সকাল। উজ্জ্বল, আলোকিত। ‘বাবা, আপনি যতই নিষেধ করেন. আমি মানব না।’ চমকে উঠলেন হিরণ্যধনু। বললেন, মানবে না! কেন মানবে না আমার নিষেধ!’ আপনার নিষেধ আমার বাসনা পূরণের অন্তরায়। বাসনা পূরণের অন্তরায়! আমার সাবধানবাণী তোমার বাসনা পূরণের অন্তরায়! তুমি এসব কী বলছ একলব্য? চিত্তচাঞ্চল্যে হিরণ্যধনুর কণ্ঠ বুজে এল। পিতার কথা শুনে একটুখানিও ভড়কাল না একলব্য। কণ্ঠকে আরও দৃঢ় করে বলল, “পিতা পুত্রের উন্নতি চান, সর্বদা। এটাই মানববিধি। আপনি তার ব্যতিক্রম। পিতা হয়ে আপনি আমার উন্নতি চাইছেন না। উপরন্তু উন্নতির পথে অন্তরায় হয়ে দাড়াচ্ছেন।”
হিরণ্যধনুর পাশে দাড়িয়ে ছিলেন বিশাখা। বিশাখা একলব্যের মা। পুত্রের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা শুনে বিশাখা স্তম্ভিত। ঘোরাচ্ছন্ন চোখ বড় করে বিশাখা একলব্যের উদ্দেশে কিছু একটা বলতে চাইলেন। কিন্তু তার গলা দিয়ে গরগর আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বের হল না। হিরণ্যধনু বাম হাত তুলে বিশাখাকে করলেন। তারপর মিয়মাণ কষ্ঠে একলব্যকে বললেন, ভুল বুঝেছ। পুত্র। পিতা কখনো পুত্রের উন্নয়নপথের কাটা হয় না। আমিও তোমার সমৃদ্ধির অন্তরায় নই। তোমাকে সতর্ক করে পিতার কর্তব্য পালন করছি মাত্র। “সতর্ক করছেন!” এবার একলব্যের বিস্ময়ের পালা।
এমন কী বিপদের আভাস পাচ্ছেন যে, আমাকে সাবধান করতে হচ্ছে আপনাকে?” হিরণ্যধনু বললেন, ‘তুমি ভুল করতে যাচ্ছ পুত্র। চরম ভুল করতে যাচ্ছ। ‘একজন মহান অস্ত্রগুরুর কাছে একজন তরুণ শিক্ষা গ্রহণ করতে যেতে চাইছে, এতে ভুলের কী আছে বাবা? আছে, আছে।’ বলে নিশ্চুপ হলেন হিরণ্যধনু। পিতা আরও কিছু বলেন কি না অপেক্ষায় থাকল একলব্য। হিরণ্যধনু তাঁর নীরবতা ভাংচ্ছেন না দেখে একলব্য নিচু স্বরে আবার আবার জিজ্ঞেস করল, কী ভুল বাবা?” হিরণ্যধনু যেন একলব্যের কথা শুনতে পাননি। গবাক্ষ দিয়ে দূর-পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বিশাখা স্বভ শান্তস্বরে বললেন, কিছু বলছ না যে! একলব্য তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছিল। সহধর্মিণীর দিকে কোমল চোখে তাকালেন হিরণ্যধনু। তারপর সেই চোখ ফেরালেন একলব্যের দিকে। বললেন, তোমার জীবনপথে অন্তরায় সৃষ্টি করার জন্য আমি তোমাকে সতর্ক করছি না। ভুলের মাশুল গোনার আগে তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি মাত্র। তুমি যেও না দ্রোণাচার্যের কাছে।
তুমি ব্যর্থ হবে। তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হবে না।’ একলব্য অস্থির গলায় দ্রুত বলে উঠল, আপনি কি আমাকে অভিশাপ দিচ্ছেন বাবা? এবার প্রশান্ত চোখে অনেকক্ষণ একলব্যের দিকে তাকিয়ে থাকলেন হিরণ্যধনু। তারপর স্নেহময় কষ্ঠে বললেন, তুমি আমার পুত্র, জীবনের অবলম্বন। উত্তরাধিকারের মূলভূমি তুমি আমার । তোমার জন্য কি আমার অভিসম্পাত সাজে?’ তাহলে, তাহলে আমাকে বাধা দিচ্ছেন কেন বাবা? বাধা দিচ্ছি- তোমার ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি বলে।’ ‘কী ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন? মন্দ কিছু কি?” অস্পষ্ট শ্লেষ একলব্যের কণ্ঠে একটু করে ঝিলিক দিয়ে উঠল বুঝি। পুত্রের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না হিরণ্যধনু। সারা মুখে ইতস্তত ভাব। এক গভীর উদ্বেগ তাকে ঘিরে ধরেছে। পুত্রের প্রশ্নের উত্তর দিলে সত্যটা বেরিয়ে আসবে। এই সত্য একলব্যের হৃদয় ভেঙে চুরমার করে দেবে। তার চেয়ে মৌন থাকাই উত্তম। হিরণ্যধনু ভাবলেন- একলব্য নাছোড়।
দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রচালনা শিখবার জন্য সে যাবেই। তার কথাবার্তা আর আচরণ বলছে- এ ব্যাপারে পিতার নিষেধ শুনতে সে রাজি নয়। সুতরাং বাধার প্রাচীরকে আরও সুদৃঢ় করা উচিত হবে না। হিরণ্যধনু ঠিক করলেন- একলব্যকে আর বাধা দেবেন না তিনি। একলব্য দ্রোণাচার্যের কাছে যেতে চায় যাক। একলব্য যুবক। তারুণ্যের অনুরণন তার শিরায় শিরায়। উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে উদ্বেল করেছে। পিতার নিষেধ যে যথার্থ কারণে, তা খুলে বললেও একলব্য বুঝবে না; বুঝতে চাইবেও না এই মুহুর্তে। তাই একলব্যকে দ্রোণাচার্যের কাছে যেতে দেওয়া উচিত। ঠেকে শিখুক সে। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন হিরণ্যধনু। তারপর বললেন, তুমি পুস্তুত হতে থাক পুত্র পুরোহিত ডেকে আমি তোমার যাত্রার দিনক্ষণ নির্ধারণ করে দিচ্ছি। তুমি আচার্য দ্রোণের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে যথার্থ ধনুর্ধর হয়ে রাজধানীতে ফিরে এস। রাজপ্রাসাদ প্রস্তুত থাকবে তোমাকে স্বাগত জানাবার জন্য । আমরা তোমার ফেরার দিনের অপেক্ষায় থাকব।’ স্ত্রী বিশাখার দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করলেন হিরণ্যধনু। পিতার কথা শুনে বিস্মিত চোখে কিছু একটা বলতে চাইল একলব্য। হিরণ্যধনু তার ডান হাতটা তুলে একলব্যকে আর কিছু বলতে নিষেধ করলেন।
তার চোখেমুখে তখন বেদনা আর বাৎসল্যের মাখামাখি। দুই অপরাতু। রোদের গায়ে পাতলা কুয়াশার আস্তর। নৃপাসনে বসে আছেন অনোমদশী। অনোমদশী মহারাজ হিরণ্যধনুর পিতা। দীর্ঘদেহী। বয়োভারে কিছুটা ন্যুজ, পক্ক কেশ । চামড়া সামান্য কুঁচকে গেছে। সবল পেশি এখনও অনোমদর্শীর শরীরে বর্তমান। কুচকুচে কালো শরীরে অপরাহ্লের ছেঁড়া রোদ ঝিলিক দিচ্ছে। পুত্র হিরণ্যধনু রাজকার্যে দক্ষ হয়ে উঠলে একদিন পুত্ৰহস্তে রাজ্যভার সমর্পণ করলেন তিনি। প্রবীণ পারিষদরা বাধা দিয়েছিলেন, “মহারাজ, এখনো আপনার শরীরে নদীর খরস্রোত, আপনাকে সামনে দেখে পশুরাজ এখনো লেজ গুটিয়ে পালায়। আপনার শাসনে এই অরণ্যরাজ্যের সকল প্রজা পরম সুখে আছে। আপনি এখনো একজন সক্ষম বিচক্ষণ বিচারক । আপনি কেন এখন রাজ্যভার যুবরাজ হিরণ্যধনুর হাতে তুলে দেবেন? আপনি আরও কিছু বছর রাজ্য শাসন করুন।’ অনোমদশী পারিষদদের কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন। তারপর বললেন, হিরণ্যধনু যুবক হয়ে উঠেছে।
তার রাজকার্যদক্ষতা প্রশংসনীয়। কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান দিতে শিখে গেছে হিরণ্যধনু। তাকে বিয়ে করিয়েছি। ও আমার একমাত্র পুত্র। আমার বয়স হয়ে গেছে। রাজকাৰ্য পরিচালনার জন্য যে দম আর বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন, তার কিছুটা ঘাটতি আমার মধ্যে লক্ষ করছি। তা ছাড়া …।’ সেনাধ্যক্ষ অনোমদশীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘তা ছাড়া! তা ছাড়া কী মহারাজ? ‘বলছি। পুত্র উপযুক্ত হয়ে উঠলে মাতা-পিতার মন তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। হিরণ্যধনু উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। তাকে রাজ্যভার দিয়ে আমি নিশ্চিত হতে চাই যে, সে একজন সুবিবেচক, সুশাসক। আমার সকল ইন্দ্রিয় সক্রিয় থাকতে থাকতে হিরণ্যকে রাজা ঘোষণা করে তার রাজ্যশাসন প্রণালিটা আমি দেখে যেতে চাই। তোমরা আমাকে বাধা দিও না। মৃত্যুর আগে এই তৃপ্তিটুকু পেতে চাই- হিরণ্যধনু ব্যাধসমাজের একজন খ্যাতিমান রাজা।’ তার কথা শুনে সেদিনের রাজসভার সকল পারিষদ আর কথা বাড়াননি। শুভক্ষণে অনোমদর্শী হিরণ্যধনুকে রাজসিংহাসনে বসিয়েছিলেন। রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরের একটি কক্ষকে রাজকীয়ভাবে সজ্জিত করিয়েছেন হিরণ্যধনু। রাজসভার আদলে এই কক্ষটি নির্মাণ করা হয়েছে। পাশেই অনোমদর্শীর শয্যাকক্ষ। একা থাকেন তিনি ওই কক্ষে। বেশ ক’বছর আগে রাজমাতার মৃত্যু হয়েছে। পুত্রকে রাজ্যভার অর্পণের পর রাজপিতা এই কক্ষে বাস করা শুরু করেছেন। রাজার শয্যাকক্ষটি পুত্র হিরণ্যধনুর অনুকূলে ছেড়ে দিয়েছেন অনোমদর্শী।
কারণ এখন তিনি মহারাজা নন, রাজপিতা মাত্র। রাজপিতা হলে কী হবে, রাজকার্য পরিচালনায় অথবা পরিবারকেন্দ্রিক কোনো সংকট দেখা দিলে হিরণ্যধনু পিতার পরামর্শ গ্রহণ করেন। পিতার শয্যাকক্ষের পাশের রাজকীয় কক্ষে এসে বসেন। পিতা এসে নৃপাসনে বসেন, পুত্র সাধারণ একটা আসন গ্রহণ করে পিতার পায়ের কাছে বসেন। আজ হিরণ্যধনুর পরিবারে সংকটকাল উপস্থিত। একলব্য হস্তিনাপুর গমনে উদ্যত। সে দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখবার জন্য বেপরোয়া। পুত্রকে যাবার অনুমতি দিয়েছেন বটে। তারপরও মনটা বড় খচখচ করছে। পিতার পরমার্শই শিরোধার্য। তাই আজ অপরাহ্নে পিতার কাছে এসেছেন হিরণ্যধনু উপদেশের জন্য, পরামর্শের জন্য। হিরণ্যধনু এই মুহূর্তে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। পিতা কক্ষে প্রবেশ করলে আসন ছেড়ে উঠে দাড়ালেন হিরণ্যধনু। অনোমদশী বললেন, বস, বস। নিজে আসন গ্রহণ করে পুত্রের দিকে তাকালেন।
দেখলেন- ভীষণ একটা উদ্বিগ্নতা হিরণ্যধনুর চোখেমুখে। কী রকম যেন বিপর্যন্ত অবস্থা তার! কঠিন সমস্যাতেও বিচলিত হয় না যে, তাকে বিষগ্ন বিচলিত দেখে অনোমদশী নিজের মধ্যেও চঞ্চলতা অনুভব করলেন। নিজেকে সংযত করে বললেন, ‘তুমি কি কোনো সংকটে পড়েছ হিরণ্য? হিরণ্যধনু বিব্রতমুখে বললেন, ‘হ্যা, বাবা।’ রাজ্য সংক্রান্ত কিছু কি? না বাবা। ‘তাহলে!’ বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন অনোমদর্শী। ‘পরিবার সংক্রান্ত।’ মাথা নিচু করে উত্তর দিলেন হিরণ্যধনু। ‘পরিবার সংক্রান্ত! তোমার পরিবারে আবার কী সংকট? তোমার মা নেই, মানি। বাবা তো আছি। তোমার ঘরে কোনো যুবতি কন্যা নেই। যুবতি কন্যারা পারিবারিক সংকট তৈরি করে। তা ছাড়া তোমার তো একটি মাত্র সন্তান একলব্য। কৈশোর ছাড়িয়ে তরুণ হয়ে উঠেছে সে। বিশ বছরের যুবা। বিদ্যার্জন সমাপন করেছে সে। ধীর, স্থির। তবে আবেগটা তার একটু বেশি।’ ধীরে ধীরে কথাগুলো বলে গেলেন অনোমদর্শী।