প্রথম পরিচ্ছেদ
চন্দ্রনাথের পিতৃ-শ্রাদ্ধের ঠিক পূর্বের দিন কি একটা কথা লইয়া তাহার খুড়া মণিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের সহিত তাহার মনান্তর হইয়া গেল। তাহার ফল এই হইল যে, পরদিন মণিশঙ্কর উপস্থিত থাকিয়া তাঁহার অগ্রজের পারলৌকিক সমস্ত কাজের তত্ত্বাবধান করিলেন, কিন্তু একবিন্দু আহার্য স্পর্শ করিলেন না, কিংবা নিজের বাটীর কাহাকেও স্পর্শ করিতে দিলেন না। ব্রাহ্মণ-ভোজনান্তে চন্দ্রনাথ করজোড়ে কহিল, কাকা, দোষ করি, অপরাধ করি, আপনি আমার পিতৃতু্ল্য, আমি আপনার ছেলের মত—এবার মার্জনা করুন।
পিতৃতুল্য মণিশঙ্কর উত্তরে বলিলেন, বাবা, তোমরা কলকাতায় থেকে বি. এ., এম. এ. পাশ করে বিদ্বান্ ও বুদ্ধিমান্ হয়েছো, আমরা কিন্তু সেকালের মূর্খ, আমাদের সঙ্গে তোমাদের মিশ খাবে না। এই দেখ না কেন, শাস্ত্রকারেরাই বলেছেন, যেমন, গোড়া কেটে আগায় জল ঢালা।
শাস্ত্রোক্ত বচনটির সহিত আধু্নিক পণ্ডিত ও সেকেলে মূর্খের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ না থাকিলেও মণিশঙ্কর যে নিজের মনের ভাবটা প্রকাশ করিয়াছিলেন, চন্দ্রনাথ তাহা বুঝিয়া মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিল, খুড়ার সহিত আর সে কোন সম্বন্ধ রাখিবে না। আর পিতার জীবদ্দশাতেও দুই সহোদরের মধ্যে হৃদ্যতা ছিল না। কিন্তু আহার-ব্যবহারটা ছিল। এখন সেইটা বন্ধ হইল। চন্দ্রনাথের পিতা যথেষ্ট ধনসম্পত্তি রাখিয়া গিয়াছেন, কিন্তু বাটীতে আত্মীয়-স্বজন কেহ নাই, শুধু এক অপুত্রক মাতুল এবং দ্বিতীয় পক্ষের মাতুলানী।
সমস্ত বাড়িটা যখন বড় ফাঁকা ঠেকিল, চন্দ্রনাথ তখন বাটীর গোমস্তাকে ডাকিয়া কহিল, সরকারমশায়, আমি কিছুদিনের জন্য বিদেশে যাব, আপনি বিষয়-সম্পত্তি যেমন দেখছিলেন, তেমনি দেখবেন। আমার ফিরে আসতে বোধ করি বিলম্ব হবে।
মাতুল ব্রজকিশোর তাহাতে আপত্তি প্রকাশ করিয়া কহিলেন, এখন তোমার কোথাও গিয়ে কাজ নেই; তোমার মন খারাপ হয়ে আছে, এ সময় বাটীতে থাকাই উচিত।
চন্দ্রনাথ তাহা শুনিল না। বিষয়-সম্পত্তির সমুদয় ভার সরকার মহাশয়ের উপর দিয়া, এবং বসত-বাটীর ভার ব্রজকিশোরের উপর দিয়া অতি সামান্যভাবেই সে বিদেশ-যাত্রা করিল। যাইবার সময় একজন ভৃত্যকেও সঙ্গে লইল না।
ব্রজকিশোরকে নিভৃতে ডাকিয়া তাঁহার স্ত্রী হরকালী বলিল, একটা কাজ করলে না?
ব্রজকিশোর জিজ্ঞাসা করিলেন, কি কাজ?
এই যে বিদেশে গেল, একটা কিছু লিখে নিলে না কেন? মানুষ কখন কি হয়, কিছুই বলা যায় না। যদি বিদেশে ভালমন্দ হঠাৎ কিছু হয়ে যায়, তখন তুমি দাঁড়াবে কোথায়?
ব্রজকিশোর কানে আঙুল দিয়া জিভ কাটিয়া কহিলেন, ছি, ছি, এমন কথা মুখে এনো না।
হরকালী রাগ করিল। কহিল, তুমি বোকা, তাই মুখে আনতে হয়েছে, যদি সেয়ানা হ’তে, আমাকে মুখে আনতে হ’ত না।
কিন্তু কথাটা যে ঠিক, তাহা ব্রজকিশোর স্ত্রীর কৃপায় দুই-চারি দিনেই বুঝিতে পারিলেন। তখন পরিতাপ করিতে লাগিলেন।
এক বৎসর চন্দ্রনাথ নানা স্থানে একা ভ্রমণ করিয়া বেড়াইল। তাহার পর গয়ায় আসিয়া স্বর্গীয় পিতৃদেবের সাংবাৎসরিক পিণ্ডদান করিল, কিন্তু তাহার বাটী ফিরিয়া যাইবার ইচ্ছা হইল না—মনে করিল, কিছুদিন কাশীতে অতিবাহিত করিয়া যাহা হয় করিবে। কাশীতে মুখোপাধ্যায় বংশের পাণ্ডা হরিদয়াল ঘোষাল। চন্দ্রনাথ একদিন দ্বিপ্রহরে একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ হাতে লইয়া তাঁহার বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। কাশী চন্দ্রনাথের অপরিচিত নহে, ইতিপূর্বে কয়েকবার সে পিতার সহিত এখানে আসিয়াছিল। হরিদয়ালও তাহাকে বিলক্ষণ চিনিতেন। অকস্মাৎ তাহার এরূপ আগমনে তিনি কিছু বিস্মিত হইলেন। উপরের একটা ঘর চন্দ্রনাথের জন্য নির্দিষ্ট হইল, এবং ইহাও স্থির হইল যে, চন্দ্রনাথের যতদিন ইচ্ছা তিনি এইখানে থাকিবেন।
এ কক্ষের একটা জানালা দিয়া ভিতরের রন্ধনশালার কিয়দংশ দেখা যাইত। চন্দ্রনাথ আগ্রহের সহিত অনেক সময় এইদিকে চাহিয়া থাকিত। রন্ধন-সামগ্রীর উপরেই যে আগ্রহ তাহা নহে, তবে রন্ধনকারিণীকে দেখিতে বড় ভাল লাগিত।
বিধবা সুন্দরী। কিন্তু মুখখানি যেন দুঃখের আগুনে দগ্ধ হইয়া গেছে! যৌবন আছে কি গিয়াছে, সেও যেন আর চোখে পড়িতে চাহে না। তিনি আপন মনে আপনার কাজ করিয়া যান, নিকটে কেবল একটি দশমবর্ষীয়া বালিকা রন্ধনের যোগাড় করিয়া দিতে থাকে। চন্দ্রনাথ অতৃপ্তনয়নে তাহাই দেখে।
কিছুদিন তিনি চন্দ্রনাথের সম্মুখে বাহির হইলেন না। আহার্য সামগ্রী ধরিয়া দিয়া সরিয়া যাইতেন। কিন্তু ক্রমশঃ বাহির হইতে লাগিলেন। একে ত চন্দ্রনাথ বয়সে ছোট, তাহাতে এক স্থানে অধিক দিন ধরিয়া থাকিলে একটা আত্মীয়-ভাব আসিয়া পড়ে। তখন তিনি চন্দ্রনাথকে খাওয়াইতে বসিতেন—জননীর মত কাছে বসিয়া যত্নপূর্বক আহার করাইতেন।
আপনার জননীর কথা চন্দ্রনাথের স্মরণ হয় না—চিরদিন মাতৃহীন চন্দ্রনাথ পিতার নিকট লালিত-পালিত হইয়াছিল। পিতা সে স্থান কতক পূর্ণ রাখিয়াছিলেন সত্য, কিন্তু এরূপ কোমল স্নেহ তথায় ছিল না।
পিতার মৃত্যুতে চন্দ্রনাথের বুকের যে অংশটা খালি পড়িয়াছিল, শুধু তাহাই পূর্ণ হইয়া আসিতে লাগিল তাহা নহে, অভিনব মাতৃস্নেহ-রসে তাহাকে অভিভূত করিয়া ফেলিতে লাগিল।
একদিন চন্দ্রনাথ হরিদয়ালকে জিজ্ঞাসা করিল, আপনার নিজের বলিতে কেহ ত নাই বলিয়াই জানি, কিন্তু ইনি কে?
হরিদয়াল কহিলেন, ইনি বামুন-ঠাকরুন!
কোন আত্মীয়?
না।
তবে এদের কোথায় পেলেন?
হরিদয়াল কহিলেন, সে অনেক কথা। তবে সংক্ষেপে বলতে হলে, ইনি প্রায় তিন বৎসর হ’ল স্বামী এবং ওই মেয়েটিকে নিয়ে তীর্থ করতে আসেন। কাশীতে স্বামীর মৃত্যু হয়। দেশেও এমন কোন আত্মীয় নেই যে ফিরে যান। তার পর ত দেখছ।
আপনি পেলেন কিরুপে?
মণিকর্ণিকার ঘাটের কাছে মেয়েটি ভিক্ষে করছিল।
চন্দ্রনাথ একটু চিন্তা করিয়া কহিল, কোথায় বাড়ি জানেন কি?
ঠিক জানি না। নবদ্বীপের নিকট কোন একটা গ্রামে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দিন-দুই পরে আহারে বসিয়া চন্দ্রনাথ বামুন-ঠাকরুনের মুখের পানে চাহিয়া সহসা জিজ্ঞাসা করিল, আপনারা কোন্ শ্রেণী?
বামুন-ঠাকরুনের মুখখানি বিবর্ণ হইয়া গেল। এ প্রশ্নের হেতু তিনি বুঝিলেন। কিন্তু যেন শুনিতে পান নাই, এই ভাবে তাড়াতাড়ি দাঁড়াইয়া বলিলেন, যাই দুধ আনি গে।
দুধের জন্য অত তাড়াতাড়ি ছিল না। ভাবিবার জন্য তিনি একেবারে রন্ধনশালায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে কন্যা সরযূবালা হাতা করিয়া দুধ ঢালিতেছিল, জননীর বিবর্ণ-মুখ লক্ষ্য করিল না। জননী কন্যার মুখপানে একবার চাহিলেন, দুধের বাটি হাতে লইয়া একবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে কহিলেন, হে দীন-দুঃখীর প্রতিপালক, হে অন্তর্যামী, তুমি আমাকে মার্জনা ক’রো। তাহার পর দুধের বাটি আনিয়া নিকটে রাখিয়া উপবেশন করিলে, চন্দ্রনাথ পুনরায় সেই প্রশ্ন করিল।
একটি-একটি করিয়া সমস্ত কথা জানিয়া লইয়া চন্দ্রনাথ অবশেষে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি বাড়ি যান না কেন? সেখানে কি কেউ নেই?
খেতে দেয় এমন কেউ নেই।
চন্দ্রনাথ মুখ নিচু করিয়া কিছুক্ষণ ভাবিয়া কহিল, আপনার একটি কন্যা আছে, তার বিবাহ কিরূপে দেবেন?
বামুন-ঠাকরুন দীর্ঘনিশ্বাস চাপিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, বিশ্বেশ্বর জানেন।
আহার প্রায় শেষ হইয়া আসিল। চন্দ্রনাথ মুখ তুলিয়া চাহিয়া বলিল, ভাল ক’রে আপনার মেয়েটিকে কখন দেখিনি,—হরিদয়াল বলেন খুব শান্ত-শিষ্ট। দেখতে সুশ্রী কি?
বামুন-ঠাকরুন ঈষৎ হাসিয়া প্রকাশ্যে কহিলেন, আমি মা, মায়ের চক্ষুকে ত বিশ্বাস নেই বাবা; তবে সরযূ বোধ হয় কুৎসিত নয়। কিন্তু মনে মনে বলিলেন, কাশীতে কত লোক আসে যায়, কিন্তু এত রূপ ত কারও দেখিনি।
ইহার তিন-চারি দিন পরে একদিন প্রভাতে চন্দ্রনাথ বেশ করিয়া সরযূকে দেখিয়া লইল। মনে হইল, এত রূপ আর জগতে নাই। রান্নাঘরে বসিয়া সরযূ তরকারি কুটিতেছিল। সেখানে অপর কেহ ছিল না। জননী গঙ্গাস্নানে গিয়াছিলেন, এবং হরিদয়াল যথানিয়মে যাত্রীর অন্বেষণে বাহির হইয়াছিলেন।
চন্দ্রনাথ নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল। ডাকিল, সরযূ!
সরযূ চমকিত হইল। জড়সড় হইয়া বলিল, আজ্ঞে।
তুমি রাঁধতে পারো?
সরযূ মাথা নাড়িয়া কহিল, পারি।
কি কি রাঁধতে শিখেছ?
সরযূ চুপ করিয়া রহিল, কেননা, পরিচয় দিতে হইলে অনেক কথা কহিতে হয়।
চন্দ্রনাথ মনের ভাবটা বুঝিতে পারিল, তাই অন্য প্রশ্ন করিল, তোমার মা ও তুমি দুই জনেই এখানে কাজ কর?
সরযূ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, করি।
তুমি কত মাইনে পাও?
মা পান, আমি পাই নে। আমি শুধু খেতে পাই।
খেতে পেলেই তুমি কাজ কর?
সরযূ চুপ করিয়া রহিল।
চন্দ্রনাথ কহিল, মনে কর, আমি যদি খেতে দিই, তা হ’লে আমারও কাজ কর?
সরযূ ধীরে ধীরে বলিল, মাকে জিজ্ঞাসা করব।
তাই ক’রো।
সেইদিন চন্দ্রনাথ হরিদয়াল ঠাকুরকে দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিয়া বাটীতে সরকার মহাশয়কে এইরূপ পত্র লিখিল—
আমি কাশীতে আছি। এখানে এই মাসের মধ্যেই বিবাহ করিব স্থির করিয়াছি। মাতুল মহাশয়কে এ কথা বলিবেন এবং আপনি কিছু অর্থ, অলঙ্কার এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি লইয়া শীঘ্র আসিবেন।
সেই মাসেই চন্দ্রনাথ সরযূকে বিবাহ করিল।
তাহার পর বাড়ি যাইবার সময় আসিল। সরযূ কাঁদিয়া বলিল, মার কি হবে?
আমাদের সঙ্গে যাবেন।
কথাটা বামুন-ঠাকরুণের কানে গেল। তিনি কন্যা সরযূকে নিভৃতে ডাকিয়া বলিলেন, সরযূ, সেখানে গিয়ে তুই আমার কথা মাঝে মাঝে মনে করিস, কিন্তু আমার নাম কখনো মুখে আনিস না। যত দিন বাঁচবো কাশী ছেড়ে কোথাও যাব না। তবে যদি কখনো তোমাদের এ অঞ্চলে আসা হয়, তা হ’লে আবার দেখা হতে পারে।
সরযূ কাঁদিতে লাগিল।
জননী তাহার মুখে অঞ্চল দিয়া কান্না নিবারণ করিলেন, এবং গম্ভীর হইয়া কহিলেন, বাছা, সব জেনেশুনে কি কাঁদতে আছে?
কন্যা জননীর কোলের ভিতর মুখ লুকাইয়া ডাকিল, মা—
তা হোক। মায়ের জন্য যদি মাকে ভুলতে হয়, সেই ত মাতৃভক্তি মা!
চন্দ্রনাথ অনুরোধ করিলেও তিনি ইহাই বলিলেন। কাশী ছাড়িয়া তিনি আর কোথাও যাইতে পারিবেন না।
চন্দ্রনাথ বলিল, একান্ত যদি অন্যত্র না যাবেন, তবে অন্ততঃ স্বাধীনভাবে কাশীতে বাস করুন।
বামুন-ঠাকরুন তাহাও অস্বীকার করিয়া বলিলেন, হরিদয়াল ঠাকুর আমাকে মেয়ের মত যত্ন করেন এবং নিতান্ত দুঃসময়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন, আমিও তাঁকে পিতার মত ভক্তি করি; তাঁকে কিছুতেই ত্যাগ করতে পারব না।
চন্দ্রনাথ বুঝিল, দুঃখিনীর আত্মসম্ভ্রম বোধ আছে, সাধ করিয়া তিনি কাহারও দয়ার পাত্রী হইবেন না। কাজেই তখন শুধু সরযূকে লইয়া চন্দ্রনাথ বাটী ফিরিয়া আসিল।
এখানে আসিয়া সরযূ দেখিল, প্রকাণ্ড বাড়ি! কত গৃহসজ্জা, কত আসবাব—তাহার আর বিস্ময়ের অবধি রইল না। সে মনে মনে ভাবিল, কি অনুগ্রহ! কত দয়া!
চন্দ্রনাথ বালিকা বধূকে আদর করিয়া কহিল, বাড়িঘর সব দেখলে? মনে ধরেচে ত?
সরযূ অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া আঁচলে মুখ লুকাইয়া মাথা নাড়িল।
চন্দ্রনাথ স্ত্রীর মনের কথা বুঝিতে চাহে নাই; প্রত্যুত্তরে কণ্ঠস্বর শুনিতে চাহিয়াছিল, তাই দুই হাতে সরযূর মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া কহিল, কি বল, মনে ধরেছে ত?
লজ্জায় সরযূর মুখ আরক্ত হইয়া গেল, কিন্তু স্বামীর পুনঃ পুনঃ প্রশ্নে কোনরূপে সে বলিয়া ফেলিল, সব তোমার?
চন্দ্রনাথ হাসিয়া কথাটা একটু ফিরাইয়া বলিল, হাঁ, সব তোমার।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তাহার পর কতদিন অতিবাহিত হইয়া গেল। সরযূ বড় হইয়াছে। স্বামীকে সে কত যত্ন করিতে শিখিয়াছে। চন্দ্রনাথ বুঝিতে পারে যে, সে কথা কহিবার পূর্বেই সরযূ তাহার মনের কথা বুঝিয়া লয়। কিন্তু সে যদি শুধু দাসী হইত, তাহা হইলে সমস্ত বিশ্ব খুঁজিয়াও চন্দ্রনাথ এমন আর একটি দাসী পাইত না, কিন্তু শুধু দাসীর জন্যই কেহ বিবাহ করে না—স্ত্রীর নিকট আরও কিছুর আশা রাখে। মনে হয়, দাসীর আচরণের সহিত স্ত্রীর আচরণটি সর্বতোভাবে মিলিয়া না গেলেই ভাল হয়। সরযূর ব্যবহার বড় নিরীহ, বড় মধুর, কিন্তু দাম্পত্যের সুনিবিড়-পরিপূর্ণ সুখ কিছুতেই যেন গড়িয়া তুলিতে পারিল না। তাই এমন মিলনে, এত যত্ন-আদরেও উভয়ের মধ্যে একটা দূরত্ব, একটা অন্তরাল কিছুতেই সরিতে চাহিল না। একদিন সে সরযূকে হঠাৎ বলিল, তুমি এত ভয়ে ভয়ে থাক কেন? আমি কি কোন দুর্ব্যবহার করি?
সরযূ মনে মনে ভাবিল, এ কথার উত্তর কি? তুমি নিজে জানো না? তাহার পর ভাবিল, তুমি দেবতা, কত উচ্চ, কত মহৎ,—আর আমি? সে তুমি আজও জানো না। তুমি আমার প্রতিপালক, আমি শুধু তোমার আশ্রিতা। তুমি দাতা, আমি ভিখারিণী।
তাহার সমস্ত হৃদয় কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ, তাই ভালবাসা মাথা ঠেলিয়া উপরে উঠিতে পারে না,—অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত নিঃশব্দে ধীরে ধীরে হৃদয়ের অন্তরতম প্রদেশে লুকাইয়া বহিতে থাকে, উচ্ছৃঙ্খল হইতে পায় না—তেমনি অবিশ্রাম বহিতে লাগিল, কিন্তু চন্দ্রনাথ তাহার সন্ধান পাইল না—অতি বড় দুর্ভাগারা যেমন জীবনের মাঝে ভগবানকে খুঁজিয়া পায় না। কিন্তু আজ অকস্মাৎ উজ্জ্বল দীপালোকে যখন সে দেখিতে পাইল, পদ্মের মত ডাগর সরযূর চক্ষু দুটিতে অশ্রু ছাপাইয়া উঠিয়াছে, তখন কাতর হইয়া সহসা তাহাকে সে কাছে টানিয়া লইল। বুকের উপর মুখ লুটাইয়া পড়িল। চন্দ্রনাথ কহিল, থাক, ওসব কথায় আর কাজ নেই—বলিয়া দুই হাতে স্ত্রীর মুখ তুলিয়া ধরিল, মুদিত চক্ষের উপর সরযূ একটা তপ্ত-নিশ্বাস অনুভব করিল।
চন্দ্রনাথ কহিল, একবার চেয়ে দেখ দেখি—
সরযূর চোখের পাতা দুইটি আকুলভাবে পরস্পরকে জড়াইয়া ধরিল, সে কিছুতেই চাহিতে পারিল না।
কিছুক্ষণ পরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া চন্দ্রনাথ কহিল, তোমার বড় ভয়, তাই চাইতে পারলে না সরযূ। কিন্তু পারলে ভাল হ’ত, না হয়, একটা কাজ ক’রো, আমার ঘুমন্ত মুখ ভাল করে চেয়ে দেখো—এ মুখে ভয় করবার মত কিছু নেই। বুকে শুয়ে আছ, ভিতরের কথাটা কি শুনতে পাও না? তাই বড় দুঃখ হয় সরযূ—আমাকে তুমি বুঝতেই পারলে না।
তবু সরযূ কথা কহিতে পারিল না, শুধু মনে মনে স্বামীর চরণে প্রণাম করিয়া কহিল, আমি পদাশ্রিতা দাসী, দাসীকে চিরদিন দাসীর মতই থাকিতে দিয়ো।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চন্দ্রনাথের মাতুলানী হরকালীর মনে আর তিলমাত্র সুখ রহিল না। ভগবান তাহাকে এ কি বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলিয়া দিলেন। এ সংসারটা কাহারো নিকট কণ্টকাকীর্ণ অরণ্যের মত বোধ হয়, তাহাদের চেষ্টা করিয়া এখানে একটা পথের সন্ধান করিতে হয়। কেহ পথ পায়, কেহ পায় না। অনেক দিন হইতে হরকালীও এই সংসার-কাননে একটা সংক্ষেপ-পথ খুঁজিতেছিল, চন্দ্রনাথের পিতার মৃত্যুতে একটা সুরাহাও হইয়াছিল। কিন্তু এই আকস্মিক বিবাহ, বধূ সরযূ, চন্দ্রনাথের অতিরিক্ত পত্নীপ্রেম, তাহার এই পাওয়া-পথের মুখটা একেবারে পাষাণ দিয়া যেন গাঁথিয়া দিল। হরকালীর একটি বছর পাঁচেকের বোনঝি পিতৃগৃহে বড় হইয়া আজ দশ বছরেরটি হইয়াছে, কিন্তু সে কথা যাক। নানা কারণে হরকালীর মনের সুখ-শান্তি অন্তর্হিত হইবার উপক্রম করিয়াছিল।
অবশ্য আজও সে-ই গৃহিণী, তাহার স্বামী কর্তা—এ সমস্ত তেমনিই আছে। আজ পর্যন্ত সরযূ তাহারই মুখ চাহিয়া থাকে, কোন অসন্তোষ বা অভিমান প্রকাশ করে না। দেখিলে মনে হয়, সে এই পরিবারভুক্ত একটি সামান্য পরিজন মাত্র। হরকালীর স্বামী এইটুকু দেখিয়াই খুশি হইয়া যেই বলিতে যান—বৌমা আমার যেন—, হরকালী চোখ রাঙ্গা করিয়া ধমক দিয়া বলিয়া উঠে, চুপ কর, চুপ কর। য বোঝ না, তাতে কথা কয়ো না। তোমার হাতে দেওয়ার চেয়ে বাপ-মা আমাকে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিলে ছিল ভাল।
ব্রজকিশোর মুখ কালি করিয়া উঠিয়া যান।
হরকালীর বয়স প্রায় ত্রিশ হইতে চলিল, কিন্তু সরযূর আজও পঞ্চদশ উত্তীর্ণ হয় নাই,—তবু তাহার আসা অবধি দুই জনের মনে মনে যুদ্ধ বাধিয়াছে। প্রাণপণ করিয়াও হরকালী জয়ী হইতে পারে না। একফোঁটা মেয়ের শক্তি দেখিয়া হরকালী মনে মনে অবাক হয়। বাহিরের লোক এ কথা জানে না যে, এই অন্তর-যুদ্ধে সরযূ ডিক্রি পাইয়াছে, কিন্তু তাহা জারি করে নাই। নিজের ডিক্রি নিজে তামাদি করিয়া বিজিত অংশ তাহাকেই সে ফিরাইয়া দিয়াছে এবং এখানেই হরকালীর একেবারে হার হইয়াছে।
হরকালী বুঝিতে পারে, সরযূ বোবা কিংবা হাবা নহে। অনেকগুলি শক্ত কথারও সে এমন নিরুত্তর অবনতমুখে উত্তর দিতে সমর্থ যে, হরকালী একেবারে স্তম্ভিত হইয়া যায়, কিন্তু না পারিল সে এই মেয়েটির সহিত সন্ধি করিতে, না পারিল তাহাকে জয় করিতে। সরযূ যদি কলহ-প্রিয় মুখরা হইত, স্বার্থপর নির্দয় হইত, তাহা হইলেও হরকালী হয়ত পথ খুঁজিয়া পাইত। কিন্তু সরযূ নিজ হইতে এতখানি করুণা তাহাকে দিয়া রাখিয়াছে যে হরকালী অপরের করুণা ভিক্ষা করিবার আর অবকাশ পায় না।
সরযূ অন্তরে সম্পূর্ণ বুঝিতে পারে যে, এ বাটীর সে-ই সর্বময়ী কর্ত্রী, হরকালী কেহ না, তাই বাহিরে সে কেহ না হইয়া হরকালীকেই সর্বময়ী করিয়াছে। ইহাতেই হরকালী আরও ঈর্ষায় জ্বলিয়া পুড়িয়া মরে।
শুধু একটি স্থান সরযূ একেবারে নিজের জন্য রাখিয়াছিল, এখানে হরকালী কিছুতেই প্রবেশ করিতে পায় না। স্বামীর চতুষ্পার্শে সে এমন একটি সূক্ষ্ম দাগ টানিয়া রাখিয়াছে যে, তাহার ভিতরে প্রবেশ না করিতে পারিলে, আর কেহ চন্দ্রনাথের শরীরে আঁচড়টিও কাটিতে পারে না। এই দাগের বাহিরে হরকালী যাহা ইচ্ছা করুক, কিন্তু ভিতরে আসিবার অধিকার ছিল না। বুদ্ধিমতী হরকালী বেশ বুঝিতে পারে যে, এই একফোঁটা মেয়েটি কোন্ এক মায়ামন্ত্রে তাহার নখদন্তের সমস্ত বিষ হরণ করিয়া লইয়াছে।
এমনি করিয়া দীর্ঘ ছয় বৎসর গত হইল। সে এগারো বছর বয়সে স্বামীর ঘর করিতে আসিয়াছিল, সতরোয় পড়িল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
বয়সের সন্মান-জ্ঞানটা যেমন পুরুষের মধ্যে আছে, স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে তেমন নাই। পুরুষের মধ্যে অনেকগুলি পর্যায় আছে—যেমন দশ, কুড়ি, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট প্রভৃতি। ত্রিশবর্ষীয় একজন যুবা বিশ বছরের একজন যুবার প্রতি মুরুব্বিয়ানার চোখে চাহিয়া দেখিতে পারে, কিন্তু মেয়েমহলে এটা খাটে না। তাহার বিবাহকালটা পর্যন্ত বড় ভগিনী, ভ্রাতৃজায়া, জননী, পিসিমা অথবা ঠাকুরমাতার নিকট অল্পস্বল্প উমেদারি করে নারী-জীবনে যাহা কিছু অল্পবিস্তর শিখিবার আছে, শিখিয়া লয়;—তাহার পরই একেবারে প্রথম শ্রেণীতে চড়িয়া বসে। তখন ষোল হইতে ছাপ্পান্ন পর্যন্ত তাহার সমবয়সী। স্থানভেদে হয়ত বা কোথাও এ নিয়মের সামান্য ব্যতিক্রম দেখা যায়, কিন্তু অধিকাংশ স্থলেই এমনি। অন্ততঃ চন্দ্রনাথের গ্রাম-সম্পর্কীয়া ঠানদিদি হরিবালার জীবনে এমনটি দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল। সেদিন অপরাহ্নে পশ্চিমদিকের জানালা খুলিয়া দিয়া সরযূ আকাশের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। হরিবালা এক থালা মিষ্টান্ন এবং একগাছি মোটা যুঁইয়ের মালা হাতে লইয়া একেবারে সরযূর নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মালাগাছটি তাহাকে পরাইয়া দিয়া বলিলেন, আজ থেকে তুমি আমার সই হ’লে। বল দেখি সই—
সরযূ একটু বিপন্ন হইল। তথাপি অল্প হাসিয়া কহিল, বেশ।
বেশ ত নয় দিদি, সই ব’লে ডাকতে হবে।
ইহাকে আদরই বল, আর আবদারই বল, সরযূর জীবনে ঠিক এমনটি ইতিপূর্বে ঘটিয়া উঠে নাই, তাই এই আকস্মিক আত্মীয়তাকে সে মনের মধ্যে মিলাইয়া লইতে পারিল না। একদণ্ডে একজন দিদিমার বয়সী লোকের গলা ধরিয়া ‘সই’ বলিয়া আহ্বান করিতে তাহার লজ্জা করিতে লাগিল, কিন্তু হরিবালা যে ছাড়েন না। ইহাতে অভিনবত্ব কিংবা অস্বাভাবিকতা যে কিছু থাকিতে পারে, হরিবালার তাহা ধারণায় নাই। তাই সরযূর মুখ হইতে প্রিয়সম্বোধনটির বিলম্ব দেখিয়া একটু গম্ভীরভাবে, একটু ম্লান হইয়া তিনি কহিলেন, আমার মালা ফিরিয়ে দাও, আমি আর কোথাও যাই।
সরযূ বিপন্ন হইয়াছিল, কিন্তু অপ্রতিভ হয় নাই, ঈষৎ হাসিয়া মৃদুস্বরে কহিল, সইয়ের সন্ধানে নাকি?
ঠানদিদি একটুখানি স্থির থাকিয়া বলিলেন, বাঃ! এই যে বেশ কথা কও। তবে যে লোকে বলে, ওদের বৌ বোবা!
সরযূ হাসিতে লাগিল।
ঠানদিদি বলিলেন, তা শোন। এ গাঁয়ে তোমার একটিও সাথী নাই। বড়লোকের বাড়ি ব’লেও বটে, তোমার মামীর বচনের গুণেও বটে, কেউ তোমার কাছে আসে না, জানি। আমি তাই আসব। আমার কিন্তু একটা সম্পর্ক না হ’লে চলে না, তাই আজ ‘সই’ পাতালুম। আর বুড়ো হয়েছি বটে, কিন্তু হরিনামের মালা নিয়েও সারা দিনটা কাটাতে পারি না। আমি রোজ আসব।
সরযূ কহিল, রোজ আসবেন।
হরিবালা গর্জিয়া উঠিলেন, আসবেন কি লা? বল সই, তুমি রোজ এস। ‘তুই’ বলতে পারবি নে, না?
সরযূ হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, রক্ষা কর ঠানদিদি, গলায় ছুরি দিলেও তা পারব না।
ঠানদিদিও হাসিয়া ফেলিলেন, বলিলেন, তা না হয় নাই বলিস। কিন্তু ‘তুমি’ বলতেই হবে। বল—সই তুমি রোজ এস।
সরযূ চোখ নিচু করিয়া সলজ্জহাস্যে কহিল, সই, তুমি রোজ এস।
হরিবালার যেন একটা দুর্ভাবনা কাটিয়া গেল। তিনি কহিলেন, আসব।
পরদিন হইতে হরিবালা প্রায়ই আসেন, শত-কর্ম থাকিলেও একবার হাজিরা দিয়া যান। ক্রমশঃ পাতানো সম্বন্ধ গাঢ় হইয়া আসিল। সময়ে সরযূও ভুলিল যে, হরিবালা তাহার সমবয়সী নহেন, কিংবা এই গলায় গলায় মেশামেশি সকলের কাছে তেমন সুন্দর দেখিতে হয় না।
এই অন্তরঙ্গতা হরকালীর কেমন লাগিত, বলিতে পারি না, কিন্তু চন্দ্রনাথের বেশ লাগিল। স্ত্রীর সহিত এ বিষয়ে প্রায়ই তাহার কথাবার্তা হইত। ঠানদিদির এই হৃদ্যতায় সে আমোদ বোধ করিত। আরও একটু কারণ ছিল। চন্দ্রনাথ স্ত্রীকে বড় স্নেহ করিত; সমস্ত হৃদয় জুড়িয়া ভালবাসা না থাকিলেও স্নেহের অভাব ছিল না। সে মনে করিত, সকলের ভাগ্যেই একরূপ স্ত্রী মিলে না। কাহারো বা স্ত্রী দাসী, কাহারো বা বন্ধু, কাহারো বা প্রভু! তাহার ভাগ্যে যদি একটি পুণ্যবতী, পবিত্রা, সাধ্বী এবং স্নেহময়ী দাসী মিলিয়াছে ত, সে অসুখী হইয়া কি লাভ করিবে? তাহার উপর একটা কথা প্রায়ই তাহার মনে হয়, সেটা সরযূর বিগত দিনের দুঃখের কাহিনী। শিশুকালটা তাহার বড় দুঃখেই অতিবাহিত হইয়াছে। দুঃখিনীর কন্যা হয়ত সারা-জীবনটা দুঃখেই কাটাইত; হয়ত বা এতদিনে কোন দুর্ভাগ্য দুশ্চরিত্রের হাতে পড়িয়া চক্ষের জলে ভাসিত, না হয় দাসীবৃত্তি করিতে গিয়া শত অত্যাচার উৎপীড়ন সহ্য করিত; তা ছাড়া, এত অধিক রূপ-যৌবন লইয়া নরকের পথও দুরূহ নহে;—তাহা হইলে?
এই কথাটা মনে উঠিলেই চন্দ্রনাথ গভীর করুণায় সরযূর লজ্জিত মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিত, আচ্ছা সরযূ, আমি যদি তোমাকে না দেখতুম, যদি বিয়ে না করতুম, এতদিন তুমি কার কাছে থাকতে বল ত?
সরযূ জবাব দিত না; সভয়ে স্বামীর বুকের কাছে সরিয়া আসিত। চন্দ্রনাথ সস্নেহে তাহার মাথার উপর হাত রাখিত। যেন সাহস দিয়া মনে মনে বলিত, ভয় কি!
সরযূ আরও কাছে সরিয়া আসিত—এসব কথায় সত্যই সে বড় ভয় পাইত। চন্দ্রনাথ তাহা বুঝিতে পারিয়াই যেন তাহাকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া বলিত, তা নয় সরযূ, তা নয়। তুমি দুঃখীর ঘরে গিয়ে কেন জন্মেছিলে, জানিনে; কিন্তু তুমিই আমার জন্ম-জন্মান্তরের পতিব্রতা স্ত্রী! তুমি সংসারের যে-কোন জায়গায় ব’সে টান দিলে আমাকে যেতেই হ’ত। তোমার আকর্ষণেই যে আমি কাশী গিয়েছিলুম, সরযূ!
এই সময় তাহার হৃদয়ের ভিতর দিয়া যে ভাবের স্রোত বহিয়া যাইত, সরযূর সমস্ত স্নেহ, প্রেম, যত্ন, ভক্তি এক করিলেও বোধ করি তাহার তুলনা হইত না। কিন্তু তৎসত্ত্বেও দুঃখীকে দয়া করিয়া যে গর্ব, যে তৃপ্তি, বালিকা সরযূকে বিবাহ করিবার সময় একদিন আত্মপ্রসাদের ছদ্মবেশে চন্দ্রনাথের নিভৃত-অন্তরে প্রবেশ করিয়াছিল, এখন শতচেষ্টাতেও চন্দ্রনাথ তাহার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করিতে পারে না।
হৃদয়ের এক অজ্ঞাত অন্ধকার কোণে আজও সে বাসা বাঁধিয়া আছে। তাই, যখনই সেটা মাথা তুলিয়া উঠিতে চায়, তখনই চন্দ্রনাথ সরযূকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া বার বার বলিতে থাকে, আমি বড় আশ্চর্য হই সরযূ, যাকে চিরদিন দেখে এসেচ, তাকে কেন আজও তোমার চিনতে বিলম্ব হচ্চে। আমি তো তোমাকে কাশীতে দেখেই চিনেছিলুম, তুমি আমার! কত যুগ, কত কল্প, কত জন্ম-জন্ম ধ’রে আমার! কি জানি, কেন আলাদা হয়েছিলুম, আবার এক হয়ে মিলতে এসেচি।
সরযূ বুকের মধ্যে মুখ লুকাইয়া মৃদুকণ্ঠে কহে, কে বললে, আমি তোমাকে চিনতে পারিনি?
উৎসাহের অতিশয্যে চন্দ্রনাথ সরযূর লজ্জিত মুখখানি নিজের মুখের কাছে তুলিয়া ধরিয়া বলে, পেরেচ? তবে কেন এত ভয়ে ভয়ে থাক? আমি ত কোন দুর্ব্যবহার করিনে—আমি যে আমার নিজের চেয়েও তোমাকে ভালবাসি সরযূ।
সরযূ আবার স্বামীর বুকের মধ্যে মুখ লুকাইয়া ফেলে। চন্দ্রনাথ আবার প্রশ্ন করে, বল, কেন ভয় পাও সরযূ? সরযূ আর উত্তর দিতে পারে না। স্বামীকে স্পর্শ করিয়া সে মিথ্যা কথা কি করিয়া মুখে আনিবে? কি করিয়া বলিবে যে, ভয় করে না? সত্যই যে তাহার বড় ভয়! সে যে কত সত্য, কত বড় ভয়, তাহা সে ছাড়া আর কে জানে?
তা কথাটা কি বলিতেছিলাম! চন্দ্রনাথ হরিবালার আগমনে আমোদ বোধ করিত। সরযূ একটি সখী পাইয়াছে, দু’টা মনের কথা বলিবার লোক জুটিয়াছে—ইহাই চন্দ্রনাথের আনন্দের কারণ।
একদিন সরযূ সমস্ত দুপুরটা হরিবালার প্রতীক্ষা করিয়া বসিয়া রহিল। আকাশে মেঘ করিয়া টিপিটিপি বৃষ্টি পড়িতেছিল; হরিবালা আসিলেন না । সরযূ মনে করিল, জল পড়িতেছে, তাই আসিলেন না। এখন বেলা যায়-যায়, সমস্ত দিনটা একা কাটিয়াছে, হরকালীও আজ বাটী নাই। সরযূ তখন সাহসে ভর করিয়া ধীরে ধীরে স্বামীর পড়িবার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। বিশেষ প্রয়োজন না থাকিলে এ ঘরটিতে কেহ প্রবেশ করিত না। সরযূও না। চন্দ্রনাথ বই হইতে মুখ তুলিয়া বলিল, আজ বুঝি তোমার সই আসেনি?
না।
তাই বুঝি আমাকে মনে পড়েছে?
সরযূ ঈষৎ হাসিল। ভাবটা এই যে, মনে সর্বদাই পড়ে, কিন্তু সাহসে কুলোয় না। সরযূ বলিল, জলের জন্য বোধ হয় আসতে পারেনি।
বোধ হয়, তা নয়। আজ কাকার ছোটমেয়ে নির্মলাকে আশীর্বাদ করতে এসেছে। শীঘ্রই বিয়ে হবে। তারই আয়োজনে ঠানদিদি বোধ হয় মেতেছেন।
সরযূ বলিল, বোধ হয়।
তাহার পর চন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, দুঃখ হয় যে, আমরা একেবারে পর হয়ে গেছি—মামীমা কোথায়?
তিনিও বোধ হয় সেইখানে।
চন্দ্রনাথ চুপ করিয়া কি ভাবিতে লাগিল।
সরযূ ধীরে ধীরে কাছে আসিয়া একপাশে বসিয়া পড়িয়া বলিল, কি ভাবচ, বল না।
চন্দ্রনাথ একবার হাসিবার চেষ্টা করিয়া সরযূর হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া আস্তে আস্তে বলিল, বিশেষ-কিছু নয় সরযূ। ভাবছিলাম, নির্মলার বিয়ে, কাকা কিন্তু আমাকে একবার খবরটাও দিলেন না, অথচ মামীমাকেও ডেকে নিয়ে গেলেন। আমরা দু’জনেই শুধু পর!
তাহার স্বরে একটু কাতরতা ছিল, সরযূ তাহা লক্ষ্য করিয়া কহিল, আমাকে পায়ে স্থান দিয়েই তুমি আরও পর হয়ে গেছ; না হ’লে বোধ হয় এত দিনে মিল হ’তে পারত।
চন্দ্রনাথ হাসিল, কহিল, মিল হয়ে কাজ নেই। তোমার পরিবর্তে, কাকার সঙ্গে মিল ক’রে যে আমার মস্ত সুখ হ’ত, সে মনে হয় না। আমি বেশ আছি। যখন বিয়ে করেছিলুম, তখন যদি কাকার মত নিতে হ’ত, তা হ’লে এমন ত বোধ হয় না যে, তোমাকে কখনো পেতুম—একটা বাধা নিশ্চয় উঠত। হয় কুল নিয়ে, না হয় বংশ নিয়ে—যেমন ক’রেই হোক এ বিয়ে ভেঙ্গে যেত।
ভিতরে ভিতরে সরযূ শিহরিয়া উঠিল। তখন সন্ধ্যার ছায়া ঘরের মধ্যে অন্ধকার করিয়াছিল, তাই তাহার মুখখানি দেখিতে পাওয়া গেল না, কিন্তু যে হাতখানি তাহার হাতের মধ্যে ধরা ছিল, সেই হাতখানি কাঁপিয়া উঠিয়া সরযূর সমস্ত মনের কথা চন্দ্রনাথের কাছে প্রকাশ করিয়া দিল। চন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিল, এখন বুঝতে পেরেছ, মত না নিয়ে ভাল করেচি কি মন্দ করেচি?
সরযূ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, কি জানি! আমার মত শত-সহস্র দাসীরও ত তোমার অভাব হ’ত না!
চন্দ্রনাথ সরযূর কোমল হাতখানি সস্নেহে ঈষৎ পীড়ন করিয়া বলিল, তা জানিনে। আমার দাসী একটি, তার অভাবের কথাই ভাবতে পারি। শত-সহস্রের ভাবনা ইছে হয় তুমি ভেবো।
পরদিন হরিবালা আসিলেন; কিন্তু মুখের ভাবটা কিছু স্বতন্ত্র। ফস করিয়া গলা ধরিয়া সই-সই বলিয়া তিনি ব্যস্ত করিলেন না, কিংবা বিন্তি খেলিবার জন্য তাস আনিতেও পুনঃ পুনঃ সাধাসাধি পীড়াপীড়ি করিলেন না! মলিনমুখে মৌন হইয়া রহিলেন।
সরযূ বলিল, সইয়ের কাল দেখা পাইনি।
হ্যাঁ দিদি—কাল বড় কাজ ছিল। ও-বাড়িতে নির্মলার বিয়ে।
তা শুনেছি। সব ঠিক হ’ল কি?
হরিবালা সে কথার উত্তর না দিয়া সরযূর মুখের পানে চাহিয়া বলিলেন, সই, একটা কথা—সত্যি বলবি?
কি কথা ?
যদি সত্যি বলিস, তা হ’লেই জিজ্ঞাসা করি—না হ’লে জিজ্ঞাসা ক’রে কোন লাভ নেই।
সরযূ চিন্তিত হইল। বলিল, সত্যি বলব না কেন?
দেখিস দিদি—আমাকে বিশ্বাস করিস ত?
করি বৈ কি।
তবে বল্ দেখি, চন্দ্রনাথ তোকে কতখানি ভালবাসে?
সরযূ একটু লজ্জিত হইল, বলিল, খুব দয়া করেন।
দয়ার কথা নয়। খুব একেবারে বড় বেশি ভালবাসে কিনা?
সরযূ হাসিল। বলিল, বড় বেশি কিনা—কেমন ক’রে জানব?
সত্যি জানিস নে?
না।
সত্যই সরযূ ইহা জানিত না। হরিবালা যেন বড় বিমর্ষ হইয়া পড়িলেন। মাথা নাড়িয়া বলিলেন, স্ত্রী জানে না স্বামী তাকে কতখানি ভালবাসে! এইখানেই আমার বড় ভয় হয়।
হরিবালার মুখের ভাবে একটা গভীর শঙ্কা প্রচ্ছন্ন ছিল, সরযূ তাহা বুঝিয়া নিজেও শঙ্কিত হইল। বলিল, ভয় কিসের?
আর একদিন শুনিস। তার পর তাহার চিবুকে হাত দিয়া মৃদুস্বরে কহিলেন, এত রূপ, এত গুণ, এত বুদ্ধি নিয়ে সই, এত দিন কি ঘাস কাটছিলি?
সরযূ হাসিয়া ফেলিল।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
তখনও কথাটা প্রকাশ পায় নাই। হরিদয়াল ঘোষালের সন্দেহের মধ্যেই প্রচ্ছন্ন ছিল। একজন ভদ্রলোকের মত দেখিতে অথচ বস্ত্রাদি জীর্ণ এবং ছিন্ন আজ দুই-তিন দিন হইতেই বামুন-ঠাকরুন সুলোচনা দেবীর সহিত গোপনে পরামর্শ করিয়া যাইতেছিল। সুলোচনা ভাবিত, হরিদয়াল তাহা জানেন না; কিন্তু তিনি জানিতে পারিয়াছিলেন।
আজ দ্বিপ্রহরে দয়ালঠাকুর এবং কৈলাসখুড়া ঘরে বসিয়া সতরঞ্চ খেলিতেছিলেন, এমন সময় অন্দরের প্রাঙ্গণে একটা গোলযোগ উঠিল। কে যেন মৃদুকন্ঠে সকাতরে দয়া ভিক্ষা চাহিতেছে, এবং অপরে কর্কশকন্ঠে তীব্র-ভাষায় তিরস্কার করিতেছে এবং ভয় দেখাইতেছে। একজন স্ত্রীলোক, অপর পুরুষ। দয়ালঠাকুর কহিলেন, খুড়ো, বাড়িতে কিসের গোলমাল হয়?
কৈলাসখুড়ো বলিলেন, কিস্তি! সামলাও দেখি বাবাজী!
আবার অনেকক্ষণ নি:শব্দে কাটিল।ভিতরের গোলমাল ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইতেছে দেখিয়া দয়ালঠাকুর উঠিয়া দাঁড়াইলেন।খুড়ো, একটু ব’স, আমি দেখে আসি।
খুড়া তাঁহার কোঁচার টিপ এক হাতে ধরিয়া কহিলেন, এবার যে দাবা চাপা গেল।
দয়ালঠাকুর পুনর্বার বসিয়া পড়িলেন। কিন্তু গোলমাল কিছুতেই থামে না। তখন দয়ালঠাকুর অগত্যা উঠিয়া পড়িলেন। প্রাঙ্গণে আসিয়া দেখিলেন, সুলোচনা দুই হাতে সেই লোকটার পা জড়াইয়া আছে এবং সে উওরোত্তর চাপা-কন্ঠে কহিতেছে, আমার কথা রাখ, না হ’লে যা বলছি তাই করব!
সুলোচনা কাঁদিয়া বলিতেছে, আমায় মার্জনা কর। তুমি একবার সর্বনাশ করেছ, যা-একটু বাকী আছে, সেটুকু আর নাশ করো না।
সে কহিতেছে, তোমার মেয়ে বড়লোকের ঘরে পড়েছে, দু’হাজার টাকা দিতে পারে না? আমি টাকা পেলেই চ’লে যাব।
সুলোচনা কহিল, তুমি মাতাল, অসচ্চরিত্র!—দু’হাজার টাকা তোমার কত দিন? তুমি আবার আসবে, আবার টাকা চাইবে,—আমি কিছুতেই তোমায় টাকা দেব না।
আমি মদ ছেড়ে দেব। ব্যবসা করব; আর কখনও তোমার কাছে টাকা চাইতে আসব না।
সুলোচনা সে কথার উত্তর না দিয়া ভূমিতলে মাথা খুঁড়িয়া যুক্ত-করে কহিল, দয়া কর—টাকার জন্য আমি সরযূকে অনুরোধ করতে পারব না।
দয়ালঠাকুর যে নিকটে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন, তাহা কেহই দেখে নাই, তাই এসব কথা জোরে জোরেই হইতেছিল। দয়ালঠাকুর এইবার কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। সহসা দুজনেই চমকিত হইল—দয়ালঠাকুর এই অপরিচিত লোকটার নিকটে আসিয়া কহিলেন, তুমি কার অনুমতিতে বাড়ির ভিতরে ঢুকেছ?
লোকটা প্রথমে থতমত খাইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার পর যখন বুঝিল, কাজটা তেমন আইন-সঙ্গত হয় নাই, তখন সরিয়া পড়িবার উপক্রম করিল। কঠিন মুষ্টিতে হরিদয়াল তাহার হাত ধরিয়া উচ্চকন্ঠে পুনর্বার কহিলেন, কার অনুমতিতে?
পলাইবার উপায় নাই দেখিয়া সে সাহস সঞ্চয় করিয়া বলিল, সুলোচনার কাছে এসেছি।
তাহার মুখ দিয়া তীব্র সুরার গন্ধ বাহির হইতেছে, এবং সর্বাঙ্গে হীনতা এবং অত্যাচারের মলিন-ছায়া পড়িয়াছে। দয়ালঠাকুর ঘৃণায় ওষ্ঠ কুঞ্চিত করিয়া সেইরূপ কর্কশ ভাষায় জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু কার হুকুমে?
হুকুম আবার কি?
লোকটার মুখের ভাব পরিবর্তিত হইল; সহসা যেন তাহার স্মরণ হইল, প্রশ্নকর্তার উপর তাহার জোর আছে এবং এ বাড়ির উপরেও কিঞ্চিৎ দাবী আছে।
দয়ালঠাকুর এরূপ উত্তরে অসম্ভব চটিয়া উঠিলেন, উচ্চস্বরে কহিলেন, ব্যাটা মাতাল, জান, তোমাকে এখনি জেলে দিতে পারি!
সে বিদ্রূপ করিয়া কহিল, জানি বৈ কি!
দয়ালঠাকুর প্রায় প্রহার করিতে উদ্যত হইলেন, জান বৈ কি! চল্ ব্যাটা, এখনি তোকে পুলিশে দেব।
লোকটা ঈষৎ হাসিয়া এরূপ ভাব প্রকাশ করিল, যেন পুলিশের নিকট যাইতে তাহার বিশেষ আপত্তি নাই। কহিল, এখনই দেবে?
দয়ালঠাকুর ধাক্কা দিয়া বলিলেন, এখনি।
লোকটা ধাক্কা সামলাইয়া স্থির হইয়া গম্ভীরভাবে বলিল, ঠাকুর, একেবারে অত বিক্রম প্রকাশ করো না, পুলিশে দেবে কি থানায় দেবে, একটু বিলন্ব ক’রে দিয়ো। আমি তোমাকে কাশী ছাড়া করতে পারি, জান?
দয়ালঠাকুর উন্মত্তের মত চীৎকার করিয়া উঠিলেন, ব্যাটা পাজী, আজ আমার চল্লিশ বছর কাশীবাস হ’ল, এখন তুমি কাশী-ছাড়া করবে?
তিনি ভাবিয়াছিলেন, লোকটা তাঁহাকে গুন্ডার ভয় দেখাইতেছে। অনেকে এ কথায় হয়ত ভয় পাইত, কিন্তু এই দীর্ঘকালের কাশীবাসে দয়ালঠাকুরের এ ভয় ছিল না। বলিলেন, ব্যাটা, আমার কাছে গুন্ডাগিরি!
গুন্ডাগিরি নয় ঠাকুর, গুন্ডাগিরি নয়। পুলিশে নিয়ে চল। সেখানেই সব কথা প্রকাশ করব।
কোন্ কথা প্রকাশ করবে?
যা জানি। যাতে তুমি কাশী ছেড়ে পালাতে পথ পাবে না। যাতে সমস্ত দেশের লোক শুনবে যে, তুমি জাতিচ্যুত অব্রাহ্মণ।
আমি অব্রাহ্মণ!
রাগ করো না, ঠাকুর। তুমি জাতিচ্যুত । শুধু তাই নয়। তোমার কাছে যত ভদ্রসন্তান বিশ্বাস ক’রে এসেছে, এই তিন বৎসরের মধ্যে যত লোককে তুমি অন্ন বেচেছ, সকলেরই জাত গেছে। সকলকেই আমি সে কথা বলবো।
দয়ালঠাকুর ভয় পাইলেন। ভয়ের যথার্থ কারণ হৃদয়ঙ্গম হইবার পূর্বেই উদ্ধত কণ্ঠস্বর নরম হইয়া আসিল। তথাপি বলিলেন, আমি লোকের জাত মেরেছি?
তাই। আর প্রমাণ করবার ভারও আমার।
ঠাকুর নরম হইয়া কণ্ঠস্বর কিছু কম করিয়া বলিলেন, কথাটা কি, ভেঙ্গে বল দেখি বাপু?
লোকটা মৃদু হাসিয়া কহিল, একাই শুনবে, না, দু’-দশজন লোক ডাকবে। আমি বলি, দু’-চারজন লোক ডাক। দু’-চারজন পাড়াপড়শীর সামনে কথাটা শোনাবে ভাল।
দয়ালঠাকুর তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন, রাগ করো না বাপু, আমি হঠাৎ বড় অন্যায় কাজ করেছি। কিছু মনে করো না। এস, ঘরে চল।
দুই জনে একটা ঘরে আসিয়া বসিলে দয়ালঠাকুর কহিলেন, তার পর?
সে কহিল, সুলোচনা—যার হাতে আপনার অন্ন প্রস্তুত হয়, তাকে কোথায় পেলেন?
এইখানেই পেয়েছি। দুঃখীর কন্যা, তাই আশ্রয় দিয়েছি।
টাকাওয়ালা লোককে আশ্রয় দিয়েছেন, এ কথা আমি বলছি না। কিন্তু সে কি জাত, তার অনুসন্ধান করেছেন কি?
দয়ালঠাকুরের সমস্ত মুখমণ্ডল একেবারে বিবর্ণ হইয়া গেল। তিনি বলিলেন, ব্রাহ্মণ-কন্যা, বিধবা, শুদ্ধাচারিণী, তার হাতে খেতে দোষ কি?
ব্রাহ্মণ-কন্যা এবং বিধবা, এ কথা সত্যি, কেউ যদি কুলত্যাগ ক’রে চ’লে যায়, তাকেও কি শুদ্ধাচারিণী বলা চলে? না, তার হাতে খাওয়া যায়?
দয়ালঠাকুর জিভ কাটিয়া বলিলেন, শিব! শিব! তা কি খাওয়া যায়!
তবে তাই! পনরো-ষোল বৎসর পূর্বে সুলোচনা তিন বছরের একটি মেয়ে নিয়ে গৃহত্যাগ করে, এবং তাকেই আশ্রয় দিয়ে আপনি নিজের এবং আর পাঁচজনের সর্বনাশ করেছেন।
প্রমাণ?
প্রমাণ আছে বৈ কি! তার জন্য ভাববেন না । যাঁর সঙ্গে কুলত্যাগ করেন, সেই অসীম প্রেমাস্পদ রাখাল ভট্চায এখনো বেঁচে আছেন।
দয়াল লোকটার মুখের পানে ক্ষণকাল চাহিয়া রহিলেন। মনে হইল যেন ইহারই নাম রাখাল। বলিলেন, তুমি কি ব্রাহ্মণ?
লোকটা মলিন উড়ানির ভিতর হইতে অধিকতর মলিন ছিন্ন-বিছিন্ন যজ্ঞোপবীত বাহির করিয়া হাসিয়া বলিল, না, না, গোয়ালা!
দয়াল একটুখানি সরিয়া বসিয়া বলিলেন, তোমাকে দেখে তো চামার ব’লে মনে হয়েছিল। যা হোক, নমস্কার।
সে ব্যক্তি রাগ করিল না। বলিল, নমস্কার। আপনার অনুমান মিথ্যা নয়, আমাকে চামার বলাও চলে, মুসলমান খ্রীষ্টান বলাও চলে। আমি জাত মানিনে—আমি পরমহংস।
তুমি অতি পাষণ্ড।
সে বলিল, সে কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবার প্রয়োজন দেখচি না, কেননা, ইতিপূর্বে অনেকেই অনুগ্রহ ক’রে ও কথা বলেছেন। কি ছিলাম, কি হয়েচি, তা এখনো বুঝি। কিন্তু আমিই রাখালদাস।
দয়ালের মুখখানি অপরিসীম ক্রোধে রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল; কোনমতে মনের ভাব দমন করিয়া তিনি বলিলেন, এখন কি করতে চাও? সুলোচনাকে নিয়ে যাবে?
আজ্ঞে না। তাতে আপনার খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হবে, আমি অত নরাধম নই।
প্রাণের দায়ে দয়াল এ পরিহাসটাও পরিপাক করিলেন। তারপব বলিলেন, তবে কি চাও? আবার এসেচ কেন?
টাকা চাই। দারুণ অর্থাভাব, তাই আপাততঃ এসেছি। হাজার-দুই পেলেই নিঃশব্দে চলে যাব, জানাতে এসেছি।
এত টাকা তোমায় কে দেবে?
যার গরজ। আপনি দেবেন—সুলোচনার জামাই দেবে—সে বড়লোক।
দয়াল তাহার স্পর্ধা দেখিয়া মনে মনে স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। কিন্ত সে অতিশয় ধূর্ত এবং কৌশলী, তাহাও বুঝিলেন। বলিলেন, বাপু আমি দরিদ্র, অত টাকা কখনও চোখে দেখিনি।
তবে সুলোচনার জামাই দিতে পারে, সে কথা ঠিক। কিন্তু সে দেবে না। তাকে চেন না, ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে দু’হাজার ত ঢের দূরের কথা—দুটো পয়সাও আদায় করতে পাববে না। তুমি যে বুদ্ধিমান লোক তা টের পেয়েছি, কিন্তু সে আরও বুদ্ধিমান। বরং আর কোন ফন্দি দেখ—এ খাটবে না।
রাখাল দয়ালের মুখের দিকে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে চাহিয়া থাকিয়া মৃদু হাসিল। বলিল, সে ভাবনা আমার। দেখা যাক, যত্নে কৃতে যদি—
দয়াল তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া বলিলেন, থাক বাবা, দেবভাষাটাকে আর অপবিত্র করো না।
রাখাল সপ্রতিভভাবে বলিল, যে আজ্ঞে। কিন্তু আর ত বসতে পাচ্চিনে—বলি তাঁর ঠিকানাটা কি?
দয়াল বলিলেন, সুলোচনাকেই জিজ্ঞাসা কর না বাপু।
রাখাল কহিল, সে বলবে না, কিন্তু আপনি বলবেন।
যদি না বলি?
রাখাল শান্তভাবে বলিল, নিশ্চয়ই বলবেন। আর না বললে কি করব, তা ত পূর্বেই বলেছি।
দয়ালের মুখ শুকাইল। তিনি বলিলেন, আমি তোমার কিছুই ত করিনি বাপু।
রাখাল বলিল, না, কিছু করেন নি। তাই এখন কিছু করতে বলি। নাম-ধামটা ব’লে দিলে জামাইবাবুকেও দুটো আশীর্বাদ ক’রে আসি, মেয়েটাকেও একবার দেখে আসি। অনেক দিন দেখিনি।
দয়ালঠাকুর রীতিমত ভয় পাইয়াছিলেন। কিন্তু মুখে সাহস দেখাইয়া কহিলেন, আমি তোমায় সাহায্য করব না। তোমার যা ইচ্ছা কর। অজ্ঞাতে একটা পাপ করেছি, সে জন্য না হয় প্রায়শ্চিত্ত করব। আমার আর ভয় কি?
ভয় কিছুই নেই, তবে পাণ্ডা-মহলে আজই একথা রাষ্ট্র হবে। তার পর যেমন ক’রে পারি, অনুসন্ধান ক’রে সুলোচনার জামাইয়ের কাছে যাব, এবং সেখানেও এ কথা প্রকাশ করব! নমস্কার ঠাকুর, আমি চললাম।
সত্যিই সে চলিয়া যায় দেখিয়া দয়াল তাহার হাত ধরিয়া পুনর্বার বসাইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, বাপু, তুমি যে অল্পে ছাড়বার পাত্র নও তা বুঝেছি। রাগ করো না। আমার কথা শোন। এর মধ্যে তুমি এ কথা নিয়ে আর আন্দোলন করো না। হপ্তাখানেক পরে এস তখন যা হয় করব।
মনে রাখবেন, সেদিন এমন ক’রে ফেরালে চলবে না। দয়াল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাহার মুখের পানে চাহিয়া বলিলেন, বাপু, তুমি কি সত্যিই বামুনের ছেলে?
আজ্ঞে।
দয়াল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আশ্চর্য! আচ্ছা, হপ্তাখানেক পরেই এস—এর মধ্যে আর আন্দোলন করো না, বুঝলে?
আজ্ঞে, বলিয়া রাখাল দুই-এক পা গিয়াই ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ভাল কথা। গোটা-দুই টাকা দিন তো। মাইরি, মনিব্যাগ্টা কোথায় যে হারালাম, বলিয়া সে দাঁত বাহির করিয়া হাসিতে লাগিল।
দয়াল রাগে তাহার পানে আর চাহিতেও পারিলেন না। নিঃশব্দে দুইটা টাকা বাহির করিয়া তাহার হাতে দিলেন, সে তাহা ট্যাঁকে গুঁজিয়া প্রস্থান করিল।
সে চলিয়া গেল, কিন্তু সেইখানে দয়াল স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিলেন। তাঁহার সর্বাঙ্গ যেন সহস্র বৃশ্চিকের দংশনে জ্বলিয়া যাইতে লাগিল।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
কিন্তু সুলোচনা কোথায়? আজ তিন দিন ধরিয়া হরিদয়াল আহার, নিদ্রা, পূজা-পাঠ, যাত্রীর অনুসন্ধান, সব বন্ধ রাখিয়া তন্ন তন্ন করিয়া সমস্ত কাশী খুঁজিয়াও যখন তাহাকে বাহির করিতে পারিলেন না, তখন ঘরে ফিরিয়া আসিয়া শিরে করাঘাত করিয়া বলিলেন, বিশ্বেশ্বর! এ কি দুর্দৈব? অনাথাকে দয়া করিতে গিয়া শেষে কি পাপ সঞ্চয় করিলাম!
গলির শেষে কৈলাসখুড়োর বাটী। হরিদয়াল সেখানে আসিয়া দেখিলেন, কেহ নাই। ডাকিলেন, খুড়ো, বাড়ি আছ?
কেহ সাড়া দিল না দেখিয়া তিনি ঘরের মধ্যে আসিলেন, দেখিলেন, কৈলাস প্রদীপের আলোকে নিবিষ্টচিত্তে সতরঞ্চ সাজাইয়া একা বসিয়া আছে; বলিলেন, খুড়ো, একাই দাবা খেলচ?
খুড়া চাহিয়া দেখিয়া বলিলেন, এস বাবাজী, এই চালটা বাঁচাও দেখি।
হরিদয়াল বিরক্ত হইয়া মনে মনে গালি পাড়িয়া কহিলেন, নিজের জাত বাঁচে না, ও বলে কিনা দাবার চাল বাঁচাও!
কৈলাসের কানে কথাগুলো অর্ধেক প্রবেশ করিল, অর্ধেক করিল না। জিজ্ঞাসা করিলেন, কি বল বাবাজী?
বলি, সেদিনের ব্যাপারটা সব শুনেছিলে?
কি ব্যাপার?
সেই যে আমাদের ভিতরের সেদিনকার গোলযোগ!
কৈলাস কহিলেন, না বাবাজী, ভাল শুনতে পাইনি। গোলযোগ বোধ করি খুব আস্তে আস্তে হয়েছিল; কিন্তু সেদিন তোমার দাবাটা আচ্ছা চেপেছিলাম!
হরিদয়াল মনে মনে তাহার মুণ্ডপাত করিয়া কহিলেন, তা ত চেপেছিলে, কিন্তু কথাগুলো কিছুই শোননি?
কৈলাস ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিলেন, না, কিছুই প্রায় শুনতে পাইনি। অত আস্তে আস্তে গোলমাল করলে কি ক’রে শুনি বল? কিন্তু সেদিনকার খেলাটা কি রকম জমেছিল, মনে আছে? মন্ত্রীটা তুমি কোনমতেই বাঁচাতে পারতে না— আচ্ছা, এই ত ছিল, কৈ বাঁচাও দেখি কেমন—
হরিদয়াল বিরক্ত হইয়া বলিলেন, মন্ত্রী চুলোয় যাক! জিজ্ঞেস করি, সেদিনকার কথাবার্তা কিছু শোননি?
খুড়া হরিদয়ালের বিরক্ত মুখের দিকে চাহিয়া এইবার একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, কি জানি বাবাজী, স্মরণ ত কিছুই হয় না।
হরিদয়াল ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া গম্ভীরভাবে বলিলেন, আচ্ছা সংসারের যেন কোন কাজই না করলে, কিন্তু পরকালটা মান ত?
মানি বৈ কি!
তবে! সেকালের একটা কাজও করেছ কি? একদিনের তরেও মন্দিরে গিয়েছিলে কি?
কৈলাস বিস্মিত হইয়া বলিলেন, কি বল দয়াল, মন্দিরে যাইনি! কত দিন গিয়েছি।
দয়াল তেমনি গম্ভীর হইয়াই বলিতে লাগিলেন, তুমি এই বিশ বৎসর কাশীবাসী হয়েছ, কিন্তু বোধ হয় বিশ দিনও ঠাকুর দর্শন করনি—পূজা-পাঠ ত দূরের কথা!
কৈলাস প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন, না দয়াল, বিশ দিনের বেশি হবে; তবে কি জান বাবাজী, সময় পাই না ব’লেই পূজোটুজোগুলো হয়ে উঠে না। এই দেখ না, সকাল বেলাটা শম্ভু মিশিরের সঙ্গে এক চাল বসতেই হয়—লোকটা খেলে ভাল।
এ বাজি শেষ হ’তেই দুপুর বেজে যায়, তারপর আহ্নিক সেরে পাক করতে, আহার করতে বেলা শেষ হয়। তারপর বাবাজী, গঙ্গা পাঁড়ের—তা যাই বল, লোকটার খেলার বড় তারিফ—আমাকে ত সেদিন প্রায় মাত করেছিল। ঘোড়া আর গজ দু’টো দু’কোণ থেকে চেপে এসে—আমি বলি বুঝি—
আঃ থামো না খুড়ো—দুপুর বেলা কি কর, তাই বল।
দুপুর বেলা! গঙ্গা পাঁড়ের সঙ্গে—তার গজ দু’টো—এই কালই দেখ না—
দয়াল অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বাধা দিয়া বলিলেন, হয়েচে, হয়েচে—দুপুর বেলা গঙ্গা পাঁড়ে আর সন্ধ্যার পর মুকুন্দ ঘোষের বৈঠকখানা—আর তোমার সময় কোথায়!
কৈলাস চুপ করিয়া রহিলেন—হরিদয়াল অধিকতর গম্ভীর হইয়া উপদেশ দিতে লাগিলেন, কিন্তু খুড়ো, দিনও ত আর বেশি নেই। পরকালের জন্যও প্রস্তুত হওয়া উচিত, আর সে কথা কিছু কিছু ভাবাও দরকার। দাবার পুঁটলিটা আর সঙ্গে নিতে পারবে না।
কৈলাস হঠাৎ হোহো করিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন, না না দয়াল, দাবার পুঁটুলিটা বোধ করি সঙ্গে নিতে পারব না। আর প্রস্তুত হ’বার কথা বলচ বাবাজী? প্রস্তুত আমি হয়েই আছি। যেদিন ডাক আসবে, ঐটে কারো হাতে তুলে দিয়ে সোজা রওনা হয়ে পড়ব—সেজন্যে চিন্তার বিষয় আর কি আছে?
কিছুই নেই? কোন শঙ্কা হয় না?
কিছু না, বাবাজী, কিছু না। যেদিন কমলা আমার চলে গেল, যেদিন কমলচরণ আমার মুখের পানেই চোখ রেখে চোখ বুজলে, সেদিন থেকেই শঙ্কা, ভয় প্রভৃতি উপদ্রবগুলো তাদের পিছনে পিছনেই চলে গেল—কেমন ক’রে যে গেল, সে কথা একদিনের তরে জানতে পারলাম না বাবাজী—বলিতে বলিতে বৃদ্ধের চোখ দু’টি ছলছল করিয়া আসিল।
দয়াল বাধা দিয়া বলিলেন, থাক সে-সব কথা। এখন আমার কথাটা শুনবে?
বল বাবাজী।
দয়াল তখন সেদিনের কাহিনী একে একে বিবৃত করিযা শেষে বলিলেন, এখন উপায়?
শুনিতে শুনিতে কৈলাসের সদাপ্রফুল্ল মুখশ্রী পাংশুবর্ণ হইল। কাতরকণ্ঠে তিনি বলিলেন, এমন হয় না, হরিদয়াল। সুলোচনা সতী-সাবিত্রী ছিলেন।
দয়াল কহিলেন, আমিও তাই ভেবেছিলাম, কিন্তু স্ত্রীলোকে সকলই সম্ভব।
ছি, অমন কথা মুখে এনো না। মানুষ-মাত্রেই পাপপুণ্য ক’রে থাকে—এতে স্ত্রী-পুরুষের কোন প্রভেদ দেখিনে। বাবাজী, তোমার জননীর কথা কি স্মরণ হয় না, সে স্মৃতি একেবারে মুছে ফেলেচ?
হরিদয়াল লজ্জিত হইলেন, অথচ বিরক্তও হইলেন, কিছুক্ষণ অধোমুখে থাকিয়া তিনি বলিলেন, কিন্তু এখন যে জাত যায়।
কৈলাস বলিলেন, একটা প্রায়শ্চিত্ত কর। অজানা পাপের প্রায়শ্চিত্ত নেই কি?
আছে, কিন্তু এখানকার লোকে আমাকে যে একঘরে করবে?
করলেই বা—
হরিদয়াল এবার বিষম ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, করলেই বা! কি বলছ! একটু বুঝে বল খুড়ো।
বুঝেই বলছি, দয়াল! তোমার বয়সও কম হয়নি—বোধ করি পঞ্চাশ পার হ’ল। এতটা বয়স জাত ছিল, বাকি দু’চার বছর না হয় নাই রইল, বাবাজী, এতই কি তাতে ক্ষতি?
ক্ষতি নেই? জাত যাবে, ধর্ম যাবে, পরকালে জবাব দেব কি?
কৈলাস কহিলেন, এই জবাব দেবে যে একজন অনাথাকে আশ্রয় দিয়েছেলে।
হরিদয়াল চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিলেন। কথাটা তাঁহার মনের সঙ্গে একেবারেই মিলল না। কিছুক্ষণ পরে বলিলেন, তবে সুলোচনার জামায়ের ঠিকানা দেব না।
কিছুতেই না। এক ব্যাটা বদমায়েস—মাতাল—সে ভয় দেখিয়ে তোমার কাছে টাকা আদায় করবে, আর এক ভদ্র-সন্তানের কাছে টাকা আদায় করবে, আর তুমি তার সাহায্য করবে?
কিন্তু না করলে যে আমার সর্বস্ব যায়! একজনও যজমান আসবে না। আমি খাব কি ক’রে?
কৈলাস বলিলেন, সে ভয় করো না। আমি সরকার বাহাদুরের কল্যাণে বিশ টাকা পেন্সন পাই, খুড়োভাইপোর তাতেই চলে যাবে। আমরা খাব, আর দাবা খেলব, ঘর থেকে কোথাও বেরোব না।
বিরক্ত হইলেও এরূপ বালকের মত কথায় হরিদয়াল হাসিয়া বলিলেন, খুড়ো, আমার বোঝা তুমিই বা কেন ঘাড়ে নেবে, আর আমিই বা কেন পরের হাঙ্গামা মাথায় বয়ে জাত-ধর্ম খোয়াব? তার চেয়ে—
কৈলাস বলিলেন, ঠিক ত। তার চেয়ে তাদের নাম-ধাম ঠিকানা ব’লে দিয়ে একজন দরিদ্র বালিকাকে তার স্বামী, সংসার, সন্মান, সমস্ত হ’তে বঞ্চিত ক’রে এই বুড়ো হাড়গোড়গুলো ভাগাড়ের শিয়াল-কুকুরের গ্রাস থেকে বাঁচাতে হবে! বাঁচাও গে বাবাজী, কিন্তু আমাকে বলতে এসে ভাল করনি। তবে যখন মতলব নিতেই এসেছ, তখন আর একটা কথা ব’লে দিই। ৺কাশীধাম, মা অন্নপূর্ণার রাজত্ব। এখানে বাস ক’রে তাঁর সতী মেয়েদের পিছনে লেগে মোটের উপর বড় সুবিধা হবে না বাবা।
হরিদয়াল ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, খুড়ো কি এবার শাপ-সম্পাত করচ!
না। তোমরা কাশীর পাণ্ডা, স্বয়ং বাবার বাহন, আমাদের শাপ-সম্পাত তোমাদের লাগবে না—সে ভয় তোমার নেই, কিন্তু যে কাজে হাত দিতে যাচ্চ, বাবা, সে বড় নিরাপদ জিনিস নয়। সতী-সাবিত্রীকে যমে ভয় করে। সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিচ্চি। অনেকদিন একসঙ্গে দাবা খেলেচি—তোমাকে ভালও বাসি।
হরিদয়াল জবাব দিলেন না, মুখ কালি করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
কৈলাস বলিলেন, বাবাজী, কথাটা তাহ’লে রাখবে না?
হরিদয়াল বলিলেন, পাগলের কথা রাখতে গেলে পাগল হওয়া দরকার।
কৈলাস চুপ করিয়া রহিলেন, হরিদয়াল বাহির হইয়া গেলেন।
কৈলাস দাবার পুঁটুলিটা টানিয়া লইয়া গ্রন্থি বাঁধিতে বাঁধিতে মনে মনে ভাবিলেন, বোধ হয় ওর কথাই ঠিক। আমার পরামর্শ হয়ত সংসারে সত্যই চলে না। মানুষ মরিলে লোকাভাব হইলে কেহ কেহ ডাকিতে আসে—দাহ করিতে হইবে। রোগ হইলে ডাকিতে আসে—শুশ্রূষা করিতে হইবে। আর সতরঞ্চ খেলিতে আসে। কৈ, এত বয়স হইল, কেহ ত কখন পরামর্শ করিতে আসে নাই!
কিন্তু অনেক রাত্রি পর্যন্ত ভাবিয়াও তিনি স্থির করিতে পারিলেন না, কেন, এই সূর্যের আলোর মত পরিষ্কার এবং স্ফটিকের মত স্বচ্ছ জিনিসটা লোক-গ্রাহ্য হয় না, কেন এই সহজ প্রাঞ্জল ভাষাটা সংসারের লোক বুঝিয়া উঠিতে পারে না।
সেই রাত্রেই হরিদয়াল অনেক চিন্তার পর মন স্থির করিয়া চন্দ্রনাথের খুড়ো, মণিশঙ্করকে পত্র লিখিয়া দিলেন যে, চন্দ্রনাথ স্বেচ্ছায় এক বেশ্যা-কন্যা বিবাহ করিয়া ঘরে লইয়া গিয়াছেন।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
হরিদয়াল সমস্ত কথা পরিষ্কার করিয়া মণিশঙ্করকে লিখিয়া দিয়াছিলেন। সেই জন্যই তাঁহার সহজেই বিশ্বাস হইল, সংবাদটা অসত্য নহে। কিন্তু বুঝিতে পারিলেন না, এস্থলে কর্তব্য কি? এ সংবাদটা তাঁহার পক্ষে সুখেরই হউক বা দুঃখেরই হউক, গুরুতর তাহাতে সন্দেহ নাই। এত ভার তাঁহার একা বহিতে ক্লেশ বোধ হইল, তাই স্ত্রীকে নিরিবিলিতে পাইয়া মোটামুটি খবরটা জানাইয়া বলিলেন, আমার পরামর্শ নিলে কি এমন হ’ত? না এতবড় জুয়াচুরি ঘটতে দিতাম? যাই হউক, কথাটা এখন প্রকাশ করো না, ভাল ক’রে ভেবে দেখা উচিত। কিন্তু ভাল করিয়া ভাবিতে সময় লাগে, দুই-চারি দিন অপেক্ষা করিতে হয়, স্ত্রীলোক এতটা পারে না, তাই হরিদয়ালের পত্রের মর্মার্থ দুই-চারি কান করিয়া ক্রমশঃ সংখ্যায় বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। মেয়ে দেখার দিন হরিবালা শুনিতে পাইয়াছিলেন, তাই ভয়ে ভয়ে সেদিন জানিতে আসিয়াছেলেন, চন্দ্রনাথ সরযূকে কতখানি ভালবাসেন। সেদিন মেয়ে-মহলে অস্ফুট-কলকণ্ঠে এ প্রশ্নটা খুব উৎসাহের সহিত আলোচিত হইয়াছিল, কেননা, তাহারাই প্রথমে বুঝিয়াছিল যে, শুধু ভালবাসার গভীরতার উপরেই সরযূর ভবিষ্যৎ নিহিত আছে।
সকলেই চাপা গলায় কথা কহে, সকলের মুখেচোখে প্রকাশ পায় যে, একটা পৈশাচিক আনন্দ-প্রবাহ এই কোমল
প্রথমটা হরকালী বিহ্বলের মত চাহিয়া রহিলেন, তাহার পরে বলিলেন, কি হয়েছে?
রামময়ের বৃদ্ধা জননী ফোঁস করিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আর কি হবে বড়গিন্নী, যা হবার তাই হয়েছে—সর্বনাশ হয়েচে। এই বলিয়া তিনি কাহিনীটা আর একবার আগাগোড়া বিবৃত করিয়া গেলেন। বলিবার সময় অল্পস্বল্প ভুল-ভ্রান্তি যাহা ঘটিল, তাহা আর পাঁচজনে সংশোধন করিয়া দিল। এইরূপে হরকালী হৃদয়ঙ্গম করিলেন, সত্যই সর্বনাশ ঘটিয়াছে। কিন্তু সেটা কতটা তাঁহার নিজের এবং কতটা আর একজনের, সেই কথাটাই বেশ করিয়া অনুভব করিতে তিনি নিঃশব্দে উঠিয়া গিয়া নিজের ঘরের মধ্যে দ্বার বন্ধ করিলেন, যাঁহারা ভাল করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহারা ভাল করিলেন কি মন্দ করিলেন, ঠিক বুঝিতে না পারিয়া হতবুদ্ধি হইয়া চিন্তিত-বিমর্ষমুখে একে একে সরিয়া পড়িলেন। নিভৃত ঘরের মধ্যে আসিয়া হরকালীর আশঙ্কা হইল, তাঁহার দগ্ধ অদৃষ্টে এতবড় সুসংবাদ শেষ পর্যন্ত টিকিবে কি না! তিনি ভাবিলেন, যদি নাই টিকে, উপায় নাই। কিন্তু যদি অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন হইয়াই থাকে, যদি ভগবান এতদিন পরে সত্যই মুখ তুলিয়া চাহিয়া থাকেন, তাহা হইলে বোনঝিটি এখনও আছে,—এখনও সে পরের হাতে গিয়া পড়ে নাই—এই তার সময়। যাহাই হউক, শেষ পর্যন্ত যে প্রাণপণ করিয়া দেখিতেই হইবে, তাহাতে আর তাঁহার কিছুমাত্র সংশয় রহিল না। তিনি মুখ ম্লান করিয়া যখানে চন্দ্রনাথ লেখাপড়া করিতেছিল, সেইখানে আসিয়া উপবেশন করিলেন।
তাঁহার মুখের ভয়ঙ্কর ভাব দেখিয়া চন্দ্রনাথ চিন্তিত হইয়া বলিল, কি হয়েছে মামীমা।
হরকালী শিরে করাঘাত করিয়া কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিলেন, বাবা চন্দ্রনাথ, দুঃখী ব’লে কি আমাদের শাস্তি দিতে হয়!
চন্দ্রনাথ হতবুদ্ধি হইয়া গেল, সে কি করিয়াছে, তাহা কিছুতেই ভাবিয়া পাইল না।
হরকালী বলিতে লাগিলেন, আর বাকি কি? একমুঠো ভাতের জন্য জাত গেল, ধর্ম গেল। বাবা, খাবার থাকলে কি তুমি এমন ক’রে আমাদের সর্বনাশ করতে পারতে!
চন্দ্রনাথ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া অনেকটা শান্তভাবে কহিল, হয়েছে কি?
হরকালী আঁচল দিয়া মিথ্যা চোখ মুছিয়া বলিলেন, পোড়া কপালে যা হবার তাই হয়েছে। আমার সোনার চাঁদ তুমি, তোমাকে ডাকিনীরা ভুলিয়ে এই কাণ্ড করেচে।
পায়ে পড়ি মামিমা, খুলে বল!
আর কি বলব? তোমার খুড়োকে জিজ্ঞেস কর।
চন্দ্রনাথ এবার বিরক্ত হইল। বলিল, খুড়োকেই যদি জিজ্ঞাসা করব, তবে তুমি অমন করচ কেন?
আমাদের সর্বনাশ হয়েছে, তাই এমন কচ্চি বাবা,—আর কেন?
চন্দ্রনাথ মাতুল ও মাতুলানীকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা-ভক্তি করিত, কিন্তু ওরূপ ব্যবহারে অত্যন্ত বিরক্ত হইতে হয়, সে বিরক্ত হইয়াছিল, আরো বিরক্ত হইয়া বলিল, যদি সর্বনাশ হয়েই থাকে ত অন্য ঘরে যাও—আমার সামনে অমন করো না।
হরকালী তখন চন্দ্রনাথের মৃত-জননীর নামোচ্চারণ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন—ওগো, তুমি আমাদের ডেকে এনেছিলে, আজ তোমার ছেলে তাড়িয়ে দিতে চায় গো।
চন্দ্রনাথ ব্যাকুল হইয়া মামীর হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, খুলে না বললে, কেমন করে বুঝব মামী, কিসে তোমাদের সর্বনাশ হ’ল। সর্বনাশ সর্বনাশই করছো, কিন্তু এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলতে পারলে না।
হরকালী আর একবার চোখ মুছিয়া বলিলেন, কিছুই জান না—বাবা?
না।
তোমার খুড়োকে কাশী থেকে তোমাদের পাণ্ডা চিঠি লিখেচে।
কি লিখেচে?
হরকালী তখন ঢোক গিলিয়া মাথা নাড়িয়া বলিলেন, বাবা, কাশীতে তোমাকে একা পেয়ে ডাকিনীরা ভুলিয়ে যে বেশ্যার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েচে।
চন্দ্রনাথ বিস্ফারিত চক্ষে প্রশ্ন করিল, কার গো?
শিরে করতাড়না করিয়া হরকালী বলিলেন, তোমার।
চন্দ্রনাথ কাছে সরিয়া আসিয়া ধীরভাবে জিজ্ঞাসা করিল, কার বেশ্যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে? আমার?
হাঁ।
তার মানে, বিয়ের পূর্বে সরযূ বেশ্যাবৃত্তি করত? মামীমা, ওকে যে দশ বছরেরটি ঘরে এনেচি, সে কথা কি তোমার মনে নাই?
তা ঠিক জানিনে চন্দরনাথ, কিন্তু ওর মায়ের কাশীতে নাম আছে।
তবে সরযূর মা বেশ্যাবৃত্তি করত। ও নিজে নয়?
হরকালী মনে মনে উদ্বিগ্ন হইয়া বলিলেন, ও একই কথা বাবা, একই কথা।
চন্দ্রনাথ ধমক দিয়া উঠিল, কাকে কি বলচ মামী? তুমি কি পাগল হয়েছ?
ধমক খাইয়া হরকালী কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিতে লাগিলেন, পাগল হবারই কথা যে বাবা! আমাদের দু’জনের প্রায়শ্চিত্ত ক’রে দাও—তারপর যেদিকে দু’চক্ষু যায়, আমরা চলে যাই। এর চেয়ে ভিক্ষে ক’রে খাওয়া ভাল।
চন্দ্রনাথ রাগের মাথায় বলিল, সেই ভাল।
তবে চলে যাই?
চন্দ্রনাথ মুখ ফিরাইয়া বলিল, যাও।
তখন হরকালী আবার সশব্দে কপালে করাঘাত করিলেন, হা পোড়াকপাল! শেষে এই অদৃষ্টে ছিল!
চন্দ্রনাথ মুখ ফিরাইয়া গম্ভীর হইয়া বলিল, তবু পরিষ্কার ক’রে বলবে না?
সব ত বলেছি।
কিছুই বলনি—চিঠি কৈ?
তোমাব কাকার কাছে।
তাতে কি লেখা আছে?
তাও ত বলেছি।
চন্দ্রনাথ ফিরিয়া আসিয়া একটা চৌকির উপর বসিয়া পড়িল। গভীর লজ্জায় ও ঘৃণায় তাহার পদতল হইতে কেশাগ্র পর্যন্ত বার-দুই শিহরিয়া উঠিয়া সমস্ত দেহ যেন অসাড় হইয়া আসিতে লাগিল। তাহার মুখ দিয়া শুধু বাহির হইল—ছিঃ!
হরকালী তাহার মুখের দিকে চাহিয়া মনে মনে ভয় পাইলেন—এমন ভীষণ কঠোর ভাব কোন মৃত-মানুষের মুখেও কেহ কোন দিন দেখে নাই। তিনি নিঃশব্দে উঠিয়া গেলেন।
নবম পরিচ্ছেদ
চন্দ্রনাথ কহিল, কৈ চিঠি দেখি?
মণিশঙ্কর নিঃশব্দে বাক্স খুলিয়া একখানি পত্র তাহার হাতে দিলেন। চন্দ্রনাথ সমস্ত পত্রটা বার-দুই পড়িয়া শুষ্ক-মুখে প্রশ্ন করিল, প্রমাণ?
রাখালদাস নিজেই আসচে।
তাঁর কথায় বিশ্বাস কি?
তা বলতে পারিনে। যা ভাল বিবেচনা হয়, তখন করো।
সে কি জন্য আসছে? এ কথা প্রমাণ ক’রে তার লাভ?
লাভের কথা ত চিঠিতেই লেখা আছে। দু’হাজার টাকা চায়।
চন্দ্রনাথ তাঁহার মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টি রাখিয়া সহজভাবে কহিল, এ কথা প্রকাশ না হ’লে সে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করতে পারত, কিন্তু সে আশায় তার ছাই পড়েচে। আপনি এক হিসাবে আমার উপকার করেছেন—এতগুলো টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
মণিশঙ্কর লজ্জায় মরিয়া গেলেন। ইচ্ছা হইল বলেন যে, তিনি এ কথা প্রকাশ করেন নাই, কিন্তু তথাপি স্মরণ হইল, তাঁহার দ্বারাই ইহা প্রকাশিত হইয়াছে, স্ত্রীকে না বলিলে কে জানিতে পারিত? সুতরাং অধোমুখে বসিয়া রহিলেন।
চন্দ্রনাথ পুনরায় কহিল, এ গ্রাম আমাদের। অথচ একজন দীন, লম্পট ভিক্ষুক আমাকে অপমান করবার জন্য আমার গ্রামে আমার বাড়িতে আসচে যে কি সাহসে সে কথা আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাইনে, কিন্তু এই কথাটা আজ আপনাকে জিজ্ঞাসা করি কাকা, আমার মৃত্যু হলে কি আপনি সুখী হন?
মণিশঙ্কর জিভ কাটিয়া কহিলেন, ছি ছি, অমন কথা মুখেও এনো না চন্দ্রনাথ।
চন্দ্রনাথ কহিল, আর কোনদিন আনবার আবশ্যক হবে না। আপনি আমার পূজনীয়, আজ যদি কোন অপরাধ করি মার্জনা করবেন। আমার সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি আপনি নিন, নিয়ে আমার ‘পরে প্রসন্ন হোন। শুধু যেখানেই থাকি, কিছু কিছু মাসহারা দেবেন—ঈশ্বরের শপথ ক’রে বলচি, এর বেশি আর কিছু চাইব না। কিন্তু এ সর্বনাশ আমার করবেন না।
তাহার কন্ঠ রোধ হইয়া আসিল এবং অধর দাঁত দিয়া চাপিয়া ধরিয়া সে কোনমতে উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন থামাইয়া ফেলিল।
মণিশঙ্কর উঠিয়া দাঁড়াইয়া চন্দ্রনাথের ডান-হাত চাপিয়া ধরিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, বাবা চন্দ্রনাথ, স্বর্গীয় অগ্রজের তুমি একমাত্র বংশধর—আমি ভিক্ষা চাইচি বাবা, আর এ বৃদ্ধকে তিরস্কার করো না।
চন্দ্রনাথ মুখ ফিরাইয়া চোখের জল মুছিয়া ফেলিয়া কহিল, তিরস্কার করি না কাকা। কিন্তু এত বড় দুর্ভাগ্যের পর দেশত্যাগ করা ছাড়া আর আমার অন্য পথ নেই, সেই কথাই আপনাকে বলছিলাম।
মণিশঙ্কর বিস্ময়ের স্বরে কহিলেন, দেশত্যাগ করবে কেন? না জেনে এরূপ বিবাহ করেচ, তাতে বিশেষ লজ্জার কারণ নেই—শুধু একটা প্রায়শ্চিত্ত করা বোধ করি প্রয়োজন হবে। চন্দ্রনাথ মৌন হইয়া রহিল। মণিশঙ্কর উৎসাহিত হইয়া পুনরপি কহিলেন, উপায় যথেষ্ট আছে। বউমাকে পরিত্যাগ ক’রে একটা গোপনে প্রায়শ্চিত্ত কর। আবার বিবাহ কর, সংসারী হও—সকল দিক রক্ষা হবে।
চন্দ্রনাথ শিহরিয়া উঠিল।
সংসারাভিজ্ঞ মণিশঙ্কর তাহা লক্ষ্য করিয়া স্থির-দৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
চন্দ্রনাথ কহিল, কোন মতেই পরিত্যাগ করতে পারব না কাকা।
মণিশঙ্কর কহিলেন, পারবে চন্দ্রনাথ। আজ বিশ্রাম কর গে, কাল সুস্থিরচিত্তে ভেবে দেখো এ কাজ শক্ত নয়। বউমাকে কিছুতেই গৃহে স্থান দেওয়া যেতে পারে না।
কিন্তু প্রমাণ না নিয়ে কিরূপে ত্যাগ করতে অনুমতি করেন?
বৃদ্ধ কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, অধিক প্রমাণ যাতে না হয় সে উপায় করব। কিন্তু তোমাকেও আপাততঃ ত্যাগ করতে হবে। ত্যাগ ক’রে প্রায়শ্চিত্ত করলেই গোল মিটবে।
কে মেটাবে?
আমি মেটাব।
কিন্তু কিছুমাত্র অনুসন্ধান না ক’রেই—
ইচ্ছা হয়, অনুসন্ধান পরে করো। কিন্তু একথা যে মিথ্যা নয়, তা আমি তোমাকে নিশ্চয় বললাম।
চন্দ্রনাথ বাটী ফিরিয়া আসিয়া নিজের ঘরে দ্বার রুদ্ধ করিয়া খাটের উপর শুইয়া পড়িল; মণিশঙ্কর বলিয়াছেন, সরযূকে ত্যাগ করিতে হইবে। শয্যার উপর পড়িয়া শূন্যদৃষ্টিতে উপরের দিকে চাহিয়া মানুষ ঘুমাইয়া যেমন করিয়া কথা কহে, ঠিক তেমনি করিয়া সে ঐ একটা কথা পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করিতে লাগিল। সরযূকে ত্যাগ করিতে হইবে, সে বেশ্যার কন্যা। কথাটা সে অনেকবার অনেক রকম করিয়া নিজের মুখে উচ্চারণ করিল, নিজে কান পাতিয়া শুনিল, কিন্তু মনে বুঝিতে পারিল না। সে সরযূকে ত্যাগ করিয়াছে,—সরযূ বাটীর মধ্যে নাই, ঘরের মধ্যে নাই, চোখের সুমুখে নাই, চোখের আড়ালে নাই, সে আর তাহার নাই। বস্তুটা যে ঠিক কি এবং কি তাহার সম্পূর্ণ আকৃতি, সহস্র চেষ্টাতেও তাহা সে নিজের মধ্যে উপলব্ধি করিতে পারিল না। অথচ মণিশঙ্কর বলিয়াছেন, কাজটা শক্ত নয়। কাজটা শক্ত কি সহজ, পারা যায় কি যায় না, তাহা হৃদয়ঙ্গম করিয়া লইবাব মত শক্তি মানুষের হৃদয়ে আছে কি না, তাহাও সে স্থির করিতে পারিল না। সে নির্জীবের মত পড়িয়া রহিল এবং এক সময়ে ঘুমাইয়া পড়িল। ঘুমাইয়া কত কি স্বপ্ন দেখিল—কোনটা স্পষ্ট, কোনটা ঝাপসা—ঘুমের ঘোরে কি একরকমের অস্পষ্ট ব্যথা তাহার সর্বাঙ্গে যেন নড়িয়া বেড়াইতে লাগিল, তাহাও সে অনুভব করিল, তাহার পর সন্ধ্যা যখন হয়-হয়, এমন সময় সে ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিয়া বসিল। তাহার মানসিক অবস্থা তখন এরূপ দাঁড়াইয়াছিল যে, মায়া-মমতার ঠাঁই নাই, রাগ করিবার, ঘৃণা করিবারও ক্ষমতা নাই। শুধু একটা অব্যক্ত অবোধ্য লজ্জার গুরুভারে তাহার সমস্ত দেহ-মন ধীরে ধীরে অবশ ও অবনত হইয়া একেবারে মাটির সহিত মিশিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছে।
এমনি সময়ে বাতি জ্বালিয়া আনিয়া ভৃত্য রুদ্ধ-দ্বারে ঘা দিতেই চন্দ্রনাথ ধড়মড় করিয়া উঠিয়া পড়িল এবং কপাট খুলিয়া দিয়া ঘরের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। চোখের উপর আলো লাগিয়া তাহার মোহের ঘোর আপনা আপনিই স্বচ্ছ হইয়া আসিয়াছিল এবং তাহারই ভিতর দিয়া এখন হঠাৎ সন্দেহ হইল, কথাটা সত্য কি?
সরযূ নিজে জানে কি? জানিয়া শুনিয়া তাহার সরযূ তাহারই এত বড় সর্বনাশ করিবে, এ কথা চন্দ্রনাথ কিছুতেই বিশ্বাস করিতে পারিল না। সে দ্রুতপদে ঘর ছাড়িয়া সরযূর শয়নকক্ষে আসিয়া উপস্থিত হইল।
সন্ধ্যার দীপ জ্বালিয়া সরযূ বসিয়া ছিল। স্বামীকে আসিতে দেখিয়া সম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখে ভয় বা উদ্বেগের চিহ্নমাত্র নেই, যেন একফোঁটা রক্তও নাই। চন্দ্রনাথ একেবারেই বলিল, সব শুনেচ?
সরযূ মাথা নাড়িয়া বলিল, হ্যাঁ।
সব সত্য?
সত্য।
চন্দ্রনাথ শয্যার উপর বসিয়া পড়িল,—এতদিন বলনি কেন?
মা বারণ করেছিলেন, তুমিও জিজ্ঞাসা করনি।
তোমার মায়ের উপকার করেছিলাম, তাই তোমরা এইরূপে শোধ দিলে!
সরযূ অধোমুখ স্হির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
চন্দ্রনাথ পুনরায় কহিল, এখন দেখচি কেন তুমি অত ভয়ে ভয়ে থাকতে, এখন বুঝচি এত ভালবেসেও কেন সুখ পাইনি, পূর্বের সব কথাই এখন স্পষ্ট হয়েচে। এই জন্যই বুঝি তোমার মা কিছুতেই এখানে আসতে স্বীকার করেন নি।
সরযূ মাথা নাড়িয়া বলিল, হ্যাঁ।
মুহূর্তের মধ্যে চন্দ্রনাথ বিগত দিনের সমস্ত কথা স্মরণ করিল। সেই কাশীবাস, সেই চিরশুদ্ধ মূর্তি সরযূর বিধবা মাতা,—সেই তাঁর কৃতজ্ঞ সজল চক্ষু দু’টি, স্নিগ্ধ শান্ত কথাগুলি। চন্দ্রনাথ সহসা আর্দ্র হইয়া বলিল, সরযূ, সব কথা আমাকে খুলে বলতে পার?
পারি। আমার মামার বাড়ি নবদ্বীপের কাছে। রাখাল ভট্টাচার্যের বাড়ি আমার মামার বাড়ির কাছেই ছিল। ছেলেবেলা থেকেই মা তাঁকে ভালবাসতেন। দু’জনের একবার বিয়ের কথাও হয়, কিন্তু তাঁরা নিচু ঘর ব’লে বিয়ে হতে পায়নি। আমার বাবার বাড়ি হালিশহর। আমার যখন তিন বৎসর বয়স তখন বাবা মারা যান, মা আমাকে নিয়ে নবদ্বীপ ফিরে আসেন। তার পর আমার যখন পাঁচ বছর বয়স, সেই সময় আমাকে নিয়ে মা চন্দ্রনাথ বলিল, তার পরে?
আমরা কিছুদিন মথুরায় থাকি, বৃন্দাবনে থাকি, তার পর কাশীতে আসি। সেই সময়ে রাখাল মদ খেতে শুরু করে। মায়ের কিছু অলঙ্কার ছিল, তাই নিয়ে রোজ ঝগড়া হ’ত। তার পর একরাত্রে সমস্ত চুরি ক’রে পালায়। সে সময় মায়ের হাতে একটি পয়সাও ছিল না। সাত-আট দিন আমরা ভিক্ষা ক’রে কোনরূপে থাকি, তার পরে যা ঘটেছিল, তুমি নিজেই জান।
চন্দ্রনাথের মাথার মধ্যে আগুন জ্বলিয়া উঠিল। সে সরযূর আনত মুখের দিকে ক্রূর দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া বলিয়া উঠিল, ছি ছি সরযূ, তুমি এই! তোমরা এই! সমস্ত জেনে শুনে তুমি আমার এই সর্বনাশ করলে? এ যে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনে, কি মহাপাপিষ্ঠা তুমি!
সরযূর চোখ দিয়া টপটপ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল, সে নিঃশব্দে নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল।
চন্দ্রনাথ তাহা দেখিতে পাইল না। অধিকতর কঠোর হইয়া বলিল, এখন উপায়?
সরযূ চোখের জল মুছিয়া আস্তে আস্তে বলিল, তুমি ব’লে দাও।
তবে কাছে এস।
সরযূ কাছে আসিলে চন্দ্রনাথ দৃঢ়মুষ্টিতে তাহার হাত ধরিয়া বলিল, লোকে তোমাকে ত্যাগ করতে বলে, কিন্তু আমার সে সাহস হয় না—তোমাকে বিশ্বাস হয় না—আমি সব বিশ্বাস হারিয়েচি।
মুহূর্তের মধ্যে সরযূর বিবর্ণ পাণ্ডুর মুখে এক ঝলক রক্ত ছুটিয়া আসিল, অশ্রুমলিন চোখ দু’টি মুহূর্তের জন্য চকচক করিয়া উঠিল, বলিল, আমাকে বিশ্বাস নেই?
কিছু না—কিছু না, তুমি সব পার।
সরযূ স্বামীর মুখের কাছে মুখ আনিয়া অবিচলিতকন্ঠে কহিল, তুমি যে আমার কি, তা তুমিও জান। একদিন তুমি আমাকে বলেছিলে, তোমার মুখের পানে চেয়ে দেখতে। আজ আমার মুখের পানে একবার চেয়ে দেখ। আজ আমি উপায় ব’লে দেব, বল, শুনবে?
শুনব। দাও ব’লে কি উপায়!
সরযূ বলিল, আমি বিষ খেলে উপায় হয় কি?
চন্দ্রনাথের মুষ্টি আরও দৃঢ় হইল, যেন পলাইয়া না যাইতে পারে, কহিল, হয়। হয় সরযূ, হয়। বিষ খেতে পারবে?
পারব।
খুব সাবধানে, খুব গোপনে।
তাই হবে।
আজই।
সরযূ কহিল, আচ্ছা, আজই। চন্দ্রনাথ চলিয়া যায় দেখিয়া সে স্বামীর পদদ্বয় জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, একটা আশীর্বাদও করলে না?
চন্দ্রনাথ উপর দিকে চাহিয়া বলিল, এখন নয়। যখন চলে যাবে, যখন মৃতদেহ পুড়ে ছাই হবে, তখন আশীর্বাদ করব।
সরযূ পা ছাড়িয়া দিয়া বলিল, তাই করো।
চন্দ্রনাথ চলিয়া যাইতে উদ্যত হইতেই সে আর একবার উঠিয়া গিয়া দ্বারে পিঠ দিয়া পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আমি বিষ খেলে কোন বিপদ তোমাকে স্পর্শ করবে না ত?
কিছু না।
কেউ কোন রকম সন্দেহ করবে না ত?
নিশ্চয় করবে। কিন্তু টাকা দিয়ে লোকের মুখ বন্ধ করব।
সরযূ বলিল, বিছানার তলায় একখানা চিঠি লিখে রেখে যাব, সেইখানা দেখিয়ো।
চন্দ্রনাথ কাছে আসিয়া তাহার মাথায় হাত দিয়া বলিল, তাই করো। বেশ ক’রে লিখে নীচে নিজের নাম স্পষ্ট ক’রে লিখে রেখো—কেউ যেন না বুঝতে পারে, আমি তোমাকে খুন করেচি। আর একটা কথা, ঘরের দোর-জানালা বেশ ক’রে বন্ধ ক’রে দিয়ো—একবিন্দু শব্দ যেন বাইরে না যায়। আমি যেন শুনতে না পাই—
সরযূ দ্বার ছাড়িয়া দিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া আর একবার প্রণাম করিয়া পায়ের ধুলা মাথায় তুলিয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, তবে যাও—বলিয়াই তাহার কি যেন সন্দেহ হইল—হাত ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, রোসো আর একটু দাঁড়াও। সে প্রদীপ কাছে আনিয়া স্বামীর মুখের দিকে বেশ করিয়া চাহিয়া দেখিয়া চমকিয়া উঠিল। চন্দ্রনাথ দুই চোখে একটা অমানুষিক তীব্র-দ্যুতি—ক্ষিপ্তের দৃষ্টির মত তাহা ঝকঝক করিয়া উঠিল।
চন্দ্রনাথ বলিল, চোখে কি দেখচ সরযূ?
সরযূ এক মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, কিছু না, আচ্ছা যাও।
চন্দনাথ ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল-বিড়বিড় করিয়া বলিতে বলিতে গেল—সেই ভাল—সেই ভাল—আজই।
দশম পরিচ্ছেদ
সেই রাত্রে সরযূ নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়া মনে মনে কহিল, আমি বিষ খেতে কিছুতেই পারব না। একা হ’লে মরতে পারতাম কিন্তু আমি ত আর একা নই—আমি যে মা। মা হয়ে সন্তান বধ করব কেমন ক’রে। তাই সে মরিতে পারিল না। কিন্তু তাহার সুখের দিন যে নিঃশেষ হইয়াছে, তাহাতেও তাহার লেশমাত্র সংশয় ছিল না।
গভীর রাত্রে চন্দ্রনাথ সহসা তাহার স্ত্রীর ঘরের মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল এবং সমস্ত শুনিয়া উন্মত্ত-আবেগে তাহাকে বক্ষে তুলিয়া লইয়া স্থির হইয়া রহিল। অস্ফুটে বারংবার কহিতে লাগিল, এমন কাজ কখনো করো না সরযূ, কখনো না। কিন্তু ইহার অধিক সে ত আর কোন ভরসাই দিতে পারিল না। তাহার এই বৃহৎ ভবনে এই হতভাগিনীর জন্য এতটুকু কোণের সন্ধানও ত সে খুঁজিয়া পাইল না, যেখানে সরযূ তাহার লজ্জাহত পাংশু মুখখানি লুকাইয়া রাখিতে পারে। সমস্ত গ্রামের মধ্যে কোথাও একবিন্দু মমতাও সে কল্পনা করিতে পারিল না, যাহার আশ্রয়ে সে তপ্ত অশ্রুরাশির একটি কণাও মুছিতে পারে। কাঁদিয়া কাটিয়া সে সাত দিনের সময় ভিক্ষা করিয়া লইয়াছে। ভাদ্র মাসের এই শেষ সাতটি দিন সে স্বামীর আশ্রয়ে থাকিয়া চিরদিনের মত নিরাশ্রিতা পথের ভিখারিণী হইতে যাইবে। ভাদ্র মাসে ঘরের কুকুর বিড়াল তাড়াইতে নাই,—গৃহস্থের অকল্যাণ হয়, তাই সরযূর এই আবেদন গ্রাহ্য হইয়াছে। একদিন সে স্বামীর হাত ধরিয়া বলিল, আমার দুরদৃষ্ট আমি ভোগ করব, সে জন্য তুমি দুঃখ করো না। আমার মত দুর্ভাগিনীকে ঘরে এনে অনেক সহ্য করেছ, আর করো না। বিদায় দিয়ে আবার সংসারী হও, আমার এমন সংসার যেন ভেঙ্গে ফেলো না।
চন্দ্রনাথ হেঁটমুখে নিরুত্তর হইয়া থাকে। ভালমন্দ কোন জবাবই খুঁজিয়া পায় না। তবে, এই কথাটা তাহার মনে হইতেছে, আজকাল সরযূ যেন মুখরা হইয়াছে। বেশি কিছু কথা কহিতেছে। এতদিন তাহার মনের মধ্যে যে ভয়টা ছিল, এখন তাহা নাই। দু’দিন পূর্বেও সে মুখ ঢাকিয়া, মুখোশ পরিয়া এ সংসারে বাস করিতেছিল; তখন সামান্য বাতাসেও ভয় পাইত, পাছে তাহার ছদ্ম আবরণ খসিয়া পড়ে, পাছে তাহার সত্য পরিচয় জানাজানি হইয়া যায়। এখন তাহার সে ভয় গিয়াছে। তাই এখন নির্ভয়ে কথা কহিতেছে। এ জীবনে তাহার যাহা-কিছু ছিল, সেই স্বামী, তাহার সর্বস্ব, সমাজের আদালত ডিক্রি জারি করিয়া নিলাম করিয়া লইয়াছে। এখন সে মুক্তঋণ, সর্বস্বহীন সন্ন্যাসিনী। তাই সে স্বামীর সহিত স্বচ্ছন্দে কথা কহে, বন্ধুর মত, শিক্ষকের মত উপদেশ দিয়া নির্ভীক মতামত প্রকাশ করে। আর সেদিনের রাত্রে দুইজন দুইজনকে ক্ষমা করিয়াছে। চন্দ্রনাথ বিষ খাইতে প্রলুব্ধ করিয়াছিল, তাহার এ আত্মগ্লানি সরযূর সব দোষ ঢাকিয়া দিয়াছে।
পরদিন প্রাতঃকাল হইতে হরকালী একখন্ড কাগজে টিকিট আঁটিয়া স্বামীকে দিয়া মাথামুণ্ডু কত-কি লিখাইতেছিলেন।
ব্রজকিশোর একবার জিজ্ঞাসা করিলেন, এত লিখে কি হবে?
হরকালী তাড়া দিয়া বলিলেন, তোমার যদি একটুও বুদ্ধি থাকত, তা’হলে জিজ্ঞেস করতে না। একবার আমার কথা না শুনে এইটি ঘটেছে, আর কোন বিষয়ে নিজের বুদ্ধি খাটাতে যেয়ো না।
হরকালী যাহা বলিলেন, সুবোধ শিশুর মত ব্রজকিশোর তাহা লিখিয়া লইলেন। শেষ হইলে হরকালী স্বয়ং তাহা আদ্যোপান্ত পাঠ করিয়া মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ঠিক হয়েছে। নির্বোধ ব্রজকিশোর চুপ করিয়া রহিলেন। অপরাহ্ণে হরকালী কাগজখানি হাতে লইয়া সরযূর কাছে আসিয়া কহিলেন, বউমা, এই কাগজখানিতে তোমার নামটি লিখে দাও।
কাগজ হাতে লইয়া সরযূ মুখপানে চাহিয়া কহিল, কেন মামীমা?
যা বলচি, তাই কর না বউমা!
কিসে নাম লিখে দেব, তাও কি শুনতে পাব না?
হরকালী মুখখানা ভারী করিয়া কহিলেন, এটা বাছা তোমারই ভালর জন্য। তুমি এখানে যখন থাকবে না, তখন কোথায় কিভাবে থাকবে, তাও কিছু আমরা আর সন্ধান নিতে যাবো না। তা বাছা, যেমন করেই থাক না কেন, মাসে পাঁচ টাকা ক’রে খোরাকি পাবে। একি মন্দ?
ভাল-মন্দ সরযূ বুঝিত। এবং এই হিতাকাঙ্ক্ষিণীর বুকের ভিতর যতটুকু হিত প্রচ্ছন্ন ছিল, তাহাও বুঝিল, কিন্তু যাহার প্রাসাদতুল্য অট্টালিকা নদীগর্ভে ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে, সে আর খানকতক ইট বাঁচাইবার জন্য নদীর সহিত কলহ করিতে চাহে না। সরযূ সেই কথা ভাবিলো। তথাপি একবার হরকালীর মুখের পানে চাহিয়া দেখিল। সেই দৃষ্টি! যে-দৃষ্টিকে হরকালী সর্বান্তঃকরণে ঘৃণা করিতেন, ভয় করিতেন, আজিও তিনি এ চাহনি সহিতে পারিলেন না। চোখ নামাইয়া বলিলেন, বউমা!
হাঁ মামীমা, লিখে দিই। সরযূ কলম লইয়া পরিষ্কার করিয়া নিজের নাম সই করিয়া দিল।
আজই দোসরা আশ্বিন—সরযূর চলিয়া যাইবার দিন। প্রাতঃকাল হইতে বড় বৃষ্টি পড়িতেছিল, হরকালী চিন্তিত হইয়া পড়িলেন, পাছে যাওয়া না হয়।
সমস্ত দিন ধরিয়া সরযূ ঘরের দ্রব্য-সামগ্রী গুছাইয়া রাখিতেছিল। মূল্যবান বস্ত্রাদি একে একে আলমারিতে বন্ধ করিল। সমস্ত অলঙ্কার লৌহসিন্দুকে পুরিয়া চাবি দিল, তাহার পর স্বামীকে ডাকিয়া আনিতে লোক পাঠাইয়া দিয়া নিজে ভূমিতলে পড়িয়া অনেক কান্না কাঁদিল। গৃহত্যাগের সময় যত নিকটে আসিতেছে, ক্লেশ তত অসহ্য হইয়া উঠিতেছে। এই সাত দিন যেভাবে কাটিয়াছিল, আজ সেভাবে কাটিবে বলিয়া মনে হইতেছে না। তাহার শঙ্কা হইল, পাছে, এই শেষ দিনটিতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, যাইবার সময় পাছে নিতান্ত তাড়িত ভিক্ষুকের মত দেখিতে হয়। আত্মসম্মানটুকুকে সে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরিয়াছিল; সেইটুকুকে ত্যাগ করিতে কিছুতেই তাহার প্রবৃত্তি হইল না।
চন্দ্রনাথ আসিলে সে চোখ মুছিয়া উঠিয়া বসিল। বলিল, এস, আজ অমার যাবার দিন। তখনও তাহার চক্ষুর পাতা আর্দ্র রহিয়াছে। চন্দ্রনাথ আর-এক দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল। সরযূ কাছে আসিয়া বলিল, এই চাবি নাও। যত দিন আর বিয়ে না কর, ততদিন অপর কাকেও দিও না।
চন্দ্রনাথ রূদ্ধস্বরে কহিল, যেখানে হয় রেখে দাও।
সরযূ হাত দিয়া টানিয়া চন্দ্রনাথের মুখ ফিরাইয়া ধরিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিল, কাঁদবার চেষ্টা করচ?
চন্দ্রনাথের মনে হইল কথাটা বড় শক্ত বলা হইয়াছে। সরযূ তখনই তাহার চক্ষু মুছাইয়া দিয়া আদর করিয়া বলিল, মনে ক’রে দেখ কোন দিন একটা পরিহাস করিনি, তাই যাবার দিনে আজ একটা তামাশা করলাম, রাগ করো না। তাহার পর কহিল, যা-কিছু ছিল, সমস্ত বন্ধ ক’রে আলমরিতে রেখে গেলাম, দেখো, মিছামিছি আমার একটি জিনিসও যেন নষ্ট না হয়।
চন্দ্রনাথ চাহিয়া দেখিল, নিরাভরণা সরযূর হাতে শুধু চার-পাঁচ গাছি কাঁচের চুড়ি ছাড়া আর কিছু নাই। সরযূর এ মূর্তি তাহার দুই চোখে শূল বিদ্ধ করিল, কিন্তু, কি বলিবে সে? আজ দু’খানা অলঙ্কার পরিয়া যাইবার প্রস্তাব করিয়া কি করিয়া সে এই দেবীর প্রতিমূর্তিটিকে অপমান করিবে? সরযূ গলায় আঁচল দিয়া প্রণাম করিয়া পদধূলি মাথায় তুলিয়া লইয়া বলিল, আমি যাচ্চি ব’লে অনর্থক দুঃখ করো না, এতে তোমার হাত নেই, আমি তা জানি।
চন্দ্রনাথ এতক্ষণ পর্যন্ত সহ্য করিয়াছিল, আর পারিল না, ছুটিয়া পলাইয়া গেল।
সন্ধ্যার পূর্বে গাড়ির সময় স্টেশনে যাইতে হইবে। বৃষ্টি আসিয়াছে, বাটীর বৃদ্ধ সরকার দুই-একখানি কাপড় গামছায় বাঁধিয়া কোচম্যানের কাছে গিয়া বসিল। সেই সীতাদেবীর কথা বোধ করি তাহার মনে পড়িয়াছিল, তাই চোখের জলও বড় প্রবল হইয়া গড়াইয়া পড়িতেছিল। চক্ষু মুছিয়া মনে মনে কহিল, ভগবান, আমি ভৃত্য—তাই আজ আমার এই শাস্তি!
যাইবার সময় সরযূ হরকালীর মনের ভাব বুঝিয়া ডাকিয়া প্রণাম করিল। পদধূলি গ্রহণ করিয়া বলিল, মামীমা, বাক্সটা একবার দেখ।
হরকালী অপ্রতিভ হইলেন—না না না, থাক;—ততক্ষণে কিন্তু টিনের বাক্স উন্মোচিত হইয়া হরকালীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। লোভ সংবরণ করা অসম্ভব। বক্রদৃষ্টিতে তিনি দেখিলেন, ভিতরে দুই-এক জোড়া সাধারণ বস্ত্র, দুই-তিনটা পুস্তক, কাগজে আবৃত দুইখানা ছবি, আরও দুই-একটা কি কি রহিয়াছে। সরযূ কহিল, শুধু এই আছে।
হরকালী ধীরে ধীরে সরিয়া গেলেন।
সন্ধ্যার পূর্বেই সরযূ গাড়িতে উঠিয়া বসিল। কোচম্যান গাড়ি হাঁকাইয়া ফটক বাহিয়া দ্রুত ছুটিয়া বাহির হইয়া পড়িল। দ্বিতলের জানালা খুলিয়া মণিশঙ্কর তাহা দেখিলেন। আজ তাঁহার হঠাৎ মনে হইল, বুঝি কাজটা ভাল হইল না।
একাদশ পরিচ্ছেদ
সমস্ত রাত্রি মণিশঙ্কর ঘুমাইতে পারিলেন না। সারারাত্রি ধরিয়াই তাঁহার দুই কানের মধ্যে একটা ভারী গাড়ির গভীর আওয়াজ গুমগুম শব্দ করিতে লাগিল। প্রত্যুষেই শয্যা ত্যাগ করিয়া বাহিরে আসিলেন। দেখিলেন, গেটের উপর একজন অপরিচিত লোক দীনবেশে অর্ধ-সুপ্তাবস্থায় বসিয়া আছে। কাছে যাইতেই লোকটা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আমি একজন পথিক। মণিশঙ্কর চলিয়া যাইতেছিলেন, সে পিছন হইতে ডাকিল, মণিশঙ্করবাবুর বাড়ি কি এই?
তিনি ফিরিয়া বলিলেন, এই।
তাঁহার সহিত কখন দেখা হ’তে পারে, ব’লে দিতে পারেন?
আমার নাম মণিশঙ্কর।
লোকটা সসম্ভ্রমে নমস্কার করিয়া বলিল, আপনার কাছেই এসেছি।
মণিশঙ্কর তাহার আপাদমস্তক বার বার নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, কাশী থেকে কি আসছ বাপু?
আজ্ঞে হাঁ।
দয়াল পাঠিয়েছে?
আজ্ঞে হাঁ।
টাকার জন্য এসেছ?
আজ্ঞে হাঁ।
মণিশঙ্কর মৃদু হাসিয়া বলিলেন, তবে আমার কাছে কেন? আমি টাকা দেব, তাই কি তুমি মনে করেচ?
লোকটি ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না। দয়ালঠাকুর ব’লে দিয়েচেন, আপনি টাকা পাবার সুবিধে করে দিতে পারবেন।
মণিশঙ্কর ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, পারব। তবে ভেতরে এস।
দুইজনে নির্জন-কক্ষে দ্বার রুদ্ধ করিয়া বসিলেন। মণিশঙ্কর বলিলেন, সমস্ত তবে সত্য?
সমস্ত সত্য। এই বলিয়া সে কয়েকখানা পত্র বাহির করিয়া দিল। মণিশঙ্কর তাহা আগাগোড়া পাঠ করিয়া বলিলেন, তবে বউমার দোষ কি?
তার দোষ নেই, কিন্তু মায়ের দোষে মেয়েও দোষী হয়ে পড়েছে।
তবে যার নিজের দোষ নেই, তাকে কি জন্য বিপদগ্রস্ত করচ?
আমারও উপায় নেই। টাকার জন্য সব করতে হয়।
মণিশঙ্কর কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, দেখ বাপু, এ দুর্নাম প্রকাশ পেলে আমারও অত্যন্ত লজ্জার কথা। চন্দ্রনাথ আমার ভ্রাতুষ্পুত্র।
রাখালদাস মাথা নাড়িয়া দৃঢ়ভাবে কহিল, আমি নিরুপায়।
সে কথা তোমার দিকে তাকালেই জানা যায়। ধর, টাকা যদি আমি নিজেই দিই, তা হ’লে কি রকম হয়!
ভালই হয়! আর ক্লেশ স্বীকার ক’রে চন্দ্রনাথবাবুর নিকট যেতে হয় না।
টাকা পেলেই তুমি গ্রাম ছেড়ে চ’লে যাবে, আর কোন কথা প্রকাশ করবে না, এ নিশ্চয়?
নিশ্চয়।
কত টাকা চাই?
অন্ততঃ দুই সহস্র।
মণিশঙ্কর বাহিরে গিয়া নায়েব লক্ষীনারায়ণকে ডাকিয়া দুই-তিনটি কথা বলিয়া দিলেন, তাহার পর ভিতরে আসিয়া একসহস্র করিয়া দুইখানি নোট বাক্স খুলিয়া রাখালদাসের হাতে দিয়া বলিলেন, এখান থেকে দশ ক্রোশ দূরে সরকারী খাজনা ঘর, সেখানে ভাঙ্গিয়ে নিয়ো, আর কোথাও ভাঙ্গান যাবে না । আর কখনো এ দিকে এসো না। আমি তোমার উপর সন্তুষ্ট নই, তাই আর যদি কখনো এ দিকে আসবার চেষ্টা কর, জীবিত ফিরতে পারবে না, তাও বলে দিলাম।
রাখালদাস চলিয়া গেল।
প্রাণপণে হাঁটিয়া অপরাহ্ণে সে শহরে উপস্থিত হইল। তখন কাছারি বন্ধ হইয়াছে। কোন কাজ হইল না। পরদিন সময়ে রাখালদাস খাজাঞ্চীর নিকট দুইখানি হাজার টাকার নোট দিয়া কহিল, টাকা চাই।
খাজাঞ্চীবাবু নোট দুইখনি ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিয়া, বসো, বলিয়া বাইরে গিয়া একজন পুলিশের দারোগা সঙ্গে লইয়া ফিরিয়া আসিয়া রাখালকে দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, এই নোট চুরি হয়েছে। জমিদার মণিশঙ্করবাবুর লোক বলচে, কাল সকালে ভিক্ষার ছল ক’রে তাঁর ঘরে ঢুকে এই দু’খানি নোট চুরি করেচে। নোটের নন্বর মিলচে।
রাখালদাস কহিল, জমিদারবাবু নিজে দিয়েছেন।
খাজাঞ্চী কহিল, বেশ হাকিমের কাছে বলো।
যথাসময়ে হাকিমের কাছে রাখাল বলিল, যাঁর টাকা, তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেই সমস্ত পরিষ্কার হবে। বিচারের দিন ডেপুটির আদালতে জমিদার মণিশঙ্কর উপস্থিত হইয়া হলফ লইয়া বলিলেন, তিনি লোকটাকে জীবনে কখনও দেখেন নাই। নোট তাহারই বাক্সে ছিল, কাহাকেও দেন নাই। রাখাল নিজেকে বাঁচাইবার জন্য অনেক কথা কহিতে চাহিল, হাকিম তাহা কতক কতক লিখিয়া লইলেন, কতক বা মণিশঙ্করের উকিল-মোক্তার গোলমাল করিয়া দিল। মোটের উপর, কথা কেহই বিশ্বাস করিল না, ডেপুটি তাহার দুই বৎসর সশ্রম কারাবাসের হুকুম করিলেন।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
হরিদয়ালের বাটীতে পুরাতন দাসীটি পর্যন্ত নাই। বামুন-ঠাকরুন ত সম্পূর্ণ নিরুদ্দেশ। সরযূ যখন প্রবেশ করিল, তখন বাটীতে কেহ নাই, শূন্য বাটী হাহা করিতেছে। বৃদ্ধ সরকার কাঁদিয়া কহিল, মা, আমি তবে যাই?
সরযূ প্রণাম করিয়া নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। সরকার কাঁদিতে কাঁদিতে প্রস্থান করিল—দয়ালঠাকুরের আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে পারিল না—ইচ্ছাও ছিল না।
সন্ধ্যার সময় দয়াল বাটী আসিলেন। সরযূকে দয়াল বসিয়া থাকিতে দেখিয়া বলিলেন, কে?
সরযূ প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। মুখ তুলিয়া বলিল, আমি।
সরযূ!—দয়াল বিস্মিত হইয়া মনোযোগ-সহকারে দেখিলেন, সরযূর গাত্রে একখানিও অলঙ্কার নাই, পরিধেয় বস্ত্র সামান্য, দাসদাসী কেহ সঙ্গে আসে নাই, অদূরে একটা বাক্স মাত্র পড়িয়া আছে। ব্যাপারটা সমস্ত বুঝিয়া লইয়া বিদ্রূপ করিয়া বলিলেন, যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই হয়েচে। তাড়িয়ে দিয়েচে?
সরযূ মৌন হইয়া রহিল।
দয়ালঠাকুর তখন অতিশয় কর্কশ-কণ্ঠে কহিলেন, এখানে তোমার স্থান হবে না। একবার আশ্রয় দিয়ে আমার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েচে—আর নয়।
সরযূ মাথা হেঁট করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মা কোথায়?
মাগী পালিয়েচে। আমাকে ডুবিয়ে দিয়ে স’রে পড়েচে, যেমন চরিত্র, সেইরূপ করেচে। রাগে তাঁহার সর্বাঙ্গ পুড়িয়া যাইতেছিল, হঠাৎ ব্যঙ্গ করিয়া বলিয়া উঠিলেন, বলা যায় না—হয়ত কোথাও খুব সুখেই আছে।
সেইখানে সরযূ বসিয়া পড়িল। সে যে অবশেষে তাহার মায়ের কাছেই ফিরিয়া আসিয়াছিল।
দয়াল বলিতে লাগিলেন, আমি তোমাকে স্থান দিয়ে জাত হারাতে চাইনে! যারা আদর ক’রে নিয়ে গিয়েছিল, শেষকালে তারা কি তোমার মাথা রাখবার একটু কুঁড়েও বেঁধে দিতে পারেনি, তাই রেখে গেছে আমার কাছে? যাও এখান থেকে।
এবার সরযূ কাঁদিয়া ফেলিল, বলিল, দাদামশাই, মা নেই, আমি যাব কোথায়?
হরিদয়ালের শরীরে আর মায়া-মমতা নাই। তিনি স্বচ্ছন্দে বলিলেন, কাশীর মত স্থানে তোমাদের স্থানাভাব হয় না। সুবিধামত একটা খুঁজে নিয়ো। তিনি নাকি বড় জ্বালায় জ্বলিতেছিলেন, তাই এমন কথাটাও কহিতে পারিলেন।
সরযূর স্বামী তাঁহাকে গৃহে স্থান দেয় নাই, হরিদয়াল দিবেন কেন? ইহাতে তাঁহাকে দোষ দিবার কিছু নাই, সরযূ তাহা বুঝিল। কিন্তু তাহারও যে আর দাঁড়াইবার স্থান নাই। স্বামীর গৃহে দু’দিনের আদর-যত্নে অতিথির মত গিয়াছিল—এখন বিদায় হইয়া আসিয়াছে। এ সংসারে, সেই যত্নপরায়ণ গৃহস্থ আর ফিরিয়া দেখিবে না, অতিথিটি কোথায় গেল! বড় যাতনায় তাহার নীরব-অশ্রু গণ্ড বাহিয়া পড়িতেছিল। এই তাহার সতেরো বছর বয়স—তাহার সব সাধ ফুরাইয়াছে! মাতা নাই, পিতা নাই, স্বামী পরিত্যাগ করিয়াছেন। দাঁড়াইবার স্থান নাই, আছে শুধু কলঙ্ক, লজ্জা আর বিপুল রূপযৌবন ।
এ নিয়ে বাঁচা চলে, কিন্তু সরযূর চলে না। সে ভাবিতেছিল, তাহার কত আয়ু, আর কতদিন বাঁচিতে হইবে! যতদিন হউক, আজ তাহার নূতন জন্মদিন। যদিও দুঃখকষ্টের সহিত তাহার পূর্বেই পরিচয় ঘটিয়াছে, কিন্তু এরূপ তীব্র অপমান এবং লাঞ্ছনা কবে সে ভোগ করিয়াছে? দয়ালঠাকুর উত্তরোত্তর উত্তেজিত-কণ্ঠে কথা কহিতেছিলেন, এবার চিৎকার করিয়া উঠিলেন, ব’সে রইলে যে?
সরযূ আকুলভাবে জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় যাব?
আমি তার কি জানি ?
সরযূ রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, দাদামশাই, আজ রাত্রি—
দূর দূর, একদণ্ডও না।
এবার সরয়ূ উঠিয়া দাঁড়াইল। চকিতে মনে একটু সাহস হইল, মনে করিল, যাহার কাছে শত অপরাধেও ভিক্ষা চাহিবার অধিকার ছিল, তাহার কাছেই যখন চাহি নাই, তখন পরের কাছে চাহিব কি জন্য? মনে মনে বলিল, আর কিছু না থাকে কাশীর গঙ্গা ত এখনও শুকায় নাই, সে সমাজের ভয়ও করে না, তাহার জাতিও যায় না; এ দুঃখের দিনে একটি দুঃখী মেয়েকে স্বচ্ছন্দে কোলে তুলিয়া লইবে। আমার আর কোথাও আশ্রয় না থাকে সেখানে থাকিবেই। সরযূ চলিতে লাগিল, কিন্তু চলিতে পারিল না, আবাব বসিয়া পড়িল।
দয়ালঠাকুর ভাবিলেন, এমন বিপদে তিনি জন্মে পড়েন নাই। তাঁহার গলাটা শুকাইয়া আসিতেছিল; পাছে অবশেষে দমিয়া পড়েন, এই ভয়ে চিৎকার করিয়া কহিলেন, অপমান না হলে বুঝি যাবে না? এই বেলা দূর হও—
এমন সময় সহসা বাহির হইতে ডাক আসিল, বাবাজী!
হরিদয়াল ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন । ঐ বুঝি খুড়ো আসচে। বলিতে বলিতেই কৈলাসচন্দ্র এক হাতে দাবার পুঁটুলি, অপর হাতে হুঁকা লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। তিনি যে এইমাত্র আসিয়াছিলেন, তাহা নহে; গোলমাল শুনিয়া বাহিরে দাঁড়াইয়া হরিদয়ালের তিরষ্কার ও গালিগালাজ শুনিতেছিলেন । তাই যখন ভিতরে প্রবেশ করিলেন, তখন হাতে দাবার পুঁটুলি ও হুঁকা ছিল, কিন্তু মুখে হাসি ছিল না। সোজা সরযূর কাছে আসিয়া দাঁডাইয়া কহিলেন, সরযূ যে! কখন এলে মা?
সরযূ কৈলাসখুড়োকে চিনিত, প্রণাম করিল।
তিনি আশীর্বাদ করিলেন, এস মা, এস। তোমাদের ছেলের বাড়িতে না গিয়ে এখানে কেন মা? তাহার পর হুঁকা নামাইয়া রাখিয়া সরযূর টিনের বাক্সটা একেবারে কক্ষে তুলিয়া লইয়া বলিলেন, চল মা, সন্ধ্যা হয়। কথাগুলি তিনি এরূপভাবে কহিলেন, যেন তাহাকে লইবার জন্যই আসিয়াছিলেন!
সরযূ কোন কথাই পরিস্কার বুঝিতে পারিল না, অধোমুখে বসিয়া রহিল।
কৈলাসচন্দ্র ব্যস্ত হইলেন, কহিলেন, তোর বুড়ো ছেলের বাড়ি যেতে লজ্জা কি? সেখানে কেউ তোকে অপমানের কথা বলবে না, মা-ব্যাটায় মিলে নূতন করে ঘরকন্না করব। চল মা, দেরি করিস নে।
সরযূ তথাপি উঠতে পারিল না। হরিদয়াল হাঁকিয়া বলিলেন, খুড়ো, কি করচো?
কিছু না বাবাজী। কিন্তু তখনই সরযূর খুব নিকটে আসিয়া হাতখানি প্রায় ধরিয়া ফেলিবার মত করিয়া নিতান্ত কাতরভাবে বলিলেন, চল্ না মা, বসে বসে কেন মিছে কটু কথা শুনচিস?
সরযূ উঠিয়া দাঁডাইল দেখিয়া হরিদয়াল কহিলেন, খুড়ো কি একে বাড়ি নিয়ে যাচ্চ?
খুড়ো জবাব দিলেন, না বাবা, রাস্তায় বসিয়ে দিতে যাচ্চি।
ব্যঙ্গোক্তি শুনিয়া হরিদয়াল বিরক্ত হইয়া বলিলেন, কিন্তু খুড়ো কাজটি ভাল হচ্চে না। কাল কি হবে, ভেবে দেখো।
কৈলাস তাহার উত্তর দিলেন না, কিন্তু সরযূকে কহিলেন, শিগ্গির চল না মা, নইলে আবার হয়ত কি ব’লে ফেলবে।
সরযূ দরজার বাহিরে আসিয়া পড়িল। কৈলাসচন্দ্রও ঘাড়ে বাক্স লইয়া পশ্চাতে চলিলেন।
হরিদয়াল পিছন হইতে কহিলেন, খুড়ো, শেষে কি জাতটা দেবে?
কৈলাসচন্দ্র না ফিরিয়াই বলিলেন, বাবাজী, নাও ত দিতে পারি।
আমাদের সঙ্গে তবে আহার বন্ধ হ’ল।
কৈলাসচন্দ্র এবার ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, কবে কার বাড়িতে দয়াল, কৈলাসখুড়ো পাত পেতেছে?
তা না পাত, কিন্তু সাবধান করে দিচ্চি।
কৈলাস ভ্রূ-কুঞ্চিত করিলেন। তাঁহার সুদীর্ঘ কাশীবাসের মধ্যে আজ তাঁহার এই প্রথম ক্রোধ দেখা দিল। বলিলেন, হরিদয়াল, আমি কি কাশীর পাণ্ডা, না যজমানের মন জুগিয়ে অন্নের সংস্থান করি? আমাকে ভয় দেখাচ্চ কেন? আমি যা ভাল বুঝি, তাই চিরদিন করেচি, আজও তাই করব। সেজন্য তোমার দুর্ভাবনার আবশ্যক নেই।
হরিদয়াল শুষ্ক হইয়া কহিলেন, তোমার ভালর জন্য—
থাক বাবাজী! যদি এই পঁয়ষট্টি বছর তোমার পরামর্শ না নিয়েই কাটাতে পেরে থাকি, তখন বাকি দু’চার বছর পরামর্শ না নিলেও আমার কেটে যাবে। যাও বাবাজী, ঘরে যাও।
হরিদয়াল পিছাইয়া পড়িলেন।
কৈলাসচন্দ্র বাটীতে পৌঁছিয়া বাক্স নামাইয়া সহজভাবে বলিলেন, এ ঘরবাড়ি সব তোমার মা, আমি তোমার ছেলে। বুড়োকে একটু-আধটু দেখো, আর তোমার নিজের ঘরকন্না চালিয়ে নিয়ো, আর কি বলব?
কৈলাসের আর কোন কথা কহিবার ছিল কি না, বলিতে পারি না, কিন্তু সরযূ বহুক্ষণ অবধি অশ্রু মুছিতে মুছিতে ভাবিয়া দেখিল, তাহার কোন কথাই আর বলিবার নাই।
সরযূ আশ্রয় পাইল।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
শরৎকালে প্রাতঃসমীরণ যখন স্নিগ্ধ-মধুর সঞ্চরণে চন্দ্রনাথের কক্ষে প্রবেশ করিত, সারা রাত্রির দীর্ঘ জাগরণের পর চন্দ্রনাথ এই সময়টিতে ঘুমাইয়া পড়িত। তাহার পর তপ্ত সূর্যরশ্মি জানালা দিয়া তাহার মুখের উপর, চোখের উপর পড়িত, চন্দ্রনাথের আবার ঘুম ভাঙ্গিয়া যাইত। কিন্তু ঘুমের ঘোর কিছুতেই কাটিতে চাহিত না, পাতায় পাতায় জড়াইয়া থাকিত, তথাপি সে জোর করিয়া বিছানা ছাড়িয়া বাহিরে আসিয়া পড়িত। সারাদিন কাজকর্ম নাই, আমোদ নাই, উৎসাহ নাই, দুঃখ-ক্লেশও প্রায় নাই; সুখের কামনা ত সে একেবারেই ছাড়িয়া দিয়াছে। শীর্ণকায়া নদীর উপর দিয়া সন্ধ্যার দীর্ঘ ভারবাহী তরণী যেমন করিয়া এপাশ ওপাশ করিয়া হেলিয়া দুলিয়া বাঁকিয়া চুরিয়া মন্থরগমনে স্বেচ্ছামত ভাসিয়া যায়, চন্দ্রনাথের ভাবী দিনগুলাও ঠিক তেমনি করিয়া এক সূর্যোদয় হইতে পুনঃ সূর্যোদয় পর্যন্ত ভাসিয়া যাইতে থাকে। সে নিঃসংশয়ে বুঝিয়াছে, যে দিগন্ত-প্রসারিত কালোমেঘ তাহার মুখের সূর্যকে জীবনের মধ্যাহ্নেই আচ্ছাদিত করিয়াছে, এই মেঘের আড়ালেই একদিন সে সূর্য অস্তগমন করিবে। ইহজীবনে আর সাক্ষাৎলাভ ঘটিবে না। তাহার নীবব, নির্জন কক্ষে এই নিরাশার কালো ছায়াই প্রতিদিন ঘন হইতে ঘনতর হইতে লাগিল এবং তাহারি মাঝখানে বসিয়া চন্দ্রনাথ অলস-নিমীলিত চোখে দিন কাটাইয়া দিতে লাগিল।
হরকালী বলেন, এই অগ্রহায়ণ মাসেই চন্দ্রনাথের আবার বিবাহ হইবে। চন্দ্রনাথ চুপ করিয়া থাকে। এই চুপ করিয়া থাকা সম্মতি বা অসম্মতির লক্ষণ, তাহা নির্ণয় করিতে স্বামীর সঙ্গে তাঁহার তর্ক-বিতর্ক হয়। মণিশঙ্করবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলেন, চন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা না করিয়া কিছু বলা যায় না।
এবার কার্তিক মাসে দুর্গাপূজা। মণিশঙ্করের ঠাকুর-দালান হইতে সানাইয়ের গান প্রাতঃকাল হইতে গ্রামবাসীদের কানে কানে আগামী আনন্দের বার্তা ঘোষণা করিতেছে। চন্দ্রনাথের ঘুম ভাঙ্গিয়াছিল। নিমীলিতচক্ষে বিছানায় পড়িয়া শুনিতেছিল, একে একে কত কি সুর বাজিয়া যাইতেছে। কিন্তু একটা সুরও তাহার কাছে আনন্দের ভাষা বহিয়া আনিল না; বরঞ্চ ধীরে ধীরে হৃদয়-আকাশ গাঢ় কালোমেঘে ছাইয়া যাইতে লাগিল। আজ হঠাৎ তাহার মনে হইল, এখানে আর ত থাকা যায় না; একজন ভৃত্যকে ডাকিয়া কহিল, আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নে, রাত্রির গাড়িতে এলাহাবাদ যাব।
এ কথা হরকালী শুনিতে পাইয়া ছুটিয়া আসিলেন, ব্রজকিশোর আসিয়া বুঝাইতে লাগিলেন, এমন কি মণিশঙ্কর নিজে আসিয়াও অনুরোধ করিলেন যে আজ ষষ্ঠীর দিনে কোথাও গিয়া কাজ নাই।
চন্দ্রনাথ কাহারও কথা শুনিল না।
দুপুরবেলা হরিবালা আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সরযূ গিয়া অবধি এ বাটীতে তিনি আসেন নাই।
চন্দ্রনাথ তাঁহাকে দেখিয়া বলিল, হঠাৎ ঠানদিদি কি মনে ক’রে!
ঠানদিদি জবাব না দিয়া প্রশ্ন করিলেন, আজ বিদেশে যাচ্চ?
চন্দ্রনাথ বলিল, যাচ্চি।
পশ্চিমে যাবে?
যাবো।
হরিবালা কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া মৃদুস্বরে বলিলেন, দাদা, আর কোথাও যাবে কি?
চন্দ্রনাথ হরিবালার অভিপ্রায় বুঝিয়া বলিল, না। তাহার পর অন্যমনস্কভাবে এটা-ওটা নাড়িতে লাগিল।
হরিবালা যে কত কথা বলিতে আসিয়াছিলেন, তাহা বলিতে তাঁহার লজ্জা করিতেছেল, সাহসও হইতেছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সাহস করিয়া বলিয়া ফেলিলেন, দাদা, তার একটা উপায় করলে না? দুইজনের দেখা হওয়া অবধি দুইজনেই মনে মনে তাহার কথাই ভাবিতেছিল,—তাই এই সামান্য কথাটিতে দুইজনের চক্ষেই জল আসিয়া পড়িল। চন্দ্রনাথ সামলাইয়া লইয়া অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া কহিল, উপায় আর কি করব দিদি?
কাশীতে সে আছে কোথায়?
বোধ হয়, তার মায়ের কাছে আছে।
তা আছে, কিন্তু—
চন্দ্রনাথ মুখপানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু কি?
ঠানদিদি ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া মৃদুকন্ঠে কহিলেন, রাগ করো না দাদা—
চন্দ্রনাথ নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল।
ঠানদিদি তেমনি মৃদু মিনতির স্বরে বলিলেন, কিছু টাকাকড়ি দিয়ো দাদা—আজ যেন সে একলা আছে, কিন্তু দু’দিন পরে—
চন্দ্রনাথ কথাটা বুঝিয়াও বুঝিল না, বলিল, কি দু’দিন পরে?
বড় বড় দু’ফোটা চোখের জল হরিবালা চন্দ্রনাথের সম্মুখেই মুছিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, তার পেটে যা আছে, ভালয় ভালয় তা যদি বেঁচে-বত্তে থাকে, তা হ’লে—
চন্দ্রনাথের আপাদমস্তক কাঁপিয়া উঠিল, তাড়াতাড়ি সে বলিয়া উঠিল, ঠানদিদি আজ বুঝি ষষ্ঠী?
হ্যাঁ, ভাই।
আজ তা হ’লে—
যাবে না মনে কচ্চ?
তাই ভাবছি।
তবে তাই করো। পূজোর’পর যেখানে হয় যেয়ো, এ ক’টা দিন বাড়িতেই থাক।
কি জানি কি ভাবিয়া চন্দ্রনাথ তাহাতেই সম্মত হইল।
বিজয়ার পর একদিন চন্দ্রনাথ গোমস্তাকে ডাকিয়া বলিল, সরকারমশাই, কাশীতে তাকে রেখে আসবার সময় হরিদয়াল কি কিছু ব’লে দিয়েছেলেন?
সরকার কহিল, তাঁর সঙ্গে আমার ত দেখা হয় নি।
চন্দ্রনাথ ভয় পাইয়া কহিল, দেখা হয় নি? তবে কার কাছে দিয়ে এলেন? তার মায়ের সঙ্গে ত দেখা হয়েছিল?
সরকার মাথা নাড়িয়া বলিল, আজ্ঞে না, বাড়িতে ত কেউ ছিল না।
কেউ ছিল না? সে বাড়িতে কেউ থাকে কি না, সে সংবাদ নিয়েছিলেন ত? হরিদয়াল আর কোথাও উঠে যেতেও ত পারেন!
সরকার কহিল, সে সংবাদ নিয়েছিলাম। দয়াল ঘোষাল সেই বাড়িতে থাকতেন।
চন্দ্রনাথ নিঃশ্বাস ফেলিয়া ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এ পর্যন্ত কত টাকা পাঠিয়েছেন?
আজ্ঞে, টাকাকড়ি ত কিছু পাঠাই নি।
পাঠান নি! চন্দ্রনাথ বিস্ময়ে, বেদনায়, উৎকণ্ঠায় পাংশুবর্ণ হইয়া কহিল, কেন?
সরকার লজ্জায় ম্রিয়মাণ হইয়া কহিল, মামাবাবু বলেন, পাঁচ টাকার হিসাবে কিছু পাঠালেই হবে।
জবাব শুনিয়া চন্দ্রনাথ অগ্নিমূর্তি হইয়া উঠিল।
পাঁচ টাকার হিসাবে? কেন, টাকা কি মামাবাবুর? আপনি প্রতি মাসে কাশীর ঠিকানায় পাঁচ শ টাকা করে পাঠাবেন।
সরকার, যে আজ্ঞে, বলিয়া স্তম্ভিত হইয়া ধীরে ধীরে সরিয়া গেল।
হরকালী এ কথা শুনিয়া চক্ষু কপালে তুলিয়া বলিলেন, সে পাগল হয়েচে। সরকারকে তলব করিয়া অন্তরাল হইতে জোর করিয়া হাসিলেন। হাসির ছটা ও ঘটা বৃদ্ধ সরকার শুনিতেও পাইলো, বুঝিতেও পারিল। হরকালী কহিলেন, সরকারমশাই, কত টাকা পাঠাতে বলেচে?
প্রতিমাসে পাঁচ শ টাকা।
ভিতর হইতে পুনর্বার বিদ্রূপের হাসি শুনিয়া সরকার ব্যস্ত হইয়া পড়িল।
হরকালী অনেক হাসিয়া পরিশেষে গম্ভীর হইলেন। ভিতর হইতে বলিলেন, আহা, বাছার রাগ হ’লে আর জ্ঞান থাকে না। সে পোড়া-কপালীর যেমন অদৃষ্ট! আমি পাঁচ টাকা ক’রে দিতে বলেচি, তাই রেগে উঠেচে। বলে, পাঁচ শ টাকা করে দিও। বুঝলেন সরকারমশায়, চন্দ্রনাথের ইচ্ছা নয় যে, এক পয়সাও দেওয়া হয়।
কথাটা কিন্তু সরকার মহাশয় প্রথমে তেমন বুঝিল না; কিন্তু মনে মনে যত হিসাব করিল, তত বোধ হইতে লাগিল, হরকালীর কথাটাই সত্য। যাহাকে বাড়ি হইতে বাহির করা হইয়াছে, তাহাকে কি কেহ ইচ্ছাপূর্বক অত টাকা দেয়?
ভাবিয়া চিন্তিয়া সে বলিল, তা আপনি যা বলেন।
বলব আর কি! এই সামান্য কথাটা বুঝলেন না?
সরকার মহাশয় অপ্রতিভ হইয়া বলিল, তাই হবে।
হ্যাঁ, তাই। আপনি কিন্তু পাঁচ টাকা হিসাবে পাঠাবেন। চন্দ্র না দেয়, আমার হিসেব থেকে পাঁচ টাকা পাঠাবেন।
হরকালী মাসিক পঞ্চাশ টাকা করিয়া নিজের হিসাবে হাতখরচ পাইতেন।
সরকার মহাশয় প্রস্থান করিবার সময় বলিল, তাই পাঠাব।
চন্দ্রনাথ বাড়ি নাই। এলাহাবাদ গিয়াছে। সরকার মহাশয় তাহাকে পত্র লিখিয়া মতামত জানিবার ইচ্ছা করিল, কিন্তু পরে মনে হইল, এরূপ অসম্ভব কথা লইয়া অনর্থক তোলাপাড়া করিয়া নিজের বুদ্ধিহীনতার পরিচয় দিয়া লাভ নাই।
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
উপরিউক্ত ঘটনার পর দুই বৎসর অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। এই দুই বৎসরে আর কোন পরিবর্তন হউক বা না হউক, কৈলাশখুড়ার জীবনে বড় পরিবর্তন ঘটিয়াছে। যেদিন তাঁহার কমলা চলিয়া গিয়াছিলেন, যেদিন তাঁহার কমলচরণ সর্বশেষ নিশ্বাসটি ত্যাগ করিয়া ইহজীবনের মত চক্ষু মুদিয়াছিল, সেই দিন হইতে বিপুল বিশ্বও কৈলাশচন্দ্রের পক্ষে চক্ষু মুদিয়াছিল; কিন্তু সরযূর ওই ক্ষুদ্র শিশুটি তাঁহাকে পুনর্বার সেই বিস্মৃত-সংসারের স্নেহময় জটিল-পথে ফিরাইয়া আনিয়াছে। সেদিন তাঁহার ক্ষুদ্র চক্ষু-দু’টি বহুদিন পরে আর-একবার জলে ভরিয়া গিয়াছিল, চক্ষু মুছিয়া বলিয়াছিলেন, আমার ঘরে বিশ্বেশ্বর এসেছেন।
তখনও সে ছোট ছিল; ‘বিশু’ বলিয়া ডাকিলে উত্তর দিতে পারিত না, শুধু চাহিয়া থাকিত। তখন সে সরযূর ক্রোড়ে, লখীয়ার মার ক্রোড়ে এবং বিছানায় শুইয়া থাকিত; কিন্তু যেদিন হইতে সে তাহার চঞ্চল পা-দু’টি চৌকাঠের বাহিরে লইয়া যাইতে শিখিয়াছে, সেদিন হইতে সে বুঝিয়াছে, দুধের চেয়ে জল ভাল এবং দ্বিধাশূন্য হইয়া পরিষ্কার-অপরিষ্কার সর্ববিধ জলপাত্রেই মুখ ডুবাইয়া সরযূকে ফাঁকি দিয়া আকণ্ঠ জল খায় এবং যেদিন হইতে তাহার বিশ্বাস জন্মিয়াছে যে, তাহার শুভ্রকোমল উদর এবং মুখের উপর কয়লা কিংবা ধূলার প্রলেপ দিতে পারিলেই দেহের শোভা বাড়ে, সেইদিন হইতে সে সরযূর কোল ছাড়িয়া মাটি এবং তথা হইতে কৈলাসচন্দ্রের ক্রোড়ে স্থান করিয়া লইয়াছে। সকালবেলা কৈলাসচন্দ্র ডাকেন, ‘বিশু’, বিশু মুখ বাড়াইয়া বলে, ‘দাদু’; কৈলাসচন্দ্র বলেন, ‘চল ত দাদা, শম্ভু মিশিরকে এক বাজি দিয়ে আসি’, সে অমনি দাবার পুঁটলিটা হাতে লইয়া ‘তল’ বলিয়া দুই বাহু প্রসারিত করিয়া বৃদ্ধের গলা জড়াইয়া ধরে। কৈলাসচন্দ্রের আনন্দের সীমা থাকে না। সরযূকে ডাকিয়া বলেন, মা, বিশু আমার একদিন পাকা খেলোয়াড় হবে। সরযূ মুখ টিপিয়া হাসে, বিশু দাবার পুঁটলি হাতে লইয়া বৃদ্ধের কোলে বসিয়া দাবা খেলিতে বাহির হয়। পথে যাইতে যদি কেহ তামাশা করিয়া কহে, খুড়ো, বুড়ো-বয়সে কি আরও দুটো হাত গজিয়েছে?
বৃদ্ধ একগাল হাসিয়া বলেন, বাবাজী, এ হাত-দুটোতে আর জোর নেই, বড় শুকনো হয়ে গেছে; তাই দু’টো নতুন হাত বেরিয়েচে, যেন সংসারের গাছ থেকে প’ড়ে না যাই।
তাহারা সরিয়া যায়—বুড়োর কাছে কথায় পারিবার জো নেই।
শম্ভু মিশিরের বাটীতে সতরঞ্চ খেলার মধ্যে শ্রীমান্ বিশ্বেশ্বরেরও একটা নির্দিষ্ট স্থান আছে। দাদামহাশয়ের জানুর উপর বসিয়া, লাল রঙের কোঁচা ঝুলাইয়া, গম্ভীরভাবে চাহিয়া থাকে, যেন দরকার হইলে সেও দুই-একটা চাল বলিয়া দিতে পারে।
হস্তীদন্তনির্মিত বলগুলা যখন একটির পর একটি করিয়া তাহার দাদামহাশয়ের হস্তে নিহত হইতে থাকে, অতিশয় উৎসাহের সহিত বিশ্বেশ্বর সেগুলি দুই হাতে লইয়া পেটের উপর চাপিয়া ধরে। কিন্তু লাল রঙের মন্ত্রীটার উপরই তাহার ঝোঁকটা কিছু অধিক। সেটা যতক্ষণ হাতে না আসিয়া উপস্থিত হয়, ততক্ষণ সে লোলুপদৃষ্টিতে চাহিয়া থাকে।
মাঝে মাঝে তাগিদ দিয়া কহে, দাদু ঐতে? কৈলাসচন্দ্র খেলার ঝোঁকে অন্যমনস্ক হইয়া কহেন, দাঁড়া দাদা—। কখনও হয়ত বা সে আশেপাশে সরিয়া যায়, কৈলাসচন্দ্রের মনটিও চঞ্চলভাবে একবার বিশু ও একবার সতরঞ্চের উপর আনাগোনা করিতে থাকে, গোলমালে হয়ত বা একটা বল মারা পড়ে—কৈলাসচন্দ্র অমনি ফিরিয়া ডাকেন, দাদু, হেরে যাই যে—আয় আয় ছুটে আয়। বিশ্বেশ্বর ছুটিয়া আসিয়া তাহার পূর্বস্থান অধিকার করিয়া বসে, সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধেরও দ্বিগুণ উৎসাহ ফিরিয়া আসে। খেলা শেষ হইলে সে লাল মন্ত্রীটা হাতে লইয়া দাদামহাশয়ের কোলে উঠিয়া বাটী ফিরিয়া যায়।
কৈলাসচন্দ্রের এইরূপে নূতন ধরনের দিনগুলা কাটে। পুরাতন বাঁধা নিয়মে বিষম বাধা পড়িয়াছে। সাবেক দিনের মত দাবার পুঁটলি আর সব সময়ে তেমন যত্ন পায় না, হয়ত বা ঘরের কোণে একবেলা পড়িয়া থাকে; শম্ভু মিশিরের সহিত রোজ সকালবেলা হয়ত বা দেখাশুনা করিবার সুবিধা ঘটিয়া উঠে না। গঙ্গা পাঁড়ের দ্বিপ্রাহরিক খেলাটা ত একরূপ বন্ধ হইয়া গিয়াছে, সন্ধ্যার পর মুকুন্দ ঘোষের বৈঠকখানায় আর তেমন লোক জমে না,—মুকুন্দ ঘোষ ডাকিয়া ডাকিয়া হার মানিয়াছে—কৈলাসচন্দ্রকে রাত্রে আর কিছুতেই পাওয়া যায় না। সে সময়টা তিনি প্রদীপের আলোকে বসিয়া নূতন শিষ্যটিকে খেলা শিখাইতে থাকেন; বলেন, বিশু, ঘোড়া আড়াই পা চলে।
বিশু গম্ভীরভাবে বলে, ঘোয়া—
হাঁ ঘোড়া—
ঘোয়া চলে—ভাবটা এই যে, ঘোড়া চলে।
হাঁ, ঘোড়া চলে, আড়াই পা চলে।
বিশ্বেশ্বরের মনে নূতন ভাবোদয় হয়, বলে গায়ী চয়ে—
কৈলাসচন্দ্র প্রতিবাদ করিয়া বলেন, না দাদা, এ ঘোড়া গাড়ি টানে না। সে ঘোড়া আলাদা।
সরযূ এ সময়ে নিকটে থাকিলে, পুত্রের বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা দেখিয়া মুখে কাপড় দিয়া হাসিয়া চলিয়া যায়।
বিশু আঙুল বাড়াইয়া বলে, ঐতে। অর্থাৎ সেই লাল রঙের মন্ত্রীটা এখন চাই। বৃদ্ধ কিছুতেই বুঝিয়া উঠিতেন না যে, এতগুলা দ্রব্য থাকিতে ঐ লাল মন্ত্রীটার উপরেই তাহার এত নজর কেন?
প্রার্থনা কিন্তু অগ্রাহ্য হইবার জো নাই। বৃদ্ধ প্রথমে দুই-একটা ‘বোড়ে’ হাতে দিয়া ভুলাইবার চেষ্টা করিতেন; বিশু বড় বিজ্ঞ, কিছুতেই ভুলিত না। তখন অনিচ্ছা-সত্ত্বে তাহার ক্ষুদ্র হস্তে প্রার্থিত বস্তুটি তুলিয়া দিয়া বলিতেন, দেখিস দাদা, যেন হারায় না।
কেন?
মন্ত্রী হারালে কি খেলা চলে?
চয়ে না?
কিছুতেই না।
বিশু গম্ভীর হইয়া বলিত, দাদু—মন্তী!
হাঁ দাদু—মন্ত্রী!
সেদিন ভোলানাথ চাটুয্যের বাটীতে কথা হইতেছিল, কৈলাসচন্দ্র ডাকিলেন, বিশু, চল দাদা, কথা শুনে আসি।
বিশ্বেশ্বর তখন লাল কাপড় পরিয়া, জামা গায়ে দিয়া, টিপ পরিয়া, চুল আঁচড়াইয়া দাদুর কোলে চড়িয়া কথা শুনিতে গেল। কথকঠাকুর রাজা ভরতের উপাখ্যান কহিতেছিলেন। করুণকণ্ঠে গাহিতেছিলেন, কেমন করিয়া সেই বনবাসী মহাপুরুষের ক্রোড়ের নিকট হরিণ-শিশু ভাসিয়া আসিয়াছিল, কেমন করিয়া সেই সদ্যঃপ্রসূত মৃগ-শাবক কাতরনয়নে আশ্রয় ভিক্ষা চাহিয়াছিল। আহা, রাজা ভরত নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দিয়াছিলেন। এই সময় বিশু একটু সরিয়া বসিয়াছিল, কৈলাসচন্দ্র তাহাকে কোলের উপর টানিয়া লইলেন।
তাহার পর কথক গাহিলেন, সেই মৃগ-শিশু কেমন করিয়া পলে পলে, দণ্ডে দণ্ডে, দিনে দিনে তাঁহার ছিন্ন স্নেহডোর আবার গাঁথিয়া তুলিতে লাগিল, কেমন করিয়া সেই শতভগ্ন মায়াশৃঙ্খল তাঁহার চতুষ্পার্শ্বে জড়াইয়া দিতে লাগিল, কেমন করিয়া সেই মৃগ-শিশু নিত্যকর্ম পূজাপাঠ, এমন কি, ঈশ্বর-চিন্তার মাঝে আসিয়াও অংশ লইয়া যাইত। ধ্যান করিবার সময়ে মনশ্চক্ষে দেখিতে পাইতেন, সেই নিরাশ্রয় পশু-শাবকের সজলকরুণ-দৃষ্টি তাঁহার পানে চাহিয়া আছে; তাহার পর সে বড় হইতে লাগিল। ক্রমে কুটীর ছাড়িয়া প্রাঙ্গণে, প্রাঙ্গণ ছাড়িয়া পুষ্পকাননে, তাহার পর অরণ্যে, ক্রমে সুদূর অরণ্যপথে স্বেচ্ছামত বিচরণ করিয়া বেড়াইত। ফিরিয়া আসিবার নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হইলে রাজা ভরত উৎকণ্ঠিত হইতেন। সঘনে ডাকিতেন, আয়, আয়, আয়! তাহার পর কবি নিজে কাঁদিলেন, সকলকে কাঁদাইয়া উচ্ছ্বসিতকণ্ঠে গাহিলেন, কেমন করিয়া একদিন সে আজন্ম মায়াবন্ধন নিমেষে ছিন্ন করিয়া গেল,—বনের পশু বনে চলিয়া গেল, মানুষের ব্যথা বুঝিল না। বৃদ্ধ ভরত উচ্চৈঃস্বরে ডাকিলেন, আয়, আয়, আয়! কেহ আসিল না, কেহ সে আকুল আহ্বানের উত্তর দিল না। তখন সমস্ত অরণ্য অন্বেষণ করিলেন, প্রতি কন্দরে কন্দরে, প্রতি বৃক্ষতলে, প্রতি লতাবিতানে কাঁদিয়া ডাকিলেন, আয়, আয়, আয়! কেহ আসিল না। প্রথমে তাঁহার আহার-নিদ্রা বন্ধ হইল, পূজাপাঠ উঠিয়া গেল—তাঁহার ধ্যান, চিন্তা—সব সেই নিরুদ্দেশ স্নেহাস্পদের পিছে পিছে অনুদ্দেশ বনপথে ছুটিয়া ফিরিতে লাগিল।
কবি গাহিলেন, মৃত্যুর কালোছায়া ভূলুণ্ঠিত ভরতের অঙ্গ অধিকার করিয়াছে, কণ্ঠ রূদ্ধ হইয়াছে, তথাপি তৃষিত ওষ্ঠ ধীরে ধীরে কাঁপিয়া উঠিতেছে। যেন এখনও ডাকিতেছেন, ফিরে আয়, ফিরে আয়, ফিরে আয়!
কৈলাসচন্দ্র বিশ্বেশ্বরকে সবলে বক্ষে চাপিয়া হাহা-রবে কাঁদিয়া উঠিলেন। অন্তরের অন্তর কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিল, আয়, আয়, আয়!
সভায় কেহই বৃদ্ধের এ ক্রন্দন অস্বাভাবিক মনে করিল না। কারণ, বয়সের সহিত সকলেরই কেহ না কেহ হারাইয়া গিয়াছে। সকলেরই হৃদয় কাঁদিয়া ডাকিতেছে—ফিরে আয়, ফিরে আয়, ফিরে আয়!
কৈলাসচন্দ্র চক্ষু মুছিয়া বিশ্বেশ্বরকে ক্রোড়ে তুলিয়া বলিলেন, চল দাদা, বাড়ি যাই—রাত্তির হয়েচে।
বিশু কোলে উঠিয়া বাড়ি চলিল। অনেকক্ষণ একস্থানে বসিয়া থাকিয়া ঘুম পাইয়াছিল, পথিমধ্যে ঘুমাইয়া পড়িল।
বাড়ি গিয়া কৈলাসচন্দ্র সরয়ূর নিকট তাহাকে নামাইয়া দিয়া বলিলেন, নে মা, তোর জিনিস তোর কাছে থাক।
সরযূ দেখিল, বুড়োর চক্ষু-দুটি আজ বড় ভারী হইয়াছে।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
এই দুই বৎসরের মধ্যে চন্দ্রনাথের সহিত তাহার বাটীর সম্বন্ধই ছিল না। শুধু অর্থের প্রয়োজন হইলে সরকারকে পত্র লিখিত, সরকার লিখিত ঠিকানায় টাকা পাঠাইয়া দিত।
দুঃখ করিয়া হরকালী মধ্যে মধ্যে পত্র লিখিতেন। ব্রজকিশোর ফিরিয়া আসিবার জন্য অনুরোধ করিয়া চিঠি দিতেন। মণিশঙ্করও দুই-একখানা পত্র লিখিয়াছিলেন যে, তাঁহার শারীরিক অবস্থা ক্রমশঃ মন্দ হইয়া আসিতেছে, এ সময় একবার দেখিবার ইচ্ছা করে।
প্রথমে চন্দ্রনাথ সে-সকল কথায় কর্ণপাত করিত না, কিন্তু, যেদিন হরিবালা লিখিলেন, তুমি সুবিধা পাইলে একবার আসিয়ো, কিছু বলিবার আছে, সেই দিন চন্দ্রনাথ তল্পি বাঁধিয়া গাড়িতে উঠিল।
হরিবালা যদি কিছু কহেন, যদি কোন পত্র, যদি কোন হস্তলিপি দেখাইতে পারেন, যদি সেই বিগত সুখের একটু আভাস তাহাতে দেখিতে পাওয়া যায়,—তাহা হইলে—কিছু নয়। তথাপি চন্দ্রনাথ বাটী অভিমুখে ছুটিয়া আসিতে চাহিল। কিন্তু এতখানি পথ যে আশায় ভর করিয়া ছুটিয়া আসিল, বাটীতে আসিয়া তাহার কিছুই মিলিল না। হরিবালার সহিত সাক্ষাৎ হইলে জিজ্ঞাসা করিল, ঠানদিদি, আর কিছু বলবে না?
না, আর কিছু না।
নিরাশ হইয়া চন্দ্রনাথ কহিল, তবে কেন মিথ্যা ক্লেশ দিয়ে ফিরিয়ে আনলে?
বাড়ি না এলে কি ভাল দেখায়? তাহার পর দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিল, দাদা, যা হবার হয়েছে—এখন তুমি সংসারী না হ’লে আমাদের দুঃখ রাখবার স্থান থাকবে না।
চন্দ্রনাথ বিরক্ত হইয়া মুখ ফিরাইয়া বলিল, তা আমি কি করব?
কিন্তু মণিশঙ্কর কিছুতেই ছাড়িলেন না। হাত ধরিয়া বলিলেন, বাবা, আমাকে মাপ কর। সেই দিন থেকে যে জ্বালায় জ্বলে যাচ্চি তা শুধু অন্তর্যামীই জানেন।
চন্দ্রনাথ বিপন্ন হইল, কিন্তু কথা কহিতে পারিল না।
মণিশঙ্কর পুনরপি বলিতে লাগিলেন, আবার বিবাহ ক’রে সংসারধর্ম পালন কর। আমি তোমার মনোমত পাত্রী অন্বেষণ করে রেখেচি, শুধু তোমার অভিপ্রায় জানবার অপেক্ষায় এখনও কথা দিইনি। বাবা, এক সংসার গত হ’লে লোকে কি দ্বিতীয় সংসার করে না?
চন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে কহিল, এক সংসার গত হয়েচে—সে সংবাদ পেলে পারি।
দুর্গা—দুর্গা—এমন কথা বলতে নেই বাবা।
চন্দ্রনাথ চুপ করিয়া রহিল।
মণিশঙ্কর হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিলেন, আমার মনে হয়, আমিই তোমাকে সংসারত্যাগী করিয়েচি। এ দুঃখ আমার ম’লেও যাব না।
চন্দ্রনাথ বহুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল, কোথায় সম্বন্ধ স্থির করেচেন?
মণিশঙ্কর চক্ষু মুছিয়া উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন, কলকাতায়; তুমি একবার নিজে দেখে এলেই হয়।
চন্দ্রনাথ কহিল, তবে কালই যাব।
মণিশঙ্কর আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, তাই করো। যদি পছন্দ হয় আমাকে পত্র লিখো, আমি বাটীর সকলকে নিয়ে একেবারে কলকাতায় উপস্থিত হব। কিছুক্ষণ থামিয়া বলিলেন, আমার আর বাঁচবার বেশি দিন নেই চন্দ্রনাথ, তোমাকে সংসারী এবং সুখী দেখলেই স্বচ্ছন্দে যেতে পারব।
পরদিন চন্দ্রনাথ কলিকাতায় আসিল। সঙ্গে মাতুল ব্রজকিশোরও আসিয়াছিলেন। কন্যা দেখা শেষ হইলে ব্রজকিশোর বলিলেন, কন্যাটি দেখিতে মা-লক্ষ্মীর মত।
চন্দ্রনাথ মুখ ফারাইয়া রহিল, কোনও মতামত প্রকাশ করিল না।
স্টেশনে আসিয়া টিকিট লইয়া দুইজনে গাড়িতে উঠিলে ব্রজকিশোর জিজ্ঞাসা করিলেন, তবে বাবাজী, পছন্দ হয়েছে ত?
চন্দ্রনাথ মাথা নাড়িয়া বলিল, না।
ব্রজকিশোর যেন আকাশ হইতে পড়িলেন,—এমন মেয়ে, তবু পছন্দ হ’ল না?
চন্দ্রনাথ মাথা নাড়িয়া বলিল, না।
ব্রজকিশোর মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, তিনি সরযূকে দেখেন নাই।
তাহার পর নির্দিষ্ট স্টেশনে ট্রেন থামিলে ব্রজকিশোর নামিয়া পড়িলেন। চন্দ্রনাথ এলাহাবাদের টিকিট লইয়াছিল।
ব্রজকিশোর বলিলেন, তবে কতদিনে ফিরবে?
কাকাকে প্রণাম জানিয়ে বলবেন, শীঘ্র ফেরবার ইচ্ছা নেই।
মণিশঙ্কর সে কথা শুনিয়া কপালে করাঘাত করিয়া কহিলেন, যা হয় হবে। আমার দেহটা একটু ভাল হ’লেই নিজে গিয়ে বউমাকে ফিরিয়ে আনব। মিথ্যা সমাজের ভয় ক’রে চিরকাল নরকে পচতে পারব না—আর সমাজই বা কে? সে ত আমি নিজে।
হরকালী এ সংবাদ শুনিয়া দন্তে দন্তে ঘর্ষণ করিয়া বলিলেন, মরবার আগে মিন্সের বায়াত্তুরে ধরেচে! সরকারকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, চন্দ্রনাথ কি বললে?
সরকার কহিল, আজ পর্যন্ত কত টাকা কাশীতে পাঠানো হয়েচে?
শুধু এই জিজ্ঞেস করেছিল—আর কিছু না?
না।
হরকালী মুখের ভাব অতি ভীষণ করিয়া চলিয়া গেলেন।
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
চন্দ্রনাথ এলাহাবাদের টিকিট কিনিয়াছিল, কিন্তু পথিমধ্যে অকস্মাৎ সঙ্কল্প পরিবর্তন করিয়া কাশী আসিয়া উপস্থিত হইল।
সঙ্গে যে দুইজন ভৃত্য ছিল, তাহারা গাড়ি ঠিক করিয়া জিনিসপত্র তুলিল; কিন্তু চন্দ্রনাথ তাহাতে উঠিল না; উহাদিগকে ডাকবাংলায় অপেক্ষা করিয়া থাকিবার হুকুম দিয়া পদব্রজে অন্য পথে চলিয়া গেল। পথে চলিতে তাহার ক্লেশ বোধ হইতেছিল। মুখ শুষ্ক, বিবর্ণ, নিজের প্রতি পদক্ষেপ নিজের বুকের উপরেই যেন পদাঘাতের মত বাজিতে লাগিল, তথাপি চন্দ্রনাথ চলিতে লাগিল, থামিতে পারিল না। ক্রমেই হরিদয়ালের বাটীর দূরত্ব কমিয়া আসিতেছে। এ সমস্তই যে তাহার বিশেষ পরিচিত পথ! গলির মোড়ের সেই ছোট চেনা দোকানটি—ঠিক তেমনি রহিয়াছে। দোকানের মালিক ঠিক তত বড় ভুঁড়িটি লইয়াই মোড়ার উপর বসিয়া ফুলুরি ভাজিতেছে। চন্দ্রনাথ একবার দাঁড়াইল, দোকানদার চাহিয়া দেখিল, কিন্তু সাহেবী পোশাক-পরা লোকটিকে সাহস করিয়া ফুলুরি কিনিতে অনুরোধ করিতে পারিল না, একবার চাহিয়াই সে নিজের কাজে মন দিল।
চন্দ্রনাথ চলিয়া গেল। এই মোড়ের শেষে—আর ত তাহার পা চলে না। সঙ্কীর্ণ কাশীর পথে যেন বিন্দুমাত্র বাতাস নাই, শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্লেশ হইতেছে, দুই-এক পা গিয়া সে দাঁড়ায়—আবার চলে, আবার দাঁড়ায়, পথ আর ফুরায় না, তথাপি মনে হয়, এ পথ যেন না ফুরায়! পথের শেষে না জানি কিবা দেখিতে হয়! তারপর হরিদয়ালের বাটীর সম্মুখে আসিয়া সে দাঁড়াইল। বহুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল, ডাকিতে চাহিল, কিন্তু গলা শুকাইয়া গিয়াছে।
বদ্ধ-স্বর, ভগ্ন-শব্দ করিয়া থামিয়া গেল। ঘড়ি খুলিয়া দেখিল, নয়টা বাজিয়া গিয়াছে, তখন সাহস করিয়া ডাকিল, ঠাকুর, দয়ালঠাকুর! কেহ উত্তর দিল না। পথ দিয়া যাহারা চলিয়া যাইতেছিল, অনেকেই চন্দ্রনাথের রীতিমত সাহেবী পোশাক দেখিয়া ফিরিয়া চাহিল। চন্দ্রনাথ আবার ডাকিল, দয়ালঠাকুর!
এবার ভিতর হইতে স্ত্রী-কণ্ঠে উত্তর আসিল, ঠাকুর বাড়ি নেই।
যে উত্তর দিল সে একজন বাঙ্গালী দাসী।
সে দ্বার পর্যন্ত আসিয়া চন্দ্রনাথের পোশাক-পরিচছদ দেখিয়া লুকাইয়া পড়িল কিন্তু মাতৃভাষায় কথা কহিতে শুনিয়া একেবারে ভয়ে অভিভূত হইয়া পলাইয়া গেল না। অন্তরাল হইতে বলিল, ঠাকুর বাড়ি নেই।
কখন আসবেন?
দুপুরবেলা।
চন্দ্রনাথ ভিতরে প্রবেশ করিল। আনন্দ, শঙ্কা ও লজ্জা তিনের সংমিশ্রণে বুকের ভিতর কাঁপিয়া উঠিল—ভিতরে সরযূ আছে। কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করিয়া আর কাহাকেও দেখিতে পাইল না। জিজ্ঞাসা করিল, বাড়িতে আর কেউ নেই?
না।
তারা কোথা?
কারা?
একজন স্ত্রীলোক—
এই আমি ছাড়া আর ত কেউ এখানে নাই!
একটা ছোট ছেলে?
না, কেউ না।
চন্দ্রনাথ পইঠার উপরে বসিয়া পড়িল, এরা তবে গেল কোথায়?
দাসী বিব্রত হইয়া পড়িল। বলিল, না গো, এখানে কেউ থাকে না। আমি আর ঠাকুরমশাই থাকি। এক মাসের মধ্যে কোন যজমানও আসেনি।
চন্দ্রনাথ স্তব্ধ হইয়া মাটির দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল। মনে যে-সব কথা উঠিতেছিল, তাহা অন্তর্যামীই জানেন। বহুক্ষণ পরে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কতদিন এখানে আছ?
প্রায় দেড় বছর।
তবুও কাউকে দেখনি? একজন গৌরবর্ণ স্ত্রীলোক আর একটি ছেলে, না হয় মেয়ে, না হয় শুধু ঐ স্ত্রীলোকটি, কেউ না, কাউকে দেখনি?
না, আমি কাউকে দেখিনি।
কারো মুখে কোন কথা শোননি?
না
চন্দ্রনাথ আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিল না। সেইখানে দয়ালঠাকুরের অপেক্ষা করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার সেই সরযূ আর বাঁচিয়া নাই, তাহা সে বেশ বুঝিতেছিল, তথাপি শুনিয়া যাওয়া উচিত, এই জন্যই বসিয়া রহিল। এক-একটি মিনিট এক-একটি বৎসর বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।
দ্বিপ্রহর উত্তীর্ণ হইলে হরিদয়াল ঠাকুর বাটী আসিলেন। প্রথম দৃষ্টিতে তিনি চমকিত হইলেন, পরে চিনিতে পারিয়া শুষ্কস্বরে কহিলেন, তাইত, চন্দ্রবাবু যে, কখন এলেন?
চন্দ্রনাথ ভগ্নকণ্ঠে কহিল, অনেকক্ষণ, এরা কোথায়?
হ্যাঁ এরা—তা এরা—
চন্দ্রনাথ টলিতে টলিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। প্রাণপণ-শক্তিতে নিজেকে সংবরণ করিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কবে শেষ হ’ল?
কি শেষ হল?
চন্দ্রনাথ শুষ্ক-ভগ্নকণ্ঠে চিৎকার করিয়া বলিল, সরযূ কবে মরেছে ঠাকুর?
ঠাকুর এবার বুঝিয়া বলিলেন, মরবে কেন, ভালই আছে।
কোথায় আছে?
কৈলাসখুড়োর বাড়িতে।
সে কোথায়?
এই গলির শেষে। কাঁটালতলার বাড়িতে।
কপাল টিপিয়া ধরিয়া চন্দ্রনাথ পুনর্বার বসিয়া পড়িল। বহুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, তাহার পর শান্তকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, সে এখানে নেই কেন?
দয়ালঠাকুর ভাবিলেন, মন্দ নয়; এবং মিথ্যা লজ্জিত হইবার কোন কারণ নাই ভাবিয়া সাহস সঞ্চয় করিয়া বলিলেন, আপনি যাকে বাড়িতে জায়গা দিতে পারলেন না, আমি দেব কি বলে? আমারো ত পাঁচজনকে নিয়েই কাজ?
চন্দ্রনাথ বুঝিল, এ কথা সম্পূর্ণ সত্য। একটু ভাবিয়া বলিল, কৈলাসখুড়ার বাড়িতে কেমন ক’রে গেল?
তিনি নিজে নিয়ে গেছেন।
কে তিনি?
কাশীবাসী একজন দুঃখী ব্রাহ্মণ।
সরযূ তাঁকে আগে থেকেই চিনত কি?
হ্যাঁ, খুব চিনত।
তাঁর বয়স কত?
বুড়া হরিদয়াল মনে মনে হাসিয়া বলিলেন, তাঁর বয়স বোধ হয় ষাট-বাষট্টি হবে। সরযূকে মা ব’লে ডাকেন।
সেখানে আর কে আছে?
একজন দাসী, সরযূ আর বিশু।
বিশু কে?
সরযূর ছেলে।
চন্দ্রনাথ দাঁড়াইয়া বলিল, যাই।
হরিদয়াল গতিরোধ করিলেন না। চন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। গলির শেষে আসিয়া একজনকে জিজ্ঞাসা করিল, কৈলাসখুড়ার বাড়ি কোথায় জান? সে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইয়া দিল।
চন্দ্রনাথ একেবারে ভিতরে প্রবেশ করিল। সম্মুখে কাহাকেও দেখিতে পাইল না, শুধু সুন্দর হৃষ্টপুষ্ট-দেহ একটি শিশু ঘরের সম্মুখের বারান্ডায় বসিয়া একথালা জল লইয়া সর্বাঙ্গে মাখিতেছিল এবং মাঝে মাঝে পরম পরিতোষের সহিত দেখিতেছিল, তাহার কচি মুখখানির কালো ছায়া কেমন করিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া তাহার সহিত সহাস্যে পরিহাস করিতেছে। চন্দ্রনাথ তাহাকে একেবারে বুকে তুলিয়া লইয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। শিশু বিস্ময় বা ভয়ের চিহ্ন প্রকাশ করিল না। দেখিলে বোধ হয়, অপরিচিত লোকের ক্রোড়ে যাওয়া তাহার কাছে নূতন নহে। সে চন্দ্রনাথের নাকের উপর কচি হাতখানি রাখিয়া, মুখপানে চাহিয়া বলিল, তুমি কে?
চন্দ্রনাথ গভীর-স্নেহে তাহার মুখচুম্বন করিয়া বলিল, আমি বাবা।
বাবা?
হ্যাঁ বাবা, তুমি কে?
আমি বিতু!
চন্দ্রনাথ ঘড়ি-চেন বুক হইতে খুলিয়া লইয়া তাহার গলায় পরাইয়া দিল, পকেট হইতে ছুরি, পেন্সিল, মনিব্যাগ যাহা পাইল, তাহাই পুত্রের হস্তে গুঁজিয়া দিল; হাতের কাছে আর কিছুই খুঁজিয়া পাইল না যাহা পুত্রহস্তে তুলিয়া দেওয়া যায়।
বিশু অনেকগুলি দ্রব্য হাতের মধ্যে পাইয়া পুলকিত হইয়া বলিল, বাবা!
চন্দ্রনাথ নিঃশব্দে তাহার ছোট মুখখানি নিজের মুখের উপর চাপিয়া ধরিয়া বলিল, বাবা!
এই সময় লখীয়ার মা বড় গোল করিল। সে হঠাৎ জানালার ভিতর দিয়া দেখিতে পাইল যে, একজন সাহেব ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া বিশুকে কোলে লইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। সে নিঃশ্বাস রুদ্ধ করিয়া একেবারে রান্নাঘরে ছুটিয়া গেল। বাটীতে আজ কৈলাসচন্দ্র নাই, অনেক দিনের পর তিনি বিশ্বেশ্বরের পূজা দিতে গিয়াছিলেন; সরযূও এই কিছুক্ষণ হইল মন্দির হইতে ফিরিয়া আসিয়া রন্ধন করিতে বসিয়াছিল। লখীয়ার মা সেইখানে ছুটিয়া গিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, মাইজি!
কি রে!
ঘরের ভেতরে সাহেব ঢুকে বিশুকে কোলে ক’রে ঘুরে বেড়াচ্চে।
সরযূ আশ্চর্য হইয়া বলিল, সে আবার কি? বলিয়া দ্বারের অন্তরাল হইতে দেখিতে চাহিল, দেখিতে পাইল না।
লখীয়ার মা তাহার বস্ত্র ধরিয়া টানিয়া বলিল, যেয়ো না—বাবাজী আসুন।
সরযূ তাহা শুনিল না, তাহার বিশ্বাস হয় নাই। অগ্রসর হইয়া যাহা দেখিল, তাহাতে বোধ হইল, দাসীর কথা অসত্য নহে, একজন সাহেবের মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে এবং অস্ফুটে বিশ্বেশ্বরের সহিত কথা কহিতেছে। সাহসে ভর করিয়া সে জানালার নিকটে গেল। যাহার ছায়া দেখিলে সে চিনিতে পারিত, তাহাকে চক্ষের নিমিষে চিনিতে পারিল—তাহার স্বামী—চন্দ্রনাথ!
ভিতরে প্রবেশ করিয়া, গলায় আঁচল দিয়া, পায়ের উপর মাথা রাখিয়া প্রণাম করিয়া, সরযূ মুখ তুলিয়া দাঁড়াইল।
চন্দ্রনাথ বলিল, সরযূ!
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
তখন স্বামী-স্ত্রীতে এইরূপ কথাবার্তা হইল।
চন্দ্রনাথ বলিল, বড় রোগা হয়েচ।
সরযূ মুখপানে চাহিয়া অল্প হাসিল, যেন বলিতে চাহে, ইহাতে আর আশ্চর্য কি! তাহার পর চন্দ্রনাথ বিশুকে লইয়া একটু অধিক পরিমাণে ব্যস্ত হইয়া পড়িল। সরযূ তাহার জুতার ফিতা খুলিয়া দিল, গায়ের কোট-শার্ট একে একে খুলিয়া লইল, পাখা লইয়া বাতাস করিল, গামছা ভিজাইয়া পা মুছাইয়া দিল। এ-সকল কাজ সে এমন নিয়মিত শৃঙ্খলায় করিল, যেন ইহা তাহার নিত্যকর্ম, প্রত্যহ এমনি করিয়া থাকে। যাঁহাকে এ জীবনে দেখিতে পাইবার আশামাত্র ছিল না, আজ অকস্মাৎ কতদিন পরে তিনি আসিয়াছেন। কত অশ্রু, দীর্ঘনিঃশ্বাসের ছড়াছড়ি হইবার কথা ছিল, কিন্তু তাহা কিছুই হইল না। সরযূ এমন ভাবটি প্রকাশ করিল যেন স্বামী তাহার নিত্য আসিয়া থাকেন, আজিও আসিয়াছেন, হয়ত একটু বিলম্ব হইয়াছে—একটু বেলা হইয়াছে।
কিন্তু চন্দ্রনাথের ব্যবহারটি অন্য রকমের দেখাইতেছে। বিশুর সহিত ঘনিষ্ঠ আলাপ যেন ঘরে আর কেহ নাই, বাড়াবাড়ি বলিয়া বোধ হইতেছে। ঘরে ক্ষুদ্রবুদ্ধি বিশ্বেশ্বর ভিন্ন আর কেহ ছিল না, থাকিলে বুঝিতে পারিত যে, চন্দ্রনাথ নিজে ধরা পড়িয়া গিয়াছে এবং সেইটুকু ঢাকিবার জন্যই প্রাণপণে মুখ ফিরাইয়া পুত্রকে লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে।
সরযূ বলিল, খোকা, খেলা কর গে।
বিশু শয্যা হইতে নামিয়া পড়িতেছিল, চন্দ্রনাথ সযত্নে তাহাকে নামাইয়া দিল। ইতিপূর্বে সে জননীকে প্রণাম করিতে দেখিয়াছিল, তাই নামিয়াই পিতার চরণপ্রান্তে ঢিপ্ করিয়া প্রণাম করিয়া ছুটিয়া পলাইল। চন্দ্রনাথ হাত বাড়াইয়া ধরিতে গেল, কিন্তু সে ততক্ষণে স্পর্শের বাহিরে আসিয়া পড়িয়াছিল।
সরযূ তাহার বুকের কাছে হাত দিয়া কহিল, শরীরে যে তোমার কিছু নেই, অসুখ হয়েছিল?
না, অসুখ হয়নি।
তবে বড় বেশি ভাবতে বুঝি?
চন্দ্রনাথ তাহার মুখপানে চাহিয়া বলিল, তোমার কি মনে হয়?
সরযূ সে কথার উত্তর দিল না, অন্য কথা পাড়িল—বেলা হয়েচে, স্নান করবে চল।
চন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিল, বাড়ির কর্তা কোথায়?
তিনি আজ মন্দিরে পূজো করতে গেছেন, বোধ করি, সন্ধ্যার পরে আসবেন।
তুমি তাঁকে কি ব’লে ডাক?
বরাবর জ্যাঠামশায় বলে ডাকি, এখনও তাই বলি।
চন্দ্রনাথ আর কিছু জিজ্ঞাসা করিল না।
সরযূ জিজ্ঞাসা করিল, সঙ্গে কারা এসেছে?
হরি আর মধু এসেচে। তারা ডাকবাংলায় আছে।
এখানে আনতে বুঝি সাহস হ’ল না?
চন্দ্রনাথ এ কথার উত্তর দিল না।
চন্দ্রনাথ আহারে বসিয়া সুমুখে একথালা লুচি দেখিয়া কিছু বিস্মিত হইল। অপ্রসন্নভাবে ঠেলিয়া দিয়া বলিল, এ আবার কি? কুটুম্বিতে করচো, না তামাশা করচো?
সরযূ অপ্রতিভ হইয়া পড়িল। মলিন-মুখে বলিল, খাবে না?
চন্দ্রনাথ ক্ষণকাল সরযূর মুখপানে চাহিয়া বলিল, দুপুরবেলা কি আমি লুচি খাই?
সরযূ মনে মনে বিপদ্গ্রস্ত হইয়া মৌন হইয়া রহিল।
চন্দ্রনাথ কহিল, আজ যে তুমি আমাকে প্রথম খেতে দিলে তা নয়; আমি কি খাই, তাও বোধ করি ভুলে যাওনি।
সরযূর চোখে জল আসিতেছিল; ভাবিতেছিল, সেই দিন যে ফুরাইয়া গিয়াছে,—কহিল, ভাত খাবে? কিন্তু—
কিন্তু কি? শুকিয়ে গেছে?
না, তা নয়,—আমি এখানে রাঁধি!
বাড়িতেও ত রাঁধতে?
সরযূ একটু থামিয়া কহিল, আমার হাতে খাবে?
এইবার চন্দ্রনাথ মুখ নত করিল। এতক্ষণ তাহার মনে হয় নাই যে, সরযূ পর হইয়া গিয়াছে, কিংবা তাহার স্পর্শিত অন্নব্যঞ্জন আহার করা যায় না। কিন্তু সরযূর কথার ভিতর বড় জ্বালা ছিল। বহুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, তারপর ধীরে ধীরে কহিল, সরযূ, দুপুরবেলা আমার চোখের জল না দেখলে কি তোমার তৃপ্তি হবে না? সরযূ তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইল—যাই, তবে আনি গে। রন্ধনশালায় প্রবেশ করিয়া সে বড় কান্না কাঁদিল, তার পর চক্ষু মুছিল, জল দিয়া ধুইয়া ফেলিল, আবার অশ্রু আসে, আবার মুছিতে হয়, সরযূ আর আপনাকে কিছুতে সামলাইতে পারে না। কিন্তু স্বামী অভুক্ত বসিয়া আছেন, তখন অন্নের থালা লইয়া উপস্থিত হইল। কাছে বসিয়া, বহুদিন পূর্বের মত যত্ন করিয়া আহার করাইয়া উচ্ছিষ্ট পাত্র হাতে লইয়া, আর একবার ভাল করিয়া কাঁদিবার জন্য রন্ধনশালায় প্রবেশ করিল।
বেলা দুইটা বাজিয়াছে। চন্দ্রনাথের ক্রোড়ের কাছে বিশ্বেশ্বর পরম আরামে ঘুমাইয়াছে। সরযূ প্রবেশ করিল।
চন্দ্রনাথ কহিল, সমস্ত কাজকর্ম সারা হ’ল?
কাজ কিছুই ছিল না। জ্যাঠামশাই এখনও আসেন নি। তাহার পর সরযূ ঘরকন্নার কথা পাড়িল। বাড়ির প্রতি ঘর, প্রতি সামগ্রী, মাতুল-মাতুলানী, দাস-দাসী, সরকারমশায়, হরিবালা সই, পাড়া-প্রতিবেশী, একে একে সমস্ত কথা জিজ্ঞাসা করিল। এই সময়টুকুর মধ্যে দু’জনের কাহারও মনে পড়িল না যে, সরযূর এ-সব জানিয়া লাভ নাই, কিংবা এ-সকল সংবাদ দিবার সময় চন্দ্রনাথেরও ক্লেশ হওয়া উচিত—একটু লজ্জা, একটু বিমর্ষতা, একটু সঙ্কোচের আবশ্যক। একজন পরম আনন্দে প্রশ্ন করিতেছে, অপরে উৎসাহের সহিত উত্তর দিতেছে। নিতান্ত বন্ধুর মত দুইজনে যেন পৃথক হইয়াছিল, আবার মিলিয়াছে।
সহসা সরযূ জিজ্ঞাসা করিল, বিয়ে করলে কোথায়?
এটা যেন নিতান্ত পরিহাসের কথা!
চন্দ্রনাথ বলিল, পশ্চিমে।
কেমন বৌ হ’ল?
তোমার মত।
এই সময় সরযূ বুকের কাছে একটা ব্যথা অনুভব করিল, সামলাইতে পারিল না, বসিয়া ছিল, শুইয়া পড়িল। মুখখানি একেবারে বিবর্ণ হইয়া গেল।
ব্যস্ত হইয়া চন্দ্রনাথ নীচে নামিয়া পড়িল, কাছে আসিয়া হাত ধরিয়া তুলিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু সরযূ একেবারে এলাইয়া পড়িয়াছিল। তখন শিয়রে বসিয়া ক্রোড়ের উপর তাহার মাথাটা তুলিয়া কাঁদ-কাঁদ হইয়া ডাকিল, সরযূ!
সরযূ চোখ বুজিল। তাহার ওষ্ঠাধর কাঁপিয়া উঠিল এবং অস্পষ্ট কি বলিল, বোঝা গেল না।
চন্দ্রনাথ অত্যন্ত ভয় পাইয়া জলের জন্য হাঁকাহাঁকি করিতে লাগিল। লখীয়ার মা নিকটেই ছিল, জল লইয়া ঘরে ঢুকিল, কিন্তু কোনরূপ ব্যস্ততা প্রকাশ করিল না। বলিল, বাবু, এখনি সেরে যাবে, অমন মাঝে মাঝে হয়।
তাহার পর মুখে চোখে জল দেওয়া হইল, বাতাস করা হইল, বিশু আসিয়া বার-দুই চুল ধরিয়া টানাটানি করিয়া ডাকিল, মা!
সরযূর চৈতন্য হইল, লজ্জিত হইয়া মাথায় কাপড় টানিয়া দিয়া উঠিয়া বসিল। লখীয়ার মা আপনার কাজে চলিয়া গেল। ভয়ে চন্দ্রনাথের মুখ কালি হইয়া গিয়াছিল।
সরযূ হাসিল। বড় ক্ষীণ, অথচ বড় মধুর হাসিয়া বলিল, ভয় পেয়েছিলে?
চন্দ্রনাথের দুই চোখে জল টলটল করিতেছিল, এইবারে গড়াইয়া পড়িল, হাত দিয়া মুছিয়া ফেলিল; বলিল, ভেবেছিলাম বুঝি সব শেষ হয়ে গেল।
সরযূ মনে মনে ভাবিল, তোমার কোলে মাথা ছিল—সে সুকৃতি কি এ হতভাগিনীর আছে? প্রকাশ্যে কহিল, এমন ধারা মাঝে মাঝে হয়।
তা দেখচি! তখন হ’ত না, এখন হয়, সেও বুঝি। বলিয়া চন্দ্রনাথ বহুক্ষণ নিঃশব্দে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার পর পকেট হইতে মরিচা-ধরা একটা চাবির গোছা বাহির করিয়া সরযূর আঁচলের খুঁটে বাঁধিয়া দিয়া বলিল, এই তোমার চাবির রিং—আমার কাছে গচ্ছিত রেখে চ’লে এসেছিলে, আজ আবার ফিরিয়ে দিলাম। চেয়ে দেখ, কখন কি ব্যবহার হয়েচে ব’লে মনে হয়?
সরযূ দেখিল, তাহার আদরের চাবির রিং মরিচা ধরিয়া একেবারে ময়লা হইয়া গিয়াছে। হাতে লইয়া বলিল, তাকে দাওনি কেন?
চন্দ্রনাথের শুষ্ক ম্লানমুখ অকস্মাৎ অকৃত্রিম হাসিতে ভরিয়া গেল, দুই চোখে অসীম স্নেহ চঞ্চল হইয়া উঠিল, তথাপি নিজেকে সংযত করিয়া বলিল, তাকেই ত দিলাম সরযূ।
সরযূ ঠিক বুঝিতে পারিল না। ক্ষণকাল স্বামীর মুখের পানে সস্নিগ্ধ-দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, আমি নূতন বৌর কথা বলচি। তোমার দ্বিতীয় স্ত্রী, তাকে দাওনি কেন?
চন্দ্রনাথ আর নিজেকে সামলাইতে পারিল না। সহসা দুই হাত বাড়াইয়া সরযূর মুখখানি বুকের উপর টানিয়া লইয়া বলিয়া উঠিল, তাকেই দিয়েছি সরযূ, তাকেই দিয়েচি। স্ত্রী আমার দুটি নয়, একটি। কিন্তু সে আমার পুরানো হয় না—চিরদিনই নতুন। প্রথম যেদিন তাকে এই কাশী থেকে বিশ্বেশ্বরের প্রসাদী ফুলটির মত বুকে ক’রে নিয়ে যাই সেদিনও যেমন নতুন, আজও আবার যখন সেই বিশ্বেশ্বরের পায়ের তলা থেকে কুড়িয়ে নিতে এসেচি এখনও তেমনি নতুন।
সন্ধ্যার দীপ জ্বালিয়া ছেলে কোলে লইয়া সরযূ স্বামীর পায়ের নিকট বসিয়া বলিল, জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে দেখা না ক’রে তোমার যাওয়া হবে না—আজ রাত্তিরে তোমাকে থাকতে হবে।
চন্দ্রনাথ বলিল, তাই ভাবচি, আজ বুঝি আর যাওয়া হয় না।
সরযূ অনেকক্ষণ অবধি একটা কথা কহিতে চাহিতেছিল, কিন্তু লজ্জা করিতেছিল, সময়ও পায় নাই। এখন তাহা বলিল, তোমার কাছে আর লজ্জা কি—?
চন্দ্রনাথ সরযূর মুখের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল।
সরযূ বলিল, ভেবেছিলাম, তোমাকে একখানা চিঠি লিখব।
লেখনি কেন, আমি ত বারণ করিনি।
সরযূ একটুখানি ভাবিয়া বলিল, ভয় হ’ত, পাছে তুমি রাগ কর। আবার কবে তুমি আসবে?
যখন আসতে বলবে, তখনি আসব।
সরযূ একবার মনে করিল, সেই সময় বলিবে, কিন্তু পরক্ষণেই ভাবিয়া দেখিল, মানুষের শরীরে বিশ্বাস নাই। এখন না বলিলে হয়ত বলাই হবে না। চন্দ্রনাথ হয় ত আবার আসিবে, কিন্তু সে হয়ত ততদিনে পুড়িয়া ছাই হইয়া কোথায় উড়িয়া যাইবে। তাই বিবেচনা করিয়া বলিল, তোমার কাছে আমার কোন লজ্জা নেই।
সে কথা ত হয়ে গেল—আর কিছু বলবে?
সরযূ কিছুক্ষণ থামিয়া বলিল, আমার বাঁচতে ইচ্ছে নেই,—এমন ক’রে বেঁচে থাকা আর ভাল দেখাচ্চে না।
চন্দ্রনাথ ভাবিল, ইহা পরিহাসের মত শুনাইতেছে না। ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিল, সরযূর মুখ আবার বিবর্ণ হইয়াছে। সভয়ে কহিল, সরযূ কোন শক্ত রোগ জন্মায় নি ত?
সরযূ ম্লান হাসিয়া কহিল, তা বলতে পারিনে! বুকের কাছে মাঝে মাঝে একটা ব্যথা টের পাই।
চন্দ্রনাথ বলিল, আর ঐ মূর্ছাটা?
সরযূ হাসিল, ওটা কিছুই নয়।
চন্দ্রনাথ মনে মনে বলিল, যা হইবার হইয়াছে, এখন সর্বস্বান্ত হইয়াও তোমাকে আরোগ্য করিব।
সরযূ কহিল, তোমার কাছে একটি ভিক্ষা আছে, দেবে ত?
চাই কি?
নিজের কিছু চাই না। তবে, আমার যখন মৃত্যু-সংবাদ পাবে, তখন—এই সময় সে খোকাকে চন্দ্রনাথের পায়ের কাছে বসাইয়া দিয়া বলিল, তখন একবার এখানে এসে খোকাকে নিয়ে যেয়ো
চন্দ্রনাথ বিপুল আবেগে বিশ্বেশ্বরকে বক্ষে তুলিয়া লইয়া মুখচুম্বন করিল।
এই সময় বাহির হইতে কৈলাসচন্দ্র ডাকিলেন, দাদা, বিশু!
বিশ্বেশ্বর পিতার ক্রোড় হইতে ছটফট করিয়া নামিয়া পড়িল,—দাদু যাই।
সরযূ উঠিয়া দাঁড়াইল,—ঐ এসেছেন।
কিছুক্ষণ পরে কৈলাসচন্দ্র বিশ্বেশ্বরকে ক্রোড়ে লইয়া প্রাঙ্গণে আসিয়া দাঁড়াইলেন, চন্দ্রনাথও বাহিরে আসিল। কৈলাসচন্দ্র ইতিপূর্বে চন্দ্রনাথকে কখনও দেখেন নাই—দেখিলেও চিনতেন না, চাহিয়া রহিলেন। খোকা পরিচয় করিয়া দিল। হাত বাড়াইয়া বলিল, ওতা বাবা।
চন্দ্রনাথ প্রণাম করিয়া দাঁড়াইল। কৈলাসচন্দ্র আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, এস বাবা, এস।
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
কিন্তু চন্দ্রনাথ যখন বৃদ্ধকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, কাল এদের নিয়ে যাব, তখন কৈলাসচন্দ্রের বক্ষ-পঞ্জরের মধ্যে এককালে শতাধিক কামান দাগার মত শব্দ করিয়া উঠিল! নিজে কি কহিলেন, নিজের কানে সে শব্দ পৌঁছিল না। কিন্তু চন্দ্রনাথ শুনিল, অস্ফুট ক্রন্দনের মত বহুদূর হইতে কে যেন কহিল, এমন সুখের কথা আর কি আছে!
সরযূ এ সংবাদ শুনিয়া আনন্দ প্রকাশ করিল না, তাহার দুই চক্ষু বাহিয়া অশ্রু গড়াইয়া পড়িল। স্বামীর পদযুগল মস্তকে স্পর্শ করিয়া বলিল, পায়ের ধূলা দিয়ে হতভাগিনীকে এইখানেই রেখে যাও, আমাকে নিয়ে যেয়ো না।
চন্দ্রনাথ বলিল, কেন?
সরযূ জবাব দিতে পারিল না—কাঁদিতে লাগিল। বৃদ্ধ কৈলাসচন্দ্রের কাতর মুখখানি তাহার চোখের উপরে কেবলি ভাসিয়া উঠিতে লাগিল।
চন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আমি তোমার স্বামী, আমি যদি নিয়ে যাই, তোমার অনিচ্ছায় কিছু হবে না। আমি বিশুকে ছেড়ে থাকতে পারব না।
সরযূ দেখিল তাহার কিছুই বলিবার নাই।
পরদিন প্রাতঃকাল হইতে কৈলাসচন্দ্র বিশ্বেশ্বরকে সেদিনের মত কোলে তুলিয়া লইলেন। দাবার পুঁটুলি হাতে করিয়া শম্ভু মিশিরের বাড়ি আসিলেন। তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন, মিশিরজী! আজ আমার সুখের দিন—বিশুদাদা আজ তার নিজের বাড়ি যাবে। বড় হয়েছে ভাই, কুঁড়েঘরে আর তাকে ধ’রে রাখা যায় না।
মিশিরজী আনন্দ প্রকাশ করিলেন।
কৈলাসচন্দ্র সতরঞ্চ পাতিয়া বল সাজাইয়া বলিলেন, আজ আমোদের দিনে এস, তোমাকে দু বাজি মাত ক’রে যাই।
খেলার প্রারম্ভেই কিন্তু কৈলাসচন্দ্র একে একে বল হারাইতে লাগিলেন। গজ চালিতে নৌকা, নৌকা চালিতে ঘোড়া, এমনি বড় গোলমাল হইতে লাগিল। মিশিরজী কহিল, বাবুজী, আজ তোমার মেজাজ চৈন নাই, বহুত গল্তি হোতা। ক্রমে এক বাজির পর আর এক বাজি কৈলাসচন্দ্র হারিয়া খেলা উঠাইয়া পুঁটুলি বাঁধিতে বসিলেন, কিন্তু লাল মন্ত্রীটা বাঁধিলেন না। বিশুর হাতে দিয়া বলিলেন, দাদা, মন্ত্রীটা তোমাকে দিলাম, আর কখনও চাব না। পথে আসিতে যাহার সহিত দেখা হইল, তাহাকেই এই সুখবরটা জানাইয়া দিলেন।
আজ সর্বকর্মেই বৃদ্ধের বড় উৎসাহ। কিন্তু কাজ করিতে কাজ পিছাইয়া পড়িতেছে। দাবাখেলার মত বড় ভুলচুক হইয়া যাইতেছে। যত বেলা পড়িয়া আসিতে লাগিল ভুলচুক ততই বাড়িয়া উঠিতে লাগিল, সরযূ তাহা দেখিয়া গোপনে শতবার চক্ষু মুছিল। বৃদ্ধের কিন্তু মুখের উৎসাহ কমে নাই, এমন কি সরযূ যখন আড়ালে ডাকিয়া পদধূলি মাথায় লইয়া কাঁদিতে লাগিল, তখনও তিনি অশ্রুসংবরণ করিয়া হাসিয়া আশীর্বাদ করিলেন, মা আমার কাঁদিস নে। তোর বুড়ো জ্যাঠার আশীর্বাদে তুই রাজরানী হবি। আবার যদি কখনো আসিস, তোদের এই কুঁড়েঘরটিকে ভুলে যেন আর কোথাও থাকিস নে।
সরযূ আরও কাঁদিতে লাগিল, বুকের মাঝে শুধু সেই দিনের কথা কাঁদিয়া কাঁদিয়া উঠিতে লাগিল, যেদিন সে নিরাশ্রিতা পথের ভিখারিণী হইয়া কাশীতে আসিয়াছিল। আর আজ!
সরযূ বলিল, জ্যাঠামশাই, আমাকে ছেড়ে তুমি থাকতে পারবে না যে—
কৈলাসচন্দ্র কহিলেন, আর ক’টা দিন মা? কিন্তু মনে মনে বলিলেন, এইবার ডাক পড়েছে, এতদিনে তপ্ত প্রাণটার জুড়োবার উপায় হয়েছে ।
সরযূ চোখ মুছিতে মুছিতে আকুলভাবে বলিল, আমার মায়া-দয়া নেই—
বৃদ্ধ বাধা দিয়া বলিলেন, ছি মা, ও-কথা ব’লো না—আমি তোমাকে চিনেচি।
রাত্রি দশটার সময়ে সকলে স্টেশনে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গাড়ির সময় ক্রমশঃ নিকটবর্তী হইয়া আসিতেছে।
বিশ্বেশ্বর ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, কিন্তু লাল মন্ত্রীটা তখনও বুকের উপর চাপিয়া ধরিয়া ছিল। বৃদ্ধ নাড়াচাড়া করিয়া তাহাকে জাগাইয়া তুলিলেন। সদ্য নিদ্রোত্থিত হইয়া প্রথমে সে কাঁদিবার উপক্রম করিল, কিন্তু যখন তিনি মুখের কাছে মুখ আনিয়া ডাকিলেন, বিশু, দাদা! তখন সে হাসিয়া উঠিল, দাদু।
দাদাভাই আমার, কোথায় যাচ্চ?
বিশু বলিল, দাত্তি। তাহার পর মন্ত্রীটা দেখাইয়া কহিল, মন্তী।
কৈলাসচন্দ্র কহিলেন, হ্যাঁ দাদা! মন্ত্রী হারিয়ো না যেন।
এ গজদন্ত-নির্মিত রক্ত-রঞ্জিত পদার্থটা সম্বন্ধে কৈলাসচন্দ্র ইতিপূর্বে তাহাকে অনেকবার সতর্ক করিয়া দিয়াছিলেন, সেও ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হারাবো না—মন্তী!
ট্রেন আসিলে সরযূ পুনরায় তাঁহার পদধূলি মাথায় লইয়া গাড়িতে উঠিল। বৃদ্ধের আন্তরিক আশীর্বচন ওষ্ঠাধরে কাঁপিয়া কাঁপিয়া ভিতরেই রহিয়া গেল।
ট্রেন ছাড়িবার আর বিলম্ব নাই দেখিয়া কৈলাসচন্দ্র বিশ্বেশ্বরকে চন্দ্রনাথের ক্রোড়ে দিয়া বলিলেন, দাদু!
দাদু!
মন্ত্রী!
সে মন্ত্রীটা দেখিয়া হাসিয়া বলিল, দাদু—মন্তী!
হারাস নে—
না।
এইবার বৃদ্ধের শুষ্কচক্ষে জল আসিয়া পড়িল। গাড়ি ছাড়িয়া দিলে তিনি সরযূর জানালার নিকট মুখ আনিয়া কহিলেন, মা, তবে যাই—আর একবার জোর করিয়া ডাকিলেন, ও দাদু—
গাড়ির শব্দে এবং লোকের কোলাহলে বিশ্বেশ্বর সে আহ্বান শুনিতে পাইল না। যতক্ষণ গাড়ির শেষ শব্দটুকু শুনা গেল, ততক্ষণ তিনি একপদও নড়িলেন না। তাহার পর ধীরে ধীরে ফিরিয়া গেলেন।
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
বাড়ি পৌঁছিয়া চন্দ্রনাথের যেটুকু ভয় ছিল, খুড়ো মণিশঙ্করের কথায় তাহা উড়িয়া গেল। তিনি বলিলেন, চন্দ্রনাথ, পাপের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়, যে পাপ করেনি তার আবার প্রায়শ্চিত্তের কি প্রয়োজন? বধূমাতার কোন পাপ নেই, অনর্থক প্রায়শ্চিত্তের কথা তুলে তাঁর অবমাননা করো না। মণিশঙ্করের মুখে এরূপ কথা বড় নূতন শোনাইল। চন্দ্রনাথ বিস্মিত হইয়া চাহিয়া রহিল। তিনি আবার কহিলেন, বুড়ো হয়ে অনেক দেখেছি যে, দোষ-লজ্জা প্রতি সংসারে আছে। মানুষের দীর্ঘ-জীবনে তাকে অনেক পা চলতে হয়, দীর্ঘ-পথটির কোথাও কাদা, কোথাও পিছল, কোথাও বা উঁচু-নীচু থাকে, তাই বাবা, লোকের পদস্খলন হয়; তারা কিন্তু সে কথা বলে না, শুধু পরের কথা বলে। পরের দোষ, পরের লজ্জার কথা চিৎকার ক’রে বলে, সে শুধু আপনার দোষটুকু গোপনে ঢেকে ফেলবার জন্যেই। তারা আশা করে, পরের গোলমালে নিজের লজ্জাটুকু চাপা পড়ে যাবে। চন্দ্রনাথ চুপ করিয়া রহিল। মণিশঙ্কর একটু থামিয়া পুনর্বার কহিলেন, আর একটা নূতন কথা শিখেছি—শিখেছি যে, পরকে আপনার করা যায়; কিন্তু যে আপনার, তাকে কে কবে পর করতে পেরেছে? এতদিন আমি অন্ধ ছিলাম, কিন্তু বিশু আমার চোখ ফুটিয়ে দিয়েছে। তার পুণ্যে সব পবিত্র হয়েছে। আজ দ্বাদশী। পূর্ণিমার দিন তোমার বাড়িতে গ্রামসুদ্ধ লোকের নিমন্ত্রণ করেচি। তখন দাদা ছিলেন, কাজকর্ম সবই তিনি করতেন। আমি কখনও কিছু করতে পাইনি—তাই মনে করছি, বিশুর আবার নূতন করে অন্নপ্রাশন দেব।
চন্দ্রনাথ চিন্তা করিল, কিন্তু সমাজ?
মণিশঙ্কর হাসিলেন, বলিলেন, সমাজ আমি, সমাজ তুমি। এ গ্রামে আর কেউ নেই; যার অর্থ আছে, সেই সমাজপতি। আমি ইচ্ছা করলে তোমার জাত মারতে পারি, আর তুমি ইচ্ছা করলে আমার জাত মারতে পার। সমাজের জন্য ভেব না। আর একটা কথা বলি—এতদিন তা বলিনি, বোধ হয় কখনও বলতাম না, কিন্তু ভাবচি, তোমার কাছে একথা প্রকাশ করলে কোন ক্ষতি হবে না। তোমার রাখাল ভট্চায্যের কথা মনে হয়?
হয়। হরিদয়াল ঠাকুরের পত্রে পড়েছিলাম।
আমার পরিবারের যদি কিছু লজ্জার কথা থাকে, শুধু সেই প্রমাণ করতে পারত, কিন্তু সে আর কোন কথা প্রকাশ করবে না, আমি তাকে জেলে দিয়েছি। কিছুদিন হল সে খালাস হয়ে কোথায় চলে গেছে, আর কখনও এ দেশে পা বাড়াবে না।
মণিশঙ্কর তখন আনুপূর্বিক সমস্ত কথা বিবৃত করিলেন। সে সকল কাহিনী শুনিয়া চন্দ্রনাথের দুই চক্ষু বাষ্পাকুল হইয়া উঠিল।
তাহার পর পূর্ণিমার দিন খাওয়ানো-দাওয়ানো শেষ হইল। গ্রামের কেহই কোন কথা কহিল না। তাহারা মণীশঙ্করের ব্যবহার দেখিয়া বিশ্বাস করিল যে, একটা মিথ্যা অপবাদ রটনা হইয়াছিল,—হয় ত সে একটা জমিদারী চাল মাত্র!
হরকালী আলাদা রাঁধিয়া খাইলেন,—তাঁহারা এ গ্রামে আর বাস করিবেন না—বাড়ি যাইবেন। হরকালী বলিলেন, প্রাণ যায় সেও স্বীকার, কিন্তু ধর্মটাকে তিনি কিছুতেই ছাড়িতে পারিবেন না। ইহা সুখের কথাই হউক আর দুঃখের কথাই হউক, চন্দ্রনাথ তাঁহাদের পঞ্চাশ টাকার পরিবর্তে মাসিক একশত টাকা বরাদ্দ করিয়া দিয়াছে।
উৎসবের শেষে অনেক রাত্রে নাচ-গান বন্ধ হইলে ঘরে আসিয়া চন্দ্রনাথ দেখিল সর্ব অলঙ্কার-ভূষিতা রাজরাজেশ্বরীর মত নিদ্রিত পুত্র ক্রোড়ে লইয়া সরযূ স্বামীর জন্য অপেক্ষা করিয়া নিশি জাগিয়া বসিয়া আছে।
আজ পূর্ণিমা।
চন্দ্রনাথ বলিল, ইস।
সরযূ মৃদু হাসিয়া বলিল, সই আজ কিছুতেই ছাড়লেন না।
বিংশ পরিচ্ছেদ
সে রাত্রে এক-পা এক-পা করিয়া বৃদ্ধ কৈলাসচন্দ্র বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। বাঁধান তুলসী-বেদীর উপর তখনও দীপটা জ্বলিতেছিল, তথাপি এ কি ভীষণ অন্ধকার! এইমাত্র সবাই ছিল, এখন আর কেহ নাই। শুধু মাটির প্রদীপটি সেই অবধি জ্বলিতেছে; তাহারও আয়ু ফুরাইয়া আসিয়াছে, এইবার নিবিয়া যাইবে। সরযূ এটি স্বহস্তে জ্বালিয়া দিয়া গিয়াছিল।
শয্যায় আসিয়া তিনি শয়ন করিলেন। অবসন্ন চক্ষু দুইটি তন্দ্রায় জড়াইয়া আসিল। কিন্তু কানের কাছে সেই অবধি যেন কে মাঝে মাঝে ডাকিয়া উঠিতেছে, দাদু! স্বপ্ন দেখিলেন, রাজা ভরত তাঁহার বুকের মাঝখানটিতে মৃত্যূশয্যা পাতিয়া ক্ষীণ ওষ্ঠ কাঁপাইয়া বলিতেছে,—ফিরে আয়! ফিরে আয়!
সকালবেলায় শয্যায় উঠিয়া বসিলেন, বাহিরে আসিয়া অভ্যাসবশতঃ ডাকিলেন, বিশু! তাহার পর মনে পড়িল, বিশু নাই, তাহারা চলিয়া গিয়াছে।
দাবার পুঁটুলি হাতে লইয়া শম্ভু মিশিরের বাড়ি চলিলেন। ডাকিয়া বলিলেন, মিশিরজী, দাদাভাই আমার চলে গেছে।
দাদাভাইকে সবাই ভালবাসিত। মিশিরজীও দুঃখিত হইল। দাবার বল সাজান হইলে মিশিরজী কহিল, বাবুজী, তোমার উজীর কি হ’ল?
কৈলাসচন্দ্র দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন, —তাই ত, মিশিরজী, সেটা নিয়ে গেছে। লাল উজীরটা সে বড় ভালবাসত। ছেলেমানুষ কিছুতেই ছাড়লে না।
তিনি যে স্বেচ্ছায় তাঁহার প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় দাবা-জোড়াটি অঙ্গহীন করিয়াছিলেন, সে কথা বলিতে লজ্জা করিল।
মিশিরজী কহিল, তবে অন্য জোড়া পাতি?
পাত।
খেলায় কৈলাসচন্দ্রের হার হইল। শম্ভু মিশির তাঁহার সহিত চিরকাল খেলিতেছে, কখনও হারাইতে পারে নাই। হারিবার কারণ সে সহজেই বুঝিল। বলিল, বাবুজী, খোকাবাবু তোমার বিলকুল ইলিম সাথে লে গিয়া বাবুজী!
বাবুজীর মুখে শুষ্ক-হাসির রেখা দিল। বলিলেন, এস, আর এক বাজি দেখা যাক।
বহুৎ আচ্ছা।
খেলার মাঝামাঝি অবস্থায় কৈলাসচন্দ্র কিস্তি দিয়া ভুলিয়া বলিলেন, বিশু!
শম্ভু মিশির হাসিয়া ফেলিল। কিস্তি কথাটা সে বুঝিত, বলিল, বাবুজী, কিস্তি, বিশু নয়। দুইজনে হাসিয়া উঠিলেন।
শম্ভু মিশির কিস্তি দিয়া বলিল, বাবুজী, এইবার তোমার দো পেয়াদা গিয়া।
কৈলাসচন্দ্র ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, দাদা, আয়, আয়, শিগগির আয়। পরে কিছুক্ষণ যেন তাহার অপেক্ষা করিয়া বসিয়া রহিলেন। মনে হইতেছিল যেন এইবার একটি ক্ষুদ্র-কোমল-দেহ তাঁহার পিঠের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িবে। শম্ভু মিশির বিলম্ব দেখিয়া বলিল, বাবুজী, পেয়াদা নাহি বাঁচনে পারবে। বৃদ্ধের চমক ভাঙ্গিল, তাই ত, বোড়ে দু’টো মারা গেল!
তাহার পর খেলা শেষ হইল। মিশিরজী জয়ী হইল, কিন্তু আনন্দিত হইল না। বলগুলা সরাইয়া দিয়া বলিল, বাবুজী, দোসরা দিন খেলা হবে। আজ আপনা তবিয়ৎ বহুৎ বে-দুরস্ত—মেজাজ একদম দিক্ আছে।
বাড়ি ফিরিয়া যাইতে দুই প্রহর হইল। মনে হইতেছিল, বিশু ত নাই, তবে আর তাড়াতাড়ি কি।
বাটীতে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, লখীয়ার মা একা রন্ধনশালায় বসিয়া পাকের যোগাড় করিতেছে। আজ তাঁহাকে নিজে রাঁধিতে হইবে, নিজে বাড়িয়া খাইতে হইবে—একা আহার করিতে হইবে। ইচ্ছামত আহার করিবেন, তাড়াতাড়ি নাই, পীড়াপীড়ি নাই—বিশ্বেশ্বরের দৌরাত্ম্যের ভয় নাই! বড় স্বাধীন! কিন্তু এ যে ভাল লাগে না। রান্নাঘরে ঢুকিয়া দেখিলেন, একমুঠো চাল, দু’টা আলু, দু’টা পটল, খানিকটা ডালবাটা। চোখ ফাটিয়া জল আসিল—মনে পড়িল, দুই বৎসর আগেকার কথা। তখন এমনি নিজে রাঁধিতে হইত—এই লখীয়ার মা-ই আয়োজন করিয়া দিত। কিন্তু তখন বিশুও আসে নাই, চলিয়াও যায় নাই।
কাঁটালতলায় তাহার ক্ষুদ্র খেলাঘর এখনও বাঁধা আছে। দুটো ভগ্ন-ঘট, একটা ছিন্নহস্তপদ মাটির পুতুল, একটা দু পয়সা দামের ভাঙ্গা বাঁশী। ছেলেমানুষের মত বৃদ্ধ সেগুলি কুড়াইয়া আনিয়া আপনার শোবার ঘরে রাখিয়া দিলেন।
দুপুরবেলা আবার গঙ্গা পাঁড়ের বাড়িতে দাবা পাতিয়া বসিতে লাগিলেন। সন্ধ্যার পর মুকুন্দ ঘোষের বৈঠকখানায় আবার লোক জমিতে লাগিল, কিন্তু প্রসিদ্ধ খেলোয়াড় বলিয়া কৈলাসচন্দ্রের আর তেমন সম্মান নাই; তখন দিগ্বিজয়ী ছিলেন, এখন খেলামাত্র সার হইয়াছে। সেদিন যাহাকে হাতে ধরিয়া খেলা শিখাইয়াছিলেন, সে আজ চাল বলিয়া দেয়। যাহার সহিত তিনি দাবা রাখিয়াও খেলিতে পারেন, সে আজ মাথা উঁচু করিয়া স্বেচ্ছায় একখানা নৌকা মার দিয়া খেলা আরম্ভ করে।
পূর্বের মত এখনও খেলিবার ঝোঁক আছে কিন্তু সামর্থ্য নাই। দুই-একটা শক্ত চাল এখনও মনে পড়ে—কিন্তু সোজা খেলায় বড় ভুল হইয়া যায়। দাবাখেলায় গর্ব ছিল—আজ তাহা শুধু লজ্জায় পরিণত হইয়াছে। তবে শম্ভু মিশির এখনও সম্মান করে; সে আর প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া খেলে না, প্রয়োজন হইলে দুই-একটা কঠিন সমস্যা পূর্ণ করিয়া লইয়া যায়।
বাড়িতে আজকাল তাঁহার বড় গোলযোগ বাধিতেছে। লখীয়ার মা দস্তুরমত রাগ করিতেছে; দু-একদিন তাহাকে চোখের জল মুছিতেও দেখা গিয়াছে। সে বলে, বাবু, খাওয়া-নাওয়া একেবারে কি ছেড়ে দিলে? আয়না দিয়া চেহারাটা দেখ গে!
কৈলাসচন্দ্র মৃদু হাসিয়া কহেন, বেটী, রাঁধাবাড়া সব ভুলে গেছি—আর আগুন-তাতে যেতে পারিনে।
সে বহুদিনের পুরানো দাসী, ছাড়ে না, বকা-ঝকা করিয়া এক-আধ মুঠা চাউল সিদ্ধ করাইয়া লয়।
এমন করিয়া এক মাস কাটিয়া গেল।
তাহার পর তিন-চারদিন ধরিয়া কৈলাসখুড়োকে আর কেহ দেখিতে পাইল না। শম্ভু মিশির এ কথা প্রথমে মনে করিল। সে দেখিতে আসিল। ডাকিল, বাবুজী!
লখীয়ার মা উত্তর দিল। কহিল, বাবুর বোখার হয়েছে।
মিশিরজী কক্ষে প্রবেশ করিয়া বিছানার নিকট আসিয়া বলিল, বাবুজী বোখার হ’ল কি?
কৈলাসচন্দ্র সহাস্যে বলিলেন, হ্যাঁ মিশিরজী, ডাক পড়েচে, তাই আস্তে আস্তে যাচ্ছি।
মিশিরজী কহিল, ছিয়া ছিয়া—রাম রাম! আরাম হো যায়েগা।
আর আরাম হবার বয়স নেই ঠাকুর—এইবার রওনা হ’তে হবে।
কবিরাজ বোলায় ছিলে?
কৈলাস আবার হাসিলেন, আটষট্টি-বছর বয়সে কবিরাজ এসে আর কি করবে মিশিরজী?
আটষট্ বয়স—বাবুজী! আউর আটষট্ আদমী জিতে পারে।
কৈলাসচন্দ্র সে কথায় উত্তর না দিয়া সহসা বলিলেন, ভাল কথা মিশিরজী! আমার দাদাভাই চিঠি লিখেছে—ও লখীয়ার মা, জানালাটা খুলে দে ত, মিশিরজীকে পত্রখানা পড়ে শুনাই। বালিশের তলা হইতে একখানা পত্র বাহির করিয়া বহুক্লেশে আদ্যোপান্ত পড়িয়া শুনাইলেন। হিন্দুস্থানী শম্ভু মিশির কতক বুঝিল, কতক বুঝিল না।
রাত্রে শম্ভু মিশির কবিরাজ ডাকিয়া আনিল। কবিরাজ বাঙ্গালী—কৈলাসচন্দ্রের সহিত জানাশুনা ছিল। তাঁহার প্রশ্নের দুই-একটা উত্তর দিয়া কহিলেন, কবিরাজমশাই, দাদাভাই চিঠি লিখেচে, এই পড়ি শুনুন।
দাদাভায়ের সহিত কবিরাজ মহাশয়ের পরিচয় ছিল না। তিনি বলিলেন, কার পত্র?
দাদু—বিশু—লখীয়ার মা, আলোটা একবার ধর ত বাছা—
প্রদীপের সাহায্যে তিনি সবটুকু পড়িয়া শুনাইলেন। কবিরাজ শুনিলেন কিনা কৈলাসচন্দ্রের তাহাতে ভ্রূক্ষেপও নাই। সরযূর হাতের লেখা বিশুর চিঠি, বৃদ্ধের ইহাই সান্ত্বনা, ইহাই সুখ। কবিরাজ মহাশয় ঔষধ দিয়া প্রস্থান করিলে, কৈলাসচন্দ্র শম্ভু মিশিরকে ডাকিয়া বিশ্বেশ্বরের রূপ, গুণ, বুদ্ধি এ-সকলের আলোচনা করিতে লাগিলেন।
দুই সপ্তাহ অতীত হইল, কিন্তু জ্বর কমিল না; বৃদ্ধ তখন একজন পাড়ার ছেলেকে ডাকিয়া বিশুকে পত্র লিখাইলেন—মোট কথা এই যে, তিনি ভাল আছেন, তবে সম্প্রতি শরীরটা কিছু মন্দ হইয়াছে, কিন্তু ভাবনার কোন কারণ নাই।
কৈলাসখুড়ার প্রাণের আশা আর নাই শুনিয়া হরিদয়াল দেখিতে আসিলেন। দুই-একটা কথাবার্তার পর কৈলাসচন্দ্র বালিশের তলা হইতে সেই চিঠিখানি বাহির করিয়া তাহার হাতে দিয়া বলিলেন, বাবাজী, পড়।
পত্রখানা নিতান্ত মলিন হইয়াছে, দুই-এক জায়গায় ছিন্ন হইয়া গিয়াছে, ভাল পড়া যায় না। হরিদয়াল যাহা পারিলেন পড়িলেন। বলিলেন, সরযূর হাতের লেখা।
তার হাতের লেখা বটে, আমার দাদার চিঠি।
নীচে তার নাম আছে বটে!
বৃদ্ধ কথাটায় তেমন সন্তুষ্ট হইলেন না। বলিলেন, তার নাম, তার চিঠি, সরযূ কেবল লিখে দিয়েছে। সে যখন লিখতে শিখবে, তখন নিজের হাতেই লিখবে।
হরিদয়াল ঘাড় নাড়িলেন।
কৈলাসচন্দ্র উৎসাহের সহিত বলিতে লাগিলেন, পড়লে বাবাজী? বিশু আমার রাত্তিরে দাদু দাদু ব’লে কেঁদে ওঠে, সে ভুলতে পারে? এই সময় গণ্ড বাহিয়া দু’ ফোঁটা চোখের জল বালিশে আসিয়া পড়িল।
লখীয়ার মা নিকটে ছিল, সে দয়ালঠাকুরকে ইশারা করিয়া বাহিরে ডাকিয়া বলিল, ঠাকুর, যাও, তুমি থাকলে সারাদিন ঐ কথাই বলবে।
আর চার-পাঁচ দিন কাটিয়া গেল। অবস্থা নেহাত মন্দ হইয়াছে, শম্ভু মিশির আজকাল রাত্রিদিন থাকে, মাঝে কবিরাজ আসিয়া দেখিয়া যায়। আজ সমস্ত দিন ধরিয়া সংজ্ঞা ছিল না; সন্ধ্যার পর একটু জ্ঞান হইয়াছিল, তাহার পর অর্ধচেতনভাবে পড়িয়া ছিলেন। গভীর রাত্রে কথা কহিলেন, বিশু দাদা, আমার মন্ত্রীটা! এবার দে, নইলে মাত হয়ে যাব! শম্ভু মিশির কাছে আসিয়া বলিল, বাবুজী কি বলচে?
কৈলাসচন্দ্র তাহার পানে একবার চাহিলেন, ব্যস্তভাবে বালিশের তলায় একবার হাত দিলেন, যেন কি একটা হারাইয়া গিয়াছে, প্রয়োজনের সময় হাত বাড়াইয়া পাইতেছেন না। তাহার পর হতাশভাবে পাশ ফিরিয়া মৃদু মৃদু বলিলেন, বিশু, বিশ্বেশ্বর, মন্ত্রীটা একবার দে ভাই, মন্ত্রী হারিইয়ে আর কতক্ষণ খেলি বল্?
এ বিশ্বের দাবাখেলায় কৈলাসচন্দ্রের মন্ত্রী হারাইয়া গিয়াছে। বিশ্বপতির নিকট তাহাই যেন কাতরে ভিক্ষা চাহিতেছে। শম্ভু মিশির নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল। লখীয়ার মা প্রদীপ মুখের সম্মুখে ধরিয়া দেখিল, বৃদ্ধের চক্ষু কপালে উঠিয়াছে, শুধু ওষ্ঠাধর তখনও যেন কাঁপিয়া কহিতেছে, বিশ্বেশ্বর! মন্ত্রী-হারা হয়ে আর কতক্ষণ খেলা যায়, দে ভাই, দে।
পরদিন দয়ালঠাকুর চন্দ্রনাথকে পত্র লিখিয়া দিলেন যে, গতরাত্রে কৈলাসচন্দ্রের মৃত্যু হইয়াছে।