মুখের দিকে দেখি

মুখের দিকে দেখি

০১. ভূতের গল্লির চানমিঞা

০১.

ভূতের গল্লির চানমিঞা হয়তো বান্দরের দুধ খাওয়া পোলা, কারণ যারা এই ঘটনার সাক্ষী, যেমন মামুন মাহমুদের মা মিসেস জোবেদা রহমান, তাদের ২৫নম্বর বাড়িতে বেড়াতে গেলে এবং কথার প্রসঙ্গ চানমিঞার দিকে মোড় নিলে সে এই কথাটা জানাতে ভুলবেই না যে, ওতো বন্দিরের দুধ খাইছিল, এবং এ বিষয়ে সন্দেহ করলে সে অবশই তর্ক করবে এবং প্রয়োজনে ঝগড়া। যেমন ধরা যাক, ফখরুল আলম লেদু, সে মামুনের ছুটুকালের বন্ধু, একসঙ্গে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, সে হয়তো মামুনের খোঁজে তাদের বাসায় গেল, কিন্তু তখন হয়তো মামুন বাসায় নাই, এরকম হইতেই পারে, লেদু যেতে পারে এবং মামুন তখন বাসায় না থাকতেই পারে, এবং তখন মামুনের মা ঘর থেকে বের হলে ফখরুল আলম লেদুর সঙ্গে তার দেখা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তারপর মামুনের মা যদি বলে, আইলি চা খায়া যা, এবং ফখরুল আলম লেদু যদি রাজি হয় তাহলে তখন ঘরের ভিতরে বসে লেদুর সঙ্গে মামুনের মার টুকটাক কথাবার্তা বলার অবস্থা তৈরি হবে; এই আলাপের ভিতর চানমিঞার প্রসঙ্গ চলে আসতে পারে, এবং তখন এই প্রসঙ্গে ফখরুল আলম লেদু বেঁকাতেরা কথা বললে, মামুন/মাহমুদের মা। তাকে অবশ্যই বলবে, তুই কিছুই জানস না!

কিন্তু মামুনুল হাই ওরফে মামুন বাসায় থাকে না কেন? ফলে ফখরুল আলম লেদু মামুনের মাকে জিগাস করে, মামুন কৈ গেছে, যায় কৈ? মামুনের মা হয়তো জানে সে কৈ গেছে, অথবা হয়তো সে জানে না, সে হয়তো বলে, জানি না কৈ যায়, অথবা হয়তো বলে, অয়তো গেছে কাঠের ভুসি আননের লাইগা–মিসেস জোবেদা রহমান কাঠের ভুসির চুলা জ্বালায়।

মামুন হয়তো একদিন তাদের স্কুল বন্ধ থাকায় একটা গমের খালি ছালা নিয়া-যে ছালাটা তার মা অন্য একটা ছালা সেলাই করে জোড়া দিয়া লম্বা করেছে–বাসা থেকে বের হয়া নয়াবাজারের কাঠের গোলার দিকে যায়। হয়তো সে জোড়পুল, লালচান মকিম লেন, মালিটোলার ভিতর দিয়া নয়াবাজারে দি নিউ চন্দ্রঘোনা স মিল এন্ড টিম্বার ডিপোট-এ যায় হাজির হয়, তখন হয়তো বৃষ্টির দিন ছিল এবং সারাদিন চলার পর সন্ধ্যায় করাতকল বন্ধ হয়া গেছিল, সে সেখানে পৌঁছায়া কোন কর্মচারি বা করাতির সঙ্গে ভুসির দরদাম করে, অবশেষে তিন টাকা বস্তা দাম ঠিক হলে সে করাত কলের লোহার-গাছের গোড়ায় ভুসির গর্তের ভিতরে নামে। সারা দিন ধরে চেরাই করা কাঠের ভুসি গর্তে জমা হয়া ছিল, এই গর্তের ভিতরে নেমে ভুসির পাহাড় দেখে আলিবাবার মত হয়তো সে খুশি হয় এবং তখন হয়তো আত্মহারা হয়া অথবা হয়তো অন্য কোন কারণে বস্তায় ভুসি ভরতে যায়া সে নিজেই ভুসির স্তুপের নিচে চাপা পড়ে, কারখানার কর্মচারিরা বিষয়টা খেয়াল করে না, ফলে সে এইভাবে চাপা পড়ে থাকে। সেদিন রাইতের বেলায় স মিলের মালিক আব্দুল মাবুদ চৌধুরির ভাই আব্দুল ওদুদ চৌধুরির পাঁচটনি চাইরটা ট্রাক দি নিউ চন্দ্রঘোনা স মিল এন্ড টিম্বার ডিপোট-এর সামনে এসে থামে এবং আগে থেকে তৈরি হয়া থাকা একদল কুলি গর্তের ভুসি টুকরিতে করে এনে ট্রাকের ভিতরে রাখা সাদা রঙের কতগুলা বস্তার উপরে ঢেলে বস্তা ঢেকে দেয়। কুলিরা ট্রাকের ড্রাইভারদের জিগাস করে, আইজ কি যায়? কিন্তু ট্রাকের ড্রাইভাররা জবাব দেয় না, চোখ কুঁচকায়া তাকায়, লাটসাহেবের ভাব নিয়া স্টিয়ারিং হুইল ধরে বসে থাকে, কিন্তু তাতে কিছু ক্ষতি হয় না, কারণ এই কুলিরা খুবই বুদ্ধিমান, তারা বলে, সার যায়, বার্মায় যাইব। অথবা আসলে হয়তো এই কুলিরা বুদ্ধিমান ছিল না, যাইহোক, ফলে কুলিরা বুদ্ধিমান হলে বা না হলে যে সমস্যা হওয়ার কথা এ ক্ষেত্রে তাই হয়, সার ও ভুসির সঙ্গে মামুন মিঞা ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের পথে চলে যায়। ব্যাপারটা এইভাবে ঘটে। এই চালাক অথবা বোকা কুলিরা ভুসি তোলার সময় অবশ্যই তাকে পায়, সে হয়তো অজ্ঞান হয়া ভুসির স্তুপের মধ্যে পড়ে ছিল, তখন তারা তাকে আবিষ্কার করে, কিন্তু কারখানার ভিতরে অন্ধকার থাকায়, কারণ তারা আলো জ্বেলে কাজ করতে পারছিল না, তারা টুকরির ভিতরে অজ্ঞান মামুনকে গোল করে ভরে একটা ট্রাকের মধ্যে ছুড়ে ফেলে দেয়, তাদের একবার মনে হয়, এটা হয়তো কাঠের একটা টুকরা, এইরকম ভাবা কঠিন কিছু না, তারা কুলির পোলা কুলি, তারা তাই ভাবে যে, কাঠের ভুসির ভিতরে যা পাওয়া যায় তা কাঠই, হয়তো দামি, সেগুন কিংবা গামারি, শিল কড়ই কিংবা গর্জনও হতে পারে, অথবা হাবিজাবি, কদম কিংবা ছাতিম, তথাপি হয়তো কোন কাঠই। অথবা তারা হয়তো এইরকম ভাবে না, তারা হয়তো অতো বোকা ছিল না, হাত দিয়া ভুসি তুলতে যায় তারা যখন সেখানে মামুনুল হাইকে পায়, অন্ধকার হলেও তারা বুঝতে পারে যে, এইটা একটা মানুষ, কাঠ না, কারণ তারা দেখে যে, তার দুই হাত দুই পাও এবং একটা মাথা আছে, এই কুলিরা জানে যে, দুই হাতপাও এবং একটা মাখা থাকে মানুষের, ফলে তখন তারা ভয় পায়া যায়, তাদের মনে হয় যে, এটা হয়তো লাশ, এবং তখন তারা তাদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়, তারা একটা কথাও না বলে মামুনকে টুকরিতে তুলে নিয়া যায়া ট্রাকের ভিতরে ফালায়, কারণ তাদের মনে হয় যে, এই বিষয় নিয়া এখন কথা বললে তারাই পুলিশের ঝামেলায় পড়বে, পুলিশ তাদেরকে এক হাজার একটা কথা জিগাস করবে, হয়তো লাত্থি গুঁতাও মারবে, তার চেয়ে মালিকের ভুসির ভিতরে পাওয়া মাল মালিকের ভাইয়ের ট্রাকের সঙ্গে চলে যাওয়া ভাল!

মামুন হয়তো ভুসির ভিতরে অজ্ঞান হয়া ছিল, গভীর রাইতে ট্রাক যখন চট্টগ্রামের দিকে রওনা হয় সে কিছু জানতে পারে না; সেদিন বৃষ্টি থাকায় ট্রাকগুলা ত্রিপল দিয়া ঢাকা দেওয়া ছিল, এগুলা নায়াবাজার থেকে বের হয় দোলাই খালের রাস্তা দিয়া যাত্রাবাড়ি চৌরাস্তা ঘুরে চিটাগংয়ের পথ ধরে। সেদিন কোনখানে যায় ট্রাকগুলা মাল খালাস করতো তা বলা মুশকিল, হয়তো চট্রগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজার, সদর ঘাট কিংবা কালুর ঘাট ব্রিজের গোড়ায় যায়া ট্রলারে অথবা সাম্পানে মাল তুলে দিত, কিন্তু কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের কাছে ট্রাক টহল পুলিশের কবলে পড়ে, পুলিশ তিনটা ট্রাক আটকায়, একটা ট্রাক থামে না, হৈচৈ এর মধ্যে ঝানু ড্রাইভার এক টানে কোন সাইড় রাস্তা দিয়া বের হয়া যায়। কিন্তু ট্রাকের ড্রাইভার হয়তো ভয় পেয়ে যায় ফলে সে ট্রাক নিয়া সরাসরি আব্দুল ওদুদ সওদাগরের গ্রামের বাড়ি সাতকানিয়ায় যায় হাজির হয়, অথবা হয়তো ফিরিঙ্গি বাজার কিংবা সদরঘাটে ট্রাক পৌঁছালে সওদাগরের কর্মচারিরা যখন পিছনে পুলিশ লাগার কথা শোনে তখন তারা মাল গ্রামের বাড়িতে নিয়া রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এইভাবে মামুন মিঞা চোরাই ইউরিয়া সারের সঙ্গে সাতকানিয়ার বোয়ালিয়া পাড়ায় আব্দুল ওদুদ চৌধুরির বাড়িতে যায় হাজির হয় এবং তখন তার দেখা হয় আসমানতারা হুরে জান্নাতের সঙ্গে; ফলে ফখরুল আলম লেদুকে একদিন মামুনুল হাইয়ের মা চানমিক্সার গল্প বলে, চানমিঞার মা খৈমনরে যায়া জিগা, চানমিঞা কি খাইছিল, কারণ চানমিঞার ছুটুকালে হয়তো মহল্লায় বান্দর ছিল, মহল্লার বাড়িঘরের ছাদ এবং দেওয়ালের উপর দেখা যেত এই বান্দরদের, তাদের খয়েরি রঙের পিঠ, সাদাটে পেট এবং লাল পশ্চাদ্দেশ; তারা দেওয়ালের উপর দিয়া হেঁটে যেত অথবা কোন বাড়ির কার্নিশে লেঙ্গুর ঝুলায়া শুয়ে থাকতো। তখন হয়তো বান্দরদের এই দলে একটা দুইটা বা অনেকগুলা মাদি বান্দর ছিল, বাচ্চাঅলা বান্দরনিদের পায়ের ফাঁকে বুকের সঙ্গে বাচ্চা ঝুলে থাকতো। হয়তো এইরকম কোন একটা বান্দরনির দুধ চানমিঞা খেয়েছিল, যখন সে শিশু ছিল তখন একদিন তার মা, খৈমন ওরফে মোছা : খৈমন বেগম তাকে ঘরে একা রেখে বাইরে থেকে দরজায় শিকল তুলে দিয়া ৩৬নম্বর বাড়ি থেকে নুরানি বিলকিস ওরফে উপমা বেগমদের ৩৭ নম্বর বাড়িতে যায়, যায় বলে, আফা আমারে এক কাপ চিনি ধার দেন।

নুরানি বিলকিসের স্বামী ফজলুর রহমান রায়সা বাজারে রেশনের দোকান চালায়, তার ঘরে এন্তার চিনি এবং চাল এবং গম, সে থৈমন বেগমের দিকে তাকায়; তখন হয়তো ময়না মিঞা বেঁচে ছিল, অথবা ছিল না, কারণ ময়না মিঞা একাত্তর সনে নিখোঁজ হয়, সে ঠাটারি বাজারে ঝাঁকায় করে লাউ/ঝিঙ্গা/কচুরলতি বেচতো, সে ছিল ঠাটারি বাজারের তরকারি বিক্রেতা, খৈমনের কথা শুনে নুরানি বিলকিস তার দিকে তাকায়া দেখে যে, তার শরীর ফাটিফাটি করে, ফলে সে পুনরায় বিরক্ত হয়, তার মনে হয় যে, নিখোঁজ তরকারি বিক্রেতার না-ঘরের না-ঘাটের বৌ-এর এমন শরীর থাকা ঠিক না, সে বলে, একদিন আহস ত্যালের লাইগা, একদিন আহস চিনির লাইগা, খালি চায়া মাইঙ্গা খাচ, কি তুই!

খৈমন হয়তো লজ্জিত হয়, সে বলে, দেন, আগামী সপ্তায় রেশন উঠাইলে দিয়া দিমু, ঈমানে!

কিন্তু নুরানি বিলকিসের মন এইসব কথায় গলে না, সে খৈমনকে বসায়া রাখে, ভাবে যে বিরক্ত হয়া হয়তো খৈমন একসময় চলে যাবে, কিন্তু সে যায় না, হাতে চিনামাটির একটা আংটা ভাঙ্গা কাপ নিয়া রান্না ঘরে পায়ের পাতার উপর বসে চুপ করে অপেক্ষা করে। নুরানি বিলকিস রান্না করে, ভাতের মাড় গালে, ডাইলে বাগার দেয়, জরুরি কাজের ভান করে উঠে ঘরে যায় আবার ব্যস্তভাবে ফিরা আসে, খৈমন বসেই থাকে, নুরানি বিলকিস আবার তাকে বলে, তুই এমুন ক্যালা?

খৈমন তার হাতের কাপটা একটু আগায়া ধরে বলে, কইলামতো দিয়া দিমু!

নুরানি বিলকিসের খুবই অসহায় লাগে, রাগ হয়, তারপর সে হতাশ হয়া পড়ে, সে বুঝতে পারে যে, সে এই অসভ্য বেহায়া এবং ছোঁচা বেটিরে কোনভাবেই খেদাইতে পারবে না, ফলে সে বলে, আমার গেউ ভাঙ্গায়া দিবি।

খৈমন রাজি হয়, দিমুনে।

নুরানি বিলকিস জিদ করে, না অখনে আগে ভাঙ্গায়া আন, হের বাদে চিনি পাবি।

খৈমন বলে যে, এই দুপুর বেলা গম ভাঙ্গানোর কুল খোলা নাই, বিকালে দোকান খুললে সে গেউ ভাঙ্গায়া দেবে; তখন নুরানি বিলকিসের কিছু করার থাকে না, খৈমনকে চিনি দিতেই হয়। চিনি নিয়া খৈমন ঘরে ফিরা সেদিন দেখে যে, দরজার শিকল নামানো এবং ঘরের ভিতর এক পাল বান্দর কিলবিল করে। বান্দরেরা হয়তো ঘরে ঢুকেছিল কিছু করার জন্য, কলাটা মুলাটা পেলে তারা নিয়া যেত; তখন তারা খৈমনের রান্দা ভাতের হাড়ির খোঁজ পায়, তাকের উপর থেকে হাড়ি নামীয়া ভাত খায়, কিন্তু তখন শিশু চনিমিঞা জেগে উঠে হয়তো চিৎকার জুড়ে দেয়, ফলে বারদের খুবই ঝামেলা হয়, তাদের ভয় হয় যে, চানমিঞার চিৎকারে হয়তো মানুষ এসে যাবে-তখন চানমিঞাকে মাদি বান্দরের দুধ খাওয়ানোর ঘটনা ঘটে। এই চোর বান্দরের দলে হয়তো একটা মা-বান্দরনি ছিল, হয়তো সে খুবই চালক ছিল অথবা সন্তানের মা হওয়ায় তার হয়তো মনটা নরম হয়া ছিল, সে তখন আগায়া যায়া চানমিঞার মুখের মধ্যে তার একটা লোমঅলা বুনি পুরে দেয়, চানমিঞা চুকচুক করে বান্দরের দুধ খায়া ঘুমায়া থাকে। পরে বিকালে খৈমন যখন নুরানি বিলকিসের বাসায় যায় গম ভাঙ্গানোর জন্য তখন সে নিজেই হয়তো এই গল্প করে, বলে, ঘরে যায়া দেখি একপলি বান্দর ঘরের ভিতরে ভাতের হাড়ি নামায়া ভাত খায়, একটা বান্দরের বাচ্চা আমার পোলাটার লগে খেলে; অথবা হয়তো প্রথম দিনই বান্দরেরা শিকল নামায়া ঘরে ঢোকে নাই, খৈমন হয়তো ভুল বলে, অথবা বানায়া বলে, সে যখন নুরানি বিলকিস উপমার বাসা থেকে চিনি নিয়া ফেরে সে হয়তো দেখে, একটাদুইটা কিংবা পাঁচটা বার তার ঘরের কাছে দেওয়ালের উপরে চুপ করে বসে আছে, এর মধ্যে হয়তো বাচ্চাঅলা বান্দরনিটাও ছিল, খৈমন সেদিন দেখে যে, বান্দরনিটার চোখ দুইটা ধূসর ও বিষণ্ণ, হয়তো ছলছল করে, সে জানালার শিকের ভিতর দিয়া ঘরের দিকে তাকায়া আছে। এই বিষয়টা দেখে খৈমনের বুকের ভিতরটা ছ্যাৎ করে ওঠে, সে নিজেকে বলে, কিরে এত্তগুলা বান্দর এইখানে বয়া কি করে, এবং দ্রুত ঘরে ঢুকে দেখে যে, না, চানমিঞা দুই ঠ্যাং দুই দিকে ছড়ায়া দিয়া চিৎ হয়া ঘুমায়; তারপর বিকাল বেলা খৈমন গম ভাঙ্গায়া দেওয়ার জন্য যায় এবং নুরানি বিলকিস তাকে দেখে বলে, এত দেরি কইরা আইলি?

খৈমন বলে, আমারে দুইপট আডা দিবেন!

তার এই কথা শুনে নুরানি বিলকিসের রাগে দম বন্ধ হয়া আসে, সে হাঁসফাঁস করে বলে, তর খাসলত ভালা না, সকালে চিনি দিলাম, কইলি গেট ভাঙ্গায়া দিবি, অখনে কচ দুই পোয়া আটা দেন, তর কিছু করন লাগব না যা!

খৈমন বলে, ফিরায়া দিমুতো, কিন্তু নুরানি বিলকিসের আর কিছু বলতে ইচ্ছা করে না, সে বলে, তুই যা, তর খালি লালচ!

বনগ্রাম লেনে গম ভাঙ্গানোর কলে যায়া খৈমন ৫/৭ সের গম ভাঙ্গায় আনে, নুরানি বিলকিস রবিনসন বার্লির মুখ কাটা একটা মাঝারি সাইজের টিনের পুরানু কৌটা নিয়া এসে বলে, খাড়া মাইপা লই।

খৈমন হাঁটে, বলে, আমি যাই, আপনে মাপেন!

তখন খৈমন তার ঘরের কাছে এসে দেখে যে, দরজায় শিকল তুলে দেওয়া আছে, কিন্তু দেওয়ালের উপর বান্দরেরা চুপ করে বসে; এই বান্দর দেখে খৈমনের পুনরায় বুকের ভিতরে শঙ্কা বাইড়াবাইড়ি করে, কিরে আমি ঘরে না থাকলেই দেখি বান্দর আয়া বয়া থাকে, সে ভাবে, তারপর সে শিকল নামায়া ঘরে ঢুকে দেখে যে, চানমিঞী খেতার উপরে আগের মতই চিৎ হয়া ঘুমায়। তারপরও, বন্দরগুলাকে দেখে প্রথমে খৈমনের তেমন কোন সন্দেহ হয় না, তার কেবল একটু ভয় হয়, হিংস্র জন্তু জানোয়ার, জংলি হয়ওয়াম, যুদি ফাল দিয়া এসে কামড়ায়া দেয়; এবং নুরানি বিলকিস উপমা যখন বলে যে, খৈমনের লালচ বেশি, তখন তা মানাই লাগে, খৈমনের হয়তো এইরকমেরই লোভ, তবে তার কেন এত লালচ তা বলা মুশকিল, হয়তো তার এইসব জন্মগত, হয়তো ছুটুকালে জন্মের পরেই তার এই স্বভাবের বিষয়টা প্রকাশিত হয়া পড়ে, তার মা জরিমনের মোটা পুরু স্ত নের বোটা হয়তো জানোর সাত দশ দিনের মাথায় চুষে চুষে সে ঘাও বানায়া ফালয়, জরিমন হয়তো বলে, এইটা কেমুন মাইয়া হইলো আল্লা, রাক্কোস নিকি!

হয়তো তা না, হয়তো খৈমন ছোট পুটলির মত নিরীহ ফুটফুইটা একটা মেয়েই ছিল; তার বাপ আব্দুল জলিল এবং ভাই রশিদুল তাকে কোলে নিয়া ঘোরে, মাথায় করে নাচে, তারপর সে যখন বড় হয় তারা বলে, তুই বড় হয় গেলি গা, হায় খোদা, অখনে তরে লয়া আমরা কি করি!

খৈমন তখন চুল বান্ধে, সে আব্দুল জলিলের কথা শোনে, সে রশিদুলের কথা শোনে, তারপর হয়তো বলে, যা মনে লয় কর!

আব্দুল জলিল তখন তাকে কোলের ভিতর টেনে নিয়া বলে, তুই আমার মা হচ না?

খৈমনের মনে হয়, আব্দুল জলিলের মাতো সে হয়ই, এবং সে বলে, হইতো!

তারপর সে আরো বড় হয়, তার নিতম্ব প্রশস্ত হয় এবং স্তন উন্নত, এবং তখন আব্দুল জলিল আবার বলে, তুই বড় হয়া গেলি গা মাইয়া, তরে লায়া যে কি করি, কিন্তু এইবার খৈমন কথা বলে না; আব্দুল জলিল হয়তো তাকে পুনরায় কাছে টেনে আনে, দুই কান্ধের উপরে হাত রেখে বলে, তুই আমার মা হচ না? খৈমন আবার চুপ করে থাকে, তখন আব্দুল জলিলের বোধোদয় হয়, রাইতের বেলা সে তার বৌ জরিমনকে বলে, মাইয়া দেখি চুপ মাইরা গেছে, কথা জিগাই, কুনু রী করে না!

তখন জরিমনের পরামর্শে আব্দুল জলিল এবং রশিদুল খৈমনের জন্য। ছেলে খুঁজতে বের হয়, তারা ডাইনে খোজে, বামে খোঁজে, উত্তরে দক্ষিণে খোঁজে, তারপর এত খুঁজে তারা ঠাটারি বাজারে ময়না মিঞাকে পায়। কেউ একজন বলে, হয়তো বাবুল মিঞাই বলে, পোলা এউকগা আছে, সুন্দর, লম্বা, রাজার পোলার মত, বাড়ি বিক্রমপুর উক্রমপুর হইব, ঠাটারি বাজারে দুকান করে, যায়া দেইখা আহগা।

বাবুল মিঞার কথায় আব্দুল জলিলের আগ্রহ হয়, যদিও পোলা দোকানদার; তারপর আব্দুল জলিলের কাছ থেকে শুনে হয়তো জরিমনেরও ভালই লাগে, এবং তখন কোন একদিন রাইতে জরিমন যখন খৈমনকে ময়না মিঞার কথা বলে, খৈমনের দেহে কাঁপুনি ধরে, তার জ্বরের মত লাগে, সে দেখে অরুণ বরুণ কিরণমালা ছবির মত এক সওদাগরপুত্র তার সামনে এসে খাড়ায়, তখন তার চোখ বুজে ঘুম আসে। কিন্তু খৈমনের মনে হয় যে, কোন দোকানদারকে সে বিয়া করবে না, রাজপুত্র হোক, সওদাগরপুত্র হোক, তাও না, সে কোন অফিসের পিয়ন কিংবা দারোয়ান কিংবা কোন স্কুলের দপ্তরিকে বিয়া করবে। তবু তারা একদিন ময়না মিঞাকে দেখতে যায়, সঙ্গে হয়তো বাবুল মিঞা থাকে, তারা ঠাটারি বাজারের বটগাছ পার হয়া কাপ্তান বাজারের দিকে একটু আগায়া গেলে ময়না মিঞাকে পায়, সে ফুটপাতের উপর ঝাকার ভিতরে আলু, পটল এবং বড় সাইজের দুইচাইরদিশটা চুনাঅলা চাল কুমড়া নিয়া খরিদ্দারের জন্য বসে আছে। আব্দুল জলিল বোঝে যে, সে প্রতারিত হয়েছে, ময়না মিঞা ভেসে বেড়াইনা লোক, তার সঙ্গে মেয়ের বিয়া দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না; জরিমনও তার সঙ্গে একমত হয়, সে বলে, বাবুল ভাইয়ে এমুন ঠকবাজি করলো!

কিন্তু তখন খৈমনের মন খারাপ হয়া যায়, সে বুঝতে পারে না যে, এই লোকটাকেই কেন তরকারিঅলা হতে হবে, টুকরিতে করে আর চালকুমড়া নিয়া বাজারে বসে থাকতে হবে ফালতু গ্রাহকের জন্য, ময়না মিঞা কেন তরকারিঅলা না হয় দারোয়ান কিংবা পিয়ন কিংবা স্কুলের দপ্তরি হলো না। তা ভেবে খৈমনের ক্ষুধা মরে যায়, ঘুম কমে আসে, তার ডাগর চোখের কোণ বসে কালা হয়া থাকে। তখন তার মা একদিন দেখে যে, মেয়ের অবস্থা খুব খারাপ, সে বলে, কিরেখৈ কি হইলো তর?

কিন্তু খৈ কোন কথা বলে না, আব্দুল জলিল এবং জরিমন হয়তো বোঝে, তারা বলে, খাড়া না তর লাইগা কত ভাল পোলা আমরা খুঁইজা বাইর করুম! পাত্রের খোঁজে তারা আবার চতুর্দিকে যায়, কিন্তু পানবিড়ি দোকানদার আব্দুল জলিলের মেয়ের জন্য সুপাত্র পাওয়া মুশকিল হয়, অবশেষে পুনরায় বাবুল মিঞা আসে, ঘটকালি বাবুল মিল্লার পেশী না, প্রাণের টানে এইসব করে, সে আব্দুল জলিলকে খুঁজে বের করে খৈমনের বিয়ার আলাপ করে, সে বলে যে, ময়না মিঞা ভাল পোলা, স্বাধীন ব্যবসা করে, খারাপ কি, চালকুমড়া বেচলে কি অসুবিদা, সে চুরিতো করে না, এখন হয়তো চাঙ্গারি নিয়া রাস্তায় বসে, কি দীর্ঘদিন সে নিশ্চয়ই এই জায়গায় বসে থাকবে না, তার নিশ্চয়ই উন্নতি হবে, এক ঝাকায় ত্রিশটা চাল কুমড়া সে যদি সাত/আট টাকায় বেচে, তার হয়তো দিনে দুই টাকা লাভ হবে, নিজের খোরাকি এইসবে সে যদি দিনে আট আনা ব্যয় করে, প্রতিদিন তার সঞ্চয় হবে দেড় টাকা, মাসে পয়তাল্লিশ টাকা এবং এক বছরে পাঁচশ চল্লিশ টাকা-ম্যালা টাকা-তখন বাজার কমিটিকে ঘুষ দিয়া হয়তো শিগগিরই সে ভিতরে তরকারি বাজারের কোন এক চিপায় একটু ঠাঁই করে নেবে, তারপর হয়তো তরকারি বাজারের ভিতর তার একটা স্থায়ী তরকারির দোকানই হয়া যাবে, তারও পরে হয়তো হবে একটা মুদি কিংবা রেশনের দোকান-হইতেই পারে, কে বলতে পারে, কি হবে বা হবে না, জন্ম থেকেই বড়লোক কয়জন? আব্দুল জলিল এই সব কথা শোনে কিন্তু ময়না মিঞার ব্যাপারে তার আগ্রহ দেখা যায় না, তরকারিঅলা তরকারিঅলাই, তার আবার সঞ্চয় কি? হয়তো ফকির একটা; বাবুল মিঞা তখন হুমায়ুন কবিরের কথা বলে, হুমায়ুন কবির দক্ষিণ মৈশুন্দি থাকে এবং শাহসাহেব। লেনে রেশনের দোকান চালায়, পাঞ্চাবিতে সোনার বোতাম পরে, ভাল পোল, খৈমনের লগে ভাল মানাবে। তখন জরিমনের সঙ্গে বিষয়টা আব্দুল জলিল বিস্তারিত ভেবে দেখে, কিসের ভিতরে কি হতে পারে এবং কিসের ভিতরে কি না হতে পারে তা তারা বিশদ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে, তারপর তারা এই বিষয় নিয়া খৈমনের সঙ্গে কথা বলে, শুনে খৈমনের মন কেমন হয়া যায়, তার মনে হয় যে, ময়না মিঞার চাইতে হুমায়ুন কবির সুন্দর নাম, অথবা হয়তো ময়না মিঞাই ভাল—পাখির নামে নাম; কিন্তু হুমায়ুন কবির রেশন দোকানের মালিক হওয়ায় তার মন খারাপ লাগে, সে এই বিষয়টা বুঝতে পারে না যে, তার কাছে কেন তরকারিঅলা, রেশন। দোকানের মালিকেরই খোঁজ আসে! তবু খৈমন তার বাপমায়ের সঙ্গে একদিন দুপুরের পর শাহসাহেব লেনে রেশনের দোকানে হুমায়ুন কবিরকে দেখতে যায়; দল বেন্ধে তাদের আগমনের কারণ হয়তো হুমায়ুন কবির বুঝতে পারে না, সে বলে, আপনেরা কৈখন আইছেন?

আব্দুল জলিল তখন অনেক মিছা কথা বলে, এবং হয়তো সে ধানাইপানাই করে হুমায়ুন কবিরকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়, অথবা হয়তো সে তার চোখে ধূলা দিতে পারে না, হুমায়ুন কবির ব্যাপারটা বুঝে ফেলে; যাইহোক, হুমায়ুন কবির বুঝুক বা না বুঝুক তাদের দেখা তারা দেখে আসে এবং হুমায়ুন কবিরকে তাদের পছন্দ হয় না। রেশন দোকানের মালিক হলেও লোকটার বয়স বেশি, মাথায় চুল কম, এবং খোঁজ নিয়া আব্দুল জন্সিল জানতে পারে যে, হুমায়ুন কবির তৃতীয় বিয়ার জন্য মেয়ের সন্ধানে আছে, তার প্রথম দুই স্ত্রীরই ইন্তেকাল হয়েছে, তবে এই স্ত্রীদের গর্ভে তার কোন সন্তানাদি নাই, সে বিপত্নীক হলেও ঝামেলামুক্ত। বাবুল মিঞা তাকে বোঝায়, খরাপ কি? ফলে আব্দুল জলিল বিষয়টা নিয়া দোনামনা করলেও ও রিমনের মায়ের মন মোচড় খায়, তার এত সোহাগের মাইয়া, সে আবার বলে, বাবুল ভাইয়ে আমাগো লগে এমুন করলো, এমুন একখান পোলা আনলো, বুইড়া দোজবর!

তারপরেও হুমায়ুন কবিরের রেশনের দোকানের মালিক হওয়ার বিষয়টা বড় প্রসঙ্গ হয়া থাকে, তারা এই কথাটা ভুলতে পারে না যে, বিয়া হলে মেয়ে ভালই থাকবে, তখন জরিমন হয়তো এইটা নিয়া খৈমনের সঙ্গে কথা বলে, শুনে খৈমন ধুম মেরে থাকে। একদিন যায়, দুই দিন যায়, পাঁচদিনের দিন জরিমন অস্থির হয়া পড়ে, সে মেয়েকে ডেকে বলে, তুই কতা কচ না ক্যালা?

তখন খৈমন বলে, আমি ময়না মিঞাঁরে বিয়া করুম, ব্যবস্থা করো!

কিন্তু মেয়ে রাজি হলেই এই দেশে একটা মেয়ের বিয়া হয়া যেতে পারে না, এর আগে খৈমন তার বাপমা ভাইকে নিয়া যায়া ময়না মিঞাকে দেখে এসেছে, এবার ময়না মিঞা তাকে দেখতে আসে ভূতের গল্লিতে তাদের বাসায়। ময়না মিঞা ৩৬নম্বর ভূতের গল্লিতে তাদের দুই কামরার বাসায় এক বিকালে এসে হাজির হয়, সে একা আসে, অথবা সঙ্গে হয়তো ঘটক বাবুল মিঞা ছিল; তখন সেদিন সন্ধ্যায় শাড়ি পরা ঘোমটা দেওয়া খৈমন বেগম বাইরের ঘরে এসে কাঠের খালি একটা টুলের উপর বসে, হারিকেন বাতির আলোয় ঘোমটার ফাঁক দিয়া ময়না মিঞাকে খুঁটায়া দেখে এবং তার আফসোসের সীমা থাকে না। ময়না মিঞা কালা, কিন্তু তার খাড়া নাক, পানিতে চুবাইনা দুইটী তরল পাথরের মত চোখ এবং হাতের পাকানো পেশি; খৈমনের পুনরায় মনে হয় যে, এই লোকটা তরকারি বেচে, রাস্তার উপরে ভোদার মত চালকুমড়া নিয়া বসে থাকে, আশ্চর্য! রাইতের বেলা ময়না মিঞার তরুণ অঙ্গের কথা খৈমনের বিশদ মনে পড়ে, তার নিদ্রাহীনতা খারাপের দিকে যায়, তখন জরিমল এবং আব্দুল জলিল আশা করতে থাকে যে, ময়না মিঞার মতামত তারা শিগগির জানতে পারবে, কিন্তু ময়না মিঞা কিছু বলে না, তার কি খৈমনকে পছন্দ হয় নাই, সে কি হারায় গেল? আব্দুল জলিল যায়া বাবুল মিঞাকে ধরে, বাবুল ভাই, কিছুতে কইলা না আর!

০২. নুরানি বিলকিস ফিরা যায়

নুরানি বিলকিস ফিরা যায়, কি করবে ফিরা না যায়, পোলার মার কোন গরজ নাই, সেতো কোথাকার কোন খালা; কি তার শান্তি লাগে না, তার মনে হয় দীর্ঘ সময় ধরে সে কাছেই কোথাও একটা মানুষের বাচ্চার কান্দার শব্দ শুনতে পায়, তার মনে হয় যে, এইটা চানমিঞাই হবে, তার মা খৈমন হয়তো মিছা কথা বলে, আহারে পোলাটা, হয়তো বান্দরেরা তাকে মাঝেমধ্যেই নিয়া যায়, পালে, তাতে ক্ষতি নাই ভেবে খৈমনও নিশ্চিন্তে ঘুমায়! মিসেস জোবেদা রহমান বন্দরের বাসায় মানুষের পোলার কান্দার শব্দ হয়তো শোনে না, তার প্রয়োজন হয় না, কারণ এইসব বিষয় একজন শুনতে পাওয়াই কি যথেষ্ট না? ফলে সে বলে যে, যে পোলার মা তার পোলারে বান্দরের দুদ খাইতে দেয়, বান্দরে যুদি সেই পোলা নিয়া যায় পালে তাহলে অবাক হওয়ার কি আছে? অবাক হওয়ার কিছু নাই, এইটা খুবই সম্ভব; ফখরুল আলম লেদুকে সে হয়তো বলে, বান্দরের দুদতো খাইছেই, বান্দরে অরে লয়া গেছিল গা!

ফখরুল আলম লেদুর বিশ্বাস হয় না, তবু তার মনে হয় যে, হইতে পারে, পারবে না কেন? কারণ লেদুর মনে পড়ে যে, সিলভারডেল কেজি স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর সাদা সার্ট, মেরুন কালারের হাফ প্যান্ট আর টাই এবং বাটার টিবয় জুতা পরে প্রথম যেদিন স্কুলে যায় সে দেখতে পায় যে, তাদের কেজি ওয়ানে ভূতের গল্লির আরো দুইজন আছে, এদের একজন মামুন, তার খুব প্রিয় বন্ধু, এবং অন্যজন চানমিঞা, যার সঙ্গে সম্পর্কের ধরনটাই সে কোন দিন বুঝতে পারে না। লেন্দু যখন মামুনের মার কথা শোনে চানমিঞার কথা তার মনে পড়ে, তখন তার মনে হয়, চানমিঞা বান্দরের দুধ খাওয়া পোলা হতে পারে, কারণ তার মনে পড়ে যে, মানুষের এমন এলোমেলো পোলা সে দেখে নাই। হয়তো মিসেস জোবেদা রহমান যে কথা বলে চানমিঞার তা জানা ছিল, সে হয়তো খৈমুনের ঘরে বাস করে বান্দরের দুধ খায়া বড় হতে থাকে, তারপর তার বয়স যখন তিন কিংবা চাইর হয় তখন কেউ হয়তো প্রথম তাকে বলে, তুই বান্দরের দুদ খাছ, তুই কি বান্দর? ফলে তখন, সেইদিন, জীবনে প্রথম তার শিশু মন বিভ্রান্ত হয়া পড়ে, হয়তো মানুষের সঙ্গে থেকে বান্দরের দুধ খাওয়ার জন্য তার লজ্জা এবং ভয় হয়, অথবা হয় বান্দরের দুধ খায়া মানুষের সঙ্গে থাকার জন্য-পরে হয়তো সেজন্য সে বান্দরদের কাছেই ফিরা যায়। কিন্তু ফখরুল আলম লেদু যত মোটা এবং তার সামনের দাঁত যত উঁচাই হোক, অথবা তাকে যত সোজা কিসিমেরই লাগুক, সে মোটেই ভোন্দা না, সেই কারণে পরে মামুনের মা তাকে যখন একদিন বলে, মামুন বাড়ি নাই, লেদু, তখন বলধা গার্ডেন পার হয়া নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে মেরি টিচারের বাসায় যায় হাজির হয়, জুলি ফ্লোরেন্স দরজা খুলে দিয়া বলে, হু লেদু ভাই, গুড যে আপনে আসছেন, ইয়োর ফ্রেন্ড ইজ ওয়েটিং ফর ইউ।

তখন সিঁড়ি দিয়া জুলির পিছন পিছন লেদু দোতলার ফ্লাটে এসে দেখে, মামুনুল হাই দেওয়ালের ছবির দিকে তাকায়া আছে; সে লেদুকে দেখে এবং জুলিকে বলে, জুলি এইটা কি মসজিদ?

বালিকা-কিশোরি জুলি হয়তো একটা লাল এক কালারের জামা পরে ছিল, সে মামুনের কথা শুনে বলে, ইটস নট এ মস্ক, ইটস এ চার্চ।

: এইটা কোথায়?

: ভ্যাটিকানে, রোমে।

: রোম কোথায়?

তখন ঘরের ভিতরে জগদ্দল লেদুকে নিয়া এইসব কথা কি আর আগায়? আগায় না, মামুনুল হাইয়ের খুব খারাপ লাগে, তার মনে হয় যে, . লেদুটা ভোন্দাই, বাবা তুই যখন জানিস যে আমি আসছি টিচারের বাসায়, তর জেনে শুনে আসার দরকার কি, আমারে একা থাকতে দে, আমার মত কইরা কথা কইতে দে, তারপর তুই অন্য একদিন আয়, কথা ক তর মত কইরা; কিন্তু তা না, সে আইসা আমার কাবাবের মধ্যে একটা মোটা লেদু হয়া থাকবে। কিন্তু লেদু এত কিছু বোঝে না, দুই জনে মিলা জুলিকে দেখলে ক্ষতি কি? সে তার বিরাট মোটা একটা হাত জুলির মাথার উপরে রেখে বলে, টিচার কৈ, কি করে? ডাক না।

জুলি ফ্লোরেন্স হয়তো যায় তার মাকে ডেকে আনে, মিসেস মেরি জয়েস ক্লার্ক ভিতরের ঘর থেকে বের হয়া এসে বাইরের রুমে বসে, চোখের চশমা খুলে নিয়া তাদের দিকে তাকায়, তার মুখের পেশি শিথিল এবং চুলের একটা অংশ সাদা হয়া গেছে; তখন হয়তো ছেলেদের দিকে তাকায়া সে ক্লান্তভাবে হাসে, লেদুকে বলে, ফখরুল কেমন আছ তুমি, ডুয়িং ওয়েল? হয়তো মামুনকে বলে, মামুন মিঞা তুমার কি খবর?

তার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকায়া লেদুর হয়তো কইলজী দুই ভাগ হয়া যেতে থাকে, আপনে কেন এমন হয়া যাইতাছেন টিচার, আপনে কত যে সুন্দর আছিলেন-কি সে এসব কিছু বলে না, কেবল তাকায়া থাকে-তারপর সে বলে, ভাল আছি টিচার, মামুন বলে, ভাল আছি টিচার; অথবা জুলি হয়তো তার মাকে ডেকেই আনে না, কারণ তার ক্লান্ত মা হয়তো তখন ঘুমায় অথবা ঘুমায় না, চুপ করে বসে থেকে বিড়বিড়ায়, কিন্তু জুলি বলে, মম ইজ ব্লিপিং।

তখন লেদু তার ভারি একখানি হাত পুনরায় জুলির কান্ধের উপরে রাখে, কিন্তু এত হালকা করে রাখে যে জুলির মনে হয় একটা টিয়া পাখির হয়া থাকবে কি সে তার কবরভাক না কে ডেকে আনে বসে, চোখে পালক বুঝি তার কান্ধের উপর খসে পড়লো এবং সে লেদুর দিকে তাকায়, লেদু বলে, আমাগো চা খাওয়াও, আমরা ছিলাম টিচারের সব থেইকা প্রিয় ছাত্র, চায়ের সঙ্গে বিস্কুট দিও আমাদের!

জুলি ফ্লোরেন্স আপ্যায়নের জন্য একদম ব্যস্ত হয় না, ঘরে বিস্কুট টিস্কুট হয়তো নাই-ও, সে তার মার এই দুই প্রাক্তন ছাত্রের কাছ থেকে একটু দূরে বসে থাকে এবং তারপর হঠাৎ কেন যেন বলে, মম লাইকড দা মাঙ্কি বয় মোষ্ট, হোয়্যার ইজ হি? হয়তো লেদুর মনে হয় যে, এই মাইয়াটা মাঙ্কি বয়কে এত খোঁজে কেন? ক্যালা? তখন খৈমনের পোলার নামকরণের প্রসঙ্গটা এসে যায়, কারণ একাত্নর সনে জিঞ্জিরা থেকে পাকিস্তানি মিলিটারির ধাওয়া খায়া ফিরা আসার পর জুন/জুলাই কিংবা আগস্ট মাসে গৈমনের সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় হয়, মনে হতে থাকে তার পেট ছিঁড়া ভূড়ি খসে পড়বে, তার পায়ের পাতায় পানি জমে ফুলে ওঠে, কিন্তু আব্দুল জলিল বলে, অখনেই হইবো, আর দেরি করা পারে না কয়েকদিন? জরিমন বলে, অখনেই না, দেরি কর কয়েকদিন। কিন্তু খৈমনের শরীরেরতো আর দেরি সয় না, রাজাকার সর্দার আব্দুল গনি হয়তো সকালে কিংবা বিকালে আসে, জিগাস করে, কি ময়না মিঞা, তুমার বৌ বিয়ায় না ক্যান?

ময়না মিঞা বলে, এই কথা ক্যান জিগান?

: না, এমনেই জিগাস করি!

তখন আব্দুল জলিলের পুরা পরিবার আতঙ্কের মধ্যে পরে এবং চানমিঞার নাম বিজয় মিঞা কিংবা স্বাধীন আলি হয়া যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, যদিও ময়না মিঞা সেই সম্ভাবনা আগেই নষ্ট করে রাখে, কিন্তু রাজাকারদেরতো সেটা জানা থাকে না, ফলে তারা বগলের মধ্যে লাঠি চেপে ধরে মহল্লায় হাঁটাহাঁটি করে, তাদের কাজ হয় মহল্লার লোকের খোঁজখবর নেওয়া; তারা তখন একদিন আব্দুল জলিলের বাসায় যায় হাজির হয়, তাদের দেখে জরিমন ঘর থেকে বের হয়া বারান্দায় এসে খাড়ায়, এবং খৈমন হয়তো ঘরের ভিতর বসে জানালা দিয়া রাজাকারদের দিকে তাকায়া থাকে, কারণ খৈমনতো খৈমনই, গর্ভের ভারে যতই সে কাবু হোক তার মনে হয় যে, তার মার দিকে লক্ষ রাখা দরকার যদিও তার নিজের বের হয়া আসতে সঙ্কোচ কিংবা ভয়ও হয়তখন আব্দুল গনি জরিমনের সঙ্গে কথা বলার সময় ঘাড় ফিরায়া জানালার ফাঁক দিয়া খৈমনকে দেখে। খৈমন ঘরের ভিতর বসে থাকায় আব্দুল গনি তার পুরা অবয়ব দেখতে পায় না, কেবল মুখটা দেখে, তখনো হয়তো খৈমনের মুখ ফুলে ওঠা শুরু করে নাই, তার ফরসা এবং শ্যামলার মাঝামাঝি রঙের এই মুখটা দেখে রাজাকার আব্দুল গনি হয়তো বিচলিত হয়, এবং মিসেস জোবেদা বেগম যেমন বলে যে, খৈমন হচ্ছে ধুরন্ধর দি গ্রেট, ফলে সে অবশ্যই জানালার পাশে বসে থেকে আব্দুল গনির চোখের ভাষা পড়ে-পুরুষের চোখের ভাষা পড়তে পারে না কোন নারী? মানুষ খুন করা ছাড়াও দেশে পাকিস্তানি মিলিটারি আর কি করে বেড়ায় তার খবর আব্দুল গনির কাছে ছিল, তার মনে হয় যে, মহল্লায় শিগগিরই পাকিস্তানি মিলিটারি আসবে, বাড়ি বাড়ি ঘুরবে, ঘর পোড়াবে, তারপর যা করার করবে, এবং এই মহল্লায় কয়েক দিন ঘুরে আব্দুল গনির হঠাৎ মনে হয় যে, জানালার পাশে বসে থাকা মায়াইলোকটার কোন উপায় নাই! তখন রশিদুলের কথা আব্দুল গনি জানতে পারে, সে জানতে পারে যে, বুড়িটা তাকে মিথ্যা কথা বলেছে, এই বাড়ি থেকে অবশ্যই কেউ মুক্তিযুদ্ধে গেছে, কারণ মানুষের হিসাব করলেই দেখা যাবে যে একজন মানুষ কম, সেই একজন কোথায়? না, মুক্তিযুদ্ধে! আব্দুল গনি আবার তার দল নিয়া খৈমনদের বাসার উঠানে এসে খাড়ায়, জরিমনের কোন উপায় থাকে না।

: আপনের পোলার নাম কি?

: রশিদুল।

তখন খৈমনকেও অবশ্যই জানালার পাশে দেখা যায়, হয়তো সে কাছেই মজুদ ছিল, আব্দুল গনি যখন রশিদুলের কথা বলে সে হয়তো ভাবে যে, জানলার কাছে যায়া ইকটু বহি-কিন্তু এই খেলা মারাত্মকই ছিল। কারণ, খৈমনকে দেখা মাত্র আব্দুল গনি তার কথা ঘুরায়, রশিদুলের প্রসঙ্গ ছেড়ে জরিমনকে জিগাস করে, আপনের মাইয়ার নাম কি?

: খৈমন।

আব্দুল গনির মনে হয় যে, খৈমন ইচ্ছা করে এসে জানালার পাশে বসে থাকে, চেহারা দেখায়, ফলে আব্দুল গনির সাহস বাড়ে সে বলে, আপনের মাইয়ারে ডাকেন, কথা জিগাই।

খৈমন নিশ্চয়ই সব শোনে, সে জানালার ভিতর থেকেই বলে, কি বলতে চান বলেন, এবং আব্দুল গনি হয়তো বিচলিত হয়া পড়ে, সে বলে, আপনের নাম খৈমন?

: আমার মায় আমার নাম কয় নাইকা আপনেরে? আপনে কি বয়রা, হুনেন না কানে?

আব্দুল গনি ঘাবড়ায়া যায়।

: কইছে, তবু জিগাইলাম।

রাজাকার আব্দুল গনির তার দলের সামনে আর ইজ্জত থাকে না, সে চেষ্টা করে কোনভাবে সেটা বাঁচায় চলে আসতে, ফলে তাকে আরো কিছু বাড়তি কথা বলতেই হয়, সে বলে, আপনের ভাই তাইলে নবাবগঞ্জে আপনের খালার বাইতে গেছে? নবাবগঞ্জ, এই জিঞ্জিরার পরেইতো?

: হঁ।

: আপনের খালা কি আপন খালা?

: হ, আপন।

আব্দুল গনি তার দল নিয়া ফিরা আসে, তারপর খৈমনের সঙ্গে সাক্ষাতের খবর আবু বকর মওলানার কানেও যায়, সে আব্দুল গনিকে সেইদিন অথবা পরদিন বাসায় ডেকে পাঠায় এবং তখন আব্দুল গনির মনের ভিতরে হয়তো একটা নারীর মুখ জেগে থাকে, সে যখন মওলানা আবু বকরকে বলে যে, ভূতের গল্লির মানুষরা অত খারাপ বলে মনে হয় না, তারা ভালই, সে কি তখন খৈমনের কথা চিন্তা করেই এই কথা বলে না? হয়তোবা, এবং সে হয়তো তার রাজাকার বাহিনীকেও এই কথা বোঝায় যে, লোক এরা খারাপ না, খামাখা ঝামেলা করে লাভ কি? এবং তার রাজাকার বাহিনীর বুদ্ধিমান সদস্যরা বিষয়টা হয়তো মেনে নেয়, কিন্তু জুলি ফ্লোরেন্স যখন মাবিয় কোথায় জানতে চায়, জুলি কার কথা বলে ফখরুল আলম লেদু বোঝে, মামুনুল হাইও, তবু তারা দুইজন তাদের মুখ কেমন বেঁকা করে রাখে; তারপর মামুন বলে, কি জানি-লস্ট পারহ্যাপস।

তখন লেদু ভেবে দেখে, হয়তো সত্যি সে জানে না, এক মহল্লায়। থাকলেও চানমিঞার সঙ্গে তার বহুদিন দেখা নাই-বান্দরের দুধ খাওয়া পোল সে! অথবা লেদুর মনে হয়, এইটা ঠিক না, কিন্তু তথাপি সে জানে যে, বান্দরের দুধ হয়তো চানমিঞা ঠিকই খেয়েছিল, কারণ সে কি মাঙ্কিবয় ছিল না? শিশুকাল থেকে হয়তো এই কথা চানমিঞার নিজেরও জানা ছিল, ফলে সে ছিল বিভ্রান্ত, ক্রমে হয়তো তার কথা অন্য সকলে জেনে যায়, এমন কি তাদের কেজি ওয়ানের টিচার মিসেস ক্লার্ক পর্যন্ত। সে কারণে চানমিঞার জন্য মিসেস ক্লার্কের হয়তো বিশেষ এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়, মমতা জন্মে, হয়তো ভাবে, পুওর চাইল্ড, কারণ লেদুর মনে হয় যে, এই মহিলা ছিল শুধুই ভালবাসার আধার; তখন ছবির মত সুন্দরী এই মহিলার সঙ্গে একদিন তারা ক্লাসের সকল পোলাপান বলধা গার্ডেনে বেড়াতে যায়-ক্লাস পিকনিকে-এবং বলধা গার্ডেনের ভিতরে পানির চৌবাচ্চার কাছে গেলে বদমাইশ পোলাপান চানমিঞাকে বলে, পানিতে তাকাইলে দেখবা একটা বান্দর চায়া আছে।

ফলে চানমিঞা ভয়ে অথবা অন্য কোন কারণে চৌবাচ্চার কাছে যায় শক্ত হয় থাকে, পানির দিকে তাকায় না–তখন ঢাকা শহরে হয়তো কেবল এইখানে, বলধা গার্ডেনে, গোল্ড ফিস ছিল-টিচার যখন তাকে বলে, দেখ চানমিঞা গোল্ড ফিস, তখন চনিমিঞাকে বিহ্বল লাগে, সে মুখ আকাশের দিকে উঁচা করে রাখে, তার জীবনের প্রথম গোল্ড ফিস দেখা হয় না। তখন কয়েকটা ছেলে তাকে জোর করার চেষ্টা করলে চানমিঞা তীক্ষ তীব্র একটা আর্তচিৎকার করে চৌবাচ্চার কাছ থেকে সরে যায় প্রাঙ্গণ প্রাচিরের সঙ্গে নিজেকে ঠেসে ধরে রাখে এবং তখন মেরি জয়েস তার হৃদয়কে মেলে দেয়, সে আগায়া যায় এই পুচি বালক চানমিঞার মুখ তার দুই হাতের জড়ো করা করতলের ভিতরে নেয় এবং বলে, ও মাই বয়, ওকে ওকে! তবে শিশু অথবা বালক চানমিঞাকে তার মা খৈমন কি মনে করে সিলভারডেল স্কুলে ভর্তি করে তা লোকে বোঝে না, মনে হয় যে, সে হয়তো কাজটা দেখাদেখিই করে, অথবা হয়তো হিসাব তার একটা ছিলই; মাসে পঁচিশ টাকা বেতনের স্কুলে ছেলে পড়ানোর অবস্থা খৈমনের ছিল না নিশ্চয়ই, সে চানমিঞাকে নারিন্দা সরকারি ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দিতে পারতো, তা না দিল সিলভারডেলে-এই বাড়াবাড়ির ব্যাখ্যা কি? পরে মিসেস জোবেদা রহমান বলে যে, খৈমনের হিসাবতো ছিলই, কারণ সে এমন সেয়ানা এক মাইয়ালোক চালাকি ছাড়া যে কুটাখন ছিঁড়া দুইভাগ করে না, এবং তার প্রমাণ যে পাওয়া যায় নাই তাও না। কেজি ওয়ানের টিচার মেরি জয়েসের সঙ্গে বলধা গার্ডেনে ক্লাস পিকনিকে গেলে চানমিঞাকে মেরি জয়েস আবিষ্কার করে, চানমিঞা যখন ভয় অথবা অন্য কোন আবেগের দ্বারা তাড়িত হয়া দেওয়ালের সঙ্গে পিঠ লাগায়া খাড়ায়া থাকে তখন মেরি এই শিশু বালকের ভীত কিন্তু একই সঙ্গে তীঃ ও উজ্জ্বল হয়া ওঠা চোখের দিকে তাকায়া বিচলিত হয়, এবং সে যখন তার মুখটা অঞ্জলি ভরে গ্রহণ করে বলে, ভয় কি বাবু, চানমিঞা কান্দতে থাকে, সেদিন তার চোখের উত্তপ্ত অশ্রুতে মেরি জয়েসের করতল শিক্ত হয়।

বাবু, অর্থাৎ চানমিঞার জানা ছিল না কি ভয়, কারণ সে তখন নিতান্তই শিশু ছিল, তার শরীর ছিল সদ্য অঙ্কুরিত বৃক্ষ পল্লবের মত হাল্কা ও স্নিগ্ধ এবং ভঙ্গুর, মন ছিল নতুন কাটা পুকুরের মত খোলা, টলটলে এবং আগাছাহীন। কিন্তু সে হয়তো দ্রুত শিখে ফেলে সমাজ এবং সংসারের রহস্য ও ভাষা, ফলে তার মনের পানির গভীরে সহসা কাঁটা গুল্ম জলে, পাড়ের জীবনের ছায়া এসে পড়ে-তা না হলে বলধা গার্ডেনে তার আচরণের ব্যাখ্যা কি? মিসেস জোবেদা রহমান হয়তো এই ঘটনার কথা জানে, হয়তো মামুন তাকে বলেছিল, ফলে অনেক পরে একদিন, মামুন এবং ফখরুল আলম লেদু যখন সেন্ট যোসেফ অথবা সেন্ট গ্রেগরিজে পড়ে মিসেস জোবেদা রহমান বলে যে, চানমিঞার এসব চালাকি ছিল, তার মাও কি খুব বেশি চালাক না? তাহলে তার ছেলের চালাক হতে অসুবিধা কোথায়! মিসেস জোবেদী রহমানের যুক্তি হচ্ছে খৈমন এইসকল চালাকি করে মেরি জয়েসকে পটানোর জন্য, যদিও হয়তো সে এই কাজে পুরাপুরি সফল হয় না; কারণ মেরি জয়েসতো বান্দর না যে সারাদিন অন্যের পোলাকে আদর যত্ন দিয়া দেখে রাখবে, খাওয়াবে পরাবে, কিন্তু তারপরেও সে হয়তো তার প্রকৃতিগত কারণে কিছুটা কাবু ইয়া পড়ে বাচ্চাঅলা বান্দরনিটার মত। এর কারণ কি তা বোঝা মুশকিল, খালি একটা বাচ্চা সুন্দর হলেই কেউ আদর করে না, পৃথিবীতে সুন্দর বাচ্চার অভাব নাই, মামুনও হয়তো সুন্দর, তার মা তাই বলে, লেদুকেও হয়তো ছুটুকালে সুন্দরই লাগতো; ক্লাসের পনের/বিশটা বাচ্চার ভিতর সব রেখে কোথাকার মোছা: খৈমনের পোলা চানমিঞাকে নিয়া মেরি জয়েস আকুল হয়া পড়লো-এইটা হয় না। চানমিঞার সৌন্দর্যের রহস্যটাই বা কি? মিসেস জোবেদা রহমান বলে যে, এর পিছনে আছে খৈমনের বদমাইশি-ই, রাস্তায় পড়ে থাকা এক তরকারিঅলাকে দেখে তার সৌন্দর্যে সে মজে গেল, এবং দুইজনে মিলা এক খেলা খেললো, বিয়ার রাইতে সে পানি ঢেলে তরকারিঅলা ময়না মিঞার সম্পত্তির দলিল নষ্ট করে দিল; ময়না মিঞা যখন কান্দে সে তাকে বোঝায় যে, আরেকটা কাগজ পরে লিখা দেওয়া যাবে। কিন্তু খৈমনকে ময়না মিঞা চেনে নাই, এই পরেটা আর আসে না, আসে নাতো আসেই না, সে খৈমনকে চাপাচাপি করে, তুমার বাপরে কও আর একটা কাগজ লেইখা দেওনের লাইগা।

খৈমন বলে, কমু, এত হুড়াহুড়ি করেন ক্যালা?

খৈমনে এই কথা শুনে ময়না মিঞা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর সে যখন বলে, আমার সঙ্গে চালাকি করলে মরবা, খৈম হয়তো ভয় পায়, কারণ গ্রামের এই লোকদের সম্পর্কে তার ধারণা কম, সে তার স্বামীর দিকে তাকায়া থাকে, তার লম্বা শরীর কালা কিন্তু চকচইকা, শহরের লোকদের শরীর এইরকম না, শহরের সাদা লোকগুলা সাদা না, কালা লোকগুলা কালা না; কি এই কালা তরকারিঅলা লোকটা কালাই ছিল এবং সে ছিল সুন্দর-তখন তার মন নরম হয়া আসে, সে বলে, চিন্তা কইরেন না, পাইবেন! অথবা হয়তো খৈমনের মনে অন্য কিছু ছিল, তবু ময়না মিঞার মনে হয় যে, খৈমন হয়তো মিথ্যা বলে না, কিন্তু বিয়ার আগে কুত্তা লেয়া দেওয়ার ঘটনাও সে ভুলতে পারে না, এবং খৈমন যতই অস্বীকার করুক সে বোঝে খৈমন বদমাইশি জানে; কারণ, যেদিন সে বাবুল মিঞাকে বলে, যান বিয়া ঠিক করেন, তার পরদিন সে ঠাটারি বাজারে তার নির্ধারিত জায়গায়, দোকান না বসায়া মাথায় তরকারির আঁকা নিয়া ভূতের গল্লিতে যায় তরকারি ফেরি করার জন্য, তখন তার মাথায় একটা ফন্দি ছিল, সে ভূতের গল্লির রাস্তায় যায় চিৎকার করে, তরকারি তরকারি, এই তরকারি!

বাড়ির মহিলারা তাকে ডাকে, এই কি তরকারি, চিচিংগা আছে?

ময়না মিঞার কাছে চিচিংগী নাই, সে আগায়; তখন হয়তো বাঘঅলা বাড়ি থেকে পারভিন সুলতানা বের হয় তাকে ডাক দেয়, এই তরকারিঅলা, পাপী আছে?

তার কাছে পেঁপেও নাই, সে আবার হাঁটে, তরকারি তরকারি, বলে চেচায়; তখন শওকতের বইন জহুরা আসে, এই তরকারি, এদিকে আসো।

ময়না মিঞা আসে না, সে হাঁটে, জহুরা হয়তো ভাবে তার বয়স কম। বলে তরকারিঅলা তাকে পাত্তা দেয় না! ময়না মিঞা তখন রাস্তায় টুলু বুলু এবং দুলালকে পায়, সে তাদের চিনতে পারে, তারা গল্লির ভিতরে ব্রিং কিংবা ডাণ্ডাগুল্লি খেলে; ময়না মিঞা এক দান খেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে টুলু অথবা বুলু অথবা দুলালকে বলে, তুমরা নতুন মানুষ পাইলে কুত্তা ছুঁয়ায়া দেও, নাকি?

ক্রিড়ারত পোলাপানগুলা তার কথায় অবাক হয়, বুঝতে পারে না এই লোকটা কি বলে, তারপর তাদের হয়তো ঘটনাটা মনে পড়ে এবং তারা বলে, একদিন দুয়াইছিলাম, একজনে কইছিল ছুঁয়াইতে!

: কে বলছিল?

: খৈমনে।

: বদমাইশ মায়ালোক!

বালকেরা ভাবে, তাদের মনে হয় যে, খৈমন অবশ্যই বদমাইশ, তবে হয়তো পুরাপুরি না; ময়না মিঞা বাসর রাইতে খৈমনকে যখন কুত্তা চুয়ানোর কথা বলে, খৈমনের মনে হয় যে, লোকটা আন্দাজে ঢিল মারে, কি তারপর ময়না মিঞা হয়তো একটু বেশি বলে ফেলে, কারণ, খৈমনও খৈমনই ছিল, ফলে অর্ধেক বাড়ি লিখা দেওয়া দলিল তার হাত ছাড়া হয়া যায়, এবং আর কোন দিন সে এর নাগাল পায় না; তবে খৈমনের গর্ভে জন্মানো ছেলের নাম সে তার পছন্দ মত চানমিঞা রাখতে পারে, খৈমন মেনে নেয়। মিসেস জোবেদা রহমান যখন এই মোছা: খৈমনের কথা বলে তার নাকটা কুঁচকায়া থাকে, ঘৃণায় না কিসে, বোঝা যায় না, তবে খৈমনকে সে দেখতে পারে না এ বিষয়ে ফখরুল আলম লেদুর কোন সন্দেহ নাই। প্রথমে হয়তো ঘৃণার এই বিষয়টা অপ্রকাশিত থাকে, কারণ ২৫নম্বর বাড়ির লোকের সঙ্গে ৩৬নম্বর বাড়ির লোকের ঝগড়া লেগে থাকার কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ পাওয়া মুশকিল হয়, হিসাব মত খৈমনের ঝগড়া থাকা উচিত ছিল ৩৭নম্বর বাড়ির নুরানি বেগম উপমা কিংবা ৩৫নম্বর বাড়ির রাজিয়া বানুর সঙ্গে, কিংবা স্বাধীনতার পরেই তাদের বাড়ি বেদখল করে যারা দুইভাগ করেছিল, সেই ৩৫/১ এর শারমিন ইয়াসমিনের সঙ্গে, তা না এতগুলা বাড়ি ডিঙ্গায়া মিসেস জোবেদা রহমানের সঙ্গে খৈমনের সম্পর্ক খারাপ হয়া গেল, আশ্চর্য, কিংবা হয়তো আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই, কারণ সংসারে কে কাকে ভালবাসবে বা ঘৃণা করবে তার বস্তুত হয়তো কোন সূত্র থাকে না। মিসেস জোবেদা রহমান যখন বাংলাবাজার স্কুলে লেখাপড়া করতো তখন সে মসজিদের গল্লিতে তার বাপের ৬২নম্বর বাসায় থাকতো, তখনই হয়তো খৈমনের ব্যাপারে তার বিষ্ণা দেখা দেয়, যদিও জীবনের প্রায় সব কিছু তার পক্ষেই ছিল। খৈমনদের বাড়িটা ছিল মহল্লায় সব চাইতে ছোট এবং জরাজীর্ণ, খালবালা ওঠানো, তার বাপ ছিল একটা মুখ পানবিড়ি দোকানদার, মা নেহায়েত মাতারি, ভাই অপদার্থ গুণ্ডা, সে লেখাপড়া বলতে কিছু করে নাই, তারপর তার বিয়া হয় এক তরকারিঅলার সঙ্গে। মিসেস জোবেদা রহমানের এইসব বিষয়ে অবস্থা ভালই ছিল, সে বাংলাবাজার গার্লস হাই স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত লেখাপড়া করা মহিলা, ফিরোজা রঙের ইউনিফর্ম পরে সে মহল্লার মানুষের সামনে দিয়া যাতায়াত করতো, মহল্লার মানুষ এর সাক্ষী, তার বিয়াও হয় মহল্লাতেই, তার বাপের ছিল বিস্কুটের কারখানী এবং শশুরের দোলাইখালে লোহালক্কড়ের দোকান, তার স্বামী গোলাম রহমান সলিমুল্লা কলেজের আইএ পাশ, কলতাবাজার খাদ্যগুদামের কেরানি-কোন দিক দিয়াই সে খারাপ ছিল না, তারপরেও খৈমনের সঙ্গেই তার লাইগা যায়। হয়তো বিয়ার আগেই এর শুরু, হয়তো কোন একদিন-যখন দোলাই খাল একটা খালই ছিল, নৌকা দিয়া গুয়ের মত পানি পার হয়া রায়সা বাজার কিংবা পাতলা খান লেনের দিকে যাওয়া যেত—জোবেদা বেগম তার স্কুলে যাচ্ছিল; সে যখন লালমোহন সাহা স্ট্রিটের কাছের গুদারী ঘাটে পৌছায় তখন এপাড়ের ঘাটে সোয়ারিতে ভরা একটা ডিঙ্গি নৌকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল, এই সময় জোবেদা বেগম দৌড়ায়া যায় নৌকায় উঠে পড়ে, ফলে নৌকা টলমল করে ওঠে, খেয়ার মাঝি তাকে ধমকায় এবং নেমে যেতে বলে। জোবেদা বেগমের হয়তো সেদিন পরীক্ষা ছিল, দেরি হলে হয়তো ঝামেলা হয়া যেত, “তাই সে নৌকা থেকে নামতে অস্বীকার করে, কিন্তু নৌকাটা এমনিতেই অতিবোঝাই থাকায় মাঝি কোনভাবেই তাকে নিতে রাজি হয় না; তখন জোবেদা বেগম ভিড়ের মধ্যে খৈমনকে দেখে, খৈমন কোথাও যাচ্ছিল, তার তাড়া ছিল কিনা বোঝা যায় না, কিন্তু জোবেদা নিশ্চয়ই ভাবে যে স্কুলে না যাওয়া বেকার মেয়ের আবার তাড়া কি, সে অনায়াসে পরের নৌকায় আসতে পারে, তার পরেরটায় আসলেই বা কি অসুবিধা! কিন্তু খৈমন তা মানবে কেন? জোবেদা বেগম যখন তাকে নেমে যেতে বলে সে রাজি হয় না, সে বলে, ক্যালা?

: পরে আয় ছেমড়ি, যা নাম, আমার স্কুলে যাওন লাগব!

খৈমন তখন ক্ষেপা ষাড়ের মত জোবেদা বেগমের উপর ঝাপায়া পড়ে, দুইজনের মারামারিতে নৌকা কাইত হয়া যায়, ফলে সব সোয়ারি যায়া পড়ে পচা পানিতে; তখন বোঝা যায় যে জোবেদা বেগমের খুব জরুরি তাড়া হয়তো ছিল না, কারণ সেদিন পানিতে ভিজা তারা দুইজন হেঁটে হেঁটে ঘরে ফেলে। তবুও হয়তো জোবেদা বেগম বিষয়টা মেনে নেয়, খৈমন বয়সে ছুটু বলে পরে, হয়তো সে ঝগড়া মিটায়া ফেলতে চায়, রাস্তায় আলাপ জমাইতে চায়, বলে, কৈ যাছ?

: খালার বাইতে যামু।

কিন্তু খৈমনের স্বভাব খারাপই, ক্ষেপলে লেঙ্গুরে আগুন দেয়, যা তা কাণ্ড করে, ফলে এই আপোষ প্রচেষ্টা বেশি দূর আগায় না; তখন হয়তো জোবেদা বেগম ক্লাস এইটে দুইবার ফেল করে ঘরে বসে আছে, বর্ষায় অথবা কোন এক ঋতুতে চন্দ্রকান্ত বসাকদের বাড়িতে ঝুলন উৎসব শুরু হয়, মঞ্চের মত কাঠের একটা কাঠামোর সঙ্গে ফুল এবং লতাপাতা দিয়া ঢাকা একটা দোলনা বেন্ধে রাধা-কৃষ্ণের দুইটা মূর্তি বসায়া উলুলু করে তারা দড়ি দিয়া টেনে দোলায়। মহল্লার লোকেরা দল ধরে ঝুলন দেখতে যায়, একদিন হয়তো জোবেদা বেগম যায়া দেখে সেখানে খৈমন হাজির, চুকান্তের মেয়ে পূর্ণলক্ষ্মীর সঙ্গে সে গুজুরগুজুর করে; জোবেদা বেগম তখন মায়ারানির দেওয়া প্রসাদ খায়া পূর্ণলক্ষ্মীকে জিগাস করে, কিরে পূর্ণ, কি করছ?

: কথা কই।

: এত কি কথা কচ!

খৈমনের তখন রাগ হতে থাকে, ক্যালা আমার লগে কথা কওন যায়? খালি তুমিই কথা কয়া পার-কেলেছ এইটে দুইবার ফেল দিছ!

জোবেদা বেগম ছাড়ে না, তুইতো একটা গোল্লা, সে বলে, নামও লিখা পারছ না, ক্লাসরে কচ কেলেছু, ফকিন্নি একটা!

ফকিরনি বলায় খৈমনের চেহারা লাল হয়া আসে, প্রথমে মনে হয় যে, সে কেন্দে দেবে, কিন্তু তা না করে সে আবার আক্রমণ করে, আমারে কও ফকিন্নি, নিজের চেহারাটা দেখছ? চাকরানি বেডি!

কিন্তু চাকরানি বলার পরেও জোবেদা বেগমেরই আগে বিয়া হয়, বাপের ৬২নম্বর বাসা ছেড়ে শ্বশুরের ২৫নম্বর বাসায় এসে ওঠে, অন্যদিকে খৈমনের ভাগড়া স্বাস্থ্য এবং ভাল চেহারা হলেও তার বিয়ার জন্যই পাত্র পাওয়া যায় না, তারপর পাওয়া যায় এক তরকারিঅলাকে এই তরকারিঅলা ময়না মিঞা একাত্তর সনে জিঞ্জিরা থেকে ফিরা আসার পর কাজকর্ম না করে শ্বশুরের বাসায় শুয়ে বসে খায়, বলে যে, বাজারে যেতে তার ভর করে। তখন, রাজাকার আসার আগে অথবা পরে মহল্লা থেকে পোলাপান মুক্তিযুদ্ধে যেতে শুরু করে, রশিদুল যায়, জোবেদা বেগমের আইএ পাশ স্বামী গোলাম রহমান যায়, কিন্তু ময়না মিঞা নড়ে না, সে মহল্লায় থেকে যায়, হয়তো সে সত্যি যুদ্ধকে ভয় পায়; এবং ফখরুল আলম লেদুকে মামুনের মা মিসেস জোবেদা রহমান যখন বলে যে, মামুন চুলার জন্য ভুসি আনতে গেছে, তখন মামুনুল হাই হয়তো চটের ছালা বগলে করে দি নিউ চন্দ্রঘোনা স মিল এল্ড টিম্বার ডিপার্ট এর সামনে এসে খাড়ায়। কাঠ চেরাইয়ের কারখানার কুলি এবং শ্রমিকেরা সব গাধাই, যদিও তারা চালাকিও খুবই জানে; এই করাত কলের কুলি-মজুরদের কাছে মামুন মিঞা হয়তো পরিচিতই ছিল, সে এক/দেড় মাস পর পর এসে হাজির হয়, এবং দরদাম করে এক কস্তার নামে তার মায়ের জোড়া দেওয়া ছালায় দেড়/দুই বস্তার মাল নিয়া চলে যায়, তারা কিছু মনে করে না, কারণ সকলেই এইরকম করে। কিন্তু এই দিন, হয়তো এইদিনও বৃষ্টি ছিল, অথবা ছিল না, হয়তো বৃষ্টির পর শুকনা শরৎ শুরু হয়েছে, তখন সে এসে খাড়ায় এবং তাকে দেখে স মিলের শ্রমিকেরা, বিশেষ করে কুলিরা কানাঘুষা করে, তাদের মনে হয় যে, এই ছেলেটাকে কি তারা পনের দিন কিংবা এক মাস কিংবা দুই মাস আগে কাঠের ভুসির সঙ্গে ট্রাকে করে পাচার করে দেয় নাই? তখন দি নিউ চন্দ্রঘোনা স মিল এন্ড টিম্বার ডিপোট এর বোকা কিংবা চালাক কুলিরা বিষয়টা প্যাচায়া ফালায়, এই বিষয়ে মালিকের কড়া নিষেধ সত্ত্বেও এই কুলিদের-হয়তো তাদের নাম ছিল ইদ্রিস, মকবুল, শ্রীধর দাস-কোন পোকায় কামড়ায়, তাদের মন কেমন ছটফটায়, ছোট একখান বিবেক নিয়া তারা পুনরায় কাহিল হয়া পড়ে, তাদের মনে হয় যে, কার জানি পোলা আহা, এবং তখন তারা হয়তো ইদ্রিস এবং মকবুল-ভূতের গল্লিতে এসে মামুনদের বাড়ি খোজে। তারা একে জিগাস করে, তাকে জিগাস করে, এবং তারপর ২৫নম্বর বাড়ির বাইরের উঠানে কামিনি ফুল গাছ তলায় যায় ডাক পাড়ে।

মামুনের মা, মিসেস জোবেদা বেগমের মনে হয় যে, এটা কোন এক ধরনের ষড়যন্ত্রই ছিল, কারণ, তার পোলা বাসায় থাকতে কেউ যদি বাসায় এসে বলে যে, আপনের পোলা আপনের পোলা না, তাহলে কেমন লাগে, তখন ব্যাপারটা কেমন হয়! সেদিন দি নিউ চন্দ্রঘোনা স মিল এন্ড টিম্বার ডিপোট এর দুই ভূত এসে কামিনি গাছ তলায় খাড়ায়া ডাকাডাকি করে, বাড়িতে কে আছেন? বাড়ির ভিতরে মামুনের মা ছিল, তার মনে হয় যে, এইটা নির্ঘাত ডাকপিয়ন হবে, ওয়ারি সাব-পোস্টাপিসের খাকি রঙ্গের পোশাক পরা পিয়ন কালেভদ্রে কোন চিঠি নিয়া ভাদের বাসায় আসে, হয়তো কোন একটা পোস্টকার্ড কিংবা একটা খাম নিয়া এসে অতিভদ্রলোকের মত ডাক দেয়, এই ডাক শুনে ঘরের লোক ঠিক বুঝতে পারে যে, এইটা ডাক পিয়নই, ডাক পিয়নরাই এমন মোলায়েম হয়; কিন্তু করাত কলের কুলিদের ডাকাডাকি শুনে ঘর থেকে বের হয়া জোবেদা বেগম দেখে যে, দুইটা লোক পিয়নের মত ডাকে কিন্তু তারা পিয়ন না। যাহোক, জোবেদা বেগম যখন দেখে গাছ তলায় দুই বান্দা খাড়ায়া, তার মনে হয় যে, এরা হয়তো মহল্লার রাইতের পাহারাদার কিংবা অন্য কিছু একটা হবে, সামনে রোযা আসছে, তারপর ঈদুল ফিতর আসবে-হয়তো কোন না কোন বকশিসের জন্য এইগুলা এসে খাড়া হয়েছে। কিন্তু ইদ্রিস এবং মকবুলতে অবশ্যই বকশিসের জন্য আসে নাই, তারা করাত কলের শ্রমিক, বকশিস

তারা চেনে না এবং তারা যখন জিগাস করে, এইটা মামনুগো বাসা না? তখন জোবেদা বেগম বিভ্রান্ত হয়, কারা এরা, কি চায় এই ব্যাটারা? এবং সে বলে, ই ক্যালা? . সেদিন, তারপর, ইদ্রিস এবং মকবুল গাছের তলা থেকে বারান্দার উপরে খাড়ানো মামুনের মার কাছে আগায়া আসে এবং যখন নিচা পারে বলে যে, তার ছেলে মামুন হারায়া গেছে, করাত কলের কাঠের ভুসির সঙ্গে ট্রাকের ভিতরে করে পাচার হয়া গেছে সে, মামুনের মা হঠাৎ মনে হয় যেন ভ্যাবাচেকা খায়া থাকে, বলে কি লোকগুলা!

কি কন আপনেরা, সে বলে।

কিন্তু এই লোকেরা, অর্থাৎ ইদ্রিস এবং মকবুল মামুনের মার আচরণ দেখে উল্টা ভ্যাবাচেকা খায়, তারা বুঝতে পারে না যে, ব্যাপারটা কি, হারাইনা পোলার খবর শোনার পরেও পোলার মায়ের কোন বিকার নাই; তারা এক অদ্ভুত সঙ্কটে পড়ে চুপ মেরে থাকে, উপায় খুঁজে পায় না, তাদের মনে হয়, উপকার করতে আইস কি যন্ত্রণায় পড়লাম, কিন্তু তখন তারা বলে যে, তারা যা বলে তা ঠিকই বলে।

: আপনে ভুসির চুলা জ্বালান না?

: জ্বালামুন ক্যালা!

: আপনের পোলা পনরা দিন কিংবা এক মাস আগে তুসি আননের লাইগা নায়াবাজার গেছিল না?

: যায়া পারে, কাইলইতো জুছি লায়া আইলো!

: আপনের পোলা আয় ফিরা আসে নাই!

তখন জোবেদা বেগম বিচলিত হয়, তাহলে কাইল ভুসি নিয়া ফিরা আসলে কে? সে বলে, আপনেরা কন আমার পোলা মামুনে ভূছি লয়া ফিরা আহেনিকা?

তখন করাত কলের এই দুই শ্রমিক বলে যে, মামুন মিঞার হারায় না যাওয়ার কোন কারণ নাই, সে অবশই হারায়া গেছে, কারণ তারা তাদের কাস্টমারদের চেনে, তারা মামুন মিঞাকেও চেনে, এবং তারা জানে যে, মামুন পনের দিন কিংবা এক মাস আগে করাত কলের মালিকের টেরাকে কাঠের ভুসির লগে চলে গেছে। তারপর তারা যখন বলে যে, এখনো করাত কলে যায়া খুজলে হয়তো মামুন মিঞার খোঁজ তার মা জানতে পারবে, জোবেদা বেগমের মনে হয় আসলে হয়তো এই গাধা দুইটা কোথাও কিছু একটা প্যাচ খাওয়ায়া ফালাইছে; সে বলে, তাইলে ভুছি লয়া আইলো কেঠা?

: আপনের পোলা আসে নাই, তারে জলদি খুঁজেন।

: আপনারা কেঠা?

: আমরা কেউ না, মামুনরে অখনেই যায়া খুঁজেন, করাত কলের মালিকরে যায়া জিগান,পরে পাইবেন না।

জোবেদা বেগমকে ভয় পাইতেই হয়, সে হৈচৈ করে, কিন্তু কাউকে পায় না যে বলবে, দেখতো মামুনে কৈ, অরে ডাইকা আনতো, ফলে বিষয়টা ছড়ায়া পড়ে, মহল্লার দুই/একজন মহিলা এসে জোটে, এবং তারা যখন জোবেদা বেগমের সমস্যার কথা শোনে, তারা বুঝতে পারে না যে, আসলে সমস্যাটা কি, জোবেদা বেগম তাদেরকে বলে যে, নয়াবাজারের দুই ব্যাটা এসে তাকে বলে গেল মামুন পনেরবিশ দিন কিংবা এক মাস আগে কাঠের ভুসি কিনা আনতে যায় আর ফিরা আসে নাই, এবং যে কাঠের ভুসি নিয়া ফিরা আসে—সে মামুন না! মহল্লার এই মহিলারা তাজ্জব হয়া যায়, তারা জিন্দেগিতে এই রকম কৃগ্ধা শোনে নাই, তারা বলে, আপনে আফা চিনা পারলেন না, মামুনে যে মামুন না আপনে বুজা পারলেন না?

: না, পারি নাইতো।

এই মহিলাদের তখন সন্দেহ হয় যে, আসলে হয়তো ভুসি আনতে যায়া মামুন আর ফিরাই আসে নাই, হয়তো ভুসি টুসি কিছুই কেউ আনে নাই, জোবেদা বেগম হয়তো ভুলে গেছে, সে হয়তো দুই মাস আগে আনা পুরান ভুসি জ্বালায় এবং আন্দাজে বলে যে, মামুন ভুসি নিয়া ফিরা এসেছে; তখন তারা বলে, আপনে আফা মনে কইরা দেখেন, হাচাই মামুনে যাওনের পর ফিরা আইছিল, নিকি আহে নাইকা, আপনে হুদাহুদি মনে করতাছেন যে ভুছি লয়া আইছে, আদতে হয়তো আহে নাইকা।

তখন জোবেদা বেগমের মত শক্ত মহিলাও এলোমেলো হয় পড়ে, তার মনে হয়, তাহলে মামুন কি ভুসি আনতে যাওয়ার পর আসলেই ফিরা আসে নাই? কি সে দ্রুত তার মনের স্বচ্ছতা ফিরা পায় এবং সন্দেহ ভঞ্জনের জন্য ভিতরে যায়া দেখে যে, রান্না ঘরের বারান্দায় ভুসির নতুন ভরা বস্তা রাখা—কেউ ভুসি আনতে যায়া থাকলে অবশ্যই সে ভুসি নিয়া ফিরা এসেছিল! মহল্লার দুই মহিলার কাছেও তখন পরিষ্কার হয় যে, তাহলে ভুসির বস্তা নিয়া কেউ ঠিকই ফিরেছে, এখন প্রশ্ন হলো, এইটা কে? মামুন যদি হারায়া যায়াই থাকে, তাহলে ভুসি নিয়া কে ফিরলো, এইটা কে, কেঠা?

মামুনের মা বিচলিত হয়, তখন হয়তো মামুনের ছোটভাই মাহমুদ বাড়ি ফেরে, হয়তো তার বাপ গোলাম রহমানও আসে এবং তারা জোবেদা বেগমের কথা শুনে কিছুই বোঝে না, কিন্তু তখন আসল অথবা নকল মামুনকে খুঁজে বের করা জরুরি হয়া পড়ে। তারা টিপু সুলতান রোডের মাথায় খ্রিষ্টানদের কবরস্থানের কাছে পোলাপানদের পায়, এই বালকেরা। ভাঙ্গা খাপরা এবং টেনিসবল দিয়া সাতখাপরা খেলায় ব্যস্ত ছিল, গায়ে ছুড়ে দেওয়া বল লাগার ভয়ে মামুন হয়তো লুকায়া ছিল কাছেই, সহসা সে বের হয়া আসে এবং তার বাপের কবলে পড়ে। মামুনকে যখন বাসায় ধরে আনা হয়, সে বুঝতে পারে না কি অপরাধে তার কি শাস্তি হতে যাচ্ছে, তবে সে বোঝে যে, কিছু একটা হবেই, তার মার হাতে পড়লে সে এমনিতেই ছেড়ে দেবে না। তাকে জোবেদা বেগমের হাওলা করার পর, জোবেদা বেগম তাকে নানাভাবে পরীক্ষা করে, অন্য ঘরে যায় তার নাম ধরে ডেকে দেখে সে ঠিকমত সাড়া দেয় কি না, স্কুলের কথা জিগাস করে, তুই কোন ক্লাসে পড়? এবং তার এই প্রশ্ন শুনে মামুন ঘাবড়ায়া যায়, কিন্তু জোবেদা বেগমের কিছু করার থাকে না, মামুনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে এইসব করতেই হয়, এবং অবশেষে সে যখন বলে, তর জন্ম দাগটা দেখি, মামুন হাফ প্যান্ট গুটায়া তার বাম উরুর কালা জড়ল দেখায়। তখন জোবেদা বেগম এইসব প্রমাণ অবিশ্বাস করতে পারে না, তার মনে হয় যে, এই মামুন মামুনই, ভেজাল না, করাত কলের দুই গরু এসে সব উল্টাপাল্টা বলে তার মাথা খারাপ করে দিয়া গেছে; সে বলে, তুই যা খেলা গা, এবং মামুন খাঁচা থেকে ছাড়া পাওয়া একটা পাখির মত ফুরুৎ করে উড়ে যায়। তখন জোবেদা রহমানের অবশ্যই মনে হয় যে, ব্যাপারটা আসলে কি? এই দুইটা লোক এসে তার সঙ্গে এমন আচরণ করে গেল কেন? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর তাকে কে দেবে? কাজেই এই ঘটনার কথা সে ভুলে যায়; কিন্তু তখন বহুদূরে ট্রগ্রামের সাতকানিয়ায় আসমানতারা হুরে জান্নাতের হাতের ভিতর দড়ি বান্ধা অবস্থায় খরকোস বড় হয়া ওঠে, করাত কলের ঘটনার কথা সে ভুলে যায়, শুধু স্মৃতির একটা কৌটার মধ্যে সে পায় তার নাম এবং ঠিকানা। ফলে আসমান তারার খরকোস পনেরবিশ বছর পর আর এক বিকালে বুড়া কামিনি গাছ তলায় এসে হাজির হয়, এবং বলে যে, তার নাম মামুন মিঞা, সে অনেক বছর আগে হারায়া গেছিল, তখন জোবেদা বেগমের সামনে বহুবছর পর পুরান প্রসঙ্গ এসে খাড়া হয়, এবং সে ভাবে যে, এইগুলা আসলে কি? এর উত্তর হয়তো দেওয়া মুশকিল-এইগুলা আসলে কি—তবে এই জটিলতার কারণ হচ্ছে এই যে, করাত কলের কুলিরা চালাক হলেও, তারা যা, তাই; তারা একটা ছেলেকে কাঠের ভুসির সঙ্গে পাচার করে দেয়, ঠিক আছে, ছেলে ভুসি আনতে গেলে ভুসির সঙ্গে সে পাচার হয়া যেতেই পারে, তরা বাবা চুপ মাইরা থাক, কিন্তু তা হওয়ার নয়, তাদের জিলা নড়বেই, ফলে তখন ট্রাকের ভিতরে পাচার হয়া যাওয়া বালকের পরিচয়ের বিষয়ে তারা গলা নামায়া আবার আলাপ করে দেখে, করাত কলের এই কুলিরা একমত হয় যে, এরা সকলেই প্রায় বান্ধা গ্রাহক, মামুন মিঞার সঙ্গে তাদের এর আগে আলাপও হয়ে থাকতে পারে, সে দক্ষিণ মৈশুন্দি ভূতের গল্লির পোলা—সে মামুন মিঞাই; তখন করাত কলের এই শ্রমিকদের কথা যখন আব্দুল মাবুদ চৌধুরির কানে যায়, সে এই গাধাদের চুপ থাকতে বলে এবং ফোন করে তার ছোট ভাই আব্দুল ওদুদ চৌধুরিকে ভুসির মধ্যে মামুন মিঞার পাচার হয়া যাওয়ার খবর দেয়, কিন্তু আব্দুল ওদুদ চৌধুরির বিষয়টা বুঝতে অসুবিধা হয়, সে বলে, আঁই অনের হতা ন বুজিদ্দে।

আব্দুল মাবুদ চৌধুরি তাকে বিষয়টা বুঝায় বলে, ট্রাকের ভুসির সঙ্গে কুলিরা একটা মরা অথবা আধমরা ছেলেকে তুলে দিয়েছে, তার নাম মামুন, সে ঢাকার নারিন্দা ভূতের গল্লির পোলা; ওদুদ চৌধুরির তখন চিন্তা হয়, বুঝতে পারে না যে, পুলিশের কাছে ধরা পড়া ট্রাকগুলার ভিতর ছেলেটা ছিল কিনা, সে বিভিন্ন জায়গায় তার কর্মচারিদের ফোন করে জানতে পারে যে, ট্রাক সাতকানিয়ার দিকে গেছে, হয়তো সেটা এর মধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেছে, অথবা পৌঁছে যাবে।

সেইদিন মামুন মিঞা যখন ভুসির ভিতরে করে পাচার হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল তখন সাতকানিয়ার বোয়ালিয়া পাড়ায় আসমানতারা হুরে জান্নাত তার মা ডলি আক্তারকে সকাল থেকে খুব জ্বালায়, হয়তো জন্মের আগেই পেটে থাকতেই সে তার মাকে ত্যক্ত করতে শুরু করে; সস্তানের জন্মদান ডলি আক্তারের জন্য নতুন কিংবা জটিল কঠিন বিষয় কখনোই ছিল না, সময় হয়ে গেলে, প্রতিবেশী আম্বিয়ার মাকে খবর পাঠায়া ঘরের দরজা টেনে দিয়া, অনেক সময় আমিয়ার মা আসার আগেই সে তার কাজ সেরে বসে থাকে, তখন আম্বিয়ার মা এসে হয়তো গর্ভের ফুল পরার জন্য প্রতীক্ষা করে, ফুল বের হয়া এলে ব্লেড দিয়া নাড়ি কেটে বাচ্চাকে গোসল দিয়া সাফসুতর করে, প্রসূতির কাপড় বদলায়া মেঝে থেকে খাটের উপর ওঠায়, তারপর বাচ্চা তার কোলে দিয়া সে ঘর পরিষ্কার করে এবং শেষে রক্তাক্ত ফুল, ডলি আক্তারের পরনের নোংরা কাপড়, মেঝেতে পাতা খেতা, রক্ত মোছার তেনা, এইসব নিয়া যায়া চৌধুরি বাড়ির ভিটার পিছনে পুকুরের পুব দিকে দেওয়ালের পাশে গর্ত করে পুঁতে ফেলে। বহুবছর আগে যখন আর প্রথম বাচ্চা হয় ছেলের মুখ দেখে ডলি আক্তারের খুশি লাগে, কারণ তার মনে হয় এরপর মেয়ে হলে কারো কিছু বলার থাকবে না; তখন আব্দুল আলি চৌধুরি হয়তো বেঁচে ছিল, বড় ছেলে আব্দুল মাবুদ প্রথমে চিটাগাং শহরে তারপর ঢাকায় যায় স্থায়ী হওয়ায় তার মনে আনন্দ ছিল না, কিন্তু ওদুদ চৌধুরি বিয়া করে বৌ সাতকানিয়ায়ই রেখে দেয়ায় সে খুশি হয়, তারপর যখন ডলি আক্তারের ছেলে হয় বুড়ার মুখে আর হাসি ধরে না, সে নাভির ডাইন কানে আল্লাহুআকবর আল্লাহুআকবর বলে মৃদু স্বরে আযান দিয়া, নাম রাখে আব্দুল কাদের চৌধুরি; নাতি তার বড় হয়, এবং আব্দুল আলি চৌধুরি তাকে কোলে নিয়া ও দাদা ও দাদা করে। পনের মাস পরে ডলি আক্তারের দ্বিতীয় বাচ্চা হয়, এইটাও ছেলে, আম্বিয়ার মা এসে দেখে যে, ডলি আক্তার প্রসবের কজি পুনরায় সেরে রেখেছে, আম্বিয়ার মা নবজাতক এবং প্রসূতিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে খাটের উপর তুলে দেয়, বুড়া আব্দুল আলি হয়তো সাতকানিয়া বাজারে টহল দিয়া ফিরা আসে, এসে শোনে আর একটা নাতি হয়েছে তার, সে বলে, আলহামদু লিল্লাহ, এবং ডাইন কানে আযান দিয়া নাম রাখে মোহসিন আলি চৌধুরি। তখন পরপর দুই ছেলের জন্ম দিয়া ডলি আক্তারের পায়া ভারি হয়া যায়, সে আবার ভাবে যে এইবার মেয়ে হলে আর কোনই ভয় নাই, কিন্তু পনের মাস পরে ডলি আক্তারের আবার ছেলে হয় এবং আব্দুল আলি বাচ্চার নাম রাখে নুরুল হক চৌধুরি। উলি আক্তার যখন চতুর্থবারের মত গর্ভে সন্তান নেয় তার খুবই মনে হয় যে, একটা মেয়ে হোক, আঁরে একয়া মাইয়াগোয়া অও খোদা, হয়তো জায়নামাজে বসে হাত তুলে কান্দে, হয়তো একটা মেয়ে চায় বুড়া আব্দুল আলিও, কিন্তু তাদের প্রার্থনা কবুল হয় না, পুনরায় ছেলে হয় এবং আব্দুল আলি তার নাম রাখে রইসুদ্দিন চৌধুরি। ডলি আক্তারের মন খারাপ লাগে, সে একে বলে, তাকে বলে, কেন তার একটা মেয়ে হয় না, ওড়ি আম্বিয়ার মা, আঁর বেতন মদপোয়া, আঁতুথে খুশি ন লার, আঁর একগুয়া মাইয়াফোয়া ন হয় কিয়া! আম্বিয়ার মা বিষয়টা ভেবে দেখে, তার প্রথমে মনে হয় যে, এরকম হতেই পারে, অনেক মহিলার কোন মেয়ে হয় না, আবার অনেক মহিলার কোন ছেলেই হয় না; তখন উলি আক্তার পুনরায় তাকে মেয়ে কেন হয় না জিগাস করলে সে তাকে সব বুঝায়া বলে, তারপর তার কি ঘটে, তার মাথায় একটা ভাবের উদয় হয়, এবং সে বলে যে, হয়তো এইটা এক রকমের অসুখ। কিন্তু এই কথা ডলি আক্তারের ভাল লাগে না, সে সাতকানিয়া গালর্স স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া মেয়ে, সে জানে এসব কোনই অসুখ না; তবে সে তার কোমরের চারপাশে তাবিজ বেন্ধে ভরায়া ফালায়, কিন্তু চৌদ্দ কিংবা পনের মাস পরে তার পঞ্চম ছেলে হলে সে ভেঙ্গে পড়ে, বুড়া আব্দুল আলি তবু খুশি, সব বাচ্চাই আল্লার দান, সে নাতির নাম রাখে শাজাহান আলি চৌধুরি। তখন আর একবার আম্বিয়ার মার কথাটা ভুলি আক্তারের মনে পড়ে, কিন্তু সে নিশ্চিত হয় যে মূর্ব আম্বিয়ার মা কিছুই জানে না, খামাখা বেশি কথা বলে, তারপরেও তার মন খারাপ লাগে এবং সে বিচলিত ও বিভ্রান্ত হয়। পড়ে, এবং তখন সে ষষ্ঠ বারের মত গর্ভ ধারণ করে। সে মন মরা হয়া থাকে, মেয়ে হয়াও তার জরায়ুতে মেয়ে সন্তানের জায়গা নাই, তার ক্ষুধামন্দা দেখা দেয় এবং রাইতে সে অদ্রিায় আক্রান্ত হয়, তাকে বারে বারে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়, কিংবা বাড়ির লোক যায় ডাক্তার ডেকে আনে। মোজাহার ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে, যন্ত্র বের করে রক্তচাপ মাপে, চোখের নিচের পাতা টেনে সে দিকে তাকায়া থাকে, এবং সে বলে, অনের অবস্থা তো গম নয় ভাবি, হাওয়াহাইদ্য ঠিকমত ন খান ফানলার!

০৩. বাবুল মিঞাও অপেক্ষায় ছিল

বাবুল মিঞাও হয়তো অপেক্ষায় ছিল যে, ময়না তাকে কিছু বলবে, কিন্তু ময়না মিঞা তার কাছেও আসে না, ফলে বাবুল মিঞাই একদিন ঠাটারি বাজারে ময়না মিঞার কাছে যায় এবং জিগাস করে, কিরে মাইয়া দেইখা আইলি, কিছু কচ না!

তখন ময়না মিঞা তাকে বলে যে, হারিকলের ঘোলা আলোয় ঘোমটা দিয়া থাকা খৈমনের কিছুই সে দেখতে পায় নাই, সে কেমনে বলবে মেয়ে দেখতে কেমন, পছন্দ হয়, নাকি হয় না! এই কথা আব্দুল জলিল এবং জরিমন, শোনে, রশিদুল শোনে; খৈমন তাদের খুবই আদরের মাইয়া, সোহাগের বইন, তারা তরকারিঅলা ময়না মিঞাকে আবার মেয়ে দেখানোর কথায় রেগে যায়, ছোটলোক একটা, তারা বলে, আমাগো মাইয়া রাস্তায় কুড়ায়া পাইছি নিহি, বারে বারে দেখামু।

তারা পুনরায় মেয়ে দেখানোর প্রস্তাব নাকচ করে দেয় এবং ভাবে যে, এইভাবে খৈমনকে এক নিদারুণ ও গভীর অপমান থেকে বাচালো; তখন হয়তো জরিমন একদিন বিকালে বা রাইতে খৈমনকে এইসব কথা বলে, হয়ত জুরিমন নারিকেলের তেল মেখে তার চুল বেন্ধে দেয়, চুলের একটা মোটা বেণি করে আগায় লাল সাটিনের ফিতার একটা ফুল বানায়া পিঠের উপরে ঝুলায়া দিয়া বলে, কয় দেখে নাইকা, গাধা, আমাগো মাইয়া কি গাঙ্গের পানির লগে ভাইসা আইছে নিহি যে আবার দেখামু! কারণ ফখরুল আলম লেদু যখন মামুনকে খুঁজতে তাদের বাসায় যায়, সে মামুনকে পায় না এবং তখন মামুনের মা মিসেস জোবেদা রহমানকে বলে, কৈ যায় মামুন? কৈ কৈ ঘোরে? মামুন হয়তো সিলভারডেল কেজি স্কুলের এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান টিচার মিসেস মেরি জে ক্লার্ক অথবা মিজ ডি কস্তার বাসায় যায়—হয়তো মিসেস ক্লার্কের বাসাতেই-কারণ মিসেস ক্লার্কই তার ছাত্রদেরকে ভালবাসা এবং প্রশ্রয় দিত, ফলে তারা তার বাসা পর্যন্ত চিনা ফালায়। মামুন হয়তো তার বাসাতেই যায়, কারণ সেখানে ছিল তার টকিং বার্বি ডলের মত মেয়ে জুলি ফ্লোরেন্স, মামুন হয়তো ফখরুল আলম লেদুকে কিছু বলে না, সে হয়তো গোপনে নিয়মিত যাতায়াত করে মিসেস ক্লার্কের বাসায়, টিকাটুলি নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে, হয়তো জুলির সঙ্গে সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলোর মধ্যে চুপচাপ বসে থাকে, হয়তো জুলি ফ্লোরেন্স ক্লার্ক বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকায়া থাকে আর মামুন দেওয়ালে টাঙ্গানো ছবি দেখে; অথবা তারা হয়তো কথা বলে, মামুন দেওয়ালের একটা ছবি দেখে বলে, এইটা কুন মসজিদ? তখন জুলি ফ্লোরেন্স হাসে, ইটস নট এ মস্ক, এটা চার্চ, সেন্ট পিটার্স বেসিলিকা, সেন্ট পিটারের চার্চ, ভ্যাটিকানে।

: ভ্যাটিকান কুন জায়গায়?

: কুন জায়গায় বলেন ক্যানি? ভ্যাটিকান রোমে, ইটালিতে।

: ইটালি কোথায়?

: ইটালি ইউরোপে।

: ইউরোপ কুন জায়গায়?

জুলি ফ্লোরেন্সের মনে হয় যে, মামুন মিঞা তার সঙ্গে মশকারি করে, সে বলে, আমি জানি না কোথায়!

: যেইখানেই হোক তুমার ইউরোপ যাইতে মন চায়?

: চায়, ইয়েস, আই যুড লাইক টু গো, বাট মাই মম ইজ ট্রায়িং টু গো টু অস্ট্রেলিয়া।

তখন মামুন মিঞা চুপ করে আবার ছবি দেখে, তার মনে পড়ে সে যখন প্রথম দিন মিসেস ক্লার্কের বাসায় একা আসে তার ইচ্ছা ছিল এ্যাংলো মেয়েদের সঙ্গে একটু লটরপটর করে, এইটা মুসলমানের দ্যাশ এইখানে। এদের সঙ্গে এইসব ইকটু করলে কিছু এমন হয়না, ফলে সেদিন সে যখন জুলিকে একটা ফুল তোলা ছিট কাপড়ের হাতা কাটা ফ্রকের ভিতর দেখে, তার শরীর ঝিমঝিম করে, জুলির অল্প উথিত স্তন, অনাবৃত বাহুমূল, হাঁটু এবং পা, গলায় স্টার্লিং সিলভারের মিহিন চেনের সঙ্গে ছোট্ট একটা ক্রুসিফি। তার মনে হয় যে, জুলি ফ্লোরেন্স মানুষ না, পরী, এখনই উড়ে যাবে রোম কিংবা অস্ট্রেলিয়ায়, তার বড় ইচ্ছা হয় জুলি ফ্লোরেন্সকে জড়ায়া ধরে একটা কিস করে; সে বলে, তুমি সাংঘাতিক জুলি, কিন্তু মেয়েটা ছিল বড় টনটইনা, সে মামুন মিঞার কাছ থেকে দূরে দরজার কাছে একটা বেতের চেয়ারে বসে থাকে, কাছে এসে বসে না, তার কথাও সে না বোঝার ভান করে, কারণ সে জানে এইসব কথা হচ্ছে ফান্দের দরজার মত, একবার ঢুকলে জড়ায়া যাবে। মামুন মিঞা তখন তাকে বলে, তুমি অতো দূরে বসে থাক কালা? কাছে আইসা বসো!

কিন্তু জুলি ফ্লোরেন্সের বয়স চৌদ্দ হলেও তার শরীরের ভিতর নারী সত্তা বাঘের রাজ্যে হরিণের মত কান খাড়া করে রাখে, সে বলে, আপনে কালা বলেন কেন?

মামুনের মনে হয় যে, জুলি হয়তো তার সঙ্গে একটু একটু খেলে, তার এই খেলা ভাল লাগে; সে বলে, ক্যালা কমু না কালা?

: বলেন, কেন। ক্যালা না, বলেন, কেন বলব না?

: বললাম, কেন। কেন যাইতে চাও তুমরা অস্ট্রেলিয়া?

জুলি ফ্লোরেন্সের ভাল ধারণা নাই, তার মা মিসেস মেরি জয়েস ক্লার্ক যেতে চায়, তার বাপ রবার্ট ফ্রান্সিস ক্লার্ক এবং ভাই যোসেফ ইউজিনও যেতে চায়, কিন্তু কেন চায়, কেন চাও দেশ ছেড়ে যেতে? ক্যালা?

জুলি ফ্লোরেন্সের মনে হয় যে, তার উত্তর জানা নাই, অথবা হয়তো আছে; তাদের হয়তো এদেশে কিছু করার নাই, তার বাপ, বব, ব্রিটিশ কাউন্সিলের গার্ডেন সুপারভাইজার, বাগানের মালিদের দেখাশোনা করে, ঘাস লাগায়, কাটায়, মৌসুম বুঝে মালিদের দিয়া ফুলের চাষ করে, এবং নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে এসে বৌ-বাচ্চাদের কাছে তার এইসব আজগুবি কাজের গল্প করে, হল্যান্ড থেকে এই মৌসুমে ক্রিসেনথিমামের বিচি আনা হবে, জন স্টেইনবাকের একটা বিখ্যাত গল্প আছে এই ফুল নিয়া, আর-যদি টিউলিপ ফোটান যেত এই দেশে। তার গল্প হয়তো বালিকা জুলি আগ্রহ নিয়া শোনে, বয়স কম হলেও বাপের জন্য তার চিত্ত ব্যকুল হয়, জীবনের ব্যর্থতার বোধ থেকে নিজেকে কিভাবে বাচানোর চেষ্টা করছে লোকটা, হয়তো তার মনে হয়, সত্যিতো যদি এই দেশে টিউলিপ ফুটতো তার বাপ তাহলে নিশ্চয়ই ফুলার রোডের ব্রিটিশ কাউন্সিলের বাগানে টিউলিপ ফুটাইতে পারতো, ফলে তখন হয়তো ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিচালক স্টিভ, মিস্টার স্টিভেন এইচ আর্নল্ড, কখনো এই ফুল দেখে খাড়ায়া পড়তেন, দুইটা আঙ্গুল লম্বা করে কোন ফুলের গায়ে স্পর্শ করে হয়তো বলতেন, আরে বব, একি কাণ্ড, তুমি দেখি আমস্টার্ডামের হলুদ টিউলিপ এইখানে ফুটায়া ফালাইছো, ব্রাভো!

তখন হয়তো রবার্ট ক্লার্ক স্মিত হেসে বলতো, এমন কিছু না স্যার, আর একটু যদি শিশিরের পানি পাওয়া যেত তাহলে দেখতে কেমন টিউলিপ আমি এই দেশেই ফোটাই!

কিন্তু তা হবার নয়, এইখানে, এই দেশে, শুধু কসমস আর ডালিয়া, আর আছে হলুদ গেন্দা, আছে অবশ্য কলাবতীও; রবার্ট বলে যে, স্টিভেন যখন নাইরোবি থেকে বদলি হয়া নতুন ঢাকায় আসে সে বৃষ্টির দিনের সাদা কলাবতীর খুব ভক্ত হয়া ওঠে। কিন্তু একই জিনিস কত আর ভাল লাগে মানুষের, যদি এই দেশে আর একটু বেশি শিশির হতো, শীতটা একটু লম্বা আর গভীর হতো, তাহলে হয়তো জীবনটা অন্য রকম হতো রবার্ট ফ্রান্সিস ক্লার্কের; তার জন্য জুলি ফ্লোরেন্সের মন খারাপ লাগে, কিন্তু যোসেফ বাপের কথা শুনতে পারে না, সে বলে, এইসব আলবিলাতি কথা কেন বলো, মালির আবার ভাল খারাপ কি, কিছু না, কুছু নেহি, তুমি ইউজলেস মানুষ। ড্যাড, টেক ইট ইজি এন্ড ইনজয় ইয়োর ফিউটিলিটি!

জুলি হয়তো যোসেফের বিষয়টাও বোঝে, যোসেফ তেজগাওয়ে বিজি প্রেসের মেকানিক, যোসেফ ইউজিন ক্লার্ক হচ্ছে, যোসেফ মিস্ত্রি; কম্পোজিটার এবং মেশিনম্যানরা তাকে সালাম দেয়, সে সরকারি প্রেসের হাইডেলবার্গ কিংবা হনার ট্রেডেল মেশিন অথবা জাপানে তৈরি ইয়াহিমা ডবল ডিমাই কিংবা ডবল ক্রাউন ফ্লাট মেশিন নষ্ট হয়া গেলে মেরামত করে। সে মাসে বেতন পায়—১৯৮৫ এর জাতীয় বেতন স্কেলের হিসাবে মূল বেতন-১৩৫০ টাকা, তবে উপরি আছে তার-খুচরা পার্টস কেনার পয়সার ভাগ পায় সে-এবং অফিসের পরে প্রাইভেট পার্টিও আসে কল দেওয়ার জন্য, মেশিনম্যানরা এসে ডেকে নিয়া যায় বংশাল কিংবা বাংলাবাজারে, হয়তো নবাবপুরে আলেকজান্ডার মেশিনি প্রেসে-ইকটু দেইখা দেন ওস্তাদ রোলার নিয়া বহুত ঝামেলায় আছি-যোসেফ মিস্ত্রি মেশিনে হাত দিলে মালিক খুশি, হয়তো মেশিনও; কিন্তু জুলি ফ্লোরেন্সের মনে হয় যে, তার মা খুশি হয় না, তার মা এইটা ভুলতে পারে না যে, সে সিলভারডেল কেজি স্কুলের টিচার আর তার স্বামী মালিদের সর্দার এবং একমাত্র ছেলে। ছাপাখানার মেশিনের মিস্ত্রি! এইসব কারণে তার মা ভোগে, জীবনে হলো

কিছু, এবং জুলি ফ্লোরেন্স যখন বড় হতে থাকে তখন সে বুঝতে পারে যে, তার বড় হওয়া নিয়াও তার মার অস্থিরতা বাড়ে, কিন্তু কোন কিছুই তার বড় হওয়া আটকায়া রাখতে পারে না, তার স্কার্ট ফ্রক প্যান্টি ক্রমাগত ছোট হয়া যায়, তার মনে হয় যে, শরীরের এই বেড়ে ওঠায় তার নিজেরও দিশাহারা মতন লাগে, কি হবে এখন, এই দেশে সে বড় হয়া যাইতাছে-এই দেশে এই শরীর নিয়া এখন কি হবে! তখন তাদের নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে কিশোর মামুন মিঞা একটা শিয়ালের মত আসে, কাকের মুখ থেকে যদি গোসের টুকরা বাইচান্স পড়ে, জুলি ফ্লোরেন্স হয়তো বিষয়টা বোঝে, অথবা খুব পরিষ্কার বোঝে না, তার তবু অনির্দিষ্ট অচেনা ভয় হয়, মামুন মিঞার মুখের দিকে তাকায়া তার কিছুটা বিভ্রান্তও হয়তো লাগে, তার হয়তো মনে হয় যে, মামুন মিঞা এই কথা বলে কেন? মামুন মিঞা কি জানে না কেন তারা যেতে চায় অস্ট্রেলিয়া? সে বলে, কেন যেতে চাই জানি না, আমার মম যেতে চায়, পার্টিকুলারলি শি ওয়ান্ট টু গো, কেন চায় জানি না, হয়তো এখানে ভাল লাগতেছে না মার।

: তুমি চাও যাইতে? কেন চাও?

মামুন মিঞার কথায় জুলি ফ্লোরেন্স বিচলিত হয়া পড়ে, তার কৈশোরিক জীবনে হয়তো এইরকম আচরণ এর আগে সে দেখে নাই, সে মামুন মিঞার মুখের দিকে তাকায়, বলে, কি বলেন আপনে, যাব না? মম গেলে অফকোর্স আই উইল গো-থাকব কোথায়?

মামুনুল হাই কি তখন সন্ধ্যার অন্ধকারের ভিতর কেন্দে ফেলে? হয়তো কান্দে না, বিষণ্ণ হয়া থাকে, জুলি ফ্লোরেন্সকে অন্ধকারের ভিতর জোর করে কিংবা আধা-জোর করে চুমা খাওয়ার চিন্তা সে বাদ দেয়, তার মনে হয় কি যে সুন্দর টিচারের এই মেয়েটা, এই দেশে তার থাকার জায়গা নাই কোন, সে বলে, তুমি যায়ো না জুলি, তুমি একটা ফুল পরী, তুমি অস্ট্রেলিয়া যায়ো না, এই দেশে থাক, তুমি গেলে গা আমাদের কি হবে, আমাদের ফুল বাগানের কি হবে বলো?

ফখরুল আলম লেদু ব্যাপারটা খুবই আন্দাজ করতে পারে, কারণ তাকে যত বোকা মনে হয় তত বোকা সে মোটেও না, সে মামুনকে বলে, টিচারের বাইতে ঘন ঘন যাস?

: গেলে, তর কি?

: জুলি ফ্লোরেন্সের দিকে নজর দেছ? কিস দিছস?

: পারি নাইকা অখনো, ইচ্ছা আছে।

: আমারও ইচ্ছা আছে।

: মান্দারপোলা, মাইরা ফালামু তরে, ভদ্র একটা মেয়েরে নিয়া তুমি বদমাইশি চিন্তা করো!

: তুমি কি করো হারামদা বান্দর? তুই যদি আবার টিচারের বাইতে যাবি আমি টিচাররে কমু, তুই বদমাইশি করনের লাইগা ঘুরতাছচ!

কিন্তু লেদুর কথায় কাজ হয় না, মামুন বোঝে যে, লেদু এইসব কথা এমনি বলে; ফলে ফখরুল আলম লেদু আবার মামুনদের বাসায় যায় দেখে যে, সে বাসায় নাই, তখন তার মার সঙ্গে দেখা হলে সে বলে, কৈ যায় কনতো খালা?

মিসেস জোবেদা রহমান এইবার চানমিঞার প্রসঙ্গে না যায় বলে, তগো এক টিচার আছিল কি জিনি নাম?

লেদু বুঝতে পারে, সে বলে, টিচারের বাইতে যায়?

: হঁ, তগো টিচারের মাইয়া আছে একটা, হের কাছে।

: আপনেরে কইলো কেঠা?

হয়তো মামুনের কাছ থেকেই তার মা শোনে, এবং মিসেস জোবেদা রহমান বলে যে, এই রকম মাইয়ামানুষ আমার পছন্দ না, বেড়া মানুষরে গিল্লা খাওনের লাইগা হাঁ কইরা বয়া থাকে-চানমিঞার মা খৈমনের মত-এই রকম সেয়ানা মাইয়ালোক খালি ধান্দা বুজে; কিন্তু জোবেদা বেগম এইসব কেন বলে? কারণ খৈমনের হয়তো ঠাটারি বাজারের সজি বিক্রেতা ময়না মিঞাকে বিয়া করার জন্য শেষ পর্যন্ত ছলাকলার আশ্রয়ই নেওয়া লাগে, তখন তার বয়স হয়তো ছিল ষোলসতের, কারণ তখন কম বয়সেই মেয়েদের বিয়া হতো, অথবা হয়তো আরো বেশি, বিশ/বাইশ, জোবেদা রহমান যেমন বলে, বুড়ি হয়া গেছিল গা, কেউয়েই দেইখা পছন্দ করতো না। তখন, তার বয়স যোলসতের কিংবা বিশ বাইশ যাই হোক, ময়না মিঞা দেখে যাওয়ার পর বলে যে, সে তাকে দেখতে পায় নাই; এর পিছনে ময়না মিঞার বদমাইশি থাকতে পারে, মেয়ে দেখার পর কেউ এইরকম বলে? আশ্চর্য! ফলে খৈমনের বাপম ঠিকই রাগ করে, কিন্তু তারা যতই রাগ দেখাক, হম্বিতম্বি করুক, খৈমনেরতো দিন কাটে না, রাইত গোয়ায় না, তার ডাগর চোখের কোনায় পাতিলার তলার মত কালি জমে, তার মনে হয় যে, ময়না মিঞা হয়তো আসলে দুষ্টামি করে, সে হয়তো তাকে ঠিকই দেখেছে, তবু হয়তো তাকে আর একবার দেখার ইচ্ছা হয় তার। ফলে তখন তার মা জরিমন যখন বলে, অতো সস্তা না, আমরা বারে বারে মাইয়া দেখাই না, তখন খৈমনের মুখের দিকে তাকায়া তার কথা বন্ধ হয়া যায়, সে বলে, কি হইছে তর, খৈ?

খৈ বলে, দেখবার চাইলে আবার দেখাও।

জরিমন তখন আব্দুল জলিলকে বলে, আব্দুল জলিল বলে বাবুল মিঞাকে, এবং ঠাটারি বাজারের রাস্তার উপরে আঁকার ভিতরে আনাজ সাজায়া বসা ময়না মিঞার কদর বোঝা যায় এই বঙ্গদেশে, তবে সে আর বেশি নখরা করে না, করলে খৈমন বেগম কেন্দে দিত অথবা ঠাটারি বাজারে যায় তাকে হয়তো জিগাস করতো, আপনে এমুন করতাছেন। ক্যালা? কিন্তু সে আর কিছু করে না, কেবল খৈমনকে আর একবার দেখতে চায়, এবং পুনরায় একদিন ভূতের গল্লিতে খৈমনদের বাড়িতে আসে। তখন ঘটনাটা ঘটে এবং সে জন্যই হয়তো মিসেস জোবেদা রহমান তার সম্পর্কে এত কথা বলে, কারণ ঘটনাটা হয়তো সাজানোই ছিল, খৈমন সাজিয়েছিল মহল্লার পোলাপানদের সঙ্গে নিয়া; কিংবা হয়তো তা সাজানো ছিল না, হয়তো ব্যাপারটা কাকতালিয় ছিল মাত্র। সেইদিন সন্ধ্যায় ময়না মিঞা সার্ট পান্ট এবং প্লাস্টিকের জুতা পরে মন্দিরের পাশের গল্লি দিয়া যখন হেটে আসে, ৩৬নম্বর বাড়ির বাইরের ঘরে পুনরায় কেরাসিনের বাত্তি জ্বালায়া খৈমন একটা মাদি মাকড়সার মত অপেক্ষা করে-মনে হয় একটা ব্লাক উইডো স্পাইডার শিকার ধরার জন্য সুতার জাল বিছায়া মাঝখাখে স্থির হয়া থাকে-ফলে ময়না মিঞা আগায়া আসে। সে ২৫নম্বর বাড়ি পার হয়, এবং তখন হয়তো বর্ষাকাল ছিল, ফলে সে এই বাড়ির ভিতর থেকে আসা কামিনি ফুলের ঘন ঘ্রাণ পায়, তারপর সে ৩২নম্বর বাঘঅলা বাড়ির সামনে দিয়া হেঁটে যায়, সে দেখে যে, বাড়ির সামনের সান বান্ধানো প্রাঙ্গণের দুই পাশে বেদির উপরে দুইটা সিমেন্টের বাঘ মাথা উঁচা করে শুয়ে আছে; ভারপর সে যখন ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে এসে পৌঁছায় তখন একদল পোলাপান হৈহৈ করতে করতে একদম হঠাৎ কোনখান থেকে যে দৌড়ায়া আসে বুঝতে পারা যায় না, এবং তখনই কোখেকে একটা কুত্তাও এসে হাজির হয়, তাগড়া মোটাসোটা কুত্তাটার লেজের আগা কাটা; ময়না মিঞা খৈমনদের বাড়ির গেট পার হয়া, ভিতরে ঢুকবে এইরকম সময় পোলাপানগুলা তার পিছনে কুত্তাটা লেলায়া দেয়, তারা ময়না মিঞার দিকে হাত লম্বা করে দিয়া বলে, ছুঁলে টমি, ছুঁ ছুঁ।

বিপজ্জনকভাবে লাফাইতে থাকা কুত্তাটা তখন ময়না মিঞার গায়ের উপরে উঠে পড়তে চায়, ফলে সে ভয়ে দৌড় দেয়, বাড়ির ভিতরে ঢুকে ঘরের মধ্যে চলে যায়-তখন খৈমন বেগম হারিকেনের বাত্তি জ্বালায়া প্রতীক্ষায় ছিল। তবে ঘরের ভিতর ঢুকেও ময়না মিঞার দুর্গতি শেষ হয় না, দরজার চৌকাঠে পাও আটকায়া সে আধোঅন্ধকারের মধ্যে হুড়মুড় করে চৌকির উপর পড়ে যায়, তারপর তার যখন সম্বিৎ ফেরে এবং চোখে ঘরের অন্ধকার সয়া আসে, সে হারিকেনের অল্প আলোয় দেখে যে, তার দেহের নিচে চাপা পড়ে আছে খৈমনের দেহ-তখন খৈমন হয়তো তাকে ভৎসনা করে, কি করেন, সরেন!

অথবা সে হয়তো তার শরীরের উপর চাপ দিয়া থাকা ময়লা মিঞার চোখ নাক এবং চাপা চিবুকের দিকে তাকায়া বলে, আমারে নিকি আপনে দেখেন নাইকা, অখনে দেইখা লন, আবার কয়েন না যে হারিকল বাত্তির আলোয় চোক্ষে দেখেন নাইকা কিছু!

ময়না মিঞা তখন কি করে তা বলা মুশকিল, সে হয়তো তার হাত দিয়া খৈমনের নরম তরুণ শরীর বেষ্টন করে এবং খৈমনের দিশা হরানোর দশা হয়, হয়তো খৈমন বলে, আমারে আপনে বিয়া করেন ময়না মিঞা, আপনে শ্যামবাজার ধন তরকারি কিন্না আননের পর আমি বাইছা ধুইয়া পরিক্ষার কইরা দিমু, আপনের কিছু করন লাগব না, আপনে খালি আরাম করবেন, পানবিড়ি খাইবেন, উক্কা টানবেন, তারপর আমি আপনের মাথায় গামছার বিড়া বানায়া চাঙ্গারি তুইলা দিলে আপনে বাজারে যাইবেন, আপনের যুদি নিকি তাও কষ্ট হয়, ভারি লাগে, আমি মাথায় কইরা চারি সয়া যামু আপনের পিছনে, অাপনে যাইবেন আগে আগে, আপনেরে দুকান সাজায় বহায়া দিয়া আমি ফিরা আমু বাইতে, আইসা আপনের লাইগা ভাত রান্দুম, ছান রাম, আপনের যা যা খাইতে মন চায় তার ব্যাক রাম, আপনে বেচাকেনা শ্যাষ কইরা আইসা ভাত খাইবেন, আমি তালের পাংখা লয়া বমু কাছে, আপনে আমারে বিয়া করেন; কিংবা খৈমন হয়তো দিশা হারায় না, ময়না মিঞা দ্রুত খৈমনের গায়ের উপর থেকে উঠে চৌকির এক কোনায় যায় বসে বলে, পোলাপানগুলান এমুন বদ, আমার পিছনে কুত্তা ইয়ায়া দিল।

: ডরাইছেন?

: না ডরামু কেন, পোলাপানগুলা খুবই বদমাইশ!

খৈমন ভিতরে যায়া তরিতে করে জরিমনের বানানো চাইলের পায়েস নিয়া আসে, কাচের গ্লাসে করে রুহ আফজা দিয়া বানানো শরবত আনে, ময়না মিঞা চিনামাটির অজ্ঞরি থেকে চামচের খচখচ শব্দ তুলে পায়েস খায়, ঢক ঢকর শব্দ করে শরবত খায়, খৈমন তার খাওয়া দেখে; তখন থৈমন টেবিলের উপরে রাখা হারিকেনের আলোর সামনে মুখ আগায়া নিয়া তাকায়া থাকে, তার চোখ বলে, আমারে দেখো, তার মুখ বলে, আমারে দেখো, তার বঙ্কিম অস্পষ্ট শরীর বলে, আমারে আবার দেখো ময়না মিী! ময়না মিঞা একবার হয়তো তাকায়, তারপর চাইলের ক্ষির খায়া ফি যাওয়ার পর সে বাবুল মিঞাকে বলে, আপনে বিয়ার ব্যবস্থা করেন, আর মাইয়ার বাপেরে জিগান আমারে কি দিব, এবং ফখরুল আলম লেদুকে যখন মামুনের মা মিসেস জোবেদা রহমান এইসব কথা বলে, তখন লেদু জিগাস করে, আপনে কেমনে জানলেন?

: বাহ জানুম না? এক মহল্লায় থাকি না!

বৈমনের তাহলে তখন ময়না মিঞার সঙ্গে বিয়া হয়া যায়, এইটা হয়তো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আগেই ঘটে, কারণ একাভুর সনে মার্চ মাসের পঁচিশ তারিখের রাইতে যখন যুদ্ধ লাগে তখন চানমিঞা হয়তো খৈমনের গর্তে, হয়তো তখন সে ভরা পোয়াতি, ফলে পাকিস্তানি মিলিটারির ভয়ে মহল্লার সকলে যখন পালায়া যায় কুমিল্লা কিংবা জিঞ্জিরার দিকে, তখন বৈমনের পক্ষে গৃহ ত্যাগ করা সম্ভব হয় না। মহল্লা একদম খালি হয়া গেলে জরিমন অস্থির হয় পড়ে, অব্দুিল জলিলও বিচলিত হয়; তারপর, মহল্লায় থেকে সকলে মিলে একসঙ্গে মরার চাইতে জরিমন মেয়েকে নিয়া বাসায় থাকে, আব্দুল জলিল তার ছেলে এবং মেয়ের জামাইকে নিয়া জিঞ্জিরার চরাইল গ্রামে জরিমনের মামাতো কিংবা খালাতো বোনের বাড়িতে যায় ওঠে। জিঞ্জিরায় পাকিস্তানি মিলিটারি ঢাকা থেকে পালায়া আসা লোকদের ইন্দুরের মত্ত ধরে, ফাটায়; ঢাকা শহরের নারী পুরুষ বৃদ্ধ শিশু এসে জড় হওয়ার পর তারা সেখানে অপারেশন চালায়, আব্দুল জলিল তার ছেলে এবং মেয়ের জামাইকে নিয়া জিঞ্জিরার ধান ক্ষেতের উপর দিয়া ছোটাছুটি করার পর মাঠের এক প্রান্তে একতলা একটা পাকা দালান দেখতে পায়, দালানের চাইর দিকে দেওয়াল দিয়া ঘেরা, দেওয়ালের একপাশে একটা কাঠের দরজা, এই দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। তখন আব্দুল জলিল এবং তার সজিদের মনে হয় যে, তাদের পক্ষে আর দৌড়ানো সম্ভব না, তাদের শরীরের শক্তি প্রায় শেষ এবং এইভাবে মাঠের ভিতর দিয়া দৌড়াইতে থাকলে পাকিস্তানি মিলিটারি তাদের দেখে ফেলবে এবং গুলি করে মারবে। তারা তাই বাড়িটার প্রাঙ্গণের দরজায় যায় ধাক্কা দেয়, কিন্তু কেউ দরজা খোলে না, তারা আবার ধাক্কায়, আবার কেউ আসে না, তখন তারা নিচা স্বরে ডাকে, আমাগো বাঁচান, দরজা খোলেন!

তবুও দরজা না খুললে রশিদুল দেওয়াল টপকায়, টপকাইতে হয়, কারণ জান বাঁচান ফরজ, সে ভিতরে ঢুকে দরজা খুলে দিলে আব্দুল জলিল এবং ময়না মিঞা বাড়ির ভিতরে ঢোকে এবং তারা দেখে যে দালানের ঘরের দরজা খোলা। তখন তারা কাছে যায় ঘরের ভিতরে উকি মারে, এবং দেখে ঘরের মধ্যে আজানুলম্বিত সাদা আলখাল্লা পরা একজন লম্বা দাড়িঅলা লোক মাটিতে পাতা মাদুরের উপর বসে দেওয়ালে হেলান দিয়া চোখ বুজ্জে তসবি টেশে, তাকে ধ্যানমগ্ন মনে হয় তার হাতের দুইটা আঙ্গুল শুধু নড়ে। এই লোকটাকে দেখে তাদের বিস্ময় লাগে, কথা বলে কিংবা ঘরের ভিতরে ঢুকে লোকটার ধ্যান ভাঙ্গাইতে তাদের ভয় হয়, তারা ঘরে কিংবা ঘরের বাইরে উঠানে আর কোন লোকজন দেখে না, তারা অন্য এক ধরনের বিপদের মধ্যে পড়ে। তারা বাইরের প্রাঙ্গণের দরজা লাগায়া দিয়া নিচা হয়া উঠানের এক কোনায় বসে থাকে, এবং তিন জনেই বিড়বিড়ায়া দোয়া পড়ে; তখন অনেক সময় কাটে, তারপর তারা দূরে জনতার অস্পষ্ট কোলাহল শোনে, তারা কান খাড়া করে থাকে, কোলাহল ক্রমে কাছে আসে এবং তখন তারা কোলাহলের ভিতর থেকে শব্দাবলী বিছিন্ন করতে পারে, তারা শোনে জনতা শ্লোগান দেয়, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, আব্দুল জলিল এবং তার সঙ্গিরা বুঝতে পারে যে, পাকিস্তানি মিলিটারি হয়তো এদিকে এগিয়ে আসছে এবং মিলিটারি দেখে মানুষ ভয়ে শ্লোগান দেয়। জনতার শ্লোগানের শব্দ স্পষ্ট হতে হতে একদম কাছে এসে পড়ে, তখন তাদের কলিজার পানি শুকায়া যায়, তারা উবু হয়া থেকেই দৌড় দিয়া যায় ঘরের মধ্যে ঢোকে, এবং তাদের দেখে লম্বা আলখাল্লা পরা লোকটা উঠে খাড়া হয়, তার ডাইন হাতটা শরীরের পাশে একটু উঁচা করে ধরা এবং এই হাতে বাদামি রঙের পুঁতি দিয়া গাঁথা তসবির মালা অনিশ্চিতভাবে দোলে, সে প্রবল চঞ্চলতায় অস্থির হয় পড়ে, আব্দুল জলিল এবং তার সঙ্গি অন্য দুই জনের কোন পরিচয় জানার আগেই বলে, আপনেরা থাকেন, আমি গেলাম; তারপর সে ঘর থেকে বের হয়া বাড়ির পিছনের দেওয়াল টপকায়া নেমে যায়। তাদের কিছু করার থাকে না, তারা পিছনের দেওয়াল টপকায়া এই লোকের মত পালানোর ইচ্ছা বাদ দেয়, তারা ঘরের ভিতরে তিনজনে মাদুরের উপরে দেওয়ালে ঠেস দিয়া বসে থাকে, দোয়াদরুদ পড়ে; আব্দুল জলিল পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়া একটা কিস্তি টুপি বের করে মাথায় দেয়, তারপর, আবার কিছু সময় কাটে, তাদের মনে হতে থাকে যে, মিলিটারির বিপদ হয়তো কেটে গেছে, ফলে তারা উৎকণ্ঠা এবং ক্লান্তিতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়া পড়ে, এই সময় অনেকটা ঘুমের ভিতরেই তাদের মনে হয়, কোথাও কেউ দরজায় ঠকঠকায়! তাদের তন্দ্রা কেটে গেলে তারা কান পাতে এবং নিশ্চিত হয় যে, এই বাড়ির বাইরের দরজায় বেশ জোরে থাপড়ায় কেউ, তাদের কোন উপায় থাকে না, রশিদুল অথবা ময়না মিঞা, হয়তো রশিদুলই, যায় দরজা খুলে দেখে সামনে চাইনিজ রাইফেল হাতে খাকি পোশাক পরা মিলিটারি, তারা দরজা ঠেলে প্রাঙ্গণে ঢোকে, তাদের একজন বলে, ইয়ে কেয়া দারবিশকা মাকান হায়? কাহা হায় তুমহারা দারবিশ?

রশিদুল কি বোঝে বলা মুশকিল, সে ভয়ের চোটে হাত তুলে ঘরের দিকে দেখায় এবং বলে, এই, এই।

সেইদিন দুপুরে মিলিটারি যখন এই ঘরের দরজায় এসে খাড়ায়, তারা ভিতরে দেওয়ালে হেলান দিয়া বসা মাথায় টুপি পরা দাড়িঅলা আব্দুল জলিলকে পায়, এবং তারা বলে, আপ দারবিশ হায় কেয়া?

