২.১৮ পূর্ব ঘটনার অনুস্মৃতি
পূর্ব ঘটনার অনুস্মৃতি
এখন বোধ হয় আপনার আর বুঝতে কোনই কষ্ট হচ্ছে না, কিভাবে সুহাস, সতীনাথ ও নিশানাথকে হত্যা করা হয়। এবং সেই অদ্ভুত হত্যারহস্যটির পরিকল্পনাকারী সতীনাথের মতই আর একটি শক্তিশালী মস্তিষ্ক হতে। অর্থাৎ the real brain behind আমাদের সুবিখ্যাত প্রথিতযশা চিকিৎসক ডাঃ কালীপদ মুখার্জী, এম.ডি। যিনি আজও বহাল তবিয়তে সমাজের মধ্যে বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন এবং আমরা অনেকেই আজও যাঁকে স্বচ্ছন্দে ডেকে এনে তাঁরই হাতে আমাদের প্রিয়জনদের জীবনরক্ষাকল্পে চিকিৎসার সকল দায়িত্ব নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে তুলে দিচ্ছি। সুহাসের হত্যাব্যাপারে সত্যিকারের যে-ই অপরাধী হোক না কেন, তাকেও হয়ত ক্ষমা করা যেতে পারে, কিন্তু ডাঃ কালীপদ মুখার্জী? নৈব চ নৈব চ!
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। রাজাবাহাদুর সুবিনয় মল্লিকই সতীনাথ ও নিশানাথের হত্যাকারী। আর সুহাসের হত্যাকারী আসলে সাঁওতাল প্রজাটি হলেও, পরিকল্পনাকারী রাজাবাহাদুর ও ডাঃ মুখার্জী ও যন্ত্র-আবিষ্কর্তা সতীনাথ।
চশমার সঙ্গে টিটেনাস রোগের বীজানু প্রয়োগে সুহাসকে হত্যার প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতেই, দ্বিতীয় প্রচেষ্টা করা হল প্লেগের বীজানু ইনজেক্ট করে।
এখন কথা হচ্ছে, সুহাসের হত্যাব্যাপারে নিরীহ ডাঃ সুধীন চৌধুরীকে কেন জড়ানো হল! তার দুটি কারণ ছিল। অবিশ্যি এটাও আমার অনুমান ছাড়া কিছুই নয়। ডাঃ সুধীন যে নির্দোষ প্রমাণ আমাকে করতে হবে বলেই আমার এ শ্রমস্বীকার সে তো আপনি জানেন। সেই কথাতেই এবারে আমি ফিরে আসছি। একেবারে গোড়া হতেই শুরু করব। এ হত্যার ব্যাপারে সুধীনের বিরুদ্ধে যে প্রমাণকে আপনারা সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ বলে মেনে নিয়েছেন, সেটাই সর্বপ্রথম আলোচনা করা যাক। রায়পুরে যাত্রার দিন সকালে সুধীন সুহাসকে যে ইনজেকশন দিয়েছিল, সেটা অ্যান্টিটিটেনাস্ ছাড়া আর কিছু ছিল কিনা?
কিন্তু তারও আগে আলোচনা করব, সত্যিই যদি সুধীনই সুহাসের হত্যাকারী হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে সুধীনের সুহাসকে হত্যার কি মোটিভ বা উদ্দেশ্য থাকতে পারে? বলবেন, প্রতিশোধ! তার পিতার নৃশংস হত্যার প্রতিশোধ! কিন্তু আমি বলব—absurd! Simply absurd! সুধীনের পিতা যখন নিহত হন, কতটুকু শিশু ছিল সুধীন! তারপর একদিন বয়স হলে মার মুখে সব কিছু সে শুনলে, তখন তার মার পক্ষে যে প্রতিহিংসা বা বিদ্বেষ থাকা সম্ভব, সেটা সুধীনের পক্ষে গড়ে ওঠা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। তাছাড়া ঘটনাচক্রে যাদের প্রতি গড়ে ওঠা উচিত ছিল একটি পরিপূর্ণ ঘৃণা ও বিদ্বেষ, সেখানে গড়ে উঠল একটা মধুর প্রীতির বন্ধন এবং সেটা একান্ত অজান্তেই। সুহাসের সঙ্গে ভালবাসাটা গাঢ় হয়ে ওঠবার পর যেদিন প্রথম সুধীন জানতে পারলে সুহাসের আসল পরিচয়, তখন তার মনে আর যাই হোক হিংসা বা ক্রোধ জাগতে পারে না। এই গেল প্রথম কথা।
দ্বিতীয় কথা, যদি ধরেই নিই অর্থের লোভে সুধীন সুহাসকে হত্যা করেছে, তাও অসম্ভব, কারণ সে ঘুণাক্ষরেও দ্বিতীয় উইল সম্পর্কে কিছু জানত না। এবং শুধু তাই নয়, অর্থের প্রতি যদি তার লোভই থাকবে, তাহলে সুহাস যখন তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছিল তখন মালতী দেবীকে সে তার ব্যবসার অংশীদার করত না।
তৃতীয়ত সুহাসকে সুধীনের যদি খুন করবারই মতলব থাকত, তাহলে প্রথমবার যখন সে টিটেনাস রোগে আক্রান্ত হয়, তখন তাকে নিজে কলকাতায় নিয়ে এসে চিকিৎসার সুব্যবস্থা নিশ্চয়ই করত না। এই তিনটি করণেই আমার মনে হয় সুধীনকে আমরা অনায়াসেই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারি। এবং তাই যদি হয় তাহলে সুধীনকে যে হত্যাকারী ইচ্ছা করেই কোন গভীর উদ্দেশ্যে সুহাসের হত্যাব্যাপারের সঙ্গে জড়িয়েছিল সেটা প্রমাণ হয়ে যায় না কি? তাই বলছিলাম হত্যাকারী দুটি কারণে সুধীনকে হত্যা-মামলার সঙ্গে জড়িয়েছিল। যেহেতু (১) হত্যাকারী উইলের ব্যাপার জানত এবং (২) জানত নিশ্চয়ই উইলের দ্বারা সুধীন লাভবান হবে—তাই মনে হয়, ঐ অ্যানটিটিটেনাস ইনজেকশন দেওয়ার সুযোগে হত্যাকারী সুধীনের বিরুদ্ধে মস্ত বড় একটা প্রমাণ হাতে পেয়েছিল, যার দ্বারা অনায়াসে হত্যার সমস্ত অপরাধ তার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজে সমস্ত সন্দেহের বাইরে চলে যেতে পেরেছিল আইনের চোখে ধুলো দিয়ে। আগেই বলেছি সুধীন নিজের বোকামিতেই অনেকটা নিজেকে বিপদগ্রস্ত করে ফেলে। সুহাসের মৃত্যুর ঠিক কয়েকদিন আগে সুধীন বেনারসে চলে গেল, আবার মাঝখানে এসে মৃত্যুর সময়টা বেনারসে চলে গেছিল। এতে করে স্বভাবতই লোকের মনে সুধীনের প্রতি সন্দেহ জাগতে পারে। তাছাড়া স্টেশনেও সে উপস্থিত ছিল। হিমোসাইটোমিটার যন্ত্রটার কোন একটা ভাল রকম explanation-ও সে দিতে পারল না। যদিও এক্ষেত্রে ডাঃ মিত্রের জবানবন্দির সত্যতাও আমি মেনে নিতে রাজী নই। আমার মতেমিঃ হালদারের ঐসম্পর্কে explanation-টাই সত্যি। ডাঃ মিত্র সত্য গোপন করেছিলেন। সুহাসের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স সম্পর্কেও সকল সন্দেহের নিরসন হয়ে যায় মালতী দেবীর statement থেকেই। এবং এ কথাও সেই সঙ্গে প্রমাণ হয় মালতী দেবীকে বাঁচাতে গিয়েই এবং সুহাসের মৃত আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাবশেই ডাঃ সুধীন চৌধুরী আনক ব্যাপার ইচ্ছে করেই চেপে গেছে আদালতে বিচারের সময় জেরার মুখে। তারপর সুহাসের কলকাতায় আগমন সংবাদ—সে-ও কেমন করে সুধীন চৌধুরী পায় তারও প্রমাণ পেয়েছেন মালতী দেবীর চিঠির জবানবন্দিতেই। তিনিই আগের বারের মত ডাঃ সুধীনকে সুহাসের অসুস্থতার সংবাদ দিয়েছিলেন। সুহাসের অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় পৌঁছবার পর তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েই ডাঃ সুধীন তার এক বন্ধুর বিয়েতে, বন্ধুর একান্ত অনুরোধ না এড়াতে পেরেই, কয়েকদিনের জন্য বেনারস চলে যেতে বাধ্য হয় তার অনিচ্ছাতেই। এখন কথা হচ্ছে, আদালতে জেরার সময় সুধীন চৌধুরী কেমন করে সুহাসের কলকাতায় আসবার সংবাদ পান, সেটা জানাতে কেন অস্বীকার করে! তার কারণ মালতী দেবী অনুরোধ করেছিলেন, সুহাস যেন কাউকে কথাটা না বলে। ব্যাপারটা আগাগোড়া এখানে অসম্ভব ও অস্বাভাবিক বোধ হলেও, সুধীন মালতী দেবীকে exposeকরেনি। ডাঃ সুধীনের আদালতের সমগ্র ব্যাপারটা study করে আমার ধারণা হয়েছে, লোকটা যেন একটু eccentric প্রকৃতির ছিল। আর কিছুই নয়। নইলে নিজের অবশ্যম্ভাবী বিপদ জেনেও সে চুপ করে ছিল কেন? সুধীন বন্ধুর বিবাহে বেনারসে গেছিল বলেই, ঠিক সুহাসের মৃত্যুর সময়টাতে কলকাতায় উপস্থিত থাকতে পারেনি। যদিও তার এই অনুপস্থিতি লোকের মনে সন্দেহেরই উদ্রেক করে। এবং সুধীন আদালতে বেনারসে কেন গেছিল সে সম্পর্কেও কোন জবাব দেয়নি যা সে অনায়াসেই পারত। তারপর রায়পুর যাওয়ার দিন সুধীন যে সুহাসকে অ্যান্টিটিটেনাস ছাড়া অন্য কিছু injection দেয়নি তার প্রমাণও মালতী দেবীর statement-য়েই পাবেন। মালতী দেবী সুধীনের প্রতি এতটুকু সন্দেহযুক্তা থাকলে সুধীনকেও বাঁচতে দিতেন না। এবং শুধু তাই নয়, সুধীন যে সুহাসের হিতাকাঙক্ষী সেকথাও মালতী দেবীর চাইতে কেউ বেশী জানতেন না। তবু যে কেন আদালতে বিচারের সময় মালতী দেবী সব কথা গোপন করে গেলেন, তারও জবাব মালতী দেবীর চিঠির মধ্যে পাই।
মোটামুটি তাহলে আপনাকে রায়পুরের সমগ্র হত্যা-মামলাটির একটা মীমাংসা করে দিলাম। এবং এখন বোধ হয় আপনার আর বুঝতে কষ্ট হবে না, হতভাগ্য রায়পুরের ছোট কুমার সুহাস মল্লিকের হত্যার পরিকল্পনাকারী স্বয়ং রাজাবাহাদুর—নিহত সুহাসের বৈমাত্রেয় জ্যেষ্ঠভ্রাতা সুবিনয় মল্লিক।
পরিকল্পনাকারী ডাঃ কালীপদ মুখার্জী ও হত্যার যন্ত্রের উদ্ভাবনকারী সতীনাথ লাহিড়ী। আসলে উপরিউক্ত তিনজনকেই সুহাসের হত্যাকারী বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এবং এক্ষেত্রে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল অর্থলাভ। অর্থ অনর্থম। নিশানাথ ও সতীনাথের হত্যাকারী স্বয়ং সুবিনয় মল্লিক। উদ্দেশ্য তাদের মধ্যে নিশানাথ ছিলেন সতীনাথের হত্যার সাক্ষী এবং সতীনাথ ছিল সুহাসের হত্যার সঙ্গী ও পরিকল্পনাকারী। এই হত্যামামলা-সংক্রান্ত সব কিছুই আপনার গোচরীভুক্ত করলাম, সেই সঙ্গে এদের জবানবন্দি, যা আমি সংগ্রহ করেছি ও অন্যান্য evidenceগুলোও আপনার কাছে পাঠালাম। ধর্মাধিকরণের হাতে সব কিছু তুলে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে কলকাতা হতে কিছুদিনের জন্য চলে যাচ্ছি, অদূরভবিষ্যতে এই মামলার ফলাফল দূর হতে দেখবার বুকভরা আশা নিয়ে। আশা করি নিরাশ হব না। নমস্কার।
ভবদীয়
কিরীটী রায়
প্রথম পর্ব:
আগের পর্ব :
১.০১ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
১.০২ পুরাতনী
১.০৩ রায়পুর হত্যা-মামলা
১.০৪ প্লেগ ব্যাসিলাই
১.০৫ মাকড়সার জাল
১.০৬ জাস্টিস মৈত্র
১.০৭ জবানবন্দি জের
১.০৮ আরও সূত্র
১.০৯ হারাধন ও জগন্নাথ
১.১০ অদৃশ্য ছায়া
১.১১ মৃত্যবাণ
১.১২ নিশানাথ
১.১৩ তারিণী, মহেশ ও সুবোধ
১.১৪ আরও সাংঘাতিক
১.১৫ আবার আততায়ীর আবির্ভাব
১.১৬ দুঃখের হোমানল
১.১৭ মামলার আরও কথা
দ্বিতীয় পর্ব :
২.০১ সূত্র সন্ধান
২.০২ নৃসিংহগ্রাম
২.০৩ শিবনারায়ণ
২.০৪ পুরাতন প্রাসাদ
২.০৫ কে কাঁদে নিশিরাতে
২.০৬ আবার বিষের তীর
২.০৭ রাণীমা
২.০৮ জবানবন্দির জের
২.০৯ পাতালঘরের বন্দী
২.১০ ঘটনার সংঘাত
২.১১ পাতালঘরে
২.১২ কিরীটীর বিশ্লেষণ
২.১৩ রাণীমার স্বীকৃতি
২.১৪ কিরীটীর চিঠি
২.১৫ কিরীটীর ডাইরী
২.১৬ বিশ্লেষণ
২.১৭ মীমাংসা
পরের পর্ব :
২.১৯ শেষ কথা