ভদ্রলোকের বাড়ি খুঁজে বের করতে অনেক দেরি হলো। কাঁঠালবাগানের এক গলির ভেতর পুরোনো ধাঁচের বাড়ি। অনেকক্ষণ কড়া নাড়বার পর অসম্ভব রোগা এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। বিরক্ত মুখে বললেন, ‘কাকে চান?’
‘মিসির সাহেবকে খুঁজছি।’
‘তাকে কী জন্যে দরকার?’
‘জ্বি, আছে একটা দরকার। আপনি কি মিসির সাহেব?’
‘হ্যাঁ। বলেন, দরকারটা বলেন।’
রাস্তায় দাড়িয়ে সমস্যার কথা বলতে হবে নাকি? আনিস অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। কিন্তু ভদ্রলোকের ভাবভঙ্গি এ রকম যে, বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন, ভেতরে ঢুকতে দেবেন না। আনিস বলল, ‘ভেতরে এসে বলি?’
‘ভেতরে আসবেন? ঠিক আছে আসুন।’
মিসির সাহেব যেন নিতান্ত অনিচ্ছায় দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন। ঘন অন্ধকার। তিন-চারটা বেতের চেয়ার ছাড়া আসবাব পত্র কিছু নেই।
‘বসুন আপনি।’
আনিস বসল। ভদ্রলোক বললেন, ‘আজ আমার শরীরটা ভালো না। আলসার আছে। ব্যাথা হচ্ছে এখন। তাড়াতাড়ি বলেন কি বলবেন।’
‘আমার স্ত্রীর একটা ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছি। আপনার নাম শুনেই এসেছি।’
‘আমার নাম শুনে এসেছেন?’
‘জ্বি।
‘আমার এত নাম ডাক আছে, তা তো জানতাম না! স্পেসিফিক্যালি বলুন তো কার কাছে শুনেছেন?’
আনিস আমতা-আমতা করতে লাগল। ভদ্রলোক অসহিষ্ণু স্বরে বললেন, ‘বলুন, কে বলল?’
‘আমাদের অফিসের এক ভদ্রলোক। কমলেন্দুবাবু। আপনি নাকি তার বোনের চিকিৎসা করেছিলেন।’
‘ও আচ্ছা,চিনেছি, কমলেন্দু। শোনেন, আমি ডাক্তার না, জানেন তো?’
‘জ্বি স্যার, জানি।’
‘আচ্ছা আগে এক কাপ চা খান, তারপর কথা বলব। রুগীটি কে বললেন?’ আপনার স্ত্রী?’
‘জ্বি।
‘বয়স কত?’
‘ষোল-সতের।’
‘বলেন কী! আপনার বয়স তো মনে হয় চল্লিশের মতো, ঠিক না?’
আনিস শুকনো গলায় বলল, ‘আমার সাঁইত্রিশ।’
‘এমন অল্প বয়সি মেয়েকে বিয়ে করেছেন কেন?’
এটা আবার কেমন প্রশ্ন। আনিসের মনে হলো, কমলেন্দুবাবুর কথা শুনে এখানে আসাটা ঠিক হয় নি। ভদ্রলোকের নিজেরই মনে হয় মাথার ঠিক নেই। একজন অপরিচিত মানুষকে কেউ এ রকম কথা জিজ্ঞে করে?’
‘বলুন বলুন, এ রকম অল্পবয়েসী মেয়ে বিয়ে করলেন কেন?’
‘হয়ে গেছে আর কি।’
‘বলতে চান না বোঝা যাচ্ছে। ঠিক আছে, বলতে হবে না। চা‘র কথা বলে আসি। চা খেয়ে তারপর শুরু করব।
ভদ্রলোক আনিসকে বাইরে বসিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। তারপর আর আসার নামগন্ধ নেই। আট-ন’ বছরের একটি বাচ্চা মেয়েমেয়ে এক কাপ দারুণ মিষ্টি সর-ভাসা চা দিয়ে চলে গেল। তারপর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। দেখতে-দেখতে সন্ধ্যা হয়ে যায় । আনিস বেশ কয়েকবার কাশল। দুই বার গলা উঁচিয়ে ডাকল, ‘বাসায় কেউ আছেন?’ কোনো সাড়া নেই। কী ঝামেলা!
কমলেন্দুবাবু অবশ্য বারবার বলে দিয়েছেন-এই লোকের কথাবার্তার ঠিকঠিকানা নেই। তবে লোকটা অসাধারণ। আনিসের কাছে অসাধারণ কিছু মনে হয় নি। তবে চোখের দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ। এইটি অবশ্য প্রথমেই চোখে পড়ে। আর দ্বিতীয় যে জিনিসটি চোখে পড়ে, সেটি হচ্ছে তার আঙ্গুল। অস্বাভাবিক লম্বা-লম্বা তার সব ক‘টা আঙ্গুল।
‘এই যে, অকেক্ষণ বসিয়ে রাখলাম।’
‘না, ঠিক আছে।’
‘ঠিক থাকবে কেন? ঠিক না।’
লোকটি এই প্রথম বার হাসল। থেমে-থেমে বলল, ‘আলসার আছে তো, ব্যথায় কাহিল হয়ে শুয়েছিলাম। অমনি ঘুম এসে গেল।’
‘আমি তাহলে অন্য একদিন আসি?’
‘না, এসেছেন যখন বসুন। চা দিয়েছিল?’
‘জ্বি।’
‘বেশ, এখন বলুন কী বলবেন?’
আনিস চুপ করে রইল। এটা এমন একটা ব্যাপার, যা চট করে অপরিচিত কাউকে বলা যায় না। ভদ্রলোক শান্ত স্বরে বললেন, ‘আপনার স্ত্রীর মাথার ঠিক নেই, তাই তো?’
‘জ্বি-না স্যার, মাথা ঠিক আছে।’
‘পাগল নন?’
‘জ্বি-না।’
‘তাহলে আমার কাছে এসেছেন কেন?’
‘মাঝে-মাঝে সে অস্বাভাবিক আচরণ করে।’
‘কী রকম অস্বাভাবিক?’
‘ভয় পায়। মাঝে-মাঝেই এ রকম হয়।’
‘ভয় পায়? তার মানে কী? কিসের ভয়?’
‘ভূতের ভয়।’
‘ঠিক জানেন ভয়টা ভূতের?’
‘জ্বি-না, ঠিক জানি না। মনে হয় এ রকম।’
ভদ্রলোক একটি চুরুট ধরিয়ে খকখক করে কাশতে-কাশতে বললেন, ‘বর্মা থেকে আমার এক বন্ধু এনছে, অতি বাজে জিনিস।’ আনিস কিছু বলল না। তবে এই ভদ্র লোকের স্টাইলটি তার পছন্দ হলো। ভদ্রলোক অবলীলায় অন্য একটি প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। এবং এমনভাবে কথা বলছেন, যেন আগের কথাবার্তা তাঁর কিছুই মনে নেই।
‘এ রকম চুরুট চার-পাঁচটা খেলে যক্ষ্মা হয়ে যাবে। আপনাকে দেব একটা?’
‘জ্বি-না।’
‘ফেলে দিলে মায়া লাগে বলে খাই। খাওয়ার জিনিস না। অখাদ্য। তবে হাভানা চুরুটগুলি ভালো হয়। হাভানা চুরুট খেয়েছেন কখনো?’
‘জ্বি-না।
‘খুব ভালো। মাঝে-মাঝে আমার এক বন্ধু আমাকে দিয়ে যায়।’
ভদ্রলোক চুরুটে টান দিয়ে আবার ঘর কাঁপিয়ে কাশতে লাগলেন। কাশি থামতেই বললেন, ‘এখন আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। যথাযথ উত্তর দেবেন।
‘জ্বি আচ্ছা।’
‘প্রথম প্রশ্ন, আপনার স্ত্রী কি সুন্দরী?’
‘জ্বি।’
‘বেশ সুন্দরী?’
‘জ্বি।’
‘আপনার স্ত্রী কখন ভয় পান-রাতে না দিনে?’
‘সাধারণত রাতে। তবে একবার দুপুরে ভয় পেয়েছিল।’
‘ভয়টা কী রকম সেটা বলেন।’
‘মনে হয় কিছু-একটা দেখে।’
‘সব বার কি একই জিনিস দেখে না একেক বার একেক রকম?’
‘এটা আমি ঠিক বলতে পারছি না।’
‘এই সময় তিনি কি কোনো রকম গন্ধ পান?’
‘আমি ঠিক বলতে পারছি না।’
‘যখন সুস্থ হয়ে ওঠেন তখন কি তাঁর ভয়ের কথা মনে থাকে?’
‘বেশিরভাগ সময়ই থাকে না, তবে মাঝে-মাঝে থাকে।’
‘আপনার স্ত্রীর স্বাস’্য নিশ্চই খারাপ।’
‘জ্বি।
‘উনি প্রথম কখন ভয় পেয়েছিলেন, বলতে পারেন?’
‘জ্বি-না। তবে খুব ছোটবেলায়।
‘প্রথম ভয়ের ঘটনাটা আমাকে বলুন।’
‘আমি সেটা ঠিক জানি না।’
‘আপনি অনেক কিছুই জানেন না মনে হচ্ছে। আপনার স্ত্রীকে একদিন নিয়ে আসুন।’
আনিস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমি তাকে আনতে চাই না।’
‘কেন চান না?’
‘সে খুব সেনসিটিভ। সে যদি টের পায় যে, তার অস্বাভাবিকতা নিয়ে আমি লোকজনের সাথেঘ আলাপ করছি, তাহলে খুব মন-খারাপ করবে।’
‘দেখুন ভাই, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা না-বলে কিছুই করা যাবে না। আপনার স্ত্রী অসুস্থ এবং আমার মনে হচ্ছে এই অসুখ দ্রুত বেড়ে যাবে। আপনি তাঁকে নিয়ে আসবেন।’
আনিস উঠে দাঁড়াল। ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘আপনাকে কত দেব?’
ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কমলেন্দবাবু কি আপনাকে বলেন নি আমি ফিস নিই না? এই কাজটি আমি শখের খাতিরে করি, বুঝতে পারছেন?’
‘জ্বি পারছি।’
‘তবে আপনি যদি ভালো গোলাপের চারা পান, তাহলে আমাকে দিতে পারেন। আমার গোলাপের খুব শখ। সব মিলিয়ে ত্রিশটি ডিফারেন্ট ভেরাইটির চারা আমার কাছে আছে। একটা আছে দারুন ইন্টারেস্টিং, ঘাসফুলের মতো ছোট সাইজের গোলাপ।’
‘তাই নাকি?’
‘জ্বি। ওরা বলে মাইক্রো রোজ। হল্যান্ডের গোলাপ। কড়া গন্ধ। দেখবেন?’
‘আরেক দিন দেখব। আজ দেরি হয়ে গেছে, আমার স্ত্রী একা থাকে।’
‘ও, তাই নাকি? শোনেন, একা তাকে রাখবেন না। কখনো যেন মেয়েটি একা না থাকে। এটা খুবই জরুরি।’
রাস্তায় নেমে আনিসের মন খারাপ হয়ে গেল। খামোকা সময় নষ্ট। লোকটি তেমন কিছুই জানে না। কমলেন্দুবাবু যে সব আধ্যাত্মিক শক্তিটক্তির কথা বলেছেন, সে সব মনে হয় নেহায়েতই গালগল্প। তবে লোকটির কথাবার্তা বেশ ফোর্সফুল। রানুকে বুঝিয়েসুঝিয়ে এক বার এনে দেখালে হয়। ক্ষতি তো কিছু নেই।
তাছাড়া ভদ্রলোক খুব সম্ভব ফ্যালনাও নন। ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রির টীচার। একেবারে কিছু না-জেনে তো কেউ মাষ্টারি করে না। কিছু নিশ্চই জানেন। মানুষের চেহারা দেখে কিছু অনুমান করাটাও ঠিক না।