মিলিটারি দেখে আব্দুল জলিল উঠে খাড়ায়, মিলিটারিরা তা দেখে অস্থির হয়া ওঠে, আগের সেই লোকটাই কথা বলে, হয়তো সেই এই চাইর/পাঁচজনের দলের সর্দার, সে যখন বলে, আপ বৈঠিয়ে জি, আপ বুজুর্গ হায়, আপ বৈঠিয়ে, তখন আব্দুল জলিল বসে, এই সুযোগে রশিদুল এবং ময়না মিঞার মনে হয় দৌড় দিয়া পালায়া যায়, কিন্তু দুইজন মিলিটারি ঘরের দরজায় খাড়ায়া বাইরের দিকে তাকায়া ছিল, ফলে তাদের পক্ষে দৌড় দেওয়া সম্ভব হয় না, তারা খাড়ায়াই থাকে, থাকাই লাগে। তবে একটা জিনিস তাদের কাছে পরিষ্কার হতে থাকে, হয়তো ঘরের ভিতরে আতঙ্কে ঘেমে গোসল করে ওঠা আব্দুল জলিলও ব্যাপারটা অল্প অল্প বুঝতে পারে; যে লোকটা দেওয়াল টপকায়া পালিয়েছিল তাকে হয়তো এলাকার মানুষ দরবেশ বলে ডাকে, সে কথা পাকিস্তানি মিলিটারি পাবলিকের কাছে শোনে, এখন এখানে এসে আব্দুল জলিলকে দেখে তারা বিভ্রান্ত হয়, তার লম্বা সাদা দাড়ি এবং মাথার টুপি তাদের জন্য বিভ্রম তৈরি করে রাখে-আব্দুল জলিলের ময়লা পাঞ্জাবি, তারচাইতেও ময়লা লুঙ্গি দেখেও বিষয়টা তাদের কাছে পরিষ্কার হয় না-তখন আব্দুল জলিল পুনরায় মাদুরের উপর বসে, হাত দিয়া মাদুরের খালি জায়গা দেখায়া দিয়া বলে, আপনেরা বসেন। এটা নিশ্চিত যে, আব্দুল জলিলের কথা তারা কিছু বোঝে নাই তবে মাদুরের দিকে ঈঙ্গিত করায় তাদের সর্দার, হয়তো বালুচ কিংবা পাঞ্জাব কিংবা সিন্দ রেজিমেন্টের ল্যান্সনায়েক অথবা নায়েক সুবেদার খামিসু খান। কিংবা শাহবাজ খান কিংবা বাচ্চা খান মাথা ঝাঁকায়, নেহি নেহি, হামলোগ নেহি বৈঠেগী, আপকা ইয়াহা কেয়া পানি হায়, হাম পানি পি সাকতা?

তখন বোঝা যায় যে, পাকিস্তানি মিলিটারি মানুষ মেরে হয়রান হয়া গলা শুকায়া ফালায়, এবং তারা দরবেশের বাসায় পানি খেতে আসে, ফলে আব্দুল জলিল হাঁক দেয়, রশিদুল, ময়না মিঞাঁ এই দিকে আহহ!

রশিদুল এবং ময়না মিঞা মিলিটারিদের ঠেলে দুই আসামির মত কাপতে কাপতে ঘরের ভিতরে এসে খাড়ায়, তখন আব্দুল জলিল বলে, ইনারা পানি খাইব, ইনাগো লাইগা পানি আনো!

রশিদুল এবং ময়না মিঞা বুঝতে পারে, পাকিস্তানি মিলিটারিকে পানি খাওয়াইতে না পারলে জান বাঁচবে না, তারা বাইরের এই ঘর থেকে পিছন দিকের একটা ঘরে যায় এবং সেখানে এলুমিনিয়ামের জগ এবং কাচের দুই/তিনটা গ্লাস পায়, কিন্তু তারা দেখে যে, জগে কিংবা ঘরের কোথাও পানি নাই, তখন ঘরে পানি না পায় তারা গ্লাসগুলা মাদুরের উপর রেখে জগ নিয়া বের হয়, তারা ঠিক করে যে, পানি পেলে তারা ফিরবে, না পেলে আব্দুল জলিলকে ফেলেই ভেগে যাবে। কিন্তু তারা বাড়ির পিছন দিকে একটা চাপকল পায় এবং ময়না মিঞা কলের হাতল চেপে জগে পানি ভরে, তখন রশিদুল পিছনের দেওয়ালের কাছে যায় পায়ের পাতার উপরে উঁচা হয়া দেওয়ালের অন্য পাশে তাকায়, সে দেখে যে, দেওয়াল থেকে সামান্য দূরে বাড়ির ভিটা ঢালু হয়া নেমে যায়া ক্ষেতের সঙ্গে মিশেছে, এইখানে ভিটার ঢালের উপরে দরবেশের গুলি খাওয়া প্রাণহীন এলোমেলো দেহ উপুড় হয়া পড়ে আছে; কিন্তু বাবুল মিঞা যখন খৈমনের বিয়া ঠিক করে, তখন পোলার যৌতুকের দাবীর কথা শুনে আব্দুল জলিল এবং জরিমনের আক্কেল গুড়ুম হয়, তারা বলে, এইটা কেমুন পোলা, কয় জিগান আমারে কি দিব, এবং তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয় যে, পোলাটা ভাল না, সে তাদের মাথায় চড়ে যাচ্ছে, তখন তারা পুনরায় বলে যে, তাদের মেয়ে অত সস্তা না যে, এক তরকারি বিক্রেতার সঙ্গে দেওয়া-খোয়া করে বিয়া দিতে হবে, দিমু না বিয়া মাইয়ার।

কিন্তু খৈমনের এত উত্তেজনা হয় না, সে বলে, জিগাও কি চায়, যা চায় দিয়া দেও!

ময়না মিঞা তাদের বাড়ির অর্ধেকটা দাবী করে, শুনে খৈমনেরও কান্দা এসে যায়, সে কান্দে আর কান্দে, এই কান্দা ফুরায় না, তার মনে হয় যে, এ কেমন লোক, একটা তরকারিঅলা মাত্র, কোন অফিসের দারোয়ান না, পিয়ন না, স্কুলের দপ্তরিও না, ফকির একখান, সে কিনা ঢাকা শহরের এক কাঠা জমির উপরকার বাড়ির অর্ধেক ভাগ চায়! যখ, কান্দাই গৈমনের সাথি হয়, তখন বাবুল মিঞা আসে, সে অবস্থার বিচার বিশ্লেষণ করে দেখে, তার এ বিষয়ে সন্দেহ থাকে না যে, গ্রামের পোলাটা খুবই অবিবেচক, সে একটা মুদি দোকান করার পয়সা চাইতে পারতো, সে অন্য কোন ব্যবসা করার বায়না ধরতে পারতো, তা না করে সে একেবারে কইলজায় হাত দিয়া দিল, তখন বাবুল মিঞা পুনরায় হুমায়ুন কবিরের কথা বলে, এবং তার এই কথা শুনে খৈমন দ্রুত কান্না থামায়, সে তার মাকে বলে, যা চায় দেও, আমি যেটুকু পামু সেইটুকুই দিয়া দেও, আমারইতো থাকব।

আব্দুল জলিল এবং জরিমন শেষে মেনে নেয়, রশিদুলও আপত্তি করে না, বিয়ার দিনই সাদা ফুলসক্যাপ কাগজের উপরে লেখা দানপত্রের নিচে আব্দুল জলিল চোখের পানি মুছে নিয়া আঁকাবাকা হাঙে সই করে, এর পরেই কেবল ময়না মিঞা কবুল বলে। এইভাবে মোছা : খৈমনের বিয়া হয় এবং বাসর রাইতে প্রথমেই সে ময়না মিঞাকে জিগাস করে, আপনে এমুন করলেন!

: কি করছি আমি।

: বিয়া করনের লাইগা বাড়িই লেইখা লইলেন?

: তুমি কুত্তা লাগাইছিলা, আমি বাড়ি নিলাম!

খৈমন হয়তো ভাবে এই লোকটা কি গনক? কিভাবে জানলো যে, সে এই কাজ করেছে। অথবা হয়তো তার অবাক লাগে, মনে হয় যে, কি বলে লোকটা, কিসের কুত্তা, সে কেন কুত্তা লাগাতে যাবে, আশ্চর্য!

সে বলে, আমি কুত্তা লাগামু ক্যালা!

আমি জানি!

তবে খৈমনকে জানতে ময়না মিঞার হয়তো আরো বাকি ছিল, ফলে ময়না মিঞা যখন বাসর ঘরে ঢোকে খৈমন বোঝে, তার পাঞ্জাবির পকেটের ভিতরে একটা কাগজ আছে এবং তার মনে হয় যে, এটা অর্ধেক-বাড়ি লিখা দেওয়ার দানপত্র, লোকটার এই কাগজ বেখে আসার একটা জায়গা পর্যন্ত নাই, এমন একটা লোক এই কাজ করলো! যাহোক, আব্দুল জলিল হয়তো বলে, মাইয়ার মুখের দিকে তাকায়া করলাম; জরিমনের মন হয়তো ভার হয়া থাকে, তবু সে ভাবে, মাইয়াটার বিয়া দেওন ফরজ আছিল! তখন মনে হয় যে, বাসর রাইতে ময়না মিঞা হয়তো খৈমনের সঙ্গে একটু বেশি কথাই বলে, কারণ, তরকারি বিক্রেতা ময়না মিরি বাড়ি লিখা দেওয়ার আবদারী বাড়াবাড়িই ছিল, ফলে এই কারণে, অথবা বিয়াজনিত ধকলের কারণে খৈমন লাল বেনারসি অথবা লাল রঙের অন্য কোন শাড়ি পরে বাসর শয্যায় হয়তো বিমর্ষ হয়াই বসে ছিল, আব্দুল জলিলের বাড়ি লিখা দেওয়ার সময়কার চেহারাও তাকে হয়তো খুবই বিচলিত করে রাখে-তারপরেও সে একটা আনন্দের প্রতীক্ষায়ই ছিল। কিন্তু ময়না মিঞা তাকে কুত্তা লেলায়া দেওয়ার বিষয়ে অভিযুক্ত করলে তার ভাল লাগে না, রাইত একটু গড়ালে ময়না মিঞা যখন প্রথম সহবাসের আয়োজনে ব্যস্ত হয়, তখন খৈমন প্রথমে চুপ করে থাকে, তারপর বলে, পাঞ্জাবির পকেটের ভিতরে কি রাখছেন, খচড়মচড় করে!

ময়না মিঞা কিছু বলে না, তখন খৈমন আবার বলে, কাগজ বাইর কইরা টেবিলের উপরে রাখেন না ক্যালা?

উত্তেজনায় বেহুশ ময়না মিঞা তাই করে, পকেটে ভাজ করে রাখা শক্ত কাগজটা বের করে সে শয্যার পাশের টেবিলের উপরে রাখে, তারপর কাজ শেষে বিছানায় কাইত অথবা চিৎ হয়া শুয়ে থাকে এবং খৈমন দ্রুত উঠে কি সব করে, টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি টেলে খায়, ময়না মিঞাকৈ দেয়, এবং এই কাজ করতে যায় সে দুর্ঘটনা ঘটায়, তড়বড় করায় জগ কাইত হয়া পড়ে, জগের ভিতরের অবশিষ্ট পানি টেবিলের উপরে গড়ায়া যায় ময়না মিঞার হঠাৎ পাওয়া বাড়ির দলিল ভিজায়া দেয়; ময়না মিঞা বলে, কি হইলো?

শৈমন কিছু বলে না, ময়না মি হয়তো ক্লান্ত ছিল, ফলে সেও চুপ করে থাকে, তারপর তারা ঘুমায়া যায়, অথবা ঘুমায় না, ময়না মিঞা অনেকক্ষণ পর আবার জিগাস করে, কি হইছে? এবং তখন মৈন বলে যে, জগের পানি পড়ে গেছে টেবিলের উপরে, তারপরেও হয়তো ময়না মিঞা ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। তখন অনেকক্ষণ পর ময়না মিঞা বিছানা থেকে ওঠে, সে দেখে, খৈমন দেওয়ালের ধার ঘেঁষে চৌকির ওপর গুটিশুটি হয়া ঘুমায়, তারপর হারিকেনের সলতে বাড়ায়া দিয়া সে যখন পেশাব করার জন্য বাইরে যাওয়ার আয়োজন করে, সে খেয়াল করে যে, টেবিলের উপর তার শ্বশুরের লিখা দেওয়া জমির দলিল ভিজা কাই হয়া আছে! ময়না মিঞার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়া যাওয়ার যোগাড় হয়, সে বাত্তির সলতে আরো বাড়ায়া দিয়া কাগজটা তুলতে গেলে পানিতে অনেকক্ষণ ধরে ভেজায় সেটা ছিঁড়া যায়; তখন সে আর্তনাদ করে ওঠে, তারপর সতর্কতার সঙ্গে কাগজের ভাজ খুলে টেবিলের উপরে বিছায়া দেখে যে, আব্দুল জলিলের কলমের কালিও হয়তো পাকা ছিল না, হয়তো হিরো ওয়াশএবল রয়াল ব্লু কালি ছিল, ফলে পানিতে সব ধুয়ে সাফ হয়া গেছে, নিল দাগ ছাড়া কাগজে আর কিছু নাই। ময়না মিঞা তখন কান্দে, বিক্রমপুইরা পোলা, লম্বা কালা উঁচানাকের তরকারি বিক্রেতা ভেউভেউ করে, তার কানে অবশ্যই খৈমনের ঘুম ভেঙ্গে যায়, সে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে, কি করেন, কি করেন আপনে, তখন অন্য ঘর থেকে বাসার সকলে উঠে আসে, তারা দেখে যে, নতুন জামাই বাসর রাইতে কেন্দে বুক ভাসায়; কিন্তু সে কিছু বলতে পারে না, তখন খৈমন তাকে সান্ত্বনা দেয়, আপনে কাইন্দেশ না এমুন কইরা, একটা কাগজ গেছে, আর একটা লেইখা দিবলে! ফলে খৈমনের প্রসঙ্গে জোবেদা বহমান যে ক্ষেপে, মনে হয় তার পিছনে কারণ আছে, তবে আবার হয়তো বলা যায় খৈমন আসলে কোন সেয়ানামি করে নাই, ঘটনাগুলা ঘটেই এইভাবে এবং এতে তার কোনই হাত ছিল না-ভলু এটা প্রমাণ করা খুবই কষ্টকর হয়। তবে খৈমন যদি চালাক হয়াই থাকে তাতে মামুনের মার কি ক্ষতি তা বুঝতে পারা যায় না, অবশ্য অনেক বছর পর চানমিঞী যখন মহল্লায় বান্দর বাহিনী গঠন করে, তখন মনে হয় যে, জোবেদা রহমান যুক্তি দিয়া বোঝার আগেই প্রবৃত্তি দিয়া কিছু জিনিস হয়তো বুঝতে পেরেছিল—একদিন এই বান্দরেরা তার কি করবে-যদিও হয়তো তার কাছে বিষয়গুলা খুব পরিষ্কার ছিল না। তখন মনে হয় যেন ধৈমনের নিন্দা করা তার একমাত্র কাজ হয়, ফখরুল আলম লেদুকে অথবা অন্য কাউকে সে হয়তো বলে যে, কেমুন চালাক মায়ালোক দেখ, পোলার দেখাশোনা করার সময় নাই দেখে কেমন করে কি ভাবে জংলি একদল জানোয়ারকে সে এই কাজে লাগায়া দিল, খাট তরা. আমি আরাম করি; ফলে বান্দারে চানমিঞাকে দুধ খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়, পাহারা দিয়া রাখে, আর ওই বেটি মহল্লায় টো টো করে। এই কথা হয়তো ঠিক, অথবা ঠিক না, কারণ জঙ্গলের বান্দর দিয়া হয়তো এত কিছু করা সম্ভব না, কিন্তু খৈমন নিজেও কি এইসব কথা নুরানি বিলকিস উপমাকে বলে নাই? নুরানি বিলকিস মাঝেমধ্যে বিরক্ত হলেও তার সঙ্গেই খৈমনের ভাব, সে সুযোগ পেলেই তার ৩৬নম্বর বাসা থেকে নুরানি বিলকিসদের ৩৭নম্বর বাসায় যায়, বলে, আফা আমারে কিছু একটা দেন!

সেদিন নুরানি বিলকিসের শরীর এবং মন ভাল ছিল, সে বলে, কি দিমু? চিনি দেই এক কাপ লয়া যা।

: চিনি দিয়া কি করুম, চিনি উড়াইছি।

: তাইলে এক বাটি ছালুন লায়া যা, বেগুন দিয়া খইলসা মাছ রানছি।

কিন্তু দেখা যায় যে, খৈমনকে যত ছোচা মনে করা হয় তত ছোচা সে, সে বলে যে, ছালুনের তার দরকার নাই।

: তাইলে কি নিবি?

: আমারে একটা শাড়ি দেন। নুরানি বিলকিসের তখন সত্যি রাগ হয়।

: ছাড়ি চাছ, তুই জানছ একটা ছাড়ির দাম কত?

: পুরান দেইখা দেন!

তখন নুরানি বিলকিসের রাগ কমে।

: তর পোলারে ঘরে রাইখা আহস ডরাছ না?

: বান্দরগুলিরে ডরাই, কিন্তু কি করুম, বাইরেতো যাওনই লাগে।

বান্দরগুলাকে খৈমন কেন ডরায় সেই গল্পও সে হয়তো নুরানি বিলকিসের কাছে করে, অথবা হয়তো অতটা করে না, কিছু করে কিছু চেপে যায়, হয়তো বানায়াও বলে কিছু। সে বলে যে, একদিন কোত্থেকে যেন সে ফিরেছে, হয়তো উপমা বেগমদের বাসা থেকেই ফিরেছে, ফিরে দেখে যে, তার ঘরের সামনে দেওয়ালের উপর সারি দিয়া বান্দরেরা বসা, তাকে ফিরতে দেখে তারা অলসভঙ্গিতে একে অপরের উকুন বাছে, এইরকম তিন/চাইর দিন ঘটে, তার খুব ভয় লাগতে থাকে, এবং সে দেখে যে, এই বান্দরের দলের মধ্যে কোলে কচি বাচ্চা একটা বান্দরনিও আছে, আর এই বান্দরনিটা ঘরের খোলা জানালার শিকের ফাঁক দিয়া চৌকিতে শোয়ানো চানমিঞার দিকে কেমন করে তাকায়া থাকে, দেইখাতো আমার কইলজার পানি শুকায়া যায়, সে বলে। তারপর সে তার ঘরের জানালায় পুরান শাড়ি কেটে পর্দা লাগায়, সে বলে যে, সে যখন কাছেই কোথাও যায়, ছেলেকে ঘরের ভিতরে রেখে তালা লাগাতে তার ইচ্ছা করে না, খারাপ লাগে—সে শিকল তুলে দিয়া বাইরে যায়। কিন্তু বান্দরের উৎপাতের কারণে জানালায় পর্দা লাগায়া তার হয়তো কোন লাভ হয় না, কারণ বান্দরতো বান্দরই, তারা পর্দা খুলে ফেলে; সরপর খৈমন যখন জানালা বন্ধ করে দিতে শুরু করে তখন বান্দরেরা যড়াবাড়ি করে ফেলে, তাদেরতো অতো জ্ঞান নাই, বান্দরগুলা একদিন দেওয়ালের উপর বসে পরস্পরের পিঠ চুলকাতে যায় যখন দেখে যে, খেমনের ঘরের জানালা বন্ধ তাদের খারাপ লাগে, তখন মা বান্দরটা পথ দেখায়, বান্দরের দল দরজার শিকল খুলে ঘরের ভিতরে ঢুকে বসে থাকে, তাকের উপর থেকে ভাতের পাতিলা নামায়া ভাত খায়, বাচ্চা বান্দরটা তার মায়ের পায়ের চিপা থেকে বের হয়া ফালাফালি করে, ফলে তখন মুতে ভিজায়া রাখা খেতার মধ্যে শোয়া চানমিঞার ঘুম ভাঙ্গে এবং বান্দরের বাচ্চাটা তার সঙ্গে খেলা জুড়ে দেয়। বান্দনিটা শুয়ে বসে এই খেলা দেখে, তারপর সে তার বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায়, তখন চানমিঞা কেন্দে উঠলে এই বান্দরনি তার মুখে দুধের বোঁটা গুজে দেয়; যদিও ফখরুল আলম লেদু বলে যে, এইটা সম্বব না, কিন্তু লেদু বললেতো হবে না, লোকে তার কথা মানবে কেন? খৈমন যদি বলে যে, বান্দরেরা তার বাসার দেওয়ালের উপর বসে থেকে চান মিঞাকে পাহারা দেয়, তা যদি তারা পারে, তাহলে এই বান্দরেরা ঘরে ঢুকে দুধ খাওয়াতে কেন পারবে না! খৈমন হয়তো এত ঘটনা জানে না, নিজের ছেলেকে সে হয়তো বান্দরের দুধ খাওয়াতে চায় নাই, কিন্তু মিসেস জোবেদা রহমান যদি এই কথা না মানে, তাহলে সে না মানতেই পারে। ফখরুল আলম অথবা অন্য কাউকে হয়তো সে বলে যে, শুধু দুদ খাওয়ানোই না, খৈমন তার ছেলের লালনপালনের ভার মহল্লার বান্দরদের হাতে ছেড়ে দেয়, নিজে ঠোঙ্গা বানায়া বেচার ধান্ধায় ব্যস্ত হয়া থাকে, তার প্রমাণ চানমিঞার জন্মের পর তাগড়া শরীর থাকা সত্ত্বেও তার নিজের বুকের দুধ মরে গেলে সে প্রথমে গোয়ালার কাছ থেকে দুধ নিতে শুরু করে, দয়াগঞ্জ কিংবা জোরপুলের পানির টাঙ্কির কাছ থেকে দুধঅলা এসে দুধ দিয়া যেতে থাকে, কিন্তু যেই মাত্র সে বন্দিরগুলাকে, বিশেষ করে দুধঅলা বান্দরনিটাকে দেখে অমনি তার বুদ্ধি গজায়, সে বান্দরনিটাকে কিভাবে ম্যানেজ করে এবং গোয়ালার দুধ নেওয়া ছেড়ে দেয়, চান মিঞা বান্দরনির মাঙ দুধ খায়া বড় হতে থাকে; দ্বিতীয়ত, খৈমন দেখলো যে, বান্দরগুলা উৎপাত করছে, ঘরের ভিতর কষ্টি পোলাটার দিকে বান্দরনিটা বিষণ্ণ চোখে তাকায়া থাকে, দেখে সে বিচলিত হলো, জানালায় পর্দা লাগালো, পরে জানালার পাল্লাও লাগায়া দিল, কিন্তু সে দরজাটা এমনভাবে রাখলো যাতে বান্দরেরা শিকল নামায়া ঘরে ঢুকতে পারে, এবং জোবেদা রহমান বলে, কেমুন চালাক মায়ালোক আল্লা!

চানমিঞা বান্দরের দুধ খেয়েছিল কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল, তবে তার নাম বন্দরের সঙ্গে বেশি করে জুড়ে যাওয়ায় পরে হয়তো সে বান্দরদের দিকেই ঝুঁকে পড়ে, এবং তখন বিষয়টা জোবেদা রহমানের জন্য ভাল হয় না, বান্দরেরা তার বাড়ির ছাদে এসে হোগে যেতে থাকে! তবে খৈমনের হয়তো কিছু করার ছিল না, তার যুক্তিও খুব দুর্বল না, দূরে গেলে সে চানমিঞাকে কোলের মধ্যে করে নিয়াই যেত, কিন্তু বাড়ির কাছে থাকলে ছেলেকে তালা দিয়া রাখায় মায়ের মন না মানতেই পারে, আর এই ফাঁকে বান্দরেরা যদি কিছু করে, সেজন্য তাকে সেয়ানা বা চালাক বা বদমাইশ বলা ঠিক না।

ফলে খৈমন হয়তো আবার ঘরের দরজায় শিকল তুলে দিয়া বিকাল বেলা নুরানি বিলকিসের বাসায় যায়, যাওয়ার সময় সে দেখে আসে যে, দেওয়ালের উপর লম্বা লাইন দিয়া বান্দরের দল বসে আছে, সে বান্দরগুলার কাছে একটু থামে, বাচ্চাঅলা বান্দরনিটার দিকে তাকায়, তার তাকানো দেখে বান্দরদের হয়তো অস্বস্তি লাগে, তারা তাদের লম্বা হাত দিয়া শরীর চুলকায়, চোখ পিটপিট করে মুখ ঘুরায়া নিয়া অন্যদিকে তাকায়া থাকে। খৈমন তারপর নুরানি বিলকিসের কাছে যায় হাজির হয়, বলে, আহনের সুময় দেকলাম বান্দরগুলা লাইন দিয়া আমার ঘরের সামনে দেওয়ালের উপরে বয়া রইছে, আমারে দেইখা চোখ পিটপিটায়।

: পোলা রাইখা আহছ, তার ডর লাগে না!

: কি করুম? অখনে মনে হয় বান্দরগুলা খরাপ না।

: কুলে উঠায়া লয়া যাইব গা তর পোলারে দেখি!

নুরানি বিলকিস তার আশঙ্কার কথাই শুধু বলে, কিন্তু এটা পরে জানা যায় যে, মানুষ যা ভাবে তা ঘটতে পারে যদি তার অনুকূল পরিস্থিতি থাকে, এ ক্ষেত্রে অনুকূল অবস্থা ছিল, খৈমন বান্দরের ব্যাপারে ক্রমে সাহসী হয়া ওঠে এবং বেখেয়াল হয়া পড়ে, তখন শিশু চানমিও হয়তো বাচ্চা বান্দরটাকে পছন্দ করতে থাকে, ফলে বান্দরনিটা একদিন তাকে তুলে নিয়া যায়। খৈমন যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারে তখন তার কিছুই করার থাকে না, অথবা হয়তো তুতদিনে বন্দিরদের এইসব আচরণে তার আর কিছু মনে হয়, সে ব্যাপারটা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু নুরানি বিলিকিসের কাছে সে প্রথমে ধরা পড়ে, কারণ, একদিন রাইতের কোন এক সময় টাট্টিতে যাওয়ার জন্য নুরানি বিলকিস উপমা ঘরের দরজা খুলে বের হলে তার মনে হয় যে, কাছেই কোথাও ছোট বাচ্চা কান্দে সে প্রথমে ভাবে খৈমনের ঘর থেকে হয়তো এই শব্দ আসে, তারপর সে বুঝতে পারে যে, এই কান্দার শব্দ আসে আশপাশের কোন দালানের ছাদের উপর খেকে, তখন সে একটু বিচলিত হয়, কিন্তু ঘরে ফেরার পথে সে যখন পুনরায় কান্নার শব্দ পায়, তখন কুয়ার পাড়ে খাড়া হয়ে সে বান্দরের কিচিরমিচিরও শোনে এবং খুব ভীত হয়া পড়ে, তার মনে হয় যে, বেহুঁশ বেখেয়াল মেয়েলোকটার পোলাটারে বন্দিরে নিয়া যায় নাইতো, হায় আল্লা! তখন সে খৈমনদের বাসার দেওয়ালের কাছে উঁচা করা ইটার উপরে খাড়ায়া খৈমনকে ডাকে, এত রাইতে ডাক শুনে খৈমন ঘুম থেকে উঠে আসে এবং জানালার পাল্লা ফাঁক করে উঁকি দিলে নুরানি বিলকিস তাকে বলে যে, চীনমিঞাকে বান্দরেরা নিয়া গেছে। খৈমন অবাক হয় এবং বলে, কি কন আপনে!

: কি কমু, কুয়ার পাড়ে খাড়ায়া হুনলাম ছাদের উপরে পোলা কান্দে।

: আপনে যায়া ঘুমান, আমার পোলা না!

০৪. ডলি আক্তারের অবস্থা

ডলি আক্তারের অবস্থার যখন কোন উন্নতি হয় না তখন আব্দুল ওদুদ চৌধুরি পুনরায় মোজাহার ডাক্তারের কাছে যায়, তবে ডাক্তারের কিছু করার থাকে না, সে পুনরায় শুদুদ চৌংয়ের বাড়িতে আসে এবং ডলি আক্তারকে পরীক্ষা করে বিদায় নেয় এবং আব্দুল ওদুদ মিঞা ভুলু নদী পার হয়া–মির্জাখিল মাজারে যায়া মাজারের গদ্দিনশিন পীর হযরত মওলানা জালালুল হাইয়ের কাছ থেকে আরো দুইটা তাবিজ এনে ডলি আক্তারের গলায় ঝুলায়া দেয়। তারপর যখন সময় হয় ডলি আক্তার এবারও বেশি সময় নেয় না, তবে শরীর দুর্বল থাকায় আম্বিয়ার মাকে খবর দেওয়ার পর সে মূর্খা যায়, মাদুরের উপর বেহুশ হয়া থাকে, তখন আম্বিয়ায় মা আসে এবং ডলি আক্তারের যখন জ্ঞান ফেরে সে দেখে যে, তার বুকের উপরে দুইটা শিশু, আম্বিয়ার মা তাদের নাড়ি কেটে পরিষ্কার করে খেতায় জড়ায়া দিয়েছে, আম্বিয়ার মা বলে, একগুয়া মাইয়া একগুয়া মরদ ফোয়া-আল্লার ইচ্ছা। ডলি আক্তার ভ্যাবাচেকা খায়া যায়, তবে সে হয়তো ভাবে যে, এটা হতেও পারে, নয় কেন, মানুষের কি না জানায়া যজ বাচ্চা হয় না। কিন্তু ডলি আক্তারের সন্দেহের কারণে, আব্দুল ওদুদের মনে সন্দেহ আসে এবং সে মোজাহার ডাক্তারকে খবর দিয়া ডেকে আনে; খবর পায়া ডাক্তার হন্তদন্ত হয়া দৌড়ায়া আসে, এবং আব্দুল ওদুদের কথা শুনে সে বোকা হয়া যায়, সে তাদের কথার মানেই বুঝতে পারে না, তার মনে হয় যে, এরা এইরকম করে কেন? মেয়ে সন্তান না হলে তাদের ভাল লাগে না, আবার হলে পড়ে এত কথা বলে, আশ্চর্য; যাহোক তখন সাতকানিয়া বাজারের একমাত্র এমবিবিএস ডাক্তার এই বিষয়ে একমত হয় যে, এইরকম না হতে পারার কোন কারণ নাই, একটা বাচ্চা আছে মনে করলেও দুইটা থাকতে পারে, তিনটাও পারে। তখন আব্দুল আলি মিঞা তার ছয় নম্বরু নাতির নাম রাখে আব্দুল ওহাব চৌধুরি এবং চিন্তা ভাবনার পর সদ্যজাত মেয়ের নাম রাখা হয় আসমানতারা ঘুরে জান্নাত।

মোজাহার ডাক্তারের বিস্তারিত ব্যাখ্যার পর ডলি আক্তারের সন্দেহ থাকে না যে, তার পেট থেকে একই সঙ্গে আব্দুল ওহাব এবং হুরে জান্নাতের জন্ম হওয়া সম্ভব; কিন্তু আসমানতারাকে নিয়া তার মন তবু খুঁতখুঁত করে—আসমানতারাকে নিয়া তার এই সন্দেহ হয় কেন? এর কারণ কি এই যে, সে ভাবেই নাই তার মেয়ে হবে বা হতে পারে। ফলে তার জ্ঞান ফিরা আসার পর আম্বিয়ার মা যখন তাকে একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে হওয়ার কথা বলে, মনে হয় যেন তার আনন্দ হয় না, তার মনে হতে থাকে যে, ব্যাপারটা বানানো, কিন্তু সে যখন তার বুকের উপর দুইটা নরম মাটির পিরে মত দুইটা শিশু দেখে সে বুঝতে পারে যে, কথা মিথ্যা না; কিন্তু তারপরেও তার সন্দেহ যায় না। ডলি আক্তার পরে ভেবে দেখার চেষ্টা করে যে, প্রথম দিন দুইটা বাচ্চার দিকে সে যখন তাকায় তখন তার মনে হয় একদম কচি আব্দুল ওহাবের পাশে মেয়েটাকে কেমন ডাঙ্গর দেখায়, ঝরঝরে লাগে; কথাটা সে হয়তো আম্বিয়ার মাকে বলে, তার মনে হয় যে, আম্বিয়ার মা তার কথা শুনে কেমন ঘাবড়ায়া যায়, অথবা হয়তো বিষয়টা তার মনের ভুলই ছিল, আম্বিয়ার মা তার কথা শুনে বলে, অনে ইন হতা ন কইওন, মাইয়া পোয়াতে ইবা আগে হৈয়ে দে। ডলি আক্তারের মনে হয় যে, আম্বিয়ার মার যুক্তিটা শক্ত না, তার কাছে মেয়েটারই কাটা নাড়ি বেশি শুকনা লাগে, ছেলেটার নাড়ি একদম কাঁচা-এরকম কি হয়? তখন ডলি আক্তার বেগম পুনরায় আম্বিয়ার মাকেই বিষয়টা জিগাস করে, আম্বিয়ার মা তার কথা শুনে পুনরায় আকাশ থেকে পড়ে, বলে, ইন গম অয় বাবি, অনে মাইয়া পোয়া চাইলেনদে আল্লায় অনেরে মাইয়া পোয়া দিইয়্যে, আনে ইন হতা পুছলিন্দে কিয়া?

ডলি আক্তার তখন শরমিন্দা হয়, আল্লার কাছে মাফ চায়, আঁরে মাফ গরো খোদা, সে কান্দে এবং দীর্ঘ সময় পর তার নবজাতক মেয়েটার দিকে সে ভালমত তাকায়, তার মুখ টেনে তুলে স্তন অনাবৃত করে পুরে দেয়; কিন্তু ডলি আক্তার দেখে, মেয়ে মুখের ভিতর দুধের বোটা নিয়া চুপ মেরে থাকে, টানে না। ডলি আক্তারের প্রথমে মনে হয় যে, ব্যাপারটা কিছু না, তার মনে হয় যে, আসমানতারা হয়তো চোখ খোলা রেখে ঘুমায়, কি তখন সে বুঝতে পারে বাচ্চাটা ঘুমায় নাই—চোখ বড়বড় করে সে সব দেখে। তখন ভুলি আক্তার একটু বিচলিত হয়, তার মনে হয় যে, মেয়ের হয়তো পেট ভরা, খাওয়ার গরজ নাই; কিন্তু তারপর দুপুরে বিকালে কিংবা সন্ধ্যায় সে যখন আবার তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে, আসমানতারা হুরে জান্নাতি পুনরায় দুধের বোটা মুখে নিয়া চুপ করে থাকে। তখন ডলি আক্তার ভয় পায়া যায়, হৈচৈ শুরু করে, তার চিৎকার শুনে বাড়ির সকলে ছুটে আসে, হয়তো আব্দুল ওদুদ বাড়িতে ছিল, সে আসে, তার বুড়া বাপ আব্দুল আলি চৌধুরি আসে এবং পাশের বাড়ি থেকে আসে আম্বিয়ার মা; তার কথা শুনে সকলে তাজ্জব হয়, সকাল থেকে মেয়ে খায় না, বলে কি! আম্বিয়ার মায়ের সামনে ভুলি আক্তার পুনরায় বিষয়টা মহড়া দিয়া দেখায়, সে স্তন অনাবৃত করে মেয়ের মুখে দেয়, কিন্তু আসমানতারার কোন ভাবান্তর নাই, তখন আম্বিয়ার মা বলে যে, সে এ রকম তার জীবনে দেখে নাই। ফলে তখন আসমানতারা হুরে জান্নাতের জীবন নিয়া সংশয় দেখা দেয়, তাদের মনে হয় যে, অনেকটা অনাহুতের মত পৃথিবীতে এসে পড়ায় সে কি লজ্জিত, অভিমান করে সে কি না খায়া মরে যেতে চায়? অথবা সে কি জন্মের পরেই রোযা করে? কিংবা এমনকি হতে পারে যে, ডলি আক্তারের এলোমেলো সন্দেহ এবং আচরণের কারণে সে ক্ষুব্ধ? আম্বিয়ার মা এই কথাটা বোকার মত উলি আক্তারকে একবার বলে, গুড়া মাইয়া ফোয়া ইবায় অনের লগে গোস্বা হইরগে ফানলার!

ডলি আক্তার অবশ্যই আম্বিয়ার মার কথা বিশ্বাস করে না, পেট থেকে পড়েই মেয়ের পক্ষে গোসা করা সম্ভব না, কিন্তু বাচ্চা যখন চব্বিশ ঘন্টা না খায়া থাকে এবং এ জন্য কান্দেও না, তখন আব্দুল আলি চৌধুরির বাড়িতে কান্দাকাটি শুরু হয়, ডলি আক্তারই কান্দে বেশি, এবং তখন আম্বিয়ার মা আবার আসে এবং সঙ্গে করে চিনামাটির বাটিতে নিয়া আসে গরুর দুধ। আম্বিয়ার মা এসে দেখে যে, ঘরের ভিতরে ডলি আক্তারের দুধের বোঁটা মুখে নিয়া ছোট্ট মেয়েটা নির্জীবের মত তাকায়া আছে, মনে হয় যেন এই শিশুর মুখের ভিতর ডলি আক্তারের কিঞ্চিত টোল খাওয়া তথাপি থরোথরো ফরসা স্তন একটা অপাঙক্তেয় উচ্ছিষ্ট ফলের মত উল্টা হয়া আছে এবং এই স্তনের মালিক ডলি আক্তার বসে বসে কান্দে। আম্বিয়ার মা ডলি আক্তারের কাছ থেকে আসমানতারাকে টেনে নেয়, নিজের কোলের উপর শোয়ায়া চা চামচ দিয়া তার মুখে বাটি থেকে গরুর দুধ তুলে দেয়, এবং তখন তারা দুইজন অবাক হয়া দেখে যে, সে চুক চুক করে গরুর দুধ খায়। ডলি অক্তিার হয়তো তার কান্দা থামায়া এনেছিল, এখন আসমানতারাকে আম্বিয়ার মায়ের হাত থেকে দুধ খেতে দেখে সে হাউহাউ করে ওঠে, তার অনাবৃত প্রত্যাখ্যাত পয়োধর কান্দার উচ্ছাসে আকুল হয়া কাপে, মনে হয় যেন আসমানতারা এইটা প্রমাণ করে যে, সে এত সহজে আসে নাই, এবং কোন হেলাফেলা তার ভাল লাগবে না; ডলি আক্তার সেদিন আম্বিয়ার মার দুধ খাওয়ানো হলে আসমানতারাকে কোলের মধ্যে টেনে নেয়, দঅও, আঁর কাছে দঅও।

মোজাহার ডাক্তারকে আবার খবর দেওয়া হয়, ডাক্তার বুঝতে পারে না যে, দুইটা বাচ্চার একটা খেতে পারলে অন্যটা কেন পারবে না, তখন সে ওদুদ চৌধুরির বাসায় এসে বাচ্চার মুখ পরীক্ষা করে দেখে মুখের ভিতরে লাল ঘও হয়া আছে; সে বলে যে, কয়েকদিন গরুর দুধ খেলে মুখের ঘাও শুকায়া যাবে, তারপর বাচ্চা বুকের দুধ চুষে খেতে পারবে। ব্যাপারটা তেমনই ঘটে, তিনচাইর দিন ডলি আক্তার তাকে বুকের ভিতরে জড়ায়া রেখে চামচ দিয়া গরুর দুধ খাওয়ায়, লোহাগা পোড়ায়া মধুর সঙ্গে মিশায়া মুখের ঘাওয়ে লাগায়, এবং যখন তার সঙ্গে কথা বলে, আর সোনা আঁর মানিক, আঁর লগে অনে গোস্বা কইরগনদে না, ওড়ি গোস্বা কইরগেনদে না? তখন ডলি আক্তার দেখে যে, শিশুটা চোখ বুজে ঘুমায়, এবং তখন সে তার ব্লাউজের বোতাম খুলে স্তনের বোঁটা মুখে পুরে দিলে আসমানতারা হুরে জান্নাত চোখ বুজে থেকেই চপচপ শব্দ করে টানে, মনে হয় যেন বাচ্চাটাই ডলি আক্তারের শরীরের গাছে ধরা একটা লাউ, কুমড়া কিংবা বাঙ্গি ডলি আক্তারের তখন আবার আনন্দে কান্দা আসে; এবং আসমানতারা হুরে জান্নাতের জন্ম হয় চোরাচালানের সারের সঙ্গে কাঠের ভুসির ভিতরে পাচার হয়া আসা খরকোসের সাথে দেখা হওয়ার জন্য, কিন্তু মামুনুল হাইয়ের মা, ভূতের গল্লির ২৫নম্বর বাসার বাসিন্দা মিসেস জোবেদা রহমান বলে, এ সবই বুজরুকি, তার ঘরে বসে সে যখন ফখরুল আলম লেদুকে বলে যে, মামুন তাদের স্কার্ট পরা এ্যাংলো টিচারের বাসায় তার মেয়ের কাছে যায়, তখন সে যতই নাক সিঁটকায়া এই কথা বলুক লেদুর মনে হয় যে, পোলার এই সাফল্যে জোবেদা রহমান গোপন আনন্দের মিহিন একটা ভাব নিয়াই এই কথা বলে। ফখরুল আলম লেদুর মনে হয় যে, তারা যখন মিসেস রোকেয়া আনোয়ারের সিলভারডেল কেজি স্কুলে ভর্তি হয়, তাদের কেজি ওয়ানের ছাত্রদের ভিতর সবচাইতে খাপছাড়া ছাত্র ছিল চানমিঞাই, এবং এ কারণেই হয়তো তাদের ক্লাস টিচার অতিশয় সুন্দরী নারী মেরি জয়েস ক্লার্ক-প্রোগ্রেস রিপোর্ট কার্ডে যে সই করতো এমজেক্লার্ক-চানমিঞার প্রতি বেশি স্নেহপ্রবণ হয়া পড়ে, তবে ছাত্রও চানমিঞা ভাল ছিল। ক্লাস শুরু হওয়ার পর একদিন এ্যাট হোম বুক ওয়ান” খুলে মেরি ক্লার্ক তাদেরকে জ্যাক. এ্যান্ড জিল পড়ায়, দেখা যায় যে, চনিমিঞাই সকলের আগে কবিতাটা মুখস্ত করে ফালায়, জ্যাক এ্যন্ড জিল/ ওয়েন্ট আপ টু দা হিল.. ইত্যাদি; তখন ক্লাসের দুই বালিকা নার্গিস এবং ইফফাত চোখ বড় করে তার দিকে তাকায় থাকে এবং মেরি ক্লার্ক কাছে যায় তার শীর্ণ কান্ধের উপরে হাত দিয়া অলিতো করে চাপড়ায়া দিয়া বলে, ইউ আর ব্রিলিয়েন্ট ছান মিঞা!

ক্লাসে বসে মামুন, লেদু এবং অভিজিৎ এইসব দেখে, টিচার চানমিঞাকে ব্রিলিয়েন্ট বলে, লাভলি বলে, কিন্তু কেজি ওয়ানে তাদের কিছু করার থাকে না, মিসেস ক্লার্কের ক্লাসে চানমিঞাকে একহাত দেখানো যায় এবং পরে তারা ব্যাপারটা ভুলে যায়। কিন্তু মনে হয় যেন মিসেস ক্লার্ক চানমিঞাকে তবুও ভোলে না, দুই বছর পর স্ট্যান্ডার্ড টু তে যায়া মিজ রোজালিন ডি কস্তা তাদের ক্লাস টিচার হয়, তখন ডি কস্তার ক্লাসে মেরি ক্লার্ক কখনো আসে এবং জিগাস করে, কেমন করছে আমার বাচ্চারা? তখন লেদু, মামুন এবং অভিজিৎ-এর মনে হয় যে, মিসেস ক্লার্ক হয়তো আসলে। চানমিঞার কথাই জিগাস করে, এবং মিজ ডি কস্তা তার কথা শুনে কষ্ট করে হাসে এবং বলে, করছে আরকি, নট ব্যাড! তখন ফাইনাল পরীক্ষার পর খেলাধুলা এবং প্রাইজ গিভিং সিরিমনি হয়, রঙ্গিণ কাগজে জড়ান একটা বান্ডিল কেজি টু এর এক মেয়ের, হয়তো খালেদা কিংবা তাবাসসুমের, হাতে আসে এবং সে পড়ে দেখে যে তাতে ইংরেজিতে লেখা, তোমার যে বন্ধুর জুতা সবচাইতে ময়লা তাকে দাও। বাচ্চা মেয়েটা প্যাকেটটা নিয়া ঘোরে, সে মন ঠিক করে উঠতে পারে না কার জুতা সবচাইতে ময়লা, তারপর সে মনে হয় চানমিঞাকে টার্গট করে এবং মিসেস ক্লার্ক বুঝতে পেরে দ্রুত এসে চানমিঞার জুতা পরিষ্কার করে দেয়, ফলে একটা নোংরা ছেলেকে খুঁজে বের করার জন্য মেয়েটাকে আরো ঘুরতে হয়, এবং তখন হয়তো প্যান্ডেলের নিচে বালিকা জুলি ফ্লোরেন্স ছিল, সে হয়তো বিষয়টা দেখে এবং যখন তার মাকে জিগস করে, মম হু ওয়াজ হি? তার মা বলে, হি ইজ দা মাঙ্কি বয়; অবশ্য তখন মামুন এবং লেদুর মনে হয় যে, অনেক বছর তারা তাদের প্রিয় টিচার এবং বালিকা জুলি ফ্লোরেন্সকে দেখে না, তারা সিলভারডেল স্কুল ছেড়ে শাহ সাহেব লেনে যায়। হয়তো সেন্ট যোসেফ স্কুলে ভর্তি হয়, সেখানে অঙ্ক ক্লাসে ভুল করায় ব্রাদার টুম তার হাঁটুর উপরে তাদেরকে কাইত করে চেপে ধরে হোগার উপরে কাঠের রুলার দিয়া মারে, ব্রাদার ডানিয়েল হোমওয়ার্ক না করার জন্য প্রায় প্রত্যেক দিন ডিটেনশন ক্লাস দিয়া রাখে, নোট বইয়ে রোল নাম্বার টুকে নিয়া যায়, তখন তাদেরকে স্কুলের পর বিকালে ডিটেনশন ক্লাসে যেতে হয়, তারা ব্লাক বোর্ডে লিখা দেওয়া একটা বাক্য-যেমন ম্যান ইজ নোন বাই হিজ কম্পানি—যার যার শাস্তির মাত্রা অনুযায়ী পঞ্চাশ, একশ কিংবা দুইশ বার লেখে, তারপর খাতার পাতা ছিঁড়া জমা দিয়া আসে। কিন্তু এইখানে, এই স্কুলে, তারা পায় বাস্কেট বল এবং ক্রিকেট, কাছেই পায় রেল লাইন এবং স্কুলের পিছনের গেট দিয়া বের হয়া মনির হোসেন লেন ধরে দয়াগঞ্জের রেলওয়ে ব্রিজে যায়া বসে থাকার পথ, ফলে তারা মিসেস মেরি ক্লার্ক এবং তার বালিকা মেয়ে জুলিকে দীর্ঘ দিন ভুলে থাকে। পরে যখন সেন্ট যোসেফ স্কুল আসাদগেট চলে যায় এবং মামুনুল হাই এবং ফখরুল আলম লেদুর জীবনে বাস্কেটবল ও ক্রিকেট তাৎপর্য হারাতে শুরু করে, তাদের হাঠাৎ মনে হয় যে, কত দিন তারা টিচারকে দেখে না। তখন একদিন গভীর রাইতে হয়তো মামুনের বুকের ভিতরে আকাক্ষা জেগে ওঠে, সে তখন লেদুকে ফোন করে এবং বলে, ল যাই টিচাররে দেইখা আসিগা।

: যাইতে পারি।

তাদের তখন জুলি ফ্লোরেন্সের জন্মদিনের তারিখের-২১ সেপ্টেম্বর-কথা মনে পড়ে; যখন তারা কেজি ওয়ানে ছিল, টিচার তার ক্লাসের সব ছাত্রকে জুলি ফ্লোরেন্সের জন্মদিনে তার বাসায় প্রথম নিয়া যায়; তারপর তারা প্রতি বছর পাশ করে ক্লাস বদলায়, কিন্তু টিচার তার পুরান ছাত্রদের মধ্যে মামুন, লেদু এবং চানমিঞাকে ভোলে না, সে জুলির জন্মদিনে তাদেরকে সবসময় দাওয়াত করে। তারা স্কুলের ড্রেস পরে জুলি ক্লার্কের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যায় এবং অন্য পোলাপানদের সঙ্গে হ্যাপি বার্থ ডে টু… গায়, জুলি একটা সাদা কেক কাটে, তারপর সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝোলানো কাগজের পেট মোটা একটা বড় ঠোঙ্গা বাড়ি দিয়া ফাটানো হলে এর ভিতর থেকে কুঁচিকুঁচি করে কাটা রঙ্গিণ কাগজের অজস্র টুকরা ঝরে পড়ে, কাগজের টুকরার সঙ্গে পড়ে রঙপেন্সিল, রাঙতা জড়ানো টফি এবং খুচরা পয়সার মুদ্রা। তখন সে কি হৈচৈ শুরু হয়, মামুনুল হাই তিনটা টফি পায় এবং লেদু পায় দুইটা, চানমিঞা পায় পঁচিশ নয়া পয়সার একটা মুদ্রা। তখন তারা ছিল স্ট্যান্ডার্ড টু-এ এবং তারা বেশ বড়, জুলি ফ্লোরেন্সও শিশু থেকে বালিকা হয়া উঠেছে, অথবা উঠি উঠি করছে, সেদিন সাদা মাইলনের ফ্রকের ভিতরে তাকে দেখে মামুনুল হাই এবং ফখরুল আলম লেদু হাঁ করে থাকে, তারপর জন্মদিনের কেক কেটে ভাগ করা হলে তারা তার ভাগ খায়, কাগজের ঠোঙ্গার ভিতর থেকে পাওয়া টফি চাবায়, মামুনুল হাই তার তিনটা টফির দুইটা খায়া ফেলে এবং একটা চানমিঞাকে পটায়া তার কাছে বেচে; অবশ্য এ জন্য পরে সে পস্তায়, কারণ চানমিঞা একটাও টফি কুড়ায়া নিতে পারলেও মামুনুল হাই এর কাছ থেকে কেনা টফিটা সে জুলি ফ্লোরেন্সকে দেয়, এবং জুলি সেটার রাঙতা খুলে মুখে পুরে দিয়া চোষে, লেদু মামুন। এবং অভিজিৎ-এর মনে হয় যে, পোলাতো কম সেয়ানা না! কিন্তু সেদিন সেখানেই ঘটনা শেষ হয় না, চানমিঞা তার প্লেট থেকে তুলে কেকের টুকরাটা নিজে খায়, সাগর কলাটা জুলির দিকে আগায়া ধরে, ভাবখান এমন যে, নেও, এবং জুলি নিয়া কলাটাও খায়। ফলে বহুদিন পর মিসেস ক্লার্ক একদিন যখন জুলিকে বলে, বি ওয়্যার অফ ম্যান এন্ড বানানা, তখন খুব দেরি হয়া যায়, তবে সেইদিন জন্মদিনের পার্টিতে তখন তারা দেখে যে, টিচার একটা ফুল তোলা কাপড়ের লম্বা ফ্রক পরে এসে জুলিকে নিয়া ছবির জন্য পোজ দেয়, কালা রঙ্গের কোট এবং সাদা সার্টের সঙ্গে কালা বো-টাই পরা বর পাশে এসে খাড়ায়, তার হাতে তামাক খাওয়ার পাইপ, তখন তাদের সঙ্গে ছবিতোলার জন্য বাচ্চারা আসে, কিন্তু তারা খেয়াল করে না যে, চানমিঞা ভিড়ের মধ্যে নাই, ফলে মধ্য রাইতে মামুনুল হাইয়ের ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে এবং লেদু জুলি ফ্লোরেন্সের জন্মদিনে নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে যায় হাজির হয় এবং আশ্চর্য হয়া দেখে যে, টিচার এই দীর্ঘ দিন একই বাসায় রয়া গেছে। আরো পরে মামুন একদিন মিসেস ক্লার্কের ড্রয়িং রুমে বসে দেওয়ালে ঝুলান ছবি দেখার সময় জুলিকে এই কথা জিগাস করে, তুমরা এই বাইতে এতদিন ধইরা রয়া গেলা? দুনিয়া বদলায়া গেল তুমরা এক জাগায় থাইকা গেলা?

: কোথায় যাব?

: ভাড়াইটারাতে রেগুলার বাসা বদলায়।

: কি জানি, আমাদের সমস্যা আছে, উই আর নট লাইক আদার্স, আমরা অন্যদের মত হইতে পারি না!

মামুনুল হাই তখন জুলির দিকে তাকায়া থাকে, কেন পার না, হোয়াই নট?

: বিকজ উই ক্যানট!

: বাট হেয়াই?

: বিকজ আই এ্যাম নট লাইক ইউ!

মামুন পুনরায় তকিয়া থাকে, জুলি তার মত না, কেন না? হয়তো সে বোঝে, হয়তো বোঝে না; তবে আব্দুল ওদুদ চৌংয়ের লোকেরা চোরাচালানের সারের ভিতর মামুনকে ট্রাক, সাতকানিয়ায় পৌছার পর আবিষ্কার করে, শেষ রাইতের দিকে তারা যখন বস্তা সরানোর কাজ শুরু করে তখন কাঠের ভুসির মধ্যে তাকে পায়, তারা দেখে যে, সে জীবিত আছে তবে তখনো হয়তো অচেতন, এবং তখন তাদের মনে পড়ে যে, পোলাটার নাম মামুন; তায়া সারের বস্তার সঙ্গে তাকে বাড়ির ভিতরে পুকুর পাড়ে একটা টিনের ঘরের মধ্যে নিয়া মায়া রাখে।

সকাল বেলা সতিকানিয়া থানার ছোট কিংবা মেঝ দারোগা হাতে একটা লাঠি নিয়া এসে হাজির হয়, তখন আব্দুল ওদুদ চৌধুরি হয়তো চিটাগাং থেকে এসে পৌঁছাতে পারে নাই, অথবা হয়তো খুব সকালেই তার টয়োটা করোনায় করে সে এসে পড়ে এবং জানতে পারে যে, ভূসির মধ্যে মামুনকে পাওয়া গেছে, ফলে তারপর দারোগা এসে যখন তাকে জিগাস করে, সওদাগর সাব, গম আছেন নি? আব্দুল ওদুদ চৌধুরি ব্যাপারটা বুঝতে পারে, সে এই ছোট অথবা মেঝ দারোগাকে বাড়ির ভিতর নিয়া যায় বেঠকখানায় ভেলভেটের সোফায় বসায় এবং বলে, আছি, খারাপ অয়, ভিতরে আইয়োন।

দারোগা ওদুদ চৌধুরির ঘরে যায়া বসে, চা পানি খায়, তারপর বলে, রাইতে ট্রাক আসছে শুনলাম, কি ছিল?

: কাঠের ভুসি আইনি এরি।

: কাঠের ভুসি দিয়া কি করবেন?

: একেনে একটা বরপের কল দেব যে, বরপের জন্য কাঠের ভুসি এনে রাখিদ্দেরি।

দারোগার কষ্ট হলেও সে বোঝে, বরফের কল বসালে ভূসি লাগতে পারে, ঠিক আছে, কিন্তু সে তখন অন্য কথা বলে, একটা ছেলে কি ছিল ভুসির মধ্যে? কিন্তু এইটা কি হয়? এইটা হয় না এবং আব্দুল ওদুদ চৌধুরি বলে যে, এটাতো সম্ভব না, ছেলেতো হাতের মোয়া না যে ভুসির মধ্যে পাওয়া যাবে, কাঠের ভুসির মধ্যে মানুষের বাচ্চা পাওয়া যেতে পারে না, ঢাকা থেকে আনা তার ভাইয়ের করাত কলের ভুসির মধ্যে মানুষের বাচ্চা, একটা বড় খরগোস পাওয়া যায়, হয়তো পাহাড়ের কাছ দিয়া যখন ট্রাক আসছিল তখন-হয়তো সীতাকুণ্ড কিংবা পাহাড়তলির কাছে কোন উপায়ে জটা ট্রাকের ভিতরে চড়ে বসে। দারোগা তারপর বেনসন খায় এবং তার। মনে হয় যে, হইতে পারে, অসম্ভব কি, এইসব পাহাড়ি আধা-পাহাড়ি এলাকায় অশোস ট্রাকে উঠে বসতেই পারে, তখন সে বিদায় নিয়া চলে গেলে চাকরদের কাছ থেকে ডলি আক্তার এবং বাড়ির অন্যান্য মহিলা এবং শিশু খরগোসের কথা জানতে পারে। আসমানতারা দুরে জান্নাতের তখন হয়তো ৩/৪ বছর বয়স, সে গরগোসের কথা শুনে উত্তেজিত হয়া পড়ে, আঁই খরকোস দেইক্কম, আম্মা অরে খরকোস আনি দও, সে বলে।

বাড়ির চাকরেরা তাকে বোঝায় যে, খরগোস খুবই খারাপ জানোয়ার, কামড়ায়া দেয়, গায়ে গন্ধ এবং খু্ব পাজি, কিন্তু আসমানতারা বুঝ মানে না, তখন ডলি আক্তারকে বিষয়টার দিকে নজর দিতে হয়, কারণ সে তার মেয়ের ছুটুকালের দুধ খাওয়া নিয়া কাণ্ডের কথা ভোলে না, সে চাকরদের সঙ্গে পুকুর পাড়ের টিনের ঘরের বন্ধ দরজার কাছে যায় তালা খোলায় এবং দেখে যে, একটা ছেলে শুয়ে আছে ভিতরে বস্তার সারির মাঝখানে। ডলি আজার বিস্মিত হয়, ওড়া আবুইল্যা, খরগোস খডে? গুড়া ফোয়া ইবা খন? সে জিগাস করে এবং বাড়ির চাকরদের তখন সব খুলে বলতে হয়, তারা হয়তো আব্দুল ওদুদের কাছ থেকে এইসব কথা শোনে, তারা বলে যে, ছেলেটার নাম মামুন, এবং তখন হয়তো মামুন মিঞার চেতনা ফিরতে থাকে; সে চোখ মেলে তাকায়, বিহবল হয় তার সামনে খাড়ানো ভলি আক্তার এবং আসমানতারাকে দেখে, ডলি আক্তার তার দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে বলে, নাম কি তুয়ার।

তার কথা শুনে ছেলেটা তাকায়া থাকে, তখন বাড়ির চাকরেরা তাকে বলে যে, তার নাম মামুন মিঞা, তারপর মামুন জানতে পারে যে, তার বাড়ি ঢাকার নারিন্দায়, ভূতের গরিতে। কিন্তু সেদিন চাকরেরা যখন বলে যে, তার নাম মামুন মিঞা, আসমানতারা তা মানতে চায় না, সে চিকরি করে, না ইবা খরকোস, ইবা খরকোস!

তখন আব্দুল ওদুদের চাকরেরা বাধ্য হয়া মামুন মিঞাকে ভূমিশয্যা থেকে তুলে গলায় একটা দড়ি লাগায়া আসমানতার হাতে তুলে দেয়, মামুন মিঞা আসমানতারার খরকোস হয়া থাকে। কারণ চানমিঞার জন্ম হয় একাত্তর সনে, হয়তো জুন মাসে, ১২ জুন, মিথুন রাশির পোলা হয়তো সে, অথবা জুলাই মাসে, ১২ কিংবা ২২ জুলাই, কর্কট রাশি, কিংবা তার জন্ম হয়তো ডিসেম্বরে, সে ধনু কিংবা মকর রাশির পোলা, সেই জন্য তার নাম হয়তো হতে পারতো বিজয় মিঞা-যাহোক, একার সনে খুবই কষ্ট ও বিপদের মধ্যে যৈমন সন্তান এবং স্বাধীনতার জন্য প্রতীক্ষায় থাকে। কিন্তু নি মিলিটারি যখন বাঙ্গালি মারা শুরু করে, তখন গৈমনের পেট বোচকার মত গোল হয়া ওঠে, তার পায়ের পাতা ফুলে যায় এবং সে একটা গাভিন বিপর্যস্ত মহিলা বিলাইয়ের মত তাদের ঘরের ভিতরে ছায়ার মত হাঁটে-তখন মহল্লায় রাজাকাররা আসে, অথবা রাজাকাররা হয়তো আসে তার আগেই। রাজাকার কমান্ডার আব্দুল গনি-রাজাকার কমান্ডারদের নাম আব্দুল গনিই হয়-লাঠি হাতে দলবল নিয়া মহল্লায় ঘুরতে যায়। একদিন খৈমনদের বাসায় এসে হাজির হয়, এবং খৈমনের মা জরিমনের সঙ্গে আলাপ করার সময় জানালার ফাঁক দিয়া ঘরের ভিতরে খৈমনকে দেখে এবং জিগাস করে, এইটা আপনের মাইয়া? সম্ভাব্য মাতৃত্বের গরিমায় ঘরের অন্ধকারের ভিতরে হয়তো খৈমনের মুখ বর্ষায় ভেজা কোন একটা ফুল কিংবা পাতার মত মনে হয়, হয়তো পানি ভরা ডোবার কিনারায় শুয়ে থাকা হিজলের একটা ভিজা কালা ঠাইলার মত লাগে, আব্দুল গনি বলতে পারে না তার কি হয়, কিন্তু তার রাজাকার হৃদয় হয়তো হাহাকার করে, মিলিটারি আসলে কি অবস্থা হবে এই মহিলার! সে জরিমনকে বলে, আপনে কন যে আপনের পোলা মুক্তিবাহিনীতে যায় নাইকা, তাইলে আপনের পোলা কৈ গেল তারতো একটা ঠিকঠাক হিসাব দেওন লাগব, নাকি কন? ঘরের ভিতরে ওইটা আপনের মাইয়া নাকি, হ্যারে ডাকেন, জিগাই; এবং তখন জরিমনের খুবই মুশকিল হয়, সে বলে, বাবা তুমি আমার পোলার লাহান, আমার মাইয়াটা পোয়াতি!

: ডাকেন, কথা কই!

তখন খৈমন এসে বারান্দায় খাড়ায়, তার পেট ধোপার গাট্টির মত চিঁড়া . পড়তে চায় এবং তাঁর মুখের দিকে তাকায়া আব্দুল গনি বলে, কত দিন হইলো?

জরিমনের খুবই আতঙ্ক হয়, খৈমন বলে, আপনে কি জিগাইবেন জিগান, এবং আব্দুল গনি ঘন হয়া আগায়া আসে, তখন হয়তো সইন্ধ্যা বেলা ছিল, ফলে সইন্ধ্যা বেলার অনিশ্চিত হওয়ার একটা ঢেউ খৈমনের শাড়ির আঁচল নিয়া মাইতা ওঠে, বাইড়াবাইড়ি করে, পিটাপিটি করে, হুহু করে; বাতাস হঠাৎ কেন যে এমন পাগল হয়া গেল, আব্দুল গনি এবং তার রাজাকাররা বোঝে না, তারা বিহ্বল হয়া পড়ে, খৈমনের শরীরের দিকে তাকায়া তাদের মনে হয় যে, কি একটা ওড়ে, এবং তারা বলে, কি উড়ান?

: কি উড়ামু? আপনেরা হাইনজা বেলা আয়া দিকদারি শুরু করলেন ক্যালা!

আব্দুল গনি তার দলবল নিয়া সেদিন চলে যায়, সে বিচলিত হয়া থাকে, গৈমনকে নিয়া বাতাসের এই খেলার অর্থ বুঝতে পারে না, তখন রাইতের বেলা ময়না মিঞা এই কথা শোনে, তার মনে হয় এবার তারা রাজাকারের পেটে যাবে। সে তখন তার শ্বশুর আব্দুল জলিলকে খুঁজে বের করে, আব্দুল জলিল হয়তো তখন বাঘঅলা বাড়ির ভিতরে আব্দুর রহিম ব্যাপারির সঙ্গে বসে তিন ব্যান্ডের ন্যাশনাল প্যানাসনিক রেডিওর কাঁটা ঘুরায়া বিবিসি কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতার শোনে-মুক্তিবাহিনীর গাবুর মাইরের চোটে ভোমা ভোমা পাকিস্তানি মেলেটারিগুলা-তখন ময়না মিঞা তাকে ডেকে বাড়িতে নিয়া এসে যখন বলে, আব্বা, এখন কি করন যায়? তখন আব্দুল জলিল খুবই বিরক্ত হয়, সে বলে, কি করবা, বইসা বইসা খাও, এবং মনে হয় ময়না মিঞাঁ ঠিক বুঝতে পারে না আব্দুল জলিল আসলে কি বলে, সে কি তাকে একটা দিক নির্দেশনা দিল, নাকি সে তাকে গাইল পড়িলো! রাইতের বেলা তার বৌ যখন একটা বেলুনের মত তার পাশে চৌকির উপরে আইসা পড়ে তখন তার মনে হয় যে, তার পোলার নাম রাখা দরকার এবং সে খৈমনকে এই কথা বলে। খৈমন বুঝতে পারে না ময়না মিঞা হঠাৎ এখনই পেটের ভিতরের পোলার নাম রাখার জন্য অস্থির কেন হয়া গেল, সে বলে, এত ডরান ক্যালা, রাজাকাররা আর আইবো না, আপনে ভরায়েন না। কিন্তু ময়না মিঞা হয়তো ভয় পায় নাই, তার হয়তো এমনিতেই মনে হয় যে, নামটা রাইখা ফালানোই ভাল, তখন সে আব্দুল জলিলের কথা বলে, আমি জিগাইলাম কি করন যায়, হায় কইলো বইসা বইসা খাও, ক্যান কইলো এই কথা? খৈমন বুঝতে পারে না ব্যাপারটা কি, সে চুপ মেরে থাকে, হয়তো সে ঘুমায়া যায়, কিন্তু ময়না মিঞা জানে সে ঘুমায় নাই, এমনি ভ্যান্দা ধরে আছে, ফলে সে এই প্রথম জিঞ্জিরার ঘটনা বিশদ খুলে বলে, তুমার বাপে কিন্তু দরবেশ, এবং খৈমন ঘুমের ভিতর থেকে বলে, আমি জানি; রাজাকাররা হয়তো খৈমনদের বাড়ির ঘটনা দক্ষিণ মৈশুন্দি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আবু বকর মওলানাকে বলে, অথবা আব্দুল গনি হয়তো আরো অপেক্ষা করে, এবং রাইতের বেলা ময়না মিঞার কোলের কাছে খৈমন যখন ঘুমায়া পড়তে চায়, ময়না মিঞা তাকে জাগায়া রাখে, বলে, পোলা হইলে নাম রাখুম চানমিঞা। খৈমনের পক্ষে এই নাম মেনে নেওয়া মুশকিল হয় এবং যদিও আব্দুল গনি দলবল নিয়া ভূতের গল্লিতে চক্কর দেয়, তারা এ বাড়ি যায় ও বাড়ি যায়, কিন্তু পানবিড়ি দোকানদার আব্দুল জলিলের বাড়ির ঘটনা তার মনে কাটার মত বিন্ধা থাকে, তারপর আবার একদিন জরিমন তাদের উঠানে বারান্দার কাছে আব্দুল গনিকে একা খাড়ায়া থাকতে দেখে, তখন সে ঘরের ভিতর থেকে বের হয়া আসে এবং বলে, আপনে?

