“মণিরম্ভার আধারে, রাজার ধন আছে লুকায়ে।”
মাথাটা চেয়ারের পিছনে হেলে গেছে অনেকটা। চোখ দুটো বোজা। শরীরটা দুলছে আরামকেদারায়। কথাটা তিন চারবার উচ্চারণ করার পর শেষে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন শ্রীমন্ত দাদু, “মাদাগাস্কারের নাম শুনেছিস তোরা?”
সবাই চুপ। শেষে উত্তরটা এল ঋজুর কাছ থেকে, “এটা তো একটা দ্বীপের নাম!”
“ভারত মহাসাগরের বুকে আফ্রিকা মহাদেশের কাছে একটা বড় দ্বীপ। তিনশো বছর আগে সেটা ছিল কুখ্যাত সব জলদস্যুদের স্বর্গরাজ্য।” কথাটা বলে তিনি বইটা কোল থেকে নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। মিনি তখন গুটি মেরে শুয়ে ছিল সেখানে। তার পিঠে আলতো করে আঙুল বুলিয়ে দিতেই সে আরাম পেয়ে শব্দ করল, মিঁইয়াও!
দিগন্ত, তুলি, ঋজু আর দোয়েল ক্রসওয়ার্ড পাজল থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিজেদের মধ্যে চোখের ইশারায় কথা বলে নিল। ওরা মাঝেসাঝে ছুটির দিনে সময় পেলে জড়ো হয় বোসবাড়ির বৈঠকখানা কাম লাইব্রেরিতে। সেখানে গাদাগুচ্ছের নতুন পুরানো বইয়ের মধ্যে মেহগনি কাঠের আরামকেদারায় বসে থাকতে ভালোবাসেন শ্রীমন্ত দাদু। ওঁর বয়েস হয়েছে ষাটের উপরে। কিন্তু শরীর আর মগজ দুটোই ফিট। আজকে ওরা ঘরে ঢুকেই দেখেছিল তিনি একটা পুরানো বইয়ের পাতা উলটে চলেছেন আতসকাচ হাতে।
কাজের লোক বংশীদাকে ডেকে এক কাপ চা আনতে বলে একগাল সাদা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে টেবিলে রাখা মোটা বইটা দেখিয়ে দাদু মন্তব্য করলেন, “আনফাউন্ড ট্রেজার অফ পাইরেটস।’ ১৯৫০ সাল নাগাদ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল লন্ডন থেকে। চোদ্দ শতাব্দীর থাইল্যান্ডের রাজা ত্রিলোকনাথের একটা বড় হিরে বসানো বহুমূল্য ব্রেসলেট ছিল। যেটা রাজবাড়ি থেকে চুরি হয় ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে। ও-দেশের উপকথায় আছে বাহুবন্ধটি ছিল নাকি কোন অসুর বা অপদেবতার। কোন এক সময়ে লক্ষ মানুষের রক্তে লাল হয়েছিল সেই হিরে। ইংরেজরা ওটার নাম দিয়েছিল ‘দ্যা রেড আই’। শোনা যায় সে সময়ে ব্রিটেনের রানি সেই পাথরটা হাতে পাওয়ার জন্য আহারনিদ্রা ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু সেটা পরে এক কুখ্যাত জলদস্যুর কাছে চলে যায়। তারপর এখনও সেটাকে আর কেউ খুঁজে পায়নি।”
“রেড আই, মানে রক্তচক্ষু! নামটা ভারি অদ্ভুত তো!” মন্তব্য করল তুলি।
দিগন্ত প্রশ্ন করল, “তা আপনি কি এতদিন পর সেটার কোন হদিশ পেলেন নাকি?”
চা আসতে, পেয়ালায় চুমুক দিয়ে দাদু বললেন, “প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। আমি তখন জিওলজিকাল সার্ভের মুম্বাই অফিসে পোস্টিং। আরব সাগরের মধ্যে নতুন কোন তেলের উৎস পাওয়া যায় কিনা সেই নিয়ে গবেষণা চলছিল। একদিন হঠাৎ করে রেডিওবার্তা পেলাম, একটা মারাত্মক সাইক্লোন ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। আমরা তখন সমুদ্রের অনেকটা গভীরে। নির্দেশ এসেছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তীরে পৌঁছানোর। তখন পশ্চিম সাগরে সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ। লঞ্চে করে বেরিয়ে পড়লাম আমরা সবাই। ম্যানেজার মিঃ কুট্টি, সাবিন আর আমি।
“কিন্তু তীরে পৌঁছানোর আগেই প্রবল বিক্রমে আছড়ে পড়ল সামুদ্রিক ঝড়। একবার ঢেউয়ের মাথায় চেপে আকাশে উঠছি, আবার পরক্ষণেই ঢুকে যাচ্ছি সমুদ্রের পেটের মধ্যে। তখনও মুম্বাইয়ের তট অনেক দূর। লঞ্চচালক জানাল, কাছেই খান্দেরি নামে একটা ছোট দ্বীপ আছে। আপাতত রাত কাটানোর জন্য সেখানেই নোঙর ফেলতে হবে। শেষপর্যন্ত তাই করা হল। সে রাতে কীভাবে যে আমরা পাড়ে উঠলাম বলে বোঝাতে পারব না। মোট কথা মরতে মরতে বেঁচে গেলাম যাকে বলে।
“জেটিতে নেমে আমরা কোনরকমে একটা মাথা গোঁজার আশ্রয় জোগাড় করলাম। পাহাড়ের মাথায় একটা লাইটহাউস, কিছুটা দূরে মেছুয়াদের তৈরি একটা মন্দির আর বোম্বে পোর্টট্রাস্টের অফিস। এ ছাড়া পুরো দ্বীপটাই এবড়োখেবড়ো পাহাড় আর বনজঙ্গলে মোড়া। পোর্টট্রাস্টের অফিসে একজন বয়স্ক কেয়ারটেকারের সঙ্গে আলাপ হল। সামুদ্রিক তুফান যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে সে-রাতে সেই নির্জন দ্বীপে বসে টের পেলাম।
“সারারাত শোঁশোঁ গর্জন আর লাগাতার জলোচ্ছ্বাস। প্রায় গোটা রাত জেগেই কাটল আমাদের। পরের দিন ভোরে ঝড় কিছুটা শান্ত হতে জেটিতে এসে চক্ষু ছানাবড়া। কোথায় আমাদের লঞ্চ? কেয়ারটেকার মুরলিধরন জানালেন, আরও দু’তিনটে মাঝারি মোটরবোট বাঁধা ছিল জেটিতে। সব কটাই নিরুদ্দেশ। সম্ভবত গতরাতের তাণ্ডবের ফল। নৌকার কয়েকটা ভাঙা কাঠের টুকরো শুধু চোখে পড়ল তটে। প্রশ্ন করলাম, ‘এখন উপায়?’
“মুরলিধরন বললেন, পোর্টট্রাস্টের অফিস থেকে বন্দরে খবর দিতে হবে। কিন্তু দেখলাম আমাদের কপালটা খুবই খারাপ। এখানের রেডিওর এন্টেনা আর যন্ত্রপাতি সবই নাস্তানাবুদ হয়েছে ঝড়ে। তবুও তিনি আশ্বাস দিলেন, চিন্তার কোন কারণ নেই। রেডিওয় কাজ না করলে হেড অফিস থেকে দু’দিনের মধ্যে লোক পাঠাবে। আর মেছুয়াদের নৌকো যাতায়াতের পথে আসে মন্দিরে পুজো দিতে। ওদের সঙ্গেও ফিরে যেতে পারি আমরা।
“যাই হোক, আক্ষরিক অর্থেই আমরা তখন জলবন্দী। হাতে গড়া ইডলি আর চা দিয়ে প্রাতরাশ সেরে আমরা চক্কর দিতে বেরোলাম সেই দ্বীপটাতে। এবড়ো খেবড়ো পাহাড় আর জঙ্গল। গাছের ডালে বড় বড় মাছধরা পাখিদের বাসা তছনছ হয়েছে ঝড়ে। গাছের মোটা মোটা ডালও ভেঙে পড়ে আছে যত্রতত্র।
“বেশ উঁচু একটা জায়গায় পাথরের গায়ে একটা গাছ উপড়ে পড়ে ছিল। তার গোড়া থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা কালচে ধাতব লম্বাটে বস্তু। আগ্রহ ভরে আমি আর সাবিন এগিয়ে গেলাম সেদিকে। হাতে তুলে নিয়ে পরিষ্কার করে দেখি সেটা একটা পুরানো দিনের চিঠি বা হলফনামার খাপ। আগেকার দিনে রাজরাজড়ারা যে-রকম লম্বা ফাঁপা খাপে করে চিঠিপত্র আদানপ্রদান করত সে-রকম। জিনিসটা খুলতে ভিতর থেকে বেরোল ইংরেজ আমলের একটা সরকারি নির্দেশ নামা। হলুদ হয়ে যাওয়া মোটা কাপড়ের তৈরি চিঠিটি অতি সাবধানে খুলে পাঠোদ্ধার করলাম আমরা।
“জনৈক ক্যাপ্টেন রবার্টের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিতে নির্দেশ আছে, ক্যাসেন্ড্রা লুট করার জন্য জলদস্যু প্ল্যান্টেনকে ইন্ডিয়া থেকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসি দিতে হবে এবং যে কোন ভাবে উদ্ধার করে রাজকোষে জমা করতে হবে লুট হওয়া ধনরত্ন, বিশেষত ‘দ্যা রেড আই’কে। তারিখ- ১৫ই জুলাই, ১৭৫৬ সাল।”
“সাবিন বলল, ‘১৭৫৬ সাল। মানে আংরের শেষ সময়। তখন তিনিই আরব সাগরের অধীশ্বর।’
“আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আংরে কে?’
“সে চোখ বড়বড় করে বলল, ‘কানোজি আংরের নাম শোননি? যাঁর নামে এখন ভারতীয় নৌসেনার একটা ব্যাটেলিয়ন আছে। ষোল শতাব্দীর শেষ থেকে সতেরশোর অর্ধেক ভাগ পর্যন্ত ভারতের পশ্চিম উপকূলের একছত্র অধিপতি ছিলেন আংরে ও তাঁর পরিবার। দেবগাদ আর পূর্ণাগাদ এই দুই জায়গায় সমুদ্রের পাড়ে ছিল তাঁর দুর্গ। ব্রিটিশ, ডাচ, পর্তুগিজ কেউই কোন যুদ্ধে তাঁকে পরাজিত করতে পারেনি। শেষে ইংরেজরা ভারতীয় জলদস্যু আখ্যা দিয়েছিল আংরেকে। সেই সময়ে তাঁর দুর্ধর্ষ নৌবহরকে এড়িয়ে চলত সারা পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলি। এই দ্বীপটা বহুকাল আগে ছিল কানোজি আংরের গড়।”
শ্রীমন্ত দাদু চায়ে আবার চুমুক দিয়ে বলে চললেন, “পোর্টট্রাস্টের বয়স্ক কেয়ারটেকার মুরলিধরনও যোগ দিয়েছেন তখন আমাদের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘খান্দেরি আর আন্দেরি এই দুটো দ্বীপ থেকে টোল আদায় করত কানোজি আংরের সৈন্যরা। মানে বাইরের দেশ থেকে সেই সময়ে যত পণ্যবাহী জাহাজ ভারতের পশ্চিম পাড়ে ভিড়ত সবাইকে পণ্যমাশুল জমা করতে হত এখানে। তার জন্য নৌসেনারা ঘাঁটি গেড়ে থাকত এই দ্বীপগুলোতে।’
“আমাদের কোম্পানির ম্যানেজার মিঃ মনজিত কুট্টি এগিয়ে এসে জানালেন, ‘আমার যতদূর মনে পড়ছে, ক্যাসেন্ড্রা নামে ব্রিটিশদের একটা পণ্যবাহী জাহাজ লুট করেছিল কিছু জলদস্যু মিলে। সেটা সতেরশো শতাব্দীর প্রথম দিকের কথা। পরে আর লুট হওয়া মাল ইংরেজরা খুঁজে পায়নি।’
“এরপরে হঠাৎ সাবিনের শরীরটা কী কারণে খারাপ হল। শুরু হল বমি। শেষে অনেক কষ্টে একটা মেছুয়াদের নৌকা পেয়ে আমরা বেশি টাকা দিয়ে পাড়ে ভিড়লাম।”
“তারপর?”
“পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ ‘ক্যাসেন্ড্রা’র ক্যাপ্টেনের নাম ছিল জেমস ম্যাকরে। সালটা ছিল ১৭২০। ভারত, বার্মা, থাইল্যান্ড, সুমাত্রা, জাভা, বালি এ সমস্ত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় তখন ইংরেজদের পতাকা উড়ছে পতপত করে। সেই উপনিবেশগুলি থেকে সংগৃহীত সোনাদানাভর্তি জাহাজ ফিরছিল ইংল্যাণ্ডের উদ্দেশ্যে। যার মধ্যে ছিল থাইল্যান্ডের রাজার সেই ব্রেসলেট।
“যে সময়ের কথা বলছি, তখন সুয়েজ খাল কাটা হয়নি। ফলে ভারতমহাসাগর থেকে কোন জাহাজ ইউরোপ যেতে হলে পুরো আফ্রিকা ঘুরে পোর্টএলিজাবেথ আর কেপটাউন হয়ে যেতে হত। পথে পড়ত মোজাম্বিক চ্যানেল।”
ঋজু হঠাৎ দাদুকে থামিয়ে বলে উঠল, “আমি জানি, এটা হল আফ্রিকা মহাদেশ আর মাদাগাস্কার দ্বীপের মধ্যবর্তী একটা প্রণালী।”
সঙ্গে সঙ্গে দাদুর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আনন্দে। বললেন, “বাহ! একদম ঠিক বলেছিস তুই! সেই মোজাম্বিক চ্যানেল ওরফে ‘র্যান্টার বে’ দিয়ে যাওয়ার সময়েই ‘কোমোরস’ নামে একটা ছোট্ট দ্বীপের কাছে লুট করা হয়েছিল ‘ক্যাসেন্ড্রা’কে। আর যার মধ্যে ছিল তৎকালীন সময়ের ৭৫ হাজার পাউন্ডের সোনাদানা, মণিমুক্ত, হিরেজহরত।”
“কিন্তু এত ধনসম্পদ নিয়ে সমুদ্রে সফর করার জন্য তাদের কাছেও নিশ্চয়ই সৈন্যসামন্ত, গোলাবারুদ ছিল অনেক?” এ প্রশ্নটা করল দোয়েল।
“তা তো ছিলই। তবে প্রতিপক্ষও ছিল কুখ্যাত জলদস্যুদের একটা দল। অনেকগুলি জাহাজ নিয়ে তারা ঘিরে ধরল ‘ক্যাসেন্ড্রা’কে। তাদের ক্যাপ্টেনের নাম শুনলে সেই সময়ে হৃৎকম্প শুরু যেত ইংরেজ, ডাচ, ফরাসি আর পর্তুগিজ নাবিকদের। ‘এডওয়ার্ড ইংল্যান্ড’ ওরফে ‘নিড’। কালো পতাকার উপর মড়ার খুলি আর ক্রস করে আঁকা দু’খানা হাড়। এই ছিল জলদস্যুদের চিহ্ন। সমুদ্রের মাঝে কোন জাহাজকে আক্রমণ করার আগে তারা এই পতাকাগুলি টাঙিয়ে দিত মাস্তুলের সঙ্গে।”
“তারপর কী হল?”
“প্রায় টানা দশ দিন ধরে সৈন্যসামন্ত নিয়ে যুদ্ধ করলেন ক্যাপটেন ম্যাকরে। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলেন না। শতাধিক ইংরেজ সৈন্য মারা গেল। আহত অবস্থায় বন্দী হলেন ম্যাকরে। কিন্তু এডওয়ার্ড তাঁকে প্রাণে মারলেন না। এর আগেও এডওয়ার্ড দক্ষিণ আমেরিকার জামাইকাতে একটা সোনা ভর্তি জাহাজ লুট করেছিলেন আর এক জলদস্যু ক্রিস্টোফার কন্ডেন্টের সঙ্গে। সেই সময়টাকে বলা হত ‘গোল্ডেন এজ অফ পাইরেসি’। মানে সমুদ্রগুলি ছিল জলদস্যুদের স্বর্গরাজ্য। থমাস হাওয়ার্ড, নাথানেল নর্থ, জন হ্যালসে, থমাস টিউ, জ্যাক এ্যাত্রে, উইলিয়াম কিড, ক্রিস্টোফার কনডেন্ট এরা ছিলেন কুখ্যাত সব জলদস্যুদের সর্দার। ইংরেজদের পণ্যবাহী জাহাজ ‘ক্যাসেন্ড্রা’ আক্রমণ করার জন্য এডওয়ার্ড ইংল্যান্ডকে সহযোগিতা করেছিলেন আর এক কুখ্যাত জলদস্যু। তার নাম ছিল জেমস প্ল্যান্টেন। পরবর্তীকালে এডওয়ার্ড ইংল্যান্ড মারা যাবার পর প্ল্যান্টেন হয়ে ওঠেন তাঁর পুরো নৌবাহিনীর কমান্ডার। মাদাগাস্কার দ্বীপটির একছত্র স্বঘোষিত রাজা ছিলেন তিনি। নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘দ্যা কিং অফ র্যান্টার বে’ নামে।”
ঋজু প্রশ্ন করল, “তার মানে, খান্দেরি দ্বীপে ইংরেজদের যে পুরানো চিঠিটা পেয়েছিলেন আপনারা, তাতে এই জেমস প্ল্যান্টেনের নামই লেখা ছিল?”
দাদু মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ। আমি কানোজি আংরে সম্পর্কে আরও কিছু বইপত্র সংগ্রহ করে পড়াশোনা শুরু করি। তিনি বিদেশী যুদ্ধজাহাজ গুলিকে টক্কর দেওয়ার জন্য নিজের নৌবাহিনীকেও সমস্ত দিক থেকে ইউরোপের সমতুল্য তৈরি করেছিলেন। আর সেজন্যই বহু ডাচ, ইংরেজ, পর্তুগিজ, জামাইকানদের নৌসেনাদের নিজের সৈন্যবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসিয়েছিলেন। এদিকে ‘দ্যা কিং অফ র্যান্টার বে’ অর্থাৎ জেমস প্ল্যান্টেন ইংরেজদের অত বড় ক্ষতি করার পরে নিশ্চিন্তে বেশি দিন ঘুমাতে পারেননি নিজের ডেরায়। কয়েক বছরের মধ্যেই ক্রমাগত আক্রমণের মুখে পড়ে তাঁর সৈন্যবাহিনী ছন্নছাড়া হয়ে যায়। তিনি জানতেন সেই সময়ে প্রবল ইংরেজ আর পর্তুগিজদের হাত থেকে বাঁচতে গেলে একটা বড় ছাতার তলায় আশ্রয় নিতে হবে। ভারত মহাসাগরের বুকে সেটা কানোজি আংরে ছাড়া আর কেউ নয়।”
তুলি বলল, “মানে শত্রুর শত্রু হল বন্ধু?”
“ঠিক তাই। প্ল্যান্টেন শেষ পর্যন্ত আংরের কাছে এসে আশ্রয় চাইলেন। আর আংরে সসম্মানে তাঁকে নিজের সৈন্যবাহিনীর প্রধান বন্দুকবাজ করে দিলেন। সেটা ছিল ১৭২৮ সাল। মানে আংরের মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগে।”
“তারপর?”
“আংরে আমৃত্যু আরব সাগরের বেতাজ বাদশা ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর বেশ কয়েক দশক ধরে সেই ট্র্যাডিশন বজায় রেখেছিলেন আংরের পরিবার। এরপর ১৭৫৬ সালে ব্রিটিশ আর পর্তুগিজ যৌথবাহিনী আংরের প্রধান ঘাঁটি বিজয়দুর্গ আক্রমণ করে ও আংরে বংশের আধিপত্য অনেকটা নষ্ট হয়।”
ঋজু হঠাৎ প্রশ্ন করল, “ইংরেজরা বিজয়দুর্গ আক্রমণ করার সময়ে কী জেমস প্ল্যান্টেন যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন?”
দাদু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “ইতিহাসের এই অধ্যায়টা বেশ অন্ধকারাচ্ছান্ন। মানে প্ল্যান্টেনের মৃত্যুর খবর কোথাও লেখা নেই। শেষ জীবনে তাঁর কী হয়েছিল তা কেউ জানে না। এই নিয়ে অনেক খোঁজখবর করেছি আমি। এর অনেক বছর পর হঠাৎ করে একটা আলোর দিশা পেলাম। আমার এক বন্ধু অনিমেষের কাকা থাকতেন জার্মানিতে। তিনি মারা যাবার পর একটা চিঠি এসে পৌঁছাল অনিমেষের হাতে। চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন ওর কাকিমা। সঙ্গে ছ’ইঞ্চি মাপের সংকর ধাতুর তৈরি বাঁকানো একটি ছোরা। তার খাপের গায়ে অদ্ভুত কারুকার্য আর জলদস্যুদের খুলির চিহ্ন আঁকা। চিঠিটাতে লেখা ছিল জলপাইগুড়ির কোন এক প্রত্যন্ত গ্রামে থাকতেন প্রশান্ত দত্ত নামে এক ব্যক্তি। বাড়ির সঠিক ঠিকানা জানা নেই। তাঁর বাড়িতে জিনিসটি পৌঁছে দিতে হবে।”
“কেন?” অবধারিত ভাবে প্রশ্নটা করল দিগন্ত।
“অনিমেষের কাকা ফ্রাঙ্কফুর্টের যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেটা ছিল মাইকেল প্রশান্তনাথ দত্ত নামে এক বয়স্ক বাঙালি ভদ্রলোকের। তিনি ছিলেন আয়ুর্বেদের চিকিৎসক। মাইকেল পদবীটা ওদেশে গিয়ে ধর্ম পরিবর্তন করার পরে হয়েছিল। বিয়ে করেছিলেন কোন খ্রিষ্টান মেয়েকে। পরে আবার ছাড়াছাড়িও হয়ে যায়। যাই হোক, সে-সময়ে নাকি জার্মানিতে ওঁর পসার ভালোই ছিল। কিন্তু শেষ জীবনটা কেটেছিল খুবই একাকীত্বের মধ্যে। দেশের পরিবার পরিজনের সঙ্গে কোন সম্পর্ক ছিল না। বন্ধুর কাকাই অনেকটা দেখাশোনা করতেন। কাকা তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ওদেশে সবে গেছেন। শেষ সময়ে মৃত্যুপথযাত্রী মিঃ দত্ত সেই ছোরাটা তাঁকে দিয়ে অদ্ভুত একটা কথা বলেছিলেন, ‘দ্যা কিং অফ র্যান্টার বে’ যে অগাধ সম্পত্তি লুকিয়ে রেখে গেছেন, তার হদিশ আছে এর মধ্যে। যদি পারো তো উদ্ধার কোর। একটা সুত্র দিয়েছিলেন তিনি, ‘মণিরম্ভার আধারে, রাজার ধন আছে লুকায়ে’।”
তুলি অবাক গলায় প্রশ্ন করল, “দ্যা কিং অফ র্যান্টার বে’ মানে জলদস্যু জেমস প্ল্যান্টেন! তাঁর গুপ্তধনের হদিশ মিঃ দত্ত পেলেন কোথা থেকে?”
দাদু বললেন, “সম্ভবত ওঁর পারিবারিক সম্পত্তি থেকে পেয়েছিলেন জিনিসটা। পরে সেটা নিয়ে জার্মানি পাড়ি দিয়েছিলেন।”
তুলি প্রশ্ন করল, “তারপর তোমার বন্ধুর কাকা কি উদ্ধার করতে পারলেন সেই গুপ্তধন?”
“নাঃ! সেটা জার্মানিতে বসে সম্ভবও ছিল না। তাঁর কাছে নিশ্চিত মাইনের চাকরি ছেড়ে সেই সময় গুপ্তধন খুঁজতে যাওয়াটা মনে হয়েছিল অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। তাছাড়া সেই গুপ্তধন উদ্ধার হবেই, এমন কোন গ্যারান্টিও তো ছিল না।”
“তাহলে কী হল শেষ পর্যন্ত?”
“কী আর হবে? বেশ কিছুদিন গুবরে পোকার মত কামড়াল মাথার মধ্যে। তারপর ভেতো বাঙালি ভুলে গেল সে-সব কথা। ছুরিটা পড়ে রইল ঘরের এক কোণে। তারপর মারা যাওয়ার সময়ে মনে পড়ল পুরানো কথা। বললেন, তাঁর মৃত্যুর পর যেন জিনিসটা পাঠিয়ে দেওয়া হয় আসল প্রাপকের কাছে। আর সেই দায়িত্ব এসে পড়ল অনিমেষের ঘাড়ে। সে আর্জি জানাল আমার কাছে। আমি ছোরাটা হাতে নিয়ে ভাবলাম, নব্বই বছর আগে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন যিনি, আবার ধর্মান্তরিত হয়ে সব শিকড়ে কাঁচি চালিয়ে দিয়েছেন, তাঁর পরিবারকে এত বড় জলপাইগুড়ি জেলায় খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার সমান।”
“পেলেন খুঁজে?”
“খুব একটা সহজ ছিল না কাজটা। অনেক খোঁজ খবর নিয়ে একটা লিস্ট বানালাম। সেই ঠিকানা ধরে ধরে খুঁজতে লাগলাম আমি আর অনিমেষ। চার নম্বর দত্ত পরিবারটিতে গিয়ে দেখলাম এরাই স্বর্গীয় মাইকেল প্রশান্তনাথ দত্তর উত্তরসূরি। সৌম্যজিৎ নামে একটি বছর পঁয়ত্রিশের ছেলে জানাল, ওদের পূর্বপুরুষ ছিলেন এই গ্রামের জমিদার। ইংরেজ আমলে বংশের কেউ বিদেশে গিয়েছিলেন পড়াশোনা করতে। পরে আর ফিরে আসেননি। তার বয়স্ক মা কানে শোনেন কম, কিন্তু প্রশান্তনাথ দত্তর নাম শুনে জানালেন, ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন বলে তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করা হয়েছিল।”
“তারপর কী সেই ছোরাটা সৌম্যজিৎকে দিয়ে দিলে?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দাদু বললেন, “জিনিসটা তো ওরই প্রাপ্য। কিন্তু দেওয়ার আগে ওদের বংশের ইতিহাসটা জেনে নিলাম। আমি আসলে মিসিং লিঙ্কটা খুঁজছিলাম বুঝলি? ওদের এক পূর্বপুরুষ শম্ভুনাথ দত্ত এই গ্রামের জমিদারী কিনেছিলেন লর্ড ক্লাইভের কাছ থেকে। এর আগে ওঁরা ছিলেন পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রামের বাসিন্দা। শম্ভুনাথ নাকি প্রথমে জাহাজের ব্যাবসা শুরু করেছিলেন সতেরশো শতাব্দীর প্রথম দিকে। তিনি পণ্যবাহী জাহাজে মালপত্র আদানপ্রদান করতেন পূর্ব থেকে পশ্চিম ভারতে। পরে কানোজি আংরের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং তাঁর নৌবাহিনীতেও যোগ দিয়েছিলেন। ১৭৫৬ সালে ইংরেজরা বিজয়দুর্গ আক্রমণ করার পরে শম্ভুনাথ ফিরে আসেন বাংলায়। এদিকে তখন সিরাজকে পরাজিত করে বাংলার মসনদে জাঁকিয়ে বসেছেন ক্লাইভ। ১৭৬০ সালে শম্ভুনাথ দত্ত এই জমিদারী কেনেন ব্রিটিশদের কাছ থেকে।”
“তার মানে জলদস্যু জেমস প্ল্যান্টেনের ছোরাটি শম্ভুনাথ দত্তই নিয়ে এসেছিলেন সঙ্গে করে?”
ঋজুর প্রশ্নের উত্তরে দাদু মাথা নেড়ে বললেন, “ঠিক তাই। তবে ছোরার সঙ্গে ছিল একটা জামাইকান বাক্স। তাতেও নাকি আঁকা ছিল মড়ার খুলির চিহ্ন।”
“আপনি এত কিছু জানলেন কী করে?”
“বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমি তখন দক্ষিণে ম্যাঙ্গালোরে থাকি। সেখানে ‘কালাই গাথু’ নামে এক জায়গায় এক সতেরশো শতাব্দীর পার্সিয়ান চার্চ আছে। পরিচয় হল সেই মন্দিরের বৃদ্ধ ধর্মযাজকের সঙ্গে। অমায়িক মানুষ। কথাপ্রসঙ্গে তিনি জানালেন, চার্চটি তৈরির পিছনে হাত ছিল এক জামাইকান জলদস্যুর। সারা জীবনের অসংখ্য পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য নিজেকে অর্পণ করেছিলেন ‘জরাথুস্ট্র’এর কাছে। অগ্নির উপাসক হিসাবে কাটিয়েছিলেন শেষ জীবন।”
“পাদ্রীর কাছে জলদস্যুর কথা শুনে আমার আগ্রহ বেড়ে গেল। তারপর সেই চার্চের নির্মাতার ইতিহাস জানার জন্য ব্যাকুলভাবে আর্জি জানালাম ওঁর কাছে। বহু পুরানো এক পুঁথির সন্ধান দিলেন তিনি। পুঁথিটি ছিল মুম্বাইয়ে ইব্রাহিম নামে আর এক পার্সিয়ান বৃদ্ধের কাছে। সেই লোকের সঙ্গে দেখা করার জন্য পৌঁছলাম মুম্বাইয়ের মালাডে। পার্সিরাও বৌদ্ধদের মত প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ পুঁথিগুলি অতি যত্নে সংরক্ষণ করে রাখেন বংশপরম্পরায় যুগ যুগ ধরে। তিনি একটি বিশেষ পুঁথি খুলে পড়ে শোনালেন পুরানো সেই ইতিহাস।”
“কী রকম?”
“অনেক কথাই বললেন। কানোজি আংরের মৃত্যুর পর ব্রিটিশরা ‘গিরাদুর্গ’ আক্রমণ করেছিল। যার বর্তমান নাম বিজয়গড় ফোর্ট। জেমস সেই যুদ্ধে আহত হয়ে কোনরকমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচান। পরে ছদ্মবেশে তিনি দক্ষিণে ‘কালাই গাথু’তে গিয়ে ধর্ম পরিবর্তন করে পার্সি হন, আর তাঁরই অর্থানুকূল্যে তৈরি হয়েছিল সেখানের পার্সি মন্দিরটি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ইংরেজরা খোঁজ পায় প্ল্যান্টেনের। তারপর আর জেমস প্ল্যান্টেনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ইব্রাহিম আরও জানালেন, জেমসের সঙ্গে ছিল একটি মহামূল্য লাল হিরে বসানো সোনার অলঙ্কার আর দামী পাথর ভর্তি এক জামাইকান বাক্স। যেটার গায়ে আঁকা ছিল মড়ার খুলির চিহ্ন।”
“জেমস প্ল্যান্টেন কি ফিরে গিয়েছিলেন নিজের দেশে?”
দাদু মাথা নেড়ে বললেন, “সে বিষয়েও নিশ্চিত কোন তথ্য যায়নি এখনও। আর শম্ভুনাথ দত্ত কীভাবে জিনিসগুলি পেয়েছিলেন? ধোঁয়াশা রয়েছে সেখানেও। তবে আমার অনুমান আংরের নৌসেনায় একসঙ্গে কাজ করার সুবাদে দুজনের হয়ত পরিচয় ছিল। আর এমনও হতে পারে জেমস প্ল্যান্টেনকে হত্যা করে শম্ভুনাথ হাসিল করেছিলেন জিনিসগুলি।”
সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর। দিগন্ত জিজ্ঞেস করল, “তা এতদিন পরে আপনার উদ্বেগের কারণ কী?”
দাদু হেসে বললেন, “আজকে তোরা আসার আগেই সৌম্যজিৎ ফোন করেছিল আমাকে। ওদের আর এক পূর্বপুরুষ রমেন্দ্রনাথ দত্ত জন্মেছিলেন আঠারো শতকের প্রথম দিকে। তাঁর একটা হাতে লেখা ডায়রি খুঁজে পাওয়া গেছে কিছুদিন আগে। সেটার মধ্যে নাকি কিছু গুপ্তধনের সংকেত লেখা আছে। ভাবছি এই ফাঁকে একবার উত্তরবঙ্গটা ঘুরে এলে মন্দ হয় না। জায়গাটা ডুয়ার্সের লাগোয়া। জলঢাকা নদীর কাছেই।”
“আরিব্বাস! তার মানে জঙ্গল, পাহাড়, নদী, বুনোজন্তু সবই আছে। আমরাও যাব তোমার সঙ্গে। এখন কদিন ছুটি চলছে স্কুলে। সেই ফাঁকে গুপ্তধন খোঁজাটাও হয়ে যাবে।” ঋজুর কথাতে বাকিরাও চিৎকার করে উঠল আনন্দে।
***
শম্ভুনাথপুরে বড় ঝিলের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে পোড়োমন্দির ফেলে বাঁশবনের দিকে, সেখানে আজ সকাল থেকেই একটা জটলা। ঘটনাটা হয়েছে কী, বৃদ্ধ হারাধন চক্কোত্তি প্রতিদিন প্রাতঃকৃত্য সারতে জঙ্গলে যান। বহু পুরানো অভ্যাস। তা আজ সকালে কাজ মিটিয়ে ঝিলের পাশ দিয়ে যখন ফিরছিলেন, আচমকা চোখে পড়ে একজোড়া পা বেরিয়ে আছে ম্যারালি পাতার ঝোপের মধ্যে থেকে। প্রথমে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছিলেন, তারপর হাতের লাঠিটা দিয়ে ঝোপটা সরিয়ে দেখেন জামাপ্যান্ট পরা একটা লোক উপুড় হয়ে পড়ে আছে সেখানে। গায়ে কোন সাড় নেই। তৎক্ষণাৎ জোরে পা চালিয়ে শ্যামলের চা দোকানে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে খবরটা দিলেন। তারপর গ্রামের কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে আবার পৌঁছালেন সেখানে।
ঝোপটা ভালো করে সরিয়ে দেখা গেল, লোকটা এ গ্রামের কেউ নয়। আগে কেউ কখনও দেখেছে বলেও মনে করতে পারল না। কী রকম অদ্ভুত চোয়াড়ে মুখ! কোটরে ঢোকা চোখ। মাথায় কোঁকড়ান সাদা চুল। মারা গেছে অনেকক্ষণ। সম্ভবত কাল রাতে। তবে শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। হয়ত অন্য কোথাও থেকে মৃতদেহ নিয়ে এসে ফেলে যাওয়া হয়েছে এখানে। শিবু থানায় ফোন করতে দারোগাবাবু বললেন, “আমি না যাওয়া পর্যন্ত কেউ যেন হাত না দেয়।”
আধঘণ্টার মধ্যে পুলিশের গাড়ি এসে পৌঁছল। মৃতদেহটাকে পরীক্ষা করে ডাইরিতে কিছু নোট করলেন দারোগা কুন্তল বৈরাগী। তারপর প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান লিখে নিয়ে মোড়ল রমেন খুড়োকে বললেন, “এর আগে এ-গ্রামে এমন ঘটনা ঘটেনি কখনও। বাইরের কিছু লোক দেখেছেন কী ইদানীং এখানে?”
রমেন খুড়ো গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে জানাল, “তেমন তো কাউকে মনে পড়ছে না। তবে আমি খোঁজখবর করে জানাচ্ছি।”
“ঠিক আছে। এখন লাশটাকে পোস্টমর্টেমে পাঠাই। দরকার হলে ফোন করব আপনাকে। দেখে তো এখানকার লোক বলে মনে হচ্ছে না।”
ঘোলাটে চোখে হারাধন চক্কোত্তি এগিয়ে এসে বললেন, “মহৎসবতলায় কিছু গানের দল এসে জুটেছে। লোকগুলোর চাউনি মোটে ভালো নয়।”
মিচকে হেসে রমেন খুড়ো উত্তর দিলেন, “আপনার চাউনির প্রতিও খুব একটা ভরসা করা যায় না কিনা!”
*****
বিট্টু অনেকক্ষণ থেকে খেয়াল করছিল লোকটাকে। শক্তপোক্ত চেহারা, গালে সাদা খোঁচাখোঁচা দাড়ি, মাথার চুল উশকোখুশকো। পরনে ময়লা রঙচঙে ফতুয়া আর হাঁটুর নিচে মলিন সাদা প্যান্ট। পোশাক আর চেহারাটা ঠিক স্থানীয় মানুষের মত নয়। কাঁধে একটা কাপড়ের রঙিন ঝোলাব্যাগ। লোকটা ক’দিন হল দুপুরে এসে বড় বটগাছের নিচে সিমেন্টের বেদীতে বসে। বিট্টুর তখন ঘুমানোর সময়। কিন্তু একা একা ঘুমাতে তার ভালো লাগে না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে বাইরে।
প্রতিদিনের মত আজকেও লোকটা এসে বসেছে সেখানে। তারপর একটা কালো রঙের সরু বাঁশি বের করে ফুঁ দিল বেশ কায়দা করে। সুন্দর সুরেলা আওয়াজ ভেসে গেল বাতাসে। অচেনা সেই সুরের মধ্যে একটা জাদু আছে। যার টানে রোজ বিট্টু দাঁড়িয়ে থাকে দোতলার জানালায়।
“কীরে ওখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস?” আচমকা পিছন থেকে ডাকটা শুনে চমকে উঠল বিট্টু। ঘুরে দেখল সুমিদি। ওরা একতলায় নতুন ভাড়া এসেছে। মাঝে মাঝে ঘুরতে আসে এখানে।
“কিছু না সুমিদি, একটা লোক বাঁশি বাজাচ্ছে কী সুন্দর! তাই এখানে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম।”
“কৈ দেখি!” বলে সেও এসে দাঁড়ালো জানালায়।
সুমিদি কিছুক্ষণ চুপ করে মন দিয়ে শুনে বলল, “তাই তো! এই প্রথম শুনছি আমি। লোকটাকে আগে কখনও দেখিনি তো!”
ঠিক সেই সময়েই হঠাৎ বাড়ির পিছন দিক থেকে হঠাৎ কানে এল একটা চিৎকারের আওয়াজ। দৌড়ে গেল সুমিদি। বিট্টুর দৌড়ানর ক্ষমতা নেই। ক্রাচ দুটোকে বগলের নিচে চেপে ধীরে ধীরে এগোল সে। সিঁড়ি দিয়ে মুখ বাড়িয়ে শুনল কাজের মিনামাসি চিৎকার জুড়েছে, ‘বাবাগো! মাগো!’ বলে।
কী ব্যাপার! সুমিদি কিছুক্ষণ পর খোঁজ নিয়ে এসে জানাল, “মিনামাসি পুরানো গুদাম ঘরে ঢুকেছিল কী একটা জিনিস খুঁজতে, সেখানে নাকি ভূত দেখেছে।”
“ভূত! গুদাম ঘরে! এই দুপুরবেলা?”
“হ্যাঁ, মিনামাসি তো থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে কথাই বলতে পারছে না। শুধু বলল একটা কালো ছায়ামূর্তি নাকি সরে গেল।”
কথাটা শুনে বেশ কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইল বিট্টু। পুরানো বাড়ি বলে অনেকের নাকি গা ছমছম করে। কিন্তু বিট্টু আজ পর্যন্ত কোনদিন কিছু দেখতে পায়নি। এককালে ওরা এই গ্রামের জমিদার ছিল। উঁচু কড়িবরগার পেটানো ছাদ, মোটা মোটা দেয়াল, পলেস্তারা খসা সিঁড়ি, ছাদের উপর চিলে ঘর, কাঠের খড়খড়ি দেওয়া বড় বড় জানালা, আর দেয়ালের গায়ে গজিয়ে ওঠা বট- অশ্বত্থের চারা। তবে চারপাশে কিছু জায়গা জমি আর একটা বড় পুকুর ছাড়া এখন আর তেমন কিছু নেই। ছাদের উপরে দাঁড়ালে উত্তরের দিগন্তরেখা বরাবর চোখে পড়ে পাহাড়ের সারি। আর একটা মন্দির আছে। কৃষ্ণের মন্দির। সেই ঠাকুরের বেদীটা কদিন আগে কেউ ভাঙার চেষ্টা করেছিল। কিছু ছিঁচকে চোর আছে গ্রামে। এ তাদেরই কাজ। বহুদিনের একটা গুপ্তধনের গুজব আছে এ বাড়িকে নিয়ে। গতকাল একটি ইউরোপিয়ান মেয়ে এসেছিল কীসব খোঁজখবর করতে। মোট পনেরটা ঘরের মধ্যে অনেকগুলি এখন বন্ধ। আসলে বিট্টুর কাকা জেঠারা সবাই পরিবার নিয়ে চলে গেছেন শহরে। অনেকে আবার বিদেশে। কিছু ঘরে তিনটে ভাড়াটিয়া থাকে। যাদের মধ্যে সুমিদিরা নতুন এসেছে।
“চলো, আমি একবার গিয়ে দেখি।” বিট্টু সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল।
সুমিদি চেঁচিয়ে উঠল, “না না, তোকে যেতে হবে না। তোকে যদি ভূতে ধরে!”
“কী যে বল, সুমিদি! তুমি তো আগে শহরে থাকতে। ভূতে বিশ্বাস করো?”
“সত্যি কথা বলতে কী, এই গ্রামে এসে আমার ভূতের ভয় বেড়ে গেছে। সন্ধ্যার পর একা পুকুর পাড়ে যেতেও ভয় লাগে। হঠাৎ হঠাৎ পুকুরের মধ্যে কী যেন নড়ে ওঠে!”
“আরে ও তো রাজা আর রানি। দুটো এত্তো বড় বড় রুই মাছ আছে পুকুরে। ওরাই আওয়াজ করে মাঝে মাঝে।” বলে হাত ফাঁক করে দেখাল বিট্টু। আর সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতের ক্রাচটা আলগা হয়ে পড়ে গেল সিঁড়ি দিয়ে।
সুমিদি গিয়ে তুলে এনে জিজ্ঞেস করল, “তুই কী ছোট থেকেই….”
“হ্যাঁ দিদি। আমার এই পা’টা জন্ম থেকেই ছোট।”
ওরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে পিছনের গুদাম ঘরের দিকে এগোল। মিনামাসির মাথায় জল দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে কেউ। সে চুল শুকচ্ছে আর হাউমাউ করে কান্না জুড়েছে, “আমি আর এ বাড়িতে কাজ করব না। বাপরে! এখুনি একটা ওঝা ডেকে ঝাড়ফুঁক করতে হবে।”
বিট্টু সামনে গিয়ে দাঁড়াল, “কী দেখছ ঠিক করে বলতো!”
পাশ থেকে ঝুমাকাকিমা এগিয়ে এসে বলল, “ওসব তুমি জেনে কী করবে বিট্টু? শুনলে ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারবে না। তোমার বাবা ফিরলে ওঁর সঙ্গে কথা বলব আমরা।”
“কিন্তু দুপুরবেলা গুদাম ঘরের চাবি খুলেছিলে কেন?” বিট্টু হট্টগোলের মধ্যে আবার চেঁচিয়ে প্রশ্ন করল।
মিনামাসি হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, “একটা হাঁড়ি আমি কদিন থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। ভাবলাম কেউ যদি গুদামঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে থাকে। তাই বড়মার কাছ থেকে চাবি নিয়ে খুলেছিলাম।”
বড়মা মানে বিট্টুর ঠাকুমা। আশির গোড়ায় বয়েস। কানে একটু কম শোনেন। হাঁটেন লাঠি ধরে। তিনি বসেছিলেন পাশে। বললেন, “তুই যে বললি গাড়ি! বুলবুলির গাড়ি ঢুকে গেছে জানালা দিয়ে।”
“কখন বললুম গাড়ি? আমি তো হাঁড়ি বললুম।”
বিট্টু এই চ্যাঁচামেচি থেকে বেরিয়ে এসে ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। পুকুরের দিকে যাওয়ার আগে বাঁদিকে গুদাম ঘরের দরজাটা খোলা। সে ধীরে এগিয়ে এসে দরজাটা ঠেলে মুখ বাড়িয়ে দেখল ভিতরটা বেশ অন্ধকার। একটা ভ্যাপসা গন্ধ ধাক্কা মারল নাকে। পিছন দিকের জানালা দিয়ে আলো এসে পড়েছে। ওদিকের জানালার কাঠ কিছুটা ভাঙা। যদিও জং ধরা মোটা রডগুলি রয়ে গেছে জেলখানার মত। ঘরের মধ্যে ঢুকে বিট্টু দেখল পুরানো যত আসবাবে ঠাসা। ভাঙা চেয়ার, টেবিল, ফুলদানি, পুরানো আমলের দাঁড়ানো পেন্ডুলাম ঘড়ি আর এক কোণে বড় একটা আলমারি। এছাড়া আরও হাজারো ছোটখাটো জিনিসে ভর্তি। মেঝেতে ধুলো আর নোংরা। কিন্তু ধুলোর মধ্যে কয়েকটা পায়ের ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তবে ভয় পাওয়ার মত কিছুই নেই।
তবু মিনামাসি ভির্মি খেল কেন? সুমিদি ততক্ষণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, “চল বিট্টু এখান থেকে। আমার কেমন ভয় ভয় করছে।”
বিট্টু আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এদিক ওদিক উঁকিঝুঁকি মেরে দেখল। তারপর গুদাম ঘরের দরজাটা টেনে বন্ধ করে তালা লাগিয়ে চাবিটা পকেটে পুরে বলল, “এটা এখন আমার কাছেই থাক। বাবা ফিরলে দেব।”
***
গ্রীষ্মের শেষে গাঙ্গুলিদের বাগানে মহোৎসব চলে এক সপ্তাহব্যাপী। দূরদূরান্ত থেকে হরিসংকীর্তনের জন্য নামগান করার লোক ভাড়া করে আনা হয়। তারা পালা করে সারা দিনরাত গান করে। এদের থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করেন পরাণ গাঙ্গুলি। মালবাজারে ওঁদের পুরানো গহনা ও বন্ধকী দোকান আছে। বনেদি বড়লোক। তাঁর পূর্বপুরুষরাই শুরু করেছিলেন এই মহোৎসব।
সেদিন সন্ধ্যায় ঠাকুরের গান শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে গিয়েছিলেন গাঙ্গুলিবাবু। চোখ বন্ধ, মাথাটা দুলছে শুধু টুকটুক করে। তাঁর চেয়ারের আশেপাশে আরও অনেক লোক। ভিড় ভালোই হয়েছে। এরই মধ্যে বড় রাস্তায় অন্ধকারে একটি বাইক এসে দাঁড়াল কৎবেলতলায়। দুজন লোক নামল। বাইকটাকে গাছের পিছনে রেখে এগিয়ে গেল। হরিতলার দিকে ভিড় ঠেলে এগোল একজন। অন্যজন দাঁড়িয়ে রইল দূরে। পরাণ গাঙ্গুলির চেয়ারের পিছনে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে কানের কাছে মুখটা নিয়ে এসে ফিসফিস করে কিছু একটা বলতেই চমকে উঠলেন তিনি। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন।
কৎবেল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে লোকটা চাপা গলায় ফোন করছিল কাউকে। পরাণ গাঙ্গুলি পিছনে এসে দাঁড়াতে মোবাইলটা পকেটে রেখে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “আসুন গাঙ্গুলিবাবু।”
“তুমি এখানে কেন এলে?”
“জিনিসটা দু’একদিনের মধ্যেই উদ্ধার করতেই হবে। রাস্তা করে দিন।”
চারপাশে একবার চোখটা ঘুরিয়ে নিয়ে পরাণ গাঙ্গুলি বললেন, “দু’দিনের মধ্যে কী করে হবে? ভাড়াটিয়া সমেত অতগুলো লোক থাকে বাড়িটাতে। বুঝতেই তো পারছ! মন্দিরে ঢোকা অত সহজ নয়। আর কিছু দিন সময় লাগবে। শিবুকে পাঠিয়েছিলাম গতকাল দুপুরে। কিন্তু সে খালি হাতে ফিরেছে।”
“ওসব কথা বস শুনবে না। তিনি বলেছেন পেমেন্ট যখন নিয়েছেন কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উদ্ধার করে দিতে হবে। খদ্দের এসে গেছে কলকাতায়।”
“এই জন্যই আমি কাজটা নিতে চাইনি। ঐ লাশটা এখানে ফেললে কেন শুনি? চারিদিকে পুলিশের খোঁচর ঘুরছে। আমি তো এমনিতেই সন্দেহের তালিকায় আছি। তার উপর এসব ঝঞ্ঝাট ভালো লাগে না। ভাবছি এডভান্সের টাকা ফেরত দেব।”
“ও কাজটা ভুলেও করবেন না গাঙ্গুলিমশাই। বসকে আপনি চেনেন না। আর লোকটাকে কিন্তু আমরা মারিনি।”
“তাহলে মারল কে?”
“বলতে পারব না। গজাকে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছিলাম। সে এসে বলল, এখানের লোক নয়। শুনুন গাঙ্গুলিবাবু, আমাদেরও পিছনে পুলিশ পড়ে গেছে। আজকেই একটা অপারেশন করব আমরা। বেশিদিন এখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকা যাবে না। আপনার লোক বাইরে পাহারায় থাকবে। ভিতরে ঢুকব আমি আর শম্ভু।”
কিছুক্ষণ গোঁজ হয়ে থেকে খকখক করে দু’বার কেশে উঠলেন পরাণ গাঙ্গুলি।
***
সন্ধ্যাবেলা সাইকেল চালিয়ে পেলুদের বাঁশ বাগানের পিছন দিয়ে ফিরছিলেন স্থানীয় স্কুলের ভূগোলের শিক্ষক সৌম্যজিৎ দত্ত। এখন গরমের ছুটি চলছে তাই বিকেল থাকতে থাকতে টিউশানি সেরে তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকে বিল্টুকে নিয়ে একটু পড়াতে বসবেন। স্ত্রী হঠাৎ করে মারা যাওয়ায় খুবই আতান্তরে পড়েছেন ভদ্রলোক। একদিকে স্কুল, টিউশানি আবার ছেলের দেখাশোনা সব দায়িত্বই ওঁর কাঁধে। বাড়িতে বৃদ্ধা মা আছেন বটে, তবে তিনি প্রায় শয্যাশায়ী। কৃষ্ণপদ হাজরার বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে একটা ডাক শুনে দাঁড়িয়ে গেলেন।
“আরে সৌম্য নাকি! শুনে যাও একবার।”
হরেনকাকুর বয়েস হয়েছে কিন্তু নজরখানা এক্কেবারে দূরবীনের মত। দূর থেকেই ঠিক চিনতে পেরেছেন অন্ধকারে। সৌম্য লক্ষ করল ওঁর সঙ্গে হোসেনচাচা আর পঞ্চুজেঠুও আছেন। প্রতি সন্ধ্যায় দাবার চালের সঙ্গে এখানে চা, চপমুড়ির জন্য আড্ডাটা জমে ভালো। সৌম্য সাইকেল থেকে নেমে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে।
“আমায় ডাকছেন কাকা?”
একটা বিড়ি ধরিয়ে দু’চক্কর ধোঁয়া ছেড়ে হরেন বাঁড়ুজ্যে প্রশ্ন করলেন, “শুনছিলাম ক’দিন আগে দুপুরে নাকি তোমাদের বাড়িতে ভূত দেখা গিয়েছিল?”
“ও কিছু নয়, আমাদের কাজের লোক মিনাদি কী দেখতে কী দেখেছে! ওর একটু ফিটের ব্যামো আছে তো।”
“তোমরা বাপু আজকালকার ছেলেরা সব জিনিসেই অবজ্ঞা কর কেন? আমরা ছোটবেলা থেকে জানি তোমাদের বাড়িতে তেনাদের আনাগোনা আছে। আরে তোমার ঠাকুরদাকে এখনও মনে আছে আমার, বয়সকালে তোমাদের পুকুর পাড়ে বসে জলের দিকে তাকিয়ে পূর্বপুরুষের সঙ্গে কথা বলতেন।”
হরেনবাবুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পঞ্চুজেঠু বলে উঠলেন, “আমার ঠাকুরদার মুখেও তো আমি শুনেছি। বহুকাল আগে এই এলাকাটা ইংরেজদের কাছ থেকে কিনে যিনি জমিদারী শুরু করেছিলেন, সেই শম্ভুনাথ দত্তও নাকি ডাকাত ছিলেন। তাঁর আত্মা যে এখনও শান্তি পায়নি, সে তো টের পেয়েছি আগেও।”
কৃষ্ণপদ বাবু একটিপ নস্যি নাকে পুরে একটু মাথাটা ঝাঁকিয়ে বললেন, “যে সে ডাকাত নয় গো, জলের ডাকাত ছিলেন। যাকে বলে জলদস্যু।”
কথার তাল ঠিক ধরে নিয়ে হোসেনচাচা হাতের বোড়েটা একঘর বাড়িয়ে দিয়ে জানালেন, “শুনেছি তো আমিও। জলদস্যু শম্ভুনাথ দত্তর গল্প বলতেন পণ্ডিত মশাই। তোমাদের বুঝি মনে নেই?”
সৌম্য বলল, “কই আমি তো তেমন কিছু দেখিনি কোনদিন।”
“ওরে বাবা! যারা বিশ্বাস করে না, তাদের কাছে তাঁরা আসেন না কোন দিন। তাঁর আত্মা হয়ত কিছু বলতে চান, কিন্তু বোঝাতে পারছেন না। তাই ফিরে ফিরে এসে জানান দিচ্ছেন যে তিনি আছেন। জলঢাকার তীরে, জঙ্গলের মধ্যে খুব ভোরে বা ভরসন্ধ্যায় অনেকেই দেখেছে এক লম্বা ছায়ামূর্তি। মাথায় টুপি, গায়ে লম্বা হাঁটু পর্যন্ত কোট।”
হঠাৎ একটা ঝোড়ো হাওয়া উঠল প্রবল বেগে। ঘূর্ণি ঝড়ের মত উড়িয়ে নিয়ে গেল একরাশ শুকনো পাতা। “আচ্ছা, কাকা পরে কথা হবে। ঝড় উঠেছে। বৃষ্টি নামল বলে।” কথাটা বলেই সৌম্য সাইকেলের সিটে বসে প্যাডেলে চাপ দিল জোরে। আকাশে শুরু হয়েছে মেঘেদের গুমগুম আওয়াজ। গুমোট করেছিল সকাল থেকেই। কালবৈশাখী আসছে। বৃষ্টিটা হলে একটু ঠাণ্ডা হবে। শান্তিতে ঘুমানো যাবে রাতে। তবে পাখা মনে হয় ঘুরবে না আজ। কারণ একটু ঝড়বৃষ্টি হলেই ইলেকট্রিক চলে যায় এ গ্রামে।
দ্রুত সাইকেল চালাচ্ছিল সৌম্য। আচমকা একটা গাছের ডাল হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে গিয়েও কী করে যেন আটকে গেল! অন্ধকারের মধ্যে একটা বিদ্যুতের ঝলক। আর সেই আলোতেই যেন দেখতে পেল শিমূল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে কে একজন! মাথায় অদ্ভুত চ্যাটালো টুপি, গায়ে একটা লম্বা জোব্বা, বড় বড় দাড়িগোঁফ। কিন্তু ঐ এক ঝলকেই মিলিয়ে গেল। পরক্ষণে ঘুরে তাকিয়ে খেয়াল হল একটা বড় পাতা শুদ্ধু কলাগাছ হেলে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের বিভ্রম আর কাকে বলে। সেই ভাঙা ডালটির নিচ দিয়ে পেরিয়ে আসতেই হুড়মুড় করে বন্ধ হয়ে গেল পথ।
সৌম্য ভাবছিল ওঁদের কথাগুলি কিন্তু একেবারে ফেলে দেওয়ার মতও নয়। নিজে ভূতে বিশ্বাস করে না, তাই হয়ত দেখেনি কোনদিন। কিন্তু অনেকেই নাকি একটা ছায়ামূর্তি মাঝে মধ্যে দেখেছেন আনাচেকানাচে। সুনসান দুপুরে, গোধূলি বেলায় বা ভোররাতে। একটা টুপি আর লম্বা জোব্বা পরা লোক নাকি দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। হেঁটে যায় মন্দিরের পিছনে। মন্দিরের চারপাশে কে নাকি ঘুরে বেড়ায় মাঝরাতে। মনে পড়ল কিছু দিন আগে কলকাতা থেকে এক গবেষক এসেছিলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। তিনিও বলেছিলেন কথাটা। কোন পুরানো গুপ্তধন নাকি লুকান আছে দত্তবাড়ির অন্দরে। কিন্তু কোথায় আছে, কে জানে!
সৌম্য বাড়ি পৌঁছে দেখল বেশ অন্ধকার। ইলেকট্রিক চলে গেছে অনেকক্ষণ হল। কিন্তু কেউ একটা আলোও জ্বালেনি। ঝড়জলের সঙ্গে ভারি মেঘের কানফাটা গর্জন আর সঙ্গে আকাশ বিদীর্ণ করা বিদ্যুতের রেখা। সাইকেলটা সিঁড়ির নিচে রেখে সে কাকভিজে হয়ে উঠে এল দোতলায়। চেঁচিয়ে ডাকল, “বিট্টু.. বিট্টু…”
কোন সাড়া এল না। আবার ডাকল, “মিনাদি … মিনাদি …” এবারেও কোন প্রত্যুত্তর পাওয়া গেল না। কোথায় গেল সবাই! ঘরের দরজা জানলা গুলি সব খোলা। দড়াম দড়াম করে ধাক্কা মারছে হাওয়ার চাপে। ঝোড় হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টির ঝাপটা ঢুকছে ভিতরে। দৌড়ে গিয়ে সেগুলি বন্ধ করল। তারপরেই খেয়াল হল আলমারি আর দেরাজগুলো হাট করে খোলা। ভিতরের সমস্ত জিনিস মেঝেতে পড়ে আছে ছড়িয়ে। মায়ের ঘরে গিয়ে দেখলেন খাটের এক কোণে চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে আছেন তিনি। গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। সৌম্য জিজ্ঞেস করল, “মা বিট্টুকে দেখছ?”
বৃদ্ধা মা এলো চুলে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে উত্তর দিলেন, “না রে! অনেকক্ষণ দেখিনি ওকে। তবে সুমির সঙ্গেই খেলছিল তো! ঘরে নেই?”
“না…”
“তাহলে নিচে রিনিদের ঘরে একবার গিয়ে দেখ। আর একটা কথা শোন, হরিমন্দিরে আবার কেউ ঢুকেছিল। মূর্তিটার গায়ে আঁচড়!”
সৌম্য ভাবল, আগে বিট্টুকে খুঁজে পাই। তারপর ভাবব মন্দিরের কথা। দৌড়ে গিয়ে দেখল, সুমি ঘরেই আছে। তার মায়ের কাছে বসে পড়াশোনা করছে। কিন্তু বিট্টু নেই। সে জানাল, বিকালের পর থেকে আর দেখেনি বিট্টুকে। তাহলে গেল কোথায় ছেলেটা? এই ঝড় জলের মধ্যে অন্য কোন বন্ধুর বাড়ি গেল কি? কিন্তু সেটাও এক প্রকার অসম্ভব।
খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির পিছন দিকে এগোল সৌম্য। আরও দু’জন ভাড়াটিয়াদের জিজ্ঞেস করল। রতনদার বৌ জানাল, “মিনাদিকে আমি সন্ধ্যার আগে পুকুরের দিকে যেতে দেখেছি। তখনও ঝড় শুরু হয়নি।”
সৌম্য কথাটা শুনেই দৌড় দিল সে দিকে। পিছনের দরজা দিয়ে বেরতেই নাকে মুখে ঝাপটা মারল একরাশ ঝোড় বৃষ্টি। তারপর পুকুর পাড়ে বাঁধানো ঘাটের পাশে আচমকা এক পাটি চটি দেখতে পেল টর্চের আলোয়। বিট্টুর চটি! দেখেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। এদিকওদিক আলো মেরে পাগলের মত খুঁজছে সৌম্য। উৎকণ্ঠা বাড়ছে। এদিকেই যে এসেছে সে বিষয়ে নিশ্চিত। কিন্তু সন্ধ্যাবেলা বাড়ির পিছনে এল কেন সে? তারপরে যেটা চোখে পড়ল তাতে গা-হাত থরথর করে কাঁপতে শুরু করল তার। পুকুরের জলে ভাসছে বিট্টুর একটা কাঠের ক্রাচ।
*****
বিট্টু যখন চোখ খুলল, চারিদিকে অন্ধকার। চোখের পাতাগুলি আর মাথাটা ভারি হয়ে আছে ভীষণ। উঠে বসল ধীরে ধীরে। কিছুক্ষণ পর দৃষ্টিটা একটু সয়ে যেতে দেখল একটা ছোট ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে সে। নোংরা কম্বলের উপর একটা বিছানা। পাশে একটা জলের জগ। কোথায় এটা? কী হয়েছিল তার?
মনে করার চেষ্টা করতে খেয়াল হল সন্ধ্যাবেলা মিনামাসি হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, “পুকুরের পিছনে জঙ্গলের দিকে দু’জন লোক গাঁইতি কোদাল দিয়ে গর্ত করছে। আমি বাসন ধুতে গিয়ে দেখেছি দূর থেকে।”
“গর্ত করছে? কেন?”
“মনে হয় গুপ্তধন খুঁজছে।”
“গুপ্তধন! জঙ্গলের মধ্যে গুপ্তধন!”
“ওমা! তুমি জানো না? হালদার বাবুরা সেদিন গল্প করছিলেন। আমি শুনেছি। তোমাদের পূর্বপুরুষের লুকিয়ে রেখে যাওয়া গুপ্তধন এখনও কেউ উদ্ধার করতে পারেনি তো! সে জন্যই তো কতবার ডাকাত পড়েছিল এই বাড়িতে। তখন অবশ্য তুমি জন্মাওনি।”
বিট্টু শুনেছে এই কথাটা এর আগে। বহুবার। তাদের এই বাড়িতে নাকি চার পাঁচবার ডাকাতি হয়ে গেছে। গুপ্তধনের গল্পটাও নেহাত নতুন নয়। আগ্রহটা বাড়ল মিনামাসির কথায়। সে পড়ার টেবিল থেকে উঠে বলল, “চলো তো দেখি, কোথায় মাটি খুঁড়ছে?”
মিনামাসি চোখ গোল গোল করে বলল, “তুমি ভর সন্ধ্যেবেলা কোথায় যাবে? তোমার বাবা আসুক। তিনিই যা করার করবেন।”
“বাবা আসতে দেরি আছে। আমি শুধু দূর থেকে দেখব, কারা ওরা।”
অনেক বারণ করার সত্ত্বেও বিট্টু ক্রাচ নিয়ে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে। পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এগোল বড় চাতালটাকে ডানহাতে রেখে। মেঘ ডাকছে আকাশে। মনে হয় বৃষ্টি নামবে। অন্ধকারের মধ্যে ঝিঁঝিঁর ডাক বন্ধ হয়ে গেছে হঠাৎ। নাকে আসছে হাসনুহানার মিষ্টি গন্ধ। কয়েক পা যেতেই মনের মধ্যে একটা চাপা শিরশিরানি অনুভূত হল। ঝোড় হাওয়া উঠেছে শোঁশোঁ করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ পিছন থেকে চেপে ধরে নাকে ঠেসে ধরল একটা ঠাণ্ডা ভিজে রুমাল। তারপর আর কিছু মনে নেই তার।
ঘরের মধ্যে দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল বিট্টু। এক পায়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এগোল দরজার দিকে। দু’পাল্লার কাঠের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ। ঝাঁকুনি দিয়ে দুম দুম করে আওয়াজ করল কয়েকবার। ফাঁক দিয়ে দিনের আলো দেখা যাচ্ছে বাইরের। সে কতক্ষণ বন্দী আছে এখানে? ঐ রুমালে নিশ্চয়ই ক্লোরোফর্ম ছিল।
একটা জানালাও নেই এই ঘরটার মধ্যে। নেই আলো পাখার ব্যবস্থা। খিদে পাচ্ছে। কোন খাবারও দেয়নি বিট্টুকে। খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। বাবা নিশ্চয়ই খুঁজছে তাকে পাগলের মত। ফিরে এসে আবার বসল নোংরা চাদরের উপর। পাশে জগ থেকে জল খেল কিছুটা। তারপর মাথা নিচু করে বসে রইল অনেকক্ষণ।
কতটা সময় কেটে গেল খেয়াল নেই। বসে থাকতে থাকতে ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে গেল পুনরায়। মাঝে আবার ঘুমটা ভেঙে ছিল। বিট্টু চিৎকার করে ডেকেছে। কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি। ঘরটার উপরে বাঁশের সঙ্গে টালির চাল। ঝুল ভর্তি। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা হল। মশারা ঢুকছে কোন ফাঁক দিয়ে। ঝিঁঝিঁর আওয়াজ কানে আসছে বিট্টুর। মাঝে একবার দুটো লোকের কথাবার্তা শুনতে পেল যেন দূর থেকে। কিন্তু চিৎকার করতেই আবার সব চুপ। প্রচণ্ড খিদের মধ্যে অবশ হয়ে এল শরীর। জলের জগও শেষ হল। বিট্টু কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল আবার।
হঠাৎ ঘুমের মধ্যে মাথায় একটা শীতল হাতের স্পর্শ! কেউ যেন মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে অতি যত্নে। মনে হল, বাবাই হবে। নিশ্চয়ই বাবা এসেছে তাকে নিয়ে যেতে। তারপর কানে এল একটা মিষ্টি বাঁশির সুর। সেই সুরের মধ্যে লুকিয়ে আছে অদ্ভুত এক মাদকতা। বিট্টু ঘুমের মধ্যে যেন তলিয়ে যেতে লাগল কোন অতল গহ্বরে। চারিদিকে তখন তার জমাটা অন্ধকার। ক্রমশ একটা আলোর বিন্দু স্পষ্ট হচ্ছে। তারপর সেটা বড় হতে হতে প্রচণ্ড উজ্জ্বল হয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিল।
কতদূর থেকে যেন একটা আওয়াজ এল কানে। কে একজন ডাকছে। “বিট্টুউউউ…. বিট্টুউউউ….. শুনতে পাচ্ছ আমার কথা…”
… কতক্ষণ পরে গভীর ঘুমের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল সে। জোর করে চোখ খুলে দেখল, আবছা অন্ধকারে সামনে বসে অচেনা এক লোক। উশকোখুশকো বড় বড় ঝাঁকড়া কাঁচাপাকা চুল দাড়ি। চিৎকার করে উঠল বিট্টু। “কে তুমি?”
জলের ঝাপটা দিতে দিতে শান্ত গলায় লোকটি বলল, “ভালো করে লক্ষ করো। আমাকে তুমি চেন।”
“না আমি চিনি না তোমাকে।”
পাশে রাখা একটি সরু কালো বাঁশি হাতে তুলে নিতেই বিদ্যুতের ঝলকের মত বিট্টুর মনে পড়ে গেল, আরে এ তো সেই পাগল বাঁশিওলা। রোজ গ্রীষ্মের দুপুরে যে বাঁশি বাজাত বটগাছের নিচে বসে।
“তুমি! সেই বাঁশিওয়ালা।”
“চিনতে পেরেছ এবার?”
“হ্যাঁ, কিন্তু তুমি আমাকে ধরে এনেছ কেন?”
লোকটি বলল, “তোমাকে ধরে এনেছে অন্য লোক। আমি তো তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি এখান থেকে। চল তাড়াতাড়ি পালাতে হবে আমাদের।”
বাইরে তখন অন্ধকার। চারপাশে ঘন গাছপালা। জায়গাটা একটা জঙ্গলের মধ্যে। কোন আলো চোখে পড়ছে না। একটা চওড়া কাপড়ের সঙ্গে লোকটা বিট্টুকে বেঁধে নিল পিঠে। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল গাছপালার ফাঁক দিয়ে। অবলীলায় হাঁটতে লাগল লোকটা। বয়েস হলেও গায়ে বেশ জোর আছে। আর বাংলায় কথা বলছে বটে লোকটা, কিন্তু উচ্চারণগুলি ঠিক যেন বাঙালিদের মত নয়।
কিছুক্ষণ পরে জঙ্গল শেষ হয়ে মাঠ পড়ল। দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত। আলপথ ধরে অনেকটা পথ গিয়ে শেষ হল জমি। এক সারি গাছের পরে উঁচু পিচ রাস্তা। সেখানে গিয়ে সে পিঠ থেকে নামিয়ে দিল বিট্টুকে।
এতটা রাস্তা লোকটা কথা বলেনি কোন। বিট্টুও জিজ্ঞাসা করেনি কিছু। এবার লোকটা বলল, “তোমার তো খিদে পেয়েছে খুব। আমার ঝোলায় কিছু খাবার আছে। খাবে তুমি?”
পথের পাশে একটা মোটা নিমগাছের গোড়ায় বসে একটা কাগজের পাতায় চিঁড়ে মুড়কি আর ঝোলাগুড় বের করে দিল লোকটা। বোতল থেকে জল ঢেলে চিঁড়েটা ভিজিয়ে নিয়ে খেতে শুরু করল বিট্টু। প্রচণ্ড খিদের মুখে এ যেন অমৃত। লোকটাকে বেশ ভালো লাগতে শুরু করেছে বিট্টুর। খেতে খেতে প্রশ্ন করল, “তোমার নাম কী দাদু?”
“আমাকে তো সবাই পাগল বলে ডাকে! আসল নাম তো ভুলেই গেছি এতদিনে!”
“ধুস! পাগল আবার কারোর নাম হয় নাকি?”
“আমার আসল নাম ‘দুস্টিন ব্রুক’।”
“কী?” খেতে খেতে থমকে গেল বিট্টু।
“বলছি … বলছি। তুমি আগে খাওয়াটা শেষ কর।”
একটু পেট ভরে যেতে বিট্টু বলল, “চল দাদু, এবার আমি বাড়ি যাব।”
একটা গাছের ভাঙা ডাল কেটে নিয়ে তাতে কাপড় ছেঁড়া জড়িয়ে ক্রাচের কাজ চলছিল। বিট্টু আর লোকটা শুনশান রাস্তায় কিছুটা চলার পর দেখা পেল একটা রিকশাভ্যানের। লোকটা চালককে হাত দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে বলল, “ভাই জলঢাকার চরে জুলুভিটাতে যাব। নিয়ে যাবে? তোমার যা টাকা লাগে দেব।”
বিট্টু ভ্যানে উঠে আরাম করে বসে জিজ্ঞাসা করল, “আমরা নদীর চরে যাচ্ছি কেন? তুমি তো বললে আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে।” লোকটা মুচকি হেসে বলল, “ওখানেও তোমাদের একটা বাড়ি আছে বিট্টু বাবু! যদিও জুলুভিটার দত্তবাড়ি এখন অনেকটাই জলঢাকা গ্রাস করেছে।”
“হ্যাঁ, শুনেছিলাম বটে অনেক দিন আগে। ঠাকুমার মুখে।”
“তোমাদের বংশের এক পূর্বপুরুষ শম্ভুনাথ দত্ত প্রায় আড়াইশো বছর আগে তৈরি করেছিলেন ঐ বাড়িটা। আর সেখানেই লুকান আছে আমার ভাগ্যের চাবিকাঠি।”
“তোমার ভাগ্যের চাবিকাঠি! মানে ঠিক বুঝলাম না। আর তখন তোমার নাম জিজ্ঞেস করতে কী যেন বললে? দুষ্টু লোক?”
“হাহাহা…. দুষ্টু লোক নয়, আমার আসল নাম ‘দুস্টিন ব্রুক’।”
“এ আবার কোথাকার নাম?”
“আমার দেশ তো অনেক দূরে। একদম পৃথিবীর উলটো দিকে। দক্ষিণ আমেরিকার জামাইকাতে। নামটাও তাই ওদেশের।”
অবাক গালায় বিট্টু বলল, “তোমার কথা আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। জামাইকার লোক এমন বাংলা বলতে পারে কখনও?”
“আমি সারা পৃথিবীর ষোলটা ভাষা জানি। আর বাংলা ভাষাটা খুব মিষ্টি। বছরদশেক ধরে শুনে শুনে অভ্যাস করেছি।”
“তোমার কথা শুনে মনে হয় না তুমি পাগল। তা নিজের দেশ ছেড়ে এত দূরে ভিখারির মত ঘুরছ কেন?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে লোকটা বলল, “সে অনেক কথা। শুনবে তুমি?”
বিট্টু মাথা নাড়তে তিনি বলতে শুরু করলেন, “আমার জন্ম জামাইকার মান্দেভিলে নামে এক গ্রামে। রাজধানী কিংস্টোন থেকে সেটা প্রায় সত্তর কিলোমিটার দূর। চাষবাস আমাদের প্রধান জীবিকা হলেও সমুদ্র আছে আমাদের রক্তে। ক্যারিবিয়ান সাগরের জলে অদ্ভুত একটা টান আছে। অভাব অনটনের মধ্যেই বড় হয়েছি আমি। এক ভাই পঙ্গু, বাবা জুয়া খেলে দেনার দায়ে জর্জরিত, মা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন ক্যান্সারে। বড় হয়ে রুজিরুটির জন্য চলে এলাম কিংস্টন। সেখানে দিনের বেলা মুটেগিরি করতাম আর রাতে চালিয়ে যাচ্ছিলাম পড়াশোনা। ইচ্ছা ছিল একদিন আমি জাহাজে করে ঘুরে বেড়াব সারা পৃথিবী। তাই জাহাজের কাজ শেখার পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষা শেখার ঝোঁক ছিল আমার।
“একটা স্বপ্ন প্রায়ই ঘুরে ফিরে দেখতাম ছোটবেলা থেকে। জেমস প্ল্যান্টেন যেন অন্ধকারের মধ্যে আমাকে ডাকছেন। কী প্রচণ্ড সেই আকর্ষণ তোমাকে বোঝাতে পারব না।”
বিট্টু ওঁর কথা থামিয়ে প্রশ্ন করল, “জেমস প্ল্যান্টেন কে?”
একটু থেমে তিনি বললেন, “বলছি। এর মধ্যেই নাইট কলেজে এক অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপ হল। নাম গ্যাবরেল রাজাফিমাহাত্রাত্রা। তাঁর দেশ ছিল আফ্রিকা উপকুলে মাদাগাস্কারে। ক্যারিবিয়ান জলদস্যুদের কথা বলতে গিয়ে একদিন উঠল গুপ্তধনের কথা। ঠিক সেই সময়ে আমার মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে গেল যে কুখ্যাত জলদস্যু জেমস প্ল্যান্টেন ছিলেন আমারই পূর্বপুরুষ। কথাটা শোনা মাত্র উনি যেন চমকে উঠলেন।”
“তারপর?”
“তারপর একদিন প্রফেসর গ্যাবরেল আমাকে ডেকে পাঠালেন ওঁর কোয়াটারে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলেন আমার বংশ পরিচয়। আমি যতটুকু শুনেছি ঠাকুমা দাদুর মুখে সবই বললাম। জেমস প্ল্যান্টেন আমার দূর সম্পর্কের মামার বাড়ির দাদু। বর্তমানে ওঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে আমরা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
“প্রফেসার জানালেন, জেমস এক সময়ে ছিলেন ‘কিং অফ র্যান্টার বে’। মাদাগাস্কারের রাজা। তাঁর লুকিয়ে রাখা গুপ্তধন যদি খুঁজে পাও তোমার দশ পুরুষ বসে খাবে। মাথাটা গেল ঘুরে। রক্তে তো পাগলামি আর অভিযানের নেশা ছিলই। তল্পিতল্পা নিয়ে ভেসে পড়লাম একটা পণ্যবাহী জাহাজে করে। এদেশ ওদেশ ঘুরে ছ’মাস পরে এসে পৌঁছলাম মাদাগাস্কারে। মনের মধ্যে তখন প্রচণ্ড উত্তেজনা। পাহাড়ে, বনে, জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাম। খোঁজ করতাম জেমস প্ল্যান্টেনের পুরানো আস্তানার। প্রতিদিন মনে হত পরের দিন ঠিক খুঁজে পাব। খুলে যাবে আমার ভাগ্যের চাকা।
“ইতিহাস খুঁড়তে খুঁড়তে বহু বছর কেটে গেল পাহাড় জঙ্গলে। একদিন এ্যান্টানানারিভো শহরের এক রেস্তোরাঁয় স্থানীয় কিছু গুণ্ডাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ালাম হাতাহাতিতে। আমার ঠাকুমার দেওয়া একমাত্র সোনার লকেটটি বাঁচাতে গিয়ে মুহূর্তের ভুলে খুন হল এক যুবক। আর পুলিশ দোষী সাব্যস্ত করে জেলে পাঠিয়ে দিল আমাকে। কুড়িটা বছর আমি কাটিয়েছি জেলে। সেখানে এক বয়স্ক আফ্রিকান জাহাজির সঙ্গে পরিচয় হল আমার। সে-ই আমাকে শিখিয়েছে বাঁশি বাজানো। সে জানাল জেমসের গুপ্তধন খুঁজতে গেলে যেতে হবে কোমোরস দ্বীপে। আমিও শুনেছিলাম ওখানেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘ক্যাসেন্ড্রা’ নামে জাহাজটিকে লুট করা হয়েছিল তিনশো বছর আগে।”
একটু থেমে দুস্টিন ব্রুক আবার বলতে শুরু করলেন, “জেল থেকে বেরিয়ে হাজির হলাম সেখানে। টানা তিন বছর ছিলাম দ্বীপটিতে। মাঝামাঝি একটি শুকিয়ে যাওয়া আগ্নেয়গিরি আছে। মাউন্ট কারটালা। বৃষ্টির জল জমে সেখানে তৈরি হয়েছে হ্রদ। অনেক খোঁজাখুঁজি আর ঘাম ঝরানোর পরে একটা গুহার ভিতর খুঁজে পেলাম শ’খানেক মানুষের কঙ্কাল, অস্ত্রশস্ত্র আর একটা ডায়রি। সেটা ছিল ইংরেজদের এক কমান্ডার গুন্টারের দিনলিপি। বহু কষ্টে ক্ষয়ে যাওয়া লেখা কিছু কিছু পাঠোদ্ধার করলাম আমি। জেমস নাকি তাদের মৃত্যু কুপে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল বেরনর মুখ। পরে জানলাম, সেখান থেকে জেমস পালিয়ে এসেছিল ইন্ডিয়াতে।
“আমি আবার ভেসে পড়লাম জলে। জাহাজে চাকরি নিয়ে হাজির হলাম বোম্বেতে। সেখানে কাটল আরও পনের বছর। অনেক ঘোরাঘুরি করার পর এক মারাঠি গবেষকের কাছ থেকে শুনলাম, তিনি আংরের নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সেই নৌসেনায় ছিল শম্ভুনাথ দত্ত নামে এক বাঙালি। যিনি জেমস প্ল্যান্টেনকে হত্যা করে তাঁর বাক্স নিয়ে চলে এসেছিলেন বাংলায়। তারপর অনেক খুঁজে খুঁজে উত্তরবঙ্গের এই শম্ভুনাথপুরে এসে ঘাঁটি গাড়লাম।”
বিট্টু সব শুনে মন্তব্য করল, “আমিও শুনেছি কিছু গুপ্তধনের গল্প। কিন্তু সেরকম কোন বাক্স তো নেই আমাদের বাড়িতে।”
“তোমাদের পুরানো বাড়ি মানে জুলুভিটাতে আছে। এতদিন পর আমার স্বপ্ন সার্থক হবে।”
কথা বলতে বলতে ওরা পৌঁছে গেল নদীর পাড়ে।
*****
ঋজু, দিগন্ত, তুলি আর দোয়েল যখন বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে সোজা গাড়িতে এসে পৌঁছাল রিসর্টে তখন দূরে পাহাড়ের সারির মাথায় মেঘেদের গায়ে চমকে দেওয়া রঙের খেলা। ঠিক যেন মকবুল ফিদা হোসেনের আঁকা একটা অসাধারণ ছবি। পিছনে খোলা মাঠ। নুড়ি বিছান রাস্তা। অসাধারণ সুন্দর কটেজ স্টাইলে রুমগুলি দেখেই পছন্দ গেল সবার। ডুয়ার্সিনি রিসর্টের মালিক প্রতীকবাবু শ্রীমন্তদাদুর বন্ধু। গাড়ি থেকে নামতেই এগিয়ে এলেন তিনি।
“আসুন বোসদা। পথে কোন অসুবিধা হয়নি তো?”
“একদম নয়।” ঋজু উত্তেজিত হয়ে বলল, “গরুমারা জঙ্গল তো পাশেই। কালকেই ওখানে যাব বুঝলে?” দোয়েল লাফিয়ে উঠে বলল, “আমি কিন্তু হাতির পিঠে চড়ব।”
প্রতীকবাবু হেসে জানালেন, “এখানে যাঁরা সরকারি বাংলোয় ওঠেন, একমাত্র তাঁরাই জঙ্গলে ঘুরতে পারেন হাতির পিঠে।”
শ্রীমন্তদাদু মন্তব্য করলেন, “তাছাড়া কালকে আমরা যাব শম্ভুনাথপুর। গাড়ি বলা আছে।”
প্রতীকবাবু একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, “আপনারাও যাচ্ছেন ওখানে?”
“আমরা তো যাচ্ছিই। আর কেউ যাচ্ছে নাকি?”
“হ্যাঁ। এক গবেষক লন্ডন থেকে এসে রয়েছেন আপনার পাশের রুমেই।”
“আচ্ছা! তা একবার পরিচয় করিয়ে দেবে তো আমার সঙ্গে। কী নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি?”
“তা তো ঠিক জানি না। ডিনারের সময়ে দেখা হবে নিশ্চয়ই। তখনই কথা বলে নিও।”
পরের দিন প্রাতরাশ সেরে ঘণ্টা দেড়েকের পথ পেরিয়ে ওরা পৌঁছাল দত্তদের জমিদারবাড়িতে। জমিদারি ইমারতের সেই জৌলুস আর নেই। ভেঙে গেছে সিংহদুয়ার। পাঁচিলের কোল ঘেঁসে আগাছার জঙ্গল। গাড়িটা পের্টিকোর মধ্যে দাঁড়াতেই বাইরে বেরিয়ে এল সৌম্যজিৎ। এলোমেলো চুল। গালে বেশ ক’দিনের না কাটা দাড়ি। বিধ্বস্ত চেহারা।
“আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আসুন ভিতরে।”
শ্রীমন্তদাদু প্রশ্ন করলেন, “কী হয়েছে? তোমার চেহারা এমন লাগছে কেন?”
এরপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সৌম্য জানাল, “আমার ছেলে বিট্টুকে খুঁজে পাচ্ছি না দু’দিন হল।”
“সেকী!” চমকে উঠল সকলে।
“হ্যাঁ। একটা হুমকি চিঠি পেলাম।”
“হুমকি চিঠি! কী লেখা ছিল?”
“রমেন্দ্রনাথ দত্তর ডায়রিটা একটা প্যাকেটে মুড়ে ঝিলের ধারে আসান গাছের ডালে বেঁধে দিয়ে আসতে হবে মাঝ রাতে। তবেই ফেরত দেবে বিট্টুকে। পুলিশকে জানালে আর কোনদিন ফেরত পাব না।”
“তারপর?”
“ওদের কথা মতই কাজ করলাম। আর কোন রাস্তা ছিল না। কিন্তু দুদিন কেটে গেল। বিট্টু এখনও ফেরেনি।”
বৈঠকখানায় ঢুকে শ্রীমন্তদাদু বললেন, “পুলিশকে তো জানাতে হবে এবার।”
“বলেছি। দারোগাবাবু আসছেন।”
ওরা ঢুকে দেখল মাথার উপরে ঘুরছে লম্বা ব্লেডওলা একটা পুরানো দিনের পাখা। দেয়ালে কয়েকটা পুরানো অয়েলপেন্টিং। উপর থেকে ঝুলছে ঝাড়বাতি। বড় সোফার পিছনে একটা ঢাউস বুক সেলফ। রাশিরাশি বইয়ের পাহাড়। শ্রীমন্ত দাদু সেটার সামনে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি যে ছোরাটা দিয়েছিলাম, সেটা তো এখানেই রাখা ছিল, তাই না?”
সৌম্য মন্তব্য করল, “বেশ কিছুদিন হল দেখছি না জিনিসটাকে।”
“কবে থেকে?”
সৌম্য কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে বলল, “খেয়াল করতে পারছি না বোসবাবু। জিনিসটা আপনি দিয়ে যাওয়ার পর থেকে বুক সেলফের এক কোণেই রাখা ছিল। তারপর আর মনে নেই।”
সোফায় বসে জিজ্ঞেস করলেন, “বিট্টু নিরুদ্দেশ হল কীভাবে?”
“দুদিন আগে ঝড় জলের সন্ধ্যায় টিউশনি সেরে বাড়ি ফিরে দেখি বিট্টু নেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর পিছনে পুকুরপাড়ে ওর ক্রাচ দুটো খুঁজে পেলাম। বাড়িতে সারাক্ষণ সুমির সঙ্গেই থাকত।”
ঋজু প্রশ্ন করল, “সুমি কে?”
“ওরা আমাদের নিচের তলায় ভাড়া থাকে।”
“একবার ডাকা যাবে ওকে?”
সৌম্য মাথা নেড়ে উঠে যেতে তুলি মন্তব্য করল, “পুরানো কোন জমিদারবাড়িতে এই প্রথম ঢুকলাম আমি। বেশ একটা রোমাঞ্চ হচ্ছে।”
মিনিট খানেকের মধ্যেই বৈঠকখানায় প্রবেশ করল সুমি। শ্রীমন্ত দাদু তাকে সামনের চেয়ারে বসতে বলে প্রশ্ন করলেন, “ক’দিনের মধ্যে বাড়ির চারপাশে কোন অচেনা লোককে দেখছ ঘোরাফেরা করতে?”
সুমি একটু ভেবে নিয়ে বলল, “না। তবে একটা পাগল রোজ বাঁশি বাজাত বাড়ির সামনে ঐ বট গাছটার নিচে বসে। আর কদিন আগে মিনাদি ভূত দেখেছিল। সেই নিয়ে হুলুসথুলুস হয়েছিল খুব।”
“ভূত!”
“হ্যাঁ। ভির্মি খেয়েছিল দুপুর বেলা ভূত দেখে।”
“হুম!” সুমির দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে শ্রীমন্ত দাদু আবার প্রশ্ন করলেন, “পাগলে বাঁশি বাজাত! ঠিক কীরকম ছিল বাঁশিটা, একবার মনে করে বল তো সুমি?”
সুমি চোখ বন্ধ করে ভেবে নিয়ে বলল, “সরু আর কালো রঙের বাঁশি। সুরটাও বেশ অদ্ভুত।”
পকেট থেকে ফোনটা বের করে কিছুক্ষণ সার্চ করে একটা ছবি বের করলেন। সেটা সুমিকে দেখিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, “এ রকম বাঁশি কী?”
“অনেক দূর থেকে দেখেছি তো! তবে এরকমই মনে হচ্ছে।”
শ্রীমন্ত দাদুর কপালে ভাঁজ। কিছুক্ষণ গুম খেয়ে থেকে মন্তব্য করলেন, “এত দূর থেকে সে কি তাহলে এসেছে? আশ্চর্য!”
“কে এসেছে দাদু?” অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর মুখ খুলল ঋজু।
“এই বাঁশিটার নাম ‘আইরিশ ফ্লুট’। আফ্রিকান ব্ল্যাকউডের তৈরি। ওদের দেশেরই ট্রাডিশনাল বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে একটি। অনেককাল আগে আমি একজনকে চিনতাম যে খুব সুন্দর আইরিশ ফ্লুট বাজাত। কিন্তু…..”
আরও কিছুটা সময় সবাই চুপ থাকার পর তিনি বললেন, “আমার মনে হয়, দিনের বেলা হঠাৎ করে মিনতি ভূত দেখেনি। বরং বিশেষ কোন লোককে হয়ত গুদামঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সেফ প্যাসেজ করে দিয়েছে। সেজন্যই একটা নাটক করেছিল সেদিন।”
সৌম্য ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল, “কিন্তু কেন?”
“কারণ তোমার পূর্বপুরুষের নিয়ে আসা সেই জামাইকান বাক্স খুঁজে বের করা। যার মধ্যে আছে তিনশো বছরের পুরানো লুট করা মহামূল্য ধনরত্ন। যার হদিশ ছিল ঐ ডায়রিতে। কিন্তু আমি ভাবছি কথাটা এত লোক জানল কী করে?”
সিঁড়ি দিয়ে খটখট করে জুতোর একটা আওয়াজ শোনা গেল সেই সময়ে। তারপরেই পর্দা ঠেলে লম্বাচওড়া চেহারা নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন দারোগা কুন্তল বৈরাগী। পরনে সাধারণ পোশাক।
সৌম্য উঠে দাঁড়িয়ে উৎকণ্ঠার সঙ্গে জানতে চাইলেন, “বিট্টুর কোন খোঁজ পেলেন দারোগাবাবু?”
“না, এখনও পর্যন্ত আশাব্যঞ্জক কোন খবর আসেনি। তবে জোর কদমে তল্লাশি চলছে। কলকাতাতেও খবর পাঠানো হয়েছে। আর গোয়েন্দা দপ্তরের খবর অনুযায়ী কলকাতার বেশ কয়েকজন সাংঘাতিক ক্রিমিনাল জড়ো হয়েছে এ অঞ্চলে।”
“তাই নাকি!”
“হ্যাঁ, তোমাদের বাড়ির কাজের মাসি মিনা আর তার বরকে এন.জি.পি. স্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আজ ভোরে। তার মুখ থেকে পাওয়া গেল আর একজনের নাম।”
“কে?”
“পরাণ গাঙ্গুলি।”
সৌম্য অবাক গলায় বলল, “পরাণবাবু! মানে যাঁর সোনার দোকান? ওঁর সঙ্গে তো আমার বেশ ভালো সম্পর্ক।”
“সে-ই নাকি ওদের বলেছিল এই বাড়ির গুদাম ঘরে ঢুকে কী একটা বাক্স খুঁজতে। তার জন্য অনেক টাকাও দেবে বলেছিল। মিনা একটা এন্টিক ছোরা চুরি করেছিল আপনাদের বুকশেলফ থেকে। সেটাও স্বীকার করেছে।”
শ্রীমন্ত দাদু জানতে চাইলেন, “সে ছোরাটা পেয়েছেন?”
“না। বলল জিনিসটা কাউকে বিক্রি করে দিয়েছে। ঐ দিন সন্ধ্যার মুখে মিনা বিট্টুকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল বাড়ির পিছনে। সেখানে আগে থেকেই পরাণ গাঙ্গুলির লোক ওত পেতে ছিল। পুরোটাই প্রি-প্ল্যান্ড। মহোৎসবের জন্য বাইরে থেকে আনা নামের দলের মধ্যেই মিশে ছিল ডাকাতরা।”
শ্রীমন্তদাদু জানতে চাইলেন, “পরাণ গাঙ্গুলিকে অ্যারেস্ট করেছেন?”
“না, ঠিক সময়ে পালিয়েছে লোকটা। মহা ধুরন্ধর! ওর বাড়িতে রেইড করার আগেই লোকটা জানতে পেরে গিয়েছিল। লোকটার দলের কয়েকজনকে ধরতে পেরেছি। তাদের নিয়ে ওর সবক’টা গোপন ডেরায় রেড করলাম। কিন্তু ….”
“কিন্তু কী ইন্সপেক্টর?” সৌম্যের চোখে মুখে উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট।
“জানা গেছে জঙ্গলের মধ্যে গাঙ্গুলির একটা গোপন ঠেক-এ রাখা হয়েছিল আপনার ছেলেকে। কিন্তু আমরা যখন গেলাম তখন সে ঘর খালি। যে দুজন লোক পাহারা দিচ্ছিল, তারা অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল বাইরে।”
“তার মানে?”
“হয়ত আপনার ছেলে নিজেই পালিয়েছে সেখান থেকে।”
“তা কী করে সম্ভব? ওর তো একটা পা ছোট, ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারে না। একা একা পালাবে কী করে? তাও দুটো লোককে অজ্ঞান করে! অসম্ভব।”
সৌম্যবাবুর কথা শুনে ইন্সপেক্টর বৈরাগী চুপ করে গেলেন। শ্রীমন্ত দাদু চেয়ার ছেড়ে উঠে পিছনে হাত দিয়ে পায়চারী করতে করতে বললেন, “পরাণ গাঙ্গুলি শতরঞ্জের শুধু একটা মোহরা মাত্র। আসল যাদের অঙ্গুলিহেলনে খেলাটা চলছে তারা আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে ইন্সপেক্টর বৈরাগী।”
“ঠিক বুঝলাম না।”
“তিনশো বছরের পুরানো জলদস্যুদের গুপ্তধন। এডওয়ার্ড ইংল্যান্ড, ক্রিস্টোফার কন্ডেন্ট আর জেমস প্ল্যান্টেন নামে তিন কুখ্যাত জলদস্যু। তাঁদের সারা জীবনে লুণ্ঠিত মূল্যবান হিরে আর মোহর সমেত ঐ জামাইকান বাক্সটির কত দাম হবে ভাবতে পারছেন? আনুমানিক কয়েকশ কোটি টাকা। তার জন্য তো তাবড় লোকেদের ঘুম চলে যাবার কথা, তাই না?”
ইন্সপেক্টর মশাই হেঁচকি তুলে একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, “সেকী মশাই! তা কোথায় আছে সেই গুপ্তধন?”
“আমার অনুমান যদি সত্যি হয় তাহলে বাক্সটা আছে এই বাড়িতে কিম্বা এর আশেপাশে। ১৭২৭ সালে জেমস প্ল্যান্টেন সেটা নিয়ে মাদাগাস্কার থেকে পালিয়ে এসেছিলেন ভারতে। প্ল্যান্টেনের মৃত্যুর সঠিক কোন খবর পাওয়া যায়নি। পরে শম্ভুনাথ দত্তর সঙ্গে নাকি জামাইকান বাক্সটা এসেছিল এ বাড়িতে। তাঁরা দুজনেই ছিলেন সেই সময়ে পশ্চিম উপকূলে ভারতীয় জলদস্যু কানোজি আংরের নৌবাহিনীর সদস্য। এমনটাও হতে পারে, যে শম্ভুনাথের হাতেই প্রাণ গিয়েছিল জেমসের।”
শ্রীমন্তদাদুর কথা থামিয়ে সৌম্য বলে উঠল, “এ বাড়িতে নয় স্যার। এই বাড়ির বয়েস তো একশো বছরের কিছু বেশি হবে মাত্র। এর আগে আমাদের পূর্বপুরুষ অন্য একটি বাড়িতে থাকতেন।”
“তাই নাকি! তা এ কথাটা তো আগের বারে জানাওনি আমাকে?”
“আসলে ব্যাপারটা আমার মনে ছিল না। কিছুদিন আগে রমেন্দ্রনাথ দত্তর ঐ ডায়রিটা হাতে পাবার পর মনে পড়ল। দাদুও বলতেন ছোটবেলায়। আমাদের আদি বাড়ি ছিল দক্ষিণের জঙ্গল পেরিয়ে জলঢাকার তীরে জুলুভিটাতে। সম্ভবত বন্যার জলে ধসে গিয়েছিল সেই বাড়ি। তারপর আমার প্রপিতামহর বাবা মানে রাধানাথ দত্ত এই বাড়িটা বানিয়েছিলেন।”
“হুম!” পায়চারী করতে করতে শ্রীমন্ত দাদু বললেন, “সেখানে একবার নিয়ে যেতে পারবে আমাকে?”
সৌম্য বলল, “তা পারব। কিন্তু সেখানে তো এখন কয়েকটা ভাঙাচোরা দেয়াল ছাড়া কিছুই নেই। পুরোটাই জঙ্গলে ভরে গেছে।”
শ্রীমন্তদাদু গম্ভীর গলায় মন্তব্য করলেন, “তাও একবার দেখা দরকার। একটা কৃষ্ণমন্দির থাকার কথা সেখানে।”
***
দুপুর রোদে খাঁখাঁ করছে শুকনো নুড়ি বিছান নদীর তট। মাঝ বরাবর তিরতির করে বইছে জলের রেখা। চড়ার উপরে বড় বড় ঘাসের বন। তারপর শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গল। দূরে পাহাড়ের রেখা। এই নদীকে এখন দেখে বোঝার জো নেই যে ভরা বর্ষায় সে কী ভয়ঙ্কর রূপ ধরে সে। তখন দু’কুল ছাপিয়ে তছনছ করে দেয় বসতবাড়ি, ক্ষেতের জমি।
উলটো দিকের জঙ্গল থেকে দু’জন লোক এগিয়ে এসে ঢুকে গেল লম্বা লম্বা ঘাসের বনে। সেখানে ভাঙাচোরা মোটামোটা ইঁটের দেয়াল গেঁথে আছে মাটির সঙ্গে। হাজার রকমের আগাছায় ছেঁকে ধরেছে তাদের। বহু বছর ধরে তারা দাঁড়িয়ে আছে এমনই। জনকোলাহল থেকে দূরে, নিভৃতে। একটি ভাঙাচোরা টেরাকোটার মন্দির আছে নদীর পাড়ে। অনেক বছর আগে সেখানে পূজিত হতেন বংশীবাদক মদনমোহন। এখন সে জমিদারিও নেই আর মূর্তি চলে গেছেন অন্য মন্দিরে।
লোকগুলি ঝোপঝাড় ঠেলে ঢুকল ভাঙা মন্দিরটিতে। ভিতরে তখন মাটি খোঁড়ার কাজ চলছে। পুরানো বেদীটা সরিয়ে মাটি কাটতে কাটতে তুমোর হয়ে উঠেছে চারপাশ।
গর্তের ভিতর থেকে একজন সাঁওতালী মুণ্ডা মাথা তুলে জানতে চাইল, “আর কতটা?”
উপরে দাঁড়িয়ে থাকা টাকমাথা বয়স্ক লোকটি চেঁচিয়ে জানাল, “যতক্ষণ না বাক্সটা পাওয়া যাচ্ছে চলবে মাটি কাটা।”
সেই মুহূর্তে আচমকা একটা গুলির আওয়াজ। একজন ষণ্ডামত লোকের পিঠে গুলি লেগে উলটে পড়ল গর্তের মধ্যে। বাকিরা ছিটকে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল দেয়ালের আড়ালে।
“আমার লোক তোদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে। সারেন্ডার কর, নইলে মারা পড়বি।” আওয়াজটা এল জঙ্গলের মধ্যে থেকে।
দশ বারো রাউন্ড ফায়ার হওয়ার পর। একটা বিকট বোমের শব্দে কেঁপে গেল মাটি। চারিদিকে ধোঁয়ায় ভর্তি। তারপর আবার গুলির আওয়াজ।
“ডেভিড, তুই আমার এলাকায় ঢুকে খুব ভুল করেছিস। শকুনের চোখ আমার। আজকেই তোর শেষ।” রাণা চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ডেভিডের উপর। চোখের পলকে ধারাল খুরের আঘাতে নেতিয়ে পড়েছে ডেভিড।
ধোঁয়া কিছুটা উড়ে যেতে দেখা গেল ফাঁকা হয়ে গেছে নদীর চর। পালিয়েছে ডেভিডের লোকেরা। রাণা ওরে রক্তাক্ত দেহটা জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দিয়ে সন্তর্পণে ভাঙা মন্দিরে ঢুকল। হাতে উদ্যত নাইন এম.এম. পিস্তল। সঙ্গে আরও জনা পাঁচেক শাগরেদ। একজন টুপি পরা লোক গর্তের মধ্যে উঁকি মেরে বলল, “এ তো ভর্তি হয়ে গেছে জলে।”
রাণার নির্দেশে কয়েকজন নেমে পড়ল জল ছাঁচতে। টুপি পরা লোকটা পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাচ্ছিল একটার পর একটা। বারবার তাকাচ্ছিল ঘড়ির দিকে। কিছুক্ষণ পর রাণা বিরক্তি সূচক ভঙ্গিতে বলল, “কী গাঙ্গুলিবাবু? আপনি তো বললেন এখানেই পাওয়া যাবে সেই গুপ্তধন।”
“ডায়রিতে তো সেরকমই লেখা ছিল।”
“কিন্তু বাক্সটা গেল কোথায়?”
“মাথায় তো আমারও কিছু ঢুকছে না।”
“মে আই কাম ইন?” কিছুক্ষণ পরে পিছন থেকে সোনালী চুলের একটি মেয়ে কথাটা বলল ভাঙা পাঁচিলের কাছ থেকে মুখ বের করে। গলায় ঝুলছে একটি দামী ক্যামেরা।
“কী চাই?” মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল পরাণ গাঙ্গুলি।
সে নম্র গলায় ইংরাজিতে জানাল, “আমি পুরানো মন্দির নিয়ে গবেষণা করছি। এসেছি অনেক দূর থেকে। ভিতরের কয়েকটা ছবি নিতে চাই।”
“এখন হবে না। কাজ চলছে।”
“আপনারা কি আর্কিওলজিকাল সার্ভের লোক?”
“হ্যাঁ। কেন?” গম্ভীর গলায় উত্তর দিল রাণা।
মেয়েটি মিষ্টি গলায় বলল, “না, মানে আমার এক বন্ধু তাহলে কথা বলবেন আপনাদের সঙ্গে।”
“বন্ধু!”
কথাটা বলেই রাণা বুঝতে পারল, ওরা ফাঁদে পড়েছে। কারণ মেয়েটি যাকে বন্ধু বলে পরিচয় দিচ্ছে, দূর থেকে দেখেই তাকে চিনতে পারল রাণা। তিনি লালবাজারের ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের দুঁদে অফিসার রবিন শাসমল। সাদা পোশাকে রয়েছেন।
চোখের পলকে ক্ষিপ্র চিতার মত পেছনের ঘাসবনে লাফ দিল রাণা। একটু গড়িয়ে গিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। ভাবল একবার ঘন জঙ্গলের মধ্যে গা ঢাকা দিতে পারলে আর চিন্তা নেই। কিন্তু রবিনবাবুও ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তীরবেগে ধাওয়া করেছেন পেছনে। মুহূর্তের মধ্যে কোমরে গোঁজা পিস্তল বের করে একটা গুলি চালালেন শূন্যে। চিৎকার করে বললেন, “পরের গুলিটায় তোর খুলিটা উঠে যাবে রাণা।”
কিন্তু রাণাও পুরানো খিলাড়ি। অত সহজে ধরা সে দেবে না। ঘুরে গিয়ে গাছের আড়াল থেকে ফায়ার করল সে। গুলিটা কাঁধ ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল রবিনবাবুর। বসে পড়লেন তিনি। জঙ্গলের মধ্যে কানফাটানো গুলির আওয়াজে চেঁচিয়ে উঠল হাজারো পাখি।
কিন্তু রবিনবাবুকে বেশি দূর কষ্ট করে দৌড়াতে হল না। কারণ পায়ে একটা দড়ি জড়িয়ে ছিটকে পড়ল রাণা। সঙ্গে সঙ্গে গাছের আড়াল থেকে ইন্সপেক্টর বৈরাগী বাঘের মত থাবা মেরে কোমরটা চেপে ধরে বললেন, “পালানোর চেষ্টা করে লাভ হবে না। পুলিশ ঘিরে ফেলেছে চারিদিক। হাত উপরে করে চুপচাপ পুলিশের জিপে ওঠ।”
জাঁদরেল পুলিশ অফিসারের এক হুমকিতেই কাজ হল। টুপি পরা পরাণ গাঙ্গুলিও ভাঙা মন্দিরের বাইরে এসে দেখল পুলিশের বিশাল টিম হাজির। শ্রীমন্ত দাদু, ঋজু, তুলি আর সৌম্যও চলে এসেছে ততক্ষণে।
রবিনবাবু নিজের বাঁ কাঁধে ডান হাত দিয়ে চেপে ধরে এগিয়ে এলেন। রক্ত গড়াচ্ছে। তবে ক্ষত সামান্যই। বললেন, “গুলিটা কাঁধ ছুঁয়ে চলে গেছে। রাণাকে কলকাতা পুলিশ খুঁজছে বেশ কিছুদিন থেকে। প্রতিবারেই পুলিশের জাল কেটে পালাচ্ছিল শয়তানটা। জালটাকা, ডাকাতি, অপহরণ, স্মাগলিং, খুন সহ অনেক কেস আছে ওরা নামে।”
একজন পুলিশ এসে খবর দিল, “পিছনের জঙ্গলে ডেভিডের লাশ পড়ে আছে।”
রবিন বাবু জানালেন, “শিলিগুড়ির ডেভিড আর এক নামকরা দুষ্কৃতি। রাণার এ্যান্টিগ্রুপ।”
ঠিক সেই মুহূর্তে দূরে গাছের আড়াল থেকে শোনা গেল একটা আওয়াজ, “বাবা!”
“বিট্টু!” সৌম্য দেখা মাত্রই দৌড়ে গেল সেদিকে।
সূর্য তখন ঢলে পড়েছে পশ্চিম নদীর কোলে। পাগলা দাদুর সঙ্গে হাত ধরে ঠিক সময়ে চড়ায় এসে পৌঁছেছে বিট্টু। সৌম্য গিয়ে জড়িয়ে ধরল ছেলেকে।
“তুই এখানে এলি কী করে?”
“এই দাদু বাঁচিয়েছেন আমাকে।”
“অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না!”
বিট্টু উৎসাহ নিয়ে বলল, “ইনি হলেন জেমস প্ল্যান্টেনে বংশধর। বাড়ি আমেরিকার জামাইকায়। নাম দুস্টিন ব্রুক।” এরপর বিট্টু নিজেই বলল, তাকে কীভাবে উদ্ধার করেছেন পাগলা দাদু।
দোয়েল সবটা মন দিয়ে শুনে শেষে প্রশ্ন করল, “তাহলে গুপ্তধনটা এই মন্দিরের নিচেই আছে?”
“গুপ্তধন নেই!” পাশ থেকে হতাশ গলায় মন্তব্য করল তুলি।
“নেই?”
ঋজু গায়ে হাতে জলকাদা মাখা অবস্থায় এগিয়ে এসে বলল, “না নেই। মন্দিরের মধ্যে আমি আর তুলি এতক্ষণ ধরে দেখলাম। প্রায় কুড়ি ফুটের মত মাটি খুঁড়েছে ওরা। কিছুই নেই সেখানে। শুধু বালি মাটি উঠেছে।”
মিঃ ব্রুক হাত তুলে মৃদু হেসে বললেন, “আছে, জামাইকান বাক্স এখানেই আছে।”
“কোথায়?”
“আসুন আমার সঙ্গে।” কথাটা বলে মিঃ ব্রুক বড় বড় পা ফেলে নদীর তট ছেড়ে এগিয়ে গেলেন জঙ্গলের দিকে। বাকিরাও এগোল ওঁর পিছনে।
বেশ কিছুটা গিয়ে একটা পুরানো অশ্বত্থ গাছের সামনে শ্যাওলায় সবুজ হয়ে যাওয়া ভাঙা চোরা স্তূপের সামনে দাঁড়ালেন উনি। বুক পর্যন্ত উঁচু ঘাস আর বুনো আগাছায় ঢেকে আছে জায়গাটা। একটা কোদাল দিয়ে গাছপালা কিছুটা পরিষ্কার করে সৌম্যকে ডেকে বললেন, “দেখুন তো এই পাথরের ফলকে কী লেখা আছে?”
সৌম্য এগিয়ে গেলেন সেদিকে। একটা শ্যাওলা ধরা পাথরের ফলকের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলেন, “আর. আই. পি., মানে ‘রেস্ট ইন পিস’। জে. প্ল্যান্টেন। ১৯শে ডিসেম্বর, ১৭৮৯।”
“ও মাই গড! তার মানে এটা জেমস প্ল্যান্টেনের সমাধি!” সৌম্য কাঁপা গলায় স্বগতোক্তি করল। “আমি তো জানতাম না!”
“কেউই জানে না মিঃ দত্ত। আমিও অদ্ভুতভাবে জানলাম সবে দুদিন আগে। সেদিন ঝড়জলের সময়ে দেখলাম অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি ঢুকে গেল জঙ্গলে। দূর থেকে পিছু নিলাম। শেষে দেখি এই সমাধির সামনে এসে মিলিয়ে গেল।”
“আর গুপ্তধন?”
তুলির প্রশ্নের উত্তরে মিঃ ব্রুক বললেন, “দারোগাবাবু আপনার লোকেদের বলুন এই গম্বুজটা ভাঙতে। আমার ধারণা জামাইকান বাক্সটা আছে এরই নিচে।”
গ্রামের উৎসাহী লোকজন ততক্ষণে চারপাশে জমা হয়েছেন বেশ কিছু। তাঁদেরকে বলতেই হাত লাগালেন। কোদাল, গাঁইতি দিয়ে খুব বেশি সময় লাগল না স্তূপের পুরানো ইটগুলি সরিয়ে ফেলতে। আরও ফুটচারেক মাটি খুঁড়তে পাওয়া গেল বহু বছরের পুরানো একটা মাটিতে মিশে যাওয়া কফিন। কিন্তু কফিনটা তো ফাঁকা! সেটা সরাতে চোখে পড়ল একটি ধাতব বাক্স। সেটা উপরে তুলে মাটি পরিষ্কার করতে দেখা গেল গায়ে খোদাই করা জলদস্যুদের মড়ার খুলি।
সেটা হাতে নিয়ে মিঃ ব্রুক চিৎকার করে উঠলেন আনন্দে। বারবার চুমু খেতে থাকলেন। কিন্তু শ্রীমন্ত দাদু এগিয়ে গিয়ে বললেন, “আইনত এটা তো সরকারের প্রাপ্য।”
“এটা আমার বংশের জিনিস। আমিই নিয়ে যাব।” বাক্সটা জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন মিঃ ব্রুক।
শ্রীমন্তদাদু হেসে উঠলেন সবাইকে চমকে দিয়ে, “তোমার বংশের জিনিস! হা..হা..হা..! ওসব ছেলে ভোলানো গল্প বিট্টুকে বলেছ, খুব ভালো কথা। আমার কাছে তোমার জারিজুরি খাটবে না হে!”
“মানে! কী বলতে চান আপনি?”
“বলছি, দিব্যি দক্ষিণী টানে বাংলাটা চালিয়ে যাচ্ছ। আর ভাবছ কেউ ধরতে পারবে না তোমাকে?”
ইনস্পেক্টর বৈরাগী এগিয়ে এসে বললেন, “কী ব্যাপার? একটু খোলসা করে বলুন তো মিঃ বোস।”
“এর আসল নাম সাবিন কুমার। বহু বছর আগে আমার ডিপার্টমেন্টেই চাকরি করত। পরে একটা প্রাচীন দামী মূর্তি চুরির জন্য ধরা পড়ে জেল হয়। কিন্তু বেশকিছু গুণ ছিল ওর। খুব সুন্দর আইরিশ ফ্লুট বাজাত। দক্ষিণী মার্সাল আর্টের সঙ্গে ছিল অদ্ভুত সম্মোহন করার দক্ষতা। এত বছর পরে চেহারায় পরিবর্তন হয়েছে অনেক। কিন্তু আমার চোখে ধুলো দিতে পারবে না। যে লোকটি কদিন আগে মারা গেছে ঝিলের ধারে সেই ছিল আসল দুস্টিন ব্রুক। সম্ভবত সাবিন কুমারই খুন করেছে তাকে।”
কথাটা শুনে চমকে উঠল উপস্থিত সবাই। লোকটা তামিল ভাষায় গালাগালি দিয়ে মারতে তেড়ে এল শ্রীমন্তদাদুকে। ইনস্পেক্টর বৈরাগী মাঝে পাহাড়ের মত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকায় লোকটার ইচ্ছা আর পূরণ হল না। পুলিশরা তাকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে চলল টানতে টানতে।
তিনি বললেন, “এবার পরিচয় করিয়ে দিই জেমস প্ল্যান্টেনের আসল উত্তাধিকারির সঙ্গে। প্লিজ কাম মিস জেনি প্ল্যান্টেন। ইনি হলেন বার্থ ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের লেকচারার। গবেষণা করছে জলদস্যুদের জীবনযাত্রা নিয়ে। সে জন্যই ওর ভারতে আসা।”
একটি সাতাশ আঠাশ বছরের ইউরোপিয়ান মেয়ে বেরিয়ে এল গাছের আড়াল থেকে। তুলিরা দেখেই চিনতে পারল। ডুয়ার্সিনি রিসর্টে দেখেছে মেয়েটিকে। রাত্রে দাদু অনেকক্ষণ কথা বলছিলেন ওর সঙ্গে। কারণটা বুঝল এবার।
জেনি ইংরাজিতে বলল, “পার্সি ধর্মমতে জেমস প্ল্যান্টেনের মৃতদেহ পশুপাখির আহারে পরিণত হয়েছিল। আর এই সমাধিটা তৈরি করা হয়েছিল তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণ করার জন্য। শম্ভুনাথ দত্ত ছিলেন জেমসের শেষ বয়েসের একমাত্র বন্ধু। সম্ভবত তাঁর স্মৃতিস্বরূপ বাক্সটাকে রেখে দিয়েছিলেন এখানে।”
সৌম্য প্রশ্ন করল, “কিন্তু আপনি এই জায়গার খোঁজ পেলেন কী করে?”
“আমার প্রথম সন্দেহ হয়েছিল যখন কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালুরুতে ‘কালাই গাথু’র পার্সি মন্দিরে যাই। পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি উত্তরবঙ্গের এক জমিদার পরিবার থেকে প্রতি বছর মোটা অঙ্কের দান যেত ঐ মন্দিরে। সেটা ১৮৪৫ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। ভাবলাম জেমস প্ল্যান্টেনের তৈরি পার্সি মন্দিরে বাংলা থেকে অর্থ সাহায্য কে পাঠাবে? আসলে ওঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর অত্যন্ত প্রিয়বন্ধু শম্ভুনাথ দত্ত এই ব্যবস্থা করেছিলেন। যেটা অন্তত তিন পুরুষ পর্যন্ত অনুসরণ করা হয়েছিল।”
একটু থেমে জেনি আবার বলল, “দুস্টিন ব্রুক আমাদের আত্মীয়। গুপ্তধনের লোভেই তিনি ভারতে এসেছিলেন। কথাটা আমি শুনেছিলাম ওঁর পরিবারের কাছ থেকে। অনেক দিন থেকে ওঁর কোন খোঁজ খবর ছিল না। কলকাতায় এসে আমি প্রথমেই পুলিশি সাহায্যের জন্য লালবাজারে যোগাযোগ করেছিলাম। ইনস্পেক্টর রবিন আমাকে সত্যিই খুব হেল্প করেছেন।”
জেনি এবার এগিয়ে এসে সাবিন কুমারের ঝোলা থেকে সেই ছোরাটি বের করে বলল, “মিঃ ব্রুক খুন হওয়ার আগে এটা জোগাড় করেছিলেন বটে। কিন্তু এই বাক্সটা খুঁজে পাননি।” তারপর খাপ খুলে ইস্পাতের খাঁজ কাটা ফলাটি বাক্সের গায়ে বিশেষ একটি ফাঁকে বসিয়ে চাপ দিতেই টুক করে খুলে গেল উপরের ঢাকনা।
সবাই তখন হুমড়ি খেয়েছে দেখার জন্য, কী আছে ভিতরে? জেনি হাত বাড়িয়ে তুলে আনল কিছু নষ্ট হয়ে যাওয়া কাগজের তাড়া। খুলতেই ছেড়ে যাচ্ছে পাঁপড় ভাজার মত। তার নিচে পাওয়া গেল কয়েকটা ছোটবড় রঙিন পাথর। আর রয়েছে একটা চওড়া সোনার বাহুবন্ধ বা ব্রেসলেট। সেটার উপরে বসানো পায়রার ডিমের সাইজের একটা ডিম্বাকৃতি লাল রুবি।
শ্রীমন্তদাদুর মুখটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল এতক্ষণ পর। বললেন, “দ্যা রেড আই’। থাইল্যান্ডের রাজা ত্রিলোকনাথের বিখ্যাত সেই বাহুবন্ধ!”
“জলদস্যুর রক্তচক্ষু!”
জেনি হেসে বলল, “দামী পাথর আর অলঙ্কার যা আছে সরকার নিক। আমি শুধু গবেষণার জন্য ঐ খালি বাক্স আর পুরানো কাগজগুলি নিতে চাই।
*****
এর পরের ঘটনা ছ’মাস পরে। সেদিনও বোসবাড়ির বৈঠকখানায় জমা হয়েছে সবাই। ঋজু, তুলি, দিগন্ত, দোয়েল ছাড়াও সৌম্যজিৎ এই আড্ডায় যোগ দেওয়ার জন্য এসেছে জলপাইগুড়ি থেকে। মুখরোচক খাওয়াদাওয়া সমেত গল্প তখন জমে উঠেছে।
শ্রীমন্ত দাদু বললেন, “মণিরম্ভার আধারে, রাজারধন আছে লুকায়ে। এতদিন পরে অর্থটা পরিষ্কার হল। মণি মানে জেমস, আর রম্ভা মানে হল কলা বা প্ল্যান্টেন।”
তুলি বলে উঠল, “তারমানে জেমস প্ল্যান্টের খালি কফিনের নিচে রাজার ধন লুকিয়ে রাখা আছে। এটাই হল মোদ্দা কথা।”
দাদু বললেন, “সাবিন কুমার এই রহস্য ভেদ করেছিল সম্মোহনের সাহায্যে। সে জন্যই বিট্টুকে বাঁচিয়েছিল সে। আর আসল দুস্টিন ব্রুকের কাছ থেকে তার জীবন কাহিনী শুনে নিয়ে নিজেই ব্রুক সেজে ধোঁকা দিতে চেয়েছিল সবাইকে।”
সৌম্য মাথা নেড়ে বলল, “ঐ কথাটা পুরুষানুক্রমে চালু আছে বটে আমাদের বংশে। কিন্তু তার অর্থ কেউ জানত বলে মনে হয় না।” তারপর হাসি মুখে একটা চিঠির খাম দাদুর হাতে দিয়ে জানাল, “সপ্তাহখানেক আগে আমার কাছে এই চিঠিটি এসেছে লন্ডন থেকে। জেনি লিখেছে, সেই বাক্সটির গোপন খাপের মধ্যে নাকি একটি ধাতব পাতে আঁকা ম্যাপ উদ্ধার হয়েছে। যাতে হদিশ আছে তিনশো বছরের পুরানো জলদস্যুদের লুণ্ঠিত সম্পদের। এখনও যা আছে মাদাগাস্কার দ্বীপের মাঝামাঝি ‘মানানান্টানানা’ নদীর উৎস ‘সাহামাঞ্জারয়’ পাহাড়ের এক গুহায়। কাগজ গুলিও আধুনিক পদ্ধতিতে অনেকটা পাঠোদ্ধার করা গেছে। মাস তিনেকের মধ্যে জেনি যাচ্ছে সেই গুপ্তধনের সন্ধানে। আমাদেরকেও আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেছে, অভিযানের সমস্ত খরচ বহন করবে এক জিওগ্রাফি চ্যানেল।”
কথাটা কানে ঢুকলেও বিশ্বাস হচ্ছিল না কারোই। সবার মুখ তখন হাঁ। শ্রীমন্ত দাদু চিঠিটা থেকে চোখ তুলে প্রথম রা কাড়লেন, “যদি জলদস্যুদের সেই গুপ্তধন খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে সেটা এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সব থেকে বড় ট্রেজার হান্ট হবে।”
“হ্যাঁ, সে জন্যই নাকি এক আমেরিকান কোম্পানি অগ্রিম অফার দিয়েছে পুরো অভিযানটাকে ক্যামেরাবন্দী করার।”
সৌম্যর গলা ছাপিয়ে তখন ঘরের মধ্যে কলবর, কোলাহল সহ সমবেত আনন্দ চিৎকার। শুধু মিনি বেকায়দায় পড়ে মিঁইয়াও করে ডেকে দৌড় লাগাল ভয়ে।