে।

বাগনান গার্লস স্কুলের একজন শিক্ষয়িত্ৰী। নাম বিনতা দেবী।

আচ্ছা, ভদ্রমহিলা অনিলবাবুর আজ পর্যন্ত কোন খোঁজখবর নিলেন না কেন?

হঠাৎ মনে হয় কিরীটীর, বাগনানে গিয়ে বিনতা দেবীর সঙ্গে একটিবার দেখা করলে কেমন হয়!

কথাটা মনে হবার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী ঠিক করে ফেলে, কাল সকালে উঠেই সোজা সে একবার বাগনানে যাবে সর্বপ্রথম।

দেখা করবে সে বিনতা দেবীর সঙ্গে একবার।

সত্যি সত্যি পরের দিন সকালে উঠে কিরীটী সোজা হাওড়া স্টেশনে গিয়ে গোমো প্যাসেঞ্জারে উঠে বসল বাগনানের একটা টিকিট কেটে। বেলা সাড়ে নয়ট নাগাদ কিরীটী বাগনান স্টেশনে এসে নামল।

গালর্স স্কুলটির নাম বিদ্যার্থী মণ্ডল। এবং স্কুলটা স্টেশন থেকে মাইলখানেক দুরে ছোট্ট শহরের মধ্যেই।

ভাঙাচোরা কাঁচা মিউনিসিপ্যালিটির সড়কটি বোধ হয় শহরের প্রবেশের একমাত্র রাস্তা।

লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে বেলা এগারটা নাগাদ কিরীটী স্কুলে গিয়ে পৌছাল।

এম. ই. স্কুল।

ছোট একতলা একটা বাড়ি। শতখানেক ছাত্রী হবে।

স্কুল তখন বসেছে। অফিস-ঘরে গিয়ে ঢুকল কিরীটী।

চোখে পুরু কাঁচের চশমা সুতা দিয়ে মাথার সঙ্গে পেচিয়ে বাঁধা, মাথায় টাক এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটা ভাঙা চেয়ারের উপর বসে টেবিলের ওপরে ঝুঁকে একটা মোটা বাঁধানো খাতায় কি যেন একমনে লিখছিলেন। সামনে আরো খান-দুই ভাঙা চেয়ার ও একটা নড়বড়ে ভাঙা বেঞ্চ।

ও মশাই শুনছেন! কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ডাকে।

ভদ্রলোক মুখ তুলে তাকালেন পর লেন্সের ওধার থেকে।

ভদ্রলোক একটু বেশ কানে খাটো, কিরীটীর গলার শব্দটাই কেবল বোধ হয় গোচরীভূত হয়েছিল, বললেন, বগলাবাবু চলে গেছেন।

বগলাবাবু! বগলাবাবু, আবার কে?

কী বললেন, কাকে?

বলছি শুনছেন, কিরীটী এবারে কানের কাছে এসে একটু গলা উচিয়েই বলে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে স্মিতহাস্যে।

ভদ্রলোকও বোধ হয় এবারে শুনতে পান।

বললেন, কি বলছেন?

বিনতা দেবী বলে কোন শিক্ষয়িত্ৰী আপনাদের স্কুলে আছেন?

আছেন। কি প্রয়োজন?

প্রয়োজন আমার তাঁরই সঙ্গে।

তাহলে বসুন, এখন তিনি ক্লাসে। টিফিনে দেখা হবে।

টিফিন কখন হবে?

ঠিক একটায়। বলেই ভদ্রলোক আবার নিজ কাজে মনোনিবেশ করলেন।

অগত্যা কী আর করা যায়, কিরীটীকে বসতেই হল। একটা চেয়ার টেনে কিরীটী তার উপরে বসে আসিবার সময় স্টেশন থেকে কেনা ঐদিনকার সংবাদপত্রটা খুলে চোখ বুলাতে লাগল। সবে বেলা এগারটা। এখনো টিফিন হতে দুঘণ্টা দেরি!

খবরের কাগজটা খুলে বসলেও তার মধ্যে কিরীটী মন বসাতে পারছিল না।

বিনতা দেবীর কথাই সে ভাবছিল। হঠাৎ তো মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে এখানে চলে এলো!

ভদ্রমহিলা কোন টাইপের তাই বা কে জানে! তাকে কি ভাবে তিনি নেবেন তাও জানা নেই।

ভাল করে তিনি যদি কথাই না বলেন, কোন কথা না শুনেই যদি তাকে বিদায় দেন।

কিন্তু কিরীটী অত সহজে হাল ছাড়বে না। যেমন করে তোক তাঁর কাছ থেকে সব শুনে যেতেই হবে।

কিরীটী বসে বসে ভাবতে থাকে কি ভাবে ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা শুরু করবে।

কিন্তু বেলা একটা পর্যন্ত সৌভাগ্যক্রমে কিরীটীকে অপেক্ষা করতে হল না

মিনিট কুড়ির মধ্যেই একটি নারীকণ্ঠে আকৃষ্ট হয়ে কিরীটী মুখ তুলে তাকাতেই তেইশ-চব্বিশ বৎসর বয়স্কা এক তরুণীর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল।

পাতলা দোহারা চেহারা। গায়ের বর্ণ উজ্জল শ্যাম। চোখ মুখ চিবুক বেশ ধারালো। মাথায় পর্যাপ্ত কেশ এলো খোঁপা করা। দুহাতে একগাছি করে সরু তারের সোনার বালা। পরিধানে সরু কালাপাড় একখানি তাঁতের শাড়ি।

কিরীটীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তরুণী দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে অদূরে লিখনরত উপবিষ্ট বন্ধের দিকে তাকিয়ে বললেন, অবিনাশবাবু, আমার মাইনেটা কি আজ পাবো?

অবিনাশবাবু, বোধ হয় শুনতে পাননি, বললেন, জমানো—জমানো টাকা আবার কোথা থেকে এলো আপনার?

জমানো টাকা নয়, বলছি মাইনেটা আজ মিলবে?

না, আজও ক্যাশে টাকা নেই। কাল-পরশু নাগাদ পেতে পারেন। হ্যাঁ ঐ ভদ্রলোকটি আপনাকে খুজছিলেন বিনতা দেবী।

আমাকে খুজছেন!

বিনতা দেবী যেন কতকটা বিস্ময়ের সঙ্গে কিরীটীর মুখের দিকে ঘুরে তাকালেন।

কিরীটী উঠে দাঁড়াল এবং নমস্কার করে বললে, আপনি অবিশ্যি আমাকে চেনেন না বিনতা দেবী। আমার নাম কিরীটী রায়। কলকাতা থেকে আসছি। আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।

আমার সঙ্গে!

হ্যাঁ। অবশ্য বেশী সময় আপনার আমি নেবো না।

কি বলুন তো?

কথাটা একটু মানে, কিরীটী একটু ইতস্তত করতে থাকে।

বিনতা দেবী বোধ হয় বুঝতে পারেন। বললেন, চলুন পাশের ঘরে যাওয়া যাক।

পাশের ঘরটি ঠিক বসবার উপযুক্ত নয়। স্কুলের বাড়তি জিনিসপত্র ভাঙ্গাচোরা চেয়ার বোড় ইত্যাদিতে ঠাসা ছিল।

একপাশে একটা ছোট বেঞ্চ ছিল, তারই উপরে কিরীটীকে বসতে বলে বিনতা দেবীও তার পাশেই বসলেন নিঃসংকোচেই।

কিরীটী বিনতা দেবীর সপ্রতিভ ব্যবহারে প্রথম আলাপেই বুঝে নিয়েছিল ভদ্রমহিলার বিশেষ কোন সঙ্কোচের বালাই নেই।

বলুন কি বলছিলেন!

কিরীটী কোনরুপ ভণিতা না করেই স্পষ্টাস্পষ্টি সোজাসুজিই তার বক্তব্য শুরু করে, দেখুন আপনাকে আগেই বলেছি বিনতা দেবী, আমি আসছি কলকাতা থেকে এবং অনিলবাবুর আকস্মিক রহস্যজনক মৃত্যু সম্পর্কে

অনিল! চমকে কথাটা বলে বিনতা কিরীটীর মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন।

হ্যাঁ। অনিলবাবু, আপনার যে বিশেষ পরিচিত ছিলেন তা আমি জানি।

কিন্তু আপনি

আমার একমাত্র পরিচয় একটু আগেই তো আপনাকে আমি দিয়েছি। তার বেশী বললেও তো আমাকে আপনি চিনতে পারবেন না। তবে ঐ সঙ্গে সামান্য একটু যোগ করে বলতে পারি মাত্র যে অনিলবাবুর মৃত্যুরহস্যটা জানবার আমি চেষ্টা করছি।

বিনতা অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। প্রায় মিনিট দুয়েক। তারপর মুখ তুলে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তা সেজন্য আমার কাছে আপনি এসেছেন কেন? আপনি কি পুলিসের কোন লোক?

না না-পুলিসের লোক ঠিক আমি নই। তবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে আমার।

কিন্তু সেজন্য আমার কাছে না এসে পুলিসের সাহায্য নিলেই তো আপনি পারতেন!

কথাটা ঠিক তা নয়।

তবে?

পুলিস অনেক সময় অনেক কিছুই জানতে পারে না। ঐ ধরনের হত্যারহস্যের সঙ্গে এমন অনেক কিছুই হয়ত রহস্য থাকে যা জানতে পারলে পুলিসের পক্ষেও অনেক জটিলতার সমস্যা হয়তো সহজেই মিলতে পারত। বুঝতে পারছেন বোধ হয় আমি ঠিক কি বলতে চাইছি আপনাকে!

বিনতা দেবী চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। কিরীটী আবার ডাকে, বিনতা দেবী?

বলুন।

আপনি তাঁর বিশেষ পরিচিত ছিলেন। তাই আপনার কাছে এসেছি যদি তাঁর সম্পর্কে এমন কোন বিশেষ খবর

কি জানতে চান আপনি কিরীটীবাবু?

আমি কয়েকটা প্রশ্ন আপনাকে করবে, তার জবাব পেলেই আমি সন্তুষ্ট হবো।

কিন্তু, বিনতা দেবী ইতস্ততঃ করতে থাকেন।

আপনি কি তাঁকে—কিছু মনে করবেন না, ভালবাসতেন না?

প্রশ্নোত্তরে বিনতা দেবী কোন জবাব দেন না।

কেবল কিরীটী দেখতে পায় তাঁর চোখের কোল দুটি যেন হঠাৎ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।

তাই বলছিলাম, আপনি কি চান বিনতা দেবী, তাঁর মৃত্যুর রহস্যটা উঘাটিত হোক?

চাই।

তবে বলুন, অনিলবাবুর মৃত্যুর কয়দিন আগে শেষবার কবে আপনার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল?

তার মৃত্যুর আগের দিন রবিবার কলকাতায় আমি গিয়েছিলাম। সেই সময়েই শেষবার আমাদের দেখা হয়েছিল।

আচ্ছা তাঁর মৃত্যুর আগে ইদানীং এমন কোন কথা কি তাঁর মুখে আপনি শুনেছেন বা তিনি আপনাকে বলেছেন বা তাঁর ঐ সময়কার ব্যবহারে এমন কোন কিছু আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল যেটা আপনার অন্যরকম কিছু মনে হয়েছিল! বুঝতে পারছেন নিশ্চয় আশা করি কি আমি বলতে চাইছি :

একটু চুপ করে থেকে বিনতা বললেন, না, তেমন কিছু মনে পড়ছে না। তবে

তবে? কিরীটী একটু যেন কৌতূহলী হয়ে ওঠে।

তবে শেষবার দেখা হওয়ার আগে এক শনিবার সে এখানে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে কথায় কথায় বলেছিল, ন্যায়রত্ন লেনের বাসা নাকি

কি! কি বলেছিলেন অনিলবাবু?

বলেছিল ন্যায়রত্ন লেনের বাসা নাকি সে ছেড়ে দেবে।

একথা কেন বলেছিলেন?

তা তো জানি না। তবে বলেছিল বাসাটা নাকি ভাল না।

অন্য কোন কারণ বলেননি বাসাটা ছেড়ে দেবার?

না।

আচ্ছা বাড়িওয়ালা কবিরাজ মশাই সম্পর্কে বা তাঁর ফ্যামিলির অন্য কারো সম্পর্কে কোন কথা কি তিনি আপনাকে বলেছিলেন কখনো কোনদিন কোন কথাপ্রসঙ্গে?

না, তবে—

তবে কি?

তবে কবিরাজ মশাইয়ের পরিবারের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল শুনেছিলাম তারই মুখে একদিন কথায় কথায়।

ও। আচ্ছা আপনি নিশ্চয়ই জানেন, অনিলবাবু, কতদিন ঐ ন্যায়রত্ন লেনের বাড়িতে ছিলেন ঘর নিয়ে?

তা মাস আষ্টেক হবে।

তার আগে কোথায় ছিলেন?

এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ের বাসায় যাদবপুরে।

আর একটা কথা বিনতা দেবী, অনিলবাবুর ইদানীং আয় কি একটু বেড়েছিল?

কিরীটীর প্রশ্নে বিনতা ওর মুখের দিকে বারেকের জন্য চোখ তুলে তাকালেন এবং তাঁর ভাবে বোধ হল যেন একটু ইতস্তত করছেন। কিরীটী তাঁর ইতস্তত ভাবটা বুঝতে পেরে বলে, ভয় নেই আপনার বিনতা দেবী, নির্ভয়ে আমার কাছে সব কথা বলতে পারেন।

মৃদুকণ্ঠে জবাব দিলেন এবারে বিনতা দেবী, হ্যাঁ। অন্তত মুখে সে না বললেও হাবে-ভাবে-আচরণে সেটা আমার কাছে চাপা থাকেনি, তাছাড়া– কথার শেষাংশে পৌছে বিনতা যেন আবার একটু ইতস্তত করতে থাকেন।

তাছাড়া কি বিনতা দেবী?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিনতার মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী শেষের কথাগুলো উচ্চারণ করল।

তাছাড়া অবস্থার সে উন্নতি করতে পারছিল না বলেই আমাদের বিবাহের ব্যাপারটা সে পিছিয়ে দিচ্ছিল বার বার এবং নিজে থেকেই উপযাচক হয়ে যেদিন সে আমার কাছে এসে আমাদের বিবাহের কথা তোলে আমি সেদিন একটু অবাক হয়েই তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সত্যিই কি এতদিনে তাহলে সে অবস্থার উন্নতি করতে পেরেছে?

তাতে তিনি কি জবাব দিলেন?

বিনতা প্রশ্নের জবাবে এবারে চুপ করে থাকেন।

হুঁ। তা আপনি আর কিছু জিজ্ঞাসা করেননি? কেমন করে অবস্থার উন্নতি হলো?

না।

কেন?

কারণ আমি আশা করেছিলাম সব কথা সে নিজেই খুলে বলবে। তা যখন বললো না, আমিও আর কিছু ও সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিনি।

নিজে থেকেও নিশ্চয়ই আর কিছু তিনি বলেননি?

না।

সামান্য আলাপ-পরিচয়েই কিরীটী বুঝতে পারে যথেষ্ট বুদ্ধি রাখেন ভদ্রমহিলা। এবং ভদ্রমহিলার সঙ্গে পরবর্তী কথাপ্রসঙ্গে বুঝতে কষ্ট হয় না যে, অনিলবাবুর ইদানীংকার ব্যবহারটা একটু কেমন যেন রহস্যজনক হয়ে উঠেছিল। অর্থ জন প্রতিপত্তির লিপ্সা মানুষ মাত্রেরই থাকে। তবে অনিলবাবুর যেন একটু বেশীই ছিল। কতদিন বিনতা বলেছেন, বেশী দিয়ে আমাদের কি হবে! তার জবাবে নাকি অনিলবাবু বলেছেন, সাধারণ ভাবে জীবনযাপন তো সকলেই করে। তার মধ্যে thrill কোথায়! এমনভাবে বাঁচতে আমি চাই যাতে দশজনের মধ্যে মাথা উঁচু করে আমি থাকতে পারি, সত্যিকারের সুখ ও প্রাচুর্যের মধ্যেই। অতি সাধারণ ভাবে বাঁচার মধ্যে জীবনের কোন মাধুর্যে উপভোগ করবার মত কিছু নেই। সেটা একপক্ষে মৃত্যুরই নামান্তর।

বিনতা দেবী আরো অনেক কথাই কিরীটীকে বললেন, যা থেকে কিরীটীর বুঝতে কষ্ট হয় না, তিনি অনিলবাবুকে সত্যি সত্যিই ভালবাসতেন। সে ভালবাসার মধ্যে কোন খাদ ছিল না। যদিচ অনিলবার ইদানীংকার ব্যবহারের মধ্যে তাঁর দিক থেকে একটা স্বার্থপরতার ভাব দেখা দিয়েছিল, তথাপি বিনতার ভালবাসায় কোন তারতম্য হয়নি।

বরং মনে মনে একটু আঘাত পেলেও মুখে কখনো সেটা অনিলবাবুকে জানতে দেননি তিনি।

আর অনিলবাবুকে বিনতা সত্যিকারের ভালবাসতেন বলেই তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর স্মৃতি নিয়েই কাটাচ্ছেন।

আড়াইটের ফিরতি ট্রেনটা না ধরতে পারলে ফিরতে রাত হবে তাই কিরীটী অতঃপর বিনতা দেবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নমস্কার জানিয়ে স্টেশনের দিকে পা বাড়ায়।

আগের পর্ব :
১. কিরীটী একটা ঘর খুঁজছিল
২. ন্যায়রত্ন লেনে
৩. দিন পনের হলো
পরের পর্ব :
৫. দুপুরের ট্রেনে
৬. কিরীটী বাসায় ফিরে এলো
৭. থানা থেকে একজন

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত