মোমের আলো: ১৯. কিরীটী মৃদু হেসে বলে

মোমের আলো: ১৯. কিরীটী মৃদু হেসে বলে

১৯. কিরীটী মৃদু হেসে বলে

কিরীটী মৃদু হেসে বলে, তাহলে পাকা ব্যবস্থা করেই যেতেন?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনি একটু আগে যা বললেন তা কি সত্যি?

কি? মিত্ৰাণী সত্যি সত্যি আপনাকে ভালবাসে কিনা?

হ্যাঁ।

হ্যাঁ সঞ্জীববাবু, আমি যা বলছি সত্যি। কিন্তু এখনও তো বললেন না, কেন সেদিন ঐ ঝড়জলের রাত্রে অত দূরে গিয়েছিলেন?

একটা শেষ বোঝাপড়া করবার জন্যে। বোঝাপড়া?

হ্যাঁ।

কিসের?

সে—

বলুন? থামলেন কেন?

কিছুতেই সে বিবাহের ব্যাপারে মত দিচ্ছিল না। কেবলই বলছিল, এখন নয় পরে–আর তাতেই আমার মনে সন্দেহ জাগে প্রথম। তারপর–

বলুন?

তারপর একদিন রাত্রে তার সঙ্গে পূর্ব ব্যবস্থা না করেই দেখা করতে যাই হঠাৎ, কিন্তু–

কী?

রাত তখন বোধ হয় সাড়ে বারোটা হবে, ভেবেছিলাম ওর ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে ওর ঘুম ভাঙাব, কিন্তু তা আর করতে হল না-দেখলাম জেগেই আছে সে-তার ভগ্নীপতি আর সে–

কি–কি বললেন?

হঠাৎ যেন কিরীটী সজাগ হয়ে ওঠে-সোজা হয়ে বসে।

হ্যাঁ, সে আর তার ভগ্নীপতি ঐ সুশান্ত চ্যাটার্জি ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে-গায়ে গা ঘেঁষে হেসে হেসে আলাপ করছে।

কিন্তু সেটা শালী-ভগ্নীপতির রহসালাপও হতে পারে।

মশাই না, রহস্যালাপ নয়—ও প্রেমালাপ–হলপ করে বলতে পারি প্রেমালাপ—

আপনি তাদের কোন কথা শুনেছেন?

না, দরকার মনে করিনি। ঘৃণায় ছুটে সেখান থেকে চলে এসেছি—আর তাই সেরাত্রে গিয়েছিলাম–

ঐ ব্যাপারটা কবে ঘটেছিল?

সেই ঝড়জলের রাত্রের দিন-চারেক আগের এক রাত্রে। তাই তো এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনি বলা সত্ত্বেও বিশ্বাস করতে পারছি না, কোথায় যেন একটা সন্দেহের কাটা খচখচ করছে–

প্রেমের ব্যাপারে অতি সামান্য কারণেই মনে সন্দেহ জাগে সঞ্জীববাবু-মন তখন বড় দুর্বল হয়ে পড়ে–

আমি দুর্বল নই কিরীটীবাবু—

কিরীটী হাসল, ব্যতিক্রম হবে না যে তা নয়, কিন্তু যাক সে কথা—দেখুন তো, এই খামের হাতের লেখাটা চিনতে পারেন কিনা?

কিরীটী পকেট থেকে বের করে মিত্ৰাণীর চিঠিটা সঞ্জীবের সামনে ধরল।—চিনতে পারছেন?

হ্যাঁ-মিতার–

রাখুন এটা আপনার কাছে-পরে পড়ে দেখবেন-কেমন? আচ্ছা সঞ্জীববাবু, আমরা এবারে উঠব–

কিরীটী উঠে দাঁড়ায়।

যাবেন?

হ্যাঁ-রাত হল। আপনি যেভাবে অকপটে সব জানিয়ে আমাদের সাহায্য করলেন তার জন্য ধন্যবাদ। চলি। নমস্কার।

নমস্কার।

কিরীটী ও অবনী বের হয়ে এল।

রাত প্রায় সোয়া দশটা তখন।

অবনী গাড়িতে উঠতে উঠতে শুধান, বাড়িতে যাবেন তো?

না।

তবে কোথায়?

সুশান্তবাবুর কোয়াটারে যেতে হবে একটিবার—

এখন! মানে এই রাত্রে–

হ্যাঁ-এখুনি একবার থানায় চলুন। তারপর সেখান থেকে সোজা সুশাবাবুর কোয়ার্টারে–

কিছু প্রয়োজন আছে নাকি সুশাবাবুর ওখানে?

আছে। চলুন দেরি করবেন না আর। যেতে যেতে সব বলব।

.

রাত সাড়ে দশটার একটু পরেই ওরা বেলেঘাটা পৌঁছে গেল। আগে-পিছে দুটো জীপ।

কিছুক্ষণ আগে থাকতে বেশ বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। বৃষ্টির জন্য ঐ সময় ঐ জায়গাটা প্রায় নির্জন হয়ে গিয়েছিল। কোয়াটারের কাছাকাছি আসবার আগেই কিরীটী অবনীকে বললে, গাড়ির হেডলাইট নিভিয়ে দিন অবনীবাবু।

অবনী সুইচ অফ করে দিলেন।

ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। গাঢ় অন্ধকার-সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে কিছু দেখা যায় না।

গাড়ি এখানেই থামান-হেঁটে যাব। কিরীটী বলে।

কিন্তু বৃষ্টি যে জোরে পড়ছে! অবনী বলেন।

পড়ুক।

কিরীটী বলতে বলতে নেমে পড়ল, আসুন।

অন্ধকারে কিরীটী এগিয়ে যায়-অবনী তাকে অনুসরণ করেন। কোয়ার্টারে পৌঁছতে পৌঁছতেই ওরা বেশ ভিজে যায়।

মিত্ৰাণীর ঘরে আলো জ্বলছিল। আর সব ঘর অন্ধকার। জানালা খোলা। সেই জানালাপথেই কিরীটীর ঘরের মধ্যে নজরে পড়ে। মিত্ৰাণী ও সুশান্ত মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। মিত্ৰাণী মাথা নিচু করে আছে, সুশান্ত তাকে যেন কি বলছে। ওরা জানালার সামনে একেবারে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল।

সুশান্ত বলছে, তোমার আপত্তিটা কিসের? আমি কোন কথা শুনতে চাই না তোমার, তোমাকে বলতেই হবে–

মিত্ৰাণী বলে, আপনাকে তো আমি বলেছিই জামাইবাবু—এ হতে পারে না।

পারে না-পারে না—সেই এক কথা, বাট হোয়াই?

সুশান্তর কণ্ঠস্বর রীতিমত অসহিষ্ণু।

মিত্ৰাণী মাথা নিচু করে থাকে। কোন জবাব নেই তার মুখে।

হুঁ, তাহলে আমার ধারণাটা মিথ্যা নয়।

মিত্ৰাণী সুশান্তর দিকে মুখ তুলে তাকাল।

সুশান্ত পূর্ববৎ অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলতে থাকে, মিঃ রায় এখন দেখছি ঠিক সন্দেহই করেছেন, সে-রাত্রে কেউ তোমার ঘরে এসেছিল! কে এসেছিল বল?

সঞ্জীব দত্ত।

কে?

বললাম তো-সঞ্জীব।

মানে সেই ছেলেটা-সেই মালদহের বখাটে ছেলেটা? সে তাহলে এখন পর্যন্তও ধাওয়া করেছে! ছিঃ ছিঃ, এই তোমার চরিত্র মিত্রাণী? এত ছোট প্রবৃত্তি তোমার? একটা বেকার লোফার–

জামাইবাবু!

সহসা মিত্ৰাণীর কণ্ঠস্বর যেন তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। চোখের দৃষ্টি প্রখর হয়ে ওঠে।শুনুন, বেকার ও নয়, লোফারও সে নয়।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ।

প্রেমে একেবারে তাই হাবুড়ুবু খাচ্ছো! ঠিক আছে, তাহলে কাল সকালেই সেই নাগরের কাছে চলে যেও। এখানে আর তোমার স্থান নেই।

কাল সকালে কেন এখনি আমি চলে যাব।

তাই যাও। ইতর, বাজারের মেয়েমানুষ—

কি বললেন?

মিত্ৰাণী অকস্মাৎ ঘুরে দাঁড়ায় গ্রীবা বেঁকিয়ে।

যা তুমি তা-ই বলছি, একটা বাজারের মেয়েমানুষ—

তবু জানবেন আপনার মত হীন প্রবৃত্তি আমার নয়—

মুখ সামলে কথা বল মিত্ৰাণী!

কেন? একজন স্ত্রী-হত্যাকারীকে ভয় করতে হবে নাকি?

কি-কি বললি?

অকস্মাৎ যেন ঝাপিয়ে পড়ল সুশান্ত মিত্ৰাণীর ওপর হিংস্র একটা জন্তুর মত অন্ধ আক্রোশে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি জানি-আমি স্বচক্ষে দেখেছি—

কিন্তু মিত্ৰাণীর বক্তব্য শেষ হয় না, সুশান্ত তার গলাটা দু-হাতে সজোরে চেপে ধরায় তার কথাগুলো গলার মধ্যে আটকে যায়।

কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকে, সুশান্তবাবু, মিঃ চ্যাটার্জী! দরজাটা খুলুন।

কে?

আগের পর্ব :
০১. যেমন ঝড় তেমনি বৃষ্টি
০২. অবনী সাহা বলছিল কিরীটীকে
০৩. সুশান্ত চ্যাটার্জি গৃহেই ছিল
০৪. পাশের ঘরটি
০৫. অবনী সাহা উৎসুক দৃষ্টিতে
০৬. শকুন্তলার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট
০৭. কিরীটীর আর জিজ্ঞাস্য
০৮. আমি হত্যা করিনি
০৯. কিরীটী থামে না
১০. চা-টা চমৎকার হয়েছে
১১. দিন-পনের পরের কথা
১২. ভেজানো দরজাটা ঠেলে
১৩. মিত্ৰাণী পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে
১৪. অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি দিয়ে
১৫. বেলা এগারটা নাগাদ
১৬. লেটার-বকস্ থেকে
১৭. কিরীটীর মুখে উচ্চারিত শেষের কথাগুলো
১৮. ঐদিন সন্ধ্যার কিছু আগে

পরের পর্ব :
২০. কিরীটীর গলার স্বরে

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত