গোরাচাঁদ আর কালাচাঁদ দুই ভাই। তাহারা সহোদর নহে, —সম্বন্ধ অতি দুর। সেকালে এমন দূর-সম্পৰ্কীয় ব্যক্তিও আপন হইয়া যাইত। গোরাচাঁদের পিতার এক মাস্তুতো ভাই বড়ই দরিদ্র ছিলেন। তাঁহার সংসারে একমাত্র স্ত্রী ছিলেন, আর কেহই ছিল না। একটা পুত্রসন্তান প্রসব করিয়াই এই মাসতুতো ভাইয়ের স্ত্রী যখন মারা যান, তখন গোরাচাঁদের পিতা এই মাতৃহীন শিশুটীর লালন-পালনের ভার গ্রহণ করেন। ছেলেটীর রং বড়ই কালো বলিয়া গোরাচাঁদের পিতা নিজপুত্র গোরাচাঁদের নামের সঙ্গে মিল করিয়া এই ছেলেটীর নাম রাখেন কালাচাঁদ।
গোরাচাঁদ আর কালাচাঁদ সহোদরের মতই প্রতিপালিত হইয়াছিলেন। যাঁহারা প্রকৃত সংবাদ জানিতেন না, তাঁহারা মনে করিতেন, ইঁহারা সহোদর ভ্রাতা। কিন্তু দুই ভাইয়ের প্রকৃতি এমন বিভিন্ন ছিল যে, চক্ষুস্মান ব্যক্তিমাত্রেই বলিতে পারিতেন, এক পিতার ঔরসে, এক মায়ের গর্ভে এমন বিরুদ্ধ স্বভাবের দুই ভাই জন্মগ্রহণই করিতে পারে না। গোরাচাঁদ সৰ্ব্ববিষয়েই গোরাচাঁদ, আর কালাচাঁদ ভিতর-বাহিরেই কালাচাঁদ।
ইঁহাদের উপাধি মুখোপাধ্যায়,-মহা কুলীন, ফুলের মুখুটী, বিষ্ণুঠাকুরের সন্তান। বাড়ী সুবর্ণপুর। অবস্থা তেমন মন্দই বা কি? জমাজমি যাহা আছে, তাহাতে বেশ চলিয়া যায় এবং দুপয়সা সঞ্চয়ও হয়। তাহার পর কালাচাঁদ মুখুয্যে যেমন-তেমন লোক নহে; যেখানে সূচ প্রবেশের পথও লোকে দেখিতে পায় না, কালু মুখুয্যে সেখানে হাতী চালাইতে পারে। বড় ভাই গোরাচাঁদ অতি কোমল-প্রকৃতি, সদাশয় ব্যক্তি। তিনি গ্রামের বিদ্যালয় হইতে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফেল করিয়াই পড়াশুনা ত্যাগ করিয়াছিলেন। পিতা যতদিন বাঁচিয়া ছিলেন, ততদিন তিনিই বিষয়-কৰ্ম্মের তত্ত্বাবধান করিতেন, গোরাচাঁদকে কিছুই দেখিতে হইত না। পিতা যখন পরলোকগত হইলেন, তখন কালাচাঁদের বয়স কুড়ি বৎসর; কিন্তু সেই বয়সেই তাহার বুদ্ধি-বিবেচনা এমন পরিপক্ক হইয়াছিল যে, গোরাচাঁদ আর বিষয়-কৰ্ম্মের ভার গ্রহণ করিলেন না, কালাচাঁদের উপরেই সম্পূর্ণ নির্ভর করিয়া সেই বয়সেই অর্থাৎ ২৬ বৎসর বয়সেই ধৰ্ম্মকৰ্ম্মে মনোনিবেশ করিলেন। তিনি খান-দান, পূজার্চ্চনা করেন, গ্রামের দশজনের সুখ-দুঃখের সময় উপস্থিত হন এবং যথাসাধ্য সকলের সাহায্য করেন। গ্রামের সকলেই তাঁহাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করিত।
কালাচাঁদ কিন্তু গোরাচাঁদের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল; দয়াধৰ্ম্ম তাহার ছিল না। যাহাতে দুপয়সা প্রাপ্তি হয়, এই চিন্তাতেই সে নিবিষ্ট থাকিত। এতদ্ব্যতীত তাহার স্বভাব-চরিত্রও তেমন, ভাল ছিল না।
গোরাচাঁদ ভুলিয়াই গিয়াছিলেন যে, কালাচাঁদ তাঁহার দুরসম্পর্কের ভাই—বলিতে গেলে কেহই নহে; কিন্তু তাঁহার পিতা মৃত্যুকালে বলিয়া গিয়াছিলেন যে, কালাচাঁদকে যখন তিনি পুত্রনিৰ্ব্বিশেষে পালন করিয়াছেন এবং তাহার যখন আর কেহই নাই, তখন গোরাচাঁদ যেন তাহাকে কিছুতেই পরিত্যাগ না করে; নিজের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বলিয়া মনে করে। গোরাচাঁদ তাহাই করিয়াছেন, কালাচাঁদের উপরেই সমস্ত ভার দিয়া তিনি নিশ্চিন্ত। কালাচাঁদ কাজকৰ্ম্মে খুব উপযুক্ত; এ অবস্থায় তাহার চরিত্র-দোষ এবং অন্তবিধ অত্যাচারের কথা শুনিয়াও গোরাচাঁদ মুখ ফুটিয়া তাহাকে কিছু বলিতে পারিতেন না-শাসন করা ত দুরের কথা।
বাড়ীতে স্ত্রীলোকের মধ্যে দুই ভাইয়ের স্ত্রী; গোরাচাঁদের মাতাঠাকুরাণী অনেক দিন হইল, পিতা পরলোক গমনের পূৰ্ব্বেই দেহত্যাগ করিয়াছিলেন। গোরাচাঁদের স্ত্রী পরমা সুন্দরী ছিলেন; তাঁহার পিতৃকুলে কেহই ছিলনা। একটী কন্যা ব্যতীত তাঁহার আর সন্তানও হয় নাই।
গোরাচাঁদ যেমন মানুষ ছিলেন, তাঁহার স্ত্রীও তেমনই লক্ষীস্বরূপিনী; কিন্তু কালাচাঁদের স্ত্রীর অবস্থা বড়ই শোচনীয় ছিল। কালাচাঁদ নিজেও কালাচাঁদ, তাহার অদৃষ্টে প্রজাপতি মিলাইয়া দিয়াছিলেনও তেমনই অর্দ্ধাঙ্গিনী। শুনিতে পাওয়া যায়, সম্পন্ন গৃহস্থের একমাত্র কন্যা দেখিয়া গোরাচাঁদের পিতা কালাচাঁদের ভবিষ্যতের কথা ভাবিয়াই কুৎসিত মেয়েটীকে কালাচাঁদের অঙ্কলক্ষ্মী করিয়া দিয়াছিলেন। দেখিতে কুৎসিত হইলেও কালাচাঁদের স্ত্রী বড় ভাল মেয়ে। স্বামী যে তাহাকে দুইচক্ষে দেখিতে পারিত না, কোন দিন ভাল মুখে একটা কথাও বলিত না, সৰ্ব্বদা দূর দূর করিত, তাহাতেও কিন্তু ব্রাহ্মণ-কন্যাকে কেহ বিচলিত দেখে নাই। ছোটবধু মন্দাকিনী বড় যায়ের মুখের দিকে চাহিয়া, তাঁহার স্নেহ আদরের অধিকারিণী হইয়া স্বামীর অনাদর নির্য্যাতন নীরবে সহ করিতেন। বড়-যা মানদা তাঁহার স্নেহের অঞ্চল দিয়া এই অভাগিনী ছোট যাকে ঢাকিয়া রাখিতেন। দেবর স্বামীর ছয় বৎসরের ছোট হইলেও মানদা কোন দিন তাহার সহিত কথা বলিতেন না। সাধারণতঃ, দেবরের সহিত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃবধু যে প্রকার ব্যবহার করিয়া থাকে, পরস্পরের মধ্যে যে প্রকার সম্বন্ধ প্রায় সকল গৃহস্থের বাড়ীতেই দেখিতে পাওয়া যায়, মানদা সে রকম ভাবে দেবরের সঙ্গে ব্যবহার করিতেন না। তিনি দেবরকে যে ঘৃণা করিতেন তাহা নহে; কিন্তু কালাচাঁদের ব্যবহার তাহার নিকট ভাল বোধ হইত না। এই কারণে তাহার সহিত ঘনিষ্ঠতা করিতেন না। কালচাঁদ, অনেক সময়ে এ জন্য বিরক্তি প্রকাশ করিত, রাগ করিত, অনেক ঠাট্টা-তামাসাও করিত; কিন্তু মানদা তাহাতে কৰ্ণপাতও করিতেন না। দুই যায়ে সংসারের কাজকৰ্ম্ম করিতেন, একমাত্র কন্যা সুহারের লালন-পালন করিতেন।
কালাচাঁদের একটা গুণ ছিল; সে নানা উপায়ে অর্থ উপার্জ্জন করিত, ন্যায় অন্যায় অবিচার অত্যাচার করিয়া টাকা, সংগ্ৰহ করিত; টাকার জন্য কাহারও প্রাণনাশ করিতেও হয়ত দ্বিধা বোধ করিত না; ব্যয়ের বেলায় কিন্তু সে ভারি হিসাবী ছিল। যাহাদের স্বভাব-চরিত্র খারাপ হয়, তাহারা অপব্যয়ী হইয়া থাকে; তাহাদের হাতে বিষয় বা টাকাকড়ি পড়িলে তাহারা দুইদিনেই উড়াইয়া সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়া পড়ে। কালাচাঁদ কিন্তু সে রকমের মানুষ ছিল না। তাহার স্বভাব অতি মন্দ ছিল; কিন্তু সে ব্যাপারেও সে মুক্তহস্ত ছিল না; সে বিশেষ হিসাব করিয়াই অপব্যয় করিত। তাহার রোজগারের অনুপাতে সে ব্যয় অতি সামান্য বলিলেই হয়। সংসার-খরচের দিকেও তাহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল; কোন প্রকারে ছপয়সা বেশী খরচ হইবার যো ছিল না। অথচ কাহার জন্য যে সে জোতজমা বৃদ্ধি করিতেছিল, অর্থ সঞ্চয় করিতেছিল, লগ্নী কারবারে একেবারে পিশাচের ন্যায় ব্যবহার করিত, কাহাকেও একটা পয়সা রেন্থাই দিত না, তাহা বুঝিয়া উঠা যাইত না। স্ত্রীর সহিত তাহার মুখ দেখাদেখিও ছিল না; সে রাত্রিতে বাড়ীতেই থাকিত না। সংসারে অবলম্বন একমাত্র তাহার দাদার মেয়েটী। তাহাকেও সে তেমন আদর-যত্ন করিত না; তাহার জন্যও কখন কোন দ্রব্য কিনিয়া দিত না। তবুও যে কেন যে এমন করিয়া অর্থ উপার্জন করিত, সেই জানে। গোরাচাঁদ যদি কখন কোন বিষয়ে কিছু বলিতেন, তাহা হইলে কালাচাঁদ অতি গম্ভীর ভাবে বলিত, “সময় অসময় আছে দাদা! চারিদিকে দেখে-শুনে খরচ করতে হয়। দু-দশ টাকা হাতে না থাক্লে কি মান-সম্ভ্রম রক্ষা করে চলা যায় না, না দশজনে মানে চেনে।” গোরাচাঁদ আর দ্বিরুক্তি করিতেন না।
এই ভাবেই কয়েক বৎসর গেল। তাহার পরই এই মুখোপাধ্যায় পরিবারে এক অভাবনীয় পৈশাচিক দৃশ্যের অভিনয় হইল। সেই কথা বলিবার জন্যই তাঁহাদের পরিবারের এই পরিচয়টুকু দিতে হইল।
আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, তাহার ছয়মাস পূর্ব্বে গোরাচাঁদ মুখোপাধ্যায় মহাশয় প্রায় মাসাধিক কাল জ্বরে ভুগিয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছেন। তাঁহার কন্যা সুহারের বয়স তখন বার বৎসর। মানদার এতদিন যখন সামান্য যাহা প্রয়োজন হইত, গোরাচাঁদকে বলিলেই তাহা পূর্ণ হইত; এখন দুইটী পয়সার প্রয়োজন হইলেই কালাচাঁদের কাছে দরবার করিতে হয়। তিনি কালাচাঁদের সহিত কথা বলিতেন না; সুহারের দ্বারাই কালাচাঁদের কাছে অভাবের কথা জানাইতে হইত। কালাচাঁদ ইহাতে, বড়ই বিরক্ত হইত; বলিত, “কেন? তোর মায়ের মুখ নেই, সে কি বোবা; যখন যা দরকার হয়, আমার কাছে নিজে চাইলেই পারে। তোর মা নিজে মুখে না চাইলে আমি কোন কথা শুনব না।” এই কারণে সুহারও তাহার কাকার কাছে কিছু বলিতে চাহিত না; তাহার মাকে বলিত “মা, তুমি কাকার সঙ্গে কথা বল্লেই পার? তা হ’লে ত কাকা এমন রাগ করতে পারবেন না।”
মানদা বলিতেন, “না মা, তিনি বেঁচে থাক্তে এতকাল যখন ঠাকুরপোর সঙ্গে কথা বলি নাই, তাঁকে দেখে লজ্জা করে এসেছি, এখন কি আর কথা বলা যায়। যাক্, আমার আর কয় দিনই বা ভিক্ষা করতে হবে। কোন রকমে তোকে পার করতে পারলেই হয়; তারপর আর আমার কিছুরই দরকার হবে না।”
এদিকে কালাচাঁদও যেন একটু বাড়াবাড়ি আরম্ভ করিল। সে যখন-তখনই বাড়ীর মধ্যে আসিয়া “বড় বৌ, এটা দেও, ওটা দেও” বলিয়া মানদাকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তোলে; ঠাট্টা-তামাসার মাত্রাও যেন ক্রমেই বাড়িয়া যাইতে লাগিল। মানদার বয়স তখনও বেশী হয় নাই; পনর বৎসর বয়সে সুহার জন্মগ্রহণ করে; সুহারের বয়স এখন বার বৎসর; সুতরাং মানদা সাতাশ বৎসরের যুবতী। তাঁহার শরীরেও কোন রোগ ছিল না।
কালাচাঁদ এতদিন বাহিরেই বেশী থাকিত; বিশেষ প্রয়োজন না হইলে বাড়ীর মধ্যে আসিত না; এবং যখন যাহা চাহিত, মানদা মন্দাকিনীর দ্বারাই তাহা যোগাইয়া দিতেন, নিজে বড়-একটা সম্মুখে যাইতেন না। ইহাতে মন্দাকিনীকে সৰ্ব্বদাই লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হইত, স্বামীর কটূক্তি শুনিতে হইত; কিন্তু বড়-দিদির কথা তিনি কিছুতেই অমান্য করিতে পারিতেন না, কাজেই সমস্ত তিরস্কার, অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করিতে হইত।
দিন কয়েক পূৰ্ব্বে কালাচাঁদের নিকট পত্র আসিল যে, তাহার শাশুড়ী অত্যন্ত পীড়িতা, বাঁচিবার আশা নাই; মন্দাকিনীকে তাঁহারা একবার লইয়া যাইতে চান। কালাচাঁদের তাহাতে কোন দিনই আপত্তি ছিল না——ও-পাপ বিদায় হইলেই সে বাঁচে। পূৰ্ব্বেও অনেকবার মন্দাকিনী পিত্রালয়ে গিয়াছেন; কিন্তু দুইমাস যাইতে না যাইতেই গোরাচাঁদ নিজে যাইয়া ভাদ্রবধূকে বাড়ী লইয়া আসিতেন; মন্দাকিনীর পিতা মাতা আপত্তি করিতে পারিতেন না। এবার শাশুড়ীর পীড়ার সংবাদ পাইয়া কালাচাঁদ শ্বশুর-বাড়ীতে পত্র লিখিয়া দিয়াছিল যে, তাঁহাদের যখন ইচ্ছা, তখনই মন্দাকিনীকে লইয়া যাইতে পারেন; তাহার কোনই আপত্তি নাই। এই পত্র পাইয়াই মন্দাকিনীর পিতা কন্যাকে লইয়া যাইবার জন্য লোক প্রেরণ করিলেন। মানদা মন্দাকিনীকে বারবার বলিয়া দিলেন যে, মাকে একটু সুস্থ দেখিলেই সে; ষেন চলিয়া আসে– “দেখ্ছ ত ভাই, আমি একেলা মানুষ, কথা বল্বার লোকটী নেই। তুই না থাক্লে আমার বড়ই কষ্ট হবে। এতদিন তবুও তিনি বেঁচে ছিলেন। এখন যে আমার সব দিক্ অন্ধকার। তুই থাক্লে কথায়-বাৰ্ত্তায় কাজে-কৰ্ম্মে দিনগুলো কেটে যায়। দেখিস্ ভাই, বেশী বিলম্ব করিস না।” মন্দাকিনী মানদার পদধূলি লইয়া বলিল “না দিদি, তোমাকে এমন একেলা ফেলে কি আমি সেখানে থাক্তে পারি; মাকে একটু ভাল দেখ্লেই আমি চলে আস্ব ।”
সেদিন একাদশী। কালু মুখুয্যের বাড়ীর পাশেই তাহাদের জ্ঞাতি চণ্ডী মুখুয্যের বাড়ী। চণ্ডী বাবুর অবস্থা পূৰ্ব্বে তেমন ভাল ছিল না। তাঁহার পিতা জ্যেষ্ঠা কন্যা রমাসুন্দরীর দেবগ্রামের জমিদার হরিপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের সহিত বিবাহ দেন এবং তদুপলক্ষে কিছু জমিজমা ও নগদ টাকা পান। চণ্ডী মুখুয্যের সেই জোত-জমার আয়েই চলে এবং যখন যা দরকার হয়, দেবগ্রামে দিদির নিকট চাইলেই তাহা পূর্ণ হয়। চণ্ডী বাবুর পরপর ছয়টী মেয়ের পর এবার একটী পুত্র-সন্তান হইয়াছে। ছয় মেয়ের পর ছেলে, তাহার অন্নপ্রাশনে ঘটা না করিলে কি ভাল দেখায়। তাই তিনি অনেক আত্মীয়-কুটুম্ব নিমন্ত্ৰণ করিয়াছেন। তাঁহার দিদিও এই শুভকৰ্ম্ম উপলক্ষে সুবর্ণপুরে আসিয়াছেন। জমিদার হরিপ্রসন্ন বাবুর মৃত্যু হইয়াছে; উপযুক্ত পুত্র সিদ্ধেশ্বর বাবুই এখন মালিক। মায়ের সঙ্গে সিদ্ধেশ্বর বাবুও মাতুল-পুত্রের অন্নপ্রাশন উপলক্ষে আসিয়াছেন। বলা বাহুল্য যে, এই অন্নপ্রাশনের সমস্ত ব্যয়ভারই চণ্ডী বাবুর দিদি বহন করিয়াছেন। সঙ্গে লোকজন, দাস-দাসীও অনেক আসিয়াছে। এই একাদশীর দিনই অন্নপ্রাশন। গ্রামের ভদ্র ইতর সকল লোকই নিমন্ত্রিত হইয়াছে। কালাচাঁদের বাড়ীতে আজ আর উনানে হাঁড়ি চড়াইবারই প্রয়োজন হয় নাই। মানদার একাদশী; কালাচাঁদ ও-বাড়ীর ব্যাপারেই নিযুক্ত; সুহার এবং চাকর-চাকরাণীরা সকলেই সেখানে নিমন্ত্রণ খাইয়াছে। লোকজনের আহারাদি শেষ হইতে প্রায় অপরাহ্ণ হইয়া গিয়াছিল। কালাচাঁদ সন্ধ্যার সময় বাড়ীতে আসিয়া পুনরায় স্নান করিয়া চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে আহার করিতে গেল,—দিনমানে আর তাহার আহার হয় নাই।
রাত্রিতে কালাচাঁদ বাড়ীতে থাকিত না; তাহার রাত্রি-বাসের অন্য স্থান ছিল। বাড়ীতে বৃদ্ধ দাসী গোপালের মা রাত্ৰিতে মানদার ঘরের বারান্দায় শয়ন করিত; বাহিরে বৈঠকখানায় দুইজন চাকর থাকিত। মন্দাকিনীর ঘর এ কয়দিন বন্ধই আছে। মন্দাকিনী এখানে থাকিবার সময়েও রাত্রিতে মানদার ঘরেই তিনি শয়ন করিতেন।
একে বৈশাখ মাস, তাহাতে একাদশী। মানদা ক্লান্ত হইয়া তাঁহার ঘরের বারান্দায় একখানি মাদুর পাতিয়া শয়ন করিয়া ছিলেন। গোপালের মা অন্য দিন সেই বারান্দার অপর পাশেই শয়ন করিত। সে দিন মানদাকে বারান্দায় শয়ন করিতে দেখিয়া সে মন্দাকিনীর ঘরের বারান্দায় সুহারকে লইয়া শয়ন করিয়া তাহাকে নানা গল্প শুনাইতেছিল; তখনও তাহাদের নিদ্রাকর্ষণ হয় নাই।
রাত্রি তখন সাতটা বাজিয়া গিয়াছে।কালাচাঁদ চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে আহার শেষ করিয়া বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। গোপালের মা ও সুহার তখনও জাগিয়া ছিল। কালাচাঁদকে আসিতে দেখিয়া তাহারা গল্প বন্ধ করিয়া চুপ করিয়া শুইয়া রহিল। কালাচাঁদ প্রাঙ্গণ অতিক্রম করিয়া মানদার ঘরের বারানায় উঠিয়া ডাকিল “বড়বৌ, একবার ওঠ ত ।”
কালাচাঁদের আহবান শুনিয়াই মানদা বস্ত্রাদি সংযত করিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়লেন।
কালাচাঁদ বলিল “বড়বৌ, কাল যে তোমার কাছে একটা কাগজের বাণ্ডিল রেখেছিলাম, সেইটা বের করে দাও ত। এখনই দরকার।”
মানদার ঘরের মধ্যে আলো ছিল না। তিনি আলো জ্বালিবারও প্রয়োজন বোধ করিলেন না, কারণ সেই কাগজের বাণ্ডিলটা তিনি বাহিরে তাকের উপরই রাখিয়াছিলেন। অন্ধকারেই তাহা আনিয়া দিতে পারিবেন ভাবিয়া তিনি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। তিনি প্রবেশ করিতে না করতেই কালাচাঁদ সেই অন্ধকার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। বোধ হয় এক মিনিটও অতীত হয় নাই—মানদা ঘরের মধ্যে চীৎকার করিয়া উঠিল। সে ভীষণ চীৎকার!
সেই চীৎকার শুনিয়াই গোপালের মা ও সুহার তাড়াতাড়ি উঠানে নামিয়া জ্যোৎস্নার আলোকে দেখিল মানদার ঘরের দ্বার বন্ধ এবং ভিতরে কেমন যেন “গোঁ গোঁ” শব্দ হইতেছে। সুহার কাঁদিয়া উঠিল; গোপালের মা চীৎকার করিতে করিতে পাশের বাড়ীর দিকে দৌড়িল “ওগো, তোমরা এসে গো! সৰ্ব্বনাশ হোলে! ছোট বাবু বড়-মাকে মেরে ফেলছে গো!”
চণ্ডী বাবুর বাড়ী তখন আত্মীয় কুটুম্বে পূর্ণ! গোপালের মায়ের চীৎকার এবং সুহারের ক্ৰন্দনের শব্দ শুনিয়া স্ত্রীপুরুষ যিনি যে অবস্থায় ছিলেন, উৰ্দ্ধশ্বাসে এ-বাড়ীতে আসিয়া পড়িলেন। সকলের মুখেই “কি হয়েছে? ব্যাপার কি ?” শব্দ।
গোপালের মা চীৎকার করিয়া বলিল “ওগো, শীগগির বড় মায়ের ঘরের দোর ভেঙ্গে ফেল! হায় হায়, ছোটবাবু বুঝি তাকে মেরে ফেল্লে গো।”
তখন চণ্ডী বাবু ও আরও দুই তিনজন একসঙ্গে মানদার ঘরের বারান্দায় উঠিয়া দেখেন দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ। ঘরের মধ্যে কি যেন একটা ‘গোঁ গোঁ’ শব্দ হইতেছে। আর বিলম্ব না করিয়া তাঁহারা দুয়ারে পদাঘাত করিতে লাগিলেন। চার পাঁচ আঘাতেই দ্বারের অর্গল ভাঙ্গিয়া গেল। ঘর অন্ধকার! মেজের এক কোণ হইতে কেবল একটা কাতরোক্তি শুনিতে পাওয়া যাইতেছিল। একজনের হাতে একটা দিয়াশলাই ছিল; সে একটা কাঠি জ্বালিতেই ঘরের মধ্যের অন্ধকার দূর হইল। সকলে সভয়ে দেখিল, মানদা ঘরের মেজের উপর পড়িয়া আছেন। তাঁহারই কণ্ঠ হইতে অব্যক্ত কাতরোক্তি বাহির হইতেছে। ঘরের চারিদিকে দেখিবার পূৰ্ব্বেই দিয়াশলাই নিবিয়া গেল। চণ্ডী বাবু বলিলেন “খবরদার, তোমরা দোর আগ্লে, দাঁড়াও, পাজিটা যেন পালাতে না পারে। আর একটা দিয়াশলাই জ্বাল।”
আর দিয়াসলাই জ্বালিতে হইল না; চণ্ডী বাবুর বাড়ী হইতে তিন-চারিটা লণ্ঠন আসিয়া উপস্থিত হইল। প্রাঙ্গণ তখন লোকে পূর্ণ হইয়া গিয়াছে।
চণ্ডী বাবু তখন চীৎকার করিয়া বলিলেন “ওগো, তোমরা মেয়েরা কে এসেছ, শীগ্গির ঘরের মধ্যে এস। বড়-বৌ যে কেমন করছেন?”
এই কথা শুনিয়াই চণ্ডী বাবুর দিদি অগ্রসর হইলেন। তাঁহাকে ঘরে প্রবেশ করিতে দেখিয়াই দ্বারের নিকট যাঁহারা ছিলেন, তাঁহারা একটু সরিয়া দাঁড়াইলেন।
কালাচাঁদ তখন দ্বারের আড়ালে দাঁড়াইয়া ছিল। সে মনে করিল, এই তাহার পলায়নের সুযোগ; সে ঘরের অন্য যে দ্বার ছিল, তাহা খুলিবার উপায় ছিল না। সে তখন রমামুন্দরীকে এক ধাক্কা দিয়া বারান্দায় আসিয়া পড়িল। সকলেই সতর্ক ছিল—তাহার আর পলায়নের পথ হইল না। একজন তাহাকে এমন এক ধাক্কা দিল যে, সে বারান্দা হইতে একেবারে নীচের উঠানে পড়িয়া গেল। তিনচারি জন আসিয়া তাহাকে চাপিয়া ধরিল; দু-চারটী উত্তম-মধ্যমও হইয়া গেল।
সিদ্ধেশ্বর বাবু বাহিরে উঠানে দাঁড়াইয়া ছিলেন। তিনি বলিলেন “আহা মেরো না গো! যাতে পালাতে না পারে, তাই কর। কোন অত্যাচার কোরে না।”
চণ্ডী বাবু তখন বারান্দা হইতে নামিতে নামিতে বলিলেন “ঘরের মধ্যে আর গোল করে কাজ নাই। মেয়েরাই যা হয় করবেন। তোমরা নেমে এস।”
প্রাঙ্গণে আসিয়া দেখেন, পাড়ার অনেক লোক আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। চণ্ডী বাবু বলিলেন “আর এখানে গোল করে কাজ নেই; আমার ওখানে যাওয়া যাক্। সেখানে গিয়ে যা কৰ্ত্তব্য তা স্থির করা যাবে।” চাকরদের উদ্দেশ করিয়া বলিলেন “ওরে, তোরা তিন চারজন এখানে থাক, দিদি যা বলেন তাই করিস।”
রমাসুন্দরী ঘরের মধ্যে হইতেই বলিলেন “কোন ভয় নেই, জ্ঞান হয়েছে। ডাক্তার ডাকতে হবে না। তোমরা বাড়ীতে যাও।”
একজন বলিল “ওরে, হারামজাদা যেন পালিয়ে যেতে না পারে।” এই বলিয়া কালাচাঁদকে পদাঘাত করিল। কালাচাঁদের মুখে আর কথা নাই; সে চোরের মত, মার খাইতে লাগিল। যে মারিতে নিষেধ করে, সেও কিন্তু দুই-ঘা দিয়া পথ দেখায়।
কালাচাঁদকে লইয়া সকলে চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন। সেখানে বৈঠক বসিল; পাড়ার মাতব্বরেরা সকলেই ছিলেন যুবকেরাও উপস্থিত। তখন কথা উঠিল, কর্ত্তব্য কি? কালাচাঁদ যে পাপ কার্য্য করিয়াছে, তাহার আর প্রায়শ্চিত্ত নাই।
বৃদ্ধ চক্রবর্ত্তী মহাশয় বলিলেন “যা হবার তা হয়ে গিয়েছে; এখন আর সে কথা নিয়ে আন্দোলন করে কি লাভ হবে। অধিক লোক-জানাজানি করে সুধু কলঙ্ক বাড়ানো। এখন চেপে যাওয়াই কর্ত্তব্য। এতবড় সম্মানী ঘর, মুখুয্যেদের দেশজোড়া নাম; লোকজানাজানি করে সেই বংশের কলঙ্ক প্রচার করা কিছুতেই উচিত হবে না! তাতে তোমাদেরই একঘরে হতে হবে। ওই গোরাচাঁদের মেয়েটী রয়েছে; তার বিবাহই হবে না। এমন কলঙ্কের কথা রাষ্ট্র হলে কি তোমাদের ঘরের মেয়ে নিতে কেউ সম্মত হবে? এখন চেপে যেতেই হবে। এই হতভাগাটা দশ ব্রাহ্মণের পা ছুঁয়ে দিব্বি করুক যে, এমন কর্ম্ম আর করবে না—”
কে একজন বলিয়া উঠিল “আর একশ হাত মেপে নাকে খত দিতে হবে।”
একটী যুবক বলিলেন “কালাচাঁদ মুখুয্যের সঙ্গে কেউ কোন সম্পর্ক রাখতে পারবে না—ওকে এক-ঘরে করতে হবে, আর ওর দুটাে কাণ কেটে দিতে হবে; অমনি ছাড়া হবে না।”
আর একটা যুবক বলিলেন “ও কথাই নয়! ওকে আদালতে আসামী করে দিতে হবে। পাঁচ বছর জেল খাটাতে হবে। অমন লোককে সহজে ছেড়ে দেওয়া কিছুতেই হবে না।”
চণ্ডী বাবু বলিলেন “আদালতে গেলে যে কলঙ্কে দেশ ছেয়ে যাবে। ওর না হয় পাঁচ বছর মেয়াদ হবে। কিন্তু তার পর? আমরা দশের কাছে মুখ দেখাব কেমন করে? না, ন, ও সব হবে না। চক্রবর্ত্তী দাদা যা বললেন, তাই কর্ত্তব্য! চেপে যাওয়াই একমাত্র উপায়—আর পথ নেই!”
হরিশ গাঙ্গুলী এক পাশে বসিয়া তামাক খাইতেছিলেন; তিনি পাড়ার মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ। তিনি বলিলেন, “বলি, এমন কি হয়েছে যে, তোমরা একেবারে নবরত্নের সভা বসিয়ে ফেল্লে। সবই এখন থিয়েটারী কাও দেখ্ছি। কেন রে বাবু, ব্যাপার কি? এ যেন আর বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে কোথাও হয় না,—এই আমাদের গাঁয়েও যেন এমনটা কোন দিন হয় নাই। ছেলে মানুষ, বেটা ছেলে, করেছে না হয় একটা কাজ; তা নিয়ে এত চেঁচামেচি, এত গোলমাল কেন রে বাপু! বাবা রে, মা রে, গেলাম রে! এখন বসাও বৈঠক, কর বিচার। অমন কত যে হয়ে যাচ্ছে; অমনই বা বলি কেন,—ওর থেকেও গুরুতর কত কি হচ্ছে, তা দেখতে পাচ্ছ না, কাণে শুন্তে পাচ্ছ না। যত সব ছেলেমানুষী আর কি! এই আশি বৎসর বয়স হলো; আমার অজানা ত কিছুই নেই। কৈ এতদিন ত অমন করে ঢাক ঢোল বাজাও নেই। ঐ যে ও-বাড়ীর—”
চণ্ডী বাবু বাধা দিয়া বলিলেন “ঠাকুরদা, আর পরের কথা তুলে কি হবে? গোপনে ত অনেক চলে যাচ্ছে; তা আপনিও দেখছেন, আমরাও দেখছি। কি করব, দেখেও দেখিনে, শুনেও শুনিনে। কিন্তু সে সবই গোপনে চলছে। এটা যে বড়ই বেজে উঠল, তার কি উপায় ?”
কেনারাম ভট্টাচার্য্য গ্রামের অনেকেরই পুরোহিত। তিনি এক টিপ নস্য গ্রহণ করিয়া গম্ভীরভাবে বলিলেন “এ সম্বন্ধে শাস্ত্রের বিধানই বলবৎ গণ্য করতে হবে। এ প্রকার কুকার্য্য যে অনুষ্ঠিত হয় না, এমন কথা উচ্চারণ করা সমীচীন হবে না। এ প্রকার ব্যাপার সংঘটিত হয়, কিন্তু অতি গোপনে। যে গৃহে এই শ্রেণীর পাপাচার হয়, সেই গৃহস্থই তাহা গোপন করিয়া ফেলেন; পল্লীর দুদশজনের তাহা শ্রতিগোচর হইলেও তাহা জনশ্রুতি মাত্র; সুতরাং তাহা শাস্ত্রের অধিগম্য নহে। কিন্তু বর্ত্তমান ক্ষেত্রে তাহার ব্যত্যয় হইয়াছে। এই কুকার্য্যের সংবাদ কেবল গৃহস্থের গৃহের সীমার মধ্যেই আবদ্ধ রহিল না, গৃহান্তরেও গেল;– গৃহান্তরই বা বলি কেন, গ্রামান্তরের অনেক ভদ্রলোকও এই ব্যাপারের প্রত্যক্ষদর্শী হইলেন। সুতরাং গোপনে অনুষ্ঠিত কুকার্য্য বলিয়া ইহা গণ্যই হইতে পারে না। ইহা প্রকাশ্য ব্যভিচার। মাতৃসমা বিধবা ভ্রাতৃবধুর উপর তাঁহার অসন্মতিতে অত্যাচার। শাস্ত্রানুসারে ইহার দণ্ড, কর্ত্তব্য। এ বিষয় লইয়া রাজদ্বারে উপস্থিত হইবার প্রয়োজনাভাব; আমাদের শাস্ত্রের অনুশাসনই প্রযুক্ত। শাস্ত্রের বিধান এই যে, কালাচাঁদ বাবাজিকে শাস্ত্রানুসারে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে, নতুবা তাহাকে পতিত হইতে হইবে। সে প্রায়শ্চিত্ত করিয়া সমাজে গৃহীত হউক; তাহার দ্বিচারিণী ভ্রাতৃবধূকে গৃহত্যাগ করিয়া যথা-ইচ্ছা গমন করিতে হইবে; আমাদের সমাজে তাহার স্থান হইবে না; —যে বিধবার সতীত্ব নষ্ট হইয়াছে তাহার স্থান আমাদের পবিত্র হিন্দুসমাজে নাই। শাস্ত্রের এই সর্ব্বজনবিদিত ব্যবস্থা অনুসারে কার্য্য করা ব্যতীত গত্যন্তর দৃষ্ট হইতেছে না। এ কার্য্য গোপন করিলে চলিবে না; অন্ততঃ কেনারাম ভট্টাচার্য্য জীবিতমানে এমন কার্য্য হইতে পারিবে না।”
রমামুন্দরী একটু পূর্বেই কালাচাঁদের বাড়ী হইতে ফিরিয়া আসিয়াছিলেন।তিনি এই গ্রামেরই মেয়ে; তাহার পর তাঁহার বয়সও পঞ্চাশ পার হইয়া গিয়াছে; সুতরাং চণ্ডী বাবুর বৈঠকখানায় যাঁহারা আলোচনা করিতেছিলেন, তাঁহাদের সন্মুখে উপস্থিত হইবার তাঁহার বাধা বা লজ্জার কারণ ছিল না। তিনি চুপ করিয়া কেনারাম ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের সাধুভাষায় বিবৃত শাস্ত্রের বিধান শ্রবণ করিতেছিলেন। ভট্টাচার্য্য যখন তাঁহার বক্তব্য শেষ করিবেন, তখন অন্যের কথা বলিবার পূর্বেই তিনি বলিলেন “কেনারাম, তোমাদের সুবর্ণপুরে যে নুতন শাস্ত্র পাওয়া গিয়েছে, এ সংবাদ ত আমি পাই নাই।”
কেনারাম বলিলেন “নুতন শাস্ত্র কি দিদি ! যে শাস্ত্র আবহমান কাল এই হিন্দুসমাজের কর্ত্তব্য বিধান করিতেছে, আমি সেই শাস্ত্রের কথাই উল্লেখ করিলাম।”
“কৈ, তুমি ত ভাই প্রমাণ কিছুই দিলে না,—দুই দশটা বচনও আওড়ালে না। বচন-প্রমাণ না দেখালে কি আমাদের মত মুর্থ মেয়েমানুষ শাস্ত্র বুঝতে পারে?”
কেনারাম বলিলেন “এ সকল ত অতি সহজ ব্যাপার; ইহার জন্য আর প্রমাণ-প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় না।”
রমাসুন্দরী বলিলেন “কেনারাম, ভাই, কিছু মনে করো না; আমি জিজ্ঞাসা করি, গোপনে কোন কুকার্য্য করলে তাতে পাপ হয় না ?”
“পাপ হবে না কেন ? কিন্তু এ যে কলিকাল দিদি ! এখন , কি আর সেই সত্যযুগের ব্যবস্থা খাটে ? তাই এখন অনেকটা অন্তরাল করিয়া চলিতে হয়। কুকার্য্যকারী সকলকেই যদি দণ্ডিত করিবার ব্যবস্থা করা যায়, তাহা হইলে কি সমাজ তিষ্ঠিতে পারে। সেই কারণে, যে যাহা অনুষ্ঠান করে, তাহা উপেক্ষা করিতে হয়, নতুবা সমাজের স্থিতি রক্ষা হইবে কি প্রকারে?”
“তা হলে তুমি বলতে চাও যে, যার যা ইচ্ছা, যেমন কুকার্য্য ইচ্ছা, তাই সে করুক; তবে যেন সাবধানে করে, গোপনে করে; তা হলে তোমরা তাদের সমাজে চালিয়ে নিতে পার। এই তোমাদের এখানকার শাস্ত্রের বিধান, কেমন ?”
“না দিদি, তা ঠিক নয়। তবে এই- এই কথাটা-এই কি জান-” কেনারামের কথায় বাধা দিয়া রমামুন্দরী বলিলেন—“কথাটা এই যে, তোমরা শক্তের কাছে নরম, আর নরমের কাছে শক্ত। যাক্ সে কথা। তুমি যে বল্লে, কালাচাঁদ একটা প্রায়শ্চিত্ত করলেই তাকে তোমরা সমাজে তুলে নিতে পার। তার এই ঘোরতর পাপের ঐ সামান্য শাস্তিই তোমাদের শাস্ত্রে লেখা আছে।আর মানদার বেলায় তোমরা ব্যবস্থা করলে যে, সে যেখানে ইচ্ছা সেখানে চলে যাক। তোমরা তাকে সমাজে কিছুতেই স্থান দিতে পারবে না। কেমন, এই ত তোমার ব্যবস্থা?” .
কেনারাম বলিলেন “শাস্ত্রের বিধানই এই । ত্রিকালজ্ঞ মুনিঋষিরা যা ব্যবস্থা করে গিয়েছেন, অল্পবুদ্ধি আমরা কি তার অন্যথা করতে পারি, না তার তাৎপর্য্য গ্রহণ করতে পারি।”
রমাসুন্দরী বলিলেন “দেখ কেনারাম, আমিও ব্রাহ্মণের মেয়ে, আমিও শাস্ত্রের বিধান মানি। কিন্তু যে শাস্ত্রর কালাচাঁদের মত মানুষের জন্য অতি সামান্য, অতি হাস্যকর প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করতে পারে, আর মানদাকে পথের ভিখারিণী করতে পারে, সে শাস্ত্র মুনিঋষিরা করেন নাই, করতে পারেন না, এ কথা আমি জোর করে বল্ছি। যদি তুমি কোন শাস্ত্র থেকে প্রমাণ দিতে পার, তা হলে আমি তোমার মুখের উপর বলৰ যে, সে শাস্ত্র তোমার এই কালাচাঁদের মত মুনিঋরিাই করেছেন; তা হিন্দুর শাস্ত্র নয়,-প্রকৃত মানুষের শাস্ত্র নয়। অপরাধ করল কালাচাঁদ, মহাপাপ করল কালাচাঁদ, আর তার ফলভোগ করবে সেই অনাথা বিধবা! একবার গিয়ে দেখে এস মানদার অবস্থা, শুনে এস তার কান্না! পাষাণও গলে যায় কেনারাম; পাষাণও গলে যায়! তার অপরাধ কি? বল না তোমরা সকলেই ত এখানে আছ, বল না মানদার কি অপরাধ, ষে তাকে পথে দাঁড়াবার ব্যবস্থা করতে চাও। এই নরপশুটা তাকে আক্রমণ করল; সে নিরুপায়া অবলা; সে কি করবে? প্রাণপণে চীৎকার করা ছাড়া আর কি উপায় তার ছিল, বল না তোমরা? তারপর, তোমরা কি না এখানে বৈঠক করে কালাচাঁদকে ধুয়ে-মুছে ঘরে তুলতে যাচ্ছ, আর মানদাকে অকুল পাথারে ভাসিয়ে দিতে চাও। দেখ, যতই তোমরা বড়াই কর না কেন, আমি বলছি এ মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত তোমাদের করতে হবে, তোমাদের এই সমাজকে করতে হবে। হাঁ, মানদা যদি অসচ্চরিত্রা হত, তা হলে তাকে তোমরা দূর করে দিতে, কেউ একটা কথাও বলতে পারত না। কিন্তু এই ঘটনাটা ভেবে দেখ দেখি। আমি এই এখনই মানদার কাছ থেকে আসছি। তার এখন যে রকম ভাব, তাতে সে নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করবে। তা ছাড়া তার আর কি পথ আছে? আর কি পথ তোমরা তাকে দেখিয়ে দিতে পার, বল না ?”
রমাসুন্দরীর পুত্র সিদ্ধেশ্বর এতক্ষণ চুপ করিয়া ছিলেন। তিনি বুদ্ধিমান বিচক্ষণ; তিনি উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি; বয়সও তাঁহার ছত্রিশ সাঁইত্রিশ হইয়াছে। ইংরাজী, বাঙ্গালা, সংস্কৃতে এত বড় পণ্ডিত হইয়াও তিনি অল্পভাষী; তাই এতক্ষণ যে বাদ্বিতণ্ডা হইতেছিল,তাহাতে তিনি কোন মতই প্রকাশ করেন নাই। বিশেষতঃ, তাঁহার পূজনীয়া মাতাঠাকুরাণী যখন কেনারাম ভট্টাচার্যের সহিত আলোচনায় প্রবৃত্ত হইলেন, তখন তিনি সে আলোচনার মধ্যে কথা বলা সঙ্গত মনে করিলেন না। কিন্তু, তাঁহার মাতা যখন বলিলেন “কি পথ তোমরা তাকে দেখিয়ে দিতে পার, বল না?” তখন সিদ্ধেশ্বর অতি ধীর ভাবে বলিলেন “মা, তুমিই একটা পথ দেখিয়ে দেও না।”
রমামুন্দরী তীক্ষ দৃষ্টি পুত্রের মুখে নিবদ্ধ করিলেন; একটু চুপ করিয়া থাকিয়াই কহিলেন “পথ দেখিয়ে দিতে পারি, কিন্তু সে পথে চল্তে পারবি সিধু!”
সিদ্ধেশ্বর দৃঢ় স্বরে বললেন “তুমি যদি আদেশ কর মা, তুমি যদি সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাক, তা হলে তোমার এই অযোগ্য সন্তান সব করতে পারে।”
“তবে শোন্ সিধু, আমি যে এতক্ষণ কেনারামের সঙ্গে তর্ক করছিলাম, সে তোর মন বোঝবার জন্য; সুবর্ণপুরের কালু মুখুয্যের জন্য আমার মাথাব্যথা পড়ে নাই। আমি ভাবছিলাম মানদার কথা—আমি ভাবছিলাম তোর কথা সিধু! আমার সে বাসনা পূর্ণ হয়েছে। তুই আমাকে পথের কথা জিজ্ঞাসা করবি, তারই জন্য এতক্ষণ এত কথা-বল্ছিলাম। শোন তবে আমার পথের কথা। আমি মানদাকে ঘরে নিয়ে যাব-দেবীপুরে নিয়ে যাব। এতদিনে দেবীপুরের নাম সার্থক করব। কেমন, পারবি এ ভার নিতে?”
“বলেছি ত মা, তোমার আদেশ প্রতিপালনে জন্য সব করতে পারব।”
চণ্ডী বাবু এতক্ষণ কোন কথাই বলেন নাই; এখন দেখিলেন ব্যাপার গুরুতর হইয়া দাঁড়াইল। তিনি আর নীরব থাকিতে পারিলেন না; বলিলেন “দিদি, সকল দিক ভেবে দেখেছ কি ? ওবাড়ীর বড়-বৌয়ের অবস্থার কথাই এখন তোমার মন অধিকার করে বসেছে; তাই তুমি আর কিছুই ভাবতে পারছ না। একটু স্থির ভাবে চিন্তা করে দেখ্লেই বুঝতে পারবে, কি কাজ তুমি করতে যাচ্চ। এই প্রথমেই ত দেখ, মুখুয্যে বংশের কি কলঙ্ক হবে? এর পর কি আর কোন ভদ্র ব্রাহ্মণ ওদের সঙ্গে আদানপ্রদান করবে? ওদের যে একঘরে হয়ে থাক্তে হবে, সে কথাটা ভেবেছ কি?”
“হাঁ ভাই চণ্ডি, সে কথা ভেবেছি। কালাচাঁদ মুখুয্যে যে পাপ করেছে, তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না? তার বংশের কলঙ্ক ত দেশময় ছড়িয়ে পড়াই চাই! তাকে সকলে ঘৃণা করবে, তাই ত চাই। আর তোমরা যদি এমন নরপিশাচের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখ, তা হলে তোমাদেরও ত প্রায়শ্চিত্তের দরকার, তোমাদেরও শাস্তি হইয়া চাই!”
চণ্ডী বাবু বলিলেন “আমাদের কথা না হয় নাই ভাবলে। আমাদের ভাবনা আমরাই ভাবব; কিন্তু তোমাদের কথাটাও ত একবার ভেবে দেখতে হয়। তোমরা দেবীপুরের জমিদার, তা সকলেই জানে। তোমাদের যে সে অঞ্চলে অসীম ক্ষমতা, তাও আমার জান্তে বাকী নেই। তোমরা ইচ্ছা করলে অনেক অসাধ্য-সাধনও করতে পার, এ কথাও স্বীকার করি। কিন্তু, তোমরা কি তোমাদের অঞ্চলের সমাজে যা ইচ্ছা তাই চালাতে পার? এমন ক্ষমতা কি তোমাদের আছে? তারপর ভেবে দেখ, দেবীপুরের তোমরা নয়-আনির জমিদার। সাত-আনির জমিদার মনোহর চাটুর্য্যের সঙ্গে তোমাদের যে রকম মনের মিল, তা আমি বেশ জানি। কেউ কারও ক্রটী দেখ্লে ছেড়ে কথা বলে না। এ অবস্থায় তোমরা যে কাজ করতে যাচ্ছ, তাতে মনোহর বাবু যে তোমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, এ ত আমি দিব্যচক্ষে দেখ্তে পাচ্ছি। তার ফল যে কি হবে, তা আর তোমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না। ঘোর একটা দলাদলির সৃষ্টি হবে; তারপর, তার থেকে মনান্তর, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মামলা-মোকদ্দমা—কত কি যে হবে, তা বলা যায় না। কেমন দিদি, কেমন বাবা সিধু, আমার এ কথাগুলো সত্যি কি না, বল দেখি? আমাদের গায়ের এই কেলেঙ্কারী মাথায় করে নিয়ে দেশে গিয়ে একটা কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে তোমাদের কি লাভ হবে, কি পৌরুষ বাড়বে, সেই কথাটা আমাকে বুঝিয়ে দিতে পার? আজ যে অত্যাচার তোমরা স্বচক্ষে দেখ্লে, তাতে তোমাদের কেন, মানুষমাত্রেরই মন বিচলিত হ’তে পারে; কিন্তু, তার প্রতিবিধানের জন্য তোমাদের এত মাথাব্যথা কেন? তার জন্য এমন বিপদ ডেকে আনা কেন?”
রমামুন্দরী বলিলেন “চণ্ডি, তুমি যে সব কথা বল্লে, আমি কি তা ভাবিনি, তুমি মনে করছ। আমি সব ভেবেছি। মানদার অবস্থা দেখে যে আমি বিচলিত হয়েছি, তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। কিন্তু, আমি যখন তোমাদের সঙ্গে এই সকল কথার আলোচনা করছিলাম, তখন আমি এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবার ভবিষ্যৎ ফলের কথাও ভাবছিলাম, আর আমার ছেলে সিধুর মুখের দিকে চাচ্ছিলাম। সে মুখে আমি যে দীপ্তি, যে ভাব দেখ্তে পেয়েছি, তাতেই আমি সাহস করে এই ভার নিতে চাচ্ছি। কেমন সিধু ?”
সিদ্ধেশ্বর বলিলেন “মামা, মায়ের আদেশ আমি মাথায় করে নিয়েছি। আজ আমি যে দৃশ্য দেখলাম, এতে আমার প্রাণে যে ভাবের উদয় হয়েছে, তা মামা, তুমি বুঝতে পারবে না। মায়ের আদেশ পেয়েছি। আমি বল্ছি, ও বাড়ীর বড়-বৌকে আশ্রয় দেবার জন্য মনোহর কাকার সঙ্গে যদি বিবাদ করতে হয়, দেশের সকলের সঙ্গে যদি মনান্তর হয়, দেবীপুরের নয়-আনির বাড়ীকে যদি একঘরে হয়ে থাক্তে হয়, তাতেও কুন্ঠিত হব না। দেবীপুরের জমিদারী যদি বিকিয়ে যায়, তাতেও আমার অণুমাত্র দুঃখ হবে না। একটী অসহায়া, নিরপরাধা বিধবাকে সামাজিক নির্যাতন থেকে রক্ষা করবার জন্য আমার যথাসর্ব্বস্ব দিয়ে আমি পথের ভিখারী হয়েছি, এর চাইতে অধিক গর্ব্বের কথা আমি ভেবেই পাচ্ছি না। মা ঠিক কথা বলেছেন, যে সমাজ নিরপরাধা বিধবাকে এমন করে ত্যাগ করতে পারে, সে সমাজ হিন্দুসমাজ নয়। আমি সে হিন্দুয়ানীর বড়াই করতে চাইনে। না মা, তুমি ভেবো না। তোমার আদেশ পালন করবার জন্য আমি সমস্ত বিপদ মাথায় করে নিতে প্রস্তুত হয়েছি।”
হরিশ গাঙ্গুলী মহাশয় বলিলেন, “তোমরা যে যা বল্লে, সবই ত শোনা গেল। কিন্তু আমি একটা কথা বলি, তাই কেন কর না। ও-বাড়ীর বড়-বৌয়ের জন্য তোমাদের প্রাণে ব্যথা লেগেছে, সে বেশ কথা; কিন্তু, তাকে ঘরে নিতে চাও কোন্ বিবেচনায়? আমরা অবশ্য তাকে আমাদের সমাজে স্থান দিতে পারব না; তোমরাও দেখে নিও, দেবীপুর সমাজেও তার স্থান হবে না; মাঝের থেকে তোমরা অনেক বিপদ, অনেক লাঞ্ছনা ভোগ করবে। সকল দিক যাতে রক্ষা হয়, আমি সেই পরামর্শ দিচ্ছি। তোমাদের অর্থ আছে, তোমরা তা অনায়াসে করতে পার। বেশ ত,তোমাদের দয়া হয়েছে, তোমরা গোরাচাঁদের স্ত্রীকে কাশীতে পাঠিয়ে দেও; সেখানে তার ভরণ-পোষণের জন্য যা ব্যয় হবে, তা তোমরা দিও।. তবে তার মেয়েটার কথা ভাববার বিষয় বটে। তারই বা কি। কাশী হোলো গে একটা সৃষ্টিছাড়া যায়গা। পয়সা খরচ করলে সেখানে বেশ্যার মেয়েও কুলীন বামুনের মেয়ে বলে পার হয়ে যায়; এ ত সামান্য কথা। এই বুড়ো বামুনের কথাটা ভেবে দেখ, সব দিক্ যাতে রক্ষা হয়, আমি সেই সুপরামর্শই দিলাম।”
সিদ্ধেশ্বর বলিলেন, “সে বিবেচনা পরে করা যাবে। আপাততঃ ওঁকে ত দেবীপুরে নিয়ে যাই। তারপর যা হয়, দেখব, কি বল মা?”
রমাসুন্দরী বলিলেন “সেই কথাই ভাল। সকালেই আমাদের যাওয়ার বন্দোবস্ত করে ফেলো সিধু! ঘাটে ত নৌকা বাঁধাই আছে; কালই রওনা হতে হবে। আমি এখন ও-বাড়ী যাই; মানদাকে আজ রাত্রিতে চোখের আড়াল করা হবে না।” এই বলিয়া তিনি কালাচাঁদদিগের বাড়ীতে চলিয়া গেলেন।
“কি হবে গিন্নি?”
“কিসের কি হবে বড়-বৌ ?”