আব্দুল গনি বোঝে না সে কি চায়, সে বলে, আপনের পোলা রশিদুলরে দেখতে আইলাম, আইজ কি হ্যায় বাইত আছে, নাকি নাইকা? কিন্তু রশিদুলতো বাড়িতে অবশ্যই নাই, থাকার প্রশ্ন ছিল না, ফলে তখন খৈমন। তার আরো ঝুলে পড়া পেট নিয়া ঘরের ভিতরে জানালার পাশে যায়া বসে; আব্দুল গনি জানালার শিকের ফাঁক দিয়া তাকায়া দেখে যে, দিনের আলো খৈমনের মুখের এক সাইডে তেরছাভাবে যায়া পড়েছে, দুইচোখের নিচের ছায়া এমন হয়া আছে যে দেখে মনে হয়, সে একটা পাতলা নেকাব পরে আছে, এই শিফনের নেকাবের ভিতর দিয়া তার নাক-মুখ দেখা যায়, আবার, যায় না, এবং তখন আব্দুল গনি বলে, আপনের মাইয়ারে ডাকেন কথা কই!

এই দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় দিন দুপুরে কিংবা দুপুরের পর বিকালে খৈমন পুনরায় বাইর হয়া বারান্দায় এসে খাড়ায়, তার মোটকা পেটের উপরের কাপড় সে হাত দিয়া উঁচা করে টেনে লজ্জা ঢেকে রাখে, এবং সে যখন বলে, আপনে রশিদুলের কথা জিগান? তখন আব্দুল গনি কথা ঘুরায়া ফালায়, সে বলে, আপনের নামের মানে কি?

খৈমন বিপদে পড়ে যায়, সে বুঝতে পারে না যে, আব্দুল গনির উদ্দেশ্যটা কি, এবং তখন আব্দুল গনি বারান্দার দিকে একটু আগায়া যায়, নজ নারীর দিকে তাকায়া বলে, খৈমন কেমুন নাম, এই নামের মানে কি? তখন ক্ষুব্ধ দমকা বাতাসে খৈমনের তেনার মত আঁচল নাইচা ওঠে এবং আব্দুল গনি অনুভব করে যে, সে একটা বাউরি বাতাসের মধ্যে পড়ে গেছে; তার দেহ কেমন হাল্কা হয়া যায়, টলমল করে, মনে হয় ভেসে যাবে কোথাও, ফলে সে তার একটা হাত প্রসারিত করে দিয়া ভারসাম্য রক্ষা করে এবং তখন তার মনে হয় যে, খৈমন কিছু একটা অবশ্যই ওড়ায় এবং সে টাল সামলায়া নিয়া যখন বলে, কি উড়ান? খৈমন বলে, কি উড়ামু? আপনে দিকদারি কইরেন না, এ্যালা যান!

আব্দুল গনি খাড়ায়া থাকে এবং বলে, কি উড়ান আপনে?

ধৈমনের শাড়ির আঁচলতো পতপত করেই, সে দুই হাতে তার শাড়ি টেনে ধরে রেখে বলে, কিছুই উড়াই না।

: কিছুতো উড়ান-ই, আমাগো দেখলেই আপনের শাড়ির আঁচল উড়বার লাগায়, আপনে কি উড়ান কন?

খৈমন তখন অধৈর্য হয়া পড়ে, সে কান্ধের উপর দিয়া আঁচলটা ছেড়ে দিয়া বলে, ফেলাগ উড়াই, এবং জরিমন ভয় পায়া যায়, কি কচ তুই; ফলে ময়না মিঞা রাইতের বেলা তার শ্বশুরের সঙ্গে বাঘলা বাড়িতে যায় বিবিসি কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রোগ্রাম শোনে, রহিম ব্যাপারির রেডিওতে স্বপ্না রায়ের গান বাজে—এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এবং তখন আব্দুল গনি খৈমনদের বারান্দার নিচে খাড়ায়া দমকা হাওয়ার মধ্যে পড়ে, তার মনে হয় যে, এই বাতাস তাকে উড়ায়া নিয়া যাবে, সে তখন তার দুই হাত উঁচা করে ধরে-তার ডাইন হাতের ভিতরে থ্রি নট থ্রি রাইফেলটা উপর দিকে তাক করা থাকে আকাশের দিকে মুখ করে উদ্বাহু হয়া নাচে, সে দেখে আকাশ লাল হয়া আছে এবং এই পাগলা হাওয়া প্যাঁচ খায়া উপরের দিকে উঠে যায়; তখন সে অকস্মাৎ তার বন্দুকের ঘোড়া টিপা দিলে ধড়াম করে কান ফাটা একটা শব্দ হয় এবং দেখা যায় যে, বন্দুকের কুঁদার বাড়ি খায়া আব্দুল গনি মাটির উপরে ধূলাবালির ভিতরে চিৎ হয়া পড়ে আছে। এই ঘটনায় জরিমনের মূৰ্ছা যাওয়ার উপক্রম হয়, সে জগে করে পানি এনে আব্দুল গনির চোখে মুখে ছিটায়া তাঁকে চাঙ্গা করে তোলে, খৈমনকে সঙ্গে নিয়া তাকে টেনে তুলে খাড়া করে, এবং তাকে যখন জিগাস করে, ব্যথা পাইছো নি বাবা? আব্দুল গনি তখন হাত দিয়া তার শরীর থেকে পানিকাদা ঝাড়ে, দেখে খৈমন ঘরের ভিতরে যায় জানালার পাশে রাজরানির মত বসে আছে, এবং তখন জানালরি শিকের ফাঁক দিয়া দাগ টানা খৈমনের দিকে তাকায়া সে বুঝতে পারে না সে এখন কি করবে, ফলে সে বলে, ব্যথা পাই নাই, আপনের মাইয়ারে ডাকেন কথা জিগাস করি। তখন খৈমন পুনরায় বারান্দায় এসে খাড়াইলে সে বলে, কিসের ফেলগি উড়ান আপনে, বলেন কিসের ফেলা উড়ান, ফাইজলামি পাইছেন, রেজাকারগো লগে ফাইজলামি মারেন? তখন জরিমন ভয় পাইলেও, খৈমনেরতো মাথা তাওয়ার মত গরম, সে আব্দুল গনির কথা শুনে ক্ষেপে, এক কথা বারে বারে কালা জিগান?

: উত্তর তো দেন না, কিসের পতাকা উড়ান-স্বাধীন বাংলার?

খৈমন চুপ করে থাকে।

: পাকিস্তানের?

: পাকিস্তানের পতাকা উড়াই না আমরা!

তখন আব্দুল গনিই শুধু তাজ্জব হয় না, খৈমনের কথা শুনে জরিমন পর্যন্ত খেই হারায়া ফালায়, সে ঘরের ভিতর কোন কোনাকাছি থেকে একটা কুঁচকায়া যাওয়া মাঝারি সাইজের সবুজ-সাদা রঙের পতাকা এনে আব্দুল গনির সামনে উঁচা করে ধরে বলে, পাকিস্তানি পতাকাতো কিন্না রাখচি, ১৪ই আগস্ট আইলে উড়ামু! কিন্তু এই কথা আব্দুল গনির কানে ঢোকে না, সে মনে হয় জরিমনকে দেখেই না, তার জগৎ বেড়ায়া তখন শুধু পোটকা মাছের মত ফুলে ওঠা খৈমন জেগে থাকে—শুধু যদি প্যাটে পোলা না থাকতো-এবং খৈমন বলে, আপনে অখনে যান!

তখন বাঘঅলা বাড়িতে রাইতের আসরটা দুঃসাহসিক হয়া যাইতেছিল, দেশের অবস্থা খুবই খারাপ, মহল্লায় শান্তি কমিটি আর রাজাকার নিয়া বসবাস, এই সময় নিয়ম করে এই কাজ করার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু আব্দুল জলিলের কাছে ব্যাপারটা নেশার মত খাড়ায়া যায় এবং খৈমনের সঙ্গে রাজাকারদের আজগুবি সংঘাতের পরেও তার মনে হতে থাকে যে, কি আর হবে। কিন্তু সে আসলে ব্যাপারটা বোঝে নাই, ফলে রাজাকাররা রহিম ব্যাপারির বাড়ি বেড় দিয়া তাদেরকে ধরে; তারা যখন বাড়ির পিছনে আন্ধকারের ভিতরে কুয়াপাড়ের উপরে বসে রেডিও শোনায় ব্যস্ত, তখন রাজাকাররা তাদের এই অপারেশন চালায়, হয়তো আবু বকর মওলানা বনগ্রাম থেকে অতিরিক্ত রাজাকার ধার করে আনে, এবং সেদিন স্বাধীন বাংলা বেতার শোনার সময় তিনজন ধরা পড়ে, আব্দুল জলিল, ময়না মিঞা এবং ২০ নম্বর বাড়ির পাজি গোফরান, আব্দুর রহিম ব্যাপারি এবং অন্য কয়েকজন ভাইগা যায়। আব্দুল জলিল এবং ময়না মিঞার আর কোন খোঁজ-খবর পাওয়া যায় না, তখন রাজাকাররা আব্দুল জলিলের বাসায় এসে হয়তো কথা পাড়ে, এবং তখন শোকে কাতর জরিমন ঘর থেকে বের না হলে খৈমন এসে পুনরায় বারান্দায় খাড়ায়, এই বারান্দাটা দুই বাড়ির মাঝখানের গল্লি বরাবর হওয়ায় বাতাস মনে হয় যেন একটা চুলার মধ্যে দিয়া এসে প্রবলভাবে বারান্দার উপরে আছড়ায়া পড়ে, আব্দুল গনি খৈমনের উড়তে থাকা কাপড়ের দিকে তাকায়া বাক্যহারা হয়া থাকে।

: কি উড়াই জিগাইলেন না?

: কি উড়ান?

: পাকিস্তানি পতাকা উড়াই, আপনেরা আমার বাপেরে ছাইড়া দেন, আমার হাজবেন্ডরে ছাইড়া দেন।

আব্দুল গনির কি তখনো মনে হয় যে, খৈমনের মুখটা পানিতে ভেজা একটা বৃক্ষ শাখার মত? সে বলে যে, আব্দুল জলিল এবং ময়না মিঞার খবর তাদের জানা নাই, সেদিনের অপারেশনে তারা ছিল না, মিলিটারি ছিল; সে বলে, কে কি ফেলাগ উড়ায় দেখুমনে, আপনে খালাস কইরা লন!

ফলে, খৈমনের জন্যনালিতে গিঁটু লাইগা যায় এবং মনে হয় চানমিঞার জন্ম হইতে চায় না, আব্দুল গনি এবং অন্য চাইর জন রাজাকার আসে আর ঘুরে যায়, খৈমনের পেট তেলের পিপার মত ঢোল হয়া থাকে, নামে না; এবং ফখরুল আলম লেদুকে মিসেস জোবেদা রহমান বলে যে, চানমিতে পোটলার পোলা, এবং লেদু তর্ক করতে চাইলে সে বলে, কি কচ তুই, অয়তো পোটলার ভিতর থন বাইরইছে, মায়ের প্যাটে হয় নাইকা!

মিসেস জোবেদা রহমানের এই কথা হয়তো ঠিকই, পোটল ভিতরে মানুষের বাচ্চা থাকতেই পারে, আবার হয়তো ঠিক না, কারণ পোটলার ভিতর থেকেই মানুষের বাচ্চা হতে পারে না, চানমিঞাও হয়তো হয় নাই। কিন্তু চানমিঞাকে পোটলার পোলা বলার কারণ কি? কারণ খৈমন-তার জিদ এবং চোপা-চানমিঞার জন্মকে খৈমন পেটিলর সঙ্গে জড়ায়া ফালায়! বাঘঅলা বাড়ি থেকে আব্দুল জলিল এবং ময়না মিল্লাকে ধরে নিয়া যাওয়ার পর আব্দুল গনি যখন বলে, আপনে খালাস কইরা লন, তখন খৈমন আসলেই ভয় পায়, কি করবে আব্দুল গনি খালাসের পর? এবং চানমিঞার আসল জন্মের পর খৈমন ফলস প্রেগনেন্সির আয়োজন করে, কোমরে কাপড়চোপড়ের তলায় তানাতুনা জড়ায়া ফুলায়া রাখে এবং আব্দুল গনি আসে আর যায়, কিন্তু খৈমনের খালাসের লক্ষণ দেখা যায় না, আব্দুল গনি যদি জিগাস করে, কয় মাস, খৈমন চুপ করে থাকে এবং বাতাসে। বিপজ্জনকভাবে তার আঁচল উড়ায়া দেয়, কিন্তু তার মা জরিমন রাজাকারদের সঙ্গে আর বাজাবাজিতে যেতে চায় না, সে বলে, অইবো ছয়/ছাত মাছ হইবো, ক্যাল? ফলে চানমিঞা আর জন্মায় না, আগস্ট যায়, সেপ্টেম্বর যায়, খৈমনের ভুড়ি কমে না, আব্দুল গনি আবার আসে এবং জরিমন বলে, এইতো হইবো, কিন্তু তা হয় না, হওয়ার কারণ নাই, কোমরে কাপড় প্যাচায় তারা আব্দুল গনিকে ঠকায়। আব্দুল গনি হয়তো বিভ্রান্ত বোধ করে, হয়তো তার সময়ের হিসাব আউলায়া যায়, তবু সে ছাড়ে না–কিন্তু আব্দুল গনি এইসব কেন করে? তখন অক্টোবর যায়, নভেম্বরের শেষ দিকে ইন্ডিয়ান বোমারু বিমান চাকা এয়ারপোর্টে বোমা ফালায়, ইন্ডিয়ান মিগ কিংবা মিরেজের পিছনে পাকিস্তানি এফ-৮৬ স্যার ফাইটার ঠা ঠা কইরা লৌড়ায়, কিন্তু ধরতে পারে না, ইন্ডিয়ান প্লেনটা ঠিকই রানওয়ের উপরে দুইটা ডিম পাইড়া থুয়া যায়, তারপর ডিসেম্বরের প্রথম দিকে মহল্লায় দুই/একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখা যায়, তারা এই আসে এই যায়, তাদের ভয়ে রাজাকাররা ভাগে, কিংবা তখনো হয়তো তারা ভাইগা যায় না, ঘাপটি মাইরা থাকে, তাদের নেতা মওলানা আবু বকর হয়তো তাদেরকে বলে, খাড়াও না, সপ্তম নৌবহর আইসা পড়লো; খাড়াও না, চীনা সৈন্য আইতাছে না? নেফার ভিতর দিয়া নাইমা আসবো, তখন ইন্ডিয়ান মালুগুলা কৈ যায়, দেখ না!

ফলে হয়তো আব্দুল গনি এবং তার টুডাফা রাজাকার বাহিনী মহল্লায় থেকে যায়, এবং খৈমনের কোমরের বোচকা নামানো হয় না। তখন ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি মিলিটারি সারেন্ডার করে, নিয়াজি সই করে আত্মসমর্পণের দলিল : Instrument of Surrender: The Pakistan Eastern Command agree to surrednder all PAKISTAN Armed Forces in BANGLA DESH to Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA, General Officer Commanding in Chief of the Indian and BANGLA DESH forces in the Eastern Theatre … The PAKISTAN Eastern Command shall come under orders of Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA…

১৬ ডিসেম্বর, বিষুদবার বিকালে অল্প শীতের ভিতর রেসকোর্সের মাঠে পাতা একটা টেবিলের সামনে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার এসে খাড়ায়, সঙ্গে আসে জেনারেল অরোরা; এ কে খন্দকার নিয়াজিয়ে বলে, সারেন্ডার করো, অস্ত্র নামাও, ফুটো এই দেশ থেইক্কা। তখন নিয়াজি বড় বড় সেগুন গাছের তলায় মুখটা শুকনা করে রাখে, তার হোগা দিয়া পাতলা ও পড়ে যেতে চায়, সে কোমরের বেল্ট থেকে তার রিভালবার বের করে রাখে টেবিলের উপরে, তখন দাড়িয়াল কাদের সিদ্দিকি আসে, সে এতক্ষণ পিছনে খাড়ায়া এইসব দেখে, কিন্তু নিয়াজি টেবিলের কাছে এসে অস্ত্রটা রাখা মাত্র কাদের সিদ্দিকি দুই পাও আগায়া এসে একটা ঘুসি মারে নিয়াজির খোতার উপরে, শুয়ারের বাচ্চা, চুতমারানির পোলা, তর মায়রে চুদি, সে বলে এবং লেঃ জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি ওরফে টাইগার নিয়াজি মাটির উপরে পড়ে যায়া মুখটা ভ্যাটকায়া ফালায়, কানতে কানতে বলে, আই এম এ প্রিজনার অব ওয়ার, আই ডিজার্ভ প্রোটেকশন এন্ড রেসপেক্ট, তখন লে: জেনারেল অরোরা ডাইন হাত উঠায়া দেখে তার পাগড়ি ঠিক আছে কি না, তারপর কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান আব্দুল কাদের সিদ্দিকির দিকে তাকায়া যখন বলে, হু আর ইউ? তখন আব্দুল কাদের বলে, আই এম এ বাঙ্গালি উইথ শক্ত হাড্ডি এন্ড লম্বা বিয়ার্ড, মাই নেম ইজ আব্দুল কাদের, আই কাম ফ্রম টাঙ্গাইল, ডুয়িং গুল্লি, ফাইটিং ফর মাই কান্ট্রি, আর ইউ?

রেসকোর্সের মাঠে এইসব হয়তো ঘটে, ঘটারই কথা, এবং ভূতের গল্লির লোকেরা যখন শোনে তারা বলে, দ্যাছলতা ছাদিন হয়া গেল গা, তখন জরিমন হয়তো রান্না ফালায়া থুয়া আসে খৈমনের কাছে, এবং খৈমন বলে, ই অখনেই, এবং তারা ভিতর বাড়ির বারান্দার কোনায় বানানো অন্ধকার খুপরি ঘরের ভিতর থেকে ময়না মিঞার তরকারির চাঙ্গারি বের করে আনে, এই চাঙ্গারির ভিতরে একটা কাপড়ের পোটলা দেখা যায়। খৈমন তার কোমরে জড়ায়া রাখা কাপড়ে বোচকা খুলে ফেলতে থাকে, সে এক প্যাচ খেলে এবং জরিমন কান্দে, সে আর এক প্যাচ খেলে জরিমন হাউমাউ করে, ভারপর সে সর্বশেষ একটা প্যাচ খুলে পুরান কাপড়টা মাটির উপরে ফেলে দেয়, তখন জরিমন চাঙ্গারির ভিতর থেকে পোটলাটা উঠায়া বুকের ভিতরে চেপে ধরলে সেটা নড়াচড়া করে, খৈমন তার মায়ের কাছ থেকে পোটলাটা নিয়া কাপড় অলিগ করলে ভিতর থেকে বাচ্চা বের হয়া আসে এবং সে বুকের মধ্যে চেপে ধরলে সেটা চিৎকার করে, তখন খৈমন আরো জোরে চাপ দেয় এবং বাচ্চাটা আরো জোরে চেচায়-মহল্লা মাথায় তুলে ফালায়। একাত্তর সনের ১৬ই ডিসেম্বর খৈমনের বাচ্চার কান্দার শব্দ ভূতের গল্লির ভিতর দিয়া প্রবাহিত হয়, কিন্তু আব্দুল গনিকে পাওয়া যায় না–মান্দারপোলা কইছিল খালাস হইব কবে-খৈমনের জীবনে চনিমিঞা এবং স্বাধীনতা আসে, কিন্তু তারা আব্দুল জলিল, রশিদুল এবং ময়না মিঞাকে হারায়।

বোচকার ভিতর থেকে বের করার পর ভূতের গল্লির লোকেরা যখন চানমিঞার কান্দার আওয়াজ শোনে, তারা বলে, খৈমনের কি হইলো, পোলা না মাইয়া? মহল্লার মহিলারা হয়তো তখন আব্দুল জলিলের বাসায় আসে এবং দেখে যে, খৈমন একটা ডাঙ্গর পোলা কোলের মধ্যে নিয়া দুধ খাওয়ায়, তারা যখন বলে, কখন হইলো, এত বড় পোলা কৈ পাইলি তুই? খৈমণ বলে, এইতো এই চাঙ্গারির মইদ্দে কাপড়ের পোটলার ভিতরে আছিল। কিন্তু এইসব করতে যায়া চানমিঞার জন্ম কবে সেইটা ঠিক করা মুশকিল হয়া পড়ে এবং খৈমন যখন তাকে স্কুলে ভর্তি করতে নিয়া যায় তখন সে জট পাকায়া ফালায়, সে বলে যে, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে তার পোলার জন্ম, এবং চানমিঞার পোটলার ভিতর থেকে নির্গত হওয়ার বিষয়টাও স্থায়ী হয়া পড়ে। ময়না মিঞার চাঙ্গারির ভিতর থেকে তুলে আনার পর পোলার নাম রাখার জন্য মা এবং নানি তৎপর হয়, জাফর ইকবাল নামটা খৈমনের পছন্দ হলেও, সেটা বাতিল করা হয়, কারণ নামটা বেশি চকচক করে, তখন মায়ের নামের সঙ্গে মিলায়া খ দিয়া তারা একটা ভাল নাম খোজে, কিন্তু পাওয়া যায় কেবল খবির, খলিল কিংবা খয়বর, এইসব নাম যা তা, তখন তারা মসজিদের হুজুরকে ডেকে আনলে হুজুর বলে, নাম রাখ আব্দুল করিম, এবং খৈমন তার মাকে থামায়, থাউক ওর নাম চান মিঞাই রাখো; তখন দুইটা খাসি আল্লাহুয়াকবর দিয়া চানমিঞার নাম পাকা করা হয়।

চানমিঞার জন্মের আগেই হয়তো মিসেস জোবেদার প্রথম পোলা মামুনের জন্ম হয়া গেছে, জোবেদা বেগম হয়তো তখন খৈমনকে ঝুলে পড়া প্যাট নিয়া হাঁটাচলা করতে দেখে, হয়তো তার সঙ্গে কথা হয়, হয়তো খৈমনের সঙ্গে তার দেখা হয় গেন্দা পোলা নিয়া বাপের বাড়ি যাওয়ার পথে, খৈমন যখন তাকে জিগাস করে, তুমার পোলার নাম কি রাকচা? জোবেদা বেগম হয়তো বলে, নাম অখনো রাখি নাইকা, রাখুম, এউকগা ভালা নাম ক দেখি; কিন্তু খৈমন বলতে পারে না, সে জাফর ইকবালের নামটা তার নিজের পোলার জন্য রাখে। তারপর হয়তো আবার তাদের দেখা হয় এবং জোবেদা বেগম তাকে বলে, তর উজুরি দেখি ফাল পাইড়া বাড়তাছে, ছিঁড়া পড়ব দেখিচ! খৈমন তার মেজাজ ঠিক রাখার চেষ্টা করে এবং সে যখন আবার জিগাস করে, তুমার পোলার নাম কি রাখলা? জোবেদা বেগম তার আল্লাদের অবস্থায় ফিরা যায়, নাম বিচরায়া পাই নাতো, এউকগা ভালা নাম দে না দেখি; কিন্তু খৈমনের কাছে একটা ভাল নাম কোথায়? জোবেদা রহমানের পোলার জন্য একটা ভাল নাম সে কোন দুঃখে দেবে, কারণ খুব শিগগিরই তার নিজের পোলার জন্যই তাকে হয়তো নাম বিচরাইতে হবে, সে বলে, রাখো কিছু একটা। তারপর তাদের আবার দেখা হয়, এই এক সমস্যা, এক মহল্লায় থাকলে বারেবারে দেখা না হয়া কোন উপায় নাই, দেখা হতেই পারে, এবং দেখা হলে পোলার নাম জিগাস করা করা ছাড়া কি বা করার থাকে? ফলে খৈমন জিগাস করে, কিছু নাম রাখলা পোলার? কিন্ত্র–নামতো এত সহজে রাখা যায় না, একটা পোলা বিয়াইতে লাগে দশমাস দশদিন, তার নামতো ভুট করে একদিন দুইদিন কিংবা পাঁচ দিনে রেখে দিয়া গর্ভের মহিমাটা নষ্ট করে দেওয়া যায় না, একবার একটা হাবিজাবি নাম যদি লেগে যায়, হাবলু/ডাব্লু, তাহলে পোলার জিন্দেগিই বরবাদ। মিসেস জোবেদা রহমান এইবার উল্টা খৈমনের উপর বিরক্ত হয়, সে বলে, এত নাম দিয়া কি করবি? খালি নাম জিগাচ, নাম রাখি নাইকা অখনো, এবং তখন খৈল, যেন খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে, ওর নাম রাখো দীলিপ কুমার এবং জোবেদা রহমানের মুখের ভাব বদলায়া যায়, সে বলে, তর পোলার নাম রাখিচ দীলিপ কুমার, নিজের পোলার কি নাম রাখচ দেখুমনে! খৈমন তারপরেও বলে, তাইলে ওর নাম রাখ আভা মিঞা!

০৫. খৈমনের অনেক যুক্তি ছিল

এইসব কাইজার জন্য পোলার নাম চানমিঞা না রাখার পিছনে খৈমনের অনেক যুক্তি ছিল, চানমিঞা কেমুন একটা নাম, পীড়া প্রতিবেশী শুনে কি বলবে, বিশেষ করে মিসেস জোবেদা রহমান? কিন্তু পোলার বাপে প্যাচটা লাগায়া রেখে যায়, এবং জোবেদা রহমান শুনে বলে, খুবই চুন্দর নাম, আমরা চান্দু কয়া ঢাকা পারুম; ফলে সিলভারডেল কেজি স্কুলের টিচার মেরি জয়েসও হয়তো চানমিঞাকে একদিন চান্দু বলে ডাকে, হয়তো মামুন কিংব্রা লেদু কিংবা অভিজিৎকে সে চানমিঞাকে চান্দু বলে ডাকতে শোনে, এবং তার হয়তো মনে হয়, পেট নেম ধরে ডেকে একটু আদর করি পোলাটাকে। এর ফল হয় উল্টা, মিসেস মেরি জয়েন্স ক্লার্কের এদেশের অনেক কিছুই জানা হয়া ওঠে নাই, যদিও তার জন্ম এদেশেই, ঢাকার তেজকুনি পাড়ায়। মেরির ঠাকুর্দা আলবার্ট চার্লস ডিসুজা গোয়া থেকে আশিনিব্বই বছর আগে এসে যশোরের শিমুলিয়া গ্রামে ফাদার আন্তনিও ম্যারিয়েতির ক্যাথলিক মিশনারিদের সঙ্গে কাজ শুরু করে; এইসব কথা, হয়তো মেরি তার মেয়ে জুলিকে বলে, নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লির ভিতরে বসে সোনামুখি সুঁই দিয়া লম্বা স্কার্টের হেম টাক দিয়া ঠিক করতে করতে সে জুলিকে এই সব বলে, জুলি তখন স্টিভেন আর্নল্ডের নিয়া আসা মাউস ট্র্যাপ পড়ে, মেরির কথা তার এক কান দিয়া টুকে আর এক কান দিয়া বের হয়া যায়, মেরি বোঝে, তবু জানালা দিয়া বাইরে দূরের একটা বিল্ডিংয়ের সঙ্গে ল্যাপটায়া থাকা বিকালের সূর্যের নরম আলোর দিকে তাকায়া সে মেয়ের সঙ্গে কথা বলে। তার ঠাকুর্দা আলবার্টের গায়ে ছিল খাটি পর্তুগিজ রক্ত, লিসবন থেকে জাহাজে করে সে ভারতের পশ্চিম উপকূলের পর্তুগিজ উপনিবেশ গোয়ায় সরাসরি এসে নামে, সেখানে একদুই মাস থাকার পর তাকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়, কৃষ্ণনগর মিশনারিতে এসে সে কয়েকদিন থাকে, বাংলাদেশের মানুষ এবং আবহাওয়ার সঙ্গে পরিচিত হয়; তারপর সে যশোর আসে, যশোরের বক্সলপুর গ্রাম, শিমুলিয়া, জগদানন্দকাঠি পল্লি এবং বিকেরগাছায় ফাদার আন্তনিও ম্যারিয়েত্তির সঙ্গে ক্যাথলিক ধর্মীয় সংস্কার প্রচারের কাজে লাগে, কিন্তু তার বয়স ছিল কম এবং দেশ ত্যাগ করে আসায় তার মন ছিল খুবই বিষণ এবং উদাস, গোয়ায়ও তার বেশি দিন থাকা হয় নাই, কিন্তু ধর্ম প্রচারের কাজে ঝিকরগাছায় গেলে তার এদেশীয় খ্রিষ্টান রমণী কুমারী লাবণ্যপ্রভা দাসী এবং তার বোন কুমারী বিদ্যুন্মালা দাসীর সঙ্গ দেখা হয়, বাক্যালাপ হয় এবং তাদেরকে তার ভাল লাগে, ফাদার আন্তনিও প্রথমে হয়তো কিছু বোঝে না, সে হয়তো বলে, আলবার্ট এত সময় এবং শ্রম কেন ঝিকরগাছায় ব্যয় করতাছ? প্রটেস্টান্টদের সরায়া তুমি ওখানে কিছুই করতে পারবা না, কিন্তু ফাদার আন্তনিওর কথা আলবার্টের কানে যায় না, কারণ তখন দুই বোনের সঙ্গে তার দেখা হয়া গেছে! লাবণ্যপ্রভার বাপ বিধুভূষণ দাস ছিল প্রটেস্টান্ট খ্রিষ্টান, তার পাটের করিবার ছিল, কাঁচা পাট রেলগাড়িতে করে ঝিকরগাছা স্টেশন থেকে বনগাঁ দিয়া কোলকাতার পার্ট কলে যেত। বিধুভূষণ তখন কপোতাক্ষ নদীর কাছে স্টেশন রোডের একটা দোতলা বাড়িতে পরিবার পরিজন নিয়া খাকে, তার ক্যাথলিকদের বিষয়ে আগ্রহ ছিল না, যদিও সে জানতো দুই/এক জন ক্যাথলিক মিশনারি সাহেব যশোর থেকে বিকিরগাছায় মাঝেমধ্যে যাতায়াত করে, তখন একদিন বিকরগাছা রেলস্টেশনে আলবার্ট ডিসুজার সঙ্গে তার দেখা হয়, লম্বা আলখাল্লা দেখে বিধুভূষণ আগায়া যায়-সে ভাবে নাই যে, এই সাদা ফাদারটা ক্যাথলিক হবে। বিধুভূষণ মোটামুটি ইংরেজি জানতো, ফলে সে পাঞ্জাবির পকেটে ধুতির খুঁট ঢুকায়া দিয়া তার ডাইন হাত লম্বা করে ধরে, হ্যালো, আই এ্যাম এ ক্রিশ্চিয়ান, মাই নেম ইজ বিধু ভাস!

বাংলা ভাষা সম্পর্কে একটা ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনের জন্য ফাদার আলবার্ট চার্লস ডিসুজা কৃষ্ণনগরে থাকার সময় দুইটা বই যোগাড় করে, একটা, পর্তুগিজ মিশনারি ম্যানোয়েল দা আসসুমসাঁও এর লেখা Crepar Xaxtrer Orth,bhed বা কৃপার শাস্ত্রের অর্থ, ভেদ, যার ভূমিকায় বলা 2006-Doxto Bengali, xono: puthi xocoler utom puthi, xaxtro xocoler utom xaxtro;… অন্যটা হচ্ছে একটা পর্তুগিজ-বাংলা অভিধান vocabulario. Portuguez E Bangalla. আলবার্ট ডিসুজা নমস্তে বলে শুরু করে কথাবার্তা খুবই কাঁচা বাংলায় আগায়া নেয়, যখন পারে না, সে ইংরেজি বলা শুরু করে, এবং দেখা যায় যে, সে ইংরেজিও ভাল জানে না; তবে আলবার্ট ডিসুজা বোঝে যে, বিধুভূষণ বন্ধুবৎসল লোক, কথা বলতে পছন্দ করে, আলাপ জমাইতে চায়, ফলে সে প্রটেস্টান্টদের এই ঘাঁটিতে বিধুভূষণকে হারাতে চায় না, তার সাদা কাসকের পকেটে দুইটা চম্পা কলা ছিল, সে একটা কলা বের করে যখন বলে, আমার লগে দুইটা কেলা রইছে, একটা আপনি খাউন? তখন বিধুভূষণ দাস এই নতুন সাহেব পাদ্রির দুরাবস্থা বুঝতে পারে, ফলে বেশি কথা না বলে বিধু দাস পাদ্রির আগায়া দেওয়া কলা খায়, এবং সে বলে, মহাশয় আমার বাটি নিকটেই, আমার বাটিতে চলুন আপনাকে কিঞ্চিত জলযোগ করাই। বিধুভূষণের সঙ্গে যখন সে তার বাড়ির দিকে রওনা হয়, তখন হয়তো আলবার্ট ডিসুজার মনে হয়, তার পরিচয়ের বিষয়টা বিধুভূষণের কাছে পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন, সে তাকে বলে যে, সে যশোরে ফাদার আন্তনিও ম্যারিয়েত্তির সঙ্গে কাজ করে, ফাদার ম্যারিয়েত্তি তাকে ঝিকরগাছায় পাঠিয়েছে ক্যাথলিক খ্রিষ্ট বিধানের নিয়ম প্রচার করতে; কিন্তু বিধুভূষণের তখন আর ফিরা যাওয়ার পথ ছিল না, তার বাড়ি এবং মালগুদাম স্টেশনের একদম কাছে, এই কয়টা কথা বলতে বলতেই তারা বাড়ির দরজায় এসে হাজির হয়, ফলে তার মেয়ে লাবণ্যপ্রভা কিংবা স্ত্রী জগত্তারিণী বাইরের দরজা খুলে দিলে বিধুভূষণ সমাদর করে আলবার্ট ডিসুজাকে ভিতরে নিয়া যায় বসায়। জগত্তারিণী যখন অতিথির জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করে, কাঁসার বগি থালায় ভিজানো চিড়ার সঙ্গে দই সন্দেশ কলা এবং তার পাশে চাইরটা নারকেলের নাড় সাজায়া আয়োজন পূর্ণ করে আনে তখন বিধুভূষণ ভিতর বাড়িতে আলবার্ট ডিসুজার পরিচয় প্রকাশ করে দেয়, সাহেব কিন্তু ক্যাতোলিক; কিন্তু তখন একহাতে কাসার গ্লাসে করে পানি এবং অন্য হাতে খাবারের খালি নিয়া লম্বা করে ঘোমটা দিয়া জগত্তারিণী বাইরের ঘরে এসে খাড়ায়, তাদের ষোল বছর বয়সী বড় মেয়ে লাবণ্যপ্রভাও সাহেব দেখার লোভে মায়ের সঙ্গে আসে, এবং ডিসুজাকে দেখে জগত্তারিণীর মনে হয় যে, খুবই কম বয়স ছেলেটার, হয়তো তার ছেলে মিহিরের চাইতে খুব বেশি বড় হবে না। ফলে জলখাবারের পর টুকটাক কথা বলতে যায় যখন বেলা বেড়ে যায়, জগত্তারিণী দুপুরে দুইটা শকান্ন গ্রহণ করার জন্য ডিসুজাকে পীড়াপীড়ি করে; লাবণ্যপ্রভা ঘরের ভিতরে ঢুকে বেশিদূর অগ্রসর হয় নাই, দরজার কাছেই খাড়ায়া সাহেব পাদ্রির খাওয়া দেখে, হাত দিয়া তুলে খেতে যায় সে কেমন কাপড়ে মাখায়া ফালায়। লাবণ্যপ্রভা সাহেব পাদ্রি সবসময়ই দেখে, ঝিকরগাছা খুবই ছোট একটা জায়গা, সে ঝিকরগাছার ব্যাপ্টিস্ট চার্চে প্রতি রবিবার উপাসনায় যোগ দেয়, হয়তো চার্চ কয়ারে অংশ নিয়া গায় .মম অন্তর মাঝে, যেন সদা বাজে, মধুমাখা যিশুর নাম গো …, কিন্তু তাদের ঘরের ভিতরে একটা আস্ত এবং জ্যান্ত সাহেব সে কোন দিনই দেখে নাই, তার মনে হয় যে, লোকটা তরি মার কথায় রাজি হয়া গেলেই পারে, তাহলে সে তাকে শিখায়া দিতে পারবে কিভাবে হাত দিয়া খাবার উঠায়া মুখে পুরতে হয়, কিন্তু আলবার্ট ডিসুজা দুপুরের খাবার গ্রহণে রাজি হয় না, তবে সে ভালভাবেই লাবণ্যকে দেখে এবং নামও জিগাস করে, কন্যার নাম কি হয়? লাবণ্য নাম বলার পর সে বলে, সাধু, এবং আরো এক গ্লাস পানি খায়া হাতের উল্টা পিঠ দিয়া মুখ মুছে উঠে খাড়ায়, তারপর দুই হাতের কর বুকের কাছে পরস্পর সংযুক্ত করে বিধুভূষণ, জগত্তারিণী এবং লাবণ্যপ্রভার দিকে মাথা ঝুকায়া বলে, নমস্তে, আজ্ঞা দেউন। কিন্তু গৃহকর্তা এবং কত্রী আজ্ঞা দিলেও দেখা যায় যে, গৃহ তার মায়ায় পড়ে গেছে, পুরান আমলের ছোট দরজা দিয়া বের হতে যায়া নিচা চৌকাঠে তার কপাল ঠুকে যায় এবং দরজার বাইরে এসে সে বিদ্যুন্মালাকে দেখে; বাড়ির চৌদ্দ কিংবা সাড়ে চৌদ্দ বছরের ছোট মেয়ে বিদ্যুন্মালা কোত্থেকে ঘুরে এসে বাড়িতে ঢুকে সাদা পাদ্রির সামনে পড়ে এবং তার দিকে তাকায়া তার দুরাবস্থা দেখে সে। হেসে ফেলে, আহা দুয়ারটার সঙ্গে কি দুশমনি গো, সে বলে, তখন আলবার্ট ডিসুজার তার পকেটের দ্বিতীয় কলাটার কথা মনে পড়ে, সে আলখাল্লার বিরাট পকেটের ভিতর থেকে ছোট্ট চম্পা কলাটা বের করে মেয়েটার দিকে আগায়া দেয়, আমার লগে একটা কলা আছে…। মালা দাস একটু বিব্রত হয়, তারপর কলাটা নেয়, একটা বুড়া আঙ্গুলের সমান হলুদ ফলটার বোটার দিকে নরম হয়া গেছে, তবুও, তথাপি, আলবার্ট ডিসুজা চলে যাওয়ার পর সে এই ছোট্ট একখান নিচুজাতের কদলি—এটা একটা শবরি কলা হলেও কথা ছিল-এই কলিটা যত্নের সঙ্গে ছিলায়া ইন্দুরের মত একটু একটু করে দাত দিয়া কামড়ায়া খায়, এবং এই জিনিসটা লাবণ্যের নজর এড়ায় না।

হয়তো ডিসুজার গল্প শোনার সময় জুলি ফ্লোরেন্স এই দুই অদেখা মরে হেজেমজে ভূত হয়া যাওয়া রমণীর কথা ভাবে, তার মনে হয় লাবণ্যপ্রতাইতো তার মায়ের ঠাকুমা হতে পারতো, কিন্তু মেরি জয়েস এইখানে এসে গল্প অন্যদিকে নিয়া যায়, লাবণ্যপ্রভা শেষ পর্যন্ত যশোর কিংবা খুলনায় যায় খ্রিস্টানদের মঠের নান হয়, এবং সে হারায়াই যায়, হয়তো নিয়তি এবং কাকতালীয় ঘটনার বুলি হয়া যায় সে, আলবার্ট ডিসুজার যদি প্রথমদিন ঘরের ভিতরে বসে জগত্তারিণীর বানানো ফলার ভক্ষণ করার সময় পকেটের চুম্পা কলার কথা মনে পড়তো তাহলে হয়তো ঘটনা অন্যরকম হতো, হয়তো সে সেটা লাবণ্যপ্রভাকেই দিত, কিন্তু ডিসুজার তা মনে পড়লো না; লাবণ্যপ্রভার মনে হয়েছিল যে, ডিসুজা নিশ্চয়ই অচিরেই একদিন আতিথ্য গ্রহণ করে কোন এক বেলা তাদের বাসায় ব্যঞ্জনসহযোগে অন্ন গ্রহণ করবে, প্রথমে হয়তো বিধুভূষণ যায়া আলবার্ট ডিসুজাকে নেমন্তন্ন করে আসবে, তখন বাড়িতে আয়োজনের ধুম লেগে যাবে এবং উত্তেজনায় বাড়ির সকলের মূৰ্ছা যাওয়ার দশা হবে, শরীর ক্লান্ত হয়া পড়বে এবং আলবার্ট ডিসুজা খেতে বসে মুখের ভিতরে ঠিকমত খাবার তুলতে পারবে না, তখন লাবণ্যপ্রভা এই ফিরিঙ্গিকে হাত দিয়া ভাত খাওয়ার কায়দা শিখায়া দেবে, বলবে, বুড়া আঙ্গুল ব্যবহার করেন, বুড়া আঙ্গুল দিয়া ঠেলে দেন। বস্তুত বিধুভূষণের হাত থেকে ডিসুজার নিস্তার ছিল না, যতই সে রোমানক্যাথলিক হোক, কিন্তু লাবণ্যপ্রভার দুর্ভাগ্য যে আয়োজন করে ব্যাপারটা ঘটে না, একদিন হঠাৎ করে ঘটে; হয়তো আবার একদিন রেলস্টেশন কিংবা ঝিকরগাছা বাজারে বিধুভূষণের সঙ্গে ডিসুজার দেখা হয় এবং বিধুভূষণ তাকে ধরে নিয়া আসে, তখন হয়তো বাসায় লাবণ্যপ্রভা ছিল না, বিদ্যুন্মালা ছিল, ফলে লাবণ্য যখন ফেরে তখন সে দেখে কাঠের বড় আসনের উপরে পদ্মাসনে বসে আলবার্ট ডিসুজা ঘরে যাই ছিল তাই দিয়া ভাত খায়। এই বিষয় নিয়া মালার অস্থিরতার সীমা থাকে না, সে লাবণ্যকে বলে, দেকি কি দিদি, ভাত তুলতে পারে না গো, আমি বুলি কি বুড়ো আঙুল ব্যবহার করো সাহেব, কিন্তু আমার কতা বুজতেই পারে না, তকন আমি হাতে ধরে না শিকিয়ে দিলাম,,, লাবণ্যপ্রভা তখন ভাগ্যের মাইরটা বোঝে, যার ভাগ্যে নাই তার নাই, যার আছে, ভাগ্য তার হাতে ধরে সার্থকতার পথে নিয়া যাবে। ডিসুজার মিশনারি কাজকারবার চুলায় ওঠে, সে সকাল কিংবা বিকালে বিধু দাসের বাড়িতে এসে বিদ্যুন্মালা দাসীর সঙ্গে গপসপ মারে, ক্যালিক খ্রিস্ট মগুলির মঙ্গলের চাইতে একটা রমণীর সঙ্গে ফালতু বসে থাকায় তার বেশি আগ্রহ হয়, সে সঙ্গে করে Crepar Xaxtrer Oith,bhed বইটা নিয়া আসে, মালাকে পড়ে শোনায়-xaxtri xocoler utom xaxtri Christor xaxtri, Crepar xaxtro ebong Crepar Xaxtrer puthi… বিদুন্মাল হেসে গড়ায়, তুমি এইগুলা কি পড় সাহেব, আসো তোমাকে বাংলা শিকাই। তারা কোষা নৌকা নিয়া কপোতাক্ষ নদীতে জলবিহারে যায়, ঝিকরগাছার লোকেরা দেখে, যশোরে ফাদার আন্তনিও ম্যারিয়েত্তি চিন্তিত হন, তার অন্য সহায়তাকারী ফাদার লুইজি ব্রিওস্কি ভবরপাড়া অঞ্চলে ভাল কাজ করছে, কি আলবার্টের হইলো কি? তিনি আলবার্টকে আবার একদিন জিগাস করেন, তোমার অগ্রগতি কি হইলো বুজতে পারতেছিনা ডিসুজা, খামাখা যেয়ে পড়ে রইছো; ফলে আলবার্ট ডিসুজার জন্য সঙ্কট তৈরি হতে থাকে, স্থানীয় জনগোষ্ঠী কিংবা প্রটেস্টান্টদের মধ্যে কাজে তার মন বসে না, এতদিন হয়া গেল সে একটাকেও ক্যাথলিক খ্রিস্টীয় বিধান বুঝায়া দলে ভিড়াতে পারে নাই, সে এইবার যশোর থেকে ফিরা চিন্তিত এবং মনমরা হয়া থাকে, বিদুলাকে বলে যে, তার কপালে দুঃখ আছে, তখন বিদ্যুন্মালা রাইতের বেলা দিদির সঙ্গে দোতলার ঘরে শুয়ে ডিসুজাকে নিয়া গল্প করে-বেচারা, দেক দিদি একন আর পকেটে করে কলা আনে না, কি অসভ্য, বলে যে কলা কিনবো টাকা কোতায় পাব, দেখ দিকিনি একনই বলে টাকা কোতায় পাব, কি ফাজিল বাবা!

তখন লাবণ্যপ্রভার ঘুম এসে যায়, কিন্তু মালার চোখে ঘুম নাই, সে বলে যে, ডিসুজার ফাদার তাকে বকে দিয়েছে, ফলে তার মন খারাপ; বিদ্যুন্মালা বলে, ফাদার আন্তনি না কি য্যানো নাম গোদাটার, তারে বলেছে একটাও ক্যাতোলিক কত্তি পারলে না, এত ঝিকরগাছা যায়ে তুমার কাম কি? ভাল হয়েছে, এবার মজা বুজুগে, কলা আনতি বললে বলে পয়সা পাব কোতায়!

লাবণ্যপ্রভা মনে হয় ছোট বইনের এইসব কথা কিছু শোনে নাই, সে দূরে স্টেশনের উপর দিয়া আসা পঁাচা এবং শিয়ালের ডাকের শব্দের ভিতর ঘুমে তুলায়া যায়। ডিসুজাকে কয়েকদিন দেখা যায় না, সে কোথায় কোথায় ঘোরে একটা দুর্বল হিন্দু, কি মুসলমান, কি প্রটেস্টান্ট-কর্তাভজের জন্য; ব্যাপ্টিস্ট মিশনের পাদ্রিরা কর্তাভজ লোকগুলাকে আগেই নিজেদের দলে টেলে নিয়া গেছে, এখন এখানে একটা দুর্ভিক্ষ যদি হয়, যদি কপোতাক্ষ কিংবা বেতনা নদীতে কূল ছাপায়া বন্যা হয়, বুধখান বিল, খড়মদা বিল কিংবা সমুন্দর বিলের পানি উপচায়া ফসলের মাঠ এবং বসত বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে, তাহলে একটা হাহাকার লাগে, এবং তাহলে হয়তো কিছু সেবার কাজ করা যায়। ডিসুজা ঘোরাঘুরি করে এবং রাইতের বেলা দোতলার ঘরে শুয়ে বিদ্যুন্মালা দুশ্চিন্তায় ধুম মেরে থাকে, তখন হয়তো কপোতাক্ষের দিক থেকে একটা বিচ্ছিন্ন গাঙচিল অন্ধকারের ভিতরে কা কা করে উড়ে আসে, লাবণ্যপ্রভার চোখে হয়তো ঘুম এসে যেতে থাকে, কিন্তু নিশাচর পাখির চিৎকারে তার কান খাড়া হয় এবং সে হঠাৎ করে তার ছোট বোনের বিষণ্ণতার বিষয়ে সচেতন হয়; সে বলে, সায়েবরে বল দিদি কাতালিক হবে-আমারে বাপতাইজ করতি বল।

আলবার্ট ডিসুজা রেল গাড়িতে করে লাবণ্যকে যশোর নিয়া যায়া ফাদার আন্তনিওর সামনে হাজির করে, যাওয়ার সময় বিদ্যুন্মালা কি বোঝে, সে কেন্দে ভাসায়, তার শোক বান্ধ মানে না, আমার কিছু চাইনে দিদি, আমাগের সাতে তুই থাক; কিন্তু তখন লাবণ্যপ্রভার আর থাকার সময় ছিল না, আলবার্ট ডিসুজার সঙ্গে সে যায়া ট্রেনে ওঠে। ঝিকরগাছা থেকে যশোর যেতে সময় লাগে খুব কম, মাত্র এই সময়টুকু, তারপর যশোর স্টেশনে লাবণ্যপ্রভা ডিসুজার পিছন পিছন ট্রেন থেকে নেমে আসে, তার টিনের ফুল তোলা ট্রাঙ্কের ভিতরে ছিল কাপড়চোপড়, ডিসুজা সেটা কান্ধের উপরে ফালায়া হাঁটে এবং তখন পকেটের ভিতরে হাত দিয়া সে দেখে যে, একটা চম্পা কলা এক কোনায় রয়া গেছে, সে কলাটা বের করে লাবণ্যপ্রভার দিকে আগায়া দেয়, আমার লগে একটা …। লাবণ্য কলাটা খায়, অনেক দিন আগে সে যেভাবে বিদ্যুন্মীলাকে খেতে দেখেছিল, সেইভাবে একই কায়দায়, পানির ভিতরে মাছের শেওলা খাওয়ার মত করে, অল্প অল্প ঠোক্কর দিয়া যত্নের সঙ্গে। তারপর সে যেন কোথায় চলে যায়, ফাদার আন্তনিও ম্যারিয়েত্তি তাকে কোথায় যে পাঠায়, হয়তো খুলনায়, হয়তো কৃষ্ণনগরে, কিত্ত্বা হয়তো নদীয়ার ভবরপাড়া প্যারিশের কনভেন্টে, সেখানে সে হয়তো সিস্টার ললিতা, সিস্টার এ্যাপোলিন, সিস্টার কুমারী আর্নেটিনা (হাসি) গোমেজকে পায়, তারা ফুলহাতা সাদা ব্লাউজ এবং সাদা পাড়ের ছাইরঙা শাড়ি পরে কটিবন্ধে রোজারিমালা এবং গলায় ক্রুশ ঝুলায় ব্যস্ত হয়া থাকে, লাবণ্যপ্রভা হয়তো রবিবারে প্রার্থনা সঙ্গিতের সময় গায়, আমি সকলি ত্যাজিয়া, যাইব চলিয়া শ্ৰীযিশুর চরণ তুলে … অথবা গুড়ফ্রাইডের শোকশোভাযাত্রায় যোগ দিয়া গান করে, যিশু তুমি মম তরে কত দুঃখ সহিলে …।

লাবণ্যপ্রভার জন্য হয়তো জুলি ফ্লোরেন্সের মন খারাপ হয়া থাকে, মিসেস ক্লার্ক যখন তার বালিকা-কিশোরী কন্যার দিকে তাকায়া হাসে, কি হইছে? জুলি মুখ বেঁকা করে রাখে, এবং তখন মিসেস মেরি জয়েস ক্লার্ক তার নাকের উপরকার চশমা ঠেলে দিয়া বলে, বিওয়্যরি অব ম্যান এন্ড বানানা তরু জুলির এই গল্প ভাল লাগে-রোমান্টিক এন্ড স্যান্ড; আলবার্ট ডিসুজার জীবনের পথ বাংলাদেশে এসে বেঁকা হয়া যায়, বিদ্যুন্মালাকে বিয়া করে সে সন্ন্যাসী থেকে গৃহী হয়, প্যান্ট এবং ক্যাসক খুলে ফালায়া ধুতিফতুয়া ধরে, গায়ে ভাল করে আঁটি সরিষার তেল মেখে স্ত্রীর বড় ভাই মিহির কান্তি দাসের সঙ্গে যায় কপোতাক্ষ নদীতে গোসল করতে। শ্বশুর বাড়িতে থেকে সে পাটের ব্যবসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, হয়তো এই ব্যাপারে শ্বশুরের মারিও ভাল লাগে না তার, সে তখন কুষ্টিয়ায় র‍্যালি ব্রাদার্সের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কয়েকদিন কাজ করে, তারপর মেদিনীপুর জমিদারি এস্টেটের এসিস্টেন্ট ম্যানেজারের চাকরি নেয়, কিন্তু এই চাকরিও তার ভাল লাগে না, ফলে সেখান থেকে অবশেষে ঢাকার তেজকুনি পাড়ায় এসে স্থিত হয়, বেগুনবাড়িতে একটা বেকারি খুলে বসে। টাকার যোগন দেয় বিধু দাস, কারণ বিদ্যুন্মালা বাপের কাছে যায়া কান্দাকাটি করে, ও টাকা কোতায় পাবে, পাদ্রি মানুষের কি কিচু থাকে?-তখন বিধু দাসকে দিতে হয়। মিসেস মেরি জয়েস ক্লার্ক তার মেয়ে জুলি ফ্লোরেন্সকে বলে যে, কোথাকার লিসবনের এক ডিসুজা ঢৗকার হাতিরঝিলের পাশে খাস্তা আর বৈলা বিস্কুট বানায়া জীবন কাটাইতে থাকে পাকিস্তান হওয়ার পর যশোরে মেরি জয়েসের ঠাকুমার পরিবার পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর চলে যায়, যশোর বৃটিশভারত ভাগ হওয়ার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে পড়ার আগে কৃষ্ণনগরখ্রিষ্টঅঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল, পাদ্রি ফাদার মারো তখন কৃষ্ণনগরের বিশপ ছিলেন, তার ভিকার জেনারেল ফাদার লুইস গোবেত্তির সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানের অনেক রোমান ক্যাথলিক কৃষ্ণনগরের কাছে পল্লিতে জমি কিনে বসতি স্থাপন করে, তখন তেজকুনি পাড়া থেকে বুড়া ডিসুজার ৫ ছেলের মধ্যে চারজনই চলে যায়, কিন্তু মেরির বাপ, বুড়া ডিসুজার ৫নম্বর ছেলে জন ডিসুজা গেল না, সে বললো, না ওইখানে যায় কি করব? ফলে মেরিরা ফাইসা যায় বাংলাদেশে, লোকসানি ব্যবসার কারণে বুড়া আলবার্ট ডিসুজার এক বিঘা জমির উপরকার বাড়িটা ছাড়া আর তেমন কিছু ছিল না। তার ছিল রেসের ঘোড়ার উপরে বাজি ধরার নেশা, সে শনিবারে রমনার রেসকোর্সে যায়া পড়ে থাকত, ঘোড়ার জাতকুল এবং অন্যান্য টিপসসহ কতগুলা কাগজ বের হতো, হকার এসে তেজকুনিপাড়ার বাসায় প্রতি সপ্তাহে দুইটা কাগজ দিয়া যেত, একটা জিমখানা রেসটিপ, অন্যটা চানমিঞা সাহেবের রেসটিপ; কত নামের যে ঘোড়া দৌড়াতো-ফ্ল্যাক ডায়মন্ড, ফুইন অব ক্যালকাটা, ফিনিক্স। মেরি জয়েসের চাচারা কৃষ্ণনগর চলে যাওয়ার আগে তেজকুনিপাড়ার বাড়ি বিক্রি করে ভাইয়েরা টাকা ভাগ করে নেয়, তখন মেরির বয়স হয়তো ছিল ৮/১০ বছর। এরপর থেকে তাদের ভাড়া বাসায় থাকী এবং ভেসে বেড়াইনা জীবনের শুরু, এর ভিতরে সে সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুল থেকে সিনিয়র কেম্বিজ পাশ করে এবং নটরডেম কলেজের ল্যাবরেটরি ডেমন্সট্রেটর রবার্টের সঙ্গে তার পরিচয় ও পরিণয় হয়; রবার্ট ছিল খুবই চটপটে এবং সুদর্শন যুবক, লক্ষ্মীবাজার কিংবা গেন্ডারিয়ায় বাপমায়ের সঙ্গে ভাড়া থাকতো, তখন হয়তো কোন এক রবিবারে তেজগাওয়ের হলি রোজারি চার্চের রবিবারের প্রার্থনা অনুষ্ঠানে মেরির সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়, এই চার্চের উঠানে হয়তো একটা উঁচা বড় শিমুল গাছ ছিল এবং তখন হয়তো বসন্তকাল ছিল, ফলে গাছের তলায় একটা লাল রঙের ফুল পড়ে ছিল; মেরি যখন নিচা হয়া ফুলটা কুড়ায়া নেয় তখন কালো প্যান্ট, কালো জুতা এবং সাদা শার্ট পরা রবার্ট গির্জায় ঢুকতে যায়া মেরিকে দেখে, সে বলে, সুন্দর ফুল।

মেরি মনে করতে পারে না তেজগাওয়ের হলি রোজারি চার্চ বা পবিত্র জপমালার গির্জায় আগে রবার্টকে দেখেছে কিনা, তবে তার কথা শুনে মনে হয় মেরি জয়েস ডিসুজা একটু ব্ৰিত হয়, সে হয়তো চায় নাই এই জংলি শিমুল ফুল কুড়ায়া নেওয়ার কাজটা কেউ দেখুক, কারণ সে নেহায়েত হঠাৎ ভাললাগার বশে কাজটা করে, ফলে রবার্টের কথা শুনে সে মুখ টিপা হাসে এবং বলে, ইয়েস!

: গাছটাও।

মেরির হঠাৎ মনে হয়, লোকটা এত কথা বলার চেষ্টা করতাছে কেন? তবু সে তখন গাছটার দিকে ঘাড় উঁচা করে তাকায়, কাঁটাঅলা গাছটাকেও তার ভালই লাগে, সে বলে, ইয়েস।

: ডু ইউ নো দা নেম অব দা ট্রি?

: শিমুল, সিল্ক কটন ট্রি, আই থিঙ্ক।

রবার্ট হালে পানি পায়, সে তখন সুন্দরী মেরিকে তার জ্ঞানের বাহাদুরি দেখানোর কাজে নামে, সে বলে যে, গাছটার একটা বোটানিক্যাল নামও আছে। শুনে মেরি হাসে, সে বলে যে, সব গাছেরই একটা বোটানিক্যাল নাম থাকে, থাকে না কি? এইটারও নিশ্চয়ই হয়তো আছে!

: এবং আপনি কি নামটা জানতে চান না?

মেরিকে তখন হাল ছেড়ে দিতে হয়, লোকটা খাতির জমানোর চেষ্টা। করছে; সে বলে, আপত্তি নাই, ইফ ইউ ক্যান সে কুইকলি!

রবার্ট ফ্রান্সিসের মনে হয় যে, সে সাড়া পাচ্ছে, মেরি সাড়া দিচ্ছে, অথবা হয়তো বিষয়টা অতটা না; এবং সে বলে, ইটস কল্ড বোম্বা সীবা লিনা।

মেরি অনিচ্ছা সত্ত্বেও দ্রুতই ইম্প্রেসড হয়, মেরির বাপ জন ডিসুজাও আপত্তি করে না; বিয়ার পর প্রথম কিছু দিন লক্ষ্মীবাজারে, তারপর মেরির স্কুলের কাছে হওয়ায় নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে যায় তারা বাসা ভাড়া করে। রবার্ট তার চাকরি বদলায়া পিডাব্লডির আরবরিকালচার ডিপার্টমেন্টে চাকরি নেয়, তারপর একাত্তর সনে দেশ স্বাধীন হয়া যাওয়ার পর বৃটিশ কাউন্সিলের গার্ডেন সুপারভাইজার হয়, এবং সে যখন একদিন তার বস স্টিভেন এইচ আর্নল্ডকৈ বলে যে, এই দেশের শীতটা যদি একটু গভীর হতো.., স্টিভ আগায়া যায় তার কান্ধের উপরে একটা হাত রেখে বলে, তুমি খুব ভাল লোক বব, এবং তখন বব তাকে বলে যে, আগামী অমুক মাসের তমুক তারিখে আমার মেয়ের জন্মদিন, আপনি কি অনুগ্রহ করে গরিবের বাসায় পায়ের ধুলা দিবেন? স্টিভেন আর্নল্ড রাজি হয় এবং জুলির জন্মদিনে নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে আসে, বিশেষ করে রাজি হয় যখন সে শোনে যে, রবার্টের স্ত্রী একজন শিক্ষিকা; এবং সে রবার্টের স্ত্রী এবং মেয়ের জন্য এক বান্ডিল বই নিয়া আসে। তখন জুলি মাউসট্রাপ এবং তার মা মাদাম বোভারি নিয়া পড়ে, অথবা মিসেস মেরি ক্লার্কের হয়তো আগ্রহ হয় না, হয়তো তার সময়ও হয় না এইসব বই পড়ার, স্কুলের পোলাপানের একজামের খাতা নিয়াই সে কাহিল হয়া যায়, এবং ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খৈমনের যুদ্ধ জারি থাকে, মিসেস জোবেদা রহমানের স্বামী গোলাম রহমান বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মহল্লায় ফিরা আসে, কিন্তু খৈমনের কেউ ফেরে না, বরং তার বাপের বাড়িটার অর্ধেক স্বাধীনতার একমাসের মধ্যে বেদখল হয়া যায়, দক্ষিণমৈশুন্দি থেকে লম্বা চুলঅলা দুইজন আসে এবং বলে যে, বাড়ির অর্ধেক তাদের, ময়না মিঞার কাছ থেকে তারা এই বাড়ি কিনেছে, খৈমন বোঝে যে, হয়তো ময়না মিঞা বাড়ি লিখে দেওয়ার বিষয়ে কাউকে কিছু বলেছিল, কিন্তু সে নিশ্চয়ই এই লোকদের কাছে বাড়ি বেচে নাই, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে খৈমনের কিছু করার থাকে না, এই পোলাপান দয়া করে বাড়ির অর্ধেকটা দখল করে, বাকি অর্ধেকটা খৈমন এবং জুরিমনকে ছেড়ে দেয়; দখলদাররা তাদের অংশটা নতুন করে আস্তর লাগায়া এবং চুনকাম করে ভাড়া দেয়, এইটার নম্বর হয় ৩৫১ ভূতের গল্লি। খৈমনদের বাসা ৩৬নম্বরই থাকে, কিন্তু তখন জারিমনও কোন কারণে মরে যায়, হয়তো ছেলের শোকে কিংবা বাড়িটা দখল করে নিয়া বুকের উপরে বাইরের লোক চাইপা বসে থাকার যন্ত্রণায়, এবং এইরকম ঝামেলার দিনে বান্দরেরা এসে খৈমনের সঙ্গে দিকদারি শুরু কতে! খৈমন যখন চানমিঞাকে নিয়া যায়া রোকেয়া আনোয়ারের সিলভারডেল কেজি স্কুলে ভর্তি করে তখন অনেকে অবাক হয়া যায়, ঠোঙ্গা বানায়া বেচইনা খৈমন, মাতারি সে, মহল্লায় তার কি দাম? কিছু না, তার পোলা কিনা গলায় টাই বেঁধে ভূতের গল্লির রাস্তা দিয়া হাঁটে; তারা জিগাস করে, পড়াবি কেমনে, অয়কি ইংরেজি পারব? তখন খৈমন বলে যে, না পারার কারণ নাই কোন, কালা পারব না? সে কি চান মিল্লাকে মাষ্টার রেখে তালিম দেয় নাই? কিন্তু মহল্লার লোকদের, হয়তো মিসেস জোবেদা রহমানেরই, মনে হয় যে এই সবকিছুর পিছনে বান্দরদের হাত ছিল, সে হয়তো বলে, বান্দরে খিলায়, বান্দরে পিলায়, খাড়া না দেখ না বান্দরে আর কত কি করে! হতে পারে, বাংলাদেশের বন্দিরেরা কি খুবই মজার প্রাণী নয়? কারণ মুরানি বিলকিস উপমার ৩৭নম্বর বাড়িতে গল্প করতে যায় খৈমনই এইসব গপ মারে, খৈমন দেখে যে, সে যখন চানমিত্রী এবং বান্দরের গল্প করে তখন নুরানি বিলকিস কেমন আগ্রহ নিয়া তার দিকে তাকায়া থাকে, তার মুখে আবছা হাসি ছড়ায়া যায়, চোখে ঘোলা আলো জেগে ওঠে, সে খৈমনের কথা গেলে, খায়, হয়তো কখনো বলে, গপ মারো? তখন খৈমন আকাশ থেকে পড়ে, তার মুখটা নির্লিপ্ত করে রেখে বলে, জীবনে নাগপ মারুম ক্যালা, হাচা কই; এবং তার মনে হয় যে, কিছু খসানোর এইটাই উপযুক্ত সময় এবং সে যখন বলে, অফা পান নাই আপনের ঘরে? নুরানি বিলকিস উঠে যায়া পান নিয়া আসে, পানের বোঁটায় করে চুন আনে-নুরানি বিলকিসের এই গল্প পছন্দ হয়, বান্দরের সঙ্গে মানুষের আশ্চর্য ভালবাসার কথা সে শুনতে চায়! তবে বান্দর নিয়া হয়তো খৈমন সত্যিই গল্প মারে না, বান্দরগুলা আসলেই বদমাইশ হয়া ওঠে, কিন্তু খৈমন গরিব মাইয়ালোক, ঠোঙ্গা বানায়া বেইচ্চা খাওয়াইনা মহিলা, তার ভাত যোগাড় করে খাওয়া লাগে, ফলে সে বান্দরগুলার সঙ্গে পারে না। ভুতের গল্লির বান্দরগুলা চানমিঞার দিকে নজর দিয়াই রাখে, ঢাকা শহরের এই বন্দিরগুলার সংবেদনশীলতা হয়তো মানুষের মত হয়া ওঠে, হয়তো ঠিক মানুষের মত না-কারণ, মানুষের সংবেদনশীলতার বিষয়টাই হয়তো একটা মিথ-তথাপি এই বান্দরেরা হয়তো বুঝতে পারে যে, পোলাটার কেউ নাই, বাপ ভাই নাই, মামাচাচা নাই, নানা/নানি, দাদা-দাদি, কিচ্ছু নাই, ফলে ধূসর বান্দরনিটার বাচ্চার সঙ্গে সে খেলা করে বড় হয়-মানুষের একটা বাচ্চা, বান্দরের একটা বাচ্চার সঙ্গে খেলাধূলা করে বড় হয়া উঠতেই পারে। কিন্তু বান্দরের বাচ্চাতো বন্দরের বাচ্চাই, দ্রুত বড় হয়া যায়, সেটার হোলের বিচি মোটা হয়া পিছনের দুই ঠ্যাংয়ের ফাঁক দিয়া লটরপটর করে, তার হোগার উপরে সিন্দুরের মত লাল হয়া ওঠে, সে মহল্লার বাড়িঘরের দেওয়াল কিংবা ছাদের কার্নিশের উপর দিয়া তার কান্তিময় তেজি লেঙ্গুর উঁচা করে ধরে বাংলাদেশী পুরুষ র‍্যাম্প মডেলদের মত হেঁটে আসে, ভূতের গল্লি, দক্ষিণ মৈশুদি এবং পদ্মনিধি লেনের অনেক কিশোরী ও যুবতী বান্দরনি তার জন্য ব্যাকুল হয়া পড়ে, কুলনারী বান্দরনি কুলত্যাগী হয়, এবং সে এইসব ভালবাসার পাত্রীদের বিমুখ করতে পারে না, তখন চাইরপাঁচটা বান্দরনি তার ঔরসজাত চাইর/পাঁচটা বাচ্চা ঠ্যাংয়ের চিপায় বুকের সঙ্গে ঝুলায়া মহল্লার কোন বিল্ডিং কিংবা দেওয়ালের উপর এসে খাড়ায়; কি নতুন যৌবনপ্রাপ্ত এই হুলাবান্দর-চানমিঞার প্রথম খেলার সাথি–চানমিঞাকে ভুলে যায় না, চানমিঞাতো মানুষের বাচ্চা, ৩/৪ কিংবা ৫ বছরে সে কিছুই বড় হয় না, ফলে এই বান্দর তার ৫ বান্দরনি এবং পোলাপানদের নিয়া তাকে দেখতে আসে, বাচ্চাদের হয়তো বলে, এইটা তগো চাচা লাগে, সালাম দে, বল আস্সালামালাইকুম, তখন বাচ্চা বান্দরগুলা চানমিঞার পায়ের কাছে ডিগবাজি খায়া ফুরতি দেখায়! খৈমন হয়তো নতুন করে নুরানি বিলকিসের কাছে এই কথা বলে, একদিন দেখি কি চাইরপাচটা বান্দরনি দেওয়ালের উপরে বয়া একটা আরেকটার উকুন বাছে, চোখ পিটপিটায়, ঘরের ভিতরে ঢুইকা দেখি বান্দরের ৫/১০টা বাচ্চা চানমিঞার লগে ফালাফালি কিলাকিলি করে, আমারে দেইখা বাচ্চাগুলান দাঁত ভেটকি দিয়া থাকে। হুলাবান্দরটা ক্রমে হয়তো বদমাইশও হয়া ওঠে, সে মহল্লায় টেরর হয়া খাড়ায়, হয়তো একদিন সে একটা জাম্বুরা নিয়া আসে, খৈমনের ঘরের ভিতরে ৫ বান্দরের বাচ্চা এবং চানমিঞা সেইটা দিয়া ফুটবল খেলে, একদিন হরলিক্সের বোতল আনে, তারা হৈচৈ করে খায়, তারপর একদিন এই নতুন বাপ-বন্দর চানমিঞার জন্য নিয়া আসে একটা বই, বান্দর হলেও সে বুঝতে পারে যে মানুষের পোলার লেখাপড়া করা লাগবে, বান্দর হলে চলবে না, ফলে নুরানি বিলকিস উপমাকে খৈমন বলে যে, একদিন ঘরে যায় সে দেখে বান্দর-সুন্দরের কোন খবর নাই, চাইর দিকে নীরব-তখন আমারতো ভয়ে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া, কিরে পোলার কুন ভাজ পাইনা, গেল কৈ, ঘুমায় নিহি? ঘরে ঢুইকা দেখি একটা বইয়ের উপরে পোলা আমার উপুড় হয়া আছে। কিন্তু খৈমনতো পড়তে পারে না, উম্মি জেনানা সে, ফলে বইটা নিয়া সে পূর্ণলক্ষ্মীর কাছে যায়, পূর্ণলক্ষ্মী হয়তো ম্যাট্রিক ফেলের পর তখনো তার বাপ চন্দ্রকান্ত বিয়ার জন্য একটা বসাক পোলা যোগাড় করে আনবে এই আশায় প্রতীক্ষা করে ছিল,

তখন খৈমন বান্দরের আনা বইটা নিয়া যায় হাজির হয় এবং পূর্ণলক্ষ্মীকে আবোলতাবোল সব কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করে; কারণ সেতো বলতে পারে না যে, মহল্লার বান্দরেরা এই বই চুরি করে আনে তার পোলার জন্য, পূর্ণলক্ষ্মী পাতা ছিঁড়া ফালানো বইটা নিয়া পড়ে, মাই ফাস্ট ইংলিশ বুক, এবং খৈমনকে বলে, তর পোলারে পড়াইব কে? কিন্তু মিসেস জোবেদা যখন বলে যে, খৈমনতো সবসময়ই ধুরন্ধর প্রকৃতির মাইয়ালোক, সে কি খুব বাড়ায়া বলে? খৈমনতো ধানাইপানাই করেই জীবন কাটাতে থাকে, পূর্ণলক্ষ্মী হয়তো এমনি তাকে কথাটা জিগাস করে, কিছু বলতে হয় সেই জন্য বলে, কিন্তু খৈমন তার কথা মাটিতে পড়তে দেওয়ার আগেই যখন বলে, তাইলে তুমি পড়াও, তখন পূর্ণলক্ষ্মী ভ্যাবাচেকা খায়া যায়, সে বলে, আমি কেমনে পড়ামু তর পোলারে?

: ক্যালা তুমি পড়ালিখি ভুইল্লা গেছ নিহি, বইয়া না থাইকা চানমিঞারে পড়াও, টাকা চাইলে টাকা নিও।

পূর্ণলক্ষ্মী চানমিঞাকে পড়াতে শুরু করে, হয়তো টাকার জন্য না, হয়তো এরকম নিরালম্ব ইয়া থাকা যায় না বলে, অথবা হয়তো টাকার জন্যও, কিন্তু চানমিঞার বান্দর বন্ধুরা তার পিছনে লেগে থাকে, তার প্রথম বান্দর বন্ধু তার কাচ্চাবাচ্চা এবং স্ত্রীদের নিয়া যখনতখন আসে, এবং খৈমন যখন ঘরে থাকে না তখন এই বান্দর বান্দরনিরা এবং তাদের পোলাপান তার ঘর ভরে ফেলে গ্যাঞ্জাম করে, চানমিঞা তার বান্দর মেহমানদের সঙ্গে হৈহৈরৈরৈ করে কাটায়; খৈমন হয়তো পোলাকে বকে, বান্দরের লগে থাইকা বান্দর হয়া গেতাছচ, সে নুরানি বিলকিস উপমাকে পুনরায় বলে, কেমুন পোলা হইলো আল্লাহ, রাইতদিন বান্দরগুলিরে লয়া আছে। খৈমন হয়তো চানমিঞাকে মাইর লাগানোরও হুমকি দেয়, বলে, ঘরের ভিতরে বান্দর লয়া ফালাফালি করলে মাইরা তরে ফাটামু, কিন্তু বান্দারেরাই চানমিঞার বড় বন্ধু হয়া খাড়ায়, মাইরা ফাটানোর কথা বলায় বুড়া হুলাটা এসে খৈমনকে ভেংচি দিয়া ভয় দেখায়; তিন চাইরপাঁচ কিংবা দশ প্রজন্মের পঞ্চাইশটা বান্দর তার খেলার সাথি হয়া পড়ে এবং এই সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ে। চানমিঞা পূর্ণলক্ষ্মীর কাছে যায় পড়ার জন্য, অথবা পূর্ণলক্ষ্মীই আসে তাদের বাসায় এবং চানমিঞাকে বলে, পড়, সি-তে ক্যাট, ক্যাট মানে বিলাই, চানমিঞা মাথা হেলায়াদোলায়া পড়ে, ক্যাট মানে বিলাই, তখন তার পড়ার সময় দেওয়ালের উপর বান্দরেরা অপেক্ষায় থাকে এবং পূর্ণক্ষ্মীর মনে হয় এই পোলারতো লেখাপড়া হবে না, এবং তবু একদিন খৈমন র‍্যাঙ্কিন স্ট্রিটে সিলভারডেল কেজি স্কুলে যায় হাজির হয়, বাইরের গেটে টুলের উপরে বসা দারোয়ান তাকে ভিতরে ঢুকতে দিতে চায় না, খৈমনের দিকে তাকায়া থাকে, তার পরনে একট ইস্তারিহীন লেড়লেড়া রঙ জ্বলা ছাপার শাড়ি, পায়ে গোড়ালি খাওয়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল; দারোয়ান। হয়তো ভাবে যে, এই বেটির এইখানে কি কাম? তখন খৈমন আসল কথাটা বলে, আমার পোলাটারে ভর্তি করুম, আমারে যাইতে দেন দারোয়ান ভাই।

দারোয়ান রামদাস হয়তো প্রথমে আপত্তি করে, কারণ তার মনে হয় যে, মাতারির মত এই মাইয়ালোকের স্কুলের ভিতরে ঢুকে কাম নাই, একে ঢুকতে দিলে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তারে চাবায়া খাবে, বলবে, রামদাস তুমি গেটে খাড়ায়া খাড়ায়া কি ঘুমাও, এইসব লোকজন ভিতরে ঢুইকা যায়? কিন্তু খৈমন তাকে ভাই বোলাইছে, তার মনে হয় যে, মাইয়ালোকটা ভাল, সে তাদের ঢুকতে দেয়, ভাবটা এমন করে যে, সে তাদেরকে দেখেই নাই, সে। জানেই না কোনখাল দিয় ঢুইকা গেল এমন দুইজন মানুষ, আমি কইতে পারব না ম্যাডাম, আমি দেখিই নাই কিভাবে ভিতরে ঢুকছে! তখন ভূতের গল্লির খৈমন তার এতিম পোলা চনিমিঞাকে নিয়া মিসেস রোকেয়া আনোয়ারের রুমের দরজার পর্দা সরায়া হুড়মুড়ায় ঢোকে এবং সে নুরানি বিলকিস উপমাকে বলে যে, তার দিকে তাকায়া রোকেয়া আনোয়ার তার চেয়ার থেকে ধুপ করে পড়ে যায়, খৈমন হয়তো এইগুলা বানায়া বলে, কারণ উপমা বেগমকে বান্দরের কথা বলতে যায় সে গল্প বানাইতে শেখে, হয়তো বিকালে নুরানি বিলকিসের রান্না ঘর কিংবা কুয়াতলায় বসে গল্প করার সময় আর কিছু বলার না পেয়ে খৈমন এইসবই বলে, তখন উপমা বেগম তার কথা মানতে চায় না, সব তর চাপা, এবং তখন খৈমন বলে, আমারে ইকটু তরকারি দেন পোলাটারে খাওয়াই। ফলে নুরানি বিলকিসের আর কি উপায় থাকে? সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তার খারাপ লাগে, তবুও সে ভাবে, গরিব এতিম পোলা এবং সে বলে, লয়া যা—খৈমন নুরানি . বিলকিসের এনামেলের বাটিতে বেগুন কিংবা ঝিংগা কিংবা আলুর তরকারি নিয়া ঘরে ফেরে। তখন চানমিঞা খায় এবং হয়তো তার মাকে ধমকায়, আম্মা পত্যেক দিন বাইগনের তরকারি আনো ক্যালা? এইসময় খৈমন নুরানি বিলকিসকে বলে যে, সিলভারডেল কেজি স্কুলের ভোটকু রোকেয়া আনোয়ার তাকে দেখে মাথা উঁচু করতে যায়া কেমন করে চেয়ার থেকে পড়ে যায়, খৈমন বলে, হয়তো সে চেয়ারে বয়া ঘুমাইতেছিল, বেড়ি নিজের স্কুলের চেয়ারে বয়া নিজেই ঘুমায়; এবং তখন ফ্লোর থেকে উঠে খাড়ানোর পর সে বিব্রত হয়া পড়ে এবং খৈমন যখন বলে, আপা আপনে পইড়া গেলেন? আমার পোলাটারে ভর্তি করেন, রোকেয়া আনোয়ার হয়তো পতনের পরে পুরাপুরি সুস্থির হয় নাই, তবে সে বিহ্বলতা কাটায়া দ্রুত এই ঝামেলা নিষ্পত্তি করতে সচেষ্ট হয়, সে বোঝে যে, এই মাইয়ালোকটা তার এই দুর্বলতা এবং পতনের সাক্ষী, ফলে সে খৈমনকে ক্ষেপাইতে চায় না, আয়াকে পাঠায় মিসেস ক্লার্ককে ক্লাস থেকে ডেকে আনার জন্য, এবং মেরি ক্লার্ক আসার পর তাকে বলে, টেক হিম টু ইয়োর ক্লাস। মেরি জয়েস একটু বিভ্রান্ত হয়া পড়ে, কারণ প্রিন্সিপালের ঘরের আলোয় আলো হয়তো কম ছিল–সে প্রথমে কেবল খৈমনকে সেখানে খাড়ায়া থাকতে দেখে, তার মনে হয় যে, কাকে সে ক্লাসে নিয়া যাবে? তখন এক মুহূর্তের খটকার পর সে খৈমনের হাঁটুর কাছে আঁচল খামচায়া ধরে খাড়ায়া থাকা চানমিঞাকে দেখে, এবং তবু যখন মেরি ক্লার্কের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয় না, সে বলে, এক্সকিউজ মি ম্যাম? তখন রোকেয়া আনোয়ার তার ধৈর্য হারায়া ফালায়, চোখে দেখো না তুমি মেরিঃ টেক দা বয় টু ইয়োর ক্লাস, এবং মেরি জয়েস সঙ্গে করে চানমিঞাকে নিয়া বের হয়া যাওয়ার পর সে বৈমনকে বলে, আমি পড়ে যাই নাই! রোকেয়া আনোয়ার হয়তো তখন আত্মবিশ্বাস ফিরা পেতে থাকে, ফলে তার রাগ বাড়ে, সে খৈমনকে আর পাত্তা না দেওয়ার ভাব দেখায়, সে মুখটা কঠিন করে খৈমনের দিকে তাকায়া বলে, এই স্কুলের বেতন কিন্তু অনেক টাকা, তখন খৈমন তার আঁচলের খুঁটে বান্ধা গিঁটু দেখায় এবং বলে, ট্যাকা আছে; এবং তখন মিসেস রোকেয়া আনোয়ারের খোঁড়া স্বামী এবং দুই নাবালক ছেলেমেয়ে, রিয়া এবং ফারুবারকে নিয়া যার সংসার-মুখের কঠিন রেখার ভিতরে হাসির আভাস দেখা দেয়, এই মহিলা কিংবা মাইয়ালোক কিংবা মাতারি আঁচলে বান্ধা টাকা দিয়া সিলভারডেলে পোলা পড়াইতে চায়, আশ্চর্য, সে নিশ্চিত হয় যে, এই সব মহিলার জন্য তার মনের কোনায় কোন মমতাই সে জাগায়া তুলবে না-রিয়াকে শিলং বোর্ডিং স্কুলে পাঠাইতেই হবে! কিন্তু মিসেস মেরি ক্লার্ক যখন চানমির শীর্ণ এবং প্রায় অস্তিত্বহীন একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়া প্রিন্সিপালের রুম থেকে বের হয়া কেজি ওয়ানের দিকে যায়, তার মনে হয় যে, এইসব পোলাপানকে রোকেয়া আনোয়ার স্কুলে ভর্তি করতাছে, এইগুলি কি করছে সে! কিন্তু তখন চানমিঞা মনে হয় মেরি জয়েসের হাতের ভিতরে অস্তিত্বহীনতার প্রান্ত থেকে ফিরা আসে, সে জ্যাক এন্ড জিল দ্রুত শিখা ফালায়, এবং মেরি ক্লার্ক পুচি চানমিঞার দিকে নজর দেয়, সে বলে, ভেরি গুড়, খুবই ভাল ছান মিঞা!

সিলভারডেল কেজি স্কুলের স্টাইলই ছিল আলাদা, ছাত্রছাত্রীর জন্য ছিল ইউনিফর্ম, সাদা সার্ট কিংবা টপের সঙ্গে মেরুন রঙের হাফ প্যান্ট কিংবা স্কার্ট, সঙ্গে মেরুন রঙের টাই, স্কুল প্রাঙ্গণের পাশে ছিল কাঠের বানানো দুইটা সি-স এবং একটা স্লাইড-এইগুলা রোকেয়া আনোয়ারের কায়দা, তার কথা হচ্ছে একটা কেজি স্কুল চালাইতে হলে এগুলা করা লাগে। প্রত্যেক বছরের প্রথমে বাচ্চা ভর্তি করা হয়া গেলে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার আয়োজন ছিল ডা: নন্দির বাসায়, এটাকে মিসেস রোকেয়া আনোয়ার নাম দেয়, মেডিকেল চেকআপ আপন এন্ট্রি; ডা: এম এন নন্দি তখন র‍্যাঙ্কিন স্ট্রিটে স্কুলের পাশের দোতলা বাসায় থাকে, নিচ তলার একপাশে তার চেম্বার, ফলে একদিন সকালে কেজি ওয়ানের পনের/বিশটা ছেলেমেয়েকে তাদের টিচার মেরি জয়েস লাইন ধরায়া রাস্তা পার করে ডা: নন্দির চেম্বারে নিয়া যায় হাজির হয়। মেরি জয়েস বাচ্চাদের নিয়া করিডোরে সোফায় বসে অপেক্ষা করে, কম্পাউন্ডার তালিকা থেকে নাম ডেকে ডাক্তারের রুমে বাচ্চা ঢোকায়, ডা: নন্দি বাচ্চাদের পরীক্ষা করে, সে তাদের সার্ট উঠায়া বুকে স্টেথো লাগায়া শোনে, প্যাট টিপা পিলার সাইজ দেখে ঠিক আছে কিনা, জিব দেখে, হাঁ করায়া গলার ভিতর দেখে, চোখের নিচের পাতা টেনে দেখে কিরকম লাল, তারপর ছেলেদের প্যান্ট টেনে নামায়া উঠবস করায়। চানমিঞা ডা: নন্দির রুমের বাইরে টিচারের সঙ্গে বসে থেকে দরজার পর্দার ফাঁক দিয়া ঘরের ভিতরে ন্যাংটা ছেলেদের কসরত করতে দেখে, এবং যখন আর দুই/তিনজন বাকি তখন মেরি জয়েস দেখে যে, বাচ্চা একজন কম, চানমিঞা নাই, এবং তাকে আর খুঁজেই পাওয়া যায় না; ফলে মেরি খুব বিব্রত হয় পড়ে এবং রোকেয়া আনোয়ার তাকে বকাঝকা করে, তুমি কেমন মেয়ে মেরি, এই পনেরটা পোলাপান দেখে রাখতে পার না!

তখন মেরির খুব রাগ হয় চানমিঞার উপর, এবং পরদিন সে যখন স্কুলে আসে তখন মেরি তাকে ধরে, তুমি কেমন পোলা, হেঁ?

চানমিঞা অধোবদন হয়া থাকে।

: তোমার সমস্যা কি, তুমি এরকম না বলে চলে গেলা কেন?

চানমিঞা কথা না বলে কান্দে, ফোঁপায়।

: তুমি কান্দো কেন, কেন কান্দো?

তখন চানমিঞা থামে এবং বলে, আমার ভয় লাগছে!

চানমিঞাকে নিয়া মেরি জয়েস আবার ডা: নন্দির চেম্বারে যায়, যেতেই হয়, না হলে রোকেয়া আনোয়ার তাকে আবার বকবে-তুমি এই রকম কেন কর বলতো? নিয়া যাও, দেখায়া নিয়া আস-তখন প্যান্টে সাসপেন্ডার লাগানো ভুড়িঅলা ফরসা ডাক্তার নন্দি তার চেম্বারে চানমিঞাকে দুই হাতে উঁচা করে ধরে, সে মুখ দিয়া একটা লম্বা শব্দ করে-আঃ-এবং মেরিকে বলে, এইটাতো দেখি ম্যাডাম এক আশ্চর্যজনক পোলা, বলে ভয় লাগছে, ভয় কিসের! তখন ডাক্তার তাকে চেম্বারে নিয়া পরীক্ষা করে, জিব দেখে, চোখ দেখে, এবং ডাক্তার নন্দি যখন তাকে জিগাস করে, তুমি ভয় পাইছো কেন? তখন সে বলে, আপনে প্যান্ট খুলছেন, আমার ভয় লাগছে।

ডাক্তার নন্দি বলে, এইটাতো ম্যাডাম দেখি এক আশ্চর্যজনক ভদ্রপোলাও, এই কথা শুনে মেরি একটু হাসে, চানমিঞার মাথার চুল আঙ্গুল দিয়া একটু নেড়ে দেয় এবং বলে, হি ইজ শাই এন্ড ব্রিলিয়েন্ট, তখন ডা: নন্দি টেবিলের সামনে বসা মেরিকে বলে, আপনে একটু বাইরে যায় বসেন, এবং তারপর ঘরের ভিতরে চানমিঞা একা হলে তার প্যান্ট নামায়া তাকে ওঠাবসা করায়, হার্নিয়ার কোন লক্ষণ আছে কিনা দেখার জন্য, ডাইন হাতে একটা পাতলা রাবারের দাস্তানা পরে চানমিঞার বড় সাইজের সিমের বিচির মত অণ্ডকোষ নিয়া নাড়াচাড়া করে দেখে, একটা, না দুইটা; তারপর তার চোখ পরীক্ষা করে, চানমিঞা একচোখ বন্ধ করে ঘরের কোনায় রাখা স্নেলেন এলফাবেট চার্ট থেকে পড়ে:

টি

ই পি

এল এইচ ভি

ও এস টি এ

এল সি ভি ই

এফ জেড টি এইচ পি

এন এল ও এস ভি এইচ

ও জেড ইউ এফ কে এল

টি ই পি সি এল ভি ও

ডাক্তার তখন তার কালার পারসেপশন বোঝার জন্যও পরীক্ষা করে এবং সে দেখে যে, চানমিঞা ইশিহারা কালার স্কিম থেকে পড়তে যায় গুলায়া ফালায়, সে ইংরেজি সংখ্যা ৭৪-কে পড়ে ২১, ডাক্তার বলে, আবার বল।

চানমিঞা বলে, টুয়েন্টিওয়ান।

০৬. ডাঃ নন্দি বোঝে

ডাঃ নন্দি বোঝে যে, ছেলেটা রেড-গ্রিন কালার ব্লাইন্ড, সে একটা কাগজের মধ্যে কলম দিয়া খসখস করে লেখে, প্রোটানোপিয়া/ডিউটারানোপিয়া; কিন্তু তখন ডা: নন্দির ফোন আসে, অন্য একটা ঘরে গরুর শিঙ্গার মত কাল রঙের টেলিফোন ঝনঝনায়া বাজে, এবং সে উঠে যায়া, হ্যালো হ্যালো হ্যালোরে করে ফিরা এসে দেখে যে, টেবিদ্রে উপরে কাগজটা নাই-হয়তো সে ফিলোসফার টাইপের ডাক্তার ছিল, ফলে দেখা যায় যে, কাগজটার কথাও সে ভুলে যায়-এবং চানমিঞা এবং তার টিচারও তখন চলে গেছে। ডাক্তার নন্দি যখন সকলের সঙ্গে চানমিল্লার মেডিকেল শিট তৈরি করে, তখন সে লেখে, চুলের রঙ কালো, চোখ বাদামি, চোখের দৃষ্টি ৬/৬ (চশমা ছাড়া), কোনো বিশেষ স্বাস্থ্যগত সমস্যা নাই; বর্ণকানা পোলাটা এইভাবে তার শারীরিক সমস্যার বিষয়ে অনবহিত হয়া থাকে। ফলে মেরি নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লির বাসায় যায়া এইসব গল্প ববকে বলে, তখন হয়তো জুলি খুবই ছোট, কিন্তু সে হয়তো তার জীবনের প্রথম থেকেই মায়ের স্কুলের গল্প শোনায় অভ্যস্ত হয় ওঠে, প্রতি বছর তালিকায় নতুন নাম যোগ হয়, লুঙ্কুল, মাসুদ, দেলোয়ার, তারপর আসে চানমি; তখন প্রাইজ গিভিং ডে-তে চানমিঞাকে সে দেখে এবং তার মাকে যখন বলে, হু ইজ হি? মেরি বলে, হি ইজ মাঙ্কি বয়! জুলি ফ্লোরেন্স হয়তো চানমিঞার কথা তার মার কাছে আগেই শুনেছিল-ক্লাসে একটা পোলা আছে, এই ছোট্ট পিচ্চি, সকলে তাকে মাঙ্কি বয় বলে-সেই কারণে মেরি যখন জুলিকে বলে যে, এইটা মাঙ্কি বয়, তখন জুলি তাকে চিনতে পারে, তাহইলে এইটা সে, এবং বালিকা জুলি তার মাকে বলে, ওকে আমাদের বাসায় আসতে বলো না, আমি ওর সাথে খেলব; কিন্তু সেটাতো আর সম্ভব না, কোন কারণ ছাড়া শুধু জুলির সঙ্গে খেলার জন্যভো চানমিঞাকে বাসায় নিয়া যাওয়া যায় না, তবে মামুন এবং লেদুর সঙ্গে চানমিঞা জুলির পরবর্তী জন্মদিনে যোগ দেয়। ছেলে মেম সাহেবের বাসায় দাওয়াত খেতে যাবে এই খবর পায়া খৈমন অস্থির হয়া পড়ে, রথখোলার মোড়ে যায়া চানমিঞার লাল নটিবয় জুতা কালি করায়া আনে, চানমিঞার হতি/পাওয়ে সরিষার তেল মাখায়া মুখে তিব্বত স্নো লাগায়া দিয়া বলে, যা এ্যালা, এবং পোলা তার মেম সাহেবের বাড়িতে দাওয়াত খেতে যায়। মেরি তাদেরকে স্কুল থেকে নিয়া যায় এবং তখন চানমিঞার সঙ্গে জুলির দেখা হয়, মেরি তার মেয়েকে ডেকে আনে, জুলি, এই যে ছানমিঞা, হ্যালো বলো, বলল হ্যালো চানমিঞা? তখন জুলির হয়তো মনে পড়ে যে, চানমিঞা হচ্ছে মাঙ্কিয়! কারণ এইসব বিটলা পোলাপান কিছুই ভোলে না, সে তাকে হ্যালো বলে এবং জিগাস করে, তুমি কি মাঙ্কি বয়? এবং মেরি তাকে থামায়া সারতে পারে না, ছিঃ জুলি এইসব বলে না; ফলে জুলি তখন তাদের নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লির বাসায় বসে বিকাল বেলা মামুন এবং ফখরুল আলম লেদুর সঙ্গে গল্প করে, এবং চানমিঞার কথা মনে হলে সে জিগাস করে, কোথায় সে এখন? এই প্রশ্ন শুনে মামুন যতই পাত্তা না দেওয়ার চেষ্টা করুক, লেদুর মনে হয় যে, জুলি এত চানমিঞার কথা জিগাস করে কেন! তখন সে একদিন “চানমিঞার খোঁজে বের হয়, তার মনে হয় যে, চানমিঞার সঙ্গে তারও বহুদিন দেখা হয় না, কি করে সে এখন? কি করে এই পোলাটা? চানমিঞা? এই খবর তার মা খৈমন হয়তো সবচাইতে ভাল জানে, পোলার পিছনে যে যৌবন খোয়ায় বসে থাকে, পোলা তার বড় হবে, জোবেদা বেগমের পোলা মামুনের মত সে তাকে সিলভারডেল স্কুলে নিয়া যায়া ভর্তি করে, ঠোঙ্গা বানায়া বেইচা পোলার স্কুলের বেতন দিতে পাছা দিয়া ধুমা, ছুটে যায় তার, তবে প্রথম দিকে চানমিঞা এই ধুমা ছোটার দাম দেয়, কেজি ওয়ান থেকে পাশ দিয়া কেজি টুতে ওঠে, সেকেন্ড থার্ড কিছু একটা হয়-অভিজিৎ হয় ফাস্ট-সে তার স্কুল থেকে নতুন বইয়ের তালিকা নিয়া আসে, খৈমন তখন নুরানি বিলকিস উপমাকে যায়া ধরে, আফা আমারে কয়টা ট্যাকা দেন, নাইলে আমার পোলাআর পড়ালিখি আমি কেমনে চালাই!

খৈমনের এই কথায় নুরানি বিলকি অবাক হয়, এই বেটি বলে কি, আশ্চর্য, তর পোলারে ইংরেজি স্কুলে কি আমরা দিবার কইচি নিহি, অখনে আয়া কচ পোলার লেখাপড়ির লাইগা টাকা দেন, আরে, এই মারিতে মহা চালুরে বাবা! নুরানি বিলকিস এমন একটা ভাব করে যেন সে বুঝতেই পারে নাই খৈমন কি বলে, তারপর সে বলে, তর রেশন কাট কয়টা? এবং খৈমন যখন বলে যে, তার তিনটা রেশন কার্ড, দুইটা সাদা রঙের ফুল কার্ড-তার একটার মালিক জরিমন ইতিমধ্যে মরে ভূত হয়া গেছে—অন্য আর একটা নীল রঙের হাফ কার্ড, চানমিঞার; তখন উপমা বেগম একটুখানি ভেবে বলে, তুই দুই সেট রেশন কাট বানায়া ল, এবং খৈমন তাই করে, সে বিশটা করে মোট চল্লিশটা অতিরিক্ত সাদা কার্ডের মালিক হয়, নুরানি বিলকিসের স্বামী ফজলুর রহমান এই ব্যাপারে তাকে সাহায্য করে, খৈমনের কোন ঝামেলা হয় না, সে প্রত্যেক সপ্তাহে দুইটা রেশন দোকান থেকে দুই সেট কার্ড দিয়া প্রতি সাদা কার্ডে দেড় সের করে চাইল উঠায়, চিনি এবং গম উঠায়, এবং ঠাটারি বাজারে নিয়া যায় মুদি কিংবা চাইলের দোকানদারদের কাছে বেচে। ঠোঙ্গা বনানো এবং রেশনের মাল বেচা পয়সা দিয়া সে চানমিঞাকে সিলভারডেলের চাইর ক্লাস পর্যন্ত টেনে নিয়া যায়, চানমিঞা যখন স্কুল থেকে পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড নিয়া আসে সে সেটা নিয়া যায় পূর্ণলক্ষ্মীর কাছে, পূর্ণলক্ষ্মী তখনো ঘরে শুয়ে বসে ঘুমায়া : মোটা হয় এবং বছরে চাইর বার খৈমনকে চানমিঞার প্রোগ্রেস রিপোর্ট পড়ে শোনায়-খৈমন তাকে এক ভালই কাজ দেয়-প্রোগ্রেস রিপোর্ট কার্ড পড়ে সে বলে, তুমার পোলাতো ছাত্র ভালই, থার্ড হইছে, দুই বিষয়ে একশর মইদ্দে একশ, তারপর পূর্ণলক্ষ্মী অবিভাবকের স্বাক্ষরের ঘরে সই করে দেয়, খৈমন বেগম। তবুও খৈমনের হয়তো আশা ছিল তার ছেলেটা মানুষ হবে, ময়না–মিঞার সঙ্গে বিয়া হওয়ায় সে কিছুই পায় নাই, এই পোলাটা ছাড়া; মেরি জয়েসের হয়তো মনে হয়েছিল যে, চানমিঞা অনেকদূর যাবে, কিন্তু খৈমনের পোলার জীবনের পথ হারানো খুব অসম্ভব ছিল না। মেরি জয়েস ক্লার্ক হয়তো ভেবেছিল যে, ছেলেটাকে সে সিলভারডেলের চৌকাঠ পার করে দেবে, বেচারা গরিবের পোলা; কিন্তু সে হয়তো বোঝে নাই যে, ভালবাসাই চানমিঞাকে বাঁচানের জন্য যথেষ্ট ছিল না, শুধু চোখের পানি আঙ্গুল দিয়া মুছে দিয়া চানমিঞার জীবনের বিচিত্ররকমের সঙ্কট দূর করা যায় নাই, ফলে মেরি ভুলের ফান্দে পড়ে, সে একদিন ক্লাসে মামুন কিংবা অভিজিৎ কিংবা লেদুর মত চানমিঞাকে আদর করে চান্দু বলে ডেকে ঝামেলা তৈরি করে, চানমিঞা বিষয়টা একদম পছন্দ করে না, সে এরপর তিনদিন স্কুলে আসে না, তখন মেরি চিন্তিত হয়া পড়ে, কি হইলো পোলাটার? এবং তখন খৈমন এসে তাকে স্কুলে দিয়া যায়, খৈমন তার দাঁতের ফাঁকে শাড়ির আঁচল কামড় দিয়া ধরে হাসে, পান-দোক্তা খাওয়া তার কালা দাঁত ভেটকায়া রাখে, মেরি জয়েসের দিকে তাকায়া সে বলে, আফা আপনে অরে চান্দু বলছেন সেইজন্য ও লজ্জা পাইছে, আমাকে বলে, টিচার আমারে চান্দু বলছে!

মেরির মনে তখন খুব কষ্ট হয়, কারণ কষ্ট পাওয়ার জন্যই মেরি জয়েসের জন্ম, সে ভাবে এই পোলাটাকে সে কত না ভালবাসে, তার জন্য কত কি না সে করে, ফলে সে একদিনদুইদিন গম্ভীর হয়া থাকে, চানমিঞা এটা করে, সেটা করে, খাতায় একটা সাম করে নিয়া যায়া দেখায়, কি মেরি তার দিকে তাকায় না, তখন চানমিঞাঁ কেন্দে ফেলে, মেরি দেখে, সে কাছে এসে বলে, কান্দ কেন, কেন কান্দ তুমি? আশ্চর্য!

চানমিঞা তখন কি বলবে? সে হাত দিয়া মুখ ঢেকে আরো কান্দে, কেন্দে ভাসায়, এবং তখন মেরি জয়েস তার মাথায় হাত বুলায়া দেয়, ওকে ওকে, ডোন্ট ক্রাই, ওকে!

চানমিঞা তার জীবনে দ্বিতীয়বার মেরি জয়েসের হাত চোখের পানিতে ভিজায়া দিয়া সুস্থির হয়, হয়তো মামুন তার মা মিসেস জোবেদাকে সব বলে, এবং জোবেদা বেগম এইসব কথা শুনে বলে, আল্লাদ, নাটকের দেখি শ্যাষ নাইকা; কি চানমিঞা ছিল কেমন যে তেরাবাকা পেলা, সিদাই হতে পারে না, ফলে জুলি ফ্লোরেন্স তার জন্মদিনের পার্টিতে যখন তাকে জিগাস করে সে মাঙ্কি বয় কিনা তখন তার এত রাগ হয় যে, রামকৃষ্ণ মিশন রোডের মোড় থেকে বারি স্টুডিওর ফটোগ্রাফার এসে যখন তার গলায় ঝোলানো ক্যামেরার উপরের ঢাকনি টেনে তুলে ডাইন হাতে ফ্লাশ গান উঁচা করে ধরে, তখন চানমিঞা সেখান থেকে সরে যায় বেলকোনিতে খাড়ায়া থাকে। মামুন এবং ফখরুল আলম লেদুর সঙ্গে পরে জুলি যখন তাদের ফ্যামিলি এলবাম দেখে, তখন এই ছবিটা তাদের সংযুক্ত শৈশবের স্মৃতি হয়, ছবির মাঝখানে রবার্ট একটা বো-টাই পরে খাড়ায়া আছে, এই ছবির মধ্যে কত লোক, শুধু চানমিঞা নাই-কেন নাই? নাই ক্যালা?

: হোয়্যার ওয়াজ হি?

মামুনুল হাই বলে যে, সেইদিন হয়তো চানমিঞা এই অনুষ্ঠানে ছিলই না; কিন্তু জুলি ফ্লোরেন্সের জানা ছিল-কিভাবে জানা ছিল বালা মুশকিল-যে, চানমিঞা অবশ্যই এসেছিল এবং সে মনে করতে পারে যে, সে চানমিঞার দেওয়া একটা লেবেথুসও খেয়েছিল; জুলি তখন তাদের ড্রয়িংরুমে বসে মামুন এবং লেদুকে বলে, বাট হি ওয়াজ দেয়ার, সে আমাকে চকলেট না কি যেন দিয়েছিল একটা!

মোটা লেদুরও বিষয়টা মনে পড়ে, সে জুলিকে বলে যে, চানমিঞা তাকে একটা কলাও দিয়েছিল খেতে; জুলির তখন তার মার কলা খাওয়া সম্পর্কিত সাবধান বাণীর কথা স্মরণ হয় এবং সে বলে, কলা খাব কেন, কলা খাওয়ার প্রশ্নই আসে না!

: খাইছ, আমার মনে আছে আমিতো বানায়া বলতেছি না, কলী খাইতে অসুবিধা কি?

জুলি তখন হতাশ হয়া পড়ে, তার মনে হয় যে, তার মা হয়তো তাকে অনেক দেরি করে সবধান করেছিল, কলা এবং পুরুষ মানুষ সম্পর্কে অবশ্য চানমিঞা তখন পুরুষ মানুষ ছিল না, তবুও—এবং সে পুনরায় জিগাস করে, লেদুভাই আপনেদের মাঙ্কিবয় এখন কোথায়?

লেদুর তখন মনে হয় যে, চানমিঞাকে জুলি ফ্লোরেন্স ভোলে নাই কেন? একটা চকলেট খাইছিল কত বছর আগে, সেইটা মনে করে রেখেছে, হোয়াই, কেন? এত কিছু কেন মনে রাখে এই মেয়েটা? হয়তো এমনি রাখে, মামুন তাকে এ ব্যাপারে সবচাইতে ভাল ব্যাখ্যা দেয়, সে বলে যে, কেউ যদি মাক্কিবয় হয় তাকে লোকে মনে রাখবে, এইটাই স্বাভাবিক, মামুনুল হাই, ফখরুল আলম এদেরকে কেউ মনে রাখবে না, এইটাও স্বাভাবিক-ফলে মাঙ্কিবয় হওয়ার কারণে চানমিঞা সুবিধা পায়-জুলি হয়তো বলে, চানমিঞাকে মাঝিবয় বলে কেন?

: হি ওয়াজ ব্ৰটআপ বাই এ শি মাঙ্কি।

: ইট ইজ ভেরি মাচ পসিবল, দুই ভাই রোমুলাস এবং রেমাস নেকড়ে বাঘের দুধ খায়া বড় হয়েছিল, পরে তারা রোম নগরের প্রতিষ্ঠা করেছিল।

: তাই নাকি? ইজ ইট সো!

: অফকোর্স ইট ইজ, হোয়াই?

হয়তো মামুন বলে, ওকে লেটস ফরগেট ইট, এবং ফখরুল আলম লেদুর মনে হয় যে, চানমিঞাটা এখন কোথায়? হয়তো খৈম জানে, কারণ জন্ম দেওয়ার পর রাজাকারের ভয়ে খৈমল তাকে পোটলার মধ্যে জড়ায়া রাখে এবং বলে যে, তার পোলার জন্ম ১৬ই ডিসেম্বর; মেরি জয়েস হয়তো বিষয়টা কেজি ওয়ানের প্রথম কোয়ার্টারের প্রোগ্রেস রিপোর্ট লিখতে যায় খেয়াল করে, সে লেখে, ফাদার্স নেম, লেট ময়না মিঞা, ডেট অব বার্থ…, তখন মেরি জয়েস চমকৃত হয়, কি সুন্দর একটা পোলা তুমি ছানমিঞা, বিজয় দিবসে তোমার জন্ম, কি চমঙ্কার একটা বিজয়, তখন টিচার্স কমেন্টসের ঘরে যায়া মেরি লেখে, হি ইজ এক্সসেপশনালি গুড়, হি ইজ আওয়ার হোপ! কিন্তু চানমিঞাকে হয়তো মামুন কিংবা লেদু কিংবা অন্য কেউ পোটলার পোলা বলে গাল দেয়, হয়তো একদিন স্কুলে চানমিঞার সঙ্গে কেউ একজন মাঞ্জা দেওয়া সুতা দিয়া ধিরি কাটাকাটি খেলে, হয়তো চানমিঞার সুতার টানে মামুন কিংবা লেদু কিংবা অভিজিৎ-এর ধিরি কেটে যায় এবং তখন ঝগড়াটা লাগে এবং চানমিঞাকে সে পোটলারপোলা বলে। সেইদিন বাসায় ফিরা সে দেখে যে, খৈমন ঘরে নাই, বান্দরেরা দেওয়ালের উপরে লাইন দিয়া বসে আছে, দাদা বান্দর, বাপ বান্দর, পোলা বান্দর, নাতি বান্দর, এবং অনেক বান্দরনিও, তাকে দেখে এই বান্দরের লাফঝাপ দেয়, কান্ধের উপরে এসে বসে, কিন্তু চানমিঞার মন খারাপ হয়া থাকে, মাঙ্কিবয় একরকম জিনিস, পোটলার পোলা অনারকম, এর মানে কি? তার জীবনে কি এইসব শেষ হবে না? হায় আল্লা! তখন হয়তো ঠাটারি বাজারে ঠোঙ্গা বেচা শেষ করে খৈমন পড়ন্ত বিকালে বাড়ি ফিরা দেখে যে, ঘর অন্ধকার, বান্দর বাহিনী দেওয়ালের উপরে গালে হাত দিয়া চুপ মাইরা আছে, তার মনে হয় যে, এত ভাল হয়া গেল এই বান্দরের বাচ্চা বান্দরগুলা, আশ্চর্য! তখন সে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখে, চানমিঞা অসময়ে চৌকির উপরে শোয়া, তারতো ভয় লেগে যায়, পরাণে পানি থাকে না, কিরে কি হইলো? সে কাছে যায়া পোলাকে উঠায়, কাপালের মাঝখানে চোপস করে একটা চুমা খায়া জিগাস করে, কি হইলো তর বাপ, আব্বা, শৈল ভালা লাগতাছে না? এবং তখন চানমিঞা যা বলে, তা শুনে, খৈমনের আক্কেলগুড়ুম হয়, ইচ্ছা হয় একটা চটকা লাগায়, লাঠি দিয়া মারে; চানমিঞা বলে, আমারে পোলাপান পোটলার পোলা কয় ক্যালা? এই কথা শুনে মোছা: খৈমন আর কি করবে, সে হয়তো নিজের কপালে নিজেই থাপ্পড় মারে, বেকুব হয়া বসে থাকে, কি বলবে সে? এই পোলা এক পাতা না গজাইতেই তার জন্মের বিষয়ে মাকে জেরা করে, কৈফিয়ত চায়, হায় খোদা; রাগে দুঃখে অপমানে তার চোখ ফেটে পানি আসে এবং সে বলে, যারা তরে পোটলার পোলা কয় হাগো থোতা ফাড়ায়া দে না কালা? আয়া ঘরের ভিতরে শুয়া থাকচ!

চানমিঞার সামনে তার মা মোছা: খৈমন একটা চ্যালেঞ্জ খাড়া করে দেয়, হয়তো স্কুলে তার ক্লাসের লিয়াকত হোসেনের সঙ্গে সে একদিন মারামারি করে-পোলাপানের মত বড় বান্দরবো আর হয় না-হয়তো কোন খেলা খেলতে যায়, কিংবা সি-সতে চড়া নিয়া ঝগড়ার পর লিয়াকত বলে, পোর্ট…, এবং চানমিঞা ভাবে যে, লিয়াকত হয়তো পোটলা বলে নাই, সে তার সঙ্গির সঙ্গে সি-স নিয়া ধপধাপর চালায়া যায়, পাশে খাড়ায়া থেকে লিয়াকত হয়তো তার দিকে তাকায়া বলে, পোটলা, এবং তখন, তারপরেও হয়তো চানমিঞা ভাবে যে, ঠিক আছে, এইটা কিছু না; কিন্তু লিয়াকত পোলাটাও বদ ছিল, সে তখন বলে, পোটলার পোলা, ফলে চানমিঞাকে কিছু করতেই হয়, তার মা বলেছিল হোতা ফাটায়া দিতে, এবং সে সি-স এর ভেঁকি থেকে নেমে লিয়াকতকে জাপটায়া ধরে, ধাক্কায় মাঠের এক কিনারায় নিয়া যায় মাটিতে ধূলার মধ্যে ফালায়া দেয়। সেইদিন স্কুলে চানমিঞা শাস্তি ভোগ করে, দারোয়ান রামদাস তাকে ধরে নিয়া যায় প্রিন্সিপালের সামনে হাজির করে এবং রোকেয়া আনোয়ার উঁচা টেবিলের পিছনে বসে তাকে জিগাস করে, লিয়াকতকে তুমি কেন মেরেছ?

চানমিঞা কি বলবে? সে মাথা নিচা করে খাড়ায়া থাকে এবং রোকেয়া আনোয়ার এই সহিংসতার জন্য তাকে শাস্তি দেয়, স্কুল ছুটি না হওয়া পর্যন্ত অফিস ঘরের এক কোনায় চানমিঞা খাড়া হয়া থাকে। এই খবর হয়তো মেরি ক্লার্কের কাছে যায়, তার হয়তো মন চায় গরিব পোলাটার জন্য কিছু করে, অফিস ঘরে যায়া হাত ধরে বের করে নিয়া আসে, কিন্তু তার ভয় হয়, রোকেয়া আনোয়ার যে জাদরেল মহিলা, সে তাকে বকাবকি করবে, মেরি তুমি এই রকম কর কেন, তুমি পোলাপান নষ্ট করতেছ; ফলে সে একে জিগাস করে, তাকে জিগাস করে, শেষে চানমিঞার স্ট্যান্ডার্ড টু এর টিচার রোজালিন ডি কস্তা তাকে ব্যাপারটা বুঝায়া বলে এবং মিসেস ক্লার্ক যারপর নাই বিভ্রাম্ভ হয়া পড়ে, হোয়াট ডাজ ইট মিন, পোটলার পোলা?

: সান অফ এ ব্যাগেজ, দ্যাটস হোয়াট ইট মিনস!

: বাট হোয়াই গুড় হি বি সান অফ এ ব্যাগেজ, ও মাই গড!

তখন, পরদিন কিংবা তারপর দিন, কিংবা তারও পর দিন মেরি হয়তো চানমিঞাকে খুঁজে বের করে বলে, লিয়াকতের সঙ্গে মারামারি করছ কেন, তুমি কি ছোট আছ? ছুটু সে নাই, ছুটুকাল হলে মেরির এই কথায় সে নির্ঘাত কানতো, কিন্তু এখন সে আসলেই বড় হয়া গেছে, কান্দার সুযোগ কম, ফলে মেরি জয়েন্স তার ডাইন হাতটা চানমিঞার কান্ধের উপরে যখন রাখে তখন চানমিঞার মনে হয় যে, দরজার কপাটের ফাঁক দিয়া আসা তেরছা আলোর মত, একটা আলোর শুম্ভ তার শীর্ণ কান্ধের উপরে এসে পড়ে, এবং সে তার মুখটা এই আলোর দিকে ফেরায়, সামনে খাড়ায়া থাকা মেরির মুখের দিকে দেখে; মেরি জয়েস বলে, কেন এইরকম করো, এ্যা, হোয়াই?

: আমাকে পোটলার পোলা বলছে!

: সেই জন্য মারবা ওকে?

খৈমন হয়তো ভেবেছিল, এত সইহ্য করা ভাল না, কেউ ইটা মারলে কখনো পাটকেলটা মারা ভাল, কিন্তু সব হিসাব আউলায়া যায়, স্কুলে লিয়াকতের সঙ্গে মারামারি করে শাস্তি ভোগের পর একসময় চানমিঞা স্কুল কামাই দিতে থাকে, ভূতের গল্লিতে মামুনের ছুটু ভাই মাহমুদকেও দুর্বল পায়া কি কারণে একদিন সে মারে, দুই চাইরটা কিল থাপ্পড় লাগায়, কিন্তু এর ফলে মাহমুদ এমন চিৎকার শুরু করে যে, মিসেস জোবেদা রহমানের পুরা পরিবার একজোট হয়া চানমিঞাকে ধরে, এবং পিটায় তার নাকলা ফাটায়া দেয়-খৈমন লাঠি নিয়া যায়া পোলাকে উদ্ধার করে আনে। তখন চানমিঞা আর স্কুলে যেতে চায় না, খৈমন রাগ করে, বকাবকি করে, কান্দে, কিন্তু চানমিঞার শরীরেতো ছিল ময়না মিঞার রক্ত, তাতে ছিল অলসতা, ফলে চানমিঞা লেখাপড়া নিয়া ক্লান্ত হয় যেতে থাকে, স্কুলের পোলাপানও তার পিছনে কাউয়ার মত লাগে, তার জীবন অতীষ্ঠ করে তোলে, সে খৈমনকে বলে যে, সে তার সঙ্গে ঠোঙ্গা বানাতে চায়, তোমার লগে আমি ঠোঙ্গা বানায়া বেচুম, পোলাপান আমারে মাকিবয় কয়, পোটলার পোলা কয়, স্কুলে যামু না আমি; এবং তখন শৈমন বোঝে যে, পোটলার ভিতর থেকে ছেলের এই জন্মের বিষয়টা ভাল হয় নাই, তার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়া যায়। তখন জোবেদা বেগম এবং তার পরিবারের দুষ্কর্মের কথা হয়তো বন্দরে শোনে, তারা হয়তো ভাবে, কি এত বড় কথা, একটা বাপ মরা এতিম পোলারে ব্যাকতে মিল্লা মাইরা ফাটাইলো? এবং এটা বান্দর-চানমিঞার প্রথম খেলার সাথি ছিল যে শিশু-বান্দরটা, হয়তো সেইটা-একদিন মামুনের মা মিসেস জোবেদা রহমানকে তাদের বাসার কুয়াতলায় দাঁত বের করে এমন একটা ভেটকি দেয় যে, জোবেদা বেগম। শ্যাওলা জমে পিছলা হয়া থাকা শানের উপরে হাড়িপাতিল থালাবাসুন নিয়া পড়ে যায়, তার মোটা কোমরের হাড্ডি ভাঙ্গে না, কিন্তু সে ভাল ব্যাথা পায়, আমার মাজা গেল, আমি শ্যাষ হয়া গেলাম, বান্দরেরা আমারে মাইরা ফালাইলো, বলে সে কান্দে, ফলে কোমরে আয়োডেক্সের মালিশ লাগায়, গরম সেক দিয়া, বিছানায় পড়ে থাকা লাগে অনেক দিন; তখন তার কিছু করার থাকে না, কারণ বান্দরের বিরুদ্ধে এই দেশে কিছু করার নাই, তাদের ধরতে পারার উপায় নাই-যদিও হয়তো বন্দুক দিয়া গুলি করা যায়—এতগুলা বান্দরকে গুলি করে মারাও মুশকিল। কিন্তু বান্দরের বিরুদ্ধে কি থানায় যায় নালিশ করা যায় না? পুলিশ কি এই বিষয়ে কিছু করতে পারে না? তখন জোবেদা বেগমের স্বামী গোলাম রহমান সূত্রাপুর থানায় গেলে দারোগা অভিযোগের বিবরণ শুনে বলে, খুব কঠিন কেস, এইগুলা জংলি বান্দর, কোন মালিক নাই, বেওয়ারিশ, পেনাল কোড অনুযায়ী পাবলিক নুইসেন্সের আওতায় ফেলানো খুব মুশকিল, তার থেইকা হাতের কাছে একটা লাঠি রাখতে বইলেন, তখন চানমিতো আর স্কুলে যায় না, মেরি জয়েস হয়তো অনেক কিছু ভাবে, এইরকমের একটা পোলার কত কিছু হতে পারে; পরে জুলি যখন মামুন এবং লেদুকে জিগাস করে যে, সে কোথায়? লেদুর মনে হয়, খৈমনতো জানবেই সে কোথায়, কারণ খৈমন হয়তো চানমিঞার মতিগতি দেখে হতাশ হয়া পড়ে, কিন্তু তার হয়তো এটাও মনে হয় যে, উপায় কি? মাইরা পিটায়া লাভ কি হবে, তার বাপ মরা এতিম পোলা, ঠিক আছে, তার রেশন কার্ড আছে দুই সেট, দিন চলে যাবে, ফলে সে হয়তো নুরানি বিলকিস উপমার বাড়িতে আসে এবং বানায়া বানায়া ফের আবোলতাবোল বলে, চানমিতে পড়তেই চায়, কিন্তু ভাইবা দেখলাম পড়ায় লাভ কি, আমরা গরিব মানুষ আফা, আমার লগে ঠোঙ্গা বানাইলে দুইজনে মিল্লা এই কাম করতে পারি।

নুরানি বিলকিস বলে, কর! আইজ কিছু লবি না?

: কি লম!

: তাল, তরকারি।

: না আফা, মনটা ভালা নাইকা, পোলাটা লেখাপড়া করলো না!

খৈমনের মন খুবই খারাপ হওয়ার কথা, কত চানমির অবস্থা তার বাপ ময়না মিঞার মতই খাড়ায়া যায়, সে শুয়ে বসে থেকে বান্দর নিয়া খেলা করে বড় হয়া ওঠে, তখন হয়তো বিশ্বব্যাংকের চাপের মুখে ঢাকা শহরের রেশন ব্যবস্থা এবং রেশনের দোকান সরকার একদিন উঠায়া দিলে খৈমনের দুই সেট রেশন কার্ড একদম বেকার হয়া যায়, বিছানার ভোশকের তলা থেকে মৈন তার মোট তেতাল্লিশটা কার্ড বের করে ছিঁড়া ফালায়া দিলে বাতাস সেগুলা উড়ায়া নিয়া যায়, খৈমন দেখে তার জীবনের শেষ ভরসা এলোমেলো হাওয়ায় ধূলার ভিতরে কেমন গড়ায়, এবং তখন সে বারান্দার কোনার খুপরি ঘরের ভিতর থেকে বহুদিনের পুরানো একটা বাঁশের টুকরি বের করে চানমিঞাকে বলে, ল পড়বি না যখুন, বাপের মত ঠাটারি বাজারে যায়া তরকারি বেচ গা, রাস্তায় রাস্তায় এই তরকারি এই তরকারি কয়া চিক্কার পাড় গা। চানমিঞার তখন হয়তো হুঁশ হয়, সে হবে তরকারিঅলা? অসম্ভব, কোনদিন না, তখন সে নায়াপল্টন যায়া শ্যাকাডেম ড্রাইভিং এন্ড ট্রেনিং ইন্সটিটিউট-এ ভর্তি হয়, হয়তো সে কোন আদম ব্যাপারির খপ্পরে পরে, আদম ব্যাপারি তাকে হয়তো বলে, ডেইরিটা শিখা ফালাও, তুমারে সৌদি আরবে সাপেকো কম্পানিতে চাকরি দিয়া পাঠায়া দিমুনে, জেদ্দা-মদিনা রুটে বাস চালাইবা; এবং চানমিঞা তার মাকে বলে, আম্মা আমার লাইগা টাকা যোগাড় কর, আমি ড্রাইভিং শিখা সৌদি আরব যামু।

খৈমন তখন অবশ্যই নুরানি বিলকিস উপমাকে বলে, চনিমিঞয়িতো আফা ডেরাইরি হিকা মিডিলইস্ট যাইতে চায়, এবং তার কথা শুন নুরানি বিলকিস বলে, টাকা লাগবো অনেক, পাবি কৈ?

: কইতে পারি না কৈ পামু!

চনিমিঞা যখন ম্যাকাডেম ড্রাইভিং এন্ড ট্রেনিং ইন্সটিটিউট-এ ভর্তি হয়, সে যে রঙ কানা তা জানার আরেকটা সুযোগ আসে তার, কিন্তু মানুষের আবিবেচনা, দুনীতি এবং দ্বায়িত্বহীনতার জন্য এইটাও হাতছাড়া হয়; ট্রেনিং ইনস্টিটিটিউটের মালিক কাম ইন্সট্রাক্টার, রহমান/দত্ত কিংবা গোমেজ, ষাইট দশকের মডেলের একটা নিসান ডাটসান গাড়িতে এল-প্লেট লাগায়া মতিঝিল কলোনির ভিতরের রাস্তায় এবং মাঠে চানমিঞাকে গাড়ি চালান শেখায়, পিছনের সিটে সৌদি আরব কিংবা দুবাই কিংবা কুয়েত গমন প্রত্যাশী আরো তিনজন বসে অপেক্ষা করে, তখন রহমান অথবা দত্ত অথবা গোমেজ-হয়তো রহমানই—ফেকচার দেয়, এইটা বাম্পার, এইটা বনেট, এইটা বুট; দেখেন পায়ের সামনে তিনটা পেডেল, পাও দিয়া চাপ দেন, ডাইনেরটা এসকালেটর, বামেরটা কেলচি, মইদ্দেরটা বেরেক, যখন গাড়ি চালাইবেন দূরে রাস্তার দিকে তাকাইবেন, বনেটের উপরে তাকায়া থাকবেন না। সে তখন তার অফিস ঘরে বসে থিওরিটিক্যাল জিনিস শেখায়, দেওয়ালের গায়ে লোহার পেরেকের সঙ্গে ঝুলান চার্টের দিকে তাকায়া বলে, দেখেন খেয়াল করেন, ডাইন দিকে মুখ করা একটা কা রঙ্গের এ্যারো, তার উপরে লাল রঙ্গের প্যাট কাটা একটা সার্কেল, মানে কি? মানে হইলো ডাইনে মোড় নিতে পারবেন না; তারপর সে তিন রঙের সিগনাল বাত্তির ছবিসহ একটা প্লাকার্ড ঝুলিয়া দিয়া টুলের উপরে চানমিঞাকে বসায়া যখন বলে, কয়টা বাত্তি দেখেন? চানমিঞা বলে, তিনটা।

: উপরেরটা জ্বললে কি করবেন? এইটা কি?

: ছাই রঙ, গাড়ি থামুমু।

রহমান বিভ্রাপ্ত বোধ করে, সে বলে, মইন্দেরটা জ্বললে? এইটা কি রঙ?

: সোলো করুম, এইটা হইলদা।

: নিচেরটা?

: এইটা ছাই রঙ, নিচেরটা জ্বললে চালামু।

: যুদি বাত্তি কাইত করা থাকে?

: এইগুলা আমি জানি, বামেরটা জ্বললে খমামু, ডাইনেরটা জ্বললে চালামু।

চানমিঞা উপর-নিচ, ডাইন-বাম করে তার বিদ্যার্জন শেষ করে, রহমান বোঝে যে, ভোদাইটা রঙকানা, কিন্তু সে তা চেপে যায়; কারণ এর কোন সমাধান নাই এবং রঙচেনে না বললে, বিআরটিএ-এর কাছ থেকে লাইসেন্স পাওয়ার উপায় নাই। তখন চানমিঞাকে ধৈমন তার কষ্টে গড়া সঞ্চয় ভাঙ্গায় আড়াই হাজার টাকা যোগাড় করে দেয়, এবং রহমান ঘুষ দিয়া এনে দেয় লাইসেন্স; ফলে চানমিঞার আর জানাই হয় না যে, সে দুইটালিক রঙই দেখে না। খৈমন হয়তো নুরানি বিলকি উপমার বাড়িতে মায়া কান্দাকাটি করে, অখনে কি করি কনতো আফা, আমি অখনে পঞ্চাইশষাইট হাজার টাকা কৈ পাই, কেমনে পাঠাই সৌদি আরব?

নুরানি বিলকিস চুপ করেই থাকে, খৈমনের এই সব নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যার সমাধান তার জানা নাই, সে কোন টাকা পয়সা দিতে পারবে না, সে খৈমনের দিকে তাকায়া আনমনা হয়া থাকার ভান করে, যেন সে বাংলা ভাষাই বোঝে না, কিন্তু খৈমন যখন আর কথা বাড়ায় না, তখন সে বলে, দিনকাল যা পড়ছে তরে কি কমু!

: কি যে করুম বুজি না কিছু বাপ মরা পোলাটা!

কামে লাগায়াদে, ক পরে টাকা যোগাড় কইরা দিবি।

: পরে দিমু কইখন?

নুরানি রিলকিসের উদ্দেশ্যই ছিল খৈমনকে বিভ্রান্ত করা, অন্য আলোচনার ভিতরে নিয়া যাওয়া, যাতে করে সে না বলে, আমারে কিছু টাকা দেন আফা, এবং আশ্চর্য খৈমন টাকা চায় না, কি হইলো, তার, সে কি বদলায়া গেল? উপমা বেগম বলে যে, কাজে লাগায়া দিলে চানমিঞা হয়তো সৌদি আরব যাওয়ার কথা ভুলেই যাবে, অথবা নিজে কামাই করে নিজের টাকাতেই যেতে পারবে, কে বলতে পারে; ফলে, চানমিঞাকে বাস্ত বতা মেনে নিতে হয়, রেশনের চাল বেচা সঞ্চয় থেকে পঞ্চাইশ/মাইট হাজার টাকা দেওয়া খৈমনের পক্ষে সম্ভব হয় না, হয়তো সে দিতেও চায় না-একমাত্র পোলা তার, সে গেলে গা খৈমন বাঁচবে কি নিয়া–এবং সে তাকে কলতাবাজার ফুড ডিপার্টমেন্টের সাইলোর পিছনে একটা মোটর গেরেজে নিয়া যায় কাজে লাগায়া দেয়, গেরেজের নাম দি কারোম মোটর গেরেজ লিঃ, এবং দেখা যায় যে, কামে আগ্রহ না জন্মালেও মোটর গাড়ির ব্যাপারে তার ঝোক বাড়ে, সে মৃত না ভাঙ্গা গাড়ি রিপিয়ার করে, তার চাইতে বেশি গাড়ি চালায়া ট্রায়াল দেয়, তখন একদিন একটা অচল গাড়ি-হয়তো একটা হোন্ডা সিভিক-কেউ ঠেইলা এনে গেরেজে ঢুকায়, গাড়ির হয়তো বিরাট কিছুই হয় নাই, তার ওস্তাদ তাকে বলে, পেলাগে কালি জমছে নিহি দেখ, তখন চানমিঞা বনেট উঠায়া কাপড় দিয়া মুছে প্লগের কার্বন পরিষ্কার করে, তারপর গাড়ির দরজা খুলে স্টার্ট দেয় এবং ব্যাক গিয়ারে গেরেজের গেট দিয়া বের হয়া যায়। তারপরে তার আর দেখা নাই, ওস্তাদ বলে, ইকটু ট্রায়াল দেয়; কিন্তু কতক্ষণ, একটা প্লাগের কালি পরিষ্কার করে কত ট্রায়াল দেওয়া লাগে? গাড়ির মালিক চেহারা গম্ভীর করে ফালায়, গেরেজের মালিকের কানাপট্টি রাগে লাল হয়া আসে–চানমিঞার পাত্তা নাই! তখন আধঘন্টা কিংবা এক ঘন্টা পর সে একটা পঙ্খিরাজের মত গাড়িটা চালায়া এনে ঘ্যাচ করে থামায়, এবং গেরেজের মালিক তাকে জুতা দিয়া মারে—শুয়ারের বাচ্চা তুই গাড়ি লয়া হাওয়া হয়া গেলি-জুতার বাড়ি খাওয়ার পর সে তার ওস্তাদকে বলে যে, গাড়িটা এমন উইড়া গেল বুঝতেই পারে নাই কোনখান দিয়া কোনখানে চলে গেল সে! তখন গেরেজের এইসব কাজকারবারের কথা ভূতের গল্লিতে খৈমন শোনে, তার মুখ কালা হয়া থাকে, কি করবে সে এই পোলা নিয়া? সৌদি আরব যেতে দিল না, কিন্তু এইখানে গেরেজের মালিক তাকে জুতা দিয়া মারে, তার আদরের পোলা, এতিম বাচ্চা, তার গায়ে হাত উড়ায়; সে বলে, তরে লয়া আমি অখনে কি করি তুই ক! কিন্তু চানমিঞার জীবন বসে থাকে না, সে একদিন বলে যে, সে পার্টনারের সঙ্গে পরান গাড়ির ব্যবসা করবে এবং দুখন তার মার মাথায়। আকাশ ভেঙ্গে পড়ে, কয় কি পোলা? টাকা পাইব কৈ? ফলে নুরানি বিলকিস উপমা বেগুন কিংবা বিলাতি কুমড়ার এক বাটি সালুন দিয়া খৈমনকে বিদায় করে, কিন্তু চানমিঞার পাত্তাই পাওয়া যায় না, নুরানি বিলকিসের দেওয়া সালুন এখন বন্দরেরা খায়; ভূতের গল্লির ৩৬নম্বর বাড়িতে বান্দরের তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে, তারা তাক থেকে হাড়ি নামায়া খৈমনের রান্দা ভাত খায়া যায়, খৈমন উপমা বেগমের দেওয়া তরকারি এনে রাখে, ঘরের ভিতরে বন্দিরের পাল ঢুকে ফ্লোরের উপরে তরকারি ফালায়া নষ্ট করে। মৈন যখন নুরানি বিলকিসকে বলে, আফা ঘরে ভাত তরকারি কিছুই রাখতে পারি না বান্দরের জ্বালায়, তখন ভূতের গল্লির বান্দর তার ভাত তরকারি খায়া এইভাবে মোটাতাজা হয়, এবং মামুনুল হাইয়ের মা/বাপ যখন সূত্রাপুর থানার দারোগার কাছে মহল্লায় বান্দরবাহিনী গঠনের অভিযোগ করে, তখন তারা কি খুব বেশি বাড়ায়া বলে? তেল, নুন কিংবা চিনি ধার করার অবসরে খৈমনই কি এইসব কথা নুরানি বিলকিস উপমাকে বারে বারে বলে নাই-চানমিঞা বড় হয়া গেলে কি হবে, বান্দরভো চানমির পাছ ছাড়ে না, হয় খোদা এই জঙ্গুলী এই পালাটার ভিতরে কি দেখলো চানমিঞা বড় হয়া যাওয়ার পর যদিও খৈমন ঘরের দরজায় ডবল তালা লাগায়, শিকল তুলে দিয়া একটা তিন লিভারের দেশি তালা, লোহার কড়ার সঙ্গে কালা রঙের একটা গ্লোব মার্কা চিনা প্যাডলক, কিন্তু বান্দরদের আটকাইতে পারার কি কোন উপায় আছে? মনে হয় না, কারণ চানমিঞা জানালার একটা শিক বান্দরদের জন্য ভেঙ্গে রেখে দেয়, বন্দিরেরা সেইখান দিয়া আসা যাওয়া করে, ভিতরে ঢুকে বসে থাকে, খৈমন আর কি বলবে?-বাপ মরা পোল তারা এখন অতিবুড়া বান্দর, বুড়া বান্দর, অল্পবুড়া বান্দর, প্রৌঢ় বান্দর, ইত্যাদি থেকে পিচ্চি কোলে ঝোলা সব বান্দর মহল্লায় তাদের দিনের কাজকাম শেষ করে খৈমনের ঘরের মধ্যে এসে বিকাল বেলা আড় জমায়, বসে থাকে চানমিঞা কখন আসে এই আশায়, এবং খৈমন নুরানি বিলকিসকে বলে, ঘরে ঢুইকা দেখি বান্দরের দল কাউমাউ করে, আমারে দেইখা দাঁত বাইর কইরা ভেটকি দেয়, চিন্তা করেন; ফলে বান্দরের ভয়ে কুয়তিলায় জোবেদা বেগম পড়ে যাওয়ার পর, যখন সূত্রাপুর থানার দারোগা বলে, জঙ্গলের জানোয়ারের বিরুদ্ধে কি ব্যাবস্থা নেব, বলেন? তখন জোবেদা বেগমের স্বামী গোলাম রহমান কথা খুঁজে পায় না, তার মনে হয় যে, বলে কি লোকটা? আশ্চর্য, কারণ এই বান্দরতো শুধু বান্দর থাকে নাই, এইগুলা লাই পায় নষ্ট হয়া যাওয়া মহল্লার বন্দর, এইগুলা জংলি বন্দির না, এবং এই বান্দরদের লাই দেয় কে তা দেশের সকলেই কি জানে না? তখন একদিন গোলাম রহমান সিড়ি দিয়া ছাদে যায় দেখে যে, তাদের ছাদ বান্দরের ও দিয়া ভরা, সে যখন জোবেদা বেগকে বলে, মহল্লার সব বান্দর দেখি আমাগো ছাদের উপরে আয়া হাগে, তখন জোবেদা বেগম ধুম মেরে থাকে, খৈমন সারাটা জীবন তার সঙ্গে দুশমনি করলো, ফকিন্নির মাইয়া ফকিন্নি, এবং গোলাম রহমান আবার নারিন্দা ফঁাড়ি কিংবা সূত্রাপুর থানায় যায়, এবং দারোগা সবকিছু শুনে বলে, বান্দরেরতো পায়খানা করা লাগবে তাই না? গোলাম রহমান আর কি বলবে? বান্দরের হাগা লাগবে বলে কি কেবল তাদের বাসার ছাদের উপরে এসে এই কাজ করবে, হেগে গুয়ের পাহাড় বানাবে! এই সবকিছুর কি সমাধান নাই? বান্দরকে কিছু বলতে না পারেন বান্দরের গডফাদারকে কিংবা গডমাদারকে বলেন, সকলে জানে ভূতের গল্লিতে বান্দরের গডফাদার হচ্ছে চানমিঞা, তাকে ধরেন, মারেন, কাটেন; কিন্তু দারোগা হাসে, সে বলে, বন্দির পুরান ঢাকার একটা ঐতিহ্য, বান্দরের আবার গড ফাদার কি, ওরে ধরলে হয়তো বান্দরেরা ম্যাজিস্ট্রেট কোটে যায়া ধরনা দেবে, তাতে মহামান্য আদালত এম্ৰাসড হবে, পত্রিকায় ছবি উঠবে এবং আমি খামাখা ক্লোজ হয়া যাব! ফলে মিসেস জোবেদা রহমানের জীবনে নতুন উৎপাত শুরু হয়, একদিন সকালে কিংবা বিকালে এক লোক এসে বলে যে, তার নাম মামুন, সে চট্টগ্রাম থেকে এসেছে; আমি চট্টগ্রাম তেকে আইসি, সে বলে, আমি এই বাসার চেলে, আমার নাম মামুন, আমি হারাই গেইলাম দেরি, এবং তখন জোবেদা বেগমের পুরান ভয় ফিরা আসে, তার মনে হয় যে, এসব খৈমনেরই কাজ। কিন্তু খৈমনতো তখন চানমিঞাকে নিয়াই ব্যস্ত হয়া থাকে, তার আফসোস হয়, চানমিঞাকে কেন যে সে ড্রাইভারি শিখতে দিল, যখন তার বিদেশ যাওয়ার টাকাই নাই; ফলে চানমিঞা বান্দরের পরে চিনলো অন্য মানুষের গাড়ি। দি কার হোম মোটর গেরেজ লিঃ-এর মালিক তাকে একদিন জুতা দিয়া পিটালেও তার লজ্জা হয় না, সে গাড়ি চালানোর লোভে গেরেজের চাকরিতে লেগে থাকে, কালিঝুলি মেখে গাড়ি রিপিয়ার করে আর ট্রায়াল দেয়, তখন হয়তো লক্ষ্মীবাজারেই, হয়তো বাহাদুরশাহ পার্কের গোল চক্করের পাশেই সে দেখে যে, আর একটা হোন্ডা সিভিক পার্ক করা আছে-হয়তো এইটা সেই গাড়িটাই যেটার জন্য তার মালিক তাকে জুতা মেরেছিল-তখন চানমিঞা একটা লোহার গুনা ঢুকায় দরজার লক খুলে গাড়ি নিয়া হাওয়া হয়া যায়। ত্রিশ/চল্লিশ মিনিট কিংবা একঘন্টা পর ফিরা সে গাড়িটা পার্কের গোল চক্করের কাছেই রেখে ভাগোয়াট হয়, তখন গাড়ির মালিক হয়তো ফিরা এসে দেখে যে, সে গাড়িটা যেখানে রেখেছিল এখন হয়তো সেটী সেখানে নাই, তবু তার কিছু সন্দেহ হয় না, তার মনে হয় যে, ঠিকই আছে, মানুষের কি সব সময় সব কিছু মনে থাকে? তখন চানমিঞার আর গেরেজ্জের কাজ ভাল লাগে না, কারণ ট্রায়াল দেওয়ার জন্য গাড়ির অভাব তার আর থাকে না, এবং সে গেরেজের মালিককে একদিন যায় বলে, আপনে আমারে জুতা দিয়া মারছেন, আমার বাপ নাই, আমি একটা এতিম পোলা, আমি আর আপনের কাম করুম না, এবং হয়তো বাহাদুরশাহ পার্ক, লক্ষ্মীবাজার কিংবা পুলিশ ক্লাবের সামনে নবাবপুর রোডের উপরে পার্ক করা একটা সাদা রঙের টয়োটা মার্ক টু গাড়ি তার নজরে পড়ে, সে গাড়িটা নিয়া উধাও হয়, আমিনবাজার দিয়া যায়, সাভার পর হয়া জাতীয় স্মৃতিসৌধ দেখে আসে, হয়তো স্মৃতিসৌধে সে ফুলও দেয়, তার মনে হয় যে, খুবই চমৎকার জিনিসটা, কিন্তু ৩/৪ ঘন্টা পর ফিরা এসে রায়সা বাজারের কাছাকাছি গাড়ি ফালায়া দিতে গেলে সে দোলাইখালের মোড়ের পুলিশের নজরে পড়ে; গাড়ির লক পুশ করে দিয়া ঘটাং করে দরজা লাগায়া ঘুরতেই সে দেখে এক পুলিশ তার সামনে খাড়ায়া, লোকটা বলে, আমার নাম সার্জেন্ট রফিক, কার গাড়ি এইটা?

চানমিঞার কিছু বলার থাকে না, কিন্তু সার্জেন্ট ধুরন্ধর প্রাণী, চানমিঞার সঙ্গে কথা বলে সে অবাক হয়, এইটা কোনখানকার চিড়িয়া, সে ভাবে এবং বলে, এই কমি যখন কই গাড়ি ফালায়া দিয়া যাও কেন? ধরা খাইলেতো বাবা না তুমিতো ধরা পড়ছো, এখনতো জেলে যাই-অফেন্স এগেনস্ট প্রপাটি, থেফট, পেনাল কোডের ধারা ৩৭৮; শাস্তির ধারা ৩৭৯, তিন বছরের জেল অথবা জরিমানা অথবা উভয়, তোমারতো উভয়ই হবে!

তখন সার্জেন্ট রফিকের এই পোলাটার জন্য মায়া হয়, সে তার কান্ধের উপরে একটা হাত রাখে এবং সেদিন চানমিক্স টয়োটা মার্ক টু গাড়িটার দরজা পুনরায় লোহার তার ঢুকায়া খুলে লম্বা ট্রিপ মেরে টঙ্গি যায়, গাজিপুর চৌরাস্তার পিছনে বসুমতি মোটর গেরেজ-এর মালিক আরফান আলির কাছে গাড়ি এবং রফিক সার্জেন্টের লেখা একটা চিরকুট পৌছায়া দিলে, আরফান আলি তাকে বলে, বিক্রি হইলে তুমি পঞ্চাইশ পাইব।

: পঞ্চাইশ কি?

: হাজার।

চানমিক্সা গাড়ি চোরে পরিণত হয় এবং সে তার মাকে যখন বলে যে, সে পুরান গাড়ির কারবার করবে, খৈমনেরতো ঘুম ছুটে যায়, সে নুরানি বিলকিন্স উপমাকে ইনিয়াবিয়া সব বলে, তার পোলা চানমিঞার যোগ্যতা কিন্তু ছিল, চাইলে সে জীবনে ভাল করতেই পারতো, সেকি ভাল ছাত্র ছিল না? পূর্ণলক্ষ্মী কি তার সাক্ষী নাই? গেরেজের কামেও সে ভাল ছিল, রোকনপুর যায়া জিগান, দেখেন কেমুন ভাল মেকেনিক সে হয়া গেছিল গা, এবং তখনই তার মাথায় পুরান গাড়ির ব্যবসা করার বুদ্ধিটা আসে! তখন উপমা বেগমের মুখের দিকে তাকায়া খৈমন বলে, চানমিঞায় পুরান গাড়ির ব্যাবসা করবার চায়।

নুরানি বিলকিস বোঝোই না ব্যাপারটা কি, তার স্বামী ফজলুর রহমান রেশন দোকান উঠে যাওয়ার পর এখন শ্যাম বাজারে চালের আড়তদারি করে, সে বলে, এইটা কি বাবসা?

খৈমনও হয়তো বোঝে না, সে বলে, গাড়ি কিনব, বেচব!

: ট্যাকা পাইবো কৈ?

: গেরেজের মালিকের লগে পাটনারি ব্যবসা করব।

নুরানি বিলকিসের হয়তো পুনরায় অস্বস্তি হয়, ফলে তখন মামুনুল হাই এবং ফখরুল আলম লেদু নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে যায় দেখে, রবার্ট খুব অসুস্থ, তার বুকে ব্যথা আর কাশি, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য মিসেস ক্লার্ক এবং জুলির কান্ধে ভর দিয়া সে সিঁড়ি বায়া নিচে নামে, তখন বিষয়টা একটা সুযোগ হয়া দেখা দেয় এবং মামুন এবং লেদু হাত লাগায়-জুলিতে মন গলে না, টলে না, যদি তার বাপের সেবা করে মামুনের কিছু হয়। তখন জুলি মামুনের দিকে তেরছা করে তাকায়া থাকে, মামুন ভাবে, কেন তাকাও খামাখা? হয়তো তারপর আবার তাদের দেখা হয়, রবার্টের অসুখটা হয়তো কঠিন কিছু না, হয়তো ঠাণ্ডার কারণে তার এই সমস্যা, হয়তো পুরুসির ভাব, তখন মামুন জুলিকে বলে, বাপের যত্ন নেও না কেন?

: আর কত যত্ন নিব, বিয়া হলেতো চলেই যাব।

: কবে বিয়া করতাছ?

জুলির বিয়া নিয়া হয়তো তার মা/বাপ ভাবে, মেয়ে তাদের বড় হয়া গেছে, মেয়ে বড় হয়া গেলে বিয়া দেওয়াই নিয়ম, হয়তো বিষয়টা নিয়া জুলিও চিন্তা করে, কিংবা জুলি হয়তো ভাবে না, জুলির বিয়া দেবে এইদেশে ছেলে কোথায়? তখন মামুনুল হাই তাকে একদিন বলে, তুমি কি বাংলা বই পড়, নাকি শুধু মাউন্ট্রাপ?

: কালের যাত্রার ধ্বনি.. পড়ছো?

: মনে হয়।

: তোমার জন্মদিনে কি তোমাকে একটা বই দিতে পারি।

: দিয়েন, কিন্তু ভিতরে কিছু লিখেন না।

মামুন বোঝে কি ভয়ানক সেয়ানা এই মাইয়া এবং ২১শে সেপ্টেম্বরে তারা দুইজন-মামুন এবং লেদু-জুলির জন্য দুইটা বই কিনা নিয়া আসে, মামুনের ভীষণ সাধ হয় বইয়ের প্রথম পাতায় সে লেখে, প্রিয়তমা জুলিকে, অথবা, আমার স্বপ্নের জুলিকে; অথবা, প্রিয় জুলিকে ভালবাসাসহ, কিন্তু তার সব আকাক্ষা অপূর্ণ থাকে; সে বলে, তোমার জন্মদিনে কোন অনুষ্ঠান নাই?

: ড্যাডের শরীর ভাল না, এল্ড আই এম অলরেডি এনি ওল্ড ওম্যান, আর কত!

: তুমি কি জান লেদু কি করতাছে?

তখন জুলি কৌতুহলি হয়, না জানি না, কি করতেছে?

: লেদু প্রেম করতাছে, শেলি আপার সঙ্গে।

: গ্রেট, অপনে করতেছেন না?

মামুন খুবই বিষণ্ণ হয়া পড়ে, এ কেমুন মাতারি, নিমজ্জমান এক অসহায় মানুষকে নিয়া খেলে! তার কি দরকার এইরকম একটা প্রশ্ন করার? যাহোক, মামুন বলে যে, তার ইচ্ছা আছে!

জুলি বলে, আমার মাঙ্কিবয়কে দেখতে খুব মন চায়।

ফলে ফখ আলম লেদু যখন চানমিঞার সঙ্গে দেখা করে, তখন সে মহল্লায় গাড়ি নিয়া আসতে শুরু করেছে, তার কারবার দেখে ভূতের গন্নির লোকেরা হা হয়া থাকে, তাজ্জব বনে যায়, এবং জোবেদা বেগম ভাবে এইটা কি সম্ভব? এইটা কি তরকারি বেচইনা ময়না মিঞার পোলা না? এইটা কি ঠোঙ্গা বানায়া জীবন চালানো খৈমনের পোল না? তারতোবৈল গাড়ি চালানোর কথা, সে কিনা মহল্লায় মোটর গাড়ি নিয়া আসে! তখন একদিন মন্দিরের সামনে সাদা, নীল কিংবা কালা রঙ্গের একটা প্রোটন সাগা কিংবা বিরা সিডান কাঁরের ছাদের উপরে তিনটা বান্দর নিয়া গাড়ির দরজা খুলে রেখে চানমিঞা খাড়ায়া খাড়ায়া বন্দরের সঙ্গে কলা খায় এবং তখন লেদু এসে তাকে বলে, কি ব্যবসা করছ তুই?

: গাড়ির ব্যবসা!

: গাড়ির কি ব্যবসা?

: গাড়ি কিনি, বেচি।

: কি কচ!

: হঁ, কলা খা।

০৭. লেদু প্রশ্ন করা বাদ দিয়া কলা খায়া খুশি হয়

লেদু প্রশ্ন করা বাদ দিয়া কলা খায়া খুশি হয় এবং সে যখন জুলি ফ্লোরেন্সের কথা চানমিঞাকে বলে, মেরি টিচারের মাইয়া জুলি তর কথা জিগাস করে, তখন কি চানমিঞার মনের জানালায় তার শৈশব এসে খাড়ায়? অবাস্তব এক শিশুকালের জীবন ছিল তার, খডের কাকতাড়ুয়া পুতুলের মত ছিল ভেঙ্গে পড়ার, বাতাসে উড়ায়া নিয়া যাওয়ার শঙ্কা এবং ভয়—তখন তার কি অতীতের কুয়াশার ভিতর থেকে জুলিকে মনে পড়ে? সে লেদুর কথা শুনে বলে, কি জিগায়? ফলে বোঝা যায় যে, জুলিকে তার মনে আছে; কিন্তু তখন লেদু কি বলবে? জুলি বলেছিল, মাঙ্কিবয় কোথায়? কিন্তু লেদুতে আর চানমিঞার মুখের উপরে তা বলতে পারে না, মোটা হলেও তারতো বিবেচনাবোধ অনেক এবং সেই কারণেই হয়তো তাদের পাশের বাসার শেপালি আপা তাকে একদিন ডেকে বলে, দেখতো লেদু বন্দরে আমার বডিসটা ছাদের উপরে নিয়া গেছে নিকি, শেপালিদের ১৮নম্বর বাড়ির একতলা দালানের ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি ছিল না, তখন লেদু আর কি করে, সে তার ভারি শরীর নিয়া দালানের দেওয়াল বায়া ছাদে উঠে দেখে যে ঠিকই একটা সাদা রঙের ব্রা ছাদের এক কিনারে পড়ে আছে। লেদু হয়তো ছাদে উঠে ক্লান্ত হয়া পড়ে, সে শেপালির ব্রাটা তার প্যান্টের পকেটে রেখে কিছুক্ষণ জিরায়, এদিকে শেপালি নিচে খাড়ায়া উপর দিকে হা করে থাকে, অনেক্ষণ যায় লেদুর কোন সাড়া শব্দ নাই, সে চোখ কুঁচকায়া ফালায়, কি করে ভোন্দা বদমাইশটা এবং তখন সে তার নাম ধরে ডাকে, লেদু, এই লেদু, কৈ গেলি তুই? তখন লেদু আবার ইটা বের হয়া যাওয়া দেওয়াল বায়া নেমে আসে, শেলি তার ব্রাটা নেয়, এবং বলে, কি করলি এতক্ষণ? লেদু বলে যে, সে কিছুই করে নাই, কিন্তু শেপালি মাইয়া মানুষ। সে এই কথা মানবে কেন, তারতো মনে সন্দেহ, সে বলে, বয়া বুয়া এইটা শুছচ, বদমাইশ! কিন্তু লেদু এইকাজ করে নাই, এইটা তার মাথায় আসে নাই, সে বলে, এইসব কাম আমি করি না, এবং শেপালি তখন উল্টা ক্ষেপে, সে সদ্য বিবাহিতা সুন্দরী মাইয়ালোক, প্রোষিতভর্তৃকা, তার জামাই আব্দুর রহমান তাকে বিয়া করার একমাস পর কাতার চলে যায়, এখন সে ক্যাসেটে ইনায়াবিয়া কথা টেপ করে বৌয়ের কাছে পাঠায়-কেমন আছ তুমি, অনেকদিন তুমার চিঠিপত্র কিছু পাই না—এবং তখন বান্দর ব্রা নিয়া গেলে শেপালি যখন লেদুকে দেখে, সে ভাবে যে, এই মোটকাটারে খাটাই; কিন্তু লেদুর কথা শুনে সে বলে, এইসব কাম করছ না, কি করচ, আহারে ফেরেস্তা! লেদু তখন কি বলবে? সে কিছু বলে না, এবং তারপর একদিন শেপালি লেদুকে ডাকে, তাদের বাড়ির ভিতরে ছিল একটা গয়াম গাছ, গাছটার ডাল ছাতির মত বেঁকা হয়া ঝুলে ছিল নিচের দিকে, তখন একটা ডালে একদিন একটা পাকা গয়াম দেখা যায় এবং দেওয়ালের উপর দিয়া শেপালি লেদুকে দেখে এবং বলে, এই লেদু গয়ামটা পাইড়া দিয়া তো। লেদু লম্বাচওড়া পোলা, কি তারপরেও দেখা যায় যে, গয়ামের ডালটা তার নাগালের ভিতরে না, সে লাফ দিয়াও ধরতে পারে না, তখন শেপালি বলে, আমারে উঁচা কইরা ধর আমি পাড়ি এবং লেদু নিচা হয়া তার হাঁটুর কাছে চেপে ধরে তাকে উঁচা করে, লেদুর মুখটা শেপালির গোল পুরু নিতম্বের উপরে চেপে বসে থাকে। শেপালি সেদিন একটা ডাল টেনে নামায়া গয়ামটা বোঁটা থেকে ছিঁড়া নেয়, তারপর তার নামা দরকার, কিন্তু মনে হয় যেন, লেদু তাকে ছেড়ে দিতে ভুলে যায়, তখন শেলি বলে, কিরে ছাড়স না ক্যাল? এবং তখন লেদু তাকে মাটিতে নামীয়া দেয়। আরেক দিন আরেকটা ডালে আরেকটা গয়াম পাকে এবং শেপালি তাদের বাসার মানুষজনের চোখ ফাকি দিয়া গায়মি পাড়ার জন্য লেটুকে ডাকে, পাইড়া দিয়া যাতে গায়ামটা; গাছের এই ডালটা হয়তো বেশি উঁচা ছিল না, নাগালের কাছেই ছিল, কিন্তু দেখা যায় যে, লেদু ধরেও ভালটা ধরতে পারে না, হয়তো লাফ দিলেই সে ধরতে পারবে, কিন্তু তার পায়ে ব্যথা হওয়ায় সে লাফও দিতে পারে না, তখন শেপলিকেই উঁচা করে ধরা লাগে, এইবার লেদু তাকে সামনে থেকে হাঁটুর নিচে চেপে ধরে উঠায়, শেপালির দুই উরুর মাঝখানে সে তার মুখ কাইত করে রাখে; তখন সে হয়তো প্রতিদিন শেপালিদের গয়াম পাড়ার প্রতীক্ষায় থাকে, এবং একদিন দেখে যে, গাছে একটা গয়াম পেকে ঝুলে আছে, কিন্তু শেপালি আপাতো তাকে ডাকে না, পাকনা গয়াম রাইতের বেলা বাদুড়ে খায়া যায়, হয়তো আন্দরেও খায় দিনে, তারপর আরো একটা পাকে, আরো একটা, কিন্তু শেপালির খবর নাই। তখন লেদু শেপালিদের বাড়িতে যায় তার মাকে বলে, খালাম্মা শেলি আশায় কৈ, এবং তখন শেলির মা তাকে বলে, শেপালিতো ওর হৌরের বাইতে গেছে, অয়তো কাতার যাইব গা; এই গয়াম পাড়ার গল্প লেদু হয়তো মামুনকে বলে, এবং মামুন জিগাস করে, আর কি করহচ? কিন্তু লেদুতে আর কিছু করে নাই, কারণ সে মোটকা পোলা, তার বিবেচনাবোধ বেশি, সে জন্যই শেলি তাকে নিয়া এইসব করে, ভাবে যে, ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা নাই এবং একদিন সে মহাআনন্দের সঙ্গে শশুর বাড়ি চলে যায়। তাই মোটকা লেদুর বিবেচনাবোধ বেশি হতে পারে, সে ভাল পোলাই, যদিও শেপালির উরু এবং নিতম্বে মুখ ঘষার জন্য তার মন কিছুদিন আকুপাকু করে, কিন্তু শেপালির সঙ্গে তার আর দেখাই হয় না, তবুও সে চানমিঞাকে বলে যে, জুলি হয়তো এমনি তার কথা জিগাস করে, ছুটুকালের কথা হয়তো মনে পড়ে, ভাই জিগায়!

: খামাখা!

: ক্যালা?

: আমারে কয় মাঙ্কিবয়!

ফখরুল আলম লেদু তখন মানব জীবনের গভীর তাৎপর্য অনুধাবন করার চেষ্টা করে, বস্তুত স্মৃতির বাইরে মানুষের জীবন নাই, স্মৃতি তাকে বাচায় এবং মারে, সে চানমিঞাকে দেখে এবং নারীশিক্ষা মন্দিরের গলিতে সূর্য ডুবে যেতে থাকলে জুলি ফ্লোরেন্স সুইচ টিপা টিউব লাইট জ্বালায়া তার মার জন্য স্টিভ আর্নল্ডের আনা মাদাম বোভারি পড়ে-এই লোকটা তার মার জন্য এমন একটা বই আনলো। সে তার মাকে জিগাস করে, মা তুমি ড্যাভের বসের আনা বইটা পড়ছো?

মিসেস ক্লার্ক পড়ে নাই, স্কুলের পরীক্ষার খাতা নিয়াই সে ব্যস্ত হয়া আছে, সে বলে, পড়ি নাই, কেন?

: মাদাম বোভারিটা পইড়ো।

: কেন?

: ইটস এ স্যাড টেল অব এ ম্যারিড ওম্যান, ইন ডেসপারেট এডালট্রাস লাভ।

: আ, ইউ আর বিকামিং ভেরি পজেসিভ জুলি, আমি যথেষ্ট বুড়া হইছি।

বয়স হয়তো মিসেস ক্লার্ককে কষ্ট দেয়, পুরান হিসাবের খাতায় অনেক শূন্য, ভুল, কাটাকাটি নতুন করে হিসাবের খাতা খোলার সময় নাই, চুল সাদা হয়া গেছে, চামড়া কুঁচকায় যেতে শুরু করেছে। মেরির মন খারাপ হয়া থাকে, কারণ রবার্ট ক্লার্কের অসুখ হয়তো সাধারণ অসুখ ছিল না, রবার্ট হঠাৎ একদিন শিমুল তুলার বৈজ্ঞানিক নাম ভুলে যায় এবং ববের কারণে মেরি জয়েস কতদিন পর কেন্দে ফেলে, তার প্রৌঢ় ফরসা গালের উপর দিয়া তপ্ত ধরণিতে বহুদিন পরে আসা বৃষ্টির মত পানি গড়ায়া নামে; সে ববকে বলে, তুমি মনে করার চেষ্টা করে দেখ। কিন্তু রবার্ট পারে না, শিমুল তুলা গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম সে ভুলেই গেছে, এবং এই কথা বুঝতে পারার পর মনে হয় ববের জীবন অবলম্বনহীন হয়া পড়ে; সে রবিবার সকালে মেরি এবং জুলির সঙ্গে প্রার্থনার জন্য যায়া পবিত্র জপমালার গির্জার গেট দিয়া ঢুকে প্রথম বুঝতে পারে গাছটার নাম তার মনে নাই, সে মেরিকে বলে, মেরি আই ফরগট দা নেম!

: হোয়াট নেম?।

: এই গাছটার।

: শিমুল!

: নো, দি আদার নেম!

মেরি যখন ব্যাপারটা বোঝে, সে বিশ্বাস করতে পারে না এটা কিভাবে সম্ভব, তুমি শিমুলের বোটানিক্যাল নামটাই ভুলে গেলা, শিমুল গাছের এই বৈজ্ঞানিক নামটা বলতে পারার জনাই কি তোমাকে আমি বিয়া করি নাই বব, পৃথিবীকে পিছনে রেখে তোমার কাছে আসি নাই? হায় যিশু, সে চার্চের প্রার্থনায় বিচলিত হয়া থাকে, প্রভুর কাছে কান্দে, প্রভু যিশু আমাকে দয়া কর, আমি জেনেশুনে কোন পাপ করি নাই প্রভু, আমাদেরকে দয়া কর; তখন গির্জার যাজক উপাসনা পরিচালনা করে।

যাজক : পিতা ও পুত্র ও পবিত্র আত্মার নামে।

সকলে : আমেন।

মেরি দুই হাতের দশ আঙ্গুল পরস্পর যুক্ত করে মাথা নত করে রাখে, জুলি হয়তো তার মায়ের অস্থিরতার কারণ বুঝতে পারে না, একটা বাজে কুৎসিত-গায়ে কাঁটা ভর্তি-গাছের নাম ভুলে গেলে কি হয়, তার বাপ বুড়া হচ্ছে স্মৃতি শক্তি কমে যাচ্ছে, হয়তো ডিমেনশিয়া, এরকম হতেই পারে; কিন্তু তার মা মনে হয় বেশি জানে, তার মা, মেরি জয়েসের বিষণ্ণতা যায় না, তার মন হাহাকার করে, গাছের নামই যদি ভুলে যায়া থাকে তাহলে ববের জীবনে আর অবশিষ্ট কিছু নাই, এবং সে তার মেয়েকে বলে, হি উইল নট লিভ লং!

স্টিভেন আর্নল্ডও খুবই উদ্বিগ্ন হয়, ববেরতো এই রকম হওয়ার কথা, সে ববকে ছুটি দেয়, কিছুদিন ছুটি কাটাও, বিশ্রাম নেও, দেখো সব ঠিক হয়া যাবে; কিন্তু বব বাঁচে না, লাঙ ক্যানসারের জন্য তাকে বিসমুতে ভর্তি করা হয়, তখন একদিন জুলিকে বাপের বিছানার পাশে রেখে মেরি শাহবাগ মার্কেটে যায় পেথিড্রিন ইঞ্জেকশন কেনার জন্য এবং তখন সে জাতীয় যাদুঘরের দিকে তাকায়া দেখে যে, তার ব্যক্তিগত বিপর্যয় নিয়া পৃথিবীর কোন ভ্রুক্ষেপ নাই, রাস্তায় মানুষ এবং গাড়ির স্রোত বয়া যায়, এবং যাদুঘর প্রাঙ্গণে পতািহীন শিমুল গছি ছেয়ে আছে লাল ফুলে। মেরি তখন যাদুঘরের প্রাঙ্গণের ভিতরে যায় বহুদিন পর মাটির উপর থেকে আর একটা লাল শিমুল ফুল কুড়ায় নেয় এবং সে শিমুল ফুল গাছের বোটানিক্যাল নামের খোঁজে পাবলিক লাইব্রেরিতে যায়া ঢোকে; কিন্তু শিমুলের ইংরেজি নামটাই সে ঠিকমত বের করতে পারে না, এইটা কি সিল্ক কটন ট্রি? কিন্তু এই নামে কোন ভুক্তি কোথাও নাই, এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকায় কিছু নাই, এনসাইক্লোপিডিয়া অব বোটানিক্যাল নেমস-এও কিছু নাই, অবশেষে সে বাংলাপিডিয়ায় শিমুলের বোটানিক্যাল নাম পায়, বোম্বাক্স..। একটা কাগজের টুকরায় সে নামটা লিখা আনে, ববের বেডের পাশে ফিরা এসে বলে, দেখ বব শিমুল ফুল, এবং ব্যাগ থেকে চিরকুট বের করে শিমুলের বৈজ্ঞানিক নাম পড়ে শোনায়, জুলির মনে হয় যে, মারাত্মক যন্ত্রণার ভিতরেও তার বাপের মুখে তখন একটা হাসি ছড়ায়া যায়, কিন্তু সে আর পনের দিনের বেশি বাঁচে না, তাকে নিয়া যায়া টিপুসুলতান রোডের মাথায় খ্রিষ্টানদের গোরস্থানে মাটি দেওয়া হয় এবং মেরির মাথায় দুশ্চিন্তার আকাশ ভেঙ্গে পড়ে; তখন স্টিভ আর্নল্ড একদিন আসে নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লির মধ্যে এবং কোন কথা খুঁজে না পায়া মেরিকে বলে, ডিড ইউ লাইক মাদাম বোভারি?

তখন মাথায় কালো স্কার্ফ জাড়ায় শোকার্ত পীড়িত মেরি চুপ করে থাকে, সে মাদাম বোভারি পড়েই নাই, সে স্টিভেন আর্নল্ডকে বলে, ক্যান। ইউ হেলপ মাই সান টু গো এব্রভ, সামহোয়্যার? এবং মেরির এই উদ্যোগের ফলে যোসেফ ইউজিনের জন্য এক সঙ্কট তৈরি হয়, কারণ শাকিলা বানুকে সে বিজি প্রেসের জব সেকশনে বসে বলে যে, তার এইসব আর ভাল লাগে না, এবং তার দিকে তাকায়া নাখালপাড়ার শাকিলা বানু অফিসের টেবিলের কাঠের উপরে নখ দিয়া সরু দাগ কেটে একটা এক্কাদোক্কা খেলার ঘর বানায়-শেষ পর্যন্ত খ্রিষ্টান পোলা যোসেফ মিস্ত্রির সঙ্গে, এইটা কিভাবে শুরু হইলো? বিজি প্রেসের জব সেকশনে শাকিলা বানুর সহকর্মীদের মনে হয় যে, এইগুলি কিছু না, খামাখা; শাকিলার বাপ ফারুক হোসেন যখন চাকরি থেকে অবসরে যায় তখন সিবিএ-র নেতাদের চাপে পড়ে তার বড় মেয়ে বিএ পাশ শাকিলাকে জব সেকশনে চাকরি দেওয়া হয়, সারাদিন শাকিলা চেয়ার টেবিল নিয়া বসে থাকে, কাজের রিকুইজিশন যখন তার টেবিলে এসে পৌছায়, সে একটা লেজার বইয়ে তার বিবরণ লিখে একটা নাম্বার লাগায়া নির্দিষ্ট সেকশনে পাঠায়া দেয়। সারাদিন সে এই কাজ করে, তার সহকর্মীরা তাকে দেখে, সে কালা না, ফরসাও না, শরীর স্বাস্থ্যও খারাপ না, কিন্তু তার উপরের দাঁতের পাটি দোতলার ব্যালকোনির বারান্দার মত ঝুলে থাকে, ফলে সে হাসে না, দাঁত ঢেকে রাখার জন্য উপরের ঠোট লম্বা করে মুখটা কাপটি মেরে রাখে এবং তাকে নিয়া বিজি প্রেসের অবিবাহিত কর্মচারিদের কোন আগ্রহ হয় না, বাইন্ডিং সেকশনের এক আইএ ফেল দপ্তরিকে শাকিলার বস, সেকশন ইন চার্জ, প্রস্তাব দিয়েছিল, কাজ হয় নাই। তখন কিভাবে যোসেফের সঙ্গে তার দেখা হয়, কিভাবে হয় সেটা এক রহস্য, তবে যোসেফ একদিন দুপুর বেলা কালিমোবিল মাখা অবস্থায় শাকিলার টেবিলে এসে বসে এবং বলে, তাহইলে খাওয়ান, এবং তার এই কথা শুনে জব সেকশনের লোকেরা শিহরিত হয়, বলে কি লোকটা, এই দেশে নারীকে খাওয়াইতে বলাটা সাংঘাতিক এক ব্যাপার, কারণ এই দেশে নারীকেও খাদ্য দ্রব্যের মত খাওয়া হয়, কি খাওয়াবে শাকিলা, কি খাইতে চায় এই খ্রিষ্টানের পোলা খ্রিষ্টান-ব্যাপার কি? এটা বোঝা মুশকিল হয় যে, ব্যাপার কি, কিন্তু মনে হয় মেয়েটা হয়তো ভাবে নাই যে, যোসেফ মিস্ত্রি সত্যি এতগুলা লোকের সামনে এসে তার টেবিলে বসে পড়বে, তখন শাকিলা তাকে তাড়াতে পারে না, ফলে সে টিফিন বক্সে করে আনা হাতে বেলা রুটি আর ডিম ভাজি বের করে সকলের চোখের সামনে ভাগ করে খায়; যোসেফ ইউজিন দেড়খান রুটি এবং পিয়াজকাচা মরিচ দিয়া ভাজা ডিমের আদ্দেকটা খায়া একটা ঢেকুর উঠায়া বলে, পেট ভইরা খাইলাম, ফলে তখন ঠোটের প্রতিরোধ ভেঙ্গে শাকিলার দাঁতের সারি বের হয়া পড়ে এবং সে তার হাত ব্যাগ খুলে এক টুকরা টিসু কাগজ বের করে যোসেফের দিকে আগায়া দেয়, যোসেফ সেটা নিতে যায়া শাকিলার আঙ্গুল স্পর্শ করে। শাকিলা হয়তো ঘরে বসে দুই দিন কাপে, তার জব সেকশনের সহকর্মীরা ভাবে মাইয়ালোকগুলা খালি ফাঁকি দেয়, অপিসে না আসতে পারলেই খুশি, কিন্তু তার পর দিন কিংবা আরো ২/৩ দিন পরে সে ফেরে, এবং হাতে করে তিন ডিব্বার একটা ছোট টিফিন ক্যারিয়ার নিয়া আসে, জব সেকশনের কেরানিরা চোখ গোল করে দেখে দুপুর বেলা শাকিলা তাদের সেকশনের পিয়নকে পাঠায় যোসেফ মিস্ত্রিকে খুঁজে আনার জন্য, এবং যোসেফ ইউজিন আসার পর সে তার টিফিন ক্যারিয়ার খোলে, এক বাটিতে ছিল পোলাও, একটায় মুরগির তরকারি এবং অন্য একটার মধ্যে চাইরটা টিক্কা কাবাব জাতীয় কিছু যোসেফ হয়তো বিব্রত হয়, তারপর তারা পোলাও ভাগ করে মুরগির ঝোল ঢেলে নিয়া খায়, এবং এইভাবে যোসেফ মিস্ত্রি ভূয়া যেতে থাকে। হয়তো আবার দিন দুই যায়, তারপর আবার তাকে শাকিলা খাওয়ায়, হয়তো আবার রুটি এবং ডিম ভাজি, তখন বিজি প্রেসের লোকেরা বুঝতে পারে যোসেফ মিস্ত্রিকে জব সেকশনের শাকিলা বানু কি খাওয়ায়, ডিমরুটিপোলাও/মুরগির গোস এইসব, তখন হয়তো তাদের মনে হয় যে, এইগুলি খাওয়াইলে দোষ নাই, খাওয়ার জন্য যোসেফের পাতে নিজেকে ভুলে না দিলেই হল, অথবা দোষ কি সত্যি নাই? কারণ, এইসব আচরণ কি মানুষকে বিপথে নিয়া যাওয়ার জন্য খোঁচায় না? অবশ্যই খোঁচায়, প্ররোচিত করে, এবং এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না যে, শাকিলা এবং যোসে ইউজিন এই খেচানিতে পড়ে, যোসেফ নাখালপাড়ায় শাকিলাদের বাসায় পর্যন্ত যায় হাজির হয়, শাকিলার মা ফিরোজা বানকে, খালাম্মা খালাম্মা করে আল্লাদ দেখায়, শক্ত খটখটা পাকন পিঠা দিয়া চা খায়া বিদায় নেওয়ার সময় বলে, যাই খালাম্মা, আসসালামালেকুম; এবং যোসেফ মিস্ত্রির এই আচরণে শাকিলা বানু খুশি হয়, তার বুকের উপর থেকে একটা ভার নেমে যায়, শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়া আসে, এবং তার মা যখন বলে, অরে মুসলমান হইতে ক, সে বলে, কমু!

কিন্তু শাকিলা কি যোসেফকে সত্যি মুসলমান হতে বলে? হয়তো বলে; হয়তো বলে যে, তার মা চায় তারা বিয়া করুক, কিন্তু সমাজ সংসার ধর্ম আছে, আছে না? এবং তখন যোসেফ মিস্ত্রি কি বলে? হয়তো সে তোতলায়, হয়তো রাগ করে, হয়তো কিছুই না বলে চুপ করে থাকে, এবং শাকিলা বানু তার মৌন মুখের দিকে তাকায়া এলোমেলোভাবে কিসব বলে, সে হয়তো তার এই সম্ভাবনার দুয়ার বন্ধ করতে চায় না। ফলে তখন হয়তো আরো ২/৪ কিংবা ১০ মাস যায়, ঢাকার আকাশে মেঘ গুরুগুরু করে বৃষ্টি হয়, বৃষ্টির পর শীত আসে এবং শাকিলার তখন খুব ঠাখ লাগে বলে সে পায়ে মুজা পরে অফিসে যাতায়াত করে, যোসেফ মিস্ত্রি তা দেখে হাসে, স্যান্ডেলের সঙ্গে মুজা পর, তুমি একটা খ্যাত, সে বলে এবং শাকিলার দন্ত রাজি মুক্ত এবং তার মুখ আরক্তিম হয়, কিন্তু তখন শাকিলার মায়ের অস্থিরতা চরম অবস্থায় যায় ঠেকে, তার ভাইদের ফাইটা পড়ার দশা হয় এবং পূর্ব নাখালপাড়ার মাস্তান পোলাপান একদিন শাকিলাদের বাসা থেকে ফেরার সময় যোসেফ ইউজিনকে এমপি হোস্টেলের কাছে থামায়, তারা তাকে চড় থাপ্পড় ঘুসি মেরে রক্তাক্ত করে ফেলে, সে তখন দৌড় দেয়, হোস্টেলের গেট পার হয় ভিতরে যায় ঢোকে-গেটের পুলিশ দেখে মাস্ত নিরা ফিরা যায়। নাখালপাড়ার পোলাপানদের হাতে মাইর খায়া, চিবুকে থুতনিতে কাটা দাগ নিয়া যোসেফ ইউজিন পরদিন কাজে যায়, সে বলে যে, সে রিকসা থেকে পড়ে যায় আহত হয়েছে, কিন্তু মহল্লায় যোসেফকে মারার ঘটনার কথা শাকিলা বানু শোনে, সে তাদের বাসায় ঘরের ভিতরে সুখ লুকায়া কান্দে। তখন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ সমিতি-এর বিজি প্রেস শাখার সদস্য নিমচন্দ্র বনিকের সঙ্গে যোসেফের দেখা হয়, নিমচন্দ্র লাইনো মেশিনে টাইপ সেটিংয়ের কাজ করে এবং তেজগাও সাতরাস্তার মোড়ে বিজি প্রেস কলোনিতে থাকে, যোসেফের সঙ্গে তার খাতির আছে, ফলে যতই যোসেফ বলুক রিক্সা থেকে পড়ে যায় তার মুখ ফাটছে, নিমচন্দ্রের বিশ্বাস করা কঠিন হয়, সে তাকে বলে, যোসেফ দাদা কি হইছে? কিন্তু যোসেফলতা কিছু বলে না, অথবা হয়তো সে বলে, এবং নিমচন্দ্র সব কিছু শুনে যোসেফকে জিগাস করে, ভুমি শাকিলারে ভালবাস?

: কি জানি।

: বিয়া করবা?

: মুসলমান হইতে বলে!

যোসেফ ইউজিন হয়তো ভেবে দেখার চেষ্টা করে যে, কিভাবে এত কিছু হয়া গেল, শাকিলার মত একটা মেয়ের জন্য সে এতকিছু করলো, কেন? প্রেম হয় নাই কি? তখন নিমচন্দ্র বনিক বলে, শাকিলারে খাইছো?

নারীকে খাওয়ার কথা আবার উচ্চারিত হয় এবং যোসেফ মিস্ত্রি চুপ করে থাকে।

: খাইতে চাইলে খায়া দেও, জায়গা লাগলে আমারে বইলো!

ফলে যোসেফের জন্য মেরি চিন্তিত হয়, সে রবার্টের মৃত্যুর পর তাদের নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লির বাসায় বসে স্টিভেন আর্নল্ডের দিকে তাকায়া যখন বলে, ক্যান ইউ হেল হিম, মাই সান? আই ওয়ান্ট টু সেল্ড হিম এওয়ে কুইকলি, তখন স্টিভেন আর্নল্ড বোঝে, সন্তানের বাইরে নারীর জীবন নাই, এবং সে বলে যে, সে চেষ্টা করে দেখবে; এবং এর ফলে মেরি জয়েসের জীবনে নতুন বিপর্যয় নেমে আসে। কারণ স্টিভেন দ্রুতই যোসেফ ইউজিনের ইংল্যান্ড যাওয়ার ভিসা যোগাড় করে দেয়, যোসেফ লন্ডনের উত্তরে মিডকান্ট্রি শহর বার্মিংহামে যায় বসতি গাড়ে, মার্কল এন্ড স্পেনসর-এর দোকানে সেলসম্যানের কাজ নেয়, সে টেসকো সুপার স্টোরে বাজার করে, তামাক এবং পত্রিকার দোকানে সাদা বুড়ি মহিলাদের সঙ্গে খাড়ায়া এক পাউন্ডে লোটোর বাজি খেলে, রান্নার আলসিতে বার্গার কিংয়ের চিকেন বার্গার খায়া কাটায়, তার জীবনে হয়তো একটা পরিবর্তন এসে যেতে থাকে, কিন্তু গায়ের রঙের কারণে তার যোসেফ ইউজিন হয়া ওঠা কঠিন হতে থাকে, ডাউন টাউনে তার দোকান থেকে ক্যানেলের পাশ দিয়া একদিন হেঁটে বাসার দিকে ফেরার সময় বার্মিংহাম সী একুইরিয়ামএর কাছে কয়েকজন মধ্যবয়স্ক শেতাঙ্গ তার মুখের দিকে তাকায়া নির্লিপ্তভাবে তাকে পাকি বলে গাল দেয়। তখন ম্যানচেস্টার এবং বার্মিংহামে দক্ষিণ এশীয় ও ক্যারেবীয় অঞ্চলের অভিবাসী তরুণদের সঙ্গে স্থানীয় শ্বেতাঙ্গ তরুণদের দাঙ্গা চলছিল, যোসেফ ইউজিনের ভয় লাগে, এ কোথায় আমি আইসা পড়লাম ঈশ্বর, এবং প্রভু যিশু হয়তো তার জন্য কান্দে, কারণ সেই উইকএন্ডে একটা পেচপেটা বৃষ্টি নামে এবং সে তার জীবনের প্রান্তে এসে খাড়ায়। সেই কারণে উইকএতে কাজ করলে পয়সা বেশি জেনেও যোসেফের মনে হয়, আমার ভাল লাগতেছে না-তখন সিটি কনভেনশন সেন্টারের থিয়েটার হলে স্যার এন্ড্রু ওয়েবার লয়েডের মিউজিক্যাল দা ফ্যান্টম অব দা অপরা চলছিল-যোসেফ ইউজিন ভাবে, যাই দেইখা আসি গা এবং তখন বার্মিংহাম সিটি কনভেনশন সেন্টারের বিশাল খোলা চত্বরের একপাশে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির ভিতরে দুবৃত্তরা তাকে ছুরি মারে এবং তার পেটের নাড়িভুড়ি বের হয়া গেলে হাল্কা বাদামি সিরামিকের ইট বিছানো ভিজা চত্বরের উপরে সে পড়ে যায়।

মৃত যোসেফ ইউজিনকে তার মা বাংলাদেশে ফিরায়া আনে, কোনভাবেই সে তাকে ইংল্যান্ডে সমাহিত করতে রাজি হয় না, বার্মিংহামে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনারের দপ্তরের মাধ্যমে সে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে, হাইকমিশনের তত্ত্বাবধানে পুলিশ যোসেফের কফিন একটা ভ্যানে করে লন্ডন নিয়া যায়া হিথ্রোতে বৃটিশ এয়ারওয়েজের বিমানে তুলে দেয়। ঢাকায় মেরি ছেলের কফিন খুলে দেখে, সে চোখ বুজে শুয়ে আছে, সার্টের নিচে পেট জুড়ে ব্যান্ডেজ বান্ধা তাতে রক্তের শুকনা দাগ, তখন মেরি জয়েস ছেলের ক্ষতের ব্যান্ডেজের উপরে হাত বুলায়; যোসেফ ইউজিনকে রবার্টের পাশে কবর দেওয়া হয়, এবং নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে যায় মামুনুল হাই দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা ছায়ার মত জুলি যখন বসার ঘরে আসে মামুন কেন্দে ফেলে, জুলি হয়তো তাকে বলে, আপনে কান্দেন কেন ভোলা পোলা, এবং জুলির বুকের ভিতর আবেগ হয়তো উচ্ছ্বসিত হয় ওঠে, প্রবল ব্যক্তিগত শোকের মধ্যেও জীবনে এই একবার তার মনে হয় যে, পোলাটার দিকে একটু গভীর করে তাকায়া মাথার চুলের মধ্যে আঙ্গুল দিয়া একটু আদর করে দেয়; তখন মামুন তার চোখের পানি মুছে নিয়া বলে যে, সে জানে না তার কেন কান্দা আসে, নাথিং ইজ গোয়িং আওয়ার ওয়ে, মাই ওয়ে জুলি, হোয়াই? কিন্তু জুলি ফ্লোরেন্সের বয়সতো ক্রমাগত বাড়ে, এবং তার সামনে অবশ্যম্ভাবী এসে খাড়ায়, কি করবে সে এখন? তার মা প্রতিদিন নিজেকে টেনে নিয়া সকালে স্কুলে যায়, দুপুরে ফিরা আসে, তারপর বিছানায় পড়ে থাকে, সে বাসায় থাকলে হয়তো পাশে যায়া বসে এবং বলে, মম লেবুর শরবত খাবা একগ্লাস, বানায়া দেব? তার মনে হয় তার মা মেরি জয়েস তলায়া যাচ্ছে, শি ইজ দ্রাউনিং, তাকে হাত বাড়ায়া ধরা দরকার; তখন সে গ্রিনহেরাল্ড স্কুলে চাকরি নেয় এবং তাদের বাইরের ঘরে বসে মামুনুল হাই এবং ফখরুল আলম লেদু বলে, টিচারের শরীর এখন কেমন? মামুনুল হাই সম্প্রতি ইস্টার্ন ব্যাংকের চাকরিতে যোগ দেয়, এভিপি, জুলি তাকে বলে, আমাদেরকে খাওয়াবেন না? তখন মামুনুল হাইয়ের হয়তো তেষ্টা পায়, জুলি ভিতরে মায়া কাচের জগে করে পানি নিয়া আসে, গ্লাসে ঢেলে মামুনকে দেয়, লেদুকে জিগাস করে, আপনেকে দেব লেদু ভাই? তখন লেদু বলে, জালো জুলি চানমিঞার সঙ্গে দেখা হইছিল, সে তোমার উপরে খুব ক্ষেপা, তুমি নাকি ছুটু বেলায় ওরে মাঙ্কিবয় বলছিলা, সে সেইটা ভোলে নাই; এবং তখন দেখা যায় যে, মাবিয়ের কথায় জুলির নিরুত্তাপ বিষ জীবনে উত্তেজনা বাড়ে, সে বলে, কোথায় পাইনে তাকে, আমি তাকে মাঙ্কিয় কেন বলব, আশ্চর্য! কিন্তু চানমিঞার তখন অন্যরকম অবস্থা, সে তখন দা কার থিফ অফ ঢাকা, তার সঙ্গে হয়তো লেদুর দেখা হয়, চাঁনমিঞা কোন এক ব্র্যান্ডের গাড়ির উপরে দুইচাইর দশটা বান্দর নিয়া মহল্লার গল্লির মধ্যে খাড়ায়া আছে, গাড়ির পিছনের সিটের উপরে রেখে দেওয়া আছে একটা আস্তা কলার ছড়া এবং বান্দরেরা এই কল ছিঁড়া খায়, হয়তো তারা চানমিঞাকেও দেয় এবং তখন লেদু যায় হাজির হয় এবং বলে, একদিন ল টিচারের বাইতে যাই, জুলি তরে খুব লাইক করে; কিন্তু নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লির বাসায় তখন মামুনুল হাই জুলিকে বলে, আমি কি তোমার যিশুকে একটা চুমা দিতে পারি?

জুলি বলে, ওই যে দেওয়ালের সঙ্গে ঝুলান আছে, যায়া দিয়া আসেন!

: তোমার গলারটাকে।

জুলি তার গলার দীর্ঘ দিনের পুরান স্টার্লিং সিলভারের চেনটা খুলে দেয়, মামুন মিঞা সেটা তার ডাইন হাতের মুঠার ভিতরে পুরে রেখে বলে, আমি এইটা নেই?

: কেন? না।

: আমাকে খ্রিষ্টান বানাও জুলি?

থে লাগবে হরে জন্মওর ওয়ার প

: দরকার কি!

শৈশবের দিনতো অবশিষ্ট থাকে না কিছুই, আয়নার উপরকার ছবির মত হারায়া যায়-যায় না কি? যাইহোক, মামুন মিঞাকে ফলে জুলির গলার চেন এবং সিফিকসটা ফিরায়া দেওয়া লাগে, জুলি হাত বাড়ায়া চেনটা নেয়, তখন মামুন তার হাত দিয়া জুলির হাত ধরে রাখে, জুলি কি কিছু বোঝে না? এইটা কি সম্ভব? জুলি হয়তো তাকে খেলায়, অথবা দ্রতা করে—এইসব ভদ্রতাও কি জীবনবিদারক হতে পারে না এবং মামুন মিঞা একটা তস্য ফকিরের মত তাকে বলে, তুমি জান আমি তোমাকে কতটা চাইছি, ক্যান আই কিস ইউ ওয়ান্স?

: মনে হয় না-আই উইল বি এভেইলএবল টু মাই হাজবেন্ড।

: কোথায় তিনি, তোমার সেই হাজবেন্ড দেবতা?

: আছে, আই এ্যাম গোয়িং টু মারি হিম সুন।

: বানায়া মিছা কথা বল তুমি খামাখা!

: বানায়া বলব কেন-আপনে তাকে চেনেন!

: কে সে-কেউগা?

: আপনাদের মিজ ডি কস্তা টিচারের ছেলে।

: পিউস? ও মাই গড, হায় খোদা!

জানালার পর্দার ফাঁক দিয়া তখন পুনরায় বিকালের আলো এসে জুলি ফ্লোরেন্সের মুখে বিম্বিত হয় এবং মামুন মিঞার মনে হয় যে, নারীর মন খার জন্য না, তার জন্য কখনোই না; তাহলে জুলি হবে মিজ রোজালিন ডি কস্তু রি ছেলের বৌ? এইটা কিভাবে সব-শি ইজ সো প্রাউড এন্ড বিউটিফুল-এইটা হইতে পারে না, কারণ তখন চট্টগ্রাম থেকে আসমানতারার খরকোস এসে ভূতের গলিতে খাড়া হয় এবং মিসেস জোবেদা তার কথা শোনার পর তাকে দ্রুত ঘরের ভিতরে নিয়া যায়া বসায়, বাপজান তুমি বহ, এই কতা তুমি রাস্তায় যায় কইয়ো না, হুনো আমার পোলা হারায় নাইকা, এবং খরকোল মিঞা মিসেস জৈাবেদার কথা শোনে এবং তার ঘরে বসে নাস্তাপানি খায়।

: আমাগোতো মামুন একটা আছে, তুমার আর কুনো নাম নাইকা?

: আমারে কুতুবউদ্দিন কইয়েরে ডাকিত্ পারন, আইবেকও ডাকি পারন, খরকোসও ডাকি পারন।

: তুমার নাম খরকোস?

: জি।

: আমি তুমারে আইবেক কমু!

খরকোসের মনে হয় যে, সে যদি মামুন নাই হয়, তাহলে সে কে? এই প্রশ্নের উত্তরতো তাকে জানতে হবে, সে কত পথ পাড়ি দিয়া কোনখান থেকে কোনখানে এসে পৌঁছেছে, তাকেতো তার জীবনের উদ্দেশ্য সাধন করা লাগবে, সন্ধান করে বের করতে হবে-কে সে, আঁই খন? কিন্তু আসমানতারা হুরে জান্নাত আব্দুল ওদুদ চৌং এর খেয়ালি এবং জেদি মাইয়া, ডলি আক্তার তার ছুটুকালের আচরণের কথা ভোলে না, ফলে তারা খরকোসের গলায় দড়ি দেওয়ার পর লোহার শিক দিয়া খরকোসের জন্য খাঁচা বানায়া দেয়, এবং খরকোস মামুন তাদের শোয়ার ঘরের এককোনায় খাঁচার ভিতরে চাকরদের দেওয়া ভাত সালুল খায়া আসমানতারার আদর সোহাগের মধ্যে বড় হয়, আসমানতারা যখন স্কুলে যেতে শুরু করে তখন দেখা যায় যে, খরকোস মামুন খাঁচার চেয়ে লম্বা হয়া গেছে, ডলি আক্তার শিল কড়ইয়ের নতুন ধাচা বানায়, তারপর এই খাঁচায়ও যখন খরকোসটা আটে না, বেঁকা হয়া শোয়, তখন আব্দুল ওদুদ হয়তো তার মেয়েকে বলে যে, খরকোসটাকে আর খাঁচায় রাখার দরকার নাই, ডলি আক্তার হয়তো বলে, ন চলে না, ইবতো শরকোস নয়, মানুষ, আই তুয়ারে আসল খরকোস আনি দিইয়ুম, ইবারে ছাড়ি দজও! আসমানতারা রাজি হয় না, সে কান্দে, আঁতুথে ন লাগিব, আঁই ন চাই, আঁই ইবারে ন ছাইড়গম!

তখন খরকোসের খাঁচার জীবন দীর্ঘায়িত হয়, সে আরো বড় এবং বেঁকা হয়, এবং খাঁচার প্রাণীর মত তৈরি হয় তার ভয়, উৎকণ্ঠা এবং আবেগ; তার আচরণে হয়তো আসমানতারা নিজেই তাজ্জব হয়া যায়, সে সতীপাড়া প্রাইমারি স্কুল থেকে ফিরা দেখে যে, খরকোস খাঁচার ভিতরে গোল ইয়া ঘুমায়, তখন আসমানতারা কাঠের স্কেল দিয়া তাকে একটা খোঁচা দেয়, চও ঘুমাচ্ছে, সে বলে, এবং একটা খোঁচাই যথেষ্ট হয়, খরকোসটা বনবিলাইয়ের মত গরগর করে ওঠে, তার উঁত বের হয়া যায় এবং চোখে হিংস্র আলো খেলা করে; হয়তো কখনো ডলি আক্তারও খরকোসের আচরণ বদলায় যেতে দেখে, কিন্তু মেয়ের মুখের দিকে তাকায়া সে এবং আব্দুল ওদুদ চৌধুরি ঘরের ভিতরে খরকোসের বসবাসের বিষয়টা পুনরায় মেনে নেয়। তখন আসমানভারী ক্লাস ফোরে ওঠে এবং একদিন রাইতের বেলা লুঙ্গির ভিতরে খোরকোসের বীর্যপাত হয়, হয়তো একটা স্বপ্নের ভিতরে এই কাজটা হয়, সে হয়তো দেখে কতগুলা ছবির পোস্টার, সাবনুর এবং পপির, হয়তো দেখে আগ্রার তাজমহল এবং দীল্লির কুতুব মিনার, স্বপ্নের ভিতরে সে কুতুব মিনারের উপর থেকে হয়তো পড়ে যায় এবং সে পিছলায়া নেমে যেতে থাকে, তখন তার দুই উরুর মধ্যেখানে জোয়ারের পানির মত উদ্বেলতা ফুলে ওঠে ভয় এবং আতঙ্ক এবং উত্তেজনায় যখন সে ফেটে পড়ে, ঘুমের ভিতরে তার মনে হয় যে, তার লুঙ্গি ভিজা গেছে। ঘুম ভেঙ্গে গেলে হাত দিয়া পিছলা এই পদার্থ—তার নিজ দেহের এই কষলে ছুঁয়ে দেখে, তার নাকে বীর্যের প্রথম সোঁদা ঘ্রাণ আসে, এবং ডিম লাইট জ্বালানো আধো অন্ধকারের ভিতরে সে পাগল হয়া যায়, এ কেমন গন্ধ, এ কেমন গন্ধের মেজাজ, তার ইচ্ছা করে খাঁচা থেকে বের হয় দুই হাত উর্ধমুখী করে ডলু নদীর পাড় দিয়া দৌড়ায়-গাছ এবং বনের ভিতরে, দূরের নীল পাহাড়ের ভিতরে চলে যায়, যেতেই থাকে-সে তার হাতে মুখে গলায় নিজের এই যৌনরস মেখে নেয় এবং খাঁচার শিক আঁকায়া চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলে। সেদিন আব্দুল আলি চৌধুরির বাড়ির সকলে খরকোসের কাণ্ড দেখে এবং এই কথা বোয়ালিয়া পাড়ার সকলে শোনে, হয়তো সাতকানিয়া শহরের সকলেও; কারণ খরকোসের ভয়াবহ চিঙ্কারে ছুটে এসে বাড়ির লেকেরা দেখে যে, গলায় লুঙ্গি পঁাচাইনা ন্যাংটা খরকোস খাঁচার ভিতরে হাঁটু গেড়ে বসে দাপাদাপি করে, ডলি আক্তার তখন ভয় পায়া যায়, কামড়ায়া দেবে নাকি? আব্দুল ওদুদ চৌধুরি হতভম্ব হয়া পড়ে, ভেবে পায় না কি হইলো পোলাটার, তখন হয়তো বাড়ির চাকর আবুইল্যা কিংবা দারোগার মসজিদের ইমাম-যে আব্দুল আলি চৌধুরির বাড়িতে স্থায়ীভাবে জাইগির থাকে-বড় এক বালতি পানি এনে খাঁচার কাছে যায়া চিড়িয়াখানার গরিলার মত বিচি ঝুলায়া দুই পায়ের পাতার উপরে বসে থাকা খরকোস মামুনের দিকে ছুড়ে দেয়, পানির ধাক্কায় উত্তেজিত খরকোস ধরাশায়ী হয় এবং কেউ হয়তো বলে, ও খুরকোস, ইন কান করদ্দে ওডা!

: আঁই খাঁচার ভিতরে ন থাইক্কম, আঁত্‌থে গম ন লার, আঁরে বাইর গরণ।

তখন হাল্কা হাওয়ায় জানালা দিয়া উড়ে আসা ছাতিম মঞ্জরির ঘ্রাণের মত খরকোসের বীর্যের অস্পষ্ট গন্ধ ঘরের ভিতরে ভেসে বেড়ায় এবং তখন হয়তো কেউ এই গন্ধ সনাক্ত করে, হয়তো আব্দুল ওদুদ করে, হয়তো ডলি আক্তারই করে, হয়তো করে দারোগার মসজিদের ইমাম; এবং তখন মসজিদের ইমাম বলে, ফোয়া ইবা বালেগ হইয়্যেদে, আলহামদু লিল্লাহ, ইবারে ছাড়ি দঅন! কিন্তু তখন আসমানতারা কৈ? দেখা যায় যে, সে ঘরে নাই, বিছানা খালি; তাকে সারা বাড়ি খোঁজা হয়, সে নাই, তারপর তাকে তার নিজের খাটের তলা থেকে বের করা হয় এবং যখন জিগাস করা হয়, অডে ক্যান করদ্দে তুই ওডি? সে বলে, আম্মা খরকোস দেখিয়েরে আঁই ডরাইয়্যি!

সকালবেলা খাঁচা খুলে খরকোসকে ছেড়ে দেওয়া হয়, আসমানতারা কান্দে কিন্তু রাইতের কথা সে ভোলে না, ফলে তার ভয় যায় না, এবং তখন খরকোস মিঞা একা একা হাঁটে, ডলু নদীর পাড় দিয়া যায়, পাকা ব্রিজের গোড়ায় বসে থাকে, তার গলায় দড়ি নাই, দড়ি ধরে পিছনে আসমানতারাও নাই; সে অবলম্বনহীন হয়া পড়ে, বিকালে বাড়ি ফেরার পর হয়তো আবুইল্যা তাকে আবিষ্কার করে, পুকুর পাড়ে বসে খরকোস একা একা কান্দে, তখন আব্দুল ওদুদ মিল্লার বাড়ির সকলে জানতে পারে যে, খরকোসের মন ভাল না এবং তখন ডলি আক্তার এসে খরকোসকে হাত ধরে ঘরে নিয়া যায় মাদুর পেতে ভাত দেয়, বলে, খান্দস কিয়া ওড? তুই মরণ ফোয়া নয় না? ন হান্দিস!

ফলে খরকোস মিঞা আরো কান্দে, জায়েজার হয়া কান্দে, তার কান্দনে বাড়ির পরিবেশ ভারি হয়া ওঠে, এবং শ্বাসনালিতে ভাতের টুকরা ঢুকে গেলে তার কাশি শুরু হয়, দম বন্ধ হয়া মরার দশা হয়, তখন ডুলি আক্তার অথবা আবুইল্যা তার পিঠে দুই/চাইরটা মৃদু চাপড় দেয়, গ্লাস তুলে ধরে পানি খাওয়ায়, মাদুরের উপরে লম্বা করে শোয়ায়া রাখে এবং হয়তো তখন ডলি আক্তারের ঘাড়ের পিছন থেকে আসমানতারা উঁকি দিলে খরকোস তা দেখে, এবং সে যখন বলে, আঁরে ডরাইয়ো না তুই? মনে হয় বালিকা আসমানতারা রাইতের কথা ভুলে যায়, সে বলে, অয়, ন ডরাই; কিন্তু ডলি আক্তার এবং ওদুদ চৌধুরি আসমানতারার ঘরে খরকৌসকে আর থাকতে দেয় না, আবুইল্যার সঙ্গে বাড়ির পিছনে পুকুর পাড়ের টিনের ঘরে তার থাকার জায়গা হয়। টিনের ঘরে শুয়ে তার আবার কান্দা আসে, এবং পুরান চাকর আবুল যখন বলে, ওড়া তুই এান করদ্দে কিয়া? তখন খরকোস মামুন বলে, আঁথে গম ন লার, আঁই ফানলার ন বাইচ্চম আবুল কাকা!

খরকোস শেষ পর্যন্ত মরে না, সে আবুলের সঙ্গে টিনের ঘরে আরামে থাকে এবং তখন, অথবা পরে কখনো, সে কুতুবউদ্দিন আইবেক সম্পর্কে জানতে পারে, কুতুব মিনারের উপর থেকে পড়ে যাওয়ার সময় বীর্যপাতের কথা হয়তো সে কাউকে বলে, বয়সে অনেক বড় হলেও আবুলকেই হয়তো বলে, আবুল হয়তো তাকে খোঁচায় এবং হয়তো তার গোয়া মারতে চায়। ডলি আক্তার এবং আব্দুল ওদুদ নিশ্চয়ই এই বিপদের কথা ভাবে নাই, ভাবলে হয়তো আবুইল্যাকে সাবধান করতো, খবরদার মারিয়েরে হাড়ি ভাঙ্গি দিইয়্যম; তখন খরকোস হয়তো আবুইল্যাকে কুতুব মিনার থেকে পড়ে যাওয়ার গল্পটা বলে, এবং তার মনের ভিতর পিছলায়া পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা যখন ভেসে ওঠে লুঙ্গির তলায় লিঙ্গ খাড়ায়া যায়, এবং তখন লিঙ্গের আগা দিয়া ধাতু বের হয়া লুঙ্গি ভিজায়া দিলে বাটপার চাকর আবুলের কিছু করার থাকে না, খরকোস উল্টা তাকে উপ্তা করে চেপে ধরে লুঙ্গি উঠায়া গোয়া মেরে দেয়। তখন আবুইল্যা ঘরের দরজা খুলে রাইতের অন্ধকারের ভিতর হারায়া যায়, পরদিন সে খরকোসের কুতুবমিনার দেখার গল্প প্রচার করে দেয় এবং সে আব্দুল ওদুদ এবং উলি আক্তারকে বলে যে, সে খরকোসের সঙ্গে থাকবে না, খরকোস রাইতে তাকে খুবই বিরক্ত করে, ঘুমাইতে দেয় না! তখন খরকোসের নাম কুতুবমিনার হয়া যায় এবং ওদুদ মিঞা ঠিক করে যে, কুতুবমিনারকে সে তার মাছ ধরার ট্রলারে নিয়া কাজে লাগাবে, সে জন্য দুই/চাইর দিন আবুইল্যাকে অপেক্ষা করতে হবে; কিন্তু রাইতের বেলা খরকোসের পুরুষাঙ্গ খাড়ায়া গেলে আবুইল্যার গলা শুকায়া যায়, সে বলে, তিয়া তিয়া ভাতিজা, এ্যান ন করিছ! কিন্তু খরকোসের অপেক্ষা করার সময় নাই, তখন আবুল ভিতরে যায় বাড়ির চাকরানি আসিয়া বুয়াকে ডেকে আনে, আসিয়া গরিবের বৌ, কিন্তু শরীরে তার যৌবন, ঝোপে ঝাড়ে নষ্ট হয়, তবে সে হয়তো বোঝে না আবুইল্যার উদ্দেশ্য কি, কারণ আবুল ভাঁকে কখনো বিরক্ত করে নাই, তাই সে অত চিন্তাভাবনা না করে আসে, চাইরচালা টিনের ঘর অন্ধকার হলেও ঘরে যায়া ঢোকে, আবুইল্যা তখন বলে যে, কুতুবমিনারের শরীর ভাল না, ফলে আসিয়া চৌকির উপরে কাইত হয় শুয়ে থাকা খরকোসের দিকে যায়, কি হইলো পোলাটার, সে ভাবে, এবং তখন খরকোস ওরফে কতুবমিনার অপেক্ষা করে; আসিয়া যখন অন্ধকারে হাত বাড়ায় সে তার হাতের ভিতরে খরকোসের গরম উখিত দটা পায়। বহুবছর পর সেইদিন রাইতে খরকোস মিঞা নারীর বুকের মধ্যে শরীর জড়ায় ঘুমায়, তখন আবুল লাপাত্তা হয়, কিন্তু পরদিন ভোরে দারোগার মসজিদে ফজরের আযান দেওয়ারও আগে অন্ধকার থাকতে সে ওদুদ মিঞা এবং ডলি আক্তারকে ডেকে আনে; ফলে আসিয়ার চাকরি যায় এবং কুতুবমিনারকে আনোয়ারা থানার গহিরা নিয়া যায়া ওদুদ চৌং বার্মায় ইউরিয়া সার চোরাচালান এবং অবসর সময়ে মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত কাঠের বড়ির ট্রলার এম ভি মায়ের দোয়া-য় নবিসিতে লাগায়া দেয়। এম ভি মায়ের দোয়া-য় খরকোস বড় সমস্যায় পড়ে, ট্রলারে আছে তিনজন, জানেআলম, শমসু এবং জাকির; এই তিনজনকে নিয়া। খরকোসের পশ্চাদ্দেশের ফুটা বাঁচানো মুশকিল হয়, প্রথম রাইতেই তারা ঝামেলা করে, সে মোচড়ামুচড়ি করে বাঁচে, এবং তিন নাবিক ভাবে, তিয়া ওডা, দরিয়ায় যাই লৈ। পরদিন ট্রলার রওনা হয়, উদ্দেশ্য সাগরে মাছ ধরা, এম ভি মায়ের দোয়া নোঙ্গর তুলে ভটভট শব্দে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়া বঙ্গোপসাগরের ঘন ঘোলা পানির ভিতর দিয়া ছোটে, ১২x৩০ আকারের কাঠের বডির এই ট্রলার সাগরের ঢেউয়ে মাতাল হয়া ওঠে; হয়তো অনেকক্ষণ সময় পার হয়, ওস্তাদ জানেআলম ঝানু সারেঙ, সে সর্বোচ্চ গতিতে দক্ষিণ দিকের লইট্টা মাছের ঝাঁকের আবাসস্থলের দিকে ট্রলার নিয়া যায়, দুই/আড়াই ঘন্টা চলার পর তারা হয়তো মাছের ঝাকটার কাছেই চলে আসে, জাকির এবং শমসু ট্রলারের পাটাতনের উপর তূপ করে রাখা বড় ফুটবল সাইজের গোল প্লাস্টিকের ফ্লোট বান্ধা জাল পানিতে ফেলে দেয়ার আয়োজন করে, তখন জাহাজের হোল্ডের ভিতর থেকে ওয়াক ওয়াক শব্দ করে সিড়ি বায়া একটা মেয়ে উঠে আসে এবং পাটাতনের উপরে বমি করে ভাসায়া দিয়া কাইত তুয়া পড়ে যায়। ব্যাপার দেখেতো জানেআলমের চোখ লাল হয়া ওঠে, জাকির এবং শমসু মুখ বেঁকা করে রাখে, জানেআলম বলে, জাহাজোত রাঞ্জি আইনে কন?

: আঁই আইন্নিদেরি, কিয়া?

তখন মাঝ দরিয়ায় জানেআলম, শমসু এবং জাকিরের কিছু করার থাকে না, কিন্তু তারা এই বিষয়টা মনে রাখে, মেয়েটার কাছ থেকে জানা যায় যে, তার নাম আরতি জলদাস, রাধাশ্যাম জলদাসের বিধবা বৌ সে, বাড়ি গহিরার কাছেই খরদা-গহিরা গ্রামে, সে বলে যে, তার বয়স ছাব্বিশ বচ্ছর, চৌদ্দ বছর বয়সের খরকোস তাকে পঞ্চাশ টাকা দিয়া ভাড়া করে আনে, কিন্তু সে রাঙি না, তার ঘরে রাধাশ্যামের তিনটা বাচ্চা; জানে আলম অবাক হয়, এই পোলাতো মহা চারে বাবা, কখন সে সময় পাইলো আর কখন এই কাম করলো? তখন জানেআলম বমি দমনের জন্য টিনের ডিব্বা থেকে স্টিমিটিল জাতীয় টেবলেট বের করে আরতিকে দেয়, আরতি গলার ভিতরে দুইটা টেবলেট দিয়া কাইত হয়া থাকে; ফলে রাইতে মেয়েলোক নিয়া থাকায় খরকোসের ইজ্জত বাঁচে, কিন্তু জানেআলম, জাকির এবং শমসু এই আনচারের কথা ভোলে না, এইটা তাদের জীবিকার নাই, এই নাউয়ে মপ্নের ফোয়া খরকোস একটা গণিকা এনে তুলেছে, ফলে একটা সংঘর্ষ অনিবার্য হয়া ওঠে। জানেআলম হয়তো বিষয়টা আব্দুল ওদুদ চৌধুরিকে বলে, আব্দুল ওদুদ শুনে খুবই দুঃখিত হয়, তার অনেক কষ্টে বানানো এইসব ট্রলার কুতুবমিনার খরকোস এইভাবে কলুষিত করছে, সে হয়তো ডলি আক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে, কিন্তু তারা কোন সমাধান খুঁজে পায় না, পোলাটার কেউ নাই, কোথায় যাবে সে? ফলে আব্দুল ওদুদ চৌং জানেআলমকে বলে যে, পোলাটা তাদের ছেলের মত, ছুটুকাল থেকে আছে, সে তাকে বকে দেবে; কিন্তু খরকোসকে বকে দিয়া লাভ হয় না, সে ট্রলারে উঠলেই সঙ্গে আরতি থাকে, জানেআলম এবং তার দুই সঙ্গির জন্য এক মহা জ্বালা হয়, তারা চায় না যে সাগর এবং মাছের সঙ্গে পাছড়াপাছড়ির এই রকম একটা কাজের মধ্যে একটা ভেজাইলা মাইয়া ফোয়া ঢুকে বসে থাকুক। তবে তখন বার্মা যাওয়ার একটা ক্ষেপ আসে, চট্টগ্রাম থেকে উপকূল ধরে পাঁচ/ছয়টা সাম্পান রাইতের অন্ধকারে এসে গহিরায় সাঙ্গু নদীর মোহনায় মায়ের দোয়া ট্রলারে মাল তুলে দেয়, ড্রামে করে আনে অকটেন এবং বস্তায় নাইট্রোজেন ইউরিয়া সার, আব্দুল ওদুদের সঙ্গে জানেআলমের জিপিটুজিপি-তে কথা হয়, ওড়া জানেআলম, মাল পাইয়োছ দে না? জানেআলম মাল বুঝে পেয়েছে, কিন্তু সাম্পান থেকে নামায়া ট্রলারে উঠাতে রাইত কাবার হয়া যায়, ফলে সে রওনা দেওয়া স্থগিত করে, মাল যাবে আকিয়াবের কাছে, হয়তো মংদুতে, জানেআলম দিনের বেলা রওনা দিতে চায় না, দিনে নানা রকমের চোখ ঘুরে বেড়ায়, রাইতে রওনা হয়া একটানে অনেক দূর আগায়া যাওয়া যাবে, সে ওদুদ চৌধুরিকে বলে যে, সব ঠিক আছে, রাইত হলেই সে রওনা হবে, তার সঙ্গে শমসু, জাকির এবং খরকোসও আছে। কিন্তু তখন সে খরকোসের বিষয়টা আবার ওদুদ চৌংকে বলে, অনে ইবারে মানা গরি দঅন; ফলে ওদুদ চৌধুরির কড়া নির্দেশের কারণে খরকোসের প্রথম পাচার অভিযান শুরু হয় আরতি জলদাসকে ছাড়া, আরতির সঙ্গে হয়তো তার দেখা হয়, খরকোসেরর উপরের ঠোটের ঘনায়মান মোচের দিকে তাকায়া আরতি বলে, আঁরে ইত্তার ন লইবা?

: লইয়্যম, পরে!

কিন্তু গহিরায় থাকার এই সময় হয়তো কুতুবউদ্দিন আইবেক সম্পর্কে খরকোল মিঞা আরো কথা জানতে পারে, হয়তো অন্য কোন জেলে নৌকার কোন সারেঙ কিংবা মাঝির কথাটা জানা ছিল, হয়তো সে খরকোসকে কুতুবউদ্দিন আইবেক সম্পর্কে বলে, অথবা হয়তো আরতির বড় মেয়ে প্রতিমার সঙ্গে তার দেখা হয়, খরকোস একদিন যখন আরতির বাড়িতে আসে হয়তো আরতি তখন অন্য বাড়িতে কিছু করে, কিংবা মাঠে যায় কিছু টোকাইতে, ফলে প্রতিমা তার একমাত্র ফ্রক এবং ইজার ধুয়ে দেওয়ায় মায়ের একটা পেটিকোট পরে গামছা দিয়া বুক ঢেকে খরকেসের কাছে এসে খাড়ায়, বাপ মরা অরক্ষিত মেয়ে সে, এবং খরকোল তার সঙ্গে ভাব করে; প্রতিমা হয়তো খরদা-গহিরা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়ে, সে খরকোসের নাম কুতুবমিনার শুনে খুব মজা পায় এবং সে হয়তো খরকোসকে বলে যে, কুতুবমিনারতো কুতুবউদ্দিন আইবেক বানাইছে, প্রতিমা হয়তো সমাজপাঠ বইয়ে এইসব পড়ে, সুলতান মোহাম্মদ ঘুরির মৃত্যুর পর ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে তাহার সেনাপতি কুতুবউদ্দিক আইবেক নিজেকে দীল্লির সম্রাট বলিয়া ঘোষণা দেন। এইসব কথা শোনার পর খরকোস পাতলা গামছার তলায় প্রতিমার নবীন স্তনের দিকে তাকায়া বিহ্বল হয়া যায়, সে বলে, আঁই তুয়ারে লই ভাগি যাইয়াম গৈ!

তখন আরতি ফিরা আসে এবং খরকোস তাকে বোঝায় যে, এইবার তারা মাছ ধরতে অনেক দূরে যাবে, ফলে আরতিকে সে নিয়া যেতে পারবে না, পরের বার নিয়া যাবে; পঞ্চাশ টাকা উপার্জন করতে না পারায় আরতির মন খারাপ হয়া যায়, কিন্তু খরকোস এই প্রথম কুতুবউদ্দিন আইবেকের নাম জানতে পারায় এবং তার মনে তখনো বালিকা প্রতিমার স্মৃতি জেগে থাকায় সে আরতির মুখের দিকে তাকায়া একটা নোট আগায়া দেয়। জানেআলম এবং তার মাঝিদের জানা ছিল যে, খরকোসের আরেক নাম কুতুবমিনার, কিন্তু তাদের কুতুবউদ্দিন আইবেক সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না, থাকার কোন কারণ নাই, ফলে তারা দুর্ভাগ্যক্রমে খরকোসের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র পাকায়; সেদিন আরতি এবং প্রতিমার কাছ থেকে বিদায় নিয়া খরকোস ফিরা আসার পর তারা রাইত একটু গভীর হলে নোঙ্গর উঠায়, হোল্ডের ভিতরে সারের বস্তা এবং পাটাতনের উপরে অকটেন তেলের তিনটা ড্রামের ওজনে ট্রলার টলমল করে, তার উপরে সামনের দিক ছাড়া পুরা ট্রলার ধূসর রঙ্গের তিরুপল দিয়া ঢেকে বেন্ধে দেওয়া হয় কেমোফ্লেজ হিসাবে, বাইনোকুলার লাগায়া দেখলেও বুঝতে পারা কঠিন হবে যে, পানির উপরে একটা জ্যান আছে, তিরপলের কারণে র‍্যাডারও ব্যর্থ হবে। জানেআলমের ভয় কোস্টগার্ড এবং নৌবাহিনীকে, তবে আল্লার দরিয়া বিরাট বিশাল আর নৌবাহিনীর ছটফটানি মাত্র দুই/চাইরখান জাহাজ নিয়া, ফাইট তেমন হয় না, জানেআলম দুই/চাইর বার পাওয়া খায় নাই তা না, খাইছে, কিন্তু সে এম ভি মায়ের দোয়া-কে পানির সঙ্গে মিশায়া দিয়া বাংলাদেশের জলসীমার ভিতর থেকে বার্মার এলাকায় বের করে নিয়া গেছে, ফলে নৌবাহিনীর জাহাজকে খাড়ায়া পড়তে হয়েছে, জানেআলম, শমসু এবং জাকির তখন ছাদে চড়ে হাত নাড়ায় বলেছে, বাই বাই, টাটা! ফলে জানেআলমের মনে বেশি ভয় ছিল না, তবুও সব সতর্কতামূলক প্রস্তুতি নিয়া তারা রওনা হয়, এবং খরকোস তিরপল দিয়া চাইরদিক ঢাকা একটা অন্ধ গুহার মত ট্রলারের ভিতরে জাকির এবং শমসুর সঙ্গে বসে থাকে। হয়তো ট্রলার সারা রাইত চলার পর তারা বাংলাদেশের পানিসীমার প্রান্তের কাছে যায়া পৌছায়, এবং তখন সারা রাইতের পেশাব পেটে জমে খরকোসের ঘুম ভেঙ্গে যায়, এবং সে শোনে যে, জানেআলম এবং দুইজন মাঝি জেগে আছে, তারা নিচু গলায় কথা বলে, এবং এভাবেই খরকোস ভাগ্যের জোরে তাদের ষড়যন্ত্রের কথা জেনে যায়; এই তিনজন ট্রলারে মেয়ে মানুষ ওঠানোর কথা ভোলে না, তারা ঠিক করে যে, খরকোসের হাত পাও বেন্ধে পানিতে ফেলে দেবে এবং ফিরা যায় আব্দুল ওদুদ চৌধুরিকে বলবে যে, খরকোস পা ফসকায়া পানিতে পড়ে গেছে। কিন্তু খরকোসতো ঘুমের ভান করে সব শুনে ফেলে, তখন সে দ্রুত অন্ধকারের মধ্যে শুয়ে থেকে দুই/তিনটা কাজ করে, প্রথমে সে পা লম্বা করে পায়ের কাছে পড়ে থাকা এক বান্ডিল দড়ি পায়, সেটা সে হাতের কাছে টেনে আনে এবং কাছেই শুয়ে থাকা শমসু এবং জাকিরের কাছে গড়ায়া যায় তাদেরকে এমনভাবে জড়ায়া ধরে যেন সে ঘুমের ভিতরে তলায়া আছে, কি সে এই জাপ্টাজাল্টির সময় দড়ি তাদের প্যান্টের বেল্টের লুপের ভিতরে ঢুকায়া বের করে অনে এবং কাছের একটা খুঁটার সঙ্গে বান্ধে, সে আবার গড়ায়া ট্রলারের একপ্রান্তেযায়, শমসু এবং জাকির কিছুই খেয়াল করে না, জানেআলমতো হাল ধরে রাখাতেই ব্যস্ত থাকে তখন খরকোস ট্রলারের ইয়ানমার ডিজেল ইঞ্জন স্টার্ট দেওয়ার তিন বেঁকা লোহার ডাণ্ডা অন্ধকারের ভিতর উঠায়া নিয়া এক বাড়িতে জানেআলমের খুলি ফাটায়া ফাঁক করে দেয়, শমসু এবং জাকিরও জানে বাঁচে না, বিপদ বুঝতে পেরে উঠে দৌড় দিতে যায়া দেখে যে তারা এক জোড়া ছাগলের মত বান্ধা পড়ে আছে এবং তারা দড়িতে বান্ধা ছাগলের মত মারা পরে, খরকোস তাদের পিটায়া মারে। তখন সাগরের বুকে ভোর হয়া আসে এবং এম ডি মায়ের দোয়া যখন। টেকনাফের কাছ দিয়া পার হয় তখন আব্দুল ওদুদ শেষবারের মত নেটওয়ার্ক পায়, মরে ভেটকায়া থাকা জানেআলমের পকেটের ভিতরে মোবাইল বাজে কিন্তু খরকোস ভয়ে ধরে না, তারপর আবার বাজে কিন্তু খরকোসতে জানে ওদুদ চৌং-এর ফোন এটা, সে আবার ভয়ে ধরে না, তারপর আবার যখন ফোন বাজে মরা জানেআলমের পকেট থেকে মোবাইল বের করে খরকোস খবর দেয় যে, নেভির আক্রমণে তিনজনই খতম, সে। একা বেঁচে আছে, ট্রলার এবং মাল তার হেফাজতে নিরাপদে আছে, অই চালাই লই যাইত পাইরগম, সে বলে। তখন আব্দুল ওদুদ চৌং-কে অনেক কিছু করতে হয়, সে আকিয়াবে আইএসড়ি ফোন করে কথা বলে, এবং তারপর পুনরায় মোবাইলে খরকোসকে বলে যে, তার ভয় নাই, তার রাস্তা চেনা লাগবে না, হুইলটা ধরে রেখে ট্রলার সোজা পুবদিকে চালালেই হবে, আব্দুল ওদুদ তাকে ট্রলারের মাথায় একটা কিছুর সঙ্গে একটা পতাকা বেন্ধে দিতেও বলে, বার্মার পাট্টি তাকে চিনে বের করে নেবে; খরকোস এই সবকিছুই ঠিকঠাক মত করে। ফলে মাল বুঝে পাওয়ার পর ওদুদ চৌংয়ের আকিয়াবের বন্ধুরা পাকা বার্মিজ মাঝিমাল্লা দিয়া ট্রলার গহিরায় পৌছায়া দেয়, এবং আব্দুল ওদুদ চৌধুরি নিজে উপস্থিত থেকে এম ভি মায়ের দোয়ার প্রত্যাগমন প্রত্যক্ষ করে, ট্রলার বঙ্গোপসাগরের পানি থেকে সাঙ্গু নদীর ভিতরে ঢুকে স্পিড কমায়া দিয়া ভটভট করতে করতে এসে পাড়ে ভেড়ে, বড় একটা জানালা দিয়া যখন খরকোস মাটিতে লাফায়া নামে, আব্দুল ওদুদ যায় তাকে জড়ায়া ধরে এবং সে ঘোষণা করে যে, এম ভি মায়ের দোয়ার সারেঙ হবে কুতুবমিনার খরকোস, এবং তার দ্রুত নৌচালনা বিদ্যার্জনে সহায়তার জন্য আব্দুল ওদুদ তার তিন ট্রলারের সবচাইতে অভিজ্ঞ মাল্লা আজিজাকে নিয়োগ করে, ফলে সাড়ে চৌদ্দ কিংবা পনের বছর বয়সে তার দখলে চলে আসে এক রাজত্ব, এবং দুইটা নারী-আসিয়া এবং আরতি। তবে আজিজ্যা হয়তো খরকোসকে চিনতে পারে না, কিংবা হয়তো চিনেও না চেনার ভান করে, সে জিগাস করে, ইবা খন? তখন কুতুবউদ্দিন আইবেক বলে যে, সে আইবেক, সে আজিজার কাছে জাহাজ

চালনা বিদ্যা শিক্ষা করতে চায়, অনে আঁর উস্তাদ, এবং আজিজার প্রশিক্ষণে সহসাই মামুন ওরফে খরকোস ওরফে কুতুবমিনার ওরফে কুতুবউদ্দিন আইবেক পাকা নাবিক হয়া ওঠে; সে চাইর বছর গহিরায় পড়ে থাকে, সাতকানিয়া যাওয়ার নাম করে না, এর মধ্যে পেটের অসুখে আরতি দাসী মরে যায়, প্রতিমার বিয়া হয় বাঁশখালির জলদি গ্রামে, এবং তখন সে ছুতার মিস্ত্রি ডেকে একটা কাঠের সিংহাসন বানায়, পিছনটা উঁচা করে সেখানে বানানো হয় তিনটা তারা—একটা উপরে, দুইটা দুই সাইডে-এবং দুই হাতলের মাখায় দুইটা হাঁ করা সিংহের মুণ্ডু, হাতল এবং মাথার পিছনে সোনালি রঙতার পাত বসায়া মোড়ায়া দিয়া মিস্ত্রি সিংহাসন বানানোর কাজ শেষ করে। জিনিসটা খরকোসের খুব পছন্দ হয়, খরকোস সিংহাসনটা মায়ের দোয়া-র সামনের ছোট্ট খোলা ডেকের উপরে নিয়া পাতে এবং এর পায়া দড়ি দিয়া পাটাতনের সঙ্গে বেন্ধে দেয়, জাহাজ যখন বঙ্গোপসাগরে সুন্দরবনের দক্ষিণ বরাবর সোয়াচ অব নোল্যান্ড-এর দিকে ছোটে কিংবা যায় কক্সবাজার থেকে সামান্য দূরে দক্ষিণের মৎস ক্ষেত্র-এর দিকে, খরকোস কখনো ট্রলারের হুইল তার সহকারী মোজাফফরের হাতে ছেড়ে দিয়া ডেকের উপরে রাঙতা লাগাইনা সিংহাসনে যায়া বসে, বাতাস তার কানের পাশ দিয়া হুহু করে বয়, চুল নিয়া বাইড়াবাইড়ি করে, খরকোস দূরে কোথাও কোন মাছের ঝাঁকের খোঁজে দিগন্ত রেখার দিকে তাকায়, তারপর সে যখন দেখে যে, কোথাও সাগরের বুকের উপরে অনেক গাঙচিল ওড়াউড়ি করে এবং বুঝতে পারে এইখানে মাছ আছে, তখন এম ভি মায়ের দোয়া-র মাঝিরা লম্বা জাল পানিতে ফালায়া দেয়, জাহাজের সাইড দিয়া প্লাস্টিকের ফ্লোটগুলা একটা বিরাট মোতির মালার মত লম্বা হয় পানির উপরে ছড়ায়া যায়, এবং জাহাজ যায়া পড়ে মাছের আঁকের মধ্যে, তখন একদিন সে সাতকানিয়া ফিরা আসে, ডলি আক্তারের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে, অলে ক্যান আছন আম্মা? তাকে পুকুর পাড়ের টিনের ঘরে আবুইল্যার সঙ্গে থাকতে দেওয়া হয় এবং তখন বিকাল বেলা আসমানতারা সাতকানিয়া বালিকা বিদ্যালয় থেকে ফিরা আসলে তার সঙ্গে দেখা হয়, মোচঅলা লোকটাকে দেখে আসমানতারা প্রথমে চেনেই না, ইবা খন?

: আঁই কুতুবউদ্দিন আইবেক।
কিন্তু এই নামে আসমানতারা কাউকে চিনতে পারে না, পারার কোন কারণ নাই, সে বলে, কুতুবউদ্দিন আইবক, ইবা খন?
: আঁই খরকেসি!

০৮. আসমানতারা বড় হয়েছে

তখন আসমানতারা তাকে চেনে, আসমানতারা বড় হয়েছে, সে সালোয়ার কামিজ পরে, বুকে ওড়না জড়ায়, তার আগের বালিকাভাব নাই এবং সে ভোলে না যে, সে ওদুদ চৌংয়ের মাইয়াপোয়া, ফলে সে এখন খরকোসকে দেখে তার ছোট্ট নাকটা ইকটু কুঁচকায়া ফালায় এবং বলে, অ তুই খরকোস, খরকোস ন খদ্দে কিয়া, তুই কথে আইবক হইয়োদুদে!

খরকোস যখন তাকে বলে যে, কুতুবউদ্দিন আইবেক দীল্লির বাদশাহ ছিল, ইবায় দাস রাজবংশ খায়েম কইরগিল দে; তখন আসমানতারা বলে, আঁই জানি, তুই কন বাশা হইয়োছ? আসমানতারার সঙ্গে খরকোস পেরে ওঠে না, তখন আব্দুল ওদুদ চৌধুরির ট্রলার বহরে দুইটা নতুন স্টিল বড়ি জাহাজ যোগ হয়, নাম রাখা হয়, এম ভি খোদার দান এবং এম ভি খোদার রহমত, এবং ডলি আক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে আব্দুল ওদুদ চৌং তার ফ্ল্যাগশিপ জাহাজ এম ভি খোদার দান-এর হেড সারেঙ বানায় আঠারো/উনিশ বছরের খরকোসকে; খরকোস ওরফে কুতুবউদ্দিন আইবেক খুশি হয়, কিন্তু তার এম ভি মায়ের দোয়া ছেড়ে আসতেও খারাপ লাগে, তবে সে সঙ্গে করে তার রাঙতা মোড়ানো কাঠের সিংহাসনটা নিয়া আসে, নতুন জাহাজের হুইলঘর মাথার উপরে দোতলায়, এই কেবিনের পাশে খোলা ব্রিজের উপরে সে সিংহাসনটা পাতে, পায়ায় ইস্কুপ মেরে ডেকের সঙ্গে লাগায়া দেওয়া হয়, মাস্তুলের ডগায় নেভিগেশন লাইটের নিচে লাল এবং হইলদা রঙ্গের দুই টুকরা কাপড় পতাকার মত ওড়ে। তখন হয়তো একবার সোনাদিয়ার কাছে খোদার দান নেভির ধাওয়া খায়, নেভির উৎপাত ইদানিং বেশি, সঙ্গে আছে কোস্টগার্ডের যন্ত্রণা, কোস্টগার্ডকেই খরকোসের বেশি ভয়, কারণ নেভির জাহাজগুলা বেশিরভাগ আকারে বড়, দূর থেকে দেখেই সাবধান হওয়া যায়, কিন্তু কোস্টগার্ড হালারপোতেরা ছোট গানবোট নিয়া ঘোরে, দেখাই যায় না, কাছে আইসা কামানের নলের উপর থেইকা কাপড় সরায়া ভো-ফিনিস! সেইদিনও হয়তো খোদার দান-এর পাটাতনের উপরে এবং খোলের ভিতরে অকটেন আর সার ছিল, বার্মিজদের সারের এবং অকটেন তেলের চাহিদার শেষ নাই, মনে হয় তারা সার খায় অকটেন পান করে, এইসব মালের একটা অংশ আরাকানের ভিতর দিয়া হয়তো ইন্ডিয়ার ত্রিপুরায়ও যায়, ফলে প্রচুর ব্যবসা, তখন এম ভি খোদার দান-এর ব্রিজের উপর থেকে কুতুবউদ্দিন আইবেক কোস্টগার্ডের টহল জাহাজটাকে দেখে, সে নিশ্চিত হয় যে, কোস্টগার্ডও তাকে দেখে ফেলেছে, ফলে লুকানোর পথ বন্ধ এবং একমাত্র উপায় পালানোর চেষ্টা করা, কোস্টগার্ডের জাহাজের গতি বেশি হলেও গভীর উত্তাল সাগরে জাহাজ চালানোর দক্ষতাও পালানোর সুযোগ করে দিতে পারে, এবং খরকোস তাই করে। কোস্টগার্ডের জাহাজ থামার জন্য ওয়ার্নিং শট ছোড়ে, ভুম্ ভুম, কিন্তু এইখানে কি থামা যায়? সে খোদার দান-কে থামায় না, যা থাকে কপালে, ফলে কোস্টগার্ডের মেশিন গানের গুল্লিতে উপরের হুইল রুম ঝাঝরা হয়, কামানের গোলা মাস্তুল ভাঙ্গে, তিরপল ছিঁড়া ফালাফালা করে, কিন্তু দীর্ঘ দৌড়ের পর খোদার দান বেঁচে যায়, এবং নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাওয়ার আগে সে আব্দুল ওদুদকে জিপিটুজিপি মোবাইলে ফোন করে বলে যে, কোস্টগার্ড গুল্লি করে হুইলরুম ফুটা করে মাস্তুল ভেঙ্গে দিয়েছে, তবে জাহাজের আর কোন ক্ষতি হয় নাই, এখন সব ঠিক আছে। আব্দুল ওদুদ চৌধুরি হয়তো তখন তার বাড়ির বসার রুমে ছিল, সে সব শুনে বলে, আলহামদুলিল্লাহ, এবং তখন–আসমানতারা আসে, সেতো আদরের মাইয়াপোয়া, সে তার বাপকে জিগাস করে, ক্যান হইয়্যেদে আব্বা? কিন্তু আব্দুল ওদুদ সওদাগর মেয়েকে এত কথা বলতে পারে না, আসমানতারা যদি জানতে পারে যে, সে মহা এক স্মাগলারের মেয়ে সে হয়তো কেন্দেই দেবে, তার এমন ফুলের মতো জীবন শেষ হয়া যাবে, সে হয়তো খাওয়া বন্ধ করবে, তার বাপ সাধবে, মা সাধবে, সে খাবে না; তারপর যখন পেটে চিনচিন শুরু হবে তখন সে খাবে এবং বলবে, ঠিক আছে, স্মাগলারই ভাল, বাংলাদেশে কার দাম আছে? কারো নাই, সাতকানিয়া গার্লস হাই স্কুলের ক্লাস সেভেনের ইচা মাছের মত চঞ্চল ছাত্রীরা এইসব গল্প মারে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারে কয় টাকা বেতন পায়, ফকির হল! তারা এদেরকে বিয়া করবে না, আসমানতারার মনে হয়েছিল সে বিসিএস এ্যাডমিন ক্যাডারের অফিসারকে বিয়া করতে পারে, যুদি তার বাপ একটা যোগড় করে আনে ভাল হয়, এ্যাডমিন ক্যাডারের অফিসারদের ডাট আছে, ইউএনওর বৌয়ের কি হাবভাব, সাতকানিয়া গার্লস স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের নতুন ল্যাবরেটরি উদ্বোধনের ফিতা কাটতে এসেছিল একদিন, ফিতা কাটার পর সকলে ভাবি ভাবি করে অস্থির হয়া গেল, তার সামনে সরবতের গ্লাস ধরা হলো, আঙ্গুরের প্লেট ধরা হলো, কাপে চা ঢেলে দেওয়া হলো, কিন্ত্র সে খেল না কিছুই, না ভাই আমার অসুবিধা আছে, সে বললো এবং একটু থেকে ইউএনওর জিপে উঠে চলে গেল; আসমানতারা কোন এক ইউএনও-কে বিয়া করবে, অবিবাহিত ইউএনও না পেলে কোন এক এসি ল্যান্ডকে, যে পরে ইউএনও হবে, তাদের একজনকে তার বাপ কি খুঁজে বের করতে পারবে না যুদি চিটাগাংয়ে মেয়ের বাপের বাড়ি আছে বলে, কিংবা ঢাকায়—তার বাপতে ঢাকায় একটা বাড়ি কিনতেই পারে-তখন কি রাজি না হয় পারবে? এবং তখন লোহাগাড়া কিংবা চন্দনাইশে যদি তার এই স্বামীর পোস্টিং হয়, সেও ফিতা কাটবে এবং কেউ খেতে বললে খাবে না, বলবে, না ভাই আমার অসুবিধা আছে, এবং সে তার স্বামীর সরকারী জিপ নিয়া সাতকানিয়া বেড়াইতে আসবে, তখন তাকে দেখে তার স্কুলের বান্ধবীরা ফিট হয়া যাবে। কিন্তু তার বাপের বসার ঘরে সাতকানিয়া উপজেলার এসি ল্যান্ডিকে দেখে তার সেই শখ শেষ হয়া যায়, তার বাপ এই তরুণ এসি ল্যান্ডকে ধমকাচ্ছিল, আপনে খামাখাই এত কথা বলছেন। কেন, বাজারের বড় পুকুরটা আপনে আমার নামে করে দেন যে, আর ঝামিলা করিয়েন না; এইসব ধমক খাওয়া লোকদের আসমানতারা বিয়া করবে না, ফলে স্মাগলার নিয়া আসমানতারার অত শুচিবাই ছিল না, তারপরেও মেয়ের কাছে বাপের একটা লজ্জার ব্যাপারতো থাকতে পারেই, তাই আব্দুল ওদুদ আসমানতারাকে বলে যে, খরকোস ফোন করেছিল, সে জাহাজ নিয়া হক্‌সোবাজার যাচ্ছে, এবং তখন টেকনাফের অদূর দিয়া মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পার হতে হতে খরকোসের জানেআলম বধের কথা মনে পড়ে, সেদিন লোহার ডান্ডার বাড়ি খায় তার মাথার ঘিলু বের হয়া গিয়েছিল আলু ভর্তার মত, জাকির এবং শমসুর মাথা, পাঁজর এবং হাতপাওয়ের হাড়িগুড়ি ভেঙ্গে মেসমার হয়া গিয়েছিল, সেইদিন টেকনাফের কাছ দিয়া যেতে যেতে সে সাগরে ফালায়া দিয়েছিল তিনটা লাশ। খরকোস খোদার দানকে একটা পাগলা ঘোড়ার মত পানির উপর দিয়া দৌড়ায়া নিয়া যায়, তখন ওদুদ চৌধুরির সঙ্গে কথা শেষ হয়া গেলে সে তার পকেটে মোবাইল রেখে দিয়া দূরে বার্মার তটরেখার দিকে তাকায়, কত কাছে মনে হয় ভূমি, কিন্তু তবু কত দূরে; তখন আসমানতারার কথা তার মনে পড়ে, তুই কতুথে বাশো হইয়োছ দে ওড়া? ফলে ওদুদ চৌধুরি যখন ফোন করে তাকে একদিন বলে, আইবেক তুই সাতকাইন্না আসবি কবে? তাকে আইবেক বলে ডাকায় খরকোস খুশি হয়, সে বলে, কিয়া, কোনো খাম আছে না? অবশ্যই খরকোস ক্রমে আব্দুল ওদুদের প্রিয় হয়া . উঠেছিল, তবে খরকোস যে আইবেক হয় যাবে ভাবাই যায় নাই, ডলি আক্তার হয়তো আব্দুল ওদুদকে বলে যে, পোলাটা খুবই কাজের, এবং তখন হয়তো বার্মায় তার ব্যবসা সংক্রান্ত কোন জটিলতা নিয়া আব্দুল ওদুদ তার পুত্রদের পাশাপাশি আইবেকের সঙ্গেও পরামর্শ করতে চায়। তখন আইবেক আসে, রাইতের বেলা ডাইনিং টেবিলের পাশেই ফ্লোরের উপরে মাদুর পেতে তাকে ভাত দেওয়া হয়, ডলি আক্তার কাছে বসে থেকে খাওয়ার তদারকি করে এবং তখন আব্দুল ওদুদ তার সঙ্গে কথা বলে, খরকোস হয়তো শোনে, অথবা হয়তো ভালমত শোনে না, সে ডলি আক্তারের দিকে তাকায়া থাকে, মায়ের মত এই মহিলা কত আদর দেয় তাকে, কি এই মহিলা আসলে তার কে? তারপর সে ওদুদ চৌধুরিকে বলে, আপনে একদিন গহিরায় আসেন না কেন, আম্মা আর ভাইজানদের নিয়া আসেন, সাগরের গভীর ভিতর থেইকা ঘুরায়া আনবনি, আপনেতো খোদার দান-এ একদিনও চড়লেন না। ডলি আক্তারের প্রস্তাবটা খুব পছন্দ হয়, নভেম্বর/ডিসেম্বরে আসমানতারা এবং আব্দুল ওহাবের স্কুলের পরীক্ষা হয়া গেলে তারা এম ভি খোদার দান-এ চড়ে বঙ্গোপসাগরে প্রমোদ ভ্রমণে যাবে, তখন শীতের দিনে আবহাওয়াও ভাল থাকবে। মনে হয় যেন, বিষয়টা ভাগ্যের লিখন হয়া দাঁড়ায়, আব্দুল ওদুদ এবং তার পরিবার ডিসেম্বরের শেষে পৌষের ১২ তারিখে সমুদ্র বিহারে যায় এবং তারা ডুবে মরে, শুধু অসমানতারা সকলের সঙ্গে যেতে পারে না বলে বেঁচে যায়। গহিরা যাত্রার সকালে এককাপ চা খেয়ে রহস্যজনকভাবে তার পেট খারাপ হয়, এতটাই খারাপ হয় যে, তাকে বারে বারে পায়খানায় দৌড়াইতে হয়, সে বলে, আঁই ন যাইয়ুম; ফলে আয়োজন বাতিল হওয়ার উপক্রম হয়, কিন্তু আসমানতারা বলে যে, সে একা থাকতে পারবে, তখন ডলি আক্তার রাজি হয় এবং খরকোস বলে যে, তারা ফিরা আসতে পারবে বিকালেই, অসুবিধা হবে না। তারা সেইদিন খুব সকালে রওনা হয় এবং মোটর গাড়িতে করে দোহাজারির ভিতর দিয়া গহিরা পৌছায়,তখন বেলা দশটার দিকে এম ভি খোদার দান দড়ি খুলে রওনা হয়, তারা দক্ষিণের পথ ধরে, তারপর মহেশখালি বরাবর পশ্চিম দিকে মুখ ঘুরালে ট্রলার গভীর সমুদ্রের দিকে আগায়া যায় এবং তখন পিছনের দিগন্তে মহেশখালির রেখা মিলায়া যাওয়ার পর তারা গানবোটটা দেখে, মনে হয় সেটা তাদের জন্য অপেক্ষা করে ছিল; কিন্তু ট্রলারে সন্দেহজনক কোন কিছু না থাকায় ভয়ের কিছু ছিল না, তবুও আইবেক কিংবা খরকোস হয়তো ভয় পায়া কাণ্ডজ্ঞান হারায়া ফালায়, সে ট্রলারের মুখ ঘুরায়া পালাইতে থাকে, আব্দুল ওদুদ উপরে হুইল ঘরে বসে এইসব দেখে এবং বলে, ইন ক্যান করদ্দে ওভা?

তখন আইবেক বলে, চঅন না!

কিন্তু এইবার গানবোর্টের গতির সঙ্গে খোদার দান পারে না, কোস্টগার্ড তাদের ধরে ফেলতে থাকে, তারা ওয়ার্নিং শট ছোড়, কিন্তু খরকোস থামে না, তখন ওদুদ চৌধুরি এবং তার পরিবার নিচে নেমে জাহাজের হোল্ডের ভিতরে যায় আশ্রয় নেয়, এবং খরকোস মাষ্টার সারেঙের সিটের গদির তলা থেকে একটা স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র বের করে কোস্টগার্ডের গান বোট লক্ষ করে গুলি ছোড়ে, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার ফলে তখন তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়া যায়, কোস্টগার্ড নিশ্চিত হয় যে, দুবৃত্ত ভেসেলটা সশস্ত্র এবং কোন দুষ্কর্মে লিপ্ত, তারা এবার সরাসরি টার্গেটের দিকে কামানের নল ঘুরায়, প্রথম গোলাটা হুইল কেবিন উড়ায়া দিলে খরকোস একটা বয়া নিয়া ট্রলারের এক সাইডে ঝুলে পড়ে এবং এভাবে আবার গুলি চালায়, ফলে কোস্টগার্ডের গানবোট টার্গেট ধ্বংস করার ব্যবস্থা করে, কামানের গোলায় এম ভি খোদার দান ছিন্নভিন্ন হয়া যায়, ট্রলারের সঙ্গে পানির নিচে হারায়া যায় আব্দুল ওদুদ চৌং এবং তার স্ত্রী ও ছেলেরা-কেবল সাতকানিয়ায় আসমানতারা বেঁচে থাকে। সেই দিন সন্ধ্যায় টেলিভিশনের খবরে আসমানতারা ট্রলার ডুবি এবং চোরাচালান দলের সলিল সমাধির খবর পায়, তারপর গহিরা থেকে মায়ের দোয়া কিংবা তাদের অন্যকোন ট্রলারের কর্মচারি ফোন করে জানায় যে, এম ভি খোদার দান ডুবে গেছে, এই জাহাজে ওদুদ চৌধুরি এবং তার পরিবার ছিল, আসমানতারার জীবনের গতি তখন থেমে যায়, তার বাপের সংসার ছত্রখান হয় ভেঙ্গে পড়ে, তখন তিনদিন পরে আইবেক কিংবা খরকোস এসে হাজির হয়, এম ভি খোদার দান-এর একমাত্র সে রক্ষা পায়, সে হয়তো কোস্টগার্ডের চোখ ফাকি দিয়া কোন বয়া টয়া কিংবা ভাঙ্গা কাঠের কোন টুকরা ধরে সাগরে ভেসে যায় জীবন বাঁচায়, খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার হলেও এরকম হতেই পারে; তখন কেসি তিন দিন ধরে অর্ধবেহুশ আসমানতারার মাথার কাছে বসে মাথায় জলপট্টি লাগায়, আসমানতারার অবস্থার কিঞ্চিত উন্নতি হয় এবং খরকোস গহিরায়, তার ঘাটি গুটায়া সাতকানিয়ায় এসে পড়ে। সাতকানিয়ায় খরকোসের বসবাস শুরু হয়, আব্দুল ওদুদের দালানের ভিতরে আসমানতারা থাকে এবং টিনের ঘরে থাকে খরকোস, আসমানতারার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়া যায়, বাইরের লোক আর তাকে দেখে না, আব্দুল মাবুদ হয়তো ঢাকা থেকে আসে, কিন্তু আসমানতারার সঙ্গে তার দেখা হয় না, খরকোস তাকে দালানের ড্রয়িং রুমে বসায়া আপ্যায়ন করে এবং বলে, ইবার শরীর গম নয়, ফলে আব্দুল মাবুদ চৌধুরি খরকোসের দেওয়া তিন বস্তা টাকা নিয়া ফিরা যায়, আর এইমুখো হয় না; তখন আসামনতারার সঙ্গে খরকৌসের দেখা হয়, কিম্ভ তাদের কথা হয় না, খরকোস চাকরানিকে হুকুম দেয় ব্লেন্ডারে আঙ্গুরের রস বানায়া দেওয়ার জন্য, চাকরানি রস করে দিলে আসমানতারা খায়। আসিয়া বুয়াকেও খুঁজে বের করে আনা হয়, খরকোস তাকে আসমানতারার। সার্বক্ষণিক দেখাশোনার কাজে লাগায়, তারপর একদিন ঘরে একা খরকোস আসে এবং আসমানতারা তাকে বলে, আইবেক আঁরে তুই ম মারো কিয়া? খরকোস এই মেয়ের মুখের দিকে তাকায়া থাকে, কেন্দে কেন্দে ফেকাসে এবং দুর্বল হয়া গেছে তার শরীর, তখন বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে সে পড়ে যেতে থাকে এবং খরকোস তাকে একটা শিশুর মত দুই হাতের ভিতরে তুলে নেয় এবং আসমানতারার চোখ দিয়া পানি গড়ায়া নামে, সে বলে, আইবেক আঁরে লই ইত্তার ক্যান করিবাদে?

খরকোস হয়তো কথা হারায়া ফালায়, সে জানে আসমানতারা কিছুদিন গেলে সুস্থ হয়া উঠবে, সুস্থভাবে চিন্তা করতে পারবে, এবং তখন এইসব কথা সে বলবে না, ফলে আসিয়া বুয়া তাকে বেদানার রস বানায় খাওয়ায়, মুরগির সুপ খাওয়ায়, কিন্তু আসমানতারার সুস্থ হতে দেরি হয় এবং খরকোস মোবাইলে আব্দুল ওদুদের চট্টগ্রাম শহরের কর্মচারিদের সঙ্গে কথা বলে, গহিরার কাজ কারবার ম্যানেজ করে, কিন্তু তার অস্থিরতা ক্রমাগত বাড়ে এবং দ্রিাহীনতা দেখা দেয়, সে টিনের ঘরের ভিতরে বসে অপেক্ষা করে, কিন্তু আসিয়া বুয়া কোন আশার বাণী বয়া আনে না। আসিয়ার হয়তো খরকোসের প্রতি ক্ষোভ ছিল, কিন্তু তার নারীর মন দ্রুত দ্রবীভূত হয়, খরকোসের জন্য তার খারাপও লাগে, খরকোসতো তাকে ভোলে নাই; ফলে সে আসমানতারাকে খরকোসের বিষয়টা বোঝায়, এই খরকোস কি তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় ছিল না। ছিল না কি? এবং আসমানতারার এই কথা স্বীকার না করে উপায় থাকে না, ফলে কোস্টগার্ডের হাত থেকে বেঁচে আসা খরকোস সেইদিন রাইতে গলায় দড়ি বেন্ধে আসমান তারার ঘরে প্রবেশ করে তার খাটের কাছে ফ্লোরের উপরে যায় বসে এবং গলা পর্যন্ত চাদর টেনে শোয়া আসমানতারার দিকে দড়ির মুক্ত প্রান্তটা বাড়ায়া ধরে, তখন আসমানতারা জুরে জান্নাত স্নানভাবে হাসে, সে দড়িটা হাতে নিয়া বলে, ক্যান কইরগম? খাঁচা খডে?

তখন পুকুরের কিনারা থেকে রইদবৃষ্টিতে কালা হয়া যাওয়া খরকোসের খাঁচা খুঁজে বের করে এনে আসমানতারার শোয়ার ঘরে দেওয়াল ঘেঁষে পাতা হয়, এবং খরকোস ওরফে কুতুবউদ্দিন আইবেক তার অবলম্বনহীনতা অতিক্রম করে পুনরায় আসমানতারার খরকোসে পরিণত হয়। তখন সেদিন বিকালে কিংবা রাইতে খরকোস এসে আসমানতারার খাটের কিনারায় বসে, তারপর খাঁচার ভিতরে ঢুকে গোল হয়া হাঁটু ভাজ করে শোয়, তার চোখে ঘুম আসে এবং আসমানতারা যায় খাঁচার দরজা বাইরে থেকে লাগায়া দিয়া রাখে এবং তখন ঘটনাটা ঘটে; এম ভি মায়ের দোয়া হয়তো ক্ষেপ নিয়া বার্মা যাচ্ছিল, মোজাফফর হয়তো চালাচ্ছিল ট্রলারটা, তখন খরকোস তার মোবাইলে মোজাফফরের জিপিটুজিপি ফোনটা পায়, মায়ের দোয়া কোস্টগার্ডের হাতে মারা পড়েছে, বাংলাদেশের জলসীমা পার হয়া বার্মায় ঢুকে যাওয়ার পরেও এইদিন হারামির বাচ্চারা বার্মার সীমানায় ঢুকে মায়ের দোয়া-কে গোলা মেরে ডুবায়া দেয়। আসমাতারার ঘরে খাঁচার ভিতরে কুঁজা হয়া শুয়ে থাকা কিংবা তার খাটের কাছে গলায় দড়ি বান্ধা অবস্থায় বসে থাকার সময় তার মনে হয় যে, মায়ের দোয়া ডুবে গেল? এতদিন ছিল, এখন নাই–কে তার মা? এবং তার তখন দুইটা জিনিস মনে পড়ে, তার নাম মামুন এবং তার বাড়ি ঢাকার নারিন্দার ভূতের গল্লিতে, ফলে সে গলার দড়ি এবং খাঁচা ফালায়া ঢাকা রওনা হয় এবং আসমানতারা হতভম্ব হয়া থাকে; হয়তো মিসেস জোবেদা রহমানও খুবই বিচলিত হয়, তার সামনে দেখা দেয়, খুবই কঠিন একটা সমস্যা কিংবা রহস্য, তার যদিও ভাবতে ইচ্ছা হয় যে, এইসবই খৈমনের কাজ, তার কারসাজি, কিন্তু সে বোঝে যে, ষড়যন্ত্র হিসাবে এইটা খৈমনের জন্য খুবই বড় হয়া যায়, ফলে সে ঘোলা চোখে তার সামনে খাড়ানো খরকোস মামুনের দিকে তাকায়া থাকে, তারপর বলে, বাবা আইবেক তুমি কি আমার কতা হুনবা?

: ন হুইম কিয়া? আপনে বলেন যে!

খরকোস তখন মামুনদের বাসার বাইরের ঘরে বসে মামুনের মার কথা শোনে, এবং সে মামুনের মা মিসেস জোবেদা রহামনের মতই বিভ্রান্ত হয়া পড়ে, আপনে এইটা কি বলতেছেন, আমি বুজতে পারতেছি না, এবং মামুনের মা তাকে পুনরায় বুঝায়া বলে, কি দাম আছে করতি কলের কয়েকটা গানজাখোর মূখ কুলির কথার, না বুইঝা না শুইনা তারা কি বলছে তার কি কোন মাথা মুণ্ডু আছে? থাকারতো কোন কারণ নাই, কার পোলারে তারা ভুসির সঙ্গে পাঠায়া দিয়া কার পোলা মনে করে বসে আছে, হয়তো কুতুবউদ্দিন আইবেক অন্য কারো ছেলে, অন্য কারো পোলা, এখন নামহীন ঠিকানাহীন হয়া পড়ছে, ফলে জোবেদা বেগম তার পোলা মামুনকে হারানোর ভয়ে কাহিল হয়া খরকোল মামুন ওরফে কুতুবউদ্দিন আইবেকের দিকে চায়ের কাপ আগায়া দিয়া যখন বলে, মনে করো আমার আরেক পোলা আছিল, তুমি আমার সেই পোলা, আমি তুমার মা, তুমি আমারে মা, ডাইকো, আইবেক গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়া তাকয়াি থাকে, তারপর সে কান্দে, ধুরন্ধর এবং নৃশংস খরকোস ওরফে আইবেকের মানবিক জীবন ভেঙ্গে পড়ে, তার দিকে তাকায়া জোবেদা রহমানের চিন্তা থৈ পায় না, এবং তখন আইবেক উঠে চলে যায়। সেদিন বিজয় নগর রোডের হোটেল আরজুতে যায়া আইবেক আরো কান্দে, তার কান্দা দেখে তার বুড়া খাদেম, পুরান চাকর আবুইল্যা তার মাথায় হাত বুলায়া দেয়, চুচু শব্দ করে তাকে সান্ত্বনা দিয়া বলে, ন হাদিস বাজি, ন হান্দিল, এবং তখন খরকোস কাশী থামায়া বলে, আঁরে একবস্তা ট্যাকা আনি দঅও! আবুল তখন চট্টগ্রামে জিপিটুজিপি ফোন করে নাইট কোচে এক বস্তা টাকা দিয়া যেতে বলে, এবং খরকোস পরদিন বিকালে অর্ধেকবস্তা টাকা দিয়া কাকরাইল থেকে একটা রিকন্ডিশনড় লেক্সাস গাড়ি কিনে ফালীয় এবং নিজে চালায় মিসেস জোবেদা রহমানের বাড়িতে যায় তার সামনে বাকি টাকা উপুড় করে দেয়, আমি আপনের চেলে, সে বলে!

মিসেস জোবেদা রহমানের জন্য এক মহাসঙ্কট তৈরি করে খরকেস, এখানে কত টাকা? আল্লাহ মালুম, সে দিশা হারায়া তাকায়া থাকে, আমি কি করুম তুমি কও?

: আপনে সত্যি করে বলেন আমি কি আপনের চেলে না?

তখন কি বলবে জোবেদা রহমান? তার মায়ের হৃদয় উথলায়, সামনে আজীবন স্নেহ বঞ্চিত বুভুক্ষু খরকোস করুণ চোখে তাকায় এবং পায়ের কাছে মেঝের শানের উপরে ছড়ানো টাকার বান্ডিল, সে কি মামুনুল হাইকে বিসর্জন দিতে পারে না? মামুনুল হাই কি আসলেই তার ছেলে? নাকি খরকোসই তার পোলা, নয়াবাজারে ভুসি আনতে যায় হয়তো আর ফিরা আসে নাই, অন্য কেউ ফিরা এসেছিল, মামুনুল হাই হয়তো অন্য কেউ, এবং কোন গোলেমালে হয়তো তারা বুঝতে পারে নাই-এই রকম কি হতে পারে না? কিন্তু মিসেস জোবেদা রহমান তার মত বদলায় না, পোলাটা তার টিচারের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে, খুবই দুর্বল অবস্থায় আছে সে, এই সময় তাকে ত্যাগ করা যায় না, ফলে মামুনুল হাই বেঁচে যায়, এবং খরকোসের কোন গতি হয় না, সে মিসেস জোবেদা রহমানকে বলে, এই টাকা আপনে নেন, আপনের জনাই আনছি।

: এই ট্যাকা আমি নিয়া কি করুম, আমি কি পোলা বদলামু, আশ্চাইর্য!

খরকোস হয়তো তখন আবার কান্দে, সে মোবাইল টেলিফোনে হোটেল আরজুতে অপেক্ষমাণ আবুইলার সঙ্গে কথা বলে, ওড়া আবুল কাকা, আঁই আইর, আজিয়া আঁরা যাইয়্যুম গৈ!

কিন্তু খরকোস মিঞার যাওয়া হয় না, কারণ মন্দিরের সামনে চানমিঞা হয়তো কোসের ঝকঝকে লেক্সাসটা দেখে, এবং মামুনদের বাড়ি থেকে বের হয়া খরকোস তার গাড়ি খুঁজে পায় না, মন্দিরের সামনে পার্ক করা তার গাড়িটা নাই। এই গাড়ি চুরির ঘটনায় খরকোসের চাইতে জোবেদা বেগম এবং তার পরিবার বেশি মর্মাহত এবং উত্তেজিত হয়া পড়ে, জোবেদা রহমান বলে, খরকোস আমার পোলা না? আমার পোলার গাড়ি চুরি করে কিমুন চোর? তারা খরকোসকে নিয়া সূত্রাপুর থানায় যায়, বড় দারোগা কিংবা ছোট দারোগা সব কিছু শুনে একটা কথা জিগাস করে, একদিন আগে ঢাকা আইসা আপনে একটা লেক্সাস গাড়ি কিনা ফালাইলেন, আপনে কি করেন বলেন তো? তখন খরকোস মিঞার সঙ্কট হয়, কি করে সে? সে তার পকেট থেকে বেনসনের প্যাকেট বের করে দারোগার দিকে মেলে ধরে, কিন্তু বুদ্ধিমান দারোগা নেয় না, বেনসনে এইসব কেসের ফয়সালা হয় না, দেশের এইরকম একজন নাগরিক কি করে ভাত খায় সেটা জানা খুবই জরুরি, সে বলে, আমি সিগারেট খাই না!

: ঠিক আছে, আইজ বিকালে হোটেল সাগরিকায় আসেন যে, মগবাজার মোড়ে।

হোটেল সাগরিকায় বসে সূত্রাপুর থানার দারোগার সঙ্গে খরকোস ঝামেলা মিটায়া ফালায়, কিন্তু দারোগী গাড়ি চোরের বিষয়ে কিছুই জানে না, সে খরকোসকে কোন নির্দিষ্ট সাহায্য করতেই রাজি হয় না, ভাবখানা এমন যে, কেস দিয়া যান দিতে চাইলে, আমরা পরে দেখব; তখন খরকোস তাকে বলে, আপনে চোরটাকে চেনেন?

: আমি গাড়ি চোরকে চিনব কেন!

খরকোসের তখন কিছু করার থাকেনা, সে বলে, ঠিক আছে ছার, আমার গাড়ি লাগবে না, আপনের কিছু লাগলে বলবেন যে, এবং সে সাতকানিয়া ফেরার পরিকল্পনা বাদ দেয়, হোটেল আরজুর ডবগবেডের রুম ছেড়ে দিয়া একটা বড় সুইট নেয়, এবং পরদিন ভূতের গল্লিতে মামুনদের বাসায় এসে হাজির হয়, মামুনের মাকে বলে, আম্মা আপনে ভলি আছেন?

তার এই কথা শুনে মামুনের মা আনন্দে উদ্বেলিত হয়া পড়ে এবং ক্রমে সে ইনায়াবিনায় খরকোসের কাছে চানমিঞা এবং তার বান্দর বাহিনীর কথা প্রকাশ করে; জোবেদা বেগমের কথা শুনে খরকোস মামুন ভাবে যে, বান্দরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কোন জাতের কাম না, ঢাকার মানুষ বড়ই চিড়িয়া, বান্দর নিয়া আছে, বান্দরের লগে ফাইট করে, আমাগো সামনে হোস্টেগার্ড, গানবোট, মেশিনগান, কামান বন্দুক। সে জোবেদা বেগমকে আশ্বস্ত করে, আপনে চিন্তা করিয়েন না, আমার কাছে আবুলকাসেম ফরটিসেভেন আছে, একবার মারলে ফিনিস; কিন্তু সে যখন মামুনদের বাড়ির ছাদে উঠে বন্দিরের হিসাব নেয়, চারদিকে বান্দরের গু দেখে পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারে এবং সে বুঝতে পারে যে, এই চিপা গল্লির মধ্যে বন্দরের মত চঞ্চল টার্গেটের বিরুদ্ধে আবুলকাসেম৪৭এর মত অস্ত্র ব্যবহার করা হয়তো সম্ভব হবে না। তবে প্রথমে খরকোল যখন বলে, সে আবুলকাসেম৪৭ ব্যবহার করবে, তখন আশায় উত্তেজনায় জোবেদা বেগম এবং তার পরিবার অস্থির হয়া পড়ে, এইটা কি বাবা, আবুলকাসেম৪৭?

: আছে একটা জিনিস, খুবই দামি।

কিন্তু পরে যখন খরকোস সিদ্ধান্ত নেয় যে, এই জিনিস সে ব্যবহার করবে না, চট্টগ্রাম থেকে এটা ঢাকায় আনাও ঝামেলা, তখন জোবেদা বেগম এবং তার পরিবার হতাশ হয়, তারা বলে, ব্যবহার না কর, আমাগো একবার দেখাও, আমরা কুনোদিন দেখিনাইকা আবুলকাসেম৪৭, এইটা কেমুন আমরা দেখতে চাই।

: আচ্ছা দেখামু।

কিন্তু খরকোস কোস্টগার্ড/নৌবাহিনীর ধাওয়া খাওয়া লোক, সে এইটা বোঝে যে, বাহিনী খুব খারাপ জিনিস, গাড়ি চোরের খবর নিতে হলে তার বান্দর বাহিনীরও সুরাহা করাই লাগবে, ফলে সে আরজু হোটেলের চাইর তলায় এ-থ্রি নম্বর সুইটে বসে পরিকল্পনা তৈরি করে, ছুতার ডেকে মামুনদের বাসার পিছনের উঠানে ৩x৩ সাইজের তিন/চাইরটা কাঠের ফন্দি বানায়, তারপর সে এবং মিসেস জোবেদা রহমানের দুই ছেলে মিলা ছাদে নিয়া যায়া ফন্দিগুলা পাতে, ভিতারে হরলিকসের বয়াম দিয়া রাখে, কিন্তু বিটলা বান্দরেরা এগুলা ধরে না। তখন খরকোস বিষ মিশায়া লাড়ুর টোপ ছাদের উপরে ছড়ায়া দেয়, বিষ খায়া দুই চাইরটা গেছে ইন্দুর মরে, হয়তো এক/দুইটা কাকও, কিন্তু বান্দরেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, তারা খরকোসের এইসব কীর্তিকলাপ দেখে, হয়তো হাসে, বন্দরেরা হাসতেও পারে, কে জানে, এবং হয়তো তারা ভাবে ঠিক আছে, খাড়াও-ফলে বিষঅলা লা পাতার পরদিন বিকালে পরিস্থিতি দেখার জন্য যখন খরকোস ছাদে ওঠে বান্দরের পাশের বিল্ডিংয়ের সিঁড়িঘরের উপর থেকে তার কাপলি বেড়ায়া একটা আধলা ইটা ছুড়ে মারে, ইটটা উড়ে এসে কিছু বোঝার আগেই তার চান্দির উপরে পরে, ঢাপ, এবং খরকোস স্লো-মোশনে বান্দরের প্রয়ের বিছানায় শুয়ে জ্ঞান হারায়া ফেলে! তবে খরকৌসের। লেল্লাসটার আসলেই পরিণতি কি হয়, বলা মুশকিল, চনিমিঞা নিয়া থাকলে সেটা গাজিপুরের বসুমতি মোটর গেরেজ লিঃ-এর ভিতর ঢোকার পর নিশ্চয়ই হজম হয়া যায়, কিন্তু দিন কয়েক পর মন্দিরের গল্লির মোড়ে চানমিঞাঁকে আর একটা গাড়ির মধ্যে দেখা যায়, হয়তো অরি একটা হোভা-হয়তো একর্ড, সিভিকও হতে পারে-সে গাড়ির ভিতরে বসে তার বান্দর বন্ধুদের নিয়া কলা খায়। তখন লেদু, মোর্টকা ফখরুল আলম লেদু, আসে এবং সে যখন বলে, আমারে তুর গাড়িতে চড়াবি না? চানমিঞা বলে, কৈ যাবি?

লেদুর মাথায় কোন দুর্বুদ্ধি ছিল না, চিকন বুদ্ধির সেইরকম পোলা সে না, মোটা শরীর নিয়া চিকন বুদ্ধি রাখা খুব মুশকিল, ফলে তারা সেদিন ভূতের গল্লি থেকে বের হয়া গৌরের মঠ এবং খ্রিষ্টানদের গোরস্থানের সামনে দিয়া হাটখোলার দিকে যায়, হয়তো তারা যাত্রাবাড়ি দিয়া পোস্তগোলার ব্রিজ পার হয়া মাওয়ার রাস্তায় লং ড্রাইভে যেতে পারতো, তখন বলধা গার্ডেন পার হওয়ার পর লেদু বলে, তুই জানছ এই সামনে কে থাকে?

: টিচার!

: ল যাই দেইখা আহি।

চানমিঞা হঠাৎ করে রাজি হয়, তখন সেই বিকালে কিংবা সন্ধ্যায় নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে জুলি ফ্লোরেন্সের সঙ্গে. চানমিল্লার প্রায় দুই যুগ পরে দেখা হয়, ফখরুল আলম লেদু বলে, চিনো? এবং আশ্চর্য জুলি চিনতে পারে, চানমিঞা?

: আমি মাঙ্কি বয়!

মিসেস মেরি ক্লার্ক ভিতরের ঘরে খাটের উপরে চোখ বুজে শুয়ে ছিল, চানমিঞা কাছে যায়া খাড়ায়া যখন বলে, টিচার আমি চানমিঞা, মেরি জয়েস হয়তো তাকায়া দেখে, কে এই পোলাটা? এবং জুলি অনুমতি দিলে নিচে চানমিঞার গাড়ি থেকে তার বান্দর বন্ধুদের দোতলার ঘরে নিয়া আসা হয়, জংলি বান্দরেরা লাফায়াঝাপায়া জুলি ফ্লোরেন্সের ঘর লন্ডভন্ড করে, জুলি আতকে উত্তেজনায় অস্থির হয়া যায়; এবং যেহেতু বান্দর থাকলে কলা থাকবে, ঘরের ভিতরে তারা সকলে মিলা কলা খায়, চানমিঞা হয়তো একটা/দুইটা কলা জুলির দিকে আগায়া দিয়া বলে, কলা বান্দরেরা খাইতে পারে, মানুষও পারে, নেও, এবং জুলিকে এই কলা নিতে হয়, তার তখন তার মার কথা মনে পরে, বি ওয়্যার অফ …। কিন্তু তার মনে হয়, তখন অনেক দেরি হয়া গেছে, কারণ লেদু কি তাকে বলে নাই যে, খুব ছুটুকালেই সে চানমিঞার দেওয়া কলা খাওয়ার কাজ সাঙ্গ করে রেখেছিল, ফলে জুলির জন্য ইট ওয়াজ টু লেট হয়; সে চানমিঞা, লেদু এবং বান্দরদের সঙ্গে মজা করে কলা খায়, এবং যখন সে চানমিঞাকে বলে, আপনে আসেন না কেন? তখন চানমিঞা আবার আসে, নিচে তার গাড়ি এবং বান্দরেরা থাকে, সে মিসেস ক্লার্কের বাসার ড্রয়িং রুমে বসে জুলির সঙ্গে কথা বলে, আমি টিচারকে ভুলি নাই।

: আপনে এখন কি করেন? হোয়াট ডু ইউ ডু নাউ?

: আমি গাড়ি চুরি করি।

জুলির একদম আক্কেলগুড়ুম হয়।

: হোয়াট?

: আমি গাড়ি চুরি করে বেচি, আমি গাড়ি চোর, কার থিফ; নিচে একটা গাড়ি খাড়ায়া আছে, টয়োটা প্রিন্টার, আইজ সকালে চুরি করছি!

জুলি হয়তো ভাবে যে, চানমিঞা নিশ্চয়ই মশকারি করে, এবং তখন চানমিঞা উঠে চলে যায়; একদিন দুইদিন কিংবা পাঁচদিন পর যখন চানমিঞা আবার আসে জুলি তাকে বলে, আজকে কি গাড়ি চুরি করলেন মিস্টার গাড়ি চোর?

: গাড়ি নাই, রিস্কায় আসছি।

তখন চানমিঞার সামনে এক অন্য জুলি খাড়ায়া যায়, সে বলে, আপনের বান্দর বন্ধুদের আনেন নাই?

: গাড়ি ছাড়া তারা চলতে পারে না।

: কলা আছে পকেটে?

জুলি ফ্লোরেন্স কি এইসব ডেসপারেট হয়া করে? কেন সে ডেসপারেট হয়? চানমিঞা পকেট থেকে দুইটা চিনিচম্পা কলা বের করে তাকে দেয়, যেমন বহুকাল আগে ফাদার আলবার্ট চার্লস ডিসুজা দিয়েছিল কুমারী বিদুন্মালা কিংবা লাবণ্যপ্রভা দাসীকে; জুলি সতর্কতার সঙ্গে কামড়ায়া কলা খায় এবং দেখে চানমিঞা ঘরের কোনার ছায়ার মধ্যে অদৃশ্য হয়া বসে আছে, সে তখন বলে, আমাকে একদিন তোমার গাড়িতে চড়াই চানমিঞা? এবং চানমিঞা ভাবে, সে মাঙ্কিবয়, কার থিফ, তার কোন মায়া নাই এই মাইয়ালোক জুলির জন্য, সে শিকারের জন্য তৈরি হয়, চাকু সে ঢুকায় দেবে কইলজা বরাবর, এবং সে বলে, চড়ামু চড়তে চাইলে, আমি একটা বিএমডাম্বু চুরি কইরা আনুম!

চানমিঞা হয়তো বিএমড়াক্কু গাড়ির কথা প্রথম জানতে পারে বসুমতি গেরেজের আরফান আলির কাছেই, জুলির সঙ্গে কথা হওয়ার পর সে এই গাড়ি সম্পর্কে আরো খোঁজখবর নেয়; আরফান আলি এই লাইনে বিদ্যান লোক, সে চানমিঞাকে সব খুলে বলে, মার্সিডিজ ভাল, তার থেইকা ভাল বিএমড়ায়ু, এইটা জার্মানির তৈরি গাড়ি, খুবই দামি, এককোটিরও বেশি দাম হইতে পারে, ঢাকায় আছে কয়েকটা, একশ/দেড়শ হইবো-কি কার আছে আরফান আলি বলতে পারে না। তখন চানমিঞা বলে,আমার একটা দরকার ওস্তাদ, আপনেরে একটা আইনা দেই?

আরফান আলির আগ্রহ দেখা যায় না, বিএমডারু খায়া ফালানো মুশকিল, হজম করা অসম্ভব, পাবলিক নাই কেনার, এই কামে সব থেইকা ভাল টয়োটা, ফটাফট হাওয়া, আরফান আলি দুইদশটা টয়োটা দিনে ম্যানেজ করতে পারে। কিন্তু চানমিঞার জন্য একটা বিএমডাব্লু পাওয়া একান্ত প্রয়োজন হয়া পড়ে, জুলির বাসায় যেতে হলে এখন বিএমডা ছাড়া গতি নাই, সে কথা দিয়েছে, এখন ইজ্জতের ব্যাপার। তাছাড়া সে জুলিকে একটা টয়োটা কি হোভা কি নিসানে চড়াইতে পারে না, এইগুলা ডাইলভাত গাড়ি, একটা মারুতি-সুজুকি এসটিম কিংবা টাটা ইন্ডিকয়িতো প্রশ্নই আসে না-এইগুলা গাড়ি না, লোহা! তখন চানমিঞার মূল কাজে গাফিলতি দেখা দেয়, সে বিএমডাব্লু-র সন্ধানে ব্যস্ত হয়া থাকে এবং একদিন ঢাকা শেরাটন কিংবা সোনারগাঁওয়ে অথবা গুলশানের লেক শোর কিংবা লেক ক্যাসেলে সে বিএমডাব্লু-র খোঁজ পায়, কোন এক ছুটির দিনে, শুক্র কিংবা শনিবার, সে দেখে যে, একটা না, এক আঁক বিএমড়ায়ু লাইন দিয়া খাড়ায়া আছে, এবং তখন চানমিঞার ধূসর জগৎ পুনরায় তার সামনে বাস্তব হয়া ওঁঠে, সে দেখে যে, পাঁচটা গাড়ির মধ্যে একটা কালা, একটা সাদা এবং একটা নীল রঙের, এবং অন্য দুইটার রঙ ধূসর কিংবা ছাই, ফলে সে ব্লু কালারের এক্সসিরিজের এক্স-ফাইভ গাড়িটা পছন্দ করে। যাইহোক, জায়গাটা হয়তো হোটেল সোনারগাও-ই ছিল, চাইরটা গাড়ি পার্কিং এলাকার কাঠবাদাম গাছের নিচে দুই লাইনে, এক দিকে দুইটা করে পরস্পরের বাম্পারের সঙ্গে নাক লাগায়া খাড়ায়া ছিল, নীল রঙের গাড়িটা ছিল একটু দূরে, বিচ্ছিন্ন অবস্থায়, চানমিঞা এইটাকে টার্গেট করে। সে পার্কিং লটের সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে আলাপ করে, ওস্তাদ বিএমড়াক্কু গাড়ি কার? তার কথা শুনে সিকিউরিটি গার্ডের, তার নাম হয়তো হাবিবুর রহমান, চুল খাড়া হয়া যায়, সে বলে, তোমার দরকার কি? কিন্তু হাবিবুর রহমানের সঙ্গে রফা করা কোন ব্যাপারই ছিল না, গাড়ির ড্রাইভারকেও সে ম্যানেজ করে, চানমিঞী বোঝায় যে, হাবিবুর রহমানের কোন রিস্ক নাই, কারণ গাড়ি খোয়া যাবে না, দেশে চুরি করা বিএমড়াকু গাড়ি বেচা যায় না, গ্রাহক নাই, সে বলে যে, গাড়িটা সে নিয়া যাবে, হয়তো দশবার ঘন্টার জন্য, তারপর অবশ্যই ফিরায়া দেবে-বেইলি রোডের মুখের কাছে রমনা পার্কের অরুণোদয় গেটের সামনে থাকবে গাড়ি। সে হাবিবুর রহমানকে বলে, পুলিশে ধরলে কুনুরকমে বারটা ঘন্টা পার করতে পারলেই আপনের আর ঝামেলা নাই-গাড়িগুলা কার ওস্তাদ?

হাবিবুর রহমান হয়তো এই গাড়ির মালিকদের চেনে, করোনা এবং করোলা কিংবা সানির ভিড়ে বিএমডাব্লু এলে তাদের মালিকদের না চিনা হাবিবুর রহমানের উপায় কি? হয়তো চানমিঞা তার হাতের মধ্যে অতিরিক্ত খাতির হিসাবে একটা প্রাণ ক্যান্ডি ধরায়া দেয়-খান দেশি জিনিস-দেখা যায় যে, হাবিবুর রহমান জ্ঞানী এবং অভিজ্ঞ লোক, দুনিয়া সম্পর্কে তার বিভিন্ন মতামত আছে, ফলে চকলেটের চোকলা ছাড়ায়া মুখে পুরে দিয়া সে গাড়ির মালিকদের বয়ান দেয়: সাদা গাড়িটা ঘাসির বিন আহরামের, সে উড়াজাহাজ দৌড়ায়, আদম উড়ায়া নিয়া যায় মিডিলইস্টে, বাংলাদেশের বাঙ্গাল আদমদের দুবাই, দাহরান কিংবা জেদ্দা এয়ারপোর্টে পাকিস্তানি এবং ইন্ডিয়ান লেন্দু কর্মচারিরা তুই বলে ডাকে, এই কিধার যাতা তু, আরবি ভাইয়েরা তাদের সঙ্গে কথাই বলে না, কিন্তু তাদের উড়ায়া নিয়া যাওয়া খুবই ভালজনক ব্যবসা; কাল রঙেরটা এন্ড্রু এল বাউটপের, তাঁর দোকানের নাম ডোকাল, সে ছড়া মুখস্ত করে চুলটানা বিবিয়ানা/সাহেববাবুর বৈঠকখানা এবং কান্দে, ডাক্তার সাব প্যার্টের ঘাস বাইর করতে পারতেছি না, মরলাম; নীলটার মালিক গাণ্ডিব বহতা, তার কম্পানি রূপের লাগিয়া, রূপতো আছেই মুরগি তুমার আন্ডার খোঁজে পাগল; লাল গাড়িটা অন্বন্তরি টুনাবঙ্গের, সে ট্যাকার কুমির, ট্যাকা দেয়, নেয়, সরকার দুই/চাইরটা ব্যাংক বেসকারিকরণ করলে গিলা ফালাবে-চানমিঞা লাল গাড়ি দেখে না, ভাবে যে, ধূসরের একটা শেড হচ্ছে লাল-আর ছাই রঙের গাড়িটা কোকিল চন্দের, তার কাজ হচ্ছে খাওয়ানো, খায়া যান ট্যাকা ফালান, সে টাকা জমায়া সময়মত ঢাকা শেরাটনটা কিনতে চায়, থ্রি-সিরিজের কম দামি গাড়িটা কিনছে বন্ধুদের দেখাদেখি বিএমডব্লু ক্লাবের সদস্য হওয়ার জন্য। ফলে বাংলাদেশে বিএমড়ায়ু ক্লাবের এই পাঁচজন সদস্য সোনারগাও এর পুল সাইডে বসে গল্প করে, হয়তো রিল্যাক্স করে, আরাম করে, স্ট্রেচ করে, ব্রেক নেয়—তাদের কত কাজ, তাই তাদের বিশ্রাম দরকার। এই সেঁতসেঁতে বৃষ্টির দেশে মরুভূমির ঘাসির বিন আহরাম নবাগত, সে বাগানের ঘাসের ভিতরে সবুজ গিরগিটির মত মিশা যাওয়া গাণ্ডি বহতাকে ওস্তাদ মনে, বলতো ওস্তাদ ব্যবসা বাড়ানোর ফন্দিটা কি?

: বিজ্ঞাপন এবং বিজ্ঞাপন।

: দেবনি বিজ্ঞাপন।

ঘাসিরের ব্যবসার সঙ্গে গাণ্ডিবের কোন সংঘর্ষ নাই, সে পরম উদারতা দেখায়, একটা ভাল বিজ্ঞাপন এজেন্সি ধরো, এই দেশে এইটা খুবই ইম্পরটেন্ট।

: আর একটু বল।

: এই দেশের সিভিল সোসাইটির নেতারা বিজ্ঞাপন এজেন্সি চালাইতে পছন্দ করে, এদের ট্যাকা দিয়া দেও, দে উইল মেক এভরিথিং একসেপ্টেল।

হাবিবুর রহমান আরেকটা প্রাণ টফি চাবায়া খায়া চানমিঞাকে বলে, যাও ভিতরে যায়া দেইখা আস গা; এবং চানমিঞা হোটেলের সুইমিং পুলের কাছে মায়া পাঁচ জনকে পায়, তারা দেড় আউন্স ড্রাই জিন আর আধা আউন্স ড্রাই ভারমুথ এবং বরফের কুঁচি দিয়া বানানো, সঙ্গে লেবুর টুকরা কেটে দেওয়া, মার্টিনির গ্লাসে চুমুক দেয়, এবং হনলুলু থেকে আমদানি করা কাজুবাদাম চাবায়, তখন চানমিঞা যায় তাদের কাছে ঘুরঘুর করে, তারা ভাবে যে, হোটেলের কোন লোক হয়তো হবে। গান্ডিব বহতা তখন বলে, এরা আর্ট কালচারের সঙ্গে জড়িত, ডোনেশন টোনেশন দেই।

: আমিও দেব।

: প্রোগ্রাম স্পন্সর করি।

: আমিও করব।

অন্বন্তরির আগ্রহ অন্য বিষয়ে, সে গান্ডিবকে বলে, খুবই ড্রাই হয়া আছি, বুজছো!

: লবঙ্গকে নিয়া পাতায়া কিংবা কোটা কিনা বালু ঘুইরা আস, ফাইভ নাইটস ওয়ান লাখ, থাকা খাওয়া যাতায়াত তোমার, আমার কাছে মোবাইল নাম্বার আছে, লাগলে দিতে পারি।

তখন তাদের চিন্তাগুলা কাছাকাছি আসে, তাদের বাক্য এবং শব্দের ভিতরকার পার্থক্য এবং অস্পষ্টতা দূর হয়; তারা, অন্বন্তরি টুনারত্নে, ঘাসির বিন আহাম, এন্ড্রু এল বাউটপ, গাণ্ডিব বহতা এবং কোকিল চন্দ, এক ভাষায় কথা বলে।

: এই দেশের লোকেরা বলে যে, দে হ্যাভ দা চিপেস্ট লেবার ইন দা ওয়ার্ল্ড।

: প্রোবলি, নো প্রবলেম, উই উইল ইউজ দেম, এন্ড উই উইল মেক মানি।

: দে আর দা চিপেস্ট, ইয়েস, উই উইল গিভ দেম ওয়ার্ক, এন্ড দে উইল সিং টু আস।

: দেয়ার উইমেন উইল!

০৯. মুরগি তোমার আন্ডার খোঁজে

তখন টেলিভিশনে পাণ্ডিব বহতার মুরগি তোমার আন্ডার খোঁজে প্রোগ্রামের কথা তাদের মনে পড়ে, তারা গাড়িকে ধরে, আমাদেরকে বল কি করতাছে।

: আমার বিজ্ঞাপন এজেন্সিকে ট্যাকা দিয়া দিছি, তারা করছে, কেউ কিছু বলতে পারতেছে না—আমরা সুন্দরীদের খুঁজে বের করব!

: এন্ড উই উইল পিক সাম অফ দেম, এন্ড বিল্ড এ লিটিল ডল হাইজ অন.. মে বি সামহোয়ার।

গান্ডিব বলে, অন দা পান্থকুঞ্জা.. উই উইল টেক লিজ অফ ইট ফ্রম মিস্টার কোকা।

তখন এন্ড্রু এল বাউটপের মনে হয় যে, এই দেশে গভার্নেন্স একটা সমস্যা, গুড গভার্নেন্সের বড় অভাব, সে বলে যে, এইটা নিয়া কি কিছু করা যায় না?

: যাবে না কেন? আমরা বলতে পারি যে, তোমরা নেজামত চালাও, আমাদের দেওয়ানিটা দিয়া দেও, আমরা চালাই, টাটা আসতেছে, ধাবি গ্রুপ আসতেছে, ভাই এইটা ফ্রি মার্কেট ইকোনমি!

মিস্টার বাউটপ বিষয়টা বোঝে না, সে বলে, হোয়াটস দ্যাট?

অন্বন্তরির ইতিহাস কিছু জানা ছিল, সে চমৎকৃত হয়, দ্যাট উইল বি একসিলেন্ট, এবং গাণ্ডিব বহতার মনে হয় যে, তিনটা সার্ভিংয়ের পর মার্টিনি হয়তো মথায় উঠতে শুরু করেছে, সে বলে, ইউ আর গোয়িং টু ফর মাই ফ্রেন্ডস।

চানমিঞা কোন একটা খালি টেবিলে বসে ঢাকার বিএমড়ায়ু ক্লাবের পাঁচ সদস্যের এইসব কথাবার্তা শোনে, অথবা শোনে না, কারণ সে ইংরেজি কথা বোঝে না, সে তাদের শুধু দেখে, তারা গ্লাসের কিনারায় জিভ আর ঠোট লাগায়া সাদা রঙের মার্টিনি চেটে খায়, এবং সে গাণ্ডিব বহতার নীল রঙের গাড়িটা চুরি করে। তখন মামুনকে জুলি হয়তো বলে যে, চানমিঞা লেদুর সঙ্গে তাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল এবং মামুন অধিক শোকে পাথর হয়া থাকে, সে চানমিঞার প্রসঙ্গে যেতে চায় না, কস্তার কথা বরং জিগাস করে, তোমার কস্তা সাহেবের কি খবর? জুলির হয়তো মামুনের জন্য খারাপ লাগে, সে বোঝে যে, মামুন এখন একটা গভীর খাদের মধ্যে পড়ে আছে, যেকোন খড়কুটা পেলেই সে আকড়ায়া ধরবে, কিন্তু জুলি কোন লাইফ লাইন তার দিকে ছুড়ে দেয় না, খুবই নির্দয় হয়া থাকে, তখন মামুন বলে, একদিন আমাদের বাসায় যাইবা?

: কেন?

: এমনি।

: আচ্ছা যাব একদিন।

: আইজই চল, এখনই।

জুলি রাজি হয় না, সে বলে যে, লেদু ভাই আসলে একদিন সে যাবে ভূতের গল্লিতে, লেদু আর মামুনের সাথে।

. : প্রমিজ?

জুলির হয়তো বেদনা হয়, তার মন হয়তো কান্দে নত মুখে জানালার সামনে বসে থাকা মামুনের জন্য, সে বলে, যাব।

: কস্তার খবর বল।

জুলি কিছু বলে না, কিংবা হয়তো বলে, কস্তার কোন খবর নাই; প্রকৃতপক্ষে তার মা মিসেস মেরি জয়েস ক্লার্ক একদিন মিজ রোজালিন ডি কস্তার বাসায় গেলে, মিজ ডি কস্তা এই বৈবাহিক সম্বন্ধের প্রস্তাব দেয়, এবং মিসেস ক্লার্কের কিছু করার থাকে না, কারণ জুলির বিয়া দেওয়া দরকার, কিন্তু ভাল পাত্র কোথায়, কে করবে তার মেয়েকে বিয়া? কস্তা ভাল একটা ছেলে, কি বলে সে না করবে, কেন করবে? যদিও জুলিকে নিয়া তার ভয় হয়, কিন্তু জুলিরও না করার মত কিছু থাকে না, সে তার মার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকায়া বলে, তোমার যা ভাল মনে হয় কর মম! ফলে পিউস কস্তু ওয়াশিংটন ডি.সি.-র এম স্ট্রিটের পুরান বইয়ের দোকানে একটা চক্কর দিয়া ৩২/৩৪ অথবা ৩৬ নম্বর মেট্রো বাস ধরে ওয়ার্ড সার্কেলে দি আমেরিকান ইউনিভার্সিটি-তে তার ক্যাম্পাসে ফেরে এবং সেন্টিনিয়াল হলের তার রুমমেট ইন্দোনেশিয়ার আন্ডারগ্রাজুয়েট ছাত্র হোতামো যখন তাকে খবরটা দেয়, তোমার মা ফোন করেছিল, কস্তার মনে হয় যে, তার মা খামাখা তাকে বিপর্যস্ত করছে, তার জন্য যন্ত্রণা তৈরি করছে; হোতোমোর উৎসাহেই তারা তাদের হোস্টেলের রুমে ন্যাশনাল বেল কম্পানির টেলিফোনটা আনে, হোততামোই টেলিটাউনে যায় সিয়ার্স থেকে হ্যান্ডসেট কিনা নিয়া আসে, এবং সে-ই সেটা রাইত দিন ব্যবহার করে, প্রত্যেক মাসে দেড় দুইশ ডলার বিল দেয়, কস্তার কোন ফোনই আসে না, তখন তার মা রোজালিন একদিন ফোন করে প্রথম জুলির কথা তাকে বলে, মেয়েটা ভাল চিন্তা করে দেখ।

সে চিন্তা করে দেখে, বিকাল সাড়ে পাঁচটায় মায়ার্স বিল্ডিংয়ে তার জুরিসপ্রুডেন্সের একটা ক্লাস ছিল, জাস্টিস রিসার্চ এর উপরে; সেদিন ক্লাস করে বিস্তার লাইব্রেরির পাশ দিয়া সে আধো-অন্ধকারের ভিতরে হলে ফেরে, এই ফল সেমিস্টারে সে ৬ ক্রেডিট আওয়ারের দুইটা সাবজেক্ট নেয়, ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে অক্টোবরের পর থেকেই গাছের পাতা ঝরতে শুরু করে, রাস্তায় তার পায়ের নিচে পড়ে ওক আর মেপলের বিষপ্ন শুকনা পাতা মুড়মুড় করে গুড়া হয় এবং যেহেতু তার মা ফোন করেছিল সে সকাল বেলা কলব্যাক করে, তার মা ফোন রিসিভ করে বলে, এখন তার ওইখানে কয়টা বাজে?

: সকাল দশটা।

আমাদের এখানে এখন রাইত আটটা, আমরা টেলিভিশন দেখতেছি, রোজালিন ডি কস্তা বলে, এবং তখন পিউস কস্তার অস্থিরতা দেখা দেয়, সে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়া নেব্রাস্কা এভিনিউ এবং লাফবড়ো রোড ধরে হেমন্তের রইদের ভিতর দিয়া এলোমেলোভাবে হাঁটে, পটোম্যাকে পাড়ে আসে-নদীর ধার দিয়া মানুষের বানানো সিএন্ডও ক্যানেলের পাশে অনেক মোটা মহিলা জগিং করে—সে যখন লিটিল ফলসের কাছে পটোম্যাকের চেইন ব্রিজের উপরে যায়া পানির দিকে তাকায়া বসে, রইদ তখন চড়া এবং গাঢ় হয়া ওঠে। তার মা আবার রাইতে ফোন করলে সে বলে যে, জুলিতে মেয়ে ভালই, কিন্তু তারতো লেখাপড়াই এখনো শেষ হইলো না, কবে হবে কে জানে!

রোজালিন তাকে বোঝায়, লেখাপড়া শেষ হবে, তুই ভাবিস না, কত দিন আর বসে থাকবি, বয়স বাড়তেছে না তর; এবং তখন জুলি তাদের বাসায় বসে ব্যর্থ শিয়াল মামুনের সঙ্গে কথা বলে, আপনে আমাকে আপনাদের বাসায় নিয়া যাইতে চান কেন? এই কথা শুনে মামুন মনে হয় বোকা হয়া যায়, এই মেয়েটা শেষ পর্যন্ত এই রকম? এত ঢং মারার কোন মানে হয় না; সে কি বোঝেই না মামুন কেন এইসব বলে? ফলে মামুন চুপ করে থাকে এবং জুলিকেই আবার নীরবতা ভাঙ্গা লাগে, লেদু ভাই দেখি আসে না!

: আমাদের বাসায় চল, বেড়ায়া আসবা।

: ঈদে যাব, রোযার ঈদে যায়া সেমাই খাব।

: ঈদ বহু দূর জুলি, তুমি জান!

জুলি বলে যে, কস্তা তাকে ওয়াশিংটন থেকে ফোন করেছিল, মামুনের তেমন আগ্রহ হয় না, তবু পিউস কস্তাকে নিয়া জুলি তার গল্প বানায়, হয়তো কস্তা তাকে ফোনে এসব কিছু বলে, অথবা হয়তো এত কিছু বলে নাই, তবু.জুলি মামুনকে শোনায়; হয়তো বলতে ভালই লাগে তার, অথবা হয়তো সম্ভাব্য স্বামীর গল্প সে করে মামুনের গায়ে পানি ঢালার জন্য, এবং মামুন মিঞার মনে হয় যে, মেয়েটার বুদ্ধির শেষ নাই।

মামুন বলে, কস্তার গল্প শুনে আমার লাভ কি?

: ক্ষতি কি? এইরকম করেন না, শোনেন-আমরা টেনলিটাউনে মেট্রো স্টেশনের কাছে থাকব, হয়তো ভেনেস স্ট্রিটে কিংবা আলবেমারল স্ট্রিটে, অথবা একটু দূরে ম্যাকুম্ব স্ট্রিটে, এখান থেকে কস্তার ইউনিভার্সিটিতে হেঁটে যাওয়া যায়, সাটল বাসও আছে, আড়াইশতিনশ ভুলারে হয়তো বেসমেন্টের একটা রুম আমরা পায়া যাব; ম্যাকুম্ব থেকে কাঁচা বাজারের দোকান জায়ান্ট হাতের নাগালের ভিতরে, খুবই সুবিধা, সঙ্গে লাগান কনভিনিয়েন্স স্টোর জি সি মারফি, আমি হয়তো চাইলে এই দোকানের সেলস কাউন্টারেও কাজ করতে পারব, কস্তা তার লেখাপড়া শেষ না করা পর্যন্ত আমাকে কাজ করতে হবে, প্রথমে আমরা পুরান হোটেল ফার্নিচার কিনা হয়তো কাজ চালায়া নেব, আলেকজান্দ্রিয়ার কিং স্ট্রিটে ওয়্যার হাউজ আছে, ভাল পুরান ফর্নিচার পাওয়া যায়, কস্তুা ইউ-হল এর ভ্যানে করে নিয়া আসতে পারবে, আমি হয়তো বিকালে ম্যাকুম্বের কোনার ভিতরের ক্যাকটাস রেস্টুরেন্ট এ বার-এও কাজ করতে পারব, বারে কাজ করলে পয়সা বেশি, তারপর একটু পয়সা কড়ি হলে-কাছেই ল্যাংলি সেন্টারে একটা দোকান আছে, নাম সামসার—সেখান থেকে হয়তো একটা নতুন ড্রেসিং টেবিল কিনা ফালাব, এইটা আমার শখ, বাচ্চা হলে একটা নতুন বেবিকট-ও কিনব এখান থেকে, আলেকজান্দ্রিয়ার ওয়্যার হাউজে হয়তো বাচচাদের খাট পাওয়া যাবে না, নতুনই কিনব তার জন্য আমাদের ম্যাকুশ স্ট্রিটের বাসার কাছেই উইসকনসিন এভিনিউ এবং ম্যাসাচুসেটস এভিনিউ এর কোনায় ওয়াশিংটন ক্যাথিড্রাল, খুবই সুন্দর গোধিক আর্কিটেকচারে তৈরি, রবিবারে কাজ না করলে হয়তো প্রার্থনায় যোগ দিতে পারব, হয়তো কখনো একটু দূরে যাব বেড়াতে, ক্যাপিটল হিলের মল এলাকায়, কিংবা উডলি পার্ক ন্যাশনাল জুতে, কিংবা আরো একটু দূরে আর্লিংটন সেমিটারিতে, প্রেসিডেন্ট কেনেডির কবর দেখে আসব, কিংবা ক্রিস্টাল সিটি অথবা পেন্টাগন সিটিতে যাব, অথবা গ্রে-হাউন্ড বাসে করে নিউ ইয়র্কেই, তখন উডওয়ার্ড লোথ্রপ কিংবা জে সি পেনিতে উইন্টার সেল দিলে লাইনে খাড়ায়া কস্তার জন্য হয়তো একটা টার্টেল নেক জাম্পার কিনব, দুই জোড়া দাস্তানাও কিনতে পারি, ভিতরে উলের লাইনিং দেওয়া, এভাবেই চলে যাবে দেখেন মামুন ভাই, জীবনটা খুবই ছোট, কোন অসুবিধা হবে না। জুলি হয়তো মামুনকে এইসব কথা বলে কান্দায় কিন্তু চানমিঞা যখন আসে তখন তাকে বলে, তোমার চুরি করা গাড়িতে একদিন চড়তে চাই!

: চড়ামু।

: কবে?

চানমিঞা হয়তো তখনো গাণ্ডিব বহতার গাড়িটার খোঁজ পায় নাই, সে বলে যে, সে তার জন্য একটা ভাল গাড়ি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে, যেনতেন একটা গাড়িতে তো তাকে চড়ান যায় না, কারণ সে হচ্ছে টিচারের মেয়ে, টিচারের মেয়ের একটা ইচ্ছা হইছে, সে একটা হাউস করছে, চুরি করা গাড়িতে চড়ার জন্য, একটা ভাল গাড়িতে আনাই লাগে, না হইলে টিচারের ইজ্জত থাকে না, তার মেয়ের ইজ্জত থাকেনা, চানমিঞারও না! তখন জুলি বলে, তুমি গাড়ি চুরি কর, তোমার খারাপ লাগে না, আর আমি চড়তে চাওয়ায় এভাবে বলতেছ?

: আমি বলি নাই যে আমার খারাপ লাগে, আমি মাঙ্কি বয়, আমার কিছুতে খারাপ লাগে না!

: এভাবে বল কেন? হোয়াই ইউ আর লাইক দিস!

চানমিঞার তখন কি বলার থাকে? কিছু থাকে না; জুলি বলে, আমি আমেরিকা চলে যাচ্ছি, আমার বিয়া হয়ে যাচ্ছে পিউস কস্তার সঙ্গে, তোমার কি কস্তাকে মনে আছে? তোমাদের এক বছর না দুই বছর সিনিয়র ছিল। চানমিঞার হয়তো কস্তার কথা মনে পড়ে না, অথবা পড়ে, কিন্তু সে সুবিধামত একটা ভাল গাড়ি খুঁজে পায় না, ফলে সে যখন আবার আসে তখন জুলি তাকে বলে যে, তার আর চানমিঞার গাড়িতে চড়ার ইচ্ছা নাই, তুমি একটা সুবারুই আনো না দেখি, না হয় মারুতি-সুজুকিই আনো, তোমার গাড়িতে চড়ে আমি একটু মামুনদের বাসায় ঘুরতে যাব।

: কেন?

: মামুন ধরছে, তাদের বাসায় যাওয়ার জন্য।

তখন জুলি আবার বলে, তোমাকে কি বলেছি যে আমার বিয়া হয়ে যাচ্ছে? এবং চানমিঞা বুঝতে পারে না জুলি এরকম কেন করে, সে ঘরের ভিতরে ছায়ার মধ্যে ডুবে থাকে, জুলি তখন স্টিভেন আর্নল্ডের আনা একটা বই বের করে আনে, বইটার নাম ইস্লোসেন্ট ইরেনদিরা এন্ড আদার স্টোরিজ লেখক গ্যাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, এবং সে বলে, বইটা নিয়া যাও, এইখানে একটা গল্প আছে, ডেথ কন্সটান্ট বিয়ন্ড লাভ, এইটা পইড়া দেখ।

: আমি এত কঠিন ইংরেজি পড়তে পারি না।

তখন জুলি বলে যে, এইটা খুব মজার একটা গল্প, সম্ভবত কলম্বিয়ার এক বয়স্ক সিনেটর, নাম অনেসিমো সানচেজ, এক কিশোরীর প্রেমে পড়ে এবং তাকে পাইতে চায়, তখন মেয়েটার বদমাইশ বাপ সেটা বুঝতে পারে, সে এই সুযোগে কিছু সুবিধা আদায়ের ধান্দা করে, মেয়েটার নাম লরা ফারিনা, তার বাপ তখন একটা চেস্টিটি বেল্ট পরায়া চাবি নিজের কাছে রেখে মেয়েটাকে সিনেটরের কাছে পাঠায়া দেয়। তারপর সিনেটর দেখে যে, মেয়েটা তালা লাগানো, তখন সে জিগাস করে, চাবি কোথায়? এবং মেয়েটা বলে, আমার বাপের কাছে। চানমিঞা এই গল্প শোনে এবং বলে, এইটা কিম গল্প কিছুই বুজলাম না, কারণ তখন সোনারগাঁও হোটেলে ঢাকার বিএমড়ার ক্লাবের পাঁচ সদস্য কথাবার্তা বলার সময় তাদের কাছে গাণ্ডিব বহতার গাড়ি চুরির খবর আসে, হয়তো বেল ক্যাপ্টেন এসে খবর দেয়, হয়তো কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার নিজেই আসে খবর নিয়া, গাণ্ডিব বহতার স্থানীয় বাঙ্গালি ড্রাইভার হাউমাউ করে একটু বেশিই কান্দে, ছার আমি একটু বাথরুমে গেছিলাম, আইসা দেখি গাড়ি নাই, এবং পার্কিং সিকিউরিটি গার্ড হাবিবুর রহমানও যখন তার বানানো গল্প বলে, আমিতো এত কিছু খেয়াল করি নাই, ভাবছি গাড়িতে ড্রাইভার আছে, ড্রাইভার যে গাড়ি ফালায়া রেখে গেছে তাতো বুঝতে পারি নাই, তখন তারা হয়তো ভাবে যে, কোন রকমে হয়তো সময়টা পার হয়া যাবে, এবং চানমিঞা হোটেলে কিংবা থানায় ফোন করে জানায়া দেবে গাড়ি কোথায় আছে; কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ থাকে না, কারণ রমনা থানা থেকে দ্রুত পুলিশ এসে হাজির হয়, সিআইপি কাম ফরেন ইনভেস্টারের কেস, দেশের ভাবমূর্তির প্রশ্ন, এদের সিকিউরিটি দিতে না পারলে বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসবে না, চীন কিংবা ভিয়েনামে চলে যাবে, সাংঘাতিক ব্যাপার, ফলে কোন উপায় নাই, গাফিলতি হলে হয়তো হোম মিনিস্টার স্বয়ং গোয়া দিয়া বাস্তু ঢুকায়া দেবে-পুলিশ গান্ডিব বহতার বাঙ্গালি ড্রাইভার এবং হাবিবুর রহমানকে বেন্ধে রমনা থানায় নিয়া যায়। তখন গান্ডিব বহতাকে হয়তো ঘাসির বিন আহরাম তার সাদা বিএমডারু-তে করে লিফট দেয়-আসো চন্সি যখন পাওয়া গেছে, পৌছায়া দেই-এবং ঘাসিরের খুব মজা লাগে, সে বলে, সো নট অনলি চিপ লেবার বাট দে অলসো হ্যাভ কার খিভস!

: ইয়েস, একচুয়েলি উই ফরগট এবাউট ওয়ান ক্লাস, হু উড প্রবাবলি নট বি টোটালি আন্ডার আওয়াব কন্ট্রোল!

: হু, কার থিভস?

: ইয়েস, উই আর ফরেন ইনভেস্টারস, হাউ ডেয়ার দে স্টিল আওয়ার প্রপার্টি।

চানমিঞারও হয়তো মনে হয়েছিল যে, বেশি ঝামেলা হবে না, কিন্তু রমনা থানায় নিয়া ড্রাইভার এবং হাবিবুর রহমানের পাছায় দুইটা বাড়ি দিতেই তারা ভরভরায়া সব পুলিশকে বলে দেয়, ফলে পুলিশ রমনা পার্কের গেট অরুণোদয়ের কাছে সাদা পোশাকে পাহারা বসায়। পুলিশের র‍্যাপিড একশন ব্যাটালিন বা র‍্যাবকে বিষয়টার সঙ্গে দ্রুত যুক্ত করা হয়, র‍্যাব-২ তাদের ডাটা বেজ ঘেটে তিনটা সম্ভাব্য গাড়ি চোরের প্রোফাইল পায় এবং গাড়ি চুরির দুই ঘন্টার মধ্যে তারা খৈমনের ৩৬নম্বর ভূতের গল্লিতে যায়া হাজির হয়, এবং দেখে যে, মন্দিরের কোনায় নীল রঙের বিএমড়াটা খাড়ায়া আছে, চানমিঞা র‍্যাবের কথা শুনে জুলিকে নিয়া লং ড্রাইভে যাওয়ার যোগাড়যন্ত্র বাদ দিয়া ভাগে; খৈমন র‍্যাবকে বলে যে, এই গাড়ি তার পোলার না, মহল্লার লোকেরাও কাপটি মেরে থাকে, তারা কিছু দেখে নাই, জানেও না কিছু, ফলে এই গাড়ির আর মালিক খুঁজে পাওয়া যায় না। দুই ঘন্টার মধ্যে গাড়ি ফেরত পায়া গান্ডিব বহতা বেজায় খুশি হয়, ভেরি গুড, থ্যাঙ্ক ইউ, সে বলে, বাট চোরটাকে ধরেন, আমি তারে দেখতে চাই। ফলে খৈমন হয়তো জীবনে এই প্রথম ভেঙ্গে পড়ে, তার কি পোলা কি হয় গেল, তার মনে হয় যে, তার প্রথমেই সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু সে ভাবেই নাই যে, চানমিঞা একদম গাড়ি চোরই হয়া যাবে। তখন খৈমন নুরানি। বিলকিসের বাড়িতে যায়া কান্দে, নুরানি বিলকিস উপমা তাকে সান্ত্বনা দেয়, কি করবি, তামান জিন্দেগি পোলা পোলা কইরা কাটাইলি, পোলার চিন্তা বাদদে, আল্লারে ডাক, নামাজ যা কর।

খৈমন শরীরে চাদ্দর জড়াইতে শুরু করে, কেনা লাগে না, নুরানি বিলকিস তাকে একটা পুরান খয়েরি রঙের চাদর দেয়, খৈমন সেটা তার দেহের উপরের অংশে জড়ায়া দৌড়ঝাপ করে; তখন নুরানি বিলকিস তাকে ধর্মের কথা শোনায়।

: কব্বরে জিগাইব, মার রান্নুকা, কি কবি?

: মানে কি?

: তুমার প্রভু কে?

খৈমন বলে, কমু আল্লা, এবং সে ঠোঙ্গা বানায়া ঠাটারি বাজারে নিয়া। যায় বেচতে।

নুরানি বিলকিস বলে, কব্বরে জিগাই, ওয়ামা দীনুকা?

: মানি কি?

: তুমার ধর্ম কি?

খৈমন বলে, কমু ইসলাম, এবং সে ঠাটারি বাজার যায় ঠোঙ্গা বেচা পয়সা উঠাইতে।

নুরানি বিলকিস বলে, কব্বরে জিগাইব, ওয়ামা নবিয়ুকা?

: মানে কি?

: তুমার নবি কে?

খৈমন বলে, কমু হযরত মোহাম্মাদ, এবং সে বনগ্রাম থেকে নুরানি বিলকিসের গম ভাঙ্গায় আনে।

তখন একদিন খৈমন ঘরে ফিরা দেখে যে, চানমিঞা ঘরের চৌকির উপরে শুয়ে বান্দরদের নিয়া খেলে, একটা বান্দর তার কানের ভিতর আঙ্গুল দিয়া সুড়সুড়ি দেয়, সে মারতে গেলে বান্দরের ছুটে পালায়, তখন চানমিঞাকে ঘরে দেখে খৈমনের জান শুকায়া যায়, তরে র‍্যাবে ধরব, ক্রসফায়ার কইরা মাইরা ফালাইব, তুই ভাইগা যা চানমিঞা!

: কৈ যামু আমি?

তখন আরেকদিন খৈমনের হাতে ইনোসেন্ট ইরেনদিরা বইটা পড়ে, সে দেখে যে, বইয়ের মলাটে একটা নীল বিছানার উপরে অর্ধনগ্ন একটা মাইয়ালোক আধশোয়া হয়া আছে, তার কোমরে একচিলতা লেসের স্কার্ট, দুই হাতের মাঝখানে উন্মুক্ত দুই স্তন ছোট সাইজের একজোড়া কদুর মত ঝোলে, এই বিছানার কাছে একটা সবুজ রঙের ঢোলা আলখাল্লা পারে ছাতি মাথায় দিয়া বসে আছে এক বুড়ি; খৈমন নুরানি বিলকিস উপমাকে বলে, ঘরে ল্যাংটা মায়ালোকের ছবিঅলা বই লয়া আহে, কতো কি করি?

নুরানি বিলকিস শুনে আতঙ্কিত হয়, সে বলে, কচ কি তুই! ফলে খৈমন চানমিঞাকে বলে, এই ল্যাংটা মাইয়ালোকের ছবিঅলা বই কইখন আইনা রাখছ?

: টিচারের মাইয়া দিছে।

: কে দিছে?

: জুলি।

খৈমন চানমিঞার টিচারের কথা মনে করতে পারে, সে ভেবে দেখে ব্যাপারটা কি, তার এই এতিম পোলাটা কোনখান দিয়া কোনখানে। যাইতাছে; পিছনে লাগছে র‍্যাব, এদিকে জুলি তাকে এইরকম একটা বই দেয়! এবং সে যখন বলে, তুই তাইলে গাড়ি চুরি করচ? চানমিঞা চুপ করে থাকে।

: ট্যাকা কি কুরচ? একটা ট্যাকাওতো ঘরে আলছু না?

: ট্যাকা অখনো পাইনিকা, পামু।

খৈমন তার ছেলের সামনে কেন্দে ফেলে, তুই ভাইগা যা বাবা! তখন। চানমিঞার কিছু বলার থাকে না, কোথায় যাবে সে? চানমিঞা তখন আরফান আলিকে ধরে, সার্জেন্ট রফিককে ধরে, তারাও তাকে পালায়া থাকার কথা বলে, কিন্তু চানমিঞার তখন পালানোর সময় কোথায়? যদিও তার পিছনে তখন শুধু র‍্যাব না, লেগে ছিল খরকোসও। মামুনদের বাসার ছাদের উপরে বান্দরের ইটা খায়া কয়েকদিন অসুস্থ থাকার পর খরকোস আবার খাড়া হয়, একটা লাল রঙের নিসান সানি কিনা সেটা এনে মন্দিরের গল্লির মুখে এমনভাবে ফালায়া রাখে যেন সেটার কোন মালিকই নাই, একদিন যায়, দুই দিন যায়, কি কেউ তার গাড়ি ধরে না, মামুনদের বাসায় খরকোস শুয়ে বসে থাকে, কিন্তু কিছু ঘটে না, তখন তৃতীয় কিংবা চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় আরজু হোটেলে ফিরা যাওয়ার সময় সে দেখে যে, মন্দিরের কাছে দেওয়ালের উপরে লাইন দিয়া বান্দরেরা বসে আছে, তার ভয় হয়, রাগও, একটা অস্ত্র থাকলে ব্রাশ ফায়ার করে দেওয়া যেত, তখন সে গাড়ির কাছে যায়া দরজা খুলে গাইল দিয়া ওঠে, মগগের ফোয়া হল, এবং তখন দেওয়ালের উপরে বসে থাকা একটা বান্দর বিদুৎবেগে দুই কেজি বাটখারার সাইজের একটা ঝামা ইটা ছুড়ে মারে, ইটটা এসে খরকোসের কানের উপরে লাগে, ভুম্, এবং খরকোস মন্দিরের সামনে রাস্ত রি ধূলার মধ্যে পড়ে যায়। খরকোস মামুন একটা জিনিস পরিষ্কার বোঝে যে, এর একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার, সে সাতকানিয়ায় ফোন করে, জিপিটুজিপি, এবং তার বিশ্বস্ত চাকর অথবা গোমস্তা অথবা সহকারী আবু জাফরকে বলে একটা আবুলকাসেম৪৭ পাঠায়া দেওয়ার জন্য, ওড়া জাফরগিয়া, তঅত্তে আবুলখাসেম খউয়া আছে? তখন খরকোসের নির্দেশানুযায়ী আবু জাফর ব্যবস্থা করে, সাতকানিয়া থেকে খরকোসের টয়োটা গাড়িতে চট্টগ্রাম, সেখান থেকে গ্রিনলাইন কম্পানির নাইট কোচে করে ঢাকা; ছত্তর কিংবা জর্জ আবুলকাসেম৪৭টা নিয়া যাবে, হয়তো দুইজনেই যাবে, তারা খুরকোসকে সেটা পৌছায়া দিয়া চলে আসবে-খুবই জরুরি বিষয়। তখন বিকাল বেলী ছত্তর এবং জর্জকে যখন কাজের বুয়া ভাত খেতে দেয়, আসমানতারা সেটা দেখে এবং আসিয়া যখন তাকে বলে যে, খরকোস খবর দিয়েছে, ছত্তর এবং জর্জ মিঞা ঢাকা যাবে, তখন আসমানতারা হুরে জান্নাত তার ব্যাগ গুছায়া তৈরি হয়-ছত্তর ও জর্জ গাড়িতে উঠতে যায়া দেখে যে, গাড়ির ভিতরে আসমানতারা এবং তারা বলে, অনে খডে যান দের

: আই ঢাকা যাইয়্যুম!

খরকোসের চাকরদের কিছু করার থাকে না, কারণ খরকোসের চাকরেরা আসমানতারারও চাকর, খরকোসও তার চাকর; আসমানতারা তাদেরকে ধমকায়, ওড়া ছত্তরগিয়া আর লগে খ্যারেনডিসি ন গরিস, আঁই কইয়্যি যাইয়ুম-হাইয়ুম।

এই ঝামেলায় পড়ে আবু জাফর তার মোবাইল ফোনে খরকোসকে ধরার চেষ্টা করে, কানেশন পায় না, পায় না তো পায়ই না, ফলে আসমানতারাকেসহ গাড়ি রওনা হয়, এবং আবু জাফর যখন রাইত বারটার পরে খরকোসকে পায় তখন অনেক দেরি হয়া যায়, দুই সঙ্গির সাথে আসমানতারা তার আগেই গ্রিনলাইন পরিবহণের এসি বাসে করে চট্টগ্রাম ছাড়ে। তখন খরকোস মোবাইল ফোনে বাসের ভিতরে ছত্তরকে ধরে, ইত্তার তুয়ারা খডে?

: ফেনি পার ন হই।

: আসমানতারা খডে?

: ঘুমাদ্দে!

ছত্তর তাকে বলে যে, সব ঠিক আছে, কোন সমস্যা নাই; কিন্তু ব্যাপারটা তেমন ছিল না, কারণ গ্রিনলাইন পরিবহণের এসি বাসে করে একটা আবুলকাসেম ঢাকায় যাওয়ার খবর চট্টগ্রামে র‍্যাব-৭ এর কমান্ডিং অফিসার লে: কর্ণেল আনোয়ারুল আজিমের কাছে পৌছায়, সোর্স জানায়। যে, টুকরা করা একটা আবুলকাসেম পাওয়া যাবে একটা তোশকের ভিতরে। বাসের দুলুনিতে সারাটা রাস্তা আসমানতারা ঘুমে কেদোর মত ইয়া থাকে এবং ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট পার হওয়ার পর বাস যখন গতি বাড়ায় এবং আব্দুস ছত্তর এবং জর্জ মিঞা ভাবে যে, বিপদ হয়তো আর নাই এবং তাদের চোখ বুজে আসে, তখন কুমিল্লা বাইপাসের উপরে র‍্যাবের একটা টহল দল ওয়্যারলেসে বার্তা পায়া বাস থামায়। র‍্যাব বাসের নিচের হোন্ড থেকে গোল করে জড়ান এবং দড়ি দিয়া বান্ধা তোশকটা টেনে নামালে কিভাবে যে ছত্তর এবং জর্জ বাস থেকে নেমে অন্ধকারের ভিতরে হাওয়া হয়া যায় সেটা বিস্ময়কর একটা ব্যাপার, তখন তোশকের মালিক খুঁজতে যায়া র‍্যাব আসমানতারাকে পায় এবং র‍্যাব হেফাজতে আসমানতারা তার জিপিটুজিপি-তে খরকোসকে ফোন করে, খরকোস তার আগেই ছত্তরের কাছ থেকে ঘটনা জেনেছিল, ফলে সে আসমানতারার ফোন করার কারণ বুঝতে পারে, সে বলে, র‍্যাব খডে?

আসমানতারা বলে যে, সে র‍্যাবের গাড়িতে বসে আছে, তখন আসমানতারার জিপিটুজিপি-তে খরকোসের সঙ্গে র‍্যাবের ক্যাপ্টেন মুজিবরের কথা হয়, খরকোস সরাসরি আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়, আমি হোটেল আরজুতে আছি, সুট নম্বর এ-থ্রি, আমাকে পাইলে আসমানতারাকে ছাইড়া দিতে হবে; ক্যাপ্টেন মুজিব রাজি হয়, নারীর জন্য পুরুষ কি না করতে পারে, দুর্ধর্ষ স্মাগলারও প্রেমিকার জন্য কেমন নরম হয়া যায়, তখন তার রিতার কথা মনে পড়ে, রিতা এখন কি করে? হয়তো ঘুমায়, তেরাবেঁকা হয় হয়তো বিছনায় বেহুশ হয়া আছে সে। ক্যাপ্টেন মুজিব রাজি হয়, কারণ খরকোসকেই তাদের দরকার, আসমানতারার কোন দরকার নাই, ঢাকার র‍্যাব-২ এর হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করে, র‍্যাব-২ এর একটা দল তক্ষণি হোটেল আরজুতে যায়া দেখে যে খরকোস মামুন ওরফে আইবেক ওরফে কুতুবউদ্দিন আইবেক এবং তার চাকর আবুল হোসেন ওরফে আবুইল্যা পলাতক র‍্যাব-২ এর ডেপুটি কমান্ডার মেজর শহিদুজ্জামান আসমানতারাকে দিয়া আবার ফোন করায়, খরকোস তাকে জিগাস করে, তুই কেন আছ?

অসিমানতারা বলে, আঁই গম আছি, চিন্তা ন হইগো, তুই খডে?

: কইর ন ফারি খডে!

: ভাগি যঅও গৈ!

আসমানতারা যখন জিগাস করে, কেন আছ তুই, খরকোস বলতে পারে না সে কেমন আছে, ফলে খৈমন তখন জুলির দেওয়া বই নিয়া চানমিঞাকে জেরা করে, চানমিঞার তখন বইয়ের গল্পটার কথা মনে পড়ে এবং সে নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে মায়া মিসেস ক্লাকের দোতলার ড্রয়িংরুমের কোনায় ছায়ার মধ্যে বসে থাকে-জুলি তার দিকে তাকায়-চানমিঞা হচ্ছে তার বাপ ময়না মিঞার প্রতিলিপি, লম্বা শরীরে তার খাড়া নাক, গণ্ডদেশের উঁচা হাড়, গভীর তরল কালো চোখ, পাকানো দড়ির মত হাতের পেশি—এই লোকটা একটা গাড়ি চোর! চানমিঞা জুলিকে বলে যে, তার জন্য একটা বিএমডাব্লিউ সে যোগাড় করেছিল, কিন্তু পুলিশ তার পিছনে লাগায় শেষ পর্যন্ত তাকে চড়ানো হয় নাই; জুলি তাকে বলে, তুমি কি মনে কর যে তোমার চুরি করা গাড়িতে চড়ার জন্য আমি মরে যাচ্ছি।

চানমিঞা ভ্যাবাচেকা খায়া থাকে, এ কেমুন মাইয়ালোক? সে ভাবে এবং জুলি তাকে বলে যে, পিউস কস্তার সঙ্গে তার এনগেজমেন্ট হয়া গেছে, দুই/একমাসের ভিতরে কস্তা দেশে আসলে তাদের বিয়া হয়া যাবে।

তখন জুলি বলে, তুমি কি বইটা পড়ছো? ও তুমিতো আবার ইংরেজি পড়তে পরি না!

চালমিঞা চুপ করে থাকে।

: তুমি কেন লেখাপড়া করল না চনিমি, কেন করলা না বল? আমার মা তোমাকে এত ভালবাসতো, তুমি তাকে দুঃখ দিলা!

চনিমি হয়তো ভাবে যে, কি হইতাছে এইসব? জুলি বলে, তোমাকে একটা বই দিলাম, আমার দুঃখ তুমি সেইটা পড়তে পারলা না, বুঝলা না।

তখন চানমিঞার ছায়ার ভিতরকরি চোখে আলো জেগে ওঠে, সে জুলিকে বলে যে, সে তাকে একটা ড্রেস বানায়া দিতে চায়, হয়তো তার বিয়া উপলক্ষেই দেবে, এবং এ জন্য জুলির কোমরের মাপ তার দরকার, তোমার কোমরের মাপটা আমাকে দিবা, সে বলে, এবং জুলি কাগজের ঠোঙ্গায় তার একটা পেন্টি দিয়া দেয়; চানমিঞা র‍্যাব এবং খরকোসের চোখে ধূলা দিয়া এইসব করে, সে জুলির ফুলতোলা নাইলনের পেন্টি নিয়া যায়া জিঞ্জিরার এক কামারকে দেয়, কামার চানমিঞার নির্দেশ এবং পেন্টির মাপ অনুযায়ী স্টিলের পাত দিয়া একটা কাঅলা চেস্টিটি বেল্ট বানায়-দেহ বর্জ্য ত্যাগের জন্য নিচের দিকে ব্যবস্থা রাখে। সম্ভবত পিউস দেশে আসার পরিকল্পনা করার একমাস আগে চানমিঞা টিকাটুলির ইলিসিয়াম রেস্ট হাউজের কাছে একটা নাভানা ইলুদ ক্যাব নিয়া অপেক্ষা করে এবং দেখে যে, জুলি হেঁটে তার বাসার দিকে যায়, তখন চানমিঞা দরজা খুলে নেমে জুলির হাত ধরে তাকে টেনে ক্যাবের ভিতরে ঢুকায়, জুলি ভিতরে ঢুকে বসে এবং বলে, কি কর তুমি?

জুলি দুই দিন নিখোঁজ থাকে, তারপর নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লিতে তাদের বাসায় ফেরে, এবং যখন সে কলিং বেল টেপে তার ভয় হয় যে, তার মাকে সে আদৌ জীবিত দেখবে কিনা। কিন্তু মিসেস ক্লার্ক দরজা খুলে জিগাস করে, কোথায় ছিলা তুমি?

: চানমিঞা আমাকে কিডন্যাপ করেছিল।

মিসেস ক্লার্ক হয়তো তার ঘরে যায় অনেকক্ষণ শুয়ে থাকে, তারপর জুলি খাবার তৈরি করে তার মাকে ডেকে এনে টেবিলে বসায়, চিরুনি দিয়া তার এলোমেলো পাকা চুল আঁচড়ায়া একটা রাবার ব্যান্ড লাগায়া দেয়, আমার কিছু হয় নাই মা, সে বলে, চানমিঞাকেতো তুমি চেনো, সে তোমাকে ভালবাসে, সে আমার কিছু করে নাই মা! কিন্তু মিসেস ডি কস্তা যখন বিয়ার দিন ঠিক করতে আসে, জুলি নানান অজুহাত খাড়া করে, এখনই না আরো কয়েক দিন যাক, এবং সেদিন রাইতে তার মা মেরি, জুলির বানানো ভেজিটেবল স্যুপ খেতে খেতে যখন বলে, প্লিজ ডোন্ট ডু দিস টু মি, আই এ্যাম টায়ার্ড জুলি ইউ শুড নো, তখন জুলি ফ্লোরেন্স তার রুগ্ন মায়ের একটা হাত ধরে বলে যে, সে নান হয় শ্রীপুর চলে যেতে চায়, এবং মিসেস ক্লার্ক তার স্যপের বাটি রেখে উঠে যায় বিছানায় শুয়ে পড়ে হয়তো জুলি তার মায়ের জন্য উদ্বিগ্ন হয়, সে এসে বিছানার পাশে বসে এবং বলে, আমার কিছু করার নাই মা, আই ক্যানট ম্যারি কস্তা!

: বাট হোয়াই? হোয়াই আর ইউ ডুয়িং দিস!

জুলি তার মায়ের একটা হাত টেনে নিয়া তার কোমরে স্থাপন করে, মিসেস মেরি জায়েস জুলির লং স্কার্টের উপর দিয়া একটা মাঝারি আকারের প্যাড লকের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে, তার আতঙ্ক দেখা দেয়, কি এটা?

: চেস্টিটি বেল্ট!

: হোট ডু ইউ সে?

জুলি বলে, আমি এই অবস্থায় কস্তাকে বিয়া করতে পারি না, আই ওয়ান্ট টু বিকাম এ নান মম!

: লকের চাবি কোথায়?

: চানমিঞার কাছে।

তখন মিসেস ক্লার্ক কান্দে-ও মাই গড, ইউ আর ওনলি পানিশিং মি, ঠিক আছে চানমিঞা আসুক-তার বুড়া ক্লান্ত গালের উপর দিয়া তপ্ত অশ্রু গড়ায়া পড়ে, এবং তখন খরকোসকে ধরতে না পেরে র‍্যাব-২ এর মেজর শহিদ খুবই চেতে, সে আসমানতারাকে ছাড়ে না, রমনা থানার মাধ্যমে কোর্টে হাজির করে আবার রিমান্ডে নিয়া আসে, আসমানতারার মধ্যে কোন ভয় কিংবা অন্য কোন বিকার দেখা যায় না, সে র‍্যাবের মেজর শহিদ কিংবা ক্যাপ্টেন আনিস যা বলে তাই করে; কিন্তু খরকোসের কোন পাত্তা নাই-সে তখন চনিমিঞাকে শায়েস্তা করা নিয়া ব্যস্ত হয়া থাকে। লেক্সাসটা চুরি করার পর চানমিঞা হয়তো খরকোস সম্পর্কে জানতে পারে, হয়তো সার্জেন্ট রফিক তাকে বলে যে, খরকোস কোন বড় চোরটোর হবে, ডাকাইত কিংবা স্মাগলারও হইতে পারে, ডেঞ্জেরাস লোক মনে হয়, ওর জিনিসে হাত দিও না, এবং চানমিঞা আর হাত দেয় নাই, খরকোসের দ্বিতীয় গাড়িটা সে ধরে নাই, যদিও খরকোস সেটা মন্দিরের গল্লির সামনে ইচ্ছা করে তিন/চাইর দিন ফালায়া রাখে; অবশ্য তার বান্দর বাহিনী এই অসভ্যতা সহ্য করতে পারে নাই, বাংলাদেশের এই ধূসর বান্দরেরা বন্ধুত্বের মূল্য বোঝে, বন্ধুর জন্য তাদের প্রাণ কান্দে, ফলে তারা খরকোসের মাথা ইটা মেরে ফাটায়া দেয়।

খরকোসের জানাই ছিল যে, র‍্যাব হয়তো তার ফালায়া রাখা লাল গাড়ির উপর নজর রাখবে, কিন্তু চানমিঞাতো এই গাড়ি ধরেই না, তখন একদিন রাইতে গাড়িটা হাওয়া হয়া যায়, সকাল বেলা দেখা যায় যে, মন্দিরের গলির মোড়ে সেটা নাই; মেজর শহিদ তার লোকজনদের গাইল পাড়ে, কি করো তোমরা অপদার্থ সব! মন্দিরের গল্লির মোড় থেকে খরকোসই হয়তো গাড়িটা সরায়, চানমিঞার প্রেমিকার খোঁজ পাওয়ার পর সে বৃহস্পতিবার রাইতে তার লাল নিসান সানিটা নারীশিক্ষা মন্দিরের গল্লির মোড়ে নিয়া যায়া পাতে, সঙ্গে সে একই রঙের আরো একটা নিসান সানি ফালায়া রাখে-এইটা ছিল বিলাইয়ের আসা যাওয়ার পথের ধারে একসঙ্গে দুইটা ইদুর বেন্ধে রাখার মত-তখন র‍্যাব-২ এর মেজর শহিদ তার সোর্সের মাধ্যমে খবর পায় যে, লাল নিসানটার সন্ধান পাওয়া গেছে এবং র‍্যাব-২ এর একটা দল অকুস্থলে যায়া দেখে যে হুবহু একইরকম দুইটা গাড়ি। তারা বিভ্রান্ত হয়, কিন্তু গাড়ির নম্বর দেখে বোঝে যে, এর একটা খরকোসের এবং তারা কাছেই অবস্থান নিয়া গাড়িটার উপরে নজরদারি শুরু করে; তখন সেদিন চানমিঞা জুম্মা নামাজের পর ভাত খায়া তাদের গোপন চিলাকোঠায় একটা ঘুম দিয়া উঠে জুলিদের বাসায় যায়। খরকোসও হয়তো আবুইল্যার সঙ্গে কোথাও যায়া দেখা করে, আঁরা আর ঢাকা ন থাইক্কম, যাইয়ুম গৈ, সে বলে এবং আসমানতারার সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবে। তখন বিকাল কিংবা সন্ধ্যায় সে ঝাড়দারের বেশে আরজু হোটেলে যায় ঢোকে, হোটেলের লোকজন কাস্টমার এবং টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখা নিয়া ব্যস্ত হয়া ছিল, ছদ্মবেশী ঝাড়দারকে তার খেয়াল করে না। খরকোস নির্বিঘ্নে ভিতরে ঢুকে চাইর তলায় সুইট এ-থ্রি এর দরজায় যায় টোকা দেয় এবং আসমানতারা দরজা খুলে দেখে যে, শলার ঝাড় হাতে লুঙ্গিগেঞ্জি পরা দাড়িঅলা ঝাড়দার খাড়ায়া, সে যখন বলে, আমার ঘর ঝাড় দেওয়া লাগবে না, লম্বা দাড়ি গজানো ঝাড়দার তার কোমরে বান্ধা গামছা খুলে মুখ মুছে বলে, আঁই খরকোস; তখন আসমানতারা পথ ছেড়ে দিলে খরকোস ভিতরে যায় বসে এবং আশ্চর্য হয়া দেখে, ঘরের ভিতরে দেওয়ালের পাশে কাঠের পুরান খাঁচাটা রাখা, খাঁচা দেখে খরকোস বিচলিত হয়, আপ্লুত হয় এবং বলে, খাঁচা কত্‌থুন আইন্নোদে?

: সাতকাইন্নাত্‌থুন!

আসমানতারা বলে যে, আবু জাফর ট্রাকে করে খাঁচাটা পৌছায়া দিয়া যায়, তখন গামছা লুঙ্গি পরা ছদ্মবেশী খরকোস হয়তো ভাবে, একবার শুয়ে দেখি এবং সে আল্লাদ করে যায়া খাঁচার ভিতরে ভাঁজ হয়া শোয়, র‍্যাবের ধাওয়া খাওয়া এবং মিসেস জোবেদা রহমানের বাসার চিলাকোঠায় বান্দরের গুয়ের গন্ধের ভিতরে ঘুমায়া ক্লান্ত হয়া থাকা খরকোস আরামে হয়তো চোখ বোজে, এবং তখন আসমানতারা যায় খাঁচার দরজা লাগায়া দেয়।

: ইন ক্যান খরদ্দে তুঁই!

তারপর আসমানতারা যখন খাঁচায় আটকা পড়া খরকোসকে বলে, চুল আমরা সাতকানিয়া চলে যাব, চানমিঞা জুম্মা নামাজের পর বিকালে জুলিদের বাসায় যায়া মিসেস ক্লার্কের বিছানার পাশে খাড়ায় এবং বলে, টিচার আমি চানমিঞা, তখন মিসেস মেরি জয়েস ক্লার্ক সারাদিন পর তার চোখের উপর থেকে হাত সরায়, সে চোখ মেলে তাকায় এবং বলে, চানমিঞা ইউ টেক জুলি, তুমি জুলিকে নিয়া যাও!

চানমিঞা বলে, আমি আসব টিচার, এবং সে জুলিদের বাসা থেকে বের হয়া দেখে, গল্লির মোড়ে দুইটা ধূসর রঙের নিসান সানি পড়ে আছে-রঙকানা পোলাটা বোঝে না যে দুইটাই লাল রঙের গাড়ি–তার ভিতরে গাড়ি চোরের স্বভাব জেগে ওঠে, অন্যের মাল লোপাট করার স্পৃহা আকুলিবিকুলি করে, তখন খাঁচার ভিতরে খরকোস দুই হাত মাথার দুই পাশে দিয়া চোখ বন্ধ করে রাখে, মনে হয় মায়ের জরায়ুতে থাকা ভ্রূণের মত আরেকটা জন্মের জন্য সে নিজেকে গোল করে আনে–খাঁচা তার মা হয়।

গল্পের বিষয়:
উপন্যাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত