।।এক।।
বেশ কিছুদিন আগে কাগজে ছোট্ট একটা খবর ছাপা হয়েছিল। খবরে প্রকাশ, ‘ভালুয়ার জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত রাতা নদীর শুকিয়ে যাওয়া বালুচরে সরীসৃপ প্রজাতির কোন প্রাণীর বিশাল মাপের পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছেন জঙ্গলের মধ্যে আদিবাসী গ্রাম কুরমার এক অধিবাসী। বিশেষ অভিযান চালিয়েও প্রাণীটির কোনও হদিস পায়নি বন দফতর। জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত আদিবাসী গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়েছে এই পায়ের ছাপ।’
বেশ কিছুদিন ধরে বৈজ্ঞানিক তপনানন্দ সেনের সঙ্গে ঘাঁটি গেড়েছি ভালুয়ার জঙ্গলে। আগেও বহুবার জঙ্গলে গেছি। কখনও একা, কখনও বা বন্ধুদের সঙ্গে। কিন্তু কোনও বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে এই প্রথম জঙ্গলে আসা।
ঘটনাটা কাগজে পড়ে মিস্টার সেন ভালুয়ার বন দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছিলেন যে, বন দফতর খুব একটা মাথা ঘামায়নি এটা নিয়ে। কারণ, বন দফতরের আদিবাসী লোকটির বর্ণিত জায়গায় গিয়ে কোনও পায়ের ছাপ খুঁজে পায়নি। আচমকা প্রচণ্ড বৃষ্টিতে সব ধুয়েমুছে যায়। বনকর্তাদের মতে, আদিবাসীরা প্রায় সময় মহুয়া খেয়ে থাকে। মহুয়ার ঘোরে কী দেখতে কী দেখেছে কে জানে। তাছাড়া জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া রাস্তাটায় হঠাৎ করে ডাকাতি শুরু হয়েছে। ওই নিয়েই ওরা বেশি চিন্তিত।
।।দুই।।
মিস্টার সেন ঠিক করেছিলেন যে তিনি নিজেই ভালুয়ার জঙ্গলে যাবেন অজানা প্রাণীটির ব্যাপারে খোঁজখবর করতে। এখন আমি প্রতি শনিবার সকালে নিয়ম করে মিস্টার সেনের বাড়ি যাই আড্ডা মারতে। অনেক নতুন নতুন বিষয় জানতে পারি কথায় কথায়। আসলে মাঝে মাঝে আমি গল্প লিখি। ওঁর সঙ্গে কথা বলে গল্পের অনেক নতুন প্লট মাথায় আসে। মিস্টার সেন জেনে গেছেন আমার গল্প লেখার কথা। উনি শুধু বলেন ভালো করে পড়াশুনা না করে, বিষয়টা ভালো করে না জেনে গল্প না লেখাই ভালো। এখন তো ইনফরমেশন পাওয়া অনেক সোজা হয়ে গেছে। আগের মতো লাইব্রেরি গিয়ে বই ঘাঁটতে হয় না। ইন্টারনেটই অধিকাংশ তথ্য পাওয়া যায়। আমি ইদানিং গল্প লেখার পর শনিবার করে চায়ের টেবিলে ওঁকে আমার লেখা গল্প পড়ে শোনাই পত্রিকা সম্পাদকের কাছে পাঠানোর আগে। বেশ কয়েকটা গল্প উনি আমাকে দিয়ে পরিবর্তন করিয়েছেন এবং বলতে নেই আগে আমি পত্রিকা অফিসে গিয়ে লেখা দিয়ে আসতাম আর এখন সম্পাদকরা রীতিমতো তাগাদা করে লেখা নিয়ে যান।
এক শনিবার মিস্টার সেন আমাকে ভালুয়ার খবরটা শুনিয়ে বলেছিলেন, “আমার সঙ্গে জঙ্গলে যাবেন নাকি জন্তুটার খোঁজখবর নিতে? বন দফতর তো ‘অল বোগাস’ বলে হাত গুটিয়ে বসে আছে!”
লুফে নিয়েছিলাম প্রস্তাবটা।
মিস্টার সেনের কথামতো সপ্তাহ খানেক থাকতে হতে পারে জঙ্গলে। অফিসে ছুটির দরখাস্ত করতে সেটা পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছিলেন বড়ো সাহেব। আমিও সাতপাঁচ না ভেবে রেজিগনেশন দিয়ে দিয়েছিলাম। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। লিখে এখন খানিক অর্থ রোজগার করতে শুরু করেছি।
মিস্টার সেন ভালুয়ার বন দফতরে ফোন করে কুরমা আদিবাসী গ্রামের লোকটির ফোন নাম্বার নিয়ে রেখেছিলেন। ভালুয়ার জঙ্গল আমাদের এখান থেকে প্রায় সাতশো কিলোমিটার দূরে। মিস্টার সেন কুরমা গ্রামের হাবো কুর্মু নামের লোকটির সঙ্গে ফোনে কথা বলে জেনে নিয়েছিলেন যে দু’নম্বর জাতীয় সড়কের ওপর পুরনাপানি শহর থেকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা মাটির রাস্তা চলে গেছে কুরমা গ্রামে। পুরনাপানি থেকে কুরমা গ্রামের দূরত্ব প্রায় পনেরো কিলোমিটার। ঠিক হল, মিস্টার সেনের বড়ো ওয়াগান ভ্যান গাড়িতে চেপে আমারা যাব কুরমা গ্রামে। ওঁর গাড়িটা একটা চলমান গবেষণাগার। এমনকি গাড়ির মাথায় দুটো সোলার প্যানেল লাগানো আছে। কাজেই স্বল্প বিদ্যুৎশক্তির অভাব নেই। তাঁবু খাটিয়ে থাকব গ্রামের ভেতর।
।।তিন।।
আমি আর মিস্টার সেন ভোর চারটের সময় রওয়ানা দিয়ে পালটাপালটি করে গাড়ি চালিয়ে যখন কুরমা গ্রামে পৌঁছলাম তখন বিকেল তিনটে।
গ্রামে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল হাবো। ছোটোখাটো চেহারা। তামাটে গায়ের রং। বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। আমাদের নিয়ে গেল ওর বাড়িতে। ওর দুই কামরার মাটির বাড়ির একটা ঘর খালি করে রেখেছিল নিঃসন্তান দম্পতি আমাদের থাকার জন্য। আমাদের ওর বাড়িতে থাকার জন্য অনেক সাধাসাধি করলেও মিস্টার সেন বললেন, আমরা গ্রামের প্রান্তে তাঁবু খাটিয়ে থাকব। আমাদের সঙ্গে আনা খাবারদাবার রান্না করে দেবার জন্য যদি একজন লোক পাওয়া যায় তা হলে ভালো হয়। বিনিময়ে আমরা অর্থ দেব। ঠিক হল হাবোর স্ত্রী রান্না করে দেবে, তবে কোনও টাকাপয়সা নিতে পারবে না।
হাবো এই গ্রামের মোড়ল। বন দফতর অজানা জন্তু সম্পর্কে ওর কথা বিশ্বাস করেনি বলে ওর খুব রাগ। তাই মিস্টার সেন যখন ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তখন হাবো বড়ো খুশি হয়েছিল। বলেছিল, ও আমাদের পুরো জঙ্গল ঘোরাবে। শর্ত ছিল, বন দফতরের কাউকে সঙ্গে নেওয়া যাবে না। পুরো গ্রামের মধ্যে হাবোই খানিক লেখাপড়া জানে। শহরের এক মিশনারি স্কুলের বোর্ডিংয়ে থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছিল হাবো। তারপর বাবা মারা যেতে পড়াশুনায় ইতি টেনে গ্রামে ফিরে আসে হাবো।
এপ্রিল মাস। রাত নামতে এখনও ঢের দেরি। আমাদের দেখতে ভিড় জমিয়েছিল গ্রামের মানুষজন। হাবো আমাদের ওদের গ্রাম দেখাতে নিয়ে চলল। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলল গ্রামের কয়েকজন। জঙ্গল-পাহাড়বেষ্টিত গোটা কুড়ি পরিবার নিয়ে কুরমা গ্রাম। মাটির দেওয়াল আর খোলার চালা দেওয়া বাড়িগুলোর দেওয়ালে দেওয়ালে বিভিন্ন রঙে আঁকা অজস্র চিত্র। অধিকাংশই জন্তু-জানোয়ার আর পাখির ছবি। সৌরশক্তিচালিত পাঁচটা আলোকস্তম্ভ আছে গ্রামের মাঝে। প্রতি চারটে পরিবার পিছু একটা করে সরকারি আলো। মোবাইল ফোন চার্জ দেবার ব্যবস্থা আছে এই আলোকস্তম্ভে। হাবো জানাল, মোবাইল ফোনে কথা বলতে কাছের পাহাড়ের মাথায় উঠতে হয়। নাহলে সিগন্যাল পাওয়া যায় না। সেই জন্যেই মিস্টার সেন বেশ কয়েকবার ফোন করে হাবোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। হাবো পাহাড়ের মাথায় ওঠার পর অনেকগুলো মিসড কল দেখে যোগাযোগ করে। মিস্টার সেন ওর পরিচয় দিয়েছিলেন একজন ফটোগ্রাফার বলে। বলেছিলেন, খবরের কাগজে প্রকাশিত সংবাদ দেখে বন দফতর থেকে হাবোর ফোন নাম্বার জোগাড় করে উনি যোগাযোগ করছেন।
গ্রামের মাঝখানে একটা সরকারি হাতে চাপা কল। সারা গ্রামের একমাত্র পানীয় জলের উৎস। বছরের কয়েক মাস বাদ দিলে জলের খুব কষ্ট এখানে। পুকুর-ডোবা সব শুকিয়ে যায়। এই কল বসার আগে গ্রামের লোকেরা রাতা নদীর শুকনো বালিতে গর্ত খুঁড়ে পানীয় জল জোগাড় করত। শুকনো নদীর বুকে এক কলসি জল জমতে লেগে যেত প্রায় একঘণ্টা। তবে শুকনোর সময়ও একটা সরু তিরতিরে জলের ধারা বয়ে যায় রাতা নদীর বিশাল চাওড়া খাত বেয়ে। সকালবেলায় জঙ্গলে গরু-মোষ চরিয়ে দুপুরে নদীতে জল খাওয়াতে নিয়ে যায় গ্রামের লোক। রাতে নদীর বুকে জলের খোঁজে আসে বন্যপ্রাণীর দল। কখনও কখনও দিনেরবেলাতেও হাতির পাল চলে আসে নদীতে। ওরা ওদের মতো থাকে আর গ্রামের লোক খানিক দূরে নির্ভয়ে ওদের গরু-মোষের পালকে নদীর বুকে একচিলতে জলে স্নান করায়।
কুরমা গ্রামবাসীদের পেশা হল জঙ্গলের শুকনো ডালপালা আর গরু-মোষের দুধ বিক্রি করা। শহর থেকে প্রতিদিন একটা করে গাড়ি আসে দুধ আর কাঠ সংগ্রহ করতে। এছাড়া গ্রামের লোকেরা জঙ্গল থেকে মহুয়ার ফুল ও ফল সংগ্রহ করে বিক্রি করে। গ্রামের কাছে খানিকটা জঙ্গল পরিষ্কার করে সামান্য চাষও করে কুরমার লোকেরা। তবে জলের অভাবে বছরে মাত্র একবারই চাষ হয়।
গ্রামটা একটা চক্কর মারা হলে হাবো আমাদের নিয়ে চলল গ্রামের একপ্রান্তে একটা ছোট্ট টিলার কাছে। এই টিলার ওপর উঠলে তবেই মোবাইলে কথা বলা যায়। পাঁচশো ফুটমতো উঁচু পাহাড়টার খানিক আগে অনেকটা জায়গা গাছপালা কেটে পরিষ্কার করা রয়েছে। গাছের ডাল কেটে কয়েকটা বেঞ্চমতো বানানো সেখানে। ঠিক যেন একটা ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড। একটা সরু পায়ে চলা রাস্তা পাহাড়ের ধার ঘেঁষে গেছে জঙ্গলের ভেতর। হাবো বলল, এই জায়গাটা পরবের সময় নাচগান করার জন্যে ব্যবহার হয়। আর সরু পায়ে চলা রাস্তাটা চলে গেছে রাতা নদীতে।
জায়াগাটা পছন্দ হল মিস্টার সেনের। বললেন, “গাড়িটা নিয়ে আসা যাক। এখানেই তাঁবু খাটাব আমরা।”
রাত্তিরটা হাবোর বাড়িতেই খেতে হল।
।।চার।।
পরিকল্পনামতো ভোর পাঁচটা নাগাদ হাবোকে নিয়ে নদীর দিকে রওনা হলাম আমরা। গাড়ির মধ্যে অনেকগুলো বিভিন্ন মাপের জিনিসপত্র বোঝাই ব্যাগ ছিল। মিস্টার সেন গাড়ি থেকে একটা বেশ বড়ো ব্যাগ নামিয়ে পিঠে চাপিয়ে নিলেন। আরেকটা ব্যাগ আমাকে দিলেন। ব্যাগটা বেশ ভারী। কী আছে কে জানে। জলের বোতল আর শুকনো খাবারভর্তি একটা থলিও নেওয়া হল সঙ্গে।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এবড়োখেবড়ো পাথুরে পথ দিয়ে হাঁটছি আমরা। চাপ চাপ অন্ধকার গাছের তলায়। আমাদের পায়ের শব্দে হুড়মুড় করে একটা শুয়োর গাছপালার ফাঁক দিয়ে ছুটে চলে গেল। হাবো বলল, এই জঙ্গলে বুনো শুয়োর আর হরিণের অভাব নেই। এমনকি গ্রামের ভেতরে চরে বেড়ায় হরিণের দল। এই জঙ্গলের গ্রামের লোকেরা এখন কেউ আর জঙ্গলে শিকার করে না, তাই জঙ্গলের প্রাণী মানুষের কাছাকাছি চলে আসে নির্ভয়ে। হাবো বলল, গরমকালে কাঁঠাল খেতে ভালুকের দল গ্রামেও চলে আসে। এই জঙ্গলে অনেক কাঁঠালগাছ আছে। শুধু ধান পাকলে মাঝে মাঝে হাতির পাল উৎপাত করে। টিন বাজালে হাতির পাল আবার চলেও যায়। এই জঙ্গলে লেপার্ড থাকলেও এখনও পর্যন্ত গ্রামে লেপার্ড হানা দেয়নি।
পাতার আড়ালে লুকিয়ে পাখিরা ডেকে চলেছে।
গতকাল কুরমা গ্রামে পৌঁছনো থেকে মিস্টার সেন অজানা জন্তুর পায়ের ছাপ নিয়ে একটাও কথা বলেননি। অজানা প্রাণী নয়, ওঁর উৎসাহ যেন গ্রামের লোকজন নিয়ে।
জঙ্গলটা আচমকাই শেষ হয়ে গেল। সামনে একটা গভীর খাত। এই খাতের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে নদীর সরু জলধারা। এটাই রাতা নদী। প্রায় দুশো মিটার চওড়া বালিখাতের দু’পাশে ঘন জঙ্গল আর ছোটো ছোটো পাহাড়। সবুজ আর সবুজ চারদিক। তার মধ্যে দিয়ে সোনালি বালির নদীখাত। নদীর পাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে একটা পায়ে চলা পথ নেমে গেছে নদীর বুকে। দেখলাম, বেশ খানিকটা দূরে কয়েকজন লোক নদীতে স্নান করছে।
হাবো জানাল, সকালবেলা অনেক সময় হাতির পাল দেখা যায় নদীর এখানে। হাবো যেখানে লম্বা নখওয়ালা পায়ের ছাপ দেখতে পায় সেটা এখান থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে।
মিস্টার সেন হাবোকে বললেন, “হাবো, নদীতে না নেমে জঙ্গল ধরে চলো। যেখানে ছাপটা দেখেছিলে সেই জায়গাটা চিনতে পারবে তো?”
হাবো বলল, “হ্যাঁ সাহেব, ভালো করে চিনতে পারব। আপনাকে বলে দিলে আপনি নিজেও বের করতে পারবেন জায়গাটা। আমরা নদীর যেই পাড় দিয়ে যাচ্ছি সেদিক থেকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একটা ঝরনা নেমে এসেছে নদীতে। কিন্তু এখন জল নেই ঝরনায়। ঝরনার কাছে নদীর ধারের বালির ওপর দুটো তিন-চার মানুষ সমান গোল গোল পাথরের ওপর একটা বড়ো গোল পাথর বসে আছে। ওই পাথরের কাছেই দেখেছিলাম পায়ের ছাপ।”
গাছপালার ফাঁক দিয়ে ঘণ্টা খানেক হাঁটার পর নদীর উঁচু পাড় থেকে নদীর বুকে পিরামিডের মতো তিনটে গোল পাথর দেখতে পেলাম আমরা। আশপাশটা ছোটো ছোটো টিলায় ভর্তি।
মিস্টার সেন বললেন, “হাবো, নদীর বুকে নামতে হবে। তবে তার আগে এই জায়গাটা একটু ভালো করে দেখে নিতে চাই।”
হাবো বলল, “এখানে একটা বিশাল ঘাসজমি আছে। ঘাসজমির শেষে পাহাড়ের গায়ে অনেক ছোটো ছোটো গুহা। বড়ো বড়ো ময়াল সাপ থাকে এই গুহাগুলোয়, তাই গ্রামের লোক এখানের জঙ্গলে আসে না। তবে নদীর বুকে কোনও ভয় নেই।”
সাপের কথা শুনে আমার শরীর শিউরে উঠল। মিস্টার সেন আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভয় পেয়ে গেলেন নাকি? একটু চোখকান খোলা রাখবেন, দেখবেন কিছু হবে না। আপনার শ্রবণশক্তির ওপর আমার অগাধ আস্থা। কংক্রিটের ছাদে পাখির চলার আওয়াজ আপনি শুনতে পান। খুব কম লোকের আপনার মতো তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তি আছে।”
আমরা শুকনো ঝরনাটার কাছে পৌঁছলে মিস্টার সেন দাঁড়াতে বললেন। তারপর ওঁর পিঠের রুকস্যাকটা খুলে একটা লম্বা দড়ি বের করে একটা বড়ো গাছের গুঁড়িতে দড়ির একটা প্রান্ত বেঁধে বাকিটা ছুড়ে দিলেন নিচে। বললেন, “দড়িটা বাঁধা থাক। নদীর বুকে নামতে উঠতে সুবিধা হবে।”
তারপর ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে শুরু করলেন। সামনেই অনেক পাথরের স্তূপ পড়ে আছে। একটা বড়ো পাথর বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন মিস্টার সেন। পেছন পেছন হাবো। তারপর আমাকে উঠতে বললেন। কোনওরকমে হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে উঠে সামনে পাথরের ফাটলে একটা সাপের খোলস দেখতে পেলাম। আমি কোনওদিন এভাবে পাথর বেয়ে উঠিনি। তারপর সাপের খোলস দেখে সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলাম। মিস্টার সেন বললেন, “কলেজে পড়ার সময় মাউন্টেনিয়ারিং করতাম। বিদ্যেটা মাঝে মাঝে কাজে লেগে যায়।”
পাথরে উঠে সামনে চেয়ে দেখি জঙ্গল আর পাহাড়ের মাঝে লম্বা হাঁটু সমান উঁচু ঘাসজমি। ঘাস ছাড়া আর কোনও গাছপালা নেই। ঘাসের মাঝে মাঝে ছোটোবড়ো পাথরের স্তূপ মাথা উঁচু করে আছে। এই ঘাসজমির শেষে আছে গুহাগুলো। হাবো বলল, “এখানে অনেক হরিণ আসে ঘাস খেতে। আর আসে খরগোস। সাপগুলো খরগোস আর ছোটো ছোটো হরিণ ধরে ধরে খেয়ে গুহায় ঢুকে ঘুমিয়ে থাকে।”
মিস্টার সেন হাবোকে বললেন, “তুমি তো বললে তোমার গ্রামের লোক এখানে আসে না, তাহলে তুমি এত কথা জানলে কী করে?”
হাবো বলল, “আমি গ্রামের মোড়ল। আমাকে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে অনেক খবরই রাখতে হয়।”
মিস্টার সেন বললেন, “চলো হাবো, এবার নদীতে নামা যাক। তারপর তুমি কী দেখেছিলে শুনব।”
হাতে একজোড়া গ্লাভস পরে দড়ি ধরে মিস্টার সেন ব্যাগ কাঁধে দ্রুত নেমে গেলেন নদীর বুকে। হাবো নামল ঝরনার বুকের পাথর ধরে ধরে। মিস্টার সেন নিচে পৌঁছে গ্লাভসদুটো দড়ির প্রান্তে বেঁধে আমাকে টেনে তুলতে বললেন। গ্লাভসদুটো টেনে ওপরে তুলে আবার দড়িটা নিচে ছুড়ে হাতে গ্লাভস পরে মিস্টার সেনের দেখাদেখি দড়ি ধরে ধরে কোনওরকমে নিচে নামলাম। শুকনো নদীর বালি-তটে পৌঁছে হাঁফ ছাড়লাম। প্রথমে খুব ভয় লাগলেও নিচে নামার পর ভয়টা অনেক কেটে গেল।
মিস্টার সেন বললেন, “হাবো, তুমি ঠিক কী দেখেছিলে বলো তো?”
হাবো বলল, “আমার গ্রামের একজনের ছাগল হারিয়ে গেছিল। সেটাকে খুঁজতে সকালবেলা নদী ধরে হাঁটতে হাঁটতে এখানে পৌঁছে দেখি ওই বড়ো পাথরগুলোর কাছে বালির ওপর লম্বা লম্বা সরু সরু পায়ের ছাপ। আমরা যেখান দিয়ে নদীতে নামলাম সেখান থেকে দাগটা শুরু হয়ে নদীটা পার হয়ে খানিক গিয়ে একটা ঘাসের ঝোপে পৌঁছে দাগটা আবার ফেরত এসে ওই শুকনো ঝরনার কাছে গিয়ে পাথরের গায়ে গিয়ে হারিয়ে গেছে। দাগটা কোনও চেনা জন্তুর নয়। অনেকটা কুমিরের পায়ের ছাপের মতো। কিন্তু এখানে তো কোনও কুমির নেই। ফরেস্ট অফিসে গিয়ে জানালাম। ওরা আমার কথা ভালো করে শুনলই না। একজন খবরের কাগজের সাংবাদিক ওখানে জঙ্গলের রাস্তায় ডাকাতির খোঁজ নিচ্ছিলেন। তিনি আমার কথাটা খবরটা কাগজে ছাপিয়ে দিলেন। খবরটা কাগজে বেরোতে একদিন ফরেস্টের লোকজন এসে জায়গাটা দেখে বলল, মহুয়া খেয়ে কী না কী দেখেছিস, আর খবরের কাগজওয়ালারাও সেই খবর ছেপে দিয়েছে। সাহেব, আপনারা ভালো করে খুঁজুন, নিশ্চয়ই জানোয়ারটাকে খুঁজে পাবেন। ছাগলটাকে লেপার্ডে খায়নি। এই জঙ্গলে লেপার্ড থাকলেও গ্রামের কাছে লেপার্ড আসে না। হয়তো ছাগলটা জঙ্গলে হারিয়ে গেছে।”
মিস্টার সেন বললেন, “নিশ্চিন্ত থাকো হাবো, যদি কোনও অজানা জন্তু এখানে থেকে থাকে তাহলে আমরা ওটাকে খুঁজে বের করব। চলো, নদীর অন্য পাড়টা ঘুরে আসি।”
হাবো বলল, “সাহেব, এখান দিয়ে উলটোদিকের পাড়ে ওঠা যাবে না। উঠতে হলে আরও অনেকটা এগোতে হবে। সেখানে খানিকটা ঢালু জায়গা আছে ওঠার মতো। ওপরে বাঁশ আর কাঁটাগাছের জঙ্গল। আমি একবার ওই ঢালু পাড় বেয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু কাঁটাগাছ দেখে আর এগোইনি। কাঁটাগাছের ঝোপে অনেক সাপ থাকে।”
মিস্টার সেন বললেন, “চলো আজকে ফেরা যাক, কাল আবার আসব। দড়িটা খুলে নামিয়ে নিয়ে আসতে হবে। আমরা নদী ধরে হাঁটব।”
হাবো বলল, “আপনারা একটু দাঁড়ান, আমি দড়িটা খুলে নিয়ে আসছি।”
তড়তড় করে শুকনো ঝরনার বড়ো বড়ো পাথর ধরে ধরে ওপরে উঠে গাছ থেকে দড়িটা খুলে নিচে ছুড়ে ফেলে পাথর বেয়ে বেয়ে নিচে নেমে এল হাবো।
দড়িটা গুটিয়ে ব্যাগে ভরে তিরতির করে বয়ে চলা সরু নদীর পাশ দিয়ে আগে আগে চলেছেন মিস্টার সেন। বালিতে অনেকধরনের জন্তুর পায়ের ছাপ। ফটো তুলছেন আর হাবোর কাছ থেকে জেনে নিচ্ছেন কোনটা কোন প্রাণীর পায়ের ছাপ। গরু ও মোষ বাদ দিলে অধিকাংশই হরিণ, নয় শেয়াল জাতীয় প্রাণীর ছাপ। বালির ওপর এক জায়গায় অনেক হাতির মল পড়ে আছে। হাবো বলল, “দিন দশেক আগে একটা বড়ো হাতির পাল এসেছিল। পুরো একটা দিন ধরে নদীর চড়ায় দাপিয়েছে দলটা।”
।।পাঁচ।।
আমরা তাঁবুতে ফিরলাম দুপুর দুটো নাগাদ। পৌঁছে দেখি হাবোর স্ত্রী ভাত, ডাল, ডিমের ঝোল বানিয়ে একটা গাছের তলায় আমাদের জন্যে বসে আছে। একবালতি জলও এনে রেখেছে। আমরা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম। মিস্টার সেন বললেন, “রাতের খাবার রান্না করতে হবে না, আমরা নুডুলস বানিয়ে নেব।”
মিস্টার সেন হাবোকে কাল ভোরে একবার আসতে বললেন।
সন্ধে নামতে মিস্টার সেন বললেন, “আমি একবার নদীর ধারে যাব। আপনি টেন্টে থাকুন।”
আমি বললাম, “আমিও যাব আপনার সঙ্গে।”
মিস্টার সেন বললেন, “ঠিক আছে।”
গাড়ি থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে এসে সেটা থেকে দুটো হেলমেট বের করে একটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে মিস্টার সেন বললেন, “পরে নিন।”
হেলমেটের সামনে দুটো দূরবীনের মতো কী লাগানো! আগে কোনওদিন এরকম হেলমেট দেখিনি। হেলমেটটা মাথায় পরতে চোখের সামনে চলে এল দূরবীনের মতো যন্ত্রটা। হালকা চাঁদের আলোয় যা এতক্ষণ আবছা আবছা দেখছিলাম তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সবকিছু সবুজ সবুজ দেখাচ্ছে। মিস্টার সেন বললেন, “এটা নাইট ভিশন চশমা। রাতের অন্ধকারে দেখার জন্য। পাঁচ-দশ মিনিট এটা পরে হেঁটে নিন, দেখবেন ধাতস্থ হয়ে গেছেন। আমি আলো জ্বালিয়ে লোকের নজর কাড়তে চাই না।”
আমরা যখন নদীর ধারে পৌঁছলাম তখন রাত আটটা বাজে। নাইট ভিশন পরে থাকার জন্যে অন্ধকার জঙ্গলে হাঁটতে কোনও অসুবিধা হয়নি। মিস্টার সেন বললেন, “চলুন, ঝরনার ওখানে যাই। রাত্রিবেলা ঘাসজমিটা ঘুরে দেখা দরকার। হাবো বলেছিল, ওখানে অনেক গুহা আছে, সেগুলোও দেখা হয়ে যাবে। নদীর অন্য পাড়ের কাঁটাভরা জঙ্গলটাও দেখা দরকার।”
আমি বললাম, “এই রাতের অন্ধকারে সাপের রাজ্যে না গেলেই নয়?”
মিস্টার সেন বললেন, “আপনি তো অন্ধকারে দেখার চশমা পরে আছেন, তাহলে আর রাতের ভয় কীসের? আমার ওপর ভরসা রাখুন। দেখুন আপনাকে কী করে ঘুরিয়ে আনি!”
বলেই মিস্টার সেন পিঠের ব্যাগটা থেকে একটা লম্বা ধাতব কৌটো বের করলেন। চমকে গেলাম। এই কৌটোটা আমি চিনি। মিস্টার সেনের আবিষ্কার, উড়ুক্কু চাদর!
মিস্টার সেন কৌটোটার ওপরের একটা নবে চাপ দিতেই ভস ভস করে ধোঁয়া বেরোতে সুর করল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ধোঁয়া জমাট বেঁধে একটা বড়ো বিছানার চাদরের মতো হাওয়ায় ভাসতে লাগল। তারপর আবার হাতের বড়ো কৌটোটায় আবার চাপ দিতেই দুটো কব্জা বেরিয়ে এল। কব্জাদুটো ওই ভাসমান চাদরের গায়ে ধরতেই চুম্বকের মতো লেগে গেল চাদরটার গায়ে। চুম্বকের মতো লেগে থাকা কৌটোটার গায়ে চাপ দিতেই তা থেকে ইলেকট্রিক পাখার মতো তিনটে ছোটো ছোটো ব্লেড বেরিয়ে এসে প্রবল গতিতে ঘুরতে শুরু করল।
মিস্টার সেন ভাসমান চাদরের ওপর চেপে বসে আমাকেও উঠে পড়তে বললেন। আমি চাদরের ওপর উঠে বসতেই মিস্টার সেন কৌটোটা থেকে বেরিয়ে আসা একটা সরু ডাণ্ডায় চাপ দিলেন আর আমরা নিঃশব্দে আকাশে ভেসে নদীর ওপর দিয়ে এগোতে লাগলাম।
প্রথমে খুব ভয় লাগলেও খানিক পর ভয়টা কেটে গেল। নিচে চাপ চাপ সবুজ অন্ধকারে দেখি দুটো কুকুরের মতো প্রাণী নদীতে জল খাচ্ছে। মিস্টার সেন বললেন, “শেয়াল।”
নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে ভাসমান চাদর-যান। নদীর জল থেকে আমরা উড়ছি ফুট কুড়ি ওপর দিয়ে। মিস্টার সেন ফিসফিস করে বললেন, “চোখকান খোলা রাখুন। কোনও নড়াচড়া দেখলেই বলবেন।”
একটা নিশাচর পাখি জঙ্গল থেকে উড়ে আমাদের চাদর-যানের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে কোনওরকমে সামলে খানিক গুপ গুপ করে চিৎকার করে আবার জঙ্গলের দিকে ফিরে গেল। মিস্টার সেন বললেন, “প্যাঁচা।”
শুকনো জলপ্রপাতের সামনে পৌঁছে দেখি চওড়া বালির চরে কতকগুলো জন্তু ঘোরাফেরা করছে। মিস্টার সেন চাদর-যানটা আরও নিচে নামিয়ে নিয়ে এলেন। চক্কর মারতে শুরু করলেন জন্তুগুলোর ওপর দিয়ে। দেখি অনেকগুলো ভাল্লুক নদীর চরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নাইট ভিশন চশমায় ভালুকগুলো সব সবুজ ভালুক হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে অন্য কোনও পৃথিবীতে চলে এসেছি। যেখানে সব সবুজ। মিস্টার সেন ফুট দশেক ওপর থেকে গোটা কয়েক ছবি তুললেন। ফ্লাশ গানের আলো ভালুকের চোখে ঝলক দিতে ভালুকগুলো ছোটাছুটি করতে লাগল। মিস্টার সেন চাদর-যানকে এগিয়ে নিয়ে চললেন।
ঝরনার কাছে পৌঁছে উড়ন্ত চাদর-যানকে নদীখাত থেকে জঙ্গলের ওপর দিয়ে ঘাসজমির আকাশে তুললেন মিস্টার সেন। আমরা এগিয়ে চললাম দূরের পাহাড়ের দিকে। নিচের ঘাসজমিতে হরিণের দল চরে বেড়াচ্ছে। পাহাড়ের সামনে পৌঁছে চাদর-যানকে একটু উঁচুতে তুললেন মিস্টার সেন। নিচে চাপ চাপ সবুজ অন্ধকার। অসংখ্য ছোটোবড়ো পাথরের স্তূপ পড়ে আছে পাহাড়ের পাদদেশে। কিছু একটা নড়ে বেড়াচ্ছে পাথরের স্তূপের মাঝে। মিস্টার সেন নিঃশব্দ চাদর-যানকে নিয়ে চললেন পাথরের স্তূপটার ওপর। মিস্টার সেন চাদর-যানে বসে একটা ছবি তুললেন। তারপর আমাকে বললেন, “ওটা একটা পিঁপড়েভূক প্রাণী আর্মাডিলো। চলুন এবার ফেরা যাক, দিনেরবেলা পায়ে হেঁটে আসতে হবে এখানে।”
যেখান থেকে আমরা উড়ানযাত্রা শুরু করেছিলাম সেখানে এসে চাদর-যানকে নদীর বালির বুকে নামিয়ে নিয়ে আসলেন মিস্টার সেন। মাটি থেকে দু’ফুট ওপরে এক জায়গায় স্থির হয়ে হাওয়ায় ভাসতে লাগল উড়ুক্কু চাদর-যান। মিস্টার সেন বললেন, “নেমে পড়ুন।”
আমরা দু’জন নামতেই মিস্টার সেন যানের পেছনে লাগানো বড়ো কৌটোটার ওপর একটা চাপ দিলেন। প্রচণ্ড গতিতে ঘুরতে থাকা ছোটো পাখাটা থেমে গিয়ে গুটিয়ে কৌটোর পেটের ভেতর সেঁধিয়ে গেল। দুটো কব্জা যেটা এতক্ষণ চাদরের যানের পেছনে কৌটোটাকে ধরে রেখেছিল সেটা আলগা হয়ে চাদরটাকে ছেড়ে কৌটোর গায়ের কতগুলো খাঁজে ঢুকে গেল। মিস্টার সেন আকাশে ভাসতে থাকা চাদরটা তাক করে কৌটোর গায়ের একটা বোতামে চাপ দিলেন। ধোঁয়ার মতো খানিক কী বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ল ভাসমান শক্ত চাদরটার ওপর। মুহূর্তের মধ্যে চাদরটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
মিস্টার সেন বললেন, “চলুন, তাঁবুতে ফেরা যাক। ভুলেও কিন্তু এই চাদর-যান বা আমাদের রাতের অভিযানের কথা হাবোকে বলবেন না! সেইজন্য রাতের অন্ধকারে নদীতে এসে চাদর-যান উড়িয়েছি যাতে কেউ কিছু টের না পায়। গ্রামের লোক যদি চাদর-যানের কথা জানতে পারে তাহলে আমাদের ভূতপ্রেত ভাববে আর সব পণ্ড হয়ে যাবে।”
গ্রামের লোক কী, আমারই মাঝেমধ্যে মিস্টার সেনের কাজকারবার দেখে মনে হয় উনি ভূতপ্রেতের কারবারি।
।।ছয়।।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখি হাবো আর ওঁর স্ত্রী দু’বালতি জল নিয়ে এসে বসে আছে। গ্রামের লোকেরা রাতের অন্ধকার নামতে না নামতে ঘুমিয়ে পড়ে আর সূর্য ওঠার আগেই লেগে কাজে লেগে পড়ে। আমরা হাতমুখ ধুতে ধুতে শুকনো কাঠ জ্বেলে আমাদের আনা রেশন থেকে রুটি আর আলুভাজা বানিয়ে দিল হাবোর স্ত্রী। আমাদের সঙ্গে কেরোসিন স্টোভ ছিল, কিন্তু হাবোর স্ত্রী স্টোভে রান্না করতে ভয় পাচ্ছিল। আমরা খেয়েদেয়ে রওনা হতে হাবোর স্ত্রী চলে গেল, পরে এসে দুপুরের খাবার বানিয়ে রাখবে।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছলাম শুকিয়ে যাওয়া ঝরনাটার ধারে। মিস্টার সেন আমাকে ও হাবোকে আগে থেকে প্যাক করা রাখা দুটো ছোটো রুকস্যাক দিয়েছিলেন পিঠে নেবার জন্য। নিজেও পিঠে নিয়েছেন একটা। জানি না কী বেরোবে এই ব্যাগগুলো থেকে!
ঝরনার ধারে পৌঁছতে আমাকে বললেন, “ব্যাগটা খুলে জিনিসপত্র আস্তে আস্তে বের করুন।”
ব্যাগের চেন খুলতে দেখলাম, ভেতরে স্পঞ্জে মোড়া ছোটো ছোটো চারটে প্যাকেট। মিস্টার সেন বললেন, “একটা প্যাকেট খুলুন। খুব সাবধানে।”
প্যাকেট খুলতে বেরিয়ে এল ছোটো ছোটো লেন্স লাগানো সারা গায়ে সবুজ আর বাদামি ছোপওয়ালা ক্যামেরা। মিস্টার সেন বললেন, “এগুলো হল হান্টিং ক্যামেরা। এই ক্যামেরাতে মোশন সেন্সার লাগানো আছে। এই ক্যামেরার পঞ্চাশ ফুট পর্যন্ত সামনে দিয়ে কোনওকিছু নড়াচড়া করলেই ক্যামেরাটা সক্রিয় হয়ে ওঠে আর ছবি তুলে ওয়েব তরঙ্গের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয় আমার কম্পিউটারে। এই ক্যামেরাগুলোতে ইনফ্রারেড লাগানো আছে, ফলে রাতের অন্ধকারেও ছবি ওঠে। কিন্তু ছবিগুলো সময়মতো পাব কি না কে জানে। মোবাইল নেটওয়ার্কের যা অবস্থা! এই ক্যামেরাগুলো আমরা বিভিন্ন স্পটে লাগাব। দেখা যাক, অজানা সরীসৃপ ধরা দেয় নাকি ক্যামেরায়।”
প্রথম ক্যামেরাটা ঝরনার ধারের একটা গাছের গুঁড়িতে এমনভাবে ফিতে বেঁধে লাগানো হল যে শুকনো ঝরনার এবড়োখেবড়ো পাথরভরা গা বেয়ে কিছু উঠলেই ধরা পড়ে যাবে ক্যামেরার লেন্সে। তারপর মিস্টার সেন ওঁর ব্যাগটা থেকে বের করলেন দড়ি। দড়িটা একটা গাছে বেঁধে আমরা দড়ি বেয়ে নেমে পড়লাম নদীর বালুচরে। পিরামিডের মতো পাথরগুলোর কাছে গিয়ে মিস্টার সেন বললেন, “এখানে একটা ক্যামেরা লাগানো যাক।”
তারপর কী ভেবে আবার বললেন, “না, এখানে আর ক্যামেরা লাগানোর দরকার নেই।”
আমরা নদীর স্রোতের পাশাপাশি হেঁটে চলেছি বালির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে। মিস্টার সেন ছবি তুলে চলেছেন অনবরত। হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় পৌঁছে দেখি ডানদিকে নদীর পাড় প্রায় একশো ফুট খাড়া উঠে গেছে। মিস্টার সেন খাড়া পাড়ের বালিমাটি আর পাথরের দেয়ালটা দেখিয়ে বললেন, “হাবো, ওই ওপরে কী আছে বলো তো?”
হাবো বলল, “সাহেব, ওপরেই তো রয়েছে ঘাসজমি আর গুহাগুলো।”
“কিন্তু ওখানে তো কেউ একটা বিশেষ যায় না বললে, তাহলে এটা এল কী করে?” ডিজিটাল ক্যামেরার মনিটরে একটা ছবি দেখিয়ে হাবোকে বললেন মিস্টার সেন।
হবোর পাশ দিয়ে উঁকি মেরে ক্যামেরার স্ক্রিনে দেখি নদীর উঁচু পাড়ের কিনারায় একটা ছেলেদের মানিব্যাগ আধা পাড়ে আধা খাদের গায়ে ঝুলছে। মনে হয় কেউ নদীর বুকে ছুড়ে ফেলতে গেছিল, কিন্তু সেটা নদীর বুকে না পড়ে আটকে গেছে খাদের কিনারায়।
ছবিটা দেখে কুরমা গ্রামের মোড়ল হাবোর ভুরু কুঁচকে গেল। বলল, “এখানে তো কোনও মানুষ আসে বলে জানি না। কোনও বড়ো পাখিটাখি মুখে করে নিয়ে এসেছে হয়তো।”
‘হুম’ শব্দ করে মিস্টার সেন, “চলো, ঝরনার কাছে ফেরা যাক।” বলে ক্যামেরা গুটিয়ে ব্যাগে ভরে নিলেন। ঝরনার কাছে না পৌঁছনো অবধি একটা কথাও বললেন না মিস্টার সেন।
দড়ি ধরে ঝরনা বেয়ে সবাই ওপরে উঠলে মুখ খুললেন মিস্টার সেন। “দড়িটা খুলে ব্যাগে ভরে নাও, হাবো।”
তারপর গম্ভীর মুখে হাঁটা লাগালেন সামনের বড়ো পাথরের স্তূপের দিকে। ঘাসজমিতে পা রেখে মিস্টার সেন বললেন, “আমি ওই গুহাগুলোর কাছে যাব। আপনারা দু’জন এখানে অপেক্ষা করুন।”
আমি বললাম, “আপনাকে সাপের রাজ্যে একা ছেড়ে দেবার প্রশ্নই আসছে না। আমিও আপনার সঙ্গে যাব।”
আমার সঙ্গে সঙ্গে হাবো বলল, “আপনারা আমাদের অতিথি। আপনাদের একা ছেড়ে দিতে পারব না।”
মিস্টার সেন বললেন, “আমি শুধু ক্যামেরাগুলো ফিট করতে যাব গুহার সামনে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ফিরে আসব।” তারপর ওঁর পিঠের ব্যাগ নামিয়ে ব্যাগ থেকে বের করলেন একজোড়া হাঁটু পর্যন্ত উঁচু গামবুট। বললেন, “এই ঘাসজমিতে চলার মতো মাত্র একজোড়া জুতোই আছে। এখানে মোবাইলে সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে। বিপদ বুঝলে আপনাদের ফোন করব। তাছাড়া এটাও দেখে রাখুন।” ব্যাগ থেকে বের করলেন একটা রিভলভার। “আমার টিপ খুব ভালো। এটার লাইসেন্স আছে।”
আমাদের কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমার পিঠের ব্যাগ থেকে বাকি তিনটে ক্যামেরা বের করে নিজের ব্যাগে পুরে গামবুট পায়ে গলিয়ে হাঁটু সমান ঘাসের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চললেন মিস্টার সেন। খানিক পরেই দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলেন মিস্টার সেন।
প্রায় ঘন্টাখানেক কেটে গেছে। মিস্টার সেনের দেখা নেই। চিন্তা লাগছে। কাছের সবচাইতে উঁচু পাথরটার ওপর উঠে কপালের সামনে দু’হাত রেখে মিস্টার সেনের যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে হাবো। এই দু’দিনেই মিস্টার সেন ও আমাকে খুব আপন করে নিয়েছে সে।
একটা হালকা আওয়াজ পাচ্ছি। বুঝতে পারছি না আওয়াজটা কীসের। আমাদের সামনের ঘাসগুলো হালকা নড়ছে। এটা হাওয়া লেগে ঘাসের দোলা নয়। একটা লাইনের মতো সোজা হয়ে দুলুনি কেটে সামান্য জায়গা নিয়ে কিছু একটা এগিয়ে আসছে ঘাসের ভেতর দিয়ে। ময়াল সাপ নয়তো?
হাবোকে ডাকতে যাব, অমনি ঘাসের মধ্যে থেকে সাপের ফণার মতো আচমকা সারা গায়ে ঘাস-গোঁজা অবস্থায় আমাদের চমকে উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার সেন। জামাকাপড়ে গোঁজা ঘাসগুলো ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বললেন, “ঘাবড়াবেন না! আমার অনেকরকম ট্রেনিং নেওয়া আছে। হাবো, বলো তো গুহাগুলোর ওখান থেকে ঘাসজমি ছাড়া জঙ্গলের অন্যদিকে যাবার অন্য কোনঅ রাস্তা আছে কি না?”
হাবো বলল, “থাকতে পারে, আমার জানা নেই।”
মিস্টার সেন বললেন, “ঠিক জানো যে কেউ ওই গুহার ওখানে যায় না?”
“যাবে কী? ওটা তো সাপের আস্তানা!”
মিস্টার সেন ভুরু কুঁচকে খালি বললেন, “গণ্ডগোল। মোড়লমশাই, একটু চোখকান খোলা রাখো।”
তারপর দেখি পকেট থেকে কী একটা বের করে সেটাকে কাঁধের ব্যাগের একটা ছোটো বাক্সে ঢুকিয়ে রাখলেন। ওটা যে কী আমার আর সেটা জানতে চাইবার সাহস হল না।
“চলুন তাঁবুতে ফেরা যাক, খুব খিদে পেয়ে গ্যাছে।” মিস্টার সেন বললেন।
।।সাত।।
“আচ্ছা হাবো, ওই ঘাসজমিতে তোমাদের গরু-মোষ চড়াতে নিয়ে যাও না কেন? সাপের ভয়ে?”
গাছপালার ফাঁক দিয়ে ঝরাপাতার ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিস্টার সেনের প্রশ্নটা শুনে একটু অবাক হয়ে গেলাম। এতদিন ধরে ওঁকে যা বুঝেছি তাতে একই বিষয়ে প্রশ্ন একবারের বেশি দু’বার করার লোক উনি নন। হাবো তো গতকালই জানিয়েছিল যে ওই ঘাসজমিতে বড়ো বড়ো ময়াল সাপ আছে, আর সাপের ভয়েই ওরা কেউ ঘাস জমিতে যায় না। ঘাড় নেড়ে মিস্টার সেনের কথায় সায় দিল হাবো।
“তোমাদের গ্রামের লোক ছাড়া আর কেউ আসে এখানে নদীর ধারে?”
“সাহেব, গ্রামের লোক ছাড়া তো কেউ এইখানে আসে না। কাছের গ্রাম এখান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। ওই গ্রামের পাশ দিয়েও এই নদীটাই গেছে। এখন যদি কেউ হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে তা হলে আলাদা কথা, না হলে নদীতে যেহেতু জল খুব কম তাই একেকটা গ্রামের জন্য নদীর এলাকা ভাগ করা আছে। তবে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক বছরে এক-আধবার এসে ঘুরে যায়।”
“আচ্ছা হাবো, এই ঘাসজমি ছাড়া তোমাকে অন্যপথ ধরে যদি ওই গুহাগুলোর ওখানে যেতে বলি তাহলে তুমি যেতে পারবে?”
“জাতীয় সড়কের ওপর পুরনাপানি থেকে আমাদের গ্রামে আসার সময় রাতা নদীর ওপর যে কাঠের সাঁকোটা পার হয়ে এলেন, ওখান থেকে এই গুহা-পাহাড়ের অন্যদিকটা দেখা যায়। ওখান দিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাহাড়ে ওঠা যেতে পারে। কিন্তু ওই জঙ্গলটা তো কাঁটাগাছে ভর্তি!”
আমি বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে? মিস্টার সেন একটা ছোটো পাহাড়ে ওঠার রাস্তা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? আমরা তো এসেছি একটা অজানা প্রাণীর সন্ধানে!
তাঁবুতে পৌঁছে দেখি হাবোর স্ত্রী পার্বতী গতকালের মতো আমাদের তাঁবুর কাছে একটা গাছতলায় বসে আছে, সঙ্গে আরেকজন মহিলা। আমরা যেতেই একবালতি জল এগিয়ে দিল পার্বতী হাতমুখ ধোবার জন্য। তাঁবুর সামনে ব্যাগপত্র রেখে হাতমুখ ধুয়ে গাছের তলায় খেতে বসে গেলাম। আজকের মেনু ভাত, ডাল, আলু চখা, আলুভাজা আর কুমড়ো ফুলের বড়া। হাবো বলল, ওর বাড়ির কুমড়োগাছে ফুল ফুটেছে, তারই বড়া।
হাত ধুতে ধুতে দেখলাম, পার্বতীর সঙ্গের মহিলাটি হাবোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে কাপড়ে চোখ মুছছে। ব্যাপারটা যে মিস্টার সেনের চোখ এড়ায়নি খেতে বসে বুঝতে পারলাম।
আমার একদিকে মিস্টার সেন আরেকদিকে হাবো খেতে বসেছে। খাবার মুখে দিয়ে মিস্টার সেন বললেন, “হাবো, গ্রামে কিছু হয়েছে নাকি?”
“আবার একটা ছাগল হারিয়ে গেছে।” খেতে খেতে জবাব দিল হাবো। “এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ছাগল হারাল কয়েকদিনের মধ্যে। ওই বউটার ছোটো ছেলে ওই কাঠের ব্রিজের কাছে কাঁটাগাছের উলটোদিকের জঙ্গলে একটা ছোটো ঘাসজমিতে গরু আর ছাগলের পাল চরাতে নিয়ে গেছিল। ফেরার সময় দ্যাখে একটা ছাগল কম। বাড়িতে ফিরে বলতে ওর বাপও গেছিল ছাগল খুঁজতে, পায়নি।”
মিস্টার সেন কুমড়ো ফুলের বড়াতে এক কামড় বসিয়ে বললেন, “দেখো, লেপার্ডে নিয়ে গেছে হয়তো!”
হাবো বলল, “লেপার্ড এখানে আসে না। ওরা থাকে জঙ্গলের অনেক ভেতরে। তাছাড়া লেপার্ডে নিলে ছাগলটা চেঁচাত, রক্ত পড়ে থাকত। জঙ্গলের মানুষ, বাপ-ব্যাটা ঠিক বুঝতে পারত। ছাগলটা জঙ্গলে হারিয়ে গেছে হয়তো। কয়েকজনকে নিয়ে খুঁজতে যাব এখুনি। সন্ধে নামতে এখনও ঢের দেরি। গ্রামের কারঅ ক্ষতি হতে দিতে পারব না। ছাগলটাকে লেপার্ডে খেলে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কাছ থেকে টাকা পাওয়া যাবে।”
খাওয়া শেষ হতে হাবো চলে গেল ছাগল খুঁজতে। মিস্টার সেন হাবো যাওয়ার আগে বললেন, “কাল সকালবেলা হাবোর আসার দরকার নেই। কাল আমরা বিশ্রাম নেব, জঙ্গলে যাব না।”
মিস্টার সেন গিয়ে বসলেন ওঁর গাড়ির পেছনের অংশের চলমান গবেষণাগারে। আমি তাঁবুতে ঢুকে শুয়ে পড়লাম।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙতে তাড়াতাড়ি তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে দেখি প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে। আধো অন্ধকারে দেখি মিস্টার সেন কাছের টিলাটার সামনের ফাঁকা জমি দিয়ে হেঁটে আসছেন। আমার ঘুম এমনিতে পাতলা। কিন্তু কিছু টের পাইনি? ভদ্রলোক এত নিঃশব্দে চলাফেরা করেন?
“গুড ইভিনিং।” বললেন মিস্টার সেন।
“গুড ইভিনিং। দুঃখিত, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
“আরে না না, ঠিক আছে। দেখুন, ক্যামেরা ঠিকঠাক কাজ করছে।” হাতের মোবাইলটা দেখিয়ে বললেন উনি। “এখানে সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছিল না তাই টিলার মাথায় উঠেছিলাম।”
ওঁর মোবাইলের স্ক্রিনে দেখি একটা খরগোস। আশেপাশের গাছপালা দেখে বুঝলাম এটা শুকনো ঝরনার কাছে যে ক্যামেরাটা রাখা আছে সেই ক্যামেরার ছবি। তার মানে অজানা প্রাণীটা ওখানে এলে আমরা নিশ্চিন্তে তার খবর পাব। জয় মা তারা!
মিস্টার সেন বললেন, রাত নামলে ঘণ্টাদুয়েক পরে একবার বেরোবেন। তার মানে আবার সেই ওঁর আবিষ্কৃত উড়ুক্কু চাদর-যানে বসে ঘুরে বেড়াবেন! গতকাল ওই যানে চড়েছি ঠিকই, কিন্তু আমার খুব ভয় লাগছিল। মনে হচ্ছিল এই বোধহয় পড়ে যাব।
মিস্টার সেন বললেন, “একটু চা খাওয়া যাক, না হলে মাথাটা ঠিক খুলবে না।” বলে নিজেই স্টোভ জ্বালিয়ে দু’কাপ চা বানিয়ে ফেললেন। চায়ের হালকা গন্ধ কাপের ধোঁয়ার সঙ্গে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এই সেই বিশেষ চা যেটা উত্তরবঙ্গে ওঁদের পারিবারিক চা-বাগানের বিশেষ অংশে শুধুমাত্র ওঁর জন্যই তৈরি হয়।
এটাই প্রথম মিস্টার সেনের সঙ্গে আমার ঘুরতে আসা। এসেছি অজানা প্রাণীর সন্ধানে। জঙ্গলে ঘুরে বেড়াব, খুঁজে দেখব সত্যিই সেরকম কোন অদেখা প্রাণী আছে কি না, এতে ‘মাথা খোলার’ কী আছে বুঝতে পারছি না। লোকটাকে আমার ক্রমশই রহস্যজনক মনে হচ্ছে।
চা খেয়ে উনি আবার ঢুকে পড়লেন ওঁর চলমান গাড়ি গবেষণাগারে। ঘাসজমি থেকে ঘুরে আসার পর থেকে মনে হচ্ছে উনি কিছু একটা লুকোচ্ছেন। নাহ্, উনি গাড়ি থেকে নামলে জানতেই হবে উনি কী গোপন করছেন।
।।আট।।
ঠিক আটটার সময় ওঁর বড়ো ভ্যান গাড়ির পেছনের ঢাকা চলমান গবেষণাগার থেকে বেরিয়ে এলেন মিস্টার সেন। পিঠে ব্যাগ। হাতে গতকালের সেই নাইট ভিশন হেলমেট। একটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “যাবেন তো?”
আমি একটা নাইট ভিশন হেলমেট হাতে নিতে নিতে বললাম, “অবশ্যই যাব! কিন্তু সত্যি করে বলুন তো, আপনি কী লুকোচ্ছেন। অজানা প্রাণী কি সত্যিই কিছু আছে এখানে?”
চাপা হাসি হেসে মিস্টার সেন বললেন, “আমি নিজেই জানি না। তবে একটা কিছু গণ্ডগোল তো জঙ্গলে হচ্ছেই! আপনি তো লেখক। অনুমান করুন। ওই গুহার কাছ ছাড়া আমিও যা দেখছি আপনিও তাই দেখেছেন।”
চুপ করে গেলাম। মিস্টার সেনের লেখক বলে ঠেস দিয়ে কথা বলাটা ভালো লাগল না।
নাইট ভিশন হেলমেটটা মাথায় সাঁটতে সাঁটতে মিস্টার সেন বললেন, “আমরা জঙ্গলে ঢুকব না। রাতা নদীর ওপর কাঠের ব্রিজটার ওখানে যাব। তবে খানিকটা রাস্তা আমরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটব। গ্রামটা ছাড়িয়ে গেলে তারপর রাস্তা ধরে এগোব। এখানে পথ হারিয়ে ফেললেই মুশকিল। অযথা সময় নষ্ট হবে। হাবোকে সঙ্গে নিচ্ছি না এ কারণেই যে, আমি গ্রামের লোকেদের জানাতে চাই না যে আমরা ওই কাঠের ব্রিজের কাছে যাচ্ছি। আপনার কানদুটোকে সজাগ রাখবেন।”
তার মানে আজ আর উড়ন্ত চাদর-যানে নয়, হেঁটেই জঙ্গলে ঘুরবেন। একটা টিউব এগিয়ে দিলেন মিস্টার সেন। “হাতে-মুখে-ঘাড়ে আর শরীরের সব খোলা জায়গায় মেখে নিন। ওডোমস। না হলে জঙ্গলে মশায় ছিঁড়ে খাবে।”
গতকাল নাইট ভিশন চশমা পরে হেঁটে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। আজকে আর রাত-চশমা পরে খুব একটা হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে না।
মাটির রাস্তা ধরে মিস্টার সেন আমার আগে আগে হাঁটছেন। শুকনো মাটির রাস্তার ধুলোগুলো সবুজ আবিরের মতো লাগছে। নাহ্, মিস্টার সেনের সঙ্গে না এলে এই অভিজ্ঞতা হত না।
জঙ্গলে একটা খচরমচর আওয়াজ কানে এল। শুকনো ঝরাপাতার ওপর দিয়ে কিছু একটা আসছে। মিস্টার সেনও শুনেছিলেন আওয়াজটা। পিঠের ব্যাগ থেকে এক ঝটকায় বের করলেন রিভলবার। তারপর হাতের ইশারায় আমাকে দাঁড়াতে বললেন। আওয়াজটা থেমে গেল। কয়েক মুহূর্ত পরে জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল দুটো দাঁতাল শুয়োর। আমাদের গ্রাহ্যের মধ্যে না এনে রাস্তার মাটি খানিক দাঁত দিয়ে খুঁড়ে রাস্তা পার হয়ে ঢুকে গেল অন্যদিকের জঙ্গলে। মিস্টার সেন রিভলভারটা ব্যাগ ঢুকিয়ে বললেন, “চলুন, এগোনো যাক।”
কাঠের ব্রিজটার কাছে পৌঁছতে একটা হালকা শব্দ শুনতে পেলাম। মিস্টার সেনের জামা টেনে ধরলাম।
“কী হল?” ফিসফিস করে বললেন মিস্টার সেন।
“একটা আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন?”
“নাহ্।”
“ভালো করে শুনুন। একটা গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ!”
“না, কিছু শুনতে পারছি না। কিন্তু আপানার কান অনেক তীক্ষ্ণ। একটু দাঁড়ানো যাক।” বললেন মিস্টার সেন।
খানিক পর গাড়ির আওয়াজ স্পষ্ট হয়ে উঠল। মিস্টার সেন বললেন, “ঠিক শুনেছেন, একটা গাড়ি আসছে। চলুন, আমরা গাছের আড়ালে লুকোই।”
একটা গাড়ি ব্রিজ পার হয়ে আমাদের খানিক আগে এসে থামল। গাড়িটার হেড লাইট জ্বলছে না। হয় খারাপ, অথবা ইচ্ছে করে লাইট বন্ধ করে এসেছে গাড়িটা। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নাইট ভিশনের চাপ চাপ সবজে কালো আলোয় দেখি মিস্টার সেন মাটিতে শুয়ে কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে এগিয়ে রাস্তার ধারের একটা ছোটো ঝোপের ফাঁক দিয়ে মাথাটা একটু বের করে স্থির হয়ে রইলেন।
কতগুলো পোকা একটানা শব্দ করে চলেছে। মশার গুনগুনানিতে বুঝতে পারছি ওডোমস না মাখলে কী হত! নাহ্, মিস্টার সেনের দূরদর্শিতার তারিফ করতে হয়।
দরজা খোলা ও বন্ধ করার আওয়াজ পেলাম। কতগুলো লোক নামল। এত রাতে গাড়ির আলো বন্ধ করে এই নির্জন জঙ্গলে কী করছে গাড়ির লোকেরা? গাড়ি খারাপ হয়ে যায়নি তো? মিস্টার সেন লুকোতেই বা বললেন কেন? এত ভয় পাবার কী আছে? মিস্টার সেনের কাছে তো রিভলভার আছে। লোকগুলোকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই তো হত। দুধ আর শুকনো কাঠ কিনতে তো পুরনাপানি থেকে বিকেলে আসে গাড়ি। তবে এরা কারা? নাহ্, মিস্টার সেনের কথামতো চুপ করে লুকিয়ে থাকাই ভালো।
গাড়ির দরজা বন্ধ করার শব্দ পেলাম। কতগুলো পায়ের শব্দ টেনে টেনে এগোচ্ছে আমাদের দিকে। কয়েকটা টর্চের আলো গাছপালার ফাঁক দিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। মিস্টার সেন পিছিয়ে আসছেন আমার দিকে। আমার কাছে এসে বললেন, “একদম চুপ করে মাটিতে শুয়ে থাকুন। আমি না আসা পর্যন্ত এখান থেকে নড়বেন না।”
রাত্তিরে একা জঙ্গলে শুয়ে থাকতে হবে শুনে সত্যি বলছি ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল। কোনওরকমে বললাম, “সা—সা-সাপ এলে!”
“নড়াচড়া না করলে কোনও ভয় নেই। সাপ-ভালুক কিচ্ছু করবে না। আর হাবোর কাছেই তো শুনেছেন, এখানে লেপার্ড নেই। নিন, আমার রিভলভারটা আপানার কাছে রাখুন। মনে জোর পাবেন।”
আমার হাতে রিভলভার গুঁজে দিয়ে মিস্টার সেন হামাগুড়ি দিয়ে নিঃশব্দে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলেন। রিভলভার হাতে নিয়ে আমার হাত কাঁপতে লাগল। গুলি চালানো তো দূরের কথা। জীবনে কোনওদিন বন্দুক-পিস্তল হাতে নিইনি। কী করে গুলি চালাতে হয় তাও জানি না।
আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে আছি। একটা পোকা ঘাড়ের কাছে কামড়েছে। অসম্ভব চুলকোচ্ছে জায়গাটা। গাছপালার ফাঁক দিয়ে কালচে আকাশের গায়ে জ্বলজ্বল করছে বড়ো চাঁদ। আর দু’দিন পর পূর্ণিমা। সড়সড় করে বাঁ-পাশ থেকে আওয়াজ হল একটা। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একটা গিরগিটি পিঁপড়ে মুখে ছুটে গাছে উঠছে। রাত-চশমায় দেখি, কালচে সবুজ বিশাল পিঁপড়ের ঢিপি সামনে। সর্বনাশ! পিঁপড়ের দল যদি আমাকে আক্রমণ করে, তবে!