“বড় বৌ! ও নাম ধরে আর আপনি আমাকে ডাক্বেন না। বড়-বৌ! সে ত নেই। সে নেই গো! সে আর নেই! আজি সন্ধ্যা পর্যন্তও আমি এক গৃহস্থের বড়-বৌ ছিলাম গিন্নি! এখন আর তা নেই! সে সব আমার ঘুচে গেছে—চিরদিনের মত গেছে। কাল সকালে আর তার চিহ্নও থাক্বে না। সে কথা বল্ছিনে গিন্নি, মেয়েটার কি হবে? আমি চলে গেলে, কে তাকে দেখ্বে? সে কার কাছে দাঁড়াবে? তার যে আর কেউ নেই।” মানদা আর কথা বলিতে পারিলেন না; তিনি কাঁদিয়া উঠিলেন।
রমাসুন্দরীর কাছেই সুহার দাঁড়াইয়া ছিল; তিনি তাহাকে মানদার কোলের কাছে বসাইয়া দিতে গেলেন। মানদা চীৎকার করিয়া সরিয়া বসিলেন; বলিলেন “না, না, ওরে সুহার, তুই আমাকে স্পর্শ করিস্ না, আমার কাছে আসিস্ না। সরে যা মা আমার, সরে যা। তোর মা নেই! তোর মা যে সন্ধ্যার পরে মরে গিয়েছে রে”-
সুহার সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া মায়ের গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল “মা, ও মা, তুমি অমন করছ কেন? ওগো, তোমরা দেখ, মা যে কেমন করছে।” সুহার কাঁদিয়া উঠিল।
রমাসুন্দরী মানদাকে বুকের মধ্যে জড়াইয়া ধরিয়া বসিলেন; কিন্তু, কি যে বলিবেন, তাহা ভাবিয়া পাইলেন না। এ দৃশ্য দেখিয়া তাঁহার বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল। যে দুইচারি জন স্ত্রীলোক সেখানে ছিলেন, তাঁহারা বলিলেন “ও বড়বৌ, অমন করছিস্ কেন? দেখ্ ত, সুহার কাঁদছে। ওকে কোলে কর; ওর মুখের দিকে চেয়ে সব ভুলে যা।”
মানদা বলিলেন “সব ভুলে যাব—সব আমি ভুলে যাব। আর একটু অপেক্ষা করুন আপনারা, আমি সব ভুলে যাব। ওগো, তোমরা কেউ আমার এই অভাগী মেয়েটাকে কোলে তুলে নেও; তোমরা কেউ বল যে, ওর মুখের দিকে চাইবে। তা হলেই আমি যাই। গিন্নি, আপনিই একবার বলুন! আপনার পায়ে ধরে বলছি, এই আমার শেষ প্রার্থনা-আপনি এই বাপ-মা-হারা মেয়েটাকে নিন্—আমি চলে যাই। আর যে আমি দেরী করতে পারছি নে। আর যে আমার সহ্য হচ্চে না। দেখ্বে তোমরা—এই দেখ না আমার বুকের মধ্যে কি আগুন জ্বলছে-আমার মাথা দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে। আর যে আমি থাক্তে পারছি নে। আয় সুহার, তুইও আমার সঙ্গেই আয়! এ দেশে তোরও থেকে কাজ নেই। না, না, তোকে রেখে যাব না-তোকেও সঙ্গে করেই নিয়ে যাই। চল্ মা, চল্ অভাগীর মেয়ে, আমার সঙ্গে চল। ঐ নদীতে ডুবে সব জ্বালার হাত থেকে নিস্তার-পাই গে! চল্ মা, চল্; এখানে তোর কেউ নেই। চল্।” এই বলিয়া পাগলিনীর মত সুহারের হাত ধরিয়া মানদা দণ্ডায়মান হইতে গেলেন ।
রমাসুন্দরী তাহাকে জোরে কোলের মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন “ও বড়বৌ, তুই পাগল হলি না কি? ও-সব কি বকৃচিস্। কি, তোর হয়েছে কি?”
মানদা বলিলেন “কৈ, কি হবে? না, না, কিছুই হয় নাই। হবে আবার কি? তোমরা সবাই সরে যাও, আমাকে ছেড়ে দেও, আমি মেয়ে নিয়ে চলে যাই। এখানে যে আমি থাক্তে পারছি নে, এ ঘরের দিকে যে আমি চাইতে পারছি নে। ওরে, এ যে আমার দেবতার ঘর ছিল রে! তোমরা কেউ এই ঘরে আগুন ধরিয়ে দিতে পার? আমি তা হলে এই ঘরের মেজেয়—ঐ ঐখানে বসে সেই আগুনে পুড়ে মরি।”
রমাসুন্দরী বলিলেন “ও সব কি কথা বল্ছিস মানদা? তুই চুপ কর্। তোর ভয় কি? আমি আছি। তোর মেয়ে সুহারের জন্য তোর ভাবনা হয়েছে? আমি ধর্ম্ম সাক্ষী করে বল্ছি, তোর মেয়েকে আমি নিলাম; তার সম্পূর্ণ ভার আমার উপর রইল। তুই এখন একটু স্থির হয়ে আমার কথা শোন্। আমি এ কথা মানি যে, নরাধমের স্পর্শে তোর দেহ কলুষিত হয়েছে। পশুটা যখন পাপ মনে তোর গায়ে হাত দিয়েছে, তখনই তোর শরীর অপবিত্র হয়েছে। কিন্তু তোর মন ত অপবিত্র হয় নাই; এ কথা ত তুই বেশ বুঝিস্। তোর মনে ত কোন পাপ স্পর্শ করে নাই, তা ত তুই জানিস্, তবে এত কাতর হচ্চিস্ কেন? লোকে কত কথা বল্বে, কেমন? আমি তার ব্যবস্থা করেছি। আমি তোকে আর তোর মেয়েকে দেবীপুরে নিয়ে যাব। তুই সেখানে আমার মেয়ের মত থাক্বি; আমি তোকে কোলে করে রাখব; তোকে আমার সংসারের কর্ত্রী করে রাখব। কেউ তোকে ঘৃণা করতে পারবে না। তোর মেয়ের বিয়ে যাতে সুপাত্রের সঙ্গে হয়, আমি তা করব। তোকে এ দেশে থাক্তে হবে না;–এ মুখুয্যে-বাড়ী আর তোকে আস্তে হবে না,—এদের মুখ তোকে দেখ্তে হবে না। এর জন্য যত কিছু সহ্য করতে হয়, আমি করব। কা’ল সকালেই তোদের নিয়ে আমি দেবীপুরে চলে যাব।”
মানদা অবাক হইয়া রমামুন্দরীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। তিনি নিজের কর্ণকে বিশ্বাস করিতে পারিলেন না; পাগলিনীর মত তাঁহার শূন্যদৃষ্টি !
রমাসুন্দরী বুঝিতে পারিলেন, মানদা তাঁহার কথার মর্ম্মগ্রহণ করিতে পারেন নাই, তাঁহার বুদ্ধি এখন প্রকৃতিস্থ নহে। তিনি বলিলেন “মানদা, আমি যা বললাম, শুন্তে পেয়েছিস্ ?”
মানদা অন্যমনস্ক ভাবে বলিলেন “হ্যাঁ—তা—হ্যাঁ কি বলছ ?”
রমাসুন্দরী বলিলেন “কা’ল সকালে আমি তোদের দেবীপুরে নিয়ে যাব, বুঝলি ?”
মানদা তেমনই ভাবে বলিলেন “আমাদের-দেবীপুরে! কেন? সে কোথায়? দেবীপুরে? কেন? এ যে আমার সুবর্ণপুর। না, না, ওগো, আমি কোথাও যেতে পারব না—যাব না গো ! আমি এই সুবর্ণপুরেই মরব। তোমরা জান না, আমি নয় বছর বয়সের সময় এই সুবর্ণপুরে এসেছি, আর এতকাল এখানেই আছি, —কোন খানেই ত যাই নাই। এখানেই আজ আমার শেষ হবে। তিনি যে আমাকে এই ঘরে এনে তুলেছিলেন! আমি কি এ ঘর ছেড়ে যেতে পারি। না, না—আমি কোথাও যাব না; আমি আজ এই ঘরে—ঐ যে তিনি এসেছেন—ঐ যে তিনি আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। আমি এই ঘরের মধ্যেই মরব। আজই আমার যাবার দিন! তোমরা কেউ আমাকে বাধা দিও না—দিও না। কি বলছ—সুহার, হ্যাঁ, সুহার! তা—আমি ওকেও নিয়ে যাব। ওর গলা-টিপে মেরে ফেলে তার পর আমিও মরব। ঐ শোন না তোমরা, তিনি যে সেই কথাই বল্ছেন। আমি কোন দিন তাঁর কোন কথা অমান্য করি নি; আজও তাঁর কথা-মতই কাজ করব। তোমার পায়ে পড়ি গিন্নি! আমাদের নিয়ে যেও না। তোমরা সরে যাও—তোমরা আমাদের ছেড়ে দেও; আমরা মায়েঝিয়ে তাঁর কাছে চলে যাই। তিনি ত ঘৃণা করছেন না—তিনি যে কোলে তুলে নিতে ডাক্ছেন। যাই গো—যাই—আর কি দেরী করা যায়—তিনি যে ডাক্ছেন—ঐ শোন।” বলিয়াই মানদা অচৈতন্য হইয়া পড়িলেন। তাঁহার এই অবস্থা দেখিয়া সুহার কাঁদিয়া উঠিল “মা, ও মা! মা যে কথা বলে না।”
রমাসুন্দরী তাড়াতাড়ি উঠিয়া বাহির হইতে জল আনিয়া মানদার মুখে-চোখে মাথায় ছিটাইয়া দিতে লাগিলেন। তাঁহার নাড়ীজ্ঞান ছিল; মানদার হাত দেখিয়া বলিলেন “ভয় নাই, মুর্চ্ছা গিয়েছে; এখনই জ্ঞান হবে। তোমরা ভাল করে বাতাস কর।”
ধীরে ধীরে বাতাস করিতে করিতে মানদার জ্ঞান-সঞ্চার হইল ; তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া অতি কাতর স্বরে বলিল “মাগো, আর যে সয় না।”
রমাসুন্দরী বলিলেন “মানদা, সবই সইতে হবে। সুহারের মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখ্,; মেয়ে যে কেমন হয়ে গিয়েছে।”
“সুহার! আমি তার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। তাই ত, সুহারকে ফেলে কোথায় যাব। আয় মা, আয় আমার কোলে আয়। তোকে বুকে করে দেখি আগুন নেবে কি না।”
রমামুন্দরী বলিলেন “মানদা, অত কাতর হলে চল্বে না। তুই মরবি কেন ? তোর কি হয়েছে। আমার কথা বেশ করে বুঝে দেখ, তোর কিছুই হয় নাই। তুই যে ভগবানের কাছে খাঁটি আছিস্। বল দেখি, আমার কথা ঠিক কি না ?”
মানদা অনেকক্ষণ চুপ করিয়া কি যেন ভাবিতে লাগিলেন। কেহই কোন কথা বলিয়া তাঁহার এই ভাবনায় বাধা দিলেন না। অবশেষে মানদা অতি ধীর ভাবে বলিলেন “গিন্নি, তোমার কথা আমার মনে লেগেছে। তুমি ঠিক কথা বলেছ। তাই ত! আমি যদি মনে প্রাণে ঠিক থাকি, তা হলে আর চাই কি। আমি বল্ছি তোমাকে গিন্নি! আমি কোন পাপই করি নাই—আমার মন ঠিকই আছে। আমি তাঁরই স্ত্রী আছি! আমি কোন অন্যায় কাজ করি নাই। যে যা বলে বলুক, না, কি বল গিন্নি, আমি খাঁটি আছি।”
রমাসুন্দরী বলিলেন “আমার কথা তা হলে বুঝেছিস্ ত! তবে আর অমন করছিস্ কেন ?”
মানদা তেমনই ধীর ভাবে বলিলেন “তা ত বুঝেছি গিন্নি, কিন্তু লোকে কি বলবে ? সকলে যে আমাকে কত কি বল্বে—আমার সঙ্গে কথা বল্বে না। তা হলে আমি কেমন করে বাঁচব? তা হলে আমার সুহারের কি গতি হবে ? তার যে বার বছর বয়স হোলো। তাকে কে নেবে গিন্নি! আমার সুহার! ”
রমামুন্দরী বলিলেন “সে কথা যে তোকে একটু আগেই আমি বল্লাম, তা বুঝি শুনতে পাস্নি; তুই স্থির হয়ে শোন্। আমি তোদের দেবীপুরে নিয়ে যাব। সেখানে কেউ তোকে ঘৃণা বা তাচ্ছিল্য করতে পারবে না। আর যেমন করে হোক, তোর সুহারকে আমি ভাল ঘর বর দেখে বিয়ে দিয়ে দেব।”
মানদা বলিলেন “তা আর হয় না গিন্নি ! আর হয় না । মনে ত বল বেঁধেছিলাম; কিন্তু সব যে ভেঙ্গে পড়ে। তা আর হবে না।”
রমাসুন্দরী বলিলেন “হয় কি না হয়, সে আমি দেখে নেব । তুই এখন একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর্ দেখি !”
মানদা বলিলেন “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক কথা বলেছ! আহা, ঘুমাতে হবে বই কি! ঘুমই যে এখন আমার একমাত্র পথ। মা দুর্গা, আমার চোখে একবার ঘুম এনে দাও মা! সে ঘুম যেন আর না ভাঙ্গে! ওগো, দয়াময়ী, আর তোমার কাছে কিছু চাইনে, আমার চোখে ঘুম এনে দাও—আমি সব ভুলে যাই—সব ভুলে যাই।”
রমামুন্দরী বলিলেন “আবার ও কি কথা ! তুই একটু স্থির হ, মানদা! রাত যে অনেক হয়ে গেল !”
