আজ শুক্রবার। তাই ভাবলাম এই ছুটির দিনে কোথাও থেকে ঘুরে আসি। শুনেছি বাংলাদেশ থেকে কতিপয় তরুণ তরুণি লেখকদের একটা দল নাকি মঙ্গল গ্রহে বন ভোজনে গেছে। শুক্রবারে শুক্রগ্রহে না গিয়ে মঙ্গলে কেন গেল বুঝলাম না। যা হোক, সাত সক্কালে ঘুম ভাঙ্গলো সম্পাদক সাহেবের ফোন পেয়ে। আমাকে ফোনের মধ্যে চাপা গলায় বললেন, “মতিন, তোর তো ভাল ফটোগ্রাফির হাত আছে। চট করে মঙ্গলে গিয়ে পোলাপান লেখকগুলার কিছু ছবি তুলে নিয়ে আয়। শুনলাম জুটি বেঁধে বেঁধে নাকি গেছে!”
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, “পাপারাজ্জি?”
“অই রকমই আর কি। পার ফটো দশ ইউনিট করে পাবি। সবার আগে মিডিয়াতে আমরা আনবো এই নিউজ উইথ ফটো! কাভার স্টোরি হবে। মার মার কাট ব্যবসা!”
দশ ইউনিটের কথা শুনে আমার ঘুম উবে গেল পুরোপুরি। গত দেড় মাস ধরে রোলাস রয়েস স্পেশ শিপটা কিনতে পারছি না দেড় শো ইউনিট শর্ট পরায়। এইগুলা পেলে সেটা হয়ে যাবে। সুজুকি স্পেশ শিপ দিয়ে আর কত দিন চলে? মেয়েরা তো ফিরেও তাকায় না এই স্পেশ শিপ দেখলে। তাঁদের জন্য হলেও একটা রোলাস রয়েস শিপ চাই।
দেরি না করে কোনো মতে ক্যামেরা আর ফিল্ম ভরে আমার সুজুকি স্পেশ শিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পৃথিবী থেকে মঙ্গলে যেতে বিশ মিনিটের ধাক্কা।
যাহোক, একটা আকিজ চুরুট ধরিয়ে শেষ করতে করতে মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে পৌছে গেলাম। ডিটেকশন মনিটরে দেখলাম মঙ্গলের একটা মৃত আগ্নেয়গিরির পাশে একটা বড় লেক আর বন আছে। ওখানেই গেছে সবাই যতটা জানি। সম্পাদক সাহেবের পাঠানো মেইলে এখানকারই ঠিকানা দেয়া। ওপর থেকে তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না। নিচে নামতে থাকলাম সুজুকি স্পেশ শিপটাকে।
যতই নামছি ততই চারপাশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মঙ্গলের বায়ুমন্ডল পৃথিবীর চেয়ে পাতলা। অনেক ওপর থেকেই মোটামুটি দেখতে লাগলাম সব কিছু। বন আর হ্রদটা দেখা যাচ্ছে এখন। গোলাপি রঙের গাছ পালা, হ্রদের পানির রঙ বেগুনী। মাঝে মাঝেই বড় বড় মাছ লাফিয়ে উঠছে। ডলফিনের মত সাইজের মাছ (মারমেইড- অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক মাছ)। লেকের পাশে ঢালের মত বেছানো রূপালি রঙের ছোট ছোট ঘাস। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। শেষ বার যখন হানিমার্সে এসেছিলাম জুলেখার সাথে তখন শীতকাল ছিল। বড় বড় ড্রামের সাইজের বরফ পড়তো। যে হোটেলে উঠেছিলাম- ওটার ছাদ ধ্বসে গিয়েছিল বরফ পাতে। জুলেখা ভয়ের চোটে সেদিনই চলে গিয়েছিল মঙ্গল ছেড়ে। ওর এসব বরফপাতে ভয় খুব।
এখন মনে হয় গ্রীষ্মকাল। চারপাশে অনেক সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে সাদা, হলুদ, লাল, নীল সব ফুল। জুলেখাকে নিয়ে আসতে পারলে ভাল হতো আজ। ও গেছে বাপের বাড়ি। দুই দিন যেতে না যেতেই খালি ঝগড়া বাঁধে। একটু কিছু হলেই ব্যাগ গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। যাওয়ার সময় কুদ্দুস আর দিলরুবাকেও নিয়ে যায়। ফ্ল্যাটের দারোয়ান হয়ে আমাকে পাহারা দিতে হয় বিমর্ষ মুখে। কারণ ফ্ল্যাট আমার শ্বশুড় আব্বার দেয়া। খামখেয়ালিপনা করলে নিয়ে যেতে পারে।
সুজুকিটা নামিয়ে লেকের কিনার দিকে রাখতে রাখতে দেখতে পেলাম লেকের ধারে রিয়েল ডেমোন সাহেব হাফ প্যান্ট পরে শুয়ে আছেন। মুখে সিগারেট ধরানো। কালো একটা ব্লেজার পরা, বুক খোলা। চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে চিমনির মত ধোঁয়া ছাড়ছেন। আমাকে স্পেশশিপ থেকে নামতে দেখেই হাই তুললেন, “কি খবর মতিন ভাই- এই সাত সক্কালে এখানে? তাও ক্যামেরা নিয়ে? খবর পেয়ে গেছেন মনে হয়?”
আমি দাঁত বের করে হাসলাম, “ ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আমি মঙ্গলে এলাম আর ক্যামেরা আনবো না? এটা কোনো কথা হল?”
“অ। ছবি তুলবেন? তোলেন- দাঁড়ান, আরেকটা সিগারেট ধরাই, এটা শেষ হয়ে গেছে।” ভদ্রলোক সিগারেট ধরানোর ছবি বড় শখ করে তোলেন। গত বছর ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়ামে মোনালিসার ছবির সামনে আমাকে দিয়ে ছবি তুলতে গিয়েছিলেন। ভুলে গিয়েছিলেন যে ওটা নো স্মোকিং জোন। যেই সিগারেট ধরিয়ে টান দিতে গেছেন ওমনি এক ঝাঁক পুলিশ এসে আমাকে আর ওনাকে ধরে কাস্টডিতে পাচার করে দিয়েছে। সেবার বের হতে গিয়ে কালো ঘাম ছুটে গিয়েছিল দুজনেরই। ভেবেছিলাম রিয়েল ভাইয়ের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসবে। কিন্তু পরের সপ্তাহেই শুনলাম জুপিটারের কোন সুপ্ত আগ্নেয়গিরির সামনে একই কায়দায় ছবি তুলতে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আমি নিশ্চিত কোনো দিন যদি খুনের দায়ে তাকে শুটিং স্কোয়াডে নিয়ে যাওয়া হয়- শেষ ইচ্ছা হিসেবে তিনি সিগারেট ধরিয়ে ছবি তুলতে চাইবেন সেখানে!
ছবি তোলা শেষে বললাম, “সবাই নাকি জুটি বেঁধে এসেছে? আপনার উনি……..”
অবাক মুখে তাকালেন রিয়েল সাহেব, “আমিও তো এনেছি! এই যে বিড়ি! আমার সার্বক্ষণিক গার্লফ্রেন্ড!”
আমি হাঁটতে লাগলাম। কবি সাহিত্যিকদের ধারে কাছে বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ না। হাজত বাস করতে হয়েছে যেহেতু এর আগে- তাই দাঁড়ালাম না আর। রিয়েল সাহেবকে ওখানে রেখে হাঁটতে লাগলাম একটা বটগাছ টাইপের গোলাপি গাছের দিকে। ওখানে ক্যাম্প ফায়ারের মত জ্বালানো হয়েছে। রান্না বান্না করা হচ্ছে মনে হয়। কয়েক জনকে দেখা যাচ্ছে।
কাছে যেতেই দেখলাম বিশিষ্ট স্বনামধন্য লেখিকা ফারহানা নিম্মী, তৃপ্ত সুপ্ত, একুয়া রেজিয়া, আয়েশা কাশফি রান্না চড়িয়েছেন চুলায়। ইট দিয়ে উঁচু করে বানানো চুলা। একটা কুলাতে চাল বাছছে নিম্মী আপা আর তৃপ্তি আপা। একুয়া আপা পেঁয়াজ কাটতে কাঁটতে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন। তাঁর সিল্কি-স্ট্রেট চুল বার বার মুখের ওপর এসে পড়ছে, চোখের জলে কাঁজল মাখিয়ে ফেলেছেন। বারবার আচঁল দিয়ে চোখ মুছছেন। একটু দূরেই বিশাল একটা গামলা নিয়ে সেদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়াচ্ছে আয়েশা কাশফি।
আমাকে ক্যামেরা হাতে এগোতে দেখেই আতকে উঠলেন একুয়া আপা, “মতিন ভাই! খবরদার ছবি তুলবেন না। আমার কাঁজল নষ্ট হয়ে গেছে। ভূতের মত দেখাচ্ছে নিশ্চই!”
আমি সহজ গলায় বললাম, “নাহ। তুলবো না। দেখতে এলাম কেবল- বাকিরা কই?”
নিম্মী আপা এদিক ওদিক তাকালো, “নিশম আর সানভিকে তো লাকড়ি আনতে পাঠিয়েছিলাম- দেখা যাচ্ছে না একটাকেও। ভেগেছে মনে হয়।”
তৃপ্তি আপা ঠোঁট ওল্টালেন বিরক্ত ভঙ্গিতে, “সব আমাদের চার জনের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে ফুটেছে। রেজা, রিমু, মেঘলা, জয়দা, শুভ, রিক, শিহাব সব গায়েব এখানে আসার পর থেকে। নিশম আর সানভিটা কেবল একটু হাত লাগাচ্ছে মাঝে মধ্যে।”
আয়েশা অস্ফূট গলায় কেবল বলল, “আমার নখের আজ চৌদ্দটা বেজে গেছে ডিমের খোসা ছুটাতে গিয়ে!”
আমি একটা টুল টেনে নিয়ে বসলাম চুলা থেকে একটু দূরে। বনের ভেতর থেকে নিশমের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ছেলেটার সাথে দেখা হয়েছিল মনে হয় মাস খানেক হবে। গলাটা মনে আছে এখনো। তাকাতেই দেখলাম বন থেকে বেরিয়ে আসছে নাদুশ নুদুশ একটা সাদা পাঞ্জাবী পরা ছেলে। হাতে একগাদা লাকড়ি। সঙ্গে শাড়ি পরা বেশ সুন্দরী এক তরুণী। আমি একটু অবাক হয়ে কাশফির দিকে তাকাতেই ও গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, “এনাটমির ম্যাম। ধরে নিয়ে এসেছে নিশম।”
আমি শিস দিয়ে উঠতে গিয়েও উঠলাম না। আড় চোখে কেবল তাকিয়ে দেখলাম বিনয়ের চোটে নিশম সাহেব গলে গলে পড়ছেন। কম বয়সী ম্যামও হেসে হেসে ভেঙে পড়ছেন বারবার। সেই হাসি দেখে বুকের ডান দিকে টন টন করে ওঠে। নিশমকে দোষ দেয়া যায় না।
বিশাল লাকড়ির স্তুপ এনে ফেলল নিশম চুলার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে একটা লাল রুমাল বের করে মুখে মুছতে মুছতে আমার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো, “আপনাকে আগে কই জানি দেখছিলাম? মতিন ভাই না? ফটোগ্রাফার?”
আমি মাথা ঝাঁকালাম কেবল। জ্ঞানী জ্ঞানী হাসি দিলাম।
সুন্দরী ম্যাম ভদ্রমহিলা ইতস্তত ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। কথা বলবেন নাকি চুপ করে থাকবেন বুঝতে পারছেন না মনে হয়। অবশ্য তাকে বেশি চিন্তা করতে হল না। দেখা গেল বিশাল টেবিল ছাতা হাতে রেজা শাওন সাহেব আসছেন লেকের উল্টো দিক থেকে। পেছন পেছন বড় একটা কাঁচি হাতে আফরিনা রিমু। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। বোধ হয় চেঁচাচ্ছিল এতক্ষণ। রেজা শাওনের চেহারা আগের বারের চেয়ে খোলতাই হয়েছে। মাথায় ছোট ছোট বেণী করা ঝাঁকড়া চুল। কাঁধ ছুই ছুই করছে। বড় একটা সানগ্লাস দিয়েছে। এমনেই লম্বা মানুষ, চুলের এই হাল ফ্যাশনে মনে হচ্ছে দানব!
রিমু এখানে এসেই সবার আগে বলে উঠল হড়বড়িয়ে, “ একুয়াপু, শাওনের কান্ডটা দ্যাখছো? আমি তিন দিনের আল্টিমেটাম দিছিলাম চুল কাটার। সে এখন বেণি পাঁকিয়ে এসেছে! এই যে কাঁচি দেখছো- ওর সব চুল কেঁটে ফেলবো আজকে। একটাও রাখবো না!” নাকের পাটা ফুলিয়ে রেজা শাওনের দিকে তাকিয়ে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।
রেজা সাহেব সরল মুখে বলল, “ না মানে সময় পাচ্ছিলাম না আরকি। সেলুনে যেতে পারিনি। আজকেই যাবো।”
“তোর কোথাও যেতে হবে না! সেলুন নিজেই হাজির হয়ে গেছে!” হুংকার দিল রিমু।
আমি বোকার মত তাকিয়ে রয়েছি এই দুজনের দিকে। কথা বলবো নাকি ছবি তুলবো বুঝতে পারছি না।
নিম্মী আপা ঝগড়া থামাতে হাত তুলে বলল, “শাওন তুমি তো নেদারল্যান্ডের বিখ্যাত ঘরোয়া শেফ। একটু হাত লাগাও না ভাই?”
হাত তুলে থামিয়ে দিল রিমু, “কি বলো? সব জিনিস কাঁচা খেতে চাও? এই শেফ সাহেবের থিওরি হল কাঁচা শাকসবজি খাওয়া উচিত সবার- তাতে নাকি ভাইটামিন ভাল মত পাওয়া যায়। লতা পাতা যা পাবে সব কাঁচা খায় মনে হয়!”
রেজা শাওন শুঁকনো মুখে বলল, “থামবা একটু? ফটোগ্রাফার ভাই আছে এখানে পত্রিকা থেকে।”
“তো?” চোখ পাঁকিয়ে রেজার দিকে তাকালো রিমু।
আমি গলা খাঁকারি দিলাম, ভারী গলায় বললাম, “না, মানে আপনাদের ওপর একটা ছোট আর্টিক্যাল আর ফটো নিতে এসেছিলাম পত্রিকার জন্য।”
নিশম তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “তাইলে আপনি জয়দার কাছে যান। উনি খুব ভাল বক্তৃতা দিতে পারে। সব গুছায়ে বলে দিবে।”
আমি কিছু বলার আগেই বনের দিক থেকে জয় কবির সাহেবকে হেলতে দুলতে আসতে দেখা গেল। সিগারেট ধরিয়েছেন। ধোঁয়া খুব যত্ন করে ছাড়তে ছাড়তে আসছেন। দেখে মনে হচ্ছে সিগারেট একা খাচ্ছেন না, গাছ পালাকেও সেকেন্ড হ্যান্ড ধোঁয়ার ভাগ দিচ্ছেন।
আমাকে দূর থেকে দেখেই আনন্দিত গলায় বলে উঠলেন, “আরে মতিন ভাই যে! হাজির হয়ে গেছেন এখানেও! বাহ্, বাতাসের আগে খবর ছড়ায় নাকি আমাদের?”
“সবার ছবি তুলতে এলাম। পিকনিকে কে কি করছে দেখতে এলাম- পত্রিকার জন্য কিছু লেখতে পারলে ভাল হয়।”
চট করে সবার দিকে তাকিয়ে নিলেন একবার, তারপর একটা দেঁতো হাসি দিয়ে বললেন, “এখানে তো দেখার কিছু নেই আপাতত। বিকালের দিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিশমের ধরণী… থুরী মঙ্গল কাঁপানো উচ্চাঙ্গ নৃত্য আছে। সেই সাথে এইসব কোকিল কন্ঠি গায়িকারা তো আছেই। আসল প্রোগ্রাম তখন হবে।”
বুঝতে পারলাম সুক্ষ ইঙ্গিতটা। সরে পড়তে বলছেন এখনকার জন্য। ফটোগ্রাফার মানুষের আজকাল কোথাও কোনো দাম নাই। ক্যামেরাতে কয়েকটা ছবি পটাপট তুলে নিলাম কেউ কিছু বলে ওঠার আগেই। একুয়া আপা তাঁর কাঁজল বিষয়ক কিছু বলতে যাচ্ছিলেন- চলে এলাম তার আগেই।
লেকের ধার দিয়ে বিমর্ষ মুখে হাটছি। মারমেইডগুলো আমার পাশ দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। খেলছে যেন।
হাঁটতে হাঁটতেও দেখলাম একটা গাছে মাচার মত টানিয়ে আসিফ শুভ সাহেব শুয়ে বই পড়ছেন গভীর মনোযোগ দিয়ে। দূর থেকে ছবি তুলে নিলাম। বিরক্ত করতে গেলাম না। গম্ভীর মানুষ। থাকুক ওর মত। আবার হাটতে লাগলাম।
লেকের পানিতে হাফ প্যান্ট পরে লাফ দিল একটা ছেলে উঁচু একটা গাছের ডাল থেকে। দেখে মনে হচ্ছে আহনাফ সানভি। কারণ পানিতে পড়ার সাথে সাথেই লাফ দিয়ে হাঁচড়ে পাঁচড়ে ডাঙ্গায় উঠে এসে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগালো বনের দিকে। প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও পরে দেখলাম বড় বড় গাছের গুড়ির মত কুমীর আছে দীঘির ঐ অংশে। সানভী সাহেব বোধ হয় কুমীর দেখেনি। মঙ্গলে যে কুমীর আছে এই তথ্যটা অবশ্য অনেকেই জানে না। নিরামিষি কুমীর- ভয়ের কিছু ছিল না।
মেঘলা তাসনিমকে দেখা গেল গোল গাল এক যুবকের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিরক্ত করতে গেলাম না। কেবল ছবি তুলে রাখলাম। পার ছবি দশ ইউনিট বলে কথা। একটু আগে সানভির দৌড়ের ছবিটা তুলে রাখতে পারলে ভাল হতো।
বনের একপাশে লেখিকা নূহা চৌধুরী আর লেখক সাদ ভাইকে দেখা গেল প্লাস্টিকের চেয়ার টানিতে ব্যস্ত। সামনের দিকে দুটো গাছের মাঝখানে বড় একটা সাদা পর্দা টানাচ্ছে ইয়াসির আরাফাত সাহেব এবং এজি মাহমুদ সাহেব। সাদ রুবায়েত সাউন্ড বক্স টানা টানি করতে করতে হাঁপাচ্ছে। ঘন ঘন রুমাল বের করে মুখ মুছছে। এক নজর দেখেই বোঝা যাচ্ছে সন্ধ্যার দিকে প্রজেক্টরে শো চালানো হবে। সেটা নিয়েই কাজ চলছে। রোগা পটকা একটা ছেলেকে দেখা গেল মোটাসোটা বিশাল দেহী একটা ছেলের সাথে ক্যারাম বোর্ড নিয়ে কোথাও যাচ্ছে। প্রথমে চিনতে না পারলেও পরে মনে পড়ল একজন সাকিব অন্য জন সৌরভ। এরাও লেখক। একবার ভাবলাম গিয়ে কথা বলি। পরক্ষণেই চিন্তাটা বাদ দিয়ে দিলাম। বিরক্ত হতে পারে। এমনিতেই উটকো মানুষ হিসেবে এসে পরেছি। দুপুরে মঙ্গলের হোটেল খোলা না পেলে এদের এখানেই ভাগ বসাতে হবে। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে আমার আবার চোখের পাতা নাই।
একা হাঁটতে ভাল লাগছে না। জুলেখা সঙ্গে থাকলে ভাল লাগতো। সমস্যা হল ওকে কোথাও নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। সে আমাকে নিয়ে যাবে, কিন্তু আমি কোথাও নিয়ে যেতে চাইলেই বেঁকে বসে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এলাম। আগ্নেয়গিরিটা দেখা যাচ্ছে এখন। রোদ লাগছে গাছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা গাছের দিকে এগিয়ে যেতেই অবাক হয়ে দেখলাম গাছের নিচে লুঙ্গি পরে গায়ে ভেজা গামছা চাপিয়ে চোখ বন্ধ করে গৌতম বুদ্ধের মত ধ্যানে বসে আছেন নিথর শ্রাবণ শিহাব ভাই। পাশে হলুদ শাড়ি পরে বসে আছে শেতাঙ্গ এক মেয়ে। লম্বা ঘোমটার জন্য চেহারা দেখতে পাচ্ছি না। তবে আন্দাজ করতে পারছি – এঞ্জেলিনা জোলী। গত বছরেই বিয়ে করেছেন শুনেছি। একটা হাত পাখা দিয়ে অনবরত স্বামীকে বাতাস করে যাচ্ছেন। নারকেল পাতার বানানো ঘড়ি হাতে জোলীর। একটা বড় ধামা ভরা মুড়ি হাতে নিয়ে বসে আছে সে। মাঝে মাঝে নিথর সাহেব নড়ে চড়ে সেখান থেকে মুড়ি নিয়ে মুখে দিয়ে আবার ধ্যান মগ্ন হয়ে যাচ্ছেন।
ভেবেছিলাম একটু এগিয়ে যেয়ে কথা বলবো- কিন্তু তার আগেই সানভি দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এলো তার কাছে, হড়বড়িয়ে বলে উঠল, “শিহাব ভাই! লেকের পানিতে বিরাট বিরাট কুমীর! আমি গাছের ডাল থেকে লাফ দিতে গেছিলাম- পানিতে পড়ার সাথে সাথে জান নিয়া পালায় আসছি!”
চোখ খুলে বিরক্ত মুখে তাকালেন শিহাব সাহেব, “এইখানকার কুমীরগুলা যে নিরামিষি জানোস না? খামাখা দৌড়াইছস্ ক্যান? সামান্য ডাইভ দিয়া সাঁতার কাটতে পারোস না?”
“ভাই নিরামিষি হোক আর যাই হোক, আপনে ডাইভ দিলেই বুঝবেন কেমন লাগে, চারপাশ থেকে যেমনে ঘিরে ধরে আসে!”
মহা বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন শিহাব সাহেব, লুঙ্গির গিট মারতে মারতে বললেন, “আয়, তোরে ডাইভিং শিখায় দেই। বিয়ার আগে বহু ডাইভিং মারছি পাহাড়ের উপর থেইকা। বহুত হাঙ্গরের মুখেও পড়ছি। এইগুলাতো পুঁটি মাছ! ডরাস ক্যান?”
জোলী ভাবি শংকিত মুখে তাকালেন, এই প্রথম দেখলাম নারকেল পারাত চশমাও পরেছেন তিনি, “ওগো, কোথায় যাও?”
“এই হাঁদাটারে ডাইভিং শিখায় আসি।” গম্ভীর গলায় বলে হাটতে লাগলেন তিনি। পেছন পেছন সানভি। আমিও যেতে লাগলাম দেখার জন্য। বহুমুখী প্রতিভাবান বলে নাকি সুনাম আছে ভদ্রলোকের। ডাইভিংও করেন বলে জানতাম না- তাও পাহাড়ের ওপর থেকে হাঙরের মুখে ডাইভিং করেছেন? দেখার জন্য উৎসুক হয়ে পেছন পেছন গেলাম।
যাওয়ার সময় দেখলাম রিয়েল ডেমোন সাহেব সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে উদাস মুখে আগ্নেয়গিরির দিকে যাচ্ছেন। শিহাব সাহেবের ডাইভিং দেখায় আগ্রহ নেই বোধ হয়।
দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখলাম সানভির লাফ দেয়া সেই গাছে লুঙ্গি মালকোচা মেরে বীরদর্পে উঠে পড়েছেন শিহাব সাহেব। আমি ক্যামেরা নিয়ে তৈরি হলাম। ওনার আরেকটা নতুন প্রতিভার ছবি তুলে রাখবো। অনেকেই জানে না।
ডাল ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন লেকের দিকে। নিচে সানভি পারে দাঁড়িয়ে আছে উৎসাহী মুখে। দেখলাম একেবারে ডালের শেষ মাথায় গিয়ে তৈরি হলেন লাফ দেয়ার জন্য। নিঃশ্বাস আটকে ক্যামেরার সাটার টিপে দিলাম মোক্ষম দৃশ্যটা ধরণ করার জন্য।
কিন্তু ভ্যাবাচেকা খেয়ে দেখলাম শিহাব সাহেব ডালটা জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়েছেন, ঝুলছেন বিচিত্র ভঙ্গিতে। তাৎস্বরে চেঁচানো শুরু করেছেন!
ঘটনাটা কিছু বোঝার আগেই দেখলাম আগ্নেয়গিরির দিক থেকে হাফ প্যান্ট পরে রিয়েল ডেমোন সাহেব উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে আসছেন। আতংকিত মুখে চেঁচাতে চেঁচাতে বলছেন, “ভল্কানো ফুটছেরে আবার! ক্যান যে বিড়িটা ফেলতে গেছিলাম!”
চোখ বড় বড় করে দেখলাম জোলী ভাবিও শাড়ি নিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে দৌড় লাগিয়েছেন এই দিকে। পেছনে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়ে গেছে।
আমিও দৌড়াতে লাগলাম ভয়ের চোটে। শিহাব সাহেবের ভারে গাছের ডাল পানি ছুই ছুই করছে। কোল বালিস জড়িয়ে ধরার মত ধরে আছেন ডালটা। গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছেন। আগ্নেয়গিরি ফাটার প্রচণ্ড শব্দ ছাপিয়ে তার গলা শুনে যা বুঝলাম – “ওরে আল্লারে! আমারে খায়া ফালাইবো! আমি গাছ থেইক্কা নামবার পারুম না! আমারে কেউ নামাও। আমি উঁচা জায়গা ডরাই!” পাহাড় থেকে হাঙরের মুখে ডাইভ দেয়া ভদ্রলোক উচ্চতা ভীতিতে আক্রান্ত! গাছের ডালে উঠেই হজম হয়ে গেছেন!
সানভিকে দেখা যাচ্ছে ভাবীকে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। শিহাব সাহেব এখনো ঝুলছেন। নিচে নিরামিষি কুমীরগুলো ঘুর ঘুর করছে- দেখে মনে হচ্ছে আমিষি হওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে সবাই। উভয় সংকটে পড়েছেন লেখক সাহেব। দূরে লাভা ছুটে আসতে দেখে জমে গেছেন। ভয়ের চোটে ধ্যানি অবস্থায় চলে গেছেন মনে হচ্ছে। চেঁচানো একদম বন্ধ।
যা হোক। লেখক সাহেবকে বাঁচানো বলে কথা। কোন মতে দৌড়ে গিয়ে সুজুকি স্পেশ শিপ এনে শেষ মুহূর্তে উদ্ধার করতে হয়েছিল সেবার নিথর শ্রাবণ সাহেবকে। পৃথিবীতে আনার পর হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন দু সপ্তাহের জন্য। এই দু সপ্তাহ লেখক সাহেবকে উপুড় হয়ে ঘুমাতে হয়েছিল। কেন সেটা আর বললাম না।