কতক্ষণ সময় গেছে জানি না। শুয়ে বোধহয় একটু ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। গাড়ির দরজা বন্ধ করার আওয়াজ কানে এল। ইঞ্জিন চালু করে গাড়িটা চলে গেল। উঠে বসলাম। ঘড়িতে দেখি সাড়ে বারোটা। তার মানে আমরা তাঁবু থেকে রওনা দেবার পর সাড়ে চার ঘণ্টা কেটে গেছে। আর শুয়ে বসে থাকা যাচ্ছে না। আস্তে আস্তে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এলাম। দেখি, মিস্টার সেন আমার দিকে আসছেন। বললাম, “কী হল? ওরা কারা ছিল?”
“গণ্ডগোল। শেষ ক্যামেরাটা গাছে বেঁধে দিয়েছি। এখানে দিব্যি মোবাইলে সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে। চলুন, ফেরা যাক।”
মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন মিস্টার সেন। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না!
ঘণ্টা খানেক পর তাঁবুতে পৌঁছে মিস্টার সেন বললেন, “ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল আমাকে একবার গাড়ি নিয়ে পুরনাপানি শহরে যেতে হবে। আপনি কাল সারাদিন ধরে গ্রামের লোকেদের আর জঙ্গলের ছবি তুলে বেড়াবেন। শুধু কাঠের ব্রিজের কাছে যাবেন না। গ্রামের লোকেরা যেন জানে আমরা অজানা জন্তুর খোঁজে আর জঙ্গলের ছবি তুলতে এসেছি। বেশি করে জন্তু-জানোয়ার নিয়ে আলোচনা করবেন।”
।।নয়।।
ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়ে গেল। দেখি, মিস্টার সেন তাঁবুতে নেই। মশারির নেট লাগানো তাঁবুর দরজাটা বন্ধ। সাতটা বাজে। ছিঃ ছিঃ, কী কাণ্ড, আমি এত ঘুমকাতুরে হয়ে গেছি! তাড়াতাড়ি তাঁবুর বাইরে এসে দেখি, মিস্টার সেন আসছেন সামনের টিলার দিক থেকে আর গ্রামের দিক থেকে একবালতি জল হাতে আসছে হাবোর বউ পার্বতী। দু’জনে প্রায় একই সময়ে এসে পৌঁছল তাঁবুর সামনে। পার্বতী এসেই খবর দিল, বিকেলবেলা যে দুধের গাড়িটা গ্রাম থেকে দুধ আর কাঠ সংগ্রহ করতে আসে তার ড্রাইভার জানিয়েছে গতকাল দুপুরবেলায় পাকা সড়কে ডাকাতরা একটা পুলিশের গাড়ি লুট করে অনেক অস্ত্রশস্ত্র আর গুলি নিয়ে পালিয়েছে।
পার্বতী আরও জানাল, গতকাল সন্ধে নেমে যাওয়ায় হাবো আর দলবল নিয়ে ছাগল খুঁজতে যেতে পারেনি। তাই আজ ভোরবেলায় কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে কাঠের ব্রিজের কাছের ঘাসজমির জঙ্গলে গেছে ছাগল খুঁজতে।
মিস্টার সেন ডাকাতি বা ছাগল খোঁজা নিয়ে কোনও উৎসাহ দেখালেন না। উনি ওঁর স্মার্ট ফোনে কয়েকটা হরিণ আর বুনো শুয়োরের ছবি দেখালেন। ঝরনার কাছের ক্যামেরাটা থেকে এই ছবিগুলো এসেছে। আমি বললাম, “ওই গুহার কাছের ক্যামেরাগুলো থেকে কোনও ছবি আসেনি?”
মিস্টার সেন বললেন, “এসেছে, কিন্তু ছবিটা বোঝা যাচ্ছে না। দেখুন।”
দেখি একটা বড়ো ঝোপের পেছন থেকে একটা সাপের মতো সরু লম্বা জিভওয়ালা ছুঁচলো মুখ বেরিয়ে আছে। ছবিটা খুব অস্পষ্ট। তার মানে সত্যিই এই জঙ্গলে অজানা প্রাণী আছে?
ব্রেকফাস্ট তৈরি হয়ে গেছিল। রুটি, আলুভাজা আর অমলেট। খাওয়া হতে মিস্টার সেন পার্বতীকে বললেন, “আমি একবার পুরনাপানি শহরে ফরেস্ট অফিসে যাব। এই সাহেব থাকবেন। গ্রামের কেউ কি ওঁকে জঙ্গল ঘোরাতে নিয়ে যেতে পারবে?”
পার্বতী বলল, কাল রভি নামের যে ছেলেটার কাছ থেকে ছাগল হারিয়ে গেছিল সে বাড়িতেই আছে। ও আমাকে জঙ্গল ঘোরাতে নিয়ে যেতে পারবে।
মিস্টার সেন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
আমার মন পড়ে আছে ঘাসজমির কাছের গুহাগুলোর ওখানে। কীসের ছবি ওটা? নতুন কোনও জানোয়ারের সন্ধান পাওয়া গেলে তো আমরা বিখ্যাত হয়ে যাব! মিস্টার সেন অজানা জন্তুর ছবি দেখেও তার খোঁজে না গিয়ে শহরে গেলেন কেন? উনি কি কিছু লুকোচ্ছেন? কিন্তু যদি তাই হয়, কেন? যাব নাকি গুহাগুলোর ওখানে?
সারাদিন ধরে গ্রামের লোকেদের ছবি তুললাম। রভির সঙ্গে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালাম। দুপুরে হাবোর বাড়িতে ভাত, ডাল আর ডিমের ঝোল খেলাম। সময় আর কাটছে না কিছুতেই।
হাবোরা ফিরে এসেছে। ছাগলটাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। গ্রামের লোক চিন্তায় পড়ে গেছে। এটা নিশ্চয়ই ওই অজানা জানোয়ারের কীর্তি। ওই ছাগলটাকে ধরে নিয়ে গেছে।
মিস্টার সেন ফিরলেন সন্ধের একটু আগে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি ভীষণ ক্লান্ত। গাড়ি থেকে নেমেই খুব ঘুম পাচ্ছে বলে তাঁবুতে ঢুকে শুয়ে পড়লেন।
।।দশ।।
স্টোভ জ্বালিয়ে চা বানালাম অনেকটা। এক কাপ নিজে নিয়ে বাকিটা ফ্লাস্কে ভরে রাখলাম। আমার কাপের চা শেষ হবার আগেই মিস্টার সেন বেরিয়ে এলেন তাঁবু থেকে। বললাম, “এই যে বললেন খুব ঘুম পেয়েছে!”
“ঘুমোলাম তো। খানিক গভীর নিশ্চিন্ত ঘুম যথেষ্ট।”
“শহরে গিয়ে কাজ হল?”
“অনেক। পুরনাপানি শহরের কাছে এখানকার প্রাচীন রাজাদের এক আধুনিক এস্টেট আছে। আলাপ করে এলাম রাজার বংশধরদের সঙ্গে। এস্টেটের একটা বিশাল হলঘর ভর্তি স্টাফ করা বাঘ, বুনো মোষ আর ভালুকের মাথাসহ চামড়া। বিশাল লম্বা পাইথনের চামড়া আছে দুটো। হাতির পায়ের বসার আসন। চারটে বিশাল হাতির দাঁত। প্রতিটা বাঘই মানুষখেকো ছিল। হাতিগুলোও মানুষ মেরেছিল। এছাড়াও বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য পাখি ও সরীসৃপের স্টাফ করা মৃতদেহ আছে এস্টেটের মধ্যে। শিকারের ইতিহাস লেখা আছে প্রতিটা ট্রফির পাশে। বিশাল মিউজিয়াম একটা। শুনলাম, এখানকার রাজারা অকারণে শিকার করা পছন্দ করতেন না। ওঁরা ছিলেন সংরক্ষণের পক্ষে। আশা করি আমরা দুয়েকদিনের মধ্যে ফিরে যাব।”
“কিন্তু আমরা কি অজানা প্রাণীর খোঁজ করব না?” আমি বললাম। “গ্রামের লোক তো ধরে নিয়েছে গতকাল যে ছাগলটা হারিয়েছে সেটা ওই অজানা জানোয়ার ধরে খেয়েছে। জঙ্গলে যেতে ওরা ভয় পাচ্ছে।”
“একটু ধৈর্য ধরুন, অজানা প্রাণীর খোঁজ আমরা বের করবই। আজও একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়েছে পুরনাপানি শহরে।”
“চায়ের গন্ধ পাচ্ছি যেন!” মিস্টার সেন বললেন।
তাড়াতাড়ি করে ফ্লাস্ক থেকে একটা কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিলাম মিস্টার সেনকে।
চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার সেন। “চলুন, একবার হাবোর বাড়ি যেতে হবে। সাতটা বাজে, আশা করি ঘুমিয়ে পড়েনি ওরা।”
গাড়ি থেকে তিনটে প্যাকেট নামিয়ে নিয়ে এলেন মিস্টার সেন। একটা প্যাকেটের ওপর বাটা কোম্পানির ছাপ মারা আর দুটোর ওপর লেখা ‘পুরনাপানি ড্রেসেস’।
হাবো আর পার্বতী উঠোনে একটা মাদুর পেতে বসে চাঁদের আলোয় গল্প করছিল। আমাদের দেখে উঠে দাঁড়াল। মিস্টার সেন বললেন, “সারাদিন তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়নি, ভাবলাম তোমাদের সঙ্গে একটু গল্প করে যাই।” প্যাকেটগুলো এগিয়ে দিয়ে বললেন, “শহরে গেছিলাম তাই নিয়ে এলাম তোমাদের জন্য।”
হাবোর স্ত্রী পার্বতী তাড়াতাড়ি করে একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে নিয়ে এল। বাটা ছাপ মারা প্যাকেট খুলতে বেরোল একজোড়া ফিতেওয়ালা পুরু সোলের স্নিকার আর একজোড়া বাহারি মেয়েদের রাবারের জুতো। মিস্টার সেন বললেন, “পরে দেখো, মাপ ঠিক আছে কি না!”
জুতো হাতে দু’জনেই কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। এতদিন হাবো বা পার্বতীর কারও পায়েই জুতো দেখিনি। এমনকি গ্রামের কারও পায়েও জুতো দেখিনি। জামাকাপড়ের প্যাকেট খুলতে বেরোল দুটো শাড়ি আর দুটো প্যান্ট-শার্ট।
মিস্টার সেন ওদেরকে কথা বলার কোনও সুযোগ না দিয়ে হাবোকে বললেন, “আজ রাতে একবার জঙ্গলে যাব ওই অজানা প্রাণীর খোঁজে। তুমি আসবে নাকি আমাদের সঙ্গে?”
হাবো বলল, “নিশ্চয়ই যাব, সাহেব। ওই জানোয়ারটাই ছাগলটাকে খেয়েছে। ওটাকে না ধরলে আরও গরু-ছাগল খাবে ওটা। তারপর হয়তো গ্রামেও হামলা চালাবে।”
মিস্টার সেন বললেন, “ঠিক আছে হাবো, আমরা চললাম। তুমি আর ঘণ্টা খানেক বাদে আমাদের তাঁবুতে এসো। কিন্তু এই জুতো আর জামা-প্যান্ট পরে আসবে।”
হাবোর বাড়ি থেকে তাঁবুর দিকে এগোতে এগোতে মিস্টার সেন বললেন, “আমি একবার টিলার ওপরে উঠব। কোনও ছবি উঠল কি না দেখতে হবে। আপনি বরং খানিক চা বানান।”
চাঁদের আলোয় মিস্টার সেন একা এগোতে লাগলেন টিলার দিকে। আমি স্টোভ জ্বালিয়ে চা বানাতে বসে গেলাম।
মিস্টার সেন টিলা থেকে নেমে আসার আগেই হাবো এসে গেল। হাতে একটা লম্বা লাঠি। খালি পায়ে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জির জায়গায় হাবোকে প্যান্ট-শার্ট আর জুতো পরে অন্যরকম লাগছে। মিস্টার সেন মনস্তত্ত্ব খুব ভালো বোঝেন।
মিস্টার সেন টিলা থেকে নেমে এসে গুনগুন করে গাওয়া গান থামিয়ে বললেন, “চা রেডি! বাহ্ বাহ্। চলুন, কিছু বিস্কুট দিয়ে চা খাওয়া যাক। এরপরে কখন খাবার জুটবে ঠিক নেই।”
মিস্টার সেনকে এ ক’দিনের মধ্যে এখনকার মতো রিলাক্সড আগে দেখিনি। তার মানে ভালো খবর আছে।
“কিছু ছবি এল?”
“ওহ্ ইয়েস!”
“অজানা জন্তুর খোঁজ পেলেন?”
“ওহ্ ইয়েস!”
“জন্তুটা কী? ছবি দেখাবেন? আমাদের নাম নিশ্চয়ই কাগজে বেরোবে?”
হেসে ফেললেন মিস্টার সেন। “আমি তো কাগজে নাম তুলতে চাই না। আপনি গল্পটা ঠিকমতো লিখতে পারলে আপনার খ্যাতি নিশ্চয়ই হবে। ছবিটা দেখাব তবে আজ নয়, কাল। চলুন, চা-বিস্কুট খেয়ে বেরনো যাক।”
।।এগারো।।
চা খাওয়া হতেই মিস্টার সেন গাড়ি থেকে নাইট ভিশন চশমা নয়, নিয়ে এলেন দুটো বড়ো টর্চ লাইট। একটা আমার, আর একটা হাবোর হাতে দিয়ে বললেন, “আমি না বলা পর্যন্ত ভুলেও আলো জ্বালাবেন না।”
তারপর আমাকে অবাক করে নদীর পথ না ধরে চললেন রাস্তার দিকে।
“আমরা কি কাঠের ব্রিজের দিকে যাচ্ছি?”
“ইয়েস স্যার, একদম কথা বলবেন না। রাস্তার ধার ঘেঁষে গাছের ছায়া দিয়ে চলুন। মনে রাখবেন, আকাশে চাঁদ আছে। রাস্তার মাঝ দিয়ে চললে আমাদের অনেকদূর থেকে দেখা যাবে।”
“গাছের আড়াল দিয়ে চললেই কি আমরা জন্তুটার থেকে লুকিয়ে থাকতে পারব? জন্তুটা যদি হিংস্র হয়? আমাদের সঙ্গে তো কোনও অস্ত্র নেই! ওহ্, আপনার কাছে একটা রিভলভার আছে!”
“আশা করি বুনো জন্তুর থেকেও সাংঘাতিক কিছু দেখতে পাবেন। অজানা জন্তু কাছে আসলে হাবোর হাতের লাঠিই ওকে তাড়াতে পারবে। ভয় পাচ্ছ না তো হাবো?” বললেন মিস্টার সেন।
হাবো যে মুচকি হাসল সেটা অন্ধকারেও টের পেলাম।
“কিন্তু জন্তুটা কী একটু আভাস দেবেন কি?”
“ওটা একটা ছোটোখাটো ড্রাগন।” চাপা হাসি হেসে উঠলেন মিস্টার সেন।
ঘণ্টা খানেক হাঁটার পর চাঁদের আলোয় ব্রিজটা দেখা গেল। মিস্টার সেন বললেন, “জঙ্গলে ঢুকে পড়ে গাছের আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ুন। আর যতক্ষণ না বলছি আলো জ্বালাবেন না প্লিজ।”
মশায় ছেঁকে ধরছে। আওয়াজ না করে যতটা পারি তাড়াচ্ছি। আমার কীরকম যেন মনে হচ্ছে, অনেক লোকের নিঃশ্বাস নেবার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মিস্টার সেন কাছে নেই। হাবোও খানিক দূরে একটা গাছে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাহ্, ব্যাপারটা মিস্টার সেনকে জানানো দরকার, উনি আমার শ্রবণশক্তির ওপর অনেক ভরসা করেন। কানে এল একটা গাড়ির আওয়াজ। ঠিক কালকের মতো। সেই একই সময়। ব্রিজের ওপর দিয়ে গাড়িটা এগিয়ে আসছে। ব্রিজের কাঠের ঘটঘটানি শেষ হতেই ব্রেক করার হালকা শব্দ। গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেছে। দরজা খোলার ও বন্ধ করার শব্দ। কয়েক জোড়া পায়ের মাটির রাস্তার ওপর পা ঘষটে চলার আওয়াজ। কিছু একটা টেনে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটা হুইসেল বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো টর্চ জ্বলে উঠল। ভেসে এল একটা আওয়াজ, “হ্যান্ডস আপ।” তারপরই গাড়িতে স্টার্ট দেবার আওয়াজ।
আর গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। রাস্তার ওপর এসে দাঁড়ালাম। ইতিউতি জ্বলতে থাকা টর্চের আলোয় দেখি অনেকগুলো পুলিশের পোশাক পরা লোক বন্দুক উঁচিয়ে তিনটে লোককে ঘিরে রেখেছে; তাদের সামনে পড়ে রয়েছে একটা বড়ো বাক্স। একটা গাড়ি অন্ধকারে ব্যাক গিয়ারে উঠে যাচ্ছে ব্রিজের ওপর। কেউ একজন গুলি ছুড়ল। প্রচণ্ড শব্দ করে গাড়ির টায়ার ফেটে ব্রিজের কাঠের রেলিং ভেঙে নিয়ন্ত্রণ হারানো গাড়িটা পড়ল নদীর চরায়। বিস্ফোরণ হল একটা, আর আগুনের শিখা দেখা দিল ব্রিজের নিচে। কেউ একটা চিৎকার করে কিছু বলতে কতগুলো পুলিশ ছুটল নদীর দিকে।
ইতিমধ্যে আমার পাশে নিঃশব্দে লাঠি হাতে এসে দাঁড়িয়েছে হাবো। এত লোকের ভিড়ে মিস্টার সেনকে খুঁজে পাচ্ছি না। পুলিশের লোকেরা গাড়ি থেকে নামা তিনটে লোককে হাত-পা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাস্তার মাঝে বসিয়ে দিল। টর্চের আলো জ্বেলে কয়েকজন মিলে গাড়িটা থেকে নামানো বিশাল ট্রাঙ্কটা খুলছে। একজন চেঁচিয়ে উঠল, “এসপি সাব, তাড়াতাড়ি আসুন। ট্রাঙ্কভর্তি পুরনাপানি ব্রাঞ্চের কাগজের সিল লাগানো টাকার বাণ্ডিল!”
একজন জিনসের প্যান্ট ও টি-শার্ট পরা লোক এগিয়ে এসে বললেন, “ট্রাঙ্কটা বন্ধ করে দিন, দু’জন পাহারায় থাক।” তারপর চিৎকার করে বললেন, “মিস্টার সেন, আপনি সামনে আসবেন কি?”
খানিক দূরের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলেন মিস্টার সেন। মোবাইলের টর্চের আলো ফেললেন বাঁ-হাতের ওপর। একটা কালচে সোনালি শক্ত আঁশের মতো কিছু ওঁর হাতের তালুতে রাখা।
“এটা কী জানেন, এসপি সাহেব? এইমাত্র কুড়িয়ে পেলাম। আর্মাডিলোর আঁশ। শক্ত আঁশে ঢাকা পিঁপড়ে খেকো আর্মাডিলো একটু বিপদের আশঙ্কা করলে নিজেকে গুটিয়ে নেয় শরীরের আঁশের বর্মের আড়ালে। এই ডাকাতগুলো জঙ্গলের মাঝে কোনও বিপদের আশঙ্কা করতে পারেনি। তাই ওদের ধরতে পারলেন। কিন্তু আপানার কাজ এখনও শেষ হয়নি। আসুন আমার সঙ্গে।”
কাঁটাগাছের জঙ্গলের ধারে গিয়ে কয়েকটা গাছ-পাতা সরাতেই দেখা গেল কাঁটাগাছের ঝোপ সুড়ঙ্গের মতো করে কাটা। দুটো মানুষ পাশাপাশি অনায়াসে কাঁটাগাছ এড়িয়ে হেঁটে যেতে পারে।
“আমার ধারণা, এই কাঁটাঝোপের মাঝের এই সুড়ঙ্গমতো পথটা দূরের ওই পাহাড়ের গুহা পর্যন্ত চলে গেছে। কয়েকজনকে এখনই পাঠিয়ে দিন এই পথ ধরে, পেয়ে যেতে পারেন হাইওয়েতে ডাকাতি হওয়া পুলিশের অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য জিনিস।” তারপর হাবোকে দেখিয়ে বললেন, “সঙ্গে নিতে পারেন জঙ্গলের এই মানুষটিকে।”
ইতিমধ্যে ব্রিজ টপকে নদীতে পড়ে আগুন ধরে যাওয়া গাড়ির ড্রাইভারকে তুলে নিয়ে এসেছিল কয়েকজন পুলিশের লোক। প্রায় ঝলসে যাওয়া লোকটাকে দেখে হাবো বলে উঠল, “আরে, এই লোকটা তো মাঝে মাঝে দুধের গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে আমাদের গ্রামে আসে দুধ নিতে!”
এসপি সাহেব বললেন, “আপনাকে কী বলব বুঝে উঠতে পারছি না, মিস্টার সেন। কিন্তু কী করে বুঝলেন যে ডাকাতরা ওই গুহায় ঘাঁটি গেড়েছে? আর আজ রাতে যে ওরা এখানে আসবে সেটাই বা কী করে আন্দাজ করলেন?”
“আপানারা আপনাদের কাজ সেরে কাল একবার সকাল দশটায় কুরমা গ্রামে আসুন, সব বলব।”
আমি আর থাকতে পারলাম না। বলে উঠলাম, “অজানা জন্তুর কী হবে?”
হাসলেন মিস্টার সেন। “সব কাল জানাব।”
।।বারো।।
আমাদের তাঁবুর কাছে টিলার সামনের ফাঁকা জায়গাটায়, যেখানে পরবের সময় গ্রামের মানুষ জমায়েত হয়ে নাচগান করেন, সেখানে উত্তেজিত গ্রামের সব মানুষ এসে ভিড় করেছে সেই ভোর থেকে। গ্রামের কাছে ডাকাত ধরা পড়েছে। নিপাট ভালো মানুষদের গ্রামে এ এক রোমাঞ্চকর ঘটনা। উঁচুস্তরের সরকারি বাবুরা আসবেন তাই গ্রামের মোড়ল হাবোর ব্যস্ততার শেষ নেই। নতুন জামাকাপড় পরে হাবো আর পার্বতী জমায়েতের তদারকি করে চলেছে। খাবার জল, পরিষ্কার করে মাজা গ্লাস আর একটা প্লেটে কিছু বাতাসা রাখা আছে একটা ভাঙাচোরা টেবিলের ওপর। গ্রামে চায়ের চল নেই সেরকম। সকালবেলায় পার্বতী আমাদের খাবার বানিয়ে দিতে ছেয়েছিল, কিন্তু মিস্টার সেন বানাতে না করে দিলেন। আমাকে তাঁবুতে রেখে মিস্টার সেন একাই ঘাসজমির ওখান থেকে ক্যামেরাগুলো খুলে নিয়ে এসেছেন।
ঠিক দশটার সময় পরপর অনেকগুলো গাড়ি এসে ঢুকল গ্রামে। এক দঙ্গল লোক নামলেন গাড়ি থেকে। কয়েকজনের হাতে ক্যামেরা আর কাগজের টুকরো দেখে বুঝলাম, এরা সাংবাদিক। ভিডিও ক্যামেরা কাঁধে উপস্থিত এক টিভি সাংবাদিক গাড়ি থেকে নেমেই ছবি তুলতে শুরু করে দিয়েছে। হাবো পথ দেখিয়ে সবাইকে নিয়ে আসছে জমায়েতের কাছে কাঠের ডাল দিয়ে তৈরি করা বেঞ্চগুলোর দিকে।
এসপি ভদ্রলোক আজ পুরোদস্তুর পুলিশের পোশাকে এসেছেন। মিস্টার সেন ও আমি ভিড় থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন ভদ্রলোক। ওঁর পেছন পেছন আসতে থাকা সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন। আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন ওঁর সঙ্গে আসা সবার সঙ্গে। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, এসডিও, বিডিও, পুরনাপানির ডাকাতি হওয়া ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, ভালুয়ার জঙ্গলের রেঞ্জার অনেকেই এসেছেন ওঁর সঙ্গে।
গাছের গুঁড়ি আর ডাল দিয়ে বানানো বেঞ্চে সবার বসার জায়গা হল না। দাঁড়িয়ে রইলেন অনেকে। বলতে শুরু করলেন এসপি সাহেব।
“আমাদের প্রশাসন মিস্টার সেনের কাছে কৃতজ্ঞ ডাকাতদের ধরিয়ে দেবার জন্য। গতকালই মিস্টার সেনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। উনি একজন বৈজ্ঞানিক। কিন্তু আমরা পুলিশ প্রশাসন যখন ডাকাতদের কোনও ক্লু খুঁজে পাচ্ছি না তখন উনি দুঁদে গোয়েন্দার মতো স্রেফ আমাদের ডেকে নিয়ে এসে ডাকাতদের আমাদের হাতে তুলে দিলেন। গতকাল রাতে কাঁটাঝোপের মাঝে ওঁর দেখানো রাস্তা ধরে গিয়ে আমরা পাহাড়ের মাঝের গুহা থেকে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র ও জঙ্গলের মাঝের হাইওয়েতে ডাকাতি হওয়া জিনিসপত্র উদ্ধার করি। মিস্টার সেনকে প্রসাশনের তরফ থেকে পুরষ্কার দেওয়া হবে।” তারপর খানিক থেমে বললেন, “মিস্টার সেন, আমরা আপনার কাছে ডাকাতদের কী করে ধরলেন সেই কথা শুনতে এসেছি।”
কাগজের লোকেরা সমানে ছবি তুলে চলেছে। ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে টিভির সাংবাদিক একদম মিস্টার সেনের মুখের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।
“সরকারি অফিসের লোকেদের অনুরোধ, মানুষের কথা ভালো করে শুনুন। এই হাবো ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে একদিন জানাতে গেছিল যে নদীর ধারে একটা হারিয়ে যাওয়া ছাগল খুঁজতে গিয়ে অজানা প্রাণীর পায়ের ছাপ দেখেছে। দফতরের লোকেরা ওর কথা ভালো করে না শুনেই ওকে হাঁকিয়ে দিয়েছিল। হাবো যখন ওই অফিসে যায় তখন একজন সাংবাদিক ওখানে ছিলেন। তিনি খরবটা ছাপিয়ে দিয়েছিলেন কাগজে। কোনও কারনে খবরটা আমার চোখে পড়ে গেছিল।” বলে একটু থামলেন মিস্টার সেন।
“এই গতকাল আমি এসপি সাহবের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম, আমাকে দেখাই করতে দেওয়া হচ্ছিল না। তারপর আমার এক পরিচিত পুলিশ অফিসারকে দিয়ে ফোন করিয়ে দেখা করি।”
“সরি, মিস্টার সেন। গতকাল ব্যাঙ্ক ডাকাতির ঘটনাটা হবার পর থেকে…”
“এসপি সাহেব, আপনাকে কোনও দোষ দিচ্ছি না। আপনি সিস্টেমের শিকার। ধরুন, আমার জায়গায় যদি অন্য কেউ ডাকাতদের কোনও খবর দিতে আসত, সে তো আপনার কাছে পৌঁছতেই পারত না!” বললেন মিস্টার সেন।
“জন্তু-জানোয়ারের ছবি তোলার শখ আমার সেই ছোটোবেলা থেকে। খবরের কাগজে অজানা জন্তুর কথা পড়ার পরে বন দফতরে খোঁজ নিয়ে হাবোর ফোন নাম্বার জোগাড় করে যোগাযোগ করে আমি এই কুরমা গ্রামে আসি আমার এক লেখক বন্ধুটিকে নিয়ে।” এ পর্যন্ত বলে আমাকে ইশারায় দেখালেন মিস্টার সেন। আমার অনেকগুলো ছবি উঠল।
“অজানা জন্তুর খোঁজ পেতে জঙ্গল আর শুকনো নদীর সরু জলের স্রোত ধরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে অজানা জন্তুটি আসতে পারে এরকম সব সম্ভাব্য জায়গায় কয়েকটা হান্টিং ক্যামেরা লাগাচ্ছিলাম আমরা। এসময় নদীর খাড়াই পাড়ে একটা মানিব্যাগের ছবি ওঠে আমার ক্যামেরায়।” এ পর্যন্ত বলে হাতের ইশারায় খাবার জল চাইলেন মিস্টার সেন।
পার্বতী এক গ্লাস জল নিয়ে গেল মিস্টার সেনের কাছে। জল খাওয়া হতে মিস্টার সেন বললেন, “একটু অন্য কথা বলি। এই গ্রামে কোনও স্কুল নেই। এমনকি কাছের পাঁচ কিলোমিটার দূরের গ্রামেও কোনও স্কুল নেই। প্রশাসনের অনেক আধিকারিক এখানে আছেন। এই গ্রামে একটা স্কুলের বন্দোবস্ত করা যায় কি না যদি একটু দেখেন। আমি স্কুল বিল্ডিং তৈরির জন্য এক লক্ষ টাকা দেব।”
সমবেত গ্রামের লোকেরা একযোগে দাঁড়িয়ে উঠে চিৎকার করে উঠল, “স্কুল চাই, স্কুল চাই।”
পার্বতী এগিয়ে গিয়ে মিস্টার সেনের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।
ডিএম সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে হাতের ইশারায় চুপ করে বসতে বললেন। বললেন, “স্কুল হবে মিস্টার সেন, আপনি প্লিজ ডাকাত কী করে ধরলেন সেটা বলুন।”
মিস্টার সেন মুচকি হেসে বললেন, “আমি তো ডাকাত ধরিনি! ধরেছে তো আপনাদের পুলিশ বিভাগ। আমি হেল্প করছি মাত্র।
“যাই হোক, নদীর যে খাদের ধারে মানিব্যাগটা ঝুলছিল তার পাশেই আছে পাইথন বোঝাই ঘাসজমি। ওই ঘাসজমির শেষে এক পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে অনেক গুহা। হাবো জানায় যে ওই ঘাসজমিতে গ্রামের কেউ যায় না সাপের ভয়ে। তা হলে মানিব্যাগটা ওই ঘাসজমির প্রান্তে এল কী করে?
“হাবো বলেছিল, কোনও বড়ো পাখিতে মুখে করে এনে ফেলতে পারে। অসম্ভব কিছু নয়। আমি ঠিক করলাম, ওই গুহাগুলোর কাছে গিয়ে দেখতে হবে। সাপভর্তি ঘাসজমিতে সবাইকে নিয়ে বিপদে ফেলতে চাইনি। তাই কায়দা করে ক্যামেরা বসাতে এবং সবার উপযুক্ত জুতো না থাকার দোহাই দিয়ে আমি একাই যাই পাহাড়তলির গুহাগুলোর কাছে। ওখানেই নজরে আসে বিড়ির খালি প্যাকেট। রান্না করা মাংসের হাড়। আমি গুহার ওখানে মানুষের উপস্থিতি নিয়ে নিশ্চিন্ত হই।”
একনাগাড়ে বলে চলেছেন মিস্টার সেন, “ঘাসজমি থেকে তাঁবুতে ফেরার পথে হাবোর কাছ থেকে জানতে পারলাম, এই পাহাড়ের অন্যদিকটা গ্রামে ঢোকার প্রায় পাঁচ কিলোমিটার আগে রাতা নদীর কাঠের ব্রিজের কাছ থেকে দেখা যায়। কিন্তু হাবো কোনওদিন ওই পথ দিয়ে পাহাড়ে ওঠেনি ঘন কাঁটাগাছের জঙ্গলের জন্য। হাবোকে বিশ্বাস না করার কোনও কারণ ছিল না। তাঁবুতে ফিরে দেখি, হাবোর স্ত্রী পার্বতীর সঙ্গে গ্রামের এক মহিলাও এসে তাঁবুর কাছে বসে আছেন। শুনলাম, আবারও গ্রামের একজনের ছাগল হারিয়ে গেছে। গুহার কাছে লাগানো হান্টিং ক্যামেরা থেকে আমার মোবাইলে কয়েকটা ছবি আসে। আমার বন্ধুর নিশ্চয়ই মনে আছে, গাছের ফাঁক দিয়ে সূচলো মুখের সাপের মতো সরু লম্বা জিভ বের করা একটা অস্পষ্ট ছবি আপনাকে দেখিয়েছিলাম?”
তার মানে এখুনি জানতে পারব অজানা জন্তুটা কী! উত্তেজনায় আমার হাত-পা কাঁপছে।
“ছবিটা দেখার পর মনে হল, কিছু একটা রহস্য আছে পাহাড়ের উলটোদিকে। রাতেই আমি আমার লেখক বন্ধুকে নিয়ে অভিযান চালাই ব্রিজের কাছে। গভীর রাত্তিরে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায় ব্রিজের কাছে কাঁটাগাছের জঙ্গলের ধারে। তিনটে লোক নেমে আসে গাড়ি থেকে। গাছের ঝোপে লুকিয়ে জানতে পারি, গাছের আড়ালের কাঁটাগাছ কেটে সুড়ঙ্গের কথা। অনেক মালপত্র নিয়ে ওই লোক তিনটে উধাও হয়ে গেছিল কাঁটাগাছের জঙ্গলে। গাড়িতে ড্রাইভার বসে থাকায় ওদের ফলো করার ঝুঁকি নিইনি। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর ওই লোকগুলো ফিরে আসে। এবার তিনজন নয়, চারজন। তার মানে আগেই ওখানে একজন ছিল। গাড়িটা চলে যেতে আমরাও ফিরে আসি তাঁবুতে।
“গতকাল সকালে হাবোর স্ত্রী পার্বতীর কাছে শুনেছিলাম যে জঙ্গলের হাইওয়েতে পুলিশের গাড়ি লুঠ করে গুলি-বন্দুক নিয়ে পালিয়েছে ডাকাতরা। আমার মনে হল, ডাকাতির সঙ্গে ছাগল হারিয়ে যাবার ও ওই গুহার সম্পর্ক থাকলে থাকতেও পারে। গতকাল শহরে ফরেস্ট অফিসে গিয়ে শুনলাম, শহরে ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়েছে। ফরেস্ট অফিস থেকে এখানকার প্রাক্তন রাজাদের এস্টেটের মিউজিয়াম দেখে সরাসরি চলে গেলাম এসপির অফিসে। তারপর আপনারা জানেন।”
সাংবাদিকরা চেঁচিয়ে উঠল, “মিস্টার সেন, আপনার মুখ থেকে পুরো ঘটনাটা শুনতে চাই, বলুন প্লিজ।”
আমার মন ডাকাতিতে নেই। আমি ভাবছি অজানা জানোয়ারের কথা। রহস্যটা কখন ফাঁস করবেন ভদ্রলোক?
আবার বলতে শুরু করলেন মিস্টার সেন। “প্রথমে তো এসপি সাহেব দেখাই করতে চাইছিলেন না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ওঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি। আমার পরিচিত পুলিশ অফিসার না বলে দিলে আমার কথা শুনে আমাকেই হয়তো জেলে পুরে দিতেন ভদ্রলোক। আমি ওঁকে সরাসরি বললাম, ডাকাত ধরতে চাইলে এখুনি জনা পঁচিশ সাহসী পুলিশ জোগাড় করুন। আর যা বলছি সেটা আপনি ছাড়া আর কেউ যেন না জানে। আমার কথামতো এসপি সাহেব রাত আটটার মধ্যে পুলিশদের রাতা নদীর কাঠের ব্রিজের এ-পাড়ের জঙ্গলে গাছের আড়ালে ছড়িয়ে দেন। আমার অনুমান মিলে যায়। ডাকাতি করা টাকা লুকিয়ে রাখতে ডাকাতরা গভীর রাতে হাজির হয়। আর পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।” এ পর্যন্ত বলে বসে পড়লেন মিস্টার সেন।
একজন সাংবাদিক বলে উঠল, “ডাকাতির সঙ্গে একটা ছাগল হারিয়ে যাবার সম্পর্কের কথা বলছিলেন। এছাড়া একটা অজানা জন্তুর কথাও বললেন একটু আগে। সব বলুন, প্লিজ।”
আবার উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার সেন। “ডাকাতদের লুকোবার জায়গাছিল ওই গুহাগুলো। গ্রামের লোকের নজরে পড়তে পারে ভেবে ঘাসজমির উলটোদিকের পাহাড়ের ঢালের কাঁটাঝোপ সুড়ঙ্গের মতো কেটে যাতায়াতের পথ বানিয়েছিল ওরা। ছাগল ধরে কেটে গুহার মাঝে রান্না করে খেয়েছে ডাকাতের দল। আর এই রান্না করা ছাগলের হাড়ই আমি দেখতে পাই গুহার ওখানে। ওই পাহাড়ের কোনও একটা গুহায় থাকে এক বিশাল রক মনিটর লিজার্ড। অনেক বছর আগে এই প্রজাতির গোসাপ আমাদের দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়া হয়ছে। মানুষের সাড়া পেয়ে বিরক্ত হয়ে ওটা ঘাসজমি পেরিয়ে নেমে এসেছিল নদীর শুকনো বালিতে। হাবো ওটার পায়ের ছাপই দেখেছিল। কাল সন্ধেবেলা গুহার কাছের হান্টিং ক্যামেরা থেকে ওই লিজার্ডটার ছবিই আসে আমার মোবাইলে। গতকাল রাজবাড়িতে দৈত্য গোসাপের স্টাফ করা চেহারা দেখে এসেছি যে!”