মানদা চারিদিকে একবার চাহিয়া বলিলেন “তাই ত, রাত যে অনেক হোয়েছে! ও সুহার! তুই একটু ঘুমিয়ে নে মা! অসুখ করবে যে। আয়, আমার কোলের কাছে আয়!” এই বলিয়া সুহারকে কোলের মধ্যে তুলিয়া লইয়া মানদা নীরব হইলেন।
রমাসুন্দরী এবং আরও দুই তিনটি স্ত্রীলোক সারা রাত্রি সেই স্থানেই বসিয়া কাটাইলেন। মানদা কখন চুপ করিয়া থাকেন, কখন আপন মনেই কত কথা বলেন; কেহই কিন্তু সে সকল কথার উত্তর দিলেন না।
এমনই করিয়া সেই কালরাত্রির অবসান হইল। প্রাতঃকালে রমাসুন্দরী জোর করিয়া মানদা ও সুহারকে নৌকায় লইয়া গেলেন। একটু পরেই তাঁহাদের নৌকা সুবর্ণপুর ত্যাগ করিল।
পূর্ব্ব রাত্রিতে চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে যে বৈঠক বসিয়াছিল, তাহাতে কথাবার্ত্তা বেশীদূর অগ্রসর হইতে পারে নাই। রমাসুন্দরীর তেজে সকলেই যেন একটু সংকুচিত হইয়া গিয়াছিলেন। তদ্ব্যতীত আরও একটা কারণ ছিল। সুবর্ণপুর গ্রামের সমস্ত সামাজিক ব্যাপারের যিনি অধিনায়ক বা অধিনায়িকা, তিনি সে বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি আর কেহই নহেন—গ্রামের পরমপূজনীয় শ্রীযুক্তা শ্যামা ঠাকুরাণী। মুখোপাধ্যায় মহাশয়েরাই বলুন, গাঙ্গুলী মহাশয়ই বলুন, আর মহাপণ্ডিত পুরোহিত ঠাকুরই বলুন, শ্যামা ঠাকুরাণীর কাছে কেহই মনুষ্য-পদ-বাচ্যই নহেন। শ্যামা ঠাকুরাণীই এ গ্রামের সমাজকে শাসনে রাখিয়া থাকেন। পূর্ব্ব রাত্রিতে যখন গোলমাল উপস্থিত হয়, যখন চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে পাড়ার সকলে সমবেত হন, তখন শ্যামা ঠাকুরাণীকে সংবাদ দেওয়ার কথা যে না উঠিয়াছিল, তাহা নহে। কিন্তু তিনি এই সমস্ত দিন চণ্ডী বাবুর বাড়ীর এত বড় ব্যাপারের কার্য্য শেষ করিয়া সন্ধ্যার সময় গৃহে গিয়াছেন এবং তাঁহার গৃহও গ্রামের অপর প্রান্তে, সেই জন্য এত রাত্রিতে তাঁহাকে বিরক্ত করা কেহই কর্ত্তব্য মনে করেন নাই; সেই জন্যই তাঁহাকে রাত্রিতে সংবাদ দেওয়া হয় নাই; সুতরাং কর্ত্তব্যও নির্দ্ধারিত হয় নাই। প্রাতঃকালে তাঁহাকে সংবাদ দেওয়া হইবে স্থির হইয়া সে রাত্রির মত সভা ভঙ্গ হয়।
এই স্থানে শ্রীযুক্ত শ্যামা ঠাকুরাণীর একটু পরিচয় দিতে হইতেছে। তিনি এই গ্রামেরই কিশোরী ঘোষাল মহাশয়ের কন্যা। ঘোষাল মহাশয়ের যখন স্ত্রী-বিয়োগ হয়, তখন শ্যামা ঠাকুরাণীর বয়স আট বৎসর। ঘোষাল মহাশয় আর দারপরিগ্রহ না করিয়া মেয়েটীকেই প্রতিপালন করিতে থাকেন। দশম বৎসর বয়সে, তাঁহার যাহা সাধ্য তাহার ও অতিরিক্ত ব্যয় করিয়া শ্যামা বিবাহ দেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ছয়মাস যাইতে না যাইতেই শ্যামা বিধবা হন; তাঁহাকে আর স্বামীর ঘর করিতে হয় না। সেই হইতে শ্যামা ঠাকুরাণী পিত্রালয়েই বাস করিতেছেন। বছর আট পরে যখন কিশোরী ঘোষাল মারা যান, তখন তিনি তাঁহার যে সামান্য জোত-জমা ছিল, তাহা বিধবা কন্যা শ্যামার ভরণ পোষণের জন্য লেখা পড়া করিয়া দিয়া যান। শ্যামার অবর্ত্তমানে ঘোষাল মহাশয়ের জ্ঞাতিদের মধ্যে যাহার আইন অমুসারে প্রাপ্য হইবে, তিনিই বিষয় পাইবেন।
সেই হইতে শ্যামা ঠাকুরাণী এই গ্রামেই বাস করিতেছেন। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন শ্যামা ঠাকুরাণীর বয়স প্রায় ৬০ বৎসর; কিন্তু তাঁহাকে দেখিলে কেহ চল্লিশের উপর বলিয়া কিছুতেই মনে করিতে পারেন না। দশ বৎসর বয়সে বিধবা হইয়া এই পঞ্চাশ বৎসর কাল শ্যামা ঠাকুরাণী নিষ্কলঙ্ক জীবন যাপন করিয়া আসিতেছেন; সুবর্ণপুরের কেহ কোন দিন তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধে কোন কথা বলিতে পারে নাই। এই চরিত্রবলেই শ্যামা ঠাকুরাণী গ্রামে একাধিপত্য করিয়া আসিতেছেন। তাঁহার যে জমাজমি আছে, তাহার আয় হইতে তাঁহার বেশ চলিয়া যায়; গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য কাহারও মুখের দিকে চাহিতে হয় না; জমাজমির ব্যবস্থার জন্যও শ্যামা ঠাকুরাণী কাহারও মুখাপেক্ষা করেন না; নিজেই সমস্ত করেন। দশ টাকা সুদেও তিনি লাগাইয়া থাকেন; সকলে বলে তাঁহার হাতেও কিছু আছে।
তাহার পর শ্যামা ঠাকুরাণী পরোপকারে কখনও পরান্মুখ নহেন; গ্রামের সকলেরই বিপদ-আপদে তিনি বুক দিয়া পড়িয়া থাকেন। এই সকল গুণের জন্য সকলেই তাঁহাকে শ্রদ্ধা করে। আবার সকলে তাঁহাকে বিশেষ ভয়ও করে, কারণ শ্যামাঠাকুরাণীর মুখের সম্মুখে কাহারও দাঁড়াইবার যো নাই; রাগ ও অভিমান তাঁহার অত্যন্ত বেশী; তাঁহার মতের প্রতিবাদ করিলে আর রক্ষা নাই; তিনি তখন একেবারে উগ্রচণ্ডা হইয়া উঠেন। তাঁহার অভিমানে আঘাত করিতে কেহই সাহস করে না। সকলেই তাঁহার পরামর্শমত কাজ করিয়া থাকে।
রমাসুন্দরী যে অতি প্রত্যুষেই মানদা ও তাহার মেয়েকে লইয়া চলিয়া যাইবেন, একথা রাত্রিতে কেহই ভাবেন নাই; তিনি যদিও সে কথা বলিয়াছিলেন, কিন্তু সকলেই মনে করিয়াছিলেন যে, প্রাতঃকালে শ্যামা ঠাকুরাণীর সহিত পরামর্শ করিয়াই রমাসুন্দরী কর্ত্তব্য স্থির করিবেন। রাত্রিতে যাহাই বলুন, শ্যামা ঠাকুরাণীকে উপেক্ষা করিয়া রমাসুন্দরী কিছুই করিবেন না, এ কথা সকলেই স্থির জানিতেন। শ্যামা ঠাকুরাণী যদি রমাসুন্দরীর প্রস্তাবে মত না দেন, তাহা হইলে মানদাকে লইয়া যাওয়া অসম্ভব হইবে, এই কথা ভাবিয়াই রমাসুন্দরী প্রাতঃকালেই যাত্রা করিয়াছিলেন; পাড়ার কেহই সে কথা জানিতেও পারে নাই; চণ্ডী বাবুও তাঁহার ভগিনীকে নিষেধ করিতে সাহসী হন নাই; তাঁহার যাহা বক্তব্য, তাহা তিনি পূর্ব্ব রাত্রিতেই বলিয়াছিলেন। রমাসুন্দরীকে ত তিনি চটাইতে পারেন না, ভগিনীর সাহায্যেই তিনি এখন গ্রামের দশজনের একজন। এ অবস্থায় তিনি আর আপত্তি করিলেন না। রমাসুন্দরী চলিয়া যাইবার পর কথাটা ক্রমে রাষ্ট্র হইয়া পড়িল।
শ্যামা ঠাকুরাণী এত বড় ব্যাপারের কিছুই রাত্রিতে জানিতে পারেন নাই। পূর্ব্বদিন চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে অধিক পরিশ্রম হওয়ায় পরদিন শয্যা ত্যাগ করিতে তাহার একটু বিলম্বই হইয়াছিল। তিনি যখন ঘরের বাহিরে আসিয়া প্রাত্যহিক কাজকর্ম্মে হাত দিয়াছেন, এমন সময় প্রতিবেশিনী হরি সরকারের মা আসিয়া বলিল “ও দিদি! তুমি বুঝি এই উঠ্লে? রাতের খবর বুঝি কিছুই জান না?”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “হ্যাঁ ভাই, কাল বড় খাটুনী গিয়াছে। বুড়ো বয়স, এখন আর অত পরিশ্রম সহ্য হয় না, তাই আজ সকালে উঠতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছে। তা, কি বলছিলে,ঐ রাতের খবর! কৈ না, আমি ত কিছুই জানিনে।”
“সে কি কথা, এমন একটা ব্যাপার হয়ে গেল, আর তুমি জান না।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বিস্মিত হইয়া বলিলেন “না, আমি কোন খবরই পাই নি। কি, হয়েছে কি?”
“হবে আর কি? গাঁময় একেবারে ঢি ঢি পড়ে গেছে। ওপাড়ার কালু মুখুয্যে না কি রাত্তিরে তার ভাই-বৌকে বেইজ্জত করেছে। তাই নিয়ে একেবারে কুরুক্ষেত্তর কাণ্ড! চণ্ডী মুখুয্যের বোন সুন্দরী ঠাকুরাণী ওদের ছেলের ভাতে এসেছিল কি না। সে না কি আজ সকালেই গোরা মুখুয্যের বৌ আর তার মেয়েকে নিয়ে চলে গেছে।”
শ্যামা ঠাকুরাণী উগ্রভাবে বলিলেন “কি বলিস্, এত বড় কাণ্ড হয়ে গেল, আর আমি খবরটাও পেলুম না, আমাকে কেউ কথাটাও জিজ্ঞাসা করল না। না, তুই হয় ত শুন্তে ভুল করেছিস্। তাও কি কখন হয় ?”
“আমি কি আর না জেনে-শুনেই কথা বল্ছি। আমার ছেলে যে কাল রাত্রিতে মুখুয্যে-বাড়ীতেই ছিল। সে আর ঐ গোলমালে বাড়ী আস্তেই পারে নাই। এই সকাল বেলা এসে সব কথা বল্ল। তারা নৌকা ছেড়ে দিয়ে চলে গেলে তবে ত আমার ছেলে বাড়ী এসেছে।”
শ্যামা ঠাকুরাণী রাগে, অভিমানে একেবারে জ্বলিয়া উঠিলেন। কি, এত বড় কথা! এখনও তিনি মরেন নাই; ইহারই মধ্যে এমন অশ্রদ্ধা! তাঁহাকে না জানাইয়াই ও-পাড়ার লোকেরা এত বড় কাজটা করিয়া ফেলিল। তিনি তখন ক্রোধভরে বলিলেন “বেশ, যার যা ইচ্ছে, সে তাই করুক গে! শ্যামা বামণী এ গাঁয়ের আর কাহার কোন কথার মধ্যে নেই। কি বেইমান গো, এই গাঁয়ের লোকগুলো! এই যে এতদিন দিন নেই, রাত নেই, যে যখন বিপদে পড়েছে, যার যখন দরকার পড়েছে, তখনই এই শ্যামা বামণী না খেয়ে না দেয়ে একেবারে বুক দিয়ে পড়েছে, এ বুঝি তারই ফল। যাক্ আমি আর কারো কিছুর মধ্যে নেই। কারও বাড়ীও যাব না, কারও কোন কথাতেও থাক্ব না। আমি কি কারও খাই না ধারি যে, যে ডাক্বে তার বাড়ী যাবো। আজ থেকে নাকে-কাণে খত দিচ্ছি হরির মা! আমার পায়ে এসে মাথা খুঁড়লেও কারও উপকার করছিনে। এত হেনেস্তা, এমন অপমান৷” শ্যামা ঠাকুরাণী এই বলিয়াই ঘরের মধ্যে চলিয়া গেলেন; হরি সরকারের মা প্রাঙ্গণে একটু দাঁড়াইয়া থাকিয়া আপন কাজে চলিয়া গেল।
শ্যামা ঠাকুরাণীর রাগও হইল, অভিমানও হইল; কিন্তু এত বড় একটা ব্যাপারে তাঁহাকে না ডাকিয়া, তাঁহার সঙ্গে পরামর্শ না করিয়া যে গ্রামের সকলে একটা কাজ করিয়া বসিল, ইহাতে মুখে তিনি যতই উপেক্ষা প্রদর্শন করুন না কেন, তাঁহার মনে কিন্তু বড়ই বাজিল। গ্রামের মধ্যে তাঁহার যে একাধিপত্য ছিল, তাহা এক কথায় ছাড়িয়া দিতে ত তিনি পারেন না; তাহা হইলে যে তিনি একেবারে দশজনের একজন হইয়া পড়িবেন; ভবিষ্যতে যে কেহই তাঁহাকে মানিবে না। সুতরাং এমন করিয়া সমস্ত সম্পর্ক ছাড়িয়া দিয়া সুবর্ণপুরে বাস করা তাঁহার পক্ষে একেবারে যে অসম্ভব। গ্রামের দশজনের দশ কথা, দশ ব্যাপার লইয়াই যে তিনি জীবনের এই সুদীর্ঘকাল কাটাইয়াছেন। তাঁহার আর গৃহকর্ম্ম এমন কি? বিধবা ব্রাহ্মণ-কন্যার এক বেলার দুটা হবিষ্যি, তার জন্য ত আর সারা দিন-রাত দরকার হয় না; জোতজমা ও খাতক লইয়াই বা কতক্ষণ সময় কাটে?
শ্যামা ঠাকুরাণী ঘরের মধ্যে যাইয়া এটা ওটা নাড়াচাড়া করেন, আর ঐ কথাই তাঁহার মনে হয়। তাই ত, এতদিন না ততদিন, গ্রামের লোক তাঁহাকে এতবড় কাণ্ড সম্বন্ধে একটা কথাও জিজ্ঞাসা করিল না। একবার ভাবিলেন, কাজ নাই, চুপ করিয়াই থাকিবেন; কিছুর মধ্যেই যাইবেন না; কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল, না, সে কিছুতেই হইতে পারে না। কথাটার বৃত্তান্ত তাঁহার জানিতেই হইতেছে। তখন আর তিনি ঘরে থাকিতে পারিলেন না; কাজকর্ম্ম আর করা হইল না; বাসি কাজ পড়িয়াই রহিল। তিনি ঘরে তালা বন্ধ করিয়া বাহির হইলেন।
রাস্তা দিয়া যাইতে ও-বাড়ীর তারার পিসি তাহার উঠান হইতে বলিল “কি গো দিদি ঠাকরুণ, মুখুয্যে বাড়ী যাচ্ছ বুঝি। তা তুমি না গেলে চলবে কেন? বাবা গো, এমন কথা ত কখন শুনিনি দিদি! তুমি গাঁয়ে আছ, কা’ল রাত্তিরেই মিটিয়ে দিতে পার নেই। আজ আবার শুনলাম, মাগীটা না কি গাঁ ছেড়ে গিয়েছে ? হ্যাঁ দিদি ঠাকরুণ, তুমি গায়ে থাক্তে এক গাঁয়ের কলঙ্ক আর এক গাঁয়ে যেতে দিলে। তা যাই বল না, এ কাজটা তোমার ভাল হয় নাই ।”
শ্যামা ঠাকুরাণী আত্ম-প্রতিষ্ঠা অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্য বলিলেন “তা কি করি বল বোন! রমা আমার ত পর নয়। তার সঙ্গে আমার যে ভাব, সে আমাকে যে রকম ভালবাসে, তাতে তার কথাও ফেলে দেওয়া যায় না। তাইতে বুঝলে বোন! ছেড়ে দিতে হোল। এখন যাই দেখি, সব মিটিয়ে দিয়ে আসি। এ গায়ের কোন কাজেই ত এই শ্যামা বামণী না হলে চলে না।”
তারার পিসি বলল “সে কি আর বল্তে দিদি ঠাকরুণ, তুমি আছ বলেই আমাদের এই গাঁটা ঠিক আছে, নইলে এতদিন কি কেউ গাঁয়ে বাস করতে পারত। তা হ্যাঁ দেখ, ও-বেলা তোমার ওখানে যাব মনে করেছিলাম। তা এখনই দেখা হয়ে গেল, এখনই কথাটা বলি। তারা বল্ছিল পিসিমা, হাতে ত টাকা নেই, জমিদারের খাজনা তিন টাকা দুই-এক,দিনের মধ্যেই দিতে হবে। তুমি যদি বামুনঠাকরুণের কাছ থেকে ধার করে এনে দাও। তাই তোমার কাছে যেতে চেয়েছিলাম। পথেই দেখা হোলো। ও-বেলা কখন যাব দিদিঠাকরুণ!”
শ্যামা ঠাকরুণ বলিলেন “এই যে তারা সে-দিন দশ টাকা নিয়ে গেছে; আবার আজ টাকা। দশ দশ টাকা; কি করে শোধ দেবে। তোমরা যে টাকা দিয়ে কি কর, তা বুঝতে পারি নে। আর আমারই কি ন-শ পঞ্চাশ আছে যে, যার যখন দরকার পড়বে, তখনই কুলোবো। এখন তাড়াতাড়ি, আর কথা বল্তে পারছিনে। তুমি আর যেও না, তারাকেই ও-বেলা পাঠিয়ে দিও। দেখ্ব, কি করতে পারি।”
তারার পিসি বলিল “আর করা-করি নয় দিদি ঠাকরুণ, এ দায়টা তোমার উদ্ধার করে দিতেই হবে। তুমি না হলে আমাদের এ গরিবদের দুঃখু আর কে বোঝে বল। তা যাও, আর দেরী করো না। মুখুয্যেদের যে এমন ব্যাভার, তা এতদিন জানতাম না।”
শ্যামা ঠাকুরাণী এ কথার কোন উত্তর না দিয়াই অগ্রসর হইলেন। একটু যাইতেই রাস্তার বাম পার্শ্বে রামতারক ভট্টাচার্যোর বাড়ী। শ্যামা ঠাকুরাণীর মনে পড়িল, তারকের ছেলেকে ত কাল দেখা হয় নাই। অমনি রাস্তা ছাড়িয়া তিনি ভট্টাচার্য্য বাড়ীর দিকে গেলেন। বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিয়া উঠানে দাঁড়াইয়াই বলিলেন “ওগো বৌমা, ছেলেটা কা’ল কেমন ছিল? কা’ল আর আসতে পারি নি; সারাদিনটা মুখুয্যে বাড়ীর ব্যাপারে ছিলাম; ছেলেটার কথা আর মনে হয় নাই। নিয়ে এস ত দেখি? কা’ল ক’বার দাস্ত হয়েছিল?”
রামতারকের স্ত্রী তাড়াতাড়ি ছেলে কোলে লইয়া উঠানে আসিয়া বলিল “কা’ল একটু ভালই ছিল। পেটের বেদনাও একটু কম, দাস্তও এই পাঁচ ছয়বার হয়েছিল। তা মা, আসন এনে দিই, একটু বোসো।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “না মা, আমার কি বস্বার সময় আছে। ভয় নেই, আমাশয় কি না, সারতে একটু সময় নেবে। ঐ যে শিকড় তোমাকে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছি, আজও তারই রস একটু আদার রসের সঙ্গে খাইয়ে দিও। আর দুই-একদিন সাবধানে রেখো, ছেলে সেরে উঠ্বে। কোন অত্যাচার করে না বৌমা! কৈ, তারক কৈ? তাকে ত দেখ্ছিনে?
তারকের স্ত্রী বলিল “সকালে উঠেই তিনি মুখুয্যে-বাড়ী গিয়েছেন। হ্যাঁ মা, মুখুয্যে-বাড়ী কি হয়েছে? ওঁকে জিজ্ঞাসা করতে উনি বল্লেন, সে সব শুনে কাজ নেই। কোন খুন-খরাবৎ হয় নি ত!”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “বৌমা, সে সব কথা আর তোমার শুনে কাজ নেই। তোমরা বৌ-মানুষ, সে কথা শুন্লে লজ্জায় তোমাদের মাথা হেঁট হবে। আশীর্ব্বাদ করি, স্বামীপুত্র নিয়ে সুখে থাক, পরের কথার মধ্যে যেও না।”
তারকের স্ত্রী তখন নতজানু হইয়া শ্যামা ঠাকুরাণীর পদধূলি লইয়া প্রথমে ছেলের মাথায় দিল, তাহার পর নিজের মাথায় লইয়া বলিল “সেই আশীর্ব্বাদই কর মা ! তাই যেন হয়। ফিরে যাবার সময় আর একবার থোকাকে দেখে যাবে ত । আমি এখনই ওষুধ এনে খাইয়ে দিচ্ছি।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “আর ত ভয়ের কিছু নেই। দেখি, ফিরবার সময় যদি পারি ত একবার খোঁজ নিয়ে যাব । আমার কি মা, সোয়াস্তি আছে, না অবসর আছে। এই গায়ের দশ তাল নিয়েই আমি আছি।”
তারকের স্ত্রী বলিল, “তাই থাক মা, তাই থাক। তুমি আছ, তাই বিপদ-আপদে ভয় হয় না; ডাক্লেই তুমি এসে উপস্থিত হও। কত যে বল ভরসা তোমার করি মা, তা এক মুখে বল্তে পারিনে৷”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “আর দেরী করতে পারছিনে। দেরী করে গেলে সবাই একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠ্বে। তাই দেখ বাছা, তোরা আছিস্ গ্রামের পুরুষ-মানুষ; তোরা লেখাপড়া জানিস; তোদেরও বুদ্ধি-বিবেচনা আছে; কিন্তু যে কাজটী পড়বে, অমনি ডাক্ এই শ্যামা বামণীকে। এক কাল ছিল, যখন এসব পেরে উঠতাম; এখন বয়সও হয়েছে, এখন কোথায় বসে ঠাকুর দেবতার নাম করব, না কে কোন্ মুখুয্যে তার ভাই বৌয়ের উপর অত্যাচার করল, এখন চললাম তার সালিস্ করতে।”
তারকের স্ত্রী বলিল “তা হলে কথাটা সত্যি না কি? ও মা, কি ঘেন্না, কি লজ্জা! আমি অমনি একটু আভাস পেয়েছিলাম। তা যাক্গে, তুমি ঠিক্ বলেছ, ও-সব লজ্জার কথা, কলঙ্কের কথা গেরস্তর বৌদের না শোনাই ভাল! কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাক্বে মা, তাড়াতাড়ি যদি না থাকে ত আসন এনে দিই, একটু বোসো।”
“না, না, আর বস্বার সময় নেই” বলিয়া শ্যামা ঠাকুরাণী ভট্টাচার্য্য-বাড়ী হইতে বাহির হইলেন। সদর রাস্তায় উঠিবার সময়ই দেখিলেন, মুখুয্যেপাড়ার দিক হইতে হরিশ গাঙ্গুলীর ছেলে মহিম আসিতেছে। তাহাকে দেখিয়াই শ্যামা ঠাকুরাণী রাস্তার পার্শ্বে ই দাঁড়াইলেন। মহিম তাঁহাকে দূর হইতেই দেখিয়াই একটু দ্রুতগতিতে আসিয়া বলিল “পিসিমা, আমি যে তোমার বাড়ীতেই যাচ্ছিলাম।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “আমার বাড়ীতে! কেন, তোর কিছু দরকার আছে না কি?” এই বলিয়াই তিনি নিজের বাড়ীর দিকে মুখ ফিরাইলেন, যেন বাড়ীর দিকেই যাইবেন।
মহিম বলিল “বাবা পাঠিয়ে দিলেন তোমাকে ডাক্তে । এখনই একবার চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে যেতে হবে। পাড়ার সকলেই তোমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করছেন।”
শ্যামা ঠাকুরাণী একটু অভিমানের সুরে বলিলেন “আমার জন্য অপেক্ষা, কেন ? আমি গরিব বামুণের বিধবা মানুষ; গায়ের এক কোণে পড়ে আছি; আমার আর তত্ত্বতলাসের দরকার কি? হাঁ, যদি রমার মত জমিদার হতাম, তা হোলে তোরাই দিনের মধ্যে পচিশ-বার খোজ নিতি। বল্গে যা, আমার এখন সময় নেই। আমার যাবারই বা দরকার কি ? তারকের ছেলেটার অসুখ, তাই দেখ্তে এসেছিলাম। আমি যেতে পাচ্ছিনে। তোরাই আছিস্, তোরাই এখন গাঁয়ের প্রধান হয়েছিস্। তোরাই যা হয় কর গিয়ে, আমার খোজ কেন?” এই বলিয়া শ্যামা ঠাকুরাণী নিজ গৃহের দিকে দুই তিন পা বাড়াইলেন।
মহিম বলিল “ও কি কথা বল্ছ পিসিমা ! তুমি না হ’লে কি আমাদের চলে। কা’ল রাত্রিতেই যখন পাড়ার সকলে একত্র হলেন, তখন আমিই বলেছিলাম, এখনই শ্যামা পিসিকে খবর দেওয়া হোক্। তাতে সকলেই বল্লেন যে, বুড়ো মানুষ, এই সারাদিন খেটেখুটে সন্ধ্যার সময় ক্লান্ত হয়ে বাড়ী গিয়েছেন, এখন আর তাঁকে কষ্ট দিয়ে কাজ নেই। কা’ল সকালে তাঁকে ডেকে এনে একটা ব্যবস্থা করলেই হবে। তাইতেই ত তোমাকে তাঁরা ডাক্তে পাঠিয়েছেন।”
“হ্যাঁরে, শুন্লাম না কি বৌটাকে আর তার মেয়েটাকে রমা। নিয়ে গিয়েছে?”
মহিম বলিল “হ্যাঁ, আজ ভোরে তাঁরা চলে গিয়েছেন।” “চলে যদি গিয়ে থাকে, তোরা যদি যেতে দিয়ে থাকিস্, তা হ’লে এখন আবার তার ব্যবস্থা কি?”
“আমরা কি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আজ ভোরেই তাঁরা যাবেন । কা’ল রাত্রিতে ঐ রকম একটা কথা উঠেছিল, এই মাত্র। তাই যে হবে, তা আমরা জান্তাম না, বুঝতেও পারি নাই ।”
“তা হ’লে বল্, কাউকে জিজ্ঞাসা না করে চণ্ডী মুখুয্যে এই কাজ করেছে ? এর একটা ব্যবস্থা করা চাই। চণ্ডী মুখুয্যে কেমন ছেলে, তা দেখ্তে হবে । মনে করেছিলাম, এ সবের মধ্যে যাব না ; কিন্তু চণ্ডী মুখুয্যের এত বড় বাড় বাড়ন্ত কেমন করে হোলো, সেটা বুঝতে হবে। চল্, যাই দেখি।” এই বলিয়া শ্যামা ঠাকুরাণী বাড়ীর দিক হইতে ফিরিয়া মুখুয্যে-পাড়ার দিকে চলিলেন। মহিম আর বাক্যব্যয় না করিয়া তাঁহার অনুগমন করিল।
চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে পৌঁছিয়াই শ্যামা ঠাকুরাণী দেখিলেন, পাড়ার অনেকেই সেখানে সমবেত হইয়াছেন। তিনি কোন প্রকার ভূমিকা না করিয়া একেবারে অতি কঠার স্বরে চণ্ডী বাবুকে আক্রমণ করিলেন; বলিলেন “আচ্ছা বলি চণ্ডীচরণ, তুমি এমনই কি গাঁয়ের মাতব্বর হয়ে বসেছ, যে কাউকে কিছু না বলে এমন কাজটা করে বস্লে।”
চণ্ডী বাবু বলিলেন “কৈ, আমি ত কিছুই করি নাই।”
“কর নাই? তোমার বোন বড় জমিদার, তা জানি; কিন্তু তাই ব’লে সে যে আমাদের গাঁয়ের এই কলঙ্কটা দশ গাঁয়ে ছড়িয়ে দিতে গেল, আর তুমি তাতে কথাটাও বল্লে না, এ কি ভাল হোলো ?”
চণ্ডী বাবু বলিলেন “আমি কেন তা করতে যাব? দিদি ওদের নিয়ে গেলেন, তাতে আমার হাত কি? আমি নিষেধ করবারই বা কে? তবুও এঁদের জিজ্ঞাসা কর, আমি আপত্তি করেছিলাম কি না।”
“তুমি আপত্তি কর্লে, আর তোমার বাড়ীর বৌকে মেয়েকে তারা জোর করে নিয়ে গেল! কাকে বোকা বোঝাও তুমি চণ্ডীচরণ! আমার বয়স এই ষাট পার হয়ে গেল; তোমাদের হাটহদ্দ সবই আমি জানি। তোমার দিদি বড়মানুষ আছেন, বেশ কথা । তিনি তাঁর নিজের দেশে, নিজের জমিদারীতে গিয়ে তাঁর ক্ষমতা দেখান। আমাদের গাঁয়ের বৌকে তিনি অমন করে নিয়ে যাবার কে? তাই বল ত শুনি? আর, তুমি এর ভিতর না থাক্লে, সে যতবড় লোকই হোক না কেন, এমন কাজ করতে পারে?”
ভট্টাচার্য্য মহাশয় দেখিলেন বেগতিক; তিনি বলিলেন “সে যা হবার তা হয়ে গিয়েছে; এখন এ অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার কি হবে, তাই বল। আমরাই কি জানি যে, তার। আজ ভোরেই ওদের নিয়ে চলে যাবে। কা’ল রাত্রে ঐ রকম একটা কথা হয়েছিল বটে; কিন্তু তার ত কোন মীমাংসাই হয় নাই। চণ্ডীর এ কাজটা যে গর্হিত হয়েছে, এ কথা বল্তেই হবে। তাদেরও বিবেচনা করা উচিত ছিল।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “সে ত ঠিক্ কথা। আমাদের গাঁয়ের বৌ দোষ-ঘাট করে থাকে, আমরাই তার শাস্তি দেব, আমরাই তার ব্যবস্থা করব; তারা কোথাকার কে যে, গাঁয়ের বৌকে এমন করে নিয়ে যায়। এতে যে তোমাদের একেবারে মাথা কাটা গেল, তা বুঝতে পেরেছ।”
একটী যুবক সেখানে দাঁড়াইয়া ছিল; তাহার আর সহ্য হইল না; সে বলিল “কাজটা অন্যায়ই বা কি হয়েছে? তোমরা ব্যবস্থা করলে, সেই বৌটাকে তাড়িয়ে দেবার। তাঁরা দয়া করে তাকে আশ্রয় দিয়ে নিয়ে গেলেন। এতে তাঁদের অপরাধটা কি হোলো।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “তাড়িয়ে দেবে না, কি মাথায় করে নাচ্বে। চুপ কর্, তোরা ছেলে-মানুষ, এ সব কথার তোরা কি বুঝবি। কত বড় অপমানটা হোলো জানিস্।”
যুবকও ছাড়িল না; বলিল “আর সেই নিরপরাধা বৌটীকে বাজারে দাঁড় করিয়ে দিলে ভারি আমাদের মান বাড়ত। যে অপরাধ করল, তার কোন শাস্তির কথা নেই, কথা হোলো কি না, যারা শত বিপদ, শত লাঞ্ছনার ভয় না করে, সেই অনাথাকে আশ্রয় দিল, তাদিকে কেমন করে নির্য্যাতন করা যায়, তারই ব্যবস্থা।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “জানিস্ নে, শুনিস্ নে; মাঝের থেকে মোড়োলী করতে আসিস্। এই যে শ্যামা বামণী দেখ্ছিস, এর কাছে কিছুই ছাপা নেই। ও বৌটা ঐ রকমই বজ্জাত ছিল। আমি আর কি না জানি; তবে গাঁয়ের বৌ, তাই এতদিন চাপা দিয়ে রেখেছিলাম। হয় না হয়, ঐ ত কালাচাঁদ বসে আছে, ওকে জিজ্ঞাসা কর্। আসল কথা ত জানিস্নে এতকাল গেল, কালাচাঁদ কিছু করল না; আর কা’ল রাত্তিরে, পাশের বাড়ীতে দশ গাঁয়ের লোক জমা, সেই সময় বৌকে আক্রমণ করতে গেল; এও কি বিশ্বাসের কথা।”
আর একটা যুবক বলিল “সে কি কথা পিসিঠাকরুণ, আমরা যে সেখানে উপস্থিত ছিলাম, আমরা যে স্বচক্ষে দেখেছি।”
“ছাই দেখেছিস্। আসল কথা ত তোরা বুঝলিনে। আমি শোনা মাত্র ওসব বুঝে নিয়েছি; আর আমি সবই জানি কি না। হয় না হয় জিজ্ঞাসা কর ঐ কালাচাঁদকে।”
যুবক বলিল “ওঁকে আবার কি জিজ্ঞাসা করব। তোমরা বিচার না কর, সে ভার আমরাই নেব।”
শ্যামা ঠাকরুণ বলিলেন “তোর যে ভারি আস্পর্দ্ধা দেখেছি রে রেমো! দুই পাতা ইংরেজী পড়ে দেখ্ছি বাপ-দাদাকেও মানিস্ নে । এই বুঝি তোদের লেখা-পড়া শেখা। আমরা দশজন বুড়েবুড়ি কথা বলছি, তার মধ্যে তোরা কথা বলতে আসিস্ কেন?”
রাম বলিল “অন্যায় দেখলেই কথা বলতে হয়। গোরাচাঁদ দাদার স্ত্রীকে এ গাঁয়ের কে না জানে। তাঁর মত সতী লক্ষ্মী গাঁয়ে কয়জন আছে? আর তোমরা কি না তাঁর চরিত্রে কলঙ্ক দিতে যাচ্ছ। আর যে এমন পাপের কাজটা করল, তাকে কিছু বল্ছ না। এ আমরা সইব না, তাতে যিনি যা বলুন।” শ্যামা ঠাকরুণ দেখিলেন ষে, এই যুবকদের সঙ্গে তিনি পারিয়া উঠিবেন নাা; তখন একটু ধীর ভাবে বলিলেন “আচ্ছা, তোরা যে এত গোল করছিস্, কিন্তু ব্যাপারটা কি, তা একবার ঐ কালাচাঁদকে জিজ্ঞাসা করেছিলি।”
“ওঁকে আবার কি জিজ্ঞাসা করব। আমরা যে তখন বাড়ীর উপর ছিলাম, আমরা যে সব দেখেছি।”
“দেখ্লেই ত হয় না, শুন্তেও হয়। আমি ত ছিলাম না তখন; কিন্তু কি হয়েছিল, তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। ঐ গোরার বৌটার স্বভাব-চরিত্র ভাল ছিল না; তা তোমরা না জান্তে পার, আমি জানি। কালাচাঁদ তাই জানতে পেরে কা’ল তাকে শাসন করতে গিয়েছিল। এই হোলো ব্যাপার। বৌটা তাই এই সোর-গোল করে নিজের সাফাই দেখাল। নইলে কালাচাঁদ কি এমন কাজ করতে পারে? তার স্বভাব ভাল না, তা সকলেই জানে; কিন্তু এই যে এতকাল গেল, এর মধ্যে তোমরা কেউ বল্তে পার যে, ও কোন দিন কোন গেরস্তর বৌঝির দিকে কু-নজরে চেয়েছে। এ সব খেলা বুঝতে তোমাদের অনেকদিন লাগ্বে। তা, সে কথা যাক্, তোমরা ত অনেক প্রবীণ লোকই এখানে রয়েছ, তোমরা যে কোন কথাই বল্ছ না? এখন কি ছেলেদের হাতে সব বিচার-আচার ফেলে দেবে? তাই যদি তোমাদের অভিপ্রায় হয়, তা হ’লে আর আমাকে ডাকা কেন?”
এইবার একটী যুবক খুব জোরের সঙ্গে বলল, “দেখ শ্যামা পিসি, তুমি কিছু মনে কোরো না, কিন্তু তুমি যা বল্লে, তার একটা কথাও সত্য নয়, এ আমি খুব বল্তে পারি। ও বাড়ীর বড় বৌয়ের স্বভাব মন্দ ছিল, এমন কথা গাঁয়ের কেউ কখন বল্তে পারবে না। আজই তোমার মুখে শুনলাম। এ কথা আমরা বিশ্বাস করিনে। কর্ত্তাদের যা ইচ্ছা হয়, তাঁরা করতে পারেন; আমরা কিন্তু বলছি, আমরা কালাচাঁদ মুখুয্যের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখব না; আর পারি ত, তাকে এই গাঁ-ছাড়া করব। এমন একটা ভয়ানক পাপের কাজ যে কর্ল, তোমরা তাকে নির্দোষী বল্তে চাও; আর যার কোন দোষ নেই, যে সতী-সাধ্বী, তার নামে তোমরা মিথ্যা কলঙ্ক দিতে চাও৷ তাঁকে ওঁরা নিয়ে গিয়ে ছেন, বেশ করেছেন; নইলে তোমরা তাঁর কি অবস্থা করতে, তা তোমাদের ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এতকাল যা হবার হয়েছে, এখন আর আমরা এ সব হতে দিচ্ছি নে৷”
বুড়া গাঙ্গুলী মহাশয় এতক্ষণ কোন কথাই বলেন নাই। যুবকের এই তেজের কথা শুনিয়া তিনি বলিলেন “তা হলে এ গ্রামে আমাদের কথা থাক্বে না? তোমরাই কর্ত্তা হয়ে বস্বে না কি?”
যুবক বলিল “আমরা কর্ত্তা হতে চাইনে; আপনার ন্যায়-মত যা করবেন, আমরা ঘাড় পেতে তা স্বীকার করব; কিন্তু আমরা অন্যায়ের প্রশ্রয় দেব না।”
গাঙ্গুলী মহাশয় বললেন “তা হ’লে বাপ-বেটায় ঝগড়া আরম্ভ হবে দেখ্ছি।”
চণ্ডী বাৰু সেই যে গোড়ায় দুই একটী কথা বলিয়াছিলেন, তাহার পর এতক্ষণ কিছু বলেন নাই। তিনি গত রাত্রেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, এবার লেখা-পড়াজানা যুবকের দল শক্তি সঞ্চয় করিয়াছে; তাহারা, যাহা উচিত তাহার জন্য লড়িবে। এখন যুবকদের মুখে সেই ভাবের কথা শুনিয়া তাঁঁহার সাহস হইল; তিনি বলিলেন “কার কথায় সমাজ চল্বে, তা বল্তে পারিনে; কিন্তু ছেলেরা যা বল্ছে, তার একটী কথাও ত অন্যায় নয়। গোরার স্ত্রীর সম্বন্ধে যে কথা বলা হোলো, আমি তার প্রতিবাদ করছি। আমি বল্ছি, তার কোন অপরাধ নেই; তার চরিত্র খুব ভাল ছিল, এ কথা আমিও সহস্র বার বল্তে পারি। কালু যে কাজ করেছে, তার জন্য তার বিশেষ দণ্ড হওয়া উচিত। তা না করে, তাকে নির্দোষী প্রমাণ করবার জন্য যে কথা হচ্চে, আমি তার মধ্যে নেই। আমি কালুর সঙ্গে কোন সম্বন্ধ রাখৰ না আমার দিদি যা করেছেন, বেশ করেছেন; নইলে সে হতভাগিনী আজ মেয়েটী নিয়ে যে পথে দাঁড়াত! আমার কথা আমি বললাম, এখন এর জন্য তোমরা আমাকে যা করতে চাও, করতে পার। গাঁয়ে দলাদলি ছিল না, এখন না হয় একটা দলাদলিই হবে। তোমরা কালুকে নিয়ে থাক, আমি সমাজে একঘরে হয়েই থাকব; তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।”
যুবকেরা কোলাহল করিয়া উঠিল “কে চণ্ডী বাবুকে একঘরে করে, দেখা যাবে। আমরা সবাই ওঁর দিকে।”
শ্যামা ঠাকুরাণী রাগে অধীর হইয়া বলিলেন “বেশ, আজ থেকে আমিই একঘরে। আমি আর তোমাদের কিছুর মধ্যে নেই! এত অপমান! যাদের বাপ-কাকাদের জন্মাতে দেখলাম, তারাই কি না সুমুখে দাড়িয়ে অপমান করে! ডেকে এনে অপমান করে! আচ্ছা দেখা যাবে, চণ্ডী মুখুয্যের কেমন তেজ!” এই বলিয়া শ্যামা ঠাকুরাণী বাড়ীর বাহির হইয়া গেলেন।